০২. অবসর-জীবন কীভাবে কাটাবেন

অবসর-জীবন কীভাবে কাটাবেন সরিৎশেখর কোনোদিন চিন্তা করেননি। সেই কোন ছেলেবেলায় চা-বাগানে ঢুকে পড়ার পর এতটা কাল হুহু করে কেটে গেল, নিশ্বাস ফেলার সময় পাননি। চাকুরির মেয়াদ ফুরিয়ে আসার মুখে ভেবেছিলেন কর্মহীন অবস্থায় এই তল্লাটে আর থাকবেনই না। আজ ডুয়ার্সের সব লোক তাতে একডাকে চেনে যেজন্যে সেটা ক্ষয়ে যাবে বেকার ক্ষমতাহীন হয়ে বসে থাকলে। তারচেয়ে কলকাতার কাছে গঙ্গার ধারে বাড়ি নিলে বেশ হয়, এরকমটা ভাবতে শুরু করেছিলেন। হেমলতা বলেছিলেন, যদি এদেশ ছেড়ে যেতেই হয় তো দেশে চলুন। দেশ বলতে সরিৎশেখর অবাক হয়েছিলেন, আজ প্রায় কুড়ি বছর তিনি নদীয়ার সেই গগ্রামে পা বাড়াননি, পিতা ষষ্ঠীচরণ দেহ রাখার পর সে-ভিটেতে খুড়তুতো ভাইলা ধুকছে। নিজের একটা দেশ আছে এই বেটা কবেই চলে গেছে। বোধহয় বড়বউ চলে যাবার পর থেকেই দেশ সম্পর্কে মায়ামমতা তার নেই। তা ছাড়া এতটা কাল সাহেবসুবোদের সঙ্গে কাটিয়ে ঐ গ্রামের জীবন তার পোষাবে না। দেশ শব্দটা তাই তার মনে পড়ে না। অথচ হেমলতা কী সহজে দেশ বলল আবেগ-আবেগ গলায়। বেচারা তো কখনো সেগ্রাম চোখেই দেখেননি। বাবার ইচ্ছের কথা শুনে মহীতোষ বেঁকে বসল, আমাদের ছেড়ে আপনি অত দূরে চলে যাবেন-এ হয় না। আপনি যখন রিটয়ার করে আমার সঙ্গে থাকবেনই না, তা হলে অন্তত কাছাকাছি থাকুন। সাপ্লয়ারদের বললে জলপাইগুড়িতে একটা জমির ব্যবস্থা হয়ে যাবে। বিপদে-আপদে আমরা যেতে পারব। কিন্তু কলকাতায় আপনি তিষ্ঠোতে পারবেন না, আর কিছু-একটা হয়ে গেলে আমরা আফসোসে মরে যাব। কথাগুলোকে খুব একটা পাত্তা দিচ্ছিলেন না সরিৎশেখর। শেষ পর্যন্ত বউমা বললেন, বাবা, আপনি চলে গেলে অনির কী হবে? ও কার কাছে পড়াশুনা করবে?

ব্যস হয়ে গেল। সরিৎশেখর জলপাইগুড়ি শহরে জমি কিনলেন। মাত্র দু-হাজার টাকায় শহরের ওপরে জমিসমেত দুটো কাঁঠালগাছ, একটা আম আর অজস্র সুপুরি। এ ছাড়া একটা টিনের চালওয়ালা দু-ঘরের মাথা গোঁজার আস্তানা, যেটায় দিব্যি থাকা যায় কিছুদিন।

জমিটা রেজিস্ট্রি হয়ে গেলেই তিনি বড় ছেলে পরিতোষকে পাঠিয়ে দিলেন। এই ছেলে তার রাতের ঘুম দিনের স্বস্তি কেড়ে নিতে যথেষ্ট। অনেক ঘাট ঘুরে সরিৎশেখরের অনেক পয়সা আজেবাজে ব্যবসায় নষ্ট করে একজন কাঠের কন্ট্রাক্টরের কাছে পড়ে ছিল। সরিৎশেখর তাকে কাজে লাগাতে চাইলেন। মিউনিসিপ্যালিটি থেকে প্ল্যান মঞ্জুর হয়ে গিয়েছিল বাড়ির। দোতলার ভিত হবে, পাঁচটা শোবার ঘর, একটা হল, বসার ঘর, কিচেন, দুটো বাথরুম, একটু ডাইনিং স্পেস, মেয়েদের গল্প করার জন্য বেশ বড় ঠাকুরঘর। মাকফার্সন সাহেবের সঙ্গে বসে বাড়ির প্ল্যান করা হল। ঘুপচিঘর নয়, দক্ষিণের বাতাস যেন চিরুনির মতো সমস্ত বাড়িটার মধ্যে দিয়ে বয়ে যেতে পারে এরকমভাবে। জানলা-দরজা বানানো হবে। পরিতোষ শহরে এসে বাড়ির তদারকি করবে দাঁড়িয়ে থেকে। কন্ট্রাক্টরকে বিশ্বাস নেই সরিৎশেখরের। ওদের কাজকর্ম তো বাগানের বিভিন্ন ব্যাপারে অষ্টপ্রহর দেখছেন। কাজ যদি সঠিক হত তা হলে পুজো বা ক্রিসমাসে এত ভেট দিতে হত না। সরিৎশেখর নিজের বাড়ি তৈরি করতে গিয়ে কন্ট্রাক্টরের ভেট চান না।

বাড়ি করার আগে সরিৎশেখর পরিতোষকে নিয়ে এক সকালে শহরে এলেন। পরিতোষের ইচ্ছা সে নিজেই মিস্ত্রি যোগাড় করে প্যানমাফিক বাড়ি বানাবে-সরিৎশেখরের একেবারে গৃহপ্রবেশ করবেন। কিন্তু ছেলের কথায় তার আজকাল খুব ভরসা নেই। শহরে সরিৎশেখরের দেশের গায়ের একজন আছেন যাকে তিনি বন্ধুর মতো বিশ্বাস করেন-সেই সাধুচরণ হালদারের বাড়িতে পরিতোষ প্রথমটা আসতে চায়নি। কিন্তু সরিৎশেখর যখন যেখানে যাবেনই পরিতোষকে বাধ্য হয়ে সঙ্গী হতে হল।

রায়কতপাড়ায় ঢুকতেই সাধুচরণের কাঠ-সিমেন্ট-মেশানো দোতলা বাড়ি। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় নদীয়া জেলার যেসব মানুষ পাকাপাকি বাস করছেন তাঁদের নাড়িনক্ষত্র সাধুচরণের জনা। দেশের খবরাখবর এবং ছেলেমেয়েদের বিয়ের সম্বন্ধের জন্য তারা সাধুচরণের শরণাপন্ন হন। কদমতলায় ওঁর বিরাট স্টেশনারি দোকান এককালে রমরম করত। স্যার আশুতোষের মতো গোঁফ তখনও কুচকুচে কালো, সরিৎশেখর শহরে এলেই দোকানে কিছুক্ষণ কাটিয়ে যেতেন। তা এখন বয়স হয়েছে সাধুচরণের, দুই ছেলে দোকানে বসে। বাড়ি বসে বন্ধকি কারবার করেন তিনি। সরিৎশেখর জিজ্ঞাসা করায় বলেছিলেন, কিছু-একটা নিয়ে থাকতে হবে, তো!

পরিতোষের এ-বাড়িতে আসতেগ না চাওয়ার পেছনে যে-কারণটা সেটা সরিৎশেখর জানেন। সাধুচরণের শুশ্রী এবং কন্যা উন্মাদ। স্ত্রী যতটা কন্যা তার দ্বিগুণ। বিবস্ত্র হয়ে যাতে না থাকে সেজন্যে পা অবধি স্কুল এবং তলায় বোম আঁটা একধরনের অর্ডারি সেমিজ মেয়েকে পরিয়ে রাখেন সাধুচরণ। মেয়েটি চিৎকার চ্যাঁচামেচি করে না, কামড়ায় না। শুধু অঙ্গভঙ্গি করে এবং শব্দ না করে হাসে। পরিতোষ এর আগে দেছেছে সাধুচরণ মেয়েটাকে বারান্দার এক কোণে চেয়ারে বসিয়ে তার খানিক তফাতে নিজে বসে অতিথির সঙ্গে কথা বলেন। সাধুকাকার সঙ্গে কথা বলতে বলতে তার চোখ মেয়েটার দিকে যেতে সে শিউরে উঠেছিল। অত কুৎসিত করে কোনো মেয়ে নিঃশব্দে হাসতে পারে সে জানত না। আর তার ঐ প্রতিক্রিয়া দেখে সাধুচরণ খুব মজা পাচ্ছেন-সেটা পরিতোষ বেশ টের পাচ্ছিল। বোধহয় মেয়েকে সামনে অতিথিদের নার্ভের ওপর একটা প্রেশার সৃষ্টি করে ভদ্রলোক তাকে নিয়ে খেলা করেন। সেদিন সাধুচরণের স্ত্রী এসে তাকে চা দিয়েছিলেন। নিশ্চিত ভদ্রমহিলা সেদিন কিছু সুস্থ ছিলেন। তবে তার চোখমুখ অসম্ভব লাল দেখ চ্ছিল। পরিতোষ গুনেছে ভদ্রমহিলা মাঝে-মাঝে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যান, তখন তাকে ঘরবন্দি করে। খা হয়-আবার টপ করে সুস্থও হয়ে যান। পরিতোষ এও শুনেছে এক জ্যোতিষী হাত দেখে বলেছে বিয়ে দিলে মেয়ের এই পাগলামি সেরে যাবে। কিন্তু সাধুচরণ নদীয়া জেলায় সে ধরনের পাত্রের সন্ধান পাচ্ছেন না।

তবু, সরিৎশেখরের সঙ্গে পরিতোষকে আসতেই হল। রিকশায় চড়া সরিৎশেখর একদম পছন্দ করেন না। লাঠি-হাতে লম্বা শরীরটা নিয়ে যখন হনহন করে হেঁটে যান, তখন তাঁর সঙ্গে পাল্লা দেওয়া মুশকিল। তা ছাড়া বাবার সঙ্গে হাঁটতে পরিতোষের ভীষণ অস্বস্তি হয়-ইচ্ছে করে পিছিয়ে পড়ে এমনভাবে সে হাঁটে যেন সরিৎশেখর তার কেউ না।

সাধুচরণ হালদার বাড়িতেই ছিলেন। সরিৎশেখরের গলা শুনে হাত জোড় করে হাসতে হাসতে অভ্যর্থনা জানালেন। চেয়ারে বসতে বসতে সরিৎশেখরের প্রথম কথা হল, বসো হে সাধু, তোমার সঙ্গে কথা আছে। আর হ্যাঁ, মেয়েটাকে আজ বাইরে আনার দরকার নেই।

সাধুচরণ ঘাড় নাড়লেন, না না, আপনারা নিশ্চিন্তে বসুন, তাকে বাইরে আনার দরকার নেই।

পরিতোষ বারান্দার একপাশে দাঁড়িয়ে ভ্রূ কুঁচকালো। সরিৎশেখর খানিক অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কেন, আনতে হবে না কেন?

আজ্ঞে, ডাক্তার বলেছে ও আর বেশিদিন বাঁচবে না। আজন্ম শুনে এলাম পাগলরা দীর্ঘজীবি হয়-কিন্তু এ-মেয়ে নাকি বড়জোর মাসখানেক। কথা তো কোনোকালেই বলে না-এখন মুখে গ্যাজলা উঠছে, বিছানা ছেড়ে উঠতে পারে না। যাক বাবা, যত শীঘ্র যায় ততই মঙ্গল। কী বলেন?

সরিৎশেখর অন্যমনস্ক গলায় বললেন, তবু তো তোমার মেয়ে হে।

মাথা নাড়লেন সাধুচরণ, না, না। বাপ তো মেয়েকে সৎপাত্রে দান করতে পারলে বেঁচে যায়তাই না? তা ওর ক্ষেত্রে মৃত্যু হল সৎপাত্রে দান। এব্যাপারে আপনি বিন্দুমাত্র চিন্তিত হবেন না। এখন বলুন আগমনের উদ্দেশ্যটা কী?

সরিৎশেখর বাড়ি বানাবার কথা বললেন। যেহেতু তিনি শহরে থাকতে পারছেন না তাই সাধুবাবুর সাহায্য নিতে চান। ভালো রাজমিস্ত্রি যোগাড় করে দেওয়া তো সাধুবাবুর কাছে কোনো সমস্যা নয়। ইট-ভাটায় খবর দিলে গরুর গাড়ি করে ইট আসবে-সিমেন্টের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। আর ঐ এলাহি কাজকর্ম ঠিক হচ্ছে কি না দেখার জন্য পরিতোষ থাকল। সাধুকাকাকে দেখতে হবে পরিতোষ ঠিকমতো কাজকর্ম দেখাশোনা করছে কি-না। সরিৎশেখর মাঝে-মাঝে এসে দেখে যাবেন।

সাধুচরণ চুপচাপ শুনলেন, তারপর বললেন, আপনি এসে আমাদের সঙ্গে থাকবেন, দুবেলা দেখা পাব-এ তো আমাদের সৌভাগ্য। সব ব্যবস্থা করে দেব। রহমত মিয়া আছে-খুব গুণী মিস্ত্রি-ওর ওপর ভার দিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে বসে থাকতে পারেন। সেসব কিছুতেই আটকাবে না। আমি ভাবছি আপনার পুত্র আহারাদি করবে কোথায়?

