কাউন্ট অব মন্টিক্রিষ্টো – আলেকজাণ্ডার ডুমা
অনুবাদ : হেমেন্দ্রকুমার রায়
পৃথিবীতে অনেক কিছু আশ্চর্য জিনিস দেখা যায় কিন্তু পিতা ও পুত্র দুজনেই বড় সাহিত্যিক হয়ে উঠেছেন এটা বড় একটা শোনা যায় না। এ ঘটনারও ব্যতিক্রম দেখা যায় আলেকজাণ্ডার ডুমার জীবনে। তাদের দুজনের নামও এক। এখানে বাবার কথাই বলব। তিনিই ‘কাউন্ট অব মন্টিক্রিষ্টোর’ বিখ্যাত ফরাসী লেখক।
১৮০২ খ্রিস্টাব্দের ২৪শে জুলাই এই লেখকের জন্ম হয়। তাঁর জন্মের চার বৎসর পরেই দুর্ভাগ্যবশত তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। কাজেই অতিশয় দুঃখ কষ্টের ভিতর দিয়েই তার বাল্যজীবন কাটে। কিন্তু এই দুঃখ কষ্টের অনুভূতি তার বাল্যকালেই সাহিত্যরচনার অনুপ্রেরণা যোগায়। প্রথম জীবনে তিনি নাটক রচনা করতে শুরু করেন, পরে উপন্যাস রচনায় হাত দেন। ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে তার যুগান্তকারী রচনা ‘থ্রি মাস্কেটিয়ার্স’ প্রকাশিত হয়।
ডুমা তার জীবদ্দশাতেই অত্যন্ত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। লোকে তার লেখা পড়বার জন্য ব্যগ্র উৎসুক হয়ে থাকত। তিনি একবার এক ভ্রমণ কাহিনী লেখার বায়না হিসাবে এক কাগজওয়ালার কাছ থেকে বিস্তর টাকা আগাম নেন। স্থির হল তিনি সিসিলি যাবেন বেড়াতে এবং সেখান থেকেই যেমন যেমন দেখবেন, তেমনি তেমনি লিখে পাঠাবেন। কথা ছিল তার সঙ্গে তার শিল্পী বন্ধু জাদিন যাবেন।
আর যাবে জাদিনের নিত্য সঙ্গী কুকুর। কিন্তু কোন কারণে সেই বন্ধুর যাওয়া হল না। ডুমাকে একাই রওনা হতে হল। ডুমা পড়লেন মহা বিপদে। তিনি কাগজওয়ালাদের কাছ থেকে টাকা নিতেন শব্দের সংখ্যা হিসাবে। যত বাড়িয়ে লিখতে পারবেন ততই তাঁর লাভ। ডুমা আর কি করবেন, শিল্পী বন্ধুকে ও তাঁর কুকুরকে কল্পনা করেই তিনি দিনের পর দিন মনগড়া ভ্রমণ কাহিনী লিখে পাঠাতে লাগলেন।
সেই কাহিনী খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠল। কিন্তু এদিকে শিল্পী বন্ধু জাদিন পড়লেন মহা বিপদে। কেউ তাকে আর জাদিন বলে স্বীকার করে না। কারণ সবাই জানে জাদিন ডুমার সাথে সিসিলিতে আছেন।
এমন শক্তিশালী ছিল আলেকজাণ্ডার ডুমার রচনা। কল্পনাকে তিনি বাস্তবের চেয়েও সত্য করে তুলতেন লেখনীর গুণে।
১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে আলেকজাণ্ডার ডুমার মহাজীবনের অবসান ঘটে।
*
কাউন্ট অব মন্টিক্রিষ্টো
১.
মার্সেঈ বন্দর।
লোকে লোকারণ্য হয়ে গেছে সেদিন বন্দরটা।
বিদেশ থেকে কোন বাণিজ্য জাহাজ ফিরে আসবার দিন এরকম ভিড় হয়েই থাকে।
খবর এসেছিল, মোরেল অ্যান্ড সন-এর ফারাওঁ নামে জাহাজখানা বন্দরে আসবে ঐদিন। তাই অতো লোকজন। জাহাজের মালিক মঁসিয়ে মোরেলও ছিলেন সেই জনতার মধ্যে। তাঁর আগ্রহাকুল দৃষ্টি তখন দূর সমুদ্রের দিকে প্রসারিত। কখন বন্দরে ঢুকবে জাহাজ–তার মনে কেবল সেই চিন্তা।
কিছুক্ষণ পরেই জাহাজখানা দেখতে পাওয়া গেল।
ধীরে ধীরে জেটির দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো ফারাওঁ। জাহাজ তীরে এসে নোঙর ফেলবার আগেই মঁসিয়ে মোরেল জেটির কিনারে গিয়ে দাঁড়ালেন। মালিককে দেখতে পেয়েই জাহাজের একজন খালাসী একগাছা দড়ি ছুঁড়ে দিল তার দিকে।
দড়িগাছা ধরে মঁসিয়ে মোরেল সুদক্ষ নাবিকের মত ঝুলতে ঝুলতে ডেক-এর উপরে উঠে পড়লেন।
ডেক-এ উঠে প্রথমেই তার দেখা হলো এডমন্ড দান্তের সঙ্গে। সে তখন ব্যস্তভাবে খালাসীদের নির্দেশ দিচ্ছিলো নোঙর ফেলবার ব্যাপারে।
এডমন্ড বয়সে তরুণ। সুশ্রী ছিপছিপে চেহারা। অভিজ্ঞ কাপ্তেনের মতই হুকুম চালাচ্ছিল সে।
মঁসিয়ে মোরেল তার কর্মকুশলতা দেখে খুশি হলেন। তিনি এগিয়ে গেলেন তার কাছে। জিজ্ঞাসা করলেন–তোমার মুখখানা ওরকম বিমর্ষ দেখাচ্ছে কেন এডমন্ড, খবর সব ভাল তো?
–আজ্ঞে না, খবর খুবই খারাপ।
–খারাপ খবর! কি হয়েছে বলো তো? মালের কোন ক্ষতি হয়েছে কি?
–আজ্ঞে না, মাল ঠিকই আছে। কিন্তু আমাদের কাপ্তেন…
–কাপ্তেন! কি হয়েছে তার?
–তিনি বেঁচে নেই।
–কি বললে? কাপ্তেন লাকমেয়ার–আমার বিশ্বস্ত বন্ধু কাপ্তেন লাকমেয়ার বেঁচে নেই? কি হয়েছিল তার? সমুদ্রে পড়ে গিয়েছিলেন কি?
–না মঁসিয়ে, ‘ব্রেন ফিভার’ রোগে মারা গেছেন তিনি।
এই পর্যন্ত বলেই খালাসীদের দিকে তাকিয়ে এডমন্ড চিৎকার করে বলে উঠলো–না না, ওভাবে নয়, দাঁড়াও আমি আসছি। মঁসিয়ে মোরেলের দিকে তাকিয়ে সে বললো–আপনি একটু অপেক্ষা করুন, নোঙর ফেলার ব্যবস্থা করে এক্ষুণি ফিরে আসছি আমি।
এই বলেই এডমন্ড চলে গেল ওখান থেকে।
এডমন্ড চলে যেতেই আর একটি যুবক-কর্মচারী এগিয়ে এলো মঁসিয়ে মোরেলের কাছে। যুবকটির নাম ড্যাংলার। মঁসিয়ে মোরেলকে অভিবাদন করে ড্যাংলার বললো–খবর শুনেছেন কি?
–কাপ্তেনের মৃত্যুর কথা বলছো তো? হ্যাঁ, এডমন্ডের মুখে এইমাত্র শুনলাম সে কথা।
–আর কিছু শুনেছেন?
–কি?
–এলবা দ্বীপে যাবার কথা? কাপ্তেনের মৃত্যু হতে না হতেই এডমন্ড ইচ্ছামত কাজ করতে আরম্ভ করেছে। কোন কাজ না থাকলেও পুরো দেড় দিন এলবা দ্বীপে কাটিয়ে এসেছে।
–এলবা দ্বীপে! সেখানে গিয়েছিল কেন?
–তা জানি না। হাওয়া খাওয়া ছাড়া আর কি কাজ থাকতে পারে সেখানে?
ড্যাংলারের মুখে এই খবর শুনে মঁসিয়ে মোরেল বেশ একটু বিরক্ত হয়েই এডমন্ডের দিকে তাকিয়ে ডাকলেন–এডমন্ড!
এডমন্ড তখন নোঙর ফেলার ব্যাপারে অত্যন্ত ব্যস্ত। সে বললো–একটু অপেক্ষা করুন, হাতের কাজটা সেরেই যাচ্ছি।
ড্যাংলার বললো–দেখলেন তো! ও এখনি নিজেকে কাপ্তেন বলে ধরে নিয়েছে।
–ঠিকই করেছে। এ জাহাজের কাপ্তেন ওকেই করবো ঠিক করেছি আমি।
মালিকের মুখে এই কথা শুনে ড্যাংলারের মুখখানা হঠাৎ বিবর্ণ হয়ে গেল। অতি কষ্টে মনের ভাব দমন করে সে বললো–কিন্তু এখনও তো আপনি ওকে কাপ্তেনের পদে নিযুক্ত করেননি?
–তা করিনি বটে, তবে দু’একদিনের মধ্যেই করবো।
ড্যাংলারের মুখের উপর আবার ঘনিয়ে উঠলো একটা কালো ছায়া। সে তখন ধীরে ধীরে নিজের কেবিনের দিকে চলে গেল। এই সময় এডমন্ড ফিরে এসে বললো, একটু দেরি হলো বলে আমাকে ক্ষমা করবেন। আপনি কেন আমায় ডাকছেন?
–জাহাজ নিয়ে এ দ্বীপে গিয়েছিলে তুমি?
–হ্যাঁ।
–কেন?
–কাপ্তেনের হুকুমে।
–কাপ্তেনের হুকুমে!
–হ্যাঁ, মঁসিয়ে। কাপ্তেন মারা যাবার আগে আমার হাতে একটা প্যাকেট তুলে দিয়ে এর কোন লোকের কাছে পৌঁছে দিতে অনুরোধ করেছিলেন। মৃত্যুপথযাত্রী কাপ্তেনের সেই অনুরোধকে জীবিত কাপ্তেনের হুকুম মনে করেই কর্তব্যবোধে সে হুকুম পালন করেছি আমি।
–কার কাছে পৌঁছে দিয়েছিলে সেই প্যাকেট?
–মার্শাল বাট্রান্ডের হাতে।
–মার্শাল বাট্রান্ডের হাতে! চমকে উঠলেন মঁসিয়ে মোরেল এডমন্ডের মুখে এই কথা শুনে। তিনি তখন গলা একটু খাটো করে বললেন–সম্রাটের সঙ্গে দেখা হয়েছিল?
–হয়েছিল।
–কি বললে! দেখা হয়েছিল সম্রাটের সঙ্গে?
–হ্যাঁ, মঁসিয়ে।
–তুমি কি বললে তাকে?
–আমি বলবো কেন, তিনিই আমাকে বললেন।
–কি বললেন তিনি তোমাকে?
–তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আমরা কবে মার্সেঙ্গ ছেড়েছি, কোন পথ ধরে গেছি–এই সব। তিনি হয়ত আমাকে জাহাজের মালিক মনে করেছিলেন, কিন্তু আমি যখন বললাম যে, জাহাজের মালিক আমি নই, আমি একজন ‘মেট’ মাত্র–জাহাজের মালিক ফ্রান্সের মোরেল অ্যান্ড সন, তখন তিনি খুশি হয়ে বললেন, মোরেল পরিবারকে তিনি চেনেন; এই পরিবারের একজন ছিলেন তাঁর সেনাপতি।
–হ্যাঁ, পলিকার মোরেল, আমার কাকা!
এই বলেই খুব চাপা গলায় তিনি আবার বললেন–তুমি খুব ভাল কাজ করেছ এডমন্ড! কিন্তু এসব কথা কোন রকমে ফাঁস হলে আর রক্ষা থাকবে না, মহা বিপদ হবে তা হলে।
এডমন্ড আশ্চর্য হয়ে বললো–বিপদ হবে! বলেন কি? আমি ছিলুম একটি প্যাকেটের বাহক মাত্র, প্যাকেটের ভিতর কি ছিল, তাও আমি জানি না। এর জন্যে আমার কোন বিপদ হতে পারে বলে তো মনে হয় না…
এই সময় একজন খালাসীকে আসতে দেখে এডমন্ড বললো –আমি চললাম মঁসিয়ে, ওরা বোধ হয় আমাকেই খুঁজছে। এডমন্ড চলে যাওয়ার উপক্রম করতেই মঁঁসিয়ে মোরেল বললেন–হ্যাঁ, আর একটি কথা!
–কি কথা মঁসিয়ে?
–সেই প্যাকেটের কথা জাহাজের আর কেউ জানে কি?
–না।
মঁঁসিয়ে মোরেল বললেন–আচ্ছা তুমি যেতে পার।
সে চলে যেতেই ড্যাংলার আবার এলো মঁসিয়ে মোরেলের কাছে। বললো–এলবা দ্বীপে যাওয়া সম্বন্ধে কি কৈফিয়ৎ ও দিলো?
–সে খবরে তোমার কি দরকার বাপু?
মালিকের কথায় ঘাবড়ে গিয়ে ড্যাংলার আমতা আমতা করে বললো– না… মানে… সন্তোষজনক কৈফিয়ৎ দিতে পেরেছে কিনা সেই কথাটাই জিজ্ঞাসা করছিলাম… মানে, এডমন্ড আমার বন্ধু কিনা…
মোরেল বললেন–হ্যাঁ, তার কৈফিয়তে আমি সন্তুষ্ট হয়েছি।
–তোমার আর কোন কাজ আছে?
–আজ্ঞে না।
–বেশ তা হলে এখন যেতে পার।
ড্যাংলার আর দ্বিতীয় বাক্যব্যয় না করে ওখান থেকে সরে পড়লো।
ড্যাংলার চলে যাবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে এডমন্ড আবার ফিরে এলো ওখানে।
মঁসিয়ে মোরেল তার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন–কি? কাজ শেষ হলো তোমার?
— হয়েছে, স্যর।
–আর এখানে কিছু করবার নেই তো? –
-না, সব কাজই শেষ করে এসেছি।
–তা হলে চলল আমার সঙ্গে, আমার ওখানেই ডিনার খাবে আজ।
–আমাকে ক্ষমা করুন মঁসিয়ে! আগে বাবার সঙ্গে দেখা না করে আমি কোথাও যেতে পারবো না।
মঁসিয়ে মোরেল খুশি হয়ে বললেন–তোমার পিতৃভক্তি দেখে খুশি হলাম। বেশ, তুমি যাও, কিন্তু বাবার সাথে দেখা করবার পর আমার কাছে আসতে পারবে তো?
এডমন্ড মাথা নত করে বললো–আমাকে আরও একজনের সঙ্গে দেখা করতে যেতে হবে, স্যর।
মঁঁসিয়ে মোরেল সহাস্যে বললেন–ও বুঝেছি, তোমার বাগদত্তা বধু মার্সেদেস-এর কথা বলছো তো? হ্যাঁ, তার সঙ্গে দেখা করবে বৈকি। ভাল কথা, তোমার টাকার দরকার আছে?
–না স্যর। আমার হাতে তিন মাসের মাইনে জমেছে।
–বল কি! তুমি তো খুব হিসেবি ছেলে দেখছি।
–আমার বাবা বড় গরীব সে কথাটা ভুলে যাবেন না, স্যর।
–বড় খুশি হলাম তোমার কথা শুনে এডমন্ড। আমার কাছে তোমার আর কিছু বলবার আছে?
–আমি দিন কয়েকের ছুটি চাইছি।
–বিয়ের জন্য বুঝি?
–হ্যাঁ স্যর, তবে বিয়ে ছাড়া আরো একটা কাজ আমাকে করতে হবে। আমাকে একবার প্যারিসে যেতে হবে।
–বেশ, তোমার ছুটি মঞ্জুর। কিন্তু সেখান থেকে ফিরে এসেই দেখা করতে ভুলো না যেন। মনে রেখো, ভবিষ্যতে তুমিই হবে ফারাওঁ জাহাজের কাপ্তেন।
–কাপ্তেন! আমি! কি বলছেন আপনি?
–ঠিকই বলছি এডমন্ড। পরবর্তী বাণিজ্য যাত্রায় তুমিই হবে ফারাওঁয়ের কাপ্তেন।
মঁসিয়ে মোরেলের মুখে এই অভাবনীয় কথা শুনে এডমন্ডের দুই চোখ অশ্রুপূর্ণ হয়ে এলো। সে বললো–আমি কি বলে আপনাকে ধন্যবাদ দেব জানি না স্যর। আমি আমার বাবা এবং মার্সেদেসের তরফ থেকে আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
.
২.
ফারাওঁ জাহাজ যে মার্সেঈ-এ ফিরে এসেছে, এডমন্ডের বাবার কাছে সে খবর তখনও পৌঁছায়নি। এসিজ-দ্য-মিলানের পনের নম্বর বাড়ির চারতলায় তার ছোট্ট ঘরখানায় বসে এটা-ওটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলেন তিনি।
হঠাৎ পিছন থেকে কে তাঁকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো। সঙ্গে সঙ্গে অতি পরিচিত কণ্ঠের ডাক শুনতে পেলেন তিনি–বাবা!
বৃদ্ধ চমকে উঠে ফিরে তাকালেন। এডমন্ডকে দেখেই তিনি যেন কেমন হয়ে গেলেন, হঠাৎ থরথর করে কেঁপে উঠে ছেলের হাতের উপরেই এলিয়ে পড়লেন।
এডমন্ড ভয় পেয়ে গেল তার অবস্থা দেখে। সে বললো– তোমার কি কোন অসুখ করেছে বাবা?
–না বাবা, অসুখ আমার করেনি। এতদিন পরে হঠাৎ (তামাকে দেখতে পেয়ে একটু…যাই হোক, তোমার খবর বলল! শরীর ভাল ছিল তো তোমার?
–হ্যাঁ বাবা, শরীর ভালই ছিল। তাছাড়া আরও একটি সুখবর তোমাকে শোনাচ্ছি। আমি এখন কাপ্তেন। ফারাওঁ জাহাজের কাপ্তেন এখন তোমার ছেলে। এরপর থেকে আমাদের আর কোন দুঃখকষ্ট থাকবে না বাবা!
আনন্দের আতিশয্যে বৃদ্ধের মুখ দিয়ে কোন কথাই বের হলো না। তাঁর দু’চোখের কোণে দেখা গেল দু’ফোঁটা অশ্রু।
বাবাকে আরও আনন্দ দেবার উদ্দেশ্যে এডমন্ড বললো– মদের বাক্সের চাবিটা দাও তো বাবা! আজ আমি নিজ হাতে মদ পরিবেশন করবো তোমাকে।
–মদ তো ঘরে নেই বাবা!
–মদ নেই! তার মানে? তোমার খরচের জন্য আমি তো দু’শ ফ্রাঙ্ক রেখে গিয়েছিলাম যাবার সময়।
বৃদ্ধ হাসিমুখে বললেন–ঠিকই বলেছো বাবা! কিন্তু তুমি বোধ হয় ভুলে গিয়েছিলে যে, তোমার বন্ধু কাদারুজের কাছে এক’শ চল্লিশ ফ্রাঙ্ক দেনা ছিল আমাদের।
–তুমি কি ঐ টাকা থেকে কাদারুজের দেনা শোধ করেছ নাকি?
–না করলে চলবে কেন বাবা?
–কি সর্বনাশ! তাহলে এই তিন মাসে তোমার সম্বল ছিল মাত্র ষাট ফ্রাঙ্ক?
বৃদ্ধ মৃদুস্বরে বললেন–হ্যাঁ।
এই কথা শুনে এডমন্ড তার পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে বললো–আমাকে এ তুমি ক্ষমা করো–বাবা!
বৃদ্ধ বললেন–ছিঃ বাবা! তাতে কি হয়েছে? তুমি তো জানো, আমার বেশি টাকার দরকার হয় না। ষাট ফ্রাঙ্কেই আমার দিব্যি চলে গেছে। তাছাড়া তুমি যখন এসে পড়েছে, তখন আর চিন্তা কি?
এডমন্ড দাঁড়িয়ে উঠে বললো–সত্যিই বাবা, আর আমাদের কোন চিন্তা নেই। এই দেখ, কত টাকা আমি নিয়ে এসেছি।
এই বলেই পকেট থেকে এক তাড়া নোট বের করে টেবিলের উপরে রাখলো সে।
বৃদ্ধ নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারলেন না। সবিস্ময়ে বললেন–এত টাকা?
এডমন্ড বললো–হ্যাঁ বাবা, এ সবই এখন তোমার। এই টাকা নিয়ে আজই তোমার দরকারী জিনিসপত্তর কিনে নাও। কাল আরও আনবো। এই বলে একটু চুপ করে থেকে এডমন্ড আবার বললো–ছেলে হয়ে বাপকেই যদি সুখী করতে না পারলাম তাহলে তো জীবনই বৃথা। কালই আমরা একটা চাকর রাখবো, আর…
এই সময় বাইরে কার পায়ের শব্দ শোনা গেল।
এডমন্ড বললো–কে যেন আসছে বলে মনে হচ্ছে বাবা।
বৃদ্ধ বললেন–বোধহয় কাদারুজ।
বৃদ্ধের কথাই ঠিক। কাদারুজই বটে। কাদারুজের বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশ। সে ওখানে দরজির কাজ করতো।
ঘরে এসেই সে একগাল হেসে বললো কি খবর এডমন্ড? ভাল আছো তো?
ড্যাংলারের কাছে তোমার খবর পেয়েই ছুটে এলাম দেখা করতে।
–ড্যাংলারের সঙ্গে তোমার পরিচয় আছে নাকি?
–আছে বৈ কি! সে আমার বিশেষ বন্ধু।
এই সময় এডমন্ডের বাবা বললেন–সত্যিই, কাদারুজ বড় ভাল ছেলে। তুমি ফিরে এসেছো শুনে ও কত খুশি হয়েছে দেখলে?
কাদারুজ বললো–কেবল আমি কেন, এ খবর পেলে আরও একজন খুব খুশি হবে।
বৃদ্ধ সহাস্যে বললেন–মার্সেদেস-এর কথা বলছ তো? হ্যাঁ, সে তো খুশি হবেই। এই বলে একটু চুপ করে থেকে কতকটা আত্মগতভাবেই তিনি আবার বললেন–কবে যে তাকে পুত্রবধু করে ঘরে আনবো, আমি সব সময় কেবল সেই কথাই ভাবি।
কাদারুজ বললো–সত্যিই মার্সেদেস-এর মত মেয়ে হয় না। তবে বিয়েটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, শেষ করে ফেলতে বলছি আমি।
কাদারুজের এই কথায় এডমন্ড বললো–কেন বলো তো?
–না, এমনই, মানে তাকে বিয়ে করবার জন্য আরও দু একজন লোক ঘুর ঘুর করছে কি না।
–তাই নাকি? কে কে বলো তো?
কাদারুজ হেসে বললো–সে কথা নাইবা শুনলে। তবে মার্সেদেস যে তোমাকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবে না একথা ঠিক। যাই হোক, আর সব খবর বলো শুনি।
–খবর আর কি! আমি ফারাওঁ জাহাজের কাপ্তেন নিযুক্ত হয়েছি।
–কাপ্তেন! তুমি কাপ্তেন হয়েছো! কাদারুজের চোখে-মুখে ফুটে উঠলো বিস্ময়। এডমন্ডের এই সৌভাগ্যের কথা শুনে ঈর্ষাও হলো তার মনে। তার মনে হলো যে, কাপ্তেন হয়ে এডমন্ড আর বোধ হয় মিশতেই চাইবে না তার সঙ্গে।
এরপর আর গল্প জমলো না ওদের মধ্যে। দু’চারটে কথার পরেই কাদারুজ বিদায় নিলো এডমন্ডের কাছে।
এডমন্ডের বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নামতেই হঠাৎ ড্যাংলারের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল কাদারুজের।
ড্যাংলার বললো–কি ব্রাদার! দেখা হলো এডমন্ডের সঙ্গে?
–হলো বৈকি! অনেক টাকা নিয়ে এসেছে দেখলাম।
–ছোকরার বরাত ভাল হে, জাহাজ এসে ঘাটে লাগতে না লাগতেই একেবারে কাপ্তেনের পদ পেয়ে গেল।
কাদারুজ বললো–তা যা বলেছো। এরপর বোধ হয়। আমাদের সঙ্গে কথাই বলতে চাইবে না ও। জাহাজের কাপ্তেন হয়ে ও মেলামেশা করবে বড়লোকদের সঙ্গে।
দাঁতে দাঁত ঘষে ড্যাংলার বললো–আমি বেঁচে থাকতে এডমন্ড কোনদিনই কাপ্তেন হতে পারবে না। হ্যাঁ ভাল কথা, এইবার বোধ হয় মার্সেদেস-এর সঙ্গে দেখা করতে যাবে ও।
–সেইটেই তো স্বাভাবিক।
–মার্সেদেস-এর কথা তুমি কিছু জানো?
–কিছু-কিছু জানি বৈকি। কেবল এডমন্ড নয়, আর এক (ছাকরাও মার্সেদেসকে বিয়ে করতে চায়। তার নাম ফার্নান্দ। (ছাকরা রোজ এসে হাজিরা দিচ্ছে মার্সেদেস-এর বাড়িতে।
–কি রকম বুঝছো?
–সে গুড়ে বালি। মার্সেদেস এডমন্ডকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করতে রাজী নয়।
–ফার্নান্দ-এর সঙ্গে তোমার পরিচয় আছে?
–তা আছে।
–আমার সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিতে পার?
–কেন বলো তো?
–না, মানে–দেখতাম তার প্রেমের গভীরতা কতখানি।
–তাতে লাভ?
–লাভ না থাক, ক্ষতিও তো নেই! ধরো যদি এডমন্ডের সঙ্গে মার্সেদেস-এর বিয়ে বন্ধ করে তার সঙ্গে বিয়ে দিতে পারি।
–বলো কি! পারবে?
–পারবো বলেই তো মনে হয়।
–তা যদি পার তাহলে খুবই ভাল হয়। ছোকরার অহংকার আমার সহ্য হচ্ছে না। একে কাপ্তেন তাতে আবার মার্সেদেস এর মত সুন্দরী বউ।
–ও দুটো থেকেই আমি তাকে বঞ্চিত করবো, এ তুমি দেখে নিও কাদারুজ।
.
৩.
কাটালান। মার্সেঈ-এর উপকণ্ঠে একখানি ছোট্ট গ্রাম। এই সুন্দর গ্রামখানার প্রতি এডমন্ডের আকর্ষণ খুব বেশি, কারণ এই গ্রামেরই একখানি ছোট্ট বাড়িতে থাকে মার্সেদেস।
বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এডমন্ড ছুটেছিল সেই গ্রামের দিকে। মনে তার আশা ও আনন্দের দোলা। দীর্ঘ তিন মাস পরে আজ সে আবার দেখা পাবে তার প্রিয়তমার।
এদিকে মার্সেদেস-এর ঘরে তখন ফার্নান্দ এসে আঁকিয়ে বসেছে। উদ্দেশ্য তার মহৎ, অর্থাৎ–মার্সেদেসকে বিয়ে করতে চায় সে। তাকে বোঝাতে চেষ্টা করে সে–মত পরিবর্তন করাবার চেষ্টা করে। কিন্তু মার্সেদেস-এর সেই এক কথা, এডমন্ড ছাড়া আর কাউকে সে বিয়ে করবে না। সেদিনও ঐ একই উদ্দেশ্যে শুভাগমন হয়েছিল ফার্নান্দের, সে বলছিল–ইস্টারের ছুটি এসে পড়লো। বলো তো, এই ছুটিতেই…
বাধা দিয়ে মার্সেদেস বললো–আমি তো তোমাকে বহুবার বলেছি যে, এডমন্ড ছাড়া আর কাউকে আমি বিয়ে করবো না।
–কিন্তু তোমার মা তো মত দিয়েছেন এ বিয়েতে। তাছাড়া আমি কোনদিক দিয়ে তোমার অনুপযুক্ত? তুমি জানো যে তোমাকে না পেলে আমি পাগল হয়ে যাব…তোমাকে…
–এসব তুমি কি বলছ ফার্নান্দ! আমি তোমাকে শেষবারের মত বলছি, এসব কথা আমাকে আর কখনও তুমি বলতে এসো না।
–এই তোমার শেষ কথা?
–হ্যাঁ।
–এডমন্ড যদি মারা যায়?
–তা হলে আমিও বাঁচব না।
–সে যদি তোমাকে ভুলে যায়?
–কি বললে? এডমন্ড আমাকে ভুলে যাবে? অসম্ভব।
ঠিক এই সময় ঘরের বাইরে এডমন্ডের আনন্দমুখর কণ্ঠস্বর শোনা গেল–”মার্সেদেস!”
মার্সেদেস আনন্দে আত্মহারা হয়ে চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে উঠলো! এডমন্ড ততক্ষণে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে।
তাকে দেখেই মার্সেদেস ছুটে গেল তার কাছে। বললো– এডমন্ড প্রিয়তম, কখন এলে?
–আজই, কিছুক্ষণ আগে। বাবার সঙ্গে দেখা করেই ছুটে এসেছি তোমার কাছে। মার্সেদেস আবেগভরে এডমন্ডের হাত ধরে নিয়ে এলো চেয়ারের দিকে।
এদিকে ফার্নান্দ-এর মনের মধ্যে তখন ঝড় বইছে। প্রণয়ীযুগলের এই মিলনদৃশ্য তার বুকের মধ্যে শেলের মত বিধছে। নিশ্চল কাঠের পুতুলের মত বসে আছে সে।
এই সময় হঠাৎ এডমন্ডের চোখ পড়লো ফার্নান্দ-এর উপর। সে জিজ্ঞাসা করলো–ইনি কে?
মার্সেদেস বললো–আমার বন্ধু।
–তোমার বন্ধু! তা হলে তো আমারও বন্ধু! করমর্দন করবার জন্যে সাদরে হাত বাড়িয়ে দিলো এডমন্ড। ফার্নান্দ কিন্তু এডমন্ডের সঙ্গে করমর্দন করবার জন্যে কোন আগ্রহই দেখালো না।
এডমন্ড বিস্মিতভাবে বললো–একি! আপনি কি আমাকে বন্ধু বলে স্বীকার করতে চান না নাকি?
মার্সেদেস ভর্ৎসনাভরা কণ্ঠে বললো–ফার্নান্দ!
ফার্নান্দ তখন অনিচ্ছাসত্ত্বেও এডমন্ডের সঙ্গে করমর্দন করে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল সেখান থেকে।
ফার্নান্দকে ঐভাবে চলে যেতে দেখে এডমন্ড আশ্চর্য হয়ে বললো–সেকি! তোমার বন্ধু যে কথা না বলেই চলে গেল?
মার্সেদেস তার মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললো–তাই (তা দেখলাম।
.
হয় পাগলের মত রাস্তা দিয়ে ছুটে চলছিলো ফার্নান্দ। তার মনের মধ্যে তখন ভেসে উঠেছে মার্সেদেস-এর হাসিমাখা মুখখানা!
“এডমন্ড দান্তে! ঐ লোকটাই আমার সকল সুখের পথে কাটা–যেমন করে হোক ঐ কাটাগাছকে তুলে ফেলতেই হবে পথ থেকে”–এই সব কথা ভাবতে ভাবতে চলছিলো ফার্নান্দ।
ফার্নান্দ! ফার্নান্দ শোনো!
কাদারুজের আহ্বান।
ফার্নান্দ সেই কণ্ঠস্বর লক্ষ্য করে মুখ ফিরাতেই দেখতে পেলো পাশের রেস্তোরাঁ থেকে কাদারুজ তাকে ডাকছে। সে তাকাতেই কাদারুজ বললো–কী ব্যাপার ফার্নান্দ? পাগলের মত ছুটছো কোথায়? এদিকে এসো না।
ফার্নান্দ এগিয়ে গেলো রেস্তোরাঁর দিকে। রেস্তোরাঁয় ঢুকতেই সে দেখলো যে কাদারুজের সঙ্গে আরও একটি যুবক বসে আছে। কাদারুজ পরিচয় করিয়ে দিল–এঁর নাম ড্যাংলার
–আমার বিশেষ বন্ধু–ফারাওঁ জাহাজের চীফ ক্লার্ক।
–ফারাওঁ জাহাজের চীফ ক্লার্ক! আপনি তাহলে এডমন্ড দান্তেকে চেনেন নিশ্চয়ই? জিজ্ঞাসা করলো ফার্নান্দ।
ড্যাংলার বললো–চিনি বৈকি সেই হামবড়াটাকে।
–হ্যামবড়া! বেশ বলেছেন কথাটা! বলতে বলতে কাদারুজের পাশের চেয়ারখানায় বসে পড়লো সে!
এইসময় কাদারুজ হঠাৎ ইয়ার্কি করে বললো–কি হে ব্রাদার, মার্সেদেস কি তাড়িয়ে দিয়েছে নাকি তোমাকে?
ড্যাংলার বললো–যাও যাও! বাজে বোকো না। এমন সুন্দর চেহারা যার, তাকে কি কোন মেয়ে তাড়িয়ে দিতে পারে?
ফার্নান্দ বললো–আর সুন্দর চেহারা! আমার সব আশাই ধুলোয় মিশে গেছে আজ!
ড্যাংলার বললো–যদি কিছু মনে না করেন, তাহলে আপনার দুঃখের কথাটা দয়া করে বলুন না আমাকে! হয়তো আমার দ্বারা কোন উপকার হতেও পারে আপনার।
ড্যাংলারের কথায় ফার্নান্দ হতাশ ভাবে বললো–অসম্ভব, মঁঁসিয়ে ড্যাংলার, অসম্ভব! আপনাদের ঐ এডমন্ড আজ আমার সব আশা ভেঙে দিয়েছে।
এই সময় মার্সেদেস-এর হাত ধরে এডমন্ডকে রাস্তা দিয়ে যেতে দেখে ফার্নান্দ বলে উঠলো–ঐ দেখ কাদারুজ, আমার সব আশা ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এডমন্ড!
কাদারুজ ওদের দিকে একবার তাকিয়ে দেখলো, পরক্ষণেই ছুটে বাইরে গিয়ে এডমন্ডকে ডাকলো–এডমন্ড!
এডমন্ড আর মার্সেদেস উভয়েই ফিরে তাকালো তার দিকে।
এডমন্ড বললো–কী ব্যাপার? এখানে কি করছো?
কাদারুজ বলল–এসো না! এখানে তোমার বন্ধু ড্যাংলারও রয়েছে, ঐ দেখ।
এডমন্ড বললো–না ভাই, আমার এখন অনেক কাজ।
কাদারুজ হেসে বললো–তাতো বটেই। আচ্ছা, ওদেরই তাহলে এখানে ডাকছি।
এই বলেই সে ড্যাংলার আর ফার্নান্দকে ডাকলো সেখানে।
ড্যাংলার এসেই বললো–বিয়েটা কবে হচ্ছে এডমন্ড?
–পরশু।
–এত তাড়াতাড়ি?
–হ্যাঁ, একটু তাড়াতাড়িই করতে হচ্ছে। বিয়ের পরেই আমাকে একবার প্যারিসে যেতে হবে কিনা!
–প্যারিসে?
–হ্যাঁ! আমাদের স্বর্গত ক্যাপ্টেন একটা জরুরি কাজের ভার দিয়ে গিয়েছেন আমার উপর। আমাকে একখানা চিঠি পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে একজন লোকের কাছে! আচ্ছা ভাই, আমি এখন তাহলে আসি।
ড্যাংলার বললো–বিয়েতে নিমন্ত্রণ করছো তো আমাদের? যেতে যেতে এডমন্ড বললো–নিশ্চয়ই।
.
এডমন্ড চলে যেতেই ড্যাংলার মনে মনে বললে–কাপ্তেনের চিঠি নিয়ে প্যারিসে যাবে তুমি! ও চিঠি নিশ্চয়ই রাজদ্রোহী গুপ্তদলের। দাঁড়াও, এই অস্ত্রেই তোমাকে শেষ করছি আমি। ফার্নান্দকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ড্যাংলার হঠাৎ বলে উঠলো–আপনি মার্সেদেসকে বিয়ে করতে চান তো?
ফার্নান্দ তখনও তাকিয়েছিল মার্সেদেস-এর চলার পথের দিকে। হতাশ স্বরে সে বললে–চাইলেই কি পাওয়া যায় বন্ধু?
–যাতে পাওয়া যায় সে ব্যবস্থা যদি আমি করতে পারি?
ড্যাংলারের এই কথায় ফার্নান্দ আর কাদারুজ দু’জনেই তাকালো তার দিকে।
কাদারুজ বললো–কি করে তা পারবে তুমি?
ড্যাংলার বললো–এখানে দাঁড়িয়ে সে সব কথা আলোচনা করা ঠিক নয়। চলো একটা কেবিনে গিয়ে বসি।
.
তিন বন্ধুতে তখন রেস্তোরাঁর একটা কেবিনে গিয়ে বসলো।
কাদারুজ বললো–কি বলছিলে তুমি?
ড্যাংলার বললো–তার আগে আমি জানতে চাই, এডমন্ডের সঙ্গে মার্সেদেস-এর বিয়ে বন্ধ করতে পারলে তুমি খুশি হও কি না?
কাদারুজ বললো–বিয়ে বন্ধ হলে যতটা খুশি হই আর না হই, ওর কাপ্তেনি পাওয়া যদি বন্ধ করতে পার তাহলে আমি সবচেয়ে বেশি খুশি হই।
–সে ব্যবস্থাও হবে! এক ঢিলেই দুই পাখি মারবার ব্যবস্থা আমি করেছি। ওর চাকরিও যাবে, বিয়েও হবে না। ড্যাংলারের এই কথায় ফার্নান্দ সোজা হয়ে বসে বললো– পারবেন এরকম করতে?
–নিশ্চয়ই। কিন্তু তার আগে গলাটা যে ভিজিয়ে নেওয়া দরকার হয়ে পড়েছে।
ফার্নান্দ বললো–নিশ্চয়ই, গলা না ভিজিয়ে নিলে কি কোন কাজ হয়? এই বলেই রেস্তোরাঁর একটা বয়কে ডেকে সে হুকুম করলো, পেগ লে আও!
কিছুক্ষণের মধ্যেই এক বোতল মদ, তিনটে গ্লাস আর কয়েক বোতল সোডা-ওয়াটার নিয়ে এসে টেবিলের উপর রেখে গেল বয়।
মদ খেতে খেতে কথাবার্তা চললো ওদের মধ্যে।
কাদারুজ বললো–কেবলই তো ভণিতা ভাঁজছো, আসল কথাটা বলো দেখি, কি করে ওর কাপ্তেনি পাওয়া বন্ধ করবে তুমি?
ড্যাংলার বললো–কি করে করবো দেখতে চাও? দাঁড়াও দেখাচ্ছি।
এই বলেই একটা বয়কে ডেকে দোয়াত কলম আর একখানা কাগজ আনতে বললো সে।
কাদারুজ ঠাট্টার সুরে বললো–কাগজ কলম দিয়ে কি করবে হে? এডমন্ডের গ্রেফতারী পরোয়ানায় সই করবে নাকি?
ড্যাংলার হেসে বললো–গ্রেফতারী পরোয়ানাই বটে!
একটু পরেই বয় কাগজ কলম আর একটা দোয়াত দিয়ে গেল। ড্যাংলার তখন কলমটি তার বাঁ হাতে নিয়ে কি যেন সব লিখে চললো। লেখা শেষ হয়ে গেলে বয়কে ডেকে দোয়াত কলম ফিরিয়ে দিয়ে বললো–শোনো কি লেখা হয়েছে। এই বলেই কাগজখানা পড়তে আরম্ভ করলো সে– সরকারী কর্তৃপক্ষকে জানানো হচ্ছে যে, ফারাওঁ জাহাজের দ্বিতীয় কর্মচারী এডমন্ড দান্তে, এলবা দ্বীপে নির্বাসিত নেপোলিয়নের পক্ষ থেকে একখানা জরুরি গোপনীয় পত্র নিয়ে প্যারিসে রাজপক্ষের শত্রুদের কাছে বিলি করতে যাবে। এডমন্ডের নিজের কাছে কিংবা তার বাড়িতে ঐ পত্র আছে। পড়া হয়ে গেলে ড্যাংলার বললো–কি রকম মনে হচ্ছে তোমাদের? এই চিঠি কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠালে ওর বিয়ে বন্ধ হবে কি না?
ফার্নান্দ লাফিয়ে উঠে বললো–নিশ্চয়ই হবে! এই চিঠি কর্তৃপক্ষের হাতে পৌঁছোবার সঙ্গে সঙ্গেই রাজদ্রোহের অপরাধে ওকে গ্রেফতার করবে। চিঠিখানা আপনি আমাকে দিন মঁসিয়ে ড্যাংলার, আমি নিজের হাতে ওখানা ডাকে দেব।
এদিকে কাদারুজের তখন নেশায় বেতর অবস্থা। কিন্তু এই অবস্থাতেও সে হঠাৎ স্থলিত স্বরে বলে উঠলো–না–না, এ কখনও হতে পারে না। এডমন্ড আমার বন্ধু। তার এরকম সর্বনাশ আমি কিছুতেই হতে দেব না।
ড্যাংলার হেসে উঠে বললো–আরে ছি ছি! তুমি কি সত্যি সত্যিই মনে করলে নাকি যে আমি এই রকম একটা কিছু করবো? আমি এতক্ষণ ঠাট্টা করছিলাম।
এই দেখ, কাগজখানা আমি ফেলে দিচ্ছি।
এই কথা বলেই সে তার হাতের কাগজখানা দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল। এর পর আবার চলতে লাগলো পানানন্দ। কাদারুজের অবস্থা আগেই বেসামাল হয়ে গিয়েছিলো, এখন একেবারে বে-এক্তার হয়ে পড়লো সে।
জড়িত কণ্ঠে কি যেন বলতে গেল সে, কিন্তু তার কোন কথাই বোঝা গেল না। ড্যাংলার তখন চেয়ার ছেড়ে পঁড়িয়ে উঠে তার হাত ধরে টেনে তুলে বললো–চল কাদারুজ, তোমাকে আমি বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।
কাদারুজকে ধরে বাইরে নিয়ে এসে একবার সে আড়চোখে ফার্নান্দের দিকে তাকালো। সে দেখতে পেলো যে, সেই দলা পাকানো কাগজখানা তখন ফার্নান্দের হাতে। ওদের দু’জনের চোখে চোখে কি যেন কথা হলো।
কাদারুজের তখন ওদিকে দৃষ্টি দেওয়ার অবস্থা নয়।
.
৪.
পরিচ্ছন্ন প্রভাত। সমুদ্রের নীলজলে ছড়িয়ে পড়েছে লীলায়িত সূর্যকরের রুপোলী আভা।
স্থানীয় গির্জায় আজ এডমন্ডের সঙ্গে মার্সেদেস-এর বিয়ের ব্যবস্থা হয়েছে। অতিথি-অভ্যাগতরা সবাই উপস্থিত।
এডমন্ডের বাবার মুখে হাসি আর ধরে না–জীবনে বদ্ধ ঝড় ঝাপ্টা সহ্য করবার পর অদৃষ্ট আজ তাঁর সুপ্রসন্ন হয়েছে। তার একমাত্র বুকের দুলাল আজ বিয়ে করে ঘরে আনবে! তা ছাড়া অদুর ভবিষ্যতে জাহাজের কাপ্তেনের উচ্চপদও লাভ করবে সে। ফারাওঁ জাহাজের মালিক মঁসিয়ে মোরেলও এসেছেন এই বিবাহ উৎসবে। কাদারুজ, ড্যাংলার, ফার্নাল ও ফারাওঁ জাহাজের নাবিকরাও এসেছে বিয়েতে নিমন্ত্রিত হয়ে।
কাদারুজের মনে আজ আর কোন রকম বিরোধী ভাব নেই। সেদিন রেস্তোরাঁয় বসে মদের ঝোঁকে এডমন্ডের বিরুদ্ধে দু’চার কথা বললেও, আজ আর তার মনে কোন পাপ নেই। এডমন্ডকে সে সত্যিই ভালবাসে।
কাদারুজ এ বিয়েতে খুশি হলেও ড্যাংলার আর ফার্নান্দ কিন্তু মোটেই খুশি নয়। তাদের দু’জনের বুকের মধ্যে যেন ঝড় বইছে। মনের উত্তেজনা চেপে রাখবার চেষ্টা করছে। দু’জনেই। বিয়ের আর দেরি নেই। একটু পরেই ধর্মযাজক এসে পড়বেন। নিমন্ত্রিত নরনারী সবাই খুশি–আর সবচেয়ে খুশি আজ এডমন্ড আর মার্সেদেস। বহুদিনের আশা আজ তাদের পূর্ণ হতে চলেছে! আর আধঘণ্টার মধ্যেই…
হঠাৎ গির্জার দরজার বাইরে বুটের শব্দ শোনা গেল। সবাই আশ্চর্য হয়ে তাকালো দরজার দিকে। দরজা দিয়ে তখন ঢুকে পড়েছে একদল সৈন্য। সৈন্যদের সামনেই দেখতে পাওয়া গেল একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে।
ম্যাজিস্ট্রেট এসে গম্ভীর স্বরে বললেন–এখানে এডমন্ড দান্তে নামে কেউ আছে কি?
এডমন্ড এগিয়ে এসে বললো–নিশ্চয়ই আছে। আমারই নাম এডমন্ড। কি দরকার আপনার বলুন?
ম্যাজিস্ট্রেট বললেন–রাজার আদেশে আপনাকে আমি গ্রেফতার করলাম।
ম্যাজিস্ট্রেটের কথা শেষ হওয়ার আগেই দু’দিক থেকে দু’জন সৈনিক এসে এডমন্ডের দু’খানা হাত ধরে ফেললো। এডমন্ড আশ্চর্য হয়ে বললো–আমাকে গ্রেফতার করলেন! আমার অপরাধ?
–অপরাধ কি তা যথাসময়েই জানতে পারবেন। আমার উপরে যে আদেশ হয়েছে, আমি শুধু তাই পালন করতে এসেছি।
–আপনাদের হয়ত কোথাও কোন ভুল হয়ে থাকবে। আমি তো আমার জ্ঞানত কোন অপরাধের কাজ করেছি বলে মনে হয় না।
–ভুল যদি হয়েই থাকে, তাহলে তা সংশোধন করতেও দেরি হবে না–আপনি আসুন।
ম্যাজিস্ট্রেট এডমন্ডকে নিয়ে যাচ্ছে দেখে আঁসিয়ে মোরেল তাড়াতাড়ি তার কাছে এগিয়ে এসে বললেন–আজ এডমন্ডের বিয়ে, এ অবস্থায় তাকে আপনি নিয়ে যাবেন না। আমাকে আপনি নিশ্চয়ই চেনেন, আমি কথা দিচ্ছি, বিয়েটা হয়ে গেলেই আমি নিজে সঙ্গে কবে এডমন্ডকে পৌঁছে দিয়ে আসবো আপনার কাছে। এডমন্ডের জন্যে আমি জামিন হচ্ছি।
ম্যাজিস্ট্রেট বললেন–তা হয় না মঁসিয়ে মোরেল। এ আসামীকে জামিন দেবার ক্ষমতা আমার নেই।
–কি এমন অপরাধ এডমন্ড করেছে যে জামিন পর্যন্ত দেওয়া চলবে না?
ম্যাজিস্ট্রেট বললেন–রাজদ্রোহ।
–রাজদ্রোহ!
ম্যাজিস্ট্রেটের মুখে ‘রাজদ্রোহ’ কথাটা শুনেই কাদারুজ জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকালো ড্যাংলার আর ফার্নান্দের দিকে।
ম্যাজিস্ট্রেট ততক্ষণ এডমন্ডকে নিয়ে চলতে আরম্ভ করেছেন। এই দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে বধু-বেশে সজ্জিতা মার্সেদেস– এডমন্ড! বলে চিৎকার করে উঠেই জ্ঞান হারিয়ে মেঝের উপর পড়ে গেল।
এডমন্ডের বাবাও ‘হা ভগবান!’ বলে দুই হাতে মুখ ঢেকে বসে পড়লেন।
এদিকে কাদারুজ তখন ড্যাংলার আর ফার্নান্দকে টানতে টানতে একান্তে নিয়ে গিয়ে কর্কশ কণ্ঠে বললো–আমি বুঝতে পেরেছি, এসব তোমাদের দু’জনের কীর্তি!
ড্যাংলার যেন কিছুই জানে না এই রকম ভাব দেখিয়ে বললো–আমাদের দু’জনের কীর্তি! বলছো কি কাদারুজ?
হ্যাঁ, তোমাদেরই কাজ এটা! তোমরা নিশ্চয়ই সেই চিঠিখানা পাঠিয়েছিলে কর্তৃপক্ষের কাছে।
–চিঠি! সে চিঠি তো আমি ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম!
–না, ছিঁড়ে ফেলে দাওনি। সেখানা তুমি দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলে।
–ও একই কথা।
–না, এক কথা নয়। আমি বেশ বুঝতে পারছি যে, তোমরা দু’জনে যুক্তি করেই ঐ চিঠি ডাকে দিয়েছিলে। তোমাদেরই দোষে আজ দুটি নির্দোষ নর-নারীর জীবন ব্যর্থ হয়ে গেল।
এই বলে ফার্নান্দের দিকে তাকিয়ে সে আবার বললো–তুমি যে এতখানি নীচ, তা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি ফার্নান্দ! তুমি কি ভেবেছো যে এইভাবে এডমন্ডকে ধরিয়ে দিলেই তুমি মার্সেদেসকে পাবে? ভুল ধারণা তোমার। মার্সেদেসকে আমি খুব ভালভাবেই চিনি। এডমন্ডের যত বিপদই হোক, তাকে ছাড়া আর কাউকে সে বিয়ে করবে না। আর ড্যাংলার! তুমি আজ যা করলে, তার কোন তুলনা হয় না! বন্ধুর ছদ্মবেশে ঘাতক তুমি! তোমার মুখ দেখতেও ঘৃণা হয়! যাই হোক, তোমরা ভেবো না যে, তোমাদের এই পাপ গোপন থাকবে! আমি এখনি যাচ্ছি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে। তোমাদের সব কথা –সেই চিঠির কথা সবই আমি খুলে বলেছি তার কাছে।
কাদারুজ সত্যি সত্যিই চলে যায় দেখে ড্যাংলার বললো– তুমি কি পাগল হলে কাদারুজ? ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ওসব কথা বললেই কি তিনি বিশ্বাস করবেন নাকি? প্রমাণ করতে পারবে তুমি যে ঐ চিঠি আমার হাতের লেখা? ও চিঠি আমি বাঁ হাতে লিখেছিলাম মনে আছে? লাভের মধ্যে এই সব কথা বলতে গিয়ে, নিজের জালে নিজেই জড়িয়ে পড়বে তুমি। ম্যাজিস্ট্রেট যখন জানতে পারবেন যে তুমি ঐ চিঠির কথা জানো, তখন তোমাকেও তিনি গ্রেফতার করবেন। এই সহজ কথাটাও বুঝতে পারছ না তুমি?
ড্যাংলারের কথা শুনে কাদারুজের মুখখানা ভয়ে সাদা হয়ে গেল। সে আর কোন কথাই বলতে পারলো না।
.
৫.
মঁসিয়ে দ্য ভিলেফোর্ট তখন ওখানকার ডেপুটি প্রকিওরার*। [*পদটি আমাদের দেশের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটারের সমার্থব্যঞ্জক।] সেদিন তিনি অফিসে আসতেই দেখলেন যে পুলিস কমিশনার তার অপেক্ষায় বসে আছেন।
মঁসিয়ে ভিলেফোর্ট বললেন–কী ব্যাপার! আজ যে বড় সকাল সকাল?
–হ্যাঁ, একটু সকাল করেই আসতে হলো আজ। এডমন্ড দান্তেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে কি না!
–এডমন্ড দান্তে! তিনি–টি আবার কে?
–ভুলে গেলেন নাকি এরই মধ্যে? সেই যে, যার বিরুদ্ধে একখানা বেনামী চিঠি এসেছিল গত পরশু দিন!
–ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে বটে। সেই গোপনীয় চিঠিখানা পাওয়া গেছে কি?
–তা ঠিক বলতে পারি না। ওকে তল্লাসি করে যা যা পাওয়া গেছে, সবই আপনার টেবিলে রাখা হয়েছে।
–এখন তাহলে কি করতে চান?
–আসামীর জিজ্ঞাসাবাদটা আজই শেষ করা দরকার। ওর হয়ে একজন নামকরা লোক জামিন হতে চাইছেন।
–কে বলুন তো?
–মঁসিয়ে মোরেল।
–তাই নাকি! আচ্ছা আমি দেখছি। ভাল কথা! লোকটার বয়স কত?
–লোকটা কি বলছেন মঁসিয়ে, ওকে এখনও বালক বলা যায়। বয়স উনিশের বেশি হবে বলে মনে হয় না।
–বেশ, আপনি তাহলে ওকে পাঠিয়ে দিন এখানে। ওকেই আগে জিজ্ঞাসাবাদ করা যাক। পুলিশ কমিশনার বেরিয়ে গেলেন এবং একটু পরেই এডমন্ড ঢুকলো সেই ঘরে।
মঁসিয়ে ভিলেফোর্ট তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন তার মুখের দিকে। কিন্তু সে মুখ দেখে বিস্মিত হলেন তিনি। কি সরল–কি সুন্দর! মঁসিয়ে ভিলেফোর্টের মনে হলো যে, এরকম সরলতামাখা মুখ যার, সে কখনও অপরাধী হতে পারে না। তাকে দেখে খুশিই হলেন মঁসিয়ে ভিলেফোর্ট। জিজ্ঞাসা করলেন–তোমার নাম?
–এডমন্ড দান্তে।
–কি কর তুমি?
–ফারাওঁ জাহাজের দ্বিতীয় কর্মচারী।
–হুঁ! কেন তোমাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে জানো?
–আজ্ঞে না। ও সম্বন্ধে কিছুই জানি না আমি।
–কোথায় তোমাকে গ্রেপ্তার করা হয়?
–গির্জায়। আমার বিবাহসভায়। বিয়ের কিছুক্ষণ আগেই।
–তুমি কোন দলের লোক? রাজা অষ্টাদশ লুইর, না নেপোলিয়নের?
–আজ্ঞে, আমি রাজনীতির বা দলাদলির কোন ধারই ধারি না।
–তুমি এলবা দ্বীপে গিয়েছিলে?
–হ্যাঁ।
–আমার স্বর্গত কাপ্তেনের বিশেষ অনুরোধে। তাঁর অন্তিমকালের সেই অনুরোধ আমি পালন না করে পারিনি।
–কি সেই অনুরোধ?
–তিনি আমাকে একখানা প্যাকেট পৌঁছে দিতে বলেছিলেন মার্শাল বার্ট্রান্ডের হাতে।
–প্যাকেটের মধ্যে কি ছিল জান?
–আজ্ঞে না। সে সম্বন্ধে আমার কোনই ধারণা নেই।
–তোমার কোন শত্রু আছে?
–না। অন্তত আমি তা জানি না।
এডমন্ডের কথাবার্তা শুনে মঁসিয়ে ভিলেফোর্ট বুঝতে পারলেন যে, সে নির্দোষ। তিনি বললেন–আমি তোমাকে মুক্তি দেব। বুঝতে পারছি তোমার কোন শত্রু তোমাকে বিপদে ফেলবার জন্য চক্রান্ত করেছে। কে তা আমি জানি না, কারণ চিঠিতে কোন নাম সই নেই। আচ্ছা দেখ তো এই চিঠিখানা কার হাতের লেখা বলে মনে হয় তোমার!
এই বলেই ড্যাংলারের লেখা সেই চিঠিখানা বের করে এডমন্ডের হাতে দিলেন তিনি।
চিঠিখানা, এডমন্ডের পড়া হয়ে গেলে মঁসিয়ে ভিলেফোর্ট আবার জিজ্ঞাসা করলেন–এ চিঠি কার হাতের লেখা চিনতে পারো?
এডমন্ড চিঠিখানা আর একবার ভাল করে দেখে বললো– না।
–এ চিঠিতে যা লেখা আছে তা কি সত্যি? –আজ্ঞে, হ্যাঁ। –কি বললে! সত্যিই তুমি একখানা চিঠি নিয়ে যাচ্ছিলে প্যারিসে?
–আজ্ঞে, হ্যাঁ। একথা সত্যি!
–কে দিয়েছিল সেই চিঠি?
–মার্শাল বার্ট্রান্ড।
–কোথায় সে চিঠি?
–পুলিশ আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে।
–তুমি আর কিছু জানো না?
–না।
–তাহলে তোমার কোন ভয় নেই।
এডমন্ড আনন্দিত হয়ে বললো–ভগবান আপনার মঙ্গল করুন। আমি কি এখন বাড়ি ফিরে যেতে পারি?
–আর একটু দাঁড়াও। প্যারিসে যার কাছে তুমি চিঠিখানা নিয়ে যাচ্ছিলে তার নামটা বলতে পার?
–পারি। তার নাম মঁসিয়ে নয়ের্তিয়ার, কক-হিরন রোডে থাকেন তিনি। এডমন্ডের মুখে নামটা উচ্চারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে মঁসিয়ে ভিলেফোর্টের মুখখানা হঠাৎ যেন ফ্যাকাসে হয়ে গেল। তিনি বললেন–কি নাম বললে? মঁসিয়ে নয়ের্তিয়ার? তের নম্বর বাড়িতে থাকেন?
–আজ্ঞে, হ্যাঁ। আপনি চেনেন নাকি তাকে? মঁসিয়ে ভিলেফোর্ট কঠিন স্বরে বললেন–না। রাজার বিরুদ্ধে যারা ষড়যন্ত্র করে তাদের কাউকেই আমি চিনি না। এডমন্ড সভয়ে বললো ষড়যন্ত্র! বলছেন কি স্যার?
–হ্যাঁ, ষড়যন্ত্র! নয়ের্তিয়ারের নাম-ঠিকানা তুমি কি করে জানলে?
–মার্শাল নিজে আমাকে বলে দিয়েছিলেন ঐ ভদ্রলোকের নাম আর ঠিকানা। নাম-ঠিকানা না জানলে চিঠি দেব কি করে?
–তা তো বটেই। আচ্ছা, এ চিঠি তুমি আর কাউকে দেখিয়েছ?
–না!
–কাউকে বলেছ এ চিঠির কথা?
–না!
–তুমি নিজে জান এ চিঠিতে কি লেখা আছে?
–না। মঁসিয়ে ভিলেফোর্ট তখন দপ্তরের ভিতর থেকে চিঠিখানা বেছে বের করে সীলমোহর ভেঙে পড়তে আরম্ভ করলেন। পড়তে পড়তে তার মুখ বিবর্ণ হয়ে।
গেল, সর্বাঙ্গ থর থর করে কাঁপতে লাগলো।
এডমন্ড ভয় পেয়ে বলে উঠলো–আপনি কি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন?
অতি কষ্টে আত্মদমন করে মঁসিয়ে ভিলেফোর্ট বললেন– তুমি সত্যি বলছো, এ চিঠিতে কি লেখা আছে তা তুমি জানো না?
এডমন্ড বললো–ভগবানের নামে শপথ করে বলছি, চিঠিতে কি লেখা আছে, সে কথা আমি কিছুই জানি না।
–বেশ। তাহলে জেনে রাখো, এই চিঠিই হচ্ছে তোমার বিরুদ্ধে একমাত্র প্রমাণ।
–আজ্ঞে …
ভিলেফোর্ট তখন দেশলাই জ্বেলে চিঠিখানায় অগ্নিসংযোগ করে বললেন–দেখ চিঠিখানা আমি তোমার সামনেই পুড়িয়ে ফেললাম এখন। তোমার বিরুদ্ধে আর কোন প্রমাণই রইল না।
এডমন্ড অভিভূত স্বরে বললো–আপনি মহৎ!
সে কথার কোন উত্তর না দিয়ে মঁসিয়ে ভিলেফোর্ট বললেন– এখন আমার একটি কথা শোন।
–আদেশ করুন।
–আদেশ নয়, উপদেশ। আপাতত কিছুদিনের জন্যে তোমাকে পুলিশের হেপাজতে থাকতে হবে। কিন্তু, কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে এই চিঠির কথা কারো কাছেই প্রকাশ করো না।
–নিশ্চয়ই করবো না, আমি প্রতিজ্ঞা করছি।
মঁসিয়ে ভিলেফোর্ট ঘণ্টা বাজালেন। সঙ্গে সঙ্গে একজন পুলিশ কর্মচারী এসে অভিবাদন জানালো। তিনি তার কানে কানে কি বললেন, সে ঘাড় নেড়ে সায় দিল।
এডমন্ডের দিকে ফিরে তিনি বললেন–এখন তুমি এঁর সঙ্গে যাও। দু’চার দিনের মধ্যেই তোমাকে ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করছি।
এডমন্ডকে নিয়ে পুলিশ অফিসার চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে মঁসিয়ে ভিলেফোর্ট দরজা বন্ধ করে দিয়ে একখানা চেয়ারের উপর ধপাস করে বসে পড়লেন। তারপর নিজের মনেই বলে উঠলেন–ভাগ্যে প্রধান সরকারী অভিযোক্তা এখন ছুটিতে আছেন, এই চিঠি তার হাতে পড়লে আমার সর্বনাশ হয়েছিল আর কি! আমি ডেপুটি প্রকিওরার, আর আমারই বাবা করছেন কিনা নির্বাসিত নেপোলিয়নের হয়ে রাজার বিরুদ্ধে চক্রান্ত! এ কথা প্রকাশ হয়ে পড়লে আমার চাকরি তো যেতোই, হয়ত কারাদণ্ড, বা তার চেয়েও কঠিন দণ্ড আমার হতো!
কিছুক্ষণ চিন্তা করবার পর হঠাৎ তিনি উৎসাহিত কণ্ঠে বলে উঠলেন–ঠিক হয়েছে। এই চিঠি থেকেই আমি আমার ভবিষ্যৎ গড়ে তুলব। চিঠি পড়ে জানা গেল, নেপোলিয়ন এ দ্বীপ ত্যাগ করে আবার ফ্রান্সে ফিরে আসছেন! খবরটা নিশ্চয়ই এখনো আমাদের রাজার কানে ওঠেনি। এ খবরটা সর্বাগ্রে আমি গিয়ে যদি রাজাকে দিতে পারি, তাহলে আমার পদোন্নতি কেউ ঠেকাতে পারবে না। আজই আমি প্যারিসে রওনা হবো।
যথাসময়ে মঁসিয়ে ভিলেফোর্ট রাজার কাছে গিয়ে খবরটা দিয়েছিলেন, এবং তার পদোন্নতিও হয়েছিল। তিনি ছিলেন সরকারী অভিযোজর সহকারী, এবং ঐ খবর জানাবার পর হলেন প্রধান সরকারী অভিযোক্তা।
কিন্তু কোন নিরপরাধ হতভাগ্যের সারা জীবনের আশা আকাঙ্ক্ষাকে নৃশংসের মত বলি দিয়ে লাভ করলেন তিনি এই উচ্চপদ, সেটা আপনারা জানতে পারবেন, পরের পরিচ্ছেদেই।