০১-৪. রূপার ঘুম ভেঙে গেল

রূপ-রূপালী – কিশোর উপন্যাস – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

হঠাৎ করে রূপার ঘুম ভেঙে গেল আর সাথে সাথে সে লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসল। সাধারণত সে নিজে থেকে ঘুম ভেঙে উঠতে পারে না, প্রতিদিনই সকালবেলা সুলতানা তার গায়ে ধাক্কা দিয়ে বলে, “রূফ-রূফালী, উঠ।” সে বিড়বিড় করে বলে, “রূফ-রূফালী না রূপ-রূপালী।” সুলতানা বলে, “তাই তো কইলাম। রূফ-রূফালী।” সে তখন বলে, “তুমি মোটেও রূপ-রূপালী বলনি। বলেছ রূফ-রূফালী।” সুলতানা তখন ফিসফিস করে বলে, “দিরং কইর না। খালাম্মা কিন্তু কাঁচা খায়া ফালাইব।” রূপা তখন বলতে চায় দিরং বলে কোনো শব্দ নেই, কিন্তু সেটা আর বলে না, আম্মু তাকে কাঁচা খেয়ে ফেলতে পারে এই কথাটা সে নিজেও বিশ্বাস করে। তার আম্মু যে কোনো মানুষকে যখন খুশি কাঁচা খেয়ে ফেলতে পারেন। তার যে এত বড় ক্ষমতাশালী আব্বু সেই মানুষটাও তার আম্মুর ভয়ে কেঁচো হয়ে থাকেন। তখন রূপা আস্তে আস্তে ঘুম থেকে ওঠে। বিছানা থেকে নামে। বাথরুমে যায়।

আজ সেরকম কিছু হয়নি, কেউ তাকে ডাকেনি। সুলতানা ডাকেনি, আপু কিংবা মিঠুনও ডাকেনি। আম্মু কিংবা আব্বুও ডাকেননি। রূপা মশারি তুলে ঘড়িটার দিকে তাকাল সাথে সাথে মনে হল ভয়ে তার হৃৎপিণ্ডটা গলার কাছে এসে আটকে গেছে। ঘড়িতে সাড়ে আটটা বাজে, তাদের স্কুল শুরু হয় নয়টার সময়। প্রত্যেকদিন ঠিক সাড়ে আটটার সময় তারা স্কুলে রওনা দেয়। কিছু একটা হয়েছে, যে কারণে আজ তাকে কেউ ঘুম থেকে ডেকে তোলেনি।

রূপা বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নেমে সাবধানে দরজা খুলল এবং সাথে সাথে বুঝে গেল আজ তার কপালে দুঃখ আছে। ডাইনিং টেবিলে সবাই বসে নাস্তা করছে, দরজা খোলার শব্দ শুনে সবাই মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে তাকাল। তার আপু তিয়াশার চোখের দৃষ্টি ভাবলেশহীন, সবসময় যেরকম থাকে। পৃথিবীর কোনো কিছুতে তিয়াশার কোনো কিছু আসে যায় না, তাকে কেউ খুন করে ফেললেও তিয়াশা এভাবে তাকাবে, সে যদি নোবেল প্রাইজ পায় তা হলেও তিয়াশা এভাবে তাকাবে। মিঠুনের দৃষ্টিতে সুস্পষ্ট আনন্দ, মুখে একটা ফিচলে হাসি। রূপা যখনই বিপদে পড়ে তখনই মিঠুনের মুখে এরকম আনন্দের একটা আভা ছড়িয়ে পড়ে। আব্বু রূপার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছেন যেন রূপা একটা মানুষ নয়, সে যেন একটা তেলাপোকা কিংবা একটা জোক। আম্মুর চোখ ধক ধক করে জ্বলছে। মনে হয় এক্ষুনি নাক দিয়ে আগুন বের হয়ে আসবে। শুধু সুলতানার চোখে তার জন্যে এক ধরনের মায়া। সুলতানা সবার দৃষ্টি এড়িয়ে হাত দিয়ে গলায় পোচ দেওয়ার ভঙ্গি করে রূপাকে বুঝিয়ে দিল এখন তাকে জবাই করে ফেলা হবে। তার চোখ-মুখ দেখে রূপা এটাও বুঝতে পারল যে, বেচারি সুলতানার কিছু করার ছিল না।

আম্মু নাক দিয়ে একটা শব্দ করে দাঁতে দাঁত ঘষে বললেন, “এতক্ষণে মহারানির ঘুম ভাঙল?”

এই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে কোনো লাভ নেই জেনেও রূপা চেষ্টা করল, “আমাকে ডাকলেই উঠে যেতাম, কেউ ডাকল না–”

“তুমি কোথাকার কোন লাটসাহেবের বেটি যে তোমাকে প্রত্যেকদিন ডেকে তুলতে হবে? তুমি কেন নিজে থেকে উঠতে পার না? তুমি সারারাত কী কর? মানুষের বাড়ি বাড়ি চুরি করতে যাও?”

রূপা এই কথার কোনো উত্তর দিল না। সে কারো বাড়িতে চুরি করতে যায় সত্যি কিন্তু সে অপরাধ ঠিকই করে। রাত জেগে সে গল্পের বই পড়ে। এই বাসায় গল্পের বই পড়া নিষেধ তাই লুকিয়ে রাত জেগে পড়তে হয়। কাল রাতে যে বইটা পড়েছে সেটা ছিল ফাটাফাটি একটা সায়েন্স ফিকশান, শেষ না করে ঘুমাতে পারছিল না। আম্মু যদি শুধু জানতে পারেন তা হলে মনে হয় সত্যি সত্যি জবাই করে ফেলবেন।

আম্মু হুংকার দিলেন, “আজ থেকে তোমাদের কাউকে আর ডেকে তোলা হবে না। নিজেরা নিজেরা ঘুম থেকে উঠবে।”

রূপা মাথা নাড়ল, বলল”ঠিক আছে।”

“ঠিক আছে?” আম্মু প্রচণ্ড রেগে ডাইনিং টেবিলে একটা থাবা দিলেন আর টেবিলের সব প্লেট-কাপ-পিরিচ ঝনঝন করে উঠল।”কোন জিনিসটা ঠিক আছে? নয়টার সময় স্কুল, সাড়ে আটটার সময় উঠেছ? কেমন করে স্কুলে যাবে? কখন রেডি হবে?”

“রেডি হতে এক মিনিটও লাগবে না আম্মু।”

রূপা কোনো রকমে দাঁত ব্রাশ করে, চোখে-মুখে পানি দিয়ে স্কুলের পোশাক পরে বের হয়ে এলো। এক মিনিটে বের হতে পারল না সত্যি কিন্তু তার থেকে খুব বেশি সময় নিল না। স্কুলের ব্যাগ ঘাড়ে নিয়ে সে প্রায় দরজার দিকে ছুটে যায়। আম্মু আবার হুংকার দিলেন, “নাস্তা না করে কোথায় যাচ্ছিস?”

“করতে হবে না আম্মু। একেবারে খিদে নেই।”

“না থাকলেই ভালো। যে রকম ধুমসি মোটা হয়েছিস, একমাস না খেলেও তো তোর গায়ে-গতরের চর্বি এক সুতাও কমবে না।”

কী কুৎসিত কথা! পৃথিবীর আর কোনো মা কী তার মেয়েকে এরকম একটা কথা বলতে পারে? রূপার মনে হল তার চোখ ফেটে পানি বের হয়ে আসবে কিন্তু সে নিজেকে সামলে নিল। ভান করল আম্মুর কথাটা সে শুনতে পায়নি।

আব্বু বললেন, “তোমার এই মেয়েটা আসলেই একটা সমস্যা।” বলার সময় আলু”এই” শব্দটাতে আলাদা জোর দিলেন।

আম্মু বললেন, “আদর দিয়ে মাথা খেয়েছ, সমস্যা হবে না তো কী হবে?”

আব্বু আরো একটা কিছু বললেন, রূপা সেটা শোনার জন্যে দাঁড়াল না, দরজা খুলে রাস্তায় নেমে এলো। সে খুব ভালো করে জানে কেউ আদর দিয়ে তার মাথা খায়নি। তাদের তিন ভাই-বোনের মাঝে সে কালো এবং একটু মোটা। তার চেহারাটাও এমন কিছু আহামরি না, চোখে ভারী চশমা থাকার কারণে চোখগুলোকে দেখায় ছোট ছোট। আপু আর মিঠুন দুইজনকে দেখলে মনেই হয়

তারা একই মায়ের পেটের ভাই-বোন। তারা ফরসা আর ছিপছিপে, তাদের দুজনের চেহারাতেই একটা ঝকঝকে ছাপ। ছোট থাকতে রূপা অসংখ্যবার শুনেছে হাসপাতালে আম্মুর আসল বেবির সাথে বদলাবদলি হয়ে সে-অন্য কারো কালো কুৎসিত বাচ্চা, ঘরে চলে এসেছে। যখন ছোট ছিল তখন সেই কথা রূপা প্রায় বিশ্বাসই করে ফেলেছিল। সেই ছোট থেকে সে লক্ষ করেছে আন্ধু-আম্মুর আদর-সোহাগ তার বড় বোন তিয়াশা আর ছোট ভাই মিঠুনের জন্যে। তার জন্যে কখনোই কিছু ছিল না। আব্বু হয়তো ঠিকই বলেছেন সে আসলেই একটা সমস্যা কিন্তু সেই সমস্যার কারণ মোটেই আদর দিয়ে মাথা খাওয়া নয়, অন্য কিছু।

তিন ভাই-বোন রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকে। মিঠুন বলল”ইস! তোমার কী মজা ছোট আপু। তুমি নাস্তা না খেলেও আম্মু তোমাকে কিছু বলে না!”

রূপা তার কথায় কোনো উত্তর দিল না। মিঠুন বলল”আমি নাস্তা খেতে না চাইলে আম্মু যা বকা দেয়!”

রূপা এবারেও কোনো কথা বলল না। মিঠুন মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “কী মজা! তোমার কী মজা!”

রূপা আর সহ্য করতে পারল না, মুখ ভেংচে দাঁত খিঁচিয়ে বলল, “হ্যাঁ খুবই মজা সকালবেলা নাস্তা না খেয়ে বকা খেতে খুবই মজা লাগে। পেট ভরে একবার বকা খেলে সারাদিন আর কিছু খেতে হয় না। গাধা কোথাকার।”

মিঠুন একটু অবাক হয়ে রূপার দিকে তাকিয়ে রইল, তার মুখ দেখে মনে হল সে এখনো বুঝতে পারছে না হঠাৎ করে রূপা কেন খেপে উঠল। তিয়াশা ভুরু কুঁচকে রূপার দিকে তাকিয়ে বলল, “দোষ তো তোরই! আম্মু তোর উপর এভাবে রেগেছে কেন? আম্মু রেগেছে তার কারণ, আম্মু যা চায় তার কোনোটাই তুই করিস না!”

“আমি পারি না তাই করি না। আমি তোমার মতো গান গাইতে পারি না, ছবি আঁকতে পারি না, নাচতে পারি না, আবৃত্তি করতে পারি না, পরীক্ষায় ফাস্টও হতে পারি না, আমি কী করব?”

“তুই চেষ্টাও করিস না।”

“আমি কীভাবে চেষ্টা করব? আম্মু চায় আমি এক কোচিং থেকে আরেক কোচিং, এক মাস্টার থেকে আরেক মাস্টারের কাছে দৌড়াতে থাকি! দৌড়িয়ে লাভ কী?”

তিয়াশা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আর তুই কী করিস? আম্মু যেটা চায় না তুই বেছে বেছে সেগুলো করিস!”

রূপা মুখ শক্ত করে বলল, “সেগুলো কী করি?”

“এই মনে কর গল্পের বই পড়া। তুই দিনরাত লুকিয়ে লুকিয়ে গল্পের বই পড়িস।”

“যদি এমনি এমনি পড়তে না দেন তা হলে কী করব?”

“তা হলে পড়বি না। না পড়লে কী হয়?”

রূপা উত্তেজিত হয়ে কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল। বলে কী হবে? এই বাসায় কাকে সে কী বোঝাবে? এই বাসায় পাঠ্যবই ছাড়া অন্য সব বইকে। বলা হয় আউট বই। বাসায় সবাই বিশ্বাস করে আউট বই পড়লে একজন নষ্ট হয়ে যায়! রূপা অবশ্য জানে না নষ্ট হয়ে যাওয়া মানে কী। মানুষ তো আর দুধের প্যাকেট না যে নষ্ট হয়ে যাবে।

রূপা একটা নিশ্বাস ফেলে হাঁটতে থাকে, কিছু খেয়ে আসেনি, এখনই খিদে লেগে গেছে। খিদে লাগলেই তার মেজাজটা গরম হয়ে থাকে তখন সবার সাথে শুধু ঝগড়া হতে থাকে। আজকে ক্লাশে সে নিশ্চয়ই সবার সাথে ঝগড়া করবে।

মিঠুনকে তার স্কুলে ঢুকিয়ে দিয়ে রূপা আর আপু তাদের স্কুলে এলো। স্কুলের সামনে বেশ কয়েকটা গাড়ি, কয়েক বছর আগেও ছেলেমেয়েরা হেঁটে স্কুলে আসত, খুব বেশি হলে রিকশায়। আজকাল অনেকেই গাড়িতে আসে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে যারা গাড়িতে আসে তাদের চেহারার মাঝে এক ধরনের মিল আছে, মিলটা কোথায়, রূপা এখনো ঠিক ধরতে পারেনি। মনে হয় সেখানে এক ধরনের চিকচিকে ভাব আছে যেটা সাধারণ ছেলেমেয়ের মাঝে নেই।

স্কুলের গেটের কাছাকাছি আসার আগেই আপু রূপা থেকে একটু আলাদা হয়ে গেল। দুই বোন যদিও একই স্কুলে পড়ে কিন্তু স্কুলের ভেতর দুজনকে দেখলে মনে হবে একজন বুঝি আরেকজনকে চিনেই না! এর কারণটাও রূপা জানে না। সে যখন ছোট ছিল তখন স্কুলে এসে তিয়াশার পিছনে ঘুরঘুর করত–তিয়াশা খুব বিরক্ত হত। তিয়াশা দেখতে ভালো, স্কুলের সবকিছুতে থাকে, স্যার-ম্যাডামেরা তিয়াশা বলতে অজ্ঞান আর সে হচ্ছে সবদিক দিয়ে আপু থেকে উল্টো। সেই জন্যে আপু মনে হয় তাকে নিয়ে অন্যদের সামনে একটু লজ্জা পায়, তাই একটু দূরে দূরে থাকে। রূপার ধারণা তার ক্লাশের বেশিরভাগ ছেলেমেয়ে জানেই না যে রূপার একজন বড় বোন এই স্কুলেই পড়ে!

তিয়াশা দোতলার সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেল। রূপা তার ক্লাশরুমে ঢুকে। আজকে আসতে একটু দেরি হয়েছে তাই জানালার কাছে তার প্রিয় সিটটা বেদখল হয়ে গেছে। সে পিছনে এসে বসল, এই জায়গাটা তার সবচেয়ে অপছন্দের–স্যার-ম্যাডামেরা একেবারে সরাসরি দেখতে পায়, এখানে বসলেই সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন করা হয়। রূপা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, দিনটা যখন খারাপভাবে শুরু হয়েছে সারাটা দিন নিশ্চয়ই খারাপভাবে যাবে।

রূপার সন্দেহটা সত্যি প্রমাণ করার জন্যেই মনে হয় মিম্মি ঠিক তখন তার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। মিম্মি হচ্ছে তার ক্লাশের কুটনি বুড়ি, তার কাজই হচ্ছে একজনের কথা আরেকজনের কাছে লাগানো। সারাক্ষণই সে ফিসফিস করে কারো সম্পর্কে কিছু না কিছু বানিয়ে বানিয়ে বলছে। কাজেই মিম্মি যখন লম্বা লম্বা পা ফেলে তার দিকে এগিয়ে এল তখন রূপা বুঝে গেল অ্যাসেম্বলির ঘণ্টা না পড়া পর্যন্ত তার এখন কুটনামি শুনতে হবে। রূপা একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে সেই জন্যে প্রস্তুত হয়ে গেল।

মিম্মি কাছে এসে গলা নামিয়ে বলল, “জানিস কী হয়েছে?”

“কী হয়েছে?”

মিম্মি চোখ বড় বড় করে বলল, “সোহেল।”

সোহেল তাদের ক্লাশের শান্তশিষ্ট দ্র একজন ছেলে। কারো সাতে-পাঁচে নেই, লেখাপড়াতেও ভালো সে কীভাবে মিম্মির বিষ নজরে পড়ে গেল কে জানে? রূপা জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে সোহেলের?”

“তুই জানিস না কিছু?”

রূপা মাথা নাড়ল, “না।”

“কী সর্বনাশ! সোহেলের বাবা-মা-” মিম্মি ইচ্ছে করে বাক্যটা শেষ না করে মাঝখানে থেমে গেল।

“কী হয়েছে সোহেলের বাবা-মায়ের?”

“হেভি ফাইটিং। এখন ডিভোর্স।”

রূপা চোখ কপালে তুলে বলল, “ডিভোর্স হয়ে গেছে?”

“না। এখনো হয়নি। কিন্তু হবে। যেরকম ডেঞ্জারাস অবস্থা ডিভোর্স যদি না হয় তা হলে মার্ডার।”

“মার্ডার?”

“হ্যাঁ। একটা না, ডাবল মার্ডার।”

ঠিক এরকম সময় সোহেলকে দেখা গেল, সে স্কুল ব্যাগ নিয়ে ক্লাশে ঢুকে একটা বেঞ্চে তার ব্যাগ রেখে দাঁত দিয়ে নখ খুঁটতে খুঁটতে ক্লাশের অন্য বন্ধুদের দিকে এগিয়ে গেল। তার চেহারা বা ভাবভঙ্গিতে কোথাও বাবা-মায়ের ডিভোর্স কিংবা ডাবল মার্ডারের চিহ্ন দেখা গেল না।

মিম্মি তাতেও খুব নিরুৎসাহিত হল বলে মনে হল না, জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলে বলল, “দেখলি? দেখলি?”

“কী দেখব?”

“এরকম একটা ব্যাপার ফ্যামিলিতে কিন্তু কাউকে একটুও বুঝতে দিচ্ছে না! কী কঠিন অভিনয়!”

“তুই কেমন করে জানিস? আসলে হয়তো ওগুলো কিছুই হয়নি—”

“হয়েছে।”

“ঠিক আছে, জিজ্ঞেস করে দেখি।” রূপা গলা উঁচিয়ে সোহেলকে ডাকার চেষ্টা করল, “এই সোহেল শুন তো একটু।”

মিম্মি লাফিয়ে রূপার মুখ চেপে ধরল। তাই শব্দটা বের হতে পারল না। মিম্মি বলল, “সর্বনাশ! তুই কী করছিস? জানাজানি হলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।”

“তুই সবাইকে বলে বেড়াচ্ছিস-জানাজানির বাকি থাকল কী?”

“আমি সবাইকে মোটেও বলে বেড়াচ্ছি না।”

“এই যে আমাকে বললি।”

“তোকে বলা আর সবাইকে বলা এক কথা হল?”

“তুই আর কাউকে বলিসনি?”

“না।” মিম্মি মুখ শক্ত করে বলল, “আর কাউকে বলিনি। শুধু তানিয়া আর টুশি আর–”

রূপা মাথা নেড়ে বলল, “আর মৌমিতা আর সাবা আর বৃষ্টি আর মিলি আর সামিয়া আর লিজা-”

“বলিনি।” মিম্মি গলা উঁচিয়ে বলল, “মোটেও আমি লিজাকে বলিনি। আমি লিজার সাথে কথা পর্যন্ত বলি না। তুই এত বড় মিথ্যুক।”

রূপা প্রায় হাল ছেড়ে দিল। দিনটা এখনো শুরু হয়নি, এখনই পেটে খিদে লেগে গেছে, সারাটা দিন কেমন করে যাবে? খিদে পেটে তার আর মিম্মির সাথে ঝগড়া করার ইচ্ছা করল না। সে চুপ করে গেল। এমনিতেই চুপ করে যেত তার কারণ ঠিক তখন সঞ্জয় হেলতে-দুলতে এগিয়ে আসছিল। সঞ্জয় হচ্ছে তাদের ক্লাশ জোকার, সে সবসময় কিছু না কিছু নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করছে, সেই ঠাট্টা তামাশা নিয়ে অন্য কেউ হাসুক আর নাই হাসুক সে নিজে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে থাকে।

সঞ্জয় এসে ডেস্কে তার ব্যাগটা রেখে একবার রূপার দিকে তাকাল তারপর মিম্মির দিকে তাকাল, তারপর কথা নেই, বার্তা নেই, হি হি করে হাসতে শুরু করল। রূপা চোখ পাকিয়ে বলল, “তুই এভাবে হাসছিস কেন ছাগলের মতো?”

রূপার কথা শুনে সঞ্জয়ের হাসি মনে হয় আরো বেড়ে গেল–সে তখন একটু বাঁকা হয়ে পেটে হাত দিয়ে হাসতে শুরু করে। মিম্মি এবারে একটু রেগে গেল, ধমক দিয়ে বলল, “কী হল তোর? বলবি এখানে হাসির কী আছে?”

সঞ্জয় অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বলল, “তো-তোরা দুজন–” সে কথা শেষ করতে পারল না আবার হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল।

“আমরা দুজন কী?”

“তোদের দুজনকে দেখে মনে হচ্ছে—” আবার হাসি।

”আমরা দুজন কী?”

“মনে হচ্ছে তোদের দুজনকে কেউ আধ-চামচ করে ইয়ে খাইয়ে দিয়েছে।” বলে সঞ্জয় আবার হাসিতে গড়াগড়ি খেতে থাকে। মিম্মি বোকার মতো জানতে চাইল, “কীয়ে খাইয়ে দিয়েছে?”

সঞ্জয় হাসতে হাসতে লাফাতে থাকল, মিম্মির কথার উত্তর দিল না। কোনো জিনিস খাইয়ে দেওয়াটা এরকম হাসির ব্যাপার হতে পারে সেটা অনুমান করতে অবশ্যি মিম্মি বা রূপা কারোই অসুবিধে হল না। রূপা হাত পাকিয়ে ঘুষির ভঙ্গি করে বলল, “দেখ সঞ্জয় নোংরা কথা বলবি না।”

রূপার কথা শুনে সঞ্জয়ের মনে হল আরো হাসি পেয়ে গেল, এবারে হাসির দমকে তার শরীর কাঁপতে থাকে, মুখ দিয়ে আর কোনো শব্দ বের হয় না। হাসি মনে হয় এক ধরনের সংক্রামক ব্যাপার, সঞ্জয়ের একেবারে পুরোপুরি অর্থহীন বোকার মতো হাসি দেখে রূপা আর মিম্মিরও হাসি পেয়ে যায়, তারাও একসময় হাসতে শুরু করে। রূপা হাসতে হাসতে বলল, “ঠিক আছে সঞ্জয়, অনেক হয়েছে। এখন থাম।”

সঞ্জয় হাসতে হাসতে বলল, “থামতে পারছি না! কিছুতেই থামতে পারছি না।”

এটা সঞ্জয়ের সমস্যা-সে যখন একবার হাসতে শুরু করে তখন সে আর থামতে পারে না। একেবারে বিনা কারণে হাসতে হাসতে লুটোপুটি খেতে থাকে। রূপা বলল, “যদি থামতে না পারিস তা হলে বাইরে চলে যা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসতে থাক।”

সঞ্জয় মাথা নেড়ে একটু কাছে এসে কোনোমতে একটু হাসি থামিয়ে বলল, “আমাকে শক্ত করে একটা কিল দে দেখি।”

“কিল?”

“হ্যাঁ।” আবার হাসি।

”কেন?”

“জোরে কিল দিলে মনে হয় হাসিটা থামাতে পারব।” কথা শেষ করে আবার হাসি।

রূপা কিল নয় একটা ফুলসাইজ ঘুষি দেওয়ার জন্যেই হাত পাকিয়ে এগিয়ে গেল কিন্তু ঠিক তখন অ্যাসেম্বলির ঘণ্টা পড়ে গেল। ঘণ্টার শব্দের কারণেই হোক বা অন্য কারণেই হোক সঞ্জয়ের হাসি থেমে আসে। সে তখন তার শার্টের হাতায় নিজের নাকটা মুছে নিল, হাসি তখনো দমকে দমকে আসছে। সেটা সামলে নিয়ে

সে চোখ মুছতে মুছতে অ্যাসেম্বলির জন্যে এগিয়ে যায়।

অ্যাসেম্বলি শেষে ক্লাশে ফিরে এসে রূপা তার জায়গায় বসল। তার বামদিকে বসেছে লিজা, ক্লাশের সবচেয়ে সুন্দরী এবং সবচেয়ে অহংকারী মেয়ে। এই মেয়েটি একবারও ভুলতে পারে না যে তার চেহারা ভালো, সারাক্ষণই সে তার চেহারা নিয়ে কিছু না কিছু করছে। সে যখন কথা বলে বা হাসে তার মাঝেও একটা ঢং ঢং ভাব থাকে, স্বাভাবিক ভঙ্গিতে লিজা কিছু করতেই পারে না। তার ডান পাশে বসেছে রাজু–চুপচাপ নিরীহ ধরনের ছেলে। ছোটখাট সাইজ, চোখে বড় চশমা। চেহারাটা একেবারে সাধারণ একটা ছেলের মতো, দেখলে কখনোই আলাদাভাবে চোখ পড়ে না। বেশ অনেকদিন রাজু তাদের ক্লাসে আছে রূপা এখনো ভালো করে বুঝতে পারে না ছেলেটা কী লেখাপড়ায় ভালো না খারাপ। ক্লাশে স্যার-ম্যাডামেরা যখন প্রশ্ন করেন তখন কখনো সে হাত তুলে প্রশ্নের উত্তর দেবার চেষ্টা করে না। মনে হতে পারে সে বুঝি উত্তর জানে না–কিন্তু কখনো যদি তাকে কিছু জিজ্ঞেস করা হয় সে আস্তে আস্তে ইতস্তত করে ঠিক ঠিক উত্তর দিয়ে দেয়! যে একটা প্রশ্নের উত্তর জানে সে কেন হাত তুলে সেটা বলার চেষ্টা করবে না রূপা এখনো বুঝতে পারে না।

প্রথম পিরিওডে জ্যামিতি ক্লাশ। জ্যামিতি পড়ান মকবুল স্যার-খুব ভালো জ্যামিতি জানেন তা নয় কিন্তু স্যারের উৎসাহ আছে, যেটা নিজে বুঝেছেন সেটা বোঝনোর জন্যে খুব চেষ্টা করেন। অন্যান্য দিন রূপা এই ক্লাশে মনোযোগ দেয়, আজ ঠিক মনোযোগ দিতে পারছিল না। সকালবেলা বাসা থেকে বের হবার সময় যে মেজাজটা খিচে গিয়েছিল সেটা আর কিছুতেই ঠিক করা যাচ্ছিল না।

জ্যামিতি ক্লাশের পর ইংরেজি ক্লাশ। ইংরেজি ক্লাশ নেন জিনিয়া মিস। জিনিয়া মিস স্কুলের অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমিসট্রেস। সবসময় কোনো না কোনো কাজে ব্যস্ত থাকেন তাই তার ক্লাশে আসতে দেরি হয়। আজকেও দেরি হতে থাকল আর পুরো ক্লাশের ছেলেমেয়েরা আস্তে আস্তে হইচই শুরু করে দিল। ক্লাশ ক্যাপ্টেন মাসুক ক্লাশের সামনে গিয়ে একটা খাতা খুলে চোখ পাকিয়ে বলল, “খবরদার কেউ কথা বলবি না, তা হলে কিন্তু নাম লিখে ম্যাডামকে দিয়ে দেব।”

কেউ তার কথাকে কোনো গুরুত্ব দিল না। সবাই জানে মাসুকের মনটা খুবই নরম। কোনোদিন সে কোনো ছেলে বা মেয়ের নাম লিখে স্যার কিংবা ম্যাডামকে দিতে পারবে না। মাসুককে কোনো পাত্তা না দিয়ে সবাই নিজেদের মাঝে কথা বলতে লাগল। অন্যদিন হলে রূপা নিজেও কথা বলতে শুরু করত কিন্তু আজকে তার আর ইচ্ছে করছিল না। সে ডেস্কে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে বসে ক্লাশের সবাইকে দেখতে লাগল।

“তোমার কী হয়েছে? কিছু নিয়ে মন খারাপ?” গলার স্বর শুনে রূপা ঘুরে তাকাল, রাজু একটা গল্পের বই পড়ছিল (বইয়ের নাম কবি, লেখকের নাম তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়), পড়া বন্ধ করে চশমার ফাঁক দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। .

রূপা বলল, “না। মন খারাপ কেন হবে?”

রাজু বলল, “ও আচ্ছা ঠিক আছে।” তারপর সে আবার কবি বইয়ে ডুবে গেল। রূপা কিছুক্ষণ রাজুর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “তোমার কেন মনে হচ্ছে আমার মন খারাপ?”

রাজু বইটা বন্ধ করে হাসি হাসি মুখ করে বলল, “ক্লাশে কোনো কথা বলছ তো তাই!”

“আমি কী ক্লাশে বেশি কথা বলি?”

রাজু মাথা নাড়ল, বলল, “না। খুব বেশি না। কিন্তু স্যারেরা যখন ভুলভাল পড়ায় তখন তুমি সবসময় স্যারদের ধর। আজকে কিছু বলনি। কাউকে ধরনি।”

“মকবুল স্যার ভুলভাল পড়িয়েছেন?”

“হ্যাঁ। সিরিয়াস উল্টাপাল্টা জিনিস পড়িয়েছেন।” রাজু দাঁত বের করে হাসল। রূপা লক্ষ করল রাজুর দাঁতগুলো সুন্দর, টুথপেস্টের বিজ্ঞাপনের মতো। একটা ছেলের মুখে এত সুন্দর দাঁত অপচয়ের মতো। মেয়েদের মুখে হলে অনেক মানাত।

রূপা জিজ্ঞেস করল, ”স্যার উল্টা-পাল্টা জিনিস পড়ালে তুমি ধরলে না কেন?”

রাজু খুক খুক করে হাসল যেন রূপা খুব মজার কথা বলেছে, “আমি কখনো কাউকে ধরি না!”

“আমি ধরি। আমি কাউকে ছাড়ি না।”

“জানি। সেই জন্যে জিজ্ঞেস করছিলাম তোমার মন খারাপ কি না–আজকে ছেড়ে দিলে তো।”

রূপা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “ঠিক মন খারাপ না–একটু মেজাজ খারাপ।”

রাজু বলল, “ও আচ্ছা।”

রূপা লক্ষ করল রাজু ছেলেটা জানতে চাইল না কী নিয়ে মেজাজ খারাপ! মনে হয় কখনোই সে নিজে থেকে কিছু জানতে চায় না। রূপা হঠাৎ করে নিজেই বলে ফেলল, “আজকে আমার আম্মু আমাকে খুব বকা দিয়েছে। শুধু শুধু।”

ছেলেটা হাসি হাসি মুখে বলল, “আম্মুরা সবসময় বকাবকি করে, সেগুলো এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দিতে হয়।”

“যদি বের না হয়?”

“চেষ্টা করলে সব বের হয়ে যায়।”

রূপা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “আজ সকালে নাস্তা পর্যন্ত করতে পারি নাই।”

“তুমি নাস্তা করনি?”

রূপা মাথা নাড়ল, বলল, “না।”

রাজু তখন তার ব্যাগের ভেতর হাত ঢুকিয়ে একটা বড় চকলেটের বার বের করে রূপার দিকে এগিয়ে দিল, বলল, “নাও এইটা খাও।”

“আমি খাব?”

“হ্যাঁ।”

রূপা একটু লজ্জা পেয়ে গেল, মাথা নেড়ে বলল, “না, না! আমি কেন খাব?”

“খেয়ে দেখ, খুব মজা। আমেরিকার চকলেট, মিস্টার গুডবার। এইটা খেয়ে একটু পানি খেয়ে নিলে তোমার পেট ভরে যাবে।”

এত বড় চকলেটের বার দেখে রূপার জিবে একেবারে পানি এসে যাচ্ছিল তারপরও সে বলল, “না, না তুমি খাও।”

“আমি খেয়েছি। আমি সকালে পেট ভরে নাস্তা করে এসেছি। তুমি খাও, খুবই মজা এটা, খেয়ে দেখ।”

রূপা ভদ্রতা করে বলল, “ঠিক আছে আমি একটু ভেঙে খাই।”

রাজু চকলেটের বারটা রূপার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “একটু ভেঙে খেলেই তোমাকে পুরোটা খেতে হবে। আমার কথা বিশ্বাস না করলে একটু খেয়ে দেখ থামতে পার কি না।”

রূপা একবারও ভাবেনি যে সে লোভীর মতো পুরোটা খেয়ে ফেলবে কিন্তু সত্যি সত্যি পুরোটা খেয়ে ফেলল। রাজু তখন পানির বোতলটা এগিয়ে দিল, রূপা ঢক ঢক করে খানিকটা পানি খেয়ে বলল, “থ্যাংকু।”

রাজু হাসি হাসি মুখ করে তার বইটা খুলে বলল, “তোমার মেজাজটা এখন কী একটু ভালো হয়েছে?”

“একটু না, অনেকখানি ভালো হয়েছে!”

“গুড।” রাজু বলল, “স্যারেরা ভুলভাল পড়ালে ধরার জন্যে প্রস্তুত?”

রূপা দাঁত বের করে হাসল, বলল, “প্রস্তুত।”

.

০২.

আম্মু-আব্বু, তিয়াশা আর মিঠুন সোফায় বসেছে, তাদের চোখে-মুখে এক ধরনের উত্তেজনা। এক্ষুনি তাদের হিন্দি সিরিয়াল শুরু হবে, দেখে মনে হচ্ছে তারা আর অপেক্ষা করতে পারছে না। এটা প্রত্যেকদিন রাতের ঘটনা–পুরো এক ঘণ্টা তারা বসে বসে এই হিন্দি সিরিয়াল দুটি দেখে। কপাল ভালো, মাত্র দুটি সিরিয়াল দেখায়, যদি আরো বেশি দেখাত তা হলে তারা আরো বেশি দেখত।

এমনিতে সবসময় আম্মুর মেজাজ খুব গরম থাকে, শুধু যখন হিন্দি সিরিয়ালগুলো শুরু হয় তখন আম্মুর মেজাজটা নরম হয়। আম্মু তখন একটু হাসাহাসি করেন। সিরিয়ালের চরিত্রগুলো নিয়ে কথা বলেন। রূপা লক্ষ করেছে তাদের কথাগুলো শুনলে মনেই হয় না চরিত্রগুলো টেলিভিশনের চরিত্র, মনে হয় তারা সত্যি মানুষ নিয়ে কথা বলছে। একটা সিরিয়ালে রূপার বয়সী একটা মেয়ে আছে, রূপার মনে হয় আম্মু রূপাকে যতটুকু ভালোবাসেন তার থেকে একশ গুণ বেশি ভালোবাসেন ঐ মেয়েটিকে। হিন্দি সিরিয়াল দেখে দেখে সবাই হিন্দি শিখে গেছে। আজকাল কথাবার্তায় মাঝে মাঝেই তারা হিন্দিতে এক-দুইটা শব্দ কিংবা পুরো একটা বাক্য বলে ফেলেন।

পুরো ব্যাপারটাই রূপার কাছে খুবই জঘন্য একটা বিষয় মনে হয় কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে এই সময়টাই হচ্ছে রূপার সবচেয়ে প্রিয় সময়! এই সময় রূপা আর সুলতানা ছাড়া বাসায় সবাই হিন্দি সিরিয়াল দেখে তাই তাদের কেউ বিরক্ত করে না। সুলতানার যদি রান্নাবান্না, ঘর পরিষ্কার আর বাসন ধোয়া শেষ হয়ে যায় তা হলে সে চুপি চুপি রূপার ঘরে আসে, তার সাথে ফিসফিস করে কথা বলে!

আজকেও যখন আম্মু-আব্বু, তিয়াশা আর মিঠুন ড্রয়িং রুমে বসে বসে তাদের প্রিয় হিন্দি সিরিয়াল দেখছে তখন সুলতানা চুপি চুপি রূপার ঘরে এসে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “রূফ-রূফালী, কী কর?”

রূপা বলল, “শব্দটা মোটেও রূফ-রূফালী না। রূপ-রূপালী।”

সুলতানা বলল, “তাই তো বলছি, রূ-ফ-রূ-ফা-লী।”

রূপা বলল, “শুধু তুমি বললে তো হবে না। সেটা আমাদের শুনতেও হবে।”

সুলতানা দাঁত বের করে হেসে বলল, “তোমার কানে সমিস্যা আছে সেইটা আমার দোষ?”

রূপাও দাঁত বের করে হাসল, বলল, “সেইটা মনে হয় ঠিকই বলেছ! সমস্যাটা মনে হয় আমার কানে।”

সুলতানা রূপার বিছানায় হেলান দিয়ে মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে একটা নিশ্বাস ফেলল। রূপা জিজ্ঞেস করল, “সব কাজ শেষ?”

সুলতানা রূপার দিকে তাকিয়ে বলল, “কাজ কখনো শেষ হয়? হয় না।”

কথাটা সত্যি, এই বাসায় কাজ কখনো শেষ হয় না। সেই অন্ধকার থাকতে সুলতানা ঘুম থেকে উঠে কাজ শুরু করে, সবাই ঘুমিয়ে যাবার পরও তাকে সবকিছু গুছিয়ে ঘুমাতে হয়। তারপরেও কাজ শেষ হয় না।

সুলতানা তার ওড়নাটা দিয়ে নিজেকে বাতাস করতে করতে বলল, “যত কাজই করি খালাম্মার গালি তো শুনতেই হবে। তাই একটু বিশ্রাম নেই।”

রূপা বলল, “হ্যাঁ। বিশ্রাম নাও।”

রূপা সুলতানার দিকে তাকিয়ে থাকে। যদি শ্যাম্পু দিয়ে মাথার চুলগুলো ধুয়ে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেওয়া যায়, সুন্দর একটা থ্রী-পিস, কামিজ কিংবা একটা শাড়ি পরিয়ে, হাতে একটা ব্যাগ দিয়ে কপালে একটা টিপ দিয়ে তাকে বই মেলায় নিয়ে যাওয়া হয় তা হলে কেউ বুঝতেই পারবে না সুলতানা কারো বাসায় কাজ করে। রূপা আর সুলতানা একই বয়সের, অথচ দুইজনের জীবনে কত পার্থক্য।

রূপা জিজ্ঞেস করল, “সুলতানা, তুমি পড়তে পার?”

“একটু একটু।”

“স্কুলে গিয়েছিলে?”

“বাবা বেঁচে থাকতে গেছিলাম।”

“লেখাপড়া করতে মন দিয়ে?” সুলতানা দাঁত বের করে হাসল, “দুষ্টামি বেশি করছি লেখাপড়া থেকে।”

রূপা টেবিল থেকে একটা বই নিয়ে সুলতানার হাতে দিয়ে বলল, “পড় দেখি এই বইটা।”

সুলতানা বইটি ওলট-পালট করে দেখল, ওপরের ছবিটি খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করল, তারপর বইটা খুলে পড়ার চেষ্টা করল, যুক্তাক্ষরগুলো পড়তে একটু সমস্যা হল কিন্তু সে বেশ সহজেই বেশ খানিকটা পড়ে ফেলল।

রূপা বলল, “বাহ! তুমি তো বেশ ভালোই পড়তে পার। তুমি পড় না কেন?”

সুলতানা হি হি করে হাসল, বলল, “কী পড়মু? কখন পড়মু? যখন খালাম্মা সকালবেলা বলবে এই সুলতাইন্যা, এক কাপ চা দে। তখন আমি বলমু, খাড়ান খালাম্মা। আমি এখন পত্রিকা পড়ি!” কথা শেষ করে সে আবার হাসিতে ভেঙে পড়ে।

বিষয়টা ঠিক হাসির বিষয় না কিন্তু সুলতানার কথা বলার ভঙ্গিটা দেখে রূপাও হেসে ফেলল। বলল, “তুমি কখন পড়বে সেটা অন্য ব্যাপার, কিন্তু লেখাপড়া জানাটা তো ভালো।”

সুলতানা মুখটা হঠাৎ করে গম্ভীর করে ফেলল, বলল, “কী জন্যে ভালো বল দেখি? তোমার লেখাপড়া জানা দরকার। লেখাপড়া শেষ করবার পর জজ বেরিস্টার হবা। বিয়া-শাদি করবা। আমার কী জন্যে দরকার?”

রূপা একটু বিপদে পড়ে গেল, লেখাপড়া নিয়ে সে যেসব ভালো ভালো কথা জানে, স্কুলে রচনা লেখার সময় যে কথাগুলো লিখে ভালো নম্বর পায় তার কোনোটাই সে বলতে পারল না। একটু ইতস্তত করে বলল, “কত ভালো ভালো গল্পের বই আছে, উপন্যাস-নাটক আছে সেগুলো পড়তে পারবে।”

সুলতানা হি হি করে আবার হাসতে লাগল, বলল, “খালাম্মা যখন বলবেন, এই সুলতাইন্যা, গোসলের জন্যে গরম পানি দে, তখন আমি বলমু, খাড়ান খালাম্মা, এই উপিন্যাসটা শেষ কইরা লই!”

রূপা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল সুলতানা তখন তাকে থামাল, বলল, “খালাম্মা তোমারেই গল্পের বই পড়তে দেন না! যদি আমারে গল্পের বই পড়তে দেখেন তাইলে এক্কেবারে হার্টফেল মারব!”

রূপা কিছু বলল না, কথাটা সত্যি। তার আম্মু যদি কখনো আবিষ্কার করেন সুলতানা বসে বসে গল্পের বই পড়ছে তা হলে সত্যি সত্যি ভয়ংকর কিছু ঘটে যেতে পারে। রূপা খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, “বুঝলে সুলতানা, বইয়ের মাঝে অনেক কিছু থাকে যেটা অন্য কোথাও থাকে না। আম্মু যখন আমাকেও বকাবকি করে তখন মনটা খুব খারাপ হয়। তারপর আমি যখন একটা ভালো বই পড়ি তখন মনটা আবার ভালো হয়।”

সুলতানা মন দিয়ে কথাটা শুনল তারপর বলল, “কী থাকে তোমার বইয়ের মাঝে?”

“কত কিছু!”

“বল দেখি একটা।”

রূপা তখন তার প্রিয় একটা বইয়ের একটা গল্প শোনাল। যুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া একটা বাচ্চা মেয়ের গল্প। সুলতানা চুপ করে পুরোটি শুনল। গল্প শেষ হবার পর সে তার ওড়না দিয়ে চোখ মুছে একটা নিশ্বাস ফেলল। ঠিক তখন ড্রয়িংরুমে হিন্দি সিরিয়াল শেষ হয়ে বিজ্ঞাপন শুরু হয়ে যায়। সুলতানা সাথে সাথে লাফ দিয়ে উঠে রান্নাঘরে ছুটে গেল। তাকে রূপার ঘরে দেখলে বিপদ হতে পারে।

.

খাবার টেবিলে বসেও সিরিয়াল নিয়ে আলোচনা হতে থাকে। আম্মা বললেন, “দমন্তী কী নিষ্ঠুর দেখেছ? আনিলার সাথে কী খারাপ ব্যবহার করল!”

আব্বু বললেন, “হ্যাঁ। মানুষ বলেই গণ্য করে না।”

আপু বলল, “জাসিন্দর কিছু বলে না কেন?”

আম্মু বললেন, “একেবারে ভীতুর ডিম। মেরুদণ্ড বলে কিছু নাই।”

আব্বু পুরো ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলেন, “সামাজিক একটা স্ট্যাটাস আছে তো-সেখান থেকে বের হতে পারছে না। জাসিন্দরের মনটা কিন্তু ভালো কিন্তু নিজের ফ্যামিলিকে আপসেট করতে চায় না।”

আম্মু প্লেটে খাবার নিতে নিতে বললেন, “এই সিচুয়েশানে যদি অভিক থাকত–তা হলে দেখতে কত সুন্দর করে পুরো বিষয়টা সামলে নিত–”

রূপা অবাক হয়ে একবার তার আব্বু আরেকবার তার আম্মুর মুখের দিকে তাকাতে লাগল–এরকম বড় বড় মানুষ হিন্দি সিরিয়ালের চরিত্রগুলো নিয়ে এইভাবে কথা বলতে পারে তার নিজেরও বিশ্বাস হতে চায় না।

খাবার মুখে দিয়ে হঠাৎ করে আম্মুর ভালো মেজাজ গরম হয়ে উঠল, হুংকার দিয়ে বললেন, “সুলতানা”

সুলতানা ভয়ে ভয়ে কাছে এসে দাঁড়াল, “জে খালাম্মা–”

আম্মু সবজিটা দেখিয়ে বললেন, “এটা কী?”

সুলতানা ঢোক গিলে বলল, “কেন খালাম্মা? কী হইছে?”

আম্মু চিৎকার করে বললেন, “দেশে লবণ পাওয়া যায় না? তরকারিতে লবণ দিসনি কেন?”

রূপা সবজিটা মুখে দিয়ে দেখল, লবণ একটু কম হতে পারে কিন্তু লবণ দেয়নি কথাটা সত্যি না।

রূপার মনে পড়ল আম্মুর ব্লাড প্রেশার ধরা পড়েছে তাই ডাক্তার বলেছে খাবারে লবণ কম থাকতে হবে সেই জন্যে মাত্র গতকাল আম্মু সুলতানাকে সেই বিষয়ে লেকচার দিয়েছেন। মনে হয় সুলতানা সেই জন্যেই সবজিতে লবণ একটু কম দিয়েছে। আম্মু আবার চিৎকার করলেন, “কেন লবণ দিসনি?”

সুলতান বলল, “দিছি তো। একটু কম দিছি–আপনি কালকে বললেন, একটু কম দিতে–”

“আমি কম দিতে বলেছি, না দিতে তো বলিনি। বলেছি?” আম্মুর মেজাজ আরো গরম হয়ে গেল, “বদমাইশ কোথাকার! কত বড় সাহস আবার আমার সাথে মুখে মুখে কথা বলিস? ছোটলোকের ঝাড়, এই বাসায় তোরে ঢুকতে দেওয়াই ভুল হয়েছে। জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতি না খেয়ে না দেয়ে মা-ভাই বোন নিয়ে ঘরে ঘরে ভিক্ষা করে বেড়াতি, মানুষের লাথি-ঝাঁটা খেয়ে বড় হতি তা হলে একটা উচিত শিক্ষা হত।”

সুলতানা একটা কথাও না বলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। এতে মনে হয় আম্মুর রাগ আরো বেড়ে গেল, হাত বাড়িয়ে খপ করে সুলতানার চুল ধরে নিজের কাছে টেনে এনে একটা ঝাঁকুনি দিলেন তারপর ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেন। সুলতানা দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে পড়তে পড়তে কোনোমতে নিজেকে সামলে নিল। ফ্যাকাসে মুখে সে সবার দিকে তাকাল, রূপা দেখল ঠোঁট কামড়ে সে অনেক কষ্টে চোখের পানি সামলানোর চেষ্টা করছে।

আন্ধু বললেন, “হয়েছে হয়েছে, এখন ছেড়ে দাও। এমনিতেই তোমার ব্লাড প্রেশার, তোমার এত উত্তেজিত হওয়া ঠিক না।”

“আমার কী এমনি এমনি ব্লাড প্রেশার হয়েছে? এই ছোটলোকের বাচ্চাদের সাথে দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা ক্যাট ক্যাট ক্যাট ক্যাট করতে করতে আমার ব্লাড প্রেশার হয়েছে। এরা দায়ী। এরা–”

রূপা প্লেটে তার খাবারগুলো নাড়াচাড়া করতে লাগল, তার ইচ্ছে করছিল খাওয়া বন্ধ করে উঠে যায় কিন্তু তা হলে অবস্থা মনে হয় আরো খারাপ হয়ে যাবে। সুলতানার সাথে সাথে তাকেও মনে হয় এক হাত নিয়ে নিবে।

রাত্রিবেলা যখন সবাই শুয়ে পড়েছে তখন রূপা পায়ে পায়ে রান্নাঘরে হাজির হল। সুলতানা রান্নাঘরের মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে একটা টিনের থালায় কিছু ভাত নিয়ে খাচ্ছে। তারা যখন খেয়েছে তখন টেবিলে অনেক কিছু ছিল, সুলতানার প্লেটে সেসব কিছু নেই, একটা বড় কাঁচা মরিচ শুধু আলাদা করে চোখে পড়ে।

সুলতানা অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল, “কী হইছে রূফ-রূফালী!”

রূপা বলল, “রূফ-রূফালী না, রূপ-রূপালী।”

সুলতানা ফিক করে হাসল, “সেইটা বলতে আসছ?”

“না। সেইটা বলতে আসি নাই। আমি আমি–”

“তুমি কী?”

“আমি বলতে এসেছি যে আমি খুবই সরি। মানে খুবই দুঃখিত।”

সুলতানা হাসি হাসি মুখে বলল, “কেন?”

“আজকে আম্মু তোমার সাথে যেরকম ব্যবহার করেছে সেইটা দেখে।”

সুলতানা আবার খেতে শুরু করল। মুখে একটু ভাত দিয়ে বলল, “আজকে তো বেশি কিছু করে নাই। খালি চুল ধইরা একটা ধাক্কা–”

“মানে?”

সুলতানা প্লেটটা নিচে রেখে বাম হাতটা দিয়ে তার কামিজটা একটু উপরে তোলে, রূপা দেখে পিঠে লাল হয়ে খানিকটা জায়গায় দগদগে ঘায়ের মতো হয়ে আছে। রূপা শিউরে উঠল, “কীভাবে হয়েছে?”

“একটা গেলাস হাত থেকে পড়ে ভেঙে গেছিল।”

রূপা কিছু বলতে পারে না, নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে। সুলতানা সহজ গলায় বলল, “আসলে মারপিট আমি সহ্য করতে পারি। গরিব মানুষ হইছি একটু লাথি ঝাঁটা খামু না সেইটা তো হতে পারে না। কিন্তু যখন তোমাদের সামনে গায়ে হাত দেওয়া তখন লজ্জা লাগে।”

সুলতানা মাথা নিচু করে তার থালার ভাত নাড়াচাড়া করতে লাগল। রূপা দেখল সেখানে টপ করে তার চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি পড়ল। একটু পর সুলতানা যখন মুখ তুলে তাকাল তখন অবশ্যি তার চোখে-মুখে মন খারাপের কোনো চিহ্ন নেই, হাসি হাসি মুখ।

রূপা কী বলবে বুঝতে পারল না, ইতস্তত করে বলল, “তুমি এখানে কেন পড়ে আছ? তুমি চলে যাও না কেন?”

“যদি দরকার হয় চলে যাব। তুমি চিন্তা কইরো না।”

“আম্মু যদি তোমার উপর এইভাবে অত্যাচার করে তা হলে তো তোমার এখনই চলে যাওয়া উচিত।”

সুলতানা কোনো কথা বলল না, প্লেট থেকে আরেক দলা ভাত মুখে নিয়ে কাঁচা মরিচটাতে কড়াৎ করে কামড় দিল। রূপা বলল, “তোমার বাড়িতে কে আছে?”

“বুড়া মা আছে। আর কেউ নাই।”

“তা হলে তুমি কই যাবা।”

“আমার দূর সম্পর্কের একটা বইন আছে। জোবায়দা। তার কাছে।”

“জোবায়দা কোথায় থাকে?”

সুলতানা রূপার দিকে তাকাল, তার দুই চোখে কৌতুক। ”তুমি জোবায়দার কথা ভুলে গেছ?”

রূপা অবাক হয়ে বলল, “আমি চিনি জোবায়দাকে?”

“সবাই চিনে।”

“সবাই চেনে?”

“হ্যাঁ।” সুলতানা আরেক দলা ভাত মুখে দিয়ে কাঁচা মরিচটাতে কড়াৎ করে আরেকটা কামড় দিয়ে বলল, “টেলিভিশনে আসছিল, পত্রিকায় আসছিল, মনে নাই? গলায় দড়ি দিল কয়দিন আগে?”

রূপা চমকে উঠল, তার মনে পড়ল, কয়দিন আগে একটা বাসার কাজের মেয়ে অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে গলায় দড়ি দিয়েছিল, সেটা নিয়ে পত্রপত্রিকা, টেলিভিশনে কয়দিন খুব হইচই হয়েছিল। রূপা চোখ বড় বড় করে সুলতানার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি সুইসাইড করার কথা বলছ?”

“বলছি না। কিন্তু এই রাস্তাটা খোলা আছে চিন্তা করলে বুকে জোর পাই।”

রূপা রান্নাঘরে হাঁটু গেড়ে বসে সুলতানার হাত ধরে বলল, “প্লীজ প্লীজ সুলতানা এরকম কথা মুখে এনো না। প্লীজ!”

“ঠিক আছে মুখে আনমু না। কিন্তু মাথায় যদি চলে আসে কী করমু বল।” সুলতানা প্লেটটা নিচে রেখে তার ওড়নাটা খুলে দেখাল, “এই যে তেল-কালি লাগা ওড়না পেঁচায়া গলায় বানতে হবে, তারপর ঐ শিকের মাঝে বেঁধে একটা লাফখুবই সোজা!”

রূপা একেবারে শিউরে উঠল। বলল, “ছিঃ! এইভাবে বলে না।”

“ঠিক আছে রূফ-রূফালী বলব না।”

“রূফ-রূফালী না রূপ-রূপালী।”

সুলতানা হাসল, রূপাও হাসল। রূপা তখন দুই হাত দিয়ে সুলতানার হাত ধরে বলল, “শোনো সুলতানা। আমি যখন বড় হব তখন তুমি আর আমি একসাথে থাকব, কেউ তখন তোমারে কিছু করতে পারবে না।

সুলতানা রূপার দিকে তাকিয়ে রইল, তার চোখে হঠাৎ পানি টলটল করতে থাকে। সে বাম হাতের উল্টা পিঠ দিয়ে চোখ মুছে বলল, “তুমি যে এইটা বলেছ সেই জন্যেই বুকটা ভইরা গেছে। এই বাসায় তুমি আছ দেখে আমি সব সহ্য করতে পারি। বুঝছ রূফ-রূফালী?

“রূফ-রূফালী না রূপ-রূপালী।”

“রূ-ফ-রূ-ফা-লী!” সুলতানা আবার হাসল, রূপা অবাক হয়ে দেখল সুলতানার হাসিটা কী সুন্দর। না কি সবার হাসিই সুন্দর?

.

০৩.

ক্লাশে এসে রূপা ডেস্কে তার ব্যাগটা রাখার আগেই মিম্মি ছুটে এলো। গলা নামিয়ে চোখ নাচিয়ে বলল, “জানিস কী হয়েছে?”

রূপা অনুমান করল, বিশেষ কিছু হয়নি। মিম্মির কথা বলার ঢঙটাই এরকম। এমনভাবে শুরু করবে যে সবারই মনে হবে ভয়ংকর কিছু একটা ঘটেছে। মিম্মি অবশ্যি রূপার উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করল না গলা আরো নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বলল, “সোহেলের বাবা-মা” তারপর দুই হাত বিচিত্র একটা ভঙ্গি করে নাড়াল। এভাবে হাত নাড়ার অর্থ যা কিছু হতে পারে, সোহেলের বাবা-মা একজন আরেকজনকে খুন করে ফেলেছেন কিংবা একজন আরেকজনের হাত ধরে নাচানাচি করছেন।

রূপা জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে সোহেলের বাবা-মায়ের!”

“কমপ্লিট ছাড়াছাড়ি।”

“তুই কেমন করে জানিস?”

“না জানার কী আছে?” মিম্মি ষড়যন্ত্রীর মতো মুখ করে বলল, “আমার কাছে সব খবর আসে। তা ছাড়া দেখিসনি সোহেল ক্লাশে আসা বন্ধ করে দিয়েছে?”

“বন্ধ করে দিয়েছে?”

“হ্যাঁ।”

রূপা খেয়াল করেনি। ক্লাশে এত ছেলেমেয়ে কে কখন আসে, কখন যায় সে। লক্ষ করতে পারে না, মিম্মি পারে। জিজ্ঞেস করল, “কেন ক্লাশে আসা বন্ধ করে দিয়েছে?”

“বুঝতে পারছিস না? কেমন করে আমাদের মুখ দেখাবে?”

“মুখ দেখাতে সমস্যা কী?”

মিম্মি হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গি করে বলল, “তুই কিছুই বুঝিস না! বাবা-মা ছাড়াছাড়ি হলে ছেলেমেয়েদের লজ্জা হয় না? সেই লজ্জায় সে আর মুখ দেখাতে পারে না!”

রূপা দেখল ঠিক তখন সোহেল তার ব্যাগ দুলাতে দুলাতে ক্লাশ রুমে ঢুকল। তার মুখে লজ্জার কোনো চিহ্ন নেই। মুখটা একটু শুকনো তার বেশি কিছু নয়। সোহেলকে দেখে মিম্মি কেমন যেন হকচকিয়ে যায়।

রূপা মিম্মিকে বলল, “ঐ তো সোহেল। দেখি জিজ্ঞেস করে—”

মিম্মি খপ করে রূপার হাত ধরে বলল, “সর্বনাশ! কী জিজ্ঞেস করবি?”

“ওর বাবা-মায়ের কী অবস্থা–”

”মাথা খারাপ হয়েছে তোর? কেউ এভাবে জিজ্ঞেস করে? কত বড় লজ্জা–”

রূপা মিম্মির হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, “লজ্জার কী আছে।”

মিম্মি রূপাকে ধরে রাখার চেষ্টা করল, রূপা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সোহেলের কাছে গিয়ে বলল, “সোহেল, তোর সবকিছু ঠিক আছে?”

সোহেল বলল, “হ্যা–” তারপর রূপার চোখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “আসলে ঠিক নাই।”

“কী হয়েছে?”

“অনেক লম্বা স্টোরি।”

“বলবি আমাকে?”

“কী আর বলব! আম্মু-আব্বুর অনেকদিন থেকে ঝগড়া। এখন মামারা এসে আম্মুকে নিয়ে গেছে। ছোট ভাইটাসহ।”

রূপা কিছু না বলে সোহেলের দিকে তাকিয়ে রইল। সোহেল বলল, “কয়দিন থেকে মনটা ভালো নাই।”

“ভালো থাকার কথা না।”

“কয়দিন খালি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছি।”

“এখন?”

“আজকে ক্লাশে আসলাম। কিছু ভাল্লাগে না।”

রূপা নরম গলায় বলল, “আমাদের বলিস, যদি কিছু করতে পারি।”

সোহেল হাসার চেষ্টা করল, “তুই আর কী করবি?”

“তবুও। অনেক সময় যখন খুব মন খারাপ থাকে তখন কারো সাথে কথা বললে একটু মন ভালো হয়।”

সোহেল বলল, “উঁহু। হয় না। সবকিছু ভুলে থাকতে পারলে হত। ভুলে থাকার রাস্তা তো একটাই–”

“কী রাস্তা?”

সোহেল মাথা নাড়ল, বলল, “নাহ্। কিছু না।”

রূপা দুশ্চিন্তিত মুখে সোহেলের দিকে তাকিয়ে রইল।

.

বিজ্ঞান ক্লাশে সোহেল একটু বিপদে পড়ল। বিজ্ঞান স্যার সবাইকে অম্ল-ক্ষার নিয়ে একটা হোমওয়ার্ক দিয়েছিলেন, স্যারকে সবাই যমের মতো ভয় পায় তাই সবাই নিয়ে এসেছে। শুধু সোহেল আনেনি। স্যার, হুংকার দিয়ে বললেন, “হোমওয়ার্ক আনিসনি কেন?”

সোহেল দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে কিছু একটা বলল। কী বলল সেটা পরিষ্কার বোঝা গেল না। স্যার আরো জোরে হুংকার দিলেন, “কী বলছিস পরিষ্কার করে বল।”

“স্যার, বাসায় একটু ঝামেলা ছিল।”

“কী ঝামেলা?”

“এই তো মানে স্যার ইয়ে স্যার–”

”ইয়ে মানে আবার কী?”

সোহেল বলল”মানে স্যার ঝামেলা।”

“বদমাইশ পাজি হতভাগা। লেখাপড়ার নামে কোনো নিশানা নাই শুধু। ফাঁকিবাজি? একটা হোমওয়ার্ক পর্যন্ত করতে পারিস না?”

সোহেল কাচুমাচু মুখ করে বলল, “ভুল হয়ে গেছে স্যার।”

“ভুল?” স্যার চিৎকার করে বললেন, “ভুল আর বদমাইশীর পার্থক্য জানিস ফাজিল কোথাকার? খুন করে ফেলব তোকে। খুন করে ফেলব।”

স্যার এগিয়ে গিয়ে খপ করে সোহেলের চুল ধরে ফেললেন, প্রচণ্ড একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, “পাজির পা ঝাড়া কোথাকার। একেবারে খুন করে ফেলব।”

রূপার কাছে পুরো ব্যাপারটা একেবারে অসহ্য মনে হল, কিন্তু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা ছাড়া আর কিছু করার নেই। স্যার সোহেলকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন, বললেন, “লেখাপড়া করার ইচ্ছা আছে? না কি নেই?”

সোহেল বিড়বিড় করে বলল, “জানি না স্যার।”

স্যার ঠিক শুনতে পেলেন না, জিজ্ঞেস করলেন, “কী বললি?”

সোহেল বলল, “না স্যার আর কিছু বলি নাই।”

স্যার আর কিছু বললেন না। সোহেলকে ছেড়ে দিয়ে ক্লাশের সামনে চলে গেলেন। যখন ক্লাশ চলছিল রূপা মাঝে মাঝেই সোহেলকে লক্ষ করছিল। কেমন যেন আনমনা হয়ে বসে আছে। মনে হয় চারপাশে কী হচ্ছে সে কিছুই লক্ষ করছে না।

পরদিন থেকে সোহেল ক্লাশে আসা বন্ধ করে দিল।

.

চারদিন পরের কথা। রূপা স্কুলে গিয়ে নিজের ক্লাশে যাচ্ছে, মিম্মি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আচার খাচ্ছিল, রূপাকে দেখে লুকিয়ে ফেলল। রূপা সেটা না দেখার ভান করে বলল, “সোহেলের কোনো খবর জানিস?”

“জানি।”

“কী জানিস? ক্লাশে আসে না কেন?”

“তোর মা-বাবার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে তুইও ক্লাশে আসতি না।”

“আরো বেশি আসতাম।”

মিম্মি গলা উঁচিয়ে বলল, “আসতি না।”

“অবশ্যই আসতাম। একশবার আসতাম।”

পাশ দিয়ে রাজু যাচ্ছিল, সে দাঁড়িয়ে গেল, জিজ্ঞেস করল, “কোথায় একশবার আসবে?”

মিম্মি চোখ পাকিয়ে বলল, “আমরা আমাদের কথা বলছি তুমি তার মাঝে নাক গলাতে চাও কেন?”

মিম্মি কথাটা বলল খুবই খারাপভাবে যে কেউ শুনলে অপমানে তার কান লাল হয়ে উঠত। রাজুর কিছু হল না, সে খিক খিক করে হেসে ফেলল, “ঠিকই বলেছ। আমার নাকটা মনে হয় বেশি লম্বা যেখানে-সেখানে গলিয়ে দিই।” বলে

সে নিজের নাকটা টানাটানি করে দেখল, আসলেই সেটা লম্বা কি না।

কথা শেষ করে রাজু চলে যাচ্ছিল, রূপা তাকে থামাল। বলল, “রাজু, তুমি কি জান সোহেল চারদিন ধরে ক্লাশে আসে না?”

“চারদিন থেকে?”

“হ্যাঁ।”

“আজ বিকেলে সোহেলের বাসায় গিয়ে খোঁজ নেব।”

রূপা জিজ্ঞেস করল, “ওর বাসা কোথায় জান?”

“না।”

“তা হলে কেমন করে যাবে?”

“খোঁজ করে বের করে ফেলব।” রাজু বলল, “আমার লম্বা নাকটা সোহেলের বাসাতেও গলিয়ে ফেলব।” তারপর মিম্মির দিকে তাকিয়ে একটু হেসে রাজু হেঁটে হেঁটে চলে গেল।

মিম্মি চোখ পাকিয়ে রাজুর দিকে তাকিয়ে থেকে রূপাকে বলল, “দেখলি? দেখলি? আমাকে খোঁচা মেরে গেল?”

রূপা মুখ শক্ত করে বলল, “ঠিকই করেছে। তোর মাঝে মাঝে খোঁচা খাওয়ার দরকার আছে।”

.

স্কুল ছুটির পর রাজু সবাইকে বলল, “সোহেল চারদিন থেকে স্কুলে আসে না, আমি খোঁজ নিতে যাচ্ছি। তোমরা আর কেউ আমার সাথে যেতে চাও!”

ক্লাশে সবাই সবাইকে তুই তুই করে বলে, রাজু একটু ব্যতিক্রম। সে কেন জানি সেটা করতে পারে না, সবাইকে তুমি করে বলে। সেই জন্যে অন্যদেরও তাকে তুমি করে বলতে হয়। মিম্মি জিজ্ঞেস করল, “তুমি জান সোহেলের বাসা কোথায়?”

“হ্যাঁ। কাছেই।”

“যদি দেরি না হয় তা হলে আমি যেতে পারি।”

রাজু বলল, “গুড।” তারপর সবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “আর কেউ?”

সঞ্জয় বলল, “আমো যাম্বো।”

মিম্মি ভুরু কুঁচকে বলল, “মানে?”

“মানে হচ্ছে আমি যাব।” বলে সে হি হি করে হাসতে থাকে।

রূপার খুব ইচ্ছে করল বলতে যে সেও যাবে। কিন্তু সে বলতে পারল না, বাসায় না বলে কোথাও যাওয়া তার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। বাসায় তা হলে তাকে কুচি কুচি করে কেটে ফেলবে।

সবাই স্কুল থেকে একসাথে বের হল, রাজু, মিম্মি আর সঞ্জয়ের সাথে সাথে রূপাও হেঁটে যেতে থাকে। তারা তিনজন সোহেলের বাসার দিকে যাবে, রূপা তখন হেঁটে নিজের বাসায় চলে যাবে। চারজন গল্প করতে করতে যাচ্ছিল, এক জায়গায় রাজু হঠাৎ থেমে গেল, এদিক-সেদিক তাকিয়ে একটা গলি দেখিয়ে বলল, “এখন এই দিকে।”

রূপা বলল, “তোরা যা। আমি বাসায় যাই।”

মিম্মি বলল, “আমাদের সথে চল কিছুক্ষণের জন্যে।”

“না। বাসায় বলে আসিনি।”

রাজু বলল, “কাছেই বাসা। বেশিক্ষণ লাগবে না।”

রূপা এক মুহূর্ত চিন্তা করে বলল, “আমি বেশিক্ষণ থাকব না। তা হলে দেরি করে বাসায় গেলে খুব রাগ করবে।”

“ঠিক আছে। তোমাকে বেশিক্ষণ থাকতে হবে না। আমরাও থাকব না। খোঁজ নিয়েই চলে যাব।”

খানিক দূর, হেঁটে একটা বাসার সামনে রাজু দাঁড়িয়ে বলল, “এই বাসাটা।”

সামনে একটা গেট, তারা ধাক্কা দিয়ে গেটটা খুলে ভেতরে ঢুকে যায়। ভেতরে একটা ভোলা জায়গা, খোয়া দেওয়া রাস্তা। রাস্তার দুই পাশে শুকনো কিছু ফুলের গাছ। তারা সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে দরজায় ধাক্কা দিল। কোনো সাড়া নেই, তাই আবার দরজা ধাক্কা দিল। ভেতর থেকে একজন মেয়েলী গলায় জিজ্ঞেস করল, “কে?”

রাজু বলল, “আমরা। সোহেলের বন্ধু।”

তখন একজন মহিলা দরজা খুলে দিল, রাজু জিজ্ঞেস করল, “সোহেল বাসায় আছে?”

“মনে হয় নাই।” বলে মহিলাটি দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইল।

রাজু বলল, “আমরা তার সাথে দেখা করতে এসেছি। গিয়ে একটু দেখবেন?”

মহিলাটা মনে হয় একটু বিরক্ত হল। বলল, “এই রকম সময় সোহেল স্কুলে থাকে।”

রাজু বলল, “সে স্কুলে নাই। আমরা স্কুল থেকে এসেছি।”

“তা হলে কোথায় জানি না।”

রূপা একটু বিরক্ত হয়ে বলল, “একটু আগে বলেছেন মনে হয় নাই। এখন বলছেন কোথায় জানি না। আমাদের জানতে হবে।”

সঞ্জয় বলল, “ইমার্জেন্সি-স্কুল থেকে আমাদেরকে পাঠিয়েছে। ভেতরে খবর দেন। রিপোর্ট করে দিলে সমস্যা হবে।

সঞ্জয়ের হুমকিতে মনে হয় কাজ হল। মহিলাটি বলল, “ঠিক আছে, আমি দেখি তার ঘরে আছে না কী।”

মহিলাটি ভেতরে চলে গেল, একটু পরে এসে বলল, “ঘরে আছে।”

রাজু বলল, “আসতে বলেন, আমরা কথা বলব।”

মিম্মি বলল, “তার চাইতে আমরা সোহেলের ঘরে চলে যাই?”

মহিলা বলল, “যান। বারান্দা দিয়ে গেলে শেষ ঘর।”

চারজন বারান্দা দিয়ে হেঁটে শেষ ঘরের দরজায় ধাক্কা দিল। দরজাটা খোলা, ভেতরে বিছানায় সোহেল গুটিসুটি মেরে বসে আছে। পরনে একটা ময়লা পায়জামা আর ঢোলা টি-শার্ট। ওদেরকে দেখে সে একটু অবাক হয়ে তাকাল, “তোরা?”

রাজু বলল, “তুমি তো কয়েকদিন থেকে স্কুলে যাও না, তাই খোঁজ নিতে এসেছি। তুমি ভালো আছ তো?”

“হ্যাঁ হ্যাঁ। ভালো আছি।” সোহেল হড়বড় করে বলল, “ভালো থাকব না কেন? খুব ভালো আছি।” বলে সে হাসি হাসি মুখ করে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল।

রাজু একটু এগিয়ে গিয়ে সোহেলের হাতটা ধরার চেষ্টা করতেই সে ঝট করে তার হাত সরিয়ে নিয়ে একটু সরে বসল। রাজু জিজ্ঞেস করল, “তা হলে তুমি স্কুলে যাও না কেন?”

“যাব। যাব। যাব। স্কুলে যাব।” সোহেল বিড় বিড় করে বলল, “স্কুলে যাব।”

রূপা জিজ্ঞেস করল, “এই কয়দিন যাওনি কেন?”

“এই তো এমনি। দুই-তিনদিন স্কুলে না গেলে কী হয়? কিছু হয় না। আবার যাব।”

সঞ্জয় এদিক-সেদিক তাকিয়ে বলল, “এইটা তোর ঘর?”

“হ্যাঁ। আমার আর সাদিবের। সাদিব এখন নাই। সাদিব মানে বুঝেছিস তো? আমার ছোট ভাই। ক্লাশ ফোরে পড়ে। ক্লাশ ফোর।”

সঞ্জয় চারদিকে তাকিয়ে বলল, “তোর ঘরের এই অবস্থা কেন? মনে হয় এইটা কেউ কোনোদিন পরিষ্কার করে না।”

সোহেল হি হি করে হাসল, হাসিটা কেমন যেন অস্বাভাবিক। মনে হল জোর করে হাসির মতো শব্দ করছে, হাসতে হাসতে বলল, “পরিষ্কার করবে না কেন? পরিষ্কার করে। কয়দিন থেকে কাউকে ঘরে ঢুকতে দেই না।”

রাজু জিজ্ঞেস করল, “কেন ঢুকতে দাও না?”

“এমনি।”

রাজু একটু কাছে গিয়ে বলল, “সোহেল, তুমি আমার কাছে একটু আসবে?”

সোহেল হঠাৎ করে কেন জানি মুখ শক্ত করে ফেলল, “কেন? আমি কেন তোমার কাছে যাব?”

“এমনি। একটু কাছে আস। আমার দিকে তাকাও।”

“আমি কেন তোমার দিকে তাকাব?” সোহেল হঠাৎ রেগে উঠল, অন্য সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি কী তোদের আসতে বলেছি? তোরা কেন এসেছিস?”

রূপা বলল, “তুই এতদিন স্কুলে যাবি না আর আমরা তোর খোঁজ নিতে পারব না?”

“কে বলেছে খোঁজ নিতে? যা এখন। তোরা যা।”

রাজু অন্যদের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমরা যাও।”

রূপা জিজ্ঞেস করল, “তুমি যাবে না?”

“আমি একটু পরে যাব।”

“না।” সোহেল চিৎকার করে বলল, “তুমিও যাও।” সে হাত তুলে চিৎকার করে বলল, “যা, তোরা যা। সবাই বের হয়ে যা।”

সবাই দেখল তার হাতটা কাঁপছে।

রাজু খুব শান্ত গলায় বলল, “রূপা, মিম্মি আর সঞ্জীব, তোমরা যাও। আমি সোহেলের সাথে একটু কথা বলে আসছি।”

সোহেল বলল, “আমি কারো সাথে কথা বলব না। না, বলব না।”

রাজু সোহেলের কথাকে গুরুত্ব দিল না, অন্যদের দিকে তাকিয়ে বলল, “যাও। তোমরা যাও। বাসায় যাও।”

রূপা, মিম্মি আর সঞ্জয় ঘর থেকে বের হয়ে গেল। বাইরের ঘরের দরজা খোলা, তারা বের হয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিল। রাস্তায় না ওঠা পর্যন্ত কেউ কোনো কথা বলল না। খানিকক্ষণ চুপ করে হাঁটার পর সঞ্জয় বলল, “আজিব ব্যাপার। সোহেলের মাথা মনে হয় আউলে গেছে।”

আজিব বলে কোনো শব্দ নাই শব্দটা আজব, তারপরেও কেউ সেটা শুদ্ধ করে দিল না।

.

পরদিন ক্লাশে ঢুকে রূপা প্রথমেই রাজুকে খুঁজে বের করল। ক্লাশের পিছন দিকে তার নির্দিষ্ট জায়গায় রাজু বসে বসে একটা গল্পের বই পড়ছে। রূপা কাছে গিয়ে ডাকল, “এই রাজু।”

রাজু বইটার পৃষ্ঠা ভাঁজ করে বইটা বন্ধ করল (পদ্মা নদীর মাঝি, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়), রূপাকে জিজ্ঞেস করল, “কী রূপা?”

“কালকে কী হল?”

রাজু এদিক-সেদিক তাকাল, তারপর গলা নামিয়ে বলল, “ভালো না।”

“কী হয়েছে?”

“খুব সিরিয়াস। এখন কাউকে বলা ঠিক হবে না। তোমাকে বলি।”

“বল।”

“সোহেল ড্রাগস ধরেছে।”

রূপা আঁতকে উঠল, “সর্বনাশ!”

“হ্যাঁ। দেখেই আমার সন্দেহ হচ্ছিল। আমি চোখের মণির দিকে দেখতে চাইছিলাম, ড্রাগ খেলে সেগুলো ফুলে যায় আমাকে কাছে আসতে দিচ্ছিল না মনে আছে?”

“হ্যাঁ। মনে আছে।”

“তোমরা চলে যাবার পর আমি চেপে ধরলাম, তখন স্বীকার করেছে। হাউমাউ করে কান্না।”

“কেন ড্রাগস ধরেছে?”

রাজু ভুরু কুঁচকে বলল, “ফ্যামিলিতে অশান্তি। বাবা-মায়ের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে, ছোট ভাইটাকে নিয়ে মা চলে গেছে। মন খারাপ, স্কুলে বন্ধু-বান্ধব নাই একা একা থাকে। রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ায় খারাপ খারাপ কিছু বন্ধু জুটেছে, তারা শিখিয়েছে। সব দুঃখ-কষ্ট ভুলে যাওয়ার না কী এক নম্বর ওষুধ।”

“কী সর্বনাশ! এখন কী হবে?”

“আমি জানি না।”

রূপা জিজ্ঞেস করল, “ওকে বোঝাওনি?”

“বুঝিয়েছি। কিন্তু লাভ কী? এমন ড্রাগস আছে একবার খেলেই তুই আটকে যাবি আর ছুটে আসতে পারবি না। খেতেই হবে তোকে, খেতেই হবে।”

“কী ড্রাগস খায়?”

“জানি না। বুলবুলি না ভুলভুলি কী একটা নাম বলল। ছোট ছোট লাল-নীল ট্যাবলেট।”

“কোথা থেকে কিনে?”

“ওই যে তার রাস্তার বন্ধু। তারা দেয়।”

“টাকা পায় কোথায়?”

“বাসা থেকে চুরি করে।”

“ওর বাসার কেউ জানে না?”

রাজু মাথা নাড়ল, “কে জানবে? আছেই তো শুধু বাবা। বাবার কোনো কিছু নিয়ে মাথা ব্যথা নেই।”

“এখন কী করা যায়?”

রাজু তখন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, ঠিক তখন মিম্মি এসে জিজ্ঞেস করল, “তোরা কী নিয়ে গুজগুজ ফুসফুস করছিস?”

রূপা বলল, “তোকে নিয়ে।”

“আমাকে নিয়ে?”

রাজু হাসল, বলল, “না তোমাকে নিয়ে না। সোহেলকে নিয়ে।”

“কী হয়েছে সোহেলের? আমরা চলে আসার পর কথা বলেছে তোমার সাথে?”

“নাহ্!” রাজু মাথা নাড়ল, “বলেনি। আমার সাথে ঝগড়াঝাটি করল।”

মিম্মি মুখ শক্ত করে বলল, “সোহেলটা কত বড় বেয়াদব দেখেছিস? আমরা গিয়েছি তার খোঁজ নিতে, আর আমাদেরকে বাসা থেকে বের করে দিল। তোমার সাথে ঝগড়া করল।”

“আহা বেচারা। মা-বাবার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে সেই জন্যে মন খারাপ।”

“তাই বলে এরকম ব্যবহার করবে?”

রূপা বলল, “ছেড়ে দে। মন খারাপ হলে মানুষ কত কিছু করে।”

মিম্মি এদিক-সেদিক তাকাল, তারপর গলা নামিয়ে বলল, “এদিকে কী হয়েছে জানিস?”

“কী হয়েছে?”

মিম্মি আরো গলা নামিয়ে ফেলল, প্রায় ফিসফিস করে বলল, “লিজা কী। করেছে জানিস?”

“কী করেছে?”

“তার তো ধারণা সে হচ্ছে বিশ্ব সুন্দরী। অহংকারে মাটিতে পা পড়ে না। সেইদিন একটা দোকানে গিয়েছে থ্রী-পিস কিনতে–”

মিম্মি তখন সবিস্তারে লিজাকে নিয়ে বিচিত্র একটা ঘটনার কথা বলতে শুরু করল, রূপা শোনার ভান করল, হুঁ হুঁ করল, মাথা নাড়ল, মাঝে মাঝে চোখে-মুখে অবাক হবার ভান করতে লাগল, কিন্তু তার মাথার মাঝে ঘুরপাক খেতে লাগল সোহেলের কথা। সোহেল হাতটা তুলে রেখেছে, হাতটা কাঁপছে কিছুতেই রূপা সেই দৃশ্যটা ভুলতে পারছে না। সোহেলের চোখে-মুখে এক ধরনের অস্থির অস্থির ভাব। তার দুই চোখের মাঝে বিচিত্র একটা দৃষ্টি। কী ছিল সেই দৃষ্টিতে?

রূপা হঠাৎ করে বুঝতে পারে সোহেলের দুই চোখে ছিল আতঙ্ক। ভয়ংকর আতঙ্ক।

.

০৪.

সোহেলকে নিয়ে কী করা যায় কিংবা আসলেই কিছু করা সম্ভব কী না সেটা নিয়ে রূপা আর রাজু চিন্তা করছিল। সমস্যা হচ্ছে বিষয়টা নিয়ে নিরিবিলি যে দুইজন একটু কথা বলবে তারও কোনো সুযোগ পাচ্ছিল না। স্কুল শুরু হওয়ার পর সারাদিন ক্লাশ, ছুটির পর রূপাকে বাসায় যেতে হয়। দুইজনে পরামর্শটা করবে কীভাবে?

কিন্তু সমস্যাটা সমাধান হয়ে গেল হঠাৎ করে। ব্যাপারটা ঘটল এভাবে :

স্কুলে যে কয়জন স্যার আর ম্যাডাম আছেন তার মাঝে সবচেয়ে ভয়ংকর হচ্ছেন বিজ্ঞান স্যার। দেশে না কী আইন করা হয়েছে স্কুলে ছেলেমেয়েদের পিটানো যাবে না কিন্তু বিজ্ঞান স্যারের সেটা নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা নেই, ক্লাশে এসে যখন খুশি তখন ছেলেমেয়েদের গায়ে হাত তোলেন। এই স্যারের মার খেয়েই সোহেল ক্লাশে আসা ছেড়ে দিয়েছে।

সেদিন মাত্র ইংরেজি ক্লাশ শেষ হয়েছে, বিজ্ঞান ক্লাশ শুরু হবে। স্যার পরমাণুর গঠনের উপর একটা হোমওয়ার্ক করতে দিয়েছিলেন সবাই সেটা হাতে নিয়ে এক ধরনের অস্বস্তি নিয়ে বসে আছে। এই স্যারের ক্লাশে একটা আতঙ্কের মাঝে সময় কাটে, যখন খুশি স্যার যে কোনো কিছু করে ফেলতে পারেন। ভালো করে লেখাপড়া করে এলেও কেউ এই স্যারের ক্লাশে নিরাপদ না।

সবাই যখন নিশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করছে তখন দেখা গেল বিজ্ঞান স্যারের বদলে ছোটখাট হাসিখুশি একজন মহিলা ক্লাশে উঁকি দিলেন। মাথা ঢুকিয়ে বললেন, “ক্লাস এইট, সেকশান বি?”

ক্লাশের ছেলেমেয়েরা মাথা নাড়ল, “জি ম্যাডাম!”

ম্যাডাম ক্লাশে ঢুকলেন। হাতে একটা বই ছিল সেটা টেবিলে রাখলেন তারপর ক্লাশের সবার দিকে হাসি হাসি মুখ করে তাকালেন। সবাই তার দিকে তাকিয়ে রইল, কেউ এখনো বুঝতে পারছে না কী হচ্ছে, বিজ্ঞান স্যার কোথায় গেলেন, তার বদলে এই ম্যাডাম কোথা থেকে এলেন?

ম্যাডাম বললেন, “আমি তোমাদের নতুন বিজ্ঞানের ম্যাডাম।”

সবাই বুকের ভেতর থেকে আটকে থাকা বাতাসটুকু কোনোভাবে বের করল, কিন্তু এখনো বুঝতে পারছিল না। এটা আসলেই বিশ্বাস করা ঠিক হবে কী না। মাসুক বলল, “পাকাঁপাকি?”

ম্যাডাম হেসে ফেললেন, জিজ্ঞেস করলেন, “পাকাঁপাকি মানে?”

“মানে আপনি এখন থেকে সবসময় বিজ্ঞান পড়াবেন?”

“হ্যাঁ।”

সাথে সাথে ক্লাশের সবাই আনন্দের মতো একটা চিৎকার করল। ম্যাডাম হাত তুলে থামানোর চেষ্টা করলেন। বললেন, “আস্তে আস্তে! তোমাদের হয়েছে কী? এত চিৎকার করছ কেন?”

সঞ্জয় বলল, “ম্যাডাম আপনি জানেন না বিজ্ঞান স্যার আমাদের উপর কত অত্যাচার করতেন। পিটিয়ে আমাদের বারোটা বাজিয়ে দিতেন। আমাদের

ম্যাডাম হাত তুলে সঞ্জয়কে থামালেন, বললেন, “দাঁড়াও দাঁড়াও! আমি প্রথম দিন এসেই অন্য স্যারের বিরুদ্ধে অভিযোগ শুনতে চাই না।” 

ক্লাশের ছেলেমেয়েরা বলতে লাগল, “শুনতে হবে। শুনতে হবে।”

“না, শুনব না।” ম্যাডাম মুখটা একটু শক্ত করে বললেন, “তার চাইতে আমি কী বলি তোমরা সেটা শুনো।”

শেষ পর্যন্ত ছেলেমেয়েরা শান্ত হল। ম্যাডাম তখন সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমি তোমাদের স্কুলে নতুন এসেছি। আমি বিজ্ঞানের শিক্ষক, কোনো একটা ক্লাশে আমার বিজ্ঞান পড়ানোর কথা। আমাকে উঁচু ক্লাশে দিতে চেয়েছিল আমি রাজি হইনি।”

মিম্মি জিজ্ঞেস করল, “কেন রাজি হননি ম্যাডাম?”

“তা হলে সিরিয়াসলি পড়াতে হবে। আমার সিরিয়াসলি পড়াতে ভালো লাগে।”

সবাই আবার আনন্দের শব্দ করল। ম্যাডাম অবাক হয়ে বললেন, “তোমরা এরকম চিৎকার করছ কেন?”

মাসুক বলল, “আনন্দে।

 “কীসের আনন্দে?”

“আপনি পড়াবেন না, সেই আনন্দে।”

“আমি মোটেও বলিনি তোমাদের পড়াব না।”

সঞ্জয় দাঁত বের করে হেসে বলল, “বলেছেন ম্যাডাম। বলেছেন।”

“আমি বলেছি আমার সিরিয়াসলি পড়াতে ভালো লাগে না।”

“একই কথা ম্যাডাম!”

“না। মোটেও একই কথা না। আমি তোমাদের পড়াব, তবে অন্যরকমভাবে পড়াব।”

রূপা জিজ্ঞেস করল, “কীভাবে পড়াবেন?”

“একটু অন্যরকমভাবে। যখন শুরু করব তখন দেখবে। এখন একটা অন্য কাজ করা যাক।”

“কী কাজ ম্যাডাম?”

“এই যে ক্লাশ রুম, এটা খুবই বোরিং। ক্লাশ রুমটা একটু অন্যরকম করে ফেলি!”

সবাই আবার আনন্দের শব্দ করল। মিম্মি জিজ্ঞেস করল, “অন্য কী রকম?”

ম্যাডাম ক্লাশের চারদিকে তাকালেন, তারপর মনে মনে কী একটা হিসাব করলেন তারপর বললেন, “বেঞ্চগুলো ঠেলে দেয়ালের সাথে লাগিয়ে দিই। তা হলে মাঝখানে ফাঁকা জায়গা হবে। সেখানে দাঁড়িয়ে সবার সাথে কথা বলা যাবে!”

সঞ্জয় দাঁত বের করে হাসল, বলল, “কী মজা হবে।”

ম্যাডাম বলল, “চল তা হলে করে ফেলা যাক!”

“চলেন ম্যাডাম।” বলে সবাই উঠে দাঁড়িয়ে বেঞ্চগুলো ঠেলে ঠেলে চারপাশে দেয়ালের সাথে লাগিয়ে দিল। কিছুক্ষণের মাঝেই ক্লাশরুমটাকে সম্পূর্ণ অন্যরকম লাগতে থাকে, ফাঁকা এবং ভোলামেলা! ম্যাডাম চারদিকে তাকালেন, খুশি হয়ে মাথা নাড়লেন, তারপর বললেন, “ক্লাশ শেষ হবার পর আবার আগের মতো করে দিতে হবে কিন্তু!”

মাসুক বলল, “করে দেব ম্যাডাম। কোনো চিন্তা করবেন না।” মাসুক ক্লাশ ক্যাপ্টেন কাজেই তার কথাবার্তা অন্যরকম।

ক্লাশে সবাই গোল হয়ে ঘিরে বসে আছে, ম্যাডাম মাঝখানে। ঘুরে ঘুরে কথা বললেন, তাই ক্লাশটাকে মোটেও ক্লাশরুমের মতো মনে হয় না। ম্যাডাম বললেন, “সারা পৃথিবীতে খুব ভয়ংকর একটা ব্যাপার ঘটেছে। সেটা কী, কে বলতে পারবে?”

লিজা বলল, “এইডস ম্যাডাম।”

“হ্যাঁ। সেটা যথেষ্ট ভয়ংকর–আমি অবশ্য এইডসের কথা বলছিলাম না। আমি আরো সাধারণ বিষয়ের কথা বলছিলাম-লেখাপড়া সংক্রান্ত”

সবাই মাথা চুলকাতে থাকে তখন ম্যাডাম নিজেই বললেন, “সারা পৃথিবীতে বিজ্ঞান পড়ায় ছাত্র-ছাত্রীরদের আগ্রহ কমে গেছে। আমাদের দেশেও কমেছে। বড় বড় দেশে অনেক রকম সুযোগ-সুবিধা। তারা গরিব দেশের মেধাবী বিজ্ঞানের ছাত্রদের টাকা-পয়সার লোভ দেখিয়ে নিজেদের দেশে নিয়ে আসবে। অবস্থার সামাল দিয়ে দেবে। আমরা কী করব?”

সঞ্জয় বলল, “আমাদের দেশের কাউকে বিদেশ যেতে দেব না। দড়ি দিয়ে পা বেঁধে রাখব।” কথা শেষ করে সে আনন্দে দাঁত বের করে হি হি করে হাসল।

ম্যাডাম হাসলেন, বললেন, “সেটা একটা সমাধান হতে পারে। সেটা করার জন্যে তোমাকে দড়ি নিয়ে স্কুলে স্কুলে, কলেজে কলেজে আর ইউনিভার্সিটিতে ইউনিভার্সিটিতে ঘুরে বেড়াতে হবে।”

সবাই হি হি করে হেসে উঠল। ম্যাডাম বললেন, “তার চেয়ে সহজ সমাধান হবে অনেক বেশি ছেলেমেয়েদেরকে বিজ্ঞান পড়ানোতে আগ্রহী করা। সেটা কীভাবে করা যাবে?”

লিজা বলল, “বাধ্যতামূলক করে দিতে হবে।”

“উঁহু। জোর করে লেখাপড়া করানো যায় না।”

মিম্মি বলল, “যারা বিজ্ঞান পড়বে তাদের সবাইকে একটা করে মোবাইল ফোন দিলেই সবাই চলে আসবে!”

ম্যাডাম হাসলেন, বললেন, “না। লোভ দেখিয়েও লেখাপড়া করানো যায় না।”

রূপা বলল, “সবাইকে সায়েন্স ফিকশন পড়ালে-”

ম্যাডাম একটু ইতস্তত করে বললেন, “সায়েন্স ফিকশন তো আসলে ফিকশান-মানে গল্প! সেটা পড়লে কতটুকু লাভ হবে বুঝতে পারছি না। তবে সায়েন্স বা বিজ্ঞানের আগ্রহ যদি ছোট থাকতে ঢুকিয়ে দেওয়া যায় তা হলে বড় হলে তারা মনে হয় সায়েন্স নিয়ে পড়বে। আমি সেই মিশন নিয়ে এসেছি।”

সঞ্জয় বলল, “গুড মিশন!”

ম্যাডাম বললেন, “থ্যাংকু!”

রূপা জিজ্ঞেস করল, “বিজ্ঞানের আগ্রহ তৈরি করার জন্যে কী করবেন ম্যাডাম?”

“ক্লাশের সবাইকে নিয়ে অনেকগুলো বিজ্ঞানের প্রজেক্ট করব। মজার মজার প্রজেক্ট। আমার ধারণা নিজের হাত দিয়ে যখন সবাই মজার মজার বিজ্ঞানের প্রজেক্ট তৈরি করবে তখন অনেকেই বিজ্ঞান নিয়ে পড়বে।”

“আমাদের কী কী প্রজেক্ট হবে ম্যাডাম?

“অনেক প্রজেক্ট। মনে করো আমরা টেলিস্কোপ তৈরি করতে পারি, মাইক্রোস্কোপ তৈরি করতে পারি, সোলার কার তৈরি করতে পারি, রোবট তৈরি করতে পারি, রকেট তৈরি করতে পারি, আরো কত কী!–”

মাসুক লাফ দিয়ে উঠে বলল, “আমি রোবট বানাতে চাই ম্যাডাম!”

ম্যাডাম হাসলেন, বললেন, “ভেরি গুড! তবে একজন তো পারবে না, তাই কয়েকজন মিলে একটা গ্রুপ তৈরি করতে হবে। ক্লাশটাকে অনেকগুলো গ্রুপে ভাগ করে দিই।”

রূপা জানতে চাইল, “এক গ্রুপে কতজন থাকবে?”

“চার থেকে পাঁচজন।”

“কারা কারা থাকবে গ্রুপে?”

“নিজেরা ঠিক করে নাও।”

সবার আগে লিজা দাঁড়িয়ে বলল, “আমার গ্রুপে থাকব আমি, তাহিরা, মৌমিতা, টুশকি আর বীথি।”

ম্যাডাম মাথা নাড়লেন, “উঁহু। শুধু মেয়েরা মেয়েরা গ্রুপ তৈরি করা যাবে না। মিলেমিশে করতে হবে। গ্রুপে ছেলেমেয়ে থাকবে। হিন্দু-মুসলমান থাকবে। চিকন-মোটা থাকবে। লম্বা-খাটো থাকবে। শান্ত-রাগী থাকবে। দুষ্টু-মিষ্টি থাকবে!”

ম্যাডামের কথার ভঙ্গি দেখে সবাই হেসে ফেলল। তারপর সবাই নিজেরা নিজেরা কথা বলে গ্রুপ তৈরি করল। রূপা রাজুর সাথে কথা বলে একটা গ্রুপ তৈরি করল, সেই গ্রুপের মাঝে থাকল রূপা, রাজু, সঞ্জয়, মিম্মি আর সোহেল। আজকে ক্লাশে সোহেল নাই কিন্তু তাতে ম্যাডাম আপত্তি করলেন না। প্রত্যেকটা গ্রুপের একটা নাম দিতে হবে–ম্যাডাম সবাইকে পরের দিন নিজের গ্রুপের জন্যে একটা সুন্দর নাম ঠিক করে আনতে বললেন।

দেখা গেল গ্রুপের নাম ঠিক করা এত সহজ না। নাম ঠিক করতে গিয়ে লিজাদের গ্রুপ নিজেদের মাঝে ঝগড়া করে টুকরো টুকরো হয়ে গেল, মাসুকের গ্রুপের মাঝে মারামারি হয়ে গেল। রূপাদের কম সমস্যা হল না, সঞ্জয় বলল নামটা হতে হবে মজার। মজার নাম হিসেবে সে ঠিক করল টুং টিং টাং! মিম্মি বলল যেহেতু এটা বিজ্ঞান সংক্রান্ত তাই নামের মাঝে একটা বিজ্ঞান বিজ্ঞান ভাব। থাকা দরকার, সে নাম দিল মিমিট্রন।

মিমিন্টুন নাম শুনে সঞ্জয় তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল। চিৎকার করে বলল,

“মিমিট্রন? নিজের নাম দিয়ে গ্রুপের নাম? তা হলে সঞ্জয়ট্রন না কেন?”

মিম্মি বলল, “আমি মোটেও নিজের নাম দিয়ে নাম দেইনি। আমার নাম মিমি না আমার নাম হচ্ছে মিম্মি! এখানে মি এসেছে মিল্কিওয়ে থেকে।”

রূপা বলল, “তা হলে নাম রেখে দিই মিল্কিওয়ে!”

মিম্মি বলল, “উঁহু। মিল্কিওয়ে শব্দের মাঝে দুধ দুধ ভাব। মনে হবে আমরা গরুর ফার্ম।”

“তা হলে বাংলায় ছায়াপথ। ছায়াপথ অনেক সুন্দর নাম।”

মিম্মি ঘ্যান ঘ্যান করতে লাগল, “কেন? তোদের মিমিট্রন নামে আপত্তি কী? কী সুন্দর বৈজ্ঞানিক একটা নাম, মি-মি-ট্র-ন!”

রূপা, মিম্মি আর সঞ্জয় যখন নিজেদের মাঝে ঝগড়াঝাটি করছে তখন রাজু তার খাতায় কী কী যেন লিখছিল। রূপা একসময় ঝগড়ায় একটু বিরতি দিয়ে রাজুকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কী করছ?”

“আমাদের টিমের নাম বের করার চেষ্টা করছি।”

মিম্মি জিজ্ঞেস করল, “কী বের করেছ?”

“একটা কাজ করলে কেমন হয়? আমাদের পাঁচজনের নামের প্রথম অক্ষর দিয়ে একটা নাম তৈরি করি।”

সঞ্জয় বলল, সঞ্জয়ের স, রাজুর রা, রূপার রূ, মিম্মির মি আর সোহলের সো, তা হলে হয় সরারমিসো–কেমন হল এটা?” জাপানি জাপানি শোনা যায়!”

রাজু বলল, “পাঁচজনের পাঁচটা অক্ষর, সব মিলিয়ে মনে হয় ফ্যাক্টরিয়াল পাঁচভাবে সাজানো যাবে। ফ্যাক্টরিয়াল পাঁচ হচ্ছে একশ বিশ। কাজেই একশ বিশটা থেকে একটা বেছে নেওয়া যায়।”

মিম্মি মাথায় হাত দিয়ে বলল, “এখন বসে বসে একশ বিশটা নাম লিখতে হবে?”

রাজু বলল, “উঁহু, আমি এর মাঝে একটা বের করেছি। রূমিসোরাস।”

“রামিসোরাস?”

“হ্যাঁ। এই নামের মাঝে একটা ডাইনোসর ডাইনোসর ভাব আছে। ডাইনোসরের নামের পিছনে সোরাস থাকে দেখিসনি? টাইরানোসোরাস, স্টেগোসোরাস, ব্রন্টোসোরাস-”

মিম্মি আবার বলল, “রূ-মি-সো-রা-স? তার মানে রূপার নামটা আগে?”

“সমস্যা কী? কোনো একজনের নাম তো প্রথমে থাকতে হবে।”

“তা হলে মিরূসোরাস না কেন?”

রূপা বলল, “ঠিক আছে, ঠিক আছে মিম্মির নামটাই আগে থাকুক। মিরূসোরাস।”

মিম্মি বলল, “আমি মোটেও আমার নামটা আগে দিতে চাচ্ছি না। মিরূসোরাস শুনতে ভালো শোনায় সেই জন্যে বলছি।”

সঞ্জয় বলল, “রামিসোরাস আর মিরূসোরাসের মাঝে কোনো পার্থক্য নাই। তুই নিজের নামটা আগে দেওয়ার জন্যে মিরূসোরাস করতে চাচ্ছিস।”

মিম্মি মুখ শক্ত করে বলল, “মোটেও না।”

সঞ্জয় বলল, “অবশ্য অবশ্য অবশ্যই।”

“না, না, না!”

আরেকটু হলে দুজনে মারামারি শুরু করে দিত, রূপা তখন ধমক দিয়ে সঞ্জয়কে থামাল, “আমি যদি আপত্তি না করি তা হলে তুই ঘ্যান ঘ্যান করছিস কেন?”

“আমি মোটেও ঘ্যান ঘ্যান করছি না। আমি যুক্তি দিয়ে কথা বলছি।”

“থাক, থাক। এত যুক্তির দরকার নাই।”

রাজু বলল, “ব্যস অনেক আলাপ-আলোচনা হয়েছে। এখন সবাই থাম। তা হলে আমাদের টিমের নাম হচ্ছে টিম মিরূসোরাস।”

রূপা বলল, “হ্যাঁ। টিম মিরূসোরাস।”

অন্যেরা মাথা নাড়ল।

.

পরের বিজ্ঞান ক্লাশে বিজ্ঞান ম্যাডাম আবার ক্লাশে বেঞ্চগুলো দেয়ালের কাছে সরিয়ে মাঝখানে জায়গা করে নিলেন। তারপর সবগুলো গ্রুপের নাম লিখে নিলেন। শুধু একটা গ্রুপের নাম বদলাতে হল–তারা নাম রেখেছিল টিম ধুরন্ধর, বিজ্ঞান ম্যাডাম সেটাকে বদলে করে দিল টিম সহজ-সরল। ধুরন্ধর কোনো টিমের নাম হতে পারে না। রূপাদের টিমের নামটা শুনে প্রথমে সবাই অবাক হল, যখন সেটা কীভাবে তৈরি হয়েছে বুঝতে পারল তখন সবাই মাথা নাড়তে লাগল, কেন তাদের মাথায় এই আইডিয়াটা আগে আসেনি সেটা নিয়েও কেউ কেউ আফসোস করল।

বিজ্ঞান ম্যাডাম তারপর কিছুক্ষণ কথা বললেন, তারপর সবাইকে জিজ্ঞেস করলেন কে কী নিয়ে কাজ করতে চায়। মাসুক তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে বলল

সে রোবট বানাতে চায়।

ম্যাডাম বললেন, “তোমার গ্রুপের অন্যেরা কী বলে?”

মাসুক বলল, “তারাও চায় ম্যাডাম।”

“তাদের মুখ থেকেই শুনি।

তখন তাদের গ্রুপের অন্যেরা উঠে দাঁড়াল। ম্যাডাম জিজ্ঞেস করল, “তোমরাও কী রোবট তৈরি করতে চাও?”

একজন মাথা চুলকে বলল, “ইয়ে মানে, আমরা তো জানি না কেমন করে তৈরি করতে হয়।”

ম্যাডাম কিছু বলার আগেই মাসুক বলল, “আমরা শিখে নেব ম্যাডাম।”

“ঠিক আছে। ঠিক আছে!” ম্যাডাম একটু হাসলেন, “আমি হলে একটা কাজ করি। অনেকগুলো প্রজেক্ট নিয়ে তোমাদের সাথে কথা বলি। তারপর তোমরা নিজেরা নিজেরা ঠিক করো কে কোনটা করতে চাও!”

সবাই রাজি হল। ম্যাডাম তখন কথা বলতে শুরু করলেন। কোনটা কীভাবে তৈরি করা যায় সেটা নিয়ে আলোচনা করলেন, কোনটা সোজা কোনটা কঠিন, কোনটা তৈরি করতে কী লাগবে সেগুলো বোঝালেন। সঞ্জয় রূপার পাশে বসেছিল, ম্যাডাম যেই প্রজেক্টের কথা বলে সে সেটাই শুনে মাথা নেড়ে বলল, “এইটাই আমাদের তৈরি করতে হবে! এইটা হচ্ছে ফার্স্ট ক্লাশ! এইটা হচ্ছে এক নম্বরী।”

ক্লাশের শেষে ম্যাডাম বললেন, “তোমরা গ্রুপের ছেলেমেয়েরা স্কুলের পরেও নিজেরা তোমাদের প্রজেক্ট নিয়ে আলোচনা করো। বাসা কাছাকাছি থাকলে ছুটির দিনেও তোমরা কাজ করতে পার।”

রূপা তখন তার হাতে কিল দিয়ে মনে মনে বলল, “ইয়েস!” এখন তার সুযোগ হয়েছে স্কুল ছুটির পরে কিংবা ছুটির দিনে রাজুর সাথে পরামর্শ করা। সোহেল যেহেতু তাদের গ্রুপের একজন তার বাসাতে যেতেও এখন কোনো সমস্যা নেই। এক ঢিলে অনেকগুলো পাখি মারা গেল।

.

কাজটা অবশ্যি খুব সহজ হল না। রাতেরবেলা খেতে বসে রূপা প্রথমে কথাটা বলল। শুনে আম্মু ঝঙ্কার দিয়ে বললেন, “এইটা কোন ধরনের ঢং? বই পড়বে, বই মুখস্থ করবে তার বদলে প্রজেক্ট? প্রজেক্ট আবার কী?”

রূপা মুখ গম্ভীর করে বিজ্ঞান ম্যাডামের কাছে শোনা কথাগুলো বলার চেষ্টা করল, “আম্মু, আজকাল সারা পৃথিবীতেই লেখাপড়াটা অন্যরকম হয়ে গেছে। এখন আর কেউ কোনো কিছু মুখস্থ করে না। আগে স্যার-ম্যাডামরা পড়াত ছাত্র ছাত্রীরা শুনত। এখন ক্লাশে ছাত্র-ছাত্রীরাও কথা বলে-”,

আম্মু চোখ পাকিয়ে বললেন, “ক্লাশে ছাত্র-ছাত্রীরা কথা বলে? কী কথা বলে?”

“যেটা পড়ানো হয় সেটা নিয়ে আলোচনা করে। প্রশ্ন করে।”

“ক্লাশে আলোচনা করে? প্রশ্ন করে? বেয়াদবের মতো?”

“বেয়াদবী কেন হবে? ছাত্র-ছাত্রীদের নিজেদের কথা বলতে বলে।”

আম্মু টেবিলে থাবা দিয়ে বললেন, “হতেই পারে না। লেখাপড়া হতে হবে লেখাপড়ার মতোন। আমরা স্কুলে বেতন দেই রং-তামাশা করার জন্যে?

তখন তিয়াশা বলল, “আম্মু লেখাপড়ার স্টাইল বদলে যাচ্ছে। আগে স্কুল ছিল ভয়ের জায়গা-এখন হবে আনন্দের জায়গা–”

আম্মু রূপাকে দুই চোখে দেখতে পারেন না। তার ভালো কথাটিও শুনতে চান না, কিন্তু তিয়াশা হচ্ছে আম্মুর প্রিয় মানুষ। তিয়াশার কথাকে আম্মু একটু হলেও গুরুত্ব দেন, তাই আম্মু তিয়াশার কথাটা শুনলেন তারপর গজগজ করতে লাগলেন, “এইটা কী হল? স্কুলে ছেলেমেয়ে পাঠাই যেন তারা লেখাপড়া শিখে আসবে, আদব-কায়দা শিখে আসবে–এখন দেখছি স্কুল হয়ে যাচ্ছে রং-তামাশার জায়গা, ঢংয়ের জায়গা।”

রূপা আবার চেষ্টা করল, “আসলে ছাত্র-ছাত্রীদের উৎসাহ দিলে তারা নিজেরা শেখে–”

আম্মু মুখ খিঁচিয়ে বললেন, “কোনোদিন শেখে না। শেখাতে হয় পিটিয়ে। বেত দিয়ে পিটিয়ে ছাল তুলে দিতে হয়। আমরা যখন স্কুলে পড়েছি তখন আমাদের এক স্যার ছিলেন এক চড়ে আমাদের ফার্স্ট গার্লের কানের পর্দা ফাটিয়ে দিয়েছিলেন। স্যারের কী তেজ ছিল, সিংহের মতোন।” সিংহের তেজওয়ালা স্যারের কথা চিন্তা করে এতোদিন পরেও আম্মুর চোখ-মুখ শ্রদ্ধায়-ভক্তিতে চকচক করতে থাকে।

রূপার ইচ্ছে হল বলতে, এখন এরকম হলে সিংহের তেজওয়ালা স্যারকে পুলিশে ধরে নিয়ে হাজতে আটকে ফেলবে। কিন্তু তার বলার সাহস হল না। রূপার প্রজেক্ট নিয়ে আরো আলোচনা হল আর শেষ পর্যন্ত আম্মু মেনে নিলেন। ঠিক হল মাঝে মাঝে প্রজেক্ট নিয়ে আলোচনা করার জন্যে তার বন্ধু-বান্ধবরা ছুটির পর কিংবা ছুটির দিনে আসতে পারবে। সে নিজেও যেতে পারবে, কিন্তু কবে কোথায় কখন কতক্ষণের জন্যে যাবে সেটা আগে থেকে বলে যেতে হবে। আর এই ধরনের কাজ-কর্মের জন্যে যদি লেখাপড়ায় ক্ষতি হয় কিংবা অন্য কোনোরকম সমস্যা হয় তা হলে তার ফল হবে ভয়ানক।

“অন্য কোনোরকম সমস্যা” বিষয়টা কী সেটা আম্মু পরিষ্কার করলেন না কিন্তু তার চোখ-মুখ দেখেই রূপা আন্দাজ করে নিল সেটা কী হতে পারে। রূপা অবশ্যি এই হুমকিতে মোটেও ভয় পেল না, প্রথমবার বাসা থেকে স্বাধীনভাবে বন্ধু-বান্ধবের বাসায় যেতে পারবে সেটা চিন্তা করেই আনন্দে তার নাচানাচি করার ইচ্ছা করছিল।

কিন্তু সে তার আনন্দটা মোটেও কাউকে বুঝতে দিল না, গম্ভীর মুখে খেতে লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *