০১-৪. ফোনটা বাজছিল

হলুদ বসন্ত – উপন্যাস –বুদ্ধদেব গুহ

.

“সুখ নেইকো মনে
নাকছাবিটি হারিয়ে গেছে
হলুদ বনে বনে।”

.

যদিও তুমি আমাকে অনুক্ষণ মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছ, আমি তোমাকে অমৃত করে দিলাম। আমার মনের হিজলের শাখা থেকে মুক্ত করে আমার একান্ত পাখিকে আমি চিরকালের, আকাশের করে দিলাম।

.

০১.

ফোনটা বাজছিল।

অন্য প্রান্তে ফোনটা কুরর্‌–কুর্‌ কুরর্‌—কুর্ করে কোনও মেঘলা দুপুরের কামাতুরা কবুতরের কথার মতো বাজছিল। শুনতে পাচ্ছিলাম। এখন রাত প্রায় সাড়ে ন’টা। টেলিফোনটা ওদের বাড়ির সিঁড়িব কাছে আছে। এখন বাড়িতে কে কে থাকতে পারে? সুজয় নিশ্চয়ই আড্ডা মারতে বেরিয়েছে। কদিন বাদে দোল। পাড়ায় দোল-পূর্ণিমার ফাংশন হবে। তাই নিয়ে পাড়ার রুস্তমরা ব্যস্ত। ফাংশন না কচু। ইলিশ মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে রেলিশ করে কিছু মেয়ে দেখা। রুস্তমদের রং ফিকে হয় না। বুকের নোম পেকে গেলেও না। বেশ আছে ওরা। টেরিলিন-টেরিকটে মোড়া বৃদ্ধ বালখিল্যের দল। নয়নার মা নিশ্চয়ই ঠাকুরঘরে চুপ করে বসে আছেন। এমন ভাব, যেন পৃথিবীর যাবতীয় ঘটনা-দুর্ঘটনা সব ওই ঠাকুরঘরের কন্ট্রোলরুম থেকেই রেডিয়ো কন্ট্রোলে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে।

ফোনটা বাজছেই—বাজছেই–বাজছেই।

নয়না এখন কী করছে? বোধহয় ঘুমুচ্ছে। সারাদিন পরিশ্রম তত কম নয়। নয়নার কথা ভাবলে আশ্চর্য লাগে। ওর সমবয়সি মেয়েদের পটভূমিতে ও বর্ষার জল-পাওয়া মৌরলা মাছের মতো লাফায়, অথচ ও আমার কাছে এলে শীতের সংকোশ নদীর ঘরেয়া মাছের মতো ধীরা হয়ে থাকে। আস্তে মাথা দোলায়, আলতো করে চোখ তুলে চায়, মুখে যত না বলে, চোখ দিয়ে তার চেয়ে বেশি কথা বলে। ওকে বুঝতে পারি না–ওকে একটুও বুঝতে পারি না। অথচ ওকে কী করে বোঝাই যে ওর এক চিলতে হাসি, ওর এক ঝিলিক চোখ চাওয়া–এইসব সামান্য সামান্য দান আমার সমস্ত সকাল, আমার সমস্ত দিন কী অসামান্য মহিমায় মহিমামণ্ডিত করে তোলে। গত পাঁচ বছর ধরে কখনও এ কথাটা ওকে বোঝাতে পারিনি কিংবা ও বুঝলেও, না বোঝার ভান করে থেকেছে।

হ্যালো।–ওপার থেকে নয়নার মা’র গলা শোনা গেল। গম্ভীর, ঠান্ডা, নিরুৎসাহব্যঞ্জক গলা। অথচ ভদ্রমহিলা আমাকে যথেষ্ট স্নেহ করেন। বন্ধুর মা তো বটেই। আমি ফোন করলেই শুধোন, ওঁদের বাড়ি কেন যাই না–কাকিমার আর্থারাইটিস কেমন আছে? মিনুর বাচ্চাটা (২ নং) ভাল আছে কি না ইত্যাদি, ইত্যাদি। অথচ তবু, আমার ইচ্ছে করে না ওঁর সঙ্গে কথা বলতে। বোধহয় মনে পাপ আছে বলে। আচ্ছা, ভালবাসা কি পাপ? জানি না। বোধহয় অন্যায়ভাবে, জোর করে ভালবাসাটা পাপ। নইলে এমন ভীরুতা, চোর চোর ভাব, অন্যায় বোধ আসে কেন?

আবার শুনলাম, হ্যালো! হ্যালো! হ্যালো!

কোনও উত্তর দিলাম না। কেন দেব? আমি তো ওঁর সঙ্গে কথা বলতে চাইনি। অফিস থেকে ফিরে, পায়জামা-পাঞ্জাবি চাপিয়ে আরাম করে সোফাটায় আসনপিড়ি হয়ে বসে পাখাটাকে আস্তে খুলে দিয়ে আমি নয়নার সঙ্গে কথা বলব বলেই ফোন ডায়াল করেছিলাম। আমি তো অন্য কাউকে চাইনি। আমি তো অন্য কাউকে চাই না।

ভাবলাম, রিসিভার নামিয়ে রেখে দিই। কিন্তু হঠাৎ দেহাভ্যন্তরীণ কোনও যান্ত্রিক গোলযোগে অনিচ্ছায় মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, হ্যালো। আমি ঋজু।

কী ব্যাপার? লজ্জায় মরে গেলাম। ইস। তবে কি ওঁর কাছেও ধরা পড়ে গেলাম? বললাম, কোনও ব্যাপার নেই। মানে, নয়না আছে? গতকাল আপনাদের ওখানে গিয়েছিলাম–বসবার ঘরে আমার দেরাজের চাবিটা বোধহয় ফেলে এসেছি। পাচ্ছি না।

মাসিমা আবার শুধোলেন, তোমার গাড়ির চাবি ফেলে গেছ?

আমি বললাম, না। দেরাজের চাবি। (গাড়ির চাবি ফেলে এলে আর গাড়ি চালিয়ে বাড়ি এলাম কী করে? যাচ্ছেতাই। কানে আজকাল কম শুনছেন।)

কোথায় ফেলেছ মনে আছে বাবা?

আমি বললাম, নয়নাকে একবার জিজ্ঞেস করুন না? কাল ও কাছে ছিল, গল্প করছিল।

দাঁড়াও। ফোনটা ধরো একটু।

শুনতে পেলাম, সিঁড়ির তলায় দাঁড়িয়ে মাসিমা নয়নাকে ডাকলেন। গমগম করে উঠল। যেমন গমগমে গলায় আমার মাথার মধ্যে নয়নার নাম শুনি আমি কোনও অসহ্য একলা গরম দুপুরে।

কিছুক্ষণ চুপচাপ। রাস্তা দিয়ে একটা গাড়ি যাওয়ার আওয়াজ শুনলাম। রিসিভারের জালে ডাবল হর্নটা ঝমঝমিয়ে বেজে উঠল। একটু পরে নয়না এসে ফোন ধরল।

কী হল? হলটা কী?

আমার চাবি।

আপনার চাবি?

হ্যাঁ! আমার চাবিটা, দেরাজের চাবিটা: তোমাদের বাড়ি কাল ফেলে এসেছি। পাচ্ছেন না?

না।

জ্বালালেন। দাঁড়ান দেখি।

কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে বলল, সব তো দেখলাম, সোফার কোনা, মেঝে; এমনকী রাস্তায় যেখানে আপনার গাড়ি ছিল সেখানে অবধি। যদি গাড়িতে উঠবার সময় পড়ে গিয়ে থাকে, তাই ভেবে। কিন্তু নেই। পেলাম না।

নেই?

না। বললাম তো পেলাম না।

পাবে না।

মানে?

মানে আমার চাবি আমার সামনেই আছে। হারায়নি। বলেই টুং টুং করে চাবিটা রিসিভারের সঙ্গে বাজালাম।

ইস। কী খারাপ আপনি–ভারী অসভ্য। কেন অমন করলেন?

তোমার মা কেন ফোন ধরলেন?

মা কি যম?

আমার যম। আমার ভীষণ ভয় করে তোমার মাকে।

আমার মা’র মতো লোকই হয় না।

তারপর একটু খুশি খুশি গলায় বলল, তারপর? আপনার কী খবর বলুন?

আমি বললাম, আমার আবার কী খবর? তোমার সঙ্গে একলা কথা বলতে একলা দেখা করতে ইচ্ছে করে। ভাল লাগে। তাই অফিস থেকে ফিরে তোমাকে ফোন করলাম। তুমি বিরক্ত হলে?

না, আপনার ফোন এলে আমার ভাল লাগে।

আমার চিঠি পেয়েছ? পরশু পোস্ট করেছিলাম।

হুঁ।

কেমন লাগল?

ভাল।

শুধু ভাল?

ভীষণ ভাল।

একটারও জবাব দাও না কেন?

মানে, সময় হয়ে ওঠে না, তা ছাড়া আপনার মতো ভাল চিঠি লিখতে পারি না। ‘কেমন আছেন? ভাল আছি। কলেজের প্রিন্সিপাল আজ এই বললেন এই রকম চিঠি লেখার তো কোনও মানে হয় না। যেদিন আপনার মতো করে লিখতে পারব, সেদিন লিখব।

অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলাম।

কী হল? কিছু বলুন।

তুমি আমাকে ভালবাসো না কেন?

বাসি না?

না।

খুব.বাসি। (বলে একটা নিশ্বাস ফেলল।)

আমি অনুক্ষণ, অনুক্ষণ তোমার কথা ভাবি, তোমার কথা ভাবি, আর তুমি আমাকে একটুও ভালবাসো না।

তারপর আবার চুপ। কোনও কথা নেই। হঠাৎ নয়না বলল, ভালবাসলে কী করতে হয়?

কী জবাব দেব জানি না। ইচ্ছে হল বলি, চুমু খেতে হয়, আষাঢ়ের প্রথম বৃষ্টির মতো বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়–অনিমেষ আশ্লেষে অন্যের মধ্যে আপ্লুত হতে হয়। কিন্তু ওসব কথা বলা যায় না। একবার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেলে আর ফেরানো যায় না। ঝড় একবার উঠলে নদীতে কত বড় বড় ঢেউ উঠবে তা আমি জানি না–সে ঢেউয়ে হাল ধরতে পারব কি না তাও জানি না। তবু খুব ইচ্ছে করল, বলি–যে কথা সব সময় বলতে চাই–ঘুমুবার সময় বলতে চাই, ঘুম ভেঙে বলতে চাই–কাজের ফাঁকে ফাঁকে বলতে চাই–সেই কথা বলবার জন্যে আমায় আমন্ত্রণ জানাল নয়না; অথচ আমি কিছুই বলতে পারলাম না। ভালবাসলে কী করতে হয় এই সরল সোজা প্রশ্নের উত্তরে বললাম, জানি না।

নয়না সঙ্গে সঙ্গে বলল, আমিও জানি না।

একটুক্ষণ চুপচাপ।

আমি বললাম, তুমি কী শাড়ি পরে আছ?

বাজে; বাড়ির শাড়ি।

তবু, বলো না!

হলুদের মধ্যে কালো কাজের একটি কটকি শাড়ি।

আর জামা?

উঃ, জ্বালালেন আপনি। হলুদ জামা।

দাঁড়াও, মনে মনে আমার চোখের আয়নায় দাঁড় করিয়ে তোমায় দেখে নিই। বাঃ, ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে তো। হুবহু একটি হলুদবসন্ত পাখি।

নামটা পছন্দ, কিন্তু আমি তো সুন্দর না।

তুমি সুন্দর না?

সবাই বলে।

সবাইর তো চোখ নেই। তোমার সৌন্দর্য সকলের জন্যে নয়।

থাক, বানিয়ে বানিয়ে বলতে হবে না। বাজে কথা রাখুন। টেনিস খেলতে গিয়ে পায়ে যে চোট লেগেছিল, এখন কেমন আছে?

কাল থেকে ভাল।

তবু, পুরোপুরি সারেনি তো?

না। এখনও একটু ব্যথা আছে।

কয়েকদিন না খেললে কী হয়? খেলোয়াড় যা, সে তো আমি জানি। যান তো অনেক সুন্দরী সুন্দরী মেয়ে দেখতে। তাই না?

সব মেয়েকে আমার দেখতে ইচ্ছে করে না। তার চেয়ে ঘোড়ফরাস দেখতে আমি বেশি ভালবাসি।

উপমাটাও ভদ্রজনোচিত দিতে পারেন না? আপনি সত্যিই একটি জংলি হয়ে যাচ্ছেন।

আমি তো জংলিই।

বাঃ। খুব বাহাদুরির কথা, না? বাহাদুরি নয়। আমি যা, আমি তাই। তোমাদের সংজ্ঞায় সভ্য হতে চাই, সবসময় চেষ্টা করি; পারি না, সত্যি সত্যি পারি না।

চেষ্টা করুন, চেষ্টা করতে থাকুন। কঠিন কাজ কি কেউ একবারে পারে? ওঃ শুনুন মনে পড়েছে। আপনার সেই লেখাটা আমার বান্ধবী সুমিতার খুব ভাল লেগেছে। আপনার সঙ্গে আলাপ করতে চেয়েছে।

জানোই তো আমি যার-তার সঙ্গে আলাপ করি না। কিন্তু লেখাটা তোমার কেমন লেগেছে বলোনি তো একবারও?

আমার? আমার মত দিয়ে কী হবে?

তুমি জানো না কী হবে?

না। জানি না।

তুমি নিজে একটি জংলি। পৃথিবীসুদ্ধ লোক হাই ফাঁই অ্যামপ্লিফায়ারে চিৎকার করে আমাকে ভাল বললেও আমার যতটুকু না আনন্দ হবে, তুমি একা যদি আমায় ভাল বলো—আন্তরিকভাবে–তাতে আমার অনেক বেশি আনন্দ হবে।

তাই হবে বুঝি?

জানো নয়না, ছোটবেলা থেকে জনারণ্যের মুখ চেয়ে বড় হইনি–আজও মাত্র একজন দু’জনের দাক্ষিণ্যে বেঁচে আছি–যা কিছু করার করছি–তাই তাদের মধ্যে কেউ যদি ফাঁকি দেয়, তখন অন্ধের মতো দিশেহারা হয়ে পড়ি পথ দেখতে পাই না। কী করব বুঝতে পারি না। বুঝলে?

বুঝলাম, কিন্তু আমি কোনও অন্ধের যষ্টি হতে রাজি নই।

তা আমার মতো করে আর কে জানে?

কিছুক্ষণ চুপ।

কী করছিলে? ঘুমুচ্ছিলে?

না স্যার। আপনার মতো সবসময় ঘুমুই না। সোমবার পরীক্ষা। পড়ছিলাম।

কী পরীক্ষা?

উইকলি পরীক্ষা।

তা হলে তো এতক্ষণ কথা বলে অনেক সময় নষ্ট করলাম।

না। এতটুকুতে আর কী ক্ষতি হবে?

বললাম, তবু যাও পড়ো গিয়ে লক্ষ্মী, সোনা মেয়ে।

নয়না বলল, আচ্ছা। ও এমনভাবে ফোন ছাড়ার আগে আচ্ছা বলে, মনে হয় সুন্দর সুগন্ধি কোনও ভালবাসার চিঠিতে সিলমোহর দিল। চুমু খাওয়ার মতো মিষ্টি করে বলল, আ–চ্ছা!

তুমি ছাড়ো ফোন।

না। আপনি আগে ছাড়ুন।

ফোন ছেড়ে দিলাম।

এই মুহূর্তে আমার এত ভাল লাগছে যে কী বলব! আমার কী যে ভাল লাগে; কী যে ভাল লাগে। নয়নার সঙ্গে এই যে একটু কথা বললাম, এর দাম জানি না। কেন এমন হয় তাও জানি না। কীই বা জানি? কতটুকু বা জানি? শুধু জানি যে শোবার সময় যখন ফুরফুর করে বসন্তের বাতাস মাধবীলতাটায় দোল দিয়ে আমার নেটের মশারিতে ঢেউ তুলে উত্তরের জানালা দিয়ে পথে বেরোবে তখন আমি রাজার মতো, মহারাজের মতো, বিড়লার সমান বড়লোকের মতো আরামে, আবেশে, নয়নার উজ্জ্বল চোখ দুটি ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ব। সেই আনন্দের বদলে আমি আর কিছুই চাই না। কিছুতেই তো বিনিময় করতে পারি না।

.

০২.

এই একটা দিন। রবিবার। সারা সপ্তাহ এর মুখ চেয়ে থাকা। সপ্তাহে ছ’দিন সকাল আটটা থেকে রাত সাতটা করি। ভাল লাগে না। মাঝে মাঝে গা জ্বালা করে। কিন্তু ওই যে পুরুষালি জেদ। ক’জন তোক আর শুধু পয়সার জন্যে খাটে? খাটে লোকে জেদের জন্যে। আমি পারি, ভাল করে পারি, এইটে প্রমাণ করার জন্যে। বিজিতেনবাবু একদিন বলেছিলেন; তখন আমি ছেলেমানুষ; সবে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে কারখানায় ঢুকেছি। বলেছিলেন, প্রফেশনাল ফার্মে গুডউইল নিজের নিজের তৈরি করে নিতে হয়–বাপ কাকার নামে চলে না। মামা বড় ইঞ্জিনিয়ার বলে লোকে আপসে ভাগনেকে বড় ইঞ্জিনিয়ার বলবে না। মানে, কটাক্ষ করে এমনভাবে কথাটা বলেছিলেন যে, মনে লেগেছিল। ভেবেছিলাম মামা বেচে খাব এই বা কেমন কথা? যে নিজের পরিচয়ে পরিচিত নয়, নিজের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত নয়, সে আবার পুরুষ কীসের? ব্যস। ওই জেদেই গেল। মাথার চুল পাতলা হল, চোখের কোনায় কালি জমল, চেয়ারে বসে বসে তলপেটে চর্বির আস্তরণ পড়তে লাগল। বিনিময়ে, বুকের কোনায় হয়তো কিছু আত্মবিশ্বাস জন্মাল।

সত্যি বলতে কী, এরকম সাফল্যে আত্মপ্রসাদ হয়তো আছে, কিন্তু আনন্দ নেই। বর্তমানটাকে পদদলিত করে নিজেকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করলাম বটে–কিন্তু কখনও কখনও–কাজের ফাঁকে ফাঁকে–টেলিফোনের রিসিভার কানে ধরে–কোনও কালোয়ারের সঙ্গে কথা বলতে বলতে হঠাৎ দূর দিগন্তে মনে মনে ছুটির ছবি দেখি কানে নিচু-গ্রামে ছুটির বাজনা বাজতে শুনি, তখনই মনটা কেঁদে ওঠে। ইচ্ছে করে গ্যাড়গিল এন্ড ঘোষ কোম্পানির মুখে লাথি মেরে, কাচের জানালা ভেঙে কোনও পাখি হয়ে উড়ে চলে যাই। কোনও সমুদ্র কিনারে। অনেকদিন আগে-যাওয়া গোপালপুরে। যেখানে আসন্ন সন্ধ্যার করুণ সুগন্ধি স্লানিমায়, সুনীল আকাশের পটভূমিতে শ্বেতা ফেনার বুদবুদ মেখে কেবলমাত্র নিজের আনন্দেই নিজে উড়ে বেড়াই। যেখানে আমার কোনও কর্তব্য নেই, আমার উপর কারও দাবি নেই। ইচ্ছে করে, নিজের মনের ইজেল বালুবেলায় সাজিয়ে অবসরের প্যাস্টেল কালারে, খুশির তুলিতে ছবির পর ছবি আঁকি।

রবিবারের Gun-club-এ একটা মেলা মেলা আবহাওয়া আছে। সারি দিয়ে সকলে বন্দুক দেখে নিচ্ছে। প্রথমে স্কিট-শুটিং, পরে ট্র্যাপ-শুটিং হবে। শুটিং-পজিশনে দাঁড়িয়ে উড়ন্ত ডিশকে গুঁড়িয়ে দেবার একটা আনন্দ আছে। মনে মনে অবচেতনে আমি যা পছন্দ করি না, আমি যা ঘেন্না করি, আমি যা সইতে পারি না–সেই সবকিছুকে আকাশ থেকে গুঁড়ো গুঁড়ো ধুলোর সঙ্গে পড়তে দেখি। ভারী আনন্দ লাগে।

সুগত হাই-হাউসের নীচে দাঁড়িয়ে ওর পাখিকে ডাকল। শট-গানটা ডান থাইয়ের উপরে বসিয়ে শক্ত করে ধরে ডাকল–পুল। অমনি হাই-হাউস থেকে মাটির ডিস্ক বেরিয়ে গেল মেশিনে– সাঁই করে। যাচ্ছে, যাচ্ছে, যাচ্ছে–মুহূর্তের মধ্যে দূরে চলে যাচ্ছে–দুম। আকাশে গুঁড়ো হয়ে গেল। নীল আকাশের পটভূমিতে একমুঠো কালো ধুলোর মেঘ ফুটে উঠে বৃষ্টি হয়ে নীচে পড়ল।

এবার লো-হাউসের পাখি আসবে। সুগত রেডি হয়ে বলল, পুল–নিচু দিয়ে এবার সামনে থেকে উড়ে এল, কাদার ডিস্ক–এল এল; এল–একেবারে সামনে দুম্‌। আবার গুঁড়িয়ে গেল।

এবার ডাবল। একসঙ্গে হাই এবং লো–দু’দিক থেকে দুটি পাখি উড়ে এল–দূরে-যাওয়া পাখিকে আগে মেরে, কাছে-আসা পাখিকে পরে মারতে হবে, তাই নিয়ম। দুম্‌ দুম্‌–আবার দুটি। পাখিরা গুঁড়ো হয়ে পড়ল।

বন্দুকের ইজেক্টরটা মাঝে মাঝে জ্যাম হয়ে যাচ্ছিল–ব্রিচটা খুলে দেখছি–এমন সময় যতি এসে ফিসফিস করে কানের কাছে বলল, ঋজুদা গাড়িটা দেখেছ? প্যাভিলিয়নের পাশে চেয়ে দেখো।

চেয়ে দেখলাম–একখানা গাড়ির মতো গাড়ি বটে–একটা চাপা রঙা জাগুয়ার স্পোর্টসকার প্যাভিলিয়নের পাশে দাঁড় করানো। ভাল করে দেখার আগেই সুগত ডাকল, এই ঋজু, কী হল? এসো।

আমি বললাম, আমার বন্দুকের ইজেক্টর খারাপ হয়ে গেছে।

ও ধমকে বলল, ঝামেলা কোরো না–এসো।

সুগতর অভিযোগ আছে যে কোনওদিনই আমি সিরিয়াসলি অনুশীলন করলাম না। কেন জানি না–প্রতিযোগিতায় আমি নামতে চাই না কারও সঙ্গে কোনও ব্যাপারেই। যে প্রতিযোগিতা পেটের জন্যে করতে হয়–তার কথা স্বতন্ত্র। সে প্রতিযোগিতায় না নেমে উপায় নেই। কিন্তু তা ছাড়া অন্য প্রতিযোগিতায় নামার শখ আমার নেই। এক প্রতিযোগিতাতেই আমি হাঁপিয়ে গেছি; ফুরিয়ে গেছি। বরং জীবনের অনেকানেক ক্ষেত্রে অনবধানে ঢুকে পড়ে রংরুটের মতো যেটুকু মজা লুটে নিতে পারি, সেটাই দৈনন্দিন প্রতিযোগিতার গ্লানি ঢেকে রাখার জন্যে প্রয়োজন আমার। আমি পারি না। প্রতিযোগিতাতে হেরে যাবার জন্যেই আমি জন্মেছিলাম।

তবু সুগত আমায় ভালবাসে; তাই বলে। ক’জনই বা ভালবাসে? এত বড় পৃথিবীতে ক’জনই বা কাকে কাছ থেকে চেনে, জানে, বোঝে? সেই মুষ্টিমেয়দের মধ্যে সুগত অন্যতম; আমার জঙ্গলের বন্ধু।

কোনওরকমে একটা ‘ডিটেল’ ছুঁড়ে দৌড়ে গিয়ে দাঁড়ালাম গাড়িটার পাশে। যতি আগেই গেছে। রঞ্জনও গুটি গুটি এল। গাড়ি একখানা।

এয়ার কন্ডিশনড তো বটেই–যেমন চেহারা তেমন গড়ন। টায়ারগুলো ইয়া মোটা, মোটা এক জোড়া সাইলেন্সর চকচক করছে–দরজাটা খুলে যেখানে খুশি ছেড়ে দিলে সেখানেই আটকে থাকে। ধরে থাকতে হয় না। রঞ্জন গাড়িটার গায়ে ঠোঁট লাগিয়ে চুঃ শব্দ করে একটা চুমু খেল। যতির চোখ দুটো জ্বলজ্বল করতে লাগল। গাড়িটার পেছনের কাচের এক কোণে এমব্যস করে নাম লেখা রয়েছে “লাভ ইন দ্য আফটারনুন”।

গাড়ির মালিককে আমরা চিনি। বেঁটেখাটো গর্বিত চেহারা। পাঞ্জাবি ভদ্রলোক। মিস্টার সিধু। অনেক ব্যাবসা-ট্যাবসা আছে। যতি ডাকত, বিধুমুখী। ভদ্রলোকের এরকম আরও গোটা পাঁচ-সাত গাড়ি আছে। এক একদিন এক একটা নিয়ে আসেন। আমরা আমাদের ঝরঝরে অ্যামবাসাডারে, এবং যতি, যতির আড়াই-পাক-ফলস্টিয়ারিংওয়ালা জিপে বসে, আড়চোখে গাড়িগুলোকে রোজ দেখি–আর ক্ষোভে হিংসায় পাটকাঠির মতো দাউদাউ করে জ্বলি। এক একটি গাড়ির দাম সোয়ালাখ; দেড় লাখ। স্টেট ট্রেডিং কর্পোরেশন থেকে কেনেন ভদ্রলোক।

হঠাৎ রঞ্জন বলল, যতি, তুই চিনে খেতে খুব ভালবাসিস, না?

এই প্রশ্নে যতি চমকে বলল, কেন? এর মানে কী হল?

রঞ্জন একটু ভেবে বলল, তোর জিপ যদি তুই ওই গাড়ির ঘাড়ে তুলে দিতে পারিস কখনও, তো তোকে তিন দিন চিনে খাওয়াব।

যতির চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠল। চিনে খাবার লোভে নয়, এতক্ষণে ব্যাপারটা বুঝেছে ও–আমিও বুঝেছি।

বললাম, আমিও তিন দিন চিনে খাওয়াব।

যতির চোখ দুটো আবার উজ্জ্বল হল। দপদপ করতে লাগল। বলল, গাড়িটার বাম্পার দেখেছ–কেমন নিচু–জিপকে একবার ঘাড়ে চড়াতে পারলে পেছনের কাঁচ এবং এয়ারকন্ডিশনার-টনার ভেঙে একেবারে সিটের উপর পৌঁছে যাব।

এই অবধি বলেই হঠাৎ মুষড়ে পড়ে বলল, কিন্তু তা হবার নয়–। এ গাড়ির যা স্পিড, এ তো ক্যাঙারুর মতো দৌড়োবে–এ গাড়িকে পেছন দিয়ে গিয়ে ধরা, জিপ গাড়ির কর্ম নয়–তবে সেন্ট্রাল অ্যাভিন্যুতে সামনাসামনি যদি কোনওদিন পাই তো “জয়, বজরঙ্গবলীকা জয়” বলে একেবারে মুখোমুখি লড়িয়ে দেব।

তারপর যো হোগা, সো হোগা।

আমি বললাম, সামনাসামনি মারলে তো সামনের সিটের লোকও মরে যেতে পারে।

যতি বলল, তা তো পারেই। তুমি বেশ কথা বলছ বটে। ছ’দিন চিনে খাব–আর তার বদলে এক-দু’জন লোক মরবে না? আমাদের জীবনের দাম কি এতই বেশি নাকি?

রঞ্জন ওকে নিরস্ত করার জন্যে বলল, দ্যাখ যতি, বেশি বাড়াবাড়ি করতে যাস না–সবটাতে তোর জ্ঞান দেওয়া স্বভাব হয়ে গেছে।

.

০৩.

কবে নয়নাকে প্রথম দেখেছিলাম ভাল করে মনে পড়ে না।

যা মনে পড়ে তা হচ্ছে একদিন গ্রীষ্ম গোধূলিতে সুজয়দের বাড়ি যাওয়া। সুজয়ের সঙ্গে তখন প্রথম আলাপ। কলেজে মাখামাখি হয়েছে, কিন্তু কখনও আমি ওদের বাড়ি যাইনি। সেই সময় আমাদের বাড়ি সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের কাছে হত বলে কলেজ-ফেরতা ও আমার সঙ্গে প্রায়ই আমাদের বাড়ি আসত। মানে, তখন কলেজে মাখামাখি হয়েছে, সাহিত্যালোচনা হয়েছে, জীবনে প্রথমে একসঙ্গে সিগারেট খেয়ে নিজেদের প্রাজ্ঞ মনে করা হয়েছে। এমনি সময় একদিন সুজয় ফোন করে বলল, আয়

না ঋজু, বাড়িতে আছি। আমাদের বাড়ি একদিনও তো এলি না।

বিকেলের মেহগিনি আলোয় একদিন ওদের বাড়িতে এসে পৌঁছোলাম। বাড়ির ভিতরে, লনের কোনায় গোয়ালা দুধ দোয়াচ্ছিল, তার পাশে একটি চোদ্দো-পনেরো বছরের ছিপছিপে সপ্রতিভ মেয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চুউক-চকচুউক-ঠাক আওয়াজ করে গোয়ালা কী করে দুধলি গোরুর গোলাপি বোঁটা থেকে দুধ নিংড়ে বের করছিল তাই দেখছিল।

শুধোলাম, সুজয় আছে?

মেয়েটি প্রথমে অবাক হল। গেটের পাশের দরোয়ানের শূন্য টুলের দিকে একবার তাকাল। তারপর সপ্রতিভ গলায় বলল, আপনি ঋজুদা?

হ্যাঁ। তুমি কে?

আমি নয়না। আপনার বন্ধু সুজয় আমার দাদা। এই অবধি বলেই বকনা বাছুরের মতো মাথা দুলিয়ে, দুই বিনুনি ছুঁড়ে আমায় পথ দেখিয়ে নিয়ে ও বসবার ঘরে বসাল। পরদা ঠেলে বসবার ঘরে ঢুকলাম। সোফায় বসলাম। সেদিন বুঝতে পারিনি, পরে এই ঘরটি, এই আদর, এই অতিথিপরায়ণ সহজ বাধাবন্ধহীন আত্মসম্মানজ্ঞানী মেয়েটির আকর্ষণ আমার কাছে এমনি দুর্বার হয়ে উঠবে।

সেই প্রথমদিনে, নয়নাকে বন্ধুর ছোট বোন হিসেবে, চটপটে কমনীয় একটি মেয়ে বলেই ভাল লেগেছিল। তার চেয়ে বেশি কিছু মনে হয়নি। অন্য কিছু ভাবিওনি। সেই নয়না আর আজকের নয়নায় কোনও মিল নেই। সব মেয়েরাই বোধহয় দ্বিজ। যৌবনে ওরা প্রত্যেকে নতুন করে জন্মায়।

তারপর একটি একটি করে বুড়ি বছরগুলি হাওয়ার সওয়ার হয়ে নিমগাছের পাতার মতো ঝরে গেছে। দুপুরের ক্লান্ত কাকের মতো কা-খ্‌বা–কা-খ্‌বাা করে প্রথম যৌবনের অস্বস্তিতে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছি। বেগুনি প্যাশান-ফ্লাওয়ারের মতো সুগন্ধি স্বপ্ন দেখেছি এবং একদিন এক জিয়াভরলি ভোরে আবিষ্কার করেছি যে,নয়না আর আমার কাছে শুধু সুজয়ের বোন মাত্র নয়। সে আমার অজানিতে আমার নয়ন-মণি হয়ে উঠেছে। ঠিক কোন সময় থেকে যে সে আমার মনে, অনবধানে, একটি কৃষ্ণসার হরিণীর মতো সুন্দরী, কাকাতুয়ার মতো নরম এবং মৌটুসি পাখির মতো সোহাগী হয়ে উঠেছে তা বুঝতে পারিনি। সেই ভোরে, হঠাৎ দরজা খুলেই মনের উঠোনে পত্রপল্লব বিস্তার করা রঙিন কৃষ্ণচূড়ার মতো তার মঞ্জরিত ব্যক্তিত্বকে অনুভব করে আমার সমস্ত সত্তায় শিরশিরানি লেগেছে।

সুগতকে মাঝে মাঝে বলতাম নয়নার কথা। ও আমার চোখের দিকে চেয়ে চুপ করে শুনত। ও নয়না কি সুজয় কাউকেই চিনত না। ওকে বেশি কিছু বলতে গেলেই ও আমার মুখ চেপে ধরত। বলত, পাগলা ছেলে, এসব কথা বলতে নেই–এসব যে একান্ত কথা। সোডার বোতলের ছিপি খুলে ফেললে সে যেমন সমস্ত ঝাঁজ, গন্ধ, আবেগ হারায়, সে যেমন নিঃশেষে বিড়বিড় করে ফুরিয়ে যায়–তুমিও তেমনি ফুরিয়ে যাবে। এসব কথা কাউকে বলতে নেই। কেবল নিজের মধ্যে দামি আতরের গন্ধের মতো, জঙ্গলে চাঁদনি রাতে হঠাৎ শোনা কোনও পাখির ডাকের ভাললাগার মতো নিজের একান্ত করে রাখতে হয়।

তারপর সুগত শুধোত, তুমি যে ভালবেসে ফেলেছ তা জানলে কী করে? ভালবাসা আর ভাল লাগায় তফাত জানো?

আমি অবোধের মতো মাথা নাড়তাম।

ও নিজেই উত্তর দিত। বলত, ভালবাসায় বড় দায়, বড় ঝুঁকি, বড় ব্যথা। ভালবাসার সমুদ্রে ভীষণ ঝড় ওঠে–সে ঝড়ে হারিয়ে যায় কত লোক। কূল খুঁজে পায় না। নৌকো ডুবে যায়। কিন্তু তবু, সোজা, সমস্ত জোরের সঙ্গে পঁাড় বেয়ে তাকে চলতে হয়; যে ভালবাসে সে কখনও ভয় পায় না ভালবাসার জন্যে সে নিজের সাধ্যাতীত অনেক কিছু করে ফেলতে পারে।

শুধোতাম, আর ভাললাগা?

ভাল লাগা কী জানো? দোতলার বারান্দায় বসে চা খেতে খেতে দেখলে পথ দিয়ে একটি ফুটফুটে মেয়ে শরৎ-সকালের শিউলির মতো হেঁটে যাচ্ছে। তুমি মনে,মনে বললে, বাঃ, বেশ তো!

ব্যস। ওই পর্যন্ত। সে যেই মোড় ঘুরল–ভিড়ে হারিয়ে গেল–তোমার ভাললাগাও ফুরিয়ে গেল। ভাল লাগলে মানুষ ভাললাগাকে তার ইচ্ছাধীন করে রাখতে পারে, কিন্তু ভালবাসলে মানুষ নিজেই ভালবাসার ইচ্ছাধীন হয়ে থাকে। তার নিজের কোনও নিজস্ব সত্তা থাকে না। ভালবাসা তাকে যা করতে বলে, পোষ পুষির মতো সে তাই করে।

সত্যি। সুগত যে কত কী জানে, কত কী ভাবে! কী সুন্দর গুছিয়ে কথা বলতে পারে। অথচ আমি কেবল পাগলামি করে বেড়াই। বুদ্ধি বলে কিছুই হল না এ পর্যন্ত। মস্তিষ্ক অসাড় করে সব কিছু জমেছে গিয়ে হৃদয়ে। নড়লে-চড়লে হৃদয়টাই শুধু ঝুমঝুমিয়ে বাজে।

শিশুর মতো বায়না ধরি, অথচ বৃদ্ধের মতো অপারগ হয়ে বসে থাকি। যাচ্ছেতাই। যাচ্ছেতাই। নিজেকে শিকারের যোধপুরি বুট পরে লাথি মারতে ইচ্ছা করে।

ঠিক কোন সময় থেকে নয়নাও আমার প্রতি কৌতূহলী চোখে চাইতে আরম্ভ করছিল তাও মনে নেই। তবে মনে হয়, প্রথম আমার চিঠি পেয়ে। চিঠি লিখতে কখনও আলস্য বোধ করিনি। এবং সে কারণে, যখনই যেখানে গেছি সেখান থেকে চিঠি লিখেছি চেনা পরিচিত অনেককে, তার মধ্যে নয়না ছিল অন্যতম। মনে হয় আমার চিঠির আয়নায় সে তার বুদ্ধিদীপ্ত মুখটিকে প্রথম আবিষ্কার করে। তারপর প্রতিটি চিঠি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওর আত্মবিশ্বাস বাড়ে, ও নিজেকে চিনতে পারে, নিজের প্রতি ওর মমত্ববোধ জাগে–এত বড় কলকাতা শহরের অগণ্য মেয়েদের। মধ্যে ও যে বিশিষ্টা–ও যে নিজের পরিচয়ে পরিচিতা, ও হাসলে ওকে যে সুন্দর দেখায়, ওর চোখে যে অন্ধকারে বুদ্ধির জোনাকি জ্বলে, ওর কাছে এলেই যে কেউ ভাল লাগায় মরে যেতে পারে, এত সব অনাবিষ্কৃত তথ্য ও বোধহয় আমার চিঠি পাবার আগে জানত না। এবং দিনে দিনে ও ঠিক যে অনুপাতে গর্বিতা, মহতী ও খুশি হয়ে উঠতে থাকে, আমি ঠিক সেই অনুপাতে হীনমন্য ক্ষুদ্র ও অখুশি হয়ে উঠতে থাকি। এও এক ধরনের আত্মাবলুপ্তি। স্লিপিং পিল খেলে এক মুহূর্তে হত। এমনি ভাবে তিলে তিলে হচ্ছে।

কিন্তু শুধু যে আবলুপ্তিই ঘটছে তাই বা বলি কী করে? নয়নাকে ভালবেসে আমি নিজের অযোগ্য অনেক মহৎ কর্মই করে ফেলেছি এ পর্যন্ত, যা ওকে ভাল না বাসলে করতে পারতাম কি না আমার সন্দেহ আছে।

স্যার উইনস্টন চার্চিল বিরোধী পক্ষের একজন পার্লামেন্টারিয়ানকে একদিন 769126010, The honourable member should not have more indignation than he can contain, তেমনি আমারও নিজেকে বলতে ইচ্ছে করত, I should not have more greatness than I contain,

একদিন সকালে বাড়িতে বসে আছি–শাল জড়িয়ে। বেশ ঠান্ডা পড়েছে। অস্বাভাবিক ঠান্ডা। রোদে, আরামে বসে চা খাচ্ছি–এমন সময় নাপিতটি এল। ইদানীং ও সপ্তাহে দু’বার করে আসছে। হাত-পায়ের নখ ইত্যাদি কাটে। ও একটি পাতলা সুতির জামা গায়ে দিয়েছিল। শীতে কুঁকড়ে কুঁকড়ে উঠছিল।

ঘুম ভেঙে উঠে আমি বসে ছিলাম। বাগানে এক ফালি রোদ লুটিয়ে পড়েছে। একটি বহুরূপী লনের শিশির-ভেজা ঘাসের মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াচ্ছে। একটি শালিক হলুদ হলুদ পা ফেলে ফেলে একা একা মুখ গোমড়া করে হাঁটছিল, এমন সময় অন্য একটি উড়ে এসে ওর গায়ে ঢলে পড়ল। One for sorow; Two for joy.

ভীষণ খুশি খুশি লাগতে লাগল। নয়নার কথা মনে হল। এখন নয়না কী করছে? ঘুম থেকে নিশ্চয়ই ওঠেনি। বড় দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে ও। এত দেরি করে উঠলে তো চলবে না। রোজ সকালে আমার ঘুম ভাঙার আগে উঠে, চান করে নেবে ও–তারপর সুগন্ধি খোলা চুল নিয়ে, জানালা খুলে দিয়ে হাতছানি দিয়ে ভোরের রোদকে ঘরে ডেকে, আমাকে বলবে–এই! আর কত ঘুমোনো হবে? ক’টা বেজেছে জানো?

আমি বলব, উঁউম্‌-ম-ম-ম…। তারপর বলব, জানি। বারোটা।

ও বলবে, সবসময় ইয়ারকি, না?

এই আবেশে, অনিমেষে, এ সব ভাবছি, এমন সময় নাপিতটি এল। এমন সময় ও আমার অমন স্বপ্নভরা চোখের সামনে শীতে কাঁপতে লাগল। কী হয়ে গেল জানি । শালটি গা থেকে খুলে ফেললাম। বোধহয় আমি নিজে খুলোম না। নয়নার অদৃশ্য লতানো হাত দুখানি আমার গা থেকে শালটি আলতো করে খুলে নিল। তারপর নাপিতটিকে বললাম–নাও নাও, গায়ে জড়িয়ে নাও; করেছ কী? নিউমোনিয়া হবে যে।

আমার কিন্তু একটিমাত্রই শাল ছিল। এরপর বিয়েবাড়ি যেতে হলে ধার করতে হবে। দিদি জানতে পেরে খুব বকবেন। বলবেন, ভাই আমার জমিদার হয়েছেন!

আমি জবাবে কিছুই বলব না। মাথা নিচু করে থাকব। দিদিকে আমি কী করে বোঝাব যে, যে মুহূর্তে আমি শালটি দান করেছিলাম, সে মুহূর্তে কোনও সামান্য জমিদার তো দূরের কথা, আমি হায়দরাবাদের নিজাম হয়ে গিয়েছিলাম। আমার মতো বড়লোক আর কে ছিল?

কিন্তু ওসব কিছুই আমি বলতে পারব না। দিদি লোককে বলবে, ঋজুর আমার মনটা ভীষণ বড়। দিদি জানবেন না যে, তার ঋজুর মনটা বড় নয়। খোঁড়া ভিখিরিকেও সে পয়সা না দিয়ে বিদায় দেয় ধমক দিয়ে, কিন্তু নয়না যখন পাশে থাকে, মানে, নয়না যখন মনে মনে তার খুব কাছ ঘেঁষে দাঁড়ায়–তখন সে মস্ত হয়ে যায়। বিরাট, বিরাট,–সি আর দাশের চেয়েও বড় দাতা হয়ে যায়। তখন সে নিজের যা কিছু আছে সব দিতে পারে।

.

০৪.

সুজয় নেমন্তন্ন করতে এসেছিল সেদিন। বলল, আমার দিদির বিয়ে। ময়নাদির বিয়ে, তোর সকাল থেকে যেতে হবে কিন্তু–কাজকর্ম করতে হবে।

বললাম, দ্যাখ, নিজের দিদির বিয়েতেই কাজকর্ম করিনি। আমি একেবারে অকর্মা। তবে, যখন অতিথি-অভ্যাগতরা আসবেন তখন তাদের আসুন বসুন করতে পারি। তার বেশি আমার দ্বারা হবে না। ভার দিলেও সব গোলমাল করে দেব।

সুজয় বলল, আরে সেটাই কি কম কাজ? আমার মা কী বলেন জানিস? বলেন, নেওতা-নেমন্তনে কেউ কারও বাড়ি খেতে আসে না। ভালমন্দ সকলেই বাড়িতে খায়। তাই এসব সামাজিক ব্যাপারে আদর-আপ্যায়নটাই বড় কথা। তার জন্যেই লোকের দরকার।

বললাম, তা হলে তো ভালই।

বিয়ের দিন সকাল সকাল গিয়ে পৌঁছোলাম। সুজয়দের লনে, পাশের প্যাসেজে এবং রাস্তায় শামিয়ানা ঘেরা হয়েছে। ব্যাঙের মতো হলুদরঙা ভাড়াকরা চেয়ার পাতা হয়েছে সারি দিয়ে। অনেক লোকজন। ব্যস্ত সমস্ত। সানাইওয়ালা আনেনি ওরা। অ্যামপ্লিগ্রামে লং প্লেয়িং রেকর্ড বাজছে।

সামনে দিয়ে অনেক লোক আসছে যাচ্ছে। সুজয়ের মা একবার বাইরে এলেন। দেখতে, মেয়ের বিয়ের প্যান্ডেল কেমন হয়েছে। আমায় দেখে বললেন, কী বাবা, এসেছ? নিজের মতো করে আদর আপ্যায়ন কোরো লোকজনকে। এটা তো তোমার নিজেরই বাড়ি।

মাসিমাকে কিছু বলতে পারলাম না। কিন্তু এ বাড়ি আমার নিজের বাড়ি ভাবতে খুব ভাল লাগে।

দেখতে দেখতে সন্ধে হয়ে গেল। শীতটাও আঁকিয়ে পড়েছে। যতির কাছ থেকে ধারকরা শালটা এত ছোট হয়েছে, যে, ভাল করে শীত মানছে না।

এবার লোকজন আসতে আরম্ভ করল। একটার পর একটা গাড়ি এসে। দাঁড়াচ্ছে–কেউ কেউ ট্যাক্সিতে, কি হেঁটেও আসছেন। ফ্লুরোসেন্ট ডে-লাইটে ফরসা লোকেদের ঠাকুমার কোলবালিশের মতো ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। আর কালো লোলাকেঁদের বেগুনিরঙা শিমের মতো মনে হচ্ছে। আলোয় মেয়েদের গয়না ঝিকমিক করছে। কয়েকটি অল্পবয়সি ছেলে টাইট-ফিটিং টেরিলিন-টেরিকটের সুট পরে এসেছে। আমার সামনে দিয়ে যাচ্ছে আসছে। ইচ্ছে করছে হঠাৎ পা বাড়িয়ে দিই; মুখ থুবড়ে পড়ুক। বুঝতাম, অফিস কাছারি থেকে সোজা আসছে, তাও নয়। সারাদিন ঘুমিয়ে কি আড্ডা মেরে, এখন শৌখিন সুট পরে আত্মীয়বাড়ি নেমন্তন্ন খেতে এসেছে। কোনদিন মাড়োয়ারি ছেলেদের মতো সুট পরে, পাঞ্জাবি ছেলেদের মতো হাতে বালা পরে, মেক্সিকান ছেলেদের মতো চোখা জুতো পরে, এবং বিটলসদের মতো এক মাথা কাকের বাসা চুল নিয়ে বাঙালির ছেলে হয়তো বিয়েও করতে যাবে। জানি না, একদিন হয়তো চোখে সবই সয়ে যাবে।

এদিকে ‘আসুন’ ‘আসুন’ করে তো হাঁপিয়ে উঠলাম। যে আসছে, তাকেই গাড়ির দরজা খুলে নামাচ্ছি। মধুর হাসি হেসে পথ দেখিয়ে যাচ্ছি। তারপর মহিলাদের বাড়ির মহিলামহলে, এবং পুরুষদের হলুদ কাঠের চেয়ারে সমর্পণ করছি।

একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল। একটা সাদা হেরাল্ড। বাঁ দিকের দরজা খুলতেই এক মোটা ভদ্রমহিলা (অল্পবয়সি) নামবার চেষ্টা করতে লাগলেন। চেষ্টা করলেই তো হল না। ওই চেহারা নিয়ে হেরাল্ড গাড়ির গর্ত থেকে বেরুনো সোজা কর্ম নয়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম, আজ আমার করণীয় কর্তব্যের মধ্যে কোনও স্থূলকায়া ময়দা-ঠাসা-নাদুস মহিলাকে গাড়ি থেকে হাতে ধরে টেনে নামানোও পড়ে কি না, এমন সময়, যিনি গাড়ি চালাচ্ছিলেন তিনি কটাং শব্দ করে হেরান্ডের দরজা খুলে স্ত্রীকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন।

কী সর্বনাশ। এ যে অনিমেষ। আমাদের কলেজেই পড়ত। আমাদের চেয়ে দু’বছরের সিনিয়র ছিল। আমরা বলতাম অনিমেষ গুন্ডা। একবার ইন্টারক্লাস ক্রিকেট ম্যাচে আমার ইনস্যুয়িং বলে আউট হয়ে রেগে গিয়ে আমাকে খুব মেরেছিল। ওকে দেখে রাগে গা চিড়বিড় করতে লাগল। কিন্তু পরক্ষণেই হাসিমুখে বললাম, ‘আসুন আসুন’।

ও আমাকে চিনতে পেরে অবাক হল। মুখের বিগলিত অবস্থা দেখে বুঝলাম, সুজয়রা নিশ্চয়ই শ্বশুরবাড়ির দিকের আত্মীয়। স্ত্রীকে উদ্ধার করে আমার হাতে দিতেই আমি মহিলামহলে পৌঁছে দিলাম। গাড়ি পার্ক করিয়ে ও যখন আবার গেটে এল, আবার বললাম, ‘আসুন’ ’আসুন’–ও খুব কাছে এল একদম মুখের কাছে মুখ নিয়ে ‘হুঁকোমুখো’র মতো হিমেল হাসি হেসে বলল, একটু বাড়াবাড়ি হচ্ছে না?

বাক্যব্যয় না করে চলে এলাম। যতির শালটায় নাক ফেটে রক্ত-টক্ত পড়লে কেলেঙ্কারি হবে। বললাম, আচ্ছা বসুন, বসুন। বলেই, সরে এলাম।

এবারে নয়নার উপর আমার সত্যিই রাগ হচ্ছিল। সেই বিকেল তিনটে-সাড়ে তিনটেতে এসেছি–রাত ন’টা বাজতে চলল। এখনও কি একবার সময় করে নীচে আসতে পারল না? কতগুলো বাজে বন্ধু জুটেছে। খালি হি-হি আর হা হা। বন্ধুগুলোই ওর মাথা খাবে। এবং আমারও সর্বনাশ করবে।

আলোর নীচে দাঁড়িয়ে এসব ভাবছি, এমন সময় রাজেন্দ্রাণী এলেন। ওকে সাজলে-গুজলে রাজেন্দ্রাণী ছাড়া আর কিছু বলতে ইচ্ছে করে না আমার। আর কিছু মনে আসে না।

একটি নীলরঙা বেনারসি পরেছে। রুপোর ফুল তোলা। চুড়ো করে খোঁপা বেঁধেছে। ওর গ্রীবাটি এত সুন্দর যে ও আমার কাছে এলেই ওর গ্রীবায় আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়াতে ইচ্ছে করে। হাতে হালকা গয়না পরেছে, পায়ে পায়জোর। পা ফেললেই ঝুমুর ঝুমুর করে বাজছে–আর আমার বুকের মধ্যে রক্ত ছলাত ছলাত করে উঠছে।

নাজিমসাহেব টুটিলাওয়াতে উর্দু কবিতা শুনিয়েছিলেন–নয়না সাজগোজ করলেই আমার সেই শায়রীর কথা মনে পড়ে,

উল্‌ঝি সুল্‌ঝি রহনে দেও,
কিঁউ শরপর্‌ আফৎ লাতি হো?
দিকা ধড়কান বাড়তি হ্যায়
যব, বাঁলোকো সুল্‌ঝাতি হো।

মানে, তুমি উসকোখুসকোই থেকো–। সেজেগুজে, চুল পরিপাটি করে আমার শিরে নতুন করে বিপদ ডেকে এনো না। তুমি কি জানোনা, তুমি সুন্দর করে সাজলে আমার বুকের মধ্যেটা কেমন করে?

এলেন। এতক্ষণে এলেন। যেন রাধারানি এলেন। গর্বিতা, সুস্মিতা, আত্মবিশ্বাসে উত্তিষ্ঠিতা, কিন্তু আত্মসচেতন নয়। ও যদি ওর কী আছে জানত তবে ওকে আমার ভাল লাগত না। চলতে ফিরতে ওর অজানিতে আমার জন্যে অচেতনে ও যা উপচে ফেলে যায়, কোনও সুখী সাওতাল ছেলের মতো, বৈশাখী সকালের ঝরে-পড়া মিষ্টি মহুয়া ফলের মতো তা আমি কুড়িয়ে বেড়াই। ও জানে না–কী সুবাস, কী স্বাদ, কী ভাললাগা ও আমার জন্যে রেখে যায়–যখনই ও কাছে আসে।

নয়না এক ভদ্রমহিলাকে পৌঁছে দিতে এসেছিল গাড়ি অবধি। ভদ্রমহিলা চলে গেলেন। এবার ও আমার দিকে ফিরল। ফ্লুরোসেন্ট আলোতে ওকে স্বপ্নময় দেখাচ্ছে। সন্ধে থেকে, সববয়সি কত সুন্দরীই তো এই আলোর নীচে এসে আমার সামনে দাঁড়াল কই, এমন তো আর কাউকে লাগল না?

ও কাছে এল, একটু হাসল, কপাল থেকে এলোমেলো অলকগুলি সরাতে সরাতে বলল, খুব কাজ করছেন?

ভী–ষণ। তুমি তো ফাঁকি দিয়ে বেড়াচ্ছ।

তা তো বলবেনই। পা-টা যে কী ব্যথা করছে না। কতবার যে উপর-নীচ করলাম। সোজা উঠলে বোধহয় কেদারবদরী পৌঁছে যেতাম।

বললাম, চেষ্টা করলেও পারতে না। দুষ্ট লোকেরা সেখানে যেতে পারে না।

ও বলল, আপনাকে বলেছে! পাপীরাই তো পাপমুক্তি ঘটাতে যায় সেখানে।

কে যেন ওকে ডাকল। ও গিয়ে দুটি কথা বলেই আবার ফিরে এল, বলল, খুব খিদে পেয়েছে, না?

বললাম, খু-ব।

ইস। বেচ্চা–রা। আর একটু কষ্ট করুন। একসঙ্গে আমরা বসে খাব।

তারপর আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার বিয়েতেও আমি খুব কাজ করে দেব; দেখবেন।

বলছ?

ও উত্তর না দিয়ে আমার চোখের দিকে চেয়ে রইল।

আমি হঠাৎ বললাম, যাও। গল্প কোরো না। কাজ করো গিয়ে।

ও চলে গেল।

নিজের গালে নিজে চড় মারতে ইচ্ছে করল। আমি যেন মাতব্বর জ্যাঠামশাই হয়ে গেছি। ওর যেন আমিই গার্জেন, যেন আমার উপদেশেই ও চলে। এতক্ষণ ওকে একটু দেখতে পাবার জন্যে ছটফট করেছি–যখন ও কাছে এল, ভাল লাগায় মরে গেলাম; অথচ ওর উপস্থিতিটা পুরোপুরি উপভোগ করার আগেই নিজের পায়ে নিজে কুড়ুল মেরে বললাম, যাও, কাজ করো গিয়ে।

এখন কেমন লাগছে? তখন তো বিশ্বামিত্র মুনির মতো ভাব দেখালাম, এখন ও যে পথে চলে গেল সে পথে চেয়ে আছি।

কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম।

একটা ঢাউস গাড়ি এসে গেল।

আর নয়নার কথা ভাবা গেল না।

ওল্ডসমোবাইল–। কালো কুচকুচে। একী? পাধামশায় যে। আমাদের কোম্পানির কাস্টোমার। হাওড়ার শ্রীরাম ঢ্যাং লেনে মস্ত কারখানা।

আমাকে দেখে তিনিও অবাক।

আরে, বোসোহেব? এখানে?

এই আমার বন্ধুর দিদির বিয়ে।

বাঃ বাঃ, বেশ বেশ।

আপ্যায়ন করে বললাম, চলুন চলুন, বসবেন চলুন।

উনি একটি চেয়ারে বসলেন। চেয়ারটা ‘কে-রে কে-রে?’ করে উঠল। মনে হল বলল, যত ভাড়া দেওয়া হয়েছে তাতে এত মোটা লোকের বসার কড়ার ছিল না। রাজার-বেটার মতো বুক চিতিয়ে বসে, পাধামশায় রুপোর সিগারেট কেস থেকে সিগারেট বের করে ধরালেন এবং আমায় অফার করলেন।

বললাম, এ গুরুজন-অধ্যুষিত জায়গা। এখানে চলবে না।

ভুরভুর করে সেন্টের গন্ধ বেরোচ্ছে। পাতা কাটা চুল, হাতির দাঁত বাঁধানো লাঠি, গিলে করা ধুতি, ফিনফিনে আদ্দির গাড়োয়ানি গা-দেখানো পাঞ্জাবি। এ সব স্পেসিমেন আজকাল ভারতীয় গন্ডারের মতো দুষ্প্রাপ্য হয়ে যাচ্ছে।

পাধামশায় ফিসফিসে গলায় বললেন, আমার ছেলে বলছিল আপনি নাকি কাগজপত্রে আজকাল গল্প-টল্প নেকেন? আসলে কাকে দিয়ে নেকান? আমার গাঁয়ের মিউনিসিপ্যালিটির লোকেরা ধরেছে একটি সাহিত্যসভার বক্তৃতা দিতে হবে। ভদ্রলোককে একবার আমার কাছে পাটিয়ে দেবেন? পয়সা কড়ি ভালই দোব।

বিনীতভাবেই বললাম, আজ্ঞে কাউকে দিয়ে লেখাই না, আমি নিজেই লিখি।

সে কী মশায়? ক’পয়সা পান নিকে?

বললাম, আমি একেবারে নতুন। সামান্যই পাই, এই চল্লিশ-পঞ্চাশ টাকা এক একটি লেখায়–বড় লেখা হলে আরও বেশিও পাই।

সে কী? আধঘণ্টা আপনার ডেস্কে বসে একটা ড্রইং করলেই তো দু’শো টাকা পেতে পারেন। তা হলে কী দরকার এ সবের?

একটা জুতসই উত্তর ঠোঁটের গোড়ায় এল, কিন্তু হেসে বললাম, এই আর কী!

উনি খুব হাসলেন, যেন উত্তরটা যে বুঝলেন শুধু তাই নয়, যেন মনোমতোও হয়েছে। হো-হো করে হেসে বললেন, তাই বলুন। সেই আর কী!

এখন আর ভাল লাগছে না। আগামী কাল শেষ রাতে উঠে পলাশী যেতে হবে। লালগোলা প্যাসেঞ্জারে। পলাশীতে একটি কনস্ট্রাকশনের কাজ হচ্ছে। শীতটাও রাতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে যাচ্ছে। ঘড়িতে প্রায় দশটা বাজে।

সুজয়ের সঙ্গে দেখা করে ওকে বললাম, যাচ্ছি। স্বাভাবিক কারণে ও বলল, যাঃ তা কী করে হয়? এত খাটাখাটনি করলি, না খেয়ে যাবি?

বললাম, তোদের বাড়ি খাইনি কখনও এমন তো হয়নি। না-গেলেই চলবে না রে এখন। ভোর সাড়ে-চারটেয় ট্রেন।

ও বলল, তা হলে আর কারও সঙ্গে দেখা করিস না। দেখা করলেই আটকে যাবি। তুই চলে যা, আমি ম্যানেজ করে নেব, মা আর নয়নাকে।

বাড়ি আসতে আসতে ভাবলাম–সাড়ে চারটেয় ট্রেন তো কী? ইচ্ছে করলে কি আর রাত বারোটা অবধি থাকতে পারতাম না? আগে কি আর কখনও এমন করিনি? আসলে চলে এলাম অনেক কথা ভেবে। ভাবলাম, সব অতিথি-অভ্যাগতদের বিদায় জানিয়ে নয়না যখন গেটে এসে দাঁড়াবে দেখবে একটি ভিখিরির ছেলে ছেঁড়া কাপড়ে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে শীতে কাঁপছে–কিছু খেতে চাইছে–নীল আলোয় বেচারিকে আরও নীল দেখাবে।

নয়না ভাববে, আরে? এখানেই তো ঋজুদা দাঁড়িয়ে ছিল–কোথায় গেল? যখন জানবে আমি নেই–-তখন ওই ছেলেটির প্রতি নয়নার আরও বেশি সমবেদনা হবে। ওকে ডেকে নিয়ে গিয়ে পাতপেড়ে বসিয়ে পেট ভরে খাওয়াবে। আমারও ইচ্ছে করে, কোনওদিন নয়না ওর মনের দরজা দিয়ে নিয়ে গিয়ে ওর শরীরের শামিয়ানার তলায় বসিয়ে ওই ভিখিরি ছেলেটির মতো করে আমাকেও সাধ মিটিয়ে খাওয়াবে।

ইচ্ছে তো কত কিছুই করে।

রসা রোডের মোড়ের লাল আলোতে দাঁড়ালাম।

বুঝলাম, সুজয়টা খুব বকুনি খাবে।

এক-ছাদ লোকের সামনে ক্লান্ত, অবসন্ন নয়না সুজয়কে খুব বকবে। বলবে, ইস তুমি কী দাদা? আমাকে ঋজুদা বলল পর্যন্ত যে ভীষণ খিদে পেয়েছে, আর তুমি চলে যেতে দিলে? খেয়ে যেতে কতক্ষণ লাগত? ও যখন সুজয়কে বকবে, আমি হয়তো তখন ঘুমিয়ে থাকব–বালিশে মুখ গুঁজে আমি ঘুমিয়ে থাকব–তা হলেও ঘুমের মধ্যেই আমার খুব ভাল লাগবে। মনটা ভরে উঠবে। ফ্রায়েড রাইস–রোস্ট চিকেন ইত্যাদি খেলে পেটটা হয়তো ভরত–কিন্তু এমন করে নটা তো ভরত না।

শোবার ঘরে ঢুকে ড্রেসিং-টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে খুব ভাল লাগতে লাগল। পাঞ্জাবির পকেট থেকে রুমালটা বের করতে গিয়ে ঠান্ডা ঠান্ডা কী যেন লাগল হাতে। দেখি, রাংতা-মোড়া একটি লাল গোলাপ। নয়না দিয়েছিল, আমার সঙ্গে কথা বলে চলে যাবার সময়। গোলাপটাকে চুমু খেলাম। একদম নয়নার মতো গন্ধ গোলাপটার। হঠাৎ আয়নায় নিজেকে বেশ সুন্দর দেখতে লাগল। বেশ হ্যান্ডসাম হ্যান্ডসাম। যদি সবসময় আমাকে এরকমই দেখাত তা হলে নিশ্চয়ই নয়না আমাকে ভালবাসত। ভগবান, তুমি আমার চেহারা নয়না যেমনটি পছন্দ করে তেমনটি করে করলে না কেন?

বড় খিদে পেয়েছে। অথচ বাড়িতে বলাও যাবে না যে খেয়ে আসিনি। মিনুরা তো সব খেয়ে-দেয়ে এসে শুয়ে পড়েছে। জেগে থাকলেও বলা যাবে না। ঠোঁট উলটে মিনু বলবে, তোর এমন ন্যাকামি না! কেন খেয়ে এলি না? মিনুর মেয়ে মিঠুয়াকে দেবার জন্যে একটি ক্যাডবেরি কিনেছিলাম। ড্রয়ার খুলে বের করে অগত্যা সেটিকেই খেলাম কুরকুর করে। তারপর ঢাকাস চকাস করে দু’গেলাস জল খেয়ে কম্বলের নীচে বডি-থ্রো দিলাম।

2 Comments
Collapse Comments
Arghadipa Chakraborty February 14, 2022 at 10:31 pm

বুদ্ধদেব গুহর “অন্য চোখে” বইটা দেবেন।

সুপ্ত গুপ্তচর November 4, 2022 at 4:18 pm

I love you

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *