পর্ব এক
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
৬৩০ খৃস্টাব্দের ৫ ফেব্রুয়ারি, ৮ হিজরী সনের ১৫ শাওয়াল। রাসূল সাঃ তায়েফ অবরোধ করলেন। হুনাইন ও আউতাসে তুমুল লড়াই করে তায়েফ, পৌছে মুসলিম লস্কর। তায়েফ শহরকে অবরোধ করার প্রাক্কালে বেঈমানদের আতঙ্ক আল্লাহর তরবারী নামে খ্যাত খালিদ বিন ওয়ালিদ মারাত্মকভাবে আহত হলেন। খালিদের আঘাত খুবই মারাত্মক। জীবনের আশা নেই। জীবন মৃত্যুর মুখোমুখী খালিদ। বীর বাহাদুর খালিদ শত্রু পক্ষের আঘাতে অশ্বপৃষ্ঠ থেকে পড়ে গিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছেন না। শত্রু বাহিনীর অসংখ্য ধাবমান ঘোড়া তার ওপর দিয়ে চলে গেছে। এমতাবস্থায় খালিদ যে জীবিত রয়ে গেছেন সেটিই ভাগ্যের ব্যাপার। রাসূলের জীবনে এটি ছিল হক ও বাতিলের মধ্যে একটি যুগান্তকারী লড়াই। আবু বকর, ওমর ও আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু-এর মতো প্রথম সারির সকল সাহাবীই লড়াইয়ে লিপ্ত।
রাসূল সাঃ-এর নেতৃত্বে তায়েফ এলাকার অধিবাসী বনী ছাকিফ ও হাওয়াযিন কবিলার মোকাবেলায় লিপ্ত। তায়েফ অঞ্চলে বনী ছাকিফ ও হাওয়াযিন কবিতা যুদ্ধবাজ হিসাবে খ্যাত। মালিক বিন আউফ নামে ত্রিশ বছরের এক যুবক মুসলিম বাহিনীর বিরুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছে। মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে এমন কঠিন লড়াইয়ে নেতৃত্বদানের কথা শুনতে অবাক লাগলেও মালিক বিন আউফ এতো অল্প বয়সেই যুদ্ধবাজ কবিলা দুটির সেনাপতিত্ব করার সময় যোগ্যতার অধিকারী। কবিলা দুটির মধ্যে মালিক বিন আউফের কোন জুড়ি নেই। মালিক বিন আউফ কবিলা দুটির জন্য বিস্ময়কর যুদ্ধ প্রতিভা, আশা ভরসা ও সকলের গর্ব। তরুণ মালিক বিন আউফ, তার কৌশলী চালে হুনাইন ও আউতাসে মুসলিম বাহিনীকে পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছিল। তার কৌশলী চালে এক পর্যায়ে মুসলিম বাহিনীর দুটি ইউনিট পশ্চাদপসারণ করতে বাধ্য হয়।
খালিদ বিন ওয়ালিদ জীবন মৃত্যুর মুখোমুখি। ক্ষতস্থান থেকে মাত্রাতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে তাঁর শরীর অসাড় হয়ে পড়ে। রাসূল সাঃ তাঁকে দেখে ক্ষতস্থানে ফুঁ দিলেন। এতে খালিদ চোখ মেলে তাকালেন। রাসূল সাঃ-এর বরকতময় স্পর্শে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন খালিদ। এরপর মারাত্মক আঘাত নিয়েই শেষ অবধি রণাঙ্গনে অবিচল থাকলেন তিনি। তায়েফ অবরোধ ছিল এ যুদ্ধের শেষ ও চূড়ান্ত মহড়া। হুনাইনে রাসূলে কারীমের নেতৃত্বে সাহাবায়ে কেরাম চরম আঘাত হানলে ছাকিফ ও হাওয়াযিন গোত্র মুসলিম বাহিনীর আক্রমণে পিছু হঠতে বাধ্য হয়। পশ্চাদপসারণ করে কবিলা দুটি দুর্গসম তায়েফ শহরে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। পশ্চাদপসারণ করলেও তাদের মনোবল এতোটুকু দুর্বল হয়নি। বরঞ্চ তারা ছিল অপরাজিতের আত্মপ্রশংসায় উকুল্ল। দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করে মালিক বিন আউফ ঘোষণা করল, “আমরা মুসলমানদের ভয়ে আশ্রয় নেইনি, বরং মুসলমানদেরকে আমাদের ইচ্ছে মতো যুদ্ধ করাতেই দুর্গে এসেছি।”
দীর্ঘ আঠারো দিন অবরোধ বহাল রাখা হলো। মুসলমানরা বিপুল উৎসাহে দুর্গপ্রাচীর ডিঙ্গানোর জন্য আক্রমণ করতে গিয়ে শত্রুপক্ষের শরাঘাতে আহত ও নিহত হতে লাগল। অবরোধ শেষে রাসূল সাঃ শীর্ষস্থানীয় সাহাবী আবু বকর, ওমর ও আব্বাস প্রমুখের সাথে পরামর্শ বৈঠকে বসলেন। নেতৃস্থানীয় সাহাবায়ে কেরাম অবরোধ প্রত্যাহার করে মদিনায় ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু অধিকাংশ সাহাবী ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে প্রবল আগ্রহ প্রকাশ করলেন। অধিকাংশ সাহাবী দুর্গপ্রাচীর ডিঙিয়ে দুর্গ জয় করার জন্য উদগ্রীব ছিলেন। সাহাবায়ে কেরামের প্রবল আগ্রহে রাসূল সাঃ আর একবার দুর্গপ্রাচীর ডিঙানোর অনুমতি দিলেন। অনুমতি পেয়ে সাহাবায়ে কেরাম দুর্গপ্রাচীরে তীব্র আঘাত হানলেন। কিন্তু দুর্গপ্রাচীরের ওপর থেকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করা হলো। এতে বহু সংখ্যক সাহাবী আহত ও নিহত হলেন। তাঁদের পক্ষে আর প্রাচীর ডিঙানো সম্ভব হলো না। বাধ্য হয়ে তাদের পিছু হটতে হলো।
অবশেষে অবরোধ প্রত্যাহার করা হলো। মুসলমানদের অধিকাংশ যোদ্ধাই ছিলেন আহত। তাদের হতাহতের সংখ্যাও ছিল প্রচুর। অনেকেই শাহাদত বরণ করেন। আহতদের অনেকেই ছিলেন চলাচলে অক্ষম। পঙ্গু হয়ে পড়েছিলেন বহু সাহাবী। অধিকাংশ যোদ্ধা আহত থাকার কারণে দ্রুত তাঁবু গুটিয়ে প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা করা তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। তবু
গোটাতে প্রয়োজনের তুলনায় বেশী সময়ের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তাছাড়া খুব বেশী আহতদের জন্য প্রয়োজন ছিল নিরবচ্ছিন্ন বিশ্রাম। রাসূল সাঃ আহতদের বিশ্রাম ও চিকিৎসার জন্য দুর্গ এলাকা থেকে তাঁবু গুটিয়ে জিরানায় পৌছে তাঁবু ফেলেন।
মুসলমানরা ব্যর্থ হয়ে প্রত্যাবর্তন করছিলেন। তাঁদের প্রত্যাবর্তন শুধু ব্যর্থতার গ্লানিই বহণ করছিল না, বিপুল সংখ্যক সহযোদ্ধাকে হারানো ও আহত হওয়ার যাতনাও তাদের মধ্যে সৃষ্টি করেছিল প্রচণ্ড মনোকষ্ট। তায়েফ নগরী নিত্যদিনের মতোই অপরিবর্তিত ছিল, অজেয় দুর্গপ্রাচীরে যেন মুসলমানদের ব্যর্থতায় উপহাস করছিল। কিন্তু প্রচণ্ড যাতনা, ব্যর্থতার গ্লানিকে ছাপিয়ে গেল আকস্মিক এক ঘটনা। যেন অলৌকিক ঘটনার মতোই ঘটে গেল ব্যাপারটি। জিরানা থেকে মুসলমানরা তখনও তাঁবু গুটিয়ে মদিনার দিকে রওয়ানা হননি, এমন সময় বনী ছাকিফ কবিলার শীর্ষস্থানীয় ক’জন লোক মুসলমানদের শিবিরের দিকে এগিয়ে এলো। তারা শিবিরের কাছে পৌছে প্রহরীদের কাছে রাসূলুল্লাহ সাঃ-এর সাথে সাক্ষাতের অনুমতি চাইলো। তাদেরকে রাসূল সাঃ-এর কাছে নিয়ে গিয়ে কয়েকজন শক্তিশালী সাহাবী নাঙ্গা তরবারী ও বর্শা নিয়ে সতর্ক প্রহরা দিতে লাগলেন।
কারণ প্রবল শত্রু পক্ষের এই লোকগুলোকে কোন অবস্থাতেই মুসলমানরা নিরাপদ ভাবতে পারছিলেন না। কেননা, বেশ কয়েকটি অমুসলিম গোত্র নবীজী সাঃ-কে হত্যা করার অব্যাহত চক্রান্ত করছিল। হাওয়াযিন গোত্রের জন্য সমূহ বিপদ সৃষ্টি করেছিল মুসলমানদের হাতে বন্দি তাদের কিছু সংখ্যক নারী ও শিশু। দুর্গ অবরোধের আগে এক যুদ্ধে ওদের পরাজয় ঘটে। তাতে কিছু সংখ্যক হাওয়াযিন নারী ও শিশু মুসলমানদের হাতে বন্দি হয়। তখনকার নীতিতে এরা ছিল যুদ্ধ বন্দি। পরাজয় কিংবা বিজয় অথবা সামরিক চুক্তি ছাড়া তাদের পক্ষে মুসলমানদের হাতে বন্দি হওয়া নারী শিশুদের ফিরে পাওয়ার কোন পথ ছিল না। এদিকে রাসূল সাঃ ঘোষণা করে দিলেন যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পরও যদি শত্রু পক্ষের কোন ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করে, তাহলে তার সকল সম্পদ ফিরিয়ে দেয়া হবে।
হাওয়াযিন গোত্রের আগত লোকদের মধ্য থেকে নেতৃস্থানীয় এক লোক বলল “হে মুহাম্মদ! আমাদের কবিলার লোকসহ সবাই আপনাকে আল্লাহর রাসূল হিসাবে মেনে নিয়েছে। আমাদের কবিলার সবাই আপনার ধর্মে দীক্ষা নিয়েছে।”
আল্লাহর কসম! তোমরা কল্যাণের পথ অবলম্বন করেছ। এটাই “সীরাতে মুস্তাকীম” বললেন রাসূল সাঃ।
কবিলার সর্দার বলল, “হে মুহাম্মদ! আপনি তো আল্লাহর রাসূল! আপনি কি আমাদের নারী শিশু ও সহায়-সম্পদ ফিরিয়ে দেবেন?” “আমাদের সাথে যুদ্ধ করে এবং আমাদের লোকজনকে হত্যা করে যে সব জিনিস তোমরা হারিয়েছ, সেগুলো ফিরে পাওয়ার কোন অধিকার তোমাদের নেই” বললেন রাসূল সাঃ। তবে যে একক ও অদ্বিতীয় আল্লাহকে তোমরা মহান প্রভু ও রব হিসাবে মেনে নিয়েছ, তার সম্মানে তোমাদের আমি হতাশ করবো না। তোমাদের কাছে নারী শিশু নাকি সহায়-সম্পদ বেশী প্রিয়?
“আপনি আমাদের নারী শিশুদের অন্তত ফিরিয়ে দিন।” বলল প্রতিনিধি দলের নেতা। রাসূল সা, হাওয়াযিন কবিলার নারী শিশুদেরকে মুক্ত করে দেয়ার নির্দেশ দিলেন।
হাওয়াযিন গোত্রের নেতাদের কাছে রাসূল সাঃ-এর এই উদারতা ছিল আশাতীত। রাসূলের এই উদারতায় গোটা হাওয়াযিন গোত্রের লোক ইসলামে দীক্ষা নিলো। এ ঘটনার দুই তিনদিন পর অজ্ঞাত পরিচয় এক ব্যক্তি মুসলমান শিবিরে অনুপ্রবেশ করতে চাইলো। লোকটির মাথা ও চেহারা ছিল কাপড়ে ঢাকা। চোখ দুটো ছাড়া তার কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। নিরাপত্তারক্ষী সাহাবায়ে কেরাম যখন তার প্রবেশ পথ আগলে দাঁড়ালেন, তখন সে নিজের পরিচয় না বলেই রাসূল সাঃ-এর সাথে সাক্ষাতের আগ্রহ প্রকাশ করল।
“তুমি কি তায়েফ থেকে আসনি? জিজ্ঞেস করলেন একজন নিরাপত্তারক্ষী।
“হ্যাঁ, তায়েফের দিক থেকেই এসেছি আমি।” বলল আগন্তুক। কিছু সংখ্যক মুসলমান যোদ্ধা ফকীর ও উট চারকের বেশে তায়েফ দুর্গের আশে পাশে বিচরণ করছিলেন, ওদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের জন্য। কারণ অবরোধ তুলে নিয়ে প্রত্যাবর্তনকালে মুসলমানদের দুর্বলতার সুযোগে ওরা কোন অতর্কিত হামলা করে কি-না এ বিষয়টি আগে ভাগেই জানার জন্য রাসূল সা, এ গোয়েন্দা ব্যবস্থা করেছিলেন। এসব সাহাবীদের কয়েকজন দুর্গফটক পেরিয়ে এই লোকটিকে মুসলিম শিবিরের দিকে অগ্রসর হতে দেখে ওর পিছু
নেন। শিবিরের নিকটবর্তী হলে তার পথ রোধ করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলে সে নিজের পরিচয় না বলেই নবীজীর সাথে সাক্ষাতের আগ্রহ প্রকাশ করে।
“আমরা তোমাকে তায়েফ দুর্গ থেকে বের হতে দেখেছি বললেন এক সাহাবী। আল্লাহর কসম! তুমি সংকল্পে সফল হতে পারবে না।” “যে সংকল্প নিয়ে এসেছি তা পূর্ণ করেই যাব।” বলল আগন্তুক। তোমরা কি আমাকে রাসূলুল্লাহ সাঃ-এর কাছে যেতে দেবে না?”
“কিভাবে দেবো? তুমি এখনো পর্যন্ত আমাদেরকে তোমার চেহারাই দেখাচ্ছ না।” একটানে চেহারা থেকে কাপড় সরিয়ে ফেলল আগন্তুক। আল্লাহর কসম! তুমি তো মালিক বিন আউফ। তোমার পথ রোধ করার শক্তি আমাদের নেই। দুই তিনজন সাহাবী মালিক বিন আউফকে নবীজীর সকাশে নিয়ে গেলেন।
“বিন আউফ! কোন প্রস্তাব নিয়ে এসেছ, নাকি অন্য কোন উদ্দেশ্য আছে?” জিজ্ঞেস করলেন রাসূল সাঃ।
‘আমি আপনার ধর্মে দীক্ষা নিতে এসেছি” বলল মালিক বিন আউফ। ঠিক সেই মুহূর্তেই ছাকিফ গোত্রপতি মালিক বিন আউফ নবীজীর হাতে হাত রেখে ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নিলেন। মালিক বিন আউফ কেন ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন ইতিহাস এ ব্যাপারে নীরব। মালিক বিন আউফ যখন রাসূল সাঃ-এর হাতে হাত রেখে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে ইসলামে দীক্ষা নিলেন, তখন তার ওপর কোন ধরনের চাপ ছিল না। দৃশ্যত সে তখন বিজয়ী গোত্রের সেনাপতি। বস্তুত মালিক বিন আউফের ইসলাম গ্রহণের কোন যৌক্তিক কারণ ছিল না। হতে পারে হাওয়াযিন গোত্রের প্রতিনিধিদের প্রতি সদয় হয়ে রাসূল সাঃ তাদের নারী ও শিশুদের মুক্ত করে দেয়া এবং হাওয়াযিন গোত্রের সকল লোক ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারটি মালিক বিন আউফকে প্রভাবিত করেছিল। ইসলাম গ্রহণের পর ছাকিফ গোত্রের এই বীরযোদ্ধা ইসলামের পক্ষে অনেকগুলো যুদ্ধে বীরত্বের সাথে লড়াই করেন। আজো তায়েফ ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী হয়ে রয়েছে।
আজ থেকে এক হাজার চারশ বছর আগে রাসূল সাঃ তায়েফ শহর অবরোধ করেছিলেন। তায়েফবাসীদের জীবনপণ মোকাবিলার কারণে শেষ পর্যন্ত মুসলিম বাহিনীকে অবরোধ প্রত্যাহার করে ফিরে আসতে হয়েছিল।
আল্লাহ তাআলা সেই অবরোধের চৌষট্টি বছর পর তায়েফকে এমন এক সৌভাগ্যে উদ্ভাসিত করলেন যা ইতিহাসের পাতায় চিরকাল মাইল ফলক হয়ে থাকবে। আর সেই সৌভাগ্যের প্রথম মাইল ফলক ছিল বনী ছাকিফ গোত্রের বীর পুরুষ মালিক বিন আউফের ইসলাম গ্রহণ। ৬৯ হিজরী সনের ঘটনা। তায়েফের অধিবাসী এক তরুণীবধু সন্তান সম্ভবা হলেন। তরুণির স্বামী ইসলামী সালতানাতের একজন তুখোড় সৈনিক। সেনাবাহিনীতে সে উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত। ছুটির অবসরে সেই সেনা বাড়িতে এলে স্ত্রী লাজনম্রকণ্ঠে স্বামীকে জানালো অন্তঃসত্তা সে। অনাগত সন্তানের চেহারা দেখার আশায় সে বুক বেঁধে রয়েছে।
সেই সাথে স্ত্রী এও জানালো, ভয়ংকর একটি স্বপ্ন দেখে সে ভীত হয়ে পড়েছে। তার স্বপ্নময় প্রত্যাশার আশপাশে উঁকি দিচ্ছে কতগুলো ভীতিকর ভূতুড়ে শঙ্কা। তরুণী স্বামীকে জানালো- আমি স্বপ্নে দেখেছি হঠাৎ আমার ঘরটি ঘুটঘুটে অন্ধকারে ছেয়ে গেছে, এমন ঘন অন্ধকার যে, আমি নিজের হাত-পা পর্যন্ত দেখতে পারছিলাম না। ভয়ে আতঙ্কে আমি জড়সড় হয়ে গেলাম। আমার ভয় হচ্ছিলো ভয়ংকর কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। কিন্তু কি হচ্ছে তা আমি বুঝতে পারছিলাম না। আমি ঘরে একা ছিলাম। খুব জোরে চিৎকার করে কাউকে ডাকতে চাচ্ছিলাম; কিন্তু আমার মুখ থেকে একটুও শব্দ বের হচ্ছিলো না। মনে করছিলাম ঘর থেকে দৌড়ে বের হয়ে যাই, কিন্তু তাও পারছিলাম না। শত চেষ্টা করেও আমার পা এক কদমও উঠাতে পারছিলাম না।
গভীরভাবে ব্যাপারটি ভাবতে চেষ্টা করি কিন্তু সব চিন্তা-ভাবনাই কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। কোন কিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না…।
কিন্তু মনে মনে আল্লাহ্ আল্লাহ্ করছিলাম। আর নানা দোয়া-কালাম পাঠ করছিলাম। এতোটুকু বোধ আমার অক্ষুন্ন ছিল। এমন সময় দূর আকাশের এক কোণে একটি তারা দেখা দিলো, তারাটি প্রথমে আবছা আলো আঁধারে অস্পষ্ট ছিল। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তারাটি ঝকমকে দীপ্তিমান হয়ে উঠল। ধীরে ধীরে আসমানের তারাটি আমার দিকে নেমে এলো। আঁধার ধীরে ধীরে সরে যেতে লাগল। দেখতে দেখতে আলোকিত তারাটি আমার ঘরে এসে পড়ল, এতে আমার ঘরটি আলোয় ভরে গেল। এ যেন জমিনের কোন আলো নয়, অন্য রকম আসমানী নূর। এ আলোয় আমার ভয় ভীতি সব দূর হয়ে গেল। মনটা এক ধরনের প্রশান্তিতে ভরে গেল। ঠিক এ সময়ই আমার ঘুম ভেঙে গেল।”
“মন্দ কোন স্বপ্ন দেখোনি। মনে তো হয় ভালোই দেখেছে” বলল তরুণির সৈনিক স্বামী।
“কিন্তু অন্ধকারটা কি দেখলাম?” অন্ধকারটার কথা মনে হলে আমার কেমন যেন ভয় লাগে। আচ্ছা, তুমি কি এমন কোন আলেম চেনো যে স্বপ্নের তা’বীর ভালো বলতে পারে?” “ভাগ্যে যা লেখা রয়েছে তা কেউ বদলাতে পারে না। স্বপ্নের তাবীর যদি ভালো না হয়, তা কি তুমি বদলাতে পারবে?” বলল স্বামী।
“মন্দের কথা মুখে এনো না। আমার বিশ্বাস ভালোই হবে। আগে তুমি জিজ্ঞেস তো করবে? জিজ্ঞেস না করে নিজে নিজেই কেন ব্যাখ্যা দিচ্ছো? স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানার জন্য এ সেনা অফিসারের যুবতী স্ত্রী স্বামীর কাছে জিদ ধরল। স্ত্রীর সন্তুষ্টি বিধানে অবশেষে সৈনিক স্বামী তায়েফের সমকালীন শ্রেষ্ট বুযুর্গ ইসহাক বিন মূসার শরণাপন্ন হলো। ইসহাক বিন মূসার কাছে ব্যক্ত করল স্ত্রীর স্বপ্নের আদি অন্ত। ইসহাক বিন মূসা স্বপ্নের ব্যাখ্যায় পারদর্শী ছিলেন। তিনি স্বপ্নের বর্ণনা শুনে গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন। অনেকক্ষণ নীরবে বসে থাকতে দেখে অনাগত সন্তানের সৈনিক পিতা বলল, “বলুন ইবনে মূসা! স্বপ্নের ব্যাখ্যা যদি মন্দও হয়, তবুও আমাকে বলুন। তাতে আমি ঘাবড়ে যাবো না।”
“না না। তাবীর মোটেও মন্দ নয়” বললেন ইসহাক বিন মূসা। তোমার স্ত্রীর গর্ভে এমন এক ছেলে জন্ম নেবে আকাশের উজ্জ্বল তারকার মতো যার দ্যুতি সারা জগতে ছড়িয়ে পড়বে। সে আল্লাহর দ্বীনের আলো দুনিয়ার দিকে দিকে বহু জনপদে ছড়িয়ে দেবে। শত শত বছর পরের লোকজনও তার কথা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে। তার নির্দেশে মুসলিম যোদ্ধারা বহু দূর পর্যন্ত ইসলামের বিজয় কেতন উড়িয়ে দেবে। কিন্তু…!”
ইসহাক কথা শেষ না করেই নীরব হয়ে গেলেন। মনে হচ্ছে তিনি কোন কথা নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখতে চান। “আল্লাহর কসম! ইবনে মূসা! আপনার এই থেমে যাওয়া খুবই রহস্যজনক। আমি যে কোন মন্দ খবরও শুনতে প্রস্তুত। আপনি নির্ধিধায় বলুন। আমাকে সংশয়ের মধ্যে না ফেলে আপনি যা বুঝতে পেরেছেন তা সরাসরি বলুন।” “তাহলে শোনা যে তারকা সদৃশ সন্তান তোমার ঘর আলোকিত করবে, সে এমন তারকাদের অন্তর্ভুক্ত যেসব তারকা অল্প সময়ের মধ্যে হারিয়ে যায়,
খসে পড়ে। অবশ্য দৃশ্যত এসব তারকা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও এদের আলো থাকে দীর্ঘ সময়। এ সন্তান তোমার ঘরে বেশীদিন না থাকলেও তোমার ঘর অন্ধকার হবে না। মানুষের মনে সে জীবিত থাকবে অনন্তকাল। তোমার ঘর আলোকিত থাকবে সারাজীবন। মানুষ মনমুকুরে তার স্মৃতি ধরে রাখবে, তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।”
“তাহলে আমিও তাকে এমনভাবে লালন-পালন করবো, যাতে সে ইসলামের উজ্জ্বল তারকা হিসাবে নিজেকে আলোকিত করতে পারে।” বলল ভাবী সন্তানের পিতা। “একথাও তোমার জেনে রাখা দরকার, এ সন্তানের লালন-পালনের সুযোগ তোমার হবে না, সে বড় হবে তোমার স্ত্রীর আদর-সোহাগে।”
কেন? আমি তাকে লালন-পালন করতে পারবো না কেন?
“সে কথা আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। আমার যা বলার ছিল আমি বলে দিয়েছি” বললেন ইসহাক বিন মূসা।
ভাবী সন্তানের সৈনিক পিতা ইসহাক বিন মূসার দরবার ত্যাগ করে স্ত্রীর কাছে ইসহাকের দেয়া স্বপ্নের ব্যাখ্যা সবিস্তারে ব্যক্ত করল।
স্ত্রী স্বপ্নের ব্যাখ্যা শুনে অজানা আশাবাদে উৎফুল্ল হলো বটে, কিন্তু সন্তানের হায়াত কম হবে ভেবে দুশ্চিন্তায় ডুবে গেল। সন্তান প্রসবের দিনক্ষণ যখন ঘনিয়ে এলো, তখন ভাবী সন্তানের সৈনিক পিতাকে সরকারীভাবে গুরুত্বপূর্ণ এক যুদ্ধে অনেক দূরে পাঠিয়ে দেয়া হলো। সেই যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করল সে। পিতার মৃত্যুতে ইসহাক বিন মূসার আশঙ্কাই বাস্তবরূপ লাভ করল যে, ভাবী সন্তানকে তার পিতা লালন-পালন করার সুযোগ পাবে না। পরবর্তীতে ইসহাক বিন মূসা এ ঘটনার ব্যাখ্যায় বলেন, ভাবী সন্তানের মা স্বপ্নের প্রথমে যে অন্ধকার দেখেছিল, তা ছিল ভাবী সন্তানের পিতা ও তার স্বামীর মৃত্যুজনিত অন্ধকার, যে অন্ধকারে আলোকবর্তিকা হয়ে ঘর আলোকিত করবে এ সন্তান।
পিতার মৃত্যু হলো তায়েফ থেকে বহু দূরে। মৃত্যু সংবাদ স্ত্রীর কাছে পৌছার কিছুদিনের মধ্যেই মৃত সৈনিকের ঘর আলোকিত করে জন্ম নিলো এক দীপ্তিময় পুত্র সন্তান। নবজাতক শিশু খুব নাদুস নুদুস। শিশুর চওড়া কপাল, দ্যুতিময় দুটো চোখ, উন্নত নাসিকা, কান্তিময় চেহারা, প্রগাঢ় দৃষ্টি আর আকর্ষণীয় অঙ্গভঙ্গি দেখে যে কারো মনে হতো এ শিশু সাধারণ কোন শিশু নয়, এ অন্য শিশুদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।
অকস্মাৎ মৃত্যুবরণকারী সৈনিকের নাম ছিল কাসিম বিন ইউসুফ। আর নবজাতক শিশুর নাম রাখা হলো মুহাম্মদ বিন কাসিম। এই মুহাম্মদ বিন কাসিমই পরবর্তীকালে জগৎ বিখ্যাত ভারত বিজয়ী মুহাম্মদ বিন কাসিম ইতিহাসের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসাবে পরিচিত। কাসিম বিন ইউসুফ আর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ছিলেন আপন ভাই। তখন খলিফা ছিলেন আব্দুল মালিক বিন মারওয়ান। কাসিম ও হাজ্জাজ ছিলেন যুদ্ধ বিদ্যা ও রণকৌশলে খুবই পারদর্শী। খলিফার সেনাবাহিনীতে উভয়েই উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত। সময়টি ছিল এমন যখন মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ বিলীন হয়ে যাচ্ছিল। ক্ষমতা ও প্রভাব বিস্তারের জন্য ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে লিপ্ত ছিল মুসলিম সম্প্রদায়। ইসলামী খেলাফতেও তখন দেখা দিয়েছিল ভাঙন। দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে ইসলামী খেলাফত। ইসলামী খেলাফত সিরিয়া ও মিসরে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের ইরাক ও হিজাযে স্বাধীন হুকুমত প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি উমাইয়া খেলাফতের আনুগত্য করতে অস্বীকৃতি জানান। ফলে উমাইয়া শাসকদের সাথে তার দেখা দেয় সংঘাত।
আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকরের খ্যাতিমান দৌহিত্র। তিনি ইয়াযীদ বিন আমীরে মুআবিয়ার আনুগত্য করতেও অস্বীকৃতি জানান এবং হিজায ও ইরাকের মুসলমানদের একত্রিত করে পাল্টা সরকার গড়ে তোলেন। ইয়াযীদের পুত্র মুআবিয়া বিন ইয়াযীদ যখন শাসন কাজ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করার ঘোষণা করেন, তখনই উমাইয়া শাসনের সূচনা ঘটে। সেই সাথে নবী বংশ তথা ফাতেমীদের বিরুদ্ধে শুরু হয় জুলুম অত্যাচার। আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের ফাতেমীদের ওপর জুলুম অত্যাচারের বিরুদ্ধে পাহাড়ের মতো দৃঢ় মনোবল নিয়ে রুখে দাঁড়ান। উমাইয়া শাসকরা আব্দুল্লাহ বিন যুবায়েরের শাসনের পতন ঘটানোর জন্য প্রথমে ইরাকে সেনাভিযান চালায়। ইরাক কব্জা করার পর পবিত্র হিজাযেও সৈন্য প্রেরণ করে এবং আক্রমণ চালায় মক্কা শরীফে। উমাইয়া শাসকদের হয়ে উভয় অভিযানেই সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেন হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। মদিনা শরীফের অবরোধ ভেঙে ফেলার জন্য হাজ্জাজ বিন ইউসুফ বাইতুল্লাহ শরীফের ওপরও মিনজানিক থেকে ভারী পাথর নিক্ষেপ করেন। ফলে বাইতুল্লাহ শরীফের ইমারত ক্ষগ্রিস্ত হয়। অবশেষে আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের জুলুমের বিরুদ্ধে আপোসহীন সংগ্রামে নিজের জীবন উৎসর্গ করেন। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ খলিফা আব্দুল মালিক বিন
মারওয়ানের খেলাফতের বিরুদ্ধবাদীদেরকে দমনে পোড়ামাটি নীতি অবলম্বন করেন। তিনি ব্যাপক ধ্বংস ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে মালিক বিন মারওয়ানের খেলাফত বিরোধীদের পরাস্ত করেন। নির্মম ও কঠোর দমননীতির কারণে জালেম ও অত্যাচারী শাসক হিসাবে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ইতিহাসে কুখ্যাত হয়ে রয়েছেন। নিজের নির্মম ও নিষ্ঠুরতার সাক্ষী হিসাবে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ আব্দুল্লাহ বিন যুবায়েরকে শহীদ করে তাঁর মৃতদেহ চৌরাস্তায় কয়েকদিন পর্যন্ত ঝুলিয়ে রাখেন। হাজ্জাজ বিন ইউসুফের অত্যাচারের ভয়ে মক্কার লোকেরা আব্দুল্লাহ বিন যুবায়েরের মরদেহকে ঝুলন্ত অবস্থা থেকে নামিয়ে আনার সাহস করেনি। আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের এর বৃদ্ধা ও দৃষ্টিশক্তিহীনা মাতা আবু বকর তনয়া হযরত আসমা লাঠিতে ভর দিয়ে চৌরাস্তায় ঝুলন্ত তাঁর আত্মজের মরদেহে লাঠি দিয়ে ঠোকা দিয়ে কাঁপা কণ্ঠে আবৃত্তি করেন সেই বিখ্যাত পক্তি- “এ কোন্ অশ্বারোহী! এখনো যে অশ্বপৃষ্ঠ থেকে অবতরণ করেনি।”
আব্দুল্লাহ বিন যুবায়েরের শাহাদাতের পর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ উমাইয়া খেলাফতের অধীনতা বরণ করেন। উমাইয়া খলিফা তাকে হেজাযের গভর্নর নিয়োগ করেন। হাজ্জাজ গভর্নর হওয়ার সাথে সাথে হিজাযের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে। অপরদিকে ইরাকের অধিবাসী খারেজী সম্প্রদায়ভুক্ত লোকেরা বিদ্রোহ ও খলিফার বিরুদ্ধাচরণ করতে শুরু করে। তাদের বিরোধিতা দমনেও খলিফা গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফকে দায়িত্ব দেন। এক পর্যায়ে রক্তাক্ত যুদ্ধের পর খলিফা মালিক বিন মারওয়ান খারেজীদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হন।
খারেজীদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়েই হাজ্জাজের আপন ভাই কাসিম মৃত্যুবরণ করেন। ফলে তার ঔরসে জন্মলাভকারী তারকা সন্তানের মুখ দেখা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। ভাই কাসিম ছিলেন হাজ্জাজের ডান হাত। বড় সহযোগী। হাজ্জাজের ভ্রাতুস্পুত্র মুহাম্মদ বিন কাসিম তাঁর ঐকান্তিক সাহসিকতা, ন্যায়পরায়ণতা ও বিজয়কীর্তি দিয়ে চাচা হাজ্জাজের জুলুম অত্যাচারের উপাখ্যানকে কিছুটা হলেও ম্লান করে দিতে সক্ষম হন। বীরত্ব ও সাহসিকতায় মুহাম্মদ বিন কাসিম এমন ইতিহাস রচনা করেন যে, অমুসলিমরা তার আদর্শিকতা ও ন্যায়পরায়ণতার কারণে তাকে পূজা করতে শুরু করে।
মুহাম্মদ বিন কাসিম যখন দুনিয়ার আলো দেখলো তখন তার ঘরে দুঃখের বিষাদ ছেয়ে গেছে! নবজাতক শিশুর পিতার মৃত্যুশোকে তার মা ও
আপনজন শোকাতুর। শিশু জন্মের খবর হাজ্জাজের কানে পৌছা মাত্রই তিনি ছুটে এলেন। হাজ্জাজ এলে শিশুকে তার কোলে তুলে দেয়া হলো। শিশুকে দু’হাতে নিয়ে তিনি ঘরে প্রবেশ করলেন। “এ শিশুর পিতা মৃত্যুবরণ করেছে বটে কিন্তু একে তুমি এতীম মনে করো না। আমি যতোদিন বেঁচে আছি মনে করো ওর বাবাই বেঁচে আছে। ছোট বউ! তুমি হয়তো জানো না, আমার এই ভাইটি আমার কতো প্রিয় ছিল। সে আমার ছোট হলেও আমরা ছিলাম খুবই ঘনিষ্ঠ। তোমার স্বপ্নের কথা এবং ইসহাক বিন মূসার স্বপ্নের ব্যাখ্যার কথা সে আমাকে জানিয়েছে। তুমি মনে রেখো, তোমার এই সন্তান শুধু তায়েফের নয় সারা আরব জাহানের তারকা হবে। তুমি কখনও নিজেকে বিধবা ও একাকী ভেব না। এই শিশুর দাদার খুনের কসম! যে খুন এই শিশুর শরীরে প্রবাহমান। আমি একে এমন শিক্ষা ও দীক্ষা দেব শত শত বছর পরও আরবের লোকেরা তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। যুগের পর যুগ সে বেঁচে থাকবে মানুষের হৃদয়রাজ্যে ও অন্তরের মণিকোঠায়।”
হাজ্জাজ বিন ইউসুফের এসব কথা আবেগতাড়িত বক্তব্য ছিল না। তিনি মুহাম্মদ বিন কাসিমের রাজকীয় লালন-পালন ও শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থা করে দিলেন। তার জন্যে বিশেষ শিক্ষক রাখার ব্যবস্থা হলো। শৈশব থেকেই মুহাম্মদকে যোদ্ধা হিসাবে গড়ে তোলার সার্বিক ব্যবস্থা করা হলো। তার খেলার সরঞ্জাম ছিল ছোট্ট ছোট্ট তরবারী, বর্শা ও ঘোড়া। বড় হওয়ার সাথে সাথে তার খেলার সামগ্রীও বড় হতে লাগলো। কৈশোর থেকেই অশ্বারোহণ ছিল তার খেলার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
শিশুর পিতার ঘাটতি যথাসম্ভব মা মিটিয়ে দিতে সচেষ্ট ছিলেন। মা হলেও তিনি শিশুকে কখনো নিজের বুকে কোলে জড়িয়ে রাখতেন না। নিজের আঁচলে বেঁধে রাখার বদলে তাকে আদর সোহাগ দিয়ে সুপুরুষ হিসাবে গড়ে তোলার প্রতি সতর্ক যত্ন নিতেন। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ মুহাম্মদ এর মাকে বলে রেখেছিলেন তিনি ভ্রাতুস্পুত্রকে কোন সাধারণ সৈনিক নয় সেনাপতি হিসাবেই গড়ে তুলতে সচেষ্ট। শুধু রণাঙ্গনের সেনাপতিই নয় তিনি তাকে গড়ে তুলতে চান একজন দক্ষ সেনাপতি ও শাসক হিসাবে।
হাজ্জাজ নিজেও ছিলেন প্রখর মেধাবী ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সম্পন্ন বীর পুরুষ। নিজের আজ্ঞা পালনে বাধ্য করতে যে কোন ধরনের জুলুম-অত্যাচারে মোটেও কুণ্ঠাবোধ করতেন না হাজ্জাজ। তার অস্বাভাবিক শাসন শোষণের কারণে
খলিফা আব্দুল মালিক বিন মারওয়ান প্রথমে তাকে হিজাযের ও পরবর্তীতে ইরাক, বেলুচিস্তান ও মাকরানের প্রধান গভর্নর নিযুক্ত করেন। একটি মাত্র ঘটনায় খলিফা হাজ্জাজের অস্বাভাবিক কঠোর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। ঘটনাটি ছিল এমন
খলিফা আব্দুল মালিকের সেনাবাহিনী ছিল বিশৃঙ্খল। শত চেষ্টা করেও আব্দুল মালিক বিন মারওয়ান সেনা বাহিনীতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে পারছিলেন না। সেনাবাহিনীর সবচেয়ে ক্রটি ছিল, তাদেরকে কোন অভিযানের নির্দেশ দিলে অভিযানের প্রস্তুতি নিতেই তারা অনেক সময় ব্যয় করে ফেলতো। অথচ খলিফা জানতেন, মুসলিম বাহিনীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল অস্বাভাবিক ক্ষীপ্রগতিতে অভিযান পরিচালনা করা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শত্রুপক্ষের ধারণাতীত কম সময়ে দুশমনদের অপ্রস্তুত অবস্থায় মুসলিম বাহিনী হামলা করে বিজয় ছিনিয়ে আনতো। তখন খলিফা আব্দুল মালিকের প্রধান উজির ছিলেন রূহ বিন রাবাহ।
ইবনে রাবাহ। একদিন প্রধান উজিরের উদ্দেশে বললেন খলিফা। আমার সেনাবাহিনীর মধ্যে কি এমন কেউ নেই যে সেনাবাহিনীর মধ্যে নিয়ম-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে একটি কার্যকর বাহিনীতে পরিণত করবে?
“একজন লোকের প্রতি আমি দৃষ্টি রাখছি আলীজা! বললেন উজির। তাকে একবার পরীক্ষা করে দেখতে হবে।”
“কে সেই লোক?”
“ওর নাম হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। তায়েফের লড়াকু বংশের ছেলে সে। সে আমাদের সেনাবাহিনীতেই আছে কিন্তু পদস্থ কোন অফিসার নয় একজন সাধারণ সৈনিক। তবে সে অন্য দশজনের মতো নয়। দেখে শুনে মনে হয় ওর মধ্যে বুদ্ধিজ্ঞান আছে।” “ওকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিন” নির্দেশ দিলেন খলিফা।
নির্দেশ পালন করা হলো। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ খলিফার সামনে দণ্ডায়মান। হাজ্জাজের চেহারা সুরত তীক্ষ দৃষ্টি ও অঙ্গ-ভঙ্গিতেই খলিফা হাজ্জাজের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে গেলেন।
“ইবনে ইউসুফ! তুমি যদি আমার একটি নির্দেশ বাস্তবায়ন করে দেখাতে পারো তাহলে তোমাকে আমি অনেক বড় পদে পদোন্নতি দেব।”
“কি হুকুম, আমীরুল মুমেনীন।” বলল হাজ্জাজ।
“সেনাবাহিনীকে আমি এমনভাবে প্রস্তুত দেখতে চাই যে, আমি কোন দিকে রওয়ানা হওয়ার সাথে সাথে তারা আমার পিছু পিছু ঘোড়া ছুটাবে। আমার যেন সেনাদের প্রস্তুতির জন্যে অপেক্ষা করতে না হয়। আমি কোথাও যাওয়ার আগে আগে তোমাকে জানাবো।”
সেকথার দুদিন পর খলিফা মালিক বিন মারওয়ান হাজ্জাজকে ডেকে বললেন, “অল্পক্ষণের মধ্যেই আমি বের হবো। অমুক অমুক ইউনিট আমার সফরসঙ্গী হবে।” উজির রূহ বিন রাবাহও তার নিরাপত্তা রক্ষীদের নিয়ে আমার সহগামী হবে। বললেন খলিফা।
এটা ছিল হাজ্জাজ বিন ইউসুফের জন্যে একটা পরীক্ষা। তখন সেনারা ছিল শিবিরে। খলিফার নির্দেশ পেয়ে হাজ্জাজ সেনা শিবিরে গিয়ে বললেন, “আমীরুল মুমেনীনের বাহন সফরের জন্য বের হচ্ছে, অমুক অমুক সেনা ইউনিটকে অশ্বারোহণ করে আমীরুল মুমেনীনের সফরসঙ্গী হতে হবে। হাজ্জাজ দেখলেন, উজির তার সেনা শিবিরে তখনও এসে পৌছেনি। দু’তিনজন কমান্ডারও শিবিরে ছিল না। সৈন্যদের কেউ গল্পগুজবে লিপ্ত। আর কেউ খানা পাকানোর কাজে ব্যস্ত। হাজ্জাজের কথা তাদের কারো কানে গেছে বলে মনে হলো না। হাজ্জাজ চিৎকার করে শিবিরময় তাড়া করছিলেন।
এসো হাজ্জাজ। হাজ্জাজকে তাচ্ছিল্যের স্বরে আহবান করলো এক সিপাহী। শুধু শুধু কেন গলা ফাটিয়ে চেচাচ্ছো? এসো খানা খাও!”
হাজ্জাজ হাতের কাছে পাওয়া একটি হান্টার উঠিয়ে খাবারে আহবানকারী সেনাকে পেটাতে শুরু করলেন। এরপর যে সৈনিককেই বসা দেখলেন, তাকেই হান্টার দিয়ে কয়েক ঘা পিটুনি লাগালেন এবং বললেন, আমি আমীরুল মুমেনীনের নির্দেশ শোনাচ্ছি।” কিন্তু এরপরও সৈন্যদের মধ্যে রওয়ানা হবার কোন তৎপরতা দেখতে না পেয়ে কয়েকটি ছাউনীতে আগুন ধরিয়ে দিলেন। অগ্নি সংযোগকৃত ছাউনীগুলোর একটি ছিল উজিরের নিজস্ব সেনা ইউনিটের। ওদের একজন দৌড়ে গিয়ে অগ্নিসংযোগের জন্যে উজিরের কাছে হাজ্জাজের বিরুদ্ধে অভিযোগ করল। হাজ্জাজের তৎপরতায় উদ্দিষ্ট সেনা ইউনিট নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই প্রস্তুতি সম্পন্ন করে খলিফার সহগামী হলো। কিন্তু উজির তার ইউনিট নিয়ে আসার পরিবর্তে খলিফার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। উজির অভিযোগের স্বরে বললেন
“আমীরুল মুমেনীন! হাজ্জাজ আমার ছাউনীসহ কয়েকটি সেনা ছাউনীতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। কয়েকজন সেনাকে পিটিয়েছে। আমীরুল মুমেনীন নিশ্চয়ই তাকে এমন কোন নির্দেশ দেননি!”
খলিফা হাজ্জাজকে ডেকে পাঠালেন। “একথা কি ঠিক যে তুমি কয়েকটি সেনা ছাউনীতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছো?” জিজ্ঞেস করলেন খলিফা।
“আমীরুল মুমেনীন! আমার মতো গোলামের কি করে এমন দুঃসাহস হবে যে সেনা ছাউনীতে আগুন ধরিয়ে দেবো? আমি কোন ছাউনীতে আগুন দেইনি।
“তুমি কি কয়েকজন সেনাকে প্রহার করোনি?” “জি-না আমীরুল মুমেনীন। আমি কাউকে প্রহার করিনি।”
খলিফাকে জ্বলন্ত ছাউনী দেখানো হলো, সেই সাথে প্রহৃত সেনাদের শরীর খুলে তাদের আঘাত দেখানো হলো।
“ইবনে ইউসুফ! তুমিই যদি না করে থাক, তাহলে কে এসব ছাউনীতে আগুন দিলো, আর কে এদের প্রহার করলো? “আগুন আপনি দিয়েছেন আমিরুল মুমেনীন! আপনিই সেনা ছাউনীতে আগুন দিয়েছেন। আর আপনিই সেনাদের প্রহার করেছেন।”
“চুপ করো! গর্জে উঠলেন খলিফা। কিসব প্রলাপ বকছো। তুমি কি পাগল হয়ে গেছো?”
“আমীরুল মুমেনীন! যা কিছু ঘটেছে, আপনার নির্দেশে ঘটেছে” বললেন হাজ্জাজ। আপনি সেনাবাহিনীকে গতিশীল তড়িৎকর্মা দেখতে চাচ্ছিলেন। এটাই ছিল একমাত্র পন্থা যা দিয়ে আমি আপনার নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে পেরেছি। তখন আমার মুখের নির্দেশ ছিল আপনার নির্দেশ, অ, আমার হাতের হান্টার ছিল আপনার হাতের হান্টার। ছাউনীতে ধরানে আগুনও আপনার দেয়া আগুন ছিল, এসন দিয়েই আমি আপনার নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছি।”
আল্লাহর কসম! এমন লোকেরই আমার দরকার আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বললেন খলিফা। এই ঘটনার পর খলিফা হাজ্জাজকে অপ্রত্যাশিত পদোন্নতি দিয়ে সেনাবাহিনীতে উর্ধতন অফিসার নিযুক্ত করে ফেললেন। সেদিন থেকেই হাজ্জাজের জুলুম ও অত্যাচারের সূচনা হলো।
এমনটিই ছিল হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ও তার মেজাজ। কঠোরতা, নির্মমতা ও দুঃসাহসিকতার এক জীবন্ত মূর্তি ছিলেন হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। সেই হাজ্জাজের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান ও পৃষ্ঠপোষকতায় বেড়ে উঠতে শুরু করল তার ভ্রাতুস্পুত্র মুহাম্মদ বিন কাসিম। হাজ্জাজ ভ্রাতুষ্পত্রের শিক্ষা-দীক্ষার দায়িত্ব নিজ কাঁধে নিয়ে বিশেষ এক ধাচে তাঁকে গড়ে তুলতে প্রতিজ্ঞ হলেন। ৭০৫ খৃস্টাব্দে খলিফা আব্দুল মালিক বিন মারওয়ানের মৃত্যুর পর তার বড় পুত্র ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিক মসনদে আসীন হলেন। ওয়ালিদ তার পিতার মতো বুদ্ধিমান ও দূরদর্শী ছিলেন না। ওয়ালিদের সৌভাগ্য এই ছিল যে, তার পিতা প্রশাসনের বিরুদ্ধে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা সকল ধরনের বিদ্রোহ কঠোর হস্তে দমন করেছিলেন। মালিক বিন মারওয়ান খারেজীদেরও গলাটিপে দিয়েছিলেন। তা ছাড়া মালিকের সেনাবাহিনীতে কুতাইবা বিন মুসলিম, মূসা বিন নুসাইর, মুসলিম বিন আব্দুল মালিকের মতো বিজ্ঞ ও পারদর্শী সেনাধ্যক্ষ ছিলেন। ওয়ালিদের সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য হলো হাজ্জাজ বিন ইউসুফের মতো দক্ষ ও অত্যাচারী গভর্নর ছিল তার সহায়ক ও পরামর্শদাতা।
শুরুতেই হাজ্জাজ খলিফা ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিকের দর্বলতাগুলো আঁচ করতে পেরেছিলেন। তিনি ওয়ালিদের দুর্বলতার সুযোগে নিজের অবস্থান আরো শক্তিশালী করণে মনোযোগী হলেন। বহুদিন পর একবার হাজ্জাজ জন্মভূমি তায়েফে এলেন। হাজ্জাজের আগমনের সংবাদ শুনে মুহাম্মদ বিন কাসিমের মা তার সাথে সাক্ষাতের জন্য হাজ্জাজের বাড়ি গেলেন। “আরে তুমি এলে কেন? আমি নিজেই তো তোমার সাথে দেখা করতে যাব” ছোট ভাইয়ের বিধবা স্ত্রীর উদ্দেশে বললেন হাজ্জাজ। তুমি ভেবেছিলে যে, আমি তোমার খোঁজ না নিয়ে এবং আমার ভাইয়ের আমানতের খোজ না নিয়েই চলে যাব? আমি তো ভাবছি, তোমাকে বলব, ভাইয়ের রেখে যাওয়া আমানত এখন আমার হাতে দিয়ে দাও। মুহাম্মদ কোথায়? ওকে দেখার জন্য আরো আগেই আমার আসা উচিত ছিল।”
“আল্লাহ্ আমার ভাইজানকে তাঁর রহমতের ছায়ায় রাখুন” বললেন মুহাম্মদের মা। আমি মুহাম্মদকে একটি তাজী ঘোড়া কিনে দিয়েছি। আগে সে সাধারণ ঘোড়া দৌড়াতো। এখন এমন এক ঘোড়া দিয়েছি, দক্ষ অশ্বারোহীরাই কেবল এতে আরোহণ করতে পারে। কাসিম তো এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। তাকে এখন যুদ্ধের অশ্বারোহণ রপ্ত করা দরকার।
কে জানে ও নতুন ঘোড় নিয়ে কোথায় চলে গেছে। আল্লাহ্ করুন ও যাতে ঘোড়া বাগে রাখতে পারে, খুবই তেজী ঘোড়া।
“আল্লাহ যাতে ওকে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যেতে সাহায্য করেন। কারণ তাঁকে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে পুনরায় উঠে সওয়ার হওয়াও রপ্ত করতে হবে” বললেন হাজ্জাজ। অশ্বারোহী ঘোড়ার পিঠে নয় ঘোড়ার পায়ের আঘাত খেয়েই অশ্বারোহণ রপ্ত করে। শোন বোন! ও যদি ঘোড়র পিঠ থেকে পড়ে আহত হয়ে আসে, তাহলে তাকে বুকে জড়িয়ে আহ্লাদ করো না। ওর শরীর থেকে যদি রক্ত ঝরতে দেখো, তাহলে আঁচল ছিড়ে পট্টি বেঁধে দিতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ো না। ওকে মায়া-মমতার জালে বেঁধে ফেলো না। ওর শরীরে প্রবাহিত রক্ত ওকে দেখতে দাও, সে যাতে বুঝতে পারে কাদের রক্ত সে বংশানুক্রমে শরীরে বহন করছে।
“তুমি এখন বাড়ি যাও বোন। আমি এখনই তোমার বাড়িতে আসছি।”
কিছুক্ষণ পর হাজ্জাজ মুহাম্মদ বিন কাসিমের বাড়ির দিকে রওয়ানা হলেন। মুহাম্মদের মা হাজ্জাজের আসার খবর শুনে তাকে স্বাগত জানানোর জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে আসলেন। হাজ্জাজ শুধু তার মৃত স্বামীর বড় ভাই নয়, প্রায় আধা মুসলিম জাহানের প্রধান শাসনকর্তা। হাজ্জাজ মুহাম্মদ বিন কাসিমের বাড়িতে প্রবেশ করতে যাবেন, এমন সময় তার কানে ভেসে এলো ধাবমান অশ্বখুরের আওয়াজ। তিনি পিছনে তাকিয়ে দেখলেন এক অশ্বারোহী তীব্র বেগে ঘোড়া হাঁকিয়ে এদিকেই আসছে। তিনি অশ্বারোহীকে দেখার জন্যে দাঁড়ালেন। মুহাম্মদ বিন কাসিমের মা হাজ্জাজের পাশেই দাঁড়ানো।
অশ্বারোহী হাজ্জাজের পাশ দিয়েই অশ্ব হাঁকিয়ে চলে গেল। সে না গতি হ্রাস করলো, না হাজ্জাজের দিকে তাকিয়ে দেখার প্রয়োজনবোধ করল। অবস্থা দৃষ্টে হাজ্জাজের চেহারায় দেখা দিলে উন্মা। স্পষ্টই তার চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছিল, এভাবে তার পাশ দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে চলে যাওয়াটা তার কাছে ধৃষ্টতা মনে হয়েছে। এতে হাজ্জাজ অপমানবোধ করছেন। কারণ হাজ্জাজ ছিলেন বনী ছাকিফ গোত্রের মর্যাদাবান ব্যক্তি। তায়েফের লোকজন তাকে খুবই সম্মান করে।
“মনে হচ্ছে আমার কবিলার ছেলেরা আমাকে ভুলে গেছে।” মুহাম্মদ বিন কাসিমের মায়ের উদ্দেশে বললেন হাজ্জাজ। মনে হচ্ছে, এ ছেলেটি আমাকে ভয় দেখানোর জন্য আমার পাশ দিয়ে এভাবে ঘোড়া হাঁকিয়েছে। আচ্ছা ছোট বউ! তুমি কি চেনো ছেলেটি কে?”
