ঋগ্বেদ-এর সৌরসূক্তে কাব্য
ঋগ্বেদ-এর ধর্ম এক কথায় সূর্যোপাসনা। বৈদিক আর্যরা যে ধর্ম নিয়ে ভারতবর্ষে আসেন তার মধ্যে নানা নামে, নানা আকৃতি ও প্রকৃতিতে সূর্যের স্তুতি আছে। এই স্তুতিগুলির একটা আনুষ্ঠানিক উপযোগিতাও ছিল এবং সেটা পুরোপুরি সাহিত্যের প্রয়োজনে নয়; তবু শুধু অনুষ্ঠানের জন্যই সূক্তগুলি রচিত হয়নি, তাই ঋগ্বেদ-এর এই সব মন্ত্রগুলির মধ্যে অনেকখানি স্বতঃ উৎসারিত আবেগ রয়ে গেছে।
মোটামুটি ১৫০০ থেকে ১০০০ বা ৯০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ হচ্ছে ঋক্মন্ত্রগুলির রচনাকাল। এ সময়ে সাহিত্য সম্বন্ধে কোনও আলোচনা শুরু হয়নি, স্বতঃস্ফূর্তি ও স্বচ্ছতা এ কাব্যের প্রধান গুণ। ‘ছান্দস’ বা বৈদিক ভাষা আজ আমাদের দুর্বোধ্য ঠেকে। রচনা এত বাসংযত ও সংক্ষিপ্ত যে ভাষ্য ছাড়া বোঝা দুরূহ; কিন্তু সে দিন এ ভাষা কথ্যভাষা থেকে হয়তো বেশি দূরে ছিল না। সহজ আবেগকে তীক্ষ্ণতর ও মধুরতর করাই ছিল অলংকার প্রয়োগের উদ্দেশ্য। অলংকার তাই উপলব্ধির প্রকাশকে জটিলতর করে তুলত না, অর্থবোধে ব্যাঘাত জন্মাত না। উপলব্ধির মধ্যেও একটা ঋজু বলিষ্ঠতা এ রচনার বৈশিষ্ট্য। সমাসের প্রয়োগ অত্যন্ত পরিমিত, সন্ধি যথাসম্ভব সহজ ও সুবোধ্য। লেখা আবিষ্কারের আগেকার রচনা, তাই কণ্ঠস্থ করার সুবিধার জন্যে অনাবশ্যক জটিলতা সযত্নে পরিহার করা হত। স্বরে পাঠ করা হত অথবা সুরে গাওয়া হত— সেও একটা কারণ যার জন্যে এ কাব্য এত সুখপাঠ্য। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা ঋগ্বেদ-এ আর্যদের যে জীবনবোধ প্রতিফলিত হয়েছে তার মধ্যে এমন একটি অকৃত্রিম ও প্রবল আবেদন আছে যাতে মনের মধ্যে সোজাসুজি সংবেদনের সাড়া জাগায়।
সূর্য এদের কাছে ছিল জীবনের প্রতীক; যে জীবন চারিদিকে অন্ধকারের দ্বারা আক্রান্ত হয়েও আলোর মধ্যে নিত্য জয়যুক্ত হচ্ছে সেই জীবন সূর্যের দান। কৃষিচারী সভ্যতা সূর্যকে অন্নদাতা বলে চিনেছে, বৃষ্টিনির্ভর কৃষির জন্যে তাই কৃষক সূর্যের কাছে যথাকালে বর্ষণ ভিক্ষা করেছে। পশুচারী সমাজ সূর্যের কাছে পশুপালনের স্বাস্থ্য ও বৃদ্ধি প্রার্থনা করছে। রোগী রোগমুক্তি ও স্বাস্থ্য কামনা করছে সূর্যালোকের কাছে মুমূর্ষু দীর্ঘ মৃত্যুঞ্জয় জীবনের স্বপ্ন দেখছে চিরনবীন সূর্যের কাছে। সর্বোপরি সূর্য মানুষের কাছে জীবনের চরম বিজয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছে; কারণ প্রতি রাত্রের অন্ধকারের পরে সূর্যের নিঃসংশয় উদয়ের দ্বারা জীবনের উপর মানুষের বিশ্বাস প্রত্যহ জয়যুক্ত হচ্ছে।