পরিতোষ চমকে উঠে কিছু বলতে চাইলে সরিৎশেখর হাত নেড়ে তাকে থামিয়ে দিলেন, কোনো হোটেলের সঙ্গে বন্দোবস্ত করে নিলেই হবে। কিং সাহেবের ঘাটে এখন তো অনেক পাইস-হোটেল হয়েছে।

সাধুচরণ বললেন, দুদিনেই পেটের বারোটা বেজে যাবে। তারচেয়ে ও আমার এখানেই থাকাখাওয়া করে কাজকর্ম দেখতে পারে। আমার সঙ্গে নিত্য যোগাযোগ হবে।

কিন্তু পরিতোষ বাইরে বেরিয়ে এসে প্রায় বিদ্রোহ করে বসল। সাধুচরণের বাড়িতে সে মরে গেলেও থাকবে না। দু-দুটো পাগলকে দিনরাত দেখার মতো নার্ভ তার নাকি নেই। সাধুচরণের বউকে যদিও সহ্য করা যায়, কিন্তু মেয়েকে অসম্ভব। তারচেয়ে সে নিজে হাত পুড়ি ভাতে ভাত বেঁধে খাবে। বাবার দিক থেকে উলটো-মুখো হয়ে সে বলল, আপনি এ-ব্যাপারে একা চিন্তা করবেন না বাবা।

সরিৎশেখরেরও সাধুচরণের কথাটা ভালো লাগেনি। হয়তো সে খোলামনেই বলেছে। তবু একটা সোথ মেয়ে রয়েছে বাড়িতে, হোক-না পাগল, সোমথ তো, সেখানে পরিতোষের মতো দুর্নামযুক্ত একটা ছেলেকে বাড়িতে রাখার প্রস্তাব-কেন যেন মনে সন্দেহ এনে দেয়। ঠিক হ, পরিতোষ নিজেই খাবার ব্যবস্থা করবে, টিনের ঘরটাকে বসবাসের উপযুক্ত করে দিয়ে গেলেন সরিৎশেখর। রহমত মিঞা কাজ করবে লোকজন নিয়ে সরিৎশেখর সপ্তাহে একদিন এসে টাকাপয়সা দিয়ে যাবেন পুত্রকে। কোনো সমস্যা দেখা দিলে পরিতোষ সাধুচরণের পরামর্শ নেবে। খুব ঠেকায় না পড়লে যেন টাকাপয়সা না নেয়।

ভিত খোঁড়া হল। প্ল্যানমাফিক কাজ এগোতে লাগল। ভিত-পুজোটুজোর ব্যাপার করেন না সরিৎশেখর। প্রথম দিকে তরতর করে কাজ চলতে লাগল। সরিৎশেখর সন্তুষ্ট, ছেলের পরিবর্তন হয়েছে দেখে খুশি হলেন। সাধুচরণও পরিতোষের প্রশংসা করেন। সারাদিন রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে থেকে। মজুরদের কাজ করায়। ক্রমশ সরিৎশেখর ছেলেকে বিশ্বাস করতে লাগলেন। লোক মারফত টাকা পাঠান, চা-বাগানের কাজ ফাকি দিয়ে ঘনঘন শহরে আসা সম্ভব হয় নাএযভাবে কাজ চলছে পুরো বাড়ি শেষ হতে মাস দুয়েক লাগার কথা নয়। এখনও রিটায়ার করতে দেরি আছে। তবে সরিৎশেখর ঠিক করলেন ভাড়াটাড়া দেবেন না।

এমন সময় সাধুচরণের একটা চিঠি পেলেন সরিৎশেখর। শনিবার সন্ধেনাগাদ চলে আসুন, দিনমানে অবশ্যই নয়। আমার গৃহে তো থাকবেন না তাই রুবি বোর্ডিং-এ আপনার ব্যবস্থা করতে পারি। আসার আপনার প্রয়োজন, কারণ আপনার পুত্রের সঙ্গে আপনার ভবিষ্যৎ এক্ষেত্রে জড়িত হয়ে পড়েছে।

মাথায় রক্ত উঠে গেল সরিৎশেখরের। অতীতের অনেক অপকর্মের নায়ক নিজের ছেলেকে তিনি জানেন। শনিবার পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন না। বিকেলের ডাকে চিঠি পেয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে সাহেবকে বলে একটা গাড়ি যোগাড় করে শহরে রওনা হলেন। যাবার সময় মহীতোষকেও কিছু বললেন না। শহরে এসে প্রথমে ভাবলেন সাধুচরণের কাছে যাবেন কি না। তারপর ঠিক করলেন নিজেই ব্যাপারটা দেখবেন আগে। সাধুচরণের চিঠির ভাষা খুবই সন্দেহজনক-সরিৎশেখর একটা বিশ্রী গন্ধ পাচ্ছেন তাতে-আর তাই সাক্ষী রাখা বাঞ্ছনীয় নয়।

সন্ধে হয়ে গিয়েছিল অনেকক্ষণ। তিস্তা নদীর গায়ে যে মাটির রাস্তা সেনপাড়ার দিকে চলে গিয়েছে, সেখানে গাড়ি রেখে ড্রাইভারকে চুপচাপ বসে থাকতে বললেন। গাড়ি থেকে নেমে ওঁর খেয়াল হল উত্তেজনায় আসবার সময় কাশ্মীরি লাঠিটা সঙ্গে আনতে ভুলে গেছেন। সামনে অনেকটা খোলা মাঠ অন্ধকারে ঢাকা-অনেক দূরে টিনের ঘরের সামনে হারিকেন জ্বলছে মিটমিট করে। কী মনে করে সরিৎশেখর গাড়ির হ্যান্ডেলটা লাঠির মতো বাগিয়ে মাঠ ভাঙতে লাগলেন।

জালতারের বেড়া দিয়ে সমস্ত জমিটা ঘিরে রাখা হয়েছিল। এদিকটা দিয়ে বাড়ির মালমশলা আনবার জন্য একটা ছোট টিনে গেট করা আছে। সরিৎশখর গেট খুলে ভেতরে ঢুকলেন।

ঢুকতেই তিনি বড় ছেলের গলা শুনতে পেলেন। এলোমেলো গলায় সায়গলের গান গাইছে। গানের গলাটা তো বেশ ভালো! ছেলের গান কোনোদিন শোনেননি তিনি। হঠাৎ মনে হল ওকে যদি গান শেখানো যেত, তা হলে নাম করতে পারত। কিন্তু গলাটা স্থির থাকছে না কেন। কয়েক পা। এগোতেই নতুন বাধাই কুয়োটার পাশে এসে দাঁড়ালেন। ভিত খোঁড়ার পর এই কুয়োটা হয়েছে। খাবার জল নয়-বাড়ির কাজে জল দরকার বলে এটা খোঁড়া। অগভীর। অন্ধকার হালকা করে অনেক তারা উঠে এল আকাশটায়। সরিৎশেখর কুয়োর দিকে তাকাতে অবাক হলেন। বেশ কিছুটা নিচে অন্ধকারেও যেন কিছু চিকচিক করছে। জল নয় অবশ্যই। হাতেই লোহার হ্যান্ডেলটা নিচে নামিয়ে দিতেই ঠক্ করে শব্দ হল। জোরে চাপ দিতে মচ করে ভেঙে গেল। সরিৎশেখর বুঝলেন ওটা কাচ। এত কাচে কুয়ো ভরতি হবে কেন? নাকি এ-কুয়োর জল পায় না বলে ওরা অন্য কুয়ো খুঁড়েছে? বোধহয় এটাতে আবর্জনা ফেলে আজকাল। কিন্তু এগুলো কিসের বোতল?

কিছুক্ষণ বাদেই গান শেষ হল। আর সঙ্গে সঙ্গে আড়ষ্ট হয়ে সরিৎশেখর শুনলেন দুটি স্ত্রী-কষ্ঠে ধবল উল্লাসের ঝড় উঠল। একটি কণ্ঠ মাতাল গলায় তুমি মাইরি ভালোই গাও, এসে তোমার গলায় একটা চুমু খাই বলে খিলখিল করে উঠল।

সরিৎশেখর আর স্থির থাকতে পারলেন না। দ্রুতপায়ে নিচু বারান্দায় উঠে এসে লোহার হ্যালেটা দিয়ে দরজায় ঠেলা দিলেন। ভেজানো ছিল দরজাটা, হাট করে খুলে গেল। দুটো ঘরের মধ্যে এটাই একটু বড়। ঘরের মধ্যিখানে একটা জলচৌকির ওপর দুটো বড় মোটা মোমবাতি জ্বলছে। দরজাটা খুলল বলে মোমবাতির শিখা দুটো থরথর করে কাঁপছে এখন। সরিৎশেখর দেখলেন পরিতোষ একটা বালিশ পেটের নিচে নিয়ে একটা কদাকার মেয়ের কোলে মুখ রেখে শুয়ে আছে। মেয়েটি হাতের গেলাস থেকে মাঝে-মাঝে নিজে নিচ্ছে আবার পরিতোষকে মদ খাওয়াচ্ছে। আর-একটা বয়স্কা মোটা মেয়েছেলে পরিতোষের পায়ের কাছে বসে ওর গোড়ালি টিপছে।

দরজাটা খুলে যেতেই বয়স্কা মেয়েছেলেটি প্রথম ওঁকে দেখতে পেল, তারপর গলা দুলিয়ে বলল, কে এলে গো, লনুন নাগর?

সরিৎশেখর প্রথমে উত্তেজনায় কথা বলতে পারছিলেন না। থরথর করে ওঁর দেহ কাঁপছিল। কোনোরকমে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গর্জে উঠলেন, পরিতোষ! বাবার গলা শুনে নেশাগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও পরিতোষ তড়াক করে উঠে বসল। অন্ধকারে মোমবাতির আলোয় পুরোটা দেখা যায় না, তাই দরজায় দাঁড়ানো সরিৎশেকরকে মোমবাতির মাথা ডিঙিয়ে অশষ্ট ছায়া-ছায়া দেখল সে।

সরিৎশেখর তখন এক পা এগিয়েছেন, হারামজাদা, বদমাশ, কুলাঙ্গার-কথা বলতে বলতে হাতের হ্যাণ্ডেলটা শূন্যে অস্ফালন করে সজোরে পুত্রের দিকে ঘোরালেন তিনি। পলকে মোমবাতি দুটো শূন্যে উঠে নিবে গেল। পরিতোষ যন্ত্রণায় চিষ্কার করে উঠে দাঁড়াল। মেয়ে দুটো তাদের বাবু বিপদে পড়েছে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে প্রায় বিবস্ত্র অবস্থায় এসে সরিৎশেখরের দুই পা জড়িয়ে ধরল। সরিৎশেখর একটাকে লাথি মেরে সরিয়ে দিলেও মোটা মেয়েছেলেটিকে পারলেন না। সে সামনে তাকিয়ে যাচ্ছে, বাবুসাহেব আর আসব না, মাইরি বলছি, টাকা দিলেও রাজি হব না ভদ্দপরপাড়ায় আসতে আমাদের বেগুনটুলিই ভালো ছিলো গো-ও-ও।

আর এই সুযোগে এক হাতে মাথার একটা পাশ ধরে তীরের মতো দরজা দিয়ে পরিতোষ ছুটে বেরিয়ে গেল। পা আটক থাকায় সরিৎশেখর পুত্রকে আর-একবার চেষ্টা করেও বিফল হলেন।

মেয়েছেলে দুটোকে দুর করে দেবার সময় আবার ঝামেলায় পড়তে হল। টাকা ছাড়া তারা যাবে। জানতে পারলেন পরিতোষ প্রায়ই তাদের নিয়ে আসে, ফুর্তি করে, যাবার সময় টাকা দেয়। চিৎকার চ্যাঁচামেচি করে ওরা সরিৎশেখরের কাছ থেকে টাকা আদায় করল। ভাগ্যিস এখনও এদিক তেমন লোকবসতি হয়নি এবং সময়টা সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে তাই কেউ জানল না। সরিৎশেখর সবকটা দরজায় তালা লাগিয়ে পেছনে আসতে হ হয়ে গেলেন। এতদিনে তার বাড়ির অর্ধেকটা কাজ হয়ে যাবার কথা। জানলা-দরজায় ফ্রেম লেগে যাবে শুনেছিলেন। কিন্তু এই অশষ্ট অন্ধকারে উনি দেখতে পেলেন ভিত-এর গাঁথুনির পর আর এক ইঞ্চি দেওয়ালও ওঠেনি।

নিজের সারাজীবনের সঞ্চয়ের একটা অংশের এই পরিণতি দেখতে দেখতে সরিৎশেখর শক্ত হয়ে দাঁড়ালেন। তারপর মাথা উঁচু করে অন্ধকারে মাঠ ভেঙে গাড়িতে ফিরে এলেন। একবার ভাবলেন। এখনই রায়কতপাড়ায় গিয়ে সাধুচরণের সঙ্গে দেখা করবেন। কেন তাকে এতদিন পর তিনি জানালেন। পুত্রের কথা? কেন সময় থাকতে সাবধান করে খবর দেননি? বন্ধু হিসেবে সরিৎশেখর তো সাধুচরণের। ওপর নির্ভর করতে চেয়েছিলেন। হঠাৎ তার একটা কথা মনে পড়ে গেল। সাধুচরণ অনেকদিন আগে তাকে একবার বলেছিলেন, আপনার এই পুত্রটিকে নিয়ে দুশ্চিন্তার দেখছি অবধি নেই। আমাদের জাতের কেউ জেনেশুনে ওকে কন্যা দেবে না। আমারও কন্যাটিকে নিয়ে ভাবনার শেষ হয় না। এই দুটিকে একসঙ্গে জুটিয়ে দিলে কেমন হয়?

সরিৎশেখর অবাক হয়ে বলেছিলেন, কী যা-তা বলছ!

সাধুচরণ বলেছিলেন, তা অবশ্য। আপনার পুত্র আগে খুব আসত, এখন আসতে চায় না।

গাড়ি আর ঘোরালেন না তিনি। সোজা কিং সাহেবের ঘাটে চলে এলেন। তিস্তার এই ঘাটটা এখন জমজমাট। অজস্র খড়ের চালের দোকান হয়েছে চা-খাবারের। সন্ধের পর ঘাট বন্ধ হয়ে গেছে, অনেকক্ষণ, অনেক কষ্টে বেশি বকশিশের লোভ দেখিয়ে সরিৎশেখর একটা জোড়া-নৌকো যোগাড় করে গাড়ি তুললেন তাতে।

সেদিন গভীর রাত্রে বাড়ি ফিরে তিনি কিছুক্ষণ নিজের খাটের ওপর গুম হয়ে বসে রইলেন সবাই আন্দাজ করছে কিছু-একটা হয়েছে, কিন্তু কেউ আগবাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করতে সাহস পাচ্ছে না শেষ পর্যন্ত নিজেই ডাকলেন তিনি হেম, মহীতোষ আর প্রিয়তোষকে। ওরা শুনলেন ওদের বাবা ওঁদে বড়দাদাকে আজ থেকে ত্যজ্যপুত্র বলে ঘোষণা করলেন। খাটোর একপাশে দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে ঘাপটি মেরে শুয়ে-থাকা অনিমেষ কথাগুলো স্পষ্ট শুনতে পেল। দাদু আসার পরই ওর ধু ভেঙে গিয়েছিল, কিন্তু ও বুঝতে পেরেছিল সেটা টের পেতে দেওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। কিন্তু ত্যজ্যপুত্র শব্দটার মানে কী?

রহমত মিঞার হাতে বাড়ি হাতের তরতর করে উঠতে লাগল। ছাতি-মাথায় সরিৎশেখ সারাদিন মিস্ত্রিদের পেছনে লেগে রইলেন। ট্রাকে করে ইট-বালি আসছে। তারা বেঁধে মিস্ত্রিরা কাভ করছে। বাউন্ডারির মধ্যে একটা করে মজুররা সেখানে আস্তানা করে নিয়েছে। সন্ধের সময় ইটের উনুন জ্বালিয়ে রুটি সেঁকতে সেঁকতে রামলীলা গায় ওরা তারস্বরে। অনি ঘুরে ঘুরে দেখে সারাদিন সরিৎশেখর ঠিক করেছেন সামনের বছর ওকে জিলা স্কুলে ভরতি করে দেন। যেহেতু এটা প্রায় বছরের শেষ, ভরতি হওয়া চলবে না। ফলে অনির আর বই নিয়ে বসতে হয় ছোট ছেলেমেয়েরা লাইন করে জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে গান গাইতে যাচ্ছে। জিলা স্কুলে ভরতি হতে অনিকে যে আরও কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হবে! সরিৎশেখর ওকে খবরের কাগজ পড়া শেখাচ্ছেন। রোজ বিকেলে যখন। কাগজওয়ালা কাগজ দিয়ে যায়, তখন প্রথম পাতা জুড়ে মহাত্মা গান্ধী আর জওহরলাল নেহরুর ছবি দেখতে পায় অনি।

এখানে শোওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে এইরকম-বড় ঘরটায় সরিৎশেখরের বিরাট খাটটা পাতা আছে। দামি মেহগনি কাঠের খাট। খাটের গায়ে চীনে-লণ্ঠন রাখার একটা স্ট্যান্ড। অনি দাদুর সঙ্গে ঐ খাটে শোয়। সারাদিন মিস্ত্রিদের পিছনে খেটে সরিৎশেখর সন্ধে পেরুলেই খাওয়াদাওয়া সেরে অনিকে নিয়ে শুয়ে পড়েন। অন্ধকার ঘরে দাদুর নাকডাকা শুনতে শুনতে অনির কিছুতেই ঘুম আসে না। রাত হয়ে গেলে মজুররা আর গান গায় না, শুধু একলা একটা ঢোলক তালে তালে বেজে যায়। সেই বাজনা শুনতে শুনতে অনির মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। আর তখনই বুক কেমন করে ওর কান্না আসে। এখানে ওর একটাও বন্ধু নেই, সমবয়সি কোনো ছেলের সঙ্গে ওর আলাপ নেই। পাশের ঘরে শোন। হেমলতা। ঘরের এক কোণে রান্নার জিনিসপত্র, অন্য কোণে ঠাকুরের আসন। এইভাবে থাকা ওঁর কোনোদিন অভ্যেস নেই। প্রথম দিন ব্যবস্থা দেখে বলেছিলেন, ওমা, এইরকমভাবে থাকব কী করে? সরিৎশেখর কোনো জবাব দেননি। তবে বাড়ি তৈরি না হওয়া অবধি কষ্ট করতে হবেই-উপায় কী-এইরকম একটা ভঙ্গি তার আচরণে ছিল। কিন্তু হেমলতা চমৎকার মানিয়ে নিলেন। এখানকার সংসার, তা যত কষ্ট হোক তার নিজের। চিরকাল ভাই ভাই-বউদের সঙ্গে থেকে এরকম একটা মজা তিনি পাননি কোনোদিন। নিজের সংসার তো কোনোকালে করা হল না, বাবা আর ভাইপোকে নিয়ে নতুন সংসারে অভূতভাবে মজে গেলেন হেমলতা।

খুব ভোরে সরিৎশেখর অনিকে ঘুম থেকে তোলেন। এই সময় প্রায়ই ভোরের দিকে বৃষ্টি হয়। সরিৎশেখর তা গ্রাহ্য করেন না। বৃষ্টি হলে গামবুট বা ছাতা নিয়ে দাদুর সঙ্গে অনিকে বেরুতে হয়। দাদুরও একই পোশাক। ঘুমে চোখের পাতা এটে থাকে, জল ছিটিয়ে চোখ ধুয়ে বেরুতে হয়। বেরুবার সময় সরিৎশেখর হেমলতার ঘুম ভাঙিয়ে যান নইলে দরজার খোলা থাকবে যে! মাঠ পেরিয়ে। নাতির হাত ধরে হনহন করে তিনি তিস্তার পারে চলে আসেন। এখন তিস্তা পোয়াতি মেয়ের লাবণ্যে টলটলে। বৃষ্টি না হলে অন্ধকার পাতলা সরের মতো পৃথিবীময় জুড়ে থাকে। টুপটাপ তারাগুলো। নিভছে। কখনো সাদা হাড়ের মতো চাঁদ আকাশের এক কোণে ঝুলে থাকে। সারারাত বিশ্রাম পেয়ে পৃথিবীর বুকের ভিতর থেকে উঠে আসা নিশ্বাসের মতো একরাশ ঠাণ্ডা বাতাস নদীর জলে খেলা করতে করতে অনিদের ছুঁয়ে ছুঁয়ে চলে যায় মণ্ডলঘাটের দিকে। নদীর বুকে অদ্ভুত এক অন্ধকার লুকোচুরি খেলা করে জলের সঙ্গে। হাঁটতে শুরু করেন সরিৎশেখর কাঁচা রাস্তা ধরে। এক পাশে নদী, অন্য পাশে ঘুমন্ত শহর। দাদুর দ্রুত পদক্ষেপের সঙ্গে তাল রাখতে অনিকে হাঁপাতে হয়। চলার সময় কোনো কথা বলেন না সরিৎশেখর। কিং সাহেবের ঘাট ছাড়াবার পর হঠাৎ পুবের আকাশটা রং বদলায়। অনি দেখেছে যে-মুহূর্তে ওরা কিং সাহেবের ঘাট পেরিয়ে পিলখানার রাস্তায় পা বাড়ায়, ঠিক। তখনই অন্ধকার মাটি থেকে হুশ করে উঠে গিয়ে গাছের মাথায়-মাথায় জমে। আর সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত চারাচর ঠাকুরঘরের মতো পবিত্র হয়ে যায়। এমনকি মাটির ওপর ধুলোগুলো কেমন শান্ত হয়ে এলিয়ে থাকে শিশির মেখে। অনি দ্যাখে নদীর গায়ে কোথাও অন্ধকার নেই। অদ্ভুত সারল্য নিয়ে জলেরা বয়ে যায়। দু-একটা তারা ড়ুবে যাবার আগে, যেন কেউ তাদের কথা দিয়ে নিয়ে যায়নি এইরকম আফসোস-মুখে চেয়ে থাকে তখনও। পুবের আকাশটায় হোলি খেলা শুরু হয়ে যায় হঠাৎ। তখনই দাদু দাঁড়িয়ে পড়েন সেদিকে হাতজোড় করে। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যায় ভোলা গলায় সূর্যপ্রণাম-ও জবাকুসুমসঙ্কাশং ক্যাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিম। ধ্বান্তারিং সর্বপাপঘ্নং প্রণতোহস্মি দিবাকরম। কবিতার সুরে সুরে অদ্ভুত এক মায়াময় জগৎ তৈরি হয়ে যায় তখন, প্রতিটি শব্দ যেন সামনের আকাশে অঞ্জলির মতো রঙ হয়ে জড়িয়ে যায়। একসময় দিগন্তরেখায় যেখানে তিস্তার বুকে অসম্ভব লালচে রঙের আকাশ মুখ ড়ুবিয়েছে সেখানটা কাঁপতে থাকে থরথর করে। সেই কাঁপুনি গায়ে মেখে টুক করে সূর্যটা উঠে সুন্দর সোনার টিপটা থেকে ঝলক ঝলক আগুন বেরোতে থাকে তখন সরিৎশেখর বাড়ির পথ ধরেন। অনির তখন মনটা কেমন করে ওঠে। যে-কোনো ভালো জিনিস দেখলেই মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। এই মুহূর্তে ওর দাদুকে খুব ভালো লাগে-ঘুম ভাঙিয়ে তোলার জন্য কোনো আফসোস থাকে না।

বাড়ি ফিরে জল খেয়ে বাড়ির কাজে লেগে যান সরিৎশেখর। সারাদিনের প্রতিটি মুহূর্তে মিস্ত্রিদের চিৎকার আর বিভিন্ন রকমের শব্দে বাড়িটা ভরে থাকে। হেমলতা নিজের মনে সংসারের কাজ করে যান। এখানে এসে প্রথমে চাকরবাকর পাওয়া যায়নি। এখন চাকর রাখলেই যেন হেমলতার অসুবিধে হবে বেশি। কোনো কাজ নিজের হাতে না করলে তার স্বস্তি হয় না। বাবার খাওয়াদাওয়ার দিকে তার কড়া নজর। ঠিক সময়ে শরবত পাঠিয়ে দেন অনির হাত দিয়ে পাথরের গ্লাসে করে। একদিন অন্তর সকালে বাজারে যান সরিৎশেখর। অনি তখন সঙ্গী হয়। দাদুর সঙ্গে যেতে-যেতে রাস্তা কতরকমের লোকের সঙ্গে দেখা হয়, তাদের বেশির ভাগই দাদুকে নমস্কার করে কথা বলে, নানা সমস্যা নিয়ে। আলোচনা করে। অনি বুঝতে পারে ইংরেজরা চলে যাওয়ায় আমাদের অনেক দায়িত্ব বেড়ে গেছে। দাদুর বন্ধুদের কেউ বলেন, যারা ইংরেজদের চাকর ছিল সেই অফিসাররা কী করে দেশ শাসন করবে? আবার একজন বুড়ো বললেন, জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে, এর চেয়ে ইংরেজ-আমল বরং ভালো ছিল। লোকটা কথা বলার সময় চারপাশে চোরের মতো তাকাচ্ছিল। অনির ওকে ভালো লাগছিল না। এসব কথাবার্তার সবটা অনি বুঝতে পারছিল না। কিন্তু ওর মনে হতে লাগল ও বড় হচ্ছে, একটু একটু করে বড় হচ্ছে।

বাড়ির একদিকে চুড়ো করে বালি রাখা ছিল। খাওয়াদাওয়ার পর অনি একা একা সেখানটায় সুড়ঙ্গ-তৈরির খেলা খেলত। অনেকটা দূর ওপরের বালি না ভেঙে গর্ত করে চুপচাপ ভেতরে ঢুকে বসে থাকা যায়। এদিকটায় নতুন-তৈরি বাড়ির ছায়া পড়ে থাকায় বেশ ঠাণ্ডা। দরজা-জানালার ফ্রেম বসে গেছে। কয়েকদিন আগেই ঢালাই শেষ হয়ে গিয়েছে। ছাদ-পেটানোর কাজ চলছে। রহমত মিঞা। কম পয়সায় বেশি কাজ পাওয়া যায়. বলে একগাদা কামিন নিয়ে এসেছে। তারা সকালে দল বেঁধে আসে, সন্ধের সময় দল বেঁধে চলে যায়। সরিৎশেখর মজুরদের বাড়ির ভিতরের খোলা জায়গায় অজস্র গাছপালা লাগিয়ে নিয়েছেন। তারা শিকড়ে জোর পেয়ে গেছে। অনি ভালোবাসে বলে তিনটে পেয়ারা এবং বাউণ্ডারির ধার ঘেঁষে সার দিয়ে কলাগাছ লাগানো হয়েছে।

সেদিন দুপুরে অনি বালির পাহাড়ের তলায় সুড়ঙ্গ করে একদম ওপাশে প্রায় চলে এল। সারা গায়ে বালি মেখে অনি বেরুতে যাচ্ছে হঠাৎ চাপা গলা শুনতে পেল। ওর মনে হল কোনো কারণে দাদ আজ, এদিকটায় চলে এসেছেন। আজ এই বালিমাখা অবস্থায় তিনি যদি অনিকে দেখেন, তাহলে নির্ঘাত শাস্তি পেতে হবে। এর আগে বালি নষ্ট করার জন্যে ওকে ধমক খেতে হয়েছে। চোরের মতো উলটোদিকে হামাগুড়ি দিয়ে ফিরতে যেতে অনি আবার গলাটা শুনতে পেল। না, এ-গলা তো দাদুর নয়। হিন্দিতে কথা বলছে। ছেলেটা কী যেন বলছে খুব চাপা গলায়, আর মেয়েটা না না বলছে সমানে। অনি ফিরল না আর। ওরা কারো দেখার কৌতূহলে ও এগিয়ে গেল হামাগুড়ি দিয়ে। একদম শেষপ্রান্তে গুহার মুখটা বড় হয়নি, একটা বড় ছিদ্র হয়ে রয়েছে, অনি সেখানে চোখ রাখল। ও দেখতে পেল একটা মাঝবয়সী মজুর, যার দাড়ি আছে অনেকটা আর রাত্রে রামলীলা গায়, নতুন-আসা একটা লম্বা কামিনের হাত ধরে কথা বলছে। কামিনটা বারবার ঘাড় নাড়ছে আর ভয়-ভয় চোখে চারপাশে তাকিয়ে দেখছে কেউ দেখে ফেলল কি না। কিন্তু মজুরটা যেন কোনো কথা শুনতে রাজি নয়। হঠাৎ সে দুহাতে কামিনটাকে জড়িয়ে ধরে নিজের বুকে চাপতে লাগল। কামিনটা প্রাণপণে নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করে দুমদাম মজুরটাকে বুকে ঘুষি মারতে লাগল। মজুরটা ভীষণ অন্যায় করছে এটা বুঝতে পারছিল অনি। ওর মনে হল কামিনটাকে বাঁচানো দরকার। চিষ্কার করবে কি না অনি যখন ভাবছে, ঠিক তখনই মজুরটা কামিনটাকে টপ করে চুম খেয়ে ফেলল। অনি অবাক হয়ে দেখল চুমু খেতেই কামিনটা কেমন হয়ে গেল। হাত-পা ছুড়ছে না, প্রতিবাদ করছে না, বরং দুহাতে মজুরটাকে জড়িয়ে ধরেছে ও। আর মজুরটা ওর সমস্ত শরীরে আদর করার মতো করে হাত বোলাতে লাগল। এখন চিৎকার করার কোনো মানে হয় না, কারণ মেয়েটা তো সাহায্য চাইছে না-এটুকু অনি বুঝতে পারল। একসময় লোকটা কামিনের ওপরের কালো জামাটা খুলে ফেলল। অনি কামিনটার পিঠ দেখতে পাচ্ছে। কালো শরীরের ওপর একটা ফ্যাকাশে সাদা দাগ। অনেকদিন চাপা-পড়ে-থাকা ঘাসের রঙ। মজুরটার এখন সব আগ্রহ কামিনের বুকের ওপরে-যেটা অনির দিক থেকে আড়াল করা। হঠাৎ কার। গলা ভেসে সাড়া দিতে দৌড়ে চলে গেল কামিনটাকে কী যেন বলে। মাটিতে পড়ে থাকা জামাটা দ্রুত তুলে নিয়ে এপাশে ফিরে হাঁটু গেড়ে বসে সে পরতে লাগল। অনি দেখল মেয়েটির তামাটে রঙের বড় বড় বুকের ওপর লালচে লালচে দাঁতের দাগ। এভাবে কোনোদিন এইরকম বুক দেখেনি অনি। মেয়েটি জামা পরতে পরতে কী মমতায় একবার দাগগুলোর ওপর হাত বুলিয়ে নিল। তারপর অনির পাশে বালির ওপর পিচ করে পুতু ফেলে হেলতে দুলতে চলে গেল।

মেয়েটি চলে যাবার পর অসাড় হয়ে অনি শুয়ে থাকল বালির ভেতর। ওর মাথা ঘুরছিল এবং বুঝতে পারছিল ওরা খুব খারাপ কিছু করছিল যেটা সবার সামনে করা যায় না। মেয়েটা তা হলে। প্রথমে অত ছটফট করছিল কেন? কেন লোকটাকে ঘুসি মারছিল। আবার পরে লোকটা যখন ওর বুকে। অমন দাঁত বসিয়ে দিল তখন ও কেন যন্ত্রণা পায়নি? কেন তখনও ও মজুরটাকে আদর করছিল। হঠাৎ ওর মালবাবুর ছোট মেয়ে সীতার কথা মনে পড়ে গেল। সীতা ওর চেয়ে এক বছরের ছোট। বাড়ি থেকে খুব কম বের হয়। কিন্তু ওর হাত একটু শক্ত করে ধরলে ভ্যা করে কেঁদে ফেলে। সীতাও কি বুকে ওরকম করে কামড়ে দিলে কাঁদবে না। সঙ্গে সঙ্গে ওর মনে পড়ল সীতার বুক তো ওদের মতোই একদম সমান। তা হলে বড় হলে সীতার বুক নিশ্চয়ই এই কামিনটার মতো হয়ে যাবে। আর বুক বড় হলে মেয়েটার নিশ্চয়ই ব্যথা লাগে না। সমস্যাটার এইরকম একটা সমাধান করতে পেরে অনির অন্যমনস্ক হয়ে পড়তেই চাপ লেগে বালির দেওয়াল ধসে পড়ল। অনি দেখল ওপরের বালি হুড়মুড়িয়ে তাকে চাপা দিতে আসছে। কোনোরকমে টেনে-হিঁচড়ে ও বাইরের খোলা হাওয়ায় বেরিয়ে এল।

বাড়ি শেষ হয়ে গেলে হেমলতার চাপে সরিৎশেখর ঘটা করে গৃহপ্রবেশের ব্যবস্থা করলেন। ঝকঝকে তকতকে বাড়ির দিকে তাকালে তার চোখ জুড়িয়ে যায়। নতুন রঙ আর সিমেন্টের গন্ধ নাক ভরে নেন তিনি। সাধুচরণের সঙ্গে এখানকার কালীবাড়ির পুরোহিতদের খুব ভাব আছে। তিনি সরিৎশেখরকে কলকাতার কাছে হালিশহরে এক তান্ত্রিকে খবর দিলেন, যিনি নাকি সিদ্ধ পুরুষ। অনেক চেষ্টাচরিত্র করে তাকে আনানোর ব্যবস্থা হল। স্বৰ্গছেঁড়া থেকে সবাই এসে হাজির। এখানে আসার পর অনি একদিনও স্বৰ্গছেঁড়ায় যায়নি। সরিৎশেখর পাঠাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু মহীতোষ জানিয়েছিলেন এত ঘনঘন এলে শহরে মন বসবে না। মাধুরী আসার পর হেমলতা বললেন, দ্যাখ, তোর ছেলে কত রোগা হয়ে গেছে।

মাধুরী ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন, নোগা কোথায়, ও দেখছি বেশ লম্বা হয়েছে!

হেমলতা বললেন, হবে না কেন? এ-বংশের ধারাই তো লম্বাটে।

একসময় একটু একলা পেয়ে মাধুরী ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলেন, হ্যাঁ রে, আমার জন্যে তোর মন-কেমন করে না? আর সঙ্গে সঙ্গে অনি ভ্যা করে কেঁদে ফেলল।

সেই কান্না শুনে বাড়ির সবাই ছুটে এসে দেখল অনি মাধুরীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। মাধুরী ছেলেকে যত থামাতে চান কান্না তত বেড়ে যেতে লাগল। শেষ পর্যন্ত হেমলতা বললেন, না ভাই, এতদিন পর দেখা হল আর তুমি ওকে বকাবকি করছ-এটা উচিত হয়নি।

এমনকি সরিৎশেখর অবদি যেতে-যেতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে বললেন, না বৌমা, তুমি বড় ছেলেকে শাসন কর। মাধুরী লজ্জায় মরে যান। ছেলে যে এভাবে কেঁদে উঠবে বুঝতে পারেননি তিনি।

তোড়জোড় চলতে লাগল গৃহপ্রবেশের। কাল মঙ্গলবার, সব মিলিয়ে দিন ভালো। আত্মীয়স্বজন তো আছেনই, সরিৎশেখর শহরের সমস্ত বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করেছেন। কিন্তু আজ সকাল থেকেই আকাশ মেঘলা, টিপটিপিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। কে যেন এসে বলে গেল তিস্তার জল বেড়েছে। তোরে বেড়াতে যাবার সময় সরিৎশেখর তেমন কিছু লক্ষ করেননি। উঠোনে ভিয়েন বসেছে। কাল দুপুরে খাওয়াদাওয়া হলেও আজ থেকে মেয়েদের রান্নাঘরে যেতে হচ্ছে না। সন্ধের ট্রেনে হালিশহরের সিদ্ধপুরুষ একজন শিষ্যসমেত এসে গেলেন। সরিৎশেখর মহীতোষকে নিয়ে স্টেশনে গিয়েছিলেন তাকে আনতে। কিন্তু তিনি সোজা গিয়ে কালীবাড়িতে উঠলেন। ঠিক হল পরদিন ভোরে পুরোহিমশাই-এর সঙ্গে উনি চলে আসবেন। খাওয়াদাওয়া সারতে রাত হয়ে গেল। ঠিক হল টিনের চালায় মেয়েরা বাচ্চাদের নিয়ে শোবেন। যেহেতু গৃহপ্রবেশ এখনও হয়নি তাই সরে নয়, নতুন বাড়ির ঢাকা বারান্দায় শতরঞ্জি বিছিয়ে ছেলেদের শোওয়ার ব্যবস্থা হল। শোওয়ার আগে ক্যাম্পখাট পেতে সরিৎশেখর একবার অনির খোঁজ করতে হেমলতা বললেন, ও মায়ের সঙ্গে শোবে।

বড় ঘর থেকে খাটটা সরানো গেল না। তাই মেয়েরা মাটিতে ঢালাও বিছানা পেতে শুলেন। খাটের ওপর মাধুরী আর অনি। মাধুরী নিচেই শুতে চেয়েছিলেন, হেমলতা বকাবকি করাতে রাজ হতে হল।

মায়ের কাছে এতদিন বাদে শুয়ে অনির কিছুতেই ঘুম আসছিল না। মায়ের গন্ধ মায়ের নরম হাত ওকে কেমন আবিষ্ট করে রেখেছিল। মাধুরী একসময় চাপা গলায় বললেন, তুই সকালে অমন বোকার মতো কাদলি কেন? সবাই আমাকে বকল!

অন্ধকার ঘরে মায়ের বুকের কাছে মুখ রেখে অনি বলল, তুমি আমাকে বললে কেন তুমি জান

বুঝি! মাধুরী ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। মায়ের বুকের ওপর গাল রাখতে গিয়ে অনির চট করে সেই কামিনটার কথা মনে পড়ে গেল। ও বলল, মা, তোমার বুকে যদি আমি কামড়ে দাগ করে। দিই তা হলে তোমার লাগবে না।

চাপা গলায় ছেলের প্রশ্নটা শুনে মাধুরী হকচকিয়ে গেলেন। অনি যে এ-ধনের প্রশ্ন করবে ভাবতেই পারেননি। কোনোরকমে বললেন, মানে?

অনি বলল, জান, এখানে না একটা কামিনের বুকে একটা কুলি অনেক দাঁত বসিয়ে দিয়েছিল, কিন্তু কামিনটা একদম কাদেনি। বড় বুকে কামড়ালে লাগে না, না?

উত্তেজনায় মাধুরী উঠে বসতে যাচ্ছিলেন, কোনোরকমে কৌতূহল চেপে জিজ্ঞাসা করলেন, তুই কী করে জানলি?

তখন অনি পুটুরপুটুর করে মাকে সব কথা বলল, এমনকি সীতার কথাটাও। মাধুরী কী করবেন প্রমটা বুঝতে পারছিলেন না। ব্যাপারটা খারাপ বললে ছেলের যদি কৌতূহল বেড়ে যায়। শেষ পর্যন্ত মাধুরী বললেন, ওরা ভীষণ অন্যায় করেছে তাই লুকিয়েছিল। তুমি ওসব আর দেখো না। ওসব দেখলেও পাপ হয়, ভগবান রাগ করেন।

অনি বলল, আমার তা হলে পাপ হয়েছে।

মাধুরী ছেলের মাথায় হাত রাখলেন, না না, মায়ের কাছে সব কথা খুলে বললে কোনো পাপ আর থাকে না। তুমি চিরকাল আমাকে সব কথা খুলে বোলা অনি।

মাধুরীর খেয়াল হল তার পেটে আর-একটি সন্তান এসে গেছে। এই অবস্থায় টানটান হয়ে শোওয়া উচিত নয়। মাধুরী হাঁটু দুটো পেটের কাছে নিয়ে এসে পাশ ফিরে শুলেন।

সিদ্ধপুরুষ তান্ত্রিকের নামশনিবাবা। বিশাল তার চেহারা, যেমন ভূঁড়ি তেমনি লম্বা। লাল কাপড় পরে খড়ম-পায়ে রিকশা থেকে যখন নামলেন তখন অনির ভয়ে চোখ বন্ধ হবার যোগাড়। পিসিমা আগে গল্প করেছিলেন, তান্ত্রিকেরা নাকি ইচ্ছে করলে যা-খুশি করতে পারে। শনিবাবাকে দেখলেই বুক হিম হয়ে যায়, সামনে যাবে কী!

পূজোয় বসার আগে শনিবাবা একবার নতুন বাড়ির চারপাশে পাক দিয়ে এলেন। যে-ঘরটা ঠাকুরঘর হবে বলে হেমলতা ঠিক করেছিলেন সেখানেই পূজোর আসন পাতা হয়েছে। আসনে বসে অনেকক্ষণ ধ্যানস্থ হয়ে থাকলেন শনিবাবা। ওর সামনে কোনো মূর্তি নেই। শুধু চারটে মোটা চন্দনকাঠের টুকরো ছড়ানো বালির ওপর সাজানো রয়েছে। শনিবাবার অনেকটা পিছনে ঘরের মধ্যে সরিৎশেখর হাঁটু গেড়ে বসে, তার পেছনে পুরোহিতমশাই, মহীতোষ এবং সাধুচরণ বসে আছেন। প্রিয়তোষ রান্নাবান্নার দিকটা তদারক করছে। মেয়েরা ভিড় করে দরজায় দাঁড়িয়ে, ভেতরে ঢুকতে সাহস পাচ্ছে না কেউ। ওঁদের আড়ালে দাঁড়িয়ে সামান্য ফাঁক দিয়ে অনি শনিবাবার পিঠটা দেখতে পাচ্ছে। হেমলতা মাধুরীকে বলেছেন অনিকে যেন শনিবার সামনে খুব একটা যেতে না দেওয়া হয়। কারণ তান্ত্রিক-মানুষকে বিশ্বাস নেই, ছোট ছেলেমেয়ের প্রতি ওঁদের নাকি আগ্রহ থাকে। শোনার পর থেকে মাধুরী ছেলেকে আগলে-আগলে রাখছেন।

হঠাৎ শনিবাবা টানটান হয়ে বসলেন। তারপর চোখ খুলে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। ঘরের সবাই অবাক হয়ে তার দিকে তাকাতেই বাজখাই গলায় তিনি ডাকলেন, সরিৎশেখর।

সরিৎশেখর চমকে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন।

শনিবাবা বললেন, এত অমঙ্গলের ছায়া কেন? এত শক্ত কেন তোমার?

উত্তরে সরিৎশেখর কোনোরকমে বললেন, সে কী!

শনিবাবা বললেন, এর মধ্যেই ওরা কাজ শুরু করে দিয়েছে। এভাবে চললে খুব শীঘ্ৰ তোমার অঙ্গহানি হবে। আমি বাড়িতে ঢুকতেই অনুভব করেছিলাম কেউ-একজন খুশি হল না।

সরিৎশেখর হাতজোড় করে বললেন, আমি তো জেনেশুনে কোনো অন্যায় করিনি বাবা-আপনি দেখুন।

শনিবাবা বললেন, এই বাড়ি বাঁধতে হবে। তোমরা একটা কুলোয় চারটে প্রদীপ, চার পাত্র দুধ, রটে ফল আর চারটে জবাফুল তুলসীপাতার ব্যবস্থা করো এক্ষুনি! কথা শেষ হওয়ামাত্র সরিৎশেখর রজায় দাঁড়ানো মেয়েদের দিকে তাকালেন। সঙ্গে সঙ্গে হুড়মুড় করে মেয়েরা ছুটল জিনিসগুলোর ব্যবস্থা করতে। মোটামুটি সবই পুজোর ব্যাপারে আনা ছিল। কয়েক মিনিটের মধ্যে সরিৎশেখর কুলোটাকে শনিবাবার সামনে ধরলেন। সেদিকে একবার চোখ বুলিয়ে শনিবাবা মাটিতে রাখা তার লাল ঝুলিটা থেকে একটা কাঠোর বাক্স বের করলেন। কাঠের বাক্সের ডালাটা সন্তর্পণে খুলতে সরিৎশেখর দেখতে পেলেন তার মধ্যে দুইঞ্চিটাকে লম্বা চারটে ফণাতোলা গোখরে সাপ রয়েছে। কুচকুচে কালো ইস্পাতের তৈরি সাপগুলোর ফণার ডগা খুব উঁচলো। চট করে জ্যান্ত বলে ভুল হয়। শনিবাবা সেগুলো বের করে কুলোর উপর রাখলেন। তারপর বললেন, এরা তোমার বাড়ি রক্ষা। করবে। এই কুলোটাকে মাথার ওপর নিয়ে তুমি বাইরে চলো। এদের প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

সম্মোহিতের মতো সরিৎশেখর কুলো মাথায় তুলে নিলেন। মেয়েরা সঙ্গে সঙ্গে দরজা ছেড়ে দল। মাধুরী ছেলেকে আড়াল করে সবে দাঁড়ালেন। প্রথমে শনিবারা, তার পেছনে কুলো-মাথায় সরিৎশেখর, পুরোহিত মশাই, মহীতোষ, সাধুচরণ লাইন দিয়ে ঘর থেকে বেরুলেন। যেতে-যেতে শনিবাবা বললেন, একটা কোদাল আনতে বলল কাউকে। কথাটা শুনে দূরে দাঁড়ানো প্রিয়তোষ একছুটে কোদাল নিয়ে এল।

শনিবাবা প্রথমে গেলেন বাড়িটার পূর্ব-দক্ষিণ কোণে। তারপর কী ভেবে বাগান পেরিয়ে একদম বাউভারির কোণায় চলে এসে ইঙ্গিতে প্রিয়তোষকে মাটি খুঁড়তে বললেন। প্রিয়তোষ যখন অনেকটা গর্ত করে ফেলেছে তখন তিনি গম্ভীর গলায় মা বলে ডেকে উঠে সরিৎশেখরের কুলো থেকে প্রথমে একটা সাপকে সযতে গর্তের ভেতর বসিয়ে দিলেন। তারপর নৈবেদ্যর মতো প্রদীপ, ফল, ফুল একটা করে তার সামনে সাজিয়ে তিনি নিজের হাতে মাটিচাপা দিতে লাগলেন। মাটি সমান হয়ে গেলে বললেন, সাত দিন যেন কেউ এখানে পা না দেয়। যে দেবে তার মৃত্যু অনিবার্য।

একে একে বাড়ির আর তিনটে কোণে সাপ প্রতিষ্ঠা করা হয়ে গেলে হঠাৎ হাওয়া উঠল বেশ। গাছের ডালপালাগুলো শব্দ করে দুলতে লাগল। শনিবাবা একবার আকাশের দিকে মুখ করে কিছু দেখলেন, তারপর সরিৎশেখরের দিকে তাকিয়ে বললেন, বেঁচে গেলি।

পুজো শুরু হতে নিমন্ত্রিতদের আসা শুরু হয়ে গেল। সরিৎশেখরের নির্দেশে পুজো শেষ না হলে খাওয়াদাওয়া হবে না। বৃষ্টি আসতে পারে যে-কোনো মুহূর্তে, তাই ঢাকা লম্বা বারান্দায় খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। পূজো করতে করতে শনিবাবা অদ্ভুত রহস্যময় হয়ে উঠেছেন। মাঝে-মাঝে অদৃশ্য কাউকে ধমক দিচ্ছেন, হাসছেন, আর ছেলেমানুষদের মতো অভিমান করছেন। শেষে চন্দনকাঠে আগুন জ্বালালেন তিনি। পুড়ছে কাঠ, অদ্ভুত সুগন্ধযুক্ত ধোয়া বেরুচ্ছে তা থেকে। হঠাৎ ঝুলি থেকে কিছু একটা বের করে তাতে ছুড়লেন শনিবাবা। সঙ্গে সঙ্গে দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠল। শনিবাবা সরিৎশেখরকে বললেন, এবার অগ্নি আমায় আকর্ষণ করবে। তোমরা আমাকে ধরে রাখবে। কথাটা বলে শনিবাবা উঠে দাঁড়িয়ে সেই বস্তুটি আরও ঐ আগুনে ছড়িয়ে দিয়ে মা মা বলে ডাকতে লাগলেন। সঙ্গে সঙ্গে আগুনের শিখা বাড়তে লাগল। ক্রমশ তা বিশাল আকার ধারণ করে শনিবার মাথা ছাড়িয়ে উঠে গেল। আর তখনই শনিবাবার সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগল। খুব। আলতো করে সরিৎশেখর শনিবাবাকে স্পর্শ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন, হঠাৎ মনে হল শনিবাকে কে যেন সামনের দিকে টানছে প্রচও জোরে। একসময় তিনি নিজে যেন আর শনিবাবাকে ধরে রাখতে পারবেন না বলে মনে হল। ওর অবস্থা দেখে পুরোহিত মশাই উঠে এসে হাত লাগালেন। শনিবাবা তখন অনর্গল সংস্কৃত শব্দসংযোগে মাকে ডেকে যাচ্ছেন। ওঁর শরীরের উত্তাপে যেন সরিৎশেখরের হাত পুড়ে যেতে লাগল। শেষ পর্যন্ত কেউ যেন পলতে কমানোর মতো আগুনটাকে কমিয়ে দিতে শনিবার কাঁপুনিটা থেমে গেল। শনিবাবার কাঁপুনিটা যে ইচ্ছাকৃত নয় এটুকু বুঝতে পারছিলেন সরিৎশেখর। কোনো মানুষকে ধরে রাখলে সেটা বোঝা যায়।

পুজো শেষ হয়ে গেলে অনেকক্ষণ আচ্ছন্ন হয়ে রইলেন সরিৎশেখর। অঙ্গহানি কেন হচ্ছিল তার। অঙ্গহানি বলতে উনি কী বোঝালেন? শারীরিক কোনো আঘাত, না কি কোনো প্রিয়জনকে হারানো! আজীবন ম-বাগানের চাকরিতে থেকে ধর্মকর্ম কোনোদিন করেননি তিনি-জ্যোতিষচর্চা অথবা এ-ধরনের ভবিষ্যৎ-বক্তাদের প্রতি তাঁর বিন্দুমাত্র আস্থা নেই। এখন তার যে-বয়েস সেখানে এলে বেশির ভাগ ভাঙালিরা দীক্ষা নেয়। সরিৎশেখরের চিন্তা তার ধার দিয়েও যায় না। এমনকি হেমলতা যখন সেই কুড়ি-বাইশ বছরে তার কাছে এসে বলল যে সে দীক্ষা নিতে চায়-ভীষণ অস্বস্তিতে পড়েছিলেন তিনি। বালবিধবা মেয়েকে পুনর্বিবাহ দেবার মতো পরিবেশ চা-বাগানে ছিল না। হেমলতা সেটাকে পাপ বলে মনে করত। ফলে অনুমতি দেওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। কিন্তু দীক্ষা। নিয়ে হেমলতার কী হয়েছে। মাঝে-মাঝে জয়গুরু বলা ছাড়া তিনি আর কোনো পরিবর্তন দেখতে পাননি।

শনিবাবাকে দেখে তাঁর প্রথমে ভক্তি জাগেনি। কিন্তু ক্রমশ এই অনুভব তাকে আচ্ছন্ন করেছে যে লোকটি তার চাইতে আলাদা জাতের। মানুষের স্তর বলে যদি কিছু থাকে, শনিবাবা সেদিক দিয়ে তার চেয়ে এগিয়ে আছেন। হোমের সময় তিনি শনিবাবাকে স্পর্শ করে বিদ্যুতের স্বাদ পেয়েছেন। সরিৎশেখরের মনে তান্ত্রিকদের সম্পর্কে একটা প্রচ্ছন্ন মোহ কোথাও লুকিয়ে ছিল, শনিবাবাকে দেখে সেটা স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। অথচ শনিবাবাকে আলাদা করে প্রশ্ন করে তিনি উত্তর পেলেন না অঙ্গহানি বলতে কী বোঝাচ্ছেন। এমনকি পূজোআচ্চা শেষ হয়ে গেলে শনিবাবা যখন কিঞ্চিৎ বিশ্রাম নিচ্ছেন মাটিতে গড়িয়ে তখনও তিনি নিরুত্তর থাকলেন।

শনিবাবা এখানে রাত্রিবাস করবেন না। সন্ধের ট্রেনেই ফিরে যাবেন। বাইরে মহীতোষ পরিতোষ খাওয়াদাওয়ার তদারকি করছে। সাধুচরণকে অন্যান্য বয়স্ক লোকের সঙ্গে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। শনিবাবা শুধু এক গ্লাস দুধ আর মিষ্টি খেয়ে ঠাকুরঘরের মাটিতে চিত হয়ে বয়ে আছেন। তাঁর শিষ্যটি পায়ের কাছে বসে পদসেবা করছে। পুরোহিত মশাই একটা হাতপাখা নিয়ে বাতাস করছেন তাকে। পাশে বসে সরিৎশেখর খুব নম্র গলায় আবার প্রশ্নটি তুললেন। শনিবাবা হঠাৎ মুখ ঘুরিয়ে তার দিকে বিশাল লাল চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। সে-দৃষ্টির সামনে সরিৎশেখরের খুব অস্বস্তি হতে লাগল। হঠাৎ শনিবাবা বললেন, এই পৃথিবীতে তোমার সবচেয়ে প্রিয়জন কে সরিৎশেখর?

খুব ধীরে নিজের অজ্ঞাতেই সরিৎশেখর বললেন, প্রিয়জন!

হ্যাঁ। যাকে তুমি নিজের পরেই ভালোবাসা!

আমার-। সরিৎশেখর কথাটা শেষ করতে পারলে না।

তাকে আমার সামনে নিয়ে এসো।

সরিৎশেখর বাইরে এলেন। হইহই করে খাওয়াদাওয়া চলছে। প্রিয়তোষ খাবারের ঝুড়ি নিয়ে দৌড়ে গেল। মহীতোষ পরিবেশন তদারকি করছে। মেয়েদের দিকে হেমলতা আর মাধুরী খোরাঘুরি করছে। ছেলে-মেয়ে-বউমার মুখের দিকে তাকালেন তিনি-এরা সবাই তার প্রিয়জন। এই মুহূর্তে বড় ছেলে পরিতোষের কথা তার মনে পড়ল-অহানি তো হয়েই গেছে। হঠাৎ দেখলেন পেয়ারাগাছটার তলায় অনি একা দাঁড়িয়ে, গাছের ডালের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে। ধীরপায়ে নেমে এলেন তিনি। দাদুকে দেখে অনি হাসল। নাতির কাঁধে হাত রাখলেন সরিৎশেখর, কী করছ দাদু,

একটা নীলরঙের পাখি এই মাত্রই উড়ে গেল! অনির মুখ উজ্জ্বল।

খেয়েছ?

হ্যাঁ।

আমার সঙ্গে এসো। বাবা তোমাকে ডাকছেন। সরিৎশেখর নাতিকে নিয়ে ঘরমুখো হলেন। কথাটা শুনেই অনি আড়ষ্ট হয়ে,লে। হেমলতার কথা সে শুনেছে। শনিবার কাছে নিয়ে যাচ্ছে দাদু অথচ পিসিমা বারণ করেছেন। শনিবাবাকে দেখলেই তার ভয় লাগে। বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। তার সরিৎশেখর নাতির অবস্থাটা বুঝতে পেরে বললেন, ভয় কী। উনিও তো মানুষ, তোমার কোনো ক্ষতি করবেন না। আর আমি তো আছি।

দাদুর শরীরের সঙ্গে লেপটে অনি হাঁটতে লাগল। দৃশ্যটা প্রথমে মাধুরীর নজরে পড়ল। তিনি কয়েক পা এগিয়ে হেমলতাকে বললেন। ওরা সবাই অবাক হয়ে দেখলেন অনিকে নিয়ে পুজোর ঘরে ঢুকে সরিৎশেখর দরজার ভেজিয়ে দিলেন ভেতর থেকে।

কাচের জানলা ভেতর থেকে বন্ধ, দরজা ভেজানো, ফলে ঘরটার আলোকম, কেমন অস্পষ্ট লাগল অনির। কিন্তু শনিবাবাকে ও স্পষ্ট দেখতে পেল। চিত হয়ে শুয়ে আছেন। বিশাল ভূঁড়ি নিশ্বাসের তালে তালে দুলছে। গলার রুদ্রাক্ষের মালা একপাশে নেতিয়ে পড়েছে। ওর সেই শিষ্য পা টিপে যাচ্ছে, পুরোহিত মশাই পাখা-হাতে মাথার কাছে বসে ওদের দিকে তাকালেন। অনি দেখল শনিবার চোখ বোজা। ওরা যে ঘরে ঢুকল যেন টেরই পেলেন না।

সরিৎশেখর নাতিকে পাশে নিয়ে মাটিতে বসলেন। অনি অবাক হয়ে দেখল দাদুর মুখটা কেমন পালটে যাচ্ছে। ঝাড়িকাকু যখন কোনো অন্যায় করে দাদুর সামনে দাঁড়াত তখন এরকম মুখ করত। শনিবাবার শরীর থেকে মাত্র হাত তিনেক দূরে বসে ওর ভয়-ভয় ভাবটা হঠাৎ চলে গেল। বরং শনিবাবার শরীরের ওঠানামা দেখতে দেখতে ওর বেশ মজা লাগছিল এখন। সরিৎশেখর বললেন, ওকে এনেছি!

শনিবাবা চোখ খুললেন, এনেছ! তোমার প্রিয়জন তা হলে এই কে হয় তোমার?

সরিৎশেখর বললেন, আমার নাতি।

শনিবাবা বললেন, আর নাতি আছে।

সরিৎশেখর উত্তর দিলেন, না। এ আমার দ্বিতীয় পুত্রের একমাত্র সন্তান। প্রথম পুত্র বিবাহ করেনি এবং আমার সঙ্গে সম্পর্ক নেই।

শুয়ে শুয়ে শনিবা হাত নেড়ে অনিকে ডাকলেন, এদিকে এসো।

ডাকের মধ্যে এমন একটা সহজ ভাব ছিল যে অনির একটুও ভয় লাগল না। ও স্বচ্ছন্দে উঠে এসে কাছে দাঁড়াতেই পিছন থেকে দাদু ওকে প্রনাম করতে বললেন। হাত নেড়ে নিষেধ করলেন শনিবাবা, না, তুমি আমার সামনে বসো। কেউ শুয়ে থাকলে কক্ষনো তাকে প্রণাম করবে না। নাম কী?

বসতে বসতে অনি উত্তর দিল, অনিমেষ।

একগাল হাসলেন শনিবাবা, বীর, মানুষ আমরা নহি তো মেষ। অনিমেষ মানে জান?

ঘাড় নাড়ল অনি, স্থির, শান্ত।

শনিবাবা বললেন, যার নিমেষ নেই, দেবতা। আবার মাছকেও অনিমেষ বলা হয়, জান তোমার বয়স কত?

পেছন থেকে সরিৎশেখর বললেন, সাত।

শনিবাবা বললেন, আমার দিকে তাকাও।

অনি শনিবাবার মুখের দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেল। অনি হঠাৎ টের পেল ওর শরীর কেমন হয়ে যাচ্ছে, ও যেন নড়তে-চড়তে পারছে না অথচ সবকিছু বুঝতে দেখতে পারছে। শনিবার চোখের মধ্যে ওগুলো কী? নিজের চোখ বন্ধ করতে গিয়েও পারল না অনি।

শনিবাবা বললেন, সরিৎশেখর! তোমার এই নাতি বংশছাড়া, যৌবন এলে একে আর তোমাদের মধ্যে পাবে না। এর জন্যে মায়া আর বাড়িও না। এই ছেলে যতটা নরম হৃদয়ের ততটাই নির্দয়। তবে হ্যাঁ, এ যদি তোমার সবচেয়ে প্রিয়জন হয় তবে তোমার আর অঙ্গহানির সম্ভাবনা নেই। জন্ম থেকে এ প্রতিরোধশক্তি নিয়ে এসেছে।

সরিৎশেখর ফিসফিস করে বললেন, ভবিষ্যৎ

কেউ বলতে পারে না সরিৎশেখর, কারণ সেটা প্রতিমুহূর্তের আবর্তনে পালটে যেতে পারে। অতীত স্থির থাকে চিরকাল তাই সেটা বলা যায়। তবে মনে ও বিদ্বান হবে কিন্তু আঠারো বছর বয়সে রাজনৈতিক কারণে ওকে জেলে যেতে হতে পারে। যদি তা-ই যায় তা হলে আমি আর কিছু বলতে পারব না। কিন্তু একটা জিনিস বলছি, এর জীবনে বহু নারী আসবে, নারীদের কাছে ও চরম দুঃখ পাবে, নারীদের জন্য কষ্ট হবে, আবার কোনো কোনো নারীর জন্য ও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে। সরিৎশেখর, একে তুমি কোনো কাজে বাধা দিও না কখনো।কথাগুলো একটানা বলে চোখ বন্ধ করলেন শনিবাবা। তারপর স্থির হয়ে গেলেন। পুরোহিত মশাই-এর ইঙ্গিতে সরিৎশেখর উঠে এসে অনিকে বাইরে নিয়ে এলেন। অনির মনে হল, অনেকক্ষণ বাদে একটা অন্ধকার ঘর থেকে সে আলোয় এল।

কাজকর্ম সারতে বিকেল হয়ে এল। সকাল থেকে টুপটাপ হালকা চালে যে-বৃষ্টিটা খেলা করে যাচ্ছিল, দুপুরের পর সেটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ব্যান্ডেজ জড়ানোর মতো আকাশটা মেঘে ঢাকা রইল। এখনও এখানে শীত পড়েনি। মাত্র ত্রিশ মাইলের ফালাকে স্বৰ্গছেঁড়া আর জলপাইগুড়ির মধ্যে প্রকৃতিদেবী দুরকম বেহারা নিয়ে বিরাজ করেন। ভোরের দিকে একটু হিম হয়। কাল রাত্রে মেঝেতে যারা বিছানা করে শুয়েছিল শেষরাত্রে তারা তাই অড়িঘড়ি উঠে পড়েছে। এবার পূজা কার্তিকের কিছুটা পেরিয়ে। মনে হচ্ছে কালীপুজোর অনেক আগেই শীত পড়ে যাবে। কাল রাত্রে আকাশে মেঘ ছিল, আজ হিমেল হাওয়া দিচ্ছে। মাধুরী অনিকে সোয়েটার পরিয়ে দিয়েছেন। আকাশ দেখে কে বলবে এটা শরৎকাল, কদিন বাদেই পুজো!

শনিবাবা বিকেলের ট্রেনে শিষ্যসমেত ফিরে গেলেন। জোলো হাওয়া লাগলে টনসিল ফুলবে বলে অনিমেষকে স্টেশনে নিয়ে যাননি সরিৎশেখর। ওঁরা ফিরতে ফিরতে মেঘে মেঘে প্রায় সন্ধে হয়ে গেল। অনি আজ সারাদিন মায়ের কাছাকাছি। শনিবাবা ওর সম্বন্ধে যা ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন তা এখন সবাই জেনে ফেলেছে। হেমলতা ঠাট্টা করে বলেছেন, বাবার তো দুটো বিয়ে ছিল, এ-ছোঁড়াকে যদি মেয়েমানুষ ধরে কটা বিয়ে করে কে জানে! মাধুরী চাপা গলায় বলেছিলেন, ঐটুকুনি ছেলের সামনে এসব কথা কেন যে ওঁরা বললেন।

হেমলতা বলেছিলেন, ভিমরতি গো, ভিমরতি। নাতি নাতি করে বাবা হেদিয়ে গেলেন। তুমি জান না এই কটা মাস আমাকে সবসময় পিটপিট করেছেন যেন অনির কোনো কষ্ট না হয়। তুমি হাসছ যে!

মাধুরী বলেছিলেন, আপনার ভাই বলে, আপনিই নাকি ওকে বেশি প্রশ্রয় দেন!

হেমলতা কিছু বললেন না প্রথমটা, তারপর আস্তে-আস্তে বলেছিলেন, কিন্তু জেলে যাবার কথাটা শুনে অবধি ভালো লাগছে না আমার। যাগো, লোকটা সত্যিই সিদ্ধপুরুষ নাকি?

কথাটা একফাঁকে মহীতোষকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন মাধুরী। সিগারেট খেতে ছাদে গিয়েছিলেন মহীতোষ। এখনও ছাদের অনেক কাজ বাকি। চিলেকোঠার ঘরে প্লাস্টার হয়নি। ইটগুলো সিমেন্টের ভজ গায়ে জড়িয়ে রয়েছে। ছাদ থেকে তিস্তা নদীর দিকে চোখ পড়তেই অবাক হয়ে গেলেন মহীতোষ। এত জল বেড়েছে যে ওপার দেখা যাচ্ছে না। জলের রং এই এত দূর থেকে কেমন কালচেকালচে লাগছে। এমন সময় অনিকে নিয়ে মাধুরী ছাদে এলেন।.ন্যাড়া ছাদে ছেলেকে একা ছাড়তে চাননি মাধুরী। এসে স্বামীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। আর তখনই জনির কথাটা, জেলে যাবার কথাটা বললেন তিনি। মহীতোষ কথাটা শুনে হোহো করে হেসে উঠলেন, তোমার মাথা-খারাপ হয়েছে, এসব কেউ বিশ্বাস করে। শনিবাবা বোধহয় ভুলে গিয়েছেন যে, দেশ স্বাধীন হয়ে গিয়েছে। এখন আর আঠারো বছর বয়সে কাউকে জেলে যেতে হবে না।

মাধুরী বললেন, কিন্তু এতবড় সিদ্ধপুরুষ—

মহীতোষ হাসলেন, কত বড়?

মাধুরী ভ্রূকুটি করলেন, সবতাতে ঠাট্টা ভালো লাগে না। দুম করে উনি ছেলেটার নামে এসব বলবেনই-বা কেন? যত্ত সব।

মাধুরী বললেন, মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেল।

মাধুরীর মুখটা খুব বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। অনিকে এক হাতে জড়িয়ে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন। সেদিকে তাকিয়ে মহীতোষ বললেন, তা দেশ যখন উদ্ধার হয়ে গিয়েছে ও নিশ্চয় চুরি-ডাকাতি করে বা নারীঘটিত ব্যাপারে জেলে যাবে-শনিবাবা মেয়েদের সঙ্গে ওর সম্পর্কের কথা কি যেন বললেন?

মাধুরী ভ্রূকুটি করে সরে দাঁড়াতে গেলেন, কী যে সব ছাইপাশ বল। ঘুরে দাঁড়াবার মুহূর্তে ওঁর মাথাটা কেমন করে উঠল। ভিজে ছাদের ওপর পা যেন স্থির থাকছে না। সারাদিন খুব পরিশ্রম হয়ে গিয়েছে, হেলতার নিষেধ শোনেননি। খাওয়াদাওয়ার ঠিক ছিল না আজ অবেলায় খেয়ে অম্বল হয়। গিয়েছিল, হঠাৎ দেখে অন্ধকার দেখলেন।

অনি এতক্ষণ হাঁ করে বাবা-মায়ের কথা শুনছিল, এখন ঘাড়ে মায়ের দুই হাতের প্রচণ্ড চাপ পড়তে চিৎকার করে উঠে দেখল মা পা পিছলে পড়ে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে ও মায়ের কোমর জড়িয়ে ধরতে গেল। পেটে চাপ পড়তে মাধুরী চিৎকার করে ছাদের ওপর উপুড় হয়ে পড়লেন। মহীতোষ দৌড়ে এসে স্ত্রীকে আঁকড়ে ধরলেন, কী হল, পড়ে গেলে কেন? চোখের সামনে ওঁকে পড়ে যেতে দেখে হতভম্ব হয়ে পড়েছিলেন প্রথমটা। মারাত্মক কিছু ঘটে গেছে একটা এইরকম বোধ হতে মাধুরীর মুখটা তুলে জিজ্ঞাসা করলেন, কষ্ট হচ্ছে?

মাধুরী ঘাড় নাড়লেন, না। কিন্তু তার মুখ দেখে মহতোষ চমকে উঠলেন। দরদর করে ঘছেন মাধুরী। স্ত্রীকে ছাদের ওপর শুইয়ে দিয়ে ছেলেকে বললেন, যা, শিগগির পিসিমাকে ডেকে আন। মাধুরীর চেতনা ছিল, তিনি হাত নেড়ে নিষেধ করতে-না-করতে অনি একলাফে ছাদ থেকে চিলোকাঠার সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এল।

পাতলা অন্ধকার নেমে এসেছে বাড়িটার ওপর, ছাদে এতক্ষণ বোঝা হয়নি। নিচে নামতেই অনি দেখল পিসিমা ছোটঘরের বারান্দায় লণ্ঠনগুলো জড়ো করেছেন। ও চিৎকার করে উঠল, পিসিমা তাড়াতাড়ি এসো-মা কেমন করছে! চিক্কারটা হঠাৎ কান্না হয়ে যেতে হেমলতা চমকে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। লণ্ঠন পড়ে রইল, তিনি দুদ্দাড় করে অনির দিকে ছুটে এলেন। সরিৎশেখর সবে স্টেশন থেকে এসে পাঞ্জাবি খুলে হাতপাখার বাতাস খাচ্ছিলেন, অনির চিৎকার শুনে তিনিও, হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলেন।

হেমলতা তার ভারী শরীর নিয়ে অনির কাছে এসে দেখলেন ছেলের মুখ সাদা হয়ে গেছে ভয়ে। তোর মা কোথায়, কি হয়েছে?

অনি কথা বলতে পারছিল না, আঙুল দিয়ে ছাদটা দেখিয়ে দিল। এক পলক ওপরদিকে তাকিয়ে হেমলতা গজগজ করতে করতে ছাদের সিঁড়ির দিকে ছুটলেন, আঃ, এই সন্ধেবেলায় আবার ছাদে উঠল কেন! এত করে বললাম পেটের বাচ্চা নড়াচড়া করছে যখন, তখন খাটাখাটুনি কোরো না, তা শুনবে আমার কথা!

সরিৎশেখর দ্রুত এসে অনিকে জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে দাদু?

অনি কেঁদে ফেলল, মা পড়ে গেছে!

সরিৎশেখর আর দাঁড়ালেন না। অনি দাদুর পেছনে পেছনে ছাদে ছুটল।

বৃষ্টিটা এতক্ষণ থমকে ছিল, বেশ আবার ছোট ছোট ফোঁটা পড়া শুরু হল। এ এক অদ্ভুত ধরনের বৃষ্টি। মেঘ ডাকছে না, সামান্য হাওয়াও নেই, আকাশ চিরে ঝলকে-ও। বিদ্যুতের দেখা নেই। তবু বৃষ্টি পড়ছে, থমথমে মেঘগুলো নিঃশব্দে গলে গলে পড়ছে। মহীতোষ বোকার মতো স্ত্রীর পাশে বসে ছিলেন, দিদিকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন। হেমলতা কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে।

যন্ত্রণার মাধুরীর চোখ বোজা ছিল, হেমলতার গলা শুনে কিছু বলতে গিয়ে না পেরে মাথা নাড়ারেন। মহীতোষ বললেন, হঠাৎ মাথা ঘুরে গেছে। কথাটা শেষ হতে-না-হতে মাধুরীর শরীরটা কাপতে লাগল। তারপর প্রচণ্ড যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবার জন্য শরীর মোচড়ানো শুরু হল। সারা শরীর ওঁর ঘামে ভিজে যাচ্ছে, তার উপর বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে এখন। বেশিক্ষণ এভাবে থাকলে ভিজে একশা হয়ে যাবে।

হেমলতা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ভাইকে বললেন, ওকে নিচে নিয়ে চল। মহীতোষ একটু বিব্রত হয়ে পড়লেন। দিদিকে ডাকতে পাঠিয়ে তিনি মাধুরীকে পাজাকোলো করে নিয়ে যেতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু মাধুরীর শরীর এমনিতেই ভারী, এখন যেন আরও ওজন বেড়েছে। সিঁড়ি দিয়ে নিচে যাওয়া খুব সহজ নয়, ওঁর পক্ষে অসম্ভব।

মহীতোষ বললেন, তুমি একটা দিক ধরো, চিলেকোঠার দিকে নিয়ে যাই, বৃষ্টিতে ভিজরে না হেমলতা বোধহয় বুঝতে পেরেছিলেন মাধুরীকে একা মহীতোষের পক্ষে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না, তাই দুজনে ধরাধরি করে চিলেকোঠার ঘরে নিয়ে এলেন। বিড়িটা এখানে চট করে ছাদে উঠে আসেনি। সিড়ি শেষ হবার পর খানিকটা সমতল জায়গাকে ঘরের মতো ঢেকে ছাদের শুরু। মাধুরীকে সেখানে রাখা হল। এটুকু আনতেই হেমলতা টের পেলেন যে ওকে নিচে নিয়ে যাওয়া বোকামি হত, সামান্য নাড়াচাড়ায় ওর কষ্ট যে অনেক গুণ বেড়ে যাচ্ছে এটা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না।

যৌবন আসতে-না–আসতে বিধবা হয়েছিলেন হেমলতা। স্বামী ছিল তার, মুখ-চোখ ভালো করে মনে ধরার আগেই একরাত্রির অসুখে মরে গেল লোকটা। তারপর এতগুলো বছর শুধু পার করে দেওয়া, একরাত্রির জন্য নারী হওয়া যার ভাগ্যে ঘটেনি, মা হবার কোনো প্রশ্নই তো ওঠে না। স্বৰ্গছেঁড়ার নির্জন চা-বাগানে বসে সরিৎশেখর মেয়ের আবার বিয়ে দেবার কথা ভাবতেন। বিদ্যাসাগর মশাই অত চেষ্টা করলেন, হয়তো কলকাতা শহরে অহরহ বিধবা-বিবাহ হচ্ছে, কিন্তু স্বৰ্গছেঁড়ার নির্জন চা-বাগানে সরিৎশেখর মেয়ের আবার বিয়ে দেবার কথা ভাবতেন। বিদ্যাসাগর মশাই অত চেষ্টা করলেন, হয়তো কলকাতা শহরে অহরহ বিধবা বিবাহ হচ্ছে, কিন্তু স্বৰ্গছেঁড়ার লোকজন ব্যাপারটা চিন্তা করতে পারে না। এমনকি হেমলতাও। স্ত্রীকে দিয়ে মেয়েকে বলিয়েছিলেন, শুনে মেহলতা বলেছিলেন, ছি! আর কথা বাড়াননি সরিৎশেখর। বিয়ের সময় ভালো করে কাপড় পরত না যে, জীবনে আর ড্রেস করে শাড়ি পরা হল না তার। একেবারে সরুপাড় সাদা শাড়ি অঙ্গে উঠল। বয়স যত বাড়ছে পাড় তত ছোট হতে-হতে নরুনে ঠেকেছে। ছোটমা যখন স্বৰ্গছেঁড়ায় এল তখন। হেমলতার বয়স বড়জোর আট। সেই বয়স থেকে হাত-পোড়ানো শুরু হয়েছে। মহীতোষ বা। পরিতোষকে নাইয়ে খাইয়ে দেবার জন্য আর কোনো লোক ছিল না। সে একরকম। ছোটমা আসার। পর হেমলতা চট করে অনেক বড় হয়ে গেলেন। বছর ঘোরার আগেই ছোটমা সন্তানসম্ভবা হলেন। স্বৰ্গছেঁড়ার চৌহদ্দিতে তখন ভালো ডাক্তার নেই। নতুন ডাক্তারবাবু তখনও আসেননি। একজন কম্পাউন্ডার কোনোরকমে কাজ চালাচ্ছেন। আর তখন লোকজনই-বা কত ছিল, এক আঙুল যদিবা ফুরোয়! সরিৎশেখর চেয়েছিলেন বউকে বাপের বাড়ি পাঠাবেন। কিন্তু সেই নদীয়ায় নিয়ে যাওয়া আর। হল না। ছোটবউ-এর বাড়ির লোকজন আসব-আসব করে শেষ পর্যন্ত এল না। কুলি-লাইনের এক বুড়ি যে নাকি মদেসিয়াদের দাই-এর কাজ করে, হেমলতাকে সঙ্গে নিয়ে আঁতুড়ঘরে ঢুকল। সরিৎশেখরের পক্ষে সম্ভব নয়। ভেতরে যাওয়া, তিনি বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে মেয়েকে নির্দেশ দিতে লাগলেন। হেমলতা প্রথম সন্তানজন দেখলেন। একটু ভয় ছিল প্রথমটা, কিন্তু বাড়ি তৈরি করার নিষ্ঠা নিয়ে পরপর কাজগুলো করে গেলেন। ছোটমার প্রথম সন্তান আঁতুরঘরেই মারা গিয়েছিল। ছোটমা যতটা-না কেঁদেছেন, হেমলতা বোধহয় অনেক বেশি। তখনও তার বিয়ে হয়নি। বিয়ের পর পরিতোষ জন্মাল! সেদিন আর বুড়ি ধাই ছিল না। হেমলতা একাই সব দিক সামলাচ্ছেন। রান্না করে সবাইকে খাইয়েছেন, কাপড় ছেড়ে আঁতুড়ঘরে গিয়েছেন, সময় এলে নাড়ি কেটেছেন। এমনকি সেদিন অনি যখন হল, তখন তো ডাক্তারবাবু ছিলেন, কিন্তু হেমলতাকে ছাড়া চলেনি। অনি হয়েছিল দুপুরে। সরিৎশেখর ঘরের চেয়ারে বসে ঘড়ির ওপর নজর রেখে মাঝে-মাঝে উঁচুগলায় জিজ্ঞাসা করছেন। বারবার করে বলেছেন ঠিক জন্মমুহূর্তে যেন হেমলতা তাঁকে জানান। শিশুর মতো ছটফট করছেন সরিৎশেখর। তারপর যখন হেমলতার খুশির চিৎকার তার কানে এল ছেলে হয়েছে, তখন সরিৎশেখরকে দেখে কে! এক হাতে ঘড়ি নিয়ে লাফাচ্ছেন তিনি একটা বেজে পনেরো মিনিট-পাজিতে লিখেছে মাহেন্দ্রক্ষণ-শখ বাজাও শখ বাজাও, দুর্গা দুর্গা।

এখন চিলেকোঠার ঘরে মাধুরীকে শুইয়ে দিয়ে মুখ তুলতেই হেমলতা সরিৎশেখরকে দেখতে পেলেন। উদ্বেগ মুখে নিয়ে উঠে আসছেন তড়িঘড়ি। চোখাচোখি হতে হেমলতা খুব সাধারণ গলায় বললেন, তাড়াতাড়ি ডাকার ডাকুন, মাধুর বাচ্চা হবে।

সরিৎশেখর থমকে দাঁড়ালেন। বউমার বাচ্চা হবে তিনি জানতেন, কিন্তু তার তো সময় হয়নি। কোনো গোলমাল হল না তো? বোকার মতো বললেন, সে কী। তার তো দেরি আছে।

কোনোদিকে না তাকিয়ে হেমলতা বাবাকে বললেন, সেসব আপনি বুঝবেন না। তাড়াতাড়ি যান!

মেয়ের মুখের দিকে এক পলক তাকিয়ে থেকে সরিৎশেখর তাড়াতাড়ি নিচে নেমে গেলেন। মহীতোষ ব্যাপারটা এইরকম দাঁড়াবে ভাবতে পারেননি। এখনও তো মাস দুয়েক দেরি আছে। হঠাৎ ওঁর খুব ভয় হল। মাধুরীর যদি কিছু হয়ে যায়। কোনো কথা না বলে মহীতোষ সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলেন, দরকার হলে ওকে হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে। হেমলতা দেখলেন মাধুরী ছটফট করছে। কী করবেন বুঝতে না পেরে মুখ তুলতেই দেখলেন অনি সিড়ির মুখে গাল চেপে করুণ চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। বোধহয় ওপরে উঠে আসতে সাহস পাচ্ছে না। হেমলতা হেসে বললেন, যা বাবা, তাড়াতাড়ি নিচ থেকে একটা বালিশ আর চাদর নিয়ে আয়। কাজ করতে পেরে অনি যেন বেঁচে গেল।

কোনোমতে বিছানা করে মাধুরীকে শুইয়ে দিয়ে হেমলতা বললেন, অনি, তুই মায়ের কাছে বোস, আমি গরম জল করি গে। পিসিমা চলে গেলে অনি খানিকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। বাইরে এখন বেশ বৃষ্টি পড়ছে। ছোট বাড়ি থেকে চাদর-বালিশ আনতে গিয়ে ও একটু ভিজেছে। অন্য সময় মা নিশ্চয় বকত, এখন কিছু বলছে না। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ওর কান্না পাচ্ছিল। মা যে খুব কষ্ট পাচ্ছে এটা ও বুঝতে পারছিল।

পিসিমা তখন দাদুকে বলল মায়ের বাচ্চা হবে। বাচ্চা হলে এত কষ্ট পেতে হয় কেন? মায়ের মুখটা একদম সাদা হয়ে গিয়েছে। ও মায়ের পাশে এসে সন্তর্পণে বসে পড়ল। এখন কাছে পিঠে কেউ নেই, কারও গলা শোনা যাচ্ছে না। চিলেকোঠার দরজাটা আলো আসার জন্যে অথবা ভুলে খোলা রয়েছে। অনি এখান থেকে বৃষ্টি পড়া দেখতে পেল। জলের ছাঁট ঘরের মধ্যে সামান্যই আসছে। অনির খুব ইচ্ছে হল মায়ের মুখে হাত বোলাতে। ঠিক সেই সময় মাধুরী চোখ খুললেন। অনি দেখল মাধুরীর চোখের কোণে দু-ফোঁটা জল টলমল করছে। মাধুরী একবার দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ালেন, তারপর মাথা ঘুরিয়ে ঘরটাতে চোখ বোলালেন। মায়ের চোখে জল দেখতে পেয়ে অনি ফুঁপিয়ে উঠল। মাধুরী, খুব ধীরে ধীরে একটা হাত তুলে ছেলের কোলের ওপর রাখতেই অনি মায়ের বুকে ওপর ভেঙে পড়ল। অনেকক্ষণ ছেলেকে মধ্যে রেখে মাধুরী বললেন, হ্যারে বোকা, কাঁদছিস কেন?

ফিসফিসিয়ে অনি বলল, তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে, না?

আমার কষ্ট হলে তোর খারাপ লাগে, না রে!

অনি ঘাড় নাড়ল। মাধুরী আস্তে-আস্তে বললেন, আমি যদি না থাকি তুই আমাকে ভুলে যাবি তো!

অনি দুই হাতে মাকে আঁকড়ে ধরে কেঁদে উঠল শব্দ করে। মাধুরী কেমন যোরের মধ্যে বললেন, আমি যদি না থাকি তুই একা একা আকাশের দিকে তাকিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলিস, আমি ঠিক শুনতে পাব। অনি, আমি তোকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারব না রে।

অনি কোনো কতা বলতে পারছি না, র ঠাট দুটো থরথর করে কাঁপছিল। মাকে এরকম করে কথা বলতে ও কোনোদিন শোনেনি। মা কেন ওকে ছেড়ে চলে যাবে! বাচ্চা হলে কি কাউকে চলে যেতে হয়! ও দেখল মাধুরী একটানা কথা বলে কেমন নিস্তেজ হয়ে গেছেন, অনেক দূর দৌড়ে এলে যেমন হয় মায়ের বুক তেমনি ওঠানামা করছে। হঠাৎ ও মায়ের দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে গেল। মাধুরী যেখানে শুয়ে আছেন তার নিচদিকটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। এটা কি সতি রক্ত? কোত্থেকে এত রক্ত এল? মায়ের তো কোথাও কেটে যায়নি! এর আগে কতবার তরকারি কুটতে গিয়ে মায়ের হাত বঁটিতে কেটে গিয়ে রক্ত পড়েছে, কিন্তু সে তো কয়েক ফোঁটা মাত্র। অনি আস্তে-আস্তে উঠে মায়ের পাশের কাছে এসে দাঁড়াল। কুঁজো ভেঙে গেলে যেমন জল গড়িয়ে যায় তেমনি একটা মোটা লাল ধারা চলে যাচ্ছে কোণার দিকে। মায়ের পায়ের গোড়ালি সেই স্রোতটা থেকে সরিয়ে দিতে গেল অনি আর তখনি ওর আঙুল চটচটে লাল হয়ে গেল। মাধুরী চোখ খুলে দেখলেন, ছেলে চোখের সামনে আঙুল নিয়ে দেখছে। চিৎকার করে উঠলেন, ওরে মুছে ফ্যাল, তোর হাত থেকে রক্ত মুছে ফ্যাল। কিন্তু ক্রমশ কথা বলার শক্তিটা চলে যাচ্ছিল ওঁর। চোখের সামনে সব ঝাঁপসা হয়ে আসছে। অনি ঝাঁপসা-মহীতোষ ঝাঁপসা-দু-চোখে এত জল থাকে কেন?

এই সময় সিঁড়িতে কয়েক জোড়া শব্দ পেল অনি। একটা অন্ধকার ঘরের মধ্যে যেন দম আটকে যাচ্ছিল ওর, হঠাৎ মনে হল ডাক্তারবাবু এসে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। হেমলতা একটা বড় লণ্ঠন নিয়ে আগে-আগে উঠে এলেন। ছাদের এই ঘরটা এতক্ষণে আবছা হয়ে এসেছে। হেমলতা পিছন পিছনে একজন বৃদ্ধ সরিৎশেখর, মহীতোষকে ব্যাগ হাতে নিয়ে উঠে আসতে দেখল অনি। ঘরে ঢুকেই থমকে দাঁড়াল সবাই, হারিকেনের আলোয় রক্তস্রোত পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। বৃদ্ধ লোকটি বললেন, ব্লিডিং হচ্ছে বলেননি তো!

হেমলতা বললেন, আমি একটু আগে নিচে গেলাম, তখনও দেখিনি। অনি বুঝতে পারল এই লোকটিই ডাক্তার, কারণ তৎক্ষণাৎ তিনি মাধুরীর পাশে বসে একটা হাত তুলে নিয়ে নাড়ি দেখতে লাগলেন। তারপর খুব গম্ভীরমুখে বললেন, আপনারা নিচে চলে যান। সরিৎশেখর অনিকে এক সসপ্যানটা এনে দে শিগগির।

মহীতোষ নিচ থেকে জল ওপরে দিয়ে এসে দেখলেন সরিৎশেখর অনিকে জড়িয়ে ধরে চুপচাপ সিঁড়ির শেষ ধাপে বসে আছেন। ছেলেকে দেখে সরিৎশেখর বললেন, হাসপাতালে রিমুভ করা যাবে?

ছোট ঘর থেকে আনা লণ্ঠনটা নামিয়ে মহীতোষ ঘাড় নাড়লেন, জানি না করতে হলে এখনই করা দরকার। সেনপাড়ার দিকটায় তিস্তার জল ঢুকে পড়েছে।

সরিৎশেখর বলেন, দেখলেন না মাইকে অ্যানউন্স করছে। মনে হচ্ছে এবার খুব ভোগাবে।

কথাটা শেষ করে মহীতোষ দেখলেন প্রিয়তোষ দরজায় দাঁড়িয়ে। এদের দেখেই সে চেঁচিয়ে উঠল, ফ্লাড আসছে, সামনের মাঠটা জলে ড়ুবে গেছে। চটপট মালপত্র ছাদে ভোলো।

মহীতোষ তাড়াতাড়ি বাইরে বেরিয়ে শুনলেন ওঁদের উঠোনে বাগানে জল শব্দ করছে। এতক্ষণ খেয়াল ছিল না, হঠাৎ ঠাণ্ডা বাতাস লাগতে টের পেলেন ওঁর সমস্ত জামাকাপড় ভিজে চুপসে গেছে, সরিৎশেখরেরও এক অবস্থা অন্ধকারে এতক্ষণ যেটুকু দেখা যাচ্ছিল আর তাও দেখা যাচ্ছে না। ঝিমঝিম বৃষ্টি পড়ছে আর হঠাৎ সমস্ত পৃথিবী ধাধিয়ে দিয়ে বিদ্যুৎ চমকে উঠতেই মহীতোষ দেখলেন ঘোলাজলের স্রোত উঠোনামা কিলবিল করছে।

বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে মহীতোষ দরজায় দাঁড়িয়ে বললেন, বন্যা এসে গেছে, এখন তো নিয়ে যাওয়ার কোনো প্রশ্ন ওঠে না।

প্রিয়তোষ বলল, কী হয়েছে?

মহীতোষ বললেন, তোর বউদির পড়ে গিয়ে ব্লিডিং হচ্ছে, অবস্থা সিরিয়াস।

প্রিয়তোষ বলল, সে কী! হয়েছে?

মহীতোষ বললেন, সে কী! কখন?

সরিৎশেখর একবার ওপরের দিকে তাকিয়ে জলের মধ্যে গেলেন। অন্ধকারে চলতে কষ্ট হচ্ছে, প্রিয়তোষ ওঁর পিছনে। ছোট ঘরে তখন পায়ের পাতার ওপর জল। কী নেওয়া যায় কী নেওয়া যায় ভাবতে না পেরে আবিষ্কার হল অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। দ্রুত জল বাড়ছে। হাঁটুর কাছটা যখন ভিজে গেল তখন মহীতোষ টর্চটা খুঁজে পেলেন। খাটের অনেকটা এখন জলের তলায়। লেপ তোশক নিয়ে যাবার কোনো মানে হয় না। মেঝেয় রাখা সুটকেসটা তুলে নিলেন। মহীতোষের টাকা এই সুইটকেস আছে। সুটকেসটা এর মধ্যে ভিজে ঢোল হয়ে গেছে।

নতুন বাড়ির বারান্দায় ইঞ্চি কয়েক নিচে জল। মহীতোষ ছাদের সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়াতে দেখলেন সরিৎশেখর ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কথা বলছেন। হারিকেনের আলোয় দেওয়ালে ওদের ছায়া কাঁপছে। ছেলেকে দেখে সরিৎশেখর কাপা-কাঁপা গলায় বললেন, আমি কিছু ভাবতে পারছি না মহী, ভগবান এ কী করলে!

মহীতোষ ডাক্তারবাবুর দিকে তাকাতেই তিনি বললেন, হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারলে একটা চেষ্টা করা যেত। কিন্তু যা অবস্থা-জল শুনলাম বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়েছে! মহীতোষ ঘাড় নাড়লেন।

হয়ে গেল তা হলে! ডাক্তারবাবু ছটফট করে উঠলেন, ভোরের আগে কোনোবার জল কমে। এইজন্যেই আমি আসতে চাইছিলাম না। এখন আমি যাই কী করে! অন্ধকারে জল ভেঙে যেতে কোথায় পড়ব-ইস!

মহীতোষ বললেন, ডাক্তারবাবু, আপনি চলে গেলে ওকে নিয়ে আমরা-না, আপনার যাওয়া চলবে না। আপনি ওকে দেখুন, আমি আপনার বাড়িতে খবর দিয়ে আসছি।

কথাটা শেষ হতে প্রিয়তোষ আমি খবর দিয়ে আসি বলে অন্ধকারে ছুটে বেরিয়ে গেল। সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ডাক্তারবাবু বললেন, আমি আর দেখে কী করব! চোখের সামনে মেয়েটা চলে যাচ্ছে আমি ফ্যালফ্যাল করে দেখছি। ভগবানকে ডাকুন।

সেটা বেরুলে তো বুঝতে পারা যেত। এতগুলো ইঞ্জেকশন দিলাম, রক্ত বন্ধ করা যাচ্ছে না। বিড়বিড় করে বকতে বকতে ডাক্তারবাবু ওপরে উঠে গেলেন।

এখন এখানে শুধু ঝোড়ো বাতাস ছাড়া কোনো শব্দ নেই। বাইরে তিস্তার জল নতুন বাড়ির বারান্দার গায়ে ধাক্কা লেগে যে-শব্দ তুলছে তাও বাতাসে চাপা পড়ে গেছে। মহীতোষ পাথরের মতো দাঁড়িয়ে। সরিৎশেখর নাতিকে দুহাতে জড়িয়ে ওপরের দিকে মুখ করে বসে আছেন সিঁড়িতে। লণ্ঠনের আলোয় দেওয়ালে-পড়া তাদের ছায়াগুলো নিয়ে বাতাস উদ্ভ ছবি এঁকে এঁকে যাচ্ছে। সময় এখন খোঁড়াতে খোঁড়াতে এগুচ্ছে। যে-কোনো মুহূর্তে ওপর থেকে কোনো শব্দ ভেসে আসবেএইরকম একটা আশঙ্কায় দুটো গরম কাঁটা হয়ে রয়েছে। দাদুর বুকের ওপর মাথা রেখে অনি অনেকক্ষণ ধরে দুপদুপ বাজনা শুনছিল। এতক্ষণ যেসব কথাবার্তা এখানে হয়ে গেল তার প্রতিটি শব্দ ওর কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে। মা আর থাকবে না। ডাক্তারবাবু ওদের ভগবানকে ডাকার কথা বললেন, কিন্তু কেউ ডাকছে না কেন? অনির মনে পড়ল স্বৰ্গছেঁড়ায় এক বিকেলবেলায় হেমলতা ওকে বলেছিলেন সবচেয়ে বড় ভগবান হল মা। অনি সমস্ত শরীর দিয়ে মনে মনে মাকে ডাকতে লাগল। চোখ বন্ধ করে নিঃশব্দে, মা, মা উচ্চারণ করতে করতে অনি দেখতে পেল মাধুরী ওর কাছে এসে দুহাতে ওকে জড়িয়ে ধরেছেন। মায়ের গায়ের সেই গন্ধটা বুক ভরে নিতে নিতে ও শুনতে পেল পিসিমা সিড়ির মুখে এসে বলছেন, অনিকে একটু ওপরে নিয়ে আসুন।

কথাটা শুনে তড়াক করে উঠে দাঁড়াল অনি। অন্ধকারে সিঁড়িগুলো লাফ দিয়ে পেরিয়ে এসে পিসিমার মুখোমুখি হয়ে গেল ও। অনিকে দেখে হেমলতা দুহাতে জড়িয়ে ধরলেন। অনি বুঝতে পারল পিসিমা কাঁদছেন। কয়েক পা এগিয়ে হেমলতা আবার থমকে দাঁড়ালেন। অনির মাথাটা ওঁর প্রায় কাঁধবরাবর। অনি শুনতে পেল কেমন কান্না-কান্না গলায় পিসিমা ওকে বলছেন, অনি বাবা, আমার সোনাছেলে, তোমার মা এখন ভগবানের কাছে চলে যাচ্ছেন, যাওয়ার আগে তোমাকে দেখতে চাইছেন। হুহু করে কেঁদে ফেললেন হেমলতা।

অনি বলল, মা-ই তো ভগবান। তবে মা কার কাছে যাচ্ছে।

ফিসফিস করে হেমলতা বললেন, আমি জানি না বাবা, তুমি কোনো কথা বোলে না, বেশি কেঁদো, তাহলে মার যেতে কষ্ট হবে। পিসিমার বারণ তিনি নিজেই মানছিলেন না।

মা শুয়ে আছেন চুপচাপ। ওঁর শরীর নড়ছে না। ডাক্তারবাবু মাটিতে বাবু হয়ে বসে আছেন। হেমলতা অনিকে এগিয়ে দিলেন সামনে, মাধু, অনি এসেছে দ্যাখ।

চোখের পাতা নাচল, পুরো খুলল না। অনি দেল মায়ের চোখের কোল জলে ভরে গেছে। অনি মাধুরীর মুখের পাশে মুখ নিয়ে ডাকল, মা, মাগো!

মাধুরী ঘোরের মধ্যে বললেন, অনি, বড় কষ্ট হচ্ছে রে।

ফুঁপিয়ে উঠল অনি, মা, মাগো।

মাধুরী ফিসফিস করে বললেন, আমি তোর সঙ্গে থাকব রে, তুই জেলে গেলেও তোর সঙ্গে থাকব। অনি পাগলের মতো মায়ের বুকে মুছ চেপে ধরে ফোপাতে লাগল। অনেকক্ষণ পরে বাইরের বৃষ্টির শব্দ, হাওয়ার শব্দ ছাপিয়ে হেমলতার বুকফাটা চিক্কার কানে আসতে অনি মায়ের বুক থেকে মাথা সরিয়ে অবাক হয়ে দেখল পিসিমা আর বাব পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদছে। ওর পাশ দিয়ে দুটো পা দ্রুত ছাদের দিকে চলে গেল। পেছন থেকে অনি দেখল দাদু এই বৃষ্টির মধ্যে এই অন্ধকারে ছাদে হেঁটে যাচ্ছেন।

মায়ের দিকে তাকাল অনি। স্বৰ্গছেঁড়ায় অনেক রাত্রে ঘুম ভেঙে ও মাধুরীকে এমনিভাবে শুয়ে থাকতে দেখত। ঘুমিয়ে পড়লে মাধুরী সহজে চাইতেন না। ভীষণ বাথরুম পেয়ে গেলে অনি মায়ের গায়ে চিমটি কাটত। তখন মাধুরী ধড়মড় করে উঠে বসতেন। অনি বুঝতে পারছিল আর মা উঠে বসবে না। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে অনি চিৎকার করে কেঁদে উঠল।

মাঝরাতেই জল নেমে গিয়েছিল। ভোরের আলো ফুটতে চারধার একটা অদ্ভুত দৃশ্য নিয়ে জেগে উঠল। সমস্ত শহরটার ওপর কয়েক ইঞ্চি পলি পড়ে গেছে। সূর্যের আলো পড়ায় চকচক করছে সেগুলো। ভেসে-আসা মৃত গরু-ছাগল আটকে গেছে এখানে-সেখানে। তিস্তার জল করলার মধ্যে ঢুকে যাওয়ায় নিচু জায়গাগুলো এখনও জলের তলায়। শ্মশানটা শহরে একপ্রান্তে, মাষকলাইবাড়ির কাছে। উঁচু জায়গা বলে সে অবধি জল পৌঁছায়নি। লোকজন যোগাড় করে এই পাকের ওপর দিয়ে হেঁটে শোনে আসতে দুপুর হয়ে গেল। ছোট ধরের অনেক জিনিসপত্র গেলেও খাটটা বেঁচেছে। সরিৎশেখর সেখানে সকাল থেকে শুয়ে রইলেন। কাল রাতে বৃষ্টিতে ভিজে সর্দিজ্বর হয়েছে ওঁর। বারবার বলছেন, আমার অঙ্গহানি ঠেকাতে পারল না কেউ।

মৃতদেহ নিয় যাবার লোকের অভাব হয় না। তারা সবাই হরিধ্বনি দিতে দিতে মাধুরীকে নিয়ে যাচ্ছিল। প্রিয়তোষ কাঁধ দিয়েছ। হেমলতা কাল রাত থেকেই সেই যে অনিকে জড়িয়ে ধরে বসেছিলেন মাধুরীর পাশে, একবারও ওঠেননি। কাঁদতে কাঁদতে অনি কখন তাঁর বুকে ঘুমিয়ে পড়ছে, আবার জেগেছে, হেমলতা পাথর। দেহ নিচে নামিয়ে খাটিয়া স জয়ে কেউ-একজন ডাকল তাকে, এয়োস্ত্রীকে যাবার সময় সিঁদুর পরিয়ে দিতে হয়, সিঁদুর নিয়ে আসুন। ঠিক তখনই হাউহাউ করে কেঁদে উঠলেন হেমলতা, আমি চাইনি গো, কাল সকালে জোর করে আমাকে দিয়ে সিঁদুর পরাল ও, আমি যে বিধবা, সেই পাপে মেয়েটা চলে গেল গো-।

মহীতোষ কাঁদতে কাঁদতে বললেন, থাক, সিঁদুর পরাতে হবে না।

সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠলেন সরিৎশেখর, ছোট ঘরের খাটে শুয়ে কান কাড়া করে সব কথা শুনছিলেন, খবরদার, আমার বাড়ির বউকে সিঁদুর না পরিয়ে বাইরে নিয়ে যাওয়া চলবে না।

এখন সিঁদুর-মাথায় মাধুরী শোনে পৌঁছে গেলেন। ওদের থেকে খানিক দূরত্বে ছেলের হাত ধরে মহীতোষ হেঁটে এলেন। পলি-জমা রাস্তায় হাঁটতে ছেলেটার কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু মুখে কিছু বলছে না। মহীতোষ কাল থেকে ছেলের সঙ্গে কথা বলেননি। এখন আসার সময় ভয় পাচ্ছিলেন অনি হয়তো মাধুরীকে নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঁকে করবে। কিন্তু আশ্চর্য, অনি গম্ভীরমুখে হেঁটে এল। মহীতোষের মনে হল এক রাত্রে ছেলেটা অনেক বড় হয়ে গিয়েছে।

শ্মশানে ওরা যখন চিতা সাজাচ্ছিল তখন ছেলেকে জড়িয়ে ধরে চুপচাপ বসে ছিলেন মহীতোষ। কাঁদতে ভয় করছিল অনির জন্যে। আজকে এই শ্মশানে আর কোনো চিতা জ্বলছে না। একমাত্র যেটি সাজানো হচ্ছে সেটি মাধুরীর জন্য।

হঠাৎ অনি কেমন কাঠ-কাঠ গলায় বলল, মাকে ওরা শুইয়ে রেখেছে কেন? মহীতোষ জবাব দিতে গিয়ে দেখলেন তার গলা আটকে যাচ্ছে। অনেক কষ্টে বললেন, ভগবান কাউকে নিয়ে গেলে তার শরীরটা পুড়িয়ে ফেলতে হয়।

হঠাৎ একজন এগিয়ে এল ওঁদের দিকে, দাদা, আর দেরি করা ঠিক হবে না। মুখাগ্নি তো ওই করবে? মহীতোষ ঘাড় নাড়লেন। ছেলেটি অনির হাত রুল, এসো তুমি। তারপর অনিকে নিয়ে। হাঁটতে হাঁটতে বলল, মা তো চিরকাল থাকে না, আমারও মা নেই, বুঝলে?

পরপর সুন্দর করে কাঠ সাজিয় মাধুরীকে শোয়ানো হয়েছে। মাধুরীর ল খুব বড়, চিতার একটা দিক কালো করে ঢেকে রয়েছে। প্রিয়তোষ এসে অনির পাশে দাঁড়াল। জনি দেখল কয়েকজন পাটকাঠিতে আগুন ধরাচ্ছে। মাকে খুব শান্ত দেখাচ্ছে এখন। অনি, আমি তোমার সঙ্গে আছি। মা, মাগো! অনি ড়ুকরে কেঁদে উঠতে প্রিয়তোষ বলল, কাদিস না, অনি, কাদিস না।

আগের ছেলেটি একগোছা পাটকাঠিতে আগুন জ্বালিয়ে এনে অনির সামনে ধরল, নাও, মায়ের মুখে আগুনটা একটু ছুঁইয়ে দাও।

কথাটা শুনে আঁতকে উঠল ও। সদ্যজ্বালা আগুনের শিখাটা যদিও ছোট কিন্তু লকলক করছে। সেদিকে তাকিয়ে অনি বলে উঠল, আগুন দিলে মুখ পুড়ে যাবে না!

কথাটা মহীতোষের কানে যেতে মহীতোষ ড়ুকরে কেঁদে উঠলেন। ছেলেটি আর দেরি করল না, অনির একটা হাত টেনে নিয়ে পাটকাঠির উপর চেপে ধরে নিজেই জোর করে আগুনের শিখাটা মাধুরীর মুখেইয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে আরও কয়েকটা শিখা চিতার আশেপাশে লকলক করে উঠল। যেন। প্রিয়তোষ অনিকে সরিয়ে নিয়ে এল চিতার কাছ থেকে। ওকে ধরে উলটোদিকে হাঁটতে লাগল সে। কয়েক পা হেঁটে অনি শুনতে পেল পেছন থেকে অনেকগুলো গলায় চিক্কার উঠছে, বোল হরি, হরি বোল।

হঠাৎ কাকার হাতের বাঁধন থেকে ছিটকে সরে গিয়ে অনি মায়ের চিতার দিকে ঘুরে দাঁড়াল। দাউদাউ করে অজস্র শিখা নিয়ে আগুন জ্বলছে। শব্দ হকোঠ পোড়ার। আগুন। মশ দলা পাকিয়ে লাল হয়ে নাচতে শুরু করেছে। অনি আগুনের মধ্যে অপই একটা অবয়ব দেখা পেল, যাকে মা। বলে কিছুতেই চেনা যায় না।

যে-ছেলেটি ওর হাত ধরে মুখাগ্নি করাল সে অনির দিকে এগিয়ে এল, তোমার হাতে কী লেগেছে? শুকিয়ে কালচে হয়ে আছে।

নিজের হাতটা চোখের সামনে ধরতেই অনির মনে পড়ে গেল একটা লাল হয়ে নাচতে শুরু করেছে। অনি আগুনের মধ্যে অস্পষ্ট একটা অবয়ব দেখতে পেল, যাকে মা বলে কিছুতেই চেনা যায় না।

যে-ছেলেটি ওর হাত ধরে মুখাগ্নি করাল সে অনির দিকে এগিয়ে এল, তোমার হাতে কী লেগেছে। শুকিয়ে কালচে হয়ে আছে!

নিজের হাতটা চোখের সামনে ধরতেই অনির মনে পড়ে গেল একটা লাল স্রোতের কথা, কাল রাত্রে মায়ের শরীর থেকে যেটা বেরিয়ে এসেছিল। কখন সেটা শুকিয়ে কালচে হয়ে গেছে, রক্ত বলে চেনা যায় না। হাউমাউ করে কেঁদে উঠল সে, কাঁদতে কাঁদতে বলল, মার রক্ত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *