আঠারো বছর পরে
গত বছরের মতো এবারেও গরমের ছুটির কিছুদিন আগে থেকে দীপ্তি শুরু করেছে, এবার গরমের ছুটিতে আমরা কেদার-বদ্রী যাব।
বলছে মেয়েকে; কিন্তু আমাকে শুনিয়ে।
এবার এপ্রিলে আমাদের বিয়ের ১৮ বছর পূর্ণ হয়েছে। এই ১৮ বছর ধরে তার যাবতীয় কামনা ও বাসনার খবর আমি প্রথম দিকে দেওয়াল ও পরবর্তীকালে চৈতি মারফত পেয়ে থাকি। সে বলে আমাকে; মেয়েকে শুনিয়ে।
কিন্তু, নতুন বছর থেকে সে সুর বদলেছে। এবার সে যে রাগে গাইছে, তারই নাম বোধহয় আশাবরী। এর মিড-গমক-মূৰ্ছনা সবটাই আলাদা। ভাবখানা, যেন কেদার-বদ্রী সেরে এসে সে জনে জনে সুতোর তাগা আর চিনি-রোলার প্রসাদ বিতরণ করছে।
এর মধ্যে একদিন, দীপ্তি বেরিয়ে যাওয়ার পর, চৈতি তিন-তিনখানা রেনকোট আমার সামনে এনে রাখল।
কেন রে?
মা সেল-এ খুব সস্তায় পেয়েছে। কেদারের পথে যেতে লাগবে।
আমাকে দেখাবার বিন্দুমাত্র প্রয়োজন সে বোধ করেনি। এবার তার আত্মপ্রত্যয় এত বেশি।
ওর কলেজের বীণাদি মনোরমাদিরা গত গ্রীষ্মে পাল স্পেশালে কেদারনাথ বদ্রীনাথ গিয়েছিল। সেই থেকে বলছে। ওদের সঙ্গে তখন যেতে পারত। তা নয়।
আমরা যাব। সামনের বছর পুজোয় আমরা ফ্ল্যাটের সেকেন্ড ইনস্টলমেন্ট দেব। শান্তিনিকেতনে, কোপাই নদীর একদম ধারেই, মাস্তৃপিসি ৫ কাঠা জমি ছেড়ে দিচ্ছে। এখন হাজার দুই দিয়ে বায়না করলেই হবে। আমরা কিনব।
এ ধরনের সঙ্কল্প সে করে মেয়ের কাছেই, তবে তখন, যখন আমি ধারেকাছে থাকি। অবশ্য, এইটুকু তিন-ঘরা ফ্ল্যাটে কত দূরেই বা যাব।
একটু জোরে ফিসফিস করেও যখন কিছু মেয়েকে বলে, এ ঘরে শোনা যায়। জানা যায় যে, সে যাবে। সে দেবে। সে কিনবে।
ভুল বললাম।
আমরা দেব। আমরা কিনব। আমরা যাব।
আমার সঙ্গে আদৌ কোনও পরামর্শ না করে, আমার সুবিধে-অসুবিধের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র কৌতূহল প্রকাশ না করে, সে এই সব সিদ্ধান্ত নেয় ও সেই সব অভিযানের তোড়জোড় করতে জমির দালাল বা পাল স্পেশালের ভূমিকায়, যখন যা, আমাকে অবতীর্ণ হতে বলে।
এখনও পর্যন্ত আমি তাকে একটি ব্যাপারেও না বলতে পারিনি।
দেব। যাব। খাব। করব। করাব। কিনব।
