দূরের ভোর – উপন্যাস – বুদ্ধদেব গুহ
০১.
তোমার শোবার ঘরে একটা গডরেজের আলমারি ছিল। সে আলমারির সামনে রোজ সন্ধেবেলায় তুমি আমায় পড়াতে বসাতে। তুমি বসতে আলমারিতে হেলান দিয়ে, আমি তোমার সামনে খালিগায়ে খাকি হাফপ্যান্ট পরে বসে পড়াশোনা করতাম।
পড়তে বসার আগে পার্কে গিয়ে ফুটবল খেলতাম গরমের দিনে। তারপর চৌবাচ্চা থেকে ঝপাঝপ করে গায়ে জল ঢেলে স্নান করে নিতাম। তুমিও তার আগে গা ধুয়ে নিতে। তোমার গা দিয়ে সাবানের গন্ধ বেরোত।
তোমার গায়ের গন্ধ আমার চিরদিনই বড়ো প্রিয় ছিল। স্নান করে উঠে, তুমি বড়ো করে সিঁদুরের টিপ পরতে কপালে। বাড়িতে কাঁচা, কিন্তু পরিষ্কার শাড়ি-জামা পরতে স্নানের পর; তারপর নিজে-হাতে বানানো এককাপ চা খেতে। কখনো-সখনো আমি সেই চায়ের কাপের তলানিটুকু একঢেকে গিলে ফেলে তোমার কাছে বকুনি খেতাম।
তুমি যতদিন আমাকে পড়িয়েছিলে, আমি ততদিন সব পরীক্ষায় ফাস্ট হতাম। তুমি যখন আর পড়াতে পারতে না, তখন পড়াশোনায় খারাপ হয়ে গেছিলাম।
ভবানীপুরের বাড়িটার কথা এখনও পরিষ্কার মনে পড়ে আমার। বড়ো রাস্তা থেকে সরু গলি দিয়ে ভেতরে যেতে হত অনেকখানি। সরু, মানে ভীষণ সরু; তাতে দুজন লোক পাশাপাশি হাঁটতে অসুবিধা হত। সেই গলি দিয়ে গিয়ে ডানদিকে দরজা ছিল। সবুজ রং করা কাঠের দরজা। তাতে বাবার নাম লেখা ছিল : এম এন রায়।
সেটি ছিল বাইরের ঘর। শুধু বসবার নয়, আমাদের বাড়িতে যে কাজের লোক ছিল, রত্না, সেও শুত কখনো-সখনো। সেই ঘরই ছিল আমার পড়াশোনার ঘর, বাইরের লোকের বসবার ঘর; আরও অনেক কিছুর ঘর।
সেই ঘর পেরিয়ে এসে একফালি বারান্দা। সেই বারান্দার পাশে ছোট্ট একটু উঠোন মতো। উঠোনে নেমে ডানদিকে ছিল পায়খানা। গ্রাম্য প্ল্যান ছিল বাড়িটার।
সেই বারান্দার পাশে, বসবার ঘরের লাগোয়া শোবার ঘর, যে ঘরে সেই গডরেজের আলমারি। আলমারির সামনে একটু ফাঁকা জায়গা আর ঘর-জোড়া খাট। পুবে ছিল দুটো বড়ো বড়ো জানলা আর জানলার সামনেই খাট; মানে তক্তপোশ। সেখানেই আগে আমি
তোমার সঙ্গে শুতাম। বিনু ও মিনু, আমার দুই বোনও শুত। আর তার পাশেই গডরেজের আলমারির উলটোদিকে আর একটা খাট ছিল। সেই খাটে বাবা শুতেন। আমি যখন বড় হয়ে গেলাম, বোনেরাও যখন আস্তে আস্তে বড়ো হল, তখন আর ওই ভেতরের ঘরে শুতাম না, বাইরের ঘরে গিয়ে শুতাম ঠাকুমার সঙ্গে।
পথে পথে গ্যাসের বাতি জ্বলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই পড়তে বসতে হত। বেশ কিছুক্ষণ পড়াশোনা হওয়ার পর বাবা আসতেন অফিস থেকে। এসে ওই ঘরেই খাটের ওপর বসে জুতো খুলতেন, কোটটা খুলে হ্যাঁগারে তুলে, দেয়ালের পেরেকে টাঙিয়ে রাখতেন। তারপর জামা-প্যান্ট খুলে, লুঙ্গি-গামছা নিয়ে বাথরুমে যেতেন স্নান করতে।
বাথরুমটা ছিল শোবার ঘরের পাশে যে আরও একটা ঘর, সেই ঘর পেরিয়ে গিয়ে। সিঁড়ি ভেঙে নামতে হত। বাথরুমটা ছোট্ট। টিনের ছাদ-দেওয়া। টিনের দরজা। বড়ো একটা চৌবাচ্চা। বাথরুমের পাশেই ছিল রান্নাঘর, রান্নাঘরের ভিত উঁচু ছিল না। বর্ষাকালে রান্নার ঘর ভেসে যেত জলে। নর্দমার জল ভরে যেত রান্নাঘরে। রান্নাকরা জিনিসসমেত হাঁড়িকুড়ি বাসনপত্র সব ঘরময় ভেসে বেড়াত। তারমধ্যে সাঁতার কাটত তেলাপোকা, ডুবে মরত নেংটি ইঁদুরের বাচ্চা।
এক বর্ষার রাতে আমরা যখন শোয়ার ঘরের পাশের ঘরে মেঝেয় বেতে-বোনা আসন পেতে বসে খাচ্ছিলাম, তখন এক কান্ড হয়েছিল। খিচুড়ি রান্না হয়েছিল সেদিন। রান্না করেছিল বুড়ো কেষ্ট। তার বাড়ি ছিল ওড়িশাতে। বড়ো ভালো লোক ছিল বুড়ো। চোখে বড়ো কম দেখত, তার ওপর ছিল রাতকানা। কড়াইতে যখন আলু ভাজছে সে, আলুর সঙ্গে দুটো তেলাপোকাও ভাজা হয়ে গেছিল। কেষ্ট রাত্তিরে দেখত না। দোষ ওর ছিল না। দোষ তেলাপোকা দুটোরই। তারা আত্মহত্যা করবে বলে আলুর সঙ্গে কড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে না-পড়লে এমন কান্ডটা ঘটত না।
আলুভাজার সঙ্গে খিচুড়ি মেখে খাচ্ছি, আলুভাজা মুখে পুরে দিতে কেমন যেন একটা নতুন নতুন স্বাদ মনে হল। মুখের মধ্যে মচমচ করে উঠল। সেই মচমচানিটা আলুভাজার মচমচানি থেকে একেবারেই অন্যরকম লাগল। স্বাদটাও, বলা বাহুল্য ভিন্ন। তাড়াতাড়ি মুখ থেকে আলু বের করে দেখি যে, আলু নয়, কড়কড়ে করে ভাজা তেলাপোকা।
যে ঘরে বসে আমরা খাচ্ছিলাম, সে ঘরটার চতুর্দিকে বাক্সের পর প্যাঁটরা, তার ওপরে বাক্স, তার ওপরে হাঁড়ি-কুড়ি, চাল-ডাল, আনাজ-তরকারি সব কিছুই থাকত। সেই ঘরেরই একটা কোনায় ছিল ঠাকুরঘর। একটা কাঠের সিংহাসনে ঠাকুমার তেত্রিশ কোটি না-হলেও অন্ততপক্ষে তেত্রিশ-জন ঠাকুর দেবতা সাজানো থাকতেন। অন্যপাশে ঠাকুমা তখন হবিষ্য রান্না করতেন। তুমি সব জোগাড় করে দিতে। ঠাকুমা তখন নিজেই রান্না করতেন এবং মাঝে মাঝে সে হবিষ্য রান্নার ভার তোমার ওপরও পড়ত।
ঝকঝকে করে মাজা পেতলের হাঁড়ি, শ্বেতপাথরের থালা, লাল পাথরের গ্লাস, কালো পাথরের বাটিতে খেতেন। সবসময় ওই ঘরটা থেকে কেমন একটা সোঁদা সোঁদা মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ বেরোত। সে গন্ধটা একটা মিশ্রগন্ধ। চাল-ডাল, তেল-নুন, শুকনো লংকা, কালোজিরে, গোলমরিচ এইসব গন্ধের সঙ্গে মিশে থাকত বাসি ফুলের গন্ধ, চন্দনের গন্ধ, ধূপের গন্ধ, বাতাসার গন্ধ, কদমার গন্ধ, নারকেলের গন্ধ, আর ঠাকুমার হবিষ্য রান্নার আতপ চাল এবং ঘিয়ের গন্ধ।