“এতো আপনারই ছেলে।” বললেন মুহাম্মদের মা। এ..লতা মুহাম্মদ।
“না না। আমাদের মুহাম্মদ এতো বড় হবে কি করে? এই তো সেদিন আমি ওকে এতটুকু রেখে গেলাম।” কিছুদূর অগ্রসর হয়ে মুহাম্মদ বিন কাসিম ঘোড়া ঘুরিয়ে এপথেই ফিরে এলো। ঘোড়র গতি দেখে মনে হচ্ছিল আরোহী থামবে না। কিন্তু মা ও তারপাশে একজন প্রবীণকে দাঁড়ানো দেখে হঠাৎ ঘোড়া থামিয়ে এক লাফে অশ্বপৃষ্ঠ থেকে নীচে নেমে এলো। সে চেহারা দেখেই বুঝে নিলো ইনিই তার সম্মানিত চাচা হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। সে দৌড়ে গিয়ে হাজ্জাজকে সালাম করল। হাজ্জাজ বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে ভ্রাতুস্পুত্রকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার ঘোড়াটা বেশ ভালো। অবশ্য আরোহী এর চেয়েও ভালো।” চাচার মুখে প্রশংসাবাণী শুনে মুহাম্মদ বলল, “ঘোড়ার গতি আপনাকে দেখানোর জন্যই আমি আগে থামাইনি। আমি আগেই আপনাকে চিনতে পেরেছিলাম।” আল্লাহর কসম! আমি তোমাকে চিনতেই পারিনি। এই বলে হাজ্জাজ বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলেন।
“এখন তোমার ছেলে বড় হয়েছে বোন।” মুহাম্মদের মাকে বললেন, হাজ্জাজ। একে আমি সাথে নিয়ে যাচ্ছি।”
“একথা শুনে মুহাম্মদ বিন কাসিমের মায়ের চোখে অশ্রু টলমল করতে লাগল। তখনো মুহাম্মদ বিন কাসিমের বয়স আঠারোতে পৌছেনি। তার কাছে ছেলে এখনো শিশু বৈকি। মায়ের চোখে শিশু হলেও মুহাম্মদ অন্য কিশোরদের চেয়ে স্বাস্থ্য-চেহারায় সম্পূর্ণ ভিন্ন। যোল, সতের বছর বয়সের মুহাম্মদকে দেখলে মনে হয় পরিপূর্ণ এক যুবক। “প্রিয় বোন। জানি মুহাম্মদের বিরহ তোমার জন্য খুবই কষ্টকর। কিন্তু বুক বেঁধে তোমাকে এ আমানত জাতির কল্যাণে উৎসর্গ করতে হবে। মুহাম্মদ তোমার ছেলে হলেও সে ইসলামের খেদমতের জন্যে যাচ্ছে, সে শুধু তোমার সেবায় নিয়োজিত থাকবে না, সমগ্র মুসলিম উম্মাহর সেবায় নিজেকে নিবেদন করবে। সে এমন এক পিতার সন্তান যাকে পিতার পথ ধরে জাতির সেবায় অবশ্যই নিজেকে আত্মনিয়োগ করতে হবে। পিতার অবস্থানকে ডিঙিয়ে তাকে আরো বহু দূর অগ্রসর হতে হবে, তাকে হতে হবে মুসলিম
বিশ্বের জন্য প্রোজ্জ্বল তারকা। যে তারকার আলোয় পথ দেখবে পথহারা মুসলিম জাতি।
“জী ভাইজান! আমিও এমন স্বপ্ন দেখি।” বললেন মুহাম্মদের রত্নগর্ভা মা। আমি সন্তান পেটে ধারণ করার সময় থেকে এ আশাই পোষণ করছি। নিজেকে এজন্য তৈরী করে রেখেছি, একদিন আমার বুকের ধন আমার কোল থেকে আকাশের তারকার মতো দুনিয়া জুড়ে দ্যুতি ছড়াবে।”
“আমি ওকে বসরা নিয়ে যাচ্ছি।” বললেন হাজ্জাজ। সাধারণ সৈনিক ও সামরিক প্রশিক্ষণ সে রপ্ত করেছে বটে; কিন্তু তাকে আরো উন্নত প্রশিক্ষণ নিতে হবে। তাকে এখন প্রশাসনিক কাজে যোগ দিয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং যুদ্ধ কৌশলের বাস্তব জ্ঞান অর্জন করতে হবে। শিখতে হবে প্রশাসনিক নিয়ম-কানুন। রণাঙ্গনে গিয়ে রপ্ত করতে হবে যুদ্ধের বাস্তব জ্ঞান। এজন্য ওকে আমি সেনাবাহিনীর বিশেষ শাখায় ভর্তি করে দেবো।”
হাজ্জাজের প্রশাসনিক সদর দফতর ছিল বসরায়। তার বাসস্থান ছিল একটি রাজপ্রাসাদের মতো। হাজ্জাজের ঔরষজাত সন্তান বলতে ছিল মাত্র একটি মেয়ে। তার নাম যুবায়দা। হাজ্জাজ যখন নিজ গ্রাম তায়েফে বেড়াতে গেলেন, তখন তার একমাত্র মেয়ে বসরায়। তখন সে পূর্ণ কিশোরী। এক রাতে যুবায়দার কক্ষের জানালায় বাইরে থেকে হাল্কা টোকা মারার শব্দ হলো। যুবায়দা বিছানায় শুয়ে শুয়ে জানালায় কড়া নাড়ার শব্দ শোনার জন্য উৎকর্ণ ছিল। তাই সামান্য আওয়াজেই বিছানা ছেড়ে দাঁড়ালো সে। জানালা খুলে বাইরে উঁকি দিলো। জানালা দিয়ে বাইরে যাওয়ার জন্য দু’পা জানালায় রেখে নিজের শরীরের ভার বাইরে অপেক্ষমাণ দুটি হাতের ওপর ছেড়ে দিলো যুবায়দা।
“এখান থেকে চলে বেরিয়ে যাই সুলায়মান। দরজা ভিতর থেকে আটকানো। জানালাটি বন্ধ করে দাও।” বলল যুবায়দা।
সুলায়মান জানালার পাল্লা বন্ধ করে দিয়ে যুবায়দার হাত ধরে প্রাসাদোপম বাড়ির বাগানে ঢুকে পড়ল।
খলিফা ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিকের ছোট ভাই সুলায়মান। আঠারো বছরের টগবগে যুবক সে। হাজ্জাজ তনয়া যুবায়দা সুলায়মানের হৃদয়ে বাসা বেঁধেছে। যুবায়দার বয়সও ষোল বা সতের। শৈশবে একই পাঠশালায় লেখাপড়া করেছে। বেড়ে উঠেছে পাশাপাশি। শৈশবের সোনা ঝরা দিনগুলো তাদের কেটেছে একসাথে খেলাধুলা করে। কিছুটা বড় হওয়ার পর ওদের
মধ্যে দেখা সাক্ষাত কমে যায়। অবাধ মেলামেশার সুযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়। দেখা সাক্ষাতে বদনাম হওয়ার আশঙ্কা তেমন ছিল না। শাহী খান্দানের রীতিটাই এমন ছিল। শাহী খান্দানের লোকজনদের নৈতিকতা নিয়ে কথা বলার প্রতি সাধারণদের মধ্যে তেমন আগ্রহ ছিল না। তাদের মধ্যে দেখা সাক্ষাত অবাধ মেলামেশার বড় বাধা ছিল সামাজিক ও পারিবারিক রীতি। তারচেয়েও যুবায়দার জন্য বড় সমস্যা ছিল পিতা হাজ্জাজ। কারণ স্বভাবের দিক থেকে হাজ্জাজ ঘরে বাইরে সর্বক্ষেত্রে কঠোর ও নির্মম ছিলেন তা যুবায়দাকেও প্রভাবিত করেছিল।
“এখানে লুকিয়ে ছাপিয়ে আমরা আর কতো দিন লুকোচুরি খেলব চাঁদ!” যুবায়দার উদ্দেশে বলল সুলায়মান। আবেগের আতিশয্যে যুবায়দাকে চাদ বলে ডাকে সে। আমি ভাইকে বলব যাতে আমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করে দেয়।” “তোমার ভাই হয়তো এ বিয়ে মেনে নিতে পারেন; কিন্তু আমি জানিনা, আমার আব্বা এ বিয়েতে সম্মতি দেবেন কি-না!” বলল যুবায়দা।
“কেন সে কি আমীরুল মুমেনীনের ভাইয়ের কাছেও তার মেয়ে তুলে দিতে রাজি হবে না?” সুলায়মান জিজ্ঞাসু স্বরে বলল।
“তুমি কি তার স্বভাবের কথা জানো না? তিনি নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নেন। খলিফার প্রভাবে তিনি কখনও প্রভাবিত হননি।” “তিনি যদি তোমার বিয়ের জন্যে অপর কোন লোক ঠিক করেন তাহলে তুমি কি করবে?” যুবায়দাকে জিজ্ঞেস করলো সুলায়মান।
“তার হুকুম বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নেব।” “আমীরুল মুমেনীনের ভাইয়ের বউ না হতে পারার জন্যে তোমার কি কোন আফসোস হবে না? আমার বউ হয়ে তুমি যে গর্ব করতে পারবে, আর কারো বউ হলে কি তুমি এতোটা গর্বিতা হবে?”
‘সুলায়মান! শৈশব থেকেই তুমি আর আমি এক সাথে বড় হয়েছি। ছোট্ট বেলা থেকেই আমি তোমাকে ভালোবাসি। এই ভালোবাসার অর্থ এই নয় যে, তখন তুমি আমীরের পুত্র ছিলে। শাহজাদা হিসাবে আমি তোমাকে ভালোবাসিনি। তোমাকে আমার ভালো লাগে তাই। তুমি যদি কোন ভিখারীর ছেলেও হতে, তবুও তোমাকে আমার ভালো লাগতো। তখন হয়তো তুমি একথা ভাবতে না, আমি কার মেয়ে।”
“একথা আমি এখনও ভাবি না যে, আমি শাহজাদা আর তুমি গভর্নরের মেয়ে।”
“তা হয়তো মনে করো না, তবে নিশ্চয়ই একথা ভাবো যে, তুমি আমীরুল মুমেনীনের ভাই। হয়তো এটাও মনে করতে পারো, তোমার এই মর্যাদা ও সম্মানের জন্য আমার গর্ব করা উচিত।”
“একথা শুনে রাখো সুলায়মান! আমি এমন পুরুষকে নিয়েই গর্ববোধ করবো, যার মধ্যে আমার প্রতি টান থাকবে, ভালোবাসা থাকবে। সে এমনটি কখনো ভাববে না, কেমন বাবার পুত্র সে, আর আমি কেমন পিতার মেয়ে।”
আজ তুমি এভাবে কথা বলছ কেন চাদ!” বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করে আফসোসের স্বরে বলল সুলায়মান, আজকের মতো এমন একটি আনন্দঘন রাতে তুমি এভাবে কথা বলছো কেন?”
