কিছুদিন আগে বীরসিংহ গ্রামে ঈশ্বরচন্দ্রের বাড়িতে বড় রকম একটা ডাকাতি হয়ে গেছে। ডাকাতরা কারুকে প্ৰাণে মারতে পারেনি। কিন্তু জিনিসপত্র নিয়ে গেছে সবই। এমনই অবস্থা যে পরদিন থালা-বাটি, হাঁড়িকুড়ি কিনে না আনলে ভাত খাওয়ারও উপায় নেই।
ঈশ্বরচন্দ্র সে সময় গ্রামের বাড়িতেই ছিলেন। প্ৰায় চল্লিশ পঞ্চাশ জন দস্যু মধ্যরাত্রে অকস্মাৎ মশাল ও বশ্য হাতে নিয়ে আক্রমণ করায় ঈশ্বরচন্দ্ৰ বৃদ্ধ পিতামাতাকে ও বাড়ির অন্য লোকজনদের সরিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু নিজে প্ৰস্তুত রইলেন ডাকাতদের মোকাবিলা করার জন্য। কিন্তু হট্টগোল শুনেও গ্রামবাসীরা সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে ডাকাতদের প্রতিরোধ করার জন্য এগিয়ে আসেনি, এক ঈশ্বরচন্দ্র কী করবেন। বাড়ির লোকেরা সবাই ঈশ্বরচন্দ্ৰকে পলায়ন করবার জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগলো, কিন্তু এ গোঁয়ার ব্রাহ্মণ একবার জেদ ধরলে সহজে ছাড়বে না। তখন ঈশ্বরচন্দ্রের পত্নী দীনময়ী দেবী তিন বৎসরের পুত্ৰ নারায়ণচন্দ্ৰকে কোলে নিয়ে সদরের কাছে বসে পড়ে বললেন, তবে আমিও থাকবো। ডাকাতরা এসে আগে আমাকে আর ছেলেকে মারুক, কাটুক, তারপর তারা আপনার গায়ে হাত দেবে। পরিবারের নির্বন্ধে তখন ঈশ্বরচন্দ্ৰকেও খিড়কির দোর দিয়ে গৃহত্যাগ করতে হয়েছিল।
পরে কলকাতায় ফেরার পর হ্যালিডে সাহেব ঈশ্বরচন্দ্রকে বিদ্রুপ করে বলেছিলেন, কি হে, পণ্ডিত, তোমার গৃহে ডাকাত পড়িয়াছিল শুনিলাম? আর তুমি কাপুরুষের মতন পশ্চাৎ দ্বার দিয়ে পলায়ন করিলে?
ঈশ্বরচন্দ্ৰ উত্তর দিলেন, আর যদি আমি এক চল্লিশজন দস্যুর সামনে এগিয়ে গিয়ে প্ৰাণ দিতাম, তখন আপনি কী বলতেন? বলতেন, লোকটি অতি আহাম্মক! তাই না? না মহাশয়, আমি এত সহজে প্ৰাণ দিতে চাই না, আমার এখন অনেক কাজ বাকি আছে।
যাই হোক, সেই ঘটনার পর ঈশ্বরচন্দ্রের পিতা ঠাকুরদাস বীরসিংহ গ্রামের বাড়িতে একজন লাঠিয়াল নিযুক্ত করেছিলেন। ডাকাতরা যাবার সময় গৃহ-প্ৰাঙ্গণে জ্বলন্ত মশাল পুঁতে রেখে গিয়েছিল, তার অর্থ তারা আবার আসবে। ঠাকুরদাসের পুত্র কলকাতায় সরকার বাহাদুরের অধীনে পাঁচশো টাকা বেতনের চাকরি করে, অথাৎ রীতিমতন বড় মানুষ, সুতরাং তাঁর গৃহের প্রতি তো দস্যু-তস্করের দৃষ্টি পড়বেই।
