০২. আতাহারের মা সালমা বানু

আতাহারের মা সালমা বানু গত এক মাস হল হাসপাতালে। তাঁর অসুখটা যে কি ডাক্তাররা ধরতে পারছেন না। শুরুতে ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা হল। এখন সেই চিকিৎসা বন্ধ করে নানান ধরনের টেস্ট করানো হচ্ছে। একই টেস্ট কয়েক জায়গা থেকে করানো হচ্ছে। রেজাল্ট একেক জায়গা থেকে একেক রকম আসছে। ডাক্তাররা তাতে বিরক্ত বা বিস্মিত হচ্ছেন না। এটাই স্বাভাবিক ধরে নিয়েছেন। দুজন ডাক্তারের ভেতর একজন মনে করছেন কিডনিঘটিত কোন জটিলতা। রক্তের দুষিত অংশ পরিষ্কার করার পর কিডনি আবার তা রক্তেই ফেরত পাঠাচ্ছে। অন্যজন বলছেন কিডনি খুব ভাল অবস্থায় আছে। সমস্যা অন্য কোথাও। সেই অন্য কোথাওটা কি তা বলতে পারছেন না।

সালমা বানু ঘোরের মধ্যে সময় কাটাচ্ছেন। আচ্ছন্ন অবস্থা। মাঝে মাঝে আচ্ছন্ন ভাবটা কেটে যায়, তখন কৌতূহলী চোখে চারপাশে তাকান। লোকজনের কথা শুনেন। নিজেও কথা বলেন। এই সময় কথা শুনতে ও বলতে তাঁর ভাল লাগে। শব্দগুলি ঝন ঝন করে কানো বাজে। নিজের গলার শব্দও নিজে চিনতে পারেন না। মনে হয়। অন্য কেউ কথা বলছে। এই রকম সময় তার বেশি আসে না। এবং আশ্চর্যের ব্যাপার, যখন আসে তখন আশেপাশে কথা বলার মত কেউ থাকে না। তখন তিনি একা একাই কথা বলেন, শব্দ করে হাসেন। এই অবস্থায় তাকে কেউ দেখলে পাগল ভাবতো। এখনো কেউ দেখেনি। শুধুমতির মা দেখেছে। মতির মা বুয়া আঠারো বছর ধরে তাঁর সঙ্গে আছে। তার সুবিধা হচ্ছে সে কোন কিছুতেই বিস্মিত হয় না। সালমা বানুর একা একা কথা বলাটাকে সে স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছে।

গতকাল গভীর রাতে তাঁর তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব কেটে গেল। শরীর ফুরফুরে হালকা বোধ হতে লাগল। মনে হল নিজেই হেঁটে হেঁটে বাথরুমে যেতে পারবেন। তার বেশ ক্ষুধাবোধও হল। মুড়ির মোয়া খেতে ইচ্ছে করল। ছোট ছোট মোয়া যা আস্ত মুখের ভেতর ফেলে দিয়ে পেয়ারার মত কচ কচ করে চিবানো যায়। এত কিছু থাকতে মুড়ির মোয়া খেতে ইচ্ছে হচ্ছে কেন তিনি বুঝতে পারছেন না। তবে তাঁর লজ্জা লজ্জা লাগতে লাগল। এই বয়সে কোন তুচ্ছ খাদ্যদ্রব্যের প্রতি লোভ হওয়া লজ্জারই ব্যাপার। তার মাথার কাছে লোহার ডেস্পীক ধরনের টেবিলে অনেক ফল-টল সাজানো–আপেল, কমলা, আঙুর, বড় বড় সাইজের সাগর কলা। এর কোনটাই তাঁর খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কচকচ শব্দে মুড়ির মোয়া খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। অসুস্থ সময়ের ইচ্ছা-অনিচ্ছাগুলিও সম্ভবত অসুস্থ।

রাত কটা বাজে তার জানার ইচ্ছে হল। তাও জানার উপায় নেই। কেবিন ঘরে কোনচ ঘড়ি নেই। আতাহার যখন এসেছিল তাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলেন। তাকে বললে সে তক্ষুণি গিয়ে একটা ঘড়ি এনে এমনভাবে বসিয়ে দিত যেন তিনি চোখ মেললেই সময় দেখতে পান। অসুস্থ মানুষ ঘড়ি দেখতে ভালবাসে হাসপাতালের লোকজন বোধহয় এই তথ্য জানে না।

সালমা বানু ঘাড় কত করে কেবিন ঘরটা দেখতে চেষ্টা করলেন। কত অসংখ্যবার এই ঘর দেখা, তারপরেও প্রতিবারই ঘরটা তাঁর নতুন মনে হয়। যেমন বাথরুমের দরজাটা এর আগের বার স্বতাঁর মনে হয়েছিল কাঠের, এবার দেখলেন শাদা রঙ করা দরজা। এমনকি হতে পারে তাঁর তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় এরা বাথরুমের দরজা রঙ করে ফেলেছে? না বোধ হয়। তাহলে নতুন রঙের গন্ধ নাকে লাগতো। তিনি কোন গন্ধ পাচ্ছেন না। ফিনাইলের গন্ধও না। শুধু ছড়ছড় শব্দে বাথরুম থেকে পানি পড়ার শব্দ আসছে। বাথরুমে পানি পড়ার শব্দ সবসময়ই বিরক্তিকর। আজ বিরক্তিকর লাগছে না, বরং শব্দটা শুনতে ভাল লাগছে। তিনি পাশ ফিরলেন। এতেও আশ্চর্য বোধ করলেন। পাশ ফেরার শক্তিও তার নেই। আজ বেশ স্বাভাবিকভাবে পাশ ফিরলেন।

মেঝেতে কম্বল বিছিয়ে মতির মা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলা অন্যায় হবে। গভীর ঘুম থেকে কাউকে ডাকতে নেই। তবু সালমা বানু ক্ষীণ কণ্ঠে ডাকলেন, মতির মা! মতির মা!

মতির মা ধড়মড় করে উঠে বসল। তার উদ্বিগ্ন চোখ দেখে সালমা বানুর খারাপ লাগছে। তাঁর কথা বলার ইচ্ছা করছে বলেই তিনি মতির মাকে ডেকেছেন, অন্য কিছু না।

কি হইছে আম্মা?

কিছু না।

মতির মা এসে কপালে হাত রাখল। মতির মার হাতে হলুদ বাটার গন্ধ। মতির মা দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতালে তার সঙ্গে আছে। হলুদ বাটছে না। তারপরেও তার হাতে হলুদের গন্ধ কেন কে জানো! জর সামান্য আছে, ভয় পাবার মত কিছু না।

পানি খাব, মতির মা।

মতির মা বোতল থেকে গ্লাসে পানি ঢালছে। তার হাত কাঁপছে। ঘুম থেকে সে পুরোপুরি জাগেনি। কিংবা হঠাৎ ঘুম ভাঙার ভয় এখনো কাটেনি।

আজ কি বার মতির মা?

রবিবার। আম্মা, আপনের শইল খারাপ লাগতাছে? ডাক্তাররে খবর দিমু?

শরীর ঠিক আছে।

শরীর ঠিক আছে বললেও সালমা বানু বুঝলেন তাঁর শরীর ঠিক নেই। পানি খেতে তেতো লাগছে। অসুস্থ মানুষের কাছে পানি সব সময় তেতো বোধ হয়। পানি যার কাছে যত স্বাদু মনে হবে সে তত সুস্থ।

বাসার খবর কিছু জান মতির মা?

বাসার খবর ভাল আম্মা। ছোড অ্যাফা মন লাগাইয়া পড়তাছে।

পরীক্ষা শুরু হবে কবে?

হেইটা আম্মা জানি না।

সালমা বানু ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললেন। মেয়েটা অনেক দিন তাঁকে দেখতে আসছে না। বোঝা যাচ্ছে পরীক্ষা নিয়ে খুবই ব্যস্ত। কিংবা হয়ত এসেছে, এমন সময় এসেছে। যখন তিনি আচ্ছন্ন অবস্থায় ছিলেন। মতির মা বলল, সক্কালে ছোট আফা আসছিল। আফনে ঘুমের মধ্যে ছিলেন আফনেরে জাগনা করে নাই। ডাক্তার জাগনা দিতে নিষেধ দিছে।

মিলি আছে কেমন?

খুব ভাল আছে।

আফনের জন্যে চিডি নিয়া আসছিল।

কোথায় চিঠি?

