২. আসল বিভীষিকা
আমি সবার কথা বলেছি শুধু বাসার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষটার কথা এখনও বলা হয় নাই। আগে আম্মু নিজেই বাসার কাজকর্ম করে ফেলতেন, আপু আম্মুকে সব কাজে সাহায্য করত। দুজনে কুটকুট করে কাজ করত, মাঝে মাঝে হি হি করে হাসত। দেখে মনে হতো বাসার কাজকর্ম করা যেন কত মজার। মাঝে মাঝে আব্বু বলতেন, “আমি তোমাদের সাহায্য করি, বাসনগুলো ধুয়ে দিই—”
তখন আম্মু আর আপু একসাথে চিৎকার করে উঠত, “না, না তোমাকে সাহায্য করতে হবে না”।
তাদের এরকম চিৎকার করে আপত্তি করার অবশ্য কারণ আছে, আব্বু জানেন না যে থালা বাটিতে সাবান লাগালে সেটা পিছলে হয়ে যায়। ঠিকভাবে
ধরলে হাত ফসকে সেটা নিচে পড়ে টুকরা টুকরা হয়ে যায়। বোয়া ধোয়ির ব্যাপারে আব্বু আরও অনেক কিছু জানেন না, তাই আব্বু বাসন ধুলে পরে আরেকবার সেগুলোকে ধুতে হয়।
আমি জানি ভদ্রতা করে আমার বলা উচিত যে আমি একটু সাহায্য করি কিন্তু আমি সেটা কখনো বলি নাই! যদি আম্মু কিংবা আপু রাজী হয়ে যায় আর সত্যি সত্যি আমাকে কাজ করতে হয় সেটা কেলেঙ্কারী হয়ে যাবে।
আগে একজন মহিলা মাঝে মাঝে এসে বাসায় বড়ো বড়ো কাজগুলো করে ফেলত। আজকাল আর সেই মহিলা আসে না কারণ গ্রাম থেকে একজন এসেছে এবং সে আমাদের বাসায় থাকে। খুবই কম বয়স— মনে হয় আপুর বয়সী কিন্তু কেন জানি আমরা তাকে ঝর্ণা খালা ডাকি। ভাসা ভাসা শুনেছি ঝর্ণা খালার একজনের সাথে বিয়ে হয়েছিল, সেই মানুষটা একদিন ঝর্ণা খালাকে ছেড়ে ছুঁড়ে চলে গেছে।
ছোট হলেও ঝর্ণা খালা খুব কাজের মানুষ, আস্তে আস্তে বাসার প্রায় সব কাজ করা শুরু করে দিয়েছে। যদি শুধু বাসার কাজকর্ম করত তাহলে আমার কিছু বলার ছিল না। কিন্তু কিছুদিন হলো মনে হচ্ছে আমার আরামের জীবনটাকেও কন্ট্রোল করা শুরু করেছে। সেটা নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তায় আছি।
যেমন ধরা যাক করলা ভাজির ব্যাপারটা জিনিসটা আমার দুই চোখের বিষ। আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি সারা পৃথিবীতে একজন বাচ্চাও পাওয়া যাবে না যে করলা ভাজি পছন্দ করে। কিন্তু এই কথাটা কিছুতেই ঝর্ণা খালাকে বোঝানো যাবে না, খেতে বসলেই ঝর্ণা খালা ঝপ করে প্লেটে এক খাবলা করলা ভাজি দিয়ে দেবে।
এখানেই শেষ হলে একটা কথা ছিল কিন্তু আরও বিপজ্জনক কাজ শুরু হয়েছে। পৃথিবীর সব স্বাভাবিক মানুষের ঘুমাতে দেরী হয়ে যায় তাই সকালে উঠতেও দেরী হয়। ঘুমাতে দেরী না হলেও দেরী করে ঘুমানো হচ্ছে জীবনের বিলাসিতা। তাই সারাজীবন স্কুলে যাওয়ার শেষ মুহূর্তে ঘুম থেকে উঠে দৌড়াদৌড়ি করে রেডি হয়েছি। কোনোমতে একটু নাস্তা করে ছোটাছুটি করে স্কুলে গেছি। আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি সারা পৃথিবীর সব বাচ্চা এভাবে স্কুলে যায়। কিন্তু হঠাৎ করে ঝর্ণা খালার মনে হলো আগে ঘুম থেকে উঠতে হবে। ঝর্ণা খালা তাই অনেক আগে ডাকাডাকি করে ঘুম থেকে তুলে দেয়। জীবনের ওপর বিতৃষ্ণা চলে আসার মতো অবস্থা। তখনও অবশ্য জানতাম না যে আমার জীবনে সত্যিকারের একটা বিভীষিকা অপেক্ষা করছে।
সেটা শুরু হয়েছে এভাবে-একদিন আম্মুর সাথে ঝর্ণা খালার গ্রামের বাড়ী নিয়ে কথা হচ্ছে তখন হঠাৎ করে আম্মু জানতে পারলেন ঝর্ণা খালার ছয় বছরের একটা ছোটো মেয়ে আছে। সেই মেয়ে গ্রামের বাড়ীতে তার নানীর সাথে থাকে। আম্মু চোখ কপালে তুলে বললেন, “তোমার একটা ছোটো মেয়ে আছে সে তোমাকে ছাড়া একা একা নানীর সাথে থাকে?”
