ইতিহাস চর্চ্চার প্রণালী
এই যে দেশময় ইতিহাস-চর্চার একটা প্রবৃত্তি জাগরূক হইয়াছে, এই যে কেহ কেহ দুঃখ করিয়া বলিতেছেন ‘ঐতিহাসিক প্রবন্ধ ছোট গল্পকে বাঙ্গলা মাসিকের পৃষ্ঠা হইতে নিষ্কাশিত করিয়াছে’ এ সুখবর যদি সত্য হয়, তবে জাতীয় মনের এই বিকাশ সম্বন্ধে সাহিত্য নেতা ও পরিষৎগুলির এক গুরুতর কর্তব্য উপস্থিত হইয়াছে, তাহা আর বেশীদিন অবহেলা করিলে চলিবে না। আমাদের কর্তব্য এই নব জাগ্রত ইতিহাস-সেবার চেষ্টাকে সমবায় সূত্রে বাঁধি, এই উদ্যমকে উপদেশ দ্বারা সংযত ও উচিত পথে চালিত করি, যেন বাঙ্গালীর মস্তিষ্কের অপব্যয় না হয়, যেন শ্রমের সর্বোৎকৃষ্ট ফল উৎপাদন হয়, যেন যন্ত্রের বা প্রণালীর দোষে ঐতিহাসিক কারিগরের প্রস্তুত দ্রব্যগুলি অঙ্গহীন বা ভঙ্গুর আকার ধারণ না করে। সুধী-মণ্ডলীই এই কাজ করিতে পারেন। ব্যক্তি বিশেষ একাকী এই কাজ করিতে সক্ষম নহেন, তাঁহার অধিকারও সাধারণে স্বীকার না করিতে পারে। সকলেই জানেন যে, কারিগর যেরূপ যন্ত্র হাতে পায় এবং যেরূপ প্রণালীতে কাজ করে, তাহার প্রস্তুত দ্রব্যও তেমনি হয়। মহামেধাবীর সুদীর্ঘ পরিশ্রমের ফলও যন্ত্রের দোষে বিশ্রী ও আশ্চর্য্যকর হয়। আর উচিত প্রণালী অবলম্বন না করিলে সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হয়। [১]
ইতিহাস-চর্চ্চার যাহা শ্রেষ্ঠ পন্থা তাহা বৈজ্ঞানিক পন্থা। দেশকালভেদে বা বিষয়ের পার্থক্য অনুসারে এই পন্থাটি ভিন্ন হয় না, কারণ জ্ঞানের ক্ষেত্রের সকল বিভাগেই ইহা সমান কার্য্যকর, এবং সর্ব্ববিধ সত্যের অন্তরে ইহা নিহিত রহিয়াছে। আমরা যদি জাতীয়তার অভিমানে মত্ত হইয়া, এই প্রথা নব্য ইউরোপীয়গণ অবলম্বন করিয়াছেন বলিয়া ইহাকে অবহেলা করি, তবে আমাদেরই ক্ষতি হইবে। জগৎ অগ্রসর হইবে; শুধু আমরা মধ্যযুগে পড়িয়া থাকিব। আমাদের রচিত ইতিহাস বিজ্ঞান-বিরুদ্ধ সুতরাং অশুদ্ধ হইবে; এবং বিদেশীরা বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে যে ইতিহাস রচনা করিয়া যাইতেছেন, তাহাই সত্যের বলে বলীয়ান হইয়া কিছু দিন পরে আমাদের প্রাচীন ধরণের ঐতিহাসিক জল্পনা-কল্পনাকে পরাস্ত করিবেই করিবে। কারণ, ঋষিবাক্য মনে রাখিবেন,–”সত্যই জয়লাভ করে, অসত্য করে না।”
ঐতিহাসিকের কি উদ্দেশ্য তাহা বুঝিলে ইতিহাস লিখিবার শ্ৰেষ্ঠ প্ৰণালী জানিতে পারা যায়। প্রকৃত ইতিহাস অতীতকে জীবন্ত করিয়া চোখের সামনে উপস্থিত করে; আমরা যেন সেই সুদূর কালের লোকদের দেহের মধ্যে প্রবেশ করিয়া তাহাদের ভাবে ভাবি, তাহাদের সুখ দুঃখ আশা ভয় আমাদের হৃদয়ে অনুভব করি। এইরূপে অতীত কাল সম্বন্ধে অবিকল ও পূর্ণাঙ্গ সত্য উপলব্ধি করাই ইতিহাসের প্রকৃত উদ্দেশ্য ৷
সত্যের দৃঢ় প্রস্তরময় ভিত্তির উপর ইতিহাস দাঁড়াইয়া থাকে। যদি সেই সত্য নির্দ্ধারিত না হইল, যদি অতীতের একটা মনগড়া ছবি খাড়া করি অথবা আংশিক ছবি আঁকিয়াই ক্ষান্ত হই, তবে ত কল্পনার জগতেই থাকিলাম। তারপর যে বিষয়ে যাহাই লিখি বা বিশ্বাস করি তাহা বালুকার ভিত্তির উপর তেতলা বাড়ী নির্মাণের চেষ্টা মাত্র।
সত্য নির্দ্ধারণের প্রণালী কি? সৰ্ব্বপ্রথমে নিজের মনকে এই কার্য্যের উপযোগী করিয়া তোলা। যশ, ধন বা প্রতিপত্তি লাভের লালসা দূর করিয়া দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করিতে হইবে-
মোরা সত্যের পরে মন
আজি করিব সমর্পণ
মোরা বুঝিব সত্য, পূজিব সত্য,
খুঁজিব সত্য ধন!