কিন্তু নবনিযুক্ত লাঠিয়ালটি যেমন প্ৰভুভক্ত, তেমনই শক্তিশালী। তার নাম শ্ৰীমন্ত। চারপাশের আট-দশখানা গাঁয়ের লোক এই শ্ৰীমন্তের লাঠির জোরের কথা জানে। তা ছাড়া নিকটস্থ থানার দারোগা একবার ঠাকুরদাসের কাছে ঘুষ চেয়ে বড় নাকাল হয়েছিল। ঠাকুরদাসের পুত্রকে যে লাট-বেলাটেরাও খাতির করে, সে খবর দারোগপ্রবর তখন জানতো না। ডাকাতির পরদিন দারোগটি ঠাকুরদাসের সেই পুত্র ঈশ্বরচন্দ্ৰকে দেখেছিল প্রতিবেশী বালকদের সঙ্গে মহানন্দে হা-ড়ু-ড়ু খেলতে। ছোটখাটো, হেঁজিপেজী ধরনের এই বামুনের এক কথায় যে দারোগার চাকরি চলে যেতে পারে, সে কথা জানার পর দারোগটি প্ৰভূতভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিল এবং সে গৃহের নিরাপত্তা রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বারবার। তারপর থেকে আর ডাকাত আসেনি।
সেই লাঠিয়াল শ্ৰীমন্তকে ঠাকুরদাস কলকাতায় পাঠিয়ে দিলেন ছেলের কাছে। এখন থেকে সে কলকাতাতেই থাকবে। ঈশ্বরচন্দ্ৰ তাকে দেখে বিস্মিত। কলকাতায় লাঠিয়ালের কী প্রয়োজন? কলকাতায় পুলিশ-কোতোয়ালি রয়েছে, তা ছাড়া কলকাতায় বাঘা বাঘা ধনী অজস্ৰ, তাঁদের ছেড়ে দস্যু-তস্কররা তাঁর মতন এক শিক্ষকের দিকে নজর দেবে কেন? কিন্তু শ্ৰীমন্ত কিছুতেই গ্রামে ফিরে যেতে রাজি নয়। সে ছায়ার মতন লেগে রইলো ঈশ্বরচন্দ্রের সঙ্গে, দিনে রাত্রে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্র যখন যেখানে যান, শ্ৰীমন্ত ঠিক পশ্চাতে পশ্চাতে থাকে।
ঠাকুরদাস গ্রামে বসে ঠিকই সংবাদ পেয়েছিলেন। কলকাতায় তাঁর পুত্রের প্রাণের আশঙ্কা আছে, লুণ্ঠন-অপহরণের জন্য নয়, অন্য কারণে। ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিধবা-বিবাহকে শাস্ত্ৰসিদ্ধ এবং আইনসিদ্ধ করবার পথে অনেকখানি অগ্রসর হয়েছেন। এইজন্য তাঁর এখন প্রচুর শত্ৰু।
বিধবা-বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্ৰস্তাব নামে ঈশ্বরচন্দ্র রচিত পুস্তিকাটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে ঝড় তুলেছিল। এই রচনার বিপক্ষে কলম ধরলেন দলে দলে ব্ৰাহ্মণ পণ্ডিত। কিন্তু যুক্তিতর্কে ঈশ্বরচন্দ্ৰকে পরাস্ত করার ক্ষমতা কারুর নেই। লেখনীকে তরবারিতে পরিণত করে ঈশ্বরচন্দ্র প্রতিপক্ষের সমস্ত যুক্তি খণ্ডন করতে লাগলেন শাস্ত্ৰ উদ্ধার করে। কিন্তু শাস্ত্রের সমর্থনের চেয়েও বড় কথা বিবেকের সমর্থন। প্রতিপক্ষকে বরাবর তিনি প্রশ্ন করতে লাগলেন, ব্যভিচার, গর্ভপাত, ভূণহত্যার চেয়ে কি বিধবার বিবাহ দেওয়া সমাজের পক্ষে বেশী উপকারী নয়? বৈধব্যের ফলে সহস্ৰ সহস্ৰ নারীদের পদস্থলন, অকালমৃত্যু, অপহরণ ঘটছে না? বিধবাকে ব্ৰহ্মচারিণী করার নামে তিথি বিশেষে তাকে কোনো খাদ্য দেওয়া হবে না, এমনকি তৃষ্ণায় কণ্ঠতালু শুষ্ক হয়ে গেলেও দেওয়া হবে না এক বিন্দু জল, এই কি বিবেকসম্মত কাজ! যে-বালিকা জ্ঞানোল্মেষের আগেই বিবাহিতা এবং বিধবা হলো, তাকে বাকি জীবন থাকতে হবে দণ্ডিতা হয়ে?