আফনের বালিশের নিচে আছে।

তিনি হাত বাড়িয়ে বালিশের নিচ থেকে খাম বের করলেন। খামের মুখ খোলা হয়নি। এর আগেও মনিকার দুটা চিঠি এসেছে। দুটারই খামের মুখ খোলা ছিল। তিনি বিরক্ত হয়েছেন, কিন্তু কাউকে কিছু বলেন নি। একজনের চিঠি আরেকজন খুলবে কেন? মনিকা হয়ত এমন কিছু তাকে লিখতে চেয়েছে যা অন্যের জানা উচিত না। যা শুধু মাই জানতে পারেন।

মতির মা!

জ্বি আম্মা।

এইটো কি মাস?

এইটা হইল আম্মা ফালগুন। কিছু খাইবেন আম্মা?

না, কিছু খাব না। মাথার কাছের বাতিটা জ্বেলে দাও তো।

মাথার কাছে আম্মা কোন বাতি নাই। ঘরে একটাই বাতি।

তিনি আবারো নিঃশ্বাস ফেললেন। তিনি যে হাসপাতালে আছেন তা তার মনে থাকে না। প্রায়ই মনে হয় নিজের ঘরেই শুয়ে আছেন। তাঁর নিজের ঘরে মাথার কাছে একটা টেবিল ল্যাম্প আছে। বড় মেয়ের চিঠি গভীর রাতে মাথার কাছের এই টেবিল ল্যাম্প জ্বলিয়ে পড়েন। মেয়েটার কথা মনে করে তিনি তখন কিছুক্ষণ কাঁদেন।

মনিকা অবশ্যি গুছিয়ে চিঠি লিখতে পারে না। প্রয়োজনীয় কথার চেয়ে অপ্রয়োজনীয় কথায় তার চিঠি ভর্তি থাকে। অসংখ্য খবর থাকে। সব খবর এলোমেলোভাবে লেখা। হাতের লেখাও খুব খারাপ। ঘরের কম আলোয় মনিকার চিঠি পড়া যাবে কিনা। তিনি বুঝতে পারছেন না। তিনি খাম খুললেন।

আম্মা,

আমার সালাম নিবেন। আমি এর আগে আপনাকে তিনটি চিঠি লিখেছি। কোন চিঠির জবাব পাই নাই। আপনার পক্ষে হয়ত জবাব দেয়া সম্ভব না। কিন্তু আপনার হয়ে অন্য কেউও তো জবাবটা দিতে পারে। মিলি তো পারে। মিলিকে আমি পৃথক চিঠি দিয়েছি, সে তারও জবাব দেয় নাই। আসলে আমার ব্যাপারে আপনাদের কারোরই কোন রকম আগ্রহ নাই। আমি বেঁচে থাকলেই কি? মারে গেলেই কি?

আপনার চিকিৎসার জন্য আমি বাবার ঠিকানায় দুশ ডলারের একটা ব্যাংক ড্রাফট পাঠিয়েছিলাম। আমি লিখে দিয়েছিলাম ব্যাংক ড্রাফটের প্রাপ্তি কথাটা যেন আমাকে না লেখা হয়। নিষেধ করার পরেও বাবা সেই কাজটা করেছেন। বিরাট চিঠি লিখে আমাকে ধন্যবাদ দিয়েছেন। এদিকে টাকাটা আমি আপনাদের জামাইকে না জানিয়ে পাঠিয়েছিলাম। সে বাবার লেখা চিঠি পড়ে খুব গভীর। আমাকে বলল–মার চিকিৎসার খরচ দিতে চাও খুব ভাল কথা। খরচ দিবে। মেয়ে মার অসুখের খরচ দিবে না তো কে দিবে? কিন্তু আমাকে জানিয়ে পাঠাতে অসুবিধা কি? আমি কি তোমাকে নিষেধ করতাম? তোমার মা তো আমারো মা।

এই হল মা আমার অবস্থা। ঢাকায় আমাদের ফ্ল্যাট বাড়িটা নিয়েও আপনার জামাইয়ের সঙ্গে সমস্যা হচ্ছে। আপনার জামাইয়ের ধারণা, ভাড়াটে ভাড়া ঠিকই দিচ্ছে–আমাদের মিথ্যা করে জানানো হচ্ছে ভাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। মা, আপনি ঐ ফ্ল্যাট বিক্রির ব্যবস্থা করে ওর নামে সোনালী ব্যাংকে যে একাউন্ট আছে সেই একাউন্টে টাকাটা জমা করে দিবেন। আমার ফ্ল্যাট বাড়ির দরকার নাই। তাছাড়া আপনার জামাই দেশে ফিরবে না। বিদেশেই স্থায়ী হবে।

ও নিজে বাবাকে এই বিষয়ে পৃথক চিঠি দিয়েছে। মা, আমি আপনাদের জন্যে সর্বদাই দুঃশ্চিন্তায় অস্থির থাকি। আতাহারকে আমেরিকা নিয়ে আসার চেষ্টা আমি করে যাচ্ছি। এখানকার পত্রিকায় প্রায়ই পাওয়া যায় আমেরিকান সিটিজেনশীপ পাওয়া বাংলাদেশের মেয়ের জন্যে পাত্ৰ খোজা হচ্ছে। আমি তার সব কটিতে যোগাযোগ করি। আতাহারকে বলেছিলাম তার কিছু রঙিন ছবি পাঠাতে। সে তার উত্তর দেয় নাই। আমি এমন কি অপরাধ করেছি যে, কেউ আমার সঙ্গে কোন যোগাযোগ রাখে না?

আম্মা, আমি খুব মানসিক অশান্তির মধ্যেও আছি। তোমার নাতনী ফারজানা এখন এক কালো ছেলের সঙ্গে ডেট করছে। ছেলেটা দেখতে দানবের মত। যখন দরজার কড়া নাড়ে তখন মনে হয় দরজা খুলে পড়ে যাবে। এই হারামজাদা রোজ সন্ধ্যায় এসে ফারজানাকে ডেটিং-এ নিয়ে যায়। আমি বলে দিয়েছি। দশটার মধ্যে মেয়েকে বাসায় পৌঁছে দিতে। সে দিন এসেছে রাত তিনটায়। আমি খুব হৈ-চৈ করেছি। এতে ফারজানা আমার উপর বিরক্ত হয়ে বলেছে সে আমার সঙ্গে থাকবে না। আলাদা এ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করে থাকবে। চিন্তা করেন অবস্থা! গরিলার মত ছেলের মধ্যে সে কি দেখেছে একমাত্র আল্লাহপাক জানেন। কি বিপদে যে আমি পড়েছি! একদিকে আপনার জামাই, অন্যদিকে ফারজানা আম্মা, আপনি অবশ্যই নফল নামাজ পরে ফারজানার জন্যে দোয়া করবেন। যেন দৈত্যাটার হাত থেকে মেয়েটা উদ্ধার পায়।

ইতি মনিকা

 

মতির মা!

জ্বি।

আতাহার আমাকে দেখতে আসে না?

ও আল্লা, আসে না আবার! এক-দুইদিন পরে পরেই আসে। ভাইজান যখন আসে তখন আফনে থাকেন ঘুমে।

মতির মার এই কথাগুলি সম্পূর্ণ মিথ্যা। আতাহার গত এক মাসে দুবার মাত্র এসেছিল। রোগীকে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখার জন্যে মিথ্যা বলতে হয়। এতে দোষ হয় না।

আতাহার আছে কেমন?

ভালই আছে আম্মা। আপনার অবস্থা দেইখ্যা খুব পেরেশান।

দুশ্চিন্তা করছে খুব?

দুশ্চিন্তা বলে দুশ্চিন্তা। ভাইজানের বলতে গেলে ঘুম হারাম।

অসুখ-বিসুখে সে সব সময় অস্থির হয়।

ভাইজান দাড়ি রাখছে গো আম্মা।

দাড়ি রাখছে কেন?

ওখন ভাইজানরে আরো সুন্দর লাগে।

সালমা বানুরাগী গলায় বললেন, সুন্দর লাগলেও হুট করে দাড়ি রাখবে কেন? আমাকে আরেকটু পানি দাও তো মতির মা।

মতির মা পানি এনে দিল। এক চুমুক খেয়েই তিনি গ্লাস ফেরত দিলেন। পানি আরো তিতা লাগছে। মনে হচ্ছে পানিতে নিমপাতার রস হালকা করে মিশিয়ে দিয়েছে।

মতির মা!?

