০২. অ্যা পেক অব আউলস
কী বললেন? হ্যারি কিছু বুঝতে না পেরে বললো।
–ও চলে গেছে। মিসেস ফিগ দুঃখ ভারাক্রান্ত মুখে হাত কচলাতে কচলাতে বললেন–দেখতে গেছে ঝাড়ুর পেছনে কিছু কড়াই পড়ে আছে কিনা। আমি ওকে আগেই বলে দিয়েছিলাম কাজে গাফিলতি মোটেই আমি পছন্দ করি না। যদি সত্যি যায়, আমি ওর গায়ের চামড়া ছাড়াবো। এখন দেখ ডিমেন্টররা এসেছিল! ভাগ্য ভাল মি. টিলসকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম। এখানে আমাদের দাঁড়িয়ে থাকা চলবে না! চটপট আমায় তোমাকে নিয়ে যেতে হবে। উ. কি দারুণ ঝাটে ফেলে পালিয়েছে। আমি ওকে খুন করব।
কিন্তু, হ্যারি দারুন বিস্মিত, কেমন করে বিড়াল-প্রেমী প্রতিবেশী এই বৃদ্ধা ডিমেন্টসদের আবির্ভাব জানতে পারলো–আপনি… আপনি ডাইনি?
–না না ডাইনি হতে যাব কেন, আমি একজন ছুঁচো, মুন্ডানগাস ব্যাপারটা খুব ভাল করেই জানে। তাহলে বল আমি কেমন করে তোমাকে ডিমেন্টরদের সঙ্গে লড়াই করতে সাহায্য করতে পারি? আমি হাজারবার ওকে বলা সত্ত্বেও, তোমাকে কোনও রকম রক্ষার ব্যবস্থা না করেই জায়গা ছেড়ে পালিয়েছে।
–ওই মুন্ডানগাস আমার নজর রাখছে? চুলোয় যাক–ও তাহলে আমাদের বাড়ির সামনে থেকে ডিস অ্যাপারেট করে ভেগে গেছে?
-হ্যাঁ গো হা ঠিক ধরেছ। ভাগ্যিস আমি মি. টিব্বলসকে একটা গাড়ির নিচে থাকতে বলেছিলাম। মি. টিব্বলস আমাকে আগেই সতর্ক করে দিয়েছিল, কিন্তু তোমার বাড়িতে গিয়ে খবর দেবার আগেই তুমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। আজকের এই কাণ্ডকারখানা ডাম্বলডোর জানতে পারলে, কি বলবেন বলত? কথাটা বলার পর মাটিতে উবু হয়ে ডাডলিকে পড়ে থাকতে দেখে বললেন–এই কুমড়োপটাস ওঠ ওঠ ওঠ শিগগিরি।
হ্যারি মিসেস ফিগের দিকে তাকিয়ে বললো–ডাম্বলডোরকে আপনি জানেন?
–অবশ্যই, অবশ্যই কেন জানবো না–তাকে কে চেনে না জানে না বল। থাকগে এখন বাড়ি যাও দেখি, যেকোনও সময়ে ওরা আবার হানা দিতে পারে। ওরা এলে, আমিতো একটুও তোমাকে সাহায্য করতে পারবো না, আমি তো এখন জলে ভেজা টি ব্যাগ। কথাটা বলে মিসেস ফিগ ডাডলির দিকে ঝুঁকে বললেন ওঠো দেখি ষাঁড়ের গোবর!
কিন্তু ডাডলি না পারে উঠতে না পারে চলতে। ও মাটিতে যেমন ছিল তেমনভাবে শুয়ে রইল। থর থর করে কাঁপছে, ছাইয়ের মতো ফ্যাকাশে মুখে কে যেন তালা লাগিয়ে দিয়েছে।
–আমি ওকে তুলছি, হ্যারি অনেক কষ্টে ডাডলিকে দাঁড় করাল। ডাডলির অজ্ঞান হয়ে যাবার মত অবস্থা। ওর ছোট ছোট চোখ দুটো চোখের কোটরে ঘুরছে, আর দরদর করে ঘামছে। হ্যারি একটু আলগাভাবে ধরতেই ডাডলি ধপাস করে পড়ে গেল।
–নাও নাও আর ন্যাকামো করো না উঠে পড়, মিসেস ফিগ রেগে গিয়ে বললেন।
হ্যারি ডাডলির একটা মোটা হাত ধরে নিজের কাঁধের ওপর রেখে ওকে নিয়ে চলতে লাগল। ভারি শরীরটা একদিকে ঝুঁকে রইল। মিসেস ফিগ চারদিকে তাকাতে তাকাতে হাঁটতে লাগলেন।
তিনি হ্যারিকে বললেন–তোমার ম্যাজিক ওয়ান্ডটা ঠিক মত রাখ। ওই। অবস্থায় উহস্টরিয়া ওয়াকে পৌঁছল। এখন আর তোমাকে স্ট্যাটুট অফ সিক্রেসি মেনে চলতে হবে না। কম বয়সের জাদুকরদের অবশ্য কিছু ছাড় আছে, তাহলেও ডাম্বলডোর এই ভয়টা পাচ্ছিলেন। আরে রাস্তার শেষ প্রান্তে ওটা কী? ওহ, মি.. তোমার দণ্ডটা সরিয়ে রেখে বাছা, কতবার তোমায় মনে করিয়ে দিতে হবে? আমার কথা শুনছো।
একহাতে ম্যাজিক ওয়ান্ড ঠিক ভাবে ধরে থেকে অন্য হাতে স্তুলাকায় ডাডলিকে ধরে হাঁটা খুবই অসুবিধাজনক। হ্যারি ডাডলির পাজরে রেগেমেগে একটা খোঁচা দিল, কিন্তু ডাডলি কারও সাহায্য ছাড়া হাঁটার যেন ইচ্ছে নেই। ও রোগা পটকা হ্যারির কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে পা টেনে টেনে চলল। হ্যারি, মিসেস ফিগকে বললো–আমায়তো কখনও বলেননি আপনি জাদুকরী? হ্যারি তখন বিরাট বোঝা নিয়ে হাঁটার জন্য হাঁফাচ্ছে। আমি তো কতবার আপনার বাড়ি গেছি, ঘৃণাক্ষরেও আভাস দেননি, কেন?
ডাম্বলডোরের নির্দেশ, আমাকে সর্বদা তোমায় চোখে চোখে রাখতে বলেছেন, কিন্তু তোমাকে কিছু জানাতে বারণ করেছেন। আসলে তুমিতো বয়সে ছোট তাই কিছু জানো না। আমার বাড়িতে এসে তোমার মোটেই ভাল লাগত না আমি জানি। যদি আমার বাড়ি তোমার ভাল লাগে ডার্সলেরা জানতে পারে, তাহলে তোমাকে আমার বাড়ি কিছুতেই আসতে দেবে না, মিসেস ফিগ দুঃখ-দুঃখ কণ্ঠে বললেন, দুঃখে হাত কচলাতে লাগলেন। ডাম্বলডোর আজকের ঘটনা শুনলে… মুন্ডানগাস বুঝতে পারছি না কেন তোমাকে একলা ফেলে চলে গেল। মাঝরাত পর্যন্ত ওর ডিউটি ছিল, এখন ও গেছে কোথায়? বুঝতে পারছি না কেমন করে ডাম্বলডোরকে খবরটা পাঠাই। আমি তো আবার অ্যাপারেট করতে পারি না।
–আমার একটা পেঁচা আছে, তাকে দিয়ে খবর পাঠাতে পারেন। হাঁফাতে হাঁফাতে বললো–ডাডলির ভারে ওর শিরদাঁড়া ভেঙে যাবে না তো?
–হ্যারি, তুমি ঠিক গুরুত্বটা বুঝতে পারছে না। ডাম্বলডোর প্রয়োজনীয় কাজ কখনও ফেলে রাখেন না, যথা সম্ভব সময় নষ্ট না করে শেষ করেন। জাদু মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব পদ্ধতি আছে আন্ডার এজ ম্যাজিক খুঁজে বার করার। ওরা তোমার কাজকর্মের খবর যথা সময়ে ধরে ফেলেছে, কোনও সন্দেহ নেই, আমার কথার মানে বুঝতে নিশ্চয়ই পেরেছ।
ডিমন্টরদের হাত থেকে বাঁচতে আমাকে ম্যাজিক করতে হয়েছে। ওদের উইস্টেরিয়া ওয়ার্ক-এ অবাধে ঘুরে বেড়ান সম্বন্ধে আরও বেশি চিন্তিত হওয়া দরকার কী ছিল না?
–ওহ, তাই যদি হত তাহলে তো ভালই হতো। আমি তাই চাই। মুন্ডানগাস ফ্লেচার, আমি তোমাকে খুন করব।
ঠিক সেই সময় বেশ জোরে একটা কড়কড় শব্দ শোনা গেল। আশেপাশে মিষ্টি তামাকের গন্ধে মো মো করে উঠল। ওরা দেখল একটা ছেঁড়া-ফাটা জীর্ন ওভারকোট গায়ে দিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন, ওর মুখে খোঁচা খোচা দাড়ি, মাথায় লাল জট পড়া বড় বড় চুল, ফোলা ফোলা চোখ–অনেকটা বেদনাহত বেনেট হাউসের মত তার দৃষ্টি। ওর হাতে একটা রূপালী কাপড়ের পুঁটলি, হ্যারি ওটা দেখেই বুঝতে পারল অদৃশ্য হবার ক্লোক ছাড়া আর কিছু নয়।
-চুপ করবে, ফিগী? ও বললো একজন মিসেস ফিগ, হ্যারি আর ডাডলির দিকে তাকিয়ে।
গুপ্তভাবে থাকার ব্যাপারটা? মিসেস ফিগ রেগেমেগে বললেন, হ্যাঁ তার ব্যবস্থা করছি। ডিমেন্টররা আক্রমণ করেছিলো জানো, ছিচকে চোর!
ডিমেন্টর? মুন্ডানগাস যেন আকাশ থেকে পড়ল, বল কী ডিমেন্টর?
–হ্যাঁ এখানে। ফাঁকিবাজ… কোনও কাজ করার মুরোদ নেই, খালি জিনিসপত্র হাতাবার তাল।
–ঈশ্বর আমাকে অন্ধকার দাও, সকলের দিকে তাকিয়ে মুন্ডনগাস বিড়বিড় করে বললো, প্রভু আমাকে অন্ধ করে দাও।
-তুমি চোরাই মাল কিনতে কাজ ছেড়ে কেটে পড়েছিলে। পই পই করে তোমাকে চোরাই কলড্রন কিনতে মানা করিনি? বল আমি করিনি?
মুন্ডানগাস খুব অস্বস্তিতে পড়ল। তোতলাতে তোতলাতে বললো–আমি আ আ আমি–খু-খুইবই ভাল ব্যাবসার সুযোগ ছিল। মিসেস হাত তুললেন। হাতে ঝোলান তারের ব্যাগটার তারগুলো ঝন ঝন করে উঠল। মুন্ডানগাসকে আপাদমস্তক দেখলেন। ব্যাগটার ভেতরে রাখা জিনিসগুলোর শব্দ শুনে মনে হয় তাতে প্রচুর বেড়ালের খাদ্য ঠেসেছেন।
–যাও যাও আমার সামনে থেকে চলে যাও, ধূর্ত লোভি ধেড়ে বাদুর কোথাকার!
–হা, হা জানি ডাম্বলডোরের কানে কেউ না কেউ কথাটা তুলবে।
–হ্যাঁ তুলবেই। মিসেস ফিগ বেড়ালের খাবার ভর্তি থলেটা দোলাতে দোলাতে বললেন–সবচেয়ে ভাল হবে তুমি যদি নিজে গিয়ে তার কাছে গিয়ে বল, কেন তুমি ডিউটি থেকে কেটে পড়েছিলে, কেন তুমি বাচ্চা ছেলেটাকে সাহায্য করনি।
মুন্ডানগাস মাথা চুলকোতে চুলকোতে বললো–যাচ্ছি, যাচ্ছি আমি যাচ্ছি। মাথার চুলের জালটা ঠিক করে রাখ!
আরও একটা প্রচণ্ড শব্দ করে মুন্ডানগাস অদৃশ্য হয়ে গেল।
–আমি চাই ডাম্বলডোর ওর অপরাধের জন্য ওকে খুন করে ফেলুক। মিসেস ফিগ অসম্ভব রেগে গিয়ে বললেন–যাকগে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই, বাড়ি যেতে হবে।
প্রায় অচৈতন্য ডাডলিকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে হ্যারি চললো।
মিসেস ফিগ ওদের সঙ্গে যেতে যেতে বললেন–চল তোমাদের বাড়ি অব্দি পৌঁছে দিয়ে আসি। ভাগ্য ভাল ওদের সংখ্যা কম ছিল। না হলে কি কাণ্ডটা হত বলত। তোমাকে একলা তাদের সঙ্গে লড়াই করতে হতো, ওদিকে ডাম্বলডোর বলেছেন, তোমাকে যেমন করেই হোক ম্যাজিক করতে না দিতে, খুব ভাল কথা। এখন আর পড়া জলে চুমুক দিয়ে কোনও লাভ নেই।
–ওদের মধ্যে একটা বেড়ালও বসে আছে।
–তাহলে ডাম্বলডোরের লোকেরা আমার ওপর দৃষ্টি রাখছে? হ্যারি হাঁফাতে হাঁফাতে বললো।
মিসেস ফিগ বললেন–অবশ্যই চোখে চোখে রাখছেন। তুমি কী বলতে চাও গত জুন মাসের ঘটনার পর তোমাকে নিজের খুশিমত যা ইচ্ছে তাই করতে দেওয়া যায়। ঈশ্বর তুমি মহান। সকলে বলে তুমি অতি বুদ্ধিমান, ঠিক আছে, তাহলে এখন বাড়ি গিয়ে বসে থাক কেমন।
ওরা তখন চার নম্বর বাড়ির সামনে পৌঁছে গেছে।
মিসেস ফিগ বললেন–আমি আশা করছি কেউ না কেউ একটুও সময় নষ্ট না করে তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করবে।
হ্যারি তৎক্ষণাৎ বললো–এখন আপনি কি করবেন?
কি আর করব, সোজা বাড়ি যাব। নতুন কোনও আদেশের প্রতীক্ষা করতে হবে বাড়িতে তাই থাকতে হবে। শুভ রাত্রি। কথাগুলো বলে মিসেস ফিগ অন্ধকার রাস্তার দিকে তাকিয়ে সামান্য কাঁপা কাঁপা স্বরে বললেন।
–চুলোয় যাক নির্দেশ। আপনি এখন যাবেন না! আমাকে একটু খুলে বলুন। আমি সব ব্যাপারটা জানতে চাই।
কিন্তু মিসেস ফিগ কাঁধে বিরাট থলেটা ঝুলিয়ে দুলকি চালে তার বাড়ির দিকে আগেই রওনা দিয়েছেন। হ্যারি শুনতে পাচ্ছে মিসেস ফিগের তার দিয়ে বানানো থলের টিং টিং শব্দ।
–দাঁড়ান! হ্যারি চিৎকার করে মিসেস ফিগকে বললো। যারা প্রত্যক্ষভাবে জাদু স্কুলের হেডমাস্টার মি. ডাম্বলডোরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে, তাদের মুখ থেকে হ্যারির হাজার হাজার প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার আছে। কিন্তু কোথায় মিসেস ফিগ? তিনি তখন হ্যারির দৃষ্টির বাইরে চলে গেছে।
রেগেমেগে হ্যারি ডাডলিকে,ঠিকমত ঝুলিয়ে নেয়। তারপর ধীরে ধীরে চার নম্বর বাড়ির বাগানের পথ ধরে ডাডলিকে নিয়ে চলল। চার নম্বর প্রিভেট বাড়ির হলের বাতি জ্বলছে। হ্যারি ওর হাতের জাদুদণ্ডটা জীনসের কোমরব্যান্ডের পেছনে রেখে দিয়ে, দরজার পাশে ঘণ্টা বাজাল। তারপর ঢেউ খেলান কাঁচের পাল্লা দিয়ে আন্টি পেটুনিয়ার ত্যাড়াবেঁকা চেহারা দেখতে পেল। হ্যারির মনে হয় ডাডলির ভারি শরীরের চাপে ওর শরীরের সব হাড়গুলো ভেঙে চুরে গেছে। এক ইঞ্চিও নড়বার শক্তি ওর নেই।
–ডিড্ডি আজ তোমার এত দেরি কেন? আমি খুব চিন্তায়–ডিড়ি কি হয়েছে তোমার?
হ্যারি বাঁকা দৃষ্টিতে ডাডলিকে দেখে কাঁধ থেকে এক ঝটকায় ফেলে দিল। ডাডলি ভারসাম্য রক্ষা না করতে পেরে দুলতে লাগল। ওর মুখটা তখনও ভয়ে নীল হয়ে রয়েছে। তারপর ও মুখটা খুলতেই হড় হড় করে বমি করে ফেলল। বমি দরজার গোড়ায় পাপোশের ওপর পড়ল।
–ডিড্ডি! সোনা আমার? কী হয়েছে ভার্নন ও ভার্নন কোথায় গেলে তুমি? আন্টির কণ্ঠে উত্তেজনা ভয়ে মুখ বিবর্ণ।
আঙ্কল হন্তদন্ত হয়ে বসবার ঘর থেকে দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন। তার বিরাট গোঁফের দুই প্রান্ত দুলছে। আঙ্কল খুব বিচলিত হলে গোঁফের অবস্থা ওই রকম হয়। ভার্নন, আন্টি পেটুনিয়ার কাছে ছুটে এলেন। আন্টি পেটুনিয়া ডাডলিকে। তখন তুলতে ব্যস্ত। ডাডলি শুধু ঘরের মেঝেতে নয় নিজের টিশার্টে বমিতে ভাসিয়েছে।
ভার্নন ডাডলির বমি দেখে বললেন–ব্যাপার কী?
পেটুনিয়া বললেন–খুব অসুস্থ ভার্নন!
–কী হয়েছে তোমার বেটা? মিসেস পলকিস তোমাকে আজেবাজে বিদেশী চা খাইয়েছেন?
–তোমার শার্ট-প্যান্ট এত নোংরা কাদা মাখামাখি কেন? তুমি কী পা পিছলে কাদাতে পড়ে গিয়েছিলে?
–ড্যাম, তোমাকে কি কেউ মেরেছে, টাকা-পয়সা ছিনতাই করতে চেয়েছিল?
আন্টি পেটুনিয়া বিকট চিৎকার করে বললেন–পুলিশকে ফোন কর ভার্নন! সোনা আমার ডিড্ডি, মার সঙ্গে কথা বল! ওরা তোমায় কী করেছে?
ডাডলির অবস্থা ও তার বমি দেখে ভার্নন, পেটুনিয়া হ্যারির দিকে তখনও তাকাতে পারেননি। আঙ্কল ভার্নন সদর দরজাটা দড়াম করে বন্ধ করার সময় হ্যারি নিজের ঘরের দিকে এগোলো। ওরা ডাডলিকে ধরে ধরে করিডোর দিয়ে রান্নাঘরের দিকে নিয়ে চললেন। হ্যারি সিঁড়ির মুখে দাঁড়াল।
–বেটা কে তোমায় এমন অবস্থা করল? নাম বল–আমি তার বাবার নাম ভুলিয়ে দেব, ধরতে ঠিক পারব… তুমি কিছু ভেবো না সোনা আমার।
–স্যু ও… ও। ও কিছু বলতে চাইছে ভার্নন! ডিডিড সোনা মাকে বলবে না?
হ্যারি তখন সিঁড়ির শেষ ধাপে পৌঁছে গেছে। তখন ডাডলির গোঙানো কথা ওর কানে গেল।
–ও।
হ্যারি দাঁড়াল। মুখটা রাগে লাল হয়ে গেল। মনে হয় ফেটে যাবে।
এই ছেলেটা এদিকে এস।
হ্যারি রাগে থরথর করে কাঁপতে লাগল। তারপর ধীরে ধীরে ভার্নন-পেটুনিয়ার কাছে এসে দাঁড়াল।
পরিষ্কার ঝকঝক করছে রান্না ঘরটা। বাইরেটা অন্ধকার, তীব্র আলোতে ঘরটা চমকাচ্ছে। আন্টি পেটুনিয়া আদর করে ডাডলিকে ধরে ধরে চেয়ারে বসালেন। তখনও ওর ভয়ের ধোর কাটেনি। আঙ্কল ভার্নন সিংকের কাছে দাঁড়িয়েছিলেন। চোখ তার হ্যারির দিকে। গর্জন করে বললেন–ডাডলিকে তুমি কিছু করেছ?
–না, কিছু করিনি, হ্যারি বললো। কিন্তু ও খুব ভাল করেই জানে ভার্নন ওর কথা বিশ্বাস করবে না।
–ডিড্ডি সোনা, ও তোমাকে মেরেছে? আন্টি পেটুনিয়ার তখনও ভয় কাটেনি। কথাগুলো কাঁপা কাঁপা। ডাডলির লেদার জ্যাকেটের সামনে জমে থাকা বমি পরিষ্কার করতে করতে হ্যারির দিকে তাকিয়ে বললেন–ও কি সেই জিনিসটা ব্যবহার করেছে? খুব ধীরে ধীরে ডাডলি ঘাড় নাড়ল। তখনও ও কাপছে।
–না, না আমি ওটা ব্যবহার করিনি। হ্যারি জোর দিয়ে বললো। আন্টি পেটুনিয়া কাঁদতে শুরু করলেন। ভার্নন হ্যারিকে মারার জন্য হাত তুলতেই হ্যারি আবার বললো–আমি ওকে কিছু করিনি, অন্য কিছু…!
কিন্তু ঠিক সেই সময়ে একটা পেঁচা কর্কশ স্বরে ডাকতে ডাকতে কিচেনের জানালা দিয়ে ঢুকল। আরেকটু হলেই আঙ্কল ভার্ণননের মাথায় ওর ডানা লাগত। ঠোঁটে করে আনা বড় আকাকের পার্চমেন্ট বাম হ্যারির পায়ের তলায় ফেলে দিল। তারপর ঝটপট ফ্রিজের ওপর দিয়ে ডানা মেলে বাইরে বাগানের দিকে উড়ে চলে গেল। যাবার সময় ফ্রিজের ওপরটা ডানা দিয়ে যেন ঝাড়ু দিয়ে গেল।
–আবার পেঁচাটা! আঙ্কল ভার্নন গর্জন করে উঠলেন। কপালের মোটা মোটা শিরাগুলো উত্তেজনায় ফুলে উঠল। ভীষণ রেগে গিয়ে জানালাটা প্রবল জোরে বন্ধ করে দিল। আবার পেঁচাটা এসেছে! ভবিষ্যতে আমার বাড়িতে পেঁচা ঢুকলে ভাল হবে না বলে দিচ্ছি।
হ্যারি তখন খামের মুখটা খুলতে ব্যস্ত। মুখটা খুলে ও চিঠিটা টেনে বার করল। পড়তে পড়তে ওর গলার কণ্ঠ মণিটা ধ্বক ধ্বক করতে লাগল।
চিঠিটা এই রকম
প্রিয় মি. পটার
আমরা বিশ্বস্ত সূত্রে খবর পেয়েছি আজ রাত নটা বেজে তেইশ মিনিটের সময় মাগলরা যে অঞ্চলে
থাকে সেখানে একজন মাগলের উপস্থিতিতে তুমি জাদু মন্ত্র পেট্রোনিয়স উচ্চারণ করেছ। বয়:কনিষ্ঠ শিক্ষার্থীদের ওই জাদুমন্ত্র ব্যবহার করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। অতএব, তুমি অধিকার লঘনের অপরাধে অপরাধী
সাব্যস্ত হয়েছে ও তোমাকে হোর্টসের জাদু বিদ্যালয়ের আবাসিক ছাত্র হিসেবে বিদ্যালয়
থেকে বহিষ্কার করা হবে।
শিঘ্রই আমাদের একজন প্রতিনিধি তোমার আবাসস্থলে গিয়ে জাদুদণ্ডটি ধ্বংস করে দেবে।
আন্তর্জাতিক ওয়ারলকস স্ট্যাটুট অফ
সিক্রেসির ১৩ নং ধারা অনুযায়ী অতীতে একবার তোমাকে সতর্ক
করে দেওয়া হয়েছিল। তাই
আমরা অতি দুঃখের সঙ্গে তোমাকে জানাতে বাধ্য হচ্ছি যে, আগামী ১২ আগস্ট সকাল নটার সময়
জাদু মন্ত্রণালয়ের ডিসিপ্লিনারী হিয়ারিং কমিটির সামনে শুনানির জন্য তোমায় উপস্থিত থাকতে হবে।
আশাকরি তুমি ভাল আছ,
তোমার
বিশ্বস্ত,
মাফালডা পেকির্ক
অবৈধ জাদু ব্যবহার সম্পর্কিত জাদুদপ্তর
জাদু মন্ত্রণালয়।
হ্যারি চিঠিটা খুব মনোযোগ দিয়ে দুবার পড়ল। পড়ার সময় আঙ্কল ভার্নন ও আন্টি পেটুনিয়ার কোনও কথাই কানে ঢুকলো না। ওর মাথার ভেতরটা বরফের মত ঠাণ্ডা ও বোবা হয়ে গেছে। চিঠিতে পরিষ্কার করে জানানো হয়েছে হোগার্টস স্কুল থেকে বিতাড়ণের কথা। এখন আর কিছু করার নেই। আর সে ফিরে যাচ্ছে না হোগার্টসে।
ও প্রায় উন্মাদ রেগে টং আঙ্কল ভার্নননের লাল মুখের দিকে তাকাল। তখনও তার হাত মারবার জন্য উদ্যত। আন্টি পেটুনিয়া ডাডলিকে জড়িয়ে বসে রয়েছে। ডাডলি মাঝে মাঝে বমি করার জন্য ওয়াক ওয়াক করে চলেছে।
হ্যারির হতবম্ব হয়ে যাওয়া মস্তিষ্ক আবার চালু হয়ে গেল, মন্ত্রণালয়ের একজন প্রতিনিধি শিগগিরই তোমার আবাসস্থলে গিয়ে জাদুদণ্ডটি ধ্বংস করে দেবে। ওর কাছে এখন একটি পথ খোলা আছে–পলায়নের। কিন্তু কোথায় পালাবে? তবে একটা জিনিস সম্বন্ধে ও নিশ্চিত যে হোগার্টস হোক বা অন্য কোথাও হোক, জাদুদণ্ড তার চাই-ই।
অনেকটা স্বপ্নাচ্ছন্নের মত ও ম্যাজিক ওয়ান্ডটা টেনে নিয়ে রান্না ঘর ছেড়ে যাবার জন্য প্রস্তুত হল।
–কোথায় যাওয়া হচ্ছে? আঙ্কল ভার্নন গর্জন করে উঠলেন। হ্যারির কোনও জবাব না পেয়ে ভার্নন দৌড়ে রান্নাঘরের দরজা আটকে দাঁড়ালেন।
–তোমার সঙ্গে তো বোঝাপড়া শেষ হয়নি ছোকরা।
হ্যারি শান্ত স্বরে বললো, পথ ছাড়ুন।
–না কোথাও তোমায় যেতে দেব না, যতক্ষণ না কবুল করছ ডাডলির এই অবস্থার জন্য দায়ী কে।
–যদি দরজা থেকে সরে না যান তাহলে আপনার কপালে দুঃখ আছে আগেই বলে দিলাম। কথাটা বলে হ্যারি জাদুদণ্ডটা তুলে ধরল।
আঙ্কল ভার্নন ঘোঁত ঘোঁত করে বললেন–ওটা দিয়ে আমায় তুমি কিছু করতে পারবে না। আমি জানি ওই পাগলা গারদ যাকে তুমি স্কুল বল, সেখানে ছাড়া কোথাও ওটা ব্যবহার করতে পারবে না।
পাগলাগারদ আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে। আমি এখন এটা যেখানে খুশি সেখানে ব্যবহার করতে পারি। মাত্র তিন সেকেন্ড সময় দিচ্ছি, এক… দুই…।
হঠাৎ রান্নাঘরটা দারুণ এক শব্দে ঝন ঝন করে উঠল। আন্টি পেটুনিয়া ভীষণ জোরে চিৎকার করে উঠলেন। আঙ্কল ভার্নন চুপ করে গেলেন। এই নিয়ে তিনবার হ্যারি কোথা থেকে ভয়ঙ্কর শব্দটা আসছে জানার জন্য চিন্তা করতে লাগল। এধার ওধার তাকিয়ে হ্যারির চোখ পড়ল একটা জবুথবু পেঁচার ওপর। লক্ষীপেঁচাটা কাঁচের জানালাতে ধাক্কা খেয়ে নিঝুম হয়ে বসে আছে।
আঙ্কল ভার্ননের বিরক্তিকর গর্জন পেঁচা ভ্রূক্ষেপ না করে হ্যারি ঘরের মধ্যে ঢুকে জানালাটা খুলে দিল। পেঁচাটা তার একটা পা বাড়াল। দেখল একটা পার্চমেন্ট গুটিয়ে ওর পায়ে বাঁধা রয়েছে। চিঠি অবশ্যই! হ্যারি পা থেকে চিঠিটা খুলে নিল। হাত ওর কাঁপছে। হ্যারি দ্বিতীয় খবরটা পড়ার জন্য চিঠিটা খুলল। আঁকাবাঁকা, তাড়াহুড়ো করে ধ্যাবড়া ধ্যাবড়া করে কালো কালিতে লেখা।
হ্যারি, ডাম্বলডোর এই মাত্র মন্ত্রণালয়ে এসেছেন, চেষ্টা করছেন তোমার ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলতে। তুমি তোমার আঙ্কল ও আন্টের বাড়ি এখন ছাড়বে না। আর কোন জাদুও করবে না। তোমার ম্যাজিক ওয়ান্ড কারও কাছে দেবে না।
আর্থার উইসলি
অতি সুখবর! ডাম্বলডোর তাহলে গোলমালটা মিটিয়ে নেবার চেষ্টা করছেন। কিন্তু ডাম্বলডোরের জাদু মন্ত্রণালয়ের অর্ডার বাতিল করার ক্ষমতা কতটা আছে? তাহলে কি ও হোগার্টসে আবার ফিরে যাবার অধিকার পাবে? ক্ষীণ একটা আশা ওর মনে গজিয়ে উঠতে থাকে কিন্তু তৎক্ষণাৎ আতঙ্কে সেই আশা নির্মূল হয়ে গেল–যখন সেভাবে কেমন করে ও ম্যাজিক ওয়ার্ল্ড প্রতিনিধির হাতে তুলে দিতে অস্বীকার করবে। তখন জাদু মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধির সঙ্গে লড়াই করতে হবে, তাই যদি করে তাহলে আজকাবানে, আটক থাকা থেকেও বাঁচতে পারবে।
ওর মন তীব্র গতিতে দৌড়ায়, কী করবে ও। পালালেও পরে কিন্তু মন্ত্রণালয় ওকে ধরে ফেলতে পারে, নাকি ও এখানে ধরা দেয়ার জন্য অপেক্ষা করবে। প্রথম চিন্তা, পালানোটাই ওর কাছে উচিত মনে হয়। কিন্তু আবার ভাবলো, মি. উইসলির চিঠিট পড়ে মনে হয় উইসলি ওর ভাল চান, অন্তর থেকে ভাল চান, যাই হোক না কেন ডাম্বলডোর এর আগে ওর চাইতেও অনেক বেশি গোলমেলে ব্যাপার মিটিয়ে দিয়েছেন। এবারও নিশ্চয়ই করবেন।
–ঠিক আছে, হ্যারি বললো–আমি মত পরিবর্তন করেছি, আমি এখন এখানেই থাকছি।
ও কিচেন টেবিলের কাছে গিয়ে ডাডলি আর আন্টি পেটুনিয়ার মুখোমুখি দাঁড়াল। ডার্সলেরা হঠাৎ ওর মনের ভাব বদলাতে দেখে একটু অবাক হয়ে গেলেন। আন্টি পেটুনিয়া আঙ্কল ভার্ননের দিকে তাকালেন। ভার্ননের কপালের শিরাগুলি দপদপ করছে।
আঙ্কল বললেন–নোংরা পেঁচাগুলো এখানে কেন আসে? কে পাঠায়? হ্যারি শান্তভাবে বললো–প্রথমটা জাদু মন্ত্রণালয় পাঠিয়ে ছিলো আমাকে স্কুল থেকে বের করে দেওয়ার বিষয়ে। কিন্তু ও কান পেতে রইল মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি আসার অপেক্ষায়। যদি আসে তাহলে আঙ্কল ভার্ননের প্রশ্নের জবাব শান্তভাবে দিতে পারবে। তখন তার রাগ কমবে। দ্বিতীয়টা এসেছে আমার বন্ধু রনের বাবার কাছ থেকে। তিনি মন্ত্রণালয়ে কাজ করেন।
–জাদু মন্ত্রণালয়? আঙ্কল ভার্নন গর্জে উঠলেন–তোমার মত হতভাগা লোকগুলো সরকারে আছে তাই না? এই কারণেই দেশটা রসাতলে যাচ্ছে।
হ্যারির মুখে কোনও কথা না শুনে ভার্নন ওর দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে খ্যাক করে থুতু ফেলে বললো–জানতে পারি স্কুল থেকে কেন তোমায় বহিষ্কার করেছে?
–কারণ আমি জাদু করেছিলাম।
–বাঃ বাঃ চমৎকার! আঙ্কল আবার গর্জন করে উঠল। হাতটা ফ্রিজের ওপর রেখে দরজাটা খুলল। গাদা করে রাখা ডাডলির কম স্নেহপদার্থওয়ালা ফাস্ট ফুড ফ্রিজ থেকে মেঝেতে ছিটকে পড়লো, তাহলে তুমি অপরাধ কবুল করছ, তুমি ডাডলিকে কী করেছ?