এ নয় যে ভবিষ্যবাচক এই সব ক্রিয়াকর্মের প্রতিটি ব্যাপারেই সে আমার মুখাপেক্ষী। বা, উচ্চারণ করে তার সকল কামনাই সে এভাবে ব্যক্ত করে। তা নয়। সে এতটা খেলো নয়। তার ব্যক্তিত্ব আছে। যেমন, ওই জামদানিটা কিনব। ফান মাঞ্চ খাব। এগুলো বলে না। আলমারি বা ফ্রিজে কমলা রঙ করাব। বলে না। বা, বাথরুম মোজায়েক, কী ডাইনিং টেবিলে সানমাইকা! রঙ, কাঠ ও রাজমিস্ত্রির ব্যাপারে সে আমার বদলি হিসেবে পাড়ার কন্ট্রাক্টর দত্তবাবুর সংস্পর্শে এসে গেছে। দীর্ঘ ১৮ বছরের দাম্পত্য-জীবনে গুণরাশিনাশি দারিদ্রদোষ থেকে আমরা যত মুক্তি পেয়েছি যতই দুধ-আনা, রেশন-আনা থেকে অব্যাহতি মিলেছে, ততই আমরা কবে থেকে যে ক্রমাগত আমি হয়ে গেছি, সরে এসেছি দুজনেই দুজনের কাছ থেকে, কত যে। কোনওদিন কাছাকাছি ছিলাম হয়ত। না পড়ুক মনে, সুখ অথবা দুঃখের কোনও কোনও ঘটনা আমাদেরও জীবনে নিশ্চয়ই ঘটেছিল। অন্তত, সিনেমা তো গেছি। দুজনে বেড়াতে গেছি অন্তত মিহিজামে। যাইনি? এক বিছানায় শুয়েছি কত না বার। কিন্তু, ওর ওই পরস্ত্রীমুখের দিকে তাকালে আজ আমার মনেও হয় না, যে, আমরা কোনওদিন পরস্পরকে হয়ত চুম্বনও করেছি। বড় ভুলো মন আমার, নিঃসন্দেহে।
তাই, সে যখন আমরা বলে, আমি দেখতে পাই লতা-পাতা-ঘাসফুলে ঢাকা এক নিখুঁত ফাঁদ। একটা গহ্বর। ফাঁদের সামনে দাঁড়িয়ে, আমি তার নির্মিতির কৃৎ-কুশলতা তারিফ না করে পারি না।
এমনকি, মাঝে মাঝে আমি যদি তাকে এখনও কাছে ডাকি, আর ঘুমন্ত মেয়েকে পাশের ঘরে রেখে সে আমার সিঙ্গল বেডে আসেও আমাদের সেই শোয়া ব্যাপারটিও কখনও যুগ্মতায় পর্যবসিত হয় না। (হয়েছিল নাকি কোনওদিন?) এই কাজটিও মূলত একা-একা সে নিম্পন্ন করে নেয়, (নিয়েছে ও বরাবর নিয়েছিল) কত অনায়াসে, কী পেশাদারি শারীর পটুতায়! সে এসে সেক্স করে যায়, তার মান-মর্যাদা, এমনকি, বলা যেতে পারে, তার কৌমার্যটুকুও অক্ষুন্ন রেখে। কী নিপুণভাবে পারে যে! শিশুপাল বধ যেন দর্পহারী শ্রীমধুসূদনের। কুচুৎ করে গলাটা কেটেই, ওই, আবার তর্জনীতে সুদর্শন। বোঁ-বোঁ করে ঘুরছে।
নাকি, কন্ট্রাক্টর দত্তবাবুর সূত্র ধরে ভাবব, ওর কাছে গোটা দাম্পত্য ব্যাপারটাই স্রেফ হিসেবের কড়ি। যে, রঙ করেছ, পারিশ্রমিক পেয়েছে। এবার এই ফ্রিজ আমার। আলমারি আমার।
সত্যি কথা বলতে কী, আমি বাঁজা নয়, এ ছাড়া আর কিছু জানবার জন্যে সে একদিন মাথায় সিঁদুর ও গায়ে লাল বেনারসি ও মুখময় চন্দন পরেছিল বলে আমার মনে হয় না।
এই যেমন আজ এপ্রিল ১৭, ১৯৮৮। সোমবার। এখন বেলা সাড়ে ৯টা। দীপ্তি ডাইনিং টেবিলে খেতে বসেছে। লেখক নই, তবু আমি এ ঘরে এই সব ছাইপাঁশ ভেবে যাচ্ছি। হঠাৎ, ডাইনিং স্পেশ থেকে, সি-শার্পে—ধূর! ইচ্ছে করে সব টান মেরে ফেলে দিই। হুশ-হুশ!