সেই ঘরটার পাশে একটা গলি ছিল। সে গলিটা কানাগলি। সেই গলির মধ্যে ওই তেতলা বাড়ির যত টুকিটাকি অপ্রয়োজনীয় জিনিস সব ফেলা হত। আমি কিছু ফেলতাম না। দোতলার ভাড়াটে ও তেতলার বাড়িওয়ালারা অনেককিছুই সেখানে ফেলতেন। সেই ঘরের লাগোয়া যে বড়ো জানলাটা ছিল, সেই জানলাটার তাকে বসে গরাদ দিয়ে আমি পাশের গলিটার দিকে তাকিয়ে থাকতাম।
দুপুর বেলায়, ছুটির দিনে অথবা গরমের ছুটির সময় যখন সারাবাড়ি নিঝুম, মধ্যের ঘরে মা, বোনেদের নিয়ে খাওয়া-দাওয়ার পরে শুয়ে থাকতেন তখন আমি জানলার তাকে বসে সেই গলিটার দিকে তাকিয়ে থাকতাম।
কেউ আম খেয়ে আঁটি ফেলেছিল কখনো, সেই আঁটি থেকে গজিয়ে উঠেছে নতুন আমের চিকণ চারা। ফেলে-দেওয়া শিশি-বোতলের টুকরো, ভেঙে যাওয়া, ব্যবহারে মলিন রঙিন চিরুনি, রিবন, কদবেলের খোসা, ভাঙা কাঁচের চুড়ি, নানা ন্যাকড়া, নানারকম কাগজ, ঠোঙা আরও কত কী! সেই বিচিত্র আবর্জনার মধ্যে নিস্তব্ধ গ্রীষ্ম-দুপুরে একা একা চেয়ে থাকতে থাকতে যে কী সৌন্দর্য, কী শান্তি দেখতে পেতাম তখন, এখন সেকথা ভাবলেও অবাক লাগে।
ছেলেবেলায় সবকিছুই এত ভালো লাগত! চোখ তখন এত অনাবিল ছিল, মন তখন এত সরল ছিল, তখন পৃথিবীর এই কুটিল কুচক্রী আবর্ত সম্বন্ধে মানুষের জ্ঞান এত কম থাকে যে, কাকের চেহারার মধ্যেও পরমসৌন্দর্য চোখে পড়ত তখন। বন্ধ গলির আবর্জনার মধ্যে আবিষ্কৃত হত পরম ঐশ্বর্য।
খাঁ-খাঁ দুপুরে ঝাঁঝাঁ করে চলে যাওয়া ট্রামের আওয়াজের মধ্যে দূরের রহস্যময় দিগন্ত সুপ্ত ছিল তখন। কল্পনা ছিল অবাধ, অবকাশ অনন্ত, কত ছোটোই ছিলাম তখন কিন্তু কল্পনার ঘোড়ার বলগা ধরে বসে কোথায়-না-কোথায় যে চলে যেতাম, কেউই আমাকে বাধা দিত না। কেউই খবরদারি করতে আসত না। কোথাওই হারিয়ে যাওয়ার মানা ছিল না তখন মনে মনে।
.
০২.
বাড়িওয়ালা মজুমদারবাবুরা তখন তেতলায় থাকতেন। দোতলায় থাকত দীপালিরা। রোজ সন্ধেবেলায় ঘুঙুর পরে গান আর নাচ শিখত তার মাস্টারমশাইর কাছে। এখনও কানে আসে দীপালির গান, নূপুর বেজে যায় রিনিরিনি, আমার মন কয় চিনি চিনি।
একদিন রবিবার সকালে দীপালিদের বাড়িতে মাংস রান্না হচ্ছিল। আমাদের বাড়িতেও তুমি মাংস রাঁধতে কোনো কোনো রবিবারে। তবে মাংস তখন রোজ অথবা প্রায়ই হত না। মাংসের গন্ধ আলুর গন্ধের সঙ্গে মিশে, গরম মশলার গন্ধের সঙ্গে একাত্ম হয়ে সমস্ত বাড়িময় ম ম করত। জিভে জল আসত।
আমি সেদিন সকালে দোতলায় দিলীপ-দীপালিদের সঙ্গে খেলতে যাবার সময় তোমাকে বলেছিলাম, কী সুন্দর মাংসের গন্ধ বেরোচ্ছে, না মা!
তুমি বলেছিলে, তোমাদেরও মাংস বেঁধে খাওয়াব খোকন। তুমি যেন আবার ওদের কাছে মাংস খেতে চেয়ো না। মাংস তো খাও-না এমন নয়, তোমার স্বভাবটা এমন কেন?
এমন কথা সব মায়েরাই হয়তো সব ছেলেদের বলেন। শুধু এই কথার জন্যেই একথার উল্লেখ করছি না। কিন্তু তোমার মধ্যে এমন একটা শালীনতা বোধ ছিল, এমন সুন্দর অভিজাত শিক্ষা ছিল তোমার মধ্যে যে, খুব কম দরিদ্র পরিবারেই আমি তা দেখেছি।
দরিদ্র বলাই ভালো। যদিও দরিদ্রকে নিম্ন-মধ্যবিত্ত বলে আমরা একটা গালভরা নামে ডেকে থাকি।
আমাদের পরিবারে বাবাই একমাত্র রোজগেরে লোক ছিলেন। তখন তাঁর রোজগারও ছিল যৎসামান্য। কাকারা তখনও কেউই নিজের পায়ে দাঁড়াননি। উত্তরবঙ্গে কিছু সম্পত্তি তখন ছিল এবং তখনও দেশ ভাগও হয়নি। কিন্তু সে তো এজমালি সম্পত্তি এবং সেখানে কী রোজগার হত, কী হত না তা আমার জানার কথা ছিল না এবং জানার ইচ্ছাও ছিল না।
আমি যখন ছোটো ছিলাম সেই ছেলেবেলায় অনেকখানি সময়েই যেভাবে তুমি সংসারকে টেনে নিয়ে গেছ এক শিশুর চোখের সামনে দিয়ে–সেই টানাটানির সংসারকে ধনীর সংসার বলে কখনো মনে হয়নি। দারিদ্র্য হয়তো ছিল কিন্তু তোমার মনে কখনো কোনো দারিদ্র্য দেখিনি। তোমাকে দেখেই শিখেছিলাম যে, মানুষ ধনবান বা ধনহীন হতে পারে কিন্তু সত্যিকারের ধনী অথবা গরিব হয় মানুষ মনেই।
যদি কোনোদিন মনের ধনে ধনী হতে পারি, তবে একথা নিশ্চয়ই জানব যে, সে দান। তোমার-ইদান।
তখন প্রতিমাসেই বাবাকে দেখেছি আমাদের বাড়ির যে চাকর, তার কাছ থেকে মাসের শেষে কুড়ি কি তিরিশ টাকা ধার নিতে। মাইনে পাওয়ার পর অবশ্য সে ধার বাবা শোধ করে দিতেন। বাবাকে দেখেছি ট্রামের সেকেণ্ড ক্লাস কম্পার্টমেন্টে উঠে অফিসে যেতে। বাবাকে দেখেছি সাইকেল চড়েও অফিসে যেতে এবং অফিস থেকে ফিরে আসতে। এবং রবিবার সারাসকাল বসে সেই সাইকেলকে যত্ন করে ধুয়ে-মুছে তেল লাগাতে।
অতিসাধারণ ছিল আমাদের জীবনযাত্রা। তাতে কোনো বাবুয়ানি ছিল না।
কিন্তু তুমি বড়ো শৌখিন ছিলে মনে মনে। তুমি মাঝে মাঝেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে : আমায় আর তো কোনো শখ নেই। একমাত্র শখ ছিল ছেলে-মেয়েগুলোকে একটু ভালো জামাকাপড় পরাব, যখন বাইরে যাবে আমার সঙ্গে, তখন সুন্দর করে সাজিয়ে নিয়ে যাব। সে শখটুকুও পূরণ হল না।
বাবা চিরদিনই খুব প্র্যাকটিক্যাল মানুষ ছিলেন। তিনি কখনো তোমার মনের এই দিকটার খোঁজ রাখেননি। খোঁজ রাখলেও তার দাম দেওয়া বাস্তব কারণে প্রয়োজন মনে করেননি। হয়তো তা অসম্ভবও ছিল। অবশ্য এই বাবাই তোমাকে সমস্তরকম পার্থিব সুখ দিয়েছিলেন পরবর্তী জীবনে।
আজকে তুমি নেই; থাকলে জিজ্ঞেস করে জানতে পারতাম হয়তো যে, তুমি কি সত্যিই তোমার যা কিছু চাওয়ার ছিল, সবই পেয়েছিলে? টাকা হলেই কি মানুষ সুখী হয়? বড়ো বাড়িতে থাকলে, গাড়িতে চড়লেই কি মানুষ সমস্ত অপ্রাপ্তির হাত থেকে বেঁচে যায়?