ঝর্ণা খালা মাথা নাড়ল। আম্মু একটু রেগে বললেন, “তুমি এটা আমাকে আগে বলো নাই কেন?”
ঝর্ণা খালা মাথা নিচু করে বলল, “এই চাকরিটা খুব দরকার ছিল, যদি জানেন আমার একটা ছোটো মেয়ে আছে তাহলে যদি চাকরিটা না দেন সেজন্য বলি নাই।”
আম্মু অবিশ্বাসের ভঙ্গীতে মাথা নেড়ে বললেন,”তাই বলে নিজের মেয়েকে একা একা তার নানীর কাছে ফেলে রাখবে? ছয় বছরের একটা মেয়ে তার মা ছাড়া বড়ো হবে?”
ঝর্ণা খালা হাসির মতো একটা ভঙ্গী করে বলল, “আমাদের মতো গরীব মানুষদের অনেক কিছু করতে হয় আপা।”
আম্মু মুখ শক্ত করে বললেন, “হয় তুমি গ্রামে গিয়ে তোমার মেয়ের সাথে থাকবে না হয় তোমার মেয়ে এখানে এসে তোমার সাথে থাকবে।”
ঝর্ণা খালা কেমন যেন আঁতকে উঠল, বলল, “আমার মেয়ে এখানে এসে থাকবে?”
“হ্যাঁ। সমস্যা কী?”
“আপা, আমার মেয়ে খুবই দুষ্টু। নানী আদর দিয়ে দিয়ে মাথা নষ্ট করেছে।”
আম্মু বললেন, “পাঁচ ছয় বছরের একটা মেয়ে দুষ্টু হবে না তো বুড়া মানুষ দুষ্টু হবে? আর আমার নিজের দুষ্টু ছেলে-মেয়ে নাই মনে করেছ?”
আমার নামটা উচ্চারণ করেন নাই কিন্তু দুষ্টু বাচ্চা বলতে আমাকে বুঝিয়েছেন। সবসময় তাই বোঝানো হয়।
ঝর্ণা খালা তবু আরেকবার চেষ্টা করল, বলল, “আপা আমার মেয়ে তার নানীর সাথে ভালোই আছে। তাকে এখানে আনা মনে হয় ঠিক হবে না।”
আম্মু হাত দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে বললেন, “তোমার দুলাভাইয়ের সাথে কথা বলে সব ঠিক করব।” কে দুলাভাই কে খালু কে ফুপা এই সম্পর্কগুলো আমার কাছে খুব জটিল মনে হয়–তবে এখানে দুলাভাই মানে আব্বু সেটা আমি বুঝতে পারলাম। আব্বুর সাথে কথা বলার অবশ্য কোনো দরকার নাই, এই বাসাতে আম্মু যেটা ঠিক করেন সেটাই ফাইনাল।
কাজেই একদিন ঝর্ণা খালার মেয়ে চলে এলো। শুকনা পাতলা একটা মেয়ে। পিলুর সমান। বড়ো বড়ো চোখ, মাথাভরা চুল, নাম চম্পা। বাসায় এসে কৌতূহলী চোখে এদিক সেদিক তাকাতে লাগল, দেখে মোটেও দুষ্টু মেয়ে বলে মনে হলো না।
তবে দুদিন পর সবার আগে আমি টের পেলাম ঝর্ণা খালার কথা শুনে এই মেয়েটিকে গ্রামে তার নানীর কাছে রেখে আসাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। হতো।
আমি ব্যাপারটা টের পেলাম তার সাথে কথা বলতে গিয়ে। প্রথম দুই দিন চুপচাপ থেকে তৃতীয় দিন সে বাসার ভেতরে ঘুর ঘুর করতে শুরু করল। আমি একদিন বসে বসে খুবই বিঘুঁটে কয়টা অঙ্ক নিয়ে ঠেলাঠেলি করছি তখন সে আমার টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি তখন মুখটা হাসি হাসি করে মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলাম, “কী খবর চম্পা?”
মেয়েটা মুখ শক্ত করে বলল, “আমার নাম চম্পা না।”
আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, “তাহলে তোমার নাম কী?”
“শম্পা।”
“কিন্তু তোমার মা যে বলেছে তোমার নাম চম্পা?”
মেয়েটা ঠোঁট উলটে বলল, “মা কী জানে? মা গেরাইম্যা।”
আমি একটু চমকে উঠলাম, “তোমার মা গেরাইম্যা?”
মেয়েটা মাথা নাড়ল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তার মানে তোমার মা তোমার নামটাও ঠিক করে জানে না?”
“নাহ! আগে চম্পা ছিল। এখন শম্পা।”
“চম্পাকে কে শম্পা বানিয়েছে?”
মেয়েটা বলল, “আমি। আবার কে?”
আমি ঢোঁক গিলে বললাম, “তুমি তোমার নামটা বদলে ফেলেছ?”
মেয়েটা মাথা নাড়ল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কেন?”
“চম্পা নামটা গেরাইম্যা।”
“আর শম্পা?”
“শম্পা হাই-ফাই।”
আমি আবার চমকে উঠলাম। এইটুকুন মেয়ে হাই-ফাই জানে? জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কেমন করে জানো?”
“টিভিতে দেখেছি।”
আমি বুঝতে পারলাম গ্রামে নানীর সাথে ছিল বলে সে যে খুব খারাপ ছিল মনে হয় না। বললাম, “আমার কিন্তু চম্পা নামটাই ভালো লাগে।”
“তার মানে তুমিও গেরাইম্যা।”
আমি এবারে রীতিমতো আঁতকে উঠলাম, বললাম, “আমি যদি তোমাকে চম্পা ডাকি তাহলে কী হবে?”
চম্পা কিংবা শম্পা খুবই শান্ত গলায় বলল, “তাহলে আমি তোমার চোখ গেলে দিব।”
আমার জীবনে এর আগে কেউ আমাকে চোখ গেলে দেওয়ার হুমকি দেয়। নাই। আমার আর কথা বলার সাহস হলো না। অবাক হয়ে এই ভয়ংকর মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলাম।
.
আস্তে আস্তে মেয়েটার আরও গুণাবলী বের হতে শুরু করল। কোনো একটা কারণে এই মেয়েটা হয় আমাকে বেশী পছন্দ করে না হয় বেশী অপছন্দ করে। তাই বেশীর ভাগ সময় আমার কাছে আসতে শুরু করল। একদিন আমি বসে একটা ফালতু জ্ঞানের বই পড়ার চেষ্টা করছি তখন সে এসে আমার কাছে হাজির হলো। আমাকে বলল, “টুলু মামা, তোমাকে একটা জিনিস জিজ্ঞেস করি?।”
আমি বললাম, “আমি মোটেও তোমার মামা না। আমাকে মামা ডাকবে না।”
চম্পা (কিংবা শম্পা) বলল, “মামা না হলেও তারে মামা ডাকা যায়। সবাই জানে।”
সবাই জানলেও এটা আমি জানতাম না, তাই জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কেমন করে জানো?”
“আমি দেখেছি। আমাদের গ্রামের টেম্পু ড্রাইভারকে সবাই মামা ডাকে। বাপও মামা ডাকে, ছেলেও মামা ডাকে।”
আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, “টেম্পু ড্রাইভারকে মামা ডাকে বলে তুমি আমাকে মামা ডাকবে?”
“হ্যাঁ।”
আমি মুখ শক্ত করে বললাম, “আমি চাই না তুমি আমাকে মামা ডাকো।”
আলাপের এই জায়গায় অন্য যেকোনো বাচ্চা হলে জিজ্ঞেস করত, “তাহলে আমি কী ডাকব?” কিন্তু এই মেয়েটা সেটা জিজ্ঞেস করল না, বাঁকা হাসি হেসে বলল, “কিন্তু আমি তোমাকে টুলু মামাই ডাকব, ডাকবই ডাকব।”
এই ব্যাপারটা নিয়ে আরও আলাপ আলোচনা করলে মেয়েটা আবার চোখ গেলে দিতে চাইবে, কিংবা কে জানে এবারে হয়ত চেষ্টা করেও দেখতে পারে তাই আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। ভয়ে ভয়ে বললাম, “তুমি আমাকে কী জিজ্ঞেস করতে চাইছিলে?”