“আমি তোমার কাছ থেকে পালিয়ে যাচ্ছি না সুলায়মান! তোমাকে এড়িয়ে যাওয়ার ইচ্ছা থাকলে এভাবে রাতের আঁধারে আমি তোমার সাথে ঘরের বাইরে বের হতাম না। দেখো তুমি কি আন্দাজ করতে পারো আমি কী ভয়ংকর ঝুঁকি নিয়েছি। ভিতর থেকে দরজার খিল এঁটে আমি জানালা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছি…। আজ আমি তোমাকে একথা বলতে এসেছি যে, এখন আর আমি ছোট্ট নই, আর…সুলায়মান। এ মুহূর্তে আমার মনের অবস্থা তোমাকে বোঝাতে পারবো না। যে কোন মুহূর্তে আমার কারো না কারো বউ হতে হবে। তুমি জানো আমাদের রীতিনীতি!”
“আমাদের রীতি তো এটাই যে, আমরা যদি কাউকে ভালোবাসি তাকে বিয়ে করে ফেলি। আর যে খলিফা হয় সে একাধিক বউ রাখে।”
“আমি এই রীতিনীতির কথা বলছি না” বলল যুবায়দা। আমি মুসলমানদের সামরিক রীতিনীতির কথা বলছি। যারা রোম পারস্যের শক্তিশালী সাম্রাজ্য ভেঙে টুকরো টুকরো করে ইসলামের সীমানা কোথা থেকে কোথা পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে অবস্থা দেখো। মুসলমানরা পরস্পর বিরোধ বিবাদে জড়িয়ে পড়েছে। কোন জায়গায় দেখা দিয়েছে বিদ্রোহ, কোথাও অসন্তোষ, কোথাও ষড়যন্ত্র। এর ফলে পরাজিত রোমানদের তরবারী আমাদের মাথার ওপরে ঝুলছে। তুমি কি একথা জানো না, রোমানদের সাথে আমাদের যে শান্তিচুক্তি করতে হয়েছে, তাতে কি পরিমাণ অর্থ দিতে হয়েছে। খুবই মোটা অংকের টাকা দিয়ে আমাদের শান্তি খরিদ করতে হয়েছে। টাকার বিনিময়ে শান্তি চুক্তি করে আমরা একথাই প্রমাণ করেছি যে, দ্বীন ও মিল্লাতের
হেফাযত ও দেশের সীমানা রক্ষার ক্ষমতা এখন আর আমাদের নেই। আমরা খুবই দুর্বল অক্ষম হয়ে গেছি।”
সুলায়মান যুবায়দার এসব কথায় অস্থির হয়ে বলল, আহা চাঁদ! তুমি এমন মনোরম রাত আর আবেগকে গলাটিপে মেরে ফেলছো। হায়! এমন চাঁদনী রাতে চাঁদের চেয়েও সুন্দর রাতটি আর আমার ভালোবাসার স্বপ্নগুলোকে নিরস, বিষাদময় কথাবার্তার বিবর্ণ চাদরে ঢেকে দিচ্ছো। তুমি কি বলতে চাচ্ছো, যেসব কথা তুমি আমাকে শোনাচ্ছ, এসব আমি মোটও জানি না? তোমার কি একথা জানা নেই যে, আমার ভাইয়ের মৃত্যুর পর খেলাফতের মসনদে আমাকেই বসতে হবে?”
“আমি চলে যাচ্ছি…বসা থেকে উঠতে উঠতে বলল যুবায়দা। আমাকে এখন চলে যেতে হবে। মা যদি টের পেয়ে যায়…।”
“তিনি তো তার ঘরে ঘুমিয়ে আছেন। বলল সুলায়মান। কি হয়ে গেল তোমার? সুলায়মানও বসা থেকে উঠতে উঠতে বলল। এর আগে তুমি কখনও এমনটি করনি।”
যুবায়দা দ্রুত পায়ে হাঁটতে লাগলো। সুলায়মানও ওর পিছু পিছু রওয়ানা হলো।
“কি ব্যাপার! তুমি কি আমার ভালোবাসাকে ভেঙেচুরে চলে যাচ্ছ?”
“না সুলায়মান! দাঁড়িয়ে বলল যুবায়দা। আমি তোমার ভালোবাসাকে অপমান করছি না। আমি বিয়ের কথা বলছি, আমাকে ভাবতে দাও সুলায়মান! আমাকে ভাবতে দাও। কথা বলতে বলতে জানালার কাছে গিয়ে জানালা খুলে ঘরে প্রবেশ করলো যুবায়দা।
কয়েক দিন পর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ তায়েফ থেকে বসরায় ফিরে আসলেন। তার বাহন মহলে প্রবেশ করতেই যুবায়দা দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। ঘোড়ার গাড়ি থেকে হাজ্জাজ নেমে এলেই পিতাকে জড়িয়ে ধরলো যুবায়দা। পিতাও পরম আদরে আদুরে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। যুবায়দার চেহারা ছিল ঘোড়ার গাড়ির দিকে। সে দেখলো, গাড়ি থেকে দীর্ঘদেহী একহারা গড়নের এক অচেনা কিশোর বেরিয়ে এলো। পৌরুষদীপ্ত, আকর্ষণীয় কিশোরের চেহারা।
যুবায়দা একেবারে লেপ্টে ছিল পিতার বুকের সাথে। অচেনা কিশোরের দিকে নজর পড়তেই তার বাঁধন শিথিল হয়ে গেল। কিশোরের প্রতি আটকে গেল তার দৃষ্টি।
“সামনে এসো মুহাম্মদ!” নাম ধরে কিশোরকে আহবান করলেন হাজ্জাজ। যুবায়দাকে দেখিয়ে বললেন, “এ আমার মেয়ে যুবায়দা। যুবায়দা! এ তোমার চাচাতো ভাই মুহাম্মদ। তুমি একে আর দেখনি। এই আমার ভাইয়ের একমাত্র সন্তান। সে আমাদের সাথে কিছুদিন থাকবে।”
মুহাম্মদ বিন কাসিম, চাচা হাজ্জাজ বিন ইউসুফের মহলে দিন কাটাতে লাগলো। যুবায়দা খুব গভীরভাবে মুহাম্মদের চলাফেরা দেখতো, মাঝেমধ্যে টুকিটাকি কথাও বলতো। চাচাতো ভাইয়ের সাথে টুকটাক কথা বললেও যুবায়দা স্বভাবজাত লজ্জা ও পর্দা কখনো লঙ্ঘন করেনি।
এক বিকেলে মহলের বাগানে পায়চারী করছিল মুহাম্মদ। বাগানের একটি জায়গা খুবই ভালো লাগল তার কাছে। পাশাপাশি দুটি ঘন গাছের ঘন ডালপালায় ঝোপের মতো হয়ে উঠেছে। গাছ দুটি ছিল ফুলধারী। বসন্তের মৌসুম থাকায় ঘন ঝোপ সদৃশ্য গাছের ডালপালাগুলো ফুলে ফুলে অপরূপ সাজে সজ্জিত, ফুলের সমারোহে ছাউনীর মতো গাছের ঝোপের নীচে মুগ্ধ মনে বসে পড়লো মুহাম্মদ। দৃশ্যটি তাঁর মন কেড়ে নিলো।
দূর থেকে যুবায়দা মুহাম্মদ এর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছিল। ফুলের ঝোপের মধ্যে বসতে দেখে যুবায়দাও পায়চারী করতে করতে মুহাম্মদের কাছে চলে এলো। যুবায়দা কাছে এসে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থেকে নীরবতা ভেঙে বলল, এখানে একাকী বসে কি ভাবছো মুহাম্মদ ভাইয়া!
“ফুলে ফুলে সাজানো জায়গাটা আমার কাছে খুবই ভালো লাগছে। এজন্য একটু বসলাম।”
“আমিও কি তোমার পাশে বসবো?” “চমকে উঠলো মুহাম্মদ। বলল, না না!” “কেন?”
“এটা ভালো দেখাবে না। কেউ দেখলে কিংবা চাচার চোখে পড়লে ব্যাপারটি ভালো দেখাবে না। আমি ভাই একাকী তোমার পাশে বসে থাকতে পারবো না।”
“চুপি চুপি আমিও তোমার সাথে বসতে চাই না মুহাম্মদ ভাইয়া!” কথাটি বলেই চিন্তায় হারিয়ে গেল যুবায়দা। “পশ্চিম আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখো যুবায়দা! সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। এমন সময় কোন যুবক যুবতী নিরিবিলি জায়গায় পাশপাশি অবস্থান করা
মোটেও ঠিক নয়…। তুমিও কি আমার মতো হাঁটতে হাঁটতে এদিকে এসেছো, নাকি আমাকে দেখে ইচ্ছা করেই এসেছো?”
“তোমাকে তো আমি প্রতিদিনই দেখি। একাকী হাঁটতে ভয় ভয় লাগছিল এজন্য…। আচ্ছা, মুহাম্মদ ভাইয়া! একটি কথা জিজ্ঞেস করছি। আমার এখানে আসায় তুমি কি বিরক্ত হয়েছ? তোমার কাছে কি আমার আসাটা খুবই বিরক্তি সৃষ্টি করেছে? আমাকে কি তোমার কাছে খারাপ লাগে?”
“শোন যুবায়দা! তোমার এখানে আসা অবশ্যই আমার কাছে ভালো লাগেনি। তবে এর সাথে তোমাকে খারাপ লাগার কোন সম্পর্ক নেই। আমি তোমার চোখ ও তোমার মুচকি হাসি দেখেই তোমার ভিতরের অবস্থা বুঝতে পেরেছি। আমার মধ্যেও যে এমনটি নেই তা বলব না। কেঁপের ভিতরে বসা থেকে উঠে বেরিয়ে আসতে আসতে মুহাম্মদ বলল, এসো, আমরা মহলের দিকে এগুতে থাকি। যাতে কেউ দেখলেও এটা ভাবতে না পারে যে, আমরা নিরিবিলি বসে ছিলাম।”
“মুহাম্মদ ভাইয়া! তুমি এখন কি করবে?” পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলল যুবায়দা।
“আমি আমার ইচ্ছা ও স্বপ্নগুলো বাস্তবায়ন করতে চাই। যেসব প্রশিক্ষণ আমি নিয়েছি এসব কলা-কৌশল আমাকে স্বস্তিতে থাকতে দিচ্ছে না।”
“তুমি কি সেনাপতি হতে চাও?”
“আমি কোন পদ পদবীর প্রত্যাশা করি না। আমার মাথায় এখন একটাই চিন্তা, চোখের সামনে একটাই পথ, আমি ওই পথ ধরে চলতে চাই, যে পথ জীবন ও রক্তের বিনিময়ে আমাদের পূর্বপুরুষগণ তৈরী করে গেছেন। একটি পথ তৈরী হয়ে গেছে সে পথে হাজার কোটি মানুষ চলতে পারে। আর যারাই সে পথ অতিক্রম করে তারা কিছু না কিছু পদচিহ্ন তো রেখেই যায়। সে পথে গমনাগমনকারীরা পূর্ববর্তীদের পদচিহ্ন মুছে দিয়ে নতুন পদচিহ্ন তৈরী করে কিন্তু এমন কিছু চিহ্ন থাকে, যেগুলো কখনও মুছে ফেলা যায় না। পথভোলা পথিকরা সেই অক্ষুন্ন পদচিহ্ন দেখে দেখে তাদের মনযিলে পৌছাতে পারে। আমিও সেইসব বীরপুরুষদের অমুছনীয় পদচিহ্ন দিব্যি দেখতে পাচ্ছি।”
“কারা সেইসব কৃতীপুরুষ?” জিজ্ঞেস করল যুবায়দা। “খালিদ বিন ওয়ালিদ আমার সেই স্বপ্নপুরুষ।” জবাব দিলো মুহাম্মদ বিন কাসিম। বিন ওয়াক্কাস, আবু বকর, ওমরও আমার অনুস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। আমি
এসব মহাপুরুষদের মিশনকে আরো এগিয়ে নিতে চাই। আমি মুসলিম শাসনের সীমানা আরো দূর দারাজ পর্যন্ত বিস্তৃত করতে চাই। আমি শুধু শুধু সেনাপতির তকমা নিয়ে সন্তুষ্ট হতে চাই না, আমি চাই আল্লাহর সৈনিক হয়ে জীবন কাটাতে।”
মুহাম্মদের কথা শুনতে শুনতে তার দৃঢ় ও সুদূরপ্রসারী সংকল্প এবং পৌরুষদীপ্ত মন-মানসিকতার প্রভাবে নিজেকে স্বপ্নময় পুরুষের বিশালতায় হারিয়ে দিলো যুবায়দা। মুহাম্মদ বিন কাসিম এভাবে কথা বলছিল, মনে হয় যেন তার কথাগুলো কোন তরুণের স্বপ্ন নয় অতি বাস্তব। সে কোন কল্পনা বিলাসে নিজেকে আপুত করছে না, ইচ্ছা ও সংকল্পকে বাস্তবে রূপ দেয়ার মতো দৃঢ়চিত্ত ও প্রত্যয়ী সে। “যুবায়দা! আমি আমার মায়ের দেখা স্বপ্নের বাস্তব প্রতীক। কিন্তু সেই স্বপ্নের এখনো বাস্তবতা পায়নি। আমাকে অবশ্যই সেই তারকা হতে হবে যে তারকার স্বপ্ন আম্মু দেখেছিলেন।”
দু’জন কথা বলতে বলতে মহলের প্রবেশ পথে এসে গেলে মুহাম্মদ নীরব হয়ে গেল এবং যুবায়দার উদ্দেশে বলল, “যুবায়দা! এখন তুমি তোমার পথে যাও। আমি একাকী মহলে প্রবেশ করবো।”
মুহাম্মদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেল যুবায়দা। তার চোখে চোখ রেখে বলল, “মুহাম্মদ ভাইয়া! জানি না, হয়তো সেই শৈশব থেকে তোমার জন্যই আমি অপেক্ষা করছি। আবেগাপ্লুত ধরা গলায় বলল যুবায়দা। বলল, আমার মন চাচ্ছে তোমার সফরসঙ্গী হতে…। তুমি কি আমাকে সঙ্গে নেবে?”