সে কথার উত্তর আজকে আর পাওয়ার উপায় নেই। তবে আমি যখন আরও বড়ো হয়েছি, যখন কলেজে পড়ি, তুমি প্রায়ই বলতে, সব স্বামী স্ত্রীর মধ্যেই মনোমালিন্য বাদানুবাদ হয়, কিন্তু বাবা যেমন ঝগড়াঝাঁটি করেন তোমার সঙ্গে, তেমন ভালোও বাসতে জানেন। বাবার মতো ভালো নাকি কম লোকই বাসতে জানেন।
একথা বাবা জানেন কিনা জানি না। তুমি হয়তো একথা বাবাকে কোনোদিন এলনি। আজ তুমি নেই বলে তোমার মুখের কথা মনে পড়ছে।
তুমি ছেলেবেলায় বিহারের এক সুন্দর ছোট্ট শহরে মানুষ হয়েছিলে। শালবন, উশ্রী নদী, খাডুলী পাহাড়–এই সমস্তর স্মৃতি তোমার চোখে আঁকা ছিল। তুমি ছিলে জন্ম-রোমান্টিক। কোনো বর্ষার দিনে, কি কোনো চাঁদনি রাতে তোমার মধ্যের এই রোমান্টিক মানুষটি মাথা চাড়া দিয়ে উঠত।
কত কষ্ট ছিল তোমার, সব কষ্ট বোঝার মতো আমার বুদ্ধি ও মানসিকতা ছিল না। কিন্তু কোনো কষ্টই তোমার উচ্ছল, সৌন্দর্য-পিপাসু, প্রকৃতি-পাগল মনটাকে একটুও বিকৃত করতে পারত না। কোনোদিনই পারেনি। এবং আমি যদি তোমার কাছ থেকে কিছুমাত্র গুণ পেয়ে থাকি, তা বোধ হয় তোমার ওই সৌন্দর্য-পিপাসা।
তোমার এই কবি-কবি ভাবের জন্যে বাবা তোমাকে প্রায়ই ঠাট্টা করতেন। তুমি হাসতে। কখনো ঝগড়া করোনি বাবার সঙ্গে। ঝগড়া বলতে যা বোঝায়। বাবা আর তোমার মধ্যে মিল বলতে এটুকুই ছিল যে, তোমরা দুজনেই দুজনকে ভালোবাসতে এবং ভালোমানুষ ছিলে। কিন্তু অন্য অনেক ব্যাপারে তোমাদের মধ্যে কোনো মিল ছিল না। তবে সে অমিল এমন নয় যে, সম্পর্কে কোনো ফাটল ধরায়।
অথবা অন্যভাবে বলতে গেলে বলতে হয় যে, সেযুগে মেয়েদের কোনোরকম স্বাধীনতা ছিল না। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা তো নয়ই। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও খুব কম নারীর ছিল, যদিও তুমি শিক্ষিত ছিলে। তবুও তখনও স্ত্রীদের কাছে পতিমাত্রই পরমগুরু বলে পরিগণিত হতেন।
তবে বাবাকে তুমি নিছক পতি বলেই শ্রদ্ধা করোনি, একজন পুরুষের মধ্যে যেসব গুণ থাকলে একজন নারীর শ্রদ্ধার পাত্র হওয়া যায় বাবার মধ্যে সেইসব গুণ পর্যাপ্ত পরিমাণে ছিল। বাবা ছিলেন পৌরুষের সংজ্ঞা। কাজের ক্ষমতা, আত্মবিশ্বাস, পুরুষালি জেদ, সাহস, আত্মনির্ভরতা, মর্যাদাবোধ এ-সমস্তই তাঁর মধ্যে প্রবলমাত্রায় ছিল। আর তোমার মধ্যে ছিল চিরাচরিত ভারতীয় নমনীয় নারীর সুন্দর স্নিগ্ধ পরনির্ভরতা। পরের ওপর পরনির্ভরশীল অনেকেই হয়তো হয়, কিন্তু পরনির্ভরতা যে, একটা উঁচুদরের আর্ট, তা একমাত্র আমাদের দেশের মেয়েরাই জানে।
তোমাকে দেখে অন্তত একথা আমার চিরদিনই মনে হয়েছে।
তুমি মানুষ হয়েছিলে ব্রাহ্ম পরিবেশে। যে-পরিবেশে কথা বলার সময় দাঁত দেখানো, হাসবার সময় মুখ বড়ো করে হাসা, উঁচু গলায় কথা বলা বারণ। আরও অনেক ব্যাপারে তখনকার দিনে ব্রাহ্ম প্রভাব অনেকানেক শিক্ষিত বাঙালি পরিবারে বেশ বেশিমাত্রায় পড়েছিল।
আমার পিতৃপরিবার কিন্তু হিন্দু ছিলেন। শুধু হিন্দু বললে পুরোপুরি বোধ হয় ঠিক বলা হয় না। অব্রাহ্ম বলাটাই ভালো।
সে কারণে খুবই বুঝতে পারতাম যে, তোমার পক্ষে বহুদিন পর্যন্ত এই অব্রাহ্ম পরিবেশ মানিয়ে নেওয়া বড়ো কষ্টকর হত। কিন্তু তোমাকে দেখেই শিখেছি, যেকোনো পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিয়েও নিজের স্বাতন্ত্র ও নিজের চরিত্র সম্পূর্ণভাবে কীভাবে বজায় রাখা যায়।
তোমার নিজের কাছে যে, মানুষটি ছিলে তুমি, অথবা তোমার প্রিয় ছেলে-মেয়ের কাছে, সে-তুমি ছিলে অন্য মানুষ। সে মানুষের মানসিকতায় সংসারের গ্লানি, গৌরব, একঘেয়েমি কোনো ছাপই রাখতে পারত না। তোমার আত্মার উজ্জ্বল স্বয়ংসিদ্ধ আনন্দে তুমি সবসময় ঝিকমিক করতে। তোমার প্রকৃত অন্তরঙ্গ রূপ আমি জেনেছিলাম আমার হৃদয়ে; অতিঅল্প বয়সেই।
আমি আম খেতে খুব ভালোবাসতাম। তুমিও। বাবার এক জ্ঞাতি কাকা, বরিশালের মানুষ তিনি; মাঝে মাঝেই ধূমকেতুর মতো উদয় হতেন আমাদের বাড়িতে। বাবার কাকা বলেই মা তাঁকে পরম যত্নে আপ্যায়ন করতেন এবং আমাদেরও শিক্ষা দিতেন তাঁকে যথেষ্ট পরিমাণে শ্রদ্ধা-ভক্তি করতে।
তখন খুবই ছোটো ছিলাম। তবুও আজ এতবছর পরে যখন পেছন ফিরে তাকাই, তখন মনে হয় যে, শ্রদ্ধা বা ভক্তি এমনই জিনিস যে, তাকে জোর করে আদায় করা যায় না।
বরিশালের দাদু হাতে করে কোনোদিন খুব বড়ো একটা ফজলি আম নিয়ে আসতেন। কোনোদিন-বা চারটে ভারি ভালো ল্যাংড়া। সেই আমের গন্ধে বাড়ি ভরে যেত। কখনো কখনো বা তিনি জলযোগ থেকে দই রসগোল্লা নিয়ে আসতেন। এনে বলতেন, বউমা, আমার খাওয়ার সময় আমাকে দিয়ে। মা যখন এতখানি ঘোমটা টেনে বসে সেই আম বঁটিতে কাটতেন, আমি বঁটির সামনে চুপ করে বসে দেখতাম।
খাওয়ার ব্যাপারে আমি ছেলেবেলা থেকেই বড়ো লোভী ছিলাম। এখনও হয়তো আছি। জানি না। লোভী লোকেরা সচরাচর স্বীকার করে না তাদের লোভের কথা। খাওয়া ছাড়াও অন্য লোভের কথাও।
মা যখন আম কাটতেন, আমি বসে থাকতাম। মা হাসতে হাসতে আমাকে বলতেন, খোকন লোভ দিয়ো না।
আমি বলতাম, না মা।
তারপর বলতেন, বাবুকে বলব একদিন তোদের অনেক আম এনে দেবেন, কেমন?