জ্বি আম্মা।

তোমার খালুজান আছেন কেমন?

ভাল আছেন আম্মা।

তাঁর বোধহয় খুব কষ্ট হচ্ছে।

কষ্ট তো আম্মা হইবই।

উনার বয়স হয়েছে তো। এই বয়সে শরীর সেবা-যত্ন চায়। উনার দেখাশোনার কেউ নাই।

ছোট আফা আছে। ছোট আফার সবদিকে খুব নজর।

নজর হলেও সে নিতান্তই বাচ্চা একটা মেয়ে। তা ছাড়া বাবার ভয়ে সব সময় অস্থির। কাউকে ভয় পেলে তার সেবা-যত্ন করা যায় না।

তাও ঠিক?

তোমার খালুজান মাঝে মাঝে রাত তিনটা সাড়ে তিনটার দিকে ঘুম থেকে উঠে আমাকে ডেকে তুলে বলে বরফ দিয়ে ঠাণ্ডা করে এক গ্লাস লেবুর সরবত দাও। লেবুর সরবতের কি যে এক নেশা! মেয়েকে সে তো আর রাত তিনটার সময় লেবুর সরবতের জন্যে ডেকে তুলবে না। তাই না?

ঠিক আম্মা।

বিয়ের রাতেও তোমার খালুজানের লেবুর সরবত খাওয়ার ইচ্ছা হল। রাত তিনটা সাড়ে তিনটা বাজে। আমি ঘুমের ভান করে শুয়ে আছি। তোমার খালুজান গায়ে হাত দিয়ে ডাকতেই লাফ দিয়ে উঠে বসলাম। তোমার খালুজান বললেন–শরীরটা ভাল লাগছে না। এক গ্লাস লেবুর সরবত খাওয়াবে? চিন্তা কর অবস্থা! আমি নতুন বৌ। ঐ বাড়ির কাউকে চিনি না। কাকে গিয়ে লেবুর সরবতের কথা বলব? দরজা খুলে বাইরে এসেছি। তোমার খালুজানের বড়বোনের সঙ্গে দেখা। আমি লজ্জার মাথা খেয়ে উনাকে লেবুর সরবতের কথা বললাম। উনি হাসতে হাসতে আমাকে বললেন–লেবুর সরবতটরবত কিছু না। তোমার ঘুম ভাঙানোর জন্যে এইসব ফন্দি করছে। কি যে লজ্জার মধ্যে পড়েছিলাম মতির মা!

লজ্জারই কথা।

তোমার খালুজানের বড়বোন আমাকে খুবই আদর করতেন। এই যে অসুখ হয়ে পড়ে আছি, উনি বেঁচে থাকলে দিনরাত আমার পাশে থাকতেন। তার মত ভাল মহিলা আমি আমার জীবনে দেখিনি মতির মা। টাইফয়েডে মারা গিয়েছিলেন। খুব সুন্দর মৃত্যু হয়েছিল উনার। অসুখের খবর পেয়ে চিটাগাং-এ তাকে দেখতে গিয়েছি–আমাকে দেখে কি খুশি। হাসতে হাসতে বললেন, বৌ আসছে, বৌ আসছে। আমাকে বৌ ডাকতেন।

আম্মা, আফনে একটু ঘুমানের চেষ্টা করেন।

ঘুম আসছে না মতির মা। তারপর শোন কি হয়েছে–সন্ধ্যার সময় উনার পাশে বসেছি। মাথায় বিলি দিয়ে দিচ্ছি। উনি বললেন, বৌ, কাকে কি বলতে হবে আমাকে বলে দাও। আমি বললাম, আপনার কথা বুঝতে পারছি না। উনি হাসিমুখে বললেন, তোমার মৃত আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে তো খুব তাড়াতাড়ি দেখা হবে–ওদের কি বলতে হবে বলে দাও। এই বলেই খুব হাসতে লাগলেন। উনি খুব রসিক ছিলেন। মৃত্যুর এক ঘণ্টা আগে রসিকতা করা তো খুব সহজ ব্যাপার না। তাই না মতির মা?

জ্বি।

মতির মা! পানি খাব।

মতির মা পানির গ্লাস এনে দিল। তিনি আবারো এক চুমুক পানি খেয়ে গ্লাস ফেরত দিলেন। দীর্ঘ সময় কথা বলে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। চোখ বন্ধ করে হাঁপাতে লাগলেন।

 

কোথায় যেন কাচ কাচ শব্দ হচ্ছে।

কচকচ শব্দে কেউ কিছু খাচ্ছে। সালমা বানু চোখ মেললেন। অপরিচিত একটা ছেলে তাঁর মাথার কাছে বসে মহানন্দে আপেল খাচ্ছে। ছেলেটার মুখ ভর্তি ফিনফিনে দাড়ি। টকটকে ফর্স গায়ের রঙ। ছেলেটাকে খুবই চেনা লাগছে। তাকে তাকাতে দেখে ছেলেটা আপেল খাওয়া বন্ধ রেখে তার দিকে তাকিয়ে হাসল। হাসতে হাসতে বলল, মা, তোমার আপেল সব খেয়ে ফেলছি।

সালমা বানুর বুকে ধ্বক করে ধাক্কা লাগল। কি আশ্চর্য কাণ্ড, নিজের ছেলেকে তিনি চিনতে পারছেন না! মুখ ভৰ্তি দাড়ি রেখেছে তো কি হয়েছে? গায়ের গন্ধেই তো তাঁর চিনে ফেলা উচিত ছিল। ছোটবেলা থেকেই আতাহারের গায়ে বার্লি বালি গন্ধ।

সালমা বানু খুশি খুশি গলায় বললেন, বটু, তোকে চিনতে পারিনি।

আতাহার আপেলে বড় করে কামড় দিতে দিতে বলল, চিনতে না পারলে তোমার কোন দোষ নেই। আমি নিজেই নিজেকে চিনতে পারি না। যখনি আয়নায় নিজেকে দেখি তখনি মনে হয় অপরিচিত কাউকে দেখছি। তোমার অবস্থা তো মা খুবই খারাপ। দিনরাত না-কি ঝিম ধরে থাক?

সালমা বানু হাসলেন। ছেলেকে দেখে তার এত ভাল লাগছে! লম্বা-চওড়া ছেলে। জন্মের সময় এই এতটুক হয়েছিল। ডাক্তার বললেন, আন্ডারগ্রোথ চাইলন্ড। মাত্র ২.৯ পাউন্ড ওজন। সারভাইভ না করারই সম্ভাবনা। ছেলেকে নিয়ে প্রায় এক মাস থাকতে হয়েছে। হাসপাতালে। রাতের পর রাত তিনি ছেলেকে কোলে নিয়ে বসে কাটিয়েছেন। সামান্য শব্দ হলেই ছেলে কেমন চমকে তাকাতো। মুঠি বন্ধ করে শরীর শক্ত করে ফেলত। কি দিন গিয়েছে! একবার তো হঠাৎ নিঃশ্বাস বন্ধ। হাত-পা সব নীল হয়ে গেল। ডাক্তার-নার্স সব ছোটাছুটি শুরু করে দিল। সালমা বানুর শরীর কাঁপতে লাগল। তিনি তাড়াতাড়ি ছেলেকে বাবার কোলে দিয়ে অজু করে জায়নামাজে গেলেন। ছেলের জীবন রক্ষার জন্যে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন–হে পরোয়ার দেগার, আমি তোমার কাছে কিছুই চাই না। ধন না, সম্পদ না, সুখ না, শান্তি না। আমি শুধু আমার ছেলের জীবন তোমার কাছে ভিক্ষা চাই। নামাজে দাঁড়িয়ে তার কাছে মনে হল শিশু যখন তার মার কোলে থাকে তখন আজরাইল তার জানি কবচ করতে পারে না। আজরাইলকে নিষেধ করা আছে সে যেন কোন মার কোল থেকে শিশুর জীবন ছিনিয়ে না নেয়। যে কারণে মার কোলে থাকা অবস্থায় কখনো কোন শিশুর মৃত্যু হয় না। মা যখন মনের ভুলে বা অন্য কোন কারণে তাঁর অসুস্থ শিশুকে অন্যের কাছে ক্ষণিকের জন্যে দেন সেই সময় টুক করে আজরাইল তার জান নিয়ে ছুটে চলে যায়। এই কথা মনে হওয়ামাত্ৰ সালমা বানু নামাজ ছেড়ে ছেলের কাছে ছুটে গেলেন। ছেলের বাবার কাছ থেকে ছেলেকে প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে নিলেন।

সেবার আজরাইলকে বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে যেতে হয়েছিল। আল্লাহ পাক সালমা বানু নামের অতি নগণ্য এক মহিলার কথা শুনেছিলেন।

ও বটু।

কি মা?

এত দূরে বসে আছিস কেন, কাছে এসে বোস না।

রোগীর গা ঘেঁসে বসে থাকতে আমার জঘন্য লাগে মা।

থাক, তাহলে দূরেই বসে থাক। বাসার খবর কি?

বাসার খবর ভয়াবহ।

ভয়াবহ মানে কি?

বাবা স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা চালু করেছেন। তুমি না থাকায় সংসারের এসেম্ৱীতে বিরোধীদল অনুপস্থিত। বাবার যা ইচ্ছা করে যাচ্ছেন।

কি করছে?

কোত্থেকে কাল দুটা বেল নিয়ে এসেছেন। কাঁচা বেল। সেই কাঁচা বেলই হাত দিয়ে কচলে পানি মিশিয়ে বাকিয়ে বেলের সরবত বানিয়ে ফেললেন। সেই বিষ সবাইকে এক গ্লাস খেতে হবে।

সালমা বানু হাসছেন। ছেলে এত সুন্দর করে কথা বলে যে, শুধু শুনতেই ইচ্ছা! করে। তার ধারণা, এই ছেলের সঙ্গে যে মেয়ের বিয়ে হবে সেই মেয়ে মহা ভাগ্যবতী। মুগ্ধ হয়ে সে শুধু স্বামীর কথা শুনবে। তাছাড়া এমন রূপবান একজন পুরুষ পাওয়াও তো ভাগ্যের ব্যাপার।

ও বটু!

বটুবটুকরবে না তো। বঁটু ডাকলে নিজেকে কুলী সর্দার কুলী সর্দার বলে মনে হয়।

এত বড় নাম মুখে নিতে পারি না। ছোট একটা কিছু ডাকতে ইচ্ছা করে।

কবি ডাকলেই পার। ছোট দুই অক্ষরের ইকারান্ত নাম। মাত্র দুই মাত্রা।

তোকে যে কবি ডাকব, তুই কবি না-কি?

অবশ্যই কবি। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত শুধু জীবনানন্দ ছাড়া আমার চেয়ে ক্ষমতাবান কোন কবি জন্মায়নি।

দাড়িতে তোকে অবশ্যি খানিকটা রবীন্দ্রনাথের মত লাগছে।

সত্যি?

হুঁ, সত্যি।

তোকে রবীন্দ্রনাথের চেয়ে সুন্দর লাগছে। উনার গায়ের রঙ ছিল কালো–তোর গায়ের রঙ দুধে-আলতায়।

রবীন্দ্রনাথের গায়ের রঙ কালো ছিল কে বলেছে?

কোন বইতে যেন পড়েছিলাম। তুই উনার চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর।

পৃথিবীর সব মা নিজের ছেলেমেয়ে সম্পর্কে এরকম ভাবে। যে ছেলের এক ঠ্যাং নেই সেই ছেলের মা নিজের ছেলে সম্পর্কে ভাবে–লাঠিতে ভর দিয়ে আমার ছেলের মত সুন্দর করে কেউ হাঁটতে পারে না।

সালমা বানু হাসছেন। প্রথমে নিঃশব্দে, তারপর শব্দ করে। আতাহার বলল, মা যাই।

যাই যাই করছিস কেন? আরেকটু বোস।

রোগীর কাছে বেশিক্ষণ বসা ঠিক না। তুমি দ্রুত শরীর সারিয়ে বাসায় ফিরে আস।

সালমা বানু বললেন, টেবিলের উপর থেকে কালো ব্যাগটা দে তো। আতাহার ব্যাগ দিল। তিনি ব্যাগ খুলে একশ টাকার একটা নোট বের করে বললেন, নে!

আতাহার অবাক হয়ে বলল, কি?

কি আবার, টাকা।

টাকা কি জন্যে?

খরচ করবি। চা-টা খাবি।

তোমাকে দেখতে আসার ঘুষ না-কি মা? তাহলে তো রোজ রোজ আসতে হয়।

আতাহার অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে টাকা নিল। আজ টাকাটা খুব কাজে আসবে। আতাহার যাবে সাপ্তাহিক সুবর্ণের সম্পাদক আবদুল গনির কাছে। বাসর কবিতাটার কোন গতি করা যায় কি-না তা দেখবে। আবদুল গনি সাহেবের কাছে খালি হাতে যাওয়া যায় না। সব সময়ই কিছু না কিছু নিয়ে যেতে হয়। সাহিত্য বিষয়ে তার দীর্ঘ এবং ক্লান্তিকর বক্তৃতা অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে শুনতে হয়। কোন রকম সাহিত্যবোধহীন একজন মানুষ এত সুন্দর একটা সাহিত্য পত্রিকা কি করে বের করছে কে জানে! জগতের অসংখ্য রহস্যের মত এও এক রহস্য।

আতাহার হাসপাতাল থেকে বের হল বেলা এগারোটায়। ভোরবেলা যখন বের হয়েছিল তখন চনমনে রোদ ছিল। আকাশ এখন মেঘে মেঘে ঢাকা। এত মেঘ হঠাৎ কোখোকে উদয় হল কে জানে! ভুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নামলে খুব যন্ত্রণা হবে।

আজ বৃষ্টিতে ভেজা যাবে না। পকেটে কবিতা। কবিতা ভিজে যাবে। কোন একটা দোকানের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি থামার জন্যে অপেক্ষা করা ভয়াবহ শাস্তির মধ্যে একটি। বৃষ্টি থামার জন্যে অপেক্ষা করলে বৃষ্টি বাড়তে থাকে–এটি জগতের আদি সত্যের একটি।

আবদুল গনি সাহেব থাকেন পুরানো ঢাকায়। আগামসি লেনে। কয়েক ফোটা বৃষ্টি পড়লেই তার বাড়ির সামনের গলিতে এক কোমর পানি জমে যায়। সেই পানি আলকাতরার মত ঘন কালো। পানির ঘনত্বও বেশি, কারণ সব কিছুই সেই পানিতে ভাসে–মরা কুকুর, মরা বিড়াল, মরা মুরগি। গলিতে ঢাকনাবিহীন দুটা ম্যানহোল আছে। আতাহারের বন্ধু সাজ্জাদের ধারণা, ম্যানহোল দুটির মধ্যে একটি জীবন্ত। সে জায়গা বদলায়। কখনো সে থাকে গলির মাঝামাঝি, কখনো সাইডে চলে আসে। বৃষ্টি-বাদলার দিনে যতবার সাজ্জাদকে নিয়ে আতাহার প্রাজ্ঞ সমালোচকের বাসায় গিয়েছে ততবারই সাজ্জাদ। ম্যানহোলে পড়ে গেছে।

 

বৃষ্টির আগে আগেই আতাহার আবদুল গনি সাহেবের বাসায় পৌঁছে কড়া নাড়ল। গনি সাহেব বের হয়ে এলেন। ছোটখাট মানুষ। শান্ত সৌম্য চেহারা। চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চমশা। গায়ে পাতলা পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির নিচে গেঞ্জি নেই বলে রোমশ বুক দেখা যাচ্ছে। গনি সাহেব অনাগ্রহের সঙ্গে বললেন, ও, তুমি আতাহার। খবর কি?

আতাহার বলল, গনি ভাই, কেমন আছেন?

