০২. অসুস্থতা ছাড়াও সুখ বিঘ্নিত

অসুস্থতা ছাড়াও সুখ বিঘ্নিত হবার অনেক রকম কারণ থাকে। কবি জড়িয়ে পড়লেন রাজনীতির ঝঞ্ঝাটে।

সরকার নতুন ভাবে শুরু করেছে দমননীতি। বাল গঙ্গাধর তিলকের পত্রিকা বন্ধ করতে বলা হয়েছে। অ্যানি বেসান্তের ওপর জারি করা হয়েছে নিষেধাজ্ঞা, তিনি বোম্বাই ও মধ্যপ্রদেশে প্রবেশ করতে পারবেন না। শুধু তাই নয়, অ্যানি বেসান্তকে অন্তরীন করা হল মাদ্রাজে।

তার প্রতিবাদে সারা দেশ উত্তাল। সরকারকে উপযুক্ত জবাব দেবার জন্য মাদ্রাজের তেজস্বী প্রাক্তন বিচারক স্যার সুব্রহ্মণ্যম আইয়ার ইংরেজ শাসকদের দেওয়া তার স্যার ও দেওয়ান বাহাদুর খেতাব বর্জন করলেন এবং প্রস্তাব দিলেন, এবারের জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে অ্যানি বেসান্তকেই সভাপতি করা হোক!

বিভিন্ন রাজ্য কংগ্রেসের কমিটি এ প্রস্তাব মেনে নিল সাগ্রহে, শুধু গণ্ডগোল বাঁধল বাংলায়। বাংলার কংগ্রেসে দলাদলি তো লেগেই আছে, অ্যানি বেসান্তকে সভাপতি করার প্রসঙ্গে মতভেদ হল তীব্র, দুই পক্ষের তর্কাতর্কি ও হুড়োহুড়িতে পণ্ড হয়ে যায় সভা।

সুরেন বাঁড়ুজ্যের মতন কংগ্রেসের এক শ্রেণীর নরমপন্থী নেতাদের ধারণা, এই বিশ্বযুদ্ধে ইংরেজরা ভারত থেকে প্রচুর সৈন্য ও সম্পদ নিতে বাধ্য হয়েছে, তার বিনিময়ে যুদ্ধশেষে সরকার ভারতে স্বায়ত্তশাসন দিতে বাধ্য হবে। ভারত সচিব তো সম্প্রতি বিলেতের পার্লামেন্টে সেই আশ্বাসই দিয়েছেন। সুতরাং এখন সরকারকে না চটিয়ে সহযোগিতার পথ নেওয়াই ভাল। অপরপক্ষে চিত্তরঞ্জন দাশের মতন চরমপন্থী নেতাদের দৃঢ় বিশ্বাস, সরকার মোটেই অত সহজে স্বায়ত্তশাসন দেবে না। ভারত সচিবের ওই আশ্বাস নিছক ধাপ্পা বা স্তোকবাক্য।

রাজ্য কংগ্রেসের ভোটাভুটি বানচাল হয়ে যাচ্ছে দেখে চরমপন্থীরা ঠিক করলেন, অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি পদে স্যার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে মনোনীত করা হোক, তা হলে সাধারণ সদস্যরা তার সমর্থনে ভোট দেবে। অ্যানি বেসান্তকে জাতীয় অধিবেশনের সভাপতি করার প্রস্তাবও গ্রহণ করা সহজ হবে। এক সকালে দল বেঁধে চিত্তরঞ্জন দাশ, বিপিনচন্দ্র পাল, ফজলুল হক ও আরও অনেকে দেখা করতে এলেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে।

রবীন্দ্রনাথ শ্রদ্ধা করেন অ্যানি বেসান্তকে। এই মহীয়সী ইংরেজ রমণী ভারতে ইংরেজ সরকারের অপশাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন। তাকে সমর্থন করা অবশ্যই উচিত। সরকার তাকে অন্তরীন করে অপমান করতে চাইছে, এখনই তো ভারতবাসীর কর্তব্য কংগ্রেস সভাপতি পদে তাকে বরণ করে সম্মান জানানো।

কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কখনও প্রত্যক্ষভাবে নিজেকে রাজনীতির সঙ্গে জড়াননি। সেই প্রায় এক যুগ আগে, বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাবের সময় তিনি রাস্তায় নেমে মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন, সেটা ঠিক রাজনীতি নয়, নেমেছিলেন প্রাণের টানে, তারপর রাজনৈতিক নেতারা এসে হম্বিতম্বি শুরু করতেই সরে এসেছিলেন তিনি। একজন কবির পক্ষে রাজনীতি থেকে দূরে সরে থাকাই তো ভাল।

কিন্তু এরকম সঙ্কটের সময়, তার নাম ব্যবহার করলে যদি একটা মহৎ কাজ হয়, তখনও কি প্রত্যাখ্যান করা যায়? কয়েকজন বন্ধুবান্ধবের নিষেধ সত্ত্বেও তিনি রাজি হয়ে গেলেন এ প্রস্তাবে, তার সম্মতিপত্র ছাপা হল প্রত্যেক সংবাদপত্রে।

অমনি গালাগালিও শুরু হয়ে গেল। নরমপন্থীদের হাতে অনেক কাগজ। তারা তাকে আখ্যা দিল, হঠকারী, অব্যবস্থিত চিত্ত। নীতিহীন কিছু রাজনৈতিক নেতার পাল্লায় পড়ে শেষ বয়েসে কবি অধঃপাতের দিকে যাচ্ছেন। কবিতা লেখা ছেড়ে এখন তার ক্ষমতা দখলের লোভ হয়েছে? অথচ রাজনীতিতে তিনি একেবারেই অনভিজ্ঞ!

চিত্তরঞ্জন দাশ, বিপিন পাল প্রমুখ কয়েকজন অন্য সময়ে রবীন্দ্রনাথের ঘোর বিরুদ্ধপন্থী, কোনও সুযোগ পেলেই তাঁর লেখার অপব্যাখ্যা করে গালাগালি দিতে ছাড়েন না। এখন রবীন্দ্রনাথ তাদের সঙ্গেই হাত মিলিয়েছেন বলে অন্যরা বিদ্রুপ করতেই বা ছাড়বে কেন?

কিন্তু তিনি ওঁদের সঙ্গে সহযোগিতা করতে সম্মত হয়েছেন কি ক্ষমতার লোভে? এর মধ্যেই স্থির সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন যে পরে আর কংগ্রেসের সঙ্গে কোনও সংস্রব রাখবেন না। রাজনীতিতে যাবেনই না কোনও পক্ষে।

ওই সব নিন্দা কটুক্তিগুলি যেন এক একটি ধারালো তির, বড় লাগে, বড় জ্বালা হয়। কবি বেশিক্ষণ সহ্যই করতে পারেন না। এক এক সময় ভাবেন, ওসব পত্র পত্রিকা পড়বেনই না। তবু কেউ না কেউ ঠিক সামনে এনে দেয়, বিশেষ বিশেষ খারাপ জায়গাগুলি দাগিয়ে রাখে। কখনও ভাবেন, ওসব তুচ্ছ মনে করবেন, অগ্রাহ্য করবেন। তবু পারা যায় না। কণ্টক যত ক্ষুদ্রই হোক, তারও বিদ্ধ করার ক্ষমতা থাকে।

এ রকম সময়ে মনে কবিতা আসে না, গান আসে না।

কোথাও পালাতে ইচ্ছে করে।

অথচ পালাবারও উপায় নেই, অনেক কাজ, অনেক দায়িত্ব। জমিদারির আয় খুব কমে গেছে। পর পর কয়েক বছর খরার জন্য শিলাইদহের প্রজারা খাজনা দিতে পারছে না ঠিক মতন। প্রমথ চৌধুরীকে দুশো টাকা মাইনেয় জমিদারির কাজ দেখাশুনো করার জন্য ম্যানেজার নিযুক্ত করা হয়েছে, সেও সুবিধে করতে পারছে না বিশেষ।

শিলাইদহে একবার নিজের যাওয়া উচিত, তার সময় নেই।

এরকম অস্থিরতা ও ব্যস্ততার মধ্যেও এক ঝলক স্নিগ্ধ বাতাসের মতন বেনারস থেকে এল আর একটি চিঠি।

 

প্রিয় রবিবাবু :

আপনি এতদিন আমাকে চিঠি দেননি বলে খুব রাগ হয়েছিল, কিন্তু আপনার চিঠি পেয়ে খুব খুশি হয়েছি। আমার ভাল নাম কী জানেন? প্রীতি। বেশ সুন্দর নাম না? ইস্কুলে সবাই আমাকে প্রীতি বলে ডাকে। কিন্তু আপনি আমাকে রাণু, রাণু বলেই ডাকবেন। আমার ও নামটা সুন্দর লাগে কি না তাই বলছি। আমার আরও নাম আছে, শুনবেন? রানি, রাজা, বাবা। সব নামগুলোই বেশ। না? আপনি যে কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম বলে একটা সুন্দর লেকচার দিয়েছিলেন না, সেটা ভারতী আর প্রবাসীতে বেরিয়েছিল। মা, বাবজা, বাবু, আশারা সেটা পড়ে বললেন যে খুব সুন্দর হয়েছে। আমিও তাই পড়তে গেলাম। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলাম না। বোধহয় সেটা খুব শক্ত। কিছুদিন আগে আমার খুব অসুখ করেছিল। এখন ভাল আছি। আপনি নিশ্চয় একদিন আমাদের বাড়ি আসবেন। আমরা এ বাড়ি ছেড়ে যাব না। এ বাড়ি আমাদের নিজের বাড়ি। ভাড়ার বাড়ি নয়। আপনি আসবার সময় আমাদের জানাবেন। আমি ইস্কুলের ছুটি নিয়ে আপনাকে ইস্টিশানে আনতে যাব। এ চিঠির উত্তর শিগগির দেবেন যেন, হারিয়ে ফেলবেন যেন। আমি কেমন সুন্দর ফুল আঁকা কাগজে চিঠি লিখেছি।

রাণু

আমাদের বাড়ির ঠিকানা আবার লিখে দিচ্ছি।
235 August Kund
Benares City

আপনি আর গল্প লেখেন না কেন?

 

কবি চিঠিখানা পড়ার পর উলটেপালটে দেখলেন। গোটা গোটা স্পষ্ট হাতের লেখা, বানান ভুল নেই। ভাষা এমন, যেন মুখের ভাষা, লেখা নয়, কথা বলছে সামনাসামনি। এবারেও সম্বোধনে শুধু গম্ভীরভাবে ‘প্রিয় রবিবাবু’, শ্রদ্ধা-ভক্তি জানাবার কোনও পাট নেই, শেষে শুধু নাম, যেন সমবয়েসী।

কে এই মেয়েটি?

ঠিকানাটা দেখে কবির খটকা লাগল।

অগস্ত্য কুণ্ড? চেনা চেনা লাগছে। কাশীতে একবার অগস্ত্য কুণ্ডের একটা বাড়িতে গিয়েছিলেন না?

হ্যাঁ। মনে পড়ল, সংস্কৃতের অধ্যাপক ফণিভূষণ অধিকারীর বাড়ি। সে বাড়ির কেউ? ফণিভূষণের স্ত্রীর নাম সরযূবালা, সে এক সময় কয়েকখানা চিঠি লিখেছিল, সে চিঠি অন্য রকম। এ মেয়েটি ইস্কুলে পড়ার কথা লিখেছে।

ফণিভূষণের বেশ কয়েকটি ছেলে-মেয়ে। তার মধ্যে একজনের কথাই একটু একটু মনে আছে। প্রথমে অদ্ভুত লেগেছিল। মেয়েটির সাজসজ্জা একেবারে ছেলেদের মতন। তাকে ডাকাও হয় নন্দদুলাল নামে। পরে জেনেছিলেন, ওঁদের পরপর দুটি পুত্রসন্তান বাঁচেনি, তাই তৃতীয় সন্তানটি মেয়ে হলেও তাকে ছেলে সাজিয়ে রাখা হয়। ওর আসল নাম আশা। শুনেছিলেন, সে মেয়েটি পড়াশুনোয় খুব ভাল, উপনিষদ থেকে নির্ভুল মুখস্থ বলে।

রাণু বা প্রীতি সেই আশারই পরের বোন? আশার বয়েসই এখন বড় জোর তেরো-চোদ্দো হবে, তা হলে এর বয়েস কত? কোন ক্লাসে পড়ে, তাও লেখেনি। এর বয়েস এগারো বাবোর বেশি হতেই পারে না! এর মধ্যেই সে তার এত লেখা পড়ে ফেলেছে? এমনকী প্রবন্ধ পড়ারও চেষ্টা করে?

আপনি আর গল্প লেখেন না কেন?

হ্যাঁ, অনেকদিন গল্প মাথায় আসেনি।

কবি ভাবলেন, আমি মানুষটি খেজুর গাছের মতন। কেউ খোঁচা না দিলে রস বেরোয় না। কেউ তাড়া না দিলে মাথায় আসে না নতুন লেখা। এখন শুধু প্রবন্ধ লেখার তাগিদ। এ মেয়েটির জন্য একটি গল্প লিখতে হবে।

রাণুর পরের চিঠিটি পেয়ে কবি একা একা হাসলেন অনেকক্ষণ।

এই সাতান্ন বছরের জীবনে চিঠি তিনি কম পাননি, নিজেও লিখেছেন কয়েক সহস্র, কিন্তু এমন ছেলেমানুষি ভরা নির্মল রসের চিঠি যেন আগে কখনও উপভোগ করেননি।

সে লিখেছে : আমি এতদিন চিঠি দিইনি বলে রাগ করবেন না। আমার খুব অসুখ হয়েছিল। কিন্তু এখন ভাল আছি। লক্ষ্মীটি রাগ করবেন না। আজকে থেকে আমাদের পুজোর ছুটি শুরু হয়েছে। 31st October-এ খুলবে। আচ্ছা, আপনার চিঠি লেখা ছাড়া আর কী কাজ! আর কই গল্পও লেখেন না। ইস্কুলেও যান না। আমার আপনার চাইতে ঢের বেশি কাজ। সকালে নটা পর্যন্ত মাস্টারমশাইয়ের কাছে পড়ি। বিকেলে চারটে পর্যন্ত ইস্কুলে থাকি। ইস্কুল থেকে এসে এক পণ্ডিতজীর কাছে হিন্দী পড়ি। আর রাত্রে লেখা, টাস্ক করি। আপনাকে দেখে বিশ্রী বলব না। ছবিতে তো আপনাকে সুন্দর করে আঁকে। আপনি নিশ্চয় ছবির চেয়ে বেশি সুন্দর। আমার বেশ একটি সুন্দর বন্ধু। না? আপনার বোধহয় কোনও সুন্দর বন্ধু নেই, আপনাকে দেখে আমার খুব ভাল লাগবে। আপনাকে এসে কিন্তু আমাদের বাড়িতে থাকতে হবে। আর কোথাও থাকতে পাবেন না। আচ্ছা, আপনি পদ্মার উপর নদীতে নৌকোয় থাকতেন না নদীর ধারে বাড়িতে থাকতেন। আমার সেখানে যেতে ইচ্ছে করে…

মেয়েটি বার বার তাকে দেখতে চায় বলে কবি লিখেছিলেন, আমায় দেখলে তুমি ভয় পেয়ে যাবে, আমার দাড়ি-গোঁফওয়ালা ভয়ংকর চেহারা, আমার অনেক বয়েস। সাতান্ন।

তার উত্তরে রাণু লিখেছে, আপনার মোটেই অত বয়েস নয়। কবিদের আবার বয়েস বাড়ে নাকি?

আপনার বয়েস সাতাশ। আমার কাছে আপনি তাই। ওর থেকে আর আপনার বয়েস বাড়বে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *