১৮৮৬ থেকে ১৮৯৬।
এই দশ বছরের মধ্যে আমাকে পাঁচটি ছেলেমেয়ে দিলেন আপনাদের রবি ঠাকুর।
আঁতুড়ঘর থেকে আমি তো প্রায় বেরোতেই পারিনি।
আমার সঙ্গে রবি ঠাকুরের বিয়ে হল ১২৯০-এর ২৪শে অঘ্রাণ। ওঁর কাছে পরে জেনেছি, ইংরেজি তারিখটা ছিল ১৮৮৩-র ৯ই ডিসেম্বর।
আমার বয়েস তখন ন’বছর ন’মাস।
আর আপনাদের রবীন্দ্রনাথ কী সুন্দর দেখতে। তরতাজা তেইশ।
আমার প্রথমটি মেয়ে। বেলা। ও পেটে এল আমার এগারো বছর ক’মাস বয়েসে।
প্রথম মা হয়ে মেয়ের মুখ দেখলাম বারো বছর বয়েসে। সেই শুরু।
আমার বড় ছেলে রথী পেটে এল পরের বছর। জন্মাল ১৮৮৮-র ডিসেম্বরে।
এর পর জন্মাল আমার সেজো মেয়ে, আমার তৃতীয় সন্তান রেণুকা।
তারিখগুলো সব গন্ডগোল হয়ে যায়। যতদূর মনে পড়ছে রেণুকা বা রানির জন্মদিন ১৮৯১ এর ২৩শে জানুয়ারি।
অই যাঃ। আপনাদের রবি ঠাকুরের মতো আমি লেখক নই। গুছিয়ে লিখতে পারিনে।
বেলা, যার ভালো নাম মাধুরীলতা, তার জন্মদিন আর রথীর জন্মদিনের কথা তো বলাই হল না।
যতদূর মনে পড়ছে, বেলা জন্মেছে ১৮৮৬-র ২৫শে অক্টোবর, মনে আছে, পুজোর মাস। আর রথীর জন্মদিন ২৭শে ডিসেম্বর।
শীতকাল, খুব শীত পড়েছিল সেবার, আঁতুড়ঘরে খুব কষ্ট পেয়েছিলুম। শীতকালে যাদের
ছেলেপুলে হয়েছে সেই মায়েরা বুঝবে আমার কষ্টের কথা।
রেণুকা জন্মাল আবার শীতকালেই।
শীতকাল মানেই যেন আঁতুড়ঘর।
শীতকাল এলেই আমার ভয় করত।
জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি কী সুন্দর বাড়ি বলুন তো! কিন্তু সে-বাড়ির ওই আঁতুড়ঘরটা যদি দেখতেন, বুঝতেন কেন বলছি এ-কথা।
শীতকালে ওই ঘরটা ছিল বাড়ির সবচেয়ে ঠান্ডা আর অন্ধকার ঘর। এতটুকু রোদ্দুর ঢুকত না।
আমার ছোট মেয়ে মীরা, যার একটা পোশাকি নামও আছে–অতসীলতা—সেও আমাকে রেহাই দিল না।
জন্মাল সেই শীতকালেই।
মাপ করবেন যদি তারিখের গন্ডগোল করে ফেলি। এতগুলো জন্মদিন তো। মীরা জন্মাল ১৮৯৪-এর ১২ই জানুয়ারি।
উনি হেসে বললেন, ‘আমার কনিষ্ঠ শাবক।’
‘আমাদের’ বললেন না কেন?
চোখে জল এল আমার।
১৮৯৬ সালে এল আমার ছোট ছেলে। আমার পাঁচ নম্বর। শমী। শমীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ঠিক ওঁর মতো দেখতে।
ও নিশ্চয় শীতকালে জন্মায়নি?
আপনারা ভাবছেন তো!
শমীও শীতে।
১২ই ডিসেম্বর।
আমার পাঁচ ছেলেমেয়ের চারটিই শীতকালে।
আর বেলা মানে মাধুরীলতা, ও শরৎকালে।
কী আশ্চর্য, ওর বরের নামও শরৎ! ওঁকে একদিন মজা করে বললুম, দ্যাখো তো, বেলির সঙ্গে শরতের সম্পর্ক সেই জন্ম থেকেই।
উনি এতটুকু হাসলেন না।
উনি যে কতবার বলেছেন, আমার কোনও রসবোধ নেই। যে-মেয়েদের সঙ্গ উনি পছন্দ করেন, যাদের কথা শুনতে, যাদের সঙ্গে কথা বলতে, যাদের চিঠি লিখতে ওঁর ভালো লাগে, তাদের মধ্যে আমি পড়ি না। একটিই কারণ, আমার তেমন শিক্ষাদীক্ষা নেই। সুতরাং বোধবুদ্ধিরও খোলতাই হয়নি।
ইন্দিরা, আমার মেজোভাশুর সত্যেন ঠাকুরের মেয়ে, আমার চেয়ে মাস কয়েকের ছোট, ওর সঙ্গে আপনাদের রবি ঠাকুরের খুব ভাব। উনি যে কত চিঠি ওকে লিখেছেন।
আর সে সব কী লম্বা-লম্বা চিঠি। চিঠি নয় তো, সব মনের কথা, কত ভাবনা, আমাকে কোনওদিন বলেন না সেসব।
ইন্দিরা যে ওঁর ভাইঝি, সে কথা উনি ভুলে যান।
মনে হয় ইন্দিরা ওঁর বন্ধু। মনের মানুষ।
পরের চিঠি পড়তে নেই। তবু আমি ইন্দিরাকে লেখা কিছু-কিছু চিঠি না পড়ে পারিনি। সব যে বুঝতে পেরেছি তা নয়।
তবে একটা জিনিস বুঝতে পেরেছি।
ইন্দিরার সঙ্গে উনি হৃদয়ের কথা বলতে পারেন।
কোনও রাখঢাক নেই। সব কথা।
কারণ, উনি জানেন, ইন্দিরা বুঝতে পারে।
আমার সঙ্গে মনের কথা বলেন না।
আমি যে বুঝতে পারব না, উনি খুব ভালো করেই জানেন।
আমার মনে আছে বিবিকে, মানে ইন্দিরাকে, ওর ডাক নাম তো বিবি, ও তো খুব মেমসায়েব মেমসায়েব, কতদিন বিলেতে ছিল, তাই ওর ডাক নাম বোধহয় বিবি, ইংরিজিতে কথা বলতে পারে, আবার ফরাসিতেও কথা বলতে পারে, ওকে একটা চিঠিতে উনি লিখেছেন, আমার স্পষ্ট মনে আছে—
তোকে আমি যে-সব চিঠি লিখেছি তাতে আমার মনের সমস্ত বিচিত্র ভাব যেরকম ব্যক্ত হয়েছে এমন আমার আর কোনও লেখায় হয়নি…তোকে আমি যখন লিখি তখন আমার এ কথা কখনও মনে উদয় হয় না যে, তুই আমার কোনও কথা বুঝবি নে, কিংবা ভুল বুঝবি, কিংবা বিশ্বাস করবি নে, কিম্বা যেগুলো আমার পক্ষে গভীরতম সত্য কথা সেগুলোকে তুই কেবলমাত্র সুরচিত কাব্যকথা বলে মনে করবি।
এসব হুবহু ওঁর কথা।
আর কারই বা হবে?
এরকম আর কে লিখতে পারে?
এত ভালো লেগে ছিল, অনেকবার পড়েছিলুম।
তাই ভুলিনি।
একদিন বললুম, বিবির সঙ্গে যেমন মনের কথা বলো, আমার সঙ্গে বলো না কেন?
বলেই মনে হল, ইস! কেন বললুম? নিজেকে খুব ছোট মনে হল। আর খুব লজ্জা করল। আর একটু ভয়ও করল।
উনি রেগে যাবেন না তো?
রাগ তো উনি প্রকাশ করেন না। শুধু গম্ভীর হয়ে যান। উনি কিন্তু সামান্য হাসলেন।
আমি দেখলুম ঠোঁটে হাসিটুকু মিলিয়ে যেতেই ওঁর বড়-বড় চোখ দুটির মধ্যে কেমন যেন ব্যথার ভাব জেগে উঠল।
উনি মৃদুভাবে বললেন, তোমার সঙ্গে মনের কথা কতবার তো বলেছি। আমি কথা বললে তো মনের কথাই বলি।
–কই বলো? শুধু তো সংসারের আর দরকারের কথা বলো।
আবার ওর মুখে হাসি ফুটে উঠল। উনি কী সুন্দর ছড়া করে বললেন—
তুমি মোরে পার না বুঝিতে?
কিছু আমি করিনি গোপন।
যাহা আছে সব আছে তোমার আঁখির
কাছে
প্রসারিত অবারিত মন।
আমি বললুম, তুমি আমার এত কাছের মানুষ, তোমার সঙ্গে এত বছর ঘর করছি, তবু তোমার মন কী জানি কেন আমি বুঝতে পারিনে। অন্যদের তো পারি। তোমাকে পারিনে।
এবারও উনি হাসলেন বটে। কিন্তু এইটুকু বুঝলাম, সেই হাসির মধ্যে কোথাও ব্যথা আছে ঠিক ব্যথা নয়, অভিমান। আবার উনি কবিতা করে জবাব দিলেন—এই রকম কিছু একটা–
এ যে সখী, সমস্ত হৃদয়।
এ রাজ্যের আদিঅন্ত নাহি জান রানি।
এ তবু তোমার রাজধানী।
আরও যেন কীসব বলেছিলেন, কোথা জল কোথা কূল, দিক হয়ে যায় ভুল, এইরকম কিছু।
আমি বললুম, কবিতাই বলো আর যাই বলো, তোমার সঙ্গে এত বছর থাকলুম, তোমার ছেলেমেয়ের মা হলুম, তোমার সংসার টানলুম, কিন্তু তোমার মনের কতটুকু পেলুম? অন্যেরা অনেক বেশি পেয়েছে। আমি কতটুকু পেয়েছি বলো? সবসময় মনে হয় একটা আড়াল। কিছুতেই সেই আড়ালের ওপারে যেতে পারিনে।
উনি আমার কথা শুনে হো-হো করে হেসে উঠলেন।
এ-হাসি মোটেই খুশির নয়।
আমি খুব লজ্জা পেলুম।
উনি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আবার কবিতায় বললেন—
নাই বা বুঝিলে তুমি মোরে।
বুঝা যায় আধো প্রেম,
আধখানা
মন—
সমস্ত কে বুঝেছে কখন?
আমি মনে-মনে বললুম, কেন, তোমার নতুন বউঠান বোঝেননি? তোমার আদরের ভাইঝি বিবি বোঝে না?
কিন্তু এসব কথা সত্যি-সত্যি বলা যায় নাকি?
বুকের মধ্যে কান্না হয়ে জমে থাকে। বুকটা আমার হিমঘর।
ওখানে অনেক কান্না আর সন্দেহ জমে বরফ হয়ে আছে।
উনি তখন শিলাইদহে। আপন মনে রয়েছেন সেখানে মাসের-পর-মাস।
আমি কলকাতায় সংসার টানছি।
ওঁর চিঠি প্রায় রোজই আসে।
আমাকে লেখেন না।
লেখেন বিবিকে।
আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করে ওঁকে। মন কেমন করে।
কিছুদিনের জন্যে বাচ্চাদের নিয়ে গেলাম ওঁর কাছে।
আমাদের সেই ‘আসা’ নিয়ে উনি বিবিকে চিঠি লিখেছিলেন।
তখন জানতুম না।
পরে একদিন ইন্দিরাই হাসতে-হাসতে দেখিয়েছিল সেই মজার চিঠি।
মজার চিঠিই বটে!
আমাদের রবি ঠাকুর জানাচ্ছেন ইন্দিরাকে, শিলাইদহের আকাশ, পদ্মার বাতাস আর নির্জনতা তাঁকে বেষ্টন করে আছে হৃদয়পুঞ্জের মতো। পরশু থেকে সেই আকাশ-বাতাস-নির্জনতা
আর থাকবে না। কারণ, পরশু তাঁর ওখানে ‘জনসমাগম’ হবে।
জনসমাগম? মানে, আমি, আমাদের ছেলেমেয়েরা ওঁর কাছে অবাঞ্ছিত ভিড়? আমরা এলে নাকি ওঁর পরিচয় পর্যন্ত পালটে যাবে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলুম না—উনি কিন্তু ইন্দিরাকে সত্যিই লিখেছেন—
ওরা এলে আমি তখন তমুকের বাপ, অমুকের স্বামী শ্রীযুক্ত অমুক। সত্যিই তো, এইরকম অবাঞ্ছিত ভিড়ের মধ্যে কি প্রাণের মেয়ে ইন্দিরাকে চিঠি লেখা যায়?
উনি কী করে ভুলে গেলেন, যাকে উনি মনের কথা জানিয়ে প্রায় রোজ লিখছেন, পাতার-পর পাতা, সেই মেয়ের উনি কাকা? শুধু আমরাই পারিবারিক ভিড়?
আর ওঁর আদরের বিবি?
ঠিক কথা, আপনাদের রবি ঠাকুর যা বলেছেন, আমি মেনে নিচ্ছি, আমার কোনও রসবোধ নেই।
কিন্তু রসবোধ যাদের না থাকে, তারা হিসেবে খুব পাকাপোক্ত হয়।
আমি একটা হিসেব করেছি।
১৮৮৭ থেকে ১৮৯৫। এই আট বছরে অন্তত দুশো বাহান্নখানা চিঠি লিখেছেন আপনাদের রবি ঠাকুর তাঁর ভাইঝি ইন্দিরাকে। আর আমাকে দিয়েছেন পনেরোখানি চিঠি, পাঁচটি সন্তান। বেশ করেছেন। আমি নালিশ করছিনা।
আমাকে যদি দুশো বাহান্নটা চিঠি লিখতেন, খুব বিপদে পড়তুম আমি।
আদ্দেক চিঠি তো আমি বুঝতেই পারতুম না।
পারি না পারি, উত্তর তো দিতে হত।
আড়াইশো চিঠি পেলে তো অন্তত পঞ্চাশটা চিঠি লিখতে হত। চিঠি লেখা আমার ধাতে নেই।
উনি আমাকে যে-ক’টি চিঠি লিখেছেন তার ক’টির উত্তর পেয়েছেন উনি?
এই অবিচারটা আমি করেছি। ইচ্ছে যে করত না চিঠি লিখতে তা নয়। কিন্তু যেই মনে হত আমার স্বামী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, এক লাইনও লেখার সাহস হত না।
তবে আমাকে যে-ক’খানি চিঠি উনি লিখেছেন, পড়লে মনে হয় না সেই সব চিঠির লেখক স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। মাঝেমধ্যে কী কর্কশ তিনি!
কোথায় গেল তাঁর ভাষার গুণ, নরম-নরম ভাব?
ইন্দিরাকে কখনও তিনি এরকম ভাষায় চিঠি লিখেছেন?
আমার কী ভাগ্য! আমি রবি ঠাকুরের বউ!
আমি চিনেছি, জেনেছি এক অন্য রবীন্দ্রনাথকে।
যে-রবীন্দ্রনাথের পরিচয় পৃথিবীর আর কোনও মেয়ে পায়নি।
একবার ওঁকে চিঠি লিখলুম, জোড়াসাঁকোর বাড়িতে কিছু ভালো গব্যঘৃত পাঠাবার জন্যে।
উত্তরে উনি লিখলেন সাজাদপুর থেকে–আমি কোনওদিন ভুলব না সেই চিঠি–
আচ্ছা, আমি যে তোমাকে এই সাজাদপুরের সমস্ত গোয়ালার ঘর মন্থন করে উৎকৃষ্ট মাখনমারা ঘেৰ্ত্ত সেবার জন্যে পাঠিয়ে দিলুম তৎসম্বন্ধে কোনও রকম উল্লেখমাত্র যে করলে না তার কারণ কি বলো দেখি? আমি দেখছি অজস্র উপহার পেয়ে পেয়ে তোমার কৃতজ্ঞতা বৃত্তিটা ক্রমেই অসাড় হয়ে আসছে। প্রতি মাসে নিয়মিত পনেরো সের করে ঘি পাওয়া তোমার এমনি স্বাভাবিক মনে হয়ে গেছে যেন বিয়ের পূর্বে থেকে তোমার সঙ্গে আমার এই রকম কথা নির্দিষ্ট ছিল। তোমার ভোলার মা যখন আজকাল শয্যাগত তখন এ ঘি বোধহয় অনেক লোকের উপকারে লাগচে। ভালোই তো। একটা সুবিধা, ভালো ঘি চুরি করে খেয়ে চাকরগুলোর অসুখ করবে না।
কী মনে হয়? আপনাদের চেনা রবীন্দ্রনাথ? তিনি এই ভাবে ও ভঙ্গিতে কথা বলতে পারেন! বিশ্বাস করতে একটু কষ্ট হচ্ছে তো? আমি মা হিসেবে কতদূর অপদার্থ সেকথাও একটি চিঠিতে জানাতে উনি কসুর করলেন না।
আমি যশোর জেলার ফুলতুলি গ্রামের মেয়ে।
বাঙাল তো বটেই। তার উপর আবার আমার বাবা বেণীমাধব জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির সেরেস্তার কর্মী।
সত্যি কথা বলব?
এমন অসম বিয়ে হওয়া উচিত নয়।
রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী হওয়ার কোনও যোগ্যতাই আমার নেই। না বংশমর্যাদায়। না শিক্ষায়।
একটি চিঠিতে ওঁর ভেতরের কথাটা দপ করে জ্বলে উঠল—
একেই তো বাঙাল। ছিঃ, ছেলেটাকে পর্যন্ত বাঙাল করে তুললে গো।
এইভাবে, আসতে-আসতে অন্য এক রবি ঠাকুরকে আমি জানতে পেরেছি। আমি রবি ঠাকুরের বউ না হলে এই মানুষটিকে আমি চিনতেই পারতুম না।
আমার কোনও রসবোধ নেই, একথা উনি নানাভাবে আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন।
কিন্তু আগেই বলেছি রসবোধ যাদের নেই, তারা পাকা হয় হিসেবপত্তরে। আমি আরও একটি হিসেব করেছি।
সেই হিসেব এইরকম—
আমার প্রথম সন্তানের জন্মের দু-বছর দু-মাস পরে জন্মাল আমার দ্বিতীয় সন্তান। বেলার পরে রথী। ঠিক তিন বছর পেরোতে-না-পেরোতেই আমার তিন নম্বর, রেণুকা। আবার দু-বছর কয়েক মাস, আমার চার নম্বর মীরা। মীরা জন্মের প্রায় পরে পরেই পেটে এল আমার পাঁচ নম্বর, শমী। শমীই রবি ঠাকুর আর আমার শেষ সন্তান—তাই তো জানেন আপনারা? একটু ভুল জানেন।
একটা অন্য গল্প আছে।
আমার সর্বনাশের গল্প।
কিন্তু আপনারা রস পাবেন। ভালোই লাগবে। এ-গল্পটা তিনজন জানি।
আমি।
উনি।
হেমলতা ঠাকুর।
হেমলতা মানে আমার বড়ভাশুর দ্বিজেন্দ্রনাথের বড় ছেলে দ্বিপেন্দ্রনাথের দ্বিতীয় বউ। আমার ভাশুরপো-বউ।
হেমলতা আমার খুব বন্ধু। এক্কেবারে আমার সমবয়সি। দুজনেই জন্মেছি ১৮৭৪-এ।
ওকে সব বলেছি। ঘটনাটা ঘটেছে সম্প্রতি।
আমি শান্তিনিকেতনে।
ঘনঘোর বর্ষা।
বোলপুরের মুন্সেফবাবুর বাড়ি নেমন্তন্ন খেতে গিয়েছিলুম। এ-বছরেই অর্থাৎ ১৯০২-এর আষাঢ় মাসে। বর্ষার জলে ওদের বাইরের সিঁড়িটা বেশ পেছল হয়েছিল।
পা পিছলে পড়লুম।
পেটে চোট লাগল।
আমার তখন ‘কয়েক মাস।’
আপনাদের রবি ঠাকুর আমাকে আরও একবার কৃপা করেছিলেন তো। বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে গেল।
আর আমার যা হবার তাই হল। সর্বনাশ। রক্ত আর থামে না।
আমার বয়েস আঠাশ।
আমার বিয়ের বয়েস উনিশ।
আমার আর বাঁচার ইচ্ছে নেই।
শক্তিও নেই।
সমস্ত জীবনটাই কেমন আবছা মনে হচ্ছে।
কেন জন্মেছিলুম?
কেন এত কষ্ট পেলুম?
রাতে ঘুম আসছে না আমার।
সমস্ত শরীরে জ্বালা।
ঘর অন্ধকারে।
সেই অন্ধকারে উনি আর আমি।
আমি বিছানায় মরা পাতার মতো শুয়ে আছি।
উনি বসে-বসে আমাকে হাত-পাখার বাতাস করছেন। উনি অনেক রাত পর্যন্ত আমাকে বাতাস করেন। আমি শুতে বলি।
কিছুতেই কথা শোনেন না।
হঠাৎ বললেন, ছোটবউ, একটা কথা তোমার কাছে স্বীকার করতে প্রাণ চাইছে।
তুমি আমার সঙ্গে এতদিন ঘর করলে, নিশ্চয় বুঝেছ, ভিতরে একটা জায়গায় আমি নির্মম।
—না গো, তুমি নির্মম নও। তুমি খুব দয়ালু, খুব ভালো। কত যত্ন করছ আমাকে।
না ছোটবউ, আমি নির্মম, আমি অনাসক্ত। কেন জানো?
—না তো।
শোনো। আমি জানি আমি অনেক দূরের যাত্রী। অনেক পথ পেরোতে হবে আমাকে।
—তাই নির্মম হতে হবে?
—এই দীর্ঘ যাত্রার জন্যেই বন্ধুবান্ধব, সংসার, তোমাকে, আমার ছেলেমেয়েদের…আমি কোনও কিছু আঁকড়ে ধরিনি।
—কোথায় পৌঁছতে চাও তুমি?
—জানি না। শুধু জানি অনেক পথ পেরোতে হবে। আটকে পড়লে চলবে না।
—তুমি এগিয়ে যাও। আমার ভালোবাসা আর শুভেচ্ছা রইল।
–ছোটবউ, আমার মধ্যে একটা প্রবল শক্তি আছে। আমি জানি, সেই শক্তি বিচিত্র পথে ধীরে-ধীরে নিজেকে প্রকাশ করবে। ভিতরে ভিতরে আমি যদি নিষ্ঠুর না হই তাহলে সেই শক্তিকে আমি বাঁচিয়ে রাখতে পারব না। যদি জড়িয়ে পড়ি, আমার সব নষ্ট হয়ে যাবে।
অন্ধকারের মধ্যে আমার গাল বেয়ে নামল চোখের জল। উনি দেখতে পেলেন না। মনে-মনে বললাম, আমার রবি ঠাকুর, আমি অন্তত তোমাকে খুব তাড়াতাড়ি মুক্তি দেব।