মেয়ে চৈতি এসে জানায়, জলের জাগের ওপর একটি আরশোলা দেখা দিয়েছিল। চলে গেছে।
আমি : তা, একটা আরশোলা গেরস্ত বাড়িতে মাঝে-মধ্যে দেখা দেবে না? ও কি সাধ করে বসেছিল জলের জাগে? ওর যদি সেই জ্ঞান থাকত যে ওটা জলের জাগ, পায়খানার মগ নয়, তাহলে কি ও…
চৈতি : হ্যাঁ। কিন্তু মাকে সেটা বোঝাবে কে?
আমি (চেঁচিয়ে) : যেভাবে আর্তনাদ করে উঠলে, জলের জাগ জড়িয়ে একটা সাপ উঠতে দেখলে, সত্যিকারের সর্বনাশ এলে, সেদিন তাহলে কীভাবে চেঁচাবে?
দীপ্তি (মুখে ভাত-তরকারি) : চৈতি, বাবাকে ভ্যাড়র-ভ্যাড়র করতে বারণ কর। আমি এখন কলেজে যাচ্ছি। এক ঘণ্টার পথ।
তা সত্যি। আমি চুপ করে যাই। সাজগোজ শেষ করে, শুধু পায়ে চটি পরার কাজটুকু বাকি রেখে, শেষকৃত্য হিসেবে সে বাথরুমে যায়। সোম আর শুক্র এই দুদিন পরপর প্রথম দু পিরিয়ড তার অনার্স ক্লাস। বাস-জার্নি ধরে ঝাড়া তিনটি ঘণ্টার ব্যাপার। কলেজে পৌঁছেই সোজা ক্লাসে। ক্লাসে যদি বাথরুম পায়, সে ভারি বিশ্রী। চৈতির সঙ্গে তার আলাপচারীতে এ কথা জানা গেছে যে, সে আজকাল ইলাবোরেশান অফ থট প্রপারপড়াচ্ছে। সাইকোলজির একটি রীতিমত জটিল বিষয়।
আলোচ্য বিষয়ে ফিরে আসা যাক। যা বলছিলাম : আমরা। আমরা বলতে আমি আর দীপ্তি। স্বামী-স্ত্রী। আমাদের দুজনের যত বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশী সমাজ যাদের সংস্পর্শে আমরা এসেছি এবং আরও আসতে থাকব—সর্বত্র আমাদের পরিচয় তো একটাই। আমরা বিবাহিত। আমরা স্বামী-স্ত্রী। আইনের চোখে তো বটেই। অন্তত, ডিভোর্স না হওয়া পর্যন্ত।
অথচ, আমরা জানি, জন্তু-জানোয়ারদের ক্ষেত্রে যেমন হয় না, আমাদের বিবাহ হয়নি।
প্রশ্ন : আচ্ছা, এ পৃথিবীতে সংজ্ঞার্থে কোনও নরনারীর বিবাহ কি এ যাবত কোথাও হয়েছে?
এটা আমার একটা আন্তরিক জিজ্ঞাসামাত্র। এর উত্তর আমার জানা নেই। তাই। শুধু জানি, আমাদের সেই অর্থে হয়নি। অর্থাৎ, সংজ্ঞার্থে।