আমি বলতাম, হ্যাঁ মা।
তারপর দেখতাম, বঁটিতে আম কাটতে কাটতে মার দু-চোখ বেয়ে জলের ধারা নেমেছে। মা সেই আম সুন্দর করে সাজিয়ে দাদুকে খেতে দিতেন। দাদু পরমপ্রীতির সঙ্গে সেই আম খেতেন।
শুধু আম নয়, দাদু যাই-ই আনতেন হাতে করে, বলতেন, বউমা আমাকে খাবার সময় দিয়ো। মা তাই দিতেন।
শিশুমনে শ্রদ্ধা বা ভক্তি আপনা থেকেই উদয় হয় না। আমার পক্ষে যেহেতু সেই স্বার্থপর বৃদ্ধ, আমার বাবার গুরুজন, সেই একমাত্র কারণবশেই আমার পক্ষে সেই মানুষকে শ্রদ্ধা করা সম্ভব হত না।
আমি হয়তো লোভী ছিলাম। কিন্তু সেই শিশুর লোভের পরিপ্রেক্ষিতে একজন বৃদ্ধর চক্ষুলজ্জাহীন লোভের কোনো তুলনাই ছিল না।
কখনো তুমি এলনি, অন্য কারও কোনো দোষের, কারও কোনো অন্যায়ের কথা। তুমি চিরদিন আমাদেরই শাসন করেছিলে।
সংসারে কিছু কিছু মানুষ থাকে, যাদের কপালে আদর লেখা নেই। আদরের ভাগ্য তারা করে আসেনি, হয়তো আমি সেই শ্রেণির লোক। কিন্তু তুমিই শিখিয়েছিলে যে, আদর পাওয়ার চেয়ে আদর করা অনেক বড়। আদর খেতে সকলেই জানে, আদর ছিনিয়ে নিতেও জানে অনেকে। কিন্তু অন্যমানুষকে নিঃশর্তভাবে শুধু হৃদয়ের আনন্দের জন্যই আদর কী করে করতে হয় সেকথা খুব কম মানুষই জানে।
আমাদের বাড়ির পেছনে যে, ছোট্ট বাগানের কথা বলেছিলাম বাথরুমের পাশে, সেটি লম্বা-চওড়ায় বোধ হয় পনেরো ফিট বাই তিরিশ ফিট ছিল। কিন্তু যেহেতু আমি নিজে অত্যন্ত ছোটো ছিলাম, আমার পদক্ষেপ ছিল সংক্ষিপ্ত, আমার উচ্চতা ছিল কম, আমার চোখে সেই বাগানকে মনে হত এক বিরাট অরণ্য। সেই বাগানের মধ্যে ছুটির দিনে সারাদুপুর নদী বানাতাম, পাহাড় সাজাতাম, বাথরুম থেকে মগে করে জল এনে সেই নদীতে বান বওয়াতাম। ছোটো ছোটো ঘাসকে বড়ো বড়ো বনস্পতি কল্পনা করে গভীর ছায়াচ্ছন্ন নির্জন অরণ্যের দুপুরে ভয় ও আনন্দের আলোছায়ায় আমি একা একা অ্যাডভেঞ্চার করতাম।
রথের মেলা থেকে একটি করবী গাছের চারা আমাকে কিনে দিয়েছিলেন সেজোকাকু। রক্তকরবী। সেই চারাটি লাগানো ছিল বাগানের খিড়কি দরজার পাশে। দেখতে দেখতে চারাটি বড়ো হয়ে পাতায় ফুলে ভরে গেছিল।
বাগানটার দেওয়ালের পেছনে ছিল এক প্রকান্ড মাঠ। প্রকান্ডতর মনে হত শিশুর চোখে। রাতভর বৃষ্টির পর সেই মাঠ জলে থইথই করত। আর কোথা থেকে কী জানি শয়ে শয়ে হলুদ সোনা-ব্যাং এসে ভোরবেলা থেকে ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর করে ডাকাডাকি করত, ওই মাঠেই শীতকালে একপাল ভেড়া এনে ভেড়াঅলা তাদের হাত-পা বেঁধে শুইয়ে ফেলে লোম কাটাত।
কলকাতার একেবারে বুকের মধ্যেও তখনও এমন এমন অনেক নির্জন জায়গা ছিল। তখন এমন অনেক কিছুই ছিল শিশুদের অনাবিল আকর্ষণের এই হৃদয়হীন গাঘিনঘিন ভিড়ের এই শহরে। অনেক গাছ ছিল, পাখি ছিল, পাড়ায় পাড়ায় ফাঁকা জমি ছিল রোদ ও মেঘের খেলা ছিল, নিস্তব্ধ দুপুরে একটা ট্রামের আওয়াজ ছিল, সকাল বিকেল কর্পোরেশনের লোকের পাইপে করে ফটফট শব্দ করে রাস্তা ধাওয়া ছিল। আজকের মতো আবর্জনার স্তূপে ভরা নোংরা, শ্রীহীন দোকানময় ফুটপাথে মোড়া ছিল না কলকাতা।
বিকেলের দিকে যখন আলো পড়ে আসত তখন সেই মাঠের এককোনায় দাঁড়ানো নিমগাছটার চতুর্দিকে চাতক পাখিরা ফটিক জল, ফটিক জল বলে, চাবুকের মতো ডাক ডেকে ঘুরে ঘুরে উড়ত। সেই মাঠের এককোনায় একটা শিমুল তুলোর গাছ ছিল। ঋতুতে ফুল ফেটে সেই তুলো ছোট্ট ছোট্ট গোলমরিচের মতো কালোবীজের সঙ্গে আলতো হয়ে হাঁসের বুকের পালকের মতো নরম রেশমি শরীরে হাওয়ায় হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে নাচতে নাচতে কোথায় না কোথায় চলে যেত। শিশুমনে সেই সমস্ত প্রাকৃতিক সামান্যতারও এক বিরাট ভূমিকা ছিল।
ছুটির দিনের দুপুরে তুমি খাওয়া-দাওয়ার পর আমাদের নিয়ে শুতে, কোনোদিন বা রাজকাহিনি পড়ে শোনাতে। অবন ঠাকুরের রাজকাহিনি। হাম্বীরের গল্প, চন্ডের গল্প, গোহোর গল্প, আরও কতসব গল্প। আরও অনেকানেক বই। আঙ্কল টমস কেবিন। রবি ঠাকুরের বই।
তোমার সুললিত কণ্ঠস্বরে যেসব গল্প একদিন তোমার মুখে শুনেছিলাম, সেই সমস্ত গল্প চিত্রকল্প হয়ে আমার চোখে আঁকা আছে। সেই চিত্রকল্পের জগৎ থেকে ছুটি হবে তখনই, যখন আমার এ-চোখ চিতায় পুড়ে ছাই হবে।
বাইরের ঘরে গোপীকাকু ও চানুকাকুও থাকতেন। রাতে মেঝেতে ঢালা বিছানা করে, ঠাকুমা, আমি, ছোটোকাকু, আর ওঁরা দুজনেও শুতাম। গোপীকাকু কোথায় যেন কাজ করতেন। খিদিরপুরে না কোথায়। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা সমস্ত ঋতুতে ভোর চারটেয় তিনি উঠতেন, উঠে স্নান করে নিয়ে ছোট্ট টিফিনের বাটিতে হাতে-গড়া আটার রুটি এবং আলুর তরকারি নিয়ে সাইকেল চড়ে বেরিয়ে যেতেন কাজে। ফিরতেন সেই সন্ধেবেলায়।
