প্রীতি উপহার (উপন্যাস)
প্রথম পরিচ্ছেদ
বসন্তের নূতন বাতাসে পৃথিবীতে একটা নূতন জীবনের অভিনয় অনুভূত হইতেছিল। আম গাছের নূতন মুকুলে মৌমাছিরা ঝাঁকে ঝাঁকে মধু সংগ্রহে ব্যস্ত। লতাপত্রে নবীনতা-প্রকৃতি হাস্যময়ী। মাঠের পার্শ্বে শ্যামশল্প কুঞ্জসারিগুলি পুলক সৌন্দর্যে মুখরা।
হালিমার বয়স চৌদ্দন সবে যৌবন সীমায় পদার্পণ করিয়াছে, কয়েক মাস পরে চাচাত ভাই আবদুল গণির সহিত তাহার বিবাহ হইবে।
হালিমা ভিতর ও বাহিরের সৌন্দর্যে সম্পদশালিনী কুসুমে কমনীয়তা, নূতন পাতার নবীনতা, জোছনার মাধুরী তার মধ্যে বিদ্যমান।
হালিমার পিতা নাই, মা আছেন। তিনি ইচ্ছা করেছেন, মেয়েকে দূরে বিবাহ না দিয়া দেবর-পুত্র আবদুল গণির সহিত বিবাহ দেন।
আবদুল গণিও পিতৃহীন। তাহার মায়ের ইচ্ছাও হালিমাকে বধূরূপে গ্রহণ করেন, কারণ সৎস্বভাবা কন্যা সব সময় পাওয়া কঠিন। তাহা ছাড়া বিশ্বস্তসূত্রে বুঝিয়েছেন, তাহার পুত্র হালিমাকে বড় পছন্দ করে।
আবদুল গণি বাংলা সাহিত্যের ব্যুৎপন্ন, ম্যাট্রিকুলেশন পাশ। জগতের খবর রাখা তাহার অভ্যাস। সে চাকরি করে না। কোনো ব্যবসায়ীর দোকানে কিছুদিন ছিল, এখন নিজেই ব্যবসায় আরম্ভ করিয়াছে।
মহকুমায় তাহার দোকান। নানা রকমের ফসল কিনিয়া ভিন্ন ভিন কেন্দ্রে চালান দেয়।
বসন্তের এক স্নিগ্ধ অপরাহে হালিমা ছাদের উপর বসিয়া দূর গ্রাম্য গগনের পানে চাহিয়াছিল, এমন সময় কুলসুম আসিয়া সেখানে উপস্থিত হইলেন। কুলসুম হালিমার ভাবি।
হালিমার বড় ভাই হাকিমী চিকিৎসা করেন। মৌলবী হইবার পর কয়েক বৎসর শাস্ত্র। অধ্যয়ন করিয়া এখন কলিকাতায় ব্যবসায় আরম্ভ করিয়াছেন। তিনি বেশ বিচক্ষণ ব্যক্তি।
কুলসুম সুন্দরী এবং বুদ্ধিমান, চিত্ত ও রুচি তাহার মার্জিত। তিনি হালিমাকে ভালবাসেন। তার ইচ্ছা হালিমা বিবাহের পর আদর্শ বধূ হয় এবং শুভ আকাঙ্ক্ষা পূর্ব হইতেই নন্দাকে কতকগুলি উপদেশ দিবেন এই কল্পনা করিয়াছেন।
বিবাহিত হইয়া কুলসুম অনেক নূতন জ্ঞান লাভ করিয়াছেন এবং এই জ্ঞানলাভ যে খুব সহজে হইয়াছে তাহা নহে। ঠেকিয়া শিখিবার পূর্বে, তিনি ইচ্ছা করিয়াছেন, হালিমাকে কিছু শিখাইয়া দেন। কুলসুম হালিমার মুখের দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “হালিমা, কী ভাবছ?”
হালিমা বিস্ময়ে চাহিয়া কহিল, “ভাবি, আসুন। বিকেল বেলায় জীবনভরা বাতাস বয়ে যায়, আপনি নিচে পড়ে কী কচ্ছিলেন”?
কুলসুম : আম্মা একা একা মাছগুলি নিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছিলেন, আমি ঠিক করে কেটেকুটে দিয়ে এলাম।
হালিমা : এ এক জ্বালা। সময় নেই, অসময় নেই সব সময়েই কাজ। বিয়ে হলে চাচিজানের তো আমার উপর অসীম আধিপত্য হবে।
কুলসুম : ছিঃ! শাশুড়ী কি বেটার বউয়ের উপর আধিপত্য খাটাতে যান, না কর্তব্য শিখাতে যান? অমন কথা বলতে নেই। যাকে তুমি ভালবাস, সে তোমার অতি আদরের
অতি প্রিয় স্বামী, তার মা কি কম ভালবাসার, শ্রদ্ধার জিনিস?
হালিম : তা ঠিক। আমার কথাটা ভালো হয় নাই–স্বামীর মার চেয়ে বউয়ের আপনার জন আর কে? মেয়ে-ছেলেকে নিজের মা অপেক্ষা স্বামীর মাকেই বেশি করে আপন মনে করতে হবে এবং সম্ভবত তাঁর কষ্ট দূর করতে হবে। ভাবি, তোমার মতো বউ ক’টা?
কুলসুম : বলি, আকাশের দিকে চেয়ে কী ভাবছ?
হালিমা : ঠিক বলব?
কুলসুম : আমি জানি না, তুমি আমার কাছে কোনো দিন অঠিক কথা বলবে। হালিমা কুলসুমের স্কন্ধে হাত রাখিয়া মুখের কাছে মুখ লইয়া কহিল, স্বামীর কথা।
কুলসুম : এ আর লজ্জার বিষয় কী?
হালিমা : বলেন কী? আপনার কাছে লজ্জা বোধ করি না বলে কি যার তার কাছে বলব, স্বামীর রূপ চিন্তা কচ্ছি?
কুলসুম : যুবতী মেয়ে-ছেলে যে মোটেই পুরুষ-ছেলের কথা ভাবে না, একথা তো সবাই জানে।
হালিমা তার ভাবির চুল টানিয়া দিল।
কুলসুম কহিলেন–স্বামীর কথা যেমনি করে ভাবছ তোমার কথাও তোমার স্বামী এমনি করে ভাবছেন।
হালিমা : আমার এমনি কপাল। আবার কহিল এখনও তো স্বামী হয় নি।
কুলসুম : আবদুল গণি তোমাকে ভালবাসে।
হালিমা : তা জানি। আশীর্বাদ করুন ভাবি যেন তাঁর এই ভালবাসা চিরকাল অটুট থাকে। যেমন আমার ভাই আপনাকে ভালবাসেন, তেমনি আমার স্বামীও যেন আমাকে ভালবাসেন।
কুলসুমের আখিদ্বয় উষ্ণ আঁখিজলে ভরিয়া উঠিল। কহিলেন খোদা করুন তোমার ভাগ্য যেন চিরকাল অটুট হয়ে থাকে। তবে একটা কথা-স্বামীর ভালবাসা অক্ষুণ্ণ রাখতে হলে প্রত্যেক মেয়ে-ছেলেকে কিছু তদ্বির করতে হবে। বাইরের রূপের গৌরব করা স্ত্রীলোকের সাজে না, বাইরের রূপ ক’দিন থাকে? রূপ থাকলেও স্বামীর চোখে দুই এক বছরের মধ্যে তাঁর ওজ্জ্বল্য মাদকতা নষ্ট হয়ে যায়।
হালিমা : ওমা! বল কি সর্বনেশে কথা?
কুলসুম : সর্বনেশে কথা নয়। চিরকাল কি পুরুষের মনে উদ্দাম মাদকতা থাকে? স্ত্রীলোককে এমন কতকগুলি গুণ লাভ করতে হবে, যাতে স্বামীর হৃদয়ে এই উদ্দাম মাদকতার স্থানে পত্নীর প্রতি একটা শ্রদ্ধার ভাব জেগে উঠে। যাতে পাড়া-প্রতিবেশী, শ্বশুর শাশুড়ী, ননদ-ভাসুরের সম্মান-সুনজর লাভ করা যায় তার চেষ্টাও মেয়েমানুষকে করতে হবে সে জন্য কিছু সাধনা চাই।
হালিমা : ভাবি, দয়া করে আমাকে শিখিয়ে দিন কী উপায়ে স্বামীর শ্রদ্ধা চিরকাল সমভাবে লাভ করা যায়। এত প্রেম ও প্রণয় সবই কি ফাঁকি?
কুলসুম : এ সম্বন্ধে অনেক কথা বলা দরকার। এখন সন্ধ্যা হয়েছে, চল নিচে যেয়ে নামাজ পড়ি।
.
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
রাত্রি এগারটার সময় আকাশে দু-একটা তারা দেখা যাইতেছিল। হালিমার মা আপন মনে মধুর কন্ঠে কোরান পাঠ করিতেছিলেন।
হালিমা তার ভাবির কাছে তখন শুইয়াছিল। জানালা দিয়ে মন্দ মন্দ সমীরণ, বহিতেছিল। হালিমা জিজ্ঞাসা করিল–ভাবি, যুবক-যুবতীর মধ্যে এই যে প্রেম প্রণয় এসব কি মিথ্যা?
কুলসুম : মিথ্যা নয়, প্রেমের মধ্যে যেটুকু শান্ত ও স্নিগ্ধ সেইটুকুই খাঁটি। প্রথম বয়সের মোহটুকু সাধারণ প্রেম নামে যুবক যুবতীর কাছে সমাদৃত। এই মোহ বেশিদিন টেকসই হয় না, তবে এই মোহকে আমি অশ্রদ্ধার চোখে দেখি না। মোহকে প্রেমে পরিণত করতে হবে, এই জন্য সাধনা চাই।
হালিমা : মোহ কি একটু ভালো করে বুঝিয়ে দিন।
কুলসুম : মোহ একটা উদ্দাম আবেগ-মনের মিথ্যা চাঞ্চল্য। ”তোমাকে না দেখলে থাকতে পারি না, তুমি আমার চোখের তারা তোমাকে আলতা পরিয়ে রানীর বেশে দেখতে চাই”–এসব মোহের কথা। আর প্রেম সে তত বাচাল নয়, প্রিয়তমের মঙ্গল, সুখ ও শান্তিই প্রেমের আকাক্ষিত বস্তু।
হালিমা : মোহ তাহলে ভালো জিনিস নয়?
কুলসুম : ভালো নয় সত্য, খারাপ বলেও মনে করতে নেই। স্বামী যদি এই মোহের মদিরা দিয়ে স্ত্রীকে পূজা করতে আরম্ভ করেন তো খুব সরল মনে শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে। স্বামীমোহ শেষকালে অবহেলায় পরিণত না হয়ে যাতে শ্রদ্ধায় পরিণত হতে পারে।
হালিমা : কোনো পুরুষই বিবাহের সময় ইচ্ছা করেন তা তাঁরা স্ত্রীকে শেষে ঘৃণা করবেন, বরং ইচ্ছা করেন তার স্ত্রীকে রত্নসিংহাসনে বসিয়ে নিজে দাস হয়ে স্ত্রীর চরণ পূজা। করবেন। মনের নেশা চাঞ্চল্য যখন কেটে যায়, তখন তিনি স্ত্রীর ব্যবহার অজ্ঞাতসারে লক্ষ। করতে থাকেন। যেমন স্ত্রীলোক ভাগ্যহীনা তারাই স্বামীর মনের এই পূজার ভাবকে না বুঝে দলিয়ে দেন। যারা চালাক তারা সদ্ব্যবহারের দ্বারা স্বামীর নাকে রসি লাগিয়ে রাখেন। স্বামীর নেশা কেটে গেলেও ক্ষতি হয় না। স্বামী স্ত্রীকে প্রতি শ্রদ্ধার অর্ঘ্য দিয়ে পূজা আরম্ভ করেন। পুরুষের নেশা যখন কেটে যায়, উদ্দাম আবেগের আগুন যখন নিবে যায়, তখন। তিনি সুবিধা পেলে অর্থাৎ স্ত্রীর উপর রিবক্ত হবার পথ পেলে স্ত্রীকে অবহেলা করেন। বুদ্ধিমতী, সৎস্বভাব স্ত্রী স্বামীকে সদ্ব্যবহারে মুগ্ধ করে রাখেন। স্বামী স্ত্রীকে অশ্রদ্ধা করতে বা কঠিন কথা বলতে সাহস পান না। তাঁর ভালবাসা অক্ষুণ্ণ থাকে স্বামীর মনের মত্তা মন্দীভূত হলেও স্ত্রীর কৌশলে না নূতন করে জেগে উঠে।
হালিমা কহিল : ভাবি, ঘোমটা জিনিসটা কী? নববধূরা স্বামীর সম্মুখে মুখ খোলেন–এতে কি কোনো লাভ আছে?