“আল্লাহর যদি মর্জি থাকে তাতে আমার আপত্তি নেই।” একথা বলেই দ্রুত পায়ে মহলের পথে পা বাড়ালো মুহাম্মদ।
বসন্তকাল। এ সময়ে দারুল খেলাফত তথা রাজধানীতে সেনাবাহিনীর বাৎসরিক কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়। সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের কুশলী যোদ্ধারা নানা ধরনের নৈপুণ্য, শৈল্পিক ও নান্দনিক যুদ্ধ কৌশল প্রদর্শন করে। সামরিক ও বেসামরিক লোকজন এ কুচকাওয়াজ দেখার জন্য উদগ্রীব থাকে। অগণিত দর্শকের সমারোহে মুখরিত হয় ময়দান। খলিফা নিজে উপস্থিত থেকে কৃতী কুশলীবদের মধ্যে পুরস্কার তুলে দেন। খেলাধুলার মধ্যে ঘোড়দৌড়, বর্শা, তরবারী, তীর ও মল্লযুদ্ধ উল্লেখযোগ্য। খলিফা আব্দুল
মালিক বিন মারওয়ানের সময় প্রশাসন নানা বিদ্রোহ দমনে ব্যস্ত থাকার কারণে বসন্তকালীন মহড়া অনুষ্ঠানের সুযোগ তেমন হয়নি। তিনি কঠোরভাবে সব ধরনের গোযোগ দমন করায় তার ছেলে ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিকের সময় কোন গোলযোগ ছিল না। এজন্য খলিফা প্রতি বছরের বসন্তে রাজধানীতে বিশাল আকারে সামরিক মহড়ার আয়োজন করতেন। এ উৎসবে এতো কঠিন প্রতিযোগিতা হতো যে, সামরিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে প্রতিযোগীর হাতে যদি কেউ মারাও যেত তবুও এতে কোন শাস্তি হতো না।
একদিন খলিফার বিশেষ দূত বসরায় হাজ্জাজ বিন ইউসুফের কাছে পয়গাম নিয়ে গেল, বাৎসরিক সামরিক উৎসবে যোগদান করার জন্যে তিনি যেন এক্ষুণি খলিফার সাথে দেখা করেন। তা ছাড়াও তার সাথে খলিফার জরুরী পরামর্শ রয়েছে। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ খলিফার পয়গামে খুশী হলেন। খুশীর প্রধান কারণ তিনি ভাতিজা মুহাম্মদকে খলিফার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার একটা সুযোগ খুঁজছিলেন। খলিফার পয়গাম এ কাজটির জন্য সুবর্ণ সুযোগ বয়ে আনলো। বাৎসরিক সামরিক উৎসবটি তার জন্যে আরো সুযোগ করে দিয়েছে। তিনি সামরিক প্রতিযোগিতায় মুহাম্মদকে অংশগ্রহণ করিয়ে খলিফা ও সেনাপতিদের এ বিষয়টি দেখিয়ে দিতে চাচ্ছিলেন, এতটুকু বয়সে তার ভাতিজা সমরবিদ্যায় কি পরিমাণ যোগ্যতা অর্জন করেছে। তিনি চাচ্ছিলেন পরিচয়ের শুরুতেই সবার চোখে মুহাম্মদকে তাঁর কৃতিত্বের মাধ্যমে একটা সম্মানজনক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে। তিনি তখনই মুহাম্মদকে ডেকে বললেন, “মুহাম্মদ! তুমি তরবারী চালনা, বর্শা নিক্ষেপ, ঘোড়দৌড়, ও মল্লযুদ্ধে কতটুকু পারদর্শী আমি জানি না। বসন্ত উৎসব একটা সুযোগ। আমি এ সুযোগটাকে কাজে লাগাতে তোমাকে সামরিক প্রতিযোগিতায় সম্পৃক্ত করতে চাই। আশা করি তুমি আমাকে লজ্জিত করবে না।” “হার জিত আল্লাহর হাতে চাচাজান! আমি বড়াই করতে চাই না। তবে প্রতিযোগিতায় অবশ্যই অবতীর্ণ হবো।”
“তাহলে চলল। তুমি যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত হও।”
“কপাটের ওপাশ থেকে এগিয়ে এসে যুবায়দা আবেদনের স্বরে বলল, এবারের প্রতিযোগিতায় আমিও যাবো আব্বু! আমাকে আপনি একবারও সামরিক প্রতিযোগিতা দেখাতে নিয়ে যাননি!”
একমাত্র কন্যার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে পারলেন না হাজ্জাজ। যুবায়দাকেও নিয়ে যেতে সম্মত হলেন।
বসরা থেকে রওয়ানা হয়ে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ মুহাম্মদ ও যুবায়দাকে নিয়ে দারুল খেলাফত রাজধানীতে পৌছলেন। তিনি খলিফার সাথে মুহাম্মদ বিন কাসিমের পরিচয় করিয়ে দিলেন।
“আল্লাহর কসম ইবনে কাসিম! তোমার বাবার অবদানকে আমাদের পরিবার কখনো বিস্মিত হবে না।” বললেন খলিফা ওয়ালিদ বিন মালিক। তিনি আমাদের খেলাফতের মর্যাদা রক্ষায় নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। তিনি যেমন ছিলেন বীর বাহাদুর, তেমনি ছিলেন বিশ্বস্ত। আশা করি তুমি তোমার পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করেই চলবে। ইবনে ইউসুফ! হাজ্জাজের উদ্দেশ্যে তিনি বললেন, আপনি কি আপনার ভাতিজাকে কারো মোকাবেলায় প্রতিযোগিতা করতে বলবেন?”
“এজন্যই তো ওকে সাথে করে এখানে নিয়ে এসেছি আমীরুল মুমেনীন! আমিও দেখতে চাই সে কতটুকু উপযুক্ত হয়েছে।”
“সে যদি তার যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারে, তাহলে আমরা তাঁকে তাঁর পিতার পদেই বরণ করবো” বললেন খলিফা। “হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ছিলেন প্রধান প্রশাসক। তার পদমর্যাদা বর্তমানের গভর্নরের চেয়ে অনেক বেশী। হাজ্জাজকে বিশেষ সম্মানে শাহী মহলেই থাকার ব্যবস্থা করলেন খলিফা। মুহাম্মদ বিন কাসিমও চাচার সাথেই শাহী মেহমান হিসাবে থাকার সুযোগ পেলো। যুবায়দাকে পাঠিয়ে দেয়া হলো অন্দর মহলে বেগমদের কাছে।
হাজ্জাজ যে মহলে অবস্থান করছিলেন, সেই মহলেই বসবাস করতো খলিফা ওয়ালিদের ছোট ভাই সুলায়মান। যুবায়দার শাহী মহলে আসার খবর শুনে সে ভীষণ খুশী হলো। সে তার একান্ত সেবিকাকে বলল, যুবায়দাকে ডেকে নিয়ে এসো। সুলায়মানের একান্ত সেবিকা এসে তাকে জানালো, যুবায়দা হাজ্জাজের ভাতিজা তার চাচাতো ভাইয়ের কক্ষে কথা বলছেন।”
“সে যেখানেই থাকুক তাকে নিয়ে এসো। তাকে গিয়ে বলো, সুলায়মান আপনাকে স্মরণ করছেন।
সেবিকা যুবায়দার কাছ থেকে ফিরে এসে জানালো, সে এখন আসতে পারবে না।”
“কোথায় সে? কি করছে?” সেবিকাকে জিজ্ঞেস করল সুলায়মান। “চীফ গভর্নরের ভাতিজার পাশে বসে হেসে হেসে কি যেন গল্প করছে।” “হাজ্জাজের ভাতিজাও কি তোমার বলার পর কোন কিছু বলেছে?”
“হ্যাঁ, সে বলেছে, পুনর্বার যেন তার কক্ষে আমি না যাই।” সুলায়মানকে জানালো সেবিকা।
একথা শুনে রাগে ক্ষোভে ফুসতে লাগলো সুলায়মান।
সেদিন বিকেলের ঘটনা। বিকেল বেলায় শাহী মহলের বাগানে পায়চারী করতে করতে যুবায়দা একটি ঘন ফুল বাগানে চলে গেল। বাহারী নানা ফুলের সমারোহে বাগানের এ অংশটিকে করে তুলেছে মোহনীয়। তাকে বাগানে পায়চারী করতে দেখে পা টিপে টিপে অতি সন্তর্পণে পিছন দিক থেকে এসে যুবায়দার দু’চোখ চেপে ধরলো সুলায়মান।
যুবায়দা হাতের ওপর হাত বুলিয়ে হেসে বলল, “হয়েছে আমি ঠিকই চিনে ফেলেছি: মুহাম্মদ ভাইয়া?”
একথা শুনে শিথিল হয়ে এলো হাত। দ্রুত সরে গেল দূরে। যুবায়দা চকিতে পিছন ফিরে তাকালো।
বলল, “ওহ! সুলায়মান! আমি আশা করেছিলাম তুমি নিশ্চয়ই আসবে!”
“না, তুমি তো আশা করেছিলে বিন কাসিম আসবে! কিছুটা ক্রোধমাখা স্বরে বলল সুলায়মান। এই জন্যই তো তোমার মুখ থেকে ওর নামই বেরিয়েছে।
“হু, ওর নাম নেয়া কি অপরাধ?” “তা জানি না, তবে কারো সাথে প্রতারণা করা নিশ্চয়ই অপরাধ! আমাকে ধোকায় ফেলে রেখো না যুবায়দা! বিন কাসিম ও আমার ব্যাপারে তোমার অবশ্যই চূড়ান্ত ফায়সালা করা উচিত। ফায়সালা ভেবে চিন্তে করা উচিত। কারণ আমি আগামী দিনের খলিফা আর বিন কাসিম হবে আমার অধীনস্ত একজন কর্মচারী মাত্র। আমি ইচ্ছা করলে তাকে সেনাপতি থেকে সিপাই বানাতে পারব, ইচ্ছা করলে ভিখারীতে পরিণত করতে পারব।…আচ্ছা…তুমি ওর মধ্যে এমন কি দেখেছ, যা আমার মধ্যে দেখতে পাওনি?”
“ওর ভালোবাসায় কোন খাদ নেই” বলল যুবায়দা আমি ওকে সেনাপতি অবস্থায় যেমন ভালোবাসবো, সিপাহী হলেও তেমনি ভালোবাসবো। তাতে আমার ভালোবাসায় কোন ভাটা পড়বে না। তুমি যদি তাকে ভিখারীতে পরিণত করো, তবুও কারো কাছে ওকে হাত পাততে দেবো না। আমার ভালোবাসা পদমর্যাদা ও ক্ষমতার গণ্ডিতে আবদ্ধ নয়।” যুবায়দা নাগাল থেকে চলে আসার জন্যে এগুতে শুরু করলেসুলায়মান আগ বেড়ে ওকে ধরে ফেলল এবং যুবায়দার কাছে প্রেম ভিক্ষা করতে শুরু করল। শৈশবের স্মৃতি মন্থন করে অতীতের ভালো লাগা, এক সাথে খেলাধুলার কথা স্মরণ করাতে লাগল। যুবায়দা তার কাছ থেকে বারবার চলে আসতে চাচ্ছে আর ফিরে ফিরে সুলায়মান তার হাত ধরে আটকে রাখতে চাচ্ছে।
“সুলায়মান! ভরাট কণ্ঠের আওয়াজ ভেসে এলো দূর থেকে।”
চকিতে সুলায়মান ও যুবায়দা তাকিয়ে দেখতে পেল ফুল গাছের আড়ালে হাজ্জাজ দাড়ানো।
“ভালো হয়েছে যে আমি নিজের চোখে দেখতে পেলাম। আরো ভালো হয়েছে, তুমি কি বলেছো, আর আমার মেয়ে কি বলেছে, তা আমি নিজের কানে শুনেছি।” প্রিয় সুলায়মান। তোমার ধৃষ্টতাকে আমি ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ মনে করছি না। কারণ যৌবন আসলে একটা পাগলামী। কিন্তু তোমাকে আমি পরিষ্কার জানিয়ে দিচ্ছি, আমি তোমার হাতে আমার মেয়েকে তুলে দিতে পারি না। এ ব্যাপারে কি করবো, সেই সিদ্ধান্ত আমি নেবো, আমার মেয়ের কোন সিদ্ধান্ত এতে থাকবে না। তুমি জানো, তোমার সমবয়স্ক আমার একটি ভাতিজা আছে। ও আমার ভাইয়ের একমাত্র ছেলে…। আমার মেয়ে তারই বউ হবে।” মাথা নীচু করে অােবদনে দাড়িয়ে ছিল যুবায়দা। হাজ্জাজ যুবায়দার হাত ধরে সাথে নিয়ে বাগান থেকে চলে গেলেন। সুলায়মান ঠায় দাঁড়িয়ে পিতা-কন্যার গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইলো। ওর চেহারা তখন ক্ষোভে অপমানে বিবর্ণ হয়ে উঠল, মাথায় যেন শুরু হলো অগ্ন্যুৎপাত। টগবগিয়ে ফুটতে থাকল শরীরে রক্তকণিকা। সে ভেবে পাচ্ছিল না হাজ্জাজ ও মুহাম্মদ বিন কাসিমকে কাবু করে কিভাবে যুবায়দাকে কব্জা করবে।”
দুদিন পরের ঘটনা। সারা আরবের মানুষ যেনো জমা হয়েছে সামরিক উৎসবে। বহু দূর দূরান্ত থেকে লোকজন এসে জমা হয়েছে। ময়দানে থাকার জন্য তাঁবু ফেলেছে দলে দলে। যেদিকেই চোখ যায় শুধু মানুষ আর মানুষ। সারা ময়দান ভরে গেছে তাঁবু, ঘোড়া আর উটে। শহরের রাস্তা দিয়ে লোকের ভীড়ে পথ চলা দায়। বিশাল ময়দান। একদিক থেকে তাকালে অপর দিকের সীমানা খুঁটি দেখা যায় না। ময়দানের মাঝখানে বৃত্তাকারে চিহ্ন দেয়া। এ বৃত্তের বাইরে আগত লোকজন অবস্থান নিয়েছে। বৃত্তের এক পাশে সুদৃশ্য প্যান্ডেল। নানা রংয়ের জড়িদার ঝালর ও বাহারী শামিয়ানা লটকানো এক মঞ্চ। মঞ্চের মাঝখানে শাহী সিংহাসন। এর পাশে দামী দামী কুরছি। এসব কুরছিতে বসবে খলিফার বেগম সাহেবাগণ। তাদের ডানে বামে উজির, সেনাপতি ও খেলাফতের পদস্থ কর্মকর্তাবৃন্দ। সেই সাথে বিভিন্ন কবিলা ও গোত্রের সর্দার ও গোত্রপতিদের বসার ব্যবস্থা।
সবার সামনে খলিফা ওয়ালিদ বিন মালিকের সিংহাসন। তার একপাশে প্রধান গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফের বসার আসন। হাজ্জাজের সাথেই তার একমাত্র কন্যা যুবায়দা উপবিষ্ট।
অগণিত দর্শক ময়দানের চারপাশে। কেউ বসা, কেউ দাঁড়ানো, কেউ নিজের বাহনের পিঠে আরোহী।
খলিফার ইঙ্গিতে প্রতিক্ষার প্রহর শেষে শুরু হলো সামরিক উৎসব। বাৎসরিক প্রতিযোগিতা। সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের প্রতিযোগিরা পালাক্রমে ময়দানে প্রবেশ করে প্রতিপক্ষকে হারিয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে অতিক্রম করছে। ঘোড়দৌড়, তরবারী চালনা, তীর নিক্ষেপ ইত্যাদির প্রতিযোগিতা একের পর এক ঘটে চলছে। তরবারী প্রতিযোগিদের এক হাতে ছিল চামড়ার তৈরী ঢাল, অন্য হাতে তলোয়ার। এই খেলায় বেশ কয়েকজন প্রতিযোগী মারাত্মকভাবে আহত হলো। সবচেয়ে দর্শনীয় ছিল অশ্বারোহী যোদ্ধাদের প্রতিযোগিতা। প্রথমে অশ্বচালনায় বিভিন্ন নৈপুণ্য প্রদর্শনের পর আরোহীদের মধ্যে তরবারী চালনার প্রতিযোগিতা হলো। মুহাম্মদ বিন কাসিম না ছিল প্যান্ডেলের অতিথিদের মধ্যে, না ছিল সাধারণ দর্শক সারিতে। সুলায়মানকেও কোথাও দেখা যাচ্ছিল না। দর্শনার্থীরা প্রতিযোগিদের উৎসাহিত করতে আনন্দ ধ্বনিতে ময়দান মুখরিত করে রাখছিল। শোরগোল এতোটাই তীব্র ছিল যে, কারো কথাই শোনা
যাচ্ছিল না। ময়দানের ধাবমান ঘোড়া ও উটগুলো এতো ধুলোবালি উড়াচ্ছিল যে, ধুলোর অন্ধকারেই ওরা হারিয়ে যাচ্ছিল।
“এখন ময়দান খালি করে দাও, কেউ মাঠে থাকবে না।” হঠাৎ শাহী ঘোষকের কণ্ঠে শোনা গেল জলদগম্ভীর নির্দেশ।
কয়েকবার এ ঘোষণা দেয়ার পর মাঠ সম্পূর্ণ খালি হয়ে গেল। উড়ন্ত ধুলোবালিও হ্রাস পেতে পেতে মাঠ পরিষ্কার হয়ে গেল। হঠাৎ মাঠের এক কোণ থেকে একটি তাজি ঘোড়া মাঠে প্রবেশ করলো। দেখলেই বোঝা যায় এটি সেনাবাহিনীর শাহী নিরাপত্তা ইউনিটের বিশেষ ঘোড়া। গলার নীচ থেকে লেজ পর্যন্ত ঘোড়ার পিঠ মখমল কাপড়ে আবৃত। সুদৃশ্য ঝালর পেটের দিকে ঝুলছে। সোনালী বর্ণের ঝিকমিকে দু’টি পাদানী ঝুলছে অশ্বপিষ্ঠের দু’পাশে। এ অশ্বপৃষ্ঠে বসা এক সুদর্শন যুবক। তার মাথায় লোহার শিরস্ত্রাণ, হাতে বর্শা। কিন্তু বর্শার মাথা চামড়া দিয়ে আবৃত। কোমরে ঝুলছে তরবারী। মাঠে প্রবেশ করে অশ্বারোহী একটা চক্কর দিলো। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল আরোহী শাহী খান্দানের বৈ-কি? আরোহী হাঁক দিলো- আছে কি তায়েফের কোন আরোহী যে আমার মোকাবেলা করার সাহস রাখে? আরোহী গলা ফাটিয়ে অজ্ঞাত প্রতিপক্ষের প্রতি হুমকি ছুড়ে দিলো। এ অশ্বারোহী আর কেউ নয়, খলিফা ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিকের ভাই শাহজাদা সুলায়মান। সে বিশেষ করে তায়েফের নাম উচ্চারণ করার দ্বারা মুহাম্মদ বিন কাসিমকে মোকাবেলায় প্রবৃত্ত হওয়ার আহবান করছে।
শাহজাদার এই হুমকিমূলক আহবানে ময়দান জুড়ে নেমে এলো নীরবতা। ভবিতব্য দেখার জন্য সকল দর্শনার্থী উৎকর্ণ ও অপলক নেত্রে মাঠের দিকে তাকিয়ে রইল। এমন সময় মাঠের এক কোণ থেকে প্রবেশ করলো এক অশ্বারোহী। এটিও সেনাবাহিনীর চৌকস সওয়ারী। এর আরোহীও যুবক। হাতে বর্শা আর কোমরে ঝুলন্ত তরবারী।
“ইবনে আব্দুল মালিক! তায়েফের কাসিম বিন ইউসুফের ছেলে তোমার। মোকাবেলা করতে এসেছে।” শাহজাদার হুমকির জবাবে পাল্টা হুমকি ছেড়ে দিলো যুবক। সারা ময়দান জুড়ে তখন পিনপতন নীরবতা।
কিছুক্ষণ পর মাঠের দু’প্রান্ত থেকে পরস্পরের প্রতি আক্রমণ শানিয়ে ঘোড়া হাঁকালো তারকা দুই প্রতিযোগী। উভয়েই পরস্পরের প্রতি বর্শা উদ্যত করলো। উভয়েই চাচ্ছিল বর্শার আঘাতে প্রতিপক্ষকে অশ্বপৃষ্ঠ থেকে ফেলে দিতে। মুখোমুখি এসে সুলায়মান বর্শা দিয়ে বিন কাসিমকে আঘাত করলো। বিন কাসিম আঘাত সামলে নিয়ে দূরে গিয়ে আবার মুখোমুখি উর্ধ্বশ্বাসে ঘোড়া হাঁকালো। দর্শনার্থীদের কারো চোখের পলক পড়ছে না। সবাই খলিফার আপন ভাই সুলায়মানকে চিনতো, প্রতিপক্ষ যুবককে অধিকাংশ লোক চিনতে না পারলেও এ মোকাবেলা যে বিশেষ তাৎপর্যবহ তা বুঝতে কারো বাকি রইল না।
এক পর্যায়ে পা-দানীতে দাঁড়িয়ে মুহাম্মদ বিন কাসিম সুলায়মানের দিকে বর্শার আঘাত হানলো। সুলায়মান নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করল বটে কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারল না। বর্শা তার পিঠে আঘাত হানলো। ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। বহু চেষ্টা করেও ঘোড়ার পিঠে নিজেকে ধরে রাখার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে নিজেই লাফ দিয়ে মাটিতে নেমে পড়ল। বর্শা পিঠে আঘাত হানলেও বিদ্ধ হলো না। কারণ বর্শার মুখে চামড়ার খোল ছিল।
অভিজাত যুবকদ্বয়ের এ যুদ্ধ এতে শেষ হয়নি। সুলায়মান ঘোড়া থেকে নেমে পড়ায় বিন কাসিমও লাফ দিয়ে ঘোড়া থেকে নেমে পড়ল এবং উভয়েই কোষমুক্ত করলো তরবারী। এবার পরস্পরের মধ্যে শুরু হলো অসিযুদ্ধ। শুরু হলো যুবকদ্বয়ের প্রচণ্ড মোকাবেলা। তরবারীর ঝলকানি ও আঘাতের শব্দে সারা ময়দানে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। উভয়েই সমানে সমান। আঘাতের তীব্রতা দেখে দর্শকদের মনে হচ্ছিল হারজিত নয় একে অপরকে মৃত্যুঘাটে পৌছে না দিয়ে এদের কেউ ক্ষান্ত হবে না। সুলায়মান বিন কাসিমের উদ্দেশে বলল, “বিন কাসিম! পরাজয় মেনে নাও। নয়তো তুমি যদি পড়ে যাও, অথবা তোমার তরবারী যদি পড়ে যায়, তাহলে কিন্তু আমি তোমার বুকে তলোয়ার বিদ্ধ করবো।” সুলায়মান ছিল আবেগ তাড়িত। সে যুবায়দাকে পাওয়ার জন্য খেলাচ্ছলে বিন কাসিমকে হত্যা করতেই উদ্যত ছিল। সুলায়মানের হুমকিতে মুহাম্মদ বিন কাসিম জবাব দেয়ার কোন প্রয়োজন বোধ করলো না।
হঠাৎ মুহাম্মদ বিন কাসিম সুলায়মানের বিরুদ্ধে আক্রমণ তীব্রতর করে তুলল। সুলায়মান তখন প্রতিঘাতের বিপরীতে আঘাত সামলাতেই হিমশিম খাচ্ছে। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে সুলায়মানের বেকাবু অবস্থা। মুহাম্মদ বিন
কাসিম সুলায়মানকে প্রতিঘাত করার কোন সুযোগই দিচ্ছিল না। এক পর্যায়ে এমন এক শক্ত আঘাত হানলো বিন কাসিম সুলায়মান আঘাত ফেরাতে সক্ষম হলো বটে; কিন্তু তরবারী তার হাত থেকে ছিটকে দূরে গিয়ে পড়লো। সে তরবারীর দিকে দৌড় দিলো বটে কিন্তু বিন কাসিম তাকে আর সেই সুযোগ দিলো না। সুলায়মান তখন খালি হাত। বিন কাসিম দুটি আঘাত করতেই ও পিছাতে পিছাতে পড়ে গেল। মুহাম্মদ বিন কাসিম তার একটি পা বুকের উপর রেখে তরবারী সুলায়মানের ঘাড়ে চেপে ধরলো।
মঞ্চ থেকে গর্জে উঠলেন হাজ্জাজ—“মুহাম্মদ তরবারী উঠিয়ে নাও।”
“ঠিক আছে আমি তোমাকে জীবন ভিক্ষা দিলাম।” দৃঢ় কণ্ঠে বলল বিন কাসিম। বনী ছাকিফের কসম করে বলছি— জীবনে আর কোনদিন তুমি তায়েফবাসীদের আত্মসম্মানে আঘাত করবে না।” “আমি জীবিত থাকলে তোর মতো হতভাগ্য আর কেউ দুনিয়াতে হবে না।
জমিন থেকে উঠতে উঠতে বলল সুলায়মান। সুলায়মান বিন আব্দুল মালিকের এ কথাগুলো কোন পরাজিতের আস্ফালন ছিল না। এ কথাগুলো ছিল তার জীবন-মরণ প্রতিজ্ঞা। এ প্রতিহিংসার প্রতিজ্ঞাই শেষ পর্যন্ত ভারতের বিজয় ইতিহাসের গতিপথ বদলে দিয়েছিল।
NICE STORY.