“আমার কাছে তিনটা নারকেল আছে। সেই নারকেলগুলো বাইশটা গ্রামে ভাগ করে দিতে হবে, কিন্তু কোনো নারকেল ভাঙা যাবে না, আস্ত দিতে হবে। কেমন করে দিব?”
নারকেল ভাঙা যায় কিনা সেটা নিয়ে আলোচনা করে লাভ নাই। আমি তার চেষ্টা করলাম না। এই রকম প্রশ্নগুলোর মাঝে একটা প্যাঁচ থাকে, সেই প্যাঁচটা আগে থেকে না জানলে প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়া যায় না। আমি তাই চেষ্টাও করলাম না, বললাম, “জানি না।”
চম্পা কিংবা শম্পা চোখ কপালে তুলে বলল, “জানো না? এই সোজা প্রশ্নের উত্তর জানো না?”
আমি মেনে নিলাম, আলোচনা শেষ করে দেওয়ার জন্য বললাম, “না, জানি না।”
“একটা দিবে কুড়িগ্রামে, একটা তোমার গ্রামে আরেকটা আমার গ্রামে। বুঝেছ?”
“বুঝেছি।”
মেয়েটা হতাশভাবে মাথা নাড়ল, বলল, “তোমার মাথায় বুদ্ধি কম।”
আমি চুপ করে রইলাম। মেয়েটা মাথা নেড়ে বলল, “মনে হয়, তোমার মাথায় বুদ্ধি নাই। এই বাসার ভেতরে মনে হয় তুমি সবচেয়ে বেকুব।”
একটা বাচ্চা মেয়ে আমাকে বেকুব বলবে, সেটা মোটেও ঠিক না তাই আমি চোখমুখ শক্ত করে ধমক দিয়ে বললাম, “খবরদার। এভাবে কখনো কথা বলবে না।”
তারপর যা একটা কাণ্ড হলো তার জন্য আমি মোটেও রেডি ছিলাম না। মেয়েটা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করল। সে এত বড়ো করে মুখ হা করল যে আমি তার আলজিভটা পর্যন্ত দেখতে পেলাম–তির তির করে নড়ছে। বাসার সবাই “কী হয়েছে? কী হয়েছে?” বলে দৌড়ে এলো।
চম্পা আঙুল দিয়ে আমাকে দেখিয়ে বলল, “টুলু মামা আমারে গালি দিছে। আমি আর এই বাসায় থাকমু না। আমি নানীর কাছে যামু। এ্যাঁ এ্যাঁ এ্যাঁ।”
আমি লজ্জার মাঝে পড়ে গেলাম, আসলে কী হয়েছে বলতেও পারি না। একটা ধমক দিয়েছি সত্যি কিন্তু কেন দিয়েছি সেটাতো জানা দরকার, আর যেটুকু ধমক দিয়েছি সেই ধমকে কি এরকম করে কাঁদতে হবে?
সবাই ধরে নিল, আমি খুবই নিষ্ঠুর প্রকৃতির ছেলে তাই এইটুকুন দুধের বাচ্চাকে গালিগালাজ করতে পারি নিশ্চয়ই পুরো দোষ আমার। শুধু ঝর্ণা খালা আমার পক্ষ নিয়ে বলল, “না, না টুলু কিছু করে নাই। এই পাজী মেয়েকে নানী আদর দিয়ে নষ্ট করেছে, এখন আহ্লাদি বেশী হয়ে গেছে। কথায় কথায় কান্দে।”
কিন্তু ঝর্ণা খালার কথা কেউ বিশ্বাস করল না, সবাই ধরে নিল আমিই নৃশংস নিষ্ঠুর অপরাধী। আমাকেই বকুনী শুনতে হলো।
আমি বুঝতে পারলাম আমার জীবনের বিভীষিকার লিস্ট পুরো করার জন্য এই মেয়ে এসেছে। সে যে একা আমার জীবন বিষাক্ত করবে তা না, মনে হয় পিলুকেও ট্রেনিং দিবে। দুজন এক বয়সী, লক্ষ করছি দুজন গুজুর গুজুর ফুসুর ফুসুর করছে। পিলু ভ্যাবলা টাইপ, দাবা খেলা ছাড়া আর কিছু জানে না, সে চম্পাকে দাবা খেলার ট্রেনিং দিচ্ছে মনে হয় না, উলটোটাই হবে। চম্পা পিলুকে ট্রেনিং দিবে, ভয়াবহ সব ট্রেনিং। তারপর দুজন মিলে আমার পুরো জীবন বিষাক্ত করে দিবে।
যাই হোক আমি এখন খুব সাবধান থাকি। চম্পার সাথে কথাবার্তা বলি না, তার কথা না শোনার ভান করি, তাকে দেখেও না দেখার ভান করি। খুব যে লাভ হয় তা না।
সেদিন এসে চম্পা আমার টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে রইল। আমি না দেখার ভান করছিলাম কিন্তু টের পাচ্ছিলাম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমাকে দেখছে। বেশ খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “তোমার চেহারাটা ভালো না।”
আমি চমকে উঠলাম, বললাম, “কী বলেছ?”
চম্পা আবার বলল, “তোমার চেহারাটা ভালো না।”
কিছু বলব না বলব না ভেবেও জিজ্ঞেস করে ফেললাম, “কেন?”
“তোমার থুতনি নাই।”
আমি চোখ বড়ো বড়ো করে চম্পার দিকে তাকালাম। আমার থুতনিটা একটু ছোটো সেটা সত্যি কিন্তু একেবারে নাই সেটা তো হতে পারে না।
চম্পা বলল, “শুধু থুতনি ছোটো না, তোমার কান বড়ো। কুলার মতন।”
আমার মনে হলো চম্পার গলা টিপে ধরি। কিন্তু আসলেই তো আর সেটা করতে পারি না তাই মুখটাকে পাথরের মতো শক্ত আর চোখ দুটিকে বরফের মতো শীতল করে সরু চোখে চম্পার দিকে তাকিয়ে রইলাম। মিনিটখানেক এভাবে তাকিয়ে থাকার পর কাজ হলো, চম্পা ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “তোমার মনে হয় বউ পাইতে সমস্যা হবে।”
তারপর আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেল। আমি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে একটা সত্যিকারের দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আমার বয়স তেরো হয়েছে, বুঝতে পারছি হরমোন কিক করতে শুরু করেছে। নিজের চেহারা নিয়ে আগে কোনোদিন মাথা ঘামাই নাই, আজকাল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝেই নিজের চেহারাটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি। চম্পার কথা শুনে খুবই মেজাজ খারাপ হয়েছে কিন্তু সে তো আর ভুল বলে নাই। আসলেই তো আমার চেহারাটা বেশী সুবিধার না। আপুর চেহারা রাজকন্যার মতো, পিলুর চেহারার সাথে একটা বোকা বোকা ভাব আছে কিন্তু চেহারাটা তো ভালো। আব্বুর চেহারা সিনেমার নায়কের মতো (আম্মু মনে হয় আব্বুর চেহারা দেখেই তাকে বিয়ে করে ফেলেছিলেন), আম্মু একেবারে টিশটাশ মহিলা, দেখে মনে হয় আপুর বড় বোন। শুধু আমার চেহারাটা পাউরুটির মতো। চম্পা সত্যিই বলেছে আমার থুতনিটা ছোটো, কান দুটি বড়ো। খোদা যখন আমাকে তৈরি করেছিল তখন মনে হয় কান দুটি আগে তৈরি করে মাটি বেশী ব্যবহার করে ফেলছে, তাই থুতনিতে মাটি কম পড়েছে সেজন্য কান দুটি বড় আর থুতনি ছোটো। কান দুটি শুধু যে বড়ো তা না, কেমন যেন ছড়িয়ে থাকে, দেখে মনে হয় দরজা খোলা গাড়ী। থুতনিটা ছোটো চেহারার মাঝে কেমন জানি সিরিয়াল কিলারের ভাব চলে এসেছে। আমি সময় পেলেই থুতনিটা টেনে টেনে বড় করার চেষ্টা করি। কোনো লাভ হচ্ছে বলে মনে হয় না।
বড়ো হওয়ার পর লম্বা চুল দিয়ে কান দুটি ঢেকে ফেলা যাবে। ছোটো থুতনিটা ঢাকার জন্য দাড়ি রাখতে হবে। লম্বা চুল আর দাড়ি দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে তো ভালোই দেখায় কিন্তু আমার যেরকম ফাটা কপাল আমাকে তো আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো দেখাবে না। আমাকে নিশ্চয়ই দেখাবে রাসপুটিনের মতো। ভয়ংকর। এই হচ্ছে আমার কপাল, বড় হয়ে রাসপুটিন হওয়া।