কুলসুম : ঘোমটা টেনে স্বামীর মনের ক্ষুধা বা পিপাসা বাঁচিয়ে রাখা আমি পছন্দ করি। নে। ছেলে-মেয়ে না হওয়া পর্যন্ত অনেক মেয়েরা স্বামীর কাছে ধরা দেয় না, এইভাবে মুখ ঢেকে রাখলে স্বামী মনে করেন, ওখানে যেন কি আছে।
হালিমা : ঘোমটা টানাটানি এক ভয়ানক ব্যাপার–যেমন বিরক্তিকর, তেমনি অসুবিধাজনক।
কুলসুম : অভ্যাসে সব ঠিক হয়ে যায়। ছেলে-মেয়ে হলেও কি স্বামী-স্ত্রীর বিরক্ত হতে পারেন না? যে সমস্ত স্ত্রীলোক স্বামীর ভালবাসার অপেক্ষা না করে ভাত-কাপড়ের জন্য। স্বামী গ্রহণ করে তারাই ছেলে-মেয়ে হওয়া পর্যন্ত স্বামী বশে রাখবার জন্য এই কৌশল করে। ছেলে হলে কিন্তু স্বামী মনে মনে স্ত্রীর উপর অসন্তুষ্ট থাকলেন, দায়ে পড়ে স্ত্রীর ভাত কাপড় যোগালেন, এতে স্বামী স্ত্রী সুখ পান না। ছেলে হওয়া পর্যন্ত ঘোমটা টানাটানি, তারপর আবার স্বামীর ভালবাসার তোয়াক্কা না করা বুদ্ধিহীন রমণীদের কাজ।
হালিমা : স্ত্রীলোক স্বামীর প্রেমকে গ্রাহ্য করে না, এও কী সম্ভব?
কুলসুম : এমা! বার আনা স্ত্রীলোকই এইরূপ। স্ত্রীলোকের অমনোযোগ ও বেপরোয়া ভাবের ফলে অনেক স্বামী বিরক্ত হন, এমন কি অনেকে চরিত্রহীন হয়ে যান। নিজের নিবুদ্ধিতার দোষে রমণীদের কপাল যখন পুড়ে যায়, তখন তারা কাঁদতে থাকেন, তখন কাদলে কোনো লাভ হয় না। স্বামী যে স্ত্রীকে কটু কথা বলেন না স্ত্রীকে অবহেলা করেন, এর জন্য স্ত্রীলোকেরাই সাধারণত বেশি দোষী। অবশ্য সব জায়গায় একথা খাটে না।
হালিমা : তাহলে আপনি স্বামীর সম্মুখে মুখ ঢেকে রাখবার পক্ষপাতী নন?
কুলসুম : মোটেই না, স্বামীর সম্মুখে মুখ মাথা সবই খুলে রাখতে হবে। লোকের সামনে কিন্তু মাথা খুলতে নেই। একাকিনী যখন স্বামীর কাছে থাকবে, তখন গা মাথা কাপড় দিয়া মুড়ে একটা পোটলা বিশেষ হয়ে থেকো না। রমণীর সাজসজ্জা, রূপ, গহনা সব স্বামীর মনস্তুষ্টির জন্য। এতএব স্বামীর চোখ থেকে নিজেকে ঢেকে রেখে পাড়ার। মেয়েদের সামনে রূপ আগলা করে বেরিয়ে লাভ কী? ঘোমটা টেনে স্বামীর মনকে জয় করার কাজ নেই।
হালিমা : আচ্ছা বিয়ে তো হয়ে গেল, তারপর বাসরঘরে আমাকে সবাই নিয়ে যাবে, তখন কী করবো?
কুলসুম : ধীরে ধীরে যাবে। কোনো কোনো মেয়ে বাসর ঘরে কিছুতেই যেতে চায়। স্বামী যদি বুঝতে পারেন যে তার স্ত্রী তার কাছে আসতে খুবই বিরক্তি প্রকাশ করছে তাহলে তিনি মনে মনে বিরক্ত হবেন। ধীরভাবে, ঘরে ঢুকে স্বামীর পার্শ্বে বসে পড়াই বিধি।
হালিমা : বিয়ের সময় কবুল বলা কাজটা বড় ভয়ানক। ‘কবুল’ বলতে বল্লে বলতে হবে, না অনেক অনুরোধের পর ‘কবুল’ উচ্চারণ করতে হবে?
কুলসুম : অনেক মেয়ে কবুল করার সময় খুব ঝঞ্ঝাট বাধায়। কেউ হয়তো কথাই বলে না। ধীরভাবে প্রথমবারের অনুরোধেই কবুল উচ্চারণ করা উচিত। বিবাহ ব্যাপারটির মধ্যে লজ্জার কিছুই নাই। স্বামী গ্রহণ কাজটা অপমানজনক নয়, সুতরাং এতে লজ্জা বোধ করার কোনো কারণ নেই।
হালিমা : স্বামীর পার্শ্বে বসে পড়বো, তারপর?
কুলসুম : স্বামী যদি কোনো কথা জিজ্ঞাসা করেন, তবে খুব আদবের সঙ্গে উত্তর। দেবে। চুপ করে নির্বাক হয়ে থাকবে না।
হালিমা : আপনি করে বলবো, না তুমি করে বলবো?
কুলসুম : কেন? তুমি করে বলবে। স্বামী তো আর পীর সাহেব নন? হবে হুঁ হাঁ না বলে জি, জে ব্যবহার করবে। হুঁ, হাঁ বল্লেও বিশেষ দোষ নেই। আপনি করে বলে যেন পর করে দেওয়া হয়।
হালিমা : বাইরে অনেক মেয়ে বর-কন্যার কথা শোনার জন্যে উৎকর্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন, এমন অবস্থায় কী করে কথা বলা যায়?
কুলসুম : যারা থাকতে পারেন তাঁরাই থাকেন। বর-কন্যার মিলন দেখে তারা তামাসা করে খুশি প্রকাশ করেন। অবশ্য কাজটি সরাহ বিরুদ্ধ।
হালিমা : স্বামী সাধারণত কী প্রশ্ন করেন?
কুলসুম : হয়তো নাম জিজ্ঞাসা করতে পারেন–কিংবা কী পড় তাই জিজ্ঞাসা করে থাকেন।
হালিমা : কন্যা কী বলবে?
কুলসুম : টপ করে করে নাম বলে ফেলবে। কী কী বই পড়েছ বলবে? পড়তে কেমন লাগে জিজ্ঞাসা করলে বলবে, খুব ভালো লাগে। যা পড়েছ তাই বলবে, বাড়িয়ে বলবে না। বন্ধুদের কথা জিজ্ঞাসা করলে বন্ধুদের নাম বলে দিতে হয়। স্বামীসঙ্গই ভালো লাগে, না বন্ধুদের কাছে থাকতে মন চায়–জিজ্ঞাসা করলে বলবে, স্বামীসঙ্গই ভালো লাগে। তোমার এত প্রশ্নের ভয় নাই। তোমার তো জানা লোক-লুকোচুরি করে যার সঙ্গে আগেই প্রেম। করেছ।
হালিমা হাসিয়া তাহার ভাবির চুলের খোঁপা ধরিয়ে কহিল-তাই বুঝি?
কুলসুম বলিলেন-তা না তো কি–আলাপ, হাসাহাসি কত কী?
হালিমা : ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে নাই নাকি? ওমা, আমি কোথায় যাবো? ছিঃ ছিঃ। হালিমা হাসিয়া হাসিয়া তাহার ভাবির গায়ের উপর শুইয়া পড়িল।
.
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
সবেবরাতের সন্ধ্যায় ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা পথে পটকা ফুটাইতেছিল, আর বাড়িতে বাড়িতে রুটি হালুয়া বিলাইয়া বেড়াইতেছিল, ইহা যে সরাহ-শরীয়ত বিরুদ্ধ তাহা তাহারা আদৌ চিন্তা করবার অবসর পায় নাই। আবদুণ গণি সেদিন বাড়ি আসিয়াছিল। সবেবরাত উপলক্ষে আবদুল গণি ভগ্নি হালিমার জন্য একখানি পুস্তক উপহার আনিয়াছে।
সন্ধ্যায় যখন চাচির আহ্বানে রুটি খাইতে আসিল, তখন পার্টির উপর বসিয়া প্রদীপ আলোকের সম্মুখে ঝকঝকে বইখানি রাখিয়া দিয়া কহিল-চাচি, হালিমার জন্য এনেছি।
চাচি জিজ্ঞাসা করিলেন–কী উপহার বাবা? বইয়ের দিকে চাহিয়া আবদুল গণি কহিল-এই বইখানি।
বেশ বাবা বলিয়া চাচি হালিমাকে ডাক দিয়া বারান্দায় যাইয়া দাঁড়াইলেন। অল্প অন্ধকারে হালিমা, মায়ের বুকের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। মা কন্যার হাতে বইখানি দিয়া কহিলেন–তোমার ভাই তোমার জন্য উপহার এনেছে।
মেয়েকে বইখানি দিয়া চাচি ফিরিয়া আসিয়া আবদুল গণির পার্শ্বে বসিয়া কহিলেন–কদিন বাড়ি আছ বাবা?
আ-গণি। বেশি নয়, দু’দিন থাকবো। নিজের কাজ নিজে না দেখলে ক্ষতি হয়, তাই কোথাও ক’দিন কাটাতে পারি নে। বাড়িতে না এলেও চলে না, ব্যবসা-বাণিজ্য তদারকও হয় না।
চাচি : টাউনে নূতন বাড়িটি কি শেষ হয়েছে?
আ-গণি। হয়েছে। পনের দিন পরে আপনাদের জন্য নৌকা পাঠিয়ে দেবো। সকলেই যাবেন। মা, আপনি, হালিমা, আর ভাবি।
চাচি : বেশি দিন তো থাকতে পারবো না।
ততক্ষণে আবদুল গণির খাওয়া হইয়াছিল। সে নূতন কলসী হইতে পানি ঢালিয়া লইতে অগ্রসর হইল, চাচি তাহার হাত গ্লাস লইয়া পানি ঢালিতে ঢালিতে কহিলেন–ওমা, পানি নাই, গ্লাসে।
আবদুল গণি বাহিরে হাত ধুইতে ধুইতে কহিলেন–একটু পরিবর্তন চাই, নইলে স্বাস্থ্য ভালো থাকে না।
চাচি : তাতো ঠিক।
এমন সময় ভাবি সাহেবা আসিয়া আবদুল গণির কুশল জিজ্ঞাসা করিলেন। গণি উঠিয়া শ্রদ্ধা জানাইল। ভাবি সাহেবা-দেবরকে বসিতে বলিয়া কহিলেন-তা ভাই, কবে আমাদের টাউনে যাওয়া হচ্ছে?
আ-গণি। আপনাদের যে দিন মরজি হয়।
ভাবি : হালিমা বিবি বলছেন মঙ্গলবারে। হালিমা বাহির হইতে সহসা ক্রোধে একবার ভাবির দিকে তাকাইল।
হালিমার মা কাহলেন–না এই মঙ্গলবারে নয়, যে মঙ্গলবার আসছে, এর পরের মঙ্গলবারে।
হালিমার ভাবি কাহিলেন–আচ্ছা মা, তাই হোক না?
.
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
নীরব সন্ধ্যায় ছাদের উপর বসিয়া হালিমা তাহার ভাবিকে জিজ্ঞাসা করিল–ভাবি, স্বামী। সেবার অর্থ কী?
ভাবি : স্বামীকে সুখ দেওয়া।
হালিমা : কেমন করে?
ভাবি : এই যেমন স্বামীকে পাখা করা, তামাক খাবার অভ্যাস থাকলে তামাকে সাজিয়ে দেওয়া, গায়ে মাথায় হাত বুলান, সামনে বসিয়ে খাবার খাওয়ান ইত্যাদি।
হালিমা : স্ত্রী কি স্বামীর চাকর?
ভাবি : কেন? এসব কি চাকরের কাজ? বন্ধু কি বন্ধুকে সেবা করে না–বন্ধুকে সুখ দিয়ে আনন্দ পায় না? মা সন্তানকে পালন করেন সেকি দাসীরূপে?
হালিমা : স্ত্রীর নিকট হইতে স্বামীর এই সেবা দাবি করবার কি অধিকার আছে?
ভাবি : অধিকার আছে। স্বামী ইচ্ছা না করলেও স্ত্রীর কর্তব্য স্বামীকে সুখ দেওয়া, সেবা করা। নারী জীবনের সাতকতাই এতে।
হালিমা : স্ত্রীর কি পাখার বাতাসের দরকার হয় না? তার নিজের গরম লাগলে তাকে কে বাতাস দেবে?
ভাবি : স্বভাবের এই অংশে নারী পুরুষ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ-নারীদের সব সম্পর্কেই স্নেহময়ী জননীর ভাব ফুটে উঠবে। স্বামী স্ত্রীর সেবা না চাইলেও স্ত্রী জোর করে স্বামীর সেবা করবে।
হালিমা : যাদ কেউ না করে? তা হলে তাকে হতোদর হতে হবে?
ভাবি : দেখ, সহানুভূতিই সব।-আমি তোমার জন্য কষ্ট করি, তুমিও আমার জন্য কষ্ট কর। স্বামী সুখ-দুঃখে, বিপদে-সম্পদে পত্নীর মঙ্গল চান, তার পরিশ্রমজাত দ্রব্যসম্ভার পত্নীকে বন্টন করে দেন, স্ত্রীর বিপদে প্রাণ পর্যন্ত দান করেন। অতএব স্ত্রীরও কর্তব্য এহেন বন্ধুকে সর্বদা সুখী করতে চেষ্টা করা। স্বামীকে নিজের শরীর ও আত্মার অংশ ভাবতে হবে। বিয়ের অর্থ–দুটি প্রাণীর একসঙ্গে বন্ধুরূপে বন্ধন। কে কাকে কতখানি সুখ দেবে তা অঙ্ক কষে হিসাব করে বলা যায় না।
হালিমা : ভাবি, আপনি বলছেন বিয়ের পর মাত্র বৎসর খানেক স্বামী স্ত্রীর জন্য মাদকতা অনুভব করেন।
কুলসুম : এই মাদকতাকে বিশ্বাস করতে হবে না। সদ্ব্যবহার দ্বারা স্বামীর শ্রদ্ধা লাভ করতে হবে।
হালিমা : ভাবি, ক্ষমা করুন; বলতে লজ্জা করে। আপনি আমার বন্ধু। আপনাকে আর লজ্জা কি? চাচির ছেলের জন্য আমার মনে অনুরাগের সঞ্চার হয়েছে। তার জন্য মনে মনে কষ্ট পাই। এই কথা বলিয়া হালিমা একটু হাসিল।
কুলসুমর না, না, এতে লজ্জা কি? যিনি স্বামী হবেন, তাঁর প্রতি অনুরাগের সঞ্চার হওয়া দোষের নয়।
হালিমা : স্বামীর প্রেম যেমন এক বৎসরেই শেষ হবে, আমার এই অনুরাগের আয়ুও কী এক বৎসর মাত্র।
কুলসুম : আশ্চর্য নয়।
হালিমা : তা ভাবতে আমার কষ্ট হচ্ছে।
কুলসুম : নারীর হৃদয়ের এই পরিবর্তনের কথা আর একদিন বলবো। আজ স্বামীকে কীভাবে সেবা করতে হয়, তাই শোন।
হালিমা : আচ্ছা বলুন।
কুলসুম : দেখ বিবাহিত জীবনে বাপের বাড়ির খামখেয়ালী সকলের আগে ত্যাগ করতে হবে। কোনো প্রকার উচ্ছল স্বভাব থাকবে না। পিতা-মাতা মেয়ের আবদার, জেদ সহ্য করেন, শ্বশুরবাড়ির কেউ তা সহ্য করে না; বরং তোমাকেই তাদের আবদার সহ্য করতে হবে। লোকে বউকে লালন পালন করবার জন্যে, তার আবদার উচ্ছৃঙ্খলতা সহ্য করবার জন্যে ঘরে নেয় না, বউই তাদের উচ্ছলতা সহ্য করবে এবং তাদেরকে পালন করবে। প্রথম কথা, খুব প্রাতঃকালে উঠবে।
হালিমা : রাত্রি তিনটার সময় কী?
কুলসুম : নামাজের ওয়াজের আধ ঘন্টা আগে। তিনটার সময় ওঠার কোনো দরকার নেই।
হালিমা : তার পর?
কুলসুম : স্নানের প্রয়োজন হরে গোসলখানায় যেয়ে গোসল করবে।
হালিমা : ভাবি, প্রাতঃকালে স্নান করতে যাওয়া বিড়ম্বনা। ছিঃছিঃ! সকলের সামনে সকাল বেলায় মাথায় পানি ঢালা কি লজ্জার কথা নয়?
কুলসুম : সবার সম্মুখে কেন? প্রত্যেক ঘরের পাশ্বেই একটা গোসল খানা থাকা চাই। ঘরের পেছনের চাল একধারে দৈর্ঘ্যে চার হাত, প্রস্থে চার হাত করে বাড়িয়ে গোসলখানা
করে নিতে হয়। এই স্থান শোবার স্থানের পাশেই হবে। প্রত্যেক মহিলার জন্য স্বতন্ত্র গোসলখানা থাকা উচিত। বাইরে স্নান করা কিছু অসভ্যতা। যে দিকে গোসলখানা সেদিকে চলাচলের পথ যেন না থাকে। এক বাড়িতে অনেকগুলি দম্পতি বাস না করলে সুবিধা হয়।
হালিমা : আচ্ছা, নারীকে পরের বাড়িতে সম্পূর্ণ অপরিচিত লোকের মধ্যে এসে বাস করতে হয় কেন? স্বামীর উপর তার দাবি আছে সুতরাং তারই সেবাসুখ চিন্তা করতে সে বাধ্য। অন্যের মন যুগিয়ে চলা কি কঠিন নয়? এতে কি মনের স্বাধীনতা এবং মনুষ্যত্ব নষ্ট হয় না?
কুলসুম : বিলাতে ছেলে বড় হলে বিয়ের পর তাকে স্বতন্ত্র স্থানে নূতন সংসার করে দেয়। আমাদের দেশে সে প্রথা নেই। ইংরেজের আচার-পদ্ধতি আমরা মানতে পারি না। স্বামীর কর্তব্য তাঁর মাতাপিতার সেবা করা, শান্তি ও সুখ দেয়া, ছোট ভাই বোনদের আবদার রক্ষা করা। স্বামী অর্থোপার্জনে বিদেশে যায় ও কম্যে ব্যস্ত থাকে; সুতরাং স্বামীর হয়ে স্ত্রীকে ঐ সমস্ত কর্তব্য করতে হয়। ইহাও একরকম স্বামীসেবা। কর্তব্যের নামে যে কাজ করা, তাকে স্বধীনতা এবং মনুষ্যত্ব নষ্ট হয় না। স্বামী স্ত্রীর ভরণপোষণ দিতে বাধ্য, সুতরাং স্বামীর বাড়িতে নিজেকে বাজে লোক মনে করবার কোনো কারণ নেই। স্বামীর কাছেও নিজের সম্মান ও দাবির মূল্য অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য কাবিনের ব্যবস্থা আছে। আমাদের সমাজে সাধারণত যত টাকার কাবিন হয়ে থাকে, তা অপেক্ষা বেশি টাকার কাবিন হওয়া উচিত; নইলে মেয়েদের মর্যাদা থাকে না। স্বামী বা শ্বশুর-শাশুড়ী যখন তখন বিপুল অসম্মানে বধুকে পথের ভিখারিনী করে দিতে পারেন। কাবিন অন্তত হাজার টাকার হবে। এই টাকা কখনও মাফ করতে নেই। কাবিনের পরিবর্তে কিছু জমি লিখে নেওয়াও মন্দ নয়, বরং তাই ভালো।
হালিমা : কিন্তু এতে স্বামীর স্বাধীনতা থাকে কি? স্বামীর সঙ্গে স্ত্রী যেরূপ ইচ্ছা সেইরূপ ব্যবহার করতে পারে, এমনকি নারী চরিত্রহীনা হলেও স্বামী কিছু বলতে পারে না!