এসপ্ল্যানেড টু চেতলা-১৭,৩বি, ট্যাক্সি বা মিনি যাতেই আসি, প্যারিস হলের সামনে দিয়ে নিত্য আসা-যাওয়া। পৌষ মাস-ভাদ্র মাস নেই সেখানে রোজ বিয়ে। দিনে দিনে প্যারিসের র্যালা যেন বেড়েই চলেছে। মাড়োয়ারিদের বিয়ে হলে তো কথা নেই। আলোর রোশনাই তখন ভিক্টোরিয়া মৃত্যু-সৌধকেও টেক্কা দিতে চায়। তোরণ-দ্বারে ইংরেজি নিয়ন অক্ষরে অনেকটা ডানলপ ইজ ডানলপ—অলওয়েজ অ্যাহেড ধরনে জ্বলে-নেবে বর কনের নাম: সুরেশ ওয়েড্স পদমিনি। ডিস্কো মঞ্চ থেকে ভেসে আসে হাসান জাহাঙ্গিরের গান:
হাওয়া, হাওয়া, এ হাওয়া, খুসবু লুটা দে
ইয়ার মিলা দে, দিলদার মিলা দে…
কিন্তু যত ফুলে-ফুলেই ভরে উঠুক বিবাহের মণ্ডপ, আলোর রোশনাই কি সানাই, কনের গা ভরে যাক গয়নায় চূড-ব্রেসলেট-নেকলেশ বাউটি ও বালায় কি লাল বেনারসিতে, সিঁথিতে যতই ঢালা হোক সিঁদুর–আদি যৌনধ্বনি উলু আর শাঁখে বর আর কনের শরীর যতই ভরিয়ে দিক মিলনোন্মত্ত বাঘ-বাঘিনীর গানে—বিবাহের উল্কি যতই করে পড়ুক তাদের সর্বাঙ্গে আমি জানি বা জানাতে চাই যে, কিছুই, কিছুই বোধহয় মানব-মানবীর বিয়েকে সে মন্ত্রমুগ্ধতা শেষাবধি দিতে পারে না যেখানে যদিদং হৃদয়ং তব। প্রকৃতপ্রস্তাবে, বিবাহিত জীবনে প্রবেশ করে প্রত্যেক মানব-মানবীর হয়ত একটাই সাধারণ অভিজ্ঞতা হয়। যে, এখানে। আর সব কিছুরই প্রয়োজন আছে, শুধু একটা জিনিসের নেই। আর সেটা হল, প্রেম।
আমার বিবাহিত বন্ধুবান্ধবদের কাছে, জোড়ায় পেলে, আমি জনে জনে জানতে চেয়েছি, আচ্ছা, তোমরা কি, তোমরা কি, পরস্পরকে ভালবাস?
প্রত্যেকে মুখ-চাওয়াচায়ি করেছে। কেউ বলেনি, হ্যাঁ। প্রশ্ন তো এ নয় যে কাল ভোররাতে দুজনে মিলে খুব তুলো উড়িয়েছিস–হ্যায় না?
তাহলে বলতে পারত, তুমি একবচন এবং তৃতীয় ব্যক্তি, তোমাকে বলব কেন হে?
কিন্তু, এ তো একটা সামাজিক প্রশ্ন।
ফ্রয়েড, হ্যাভলক, এলিস, কিনস্ থেকে অধুনাতন মাস্টার্স অ্যান্ড জনসন জোড়ায় জোড়ায়। শত শত দম্পতিকে কাছে ডেকে কত না প্রশ্নোত্তর করল। যৌন প্রসঙ্গে কত কী নতুন তথ্য জানা গেল। মাস্টার্স অ্যান্ড জনসন তো পূর্বাপর অনেক ধারণাই ভেঙে দিল। কারা এদের সাহায্য করল?
না, সারা পৃথিবী থেকে চয়ন করা বিভিন্ন বয়স, ধর্ম ও জাতির পাঁচ শত ইচ্ছুক দম্পতি। কিন্তু, এই একটা ব্যাপারে, স্যাম্পল বা র্যানডম, কোনও প্রকার সার্ভেই আজও হল না। কেউ সাহস করল না করতে। যে, ওহে, ভাল কি বাস?
স্বীকার করি, এমন একটা বিষয়ে অনুসন্ধান করতে যাওয়া টুটেনখামেনের রত্নময় অন্ধকার সমাধিগৃহে প্রবেশ করার চেয়েও ঢের সাহসের কাজ। কারণ, উত্তরে যদি না পাওয়া যায়—সে হবে এপ-প্রজাতিতে দুবর্লতম হলেও বৃহত্তম জননাঙ্গধারী,সমস্তরকম আবহাওয়ায় যত্রতত্র (এমনকি বরফ-ঘর ইগলুর মধ্যে এস্কিমোরাও) সঙ্গম করতে সক্ষম মানব সমাজের পক্ষে চূড়ান্ত লজ্জার ব্যাপার। কেন না, প্রেমময় মনোগ্যামি, সে তো আজকের কথা নয়। সেই উদ্দালকের কাল থেকে চলে আসছে। মানব সভ্যতার সে টেংরি খুলে নেবে, এমন বাপের ব্যাটা কে! কেন না, প্রেম যদি সমস্ত দাম্পত্য মূল্যবোধের পিতা না হয়, তাহলে মেনে নিতে হয়, পৃথিবীর সমস্ত দাম্পত্য জারজ।
বিশেষত, যে-কোনও আত্ম-জিজ্ঞাসুনারীর পক্ষে এ-প্রেমহীনতা মেনে নেওয়া বড় লজ্জার কথা, আমি মনে করি। যে, প্রেমই যদি না থাকবে, তাহলে, যৌনতার অবসানে, মাতৃত্বের অবসানে, আমি তোমার কাছ থেকে শেষ পর্যন্ত পেলামটা কী। শুধু বাথরুম-বেডরুম, এই বাড়ি আর গাড়ি, ফ্রিজ-টিভি-টেলিফোন-লকারে গয়না? শুধু প্রজন্ম রক্ষা–এ কাজ তো স্বামীর স্ত্রী-ভূমিকাবর্জিত রক্ষিতার দ্বারাও দিব্যি সম্পন্ন হত। হত না কি!
আসলে, প্রজাপতি ঋষির নামে ওই মন্ত্রগুলো। কবিতা, ছবি আর গানগুলো। ওই ভালবাসার গল্পগুলো। রোমিও-জুলিয়েট না হয় মিঠুন চক্রর্তী আর মাধুরী দীক্ষিত, অমন যে ডাকসাইটে রাসকলনিকভ, সেও কিনা, সোনিয়ার (যদিও বেশ্যা, স্ত্রী নয়) প্রেমে হ্যাঁ বলল। বা, পুতুলনাচের ইতিকথার শশী! সেও কি একবারটি জ্বলে উঠল না সেই অলীক শিখা হয়ে যার বাইরেটা হলুদ এবং ভেতরটা নীল—অর্থাৎ কিনা, রাধা এবং কৃষ্ণে-যখন সে জানতে চাইল, শরীর, শরীর! তোমার মন নাই কুসুম? (যদিও পরস্ত্রী)।এ পৃথিবীতে একজন সন্তও আজও দেখা গেল না, হায়, যার ঈশ্বরে প্রয়োজন নেই। অথচ, ঈশ্বর বিনা সন্ত হওয়ার সম্ভাবনা যদি না থাকবে, তাহলে প্রেম বিনা এত লক্ষ কোটি দম্পতি এই গ্রহের পিঠে এমন ড্যাং ডেঙিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে কী করে।
তাই বলছিলাম, দীপ্তি যখন বলে আমরা, ঘাসফুল ও লতা-পাতায় ঢাকা নিপুণ হাতে ফদা সেই গহ্বরের সামনে আমি থমকে দাঁড়াই ও পাথরে দুবার খুর ঠুকি।
আমার মনে পড়ে, মধ্যিখানে-চরে দাঁড়িয়ে থাকা নিঃসঙ্গ কালোধূসর সেই বাইসনকে–যেবার, বিয়ের তৃতীয় বছরে ১৯৭২-এর ডিসেম্বরে, আমরা গিয়েছিলাম মানস স্যাংচুয়ারিতে।
তখন বিকেলবেলা। তার পিছনে তিন দিকে কোথাও নীল, কোথাও সবুজ, কোথাও অস্তরাগে রাঙা ভুটান হিলস। তার দুপাশ দিয়ে কাকচক্ষু মানস নদী দ্বিধারায় বহে চলেছে। তার সামনে, নদীর ওপার। যেখানে, যতদূর দেখা যায় দিগন্ত পর্যন্ত হাতি-ঘাসের অরণ্য। সূর্য সেখানেই অস্ত যাবে।
হাতির পিঠে সামনে মাহুত, মাঝখানে আমি, পিছনে দীপ্তি।হঠাৎবাঁ-হাতের তর্জনী ঠোঁটের ওপর রেখে দক্ষিণবাহু অঙ্কুশ সহ তুলে মাহুত তিন-চারশো গজ দূরে অনন্ত স্থিরচিত্রে অর্পিত সেই তাকে, বাইসনটিকে, আমাদের দেখায়।
আমরা দেখলাম, তিন-চারটি বৃত্তে পাকানো তার দুটি শিঙে। (যা দৈঘে সাত থেকে ন ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে এবং শুরু হয় কমপক্ষে আট ইঞ্চি প্রস্থ দিয়ে) জড়িয়ে আছে অনেকদিনের লতাপাতা, ঘাস ও ফুল–যা বিশাল ও বর্ণময় মুকুটের মতোই দেখাচ্ছিল। সে একা চুপ করে দাঁড়িয়েছিল স্থির অথচ বিপন্ন এক মুগ্ধতার দৃষ্টান্ত হয়ে। পশ্চিম দিগন্ত থেকে বিধাতার শ্রেষ্ঠ আলোকসম্পাত ক্রমে এগিয়ে এসে তার একাকীত্বকে ঘিরে ধরে।
এমন দৃশ্য জীবনে কটা, যা আমৃত্যু মনে থাকবে? এটা ছিল তেমনি এক নিঃসঙ্গ অভিজ্ঞতা।
আমাদের সে দেখতে পেয়েছিল অনেক আগেই। তবু হঠাৎ একটা হাওয়া উঠে মনুষ্যগন্ধ তার নাকে নিয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত সে নিশ্চিত হতে পারেনি। তারপর…
সেই প্রথম বোঝা গেল সে চলৎশক্তিহীন নয়।
সে দুবার পেছন পায়ের খুর ঠোকে। তারপর শুরু হল তার মৃত্যু-ভীতির সেই প্রবল ঝড়-দৌড়।
অমন ভয়াবহ ভয় পেল সে, কেন যে।
প্রথমে বালি, তারপর নুড়ি, তারপর ছোটবড় বোল্ডার–স্তরে স্তরে খুরধ্বনি বাড়িয়ে গোটা নদী-উপত্যকা ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত করে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে শোন ব্রিজের ওপর দিয়ে ডুন এক্সপ্রেসের আলো চলে যাওয়ার গতিদিব্যতায় সে নদী পেরিয়ে ছুটে চলল একটানা, ওপারের ওই ঘন ঘাসের জঙ্গলের দিকে। জঙ্গলের ভেতর অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার আগে, বুঝি তার শিঙের নাড়া খেয়েই, দিগন্তে সূর্য উঠল ঈষৎ লাফিয়ে।
হাতির পিঠ থেকে মাহুত যেভাবে দেখিয়েছিল, সেভাবে, অশরীরী বিমুগ্ধ হাত তুলে আমি দীপ্তিকে দেখাই : লতাপাতা আর ঘাসফুলে তৈরি সেই বিশাল মুকুটটা নদী পেরোবার সময় কখন তার মাথা থেকে খসে পড়ে, আমি লক্ষ্যই করিনি। এখন স্বর্গস্রোতধারা ধরে ভেসে চলেছে। ওই যে।
দীপ্তি মাহুতকে বলল, বাংলোয় ফিরে চল।
বলবার দরকার ছিল না। মাহুত হাতির মুখ আগেই ঘুরিয়ে নিয়েছে। সূর্য ডুবে গেছে।
এখানে হঠাৎ অন্ধকার নেমে আসে।
দীপ্তি বলল মাহুতকে, দাঁড়াও। হাতি বৈঠাও। আমার দিকে চেয়ে, আমি পেছনে বসব না।
মাচান থেকে যখন হাতির পিঠে সবার পিছনে চাপে, আমি তখনই বলেছিলাম, এটা মথানগুড়ির বাংলো। কোর এরিয়া। এখানে বাঘ থাকে। আর বাঘে হাতির পিঠে লাফায় পেছন থেকেই।
মাকড়সায় ঘৃণা, আরশোলায় আতঙ্ক। কিন্তু তখন ভাবখানা ছিল, আমার বাঘের ভয় নেই। তাছাড়া আমি যখন জানি, কথাটা ভুল। এখানে বাঘ থাকে না। তাহলে কি বাংলো থাকত। মানুষ আসত। থাকলেও বাঘ পেছন থেকে লাফায় না। হাতির পিঠে।
আমি বলেছিলাম : আমি ছাপার হরফে পড়েছি। তাও বাংলায় নয়। ইংরেজিতে।
দীপ্তি তখন শোনেনি। সেই পিছনেই বসেছিল।
ফেরার পথে হাতি বসলে, এবার আমি পিছনে চলে এলাম। ওর কথাই ঠিক। হাতির পিঠে বাঘ পেছন থেকে লাফায় না। বরং এবার আমার কথায় সামনে বসার দরুন, মাঝখান থেকে, একটা ডালের ঝাপ্টা লেগে ওর কপালটা বেশ ছড়ে গেছে। বাংলোয় হাতি থেকে নেমেই দীপ্তি আমাকে অভিযুক্ত করল।
এসব ব্যাপারে বলতে হয় না কিছুই। বাংলোয় না ফিরে পাহাড়ি বনের ভিতর দিয়ে আমি অ্যান্টিসেপটিকের খোঁজে বিট অফিসার দেবেন্দর ঠাকুরের কোয়ার্টারের দিকে চললাম।
ভুটান এবং আসাম, মানস স্যাংচুয়ারি দুদিকেই ছড়িয়ে। ২৮৪০ স্কোয়্যার কিলোমিটার। আমি জানি। এখানে ১৮০টা বাঘ আছে, আসার সময় টাইগার প্রোজেক্টের দেববর্মা আমাকে বলেছে। আমি জানি।১৮০ ব্যাঘ্ৰসঙ্কুল মানসের কোর এরিয়া ভেদ করে, ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে, দীপ্তির জন্যে দু-চার ফেঁটা স্যাভলনের খোঁজে এই ভরা সন্ধেবেলায় আমি এগিয়ে যাই।
আজ পূর্ণিমা। বিকেল এখনও ফুরায়নি। এর মধ্যেই চাঁদ উঠে এল এতটা! নিচে, নদীর বুকে, দিনের আলো আর জ্যোৎস্না মিশে স্বর্গরঙ। শেষ যাত্রী-নৌকা চলেছে ভুটানের দিকে।
বাংলোর বারান্দায় চা খেতে খেতে দীপ্তি নিশ্চয়ই এটা মিস করছেনা, ভেবে ভাল লাগল।
প্রথম রাতেই মথানগুড়িতে বাঘ ডাকল। খুব একটা দূর থেকেও নয়। কাঠের খুঁটির ওপর গোটা বাংলোটা কেঁপে উঠল। শার্সির ঝনঝন শোনা গেল। দীপ্তি ভয়ে জড়িয়ে ধরল আমাকে। অমন নিবিড়, সপ্রেম আলিঙ্গন সেই প্রথম। এবং একবারই।
পরদিন সকালে একটু বেলা করে ঘুম থেকে উঠে দেখি জিনিসপত্র গুছিয়ে স্নানটান করে দীপ্তি একদম রেডি। কী ব্যাপার!
এখানে আর থাকব না। শিলং যাব।
সে কী। গোল্ডেন লেঙ্গুর দেখবে না? নদীর ওপারে ভুটানে গেলেই সোনালি ল্যাজ ঝুলিয়ে সব… আর একদিন থাকা যাক না।
না।
ওই বিশ-তিরিশটা যা আছে এখানেই। জান? পৃথিবীতে এই স্পিসিসটা আর কোথাও নেই।
একটা জিপ বরপেটা যাচ্ছে। এখুনি। লেট আস মুভ।
এটা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর স্যাংচুয়ারি। আর একদিন থাকবে না?
এঃ। কী আমার ভূপর্যটক রে। জেলেপাড়ার ছেলে। নাও ওঠো তো। এরপর কবে ট্রান্সপোর্ট পাওয়া যাবে…
বলেছিলাম, আমি পড়েছি। মোস্ট বিউটিফুল স্যাংচুয়ারি ইন দ্য ওয়ার্ল্ড।
ছাপার অক্ষরে?
ছাপার অক্ষরে।
ইংরেজিতে?
ইংরেজিতে। গ্রন্থের নাম : ই পি গির ওয়াইল্ড লাইফ ইন ইন্ডিয়া। তাতে মানস নিয়ে একটা পুরো চ্যাপ্টার আছে। সেখানে রয়েছে। এত সুন্দর জায়গা! তোমার প্রকৃতি ভাল লাগে
দীপ্তি? (আজ আমারও যাচ্ছেতাই লাগে।)।
তুমি থাক তোমার ই পি–কী বললে যেন গি নিয়ে? আমি চললাম–এত বলে সে তার স্যুটকেস তুলে নেয়।
চটি গলাবার আগে খালি পায়ের চেটোর ওপর ভর দিয়ে সে একবার ঈষৎ লম্বা হয়ে আমার সামনে দাঁড়ায়। শিফনের সাদা প্রিন্ট শাড়ির মধ্যে দিয়ে দেখা যায় কালো ব্রেসিয়ার উদ্ধত স্তনের স্পর্ধা তার বোঁটাদুটি : রঙ করেছ। পারিশ্রমিক পেয়েছে। এখন এই স্তন, কটি, জঙ্খ, যোনিদেশ–এসব আমার।
বিয়ের মাত্র ৩ বছর ঘুরতে না ঘুরতেই, সেই প্রথম দীপ্তির সঙ্গে চোখে-চোখ কুৎসিত ঝগড়া। সেই প্রথম তার আমিত্বের ঘোষণা। আমি তার ঔদ্ধত্য দেখে স্তব্ধ। প্রস্তরীভূত। তার মধ্যে পর-স্ত্রী দর্শন, আমার সেই প্রথম।
দেন, গো টু হেল।
আমি পিছন থেকে তার পাছার উদ্দেশে বলি : আগুন যাকে পোড়াতে পারে না, অস্ত্র যাকে বিদ্ধ করতে পারে না তুমি কি সেই জিনিস?
আজ এমন ঘটনা ঘটলে বলি (মনে মনে), দেন, ফাঁক ইওরসেলফ।
মানসের একা বাইসন, সে বড় ভয়ঙ্কর। ই পি গির বইতে বারবার সতর্কীকরণ আছে। যে, যে-প্রাণভয়ে ভীত হয়ে সে ওভাবে পালাতে পারে, যে ভয় দেখায়, সেই একই অমিত প্রাণভয়ে সে তাকে আক্রমণও করে থাকে। সে যে কী করবে, পালাবে না গুঁতোবে, সেটা তার সম্পূর্ণ নিজস্ব ব্যাপার। অরণ্যে তার চেয়ে ভীরু ও দুর্বল প্রাণী নেই। এবং তার চেয়ে সাহসী ও শক্তিশালী প্রাণীও আর নেই।
আক্রমণ করার আগে, ই পি গি জানিয়েছেন, সে দুবার পিছন-পায়ের খুর আছড়ায়। পালাবার আগেও তাই করে। তার পলায়ন ও আক্রমণের ভঙ্গিমা একই। সে দুবার পিছনের পা আছড়ালে, তাই বাঘেও রিস্ক নেয় না। বোঝে না, সে পালাবে, না শিং নামিয়ে তেড়ে আসবে। বাঘ উভয়ত পালায়।
দীপ্তিকে কিছুকাল আগেও আমি মাঝে-মাঝেই বোঝাতাম, আচ্ছা,দীপু,এই যে দিবারাত্র এত খোঁচাখুঁচি কর, আঁ, সে কোন ভরসায়। আমি তো খাঁচার মধ্যে নেই। কিংবা, যদিই থাকি, যাকে তুমি খাঁচা বলে দেখছ, সেটা তো পাকাটিরও হতে পারে?
এত বলে আমি মানসের সেই ভীত বাইসনটির কথা না-ভেবে পারি না যে পা আছড়েছিল ঠিকই। কিন্তু সেবার ভয়ে।
এ সব তোমার মালের টেবিলের বন্ধুদের বোলো। হাতোলি পাবে।
খুব একটা ভুল বলে না দীপ্তি। আজ আর।
তার ভাষা নেই। তাই তার হয়ে উত্তরটা আমি আজ নিজেই নিজেকে দিয়ে থাকি।
ষাঁড় বটে। কিন্তু তুমি ভাই দাগা। ধর্মের। ঘুরে বেড়াচ্ছ কাশীতে।
রাঁঢ় ষাঁড় ঔর সিঁড়ি-সন্ন্যাসী
যব তক বাঁচে
তব তক কাশী।