–কিছু না। এবার গলার স্বর নরম নয়। যা ঘটেছে তার সঙ্গে আমি যুক্ত ছিলাম না।
–ছিলে। ডাডলি বিড়বিড় করে বললো।
ডাডলির কথা শুনে আঙ্কল-আন্টি দুজনেই হাত তুলে হ্যারিকে চুপ করে থাকার ইঙ্গিত দিলেন। ডাডলির দিকে ঝুঁকে পড়লেন। বল, বল সোনা আমার, বলে যাও ও কি করেছিল। আঙ্কল বললো।
পেটুনিয়া ফিস ফিস করে বললেন–লক্ষ্মী সোনা ছেলে আমার, বল।
ডাডলি ঘোলাটে চোখে অস্পষ্টভাবে বললো–আমার দিকে জাদুদণ্ড তাক করেছিল।
–হ্যাঁ করেছিলাম–চালু করিনি। রেগে টং হয়ে বললো–কিন্তু।
–এই চোপ! আঙ্কল ও আন্টি পেটুনিয়া ভার্নন দুজনেই একসঙ্গে বলে উঠলেন।
–বলে যাও বাছা আমার। আঙ্কল আবার সোহাগ করে বললো। ওর গোঁফ দুটো পত পত করতে লাগল।
ডাডলি কাঁপতে কাঁপতে বললো–সব কিছু অন্ধকার হয়ে গেল, তারপর আমি শুনলাম আমার ভেতরে জট পাকানো নানা কথার শব্দ।
আন্টির ভয়ে আঙ্কলের মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল। পরস্পরের মুখের দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকাল। পৃথিবীর মধ্যে তাদের সবচেয়ে অপছন্দ জাদু; আর সেই জাদুর কথা তারা এখন শুনছে আগ্রহ ভরে। তাদের আরেকটি অপছন্দ হলো, যখন প্রতিবেশীরা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মোটা হোস পাইপ দিয়ে বেশি পানি বাগানে দেয়।
–শব্দটা কি ধরনের বাবা, পপকিন? আন্টির গলা শুষ্ক, ফ্যাকাশে মুখ, দু চোখে জল।
কিন্তু ডাডলির কথা বলার শক্তি নেই। ও আবার কেঁপে কেঁপে উঠল। মাথার সোনালী চুলগুলো দুলে দুলে উঠল মাথা ঝাঁকুনি দেবার সাথে সাথে।
হ্যারি প্রথম পেঁচাটা চিঠি নিয়ে আসার পর থেকে মোটামুটি চুপচাপ, তাহলেও ডাডলির মুখ থেকে কিছু শোনার কৌতূহল হল–কাপুরুষ ডাডলি ডিমেন্টরদের মুখ থেকে কি শুনেছে?
–তা তুমি পড়ে গেলে কি করে বাবা? আঙ্কল ভার্নন অস্বাভাবিক শান্ত স্বরে বললেন। অনেকটা অতি অসুস্থ রোগীর পাশে বসে কথা বলার মত।
–হোঁচট খেয়েছি। ডাডলি ভয়ে ভয়ে বললো তারপর বুকে হাত ছোঁয়াল। হ্যারি বুঝতে পারল ডাডলি সেই ভয়ঙ্কর ঘটনা মনে করছে আঠাল স্যাঁত স্যাঁতে ঠাণ্ডা যা মানুষের মধ্যে থেকে সব আশা–আনন্দ চুষে নিয়ে বুকে পূর্ণ করে দেয়।
–অসম্ভব ভয়ঙ্কর এক শব্দ। দাঁড়কাকের মত স্বরে বললো ডাডলি ঠাণ্ডা, বলা যায় না এত ঠাণ্ডা। আঙ্কল ভার্নন বাধ্য হয়ে নরম শান্ত গলায় বললেন–বেশ বেশ ঠিক আছে। আন্টি পেটুনিয়া ডাডলির কপালে হাত ঠেকিয়ে জ্বর হয়েছে কিনা বোঝার চেষ্টা করলেন। তারপর কী হল ডাডলি সোনামনি আমার?
–মনে হলো… মনে হলো… যেন…. যেন…।
–জীবনে আর কখনও তুমি সুখী হতে পারবে না। হ্যারি শূন্যস্থান পূর্ণ করল।
-হ্যাঁ। ডাডলি জড়িত কণ্ঠে বললো। তখনও ওর ভয়ের কাঁপুনি থামেনি।
–বুঝলাম। আঙ্কল ভার্নন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন–তুমি মনে হয় ডাডলিকে অদ্ভুত ধারণা বয়ে বেড়াবার জাদু করেছ। ভাল কথা, ও এমন এক বিশ্বাসে অভিভূত যে সুস্থ জীবন, শান্ত সুন্দর জীবনের কথা ভাবতে পারছে না, ভাবছে সবকিছুই সর্বনাশ হয়ে গেছে।
–আর কতবার আপনাদের বলব আমি কিছু জানি না। সবই দুজন ডি-মে স্ট-রের কাণ্ড কারখানা।
–ওই ডিমেন্টর আজেবাজে বস্তুটি কি শুনি?
–ওরা জাদুকরদের জেলখানা, আজকাবানের পাহারাদার। আন্টি পেটুনিয়া বললো। খুব বেশি হবে তো মাত্র দু সেকেন্ড স্তম্ভিত হয়ে নীরব থেকে আন্টি পেটুনিয়া কথাটা বলে ঠোঁটে আঙ্গুল রাখলেন, যেন এক নিদ্রিত প্রতিজ্ঞাকে অসাবধানে জাগিয়ে দিয়েছেন। আঙ্কল ভার্নন একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন পেটুনিয়ার দিকে। হ্যারির মাথার ভেতরটা ঝিন ঝিন করে উঠল। মিসেস ফিগকে মোটামুটি বুঝতে পেরেছে; কিন্তু আন্টি পেটুনিয়া?
আঙ্কল ভার্নন আশ্চর্য হয়ে বললো–তা তুমি জানলে কেমন করে? আন্টি পেটুনিয়া ভার্ননের মুখের দিকে আতঙ্কিত হয়ে তাকাল, অনেকটা ক্ষমা প্রার্থনার দৃষ্টিতে। তারপর এবড়ো-থেবড়ো দাঁতগুলো ঢাকতে মুখে হাত চাপা দিল।
–আমি ওই অদ্ভুত ছেলেটাকে, বছর খানেক আগে, ওর মাকে বলতে শুনেছি। আন্টি পেটুনিয়া ঝাঁকি দিয়ে বললো।
–তুমি যদি আমার মা-বাবার প্রসঙ্গ তোলই, তাহলে তাদের নাম বলছ না কেন? হ্যারি বেশ জোরে কথাটা বললো, কিন্তু পেটুনিয়া ওর কথায় কান দিলো না। মনে হয় খুব হকচকিয়ে গেছে।
হ্যারি দারুণ হতভম্ব হয়ে গেছে। বছর খানেক আগে একবার মাত্র আন্টি পেটুনিয়াকে তীক্ষ্ম আর্তনাদ করে বলতে শুনেছে ওর মা নাকি অস্বাভাবিক অদ্ভুত হিল। আর কখনও তার বোনের কথা (হ্যারির মা) উচ্চারণ করতে শোনেনি। হ্যারি আরও আশ্চর্য হয় ক্ষুদ্র বিষয়টি এতদিন ধরে মনে রেখেছে, যদিও ও ভান করে এসব বিষয়ে কিছুই জানেন না।
আৰুল ভার্নন বিস্ময়ে বেশ উত্তেজিত, কখনও মুখ খোলেন কখনও বা বন্ধ করেন। অবশেষে কথা বললেন–তাহলে, তাহলে ওরা এখনও আছে পৃথিবীতে? কি যেন বলে… বিকৃত মস্তিষ্ক?
আন্টি পেটুনিয়া ঘাড় নাড়লেন।
আঙ্কল ভার্নন পালাক্রমে ডাডলি, পেটুনিয়া আর হ্যারির দিকে তাকালেন।
যেন ওদের মধ্যে কেউ এপ্রিল ফুল বলে উঠবে।
কিন্তু কেউ মুখ না খুললেও ভার্নন মুখ খুললেন। তৃতীয়বার পেঁচা ঘরে আসার পর কি বলবে ঠিক করে উঠতে পারে না।
পেঁচাটা খোলা জানালা দিয়ে অনেকটা পালকের কামানের গোলার মত ফটফট শব্দ করতে করতে রান্না ঘরের টেবিলে বসল। ওকে দেখে তিনজনই আতঙ্কে লাফ দিয়ে উঠল।
হ্যারি দ্বিতীয় অফিসিয়াল পেঁচার ঠোঁট থেকে চিঠি নিয়ে খুলল। পেঁচাটা উড়ে গেল রাতের অন্ধকারে।
আঙ্কল ভার্নন বললো–আবার পেঁচা এসেছে। কথাটা বলে জানালার কাছে গিয়ে জানালার দুটো পাল্লা শব্দ করে বন্ধ করে দিলেন।
প্রিয় পটার,
প্রায় বাইশ মিনিট আগের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে তোমাকে জানান
হচ্ছে জাদু মন্ত্রণালয় তাদের নির্ণয় পুনরায় বিবেচনা করেছে। তোমাকে ম্যাজিক
ওয়ান্ড এখনই ধ্বংস করতে হবে না।
১২ই আগস্ট কমিটির শুনানি শেষ না হওয়া পর্যন্ত তোমার ম্যাজিক
ওয়ান্ড কাছে রাখতে পার।
সেইদিনই অফিসিয়াল সিদ্ধান্ত নেবার সম্ভাবনা আছে।
হোগার্টস জাদু
শিক্ষা বিদ্যালয়ের হেড মাস্টারের সঙ্গে আলাপ আলোচনার পর ঠিক হয়েছে মন্ত্রণালয় তোমাকে স্কুল থেকে বহিষ্কার সংক্রান্ত আদেশ ওই দিনের সিদ্ধান্ত পর্যন্ত স্থগিত
থাকবে। পরবর্তী সিদ্ধান্ত
পর্যন্ত তোমাকে স্কুল থেকে সাসপেন্ড করা হল।
শুভেচ্ছাসহ
তোমার
বিশ্বস্ত
মাফলডা হফকার্ক
অবৈধ জাদু ব্যবহার সম্পর্কিত জাদু দপ্তর
জাদু মন্ত্রণালয়
হ্যারি দম বন্ধ করে অন্তত বার তিনেক চিঠিটার আদ্যপ্রান্ত পড়ল। বুকের মধ্যে যে হতাশার গ্রন্থী ছিল সেটা সামান্য শিথিল হল। আপাতত বহিষ্কার হচ্ছে না। তাহলেও ভয় মনের মধ্যে দানা বেঁধে রইল। সবকিছুই ঝুলে রইল বারই আগস্টের শুনানির ওপর।
–ভাল কথা, ভার্নন বললো। হ্যারিকে বললেন–তাহলে কী করবে এখন? তোমাকে শাস্তি দিয়েছে? তোমার ভাগ্যে কী মৃত্যুদণ্ড ঝুলছে?
–আমাকে শুনানির জন্য উপস্থিত থাকতে হবে, হ্যারি বললো।
–তারপর সেখানেই তোমাকে দণ্ডাদেশ দেবে?
–আমার তো তাই মনে হয়।
আঙ্কল ভার্নন অতি বিশ্রীভাবে বললেন–আমি আশা ছাড়ছি না, তাহলে।
–বেশ, তাহলে আপনাদের কথা শেষ হয়েছে? হ্যারি উঠে দাঁড়াল। ও এখন সম্পূর্ণ একা থাকতে চায়, ভাবতে চায় রন, হারমিনিওয়ন অথবা সিরিয়সকে একটা চিঠি পাঠানোর কথা ভাবতে লাগলেন।
–না, এখানেই শেষ নয়, আঙ্কল ভার্নন গর্জন করে ওঠেন–যেও না এখানেই বসে থাক!
হ্যারি অধৈৰ্য্য হয়ে বললো–এখন বসে থাকতে হবে কেন?
ডাডলি! আঙ্কল ভার্নন চীৎকার করে বললেন–আমি জানতে চাই ঠিক কি হয়েছিল।
–চমৎকার, হ্যারি জোর দিয়ে বললো। ওর হাতের জাদুদণ্ড থেকে লাল, সোনালী স্ফুলিঙ্গ বিচ্ছুরিত হতে লাগল।
ডার্সলি পরিবারের তিনজনই ভীষণ ভয় পেয়ে গেল, মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল উৎকণ্ঠায় আতঙ্কে!
ডাডলি আর আমি ম্যাগনোলিয়া ক্রিসেন্ট আর ওইস্টেরিয়া ওয়াকের মাঝখানে কানাগলিতে দাঁড়িয়েছিলাম, হ্যারি খুব দ্রুত বলতে লাগল, অনেক কষ্টে মনের রাগ চেপে, ডাডলি ভেবেছিল আমাকে একা পেয়ে মারধোর করবে। আমি তাই ম্যাজিক ওয়ান্ড বার করেছিলাম, কিন্তু ব্যবহার করিনি। তারপর দুজন ডিমেন্টর হঠাৎ সেখানে এসে পড়ে।
আঙ্কল ভার্নন রাগে ফেটে পড়ে বললেন–ডিমেন্টইডস কারা? তাদের কাজ কী?
হ্যারি বললো–আগেই বলেছি তাদের কাজ অন্যদের সুখ-আনন্দ চুষে বার করা। যদি সুযোগ পায় তো তারা মুখে মুখ লাগিয়ে চুম্বন করে। সুখ শান্তি চুষে নেয়।
–চুম্বন করে সুখ শান্তি চোষে? আঙ্কল ভার্নন চোখ সামান্য গোল গোল করে বললেন–রক্তচোষা?
–আপনার মুখে মুখ লাগিয়ে যখন আপনাকে আত্মাহীন করে ফেলে, তখন তাদের কি বলা চলে?
কথাটা শুনে পিটুনিয়া সামান্য শিউরে ওঠেন।
–ওর আত্মাতো…? না তারা তো নেয়নি, এখনও ওর ভেতরে আছে।
পেটুনিয়া ডাডলিকে সভয়ে আঁকড়ে ধরলেন। বুকে কান রেখে বুঝতে চেষ্টা করলেন ডাডলির শরীরে আত্মা আছে কি নেই।
–ডাডলিকে দেখে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন ওরা ওটা নিতে পারেনি। হ্যারি রাগত স্বরে বললো।
–ওদের মেরে ভাগিয়েছো তাই বল না কেন ডাডলি? আঙ্কল ভার্নন উচ্চস্বরে বললেন–নিশ্চয়ই তোমার বক্সিং-এর এক-দুই পাঞ্চ করেছ, করতে পারনি?
–ডিমন্টেটরদের কেউ তা করতে পারে না, হ্যারি দাঁত কিড়মিড় করে বললো।
–তাহলে এখনও ঠিক আছে কেন? এখনও দেহে আত্মা আছে কেন? ফাঁকা হয়ে যায়নি কেন? আঙ্কল ভার্নন তর্জন-গর্জন করে বললেন।
–কারণ আমি পেট্রোনাস ব্যবহার করেছিলাম।
হুস শব্দ করে, ডানা উড়িয়ে, সামান্য ধূলো ছটিয়ে চতুর্থ পেঁচাটা রান্না ঘরের ফায়ার প্লেস থেকে বেরিয়ে এল।
ঈশ্বরের দোহাই। আঙ্কল ভার্নন গর্জে উঠলেন গোফের শেষ প্রান্ত থেকে কয়েকগাছা চুল ছিঁড়ে (আগে কখনও করেনি) বললেন–আমি কিছুতেই আমার বাড়িতে পেঁচা ঢুকতে দেবো না। বলেছিলাম একটুও বরদাস্ত করবো না, আমি তোমাকে বলছি।
হ্যারি তার আগেই পেঁচার পায়ের সঙ্গে বাধা রোল করা পার্চমেন্টের খামটা খুলে নিয়েছে। ও নিশ্চিত চিঠিটা অবশ্যই এসেছে ডাম্বলডোরের কাছ থেকে। চিঠিতে তিনি ডিমেন্টরস, মিসেস ফিগ, মন্ত্রণালয় কি ভাবছে ও করবে, তিনি কি ভাবছেন, কি করতে চান এইসব জানিয়েছেন। কিন্তু জীবনে এই প্রথম সিরিয়সের হাতের লেখা দেখে হতাশ হল। আঙ্কল ভার্ননের রাগ, বিরক্তি পেঁচার প্রতি বিতৃষ্ণা ইত্যাদি উপেক্ষা করে হ্যারি সিরিয়সের পাঠান খবর পড়ল
আর্থার আমাকে সব ঘটনা জানিয়েছে। যাই হোক না কেন তুমি ওই বাড়ি ছেড়ে এখন যাবে না।
হ্যারি ভাবল চিঠিটার পেছনের পাতায় আরও কিছু লেখা থাকতে পারে। কিন্তু পাতাটা উল্টে খুবই হতাশায় ভেঙে পড়ল। কিছুই নেই।
আবার হ্যারির রাগ চড়তে থাকে। কেউ বলছে না কেন, তুমি দু দুটো ডিমেন্টরদের একা হাতে লড়ে হারিয়ে দিয়েছ, দারুণ কাজ করেছ? সিরিয়স, উইসলি এমন ভাব দেখাচ্ছে যে ও দারুণ অপরাধ করেছে, চুপচাপ রয়েছে কতটা ক্ষতি হয়েছে তা জানার প্রতীক্ষায়।
আবার একটা পেঁচা, মানে একগাদা পেঁচা আমার বাড়িতে আসছে যাচ্ছে। আমি মোটেই বরদাস্ত করবো না বলে দিলাম ছোকরা। কিছুতেই না।
–আমি তো ওদের আসা-যাওয়া বন্ধ করতে পারি না, হ্যারি সিরিয়সের পাঠানো চিঠিটা হাতের মুঠোতে মুচড়োতে মুচড়োতে বললো।
–আমি জানতে চাই আজ রাতের সত্য ঘটনা–আঙ্কল ভার্নন ঘেউ ঘেউ করে উঠলেন–যদি ওরা ডিমেন্টর হয় তাহলে কে ডাডলিকে মেরেছে, তোমায় তার জন্য স্কুল থেকে কেন তাড়িয়ে দিল? তুমি সব ভাল করেই সত্য মিথ্যা জান, একটু আগে স্বীকার করেছ। তাই না?
হ্যারি বড় করে একটা শ্বাস নেয়। ওর মাথায় অসম্ভব যন্ত্রণা শুরু হয়েছে ও যেন রান্না ঘরে এক মুহূর্ত থাকতে পারছে না। অন্ততঃ ডার্সলেদের সামনে।
ডিমেন্টরদের হাত থেকে বাঁচার জন্য যাদু মন্ত্র পেট্রোনাম ব্যবহার করেছিলাম। ওই একটি অস্ত্র ওদের কাবু করতে পারে। হ্যারি বাধ্য হয়ে বললো চুপ করে না থেকে।
–কিন্তু ছোকরা ডিমেন্টইডস লিটিল হুইংগ গিংগে করতে এসেছিল? আঙ্কল ভার্নন রাগত স্বরে বললেন।
হ্যারি বললো–বলতে পারি না, আমার কোনও ধারণা নেই।
তীব্র আলোক রশ্মি চোখে পড়ে হ্যারির মাথাটা দপদপ করছিল। ওর রাগ একটু একটু কমে যাচ্ছে। ও ভীষণ ক্লান্ত, ডার্সলে দম্পতি ও ডাডলি ওর দিকে তাকিয়ে রইল।
–সবই তোমার কারসাজি, ভার্নন বললেন জোরের সঙ্গে, ছোকরা আমাকে লুকোতে যেও না, আমি জানি। বলতে পারি ওরা কেন ওখানে গিয়েছিল? ওদের কানাগলিতে কি কাজ ছিল? তুমিই ছিলে। ভার্নন জাদুকর শব্দটা ব্যবহার করলেন না।
–আমি জানি না কেন ওরা এসেছিল।
আঙ্কল ভার্ননের বার বার একই কথার খেচানিতে হ্যারির ক্লান্ত মস্তিষ্ক আবার কর্মতৎপর হয়ে গেল। সত্যিতো ডিমেন্টররা লিটিল হুইংইংতে কেন এসেছিল? হ্যারির জন্য কি এসেছিল? ওদের কি কেউ পাঠিয়েছিল? জাদু মন্ত্রণালয় কী ডিমন্টসদের গতিবিধি রুখবার ক্ষমতা হারিয়েছে? ওরা কী আজকাবান থেকে পালিয়ে এসে ভোল্ডেমর্টের সঙ্গে যোগ দিয়েছে? ডাম্বলডোর অনেক আগেই সূচনা দিয়েছিলেন যে ওরা এইসব করবে।
আঙ্কল ভার্নন জিজ্ঞেস করলেন–ওই ডিমেন্টরেরা কি কতগুলো প্রায় উন্মাদ বিকৃত মস্তিষ্কের লোকজনের জেলখানা পাহারা দেয়?
–হা, হ্যারি বললো।
ওর মন চাইছে আঙ্কল-আন্টের রান্নাঘর থেকে চলে গিয়ে ওর অন্ধকার শোবার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে চিন্তা করে।
–ও, হো হো ওরা আসছে তোমাকে গ্রেফতার করতে; আঙ্কল ভার্নন এমনভাবে বললেন যেন জটিল এক সমস্যার সমাধানের সূত্র পেয়ে গেছেন। -বুঝলে ছোকরা যেমন কর্ম তেমনি ফল, আইনের জালে ধরা পড়েছ।
–অবশ্যই না হ্যারি, মাছি তাড়াবার মত মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে বললো। কি করবে সেই কথা ভাবতে থাকে হ্যারি।
তাহলে কেন?
লর্ড ভোল্ডেমর্ট নিঃসন্দেহে তাদের পাঠিয়েছিল; হ্যারি এমনভাবে বললো যেন নিজেকে বললো, ভার্ননকে নয়।
–সে কে? কে ওদের পাঠিয়েছিল?
–বললোম তো লর্ড ডোন্ডেমর্ট…।
হ্যারি একটু আশ্চর্য হয়ে গেল ভার্সলেদের ভোল্ডেমর্ট সম্বন্ধে অজ্ঞতা জেনে। অথচ ওরা জাদুকর, জাদু অথবা জাদুদরে নাম শুনলে ভয় পায়, সঙ্কুচিত হয়, চিৎকার করে ওঠে, অথচ সবচাইতে মারাত্মক ক্ষতিকর অশুভ জাদুকরের নাম জানে না, ভয় পায় না।
–লর্ড নিপাত যাক, ভার্নন বললো–ওর মুখটা বিকৃত হল, শুয়োরের মত ছোট ছোট চোখের দৃষ্টি হ্যারির কথা উপলব্ধি করার চেষ্টা করে।
. ও হ্যাঁ, ওর নাম শুনেছি, ওই লোকটাই তো…।
–আমার বাবা–মাকে খুন করেছেন; হ্যারি নীরসভাবে বললো।
–কিন্তু শুনেছি লোকটা নেই; আঙ্কল ভার্নন অধৈর্য সহকারে বললেন–এমন ভাবে বললেন যে বাবা-মার মৃত্যুটা হ্যারির কিছু দুঃখজনক, যন্ত্রণাদায়ক নয়। সকলে বলে সেই দৈত্যের মত লোকটাতো পালিয়েছে।
–ফিরে এসেছেন। হ্যারি গম্ভীর হয়ে বললো।
আন্টি পেটুনিয়ার ঝকঝকে তকতকে রান্না ঘরে, দামি ফ্রিজ আর বিরাট স্কিনের টিভির সামনে বসে শান্তভাবে আঙ্কল ভার্ননের সঙ্গে লর্ড ভোল্টেমর্টের সম্বন্ধে আলোচনা করা ওর খুব অদ্ভুত দুঃখজনক মনে হল।
হ্যারির জীবনের সবকিছু যেন ওলোটপালট হয়ে গেছে, ডার্সলেরা বিশদভাবে জানতে চাইছে জাদু পৃথিবীর সবকিছু, মিসেস ফিগের সঙ্গে এলবাস ডাম্বলডরের পরিচয়, ডিমেন্টরসরা লিটিল হুইংগগিংর আশেপাশে দাপাদাপি, হোগওয়ার্টসে ও আর হয়ত ফিরে যেতে পারবে না। আরও অনেক কিছু।
হ্যারির মাথার ভেতরটা আরও বেশি দপ দপ করতে থাকে।
–ফিরে এসেছে? আন্টি পেটুনিয়া ফিস ফিস করে প্রশ্ন করেন।
অদ্ভুতভাবে হ্যারির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। এর আগে কখনও এমনভাবে তাকাননি। জীবনে এই প্রথম হ্যারি মেনে নেয় পেটুনিয়া ওর মায়ের আপন বোন। ও বুঝতে পারে না হঠাৎ কেন পিটুনিয়ার সঙ্গে তার সম্পর্কটা ভীষণভাবে মনে আঘাত করে। এইটুকু বুঝতে ও একা নয় ঘরের মধ্যে যারা রয়েছে তারা সবাই জানে লর্ড ভোল্টেমর্টের পুনরায় ফিরে আসাটার মানেটা কী। আন্টি পেটুনিয়া এর আগে কখনই ওর বড় বড় বিষণ্ণ দুই চোখ (মায়ের মত নয়) আর যেন অপছন্দের দৃষ্টি বহন করছে না, রাগ নেই। হ্যারির জীবনে আন্টি পেটুনিয়া যে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য দেখিয়ে এসেছেন তা সত্য নয়। তার মধ্যে কোনও ম্যাজিক নেই এবং যে পৃথিবীতে তিনি আঙ্কলের সঙ্গে অতিবাহিত করছেন সেটা অনেক দূরে চলে গেছে।
–হ্যাঁ, হ্যারি বললো সোজা আন্টি পেটুনিয়ার দিকে তাকিয়ে, মাসখানেক আগে উনি ফিরে এসেছেন। আমি দেখেছি। পেটুনিয়া ডাডলির কাদামাখা বিরাট কাঁধটা চেপে ধরে রইলেন।
–চুলোয় যাক, আঙ্কল ভার্নন বললেন। কথাটা বলার সময় হ্যারি, পেটুনিয়ার দিকে তাকাল। ভার্ণননের মুখ দেখে মনে হলো পেটুনিয়া আর হ্যারির অভাবনীয় পরস্পরের প্রতি বোঝাপড়া ওকে বিশেষভাবে বিভ্রান্ত ও হতবুদ্ধি করেছে। চুলোয় যাক তুমি বলছ ওই লর্ড ভোল্ডেমর্ট ফিরে এসেছে।
–হ্যাঁ তাই বলছি, হ্যারি বললো।
–এখনও ডিমেন্টরস তোমার ক্ষতি করার জন্য পাঠাচ্ছে?
–তাই তো মনে হয়; হ্যারি বললো।
–ও আচ্ছা, আঙ্কল ভার্নন পেটুনিয়া আর হ্যারির দিকে তাকিয়ে ঝুলে পড়া প্যান্টটা টেনে তুলতে তুলতে বললেন। পেটুনিয়ার মুখটা তখন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।
–ছোকরা এখন তুমি আমাদের বাড়ি থেকে বিদেয় হও।
–কী বললেন? হ্যারি বললো।
–ভাল করেই তুমি আমার কথা শুনতে পেয়েছ–বিদায় হও। এমনভাবে গর্জে উঠে ভার্নন হ্যারিকে বললেন, শুনে ডাডলি, পেটুনিয়া দুজনেই চমকে উঠল। এক বছর আগেই তোমাকে তাড়িয়ে দেওয়া দরকার ছিল বিদায় হও! বিদায় হও। কি মনে করেছে তোমার পেঁচা? আমার বাড়িটা যেন তাদের রেস্ট হাউজ। সারা বাড়িটা নোংরা করে তুলেছে, ডাডলিকে তাড়া করছে, ঘরের সিলিং-এ ঝুলছে ফ্লাইং ফোর্ড অ্যাঞ্জলিয়া… ভাগো! ভাগো! এখান থেকে। তোমার জন্য আমাদের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তুমি এখানে থাকলে ডাডলি, আমার স্ত্রী দুজনেই নিরাপদ নয়, আমাদের অতিষ্ঠ করে তুলেছে, নানা ঝঞ্ঝাট পোয়াতে হচ্ছে। তোমার অকর্মন্য বাবা-মার পথ ধরে চলেছ, অনেক সহ্য করেছি! কেটে পড়।
হ্যারি শক্ত পায়ে দাঁড়িয়ে রইল। বাঁ হাতের মুঠোর মধ্যে মন্ত্রণালয়ের মি. ওয়েসলের আর সিরিয়সের চিঠি দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। যাই করো না কেন খবরদার এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবে না, আঙ্কল–আন্টের বাড়ি ছাড়বে না।
–কী হে ছোকরা আমার কথা শুনতে পাওনি! হ্যারির মুখের কাছে ওর বিরাট মুখটা এনে ভার্নন বললেন। আসলে ওর থুতু ফেলতে চেয়েছিলেন। তোমার আধঘণ্টা আগেই এ বাড়ি ছেড়ে যাওয়া উচিত ছিল। ভালয় ভালয় এখান থেকে চলে যাও। ভবিষ্যতে আমার বাড়ির দরজার গোড়ায় পা রাখার চেষ্টা করবে না। আমরা তোমার ভাল চেয়েছিলাম, তোমাকে শুধরোবার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু এখন দেখছি সবই ব্যর্থ। তুমি জন্ম থেকেই গোল্লায় গিয়েছে, উঃ… আর সহ্য হয় না, আবার পেঁচা! পাঁচ নম্বর পেঁচাটা চিমনীর গর্ত থেকে সজোরে মেঝেতে এসে পড়ে ভীষণভাবে কা কা করে উঠল।
পেঁচাটা মেঝেতে পড়ার আগে আন্টি পেটুনিয়ার মাথার ওপর টুক করে গোলাপী রঙ-এর খামটা ফেলে দিয়েছে। পেটুনিয়া সভয়ে আঁতকে উঠে দুহাতে মুখ ঢাকতেই হ্যারি চিঠিটা হাত বাড়িয়ে তুলে নেবার আগেই আন্টি বাধা দিলেন।
–ইচ্ছে হলে চিঠিটা আপনি পড়তে পারেন, হ্যারি বললো। কিন্তু চিঠিতে কি লেখা আছে আমার জানা দরকার। মনে হয় হাউলারের!
–খুলো না, ফেলে দাও; ভার্নন গর্জন করে উঠলেন। হাত লাগিও না, মারাত্মক কিছু হতে পারে!
আন্টি পেটুনিয়া ভয় মিশ্রিত কাপা কাঁপা গলায় বললেন। খামে দেখছি আমার নাম-ঠিকানা লেখা। ভার্নন তুমি দেখ!
পেটুনিয়া হাতে ধরা গোলাপী খামটার ভেতর থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে।
হ্যারি জোর দিয়ে বললো, দেরি করবেন না, চটপট খুলে ফেলুন। যা হবার তা হবেই।
–না।
পেটুনিয়ার হাত কাঁপছে। রান্নাঘরের চারদিকে তাকালেন পালাবার পথ খুঁজছেন; কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে। খামটা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। আন্টি পেটুনিয়া আঁতকে উঠে জলন্ত খামটা ফেলে দিলেন।
অদ্ভুত, ভীষণ বীভৎস গলার স্বর ঘরটা ভরিয়ে দিল, প্রতিধ্বনিত হতে লাগল সারা ঘরে। স্বরটা যেন টেবিলে রাখা জ্বলন্ত খাম থেকে বেরিয়ে আসছে।
আমার শেষ কথাটা মনে রেখ পেটুনিয়া
আন্টি পেটুনিয়া যেন জ্ঞান হারাবে, ধপ করে ডাডলির পাশে দুহাতে মুখ ঢেকে বসে পড়লেন। নিমেষে খামের বাকি অংশ পুড়ে শেষ হয়ে গেল। সকলেই নীরবে সেইদিকে তাকিয়ে রইল।
আঙ্কল ভার্নন কর্কশ গলায় বললো–এসবের মানে কী? পেটুনিয়া, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
আন্টি পেটুনিয়া সে কথার কোনও জবাব দিলেন না। ডাডলি বোকার মত মার মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে রইল। নিঃস্তব্ধতা বীভৎস্যভাবে সাপের মত পেঁচিয়ে রইল ঘরে। হ্যারি হতবুদ্ধি হয়ে আন্টির দিকে তাকিয়ে থাকে। ওর মাথার ভেতরটা। যেন যন্ত্রণায় ফেটে পড়বে।
আঙ্কল ভার্নন সোহাগের সুরে বললেন–পে… পেটুনিয়া কী হয়েছে? পেটুনিয়া ধীরে ধীরে মাথা তুলল। তখনও তার কাঁপুনি থামেনি। বার বার ঢোক গিলতে লাগলেন।
–হ্যারি কোথাও যাবে না। এখানেই থাকবে ভার্নন, পেটুনিয়া দূর্বল কণ্ঠে বললেন।
–কী? কী বললে?
–ও থাকবে হ্যারির দিকে না তাকিয়ে পেটুনিয়া বললেন।
–ও, কিন্তু পেটুনিয়া।
পেটুনিয়া বললেন–ওকে তাড়িয়ে দিলে পাড়া-প্রতিবেশীরা, পাঁচজনে পাঁচ কথা বলবে। পেটুনিয়া একটু একটু করে ধাতস্থ হচ্ছে।
–তাহলেও অত্যন্ত বিদঘুঁটে সব প্রশ্ন করবে কোথায় গেছে জানতে চাইবে। না ওকে আমাদের কাছে রাখতেই হবে।
আঙ্কল ভার্নন ফেটে যাওয়া টায়ারের মত চুপসে গেলেন।
–কিন্তু পেটুনিয়া।
পেটুনিয়া ভার্ননের দিকে তাকালেন না, কথার ভ্রূক্ষেপও করলেন না।
হ্যারির দিকে তাকিয়ে বললেন–তোমার ঘরে তুমি থাকবে, এই বাড়ি ছেড়ে তুমি নড়বে না। যাও অনেক রাত হল শুয়ে পড়গে।
হ্যারি দাঁড়িয়ে রইল।
হাউলার কে? কোথায়?
আন্টি পেটুনিয়া বাধা দিয়ে বললেন–প্রশ্ন করবে না।
–আপনি কী জাদুকরদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন?
–আমি তোমাকে শুতে যেতে বলেছি না?
–ওই শেষ কথার মানে কী? হ্যারি প্রশ্ন করল।
–যাও শুয়ে পড় বলছি!
–কোথা থেকে এল?
–তুমি কি তোমার আন্টির কথা শুনতে পেয়েছ, টু শব্দটি না করে ওপরের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়।