কুলসুম : পুরুষ চরিত্রহীন হলে নারীর কি বলবার থাকে? স্বাধীনতা ও শক্তি হারিয়ে নারীর কারো সঙ্গে প্রেম করা অসম্ভব। এরূপে প্রেম হতেই পারে না। যে প্রতি মুহূর্তে নিজেকে স্বামীর কৃপার পাত্র মনে করে থাকে, সে কোনো প্রাণে স্বামীর প্রেমচুম্বন হাসিমুখে গ্রহণ করে? অসম্ভব! পুরুষ বহু স্থলে নারীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে থাকেন। নারী কবে কোথায় স্বামীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে? স্বামীর নিকট তার এমন কিছু আছে যা না পেলে তার জীবন মিথ্যা হয়ে যায়। নারীর কি ধর্ম ও বিবেক নেই?সে কি খোদাকে স্বীকার করে না? পুরুষ যে আবার বিয়ে করতে পারে।
হালিমা : স্বামী যা বলেন, তাই করতে হবে। তাকে ভক্তি করতে হবে। এসব কথার অর্থ কি? এত শ্রদ্ধার আদান-প্রদান, যেখানে-সেখানে প্রেম প্রণয় কি প্রকারে সম্ভব? স্বামীকে এত ভয় করে কি জীবনী ধারণ করা যায়? স্ত্রীলোককে স্বামীর বাড়ি যেয়ে দরকার কি? পুরুষ তার শ্বশুর শাশুড়ীর আজ্ঞা পালন করতে বাধ্য নয়, নারী তার শ্বশুর-শাশুড়ীর আজ্ঞা পালন করতে বাধ্য, এর অর্থ কি? পুরুষ শ্বশুর-শাশুড়ীর আজ্ঞা অনুযায়ী কাজ করলে লোকে তাকে কাপুরুষ বলে; নারী শ্বশুর-শাশুড়ীকে অবজ্ঞা করলে সকলের কাছে সে নিন্দনীয় হয়। এর কারণ কি?
কুলসুম : সাধারণত স্বামী স্ত্রী অপেক্ষা জ্ঞানী হয়ে থাকেন, সুতরাং তার কথামতো কাজ করতে কোনো ক্ষতি নেই। কাজ হওয়াই চাই–স্ত্রী ও স্বামীতে আড়াআড়ি ভাব থাকলে পরিবারে সুখ-শান্তি তাকে না, কোনো কাজও হয় না। স্বামী-স্ত্রীর অমঙ্গল চান না–বন্ধুর কথামতো কার্য হওয়া চাই তাতে নিরানন্দের কারণ কি? স্ত্রী যদি স্বামী অপেক্ষা শিক্ষিতি ও জ্ঞানী হন, তাহলে স্ত্রীর কথামতো কাজ হতে পারে। শিক্ষিত ও জ্ঞানী স্বামীকে ভক্তি শ্রদ্ধা করার অর্থ দিবারাত্র পদপ্রান্তে লুটিয়ে থাকা নয়। পিতার কাছে পুত্রের ব্যক্তিত্ব বা কথার মর্যাদা বা দাবি নাই, স্ত্রীর তা আছে; সুতরাং স্ত্রীর দুঃখ করবার কিছু নাই। অতএব প্রেম প্রণয় পূর্ণ গতিতে চলতে পারে। স্বামীকে ভয় করতে হয় না। স্বামীর ভালবাসাকে বিশ্বাস। করতে হবে। নারীর হাতে যদি কাবিন থাকে–সে যদি শিক্ষিতা হয়, সে যদি সম্মান বজায়। রেখে প্রয়োজন মতো এখানে ওখানে যাওয়ার ক্ষমতা পায়, তা হলে তার স্বামীকে বিশেষ ভয় করতে হয় না। স্ত্রীলোকের স্বামীর বাড়ি থাকার কারণ এই বাঙালি সংসারের নূতন নূতন পরিবার গঠন করা কঠিন। আমরা স্বামীর মাতা-পিতাকে নিজের মাতাপিতা মনে করি, সুতরাং তাদের খেদমত করতে আনন্দই হয়। পুরুষ স্ত্রীর গৃহে এলে স্ত্রীরই ক্ষতি। তাতে পুরুষের সম্পর্ক খর্ব করা হয়। ফলে সন্তানাদি কাপুরুষ হয়ে জন্মে। বাৰ্হিজগতের সঙ্গে পুরুষের সম্বন্ধ অধিক-জতের ভাব ও কর্মকে সেই গতি প্রদান করি। সে নারীর বাড়ি এসে নারীর মাতাপিতার বাক্য অনুযায়ী চলতে পারে না–তাতে তার জীবন মিথ্যা হয়ে যায়।
হালিমা : ঊষার স্নান শেষ করে বধূ কি করবে?
কুলসুম : স্বামীর তামাক খাবার অভ্যাস থাকরে তামাক ঠিক করে রাখবে। বদনায় পানি ভরে কোনো নির্দিষ্ট স্থানে রেখে দেবে। গোছলখানায় গামোছা আর কাপড় রেখে অজু করে নামাজ পড়বে। নামাজ পড়ে বাড়িতে দাসী না থাকলে কলমদানীতে পানি দেবে বদনাগুলি মেজে নির্দিষ্ট স্থানে গামছাসহ রেখে দেবে। শ্বশুরের তামাক খাবার অভ্যাস থাকলে হুঁকায় পানি বদলিয়ে কলকায় তামাক দিয়ে দেশলাই ও কয়লা কাছে রেখে দেবে। শ্বশুরের খেদমত শাশুড়ীও করতে পারেন-বধু সাধ্যমতো শাশুড়ীকে সাহায্য করবে।
হালিমা : ছেলে হলে স্বামীর খেদমত ঠিক মতো করা যায় না বোধ হয়?
কুলসুম : একটু বাধা আছে। যতটুকু সম্ভব তা করতে অবহেলা করবে না।
হালিমা : স্বামী যখন আহার করেন তখন স্ত্রীর কিছু কর্তব্য আছে না কি?
কুলসুম : নিশ্চয়ই। সে কথা জিজ্ঞেস করে আর কষ্ট করার দরকার কি আসন দিয়ে দস্তরখানা ও পানি দিও। দাস-সাসী অনেক সময় পানি ও দস্তরখানা না দিয়েই ভাত নিয়ে হাজির হয়। এরূপ দাস-দাসীকে আদব-কায়দা শিখাবে। বিনা দস্তরখানে বাড়ির কেহ যেন ভাত না খায়।
হালিমা : পানি ও দস্তরখানা দিয়ে বুঝি ভাত দিতে হবে?
কুলসুম : হ্যাঁ, প্রথমে সামনে যে ভাত দেবে তা যেন কখনও বেশি না হয়। স্বতন্ত্র থালায় সম্মুখে ভাত রেখে চামচ দিয়ে নিজ হস্তে অল্প অল্প ভাত স্বামীর পাতে উঠিয়ে দিতে থাকবে। এক সময়ে অনেক ভাত স্বামীকে দিও না। পাত্রে তরকারি দেবে। নিজ হস্তে তরকারি তুলে দিতে হয়। খাবার সময় স্বামীকে আদর করে আরও কিছু নিতে অনুরোধ করতে হয়। স্বামীর পরিতুষ্ট আহারে তুমি খুব খুশি এরূপ ভাব দেখান চাই। স্বামী যত কম খান ততই স্ত্রী খুশি হন, এরূপ সন্দেহ যেন কখনও স্বামীর মনে না আসে।
হালিমা : অনেক রমণীকে দেখে থাকি স্বামীর ভাত খাবার সময় পাখা দিয়ে তার। স্বামীকে বাতাস করতে থাকে।
কুলসুম : এতে খুব ভালো কথা-স্বামীর আহারকালে বাতাস দেওয়া খুব ভালো। গরম ভাতের উপর স্বামী উপুড় হয়ে ফুঁ দিচ্ছেন তা দেখে চুপ করে থাকতে নেই। বাতাস দিয়ে ভাত ঠাণ্ডা করে দেবে। স্বামীকে যেন পানি বা লবণ দিতে ভুল না হয়। ভাত খাবার সময় ভাতের উপর মাছি না বসে, সেদিকেও লক্ষ রাখবে। ছেলেপিলেকে ছেড়ে দিয়ে। খাবার সময় বিরক্তি করা ঠিক নয়। ছেলেপিলেকে স্বতন্ত্র স্থানে খেতে দিলে, কাঁদা কাটির অভিনয় বন্ধ হতে পারে।
হালিমা : স্বামী পরিশ্রান্ত হয়ে এলেও তাঁকে পাখা দিয়ে বাতাস করতে হবে না কি? লোকে কী বলবে? লজ্জা লজ্জা!
কুলসুম : লোকে কী বলবে–এই ভেবে ক্লান্ত স্বামীর নিকট যে রমণী অগ্রসর না হয় তার জীবন বৃথা। স্ত্রী তো আর উপপত্নী নয় যে লোকের কথা শুনবে। এমন নরপিশাচ কে আছে যে স্ত্রী লোকের স্বামীর প্রতি ভালবাসা দেখে বিরক্ত হয়?
হালিমা : এত সেবা করে কি জীবন ধারণ করা যায়?
কুলসুম : এই স্বামী সেবায় রমণীরা আনন্দ বোধ করেন। এতে আদৌ তার কষ্ট হয় না। তাদের প্রেমে ও মধুর ব্যবহারে সংসার স্বর্গে পরিণত হয়। যে সমস্ত রমণী স্বামীকে ভালবাসে না, তারাই স্বামীর সেবা করা বা স্বামীকে সুখ দিতে কষ্টবোধ করে। আমি তোমার ভাইকে গরমকালে ঘুম না আসা পর্যন্ত বাতাস দিয়ে থাকি। এতে আমার আনন্দ ছাড়া কষ্ট হয় না। এতে আমার সম্মানও নষ্ট হয় না।
হালিমা হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিল-বটে? আচ্ছা, স্বামীকে রাত্রিকালে ঘুম হতে জাগান কি ভালো?
কুলসুম : আবশ্যক থাকলে তাতে দোষ নাই। ধীরে ধীরে মিষ্টি কথায় স্বামীকে জাগালে স্বামী বিরক্ত হন না বরং সুখী হন। যদি বোঝা যায় স্বামী জাগতে ইচ্ছুক নন, তা হলে ঘুমাতে না দিয়ে উপায় কি? অবশ্য স্বামীর এরূপ ব্যবহার স্ত্রীর মনে কষ্ট হতে পারে তা স্বামীরই বিবেচনা করা উচিত।
হালিমা : স্বামী যদি স্ত্রীকে জাগান?
কুলসুম : তা হলে স্ত্রী আদৌ বিরক্ত প্রকাশ করবে না বরং সুখী হয়েছে এইরূপ ভাব দেখাবে। সাবধান, কখনও স্বামীর সোহাগের প্রতি তাচ্ছিল্য প্রকাশ করো না–তাতে রমণী জীবনে সমূহ বিপদ ঘটতে পারে। স্বামীর সকল আদর মাথা পেতে নেবে। বস্তুত স্ত্রী এমন কোনো কথা বলবে না বা এমন কোনো ব্যবহারের পরিচয় দেবে না যাতে মনে হতে পারে স্ত্রী স্বামীর প্রতি তত আসক্ত নয়।
হালিমা : ভিতরে ভালবাসা রইল, বাইরে তার পরিচয় না দিলাম। নিষ্ঠুর কথা বলে বা অবজ্ঞা ভরা ব্যবহার করে ভিতরে প্রেম পোষণ করলে কি ক্ষতি? গভীর প্রণয় ভিতরেই থাকে। বাইরে তার সাড়া পাওয়া যায় না।
কুলসুম : এটা পাগলের কথা। যে প্রেমের কোনো সাড়া পাওয়া যায় না, সে প্রেমের কোনো মূল্য নাই। কাজের মধ্যেই প্রেমের পরিচয়। ভিতরে প্রেম আছে কাজে তার পরিচয় নাই, এরূপ প্রেম দিয়ে কী লাভ? নারীর পক্ষে নিষ্ঠুর কথা বলা বা অবজ্ঞাপূর্ণ ব্যবহার করা বড়ই বিপজ্জনক। এতে নারীর কপাল পুড়ে যায়। সে নিজ হাতে নিজের বিপদ টেনে আনে। কখনও কোনো নারী এরূপ করবে না। মুখে হাসি সহানুভূতিপূর্ণ কুশল জিজ্ঞাসা, মধুর আলাপ, সরস রসিকতা, প্রীতিপূর্ণ ব্যবহার নারীর ভূষণ। মায়ের মতো গভীর ভালবাসা এ জগতে কার?-মাতা সন্তানকে বাচালতা কথা দিয়ে সোহাগ করেন তা জান? নারী কথা ও ব্যবহারের ভিতর দিযে সর্বদা স্বামীর প্রতি ভালবাসার পরিচয় দিবে।
হলিমা : শুনেছি, স্বামী স্ত্রীকে চুম্বন করে থাকেন, স্ত্রীও স্বামীকে চুম্বন করে থাকেন। এটা বড়ই জঘন্য কাজ, কেমন?
কুলসুম : আশ্চর্য! কে বললে জঘন্য! স্বামী স্ত্রীতে চুম্বনের বিনিময়ে কারো মনে কোনো অবিশ্বাস আসতে পারে না। চুম্বন বিনিময় অতি উত্তম প্রথা। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কেউ কারো উপর বিরক্ত হলে চুম্বনে তা দূর হয়। ভদ্রলোকে ভদ্রলোকে যেমন আলাপ করে বা হামেশা কুশল জিজ্ঞাসা করে পরস্পরের সদ্ভাব সঞ্জীবিত করে রাখেন, স্বামী স্ত্রীর মধ্যেও তাই। তবে স্বামী-স্ত্রীর চুম্বন বিনিময় কাজটি গোপনে হওয়া চাই।
হালিমা : স্ত্রীও কি স্বামীকে চুম্বন করবে?
কুলসুম : স্ত্রী স্বামীকে বেশি চুম্বন করবে। এতে দোষ নেই। স্বামী স্ত্রীর উপর রেগে থাকলে স্ত্রীর চুম্বন তা দূর করতে সক্ষম। চুম্বন জিনিসটি ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ ছাড়া তো আর কিছুই নয়। বিলাতে তো রাস্তাঘাটেই বন্ধুতে বন্ধুতে চুম্বনের বিনিময় হয়।
হালিমা : এরূপ করলে স্বামী স্ত্রীকে বেহায়া মনে করতে পারেন।
কুলসুম : কেন? স্ত্রী কি রক্ষিতা যে তার এত লজ্জা? যে পুরুষ মুখে নারীকে সমকক্ষ মনে করে অথচ কার্যের বেলায় তাকে সকল দাবি বুঝিয়ে দেয় না, সে পুরুষের মূল্য কী? স্ত্রী পুরুষের চেয়ে কিছুতেই ছোট নয়–তার ব্যক্তিত্ব ও স্বাধীনতা আছে। পুরুষের যদি সোহাগ করার অধিকার থাকে, নারীরও তা আছে।
হালিমা : স্বামী যখন বাহির হতে আসেন তখন কী করতে হবে?
কুলসুম : উঠে দরজার কাছে যাবে এবং মৃদু হাস্যে সাদর অভ্যর্থনা করবে।
.
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
বর্ষাকাল–সমস্ত মাঠখানি বন্যা প্লাবিত। শ্যামল সজীব শৈবালে পরিষ্কার জলরাশি অপূর্ব শ্রী ধারণ করিয়াছে।
আবদুল গণি, তাঁহার মা, হালিমা ও ভাবি সাহেবাদের লইয়া শহরে বেড়াইতে যাইতেছেন। জোছনার স্নিগ্ধ অমিয় বিশ্বে আনন্দের ধারা ঢালিতেছিল। মৃদু মধুর মলয় হিল্লোল জীবনকে পুলকিত পূর্ণ করিতেছিল।
নৌকার ছাদের উপর বসিয়া হালিমা ও কুলসুম কথা বলিতেছিলেন। দূরে জল বিস্তারের উপর চাহিয়া চাহিয়া তাঁহারা নাতিউচ্চ স্বরে কথা কহিতেছিলেন।
দীর্ঘ ওড়না তাহাদের গায়ে। ঘোমটা টানিয়া দিয়া অসঙ্কোচে তাঁহারা প্রকৃতির মহিমা ভোগ করিতেছিলেন।
হালিমা জিজ্ঞাসা করিল-ভাবি, বিশৃঙ্খলা জিনিসটা আমি আদৌ ভালবাসি নে।
কুলসুম : কারণ বিশৃঙ্খলা জিনিসটা আদৌ ভালো নয়। মনের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে সকল বিষয়ে শৃঙ্খলা এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করবার ঝোঁক তো হবেই। কথায়, মনে, ব্যবহারে, কাজে-কর্মে,-সব জায়গায় পরিষ্কার হওয়াই ভালো লোকের কাজ।
হালিমা : বিশৃঙখলাকে ঘৃণা করলেও বিশৃঙ্খলা এসে পড়ে।
কুলসুম : সকাল বেলা উঠেই টপ করে ঘরখানি ঝাট দেওয়া চাই তার পর স্নান শেষ করে নামাজ পড়ে জিনিস-পত্রগুলি গুছিয়ে রাখবে। বিছানাপত্র অযত্নে পোঁটলার মতো ফেলে রাখবে না। ছেলেরা বিছানায় পেশাব করলে সে বিছানা ঊষাকালেই বাইরে সরিয়ে রাখতে হয়। দুপুর বেলা পর্যন্ত সেগুলি ঘরের মধ্যে রাখবে না। এতে মন খারাপ হয়, অসুখ-পীড়ার পথ তৈরি হয়। কাপড়-চোপড়, বই-খাতা দোয়াত-কলম, আরশী-চিরুনী সব ঠিকমতো রাখবে। সপ্তাহে যদি একবার মাত্র শৃঙ্খলার দিকে মন দাও, তা হলে শৃঙ্খলা কোনোকালে রক্ষা করতে পারবে না। সকাল, দুপুর, সন্ধ্যায়, দিনের মধ্যে তিনবার করে দেখবে, জিনিসপত্র যথাস্থানে আছে কি না। পথে কোন জিনিস কাকেও রাখতে দেখলে তৎক্ষণাৎ বিরক্তি প্রকাশ করবে। শৃঙখলা রাখবার জন্য সব সময় সজাগ থাকবে। বিশৃঙ্খলা ভালবাস
বলেই বিশৃঙ্খলা দূর হবে না। কুড়ে আলসেরাও বেশি রকম বিশৃঙ্খল। বাড়ির ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের স্বভাব থেকে প্রথম হতেই এই দোষ দূর করে দিতে হয়। কাপড়-চোপড়, জুতা-জামা, রান্না ঘরে ফেলে ভাত খেতে বসা ছেলেদের অভ্যাস। এই বদ অভ্যাস দেখলেই বিরক্তি প্রকাশ করবে। যথস্থানে জিনিসপত্র রাখবার প্রবৃত্তি তাদের শিক্ষা দিতে সর্বদা সচেষ্ট হবে। ভবিষ্যৎ জীবনে তাদের জীবনের অনেক দুঃখ তাতে কমে আসবে।
হালিমা : ছেলের ভাবনা ভাববার ঢের দেরি।
কুলসুম : বিয়ের পর এক বছরেই ছেলে হতে পারে।
thank you this scop but if there is a download link it would better