যদিও ঋগ্বেদ-এর সমস্ত সৌরদেবতাই হিরণ্যবর্ণ, স্বর্ণাভবেশ ও হিরণ্ময়রথে আরূঢ়, তথাপি তাঁদের প্রকৃতি ও কর্মক্ষেত্র ভিন্ন। প্রথমেই ধরা যাক সূর্য। স্তবে বলা হয়েছে, উদুত্যদ্দর্শতং বপুর্দিব এতি প্রতিহ্বরো যদীমাশুর্বহতি/দেব এতশো বিশ্বস্মৈ চক্ষসে অরম্। (ঋগ্বেদ ৭:৬৬:১৪)— অন্তরীক্ষের কাছে সেই দর্শনীয় মূর্তি উদিত হচ্ছে, দ্রুতগামী অশ্বরা তাঁকে বহন করে; বিশ্বলোকের নয়নরঞ্জন সেই দেব।’ ‘শীর্ষোঃশীর্ষোজগতস্তম্ভূষস্পতিং সময়া বিশ্বমা রজঃ/সপ্ত স্বসারঃ সুবিতায় সূর্যংবহন্তি হরিতো রথে (৭:৬৬:১৫)।— সূর্য শীর্ষদেশেরও শীর্ষস্থানীয়, অর্থাৎ ঊর্ধ্বতম লোকে বিরাজিত, সমস্ত স্থাবর জগতের অধিপতি অথচ সর্বলোকের নিকটবর্তী। জগতের কল্যাণের জন্যে সাতটি দ্রুতগতি অশ্ব তাঁকে রথে বহন করে আনছে।’ ‘তচ্চক্ষুদেবহিতং শুক্রমুচ্চরৎ পশ্যেম শরদঃ শথং জীবেম শরদঃ শতম্।’ (৭:৬৬:১৬)— সূর্য দেবতাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠাপিত চক্ষু, তাঁর স্তব করে আমরা একশ শরৎ দেখব, একশ শরৎ বাঁচব।’’নমো মিত্রস্য বরুণস্য চক্ষসে মহো দেবায় তদৃতং সপর্যত/দূরেদৃশে দেবজাতায় কেতনে দিবস্পুত্রায় সূর্যায় শংসত। (১০:৩৭:১)— মিত্র ও বরুণের সেই মহান্ চক্ষুকে যজ্ঞকর্মের দ্বারা উপাসনা কর, তিনি বহুদূর পর্যন্ত দেখতে পান, দেবতারূপে জাত আকাশের পুত্র ও আকাশের কেতনস্বরূপ সেই সূর্যের স্তুতি কর।’ ‘সূর্য আকাশকে ঊর্ধ্বে ধরে রাখছে, যেমন সত্য ধরে রাখছে ভূমিকে। আদিত্যেরা স্থিতিলাভ করছে ঋতের দ্বারা, আর ঊর্ধ্ব আকাশে বিরাজিত সোম— সত্যেনোত্তভিতা ভূমিঃ সূর্যেণোত্তভিতা দ্যৌ। ঋতেনাদিত্যাস্তিষ্ঠন্তি দিবি সোম অধি শ্রিতঃ।।’ (১০:৮৫:১)
সবিতা কথাটির মানে জন্মদাতা, সূর্যবাচক দেবতাদের জন্মদাতারূপে কল্পনা করা হয়েছে সবিতাকে, অর্থাৎ তিনি আলোকসর্বস্ব জ্যোতিষ্কদের উৎপত্তিস্থল। আলোকপূজারী ঋষিরা এঁর কাছে প্রার্থনা করছেন মঙ্গল, নিরাপত্তা ও দীর্ঘায়ুর জন্যে— ‘সবিতা পশ্চাতাৎ সবিতা পুরস্তাৎ সবিতোত্তরাত্তাৎ সবিতাধরাত্তাৎ/সবিতা নঃ সুবতু সর্বতাতিং সবিতা নো রাসতাং দীর্গমায়ুঃ। (১০:৩৬:১২)—সবিতা আমাদের পশ্চাতে, সম্মুখে, উপরে নিচে থাকুন, সর্বপ্রকার মঙ্গল ও দীর্ঘপরমায়ু দান করুন।’ সবিতা হল প্রভাতের সেই মুহূর্তটি, পূর্বাকাশের সেই বিন্দুটি যেখানে সূর্যের উদয় সম্ভাবনারূপে নিহিত, রাত্রি ও রাত্রির সমস্ত অমঙ্গলের নিশ্চিত পরাজয় যেখানে সূচিত। তাই ঋক্মন্ত্রকার বলছেন— ‘অদ্যা নো দেব সবিতঃ প্রজাবৎ সাবীঃ সৌভগম। পরা দুঃস্বপ্ন্যং সুব।’ (৫:৮২:৪)— হে দেব সবিতা প্রজাবৃদ্ধিরূপ সৌভাগ্য আজ আমাদের প্রদান কর, আর রাত্রির দুঃস্বপ্নকে দূরে প্রেরণ কর।’ অন্ধকারভীরু দুঃস্বপ্নকাতর মানুষের এই প্রার্থনা আলোকের কাছে।
অর্যমার সঙ্গে আর্য নামটির সাদৃশ্য আছে। আর্য অর্থাৎ মার্জিত ও সুনীতিপায়ণ আচরণ যাঁদের, অর্যমা হয়তো আদিতে তাঁদের কুলদেবতা ছিলেন। দান সম্বন্ধে এক সুক্তে আছে— ‘মোঘমন্নং বিন্দতে অপ্রচেতাঃ সত্যং ব্রবীমি বধ ইৎ স তস্য/নার্যমণং পুষ্যতি নো সখায়ং কেবলাঘো ভবতি কেবলাদী।। (১০:১১৭:৬)— মূর্খ কৃপণ যে তার অন্ন বৃথা, আমাদের সখা অর্যমাকে সে পুষ্ট করে না; যে একা অন্ন ভোজন করে সে একাই পাপ বহন করে।’ এখানে অর্যমা দান করে ভাগ করে অন্ন ভোগ করবার আর্যজনোচিত আদর্শের সঙ্গে সম্পৃক্ত; সূর্যের সঙ্গে এর সংযোগ অনেকটা বাঁকাপথে।
যেমন পূষার। পশুর সঙ্গে হয়তো ভাষাতাত্ত্বিক ভাবে পূষার নামের সংযোগ আছে, কার্যতও ইনি পশুর রক্ষা ও পুষ্টির সঙ্গেই সাক্ষাৎভাবে সংযুক্ত; সূর্যের সঙ্গে এঁর সংযোগ আপাতদৃষ্টিতে ক্ষীণ। দলছাড়া হারানো পশুকে পথ খুঁজে ফিরিয়ে আনেন পূষা, এই কারণেই পরলোকগত আত্মীয় সম্বন্ধে পূষাকে অনুনয় করে বলা হয়েছে তিনি যেন সেই অপরিচিত জগতে পথভ্রষ্টদের পথ দেখিয়ে দেন। পথের দেবতা পূষা; ইহলোকেও, পরলোকেও। ‘পূষার সোনার নৌকাগুলি আকাশের সমুদ্রে চলাফেরা করে— যাস্তে ষন্নাবোঃ অন্তঃ সমুদ্রের হিরণ্যয়ীরন্তরিক্ষে চরস্তি।’ (৬:৫৮:৩] ক খ) এই পূষা প্রত্যক্ষ ভাবেই সূর্য; প্রাচীন মিশরের সূর্যদেবতা ‘রা’ যেমন সোনার নৌকায় আনাগোনা করতেন ইনিও তেমনি করেন।
বিষ্ণু পরবর্তীকালে ভারতবর্ষের অন্যতম প্রধান দেবতা হয়ে ওঠেন, কিন্তু ঋগ্বেদ-এ বিষ্ণুর স্থান গৌণ। ইন্দ্ৰস্য যুজ্যঃ সখা।’ (১:২২:১৯] গ) ইন্দ্রের সহচারী সখা বিষ্ণু, স্বতন্ত্র ভাবে এঁর স্তব খুব কম আছে। ইনি অমিতবিক্রম, যেন পাহাড়ি সিংহ— ‘প্রতদ্বিষ্ণু স্তবতে বীর্যেণ মৃগো ন ভীমঃ কুচরো গিরিষ্ঠাঃ।’ (১:১৫৪:২] ক খ) তাঁর তিনটি বিপুল পদক্ষেপে বিশ্বভুবন সমাশ্রিত— ‘যস্যোরুষু ত্রিষু বিক্রমণেম্বধিক্ষিয়ন্তি ভুবনানি বিশ্বা।’ (১:১৫৪:২) সাধারণ ভাবে প্রাতঃসূর্য, মধ্যাহ্নসূর্য ও অস্তসূর্য আকাশের— এই তিনটি স্থান অধিক্রমণের জন্যে সূর্যের ত্রিপাদবিক্রমের কল্পনা। পরবর্তীকালে এরই ওপরে গড়ে উঠেছে বামনাবতারের কাহিনি। এঁর তৃতীয় পরমপদক্ষেপ মনীষীরা সর্বদা দেখতে পান। বিষ্ণু যেন আকাশে আয়ত একটি চক্ষু— ‘তদ্বিষ্ণোঃ পরমং পদং সদা পশ্যন্তি সূরয়ঃ/দিবীব চক্ষুরাততম্।।’ (১:২২:২০)
ঋগ্বেদ-এ সূর্যা বলে নারীরূপে একটি সৌর দেবতার সাক্ষাৎ পাই। প্রাচীন জার্মান উপকথায় ও উত্তর ইউরোপীয় দেবকল্পনাতেও এঁর দেখা পাওয়া যায়। ইনি সবিতার কন্যা; সোমের সঙ্গে এঁর বিবাহের বর্ণনা ঋগ্বেদ-এর শেষের দিকের একটি সূক্তে আছে। কিংশুকশল্মলি শোভিত সুদর্শন হিরণ্যবর্ণ, সুনির্মিত, সুচক্র রথে আরোহণ করে, সূর্যা, মঙ্গলময় অমৃতলোকে পতির কাছে যাও— ‘সুকিংশুকং শল্মলিং বিশ্বরূপং হিরণ্যবর্ণং সুবৃতং সুচক্রম্/আ রোহ সূর্যে অমৃতস্য লোকং স্যোনং পত্যে বহুতুং কৃণুম্ব।।’ (১০:৮৫:২০) বিবাহে সমাগত জনতাকে বলা হচ্ছে, এই সুমঙ্গলী বধূকে এসে দেখ, তোমরা ওকে সৌভাগ্য দান করে বাড়ি ফিরে যেও— ‘সুমঙ্গলীরিয়ং বধূরিমাং সমেত পশ্যত/সৌভাগ্যমস্যৈ দত্বায়াথাস্তং বি পরেতন।’ (২০:৮৫:৩৩) সূর্য ও চন্দ্রের বিবাহ একটি বহু প্রাচীন কল্পনা। সোমের এই সুন্দরী বধূটি সূর্যা; হিমের দেশে যখন আর্যরা বাস করত তখন উষ্ণতার আরামে যে তাঁদের পরিতৃপ্ত করত সে এই কল্যাণী সূর্যা।
ঋগ্বেদ-এর সৌরদেবতার স্তবে চরম কাব্যিকে উৎকর্ষ ঊষার বর্ণনায়। ঊষা সূর্যের সুন্দরী বধু— ‘ঊষো যাতি স্বসরস্য পত্নী।’ (৩:৬১:৪) স্তুতিমতী অর্থাৎ স্তুতির অধিকারিণী নিম্নমুখী আরক্তবদনা এই যে রূপসী ঊষা, ইনি বিস্তৃত দশটি বাহুর মত দশটি দিক উদ্ভাসিত করে চলেছেন— ইয়ং যা নীচ্যর্কিণী রূপা রোহিণ্যা কৃতা/চিত্রেষু প্রত্যাদর্শায়ত্যর্ন্তদশসু বাহুষু।।’ (৮:১০১:১৩) ভোরে যখন মানুষ লাঙলে নিয়ে ক্ষেতে চাষ করতে যায় তখন সূর্য উজ্জ্বলকান্তি ঊষার পশ্চাদ্বাবন করেন, যেমন সুন্দরী নারীর অনুধাবন করে পুরুষ— ‘সূর্যো দেবীমুষসং রোচমানাং মর্যো ন যোষামভ্যেতি পশ্চাৎ/যত্রা নরো দেবয়ন্তো যুগানি বিতন্বতে প্রতি ভদ্রায় ভদ্রম।।’(১:১১৫:২)। কেমন দেখায় এই সুন্দরী ঊষাকে? ‘সুসংকাশা মাতৃমৃষ্টেব যোষাবিস্তম্বং কৃণুষে দৃশে কম্ (১:১২৩:১১)— যেন মায়ের নিজের হাতে সাজিয়ে দেওয়া সুরূপা কন্যাটি মানুষের দৃষ্টির সামনে নিজের তনু প্রকাশ করছে।’ পূর্ব আকাশে যখন প্রথম ঊষার শুভ্র আলোর আভা বিচ্ছুরিত হয় তখন মনে হয় আকাশের কন্যা ঊষা যেন রাত্রির আকাশে স্নান করে উঠে তার শুভ্র তনু আমাদের সামনে উদ্ধারিত করছে। আলোকের দ্বারা অন্ধকারকে অপধ্বস্ত করে জ্যোতির মধ্যে দিয়ে এগিয়ে আসছে— ‘এষা শুভ্রা ন তন্বো বিদানোরে স্নাতী দৃশয়ে নো আস্থাৎ/অপ দ্বেষো বাধমানা তমাংস্যুষো/দিবো দুহিতা জ্যোতিষাগাৎ।।’ (৫:৮০:৫)
কিন্তু এই সুন্দরী ঊষার একটা নিষ্ঠুর দিক কবির চোখে পড়েছে; ঋগ্বেদ-এর কবি বারবার এই সুন্দর ও নিষ্ঠুরের দ্বন্দ্বের আভাস দিয়েছেন: যে ঊষা জীবকে পালন করে, যার আগমনে পাখি আকাশ ওড়ে, সেই প্রতিদিন মানুষকে জীর্ণ করে। অর্থাৎ নতুন দিনের মধ্যে গত দিনের অবসান নিহিত বলে প্রতি প্রভাতে ঊষা পরমায়ুর ক্ষয় সূচিত করে। কান্তিমতী রক্তবসনা সুন্দরী একদিকে মনোমুগ্ধকারিণী, অন্যদিকে সে অনায়াস ঔদাসীন্যে মানুষকে একদিন একদিন করে মৃত্যুর পথে এগিয়ে দেয়— ‘আ ঘা যোষের সুনযুষা যাতি প্রভুঞ্জতী জরয়ন্তী বৃজনম।।’ (১:৪৮:৫) ‘পুনঃপুনর্জয়মানা পুরাণী সমানং বর্ণমভিশুম্ভমানা/শ্বঘ্নীর কৃতবিজ আমিমানা মতস্য দেবী জরয়ন্ত্যায়ুঃ।। (১:৯২:১০)— পুনঃ পুনঃ উদিত হয়ে পুরাতনী ঊষা একই রূপমাধুর্যে প্রতিদিন প্রকাশিত হচ্ছে। কিন্তু ব্যাধনারী যেমন করে তার শিকার করা পাখির ডানা ছিঁড়ে দেয়, তেমনই করে এই সুন্দরী মর্ত্যমানুষের আয়ু জীর্ণ করছে।’ ঊষার চিরযৌবনের সঙ্গে মানুষের পরমায়ু-ক্ষয়ের এই উপলব্ধি হয়তো প্রাচীন ইন্দো-ইয়োরোপীয় কবিকল্পনার একটি সম্পদ, যার অন্যতম রূপায়ণ চিরনবীনা এয়স্ ও স্থবির টিথোনসের প্রেম-কাহিনির মধ্যে বিধৃত
সমস্ত সৌরদেবতার কাছে পর্যায়ক্রমে প্রার্থনা করা হয়েছে মঙ্গল শান্তি ও শ্রী— শং নো মিত্রঃ শং বরুণঃ শং নো ভবত্বমা/শং ন ইন্দ্র বৃহস্পতিঃ শং নো বিষ্ণুরুরুক্রমঃ।।’(১:৯০-৯) সূর্য যখন প্রত্যক্ষগোচর তখন মানুষ তাকে দেখছে বীর্যবান্, সুন্দর জীবন সম্বন্ধে চূড়ান্ত প্রত্যয়ের প্রতীক; আর সূর্য যখন মানুষের দৃষ্টিপথ থেকে অন্তর্হিত তখন মানুষ কল্পনা করেছে সেই অদৃশ্য লোকে সৌরদেবতা, বিষ্ণুর অধিষ্ঠান যেখানে মধুর উৎস— ‘বিষ্ণোঃ পদে পরমে মধ্ব উৎসঃ।’ (১:১৫৪:৫) সূর্যের মধ্যে আর্যরা পেয়েছিলেন এক পরম আশ্বাস, নিরাপত্তা, স্থিতি ও শ্রীবৃদ্ধি। তাই তাঁরা বলছেন, ‘সূর্য আত্মা জগতস্তস্তুযশ্চ (১:১১৫:১)— স্থাবর ও জঙ্গমের আত্মা হল সূর্য।’