যুক্তিতে হেরে গেলেই মানুষ বেশী ক্রুদ্ধ হয়। প্রতিপক্ষীরা এই ক্ষুরধার বুদ্ধিসম্পন্ন ব্ৰাহ্মণের কাছে যুক্তিতর্কে পরাজিত হয়ে যে কোনো উপায়ে ঈশ্বরচন্দ্রকে নিবৃত্ত করার জন্য উঠে পড়ে লাগলো। তিনি পথে বেরুলেই এক দল লোক তাঁকে বিদ্রুপ করে, দূর থেকে গোপনে ইট-পাটকেলও ছোঁড়ে। হঠাৎ হঠাৎ তিনি দেখতে পান তাঁকে ঘিরে ধরেছে একদল লোক। তিনি সোজা তাকান তাদের চোখের দিকে। এখনো সামনাসামনি কেউ গায়ে হাত তুলতে সাহস পায় না। তবে অনেক বড় মানুষের বাড়িতেই মোসাহেবরা পরামর্শ দিতে আরম্ভ করেছে, হুজুর, অত তর্কাতর্কিতে কাজ কী? রেতের বেলায় ঐ বিটুলে বামুনটাকে এক কোপে সাবাড় করে দিলেই তো হয়। জাতি-ধম্মো সব রসাতলে দিলে, ছ্যা ছা!
আমাদের পূর্ব পরিচিত সিমুলিয়ার বাবু জগমোহন সরকার এখন ঘোর সনাতনপন্থী হয়েছেন। এককালে তিনি স্ত্রী-শিক্ষা নিয়ে খেপেছিলেন। কিন্তু তাঁর দমদমার বাগানবাটিতে তাঁর ইয়ারবকশীরা একবার দুটি দশ-এগারো বৎসর বয়স্ক বালিকাকে এনে খুব আমোদ-ফুর্তিতে মাতে, আমোদ কিঞ্চিৎ মাত্রাতিরিক্তই হয়েছিল নিশ্চয়ই, কারণ পল্লীস্থ ভদ্রব্যক্তিরা তিতিবিরক্ত হয়ে এক সময় সদলবলে এসে সেই গৃহ চড়াও করে। ইয়ারবকশীরা দুৰ্ভিক্ষ সময়কালীন ইঁদুরের মতন এদিক ওদিক ছুটে পালায়। আর বে-এক্তিয়ার জগমোহন সরকার মুক্তকচ্ছ হয়ে বলে ফেলেন, আপনারা নিজেই হল্লা করচেন, এখানে কোনো আনফেয়ার মিন্স নেওয়া হচ্চে না। আমরা মেয়ে দুটিকে নেকাপড়া শেকচ্চিলুম, আমরা অফ টাইমে ফিমেল এড়ুকেশনের চর্চা করি।
পল্লীর ভদ্রব্যক্তিরা সে কথায় কৰ্ণপাত না করে জগমোহন সরকার ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের উত্তম মধ্যম দেয় এবং ব্যাপারটি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। সেই সময় বেথুন সাহেব মীর্জাপুরে সবেমাত্র বালিকা বিদ্যালয়টি স্থাপন করেছেন। কিছু পত্র-পত্রিকায় স্ত্রী-শিক্ষার ঘোর বিরোধিতা করে নানা প্রকার চটুল, অশ্লীল মন্তব্য প্রকাশিত হচ্ছিল, সেই সংবাদপত্রের মসীজীবীরা জগমোহন সরকারের মুখরোচক মামলাটি উপজীব্য করে বিদ্রুপের বন্যা বইয়ে দেয়। বঙ্গবাসিগণ, স্ত্রী-শিক্ষার কী সুচারু পরিণতি তোমরা দ্যাখো। আজিকালি