সত্য প্রিয়ই হউক আর অপ্রিয়ই হউক সাধারণের গৃহীত হউক আর প্রচলিত মতের বিরোধী হউক, তাহা ভাবিব না। আমার স্বদেশ-গৌরবকে আঘাত করুক আর না করুক, তাহাতে ভ্রূক্ষেপ করিব না। সত্য প্রচার করিবার জন্য সমাজে বা বন্ধুবর্গের মধ্যে উপহাস ও গঞ্জনা সহিতে হয়, সহিব; কিন্তু তবুও সত্যকে খুঁজিব, বুঝিব, গ্রহণ করিব। ইহাই ঐতিহাসিকের প্রতিজ্ঞা। ভারতের অতি প্রাচীনকালের কথা, মহাভারত রামায়ণ প্রভৃতির রাজকাহিনী কাল্পনিক বলিয়া ধরি, তবে হিন্দুধর্ম্মের গ্লানি হইবে, এই যে আমাদের একটা স্বাভাবিক ধারণা আছে, তাহা উচ্ছেদ করিতে হইবে। প্রতিজ্ঞা করিতে হইবে যে প্রমাণ না পাইলে কিছুই বিশ্বাস করিব না।
প্রামাণিক ঘটনা হইতেই ইতিহাসের আরম্ভ। এই জন্য ইউরোপে ইতিহাস রচনায় এক ক্রমোন্নতির ধারা দেখিতে পাই। জ্ঞানের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমাগত পুরাতন মত, পুরাতন গ্রন্থ ঠেলিয়া সরাইয়া দেওয়া হইতেছে। আইনের পুস্তকের মত ইতিহাসেরও ক্রমাগত নূতন সংস্করণ কিনিতে হইতেছে। পিতামহের সময় হইতে আগত বিশ্বাসের মূল পরীক্ষা করিয়া সেই পুরাতন অট্টালিকাগুলি ক্রমাগত নির্মমভাবে ভাঙ্গিয়া ফেলিয়া তাহাদের স্থানে নূতন নূতন গৃহ রচিত হইতেছে। ইহার কয়েকটি দৃষ্টান্ত কিছু পরে দিতেছি।
সভ্যতা, সমাজ ও বিশ্বাসের বৃদ্ধি ও পরিবর্তন ইতিহাসের বিষয়ের মধ্যে বটে। ইহার মানবের লিখিত সাক্ষী না পাইলেও মানুষের হাতের কাজ কত যুগ ধরিয়া পৃথিবীর নানা স্থানে সঞ্চিত আছে। কিন্তু ইতিহাস বলিতে আমরা সাধারণত যাহা বুঝি তাহার আরম্ভ প্রামাণিক ঘটনা হইতে। প্রমাণের জন্য সাক্ষ্য সংগ্রহ ও বিচার করা ঐতিহাসিকের সর্ব্বপ্রথম কাৰ্য্য। এই মূল মন্ত্রটি এত সহজ, আপনারা প্রত্যহ আদালতে, সাংসারিক কাজে, ইহার এত ব্যবহার করেন যে ইহার ব্যাখ্যা করা অনাবশ্যক হইতে পারে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের নানা প্রদেশে লিখিত আধুনিক ইতিহাস ও ঐতিহাসিক প্ৰবন্ধ পড়িয়া মনে হয় যে ইতিহাসের ক্ষেত্রে এ নিয়ম আমরা এখনও স্বীকার করি নাই।
সাক্ষ্য পাইলেই আপনারা তিনটি প্রশ্ন করেন,-(১) সর্ব্বাগ্রে কে এজাহার দিয়াছে? সেই first information অর্থাৎ প্রথম সাক্ষ্যের নকলটা সংগ্রহ হইয়াছে ত? পুলিস ডায়েরীর নকল কি করিয়া পাওয়া যায়?
(২) এই সাক্ষীটি ঘটনা জানিবার কি সুযোগ পাইয়াছিল? একি স্বচক্ষে দেখিয়াছে, না পরের কথা শুনিয়া বলিতেছে?
(৩) মোকদ্দমার কোন পক্ষের সহিত ইহার স্বার্থ জড়িত আছে কি?
প্রত্যেক ইতিহাস-লেখককেও পদে পদে এই প্রশ্ন তিনটি করিতে হয়। ঘটনা সম্বন্ধে যাহারা কিছু লিখিয়া গিয়াছে, তাহাদের নামের তালিকা প্রস্তুত, শ্রেণী বিভাগ, পরস্পরের উক্তির বিরোধ ভঞ্জন ও সমালোচনা করিয়া তবে ইতিহাস লেখা আরম্ভ করা উচিত। প্রথমে এইরূপ তালিকা (critical bibliography) সংগ্রহ না করিয়া রচনায় প্রবৃত্ত হওয়া যে মহাভ্রম তাহা আমরা এখনও সম্পূর্ণরূপে বুঝি না।
বর্ণিত ঘটনার সর্বপ্রথম ও প্রধান সাক্ষীর উক্তি খুঁজিয়া বাহির করিতে হইবে। সমসাময়িক লেখক না থাকিলে, ঘটনার যত অদূরবর্তী সাক্ষী পাওয়া যায় ততই ভাল। পুরাতন বিবরণ সংক্ষিপ্ত বা কর্কশ ভাষায় লিখিত হইলেও, আধুনিক সময়ের সুদীর্ঘ ও সুললিত বর্ণনার উপরে তাহাকে স্থান দিতে হইবে। আদি গ্রন্থ পাইলে অনুবাদ ব্যবহার করা অনুচিত।
অথচ আমাদের দেশের অনেক ঐতিহাসিকের নিকট মুড়ি মুড়কী এবং সীতাভোগের একই দর। ঘটনা সম্বন্ধে যাহারাই দু’কথা লিখিয়া গিয়াছে, সকলেই সমান বিশ্বাসযোগ্য বলিয়া আমরা মানিয়া লই; বিচার করি না, সমালোচনা করি না, সত্যের আদি উৎসে পৌঁছিতে চেষ্টা করিনা। এই দেখুন, পাঠান যুগের ভারত ইতিহাস লিখিতে গিয়া আমরা ফেরিতা এবং আল্বাদায়ুনীর উপর এবং সপ্তদশ শতাব্দীর মুঘল সম্রাটগণ সম্বন্ধে খাফি খাঁর উপর অন্ধভক্তি করিয়া নিজ নিজ গ্রন্থ রচনা করি। অথচ এই তিন লেখকই বর্ণিত ঘটনার অনেক পরে জন্মগ্রহণ করেন এবং ঐ ঐ যুগের সমসাময়িক বিবরণ হইতে শুধু সংকলন করেন। আমরা সেই সব সমসাময়িক বিবরণ গ্রহণ করিতে চেষ্টা করি না, তাহা যে গ্রহণের উপযোগী একথাও মনে মনে বিশ্বাস করি না। একজন সমসাময়িক সাক্ষীর বিরুদ্ধে হাজার জন পরবর্তী যুগের নকলনবিশ খাড়া হইলেও ঘটনা সম্বন্ধে তাহাদের সাক্ষ্যের কোন মূল্য নাই; তাহাদের কথা সমালোচনা হইতে পারে, ইতিহাসের মূল উপাদান নহে, –এই সত্যটি কাৰ্য্যত মানিয়া লই না।
আবার, সাক্ষীটি সত্য জানিবার কতটুকু সুযোগ পাইয়াছিল, তাহা দেখা আবশ্যক। এই যেমন, শাহজাহানের পুত্র শূজা আরাকানে মারা যান। সেখানে হিন্দু মুসলমানের যাতায়াত নিষেধ ছিল, মগরাজ ওলন্দাজ ও পর্তুগীজ ভিন্ন অন্য বিদেশীকে তাঁহার রাজ্যে ঢুকিতে দিতেন না। এই ইউরোপীয় বণিকগণ শূজার শেষ দশা সম্বন্ধে যে সংবাদ ভারতে তাহাদের কুঠীতে প্রেরণ করে, তাহা বার্ণিয়ারের ভ্রমণ বৃত্তান্তে কিছু কিছু, এবং আর্তিন-অনূদিত মানুচীর আত্মজীবনীতে বিস্তৃতভাবে দেওয়া হইয়াছে। অথচ আমাদের লেখকেরা অন্য সব স্থান হইতে নানা গুজব সংগ্রহ করিয়া প্রবন্ধ পূরণ করেন, এই দুই গ্ৰন্থ দেখেন না, দেখিলেও ইহাদের উক্তি সর্ব্বশ্রেষ্ঠ বলিয়া গ্রহণ করেন না।
আদি সাক্ষীর অনুসন্ধান করায় বিলাতে ইতিহাস ক্ষেত্রে কি রাষ্ট্র বিপ্লবের ন্যায় পরিবর্তন হইতেছে, তাহার দুই একটি দৃষ্টান্ত দিতেছি। চারিশত বৎসর ধরিয়া ইংলণ্ডরাজ তৃতীয় রিচার্ড ইতিহাসে নরপিশাচ বলিয়া বর্ণিত হইয়া আসিতেছেন। অধুনা সার্ ক্লেমেন্টস্ মার্কহাম্ এই বিশ্বাসের ভিত্তি পরীক্ষা করিয়া ইহাকে মিথ্যা বলিয়া প্রমাণ করিতে চেষ্টা করিয়াছেন। আমরা পড়িয়া আসিতেছি যে স্পেনের ভিসিগথ বংশীয় শেষ রাজা রডেরিক্ তাহার সেনাপতি জুলিয়ানের কন্যার