তুমিও প্রায় সেই সময়ই উঠতে। সেই সময় থেকেই শুরু হত তোমার দৈনন্দিন জীবনের কর্তব্য। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত যৌথপরিবারের তাবৎ কর্তব্য-কৰ্ম হাসিমুখে সম্পন্ন করতে তুমি। সে যুগে পূর্ববঙ্গীয় পরিবারমাত্রই এমনভাবে যৌথ ছিল যে, সেরকম পরিবার আজকাল আর চোখে পড়ে না। বসবাস খাওয়া-দাওয়ার যৌথতা ছাড়াও অতিথি আগন্তুকের কমতি ছিল না। তখন এদেশীয় জীবনযাত্রা বড়োই মন্থর ছিল। মানুষ মাত্রই খুব অল্পে সন্তুষ্ট ছিল। মানুষ হয়তো অপেক্ষাকৃত অলসও ছিল। প্রত্যেকেরই বোধ হয় হাতে অবকাশ ছিল প্রচুর। জাগতিক ব্যাপারে উচ্চাশাও বোধ হয় এখনকার মতো সর্বগ্রাসী ছিল না।
আমরা অত কষ্টে থাকতাম, অত অল্প জায়গায়, অত লোকের মধ্যে, অত অসুবিধার মধ্যে, কিন্তু তবুও যেকোনো সময়েই কোনো অতিথি বাড়িতে এলে তাঁকে না-খাইয়ে ছাড়া হত না। খাওয়া মানে, পোলাও-মাংস নয়, যাই-ই রান্না হত, তাই-ই তাঁরাও দু-মুঠো খেয়ে যেতেন আমাদের সঙ্গে।
এই সমস্ত রেওয়াজের যেমন ভালো একটা দিক ছিল, তেমন খারাপ দিকও ছিল। ভালোদিক বলতে, শিশুবেলা থেকেই ওই পরিবেশে আমরা অভ্যস্ত হয়েছিলাম। তা থেকে কিছু শিখি আর নাই-ই শিখি। সকলকে নিয়ে জড়িয়ে থাকা দেখেছিলাম।
কিন্তু খারাপ দিকের মধ্যে ছিল বহু দূরসম্পর্কের আত্মীয়-স্বজন, জ্ঞাতি-কুটুম্ব আমাদের সেই ছোট্ট বাসাবাড়িকে কলকাতার বিনিপয়সার অতিথিশালা বলে মনে করতেন। এমন অনেক অনেক লোকের মুখ এখনও চোখে ভাসে, যাঁদের পরবর্তী জীবনে কখনো দেখিনি, কখনো কাছে পাইনি আমাদের কোনো বিপদে বা আপদে।
সমস্ত সময় এমন গোলমাল, আসা-যাওয়া, খাওয়া-দাওয়া আমার ভালো লাগত না। একটুও একা থাকা মুশকিল ছিল। খাওয়া ব্যাপারটা পূর্ববঙ্গীয় সমস্ত মানুষের কাছেই একটা অবসেশন। তাঁরা সকলেই বিশ্বাস করেন যে, কারও হৃদয়ে পৌঁছোবার একমাত্র পথই হচ্ছে পেটের মধ্য দিয়ে। কাউকে খাইয়ে যতখানি আদর করা যায়, আর কিছু করেই অতখানি আদর করা যায় না।
সমস্ত যৌথপরিবারে মা অমোঘ, আমাদের পরিবারেও সেই অমোঘতা বিদ্যমান ছিল। পরিবারে যে মানুষটি করে, তাকে একাই সব করতে হত। ঘরে মাকে; বাইরে বাবাকে। যে বোঝা বয়, সে চিরদিনই বোঝা বইত। আর অন্য অনেকেই গায়ে হাওয়া দিয়ে, পরনিন্দা পরচর্চা করে এবং আরও অনেকানেক শখের পেছনে সময় এবং জীবন কাটিয়ে তাঁদের যে কারও প্রতি কিছুমাত্র কর্তব্য ছিল একথা বেমালুম ভুলে গিয়ে দিব্যি খোশমেজাজে বিবেকরহিত হয়ে থাকতেন।
বেশিরভাগ নির্ধন যৌথ-পরিবারেই এই নিয়ম চলে এসেছে। চিরদিন। যৌথ-পরিবারের অনেকানেক ভালদিক থাকা সত্ত্বেও যে আজ যৌথ-পরিবার বিরল হয়ে এসেছে তার এইটা একটা বড়ো কারণ।
নিম্ন-মধ্যবিত্ত যৌথ-পরিবারে সবচেয়ে বড়ো অভিশাপ এই যে, শিশুরা বড়ো অবহেলিত হয়। তাদের কোনো নির্জনতা থাকে না, তাদের পড়ার জায়গা, তাদের সুবিধা-অসুবিধা, তাদের মানসিকতা সম্বন্ধে বাড়ির বড়োদের সকলেরই নিদারুণ উদাসীনতা পরিলক্ষিত হয়।
তা নিঃসন্দেহে সমালোচনার। এবং হয়তো নিন্দারও।
.
০৩.
মাগো, তোমার কথা বলতে বসে কত কী অবান্তর কথা মনে আসছে!
কিন্তু এসমস্তই তোমার স্মৃতি ঘিরে। তুমি ছিলে বলেই এইসমস্ত কিছুর অবতারণা আজ। তোমাকে সারাদিনে খুব বেশি কাছে পেতাম না। কিন্তু তবুও যখন পেতাম, তোমার স্নিগ্ধ, সুন্দর, উজ্জ্বল সান্নিধ্য আমার মনে, আমার শরীরে এমন এক প্রলেপ লাগাত যে, তা আজও অন্তরে, শরীরে অনুভব করি।
জ্বরের মধ্যে বেহুঁশ হয়ে যখন পড়ে থাকতাম; যখন তুমি কপালে তোমার নরম হাত রাখতে, তখন মনে হত বুঝি সমস্ত কষ্ট দূর হয়ে গেল। অসুখ করলে, সে যে বয়েসেই হোক না কেন, তুমি চিরদিন আমাকে কাছে টেনে নিতে, তোমার কাছে রাখতে। যখন অনেক বড়ো হয়েছিলাম, তখনও আমার অসুখে তুমি এসে সবসময় আমাকে দেখাশোনা করতে।
মায়ের হাতের পরশ, যে আরোগ্যবাণী নিয়ে আসে সন্তানের মনে, সে-বাণী যে আর কারও পক্ষেই পৌঁছোনো সম্ভব নয়।
যখন আমি অনেক বড়ো হয়ে গেছি, তখনও পরীক্ষা দেবার সময় খুব নার্ভাস হয়ে পড়তাম। অন্য কোনো ব্যাপারে নার্ভাস ছিলাম না, অথচ পরীক্ষার সময়ে কেন যে, নার্ভাস হতাম, সেটা আজও বুঝে উঠতে পারি না। পরীক্ষার প্রস্তুতি যে থাকত না তা নয়, কিন্তু পরীক্ষাতে যেমন ফল করব ভাবতাম, তেমন ফল করা কখনোই সম্ভব হত না। কারণ ঠিক পরীক্ষা চলাকালীন সময়টাতে চিরদিনই অত্যন্ত উত্তেজিত ও ভীত হয়ে পড়তাম। সেই সময় প্রত্যেকদিন পরীক্ষার শেষে আমাকে তোমার ঘরে নিয়ে আসতে তুমি। মনে আছে, গরম জলে বায়োকেমিক ওষুধ কালিফস গুলে তুমি আমাকে খাওয়াতে। যতদিন পরীক্ষা চলত ততদিনই আমি রাতে তোমার ঘরে শুয়ে থাকতাম।
মা, আজকে আমার জীবনে রোজই পরীক্ষা। শুধু আমার কেন, হয়তো প্রত্যেকের জীবনেই। যে পরীক্ষা প্রাতিষ্ঠানিক, যে পরীক্ষা স্কুলকলেজের অথবা ইউনিভার্সিটির, সে পরীক্ষা যে জীবনের সহজতম পরীক্ষা, তা প্রত্যেক মানুষই শুধুমাত্র বড় হবার পরই বুঝতে পারে।
এখন সকাল থেকে রাত অবধিই পরীক্ষা। যৌবনের পরীক্ষা, প্রেমের পরীক্ষা, বিরহের পরীক্ষা, বিশ্বাসের পরীক্ষা, পুত্রের পরীক্ষা, পিতার পরীক্ষা, স্বামীর পরীক্ষা, স্ত্রীর পরীক্ষা, সম্পর্কের পরীক্ষা, বন্ধুত্বের পরীক্ষা, জীবিকার পরীক্ষা, সতোর পরীক্ষা, প্রৌঢ়ত্বের পরীক্ষা, বার্ধক্যের পরীক্ষা, পরীক্ষার পর পরীক্ষা।
আজকে তুমি নেই। গরম জলের সঙ্গে কালিফস গুলে আমাকে আর কেউ খাওয়ায় না। অথচ কোনো পরীক্ষাতেই পিছপা হওয়া যায় না বেঁচে থাকবার কারণে। তুমি ছাড়াই সমস্ত পরীক্ষায় বসতে হয়, পাস অথবা ফেল করতে হয়। কিন্তু আজকে পরীক্ষা পাস করলে, জীবনের স্কুল থেকে নিত্য নতুন সাফল্যের রিপোর্ট নিয়ে ফিরে এলে, কারও মুখই আনন্দে তোমার মুখের মতো আর উজ্জ্বল হয়ে ওঠে না। কেউ আমাকে বুকে জড়িয়ে আনন্দে, গর্বে, ফুলে উঠে আর বলে না, খোকন, আমার যা আনন্দ হচ্ছে না! বলতে পারছি না।
এখনও পরিষ্কার মনে আছে বাবা একবার আমাদের পুজোর সময় বিন্ধ্যাচলে নিয়ে গেছিলেন। উত্তর প্রদেশের মির্জাপুর শহর থেকে মাইল তিন-চার দূরে ছোট্ট একটি গ্রাম। তার নাম শিউপুরা।
পাথরের বাড়ি, কয়েকটি ছোটো ছোটো, মধ্যে দিয়ে ফাঁকা রাস্তা চলে গেছে। সে-রাস্তার বুক চিরে চলে গেছে রেললাইন এলাহাবাদের দিকে। বাঁ-দিকে বেনারস। শিউপুরার পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে গঙ্গামাই। সারাদিন সেই নদীর ওপর ঘুরে ঘুরে চখাচখি ওড়ে। নদীর ঘাটে একটা বিরাট অশ্বত্থ গাছ, কী ছায়া তার।
তুমি কিন্তু কখনো নদীতে স্নান করতে যেতে না। জলে তোমার বড় ভয় ছিল। একবার পুরীতে গিয়ে বাবা আমাদের বলেছিলেন যে, আমাদের মধ্যে কেউ যদি তোমাকে সমুদ্রে একটা ডুব দেওয়াতে পারি, তাহলে তিনি দশ টাকা দেবেন। তখনকার দিনে দশ টাকার প্রলোভনটা নিতান্ত কম ছিল না। কিন্তু আমাদের সকলকেই সেদিন ব্যর্থ হতে হয়েছিল। তুমি পায়ের পাতাটুকু খালি ভিজিয়েছিলে সমুদ্রের জলের ঢেউয়ে। তার বেশি ভেতরে তোমাকে আর কারও পক্ষেই এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি।
বিন্ধ্যাচলের কথা বলছিলাম। সেই ছোট্ট ঘুমন্ত শিউপুরা গ্রাম ছাড়িয়ে কাঁচা পাথুরে একটা পথ পিচের রাস্তাকে সমকোণে কেটেছিল। সেই বড়োরাস্তাটা রেললাইনের সমান্তরালে চলে গেছে। টান টান হয়ে রেললাইন শুয়ে আছে একটা বিরাট কালো, চকচকে সাপের মতো। তার মুখ রয়েছে এলাহাবাদে আর ল্যাজ রয়েছে বারাণসীতে। কাঁচারাস্তাটা শিউপুরা থেকে এসে উঠে গেছে বিন্ধ্যপাহাড়ের ওপরে।
পাহাড়ের ওপরে বিন্ধ্যবাসিনী দেবীর মন্দির। পাথরের সিঁড়ি বেয়ে সেই মন্দিরে উঠতে হয়, দু-পাশে ছোটোখাটো দু-একটি দোকান পান্ডাদের। ক্ষীরের মেঠাই তৈরি করে পান্ডারা, বহু দূর দূর থেকে তীর্থযাত্রীরা এসে বিন্ধ্যবাসিনীর মন্দিরে পুজো দিয়ে যান। পথের দু-পাশে জঙ্গল ঘন হয়ে থাকে। পবন-নন্দনের দল হুপ-হাপ শব্দ করে জঙ্গলের নিস্তব্ধতাকে মথিত করে। কিন্তু বড়ো শান্তির পথ ছিল বিন্ধ্যবাসিনীর পথ।
তোমার ভগবানকে কোনোদিন তুমি দেখেছিলে কি না জানি না আমি। কিন্তু বিপদে, আনন্দে, নির্জনতায়, কোলাহলে তাঁর অস্তিত্ব হৃদয়ে অনুভব করাতে শিখিয়েছিলে আমায়।
বিন্ধ্যবাসিনীর মন্দিরে যেতাম বিকেল বেলায়। সেই নির্জন পাহাড়ি বনপথ দিয়ে। যখন ময়ুর ডাকত এপাশ-ওপাশ থেকে কেয়া কেয়া কেয়া রবে, যখন কত না কত পাখি সন্ধ্যার আরতি জানাত বিন্ধ্যবাসিনীকে, তখন একটি মুগ্ধ শিশু তার সুন্দরী মায়ের নরম হাতে হাতে রেখে ভগবান দর্শনে যেত প্রতিদিন।
আমি কিন্তু কোনোদিনও মন্দিরের ভেতরে ঢুকিনি। মন্দিরের ভেতরে ঢুকলে আমার কেমন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যেত। আমি বলতাম আমি বাইরে আছি, তুমি পুজো দিয়ে এসো। আশ্চর্য, তুমি কোনোদিনও আমাকে জোর করোনি। চিরদিন বলেছ, আচ্ছা তুই বোস, আমি আসছি। পরবর্তী জীবনে তোমাকে দক্ষিণেশ্বরে মাঝে মাঝে নিয়ে যেতাম, যখন তুমি যেতে চাইতে। তখনও আমি চত্বরে বসে থাকতাম, তুমি ভেতরে গিয়ে পুজো দিয়ে আসতে।
ভগবানে ভক্তি ছিল তোমার অগাধ। সেই ভক্তি তুমি পেয়েছিলে তোমার মায়ের কাছ থেকে,তোমার মামাবাড়ির কাছ থেকে। তুমি বড়ো নরম ছিলে। রক্ত দেখতে পারতে না তুমি। বাবা যখন পাখি মেরে আনতেন শিকার করে, অথবা হরিণ মেরে আনতেন, শম্বর মেরে আনতেন, আঁতকে উঠতে তুমি সেই রক্তাক্ত পশুপাখি দেখে। কিন্তু কখনো তুমি তা রান্না করে দিতে অস্বীকার করোনি। কারণ তোমার স্বামীর শখে তুমি কখনো বাধা দাওনি। কিন্তু মনে মনে তুমি যে এটা পছন্দ করতে না, আমরা সকলেই বুঝতে পারতাম।
.
০৪.
বাবার খুব শিকারের শখ ছিল।
পরবর্তী জীবনে বাবা প্রায়ই শিকারে যেতেন। শিকার সম্বন্ধে তোমার বিরূপতা বাবার এবং বাবার বন্ধুবান্ধবদের কাছে, যাঁদের সঙ্গে বাবা শিকারে যেতেন, তাঁদের সকলের কাছে এক হাসির ব্যাপার ছিল। যদি কোনোদিন শিকারে গিয়ে শিকার না পাওয়া যেত, তাহলে বাবার বন্ধুরা বলতেন, কী করে হবে শিকার? বাড়িতে যা হাই ভোল্টেজ রেসিসট্যান্টস, শিকারের দোষ কী?
এই কথা নিয়ে আমরাও অনেকদিন হাসাহাসি করেছি, তোমাকে খেপিয়েছি।
কিন্তু তুমি কেবলই হাসতে আর বলতে, বুঝবি, বুঝবি, এমন করে এই পাখি আর জন্তুদের মারিস, ভগবান যে একদিন কী শাস্তি দেবেন তোদের, আমি খালি সেই কথা ভেবে আঁতকে উঠি।
বিন্ধ্যাচলে আমি সারাদিন পাহাড়ের ওপরে, মালভূমিতে একা একা হেঁটে বেড়াতাম। বন্দুক নিয়ে সারাদিন ঘুরে বেড়াতাম। শিকারটা ছিল একটা ছুতমাত্র। সেই প্রাকৃতিক পরিবেশ, সেই আদিগন্ত মালভূমি, সেই নীল আকাশ, সেই আমলকীতলায় চরে-বেড়ানো চিতল হরিণের দল, গঙ্গার ওপরে চক্রাকারে ঘুরে ঘুরে ওড়া বাদামি চখাচখির ঝাঁক আর অনেক নীচে সমতলে ধুয়ো-উড়িয়ে চলে-যাওয়া দেশলাইয়ের বাক্সর মতো রেলগাড়ি এইসব সুদূর গোধূলির আশ্চর্য সুন্দর ছবিগুলি এখনও চোখে ভাসে।
তুমি বলতে, ভগবান কিন্তু মন্দিরে থাকেন না। মাঝে মাঝে মন্দিরে আসেন। ভগবান থাকেন আকাশে-বাতাসে, রোদে-বৃষ্টিতে, হাওয়ায়-মাটিতে, আমাদের নিঃশ্বাসে। ভগবানকে যে বুঝতে চায়, যে হৃদয়ে অনুভব করতে চায়, সে সবসময় তা করতে পারে।
ভগবান কাকে বলে আমি জানতাম না, আজও জানি না।
সারাদিন ঘুরে ঘুরে সন্ধের মুখে মুখে বিন্ধ্যাচলের মালভূমির ওপর দিয়ে যখন ফিরে আসতাম যখন শেষসূর্যের সোনা আলো নরম আলতো আঙুলে সমস্ত মালভূমির শায়িত শরীরকে ছুঁত, সমস্ত মালভূমির গাছ-গাছালি শেষসূর্যের স্পর্শে ধন্য হত, যখন ওম-ধরা বুকের খয়েরি তিতিররা কী এক চমকতোলা তীক্ষ্ণডাক ডেকে তাদের উড়ে যাওয়ার সরল তীক্ষ্ণছন্দে অপস্রিয়মাণ স্তিমিত সূর্যকে ধাওয়া করে তিরবেগে ছুটে যেত, তখন আমার মনে হত ভগবান বোধ হয় এরকম জায়গাতেই থাকেন।
সেই পথের পাশে যখন টি-টি পাখিরা তাদের লম্বা লম্বা উড্ডীন পা নিয়ে পাগলের মতো দল বেঁধে চিৎকার করত, যখন পাহাড়ের গুহাতে বসে পাশে কমন্ডলু রেখে নাগা সন্ন্যাসীরা সামনে ধুনি জ্বালিয়ে ভগবানের নাম গাইতেন, যখন সেই আসন্ন সন্ধ্যার হিমসিম রহস্যময় পরিবেশে দিগন্তের কাছে একঝাঁক কৃষ্ণসার হরিণ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেত গাছগাছালির ধূলিমলিন ধূসর সবুজ আঁচলে, যখন মালভূমি থেকে ফুল-পাতা, ঝোঁপ-ঝাড়, পাহাড় আর পাখির আর সুন্দরী পৃথিবীর গায়ের গন্ধ মিশে এক আশ্চর্য শান্ত স্নিগ্ধ মিশ্র গন্ধ বেরোত, তখন মনে হত ভগবান বোধ হয় এখানেই থাকেন।
অথবা, যেদিন সূর্য ওঠার আগে স্নিগ্ধ, সিক্ত মালভূমি পেরিয়ে নীচে উপত্যকাতে নেমে যেতাম, যখন কচি-কলাপাতা সবুজ ছোটো ছোটো টিলা ছাওয়া উপত্যকাতে শিশির পড়ে থাকত রুপোলি চাঁদরের মতো, যখন সেই সবুজ রুপোলি সিক্ত গালচেয় ধূসর-নীল গাইয়ের দল দৌড়াদৌড়ি করে খেলে বেড়াত, যখন প্রথম সূর্যের আলো পড়ে সেই ধাবমান নীল গাইয়ের দলের ক্ষুরে ক্ষুরে ছিটকে-ওঠা শিশিরে লক্ষ লক্ষ হিরে চমকাত অথবা যখন রাতভর বজরা-খেত পাহারা দেওয়া গাঁওয়ার ছেলে বাঁশি বাজিয়ে পাহারতলির গাঁয়ে ফিরত ভোরের বেলায়, সেই বাঁশির সুরের আবেশে এবং সেই নির্জন আদিগন্ত শান্তিস্বরূপ প্রকৃতিতে দু-চোখ ভরে গেলে মনে হত, বোধ হয় ভগবান এখানেই থাকেন।
ভগবানকে দেখার চোখ, অনুভব করার চোখ, তুমি আমাকে দিয়েছিলে।
.
০৫.
আমাদের কলকাতার বিশেষ বৈচিত্র্যহীন জীবনে হঠাৎ আনন্দের ঝলক নিয়ে আসতেন ছোটোমামা। তুমি যদি রোমান্টিক ছিলে, তাহলে ছোটোমামাকে কী বলে ব্যাখ্যা করব জানি না। রোমান্টিসিজম ছিল তাঁর প্রতি রক্তকণিকায়। এত মাত্রায়ই তা ছিল যে, জীবনের বাস্তবতার মুখ সেই রোমান্টিসিজমের পর্দা ভেদ করে কোনোদিনও আমৃত্যু তাঁর পক্ষে দেখে ওঠা সম্ভব হয়নি। ছোটোমামার মতো সরল শিশুসুলভ দেবদুর্লভ মানুষ জীবনে বেশি দেখিনি। চিরদিন শিশুর মতো একটি অনাবিল মন বজায় রাখার জাগতিক কষ্ট অনেক, সে বড়ো কঠিন সাধনা।
ছোটোমামাও আজ নেই, তাই অনেক কথা মনে পড়ে। দাদুর ব্যাবসা ছিল বিহারের সাঁওতাল পরগনায়। অভ্রর খনি ছিল দাদুর। ছোটোমামার প্রথম যৌবনে সেই অভ্রর খনির দেখাশোনার ভার পড়েছিল তাঁর উপর। অভ্রর ব্যাবসা সম্বন্ধে ছোটোমামা কতটুকু উৎসুক ছিলেন, অথবা কতটুকু জেনেছিলেন সে বিষয়ে আমার তখন এবং আজও যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কারণ ব্যাবসা, কোনো ব্যাবসাই তাঁর ধমনীতে ছিল না। তাঁর দুই কবি-চোখ মুগ্ধ হয়েছিল সাঁওতাল পরগণার বনপাহাড়ের অপূর্ব সৌন্দর্যে। পরম অসুবিধার মধ্যে থেকেও, এই ডিজেলের ধোঁয়া-ভরা আবর্জনাময় শহরে বাস করেও তিনি চিরদিন তাঁর শালবন, খালী পাহাড় ও উশ্রী নদীর কল্পজগতে বাস করে গেছেন।
কোনো গরমের সন্ধ্যাবেলায় ছোটোমামা আমাদের বাড়িতে আসতেন। বসবার ঘরে আলো নিভিয়ে তিনি গল্প বলতেন। তখনকার দিনে সন্ধ্যার পর কলকাতায় এমন এক দখিনা হাওয়া ছাড়ত যে, সেই হাওয়া আজকাল এই মালটিস্টোরিড শহরে আর বয় না। সারাদিনের আদ্রতা ভরা গরম যে ক্লান্তি পুঞ্জীভূত করে তুলত, সেই সমস্ত ক্লান্তি অপনোদিত হয়ে যেত মুহূর্তের মধ্যে সন্ধের পরের সেই হুহু মিষ্টি বাতাসে।
পথ দিয়ে কুলফি মালাইওয়ালা, চাই কুলফি মালাই বলে হেঁকে যেত। ফুলওয়ালা ফিরি করত বেলফুলের মালা অথবা রজনিগন্ধা। স্নান-টান করে উঠে তুমি ধূপকাঠি জ্বালাতে, তারপর ছোটোমামার জন্যে চা করে নিয়ে সেই অন্ধকার ঘরে তুমি আমাদের সঙ্গে বসতে এসে।
ছোটোমামা গল্প করতেন টিকায়েতের। ডাকাইত টিকায়েত, অত্যাচারী টিকায়েতের। যে কুলিদের সুদের লোভে সর্বস্বান্ত করত, তাদের মেরে খাদে ফেলে দিত। সেইসব গল্প শুনতে শুনতে দেহাতি সরল মানুষদের কষ্টে তখন আমার চোখে জল এসে যেত।
ছোটোমামার এক বন্ধু ছিলেন। মনুমামা। তাঁকে আমার একবারই দেখবার সৌভাগ্য হয়েছিল গিরিডিতে। এখনও তাঁর চেহারাটা মনে আছে। ছ-ফিট লম্বা ধবধবে ফর্সা, একটা বুক-খোলা নীল রঙের টুইলের শার্ট, ধুতির ওপরে পরা। শার্টের হাতা গোটানো। এমন চমৎকার সুগঠিত, সুপুরুষ বাঙালি চেহারা আমি জীবনে খুব কমই দেখেছি। সেই মনুমামা টগবগ করে ঘোড়া ছুটিয়ে খাদে খাদে ঘুড়ে বেড়াতেন। দুর্ধর্ষ টিকায়েতরাও তাঁর ভয়ে তটস্থ থাকত। মনুমামার পিঠে বাঁধা থাকত চামড়ার বেল্টে লাগানো দোনলা বন্দুক। চাঁদনি রাতে আলোছায়ার বুটি-কাটা গালচের রাস্তা বেয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে এ-পাহাড় থেকে ও-পাহাড়ে পাড়ি দিতেন মনুমামা।
একবার ছোটোমামা আর মনুমামা অভ্রখনিতে যাওয়ার পথে এক গ্রামে রাতের মতো আশ্রয় নিয়েছেন। যে ঘরে তাঁরা ছিলেন সেই ঘরেই সকালবেলা জঙ্গল থেকে ধরে আনা একটি ভাল্লুকের বাচ্চা এনে রেখেছিল গ্রামের লোকেরা। চাঁদনি রাত। বসন্তের দিন। সন্ধ্যার পর বেশ হিম হিম ভাব থাকে তখন পাহাড়ে জঙ্গলে। ফুরফুর করে হাওয়া দিচ্ছে। মহুয়া আর করৌনজের গন্ধ ভাসছে হাওয়ায়। পাহাড়ি কোকিল ডাকছে পাগলের মতো। পাশের বাড়িতে ঝুমুরের গান হচ্ছে মাদলের সঙ্গে। দ্রিম দ্রিম, দ্রিমি দ্রিম করে মাদল বাজছে আর তার সঙ্গে দেহাতি সুরের ঘুম পাড়ানিয়া গান।
মাটির ঘরের মধ্যে চৌপাই পেতে দুই বন্ধুতে রাতে খিচুড়ি খেয়ে শুয়েছেন। সারাদিনের ক্লান্তি রাতে শোবার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের চোখে ঘুম এনে দিয়েছে। ওপরে খাপরার চাল, ঘুমোবার আগে আগে সেই খাপরার চালের মধ্যে ছুঁচোর নাচানাচির নরম চিকন আওয়াজ তাঁদের কানে এসেছিল। দু-দিকে দুটি উঁচু জানলা, কাঠের শিক বসানো, তা খুলে দিয়ে তাঁরা চাদর গায়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন।
হঠাৎ মাঝরাত্তিরে কী একটা শব্দ শুনে ওঁদের ঘুম ভেঙে গেল। বাইরে কে যেন দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে। মনুমামা কোনোদিনই ভীরু ছিলেন না, কিন্তু ছোটোমামা ভীরু ছিলেন। তাঁর সবরকম ভয় ছিল। ভূতের ভয়, বাঘের ভয়, ভাল্লুকের ভয়, টিকায়েতের ভয়। তাই ছোটোমামা কথাবার্তা না বলে যে চাদরটা বুক অবধি ছিল, সেই চাদরটা তাড়াতাড়ি মুখ অবধি টেনে মুখটাও ঢেকে নিয়ে নিঃসাড়ে শুয়ে রইলেন।
মনুমামা বললেন, কোন হ্যায় রে? বাহারমে কোন হ্যায়?
কিন্তু বাইরের আগন্তুক কোনো উত্তর দিল না। দরজার মধ্যে খচ খচ খচর খচ করে কী একটা শব্দ হতে লাগল। মনুমামা পা টিপে টিপে সেই মাটির ঘরের কাঠের গরাদ লাগানো জানলার কাছে উঠে গেলেন। জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখেন, এক বিরাট ভাল্লুক পেছনের পায়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সামনের দু-পায়ের নখ দিয়ে দরজাটাকে আঁচড়াচ্ছে।
এই দৃশ্য দেখে মনুমামা তাড়াতাড়ি ছোটোমামাকে ডাকলেন।
বললেন, দ্যাখ দ্যাখ ছোটকা, কী অপূর্ব দৃশ্য! জীবনে এমনটি আর দেখতে পাবি না। বলতে বলতে মনুমামা জানলাতে দাঁড়িয়ে ধারাবিবরণী দিতে লাগলেন : কী সুন্দর চাঁদের আলল, দারুণ সুন্দর দেখাচ্ছে ভাল্লুকটাকে। বুকের মধ্যে একটা সাদা ভি চিহ্ন। কী বিরাট ভাল্লুকটা রে। আমার চেয়েও লম্বা। উঠে আয়; উঠে আয়। দেখবি তো উঠে আয়। ছোটকা।
ছোটোমামা বললেন, না। আমি দেখব না।
কিন্তু ভাল্লুকটা আস্তে আস্তে উত্তেজিত হয়ে উঠছিল। তার মাকে বাইরে দেখে ভেতরের ভাল্লুকের বাচ্চাও কুঁক কুঁক কুঁক করে সমানে তার মার কাছে নালিশ জানিয়ে চলেছে। কিন্তু এখন বাচ্চাকে তার মার কাছে দেওয়া যায় কী করে? দরজা খুললেই তো বিপত্তি! আর ভারতবর্ষের বনে-জঙ্গলের মানুষ যে-জানোয়ারকে বাঘের চেয়েও বেশি ভয় পায় তা হচ্ছে ভাল্লুক।
মনুমামার গাঁয়ের লোকদের ওপরে ভীষণ রাগ হল।
ভাবলেন, পরদিন ওদের ভালো করে শিক্ষা দিতে হবে। প্রথমত, এরকম বিপত্তি ঘটবার জন্যে এবং দ্বিতীয়ত তাদের ঘুমের দফারফা করার জন্যে। কিন্তু সে তো সকাল হলে! এখন রাত কী করে কাটে!
অনেক করে মনুমামা ভাবতে ভাবতে শেষে একটা বুদ্ধি বের করলেন। দেখলেন, ঘরের কোণে দুটি চকচকে টাঙি দাঁড় করানো আছে।
মনুমামা সেই টাঙি তুলে নিয়ে মাটির ঘরের জানলার কাঠের গরাদগুলো ঝপাঝপ কোপ মেরে কেটে ফেললেন। সেই কালো কোলো, গুবলু-গাবলু ভাল্লুকের বাচ্চাটাকে দু-হাতে তুলে ধরে সেই জানলার মধ্যে দিয়ে বাইরে গলিয়ে দেবার মতলব করলেন। মা ভাল্লুকটাকে প্রাণে মারার কোনো ইচ্ছা ছিল না তাঁর।
কিন্তু গলিয়ে দিতে চাইলেই কি গলে? বাচ্চাটা বেশ নাদুস-নুদুস ছিল, কিন্তু জানলার যা ফুটো তা দিয়ে বাচ্চাটাকে গলিয়ে ফেলা মুশকিল। অথচ বাচ্চাটাকে দেখতে পেয়ে ভাল্লুক-মা অত্যন্ত হিংস্র হয়ে উঠেছিল এবং সে তখন দু-হাতের নখ দিয়ে মাটির ঘরের দেওয়াল আঁচড়াতে আঁচড়াতে ভাঙতে আরম্ভ করল।
অবস্থা বেগতিক দেখে মনুমামা জানলার গরাদের ওপর এবং নীচের দিকের কিছুটা মাটি ওই টাঙি দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে কেটে ফেলে ভাল্লুকের বাচ্চার গলে যাবার মতো জায়গা হতেই তাকে সেই ফুটোতে বসিয়ে দু-হাতের মুঠো জড়ো করে, যেমনি করে লোকে ভলিবল খেলে, তেমনি করে জোরসে এক ধাক্কা মারলেন! ধাক্কা মারার সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পেলেন বাইরে তার থপ করে পপাতধরণিতলের আওয়াজ।
বাচ্চাটি মাটিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে যে কী দৃশ্য তা ভোলবার নয়।
দৃশ্য অবশ্য ছটোমামা দেখেননি, তিনি আপদমস্তক মুড়ি দিয়ে মনুমামার ধারাবিবরণী থেকে যেটুকু শুনেছিলেন, সেটুকুই আমাদের অত্যন্ত রসিয়ে রসিয়ে এবং এক অননুকরণীয় ভঙ্গিতে বলতেন।
বাচ্চাটি নীচে পড়তেই ভাল্লুক-মা দৌড়ে এসে তাকে কোলে তুলে নিল। একলাফে চার পায়ে সেই চন্দ্রালোকিত, ধূলি-ধূসরিত আলো-ছায়ার ডোরাকাটা পাহাড়ি গাঁয়ের পথে, বড়ো বড়ো পা ফেলে হেঁটে যেতে লাগল কুক কুক আওয়াজ করতে করতে। আর তার পাশে পাশে বন্দিদশা থেকে সদ্যমুক্ত বাচ্চাটি মনের আনন্দে লাফাতে লাফাতে ডিগবাজি খেতে খেতে চলতে লাগল।
ফুটেফুটে জ্যোৎস্নায় তারা কিছুদূর পথ বেয়ে হেঁটে গিয়ে, পথ ছেড়ে বাঁ-দিকে ঢুকে জানোয়ার-চলা সরু পথ দিয়ে চলে গেল কোথায় না কোথায় আলো আঁধারের গা ছমছম বনে।