রিফর্মড বাবুগণ অবসর বিনোদনের নামে বৃথা সময় ব্যয় না করিয়া প্রমোদভবনে কচি দুই বালিকাদের উলঙ্গ করিয়া তাহাদের সঙ্গে নৃত্য করিতে ২ এ বি সি ডি শিক্ষা দিতেছেন। এক হস্তে সুরার পাত্র অন্য হস্তে কেতাব। ভাবাবেগে চক্ষু মুদিয়া নাম সঙ্কীর্তনের মতন তাঁহারা গাহিতেছেন বি এ টি ব্যাট, সি এ টি ক্যাট। নিশিকালে পুরবাসীরা পাঁচী-কুঁচি, বিমি-ক্ষেমীদের কণ্ঠে কলতান শুনিতেছে বি এ টি ব্যাট, সি এ টি ক্যাট। এতদেশীয় নারীগণের ইমানসিপেশনের আর বাকি রহিল কি! যে কালিতে কলম ড়ুবাইয়া এই বাক্য সকল লিখিতেছি, ইচ্ছা করে সেই কালিতেই ড়ুবিয়া মারি!
এই ঘটনার পর জগমোহন সরকার কিছুদিন জনসমক্ষে মুখ লুকিয়ে ছিলেন। এখন আবার নব পরিচয়ে উদিত হয়েছেন। লিভারে ব্যথা উঠে কিছুদিন কষ্ট পাবার ফলে তিনি এখন মদ্যপান সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করে সুরাপান না বিষপান নামে একটি গ্রন্থ ছাপিয়ে ফেলেছেন। তাঁর বাড়িতে সুরাপান নিবারণী সমিতি স্থাপিত হয়েছে। তা ছাড়া সনাতন হিন্দুধর্ম রক্ষার জন্য তাঁর চেষ্টার অন্ত নেই।
প্রতি সন্ধ্যায় তাঁর বৈঠকখানার আসরে এখন বিদ্যাসাগরের মুণ্ডপাত হয়। ঈশ্বরচন্দ্র নিজে দু-একবার এসেছেন এ বাড়িতে। তিনি কলকাতার বহু ব্যক্তির কাছে স্বয়ং গিয়ে বিধবা-বিবাহের ব্যাপারে সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছেন এখন। সামনাসামনি বোঝালে অনেক সময় কাজ হয়। জগমোহন সরকারকে বিদ্যাসাগর চিনতেন না, তবে বিশিষ্ট ধনী হিসেবে এই ব্যক্তিটির নাম আছে এবং মন্দির-বিদ্যালয় স্থাপন ইত্যাদি ব্যাপারে কিছু দানধ্যানও করেছেন। তাই বন্ধু রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র এসেছিলেন এই জগমোহন সরকারের কাছে। কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলেই বুঝেছিলেন যে এখানে সুবিধে হবে না, নিরাশ হয়ে ফিরতে হয়েছিল তাঁকে।
মোসাহেব পরিবৃত হয়ে জগমোহন সরকার সগৌরবে বলেন, কেমন দিলুম ঐ সাহেবের পা-চাটা বামুনটার থোঁতা মুখ ভোঁতা করে। আমার কাচে শাস্ত্ৰ কপচাতে এয়েচেন। বিলেতে বেধবার বে হয় বলে এদেশেও হবে? সাহেবদের খুশি করবার জন্য আমরা আমাদের মাসী-পিসীদের আবার বে দেবো!
এক মোসাহেব বললো, হুজুর, এই বিদ্যেসাগর লোকটার জন্য মাগীগুলোর কেমন আস্পর্ধা বেড়ে গ্যাচে একবার শুনুন। যত বুড়ি ধুড়ি রাঁড়েরাও এখন বের জন্য ক্ষেপেচে।
অপর এক মোসাহেব বললো, আরো বুড়ি বলচিস কি! আমার আপনি পিসী, পঁচাশি বচর বয়েস, বেধবা হয়েছেল সে ছ না সাত বচরে, এতদিন মন দিয়ে পুজোআচ্চা করেচে, আহা নিরামিষ্যি রান্না আমার পিসী বড় ভালো রাঁদে, একবার কাঁচকলা আর বড়ির সুক্তে যা খেইচিলুম, আমার বাবার দাঁত নেই, মাছ-মাংস ছেড়ে দিয়েচেন, পিসীর হাতের নিরিমিষ্যি রান্না ছাড়া মুখে কিচু রোচে না, মেথি ফোঁড়ন দিয়ে লাউঘণ্ট।
জগমোহন ধমক দিয়ে বললেন, আরো গেল যা, নিরিমিষ্যির সাত কহন শুরু করে দিলে। পিসীর কত কী বলচিলি?
মোসাহেব বললো, হ্যাঁ, আমার সেই পঁচাশি বচরের বুড়ি পিসী হঠাৎ বলে কিনা, আর আমি তোদের হেঁসেল ঠেলতে পারবো না, তোদের জন্যে তো এতকাল হাড় পচালুম, এবার ক্ষ্যামা দে। ও-বাড়ির রাইমণি আর নীরোবালা বলছেল যে বিদ্যেসাগর না কে যেন এক মহাপণ্ডিত বিধেন দিয়েচে যে বিধবা মাগীদের আবার বে হবে। তোরা পাত্তর দ্যাক, আমি আবার বে কর্বো।
জগমোহন বললেন, বলিস কি রে? পঁচাশি বচরের বুড়ি?
মোসাহেব বললো, আজ্ঞে হ্যাঁ, হুজুর, সে একেবারে ক্ষেপে উঠেচে। বলে কি না আর রান্না কর্বো না, আজই আমার বে দে। মরার আগে একটু সুক করে নিই।
-বুড়ি মাগীর সুক করার শক হয়েচে? হো-হো-হো-হে।
—আরও বলে কিনা, আমার নুকোনো সোনার গয়না আচে, আমার বের খচা আমিই দেবো।
হাসির হুল্লোড় পড়ে যায়, জগমোহন সরকার মোসাহেবটির পিঠা, থাবড়ে সাবাস জানান। অপর এক মোসাহেব বললো, ঈশ্বর গুপ্ত বেড়ে লিকেচেন কিন্তু। আপনি পড়েচেন হুজুর? জগমোহন বললেন, কী লিকেচে, শুনি, শুনি? মোসাহেবটি মুখস্থ বলতে লাগলো :
বাধিয়াছে দলাদলি লাগিয়াছে গোল
বিধবার বিয়ে হবে বাজিয়াছে ঢোল।
কোথা বা করিছে লোক শুধু হেউ হেউ
কোথা বা বাঘের পিছে লাগিয়াছে ফেউ।
অনেকেই এত মত লতেছে বিধান
অক্ষত যোনির বটে বিবাহ-বিধান।
কেহ বলে ক্ষতাক্ষত কেবা আর বাছে?
একেবারে তরে যায় যত রাঁড়ী আছে।…
সে আরও বলতে যাচ্ছিল, জগমোহন তাকে মধ্য পথে বাধা দিয়ে বললো, কী বললি, কী বললি, ক্ষতাক্ষত কে বা আর বাছে?
মোসাহেবটি বললো, হাঁ হুজুর, কেউ কেউ বলচে। কিনা বেধবার বে হতে পারে বটে। তবে শুধু অক্ষত যোনির বেধবাদের।
জগমোহন সোল্লাসে। উরু চাপড়ে বললেন, ওরে ঈশ্বর গুপ্ত মশাই তো ঠিকই বলেচেন রে! ক্ষতাক্ষত কে বা আর বাচে? মেয়ে ধরে ধরে কি আগে পরীক্ষে করে দেখতে হবে নাকি যে কার অক্ষত যোনি আর কার ছিঁড়েচে? হো-হো-হো-হে।
এক রসিক মোসাহেব। আবার আর একটু যোগ করলো, মেয়েছেলের যোনি পরীক্ষার জন্য তা হলে ইন্সপেকটর রাখতে হবে বলুন, হুজুর! সে ইন্সপেকটোরি কাজের জন্য যে হাজারে হাজারে লোক লাইন লাগাবে।
কানু বিনা গীত নাই আর স্ত্রীলোকের উল্লেখ ছাড়া রসের গল্প হয় না। সে স্ত্রী-শিক্ষাই হোক আর বিধবা-বিবাহই হোক, যে কোনো একটা প্ৰসঙ্গ পেলেই হলো। স্ত্রীলোকেরা যখন জড়িত তখন আদিরসের স্রোত অমনি বয়ে যায়। এই প্রকার বাক্যালাপ শুধু জগমোহন সরকারের বৈঠকখানায় নয়, কলকাতার বহু বড় মানুষের বাড়িতেই এ রকম চলছে।
ঈশ্বরচন্দ্ৰ জোরালো সমর্থন পেয়েছেন ইয়ং-বেঙ্গলের দলের কাছ থেকে। এই শিক্ষিত সম্প্রদায় তাঁকে সর্বপ্রকার সাহায্য করতে প্ৰস্তুত। ব্ৰাহ্মরাও তাঁকে নৈতিক সমর্থন জানিয়েছে। অধিকাংশ পত্র-পত্রিকাও তাঁর সমর্থক। কিন্তু দেশের ধনী সম্প্রদায় তাঁর প্রতিকূলতা করে চলেছে। এবং এই ধনীদের বেতনভোগী ব্ৰাহ্মণরাই তাঁর বিরুদ্ধে প্রচারক। নব্য ধনীরা আগেকার দিনের রাজসভার কায়দায় বাড়িতে একটি সভা বসিয়েছে এবং উচ্ছিষ্টলোভী ব্ৰাহ্মণের সেজে বসেছে সেই সব সভার সভাপণ্ডিত। এবং এই সব রক্ষণশীল ধনীরা তাদের মুরুবিবি হিসেবে ধরেছে রাজা রাধাকান্ত দেবকে।
রাজা রাধাকান্ত দেব রক্ষণশীলতার শিরোমণি হিসেবে পরিচিত হলেও স্বয়ং কৃতবিদ্য পুরুষ এবং অনেক বিষয়ে উদার মতাবলম্বী। এ দেশে রাজা রাধাকান্ত দেবের প্রভাব খুব। তিনি প্ৰতিবন্ধকতা করলে সামাজিকভাবে বিধবা-বিবাহ চালু করা খুবই কঠিন কাজ হবে। সেইজন্য ঈশ্বরচন্দ্ৰ চেষ্টা করেছিলেন রাধাকান্ত দেবকে বিধবা-বিবাহের পক্ষে আনার।
রাধাকান্ত দেবের দৌহিত্র আনন্দচন্দ্ৰ বসুর সঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্রের সৌহাৰ্দ্য আছে। এর কাছে তিনি শেক্সপীয়ার পাঠ করেছেন এক সময়। তিনি আনন্দচন্দ্ৰকে বললেন, তোমার দাদামশাইয়ের সমাজে ও রাজদরবারে খুব সম্মান। তিনি ইচ্ছে করলে এ দেশের বিধবাদের দুঃখ দূর করতে পারেন। তুমি তাঁকে একটু বুঝিয়ে বলো না! আনন্দচন্দ্র রাজি হতে দ্বিধা করলেন। তাঁর দাদামশাই অতি রাশভারি মানুষ, তাঁর কাছে অন্য ব্যাপারের আবদার করা যায় যদিও, কিন্তু এই সব সামাজিক প্রসঙ্গ তুলতে গেলে তিনি যদি প্ৰগলভতা মনে করেন! আনন্দচন্দ্ৰ বন্ধুকে বললেন, তুমি বরং তোমার বই একখানি দাদামশাইয়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে তাঁর মতামত চাও।
ঈশ্বরচন্দ্ৰ প্রেরিত বই পাঠ করে রাধাকান্ত দেব সুকৌশলে মতামত এড়িয়ে গেলেন। তিনি ঈশ্বরচন্দ্রের লিপিচাতুর্যের প্রশংসা করে বললেন, দ্যাখো, আমরা বিষয়ী লোক, আমরা আর এ সম্পর্কে কী বিচার করতে পারি। বরং, তুমি যদি রাজি থাকে, তবে আমার সভায় পণ্ডিতদের একদিন ডাকি, তাঁদের সঙ্গে তোমার শাস্ত্ৰ বিচার হোক।
ঈশ্বরচন্দ্র রাজি হলেন। কিছুদিনের ব্যবধানে দু-বার পণ্ডিতদের সঙ্গে তর্ক-যুদ্ধে নামলেন ঈশ্বরচন্দ্ৰ। রাজা রাধাকান্ত দেব একদিন একটি শাল উপহার দিলেন ঈশ্বরচন্দ্ৰকে, আর একদিন দিলেন নবদ্বীপের স্মার্ত পণ্ডিত ব্ৰজনাথ বিদ্যারত্নকে। যেন তিনি দুজনের শাস্ত্রজ্ঞানেই মুগ্ধ হয়েছেন। রাধাকান্ত দেবের মনোভাব অনেকটা যেন এই যে, বিধবা-বিবাহের পক্ষে বিপক্ষে তাত্ত্বিক আলোচনা চলছে চলুক না, ভালোই তো, এতে দু পক্ষের কাছ থেকেই অনেক শাস্ত্রবচন জানা যাচ্ছে।
কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্ৰ শুধু বিদ্যা জাহির করবার জন্য বিধবা-বিবাহের পক্ষে কলম ধরেননি। একে কার্যোনা পরিণত করে ছাড়বেন না। এক সময় তিনি ঠিক করলেন, ধনীরা যতই বাধা দেবার চেষ্টা করুক, বিধবা-বিবাহের প্রচলনের জন্য আইন পাস করাতে হবে। ইয়ং বেঙ্গল এবং ব্ৰাহ্মীরাও চায় সরকারের কাছে এই মর্মে আবেদন করা হোক। আবেদনপত্র রচনা করে ঈশ্বরচন্দ্ৰ এবার ঘুরে ঘুরে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের স্বাক্ষর সংগ্ৰহ করতে লাগলেন।
এবার দপ করে জ্বলে উঠলেন রাধাকান্ত দেব। তক্যািতর্কি করা এক ব্যাপার, আর বিদেশী রাজশক্তির সাহায্য নিয়ে দেশের ওপর একটি আইন চাপিয়ে দেওয়া অন্য ব্যাপার। সতীদাহ বন্ধ করার সময় রাধাকান্ত দেব যে কারণে বিরোধিতা করেছিলেন, বিধবা-বিবাহের ব্যাপারেও তিনি সেই কারণেই উগ্র হয়ে উঠলেন। সমাজের পরিবর্তন যদি আসে, তবে তা আসবে জনমানসের ক্ৰম-পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে, এতে রাজশক্তির হস্তক্ষেপের কোনো প্রয়োজন নেই, কারণ রাজশক্তি একবার নাসিক গলাতে শুরু করলে তার আর কোনো শেষ থাকবে না।
বিধবা-বিবাহের পক্ষপাতীদের মত এই যে দেশের আইন-কানুন রক্ষার দায়িত্ব রাজশক্তির। বিধবা-বিবাহ যদি আইনসম্মত না হয়, তবে সাধারণ মানুষ এই বিবাহে সম্মত হবে না। কিংবা হলেও, বিধবার পুনর্বিবাহের পর তার সন্তান সম্পত্তির অধিকার পাবে না। সন্তান যদি পিতামাতার সম্পত্তির বৈধ অধিকারী না হতে পারে, তাহলে সেই বিবাহ যে অসিদ্ধ হিসেবে গণ্য এই সরল কথাটি রাজা রাধাকান্ত দেবের দল বুঝেও বুঝলেন না। তাঁরাও দ্বিগুণ উৎসাহে প্রতিবাদী স্বাক্ষর জোগাড় করতে শুরু করলেন।
বিধবা-বিবাহের সমর্থনে আবেদনটিই আগে পেশ করার ব্যবস্থা হলো সরকার সমীপে। এতে স্বাক্ষর করলেন নয়শো বত্ৰিশ জন ব্যক্তি, একেবারে শেষ স্বাক্ষরকারীর নাম ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগর।
আবেদনপত্র জমা দেবার আগের দিন ঈশ্বরচন্দ্র সারাদিন ঘোরাঘুরি করেছেন, তিনি গাড়ি-পাল্কির তোয়াক্কা করেন না, তাঁর দুই পা দুই অশ্বশক্তি, হাঁটাহাঁটি করতে তাঁর কোনো ক্লান্তি নেই।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেল। পথঘাট নির্জন, ঈশ্বরচন্দ্ৰ ঠনঠনের কাছাকাছি এসেছেন, দেখলেন। কিয়ৎদূরে কয়কজন লোক দাঁড়িয়ে আছে পথজুড়ে। তাদের ভাবভঙ্গি দেখলেই বোঝা যায়, তারা অপেক্ষা করছে ঈশ্বরচন্দ্রের জন্য।
ঈশ্বরচন্দ্র একবার পিছন ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, কি রে, ছিরো আছিস তো?
লাঠিয়াল শ্ৰীমন্ত বললো, হ্যাঁ, তুমি থেমে না, এগিয়ে যাও। তোমার চাকর তৈরি আছে, সম্বুন্ধির ভাইদের সে দেখবে।
শ্ৰীমস্তের তাড়া খেয়ে লোকগুলো ভয়ে দৌড় লাগাল। ওদের মধ্যে একটি লোককে যেন ঈশ্বরচন্দ্ৰ চিনতে পারলেন। কিছুদিন আগেই তিনি ঐ লোকটিকে কোনো এক বাবুর পার্শ্বচর হিসেবে দেখেছেন।
তিনি হনহন করে এগিয়ে গেলেন সিমুলিয়ার দিকে। জগমোহন সরকারের গৃহের সামনে গিয়ে তিনি শ্ৰীমন্তকে বললেন, ছিরে, তুই বাইরে দাঁড়া!
তিনি বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে সোজা উপস্থিত হলেন জগমোহন সরকারের সামনে, জগমোহন সরকার আঁতকে উঠলেন একেবারে।
ঈশ্বরচন্দ্ৰ বললেন, আপনি আমাকে মারতে লোক পাঠিয়েছিলেন না? অতি কষ্ট করার দরকার কী? এই তো আমি এসেছি, মারতে হয় মারুন দেখি?
অনেক সুন্দর