প্রতি অত্যাচার করায়, জুলিয়ান মুসলমানদের ডাকিয়া রাজাকে বিনষ্ট করেন। কিন্তু ডোজি প্রভৃতির অনুসন্ধানের ফলে প্রমাণ হইয়াছে যে এই বিবরণটি উপন্যাস মাত্র; রমণীর প্রতি অত্যাচারের গল্প ঘটনার ছয়শত বৎসর পরে একজন ইটালীয় সন্ন্যাসী প্রথম রচনা করে; জুলিয়ান বলিয়া কেহ ছিল না। স্পেন দেশীয় যে সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি মুসলমানদের পক্ষ লয়, তার নাম আর্বান; রডেরিক্ স্পেন রাজ্যের ন্যায্য অধিকারী ছিলেন না, ইত্যাদি। ফলত: আরবদের স্পেন বিজয় কাহিনী একেবারে নূতন করিয়া লিখিত হইতেছে। পুরুষগণের নাম ও চরিত্র, ঘটনা পরস্পরা, ঘটনার কারণ পর্যন্ত বদলাইয়া দিতে হইতেছে। নেপোলিয়ান সম্বন্ধে তিয়র (Thiers) যে ইতিহাস লিখিয়া যান, এবং যাহা আমাদের দেশে আদৃত য়্যাবটের নেপোলিয়ন-চরিতের মূল, তাহা নানা দেশের সরকারী কাগজপত্র ও গোপনীয় চিঠি অনুসন্ধানের ফলে এখন শিক্ষিত-সমাজে কাব্য বলিয়া ঘৃণায় পরিত্যক্ত হইয়াছে। অথচ এই নব অনুসন্ধানের ফল যেখানে একত্রীভূত করা হইয়াছে সেই Holland Rose’s Life of Napoleon 1-এর নাম পর্যন্ত আমরা অনেকে শুনি নাই। সেই য়্যাবট লইয়াই আমরা নেপোলিয়ান জোসেফিন প্রভৃতির চরিত্র বর্ণনা করিতেছি। আমাদের দ্বিতীয় নীলমণি টডের “রাজস্থান”ও যে অনেক স্থলে অবিশ্বাসযোগ্য উপন্যাস মাত্র একথা আমরা ভাবি না।
আসল গ্রন্থ বর্তমান থাকিতে অনুবাদের উপর নির্ভর করা যে কি ভুল, তাহার একটি দৃষ্টান্ত দিতেছি। গ্র্যান্ট ডাফের মারাঠা জাতির ইতিহাস এক উপাদেয় গ্রন্থ; অথচ ডাফ সাহেবের মত পণ্ডিত ভুল করায় আফজাল খাঁর দূতের নাম শিবাজীর দূতকে দেওয়া হইয়াছে। এটি নগণ্য বিষয় নহে; আফজাল খাঁর দূত যদি শিবাজীর টাকা খাইয়া নিজ প্রভুকে বধ্যভূমিতে ভুলাইয়া আনিত তবে সে বিশ্বাসঘাতক হইত; শিবাজীর দূতের পক্ষে ঐ কাজ ততদূর নীতি-গর্হিত নহে। সেই মত Dow’s History of Hindostan নামক একখান ইংরেজী গ্রন্থ অনেক মুঘল সম্রাটদের অতি বিশ্বাসযোগ্য ইতিহাস মনে করিয়া তাহার মত উদ্ধৃত করেন; অথচ ডাওসাহেব সমসাময়িক ও প্রামাণিক কোন ফার্সী গ্রন্থ ব্যবহার করেন নাই এবং যে-সব নব্য ফার্সী গ্রন্থের সাহায্য লইয়াছেন তাহারও বিশুদ্ধ বা অবিকল অনুবাদ দেন নাই; অধিকাংশ স্থলেই নিজের কল্পনাবলে সুরঞ্জিত কাহিনী লিখিয়াছেন। এখন পণ্ডিত সমাজে কেহই ডাও-এর গ্রন্থকে ইতিহাস বলিয়া মানেন না। সমসাময়িক লেখককে অন্ধভাবে বিশ্বাস করিয়া পূর্ব্বে গ্রীস দেশের ইতিহাস রচিত হইত। কিন্তু এখন প্রস্তরফলক, মুদ্রা প্রভৃতির সাহায্যে এবং যুক্তিসঙ্গত সমালোচনার ফলে গ্রীস ইতিহাসে যে কি মহা পরিবর্তন হইয়াছে তাহা বিউরী (Bury) প্রণীত History of Greece পড়িলেই বুঝিতে পারা যায়। সেইরূপ, ইসলামের অভ্যুদয় ও আদিযুগের বিশুদ্ধ ইতিহাস নব প্রকাশিত Cambridge Medieval Historyতে লিপিবদ্ধ হইয়াছে। ইহাতে অনেক ভ্রম দূর করে।
অতএব, যদি মারাঠা ভাষাবিদ লেখক শুধু গ্র্যান্ট ডাফ অবলম্বনে এবং ফার্সী জানা লেখক ডাও অবলম্বনে ইতিহাস লেখেন তবে সে পুস্তকের মূল্য কি? তাহা আমাদের জ্ঞান বৃদ্ধি করিতে পারে না। এরূপ গ্রন্থের আমরা কেন আদর করিব? এরূপ উপগ্রন্থকে, মহাগ্রন্থের গায়ে পরগাছা গ্রন্থকে বিলাতে reehauffee বলে, অর্থাৎ বাসি চপ কালে পরদিন গরম করিয়া বেচিবার চেষ্টা করা হইতেছে এরূপ মাল। বাঙ্গলা সাহিত্যে যদি এইরূপ গরম-করা বাসি ইতিহাসের বেশী কাটতি হইতে দেওয়া যায় তবে সাহিত্যভোক্তাদিগের স্বাস্থ্য সম্বন্ধে বিশেষ শঙ্কিত হইতে হইবে। এইরূপ গ্রন্থের নির্মম সমালোচনা করা একটি অবশ্য কর্তব্য কাৰ্য্য যদিও ইহা অত্যন্ত অপ্রীতিকর। এ কাজ ব্যক্তিবিশেষ না করিয়া সুধীমণ্ডলী করিলে ভাল দেখায় এবং তাহাতে বেশী ফল হয়।
যেখানে অনুবাদ ব্যবহার না করিলে চলে না, সেখানে সৰ্ব্বশেষে রচিত অথচ সৰ্ব্বাপেক্ষা বিশুদ্ধ অনুবাদটি অবলম্বন করিতে হইবে। এই দেখুন, সম্রাট জাহাঙ্গীরের আত্মজীবনীর ইংরাজী দুই অনুবাদ অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে প্রাইস্ ও অ্যাণ্ডারসন্ নামক দুই সাহেব বাহির করেন; তাহা কোন অশুদ্ধ ফার্সী পুঁথি অবলম্বনে লিখিত এবং অনুবাদকেরাও অনেক স্থলে অর্থ ভুল বুঝিয়াছেন। ঐ পুস্তকের বিশুদ্ধ ফার্সী পাঠ অবলম্বন করিয়া রজার্স সাহেব যে ইংরাজী অনুবাদ রচনা করেন তাহাতে মূল্যবান ভৌগোলিক টীকা ও সংশোধনী যোগ করিয়া দিয়া বেভরিজ সাহেব তাহা কয়েক বৎসর হইল প্রকাশ করিয়াছেন। যদি আমরা প্রথমোক্ত অশুদ্ধ ইংরাজী অনুবাদের বাঙ্গলা অনুবাদ করি, রজার্সের অনুবাদ দেখা আবশ্যক বিবেচনা না করি তবে এরূপ অনুবাদে বঙ্গসাহিত্য পরিপুষ্ট হইল, একথা বলা যায় না। সেইমত, চীন পর্যটকদিগের ভ্রমণ কাহিনীর, মানুচীর গ্রন্থের এবং অশোকের অনুশাসনের একাধিক ইংরাজী অনুবাদ আছে। তাহার মধ্যে সর্ব্বশ্রেষ্ঠ অনুবাদটিই বাঙ্গলা লেখকেরা ব্যবহার করুন এই বলিয়া জেদ করা সুধীমণ্ডলীর কর্তব্য।
কখনও কখনও বাধ্য হইয়া অনুবাদের অনুবাদ ব্যবহার করিতে হয়। কিন্তু কোটেসনের কোটেসন তথ্য কোটেসন কেন ব্যবহার করিব? ইংরেজীতে একটা বড় কাজের কথা আছে “Always verify your references” অর্থাৎ যাহার মত উল্লেখ করিলে তিনি ঠিক সেই কথাগুলি বলিয়াছেন কিনা তাহা ভাল করিয়া দেখিবে। আমি যে পরের বচনটি তুলিয়া দিলাম, তাহা কাহার বচন এবং কোন গ্রন্থ হইতে আমি পাইয়াছি তাহা নির্দেশ না করিলে সাহিত্যিক অসাধুতা হয়, এবং ভ্রম সংশোধনেও বাধা পড়ে।
ইতিহাস-লেখক বিস্তৃত ও বিশুদ্ধ প্রমাণপঞ্জী দিতে বাধ্য। আইনের পুস্তক যেমন গুঁড়ি গুঁড়ি অক্ষরে ছাপা নজীরের উল্লেখ পূর্ণ না হইলে চলে না, তেমনি ইতিহাসও বাইস অক্ষরের ফুটনোটে আবৃত হওয়া আবশ্যক; ইহা পাণ্ডিত্য ফলাইবার উপায় নহে, ইহা না থাকিলে গ্রন্থের মূল্যহানি হয়। প্রত্যেক প্ৰকৃত ঐতিহাসিক প্রতি পৃষ্ঠার পাদদেশে টিকা দিয়া তাহাতে প্রামাণিক গ্রন্থের নাম, সংস্করণ বা প্রকাশের বৎসর, পৃষ্ঠাঙ্ক প্রভৃতি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে শুদ্ধ করিয়া উল্লেখ করা অবশ্যকর্তব্য বলিয়া জ্ঞান করেন। আমাদের বড় দোষ যে আমরা অনেকেই নিজের রচিত ইতিহাস বা প্রবন্ধে এইরূপ আদি বৃত্তান্তের নাম ও পৃষ্ঠাঙ্ক উল্লেখ করার পরিশ্রমটুকু সহিতে চাহি না; হয়ত প্রথমে কতকগুলি গ্রন্থের নাম মাত্র করিয়া ছাড়িয়া দিই। ইহাতে আমাদের জ্ঞানকৃত ও অজ্ঞানকৃত ভ্রমগুলি সংশোধন করিবার উপায় থাকে না, এবং জ্ঞানপিপাসু পাঠকও নিজে আদিবৃত্তান্ত পড়িয়া কোন বিষয়ে বেশী জানিবার পথ দেখিতে পান না।
এই যে সব প্রণালী এ পর্যন্ত নির্দ্দেশ করিলাম, তাহা হিসাব রাখার মত শুধু পরিশ্রমের কাজ, ইহাতে বিশেষ মেধার আবশ্যক নাই। আমরা যদি এই কাজ অবশ্য কর্তব্য বলিয়া মনে করি এবং আলস্য ত্যাগ করি তবে আমাদের মধ্যে সকলেই একাজ করিতে পারেন।
এখন ইতিহাস রচনার আরও উচ্চতর সোপানে চড়া যাউক। ইতিহাস- লেখক ব্যক্তিগত ভ্রম-সংশোধনের যথাসাধ্য চেষ্টা করিবেন; একই ঘটনার উপর ভিন্ন ভিন্ন দিক হইতে আলোকপাত করিবেন। শত্রুপক্ষ ইহা বলিয়াছে, মিত্রপক্ষ উহা বলিয়াছে, বিদেশী ভ্রমণকারী এরূপ দেখিয়া গিয়াছে, স্বদেশী কবি ওরূপ সাক্ষ্য দিয়াছে– এই সকল তথ্য একত্র করিয়া, তাহার মধ্যে কোন্ সাক্ষীটি বিশ্বাসযোগ্য এবং কতদূর পর্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য তাহা স্থির করিলে, তবে অতীত ঘটনার প্রকৃত স্বরূপ জানা যায়। যদি ইতিহাসে কোন পক্ষ প্রথমে এক তফা ডিক্রী পান, তবে তাহা একদিন আপসেট হইবেই হইবে, কারণ জগতের জ্ঞানের আদালতে আপীল কখনও তমেয়াদি দোষে বারিত হয় না; শত শত বৎসর পরেও অন্যায় মতের বিরুদ্ধে নালিশ করা চলে; আপীলের চূড়ান্ত সীমা সত্যনির্ধারণ পর্য্যন্ত গিয়া তবে থামে। যদি মার্জ্জনা করেন, তবে আমার নিজের অভিজ্ঞতা হইতে দুটি দৃষ্টান্ত দিতে চাই। আমি এখন মীরজুমলার আসাম ও কুচবিহার জয়ের ইতিহাস লিখিতে প্রবৃত্ত আছি; এজন্য একপক্ষে মুঘল সংবাদদাতার ফার্সী গ্রন্থ ও বাদশাহী ফার্সী ইতিহাস, অপরপক্ষে আসামীদের লিখিত বুরঞ্জী এবং একজন ডাচ্ জাহাজী সৈন্যের কাহিনী ব্যবহার করিতে হইতেছে। সেইমত, শিবাজীর ও শম্ভাজীর কার্য্যকলাপের জন্য মুঘল বাদশাহদিগের পক্ষে লিখিত ফার্সী ইতিহাস, দুইজন সমসাময়িক নিরপেক্ষ হিন্দুর লিখিত ফার্সী ইতিহাস, বিজাপুর ও গোলকুণ্ডার সুলতানদের জন্য লিখিত ফার্সী ইতিহাস, মারাঠী ভাষায় লিখিত বখ্ ও পত্রাদি, এবং ইউরোপীর বণিকদের সাক্ষ্য– এই পাঁচ প্রকার বিভিন্ন উপাদান সংগ্রহ করিতে হইয়াছে।
ঘটনার সত্যনির্দ্ধারণ করিয়াই ঐতিহাসিকের কার্য্য শেষ হইল না। অতীত যুগের বাহ্য আবরণ,- তাহার গায়ের চামড়াটি, চক্ষুর সম্মুখে সহজে আনা যায়। কিন্তু তাহার হৃদয়টি দেখাইতে না পারিলে প্রকৃত ইতিহাস হয় না। শুধু রাজা, রাজ্যপরিবর্তন, যুদ্ধ বিগ্রহ লইয়া ইতিহাস হয় না। ইতিহাস দর্শন নামের যোগ্য, কিন্তু পদে পদে দৃষ্টান্ত নজীর দেখাইয়া এই দর্শন লিখিতে হয়। দার্শনিক না হইলে প্রথম শ্রেণীর ঐতিহাসিক হওয়া যায় না। কিন্তু এরূপ লেখক ক্ষণজন্মা পুরুষ; আমাদের পরিষৎ বা সম্মিলন তাহাকে সৃষ্টি করিতে পারে না। সুতরাং সুধীমণ্ডলীর চেষ্টায় এ মহাকার্য্যের যতদূর সাহায্য হইতে পারে, কেবল তাহার বিষয়েই আমি বলিব।
১. প্রত্যেক বিভাগের প্রধান প্রধান বিষয়ে ও শাখায় যে কয়খানি বই হইতে নূতনতম ও সর্ব্বাধিক মূল্যবান জ্ঞানলাভ করা যাইতে পারে, তাহার তালিকা প্রকাশ। সেই বিষয়ে দেশীবিদেশী পণ্ডিতমণ্ডলী এ পর্যন্ত কতদূর অগ্রসর হইয়াছেন তাহার ঠিক বিবরণ এইসব বই হইতেই আমরা পাইব। পূর্ব্বে অর্জিত জ্ঞানের সিঁড়ির ওপর না দাঁড়াইলে আমরা বিদ্যা-বৃক্ষের উচ্চতর শাখায় চড়িতে পারি না।
২. পরিষৎ ও অন্য সুধীমণ্ডলী অথবা মহানুভব জমিদারগণ এইসব সর্ব্বশ্রেষ্ঠ পুস্তক, প্রাচীন মুদ্রার সচিত্র তালিকা, লণ্ডন ও বঙ্গীয় এশিয়াটিক সোসাইটিদ্বয়ের গত ৩০ বৎসরের পত্রিকা, ইণ্ডিয়ান এণ্টিকোয়েরী ও এপ্রিগ্রাফিয়া ইণ্ডিকা, সার্ভেয়ার জেনারেলের আপিস হইতে প্রকাশিত ১ ইঞ্চি = ৪ মাইল স্কেলের ভারতবর্ষের ম্যাপ, প্রভৃতি অত্যাবশ্যক উপকরণ সংগ্রহ করিয়া রাখিবেন। সেগুলির মধ্যে বাছিয়া বাছিয়া এক এক বাক্স গ্রন্থ ক্রমান্বয়ে সমস্ত শাখা পরিষৎ ও মফস্বলের বিশ্বাসযোগ্য পুস্তকালয় ঘুরিয়া আসিবে। আমাদের গবর্ণমেণ্ট চিকিৎসা-বিভাগে এইরূপে ভ্রাম্যমান পুস্তকালয় স্থাপন করিয়া মফস্বলের ছোট ছোট শহরের ডাক্তারদের জ্ঞানের বিস্তার ও নবীনতার উপায় করিয়া দিয়াছেন।
৩. মূল পরিষদের এক বিভাগ খুলিতে হইবে, যাহার নিকট আবেদন করিলে জিজ্ঞাসু নিজের চর্চ্চার বিশেষজ্ঞ কর্তৃক রচিত প্রমাণপঞ্জী পাইবেন। পরিষৎ বাছিয়া ইতিহাসের প্রতি শাখার জন্য এক বা দুই জন বিশেষজ্ঞ স্থির করিবেন, এবং জিজ্ঞাসুর পত্রখানি উপযুক্ত শাখার বিশেষজ্ঞের নিকট পাঠাইয়া দিবেন, তিনি তাহার উত্তর দিবেন। এইসব বিশেষজ্ঞের নাম ও ঠিকানা পরিষৎ পত্রিকায় সৰ্ব্বদা ছাপা থাকিবে এবং তাহারা জিজ্ঞাসুদের নিকট যেসব সমালোচনাপূর্ণ প্রমাণপঞ্জী (critical bibliography) পাঠাইবেন, তাহাও প্রকাশিত হইবে। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দের মডার্ন রিভিউ-এ শিখ-ইতিহাস সম্বন্ধে এইরূপ একটি তালিকা প্রকাশিত হয়।
আমাদের সম্মিলন বঙ্গভাষাভাষীদিগের। সুতরাং ঐতিহাসিক চর্চ্চার অত্যাবশ্যক গ্রন্থগুলি বাঙ্গলা আকারে সাধারণের হাতে দিতে না পারিলে আমাদের কর্তব্যে ত্রুটি হইবে। এই দেখুন– প্রতি বৎসর শত শত বঙ্গভাষী সংস্কৃত পরীক্ষা দেয়, তাহারা ইংরাজী জানে না, এবং অসংখ্য বাঙ্গলা মাসিকের পৃষ্ঠায় ঐতিহাসিক প্রবন্ধগুলি খুঁজিয়া পড়িবার অবসর এবং সুযোগও তাহাদের নাই। সুতরাং ভারতীয় প্রাচীন ইতিহাস ও সভ্যতা সম্বন্ধে যেসব নব নব সত্য ইংরাজীতে প্রকাশিত হইয়াছে, তাহা এইসব ছাত্রদের নিকট সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। তাহারা প্রত্নতত্ত্ব ও বৈজ্ঞানিক ইতিহাস সম্বন্ধে এখনও মধ্যযুগে বাস করিতেছে, মানবজ্ঞান যে এতদিনে কতদূর অগ্রসর হইয়াছে তাহার কিছুই জানে না। অথচ তাহাদের মধ্যে অনেক মেধাবী ও মৌলিকতাসম্পন্ন ছাত্র আছে; দেশ সম্বন্ধে, তাহাদের পাঠ্যবিষয় সম্বন্ধে নিজ ধৰ্ম্ম-জাতি সম্বন্ধে পূর্ণ জ্ঞান হইতে শুধু ত্রিভাষী নয় বলিয়া ইহারা যে চিরবঞ্চিত হইয়া থাকিতেছে, ইহা কি পরিতাপের কথা নয়? প্রাচীন লেখমালার উদাহরণ হিন্দীতে গ্রন্থাকারে একত্র ছাপা হইয়াছে; বাঙ্গলায় হয় নাই। (নব প্রকাশিত ‘গৌড়লেখমালা’ আংশিক গ্রন্থ।) ভিনসেন্ট স্মিথ রচিত প্রাচীন ভারতের ইতিহাস এবং ম্যাকডনেলের সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস যে এ পর্যন্ত বাঙ্গলায় অনুবাদ করা হয় নাই, ইহা আমাদের মণ্ডলীর পক্ষে লজ্জার বিষয়। গুজরাতী ভাষা বাঙ্গলার চেয়ে কত কম লোকে বলে, অথচ গুজরাতী ভাষার সেবকগণের আগ্রহ, শ্রমশীলতা ও দূরদর্শিতার ফলে সর্ববিধ বিভাগের পুস্তকের অনুবাদে গুজরাত ছাইয়া গিয়াছে। আর আমরা বঙ্কিম রবীন্দ্রনাথের মৌলিকতার গর্ব্ব করিয়া অলস হইয়া বসিয়া আছি। লোকশিক্ষার দিকে দৃষ্টি নাই! অথচ এই লোকশিক্ষার প্রতি অধিকতর দৃষ্টি দেওয়ার ফলে ক্রমে গুজরাত ও মহারাষ্ট্রে সাধারণের জ্ঞানের সীমা বঙ্গের লোকসমষ্টির জ্ঞানের সীমাকে অতিক্রম করিবে। তখন বাঙ্গালীর মানসিক প্রাধান্য কোথায় থাকিবে? পুনা ও বরদা ভ্রমণ করিয়া তথাকার স্কুলগুলি দেখিয়া আমার দৃঢ় বিশ্বাস হইয়াছে যে, আর বিশ বৎসরের মধ্যে মারাঠাগণ জ্ঞানের বিস্তৃতিতে বাঙ্গালীদিগকে পিছু ফেলিয়া যাইবে।
ইতিহাসের জ্ঞান জাতীয় উন্নতির প্রধান সোপান। যে-পরিমাণে অতীত জগৎ সম্বন্ধে প্রকৃত সত্য আবিষ্কার করিব, যে-পরিমাণে অতীতের উপদেশগুলি বর্তমানে লাগাইতে পারিব, সেই পরিমাণে আমাদের জনগণমন উচিত পথে ধাবিত হইবে, আমাদের সমবেত শক্তি ফলপ্রসব করিবে। আর, যে পরিমাণে আমরা অসত্য বা অর্দ্ধসত্য লাভ করিয়াই সন্তুষ্ট থাকিব, সেই পরিমাণেই আমাদের জাতীয় উন্নতিতে বাধা পড়িবে, জনসমষ্টির শ্রম বিফল হইবে।
ইতিহাস কাব্য নহে। চিত্তবিনোদক ললিত আখ্যান অথবা শুষ্ক গবেষণাই ইহার চরম ফল নহে। অধ্যাপক সীলী সুন্দররূপে দেখাইয়াছেন রাষ্ট্রনেতার, সমাজনেতার পক্ষে ইতিহাস সর্ব্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক, পথ প্রদর্শক, মহাবন্ধু ৷ ইতিহাসের সাহায্যে অতীতকালের স্বরূপ জানিয়া সেই জ্ঞান বর্তমানে প্রয়োগ করিতে হইবে দূরবর্তী যুগে বা দেশে মানব ভ্রাতারা কি করিয়া উঠিলেন, কি কারণে পড়িলেন, রাজ্য সমাজ ধর্ম্ম কিরূপে গঠিত হইল, কি জন্য ভাঙ্গিল সেই তত্ত্ব বুঝিয়া আমাদের নিজের জীবন্ত সমাজের গতি ফিরাইতে হইবে। অতীত-হইতে-উদ্ধার-করা সত্য ও দৃষ্টান্তের দীপশিখা আমাদেরই ভবিষ্যতের পথে রশ্মিপাত করিবে। ইহাই ইতিহাস চর্চ্চার চরম লাভ।
মহাকবিদের সম্বন্ধে সত্যই বলা হইয়াছে যে, তাঁহারা অমরধামে গমন করিবার পরও পৃথিবীতে নিজ নিজ আত্মা রাখিয়া গিয়াছেন, যাহা হইতে আমরা শিখি–
ব্যক্তিগত গৌরব কি? লজ্জার বিষয় কি?
লোকে কিসে বল লাভ করে, কিসে পঙ্গু হয়? (কীট্স্)
সেইরূপ আমরা বলিতে পারি যে প্রকৃত ঐতিহাসিক জনসঙ্ঘকে ব্যক্তি সমষ্টিকে শিখান– কিসে জাতীয় উত্থান পতন, রোগ স্বাস্থ্য, নব জীবন লাভ ও মৃত্যু ঘটে। এই মহাশিবতন্ত্র, এই জাতীয় আয়ুর্বেদ শাস্ত্র সাধনা বিনা, সত্যনিষ্ঠা বিনা, ক্রমোন্নতির অদম্য স্পৃহা বিনা, লাভ করা সম্ভব নহে।*
[প্রবাসী, ভাগ ১৫, খণ্ড ১, সংখ্যা ১, বৈশাখ ১৩২২]
—
১। ইতিহাস রচনার প্রণালী সম্বন্ধে গভীর ও সূক্ষ্ম তত্ত্ব জানিতে হইলে নিম্নলিখিত পুস্তকগুলি পড়া উচিত-
(1) Historical Evidence by George. (Oxford University Press),
(2) History and Historians in the 19th century by Gooch (Longman),
(3) Cambridge Ancient History (Chapters on the Gr. of Roman Historians).
* ১৩২১ সালের চৈত্র মাসে বর্ধমানে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনে ইতিহাস শাখার সভাপতির অভিভাষণ।