বলেই গাল ভর্তি করে হাসল। তার হাসি থেকে মনে হতে পারে যে মহাপুরুষের দর্শন পেয়ে সে কৃতাৰ্থ। তাঁর আনন্দ রাখার জায়গা নেই।

আপনার জন্যে এক প্যাকেট সিগারেট এনেছি, গনি ভাই।

আতাহার সিগারেটের প্যাকেট বের করল। বেনসন এন্ড হেজে জ। এমিতে যাট টাকায় পাওয়া যায়, আজ আশি টাকা লাগল। সিগারেটের প্যাকেট দেখেও গনি সাহেবের মুখের নিষ্পৃহ ভাব কাটল না। তবে তিনি বললেন, বোস।

আতাহার বলল, আপনার সময় নষ্ট করব না। গনি ভাই। এক্ষুণি বিদায় হব। লিখছিলেন নিশ্চয়ই।

গনি সাহেব শুকনো গলায় বলেলেন, লিখছিলাম না। পড়ছিলাম। লেখালেখির প্রথম ধাপ পড়াশোনা। তোমরা কেউ পড়াশোনার ধার দিয়ে যাও না, লেখালেখি শুরু করে দাও। এটা একটা আফসোস। ঐদিন এক ইয়ং ছেলে চারটা কবিতা নিয়ে এসেছে। আমি তাকে বললাম, অমিয় চক্রবতীর কবিতা পড়েছ? সে হা করে তাকিয়ে রইল। মনে হয় নামটা প্রথম শুনল। দেখে খুব মায়া লাগল। চা খাবে না-কি আতাহার?

জ্বি গনি ভাই, এক কাপ খেতে পারি।

গনি সাহেব চায়ের কথা বলে ফিরে এলেন। তাঁর চেহারা থেকে নিষ্পৃহ ভাব কিছুটা দূর হয়েছে। ঠোঁটের কোণায় হাসি হাসি ভাব। এটিও ভয়াবহ সংবাদ। সাহিত্য বিষয়ক দীর্ঘ বক্তৃতা দেয়ার আগে গনি সাহেবের ঠোঁটে মৃদু হাসি দেখা যায়।

আতাহার।

জ্বি গনি ভাই।

পড়। পড়। এক লক্ষ কবিতা পড়ার পর একটা কবিতা লিখবো। এবং সেই কবিতা ছাপানোর জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়বে না। কবিতা লিখতে পারাটাই প্রধান, ছাপানো প্রধান না।

যদি কবিতা নাই ছাপি তাহলে লেখারই দরকার কি? কবিতা মাথায় থাকলেই হয়।

যথার্থ বলেছ। সেটাই হওয়া ভাল। পৃথিবীর প্রধান কবিরা তাদের শ্ৰেষ্ঠ কবিতা কোনটাই লিখেননি। মাথার মধ্যে রেখে দিয়েছেন।

আতাহার মনে মনে বলল, চুপ থাক গাধর বাচ্চা। অফ যা।

শোন আতাহার। দাড়ি রেখে পাঞ্জাবি পরে ঘুরঘুর করলেই কবি হওয়া যায় না।

আতাহার আবার মনে মনে বলল, গাধার বাচ্চা গাধা হয়, তুই হয়েছিস খাটাস।

চা চলে এসেছে। অতিরিক্ত চিনি দেয়ার পরেও সেই চায়ের তিতকুটে ভাব যায়নি। চায়ের প্রধান যে গুণ উত্তাপ তাও তার নেই। এই চা গনি সাহেবের মতই ঠাণ্ডা।

আতাহার?

জ্বি গনিভাই।

ছন্দ বিষয়ে বিন্দুমাত্র জ্ঞান ছাড়াই তোমরা কবিতা লিখতে যাও। এত হাস্যকর আমার কাছে লাগে! এ দেশের খুব নামী দামী একজন কবি কয়েকদিন আগে আমার কাছে দুটা কবিতা পাঠিয়েছেন। আমি তার নাম বলব না। নাম বলাটা ঠিক হবে না। অক্ষরবৃত্ত ছন্দে লেখা–পদে পদে ছন্দ ভূল। যেখানে তিন মাত্ৰা হওয়ার কথা সেখানে দুমাত্রা। ক্লান্তি শব্দটা ট্রিট করেছে তিন মাত্রা হিসাবে। রীতিমত স্কুল করে এদের ছন্দ শেখানো উচিত। কাজটা কে করবে?

আপনি ছন্দের উপর একটা বই লিখুন গনি ভাই। এই বিষয়ে আপনার চেয়ে বেশি দুই বাংলায় কেউ জানে না।

গনি সাহেব আত্মপ্রসাদের হাসি হেসে অতিরিক্ত গভীর হয়ে গেলেন। আতাহার মনে মনে হাসল। খাটাসটা ফ্লাটারি ধরতে পারে না। আতাহারের কথা সত্যি বলে ধরে নিয়েছে। খাটাসটার দোষ নেই–বুদ্ধিমানরাই ফ্রােটারি ধরতে পারে না, আর এ হচ্ছে গাধার বাচ্চা খাটাস।

আতাহার।

জ্বি।

ছন্দের উপর একটা বই লেখার ইচ্ছা আমার আছে। লিখব কাদের জন্যে? পণ্ডশ্ৰম।

পণ্ডশ্রম হলেও আপনাকেই লিখতে হবে। আমরা আপনার ছন্দজ্ঞান নিয়ে প্রায়ই কথা বলি। আপনাকে আমরা আড়ালে কি ডাকি জানেন গনি ভাই? আড়ালে ডাকি–চালুনি।

আপনাকে আমরা বলি ছন্দের চালুনি। যত বড় কবিই হোক চালুনির মধ্যে আটকা পড়ে যাবে।

গনি সাহেব অত্যন্ত প্রীত হলেন। আনন্দ তাঁর চোখ-মুখে ফুটে উঠল। উদার গলায় বললেন–তুমি ইদানীং কিছু লিখেছ না-কি?

একটা কবিতা লেখার চেষ্টা করেছিলাম।

নাম কি?

বাসর।

বাসর নামে মডার্ন একজন কবি কবিতা লিখবে ভাবাই যায় না, বাসর-ফাসর হচ্ছে মিডল ক্লাস ফ্যান্টাসি।

একটু যদি পড়ে দেখেন গনি ভাই। আপনি কবিতাটা পড়েছেন এটাই আমার জন্যে বিরাট ঘটনা।

গনি সাহেব চোখ-মুখ কুঁচকে কবিতা পড়তে শুরু করলেন–এক হাতে তাল দিয়ে ছন্দ দেখছেন। ছন্দের সমস্যা হচ্ছে বলে মনে হয়। মাঝে মধ্যে গনি সাহেবের মুখ বিকৃত হয়ে যাচ্ছে। হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ছেন।

কেমন হয়েছে। গনি ভাই?

আছে–থোর বড়ি খাড়া। খাড়া বড়ি থোর।

আতাহার মনে মনে বলল–থোর বড়ি তোর পশ্চাদেশ দিয়ে ঢুকিয়ে দেব শালা চালবাজ।

গনি ভাই।

হুঁ।

ঠিকঠাক করে যদি আপনার পত্রিকায়।

আচ্ছা, দেখি।

আপনার হাত দিয়ে একটা কবিতা ছাপা আমার জীবনের একটা স্মরণীয় ঘটনা হয়ে থাকবে।

দেখি দেখি–অনেক কাটাকুটি লাগবে।

আমি তাহলে উঠি গনি ভাই।

উঠবে! আচ্ছা যাও— ও ভাল কথা, এন্টাসিডের একটা বোতল এনে দাও তো–গ্রাক্সো কোম্পানীর। দাঁড়াও টাকা এনে দি।

টাকা লাগবে না। গনি ভাই আছে আমার কাছে, পরে দিয়ে দেবেন।

আবদুল গনি অত্যন্ত উদার ভঙ্গিতে বললেন, দেখি সামনের সংখ্যায় দিয়ে দেব। তবে লিসন টু মাই অনেস্ট এডভাইজ। এইসব আজেবাজে লেখা ছেড়ে ভাল কিছু লেখার চেষ্টা করো। গ্রো আপ। গ্রো আপ।

আতাহার মনে মনে বলল, হে খাটাস, তোকে আমি পুঁতে ফেলব। পাঁচ হাত গভীর একটা গর্ত করে তার ভেতর পুঁতব। গোবর সার দেব, পানি দেব, যাতে একটা গাছ হিসেবে তুই আবার পৃথিবীতে আসতে পারিস। সেই গাছে কোন ফল হবে না, ফুল ফুটবে না। সেই গাছে শুধু আঁটি জন্মাবে। শক্ত শক্ত আঁটি।

কিছু ভাবছো না-কি আতাহার?

জ্বি না।

 

গ্ল্যাক্সো কোম্পানীর এন্টাসিড কিনে গনি সাহেবের হাতে দিয়ে ফেরার পথে দুর্ঘটনা ঘটল। ম্যানহোলে পা বেজে গিয়ে চামড়া ছিলে গেল। ম্যানহোলের বিষয়ে অতিরিক্ত সাবধানতার জন্যই ঘটনাটা ঘটেছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে হাঁটলে এই সমস্যা হত না। আতাহার আকাশের দিকে তাকাল। আকাশ ঘন কালো। মেঘ। আর মেঘা জমছে। মেঘের পরে মেঘ জমেছে, আঁধার হয়ে এল। সুন্দর যে সব কথা সবই বলা হয়ে গেছে। সবচে বেশি বলেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথের জন্ম বাংলা সাহিত্যের বড় দূর্ঘটনার একটি। তাঁর কারণে সুন্দরের চিন্তা ও ব্যাখ্যায় অন্যেরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। এই ব্যাপারটা কি কেউ লক্ষ্য করেছে?

বৃষ্টি ধরে গিয়েছিল, রাস্তার মোড় পর্যন্ত যেতেই আবার শুরু হল। আতাহার লোহালক্করের এক দোকানে ঢুকে গেল। নাট-বল্ট, স্ক্রুর বিশাল দোকান। দোকানের মালিক মধ্যবয়স্ক চশমা পরা এক ভদ্রলোক। গভীর আগ্রহে তিনি হাদিসের কি একটা বই পড়ছেন এবং পা নাচাচ্ছেন। লোহালক্করের দোকানের মালিক বলেই বোধহয় ভদ্রলোকের মুখ লৌহ-কঠিন। চোখ দুটিও মনে হয় পাথরের–কোন জ্যোতি নেই। ভদ্রলোক মুখ তুলে তাকাতেই আতাহার বলল, বৃষ্টির জন্যে ঢুকেছি। বৃষ্টি থামলেই চলে যাব।

ভদ্রলোক বললেন, কোন অসুবিধা নেই–যতক্ষণ ইচ্ছা বসুন। আতাহার বসল। ভদ্রলোক আতাহারকে বিস্মিত করে দিয়ে বললেন, চা খাবেন? আতাহার বলল, জ্বি খাব। ভদ্রলোক পিছন ফিরে বললেন, দু কাপ চা।

এই দোকান ঘরটা লম্পবাটে। পেছন দিকে অনেকখানি খালি জায়গা। সেখানে কঙ্কালসার এক বৃদ্ধ চা বানাচ্ছে। সে এতই বৃদ্ধ যে তার মেরুদণ্ড বেঁকে গেছে।

ভদ্রলোক বই পড়তে পড়তেই বললেন, বৃষ্টি আজ রাত দশটার আগে থামবে না।

আতাহার বলল, ও আচ্ছা।

একথা বলায় মনে করবেন না যে, আপনাকে বৃষ্টির মধ্যে বের করে দিতে চাচ্ছি। চা খান, যতক্ষণ থাকতে ইচ্ছা করে থাকুন।

থ্যাঙ্ক য়্যু।

ভদ্রলোকের কথাবার্তা লোহা-লক্করের দোকানের মালিকের মত না। কলেজের সাহিত্যের অধ্যাপকের মত। সুবর্ণ পত্রিকার মালিক হলে ভদ্রলোককে বেশি মানাত।

বুড়ে চা নিয়ে এগুচ্ছে। তার হাত এমনভাবে কাঁপছে যেন এক্ষুণি হাত থেকে কাপ মাটিতে পড়ে যাবে। বুড়োর দিকে তাকিয়ে থাকাই এক ধরনের টেনশন।

ভদ্রলোক বই পড়তে পড়তেই চা খাচ্ছেন। একবারও চায়ের কাপের দিকে তাকাচ্ছেন না। ভদ্রলোক বই যে পড়ছেন তাও মনে হচ্ছে না। তিনি বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছেন না। তার দৃষ্টি একটা পাতাতেই স্থির হয়ে আছে। বুড়ো চা ভাল বানিয়েছে। কড়া লিকার, চা পাতার সতেজ গন্ধ, দুধ-চিনি সব ঠিকঠাক আছে।

একজন মানুষের মুখোমুখি চুপচাপ বসে থাকা যায় না। বৃষ্টি যেভাবে নেমেছে, বের হবার প্রশ্নই ওঠে না। ভদ্রলোকের কথা ঠিক হলে এই বৃষ্টি রাত দশটার আগে থামবে না। সংসারে কিছু লোক আছে যারা ভবিষ্যদ্বাণী করতে ভালবাসে। এও বুঝি সেই পদের।

ভাই, একটা টেলিফোন করব।

ভদ্রলোক পিছন ফিরে বললেন, টেলিফোনের চাবি খুলে দাও।

বুড়ো আবারও কাঁপতে কাঁপতে আসছে। টেলিফোনের চাবি তার কোমরের ঘুনাসির সঙ্গে বাঁধা। টেলিফোনের চাবি খুলতে তার দীর্ঘ সময় লাগল। হাত এমনভাবে কাঁপছে যে তালার ফুটোয় চাবি দুকানো যাচ্ছে না। যতবার টেলিফোন করা হয় ততবার কি এই জরাগ্রস্ত বৃদ্ধকে প্রাণান্ত পরিশ্রমের ভেতর যেতে হয়?

একটা টেলিফোন নাম্বারই আতাহারের মুখস্থ। সাজ্জাদদের টেলিফোন। সেই টেলিফোনের সমস্যা হচ্ছে–টেলিফোন ধরে নীতু। সামনাসামনি সে কথা বলে না। বললেই হয়, কিন্তু টেলিফোন সহজে ছাড়তে চায় না।

হ্যালো, নীতু?

সাজ্জাদ আছে?

না।

কোথায় গেছে?

কোথায় গেছে সেটা আতাহার ভাই আপনি খুব ভাল করেই জানেন। কিন্তু আমাদের জানাচ্ছেন না।

আমি জানি না নীতু।

আপনার এইসব রসিকতা ভাল লাগে না। সাত দিন হয়ে গেল একটা মানুষের খোঁজ নেই।

সাতদিন হয়ে গেছে?

আজ অষ্টম দিন।

আতাহার ভাই, ফাজলামি করবেন না। ফাজলামি আমার ভাল লাগে না।

ফাজলামি করছি না। সিরিয়াসলি বলছি–থানায় একটা ডায়েরি করিয়ে রাখা দরকার।

আতাহার ভাই, আপনি কি দয়া করে একটু বাসায় আসবেন? বাবা আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান।

আসব কি করে? বৃষ্টি কেমন নেমেছে দেখছিস না?

বৃষ্টি থামলে আসুন।

বৃষ্টি চট করে থামবে না। রাত দশটার দিকে বৃষ্টি থামার ক্ষীণ সম্ভাবনা আছে।

গোঁৎ গোঁৎ শব্দে করে হঠাৎ লাইন কেটে গেল। আতাহার টেলিফোন নামিয়ে রাখতেই ভদ্রলোক বললেন, বৃষ্টি থামার সম্ভাবনা ক্ষীণ নয়, বৃষ্টি থামবেই।

ও আচ্ছা, আপনি কি পুরোপুরি নিশ্চিত যে বৃষ্টি থামবেই?

জ্বি। আবহাওয়ার ব্যাপারে আমার সিক্সথ সেন্স খুব প্রবল।

কি বই পড়ছেন এত মন দিয়ে?

বই পড়ছি না। তাকিয়ে আছি।

ও আচ্ছা।

ব্যবসা-বাণিজ্য নেই, কাজেই কিছু করার নেই। দিনের পর দিন বই মুখের সামনে ধরে ধরে অভ্যাস হয়ে গেছে।

ব্যবসাপাতি ভাল না?

কোন কালেই ভাল ছিল না।

ও আচ্ছা।

সৎ ব্যবসা করতে গিয়ে বিপদে পড়েছি। সব জিনিসের দাম আমার এখানে সস্তা। লোকে ভাবে নকল জিনিস দিচ্ছি। বেশি দাম দিয়ে জিনিস কেনা মানুষের অভ্যাস হয়ে গেছে। একই কমলা আপনি যদি দুটা ঝুড়িতে রাখেন–এক ঝুড়ির কুড়ি টাকা হালি, অন্য ঝুড়ির পঁচিশ টাকা হালি বিক্রি করেন, লোকজন পঁচিশ টাকা হালির কমলা কিনবে। আপনি নিজেও কিনবেন।

আতাহার গম্ভীর মুখে বলল, এর একটা কারণও আছে। বাংলায় একটা বাগধারা আছে–সস্তার তিন অবস্থা। এই ভেবেই সস্তার জিনিস কেউ কেনে না। নতুন একটা বাগধারা যদি রচনা করা যায়…

কি রকম বাগধারা?

চট করে বলা যাবে না। চিন্তাভাবনা করে বলতে হবে। আমি চিন্তাভাবনা করে বের করে আপনাকে বলে যাব। আপনার নাম কি ভাই?

আবদুল্লাহ। নিন, কার্ডটা রেখে দিন। যদি কখনো আপনার বা আপনার কোন বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের লোহালক্করের কিছু দরকার হয়, বলবেন। বাজারের কারেন্ট প্রাইসের চেয়ে দশ পার্সেন্ট কম না হলে কান কেটে কুত্তাকে দিয়ে খাইয়ে দেব।

আমি তাহলে উঠি আবদুল্লাহ সাহেব?

অসুবিধা হবে না। আমি আগের জন্মে ব্যাঙ ছিলাম। ব্যাঙ। স্বভাবের কিছুটা এখনো আছে। বৃষ্টিতে কিছু হয় না।

ছাতা আছে। ছাতা নিয়ে যান। পরে ফেরত দিলেই হবে।

আপনার লাগবে না?

আমি দোকানের উপরের ঘরে থাকি।

বের-টের তো হবেন। ঘরে তো আর বসে থাকবেন না।

আমি বের হই না। আমার পা নেই। দুটা পা ট্রেনে কাটা পড়েছে।

সে কি?

আতাহার এতক্ষণে লক্ষ্য করল, ভদ্রলোক চেয়ারে বসে আছেন, তার গায়ের উপর খয়েরি রঙের একটা চাদর। আতাহারের মনটা খারাপ হয়ে গেল। তার এখন আর এক মুহুর্তের জন্যেও এই ঘরে থাকতে ইচ্ছা করছে না। দমবন্ধ হয়ে আসছে। সে ঘোর বর্ষণের মধ্যে ছাতা হতে বের হয়ে গেল।

বৃষ্টির এতই তোড় যে ছাতায় বৃষ্টি মানছে না। ছাতার কাপড়টাও পুরানো। কয়েক জায়গায় ফুটো। ফুটো গলে মাথায় টপ টপ করে বৃষ্টির পানি পড়ছে। আবদুল্লাহ সাহেবের বুড়ো কৰ্মচারী এই ছাতাও হাতছাড়া করতে চায়নি। ছাতা হাতে দেয়ার সময় কঠিন চোখে তাকাচ্ছিল। বুড়োকে নিয়ে একটা কবিতা লিখে ফেলতে হবে।

এক জরাগ্রস্ত বৃদ্ধ ছিলেন নিজ মনে
আপন ভুবনে।
জরার কারণে তিনি পুরোপুরি বৃক্ষ এক।
বাতাসে বৃক্ষের পাতা কাঁপে
তাঁর কাপে হাতের আঙ্গুল।
বৃদ্ধের সহযাত্রী জবুথবু-–
পা নেই, শুধু পায়ের স্মৃতি পড়ে আছে।
জরাগ্রস্ত বৃদ্ধ ভাবে চাদরের রঙটা নীল হলে ভাল ছিল।
স্মৃতির রঙ সব সময় নীল।

রশীদ সাহেব ভেতরের বারান্দায় উবু হয়ে বসে আছেন। হঠাৎ দেখলে মনে হতে পারে, তিনি বৃষ্টি দেখছেন। ঘটনা তা না–বৃষ্টির পানি জমে বারান্দা পর্যন্ত চলে এসেছে। আরো যদি বাড়ে তাহলে বারান্দা উপচে নোংরা পানি ঘরে ঢুকে যাবে। রশীদ সাহেব সেই ভয়াবহ সময়ের অপেক্ষা করছেন। গত বৎসর এ রকম নোংরা পানি ঘরে ঢুকে গিয়েছিল। পানি পরদিনই নেমে গেল। দুৰ্গন্ধ নামল না। বিকট গন্ধ তিন মাস থাকল। এই ব্যাপার দ্বিতীয়বার ঘটতে দেয়া যায় না। কি করা যায় তিনি তাই ভাবছেন।

আতাহারকে ঢুকতে দেখে তিনি আনন্দিত হলেন। প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ এক করা যায় না। শক্তসমর্থ সঙ্গিী-সাথী লাগে। যুবা-পুরুষ লাগে। রক্ষা পেয়েছে–কিন্তু শরীর পুরোটা ভেজা। শীতে গা কাঁপছে। গরম এক কাপ চা খেয়ে চাদরের ভেতর ঢুকে পড়ে বর্ষ যাপন করতে হবে। বাবার হাত থেকে কতক্ষণে মুক্তি পাওয়া যাবে কে জানে! বাবার তোকানোর ভঙ্গি আতাহারের ভাল লাগছে না।

রশীদ সাহেব অস্বাভাবিক কোমল গলায় বললেন, বৃষ্টির পানি কি রকম বাড়ছে দেখছিস না—কি রে?

আতাহার চমকে উঠল। এ রকম মিষ্টি-মধুর স্বরে বাবা কথা বলছেন–এর মানে কি? সামথিং ইজ ভেরী রং। আতাহার শঙ্কিত হৃদয়ে অপেক্ষা করছে। মধুর প্রস্তাবনার পরের অংশটা শোনা দরকার।

রশীদ সাহেব বললেন, তোর কি মনে হয় বৃষ্টি কমবে?

আতাহার অস্বস্তির সঙ্গে বলল, রাত দশটার আগে বৃষ্টি কমবে না।

তাহলে তো একটা ব্যবস্থা করা দরকার।

আতাহার ভয়ে ভয়ে বলল, কি ব্যবস্থা?

বাবার চিন্তার গতি সে এখনো ধরতে পারছে না। রশীদ সাহেব বললেন, গতবারের মত এবারও ঘরে পানি ঢুকে যাবে। পানি আটকাতে হবে।

কি ভাবে?

কোদাল নিয়ে তুই নেমে পড়। একটা ড্রেনেজ সিস্টেমের ব্যবস্থা কর। জমা পানি যেন বেরিয়ে যেতে পারে।

আতাহার হতভম্ভ গলায় বলল, পুরো উঠান সিমেন্টের ঢালাই করা। কোদাল দিয়ে আমি তার কি করব?

একটা কিছু বুদ্ধি বের কর। রান্নাঘরের পাশের জায়গাটা তো সিমেন্টের না–সেখানে একটা খালের মত কেটে দে।

খাল কাটতে বলছ?

একটা কিছু বুদ্ধি বের করতে বলছি। কোন একটা কাজের কথা বললেই তুই এরকম করে তাকাস কেন? মানুষের জন্ম কি জন্যে হয়েছে? কাজ করার জন্যে হয়েছে, না বিছানায় গড়াগড়ি করার জন্যে হয়েছে?

আতাহার মনে মনে বলল, মানুষের জন্ম হয়েছে সৌন্দর্যের অনুসন্ধান ও ব্যাখ্যার জন্যে।

মনে মনে কথা বলার একটা ব্যবস্থা থাকায় জীবন যাপন কিছুটা সহনীয় হয়েছে। মনে মনে কথা বলার সিস্টেম না থাকলে অর্ধেক মানুষ মরে যেত বলে আতাহারের ধারণা। রশীদ সাহেব বললেন, কি রে, হা করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?

কোদাল কোথায় পাব?

জোগাড় করবি। জোগাড় করতে না পারলে বিকলপ ব্যবস্থা দেখবি।

টিপ টপ করে যেভাবে বৃষ্টি পড়ছে তাতে মনে হয় না ঘরে পানি ঢুকবে।

এখন টিপ টপ করে পড়ছে, দশ মিনিট পরে যে ঝুম ঝুম করে পড়বে না তার নিশ্চয়তা কি? বৃষ্টি তো আর তুই কনট্রোল করছিস না।

আতাহার পানিতে নেমে পড়ল। রান্নাঘরের পাশের একফালি জায়গায় বটি দিয়ে কুপিয়ে নালার মত করতে করতেই ঝমবৃষ্টি নেমে গেল। রশীদ সাহেব বারান্দা থেকে আনন্দিত গলায় বললেন–দেখলি, কেমন ক্যাটস এন্ড ডগস বৃষ্টি শুরু হয়েছে? আজ আমাবশ্য, বৃষ্টি হবেই।

খাল কাটায় পানির কোন হেরফের হল না, তবে রশীদ সাহেব ঘোষণা করলেন–পানি দুই আঙ্গুলের মত নেমে গেছে। জ্যেষ্ঠ পুত্রের প্রতি তিনি খানিকটা মমতাও বোধ করলেন। উদার গলায় বললেন, ভাল করে গরম পানি দিয়ে গোসল কর। সাবান ডলে গোসল। তারপর আগুন-গরম এক কাপ চা খা। আদা-চা। নয়তো ঠাণ্ড-ফাগু লেগে যাবে।

আতাহার মনে মনে বলল, পুত্রের প্রতি আপনার এই গভীর মমতায় আমি অভিভূত হয়েছি। আপনাকে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ধন্যবাদ। আতাহার পুতি-গন্ধময় পানি থেকে বটি হাতে খোড়াতে খোড়াতে উঠে এল। সে বেকুবের মত খালি পায়ে নেমেছিল। ভাঙা কাচে বাম পা কেটে গেছে। আতাহারের ধারণা, তার শরীরের শ্বেতকণিকাদের মধ্যে সাজ সাজ রাব পড়ে গেছে। কারণ ক্ষতস্থান দিয়ে বহু বিচিত্র ধরনের জীবাণু একসঙ্গে শরীরে ঢুকে গেছে। এদের সঙ্গে যুদ্ধ করে মরাতেও আনন্দ। বাবাশ্বেতকণিকারা তাদের ছেলেমেয়েদের শেখাচ্ছে–এই যে দেখ, এটা হচ্ছে টিটেনাসের জীবাণু, আর ঐ পাশে দেখ, এরা জণ্ডিসের জীবাণু। বৈজ্ঞানিক নাম হেপাটাইটিস-এ। কিছু কলেরার জীবাণুও আছে। বল তো লক্ষ্মী সোনারা, কলেরার জীবাণু দেখতে কেমন?

কমার মত।

এই তো পেরেছ। এখন ছুরি-কাচি যা পাও হাতে নিয়ে চলে এসো—জীবাণুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে।

বাবা, আমরা তো ছোট।

ছোট-বড় এখন আর ব্যাপার না। কোটি কোটি জীবাণু ঢুকে পড়েছে। লোকটাকে বাঁচাতে হলে আমাদের সবাইকে কাঁপিয়ে পড়তে হবে। সবাই এক সঙ্গে ঝাপিয়ে না। পড়লে বেচারা বাঁচবে না।

 

চাদর মুড়ি দিয়ে আতাহার তার বিছানায় বসে আছে। জ্বর আসছে বলে মনে হচ্ছে। সিগারেটের ধোয়ার কোন স্বাদ পাওয়া যাচ্ছে না, পানি তিতা লাগছে।

মিলি বড় মগভর্তি একমগ চা এনে আতাহারের সামনে রাখল। আতাহার বলল, চা খাব না। চা নর্দমায় নিয়ে ফেলে দে।

মিলি বলল, আমার উপর রাগ করছ কেন? আমি তো তোমাকে বৃষ্টিতে চুবাইনি।

কারো উপর রাগ করছি না। চা খেতে ইচ্ছা করছে না। জ্বর আসবে বলে মনে হচ্ছে।

প্যারাসিটামল খাবে?

খেতে পারি।

আগে দেখি ঘরে আছে কি-না। না থাকলে তোমকে গিয়েই আনতে হবে। সেলফ হেলপ।

মিলি হাসছে। আতাহারের মেজাজ খুবই খারাপ, তারপরও মিলির হাসি তার দেখতে ভাল লাগছে। মিলি বলল, তোমার কাছে একটা খোলা চিঠি এসেছে। চিঠির উপরে লেখা–আৰ্জেন্ট। যেহেতু খোলা চিঠি আমি পড়ে ফেলেছি।

ভাল করেছিস।

নীতু নামক জনৈক তরুণী কিংবা কিশোরী, কিংবা মহিলা লিখেছেন যে, তাঁর ভাইয়ের এখনো কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। তুমি যেন দ্রুত কোন ব্যবস্থা কর।

আমি কি ব্যবস্থা করব? আমি কি আইবির লোক?

আমাকে ধমকাচ্ছ কেন? ধমক দিতে হলে নীতুকে ধমক দাও।

নীতুটা কে ভাইয়া?

সাজ্জাদের ছোট বোন।

ও আচ্ছা, সাজ্জাদ ভাইয়ার ছোট বোন। তোমার মুখে তো কোন দিন তার নাম শুনিনি।

নাম শোনার কি আছে?

এই নাও নীতুর চিরকুট।

ফেলে দে। আমি ওটা নিয়ে করব কি? খবর যা জানার তা তো জানলামাই। এখন চিরকুট দিয়ে হবে কি? তাবিজ করে গলায় ঝুলাব?

মিলি আবারও হাসল। সেই হাসি দেখে আতাহারের মন দ্রবীভূত হল। সে চায়ের কাপে চুমুক দিল। চা খেতে ভাল হয়েছে। মিলি হাসি মুখে বলল, ভাইয়া, দুই মিনিটের জন্য বসি? খুব জরুরি কথা আছে। ভয়াবহ একটা সমস্যা তৈরি হয়েছে। বাবাকে সেই সমস্যার কথা কিভাবে বলা হবে বুঝতে পারছি না। তোমার পরামর্শ দরকার।

সমস্যাটা কি?

ফরহাদ ভাইয়া পরীক্ষা ড্রপ দিয়েছে।

সে কি?

আজ তার সেকেন্ড পেপার ছিল। প্রশ্নপত্র হাতে পেয়ে দেখল। খুব সহজ প্রশ্ন। প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর যে সে জানে তাই না–তার ঝাড়া মুখস্থ। এই আনন্দে তার মাথা ঘুরে গেল। অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। জ্ঞান হবার পর দেখে তার মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে। সারা শরীর পানিতে ভেজা। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে এক ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। তার পর আর হলে ঢোকেনি। তার জন্যে গরম দুধ আনা হয়েছিল। দুধ খেয়ে সে বাসায় চলে এসেছে।

বলিস কি?

মিলি এখনও হাসছে। আতাহার শক্তিকত বোধ করছে। ঘটনা যা ঘটেছে তাতে হাসোহাসি করা যায় না। বাবা ঘটনা শুনে কি করবেন তা ভাবতেই গায়ের লোম খাড়া হয়ে যাচ্ছে।

ফরহাদ এখন করছে কি?

ঘুমুচ্ছে।

ঘুমুচ্ছে মানে?

ঘুমুচ্ছে মানে ঘুমুচ্ছে। স্লিপিং। আরাম করে নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছে।

আতাহার বিড় বিড় করে বলল, ওহি মাই গড়! মিলি বলল, ওহি মাই গড় বলা ঠিক না ভাইয়া। গড় তো তোমার একা না। কাজেই আমাদের বলা উচিত–ওহ আওয়ার গড়!

মিলির ফাজলামি ধরনের কথা শুনতে ভাল লাগছে না। আতাহার চিন্তিত মুখে জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে। বৃষ্টি দেখছে। বৃষ্টি মুষল ধারে পড়ছে। বৃষ্টি রাত একটা পর্যন্ত হল। আতাহারের সমস্ত প্রচেষ্টাকে ব্যৰ্থ করে দিয়ে রাত একটার সময়ই নোংরা। পানি বাড়িতে ঢুকে গেল।

 

সেই রাতে আতাহারের খুব ভাল ঘুম হল। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখল। সে জাপানে। কিমানো পরা এক জাপানি তরুণী তার সঙ্গে হেসে হেসে বাংলায় কথা বলছে। তরুণীর মুখটা কিছুটা নীতুর মত। আতাহার বলল, আপনি এত সুন্দর বাংলা কোথায় শিখেছেন? জাপানি তরুণী তাতে খুব মজা পেয়ে গেল। খিল খিল করে হাসতে লাগল। হাসি থামিয়ে বলল, আপনার কাছ থেকে শিখেছি। আপনি ছাড়া আর আমাকে কে শেখাবে? আতাহার কিছুতেই ভেবে পেল না কখন সে এই মেয়েকে বাংলা শিখিয়েছে। স্বপ্নের মধ্যেই তার খুব অস্থির লাগতে লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *