০১.৩ ত্রিকোণ যন্ত্র পাতালভেদী মধ্যে আছে মহা ঔষধি

ত্রিকোণ যন্ত্র পাতালভেদী মধ্যে আছে মহা ঔষধি

পাঁচ পিড়ির আশ্রমে বসে আছি। বৈশাখের বিকেলবেলা। তবু তাত কমেনি সেইভাবে বাতাসে। ভক্তশিষ্য তেমন কেউ নেই। ফাঁকা, নিরিবিলি বসে আছি শিবশঙ্কর দাস বৈরাগ্যের পাশে। পুঁইয়ের মাচার নধর লতাও সব নুয়ে পড়েছে তাপে। পেঁপের রং হলুদ হয়েছে। কিন্তু পাতা সব নেতিয়ে রয়েছে। কুয়োতলা থেকে জল তুলে বাউলানি ভিজিয়ে দিচ্ছেন আশ্রমের গাছের গোড়া। ডালপালাতেও ছিটে দিচ্ছেন।

শিবশঙ্কর বললেন, দেখেন খ্যাপা, গাছ-লতা সব কেমন হাসছে। জল হল গিয়ে খ্যাপা আশ্রয়। মানুষের, পশু-পাখির, গাছ-লতার। বাউল তো তাই জলসাধনা করে। জলের জন্যই তো তার আকুতি। প্রাণপাত। তাই তো নদীর ঘাটে যাওয়া খ্যাপা।

একতারা তুলে নিলেন বাউল। বললেন, জলের একখানা গান গাই খ্যাপা। বোঝেন খ্যাপা, জল কী করে, কীভাবে করে।

গাইতে থাকলেন বাউল চিরপরিচিত সেই গান। তার গানে পাঁচ পিড়িতে মানুষ ভিজছে যেন। শীতল হচ্ছে মন।

গাইছেন বাউল:

মেয়ে গঙ্গা যমুনা সরস্বতী
মাসে মাসে জোয়ার আসে ত্রিবেণী সংহতি।
যখন নদী হয় উতলা তিনজন মেয়ের লীলাখেলা
একজন কালা একজন ধলা একজনা লালমতী।
মেয়ের গুণ কে বলতে পারে কিঞ্চিৎ জানেন মহেশ্বরে
একজন শিরে একজন বুকে ধরেন পশুপতি
রসিক মেয়ে থাকে ঘরে ঘরের রসের জগৎ দেখে
তার সাক্ষী আছে গোপের মেয়ে গোকুলের সতী–
সতী হয়ে ধর্ম রাখে লয়ে উপপতি।
এবার মলে মেয়ে হব মহৎ সঙ্গ চেয়ে লব
দাস কমল বলে থাকবে না তার বংশে দিতে বাতি।।
মেয়ে গঙ্গা যমুনা সরস্বতী।

বাউল বললেন, মেয়ে হল খ্যাপা, ভবনদী। সাধক বাউল মেয়ে ধরেই পরপারে যান। মেয়ে রতি নিয়ে জন্মায় বলেই বাউল তার ধারা পায়। রজঃধারা কি পুরুষ শরীরে বয়? রতি হল অনুরাগ।

জিজ্ঞাসা করলাম, কীসের অনুরাগ?

–প্রেমের, রাগের, ভাবের সে অনুরাগ শরীরে হয়। বাউল নদীর ভাবেই ভবনদী পার হয় নারী কী এমনি-এমনি নদী খ্যাপা? নদীর ভাবেই সাধকের মহাভাব হয়।

–রতিকে তো আপনারা রসও বলেন?

–রসই তো। তিন নদীর তিন ধারার রসে বাউল স্নান করে। হাবুডুবু খায়। পরে যারা যায় তারা ভবনদী থেকে মহাভাবখানা তুলে নেয়। সাধক তো নৌকা খ্যাপা। নদীর উজানে বায়।

আসাননগরে বসে বাঙালঝির মোজাম্মেল ফকিরের গলাতে শুনেছিলাম এমনই এক নৌকার গান। ধরা বিকেলে লালন মেলায় রং লাগেনি তখনো। দুই বাংলার একত্র হাওয়ায় মোজাম্মেলের কথা ছড়িয়ে পড়ছে চারধারে। তার পাশে বসে চুপ করে শুনছি আর ভাবছি বাউল-ফকিরদের প্রক্ষেপণগুলো এক হয়ে গিয়েছে কোথাও সহজিয়া প্রেরণায়। হাটে-মাঠে-গঞ্জে সহজিয়া প্রবচন এখনো এই অস্বাচ্ছন্দ্যের সুরে কী ভীষণ শরিক

সংগতির সুরকে একত্র করে রাখছে খসে পড়ছে সব ভেদাভেদের দেওয়াল।

মোজাম্মেল গাইছেন:

নৌকা বাইও সাবধান হইয়ারে মাঝি ভাই–
বাইও সাবধান হইয়া।
আল্লাহ নবীর নামরে মাঝি ভাই স্মরণ রাখিয়া।
তিন তক্তারি নৌকারে মাঝি ভাই মধ্যে জোড়া
বিপাকে পড়িলেরে মাঝি ভাই নৌকা যাবে মারা।
বাতাসে চালায় রে নৌকা আজবও গঠন
গলইয়ে ভরিয়া রে দিছে অমূল্য রতন।
শরীয়তের পাইকরে মাঝি ভাই মারিফতের নাও।
মায়া-নদী বাঁকেরে নৌকা উজান বাইয়া যাও।
গাবকালি লাগাইয়ারে নৌকা যত্ন করে বাও।
নুনা জলে খাইলেরে তক্তা ভাঙ্গিয়া পড়ে নাও।।
নায়ের মাঝে আছেন রে মাঝি ভাই নায়ের মহাজন।
এ করিম কয় না চিনিলে বিফলও জীবন।

ফকির বললেন, আল্লাহ নবীর নামে নৌকা, হেইয়া বাওয়াই কর্তা সারা জেবনের কাজ। আল্লাতালার প্রেরিত পুরুষ হইল গিয়া নবী। তিনিই তো বানাইছেন সাধের তরণীখানি। মাইনষের কাজ হইল হেইডা শুধু সুন্দরভাবে বাইয়া যাওয়া। হের লেইগ্যা তো সাধনা। তিন তক্তারি কাঠে বানাইতে কইছে মুর্শিদ নৌকারে। ববাঝেননি তিন তক্তারি কী?

বললাম, শরীরের তিনখানা নাড়ি।

–হ ঠিক কইছেন একেবারে কর্তা। নাড়ির বাতাসই তো চলায় নৌকা। নৌকা বাইতে হয় মায়া-নদীর বাঁকে-বাঁকে। তা কর্তা, মুর্শিদে মতি হইছে আপনের? নাম লইছেন? নাড়া বাঁধছেননি?

বললাম, না না। আমি হলাম জিজ্ঞাসু মানুষজন শুধু।

— এইডা কী কন্। আপনে অনুরাগী মানুষজন। নবীর নিকটে আইতে আইতেই দ্যাখবেন কর্তা, একদিন না একদিন আপনের অনুরাগ আইব। তখনই কর্তা মুর্শিদের দেখা পাওনের লাগি মন আনচান করব। এত উৎসুক্য আপনের। কর্তা দেহ গঠন করতে হইব না? সোনার গৌর আপনার দেহখান না হইলে তো পোকে খাইব। যমে শয়তানে টানাটানি করব। সময় আছে কর্তা, আপনের এই কাঁচা বয়সে মুর্শিদ ধইরা দেহখান গইড়া লন। তারপর ঘুরেন যত খুশি মেলায়-খেলায়। না হইলে কর্তা সব বৃথা যাইব। আল্লাহরে ডাকলে হইব না শুধু।

বাতাস বইছে। দুই বাংলার বাতাস এসে যেন ভিজিয়ে দিচ্ছে আমাকে আর মোজাম্মেলকে। অদূরে বাংলাদেশের গাছগাছালির হাওয়া একত্রিত হয়ে নাচছে অখণ্ড বাংলায়। ফকির এবার তাঁর সাধের দোতারাটা হাতে তুলে নিলেন। গান ধরলেন:

শুধু কি আল্লা বলে ডাকলে তারে
পাবি ওরে মন-পাগলা
যে ভাবে আল্লাতালা বিষম লীলা ত্রিজগতে করছে খেলা।
কতজন জপে মালা তুলসী-তলা হা
তে ঝোলা মালার ঝোলা
আর কতজন হরি বলি মারে তালি
নেচে গেয়ে হয় মাতেলা।
কতজন হয় উদাসী তীর্থবাসী
মক্কাতে দিয়াছে মেলা।
কেউ বা মসজিদে বসে তার উদ্দেশে
সদায় করে আল্লা আল্লা।
স্বরূপের মানুষ মিশে স্বরূপ দেশে
বোবায় কালায় নিত্য লীলা
স্বরূপের ভাব না জেনে চামর কিনে
হচ্ছে কত গাজীর চেলা।
নিত্য সেবায় নিত্য লীলা চরণ মালা
ধরা দিবে অধর কালা
পা তাই করে হেলা ঘটল জ্বালা
কি হবে নিকাশের বেলা।

গান শুনতে শুনতে দেখি সন্ধ্যা মজেছে সবে। বাউল-ফকিরের জমায়েতে মেলা সরগরম হয়ে উঠছে। গুরু-মুর্শিদের দেশে আমি তখন খুঁজে ফিরছি বাউলকে। আমার দোরের কপাট তাঁর গানগুরু ও সঙ্গের অনুশাসনই কেবল খুলে দিতে পারে। হাওয়া বইছে। আসাননগরে। গুরুর দিগ্বলয়ে নেমে আসছে হাওয়া বাউলেরই সমাসীন আধারে, ছেড়ে আসা মোজাম্মেলের মুখও যেন ঝলসে উঠছে তার ভেতর।

পাঁচ পিড়িতে বসে শিবশঙ্কর গাইছিলেন তিনটি ধারার সঙ্গম স্থল ত্রিবেণীর গান। নারীকে বাউল নদীর প্রতীক দিয়েছেন। যোনি বা জননাঙ্গ হল নারী দেহের নদী। তাঁর স্রোতপ্রবাহ রজঃপ্রবৃত্তির সমাচ্ছন্নতা। বাউল সাধনা রস-রতির মিলন। সাধনমার্গে এই মিলন আত্মার সঙ্গে আত্মার। রজের সঙ্গে বীর্যের নয়। দুই আত্মা বা সাধন শরীরের একত্র মিলনে জন্ম হয় পরমাত্মার। বাউল বলেন তাঁদের সিদ্ধদশার করনকারণ তিনদিনের। সঙ্গিনীর শরীরে রজ-উদয়ের সময়কে তারা অমাবস্যা হিসাবে চিহ্নিত করে থাকেন। ওই দিনে সঙ্গিনীর শরীরে তমগুণের বিকাশ ঘটে। তম হল তামসিক ভাব। অজ্ঞানতা। এই অজ্ঞানতা কামের বশীভূত দশা আসলে। সঙ্গিনীর এই কামের মত্ততাকে সাধক বাউল বলেন ‘জীবাচার’। জীবাচারের ঊর্ধ্বে উঠে যেতে চান তারা। তাই তারা বলেন প্রকৃতি বা সঙ্গিনীর অন্তর্নিহিত সত্তাই হল রজ। পুরুষের বীর্য বা বীজ। এর মিলনে তাঁরা বিশ্বাসী। তাই জন্যই তাঁদের দেহসাধনা। কেননা তাঁদের মিলন জীবাচারের কখনও নয়–জীবাচারের মিলনে রজবীজের মিলন ঘটে দেহের ভিতরে।

প্রাজ্ঞ বাউল শশাঙ্কশেখর একবার আমায় বলেছিলেন, পুরুষ পুরুষ তো নয়।

জিজ্ঞাসা করেছিলাম, পুরুষ তাহলে কে?

বললেন, পুরুষ বীর্য। আর রজ হল নারী। যোনি-লিঙ্গ তাকে নারী-পুরুষ হিসাবে দেখে ঠিকই। আসলে নারী-পুরুষ কেউই তারা নয়, সবাই একেকজন হিজড়া।

জিজ্ঞাসা করলাম, কী হিসাবে একথা বলছেন আপনি?

–দুই দেহেই বাবা রজ-বীর্য থাকে। তাহলে দাঁড়ায় কী না তাঁরা ছেলে, না মেয়ে। সাধনই বাবা হিজড়াকে নারী বা পুরুষের রূপে এনে দেয়।

–কীভাবে আনে?

–তোমার দেহের উর্ধ্বচক্রে বীহ আছে। নিম্নে রজ। স্রোতধারা যে বয় মৈথুনে, ঊধ্বচক্রের বীজ নীচে নামে। বীজ তখন রজ হয়। সাধক রজকে রজর সঙ্গে মিশায় না কখনও। আবারও উর্ধ্বে তুলে বীজ করে দেয়। এভাবে সাধক সিদ্ধ হয়। পুরুষ হয়। অটল হয়।

ঢিলাইচণ্ডীর তান্ত্রিক সাধু পরিতোষ বাবা একবার বলেছিলেন আমায়, তোর দেহে নারী আছে তুই জানিস? সবার দেহে নারী থাকে। পুরুষ থাকে।

কীভাবে থাকে তা বাবা? জিজ্ঞাসা করেছিলাম।

বললেন, নারী থাকে মূলাধারে। পুরুষ সহস্ৰারে। সাধক সিদ্ধ হলে সহস্রারে কুণ্ডলিনী উঠে যায়। এই শক্তি নারীশক্তি। মূলাধারের সুপ্ত কুণ্ডলিনী সহস্রারে এসে শক্তির সৃষ্টি করে রে। যখন তা সহস্রারে এল তখন সে পুরুষ হল। তাঁর আগে শক্তির নারীর বেশ। আমরা তাই তো বলি নারীশক্তি। পুরুষ শক্তি বলি কখনও?

আমি চুপ।

বাবা বলছেন, সাধনা শুরু হয় নারীতে-নারীতে। সাধক সিদ্ধ হল পুরুষ হয়ে। বীজ ধরে। আর সাধিকার নারীরূপ চিন্ময় হয়। এই যে দেখছিস কালী মা, মা, মাগো… এই মা মৃন্ময় মা চিন্ময় হয় ভৈরবীর শরীরে। জ্যান্ত শিব মা তৈরি করে নারী ছাড়া সাধন হয়? জীবনেও বউ ছাড়া তুই পুরুষ নোস। নারী, বউই তো পুরুষ করে। প্রাণ আনে তোর বউ তোকে সাহায্য করে তোর বউ তোকে পুরুষ করে দিয়ে সে নারী হয়ে ওঠে। তাই তো তাঁর মাতৃরূপ সেই তো আমার মা। মা না থাকলে শালা সব অন্ধকার রে।

মা মা বলে চিৎকার করছেন পরিতোষ বাবা। ঢিলাইচণ্ডীতে মায়ের আজ অমাবস্যার পুজো। বাবা সকাল থেকেই যোগাড়ে লেগেছেন তাঁর। ভক্তশিষ্য গমগম করছে আশ্রমে ভক্তিতে আর বাবার কথায় মাতোয়ারা হচ্ছে সবাই।

*****

শিবশঙ্কর বলেছেন: ‘মেয়ে গঙ্গা যমুনা সরস্বতী/ মাসে মাসে জোয়ার আসে ত্রিবেণী সংহতি।’

সঙ্গিনীকে এই রূপক পরিয়েছেন পদকর্তা সাধক। ত্রিবেণী বাউলের তিন রতি। তিনদিনের রজঃপ্রবাহকে বাউল তাই তিন নামেই চিহ্নিত করেছেন। কারুণ্যামৃত, তারুণ্যামৃত, লাবণ্যামৃত। তিন ধারার এই নামও অর্থদ্যোতক। প্রথম ধারায় সঙ্গিনীর শরীরের কামস্রোতকে সাধক বাউল সদর্থক দিকে চালিত করেন।

ষষ্ঠীখ্যাপা একবার বলেছিলেন, বাউল কাম মারে। মানুষ কাম তোলে।

জীবাচারে আবদ্ধ যেহেতু মানুষ তাই তাঁরা কামকে উপভোগ করেন। আমাদের কামশাস্ত্র সেই কামোপভোগকে সুন্দর সব ধারাভাষ্যেই চালিত করেছে। আর তা করতে গিয়ে পুরুষ বিভাগ এসেছে—‘শশো বৃষোহশ্ব ইতি লিঙ্গতো নায়কবিশেষাঃ।’ পুরুষের লিঙ্গমাপ অনুসারে তাকে শশ, বৃষ ও অশ্ব–এই তিনভাগে ভাগ করা হয়। যেসব পুরুষের লিঙ্গের দৈর্ঘ্য ছোট তাদের শশকের রূপ দেওয়া হচ্ছে। মধ্যম লিঙ্গ ধারণের অধিকারী পুরুষ বৃষ। আর দৈর্ঘ্যের দিক থেকে বারো আঙুল পরিমাপক যে লিঙ্গ ধারণের অধিকারী পুরুষ তিনি অশ্ব শ্রেণির বাৎস্যায়ন এখানে বোধহয় যথেষ্ট বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন লিঙ্গ পরিমাপক স্যাংখ্যিক হিসাব আনতে। শশ = ছয়, বৃষ = নয়, অশ্ব = বারো। আদতে শেষ দুটো যথেষ্ট রকম বাড়াবাড়ির। পর্ণগ্রাফি এই মাপকে অবশ্য গ্রহণ করে মনোরঞ্জন করছে। আপাতত। নীল ছবিতে তাই এখন ঠাঁই হয়েছে বাৎস্যায়নের বৃষ ও অশ্ব পুরুষের। নারীর তিনটি ভাগ হল–‘নায়িকা পুনমৃগী বড়বা হস্তিনী চেতি।’ নায়িকাও আবার পশুদের সঙ্গে উপমা অনুসারে তিন ধরণের হয়ে থাকে–মৃগী, বড়বা বা ঘোটকী, হস্তিনী। পুরুষের। লিঙ্গের দৈর্ঘ্য অনুসারে ভেদ-সূচিত তিন প্রকারের পুরুষ আর নারীর এই পরিমাপকে যোনির সেই ছয়, আট, বারো আঙুল মাপকেই সামনে আনা হয়েছে। চওড়াতে তাকে স্যাংখ্যিক পরিমাপকের আধার দেওয়া হয়েছে। মিলনে সুখদায়ক অনুভূতির জন্যই কামশাস্ত্রের নির্দেশিকা সব। সেজন্যই শশ শ্রেণীর পুরুষের সঙ্গে মৃগী, বৃষর সঙ্গে বড়বা, অশ্বর সঙ্গে হস্তিনীর মিলন বেঁধে দেওয়া হয়েছে। নারীদের ক্ষেত্রেও শেষ দুই শ্রেণীর বিভাজনকে নীল ছবি পুরোপুরি গ্রহণ করেছে।

চৌষট্টি কলার উল্লেখ আছে কামশাস্ত্রে। মিলনের সময় আলিঙ্গনাদিকে চৌষট্টি প্রকার হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে—‘আলিঙ্গন-চুম্বন-নখচ্ছেদ্য-দর্শনচ্ছেদ্য-সম্বেশন সৌকৃত-পুরুষায়িতৌ-পরিষ্টকানাদ্মষ্টানমষ্টধা।’ আলিঙ্গন, চুম্বন, নখ দিয়ে আঘাত করা, দাঁত দিয়ে উত্তেজনা জাগানো, অঙ্গমর্দন করা, উত্তেজিত অবস্থাতে সাড়া দেওয়া, মিলন, চূড়ান্ত পর্বের পর স্থিতাবস্থা–এই আট প্রকার ভেদের প্রত্যেকটির আট ভাগের উপবিভাগ করে চৌষট্টি কলার কথা বলা হয়েছে। তবে একথারও উল্লেখ আছে যে, মিলনে সব সময়ই যে চৌষট্টিটি দশার সূত্রপাত ঘটবে এরকম কোনো কারণ নেই। বিশেষণ হিসাবে বলা হয়েছে সপ্তপর্ণ অর্থাৎ কিনা ছাতিম গাছের প্রত্যেক পল্লবেই যে সাতটি করে পাতা থাকবে বা পূজা সবসময় যে পঞ্চাপচারে হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা যেমন নেই তেমনই মিলনে যে সব সময় এই চৌষট্টিকলার প্রয়োগ ঘটবে এরও কোনো মানে নেই। পদাবলি আমাদের কিন্তু চৌষট্টি নায়িকার সন্ধান দিয়েছে। আবার আমরা চৌষট্টি রসের কীর্তনের সম্বন্ধেও কিন্তু অবহিত আছি। বৈষ্ণবীয় আচরণে চৌষট্টি প্রকার সেবারও উল্লেখ পাই। বৌদ্ধ-সহজিয়াতেও চৌষট্টি পাপড়ির পদ্মের কথা উল্লেখ আছে। আমাদের শরীরস্থ

যে সপ্তম পদ্মচক্র তাঁর দলকেও কিন্তু চৌষট্টিদল বিশিষ্ট হিসাবে দেখানো হয়েছে। বাউলও তাঁর গানে চৌষট্টির প্রতীককে সামনে এনেছেন। মানবদেহকে কোলকাতার সঙ্গে তুলনা করে পদকর্তা বলেছেন: ‘তাঁর বাইরে আলো ভিতরে আঁধার / মানবদেহ কলিকাতা অতি চমৎকার / চৌষট্টি গলির মাঝে ষোলোজন প্রহরী আছে / তিনশত ষাট নম্বরে হয় রাস্তা বাহাত্তর হাজার।’ চৌষট্টি গলি হল রক্তবাহী প্রধান ধমনী, তা সংখ্যারূপ। যেটা বলতে চাইছি তা হল: চৌষট্টির রূপক, প্রতীকী আবেগ-ইচ্ছা-অনুভূতি ব্যক্ত যে কুক্ষিগত আচরণ। তা অতি আবশ্যিক উপাচার। কখনও তা সুখদায়ক কামাচারের কখনও বা তা সাধিত অনুশাসনে আচ্ছন্ন দেহাচারের। আটটি ভাবের উল্লেখ আমরা পাই দেহসাধনায়–স্তম্ভ, স্বেদ, রোমাঞ্চ, স্বরভঙ্গ, বেপথু, বৈবর্ণ, মূৰ্ছা ও অশ্রু। অষ্টশক্তির কথাও বলে থাকেন সাধক। অণিমা, লঘিমা, ব্যাপ্তি, প্রকাম্য, মহিমা, ঈশিত্ব, বশিত্ব, কামবসায়িত। অষ্টপাশের কথাও বলে থাকেন সাধক বাউল–ঘৃণা, লজ্জা, শঙ্কা, ভয়, জিগীষা, জাতি, কুল, মান। এই অষ্টরূপকে কিন্তু আমরা কামশাস্ত্রেও দেখে থাকি। সেখানে ললাট, অলক, কপোল, নয়ন, বক্ষ, স্তন, ওষ্ঠ ও মুখের মধ্যে চুম্বনের উল্লেখ আছে। চৌষট্টিকলার একটি রূপ নখচ্ছেদ্য। তাকেও আবার আটটি স্থানে রাখা হয়েছে–বগল,স্তন, গলদেশ, পৃষ্ঠদেশ, জঘন, কটির একদেশ, কটির পুরোভাগ, নিতম্ব–এই আট স্থানে নায়কের নখক্ষত সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে। বাউল কিন্তু অষ্টম ইন্দু বা অষ্টম চন্দ্ৰস্পর্শের কথা বলে থাকেন। তাহলে এই আটের ব্যবহার দু’ধারায় আছে। সুখদায়ক কামাচারেও রয়েছে আটের বহুরূপী প্রতিফলন। আবার সাধনাচারের আট চেতনাসম্পৃক্ত এক অধ্যায়। এই চেতনা কামকে প্রেমে সমুজ্জ্বল ও ঋদ্ধ করে নিয়ে আত্মাকে সংগৃহীত পরমাত্মার সঙ্গেই মিলিয়ে দেওয়া। বাউল সাধনে এ যেন এক শৌর্য প্রদর্শন। তন্ত্র তথা সমস্ত যুগল দেহসাধনার সম্মিলিত চেতনা, আশা, উদ্বেগ, প্রেরণা, প্রতিজ্ঞা, প্রার্থনা–এগুলো সবই দাউ দাউ আদর্শের গহন শিখা।

শিবশঙ্কর গানে ‘ত্রিবেণী সংহতি’কে তিন রতির উর্ধ্বাঙ্গই দিয়েছেন। তিন রতি, তিন নদীরূপী স্রোতধারা, বাউল প্রতীকের ‘রূপ সায়রের তিনধারা’। প্রথম দিনের মিলনে বাউল বলেন গুণের মানুষ উঠে আসবে। এই গুণ তমগুণ। দ্বিতীয় দিনে রসের মানুষ। তৃতীয় দিনে সহজ মানুষ। বাউল বলেছেন: ‘যখন নদী হয় উথলা তিনজন মেয়ের লীলাখেলা।’ কীভাবে হয় এই লীলাখেলা?

চৈতন্যচরিতামৃতে বাউলের তিন রতিকে তিন বাঞ্ছা হিসাবে দেখা হয়েছে। বলা হয়েছে: ‘তিন বাঞ্ছ পুণ্য করি রস আস্বাদন।।/ আলিঙ্গনে ভাব পুণ্য কান্তিতে চুম্বন। / সিঙ্গারে প্রেমরস বাঞ্ছিতপূরণ।।/ পিরিতি আনন্দময় চিন্ময় কেবল। / সেইভাবে বস হইয়া করে সম্বল।।/ নিজরূপে স্বয়ং রূপে এক রূপ হয়। / এক দেহ সে জানিহ নিশ্চয়/ নিজরূপে সঅং রূপ এক দেহ হয়। গোলোক বৃন্দাবন বলি অতএব কয়।’ বাউলের এই লীলাখেলাতে প্রথম চারচন্দ্র ভেদ করতে হয়। সঙ্গিনীর রজ গুরু যোগাড় করে রাখেন। তা সাধক বাউলকে পান করতে হয়। কেউ বলেন সঙ্গিনী নিজে তা পান করেন। আবার কেউ বলেন না, সঙ্গিনীর কাজ তা নয়। পান করে থাকেন কেবল সাধক বাউল, যথেষ্ট মতভেদ আছে এই ক্রিয়াকরণে। এই পান ক্রিয়াকে তাঁরা বলেন গ্রহণ। অর্থাৎ শরীরের জিনিস শরীরেতে ফিরিয়ে নেওয়া। এটাই তাঁদের ভেদ। চার চন্দ্রের একচন্দ্র ভেদ। তারপর মূত্র যতবার হবে তা নারকেল মালা বা পাত্রে ধরে আবার শরীরে ফিরিয়ে আনা। মল হাতের তালুতে ফেটে খাওয়া আর বাকিটা শরীরে মাখা। এই চারচন্দ্র ভেদকে বাউল ব্রহ্মচর্যদশা বলেন। এরপরই মিলন দশা আসে। তবে ব্রহ্মচর্যে কতদিন পর রসরতির মিলন হবে তা নিয়েও যথেষ্ট মত পার্থক্য আছে। কেউ এক মাস, ছ মাস, দশ বা বারো মাসের কালক্ষেপের কথা বলেন। তবে সেই অপেক্ষা-যোগ এখন এতখানি সময় পর্যন্ত মানা হয় কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কেননা বাউলকে তো এখন তাড়াতাড়ি সিদ্ধ স্তরে পৌঁছতে হবে। তবে না তাঁর পসার জমবে। ভক্তশিষ্য তৈরি হবে। খ্যাতি রটবে। যেটা মনে হয় চারচন্দ্র ভেদ একটা নিমিত্তকরণ। আসলে যে করণকার্য তা তো নাড়ির। ইড়া নাড়ির, পিঙ্গলা নাড়ির, সুষুম্না নাড়ির। শরীরের বাইরের বায়ুকে প্রথমে বাঁ নাক দিয়ে টেনে কিছুক্ষণ সেই বায়ু বাঁ নাকে রেখে তাকে আবার ডান নাকে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। বায়ু যখন টেনে অভ্যন্তর পূরণ করা হয় তখন তা পূরক। এতে উদর জলপূর্ণ কলসির মতো বায়ু জমা থাকে তাই তা কুম্ভক আর যখন তা ডান নাক দিয়ে বের করে দেওয়া হয় তখন তা রেচক। এই যোগশিক্ষাই বাউল সাধককে ক্রিয়াকরণে আসলে সাহায্য করে। মিলনে এর সাহায্যেই বাউল মূলাধারের শুক্রকে ব্রহ্মরন্ধ্রে উঠিয়ে নিতে পারেন। তাই চারচন্দ্র ভেদ না হয় হল কিন্তু শ্বাসক্রিয়া ঠিকঠাক না হলে শুধু চারচন্দ্র ভেদ, ব্রহ্মচর্যের দীক্ষার কি মূল্য আছে? আসল হল শরীর গঠন। তা ভেদে হয় ঠিক কিন্তু সেই ভেদ বায়ুভেদ বায়ুকেই বশ করেন সাধক। তবে বাউল ‘দমের কাজ’ করার কথা সব সময়ই বলেন।

শিবশঙ্কর আমাকে বলেছিলেন, দম হল দমন রিপুকে, রতিকে দমন।

জিজ্ঞাসা করেছিলাম, দমই তো বাউল সিদ্ধির আসল কথা?

–তা ঠিক। তবে চন্দ্রভেদ অনেকটা মন্ত্রসিদ্ধির মতো। বাউলের জপ আর কী।

–বাউল তাহলে গুরুমন্ত্র জপেন?

–হ্যাঁ, আমাদের মন্ত্রজপ তো আছে।

–কী মন্ত্র?

–কৃষ্ণমন্ত্র।

বাউল তো মূর্তিতেই বিশ্বাস রাখেন না। সবই তাঁর জ্যান্ত তবে বাউল কৃষ্ণমন্ত্র। জপ করেন কেন? মজলিশপুরে বসে শশাঙ্কশেখর দাস বৈরাগ্যকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম।

বললেন, কৃষ্ণ অনুরাগ। প্রেমের অনুরাগ কৃষ্ণ। কামের বিরাগ কৃষ্ণ। শরীর কৃষ্ণ। ভাব কৃষ্ণ। দুইজনের মিলন কৃষ্ণ।

বললাম, সব তো কাম-গায়ত্রীর দিকেই যাচ্ছে?

–যাবেই তো। কাম হল ক্লীং। ক্লীং হল কৃষ্ণ। কামকৃষ্ণ। এই কামকৃষ্ণকে সাধক শুধু কৃষ্ণ করেন।

–কৃষ্ণ তাহলে কী? জিজ্ঞাসা করলাম।

–কৃষ্ণ হল আত্মাকে ত্যাগ করে পরমাত্মায় বিরাজ করা। কৃষ্ণ হল প্রাপ্তি। স্কুল শরীরের মৃত্যু কৃষ্ণপ্রাপ্তি। সিদ্ধ শরীরের দশা। কৃষ্ণলাভ।

গানে তিন দিনের লীলাখেলাকে তিন রঙ দিয়েছেন পদকর্তা–’একজন কালা একজন ধলা একজন লালমতী।‘ এই তিন রঙ প্রতীকী রজঃরং। ধারাস্রোতের যেমন নাম দিয়েছেন বাউল, তেমনই রজঃরঙের নামকরণ। তবে মতান্তরে চার রঙের কথা বলে থাকেন কোনো কোনো বাউল সাধক। ঢিলাইচণ্ডীর তান্ত্রিক সাধু বলেছিলেন নারী থাকে। মূলাধারে। পদকর্তা কমল বলেছেন: ‘মেয়ের গুণ কে বলতে পারে কিঞ্চিৎ জানেন মহেশ্বর / একজন শিরে একজন বুকে ধরেন পশুপতি।‘ মহেশ্বর এখানে শিবরূপী বাউল সাধক। ‘মেয়ের গুণ’ হল সাধনসঙ্গিনীর রজ নয়–তিন দিনের রজঃযোগ। সাধনক্রিয়া। কমল বলেছেন ‘মেয়ের গুণ’ শিরে ধরবার কথা। শির এখানে মস্তিষ্ক দ্যোতক হলেও আসলে তা সাধক শরীরের নবম পদ্মচক্র সহস্রার। ব্রহ্মরন্ধ্রের উপর মহাশূন্যে শ্বেতবর্ণের সহস্রদল পদ্মচক্রের কল্পনা করে থাকেন দেহসাধক। বলা হয় এখানে মাতৃকাবর্ণেরা আছে। এটি বৃহৎ শক্তিমণ্ডল হিসাবে কল্পনা করেন সাধক। কেননা মূলাধারের শুক্র প্রাণ-অপান বায়ুর সহযোগে প্রধানত তিন নাড়ির সাহায্যে ব্রহ্মরন্ধ্রে গিয়ে অবস্থান করে। এতে নাকি সাধক শরীরে তুরীয় দশার সৃষ্টি হয়। রজগুণেই মহাযোগক্রিয়ায় তা হয়ে থাকে। তাই পদকর্তা বলেছেন মেয়ের গুণ শিরে অধিষ্ঠান করবার কথা। মেয়ের গুণকে শিরে/ ব্রহ্মরন্ধ্রে ধারণ করার অর্থ সিদ্ধাসন লাভ। পরিতোষ বাবার মত নিলে সাধকের সিদ্ধ হয়ে ওঠা মেয়ের গুণ বুকে ধরার অর্থ দ্বাদশ পদ্মকে ধারণ। হৃদয়ে বন্ধুকপুষ্পসদৃশ বর্ণবিশিষ্ট দ্বাদশদলযুক্ত অনাহত চক্র আছে। এর বারোটি বৃত্তি মেয়ের গুণেই সাধক নাশ করতে পারেন। বৃত্তিগুলো: আশা, চিন্তা, চেষ্টা, মমতা, দম্ভ, বিকলতা, বিবেক, অহঙ্কার, লোলতা, কপটতা, বিতর্ক ও অনুতাপ। কীভাবে এইসব বৃত্তি নাশ হয়? কুলকুণ্ডলিনী জাগবার পর মণিপুরে এসে সেই শক্তিরূপী নারী বা এক্ষেত্রে পদকর্তা কথিত ‘মেয়ের গুণ’ যখন অনাহত পদ্মচক্রকে ফাটিয়ে বিশুদ্ধতে ঢুকতে যায় তখন এইসব বৃত্তি নাশ হয়। এগুলো সবই স্থূল শরীরের পাশ। অনাহতে এলে সাধক শরীরের স্থূলতা নষ্ট হতে থাকে না; একেবারে নষ্ট হয়ে যায়। তাই সাধক তখন মেয়ের গুণে বুকে পশুপতিকে ধরেন। অর্থাৎ তাঁর পশুত্ব বৃত্তি সব নাশ হয়ে যায়। কমল বলেছেন–রসিক মেয়ে থাকে ঘরের রসে জগত দেখে। এই রস সহজসত্তার বিকাশ। বাউলের মনের মানুষের শিরোপা। তার সাক্ষী হিসাবে পদকর্তা ‘গোপের মেয়ে গোকুলের সতী’র কথা বলেছেন। কারণ দেহসাধনাতে রাধাও শক্তি বিশেষত আদ্যাশক্তি হিসাবে বন্দি হয়েছেন। দেহের বিভিন্ন পদ্মচক্রে তাঁর গুণশক্তিকে উপলব্ধ করে থাকেন বাউল সাধক। রাধা সঙ্গিনী যেমন ঠিকই, তেমনই রাধা সাধনশক্তির দ্যোতক বলেই সাধক শরীরেও অবস্থান করেন এভাবেই প্রতীকময়তাতে। তাই রাধারূপী শরীরই ‘সতী হয়ে ধর্ম রাখে লয়ে উপপতি। মেয়ে হবার বাসনা প্রকাশ করেছেন পদকর্তা–’এবার মলে মেয়ে হব মহৎ সঙ্গ চেয়ে লব/ দাস কমল বলে থাকবে না তাঁর বংশে দিতে বাতি।‘ মরা কিন্তু এখানে দেহসাধকের ‘জেন্তে মরা’। জীবাত্মার বিনাশ হয়ে পরমাত্মার প্রকাশ। বাউল সাধনা, বাউলের গান সেই আলোকেই প্রকাশিত হতে চায়। বারবার।

*****

চৈতন্য বাউল আশ্রমে বসে নরোত্তম দাসের মুখে শুনেছিলাম নদীর আরেক বিজয়দুন্দুভি। ভরা বর্ষার প্যাচপ্যাচে কাদা নিয়ে সেদিন উপস্থিত হয়েছিলাম বাউল আশ্রমে। নরোত্তমের সঙ্গিনী পা ধোবার জল দিলেন প্রথমে। তখন চাঁদমারীর কাছে গঙ্গা ফুসছে। হরি বৈদ্য বাউল সে খবর দিয়ে দিয়েছেন আমাকে।

নরোত্তম বললেন, আজ ‘তালে নদী পেরোনোর একখানি গাই গাই।’

হরি বৈদ্যই একতারায় সুর দিলেন।

বাউল গাইলেন:

শ্রীরূপ-নদীটি অতি চমৎকার।
তোরে বলি সার, হৃদে কর বিচার,
দেখে ভব-গর্ত হলি মত্ত,
আস্বাদন কি বুঝলি তাঁর।।

বিষম সে ত্রিপানি নদী,
ত্রিকোণ যন্ত্র পাতালভেদী,
মধ্যে আছে মহা ঔষধি।
ওঠে ঘুরনো জল, যদি না থাকে গুরুবল,
তবে খুলবে মণিকোঠা, বাঁধবে ল্যাঠা,
সেখানে খুব খবরদার।।
নদীর ভিতর তলায় গরল-সুধা,
এক পাত্রেতে রহে সদা,
সুধা খেলে যায় ভব-ক্ষুধা।
গরল পান করে প্রাণেতে মরে,
ছুটে সেই উল্টো কল নেমেছে ঢল,
শিখতে হবে আপ্তসার।।

ত্রিপানিতে তিনটি ধারা,
নিধারাতে আছে ধরা,
ঠিক রেখ নয়নের তারা।
পলকে প্রলয়, হয়ে যাবি ক্ষয়,
স্থূলে মূলে সকল ভুলে
করতে হবে হাহাকার।।

বাঁকা নদীর পেছল ঘাটে
যেতে হবে নিষ্কপটে
সাধুবাক্য ধরে এঁটে।
তিনদিন বারুণী, তাইতে স্নান শুনি,
নাইলে সে মহাযোগে অনুরাগে,
কাম-কুম্ভীর কি করবে তার।।

রসিক ডুবুরি হলে,
ডুব দিয়ে সেই গভীর জলে,
অনায়াসে রত্নধন তোলে।
গোঁসাই গোবিন কয়,কুবীরচাঁদের জয়,
ভেবে গোপাল মূর্খ, পায় রে দুঃখ,
দিনে দেখে অন্ধকার।।

শ্রীরূপ-নদী নারীর শ্রী-মণ্ডিত বিভা নিয়েই গোবিন্দ গোঁসাইয়ের গানে যেন উঠে এসেছে। শ্রী এখানে নারীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নয়। শ্রী তার রজঃপ্রবাহের স্রোতধারার। এই শ্রীরূপ-নদীটিকে হৃদয় দিয়ে বিচার করার কথা বলা হয়েছে গানে। হৃদয় হল পূর্ণচন্দ্রের। হৃদয়। নারীর রজঃপ্রবৃত্তি হল বাউল সাধকের অমাবস্যা-যোগ। এই অমাবস্যা এই কারণেই, এ সময় সঙ্গিনীর শরীরে অন্ধকারময় কামের ঘনঘটা দেখা দেয়। আর তার ভেতরই পূর্ণচন্দ্রের উদয় হয়। পূর্ণচন্দ্র প্রেম। কামকে বাউল প্রেমে রূপান্তরিত করে নেন। অধর মানুষ হয়ে ওঠেন তিনি। সহস্রারে অটল রূপে বিরাজ করেন তিনি। তাঁর জন্যই শ্রী রূপ নদীতে অবগাহন। পদে বলা হয়েছে: ‘দেখে ভব-গর্ত হলি মত্ত/ আস্বাদন কি বুঝলি তার।’ ভব-গর্ত হল সঙ্গিনীর যোনি। ভব কথার অর্থ জন্ম বাঁ উৎপত্তি। সত্তা, স্থিতি, ইহলোক হিসাবেও ‘ভব’কে আমরা দেখতে পারি। রজঃস্রোতের উৎপত্তিকেই এখানে ভব-গর্ত হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। রজঃবীজকে বাউল সত্তা হিসাবে মানেন। জীবের স্থিতি রজঃপ্রবাহেই আসে। এর আস্বাদন না বোঝার কথাই বলা হয়েছে। কারণ ভবগর্তে নিরবচ্ছিন্ন কামাচার বাউল সাধকের উদ্দেশ্যে কখনও নয়। বাউল সাধনার মুখ্য বিষয় তিন দিনের ক্রিয়া ও শেষে বিশেষ ক্রিয়া। যোগ-মিলনের আগে দুই পর্ব আছে। নামগ্রহণ আর ভাবগ্রহণ প্রবীণ সাধক দয়াল খ্যাপা এ কথা বলেছিলেন আমাকে।

মদনমোহন আশ্রমে বসে দয়ালকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম দেহ মিলনের যোগক্রিয়ার কথা।

বললেন, প্রথমে গুরু নাম দেন। গুরুমন্ত্র জপতে জপতেই শরীর সেই মন্ত্রভাবকে টেনে নেয়। ভাব এলেই ক্রিয়াকরণ শুরু হয়। চারচন্দ্র তো আগে থেকেই নিয়ম করে পালন করতে হয়।

খুব জরুরি কি চারচন্দ্রের ক্রিয়া? জিজ্ঞাসা করলাম।

–অবশ্যই। চারচন্দ্র শরীরকে উপযোগী করে। দম ধরতে সাহায্য করে গিয়ে ওই চারচন্দ্র। এই আমার নিরোগ সুঠাম শরীর নিয়মিত চার চন্দ্র সাধনের ফল।

–আপনি কি এখনও এই ক্রিয়াযোগ করেন? মল, মূত্র শরীরে ফিরিয়ে নেন?

বললেন, এ বিষয়ে তো বলে বোঝানো যাবে না বাবা। গুরু শিষ্যকে শ্বাস নিয়ন্ত্রণ শেখান। এই ক্রিয়া আটবার, বত্রিশবার–এই করে করে রপ্ত করে নিতে হয়। রেচক, পূরক, কুম্ভক করতে হয়। কুম্ভক নাড়ি শোধন করে বাবা। বিন্দুকে স্থিরতা দেয় শরীরে।

গানে যে আস্বাদনের কথা বলা হয়েছে তা হচ্ছে বিন্দুধারণের স্থিরতা। বাউল সাধক বলে থাকেন কুম্ভক ক্রিয়াতে এই শক্তি অর্জিত হয়। বায়ুর সাম্যতা রাখে কুম্ভক ক্রিয়া। মূল-সাধনা বাউলের ধরে রাখে কুম্ভক ক্রিয়াই। প্রথমে যেটা করতে হয় শরীরের বাইরে বায়ুকে বাঁ নাকে টেনে নিতে হয়। প্রাণ বায়ু এতে শরীরের ভেতর প্রবেশ করে। এই জমা বায়ুকে ডান নাকে নিয়ে কিছু সময় রেখে দিয়ে তাকে আবার বাঁ নাকেই ত্যাগ করে দেন দেহসাধক। বাইরের বায়ুকে টেনে শরীরের অভ্যন্তরভাগ পূরণ করাই হল বাউলের পূরক। আর বায়ু যে এভাবে শরীরে ধারণ করে রাখা; শরীরকে বায়ু ভরিয়ে পূর্ণ করে রাখা। তা হল তাঁদের কুম্ভক। আবার বায়ুকে বাইরে বের করে দেওয়া বাউলের রেচক। মূলত দুই বায়ুর ক্রিয়া ইহা। সাধুসন্তরা বলেন প্রথমে ডান হাতের আঙুল দিয়ে ডান দিকের নাকে বায়ুকে রোধ করে ওঁ বা যার যার গুরুমন্ত্র ষোলো বার জপ করতে করতে বাঁ নাকের সাহায্যে বায়ুকে ভেতরে এনে কনিষ্ঠা ও অনামিকা আঙুল দিয়ে বাঁ নাকে রেখে বায়ুরোধে। ওঁ বা গুরুমন্ত্র চৌষট্টিবার জপ করতে করতে কুম্ভক করতে হবে। তারপর আঙুল ডান নাক থেকে তুলে মন্ত্র বত্রিশবার জপ করতে করতে ডান নাকে এনে বায়ু রেচক করতে হবে। এইভাবেই পুনরায় বিপরীতক্রমে অর্থাৎ শ্বাসত্যাগের পর এই ডান নাকের সাহায্যে মন্ত্র। জপ করতে করতে পূরক এবং দুই নাকে কুম্ভক, শেষে বাঁ নাকে রেচক করতে হবে। আবার প্রথমবারের মতো অবিকল দু নাকের সাহায্যে পূরক, কুম্ভক, রেচক করতে হবে। বাউল বলেন কুম্ভক শক্তির উপরই তাঁদের বাণক্রিয়া নির্ভর করে। দেহ মিলনের সময় মদন, মাদন, শোষণ, স্তম্ভন, সম্মোহন–এই পঞ্চবাণের ক্রিয়ার কথা বলে থাকেন বাউল সাধক। লালনের গানে আমরা পাই—’পঞ্চবাণের ছিলা কেটে/ প্রেম যজ স্বরূপের হাটে। সিরাজসাঁই বলে রে, লালন, / বৈদিক বাণে করিস নে রণ, / বাণ হারায়ে পড়বি তখন রণ-খোলাতে হুবড়ি খেয়ে।।’

‘বৈদিক বাণ’ কী? দেহমিলনের সময় কামই কামের একান্ত পরিনাম। কামকে উপভোগ্য স্তরে নিয়ে যাবার জন্যই নরনারী নানা প্রত্যঙ্গে নানারূপ ক্রিয়াকরণে মেতে ওঠেন। কেননা কামকে তাঁরা চুড়ান্ত রূপে ভোগ করতে চান। তার জন্যই কামশাস্ত্রে যৌনমিলনের প্রস্তুতিস্বরূপ নানা আলিঙ্গন, চুম্বন, দেহে নখচিহ্নের স্মরণীক অধ্যায়, দন্তক্ষতের রূপকল্প, ভঙ্গি বা আসন, শীৎকার ধ্বনির নানা রূপের কৌশলক্রিয়ার কথা লেখা হয়েছে। যাতে কাম, সম্ভোগক্রিয়া একেবারে উত্তেজক অধ্যায়ে চলে আসে। নরনারী তৃপ্তি লাভ করেন। বাস্তবিক এই তৃপ্তি। রিপুর উত্তেজনা থেকেই এই আকর্ষণ, মিলন। যে মিলনে তৃপ্তির সাথে সন্তান জন্মেরো এক বিধিবদ্ধ অধ্যায় আছে। তাই বলা ভালো, এই কাম-প্রবর্তিত দেহ-মিলন এবং এতে সন্তান সৃষ্টিই হল বৈদিক বাণ। লালনের গানে এই বাণকৌশলের ইঙ্গিত রয়েছে। বাউল বলেন, বিশ্বাস রাখেন যে, এই পঞ্চবাণের যে ক্রিয়া তাতে রয়েছে কেবল চূড়ান্ত সম্ভোগক্রিয়ায় কামকে উপভোগ। এই কাম ভোগমূলক। লালনের পদে, গুরু সিরাজ সাঁই তাই লালনকে বলছেনেই পঞ্চবাণের ছিলা কেটে ফেলতে হবে। দেহকে কামক্রিয়ার ভেতর না রেখে দেহকে ব্যবহার করতে হবে স্বরূপতত্ত্বকে জানার জন্য। তার জন্যই বাউল সাধক দেহ থেকে কামকে তুলে ফেলে প্রেমে রূপান্তরিত করে ফেলেন। ঠিক যেমন দুধ থেকে সর তুলে মাখন বা ঘি বানানো হয়। কীভাবে বাউল সাধক এই পঞ্চবাণের ছিলা কেটে ফেলেন?

পঞ্চবাণের প্রথম যেটি মদন, বাউল বলেন সেটি কামরতির প্রথম সিঁড়ি। এই সিঁড়ি তিনি টপকে যান কীভাবে? অমাবস্যায় প্রথম মিলনে সঙ্গিনীর দেহের স্পর্শকাতর প্রত্যঙ্গগুলোকে তিনি স্পর্শ করে সঙ্গিনীর শরীরে কামের বাণকে আরো যেন শানিয়ে দেন। উত্তেজনা বৃদ্ধি করে দেন সঙ্গিনীর শরীরে। এই স্পর্শ করনখে, পদনখে, গলায়, অধরে, জিহ্বায়, ললাটে বাউল বলেন সাড়ে চব্বিশ চন্দ্ৰস্পর্শর কথা। করনখে দশ, পদনখে দশ, দুই গলায় দুই, অধরে এক, জিহ্বার এক, ললাটে দেড়। মূলত দৃষ্টিস্পর্শর কথা তাঁরা বলে থাকেন। কীভাবে হয়ে থাকে এই চক্ষুস্পর্শ। আমাদের শরীরস্থ সুষুম্না নাড়ি মূলাধার চক্র থেকে উৎপন্ন হয়ে নাভিমণ্ডলের যে ডিম্বাকৃতি নাড়িচক্র আছে, তার ঠিক মাঝখান দিয়ে উঠে গিয়ে সহস্রার চক্রের ব্রহ্মরন্ধ্র পর্যন্ত চলে গিয়েছে। সুষুম্না নাড়ির বাঁ দিকে রয়েছে ইড়া নাড়ি। দক্ষিণ বা ডানদিকে রয়েছে পিঙ্গলা নাড়ি। এই দুই নাড়ি দু’দিক থেকে উঠে স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত ও বিশুদ্ধ চক্রকে ধনুকাকারে বেষ্টন করে আছে। ইড়া দক্ষিণ নাসাপুট পর্যন্ত এবং পিঙ্গলা বাম নাসাপুট পর্যন্ত গমন করেছে। মেরুদণ্ডের মধ্যে দিয়ে সুষুম্না নাড়ি ও মেরুদণ্ডের বাইরে দিয়ে পিঙ্গলা নাড়ি চলে গেছে। বাউল সাধক দক্ষিণের পিঙ্গলা নাড়িতে কিছু সময় নিঃশ্বাস প্রশ্বাস প্রবাহিত করে দক্ষিণ চোখে দৃষ্টিকে নিবদ্ধ করে রাখেন। মদন বাণের সময় ইড়া নাড়িতে(বাঁ নাকে) শ্বাসগ্রহণ করে মদন বাণের সময় পিঙ্গলাতে নিয়ে যান। মাদনের সময় ডান বা দক্ষিণ নাকে শ্বাসগ্রহণ করে সঙ্গিনীর শরীরে উত্তেজনা বৃদ্ধি করেন। দক্ষিণ বা ডান দিককে তাঁরা বলেন কামের অবস্থা। সেজন্য তাঁরা দক্ষিণকে পরিত্যাগ করেন। শোষণ বাণের সময় তাঁরা যোগাভ্যাসের ক্রিয়াকে চালিত করেন। লিঙ্গ নালে উত্থিত শুক্রকে তাঁরা ঠেকিয়ে রাখেন। স্তম্ভন বাণে যুগল শরীরেই একটা। স্থিরতা আসে। শ্বাসাদির কাজ কিন্তু কিছুটা বাউল সঙ্গিনীও করে থাকেন। বিশেষত কুম্ভক প্রক্রিয়া। স্তম্ভন বাণের সময়ই দেহের বিভিন্ন স্পর্শকাতর অংশ স্থির অচঞ্চল হয়ে পড়ে। সাধক তখন চরম দশায় উত্তীর্ণ হয়ে যান। সম্মোহনের সময় তাঁদের দেহস্মৃতি লুপ্ত হয়। বাহ্য দেহে বিপুল আনন্দের তরঙ্গ উত্থিত হয়ে পড়ে। এরপরই তাঁরা বলেন পরমাত্মার বিকাশ ঘটে। নাভিপদ্ম থেকে হৃদয়পদ্মে এই অনুভূতির জাগরণ ঘটে। এতে তাঁরা নানা। সুমধুর ধ্বনি শুনে থাকেন। পরিশেষে যখন চরম পরিণতি আসে তখন আজ্ঞাচক্রের দ্বিদলপদ্মে তাঁরা মনের মানুষকে উপলব্ধ করে থাকেন। এখন প্রশ্ন বাণক্রিয়া যদি শুধু চক্ষুস্পর্শেরই হবে তবে স্তম্ভন বাণের সময় দেহ স্থির অচঞ্চল হয়ে পড়ছে কেন? যেটা। মনে হয় চন্দ্ৰস্পর্শ। অষ্টমচন্দ্র স্পর্শ এগুলো কোনওটাই আসলে চক্ষুস্পর্শ নয়। প্রত্যঙ্গকে। প্রত্যক্ষ ছোঁয়া। মদনের সময়ই তা শুরু হয়। শ্বাসক্রিয়া দিয়ে সাধন সঙ্গিনীর অঙ্গ স্পর্শ করেন আর সঙ্গিনীও শ্বাসাদির চোখে সাধকের অঙ্গকে নিজ শরীরে একীভূত করে নেন। কামশাস্ত্র মিলন ক্রিয়ার সময় চার প্রকার আলিঙ্গনের কথা বলেছে। সঙ্গিনী সঙ্গীর দিকে আসতে থাকলে যদি তাকে আলিঙ্গন করা সম্ভব না হয়, অথচ সঙ্গিনীকে সঙ্গীর অনুরাগ জানানোর প্রবল ইচ্ছে তখন সঙ্গী অন্য কোনও কাজ করবার ছলে, বুদ্ধি করে সঙ্গিনীর পাশ দিয়ে যেতে যেতে তাঁর শরীরে নিজের শরীর স্পর্শ করবে। একে সৃষ্টক আলিঙ্গন(slight contact) বলে। সঙ্গী কোনও নির্জন স্তাহ্নে থাকলে তাকে সেই অবস্থায় দেখে সঙ্গিনী যদি কিছু নেবার ছলে সেখানে গিয়ে স্তন দিয়ে সঙ্গীকে আঘাত করে তখন সঙ্গী সঙ্গিনীকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে যদি নিজের শরীরে চেপে রাখে সেটা বিদ্ধক আলিঙ্গন (Breast Pressure Embrace)। অন্ধকার জায়গাতে সঙ্গিনীর শরীরের। সঙ্গে সঙ্গী যখন উধৃষ্টক আলিঙ্গন (Huffing Embrace)। আর সঙ্গিনী এবং সঙ্গী যখন উদৃষ্টক আলিঙ্গনে আবদ্ধত অবস্থার কথা ভেবে একা একাই নিজের দুহাত চেপে নিজেকে জড়িয়ে নেয় সেটা পীড়িত আলিঙ্গন (Pressive rubbing embrace)। কামশাস্ত্রে চুম্বনের সঙ্গে পাঁচটি ব্যাপারকে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে–চুম্বন, নখক্ষত, দক্ষত, প্রহণন ও শীক্কার। তবে কামশাস্ত্র কখনওই মিলনক্রিয়ার সময়, তিথি নির্দেশ করেনি। বাউল সাধনে মিলন সময় নির্ণীত। ইড়া নাড়িতে যখন পুরুষের শ্বাস বইতে থাকে। অর্থাৎ চন্দ্র বাঁ নাকে আর সঙ্গিনীর পিঙ্গলা নাড়িতে বাঁ নাকে শ্বাস চলে তখনই মিলনের প্রশস্ত সময় বলে থাকেন বাউল গুরু। এই সময়টা রাতে খাবার ঘন্টা দুই পরে আসে বলে বাউল বলে থাকেন। এটিকে সাধক অর্ধপ্রহর হিসাবে চিহ্নিত করে থাকেন। সময়কাল তাঁরা বলেন দেড় থেকে দুই ঘণ্টা স্থায়ী হয়। এই ক্রিয়ার আরম্ভের সময় প্রথম চলে আলাপন। পরস্পর স্পর্শ করে পরস্পরের প্রত্যঙ্গগুলিকে। তারপরই শুরু হয়ে যায় দমের খেলা। অনেক সাধক বলেন এই সময় কাম-বীজ জপ করতে হয়। আর সঙ্গিনীকে কাম গায়ত্রী।

এই জপক্রিয়া কেন করা হয় জিজ্ঞাসা করেছিলাম প্রবীন প্রাজ্ঞ সাধক দয়াল খ্যাপাকে।

বললেন, কাম-বীজ ও কাম-গায়ত্রী জপে সাধক সাধিকার শরীর রাধা-কৃষ্ণ হয়ে যায়।

জিজ্ঞাসা করলাম, কী এই মন্ত্র?

বললেন, কাম বীজ ক্লীং। ক্লীং কামদেবায় বিদ্বহে পুষ্পবাণায় ধীমহি তন্নো কৃষ্ণ প্রচোদ্দয়াৎ।

–এগুলো কী?

–সব হল কৃষ্ণবীজ। শরীরে কৃষ্ণ জাগানো।

রাধামন্ত্র জপের কথা একবার বলেছিলেন জগদীশ পণ্ডিতের শ্রীপাঠের সদানন্দ বাবাজি।

বললেন, কৃষ্ণই চৈতন্য। তাঁর বীজমন্ত্র হল–ক্লীং কৃষ্ণচৈতন্য নমঃ। রাধা হলেই কৃষ্ণ মেলে। রাধার বীজমন্ত্র তাই জপতে হয় সবসময়।

কী এই মন্ত্র? জিজ্ঞাসা করলাম।

বললেন, ওঁ শ্রীং হ্রীং রীং রাধিকায়ে স্বাহা। আর রাধিকারও গায়ত্ৰীমন্ত্র আছে। হল–ক্লীং রাধিকায়ৈ বিদ্বহে প্রেমরূপায় ধীমহি তন্নো রাধে প্রচোদ্দয়াৎ।

এগুলো সব হল গিয়ে আসলে রক্ষামন্ত্র। ঢিলাইচণ্ডীর সাধু পরিতোষ বাবা একবার আমায় দক্ষিণাকালীর বীজমন্ত্রের ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন।

বললেন, ওঁ ক্রীং ক্রীং ক্রীং হুং হুং হ্রীং হ্রীং দক্ষিণে কালিকে ক্রীং ক্রীং ক্রীং হুং হুং হ্রীং হ্রীং স্বাহা। ক্রীং হল বুঝলি রক্ষা কর। দক্ষিণা কালী আমার মস্তক রক্ষা করো। ক্রীং ক্রীং ক্রীং–এই ত্রিবীজরূপিণী খড়গধারিণী কালিকা আমার ললাট, হুং হুং বীজদ্বয়রূপিনী নেত্রযুগল, হ্রীং হ্রীং বীজদ্বয়রূপিনী আমার কর্ণযুগল রক্ষা করুন। এরপর বলা হয় স্বাহা বাঁ ফটু স্বাহা। বুঝিস এর মানে?

বললাম, আপনি বলুন?

–স্বাহা হল প্রণাম করা। লুটিয়ে পড়া। ফটু হল সর্বাঙ্গে। মানে কালী সারা দেহে বিরাজমান হও। এ হল গিয়ে সাধনের শক্তি।

ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব প্রেমোন্মত্ত হয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে বুঝিয়েছিলেন, ‘তাকে পাণ্ডিত্য দ্বারা বিচার করে জানা যায় না।

তবে কীভাবে তাকে জানা যায়? ঠাকুর গেয়েছিলেন:

কে জানে কালী কেমন?
ষড়দর্শনে না পায় দরশন।।
মূলাধারে সহস্রারে সদা যোগী করে মনন।
কালী পদ্মবনে হংস-সনে, হংসীরূপে করে রমণ।।
 আত্মারামের আত্মা কালী প্রমাণ প্রণবের মতন।
তিনি ঘটে ঘটে বিরাজ করেন, ইচ্ছাময়ীর ইচ্ছা যেমন।।
মায়ের উদরে ব্রহ্মাণ্ড ভাণ্ড, প্রকাণ্ড তা জানো কেমন।
মহাকাল জেনেছেন কালীর মর্ম, অন্য কেবা জানে তেমন।।
 প্রসাদ ভাষে লোকে হাসে, সন্তরণে সিন্ধু-তরণ।
আমার মন বুঝেছে প্রাণ বুঝে না ধরবে শশী হয়ে বামন।।

গান থামিয়ে ঠাকুর বিদ্যাসাগরকে বলেছিলেন, ‘দেখলে, কালীর উদরে ব্রহ্মাণ্ড ভাণ্ড প্রকাণ্ড তা জানো কেমন। আর বলছে, ষড়দর্শনে না পায় দরশন–পাণ্ডিত্যে তাকে পাওয়া যায় না।’

কালী শব্দটির যদি আমরা অর্থ করি তাহলে দাঁড়ায়: কালের সঙ্গে ঈ শক্তি যুক্ত হয়ে হয়েছেন কালী। ঈ হলেন ঈশ্বরী। কালী হচ্ছে আসলেই কালকে উপলব্ধ করার মহাশক্তি। কালীর যে রূপ শিবের বুকে পা দিয়ে জিভ বের করে থাকা, এর অর্থ হল কালী আদ্যাশক্তি হিসাবে পূজিতা। আদ্যাশক্তির অর্থ হল অদনময়ী। অদন মানে ভোগ। যা কিছু আমরা ভোগ করছি তা শুধু পঞ্চইন্দ্রিয় দিয়েই ভোগ করছি না, করছি সর্বাঙ্গ দিয়ে। ঠাকুর বলেছেন ষড়দর্শনে কালীকে জানা যায় না। সাধনার মূল আধারই তো ষড়রিপুকে ত্যাগ করা। বাউলও তো তাই বলেন। বলেন ষড়রিপুকে মারার কথা। তাঁরও তো রয়েছে পঞ্চভূত। যা শরীরস্থ চক্রে জাগিয়ে রাখেন দেহসাধক। বাউলের যে পঞ্চবাণ তা তো রিপু দমনেরই। নিক্ষেপ। এটাই তাঁর অঙ্গীভূত সাধনা। গোবিন্দ গোঁসাই এর যে গান নরোত্তম বাউল। আমাকে শুনিয়েছিলেন সেখানে ‘বিষম সে ত্রিপাণি নদী’র কথা বলেছেন পদকর্তা। তা যেমন তিন নাড়ি তেমনই তিন গুণও। তিন রস হিসাবেও কিন্তু তাকে চিহ্নিত করতে পারি। বাউল বলেন তিনদিনের কারণ-রসে তিন শক্তির আধিপত্য থাকে। প্রথমদিনে ব্রহ্মার, দ্বিতীয় দিনে বিষ্ণুর, তৃতীয় দিনে মহেশ্বরের। বহু বাউল গানেই এই প্রতীকময়তাকে দেখতে পাই। পদকর্তা বলেছেন: ‘ত্রিকোণ যন্ত্র পাতালভেদী / মধ্যে আছে মহা ঔষধি।’ ত্রিকোণ যন্ত্র হল গিয়ে সঙ্গিনীর যোনির অবয়ব। মহাঔষধি রজঃধারা। এই জল নিয়েই বাউলের কারবার। তাই বলা হয়েছে— ‘ওঠে ঘুরনো জল যদি না থাকে গুরুবল/ তবে খুলবে মণিকোঠা বাঁধবে ল্যাঠা/ সেখানে খুব খবরদার।‘ জল ওঠার অর্থ–সঙ্গিনীর সত্তায় রজঃরূপের যখন পূর্ণপ্রকাশ হয় তখন রজঃবীজ মস্তক থেকে নেমে এসে রজঃদ্বারে প্রবাহিত হতে থাকে। এই স্রোতপ্রবাহকে, জলকে সাধক গুরুবলেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। গুরু সেই রজঃস্রোতে সাঁতার কাটতে শেখান। কিন্তু তা করতে গিয়ে মূলাধারের শুক্রের যদি নিয়ন্ত্রণ না থাকে, শুক্র নিম্নগামী হয়ে পড়ে তখন সাধন পথে বিপর্যয়। তাকেই ল্যাঠা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে গানে। নদীর ভিতর গরল-সুধা’র কথা বলেছেন পদকর্তা। যা আসলে প্রথম দিনের রজঃনাম হিসাবে চিহ্নিত। গরল পানের অর্থ হল গরল রসকে ওজে বা মিছরিতে পরিণত করে নেওয়া। গরল স্রোত থেকে কামকে তুলে প্রেমের জলধারাকে সাজিয়ে দেওয়া। আর এ ধারাকেই ‘উল্টো কল নেমেছে ঢল’ বলে চিহ্নিত করে দিয়েছেন গোবিন্দ গোঁসাই। তিন দিনের বারুণী স্নান’ হল–তিনদিনের রজঃযোগে অবগাহন। শাস্ত্রমতে চৈত্রমাসের কৃষ্ণ ত্রয়োদশী শতভিষা নক্ষত্র যুক্ত হলে এই শুভযোগ হয়। এই যোগে গঙ্গাস্নানে পূণ্য লাভ হয়ে থাকে বলে কথিত আছে। বাউলের এই যোগ অমাবস্যার তিথি পদকর্তা তাই বলেছেন: ‘তিন দিন বারুণী তাইতে স্নান শুনি / নাইলে সে মহাযোগে অনুরাগে / কাম-কুম্ভীর কি করবে তার।

ক্রিয়াযোগেই বাউল কামকে বশীভূত করে রাখেন। আলাপনের কথা আগেই বলেছি। ক্রিয়া শুরু হয় তা দিয়েই। এখানে চলে দৃষ্টিস্থাপন। তাঁরা একে ‘নেহার’ বলে থাকেন। স্থিরদৃষ্টি তাঁদের ‘আরোপ’। বহু বাউল গানে এর উল্লেখ আছে। এই অবস্থাতেই কুম্ভক শুরু করেন বাউল। কুম্ভকেই মিলন ক্রিয়ার মূল ভিত্তি। প্রাণ আর অপান বায়ুকে কুম্ভকের সাহায্যে মিলিয়ে দিয়ে ঊর্ধ্বগত হতে যান বাউল সাধক। এই সাধনা তাঁদের দম সাধনা।

সাধন দাস বৈরাগ্য একবার আমাকে বলেছিলেন, বাউল জীবন দমে শুরু দমে শেষ।

জিজ্ঞাসা করেছিলাম, দমক্রিয়া কি শুধু সঙ্গিনীর সঙ্গে দেহ মিলনের সময়ই করে থাকেন বাউল সাধক?

–তা কেন? দমেই তো শরীর গঠন। সঙ্গিনীর সঙ্গে মিলন না হলেও সাধক কি শুক্র ক্ষয় করেন কখনও? করেন না। দমেতেই তো শুক্র উপরে ওঠে। বিন্দুবীজকে তো দমেতেই সাধক শরীরে রেখেছেন।

জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তাহলে চার চন্দ্রের সাধনা কি বাউল সারা জীবন করে করেন।

–সেইভাবে চারচন্দ্র সকল সাধক হয়তো করেন না। তবে বীজকে তো উধ্বগতি দেন সকলেই। না হলে আর সহজ সাধনাটা হল কী করে?

গোবিন্দ গোঁসাই বলেছেন: ‘রসিক ডুবুরি হলে/ ডুব দিয়ে সেই গভীর জলে/ অনায়াসে রত্নধন তোলে।’ বাউলের রত্নধন স্থিতাবস্থা। অভ্যাস-প্রণালীতে অটল হয়ে যাওয়া। বাউল বলেন: ‘টলে বীজ, অটলে ঈশ্বর, / টলাটল ত্যজ্য করে ভজে সেই রসিক শেখর।‘ রস তাঁদের সাধনার মূলবস্তু। রসই তাঁদের অপ্রাকৃত দেহধারী ভাবের মানুষে পরিণত করে রাখে। দ্বিদল পদ্মে বাউল বলেন ভাবের মানুষের দেখা পান। সাধক আর সাধন সঙ্গিনীর দুই আত্মা যখন এক হয়ে ওঠে দমক্রিয়ায় তখনই আজ্ঞাচক্রে এই পদ্ম। ফোটে। বাউল বিকশিত হন মনের মানুষ বা ভাবের মানুষে।

*****

নিয়ামতপুরে প্রতি সাত-ই বৈশাখ খ্যাপাচাঁদের স্মরণ-উৎসব হয়। সেই উপলক্ষ্যে বাউল গানের আসরও বসে। এই আসরেই রামনগরের রসিক ভক্তিদাস বাউলের একখানি গান শুনেছিলাম যেখানে সেই নদীর দখলদারিকেই আয়ত্ব করতে চাইছেন বাউল সাধক।

বাউল গাইছিলেন:

নদী নদী হাতড়ায়ে বেড়াও অবোধ মন!
মিছে ভ্রমেতে কর ভ্রমণ।।
তোমার হৃদয়-রত্নাকরের মাঝে,
আছে অমূল্য রতন।।
 দেহে থাকতে সহজ মানুষ, ধরতে না পারে যে জন।
তাঁর বৃথাই জন্ম, নরের অধম, বিধাতারই বিড়ম্বন।।

কাঞ্চন ত্যাজিয়ে কেবা কাচেতে করে যতন।
যেমন স্বর্গ ত্যাজে ইচ্ছা করি নরকে করে গমন।।
যে যা বলে তারই কথায় দৌড়ে বেড়ায় ত্রিভুবন।
তোমার ঘরের মধ্যে বিরাজ করে বিশ্বজয়ী সনাতন।।

কারুর কথা না শুনিবি, শুনবি স্বগুরুর বচন।
তবে ঘরে বসি দিবানিশি করবি তারে দরশন।।
ছাড়বি না পাইলে রসিক, প্রেমিক, সুজন মহাজন।
ও তোর যে দিনে চৈতন্য হবে, লক্ষ্য করবি নিত্যধন।।
নিতাই দাস বাউলে বলে, শুনশুন সাধুজন।
কেন আত্মতীর্থ ত্যাজ্য করে মিছে তীর্থ পর্যটন।।

শাস্ত্রে বলা হয়েছে–’অন্তঃস্নানবিহীনস্য বহিঃস্নানেন কিং ফলম!’ অর্থাৎ অন্তস্নান বিহীন ব্যক্তির বাহ্যস্নানে কোনো ফল নেই। অন্তঃস্নান কীভাবে করা যায়? এই স্নান সম্পন্ন হয় গুরুর কৃপায়। গুরুই শিষ্যকে আত্মতীর্থ দর্শন করান। কোথায় রয়েছে এই তীর্থ? এই তীর্থ ভ্রদ্বয়ের মধ্যে অবস্থিত। আজ্ঞাপদ্মচক্র। দ্বিদলের পদ্ম। এই পদ্মের কর্ণিকাভ্যন্তরে শরচ্চন্দ্রের ন্যায় নির্মল শ্বেতবর্ণ ত্রিকোণমণ্ডল আছে। ত্রিকোণের তিন কোণে। সত্ত্ব, রজ, তম এই তিনগুণ এবং ত্রিগুণান্বিত ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব এই তিন দেব আছেন। ত্রিকোণমণ্ডলের মধ্যে শুক্লবর্ণের চন্দ্ৰবীজ ঠং দীপ্তিমান হয়ে আছে। ত্রিকোণমণ্ডলের এক দিকে শ্বেতবর্ণ বিন্দু আছে। তাঁর পাশে চন্দ্ৰবীজ প্রতিপাদ্য বরাভয় শাসিত দ্বিভুজ দেববিশেষের কোলে জগন্নিধান-স্বরূপ শ্বেতবর্ণ দ্বিভুজ ত্রিনয়নের জ্ঞানদাতা শিব আছেন বলে সাধক কল্পনা করেন। তিনি এও কল্পনা করে থাকেন যে, দ্বাদশভূজা হাকিনী শক্তিরও বিকাশ এখানেই। আজ্ঞাচক্রের উপরেই ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না–এই তিন নাড়ির মিলন স্থান। এই স্থানের নাম ত্রিকূট বা ত্রিবেণী। ত্রিবেণীর উপরে সুষুম্না নাড়ির মুখের নীচে একটা অর্ধচন্দ্রাকার মণ্ডল আছে। অর্ধচন্দ্রের উপর তেজঃপুস্বরূপ একটি বিন্দু আছে। ওই বিন্দুর উপরে উধ্বাধোভাবে দণ্ডাকার নাদ আছে। এটি দেখতে অনেকটা দণ্ডায়মান তেজোরেখার মতন। এর উপরে শ্বেতবর্ণ একটি ত্রিকোণমণ্ডল অবস্থিত। তাঁর মধ্যে শক্তিরূপে শিবাকার হকারার্ধ্ব আছে। এখানেই বায়ুর ক্রিয়া শেষ হয়ে এসেছে। এই আজ্ঞাপদ্মকেই জ্ঞানপদ্ম বলা হয়ে থাকে। এর অধিষ্ঠাতা পরমাত্মা। ইচ্ছা তাঁর শক্তি। অষ্টশক্তির এক শক্তি। সাধক দেখেন এখানে প্রদীপ্তশিখারূপিণী আত্মজ্যোতি স্বর্ণরেণুর মতোই বিরাজমান। তিনি বলেন এই স্থানেই জ্যোতির্দর্শন হয়। যা হল সাধকের আত্মপ্রতিবিম্ব। এই পদ্মচক্রে ধ্যানে বসলে জ্যোতিঃদর্শন ঘটলে যোগের চরম ফল নির্বাণপ্রাপ্তি হয়।

সাধকে এই আত্মপ্রতিবিম্ব দর্শনই বাউল সাধকের কাছে রস-রতিকে উধ্বর্গত করে উচ্চস্থানে দ্বিদলপদ্মে নিয়ে যাওয়া। টল অটল নয়, একেবারেই সুটল হয়ে যাওয়া।

দয়াল খ্যাপা আমাকে বলেছিলেন, সাধক সাধনা করেন লিঙ্গ শাসনের। লিঙ্গতেই ব্রহ্মাণ্ড থাকে।

কী এই ব্রহ্মাণ্ড? জিজ্ঞাসা করেছিলাম আমি।

বললেন, রজ আর বীর্য। রজ হল স্ত্রীলিঙ্গ। বীর্য হল পুংলিঙ্গ। লিঙ্গ শাসন হয় এই রস রতি দিয়েই। ত্রিবেণী পেরোতে হয়। নদীই হল সাধন। নদীই সাধককে ভবপারে নিয়ে যায়। এর জন্য সাধকের পাঁচতত্ত্ব রপ্ত করতে হয়।

–কী এই পাঁচটি তত্ত্ব?

–বিবেক,জ্ঞান, সংযম, বৈরাগ্য আর ভক্তি। নদী পারাপারে এ তো লাগেই।

গানে নদী হাতড়ে হাতড়ে বেরানোর কথা বলা হয়েছে। অবোধ ঘন নদীকেই কেবল খুঁজে চলেছে। কিন্তু পদকর্তা বলছেন নদী খুঁজতে গেলে আগে হৃদয় রত্নাকরের মাঝে, যে অমূল্য রতন আছে তাকে খুঁজতে হবে। প্রশ্ন হল–হৃদয় রত্নাকর বলতে পদকর্তা কী বোঝাতে চাইছেন?

‘হৃদয় রত্নাকর’ হল অনাহত পদ্মচক্র। হৃদয়ে দ্বাদশদলের পদ্ম একটি। এই পদ্মের কর্ণিকামধ্যে অরুণবর্ণ সূর্যমণ্ডল এবং ধূম্রবর্ণ ষট্‌কোণবিশিষ্ট বায়ুমণ্ডল আছে। তাঁর একদিকে ধূম্রবর্ণ বায়ুবীজ যং আছে। এই বায়ুবীজের মধ্যে চতুর্ভুজ বায়ুদেব কৃষ্ণসাধিরোহণে অধিষ্ঠিত। তাঁর কোলে বরাভয়-লসিতা ত্রিনেত্রা সর্বালঙ্কারভূষিতা মুণ্ডমালাধরা পীতবর্ণা কাকিনী শক্তি বিরাজিতা। সাধককে এই বায়ুবীজকে জাগরিত করতে হয়। বায়ুপথ ঠিকঠাক প্রসারিত না হলে, হাওয়া না খেললে, দম ঠিক না হলে কখনওই বাউল সাধক নদীপথকে শাণিত বা চালিত করতে পারেন না। ভেতর নদীতে অন্তস্নান না হলে বাউল তিন রতির রসে, বাঁকা নদীতে অবগাহন করবেন কী রূপে! বাঁকা নদী তো আসলেই স্ত্রী জননাঙ্গের প্রতীক। নদীর বেগ হল বাউলের কামনা। বাউল সাধক বলেন। তাঁদের সাধনা হল গিয়ে পরকীয়া সাধনা। পরকীয়ার অর্থ তাঁরা করেন কিন্তু নিষ্কাম সাধনা। স্বকীয়া তাঁদের স্বকামের নামান্তর। তাঁদের মত গৃহী লোকের পথ এটি। বাউল স্বকীয়া থেকেই পরকীয়াতে যায়। পরকীয়া সাধনে মনকে তাঁরা মৃত প্রতিপন্ন করেন। অচঞ্চল মনকে তাঁরা মৃত হিসাবেই ঘোষণা করে থাকেন–’য চঞ্চলতাহীনং তন্মনো মৃতমুচ্যতে।‘

গানে ‘হৃদ্যে-রত্নাকরের’ মাঝে অমূল্য রতন আছে বলার অর্থই হল বায়ুকে চেনা-জানা, তার সঙ্গে বসতি করার কথা বলা। কেননা শ্বাসের কাজ রপ্ত না হলে নদীরূপী নাড়িও জাগবে না। অন্তস্নানও হবে না। আর বাঁকা নদীর পেছল ঘাটে দম আটকে পড়ে থাকতে হবে।

প্রবৃদ্ধ সাধক শশাঙ্কশেখর দাস বৈরাগ্য একবার আমায় বলেছিলেন, বুঝলে বাবা, সাধকের হল–বায়ুর ঘর বায়ুর বাড়ি বায়ু নিয়ে নাড়িচাড়ি। এই নাড়াচাড়া না হলে সাধক সিদ্ধ হবেন কোন প্রকারে শুনি?

বললেন, বায়ু কী জানো বাবা?

বললাম, কী?

–বায়ু হল বীজাবস্থা। শুদ্ধ চৈতন্য বায়ু। বায়ু না হলে শক্তিতত্ত্ব আর শিবতত্ত্ব জাগবে কীভাবে? এই শক্তি কোথা থেকে আসে জানো বাবা?

জিজ্ঞাসা করলাম, কোথা থেকে?

–মায়া থেকে বাবা।

–মায়া তো পাশ বলেন আপনারা? জিজ্ঞাসা করলাম।

–মায়া তো পাশই বাবা। মায়া মুক্ত হলে আসে শুদ্ধ মায়া। আর এই শুদ্ধ মায়া থেকেই শক্তি ও শিব জাগরিত হয়। যুগল নেয় সত্তা। মায়া হল শরীরের সব সৎ বৃত্তি। অসৎ কী জানো বাবা?

বললাম, আপনার চোখে অসৎ কী? আমি যে অর্থে অসৎ বলব তা হয়তো আপনার সঙ্গে মিলবে না।

বললেন, তা তুমি যে অর্থেই বল অসৎ আসলেই হল অনস্তিত্ব মন। মায়া যে সৎ বৃত্তি তার কারণ মায়া অস্তিত্বের প্রকাশ। মায়াকে শুদ্ধ মায়াতে আনতে হবে। শরীরকে, মনকে অনস্তিত্বের জায়গায় আনতে হবে। তবে না আনন্দশক্তির আত্মপ্রকাশ আসবে। ঘর কী?

বললাম, কী?

বললেন, ঘর হল গিয়ে দেহক্রিয়া। মূলাধারের অস্থি, স্বাধিষ্ঠানের মেদ, মণিপুরের মাংস, অনাহতের রক্ত, বিশুদ্ধের ত্বক আর আজ্ঞার মজ্জা নিয়ে ঘর গঠিত। ঘরকে আগে ক্রিয়াশীল করতে হবে। গুরুই তো ঘরকে দেখায়, চেনায়, জানায়।

খ্যাপাচাঁদের উৎসবে বাউল গিয়েছিলেন–’কারুর কথা না শুনিবি, শুনবি স্বগুরুর বচন। / তবে ঘরে বসি দিবানিশি করবি তাঁরে দরশন।‘

বাউলের এই দেখা, অনস্তিত্বের স্বীকৃতি, অন্তরাত্মার ভেতর মনের মানুষের আনাগোনা নিয়েই বাউলের পথ চলা।

দয়াল খ্যাপা বলেছিলেন, পথ কেমন?

–কেমন সে পথ? জিজ্ঞাসা করেছিলাম।

–পথ হল আনুগত্য। সব উজাড় করে দিলে তারে, তবেই পথ মেলে।

–পথচারী কারা?

জিজ্ঞাসা করলাম, কারা?

–নাড়ি, হৃদয়–এরা হল সব পথচারী। তাদের গুনগুন না শুনলে তুমি পথ পাবা না কোনওকালে। পথ হল ভোমরা। সদানন্দ ভোমরা।

ষষ্ঠী খ্যাপা একবার আমাকে বলেছিলেন, বাউলের পথ হল একতারা। তা খ্যাপা জানো কী এই একতারা?

— কি? জিজ্ঞাসা করেছিলাম।

বললেন, একতারা হল একতানে নিজেরে বেঁধে ফেলা। গানে। মানে।

আমি সেই মনের প্রজ্জ্বলিত ধ্বনি নিয়েই ভাবছি, বাউলের গান কতখানি আজ বাজতে পারে প্রতীকী সেই একতারায়? আমাদের মনে এখন মনেরই কৈশোর বার্ধক্যে উপনীত হয়ে বসে আছে। বাউলের দাউ দাউ আদর্শেও তো ঘুণ ধরেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *