প্রত্যেকেরই জীবনে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যা আমরা কোনো দিনই ভুলতে পারি না। তেমন একটা ঘটনার কথাই আমি বলতে যাচ্ছি। আমার মনের পর্দায় এখনো এমন উজ্জ্বল হয়ে আছে, মনে হয় মাত্র কালই বুঝি ঘটেছিলো ঘটনাটা।
প্রায় বিশ বছর আগের এক রাত। আমি, লুডউইগ হোরেস হলি, আমার কেব্রিজের বাসায় বসে জটিল একটা গাণিতিক সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছি। সেই সন্ধ্যায় শুরু করেছি, এখন মাঝরাত, কিন্তু কিছুতেই বের করতে পারছি না সমাধানটা। শেষমেশ বিরক্ত হয়ে বই খাতা সব ছুড়ে ফেলে দিয়ে উঠে পড়লাম। ম্যান্টেলপিসের ওপর থেকে পাইপটা নিয়ে তামাক ভরলাম। ম্যান্টেলপিসের ওপর মোমবাতি জ্বলছে, পেছনে লম্বা সরু একটা আয়না। মোমবাতির আগুনে পাইপ ধরাতে গিয়ে চোখ পড়লো আয়নায়। নিজের চেহারাটা দেখতে পেলাম পরিষ্কার।
জীবনে যদি কিছু করতে হয়, নিজেকে শোনানোর জন্যেই যেন বললাম আমি। মাথার ভেতরটা দিয়েই করতে হবে। বাবারটা দিয়ে যে কিছু সম্ভব নয় তা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো?
অনেকের কাছেই হয়তো দুর্বোধ্য লাগবে, হঠাৎ এমন একটা মন্তব্য কেন? আমার চেহারার কথা বলছি। দেখতে যেমনই হোক, বাইশ বছর বয়েসে বেশির ভাগ লোকের চেহারায় আর কিছু না হোক যৌবনের দীপ্তি অন্তত থাকে। কিন্তু আমার বেলায় এ জিনিসটাও অনুপস্থিত। আমাকে কুৎসিত বললেও কম বলা হয়—বেঁটে, মোটা, প্রায় বিকৃত চাপা বুক; লম্বা মোটা মোটা দুটো হাত; চোখগুলো কুতকুতে, ধূসর; বিশ্রী মোটা এক জোড়া ভুরু।
প্রায় সিকি শতাব্দী আগে এমন ছিলো আমার চেহারা, দুঃখের বিষয় সামান্য কিছু পরিবর্তন ছাড়া এখনও তেমনই আছে। চেহারার দিক দিয়ে প্রকৃতি আমাকে বঞ্চিত করেছে সন্দেহ নেই, তবে পুষিয়ে দিয়েছে অন্য দিক দিয়ে। লোহার মতো শক্ত আমার শরীর, অস্বাভাবিক শক্তি পেশীগুলোয়। মগজের শক্তিটাও, বলা যায়, একটু অসাধারণ। ফলে আমার কোনো বন্ধু নেই-না একজন আছে। কোনো মেয়ে স্বেচ্ছায় কখনো আমার ছায়া মাড়ায় না। এই গত সপ্তায়ই শুনেছি, আড়ালে একটা মেয়ে আমাকে বলেছিলো, রাক্ষস। আমি যে শুনে ফেলেছি সে টের পায়নি। পেলে হয়তো বলতো না।
একবার হঠাৎ করেই আমার সম্পর্কে কৌতূহলী হয়ে উঠেছিলো একটা মেয়ে। ব্যাপারটা টের পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি পারলে জান দিয়ে ফেলি ওর জন্যে। এমন সময় আমার টাকার উৎসটা গেল বন্ধ হয়ে। মেয়েটারও আর চেহারা দেখি না। অনেকদিন পর ওকে খুঁজে বের করে কাকুতি মিনতি করলাম। জীবনে ঐ প্রথম এবং ঐ-শেষ কোনো মেয়েকে কাকুতি মিনতি করা। বললাম যেন আমাকে প্রত্যাখ্যান না করে। কিছুই বললো না সে, আয়নার সামনে নিয়ে গেল আমাকে। আমার পাশে দাঁড়িয়ে বললো, দেখ, আমি যদি বিউটি হই, তুমি কে?
তখন আমার বয়স মাত্র বিশ।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের কুৎসিত মুখটা দেখছি আর এই সব আবোল তাবোল ভাবছি, হঠাৎ একটা শব্দ হলো দরজায়। বাস্তবে ফিরে এলাম আমি। কান খাড়া, করলাম। আবার শব্দ। কেউ দরজা ধাক্কাচ্ছে। রাত প্রায় বারোটা। এত রাতে কে আসতে পারে? কলেজে একজনই আমার বন্ধু, সম্ভবত পৃথিবীতেও-ও-ই কি?
একটা কাশির শব্দ শোনা গেল বাইরে। তাড়াতাড়ি এগোলাম দরজা খোলার জন্যে-কাশিটা পরিচিত।
লম্বা এক লোক এস্ত পায়ে ঢুকলো ঘরে। বছর তিরিশেক হবে বয়েস, অসম্ভব সুন্দর পুরুষালি চেহারা। ডান হাতে ভারি একটা লোহার বাক্স। ওজনে নুয়ে। পড়েছে সে। সিন্দুকের মত বাক্সটা কোনো রকমে টেবিলের ওপর রেখেই কাশতে শুরু করলো লোকটা। প্রচণ্ড কাশি। কাশতে কাশতে লাল হয়ে গেল তার মুখ। অবশেষে একটা চেয়ারে বসে থু করে একদলা রক্ত ফেললো মেঝেতে।
একটা গেলাসে খানিকটা হুইস্কি ঢেলে এগিয়ে দিলাম। ওটুকু খেয়ে একটু যেন ভালো বোধ করতে লাগলো সে। তারপর চোখ-মুখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, এই ঠাণ্ডায় এতক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখলে কেন? জানো ঠাণ্ডায় শ্বাস নেয়া আর মরে যাওয়া একই কথা আমার জন্যে!
আমি কি করে জানবো তুমি এসেছো? বললাম আমি। এত রাতে কেউ আসে কারো কাছে?
হ্যাঁ, সম্ভবত তোমার কাছে এ-ই আমার শেষ আসা, অনেক কষ্টে একটু হাসার চেষ্টা করলো সে। আমি শেষ, হলি, আমি শেষ। মনে হয় না কালকের দিন পর্যন্ত টিকবো।
পাগল! বসো তো আমি ডাক্তার ডেকে আনছি।
হাত নেড়ে আমাকে নিষেধ করলো সে। আমি বুঝতে পারছি আমার অবস্থা। ডাক্তার ডেকে লাভ হবে না। আমি ডাক্তারি পড়েছি, ভালোই জানি, কোনো ডাক্তারই আর কিছু করতে পারবে না। আমার শেষ সময় ঘনিয়ে এসেছে! তার চেয়ে যা বলছি মন দিয়ে শোনো-হয়তো দ্বিতীয়বার শোনার জন্যে জীবিত পাবে আমাকে। দুবছর ধরে আমরা বন্ধু। বলো তো, আমার সম্পর্কে কতটুকু জানো, তুমি?
জানি: তুমি ধনী, সাধারণত যে বয়েসে সবাই কলেজ থেকে বেরিয়ে যায় সেই বয়েসে তুমি কলেজে ভর্তি হয়েছে। তুমি বিবাহিত, তোমার স্ত্রী মারা গেছেন তা-ও জানি। আর জানি, তুমি আমার সবচেয়ে ভালো এবং সম্ভবত একমাত্র বন্ধু।
আমার একটা ছেলে আছে তা জানো?
না তো!
পাঁচ বছর বয়েস। ওর মায়ের বিনিময়ে ওকে পেয়েছি, সেজন্যে কোনোদিনই ওর দিকে তাকানোর ইচ্ছে হয়নি আমার। হলি, ছেলেটার ভার আমি তোমাকে দিয়ে যেতে চাই।
চেয়ার ছেড়ে প্রায় লাফিয়ে উঠলাম আমি। আমাকে!
হ্যাঁ, তোমাকে। গত দুবছর ধরে খামোকা আমি তোমার সঙ্গে মিশেছি ভাবো? কিছুদিন ধরেই বুঝতে পারছিলাম, আমার দিন শেষ। তখন থেকে খোজ করতে থাকি এমন একটা লোক যার জিম্মায় রেখে যেতে পারবো আমার ছেলেকে আর এটাকে, লোহার সিন্দুকটায় টোকা দিলো সে। তুমিই সেই লোক, হলি। অনেক ঝড়জল সওয়া প্রাচীন বৃক্ষের মতো শক্ত তুমি, জানি পারবে তুমি ছেলেটাকে মানুষ করে তুলতে। শোনো, আমার মৃত্যুর পর, দুনিয়ার সবচেয়ে প্রাচীন বংশগুলোর একটার একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে বেঁচে রইবে ছেলেটা।
আমার পঁয়ষট্টি কি ছেষট্টিতম পূর্বপুরুষ ছিলেন দেবতা আইসিসের মিসরীয় পুরোহিতদের একজন। তুমি হয়তো হেসে উড়িয়ে দেবে, কিন্তু আমি বলছি একদিন নিঃসংশয়ে প্রমাণিত হবে একথা। তার নাম ক্যালিক্রেটিস। গ্রিসীয় বংশোদ্ভূত হয়েও মিসরীয়দের পুরোহিত হয়েছিলেন তিনি। ঊনত্রিশতম রাজবংশের এক মেনডেসিয়ান ফারাও হাক হোর গ্রীক ভাড়াটে সৈন্যদের নিয়ে এক বাহিনী গঠন করেছিলেন। এই বাহিনীরই সৈনিক ছিলেন তার বাবা। হেরোডোটাস যে ক্যালিক্রেটিসের কথা উল্লেখ করেছেন, আমার বিশ্বাস তিনি আমার পূর্বপুরুষ ক্যালিক্রেটিসের দাদা অথবা পরদাদা। ফারাও পরিবারের এক রাজকন্যা এই পুরোহিত ক্যালিক্রেটিসের প্রেমে পড়েন। খ্রীষ্টপূর্ব ৩৩৯ অব্দের দিকে, ফারাওদের চূড়ান্ত পতনের সময় মিসর থেকে পালিয়ে গেলেন ক্যালিক্রেটিস। কৌমার্যের ব্রত ভঙ্গ করে সঙ্গে নিয়ে গেলেন সেই রাজকন্যাকে। জলপথে পালাচ্ছিলেন তাঁরা। পথে জাহাজডুবি হলো। কোনো মতে তীরে উঠলেন দুজন। দলের বাকিরা মারা পড়ে।-জায়গাটা আফ্রিকা উপকূলে, সম্ভবত আজকের ডেলাগোয়া উপসাগরের উত্তরে কোথাও।
প্রচণ্ড কষ্ট সহ্য করে তারা জীবন ধারণ করতে লাগলেন সেখানে। অবশেষে সেখানকার এক জংলী হাতির দোর্দণ্ড প্রতাপ রানীর অনুগ্রহ লাভ করলেন। জাতিটা জংলী হলেও তাদের রানী অদ্ভুত সুন্দরী এক শ্বেতাঙ্গিনী। কোনো কারণে-কারণটা আমি জানতে পারিনি, বেঁচে থাকলে এই বাক্সের জিনিসগুলো থেকে তোমরা হয়তো জানবে—সেই শ্বেতাঙ্গিনী রানী খুন করে আমার পূর্বপুরুষ ক্যালিক্রেটিসকে। তাঁর স্ত্রী, কিভাবে জানি না, শিশু পুত্রকে নিয়ে পালিয়ে চলে গেলেন এথেন্সে। ছেলের নাম রাখলেন টিসিসথেনেস, অর্থাৎ শক্তিমান প্রতিশোধগ্রহণকারী।
পাঁচশো বা তার কিছু বেশি বছর পর পরিবারটা চলে আসে রোমে-কি পরিস্থিতিতে, কেন, কিছুই জানা যায়নি। এখানেও ওঁরা পাঁচ শতাব্দী বা তার কিছু বেশি সময় বসবাস করেন। তারপর ৭৭০ খ্রীষ্টাব্দের দিকে শার্লেমেন। যখন লোম্বার্ডি দখল করলেন, ওঁরা চলে এলেন লোম্বার্ডিতে। পরিবারের কর্তা খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন ম্রাটের সাথে। অবশেষে তারা আলপস পর্বতমালা পেরিয়ে ব্রিটানিতে এসে স্থিত হলেন। আট পুরুষ পরে তাঁর (পরিবারকর্তার) এক বংশধর চলে গেলেন ইংল্যাণ্ডে। এডওয়ার্ড দ্য কনফেসরে আমল সেটা। উইলিয়াম দ্য। কনকোয়ারের সময় খুবই ক্ষমতাশালী আর সম্মানিত লোক হয়ে উঠলেন তিনি (সেই বংশধর)।
সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত পূর্বপুরুষদের পরিচয় নিখুঁতভাবে জানি আমি। যাহোক, উইলিয়াম দ্য কনকোয়ারায়ের আমলে ক্ষমতাশালী হয়ে উঠছিলেন যিনি, তার বংশধরদের কেউই খুব একটা নাম করতে পারেননি। তাই বলে ভেবো না, সবাই খুব নিচু ধরনের পেশা বেছে নিয়েছিলেন। কখনো তাঁরা সৈনিক হিসেবে কাজ করেছেন, কখনো সওদাগর—মোট কথা মাঝামাঝি একটা অবস্থানে থেকেছেন সব সময়। দ্বিতীয় চার্লসের সময় থেকে এই শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত শুধু সওদাগরীই ছিলো তাদের পেশা।
১৭৯০-এর দিকে আমার দাদা মদ চোলাইয়ের ব্যবসা করে বেশ মোটা অঙ্কের সম্পদের মালিক হয়ে যান। ১৮২১ সালে তিনি মারা গেলে আমার বাবা উত্তরাধিকারসূত্রে মালিক হলেন তার সম্পত্তির। ঐ বিশাল সম্পত্তির বেশির ভাগই বাজে খরচ করে উড়িয়ে দিলেন বাবা। দশ বছর আগে মারা গেছেন তিনি। আমার জন্যে রেখে গেছেন বছরে দুহাজার পাউণ্ড আয়ের সম্পত্তি।
হাতে নগদ টাকা আসার সঙ্গে সঙ্গে আমি বেরিয়ে পড়লাম অভিযানে। এটার সঙ্গে সম্পর্ক ছিলো সেই অভিযানের, লোহার বাক্সটার দিকে ইশারা করলো সে। শোচনীয়ভাবে শেষ হলো আমার সেই অভিযান। কোনো মতে প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারলাম আমি। ফেরার পথে দক্ষিণ ইউরোপ ভ্রমণ করলাম, শেষে পৌঁছুলাম এথেন্সে। ওখানে পরিচয় হলো আমার প্রিয়তমা স্ত্রীর সাথে। আমার গ্রীক পূর্বপুরুষদের ঢংয়ে যদি নাম দেয়া হতো, তাহলে হয়তো ওর নাম হতো অপরূপা। ওকে বিয়ে করলাম আমি। এক বছর পর আমার এক ছেলেকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেল ও।
কিছুক্ষণের জন্যে থামলো সে। মাথাটা ঝুলে পড়লো হাতের ওপর। একটু পরে আবার শুরু করলো–
বিয়ে আমাকে সরিয়ে দিলো আমার কাজ থেকে। এখন ইচ্ছে করলেও আর তাতে ঢুকতে পারবো না আমি। আমার সময় শেষ, হলি-আমার সময় শেষ! আমি যে দায়িত্ব তোমাকে দিতে যাচ্ছি তা যদি নাও, একদিন সব জানতে পারবে তুমি।
স্ত্রীর মৃত্যুর পর মন শক্ত করে আরেকবার চেষ্টা করার সিদ্ধান্ত আমি নিয়েছিলাম। কিন্তু আমার প্রথম অভিযানের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারলাম, পুব দেশীয় কথ্য ভাষা, বিশেষ করে আরবী বলায় দক্ষ না হলে লাভ হবে না। এ ভাষা, শেখার জন্যেই এখানে এসেছিলাম আমি। এখানে আসার কিছু দিনের ভেতরেই আমার এই রোগটা দেখা দেয়। এখন তো শেষ অবস্থায় এসে পড়েছি। কথাটার ওপর জোর দেয়ার জন্যেই যেন তীব্র কাশির দমকে কুঁকড়ে গেল সে।
আমি আর একটু হুইস্কি দিলাম তাকে। খেয়ে আবার একটু সুস্থ বোধ করতে লাগলো সে। বলে চললো–
লিও মানে আমার ছেলেকে কখনো দেখিনি আমি। জন্মের পর, যখন ছোট্ট এতটুকুন ছিল তখন দেখেছি, তারপর আর না। দেখার ইচ্ছেই হয়নি কখনো। তবে শুনেছি, এখন নাকি খুব চটপটে হয়েছে, সুন্দরও। পকেট থেকে আমার নাম লেখা একটা চিঠি বের করলো সে। আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, এতে আমি লিখে দিয়েছি, কি পাঠক্রম অনুসরণ করবে ছেলেটাকে লেখাপড়া করানোর সময়। একটু অদ্ভুত মনে হবে, কিন্তু উপায় নেই, ওভাবেই গড়ে উঠতে হবে ওকে। সে-কারণেই অপরিচিত কারো ওপর ওর ভার দেয়া যাবে না। হলি, তুমি নেবে এই দায়িত্ব?
কি দায়িত্ব, সেটা আগে জানতে হবে আমাকে, বললাম আমি।
আমার ছেলে লিওর দায়িত্ব। ওর বয়স পঁচিশ না হওয়া পর্যন্ত তোমার কাছে থাকবে-একটা কথা মনে রাখবে, কখনো স্কুলে পাঠাবে না ওকে। যেদিন ওর বয়স পঁচিশ পূর্ণ হবে সেদিনই শেষ হবে তোমার অভিভাবকত্ব। তারপর এই চাবিগুলো দিয়ে, টেবিলের ওপর রাখলো সে চাবি কটা। ঐ লোহার বাক্সটা খুলবে। ওকে পড়তে দেবে ভেতরের জিনিসগুলো। পড়া শেষ হলে ওকে জিজ্ঞেস করবে, রহস্য অনুসন্ধানে যেতে চায় কিনা। কোনোরকম বাধ্যবাধকতা নেই; ওর ইচ্ছে হলে যাবে, না হলে যাবে না।
এবার শোনো শর্তগুলো। আমার বর্তমান আয় বছরে দুহাজার দুশো। যদি আমার ছেলের অভিভাবকত্ব নাও তাহলে আমার উইল অনুযায়ী ওর অর্ধেকটা তুমি পেতে থাকবে সারা জীবন। বছরে এক হাজার তোমার পারিশ্রমিক-আগেই বলেছি ওকে স্কুলে পাঠাতে পারবে না, সুতরাং ছেলেটাকে মানুষ করতে হলে জীবন দিয়ে খাটতে হবে তোমাকে। আর একশো হচ্ছে ছেলেটার ভরণপোষণের খরচ। বাকি অর্ধেক লিওর বয়স পঁচিশ না হওয়া পর্যন্ত জমা হতে থাকবে। যে রহস্যের কথা বললাম তা সমাধানের জন্যে যদি ও বেরোতে চায়, তখন যেন মোটা অঙ্কের একটা টাকা থাকে হাতে।
ধরো দায়িত্ব শেষ হওয়ার আগেই আমি মারা গেলম, তখন? জিজ্ঞেস করলাম আমি।
চ্যান্সারি ওর অভিভাবক হবে। তোমাকে শুধু একটা উইল করে যেতে হবে। যেন এই বাক্সটার মালিক হয় লিও। শোনো, হলি, আমাকে ফিরিয়ে দিও না। বিশ্বাস করো, তুমি ছাড়া আর কেউ পারবে না এ দায়িত্ব নিতে।
আগ্রহী, চোখে আমার দিকে তাকালো সে। আমি এখনো ইতস্তত করছি, দায়িত্বটা এত অদ্ভুত!
আমার মুখ চেয়ে দায়িত্বটা নাও, হলি। আমাদের বন্ধুত্বের কথা স্মরণ করো, তাছাড়া, আমার শরীরের যা অবস্থা আর কোনো ব্যবস্থা করার সময় আমি পাবো না।
ঠিক আছে, অবশেষে আমি বললাম, আমি করবো, তবে এতে যা লিখেছো তা যদি আমার মনঃপূত হয় তবেই। একটু আগে যে খামটা ও দিয়েছে সেটা দেখলাম।
আহ্, বাঁচালে, হলি। কি বলে তোমাকে ধন্যবাদ দেবো, জানি না। নিশ্চিন্ত থাকো, তোমার মনঃপূত হবে না এমন কোনো কথাই ওতে নেই। কথা দাও, বাবার মেয়ে মানুষ করবে ছেলেটাকে, আর ঐ চিঠিতে আমি যেভাবে যেভাবে বলেছি সেভাবে ওকে শিক্ষা দেবে।
বেশ, কথা দিলাম।
এবার তাহলে যাই আমি, হলি, বাক্সটা রইলো, এখানে। খামের ভেতর পাবে উইল। ছেলেটাকে আনিয়ে নিও। উইলটা দেখালেই ওরা দিয়ে দেবে তোমার কাছে। তোমার সততা সম্পর্কে আমার কোনো সন্দেহ নেই, হলি, তবু বলছি, যদি বিশ্বাসঘাতকতা করো, আমার আত্মা সারাজীবন তোমাকে তাড়া করে ফিরবে।
কিছু বললাম না আমি।–আসলে বলতে পারলাম না।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে। মোমবাতিটা তুলে নিয়ে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকালো। মুখটা এক কালে সুন্দর ছিলো, কিন্তু অসুখ সেটাকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছে।
পোকার খাদ্য, বললো সে। ভাবতে পারো, কয়েক ঘণ্টার ভেতর ঠাণ্ডা শক্ত হয়ে যাবে আমার এই শরীর-বেড়ানো শেষ, খেল খতম। বেঁচে থাকার যে যন্ত্রণা তার তুলনায় কতটুকু দাম জীবনের অন্তত আমার ক্ষেত্রে তো শূন্য! আশা করি আমার ছেলের বেলায় তা হবে না, যদি ওর সাহস আর বিশ্বাস থাকে। বিদায় বন্ধু! বলেই আচমকা আমাকে জড়িয়ে ধরলো সে। কপালে একটা চুমু খেয়ে ঘুরে দাঁড়ালো যাওয়ার জন্যে।
শোনো, ভিনসি, তুমি যদি এতই অসুস্থ, একটু বসো, আমি ডাক্তার নিয়ে আসি।
না-না, হলি। ডাক্তার ডাকার কোনো দরকার নেই। ডাক্তার আমার মরণ ঠেকাতে পারবে না। বিষ খাওয়া ইদুরের মতো আমি মরুবো। আমি চাই না, সে সময় কেউ থাকুক আমার কাছে।
না-না, ভিনসি, আমি বিশ্বাস করি না…
হাসলো সে। একটা মাত্র কথা উচ্চারণ করলো, মনে রেখো তোমার দায়িত্ব! তারপর চলে গেল।
আর আমি, আস্তে আস্তে বসে পড়লাম একটা চেয়ারে—ভিনসিকে ঠেকানোর কথা মনে পড়লো না। বসে বসে চোখ ডলতে লাগলাম, যেন নিশ্চিত হতে চাইছি, সত্যিই জেগে আছি না স্বপ্ন দেখছি। স্বপ্ন যে দেখছি না তা বুঝতে অসুবিধা হলো না। তখন মনে হলো, নিশ্চয়ই মাতাল অবস্থায় ছিলো ভিনসি। ও যা বলে গেল বা করে গেল, কোনো স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে তা বলা বা করা অসম্ভব। অনেকগুলো প্রশ্ন জাগলো আমার মনে, এক এক করে সেগুলোর উত্তর। খুঁজতে লাগলাম। পাঁচ বছর বয়েসের একটা ছেলে আছে অথচ তাকে বাচ্চা বয়েসে ছাড়া কখনো দেখেনি, সম্ভব? না। এত নিখুঁত ভাবে কেউ তার মৃত্যুর কথা আগে থাকতে বলে দিতে পারে?। খ্রীষ্ট-জন্মের তিনশো বছর আগের পূর্বপুরুষের পরিচয় জানা বা এমন আচমকা একমাত্র ছেলের অভিভাবকত্ব আর নিজের সম্পত্তির অর্ধেক কোনো কলেজ বন্ধুকে দিয়ে দেয়া সম্ভব কারো পক্ষে? অবশ্যই না। তাহলে? হয় পাগল হয়ে গেছে, নয়তো মাতাল অবস্থায় ছিলো ভিনসি। তা-ই যদি হয়, লোহার বাক্সটায় কি আছে?
মাথা-মুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। পাগল হওয়ার অবস্থা আমারও। শেষে বিরক্ত হয়ে শুয়ে পড়লাম বিছানায়। সঙ্গে সঙ্গে তলিয়ে গেলাম গভীর ঘুমে।
ঘুম ভাঙলো সকাল আটটায়। শুনলাম কে যেন ডাকছে আমার নাম ধরে। উঠে গিয়ে দেখি, জন। কলেজে নানা কাজে আমাকে আর ভিসিকে সাহায্য করে ছেলেটা।
কি ব্যাপার, জন, কি হয়েছে? জিজ্ঞেস করলাম আমি। এমন চেচাচ্ছো, ভূত দেখেছো নাকি?
আরো খারাপ, স্যার, জবাব দিলো সে। লাশ! রোজকার মতো আজও মিস্টার ভিনসিকে ডাকতে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি, ঠাণ্ডা, শক্ত, মরে পড়ে আছেন!
.
০২.
হতভাগ্য ভিনসির মৃত্যুতে বেশ একটা আলোড়ন হলো কলেজে। তবে তার মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানের কোনো তোড়জোড় হলো না। কারণ সবাই জানতো, ও অসুস্থ, তাছাড়া ডাক্তারও রায় দিলেন, মৃত্যুটা স্বাভাবিক, আগের দিন রাতে ওর সাথে আমার যে আলাপ হয়েছিলো, সে সম্পর্কে আমি কোনো উচ্চবাচ্য করলাম না। শুধু বললাম, প্রায়ই যেমন আসতো সেদিনও তেমন ও এসেছিলো আমার কাছে।
অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার দিন এক আইনজীবী এলেন লণ্ডন থেকে। ভিনসির শব যাত্রায় অংশ নিলেন ভদ্রলোক। তারপর চলে গেলেন। যাওয়ার আগে ওর ঘর থেকে নিয়ে গেলেন উত্তরাধিকার সংক্রান্ত কাগজগুলো। নিশ্চয়ই ভিনসি উকিলকে আগেই জানিয়েছিলো কোথায় পাওয়া যাবে ওগুলো। লোহার বাক্সটা রইলো আমার কাছে।
পরের এক সপ্তাহ আর এ নিয়ে ভাবনা-চিন্তার সুযোগ পেলাম না আমি। ভীষণ ব্যস্ত থাকতে হলো ফেলোশীপের পরীক্ষা নিয়ে। অবশেষে শেষ হলো পরীক্ষা। ক্লান্ত শরীরে ঘরে ফিরে ডুবে গেলাম একটা আরাম কেদারায়। মনটা বেশ খুশি খুশি, ভালোই হয়েছে পরীক্ষা।
আর সব চিন্তা বিদায় হয়েছে। মস্তিষ্কটা ফাঁকা। এই সুযোগে আবার গুড়ি মেরে এগিয়ে এলো ভিনসি, তার ছেলে, তার সম্পত্তি, তার রহস্যময় আচরণ। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ভেবে দেখলাম আবার। মনে হলো, একটাই সিদ্ধান্ত টানা। যায়, আত্মহত্যা করেছে ভিনসি। কিন্তু কেন? এ প্রশ্নের সমাধান তমার জানা নেই। লোহার সিন্দুকটা খুলতে পারলে হয়তো জানা যেতো। কিন্তু তা সম্ভব নয়। ভিসির কাছে প্রতিজ্ঞা করেছি-ওর ছেলের বয়স পঁচিশ হওয়ার আগে খোলা হবে না ওটা।
বসে বসে ভাবছি এসব, এমন সময় দরজায় শব্দ। বড়, পেট মোটা, নীল একটা খাম দিয়ে গেল ডাক-পিয়ন। দেখেই বুঝলাম উকিলের চিঠি, আর নিঃসন্দেহে ভিনসির দেয়া দায়িত্বের সাথে এর সম্পর্ক আছে। চিঠিটা পড়লাম। ভিনসি তার সম্পত্তি আর ছেলের দায়িত্ব নেয়া সম্পর্কে যা যা বলেছিলো প্রায় তা-ই বলেছেন আইনজীবী দুজন। অতিরিক্ত যা বলেছেন তা হলো, নাবালক লিও ভিনসির স্বার্থ ঠিকমতো রক্ষা হচ্ছে কিনা তা তদারকির জন্যে ভিনসির উইলের ব্যাপারটা কোর্ট অভ চ্যান্সারিকে জানিয়েছেন তারা। বাচ্চাটাকে কবে, কোথায় কিভাবে হস্তান্তর করবেন তা জানতে চেয়েছেন সবশেষে।
চিঠির নিচে স্বাক্ষর রয়েছে, জিওফ্রে অ্যাণ্ড জর্ডান।
চিঠি রেখে এবার উইলের অনুলিপিটা তুলে নিলাম। সহজ ভাষায় পরিষ্কার করে লেখা। আমার সাথে শেষ সাক্ষাতের সময় উইল সম্পর্কে ভিনসি যা যা বলেছিলো হুবহু তাই। তার মানে সত্যিই ছেলেটার দায়িত্ব নিতে হবে আমাকে। হঠাৎ মনে পড়লো লোহার সিন্দুকের সঙ্গে যে চিঠিটা রেখে গেছিলো ও সেটার কথা। তাড়াতাড়ি নিয়ে এসে খুললাম চিঠিটা। প্রথমে লেখা লিওর পঁচিশতম জন্মদিনে সিন্দুকটা খোলার নির্দেশ। তারপর লিখেছে কি কি পদ্ধতি এবং শিক্ষাক্রম অনুসরণ করতে হবে ছেলেটার শিক্ষার ব্যাপারে: গ্রীক, উচ্চতর গণিত এবং আরবী যেন অবশ্যই পড়ানো হয় সে সম্পর্কে রয়েছে স্পষ্ট নির্দেশ। সবশেষে পুনশ্চ দিয়ে লিখেছে, পঁচিশ বছর বয়স হওয়ার আগেই যদি ছেলেটা মারা যায়, যদিও ওর বিশ্বাস তেমন কিছু ঘটবে না। আমিই খুলবো সিন্দুকটা এবং যে সব তথ্য পাবো, নিজেকে যোগ্য মনে করলে সে অনুযায়ী বের হবো রহস্য অনুসন্ধানে আর অযোগ্য মনে করলে পুড়িয়ে ফেলতে হবে ভেতরের জিনিসগুলো। কোনো পরিস্থিতিতেই অপরিচিত কারো কাছে দেয়া চলবে না ওসব।
চিঠিটা পড়ার পর আপত্তি করার মতো কিছু খুঁজে পেলাম না আমি। মেসার্স জিওফ্রে অ্যাণ্ড জর্ডানকে লিখে দিলাম, দায়িত্ব গ্রহণ করছি। আশা করি, দিন দশেকের ভেতর আমি লিও ভিসির অভিভাবকত্ব নিতে পারবো।
চিঠিটা পাঠিয়ে দিয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে গেলাম আমি। আসল কথা পুরোটা চেপে গিয়ে কেবল ভিসির অনুরোধে তার ছেলের অভিভাবকত্ব নেয়ার কথাটুকু জানালাম। কলেজের ফেলো থাকা অবস্থায় ছেলেটাকে যেন আমার কাছে রাখতে পারি তার অনুমতি চাইলাম। প্রথমে তো কিছুতেই রাজি হবে না কর্তৃপক্ষ। অনেক পীড়াপীড়ির পর রাজি হলো, তবে এক শর্তে, কলেজের ঘর ছেড়ে দিতে হবে আমাকে, নিজের থাকার ব্যবস্থা নিজেকেই করতে হবে।
ভালো কথা। একটু কষ্ট হলেও কলেজের কাছাকাছিই একটা বাসা খুঁজে বের করে ফেলতে পারলাম। এবার ছেলেটার দেখাশোনার জন্যে একজন লোক ঠিক করতে হবে। একটা ব্যাপার ভেবে রেখেছি প্রথমেই, কোনো মহিলাকে খবরদারী করতে দেবো না লিওর ওপর। আমার জন্যে যদি বিন্দুমাত্রও ভালোবাসা জন্মায় ওর মনে তাতে কিছুতেই ভাগ বসাতে দেবো না কোনো মেয়েকে। তাছাড়া বাচ্চাটার যা বয়েস তাতে মেয়েমানুষের সাহায্য ছাড়াই ও চলতে পারবে। বেশ খোঁজাখুঁজি করে গোলমুখো এক যুবককে ঠিক করে ফেললাম। নাম। জব। এক শিকারীর আস্তাবলে সাহায্যকারীর কাজ করতো। পাঁচ বছরের একটা বাচ্চার দেখাশোনা করতে হবে শুনে বেশ খুশি মনেই ও চলে এলো আমার সঙ্গে। এরপর সিন্দুকটা নিয়ে লণ্ডন গেলাম। ব্যাঙ্কে জমা রাখলাম ওটা। তারপর শিশুর স্বাস্থ্য ও পরিচর্যা বিষয়ক কয়েকটা বই কিনে ফিরে এলাম বাসায়। বইগুলো প্রথমে নিজে পড়লাম, তারপর জোরে জোরে পড়ে শোনালাম জবকে। তারপর অপেক্ষা লিওর জন্যে।
অবশেষে এলো লিও। বয়স্ক এক মহিলা দিয়ে গেল তাকে।
কি সুন্দর ছেলেটা! এমন নিখুঁত সুন্দর শিশু এর আগে কখনো দেখিনি আমি। চোখ দুটো ধূসর, চওড়া কপাল, মুখটা এই বাচ্চা বয়সেই খোদাই করা মূর্তির মতো কাটা কাটা। সবচেয়ে আকর্ষণীয় জিনিসটা, সম্ভবত, ওর চুল। নিখাদ সোনার মতো রং। কোঁকড়া। ঘন হয়ে লেপ্টে আছে সুগঠিত মাথার সাথে।
সঙ্গের মহিলা যখন চলে গেল, সামান্য কাঁদলো ও। কখনো আমি ভুলতে পারবে না সে দৃশ্য। দাঁড়িয়ে আছে ও, জানালা দিয়ে রোদ এসে পড়েছে ওর সোনালি চুলে, একটা হাত মুঠো পাকিয়ে ডলছে একটা চোখ, অন্য চোখে চেয়ে আছে আমাদের দিকে। চেয়ারে বসে আছি আমি, একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে অপেক্ষা করছি, কখন আসবে আমার কোলে। অন্যদিকে জব, ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে নানা ধরনের ছেলেভোলানো শব্দ করে চলেছে। কয়েক মিনিট চললো। এরকম, তারপর হঠাৎ দুহাত বাড়িয়ে দিয়ে আমার দিকে ছুটে এলো ছেলেটা।
তুমি ভালো, বললো ও। দেখতে পচা, কিন্তু ভালো। বু
কের ভেতর জড়িয়ে ধরলাম লিওকে।
দশ মিনিট পর দেখা গেল, মাখন লাগানো বিরাট এক টুকরো রুটি পরম তৃপ্তির সাথে খাচ্ছে ও। রুটিতে জ্যাম মাখিয়ে দিতে চাইলো জব। কড়া চোখে ওর দিকে তাকালাম আমি, স্মরণ করিয়ে দিলাম, মাখনের সঙ্গে জ্যাম কঠোর ভাবে নিষেধ করা হয়েছে বই-এ।
অল্পদিনের ভেতর সারা কলেজের প্রিয় পাত্র হয়ে উঠলো লিও। আমার সঙ্গে খুব ভাব হয়ে গেছে ওর। যত দিন যাচ্ছে ততই আমরা আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠছি। আমি ওকে যতটা আদর করি খুব কম ছেলেই বাবার কাছ থেকে ততটা আদর পায়, আর ও আমাকে যতটা ভালোবাসে খুব কম বাবাই তা পেয়েছে ছেলের কাছ থেকে। পৃথিবীটাকে আজকাল খুব সুন্দর মনে হয় আমার।
দিনগুলো কেমন দ্রুত চলে যাচ্ছে। ছোট্ট লিও শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে পা দিলো। তারপর যৌবনে। বয়স যত বাড়ছে ওর শরীরের এবং মনের সৌন্দর্যও যেন ততই বাড়ছে।
ওর বয়স যখন পনেরো, কলেজের সবাই ওকে ডাকতে লাগলো বিউটি বলে আর আমার নাম দিলো বিস্ট। আমরা দুজন এক সাথে বেরোলেই আড়ালে ওরা বলাবলি করে, ঐ দেখ, বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট যাচ্ছে।
এক লোক একদিন একটু জোরেই বলে ফেললো কথাটা। শুনতে পেলো লিও। চোখের পলক ফেলার আগেই দেখলাম, ছুটে গেল ও। টুটি টিপে ধরলো ওর দ্বিগুণ আকারের লোকটার। মজা দেখার জন্যে কিছু দেখতে পাইনি, এমন। ভঙ্গি করে এগিয়ে গেলাম আমি। একটু পরে পেছন ফিরে দেখি, লোকটাকে মাটিতে শুইয়ে দিয়ে ফিরে আসছে লিও।
আরো কয়েকটা বছর কেটে গেল। এখন কলেজের নিন্দুকেরা আড়ালে আমাকে ডাকে চ্যারণ (গ্রীক পুরাণে বর্ণিত মৃত্যু নদীর খেয়া নৌকার মাঝি) আর লিওকে গ্রীক দেবতা! এবার দারুণ একটা নাম দিয়েছে ওরা। লিওর দিকে তাকালে মনে হয়, সত্যিই সাক্ষাৎ অ্যাপোলো যেন নেমে এসেছে মর্তের মাটিতে।
এ তো গেল চেহারার কথা, জ্ঞান বুদ্ধির দিক থেকেও লিও চমৎকার! ওর বাবার নির্দেশ মতো ওকে শিক্ষা দিচ্ছি আমি। গ্রীক এবং আরবীতে আশানুরূপ দক্ষতা দেখাচ্ছে ও। আরবী ভাষাটা ওকে ঠিকমতো শেখানোর জন্যে আমাকেও শিখতে হয়েছে। পাঁচ বছরের ভেতর দেখলাম, আমার চেয়ে তো বটেই, যে অধ্যাপক আমাদের দুজনকেই শিখিয়েছেন তাঁর চেয়ে কোনো অংশে খারাপ জানে না ও ভাষাটা।
।শিকার সব সময়ই আমাকে বিশেষ ভাবে আকর্ষণ করে। আমার অপ্রতিরোধ্য আবেগের প্রকাশ যেন আমি ঘটাতে পারি এর ভেতর দিয়ে। লিওর মাঝেও আমি সঞ্চারিত করেছি এই আবেগটা। প্রতি শরতে আমরা কোথাও না কোথাও চলে, যাই। হয় মাছ ধরতে, নয়তো শিকার করতে। কখনো স্কটল্যাণ্ডে, কখনো নরওয়েতে, রাশিয়ায়ও গিয়েছি একবার। বন্দুকে আমার হাতের টিপ খুব ভালো, কিন্তু আজকাল দেখছি আমাকেও হারিয়ে দিচ্ছে লিও।
লিওর বয়স যখন আঠারো, ওকে কলেজে ভর্তি করে দিলাম। একুশ বছর বয়সে ও ডিগ্রি নিয়ে বেরোলো-সম্মানজনক একটা ডিগ্রি, যদিও খুব উঁচু কিছু নয়। এই সময় আমি প্রথম বারের মতো ওকে ওর ইতিহাস শোনালাম। সামনে যে রহস্য উন্মোচন করতে হবে তা-ও বললাম। খুবই কৌতূহলী হয়ে উঠলো লিও। আমি বললাম, পঁচিশ বছর বয়েস হওয়ার আগে কৌতূহল মেটানোর কোনো উপায় নেই, কেননা ওর বাবা সেরকমই নির্দেশ দিয়ে গেছে।
ওকে নিয়ে একটাই মাত্র ঝামেলা আমার–কোনো মেয়ে পরিচিত হওয়া মাত্র প্রেমে পড়ে যায় ওর। তবে আমার ভাগ্য ভালো, খুবই বুদ্ধিমান ছেলে লিও, প্রেমের প্রতিটা ফাঁদই সাফল্যের সঙ্গে কেটে বেরিয়ে আসে ও।
এভাবে পেরিয়ে গেল বাকি দিন কটা। পঁচিশ বছর পূর্ণ হলো লিওর।
.
০৩.
লিওর পঁচিশতম জন্মদিনের আগের দিন আমরা দুজনেই লণ্ডন গেলাম। সেই রহস্যময় সিন্দুকটা ব্যাঙ্ক থেকে তুলে সন্ধ্যার দিকে ফিরে এলাম কেমব্রিজে।
সারারাত ঘুমোতে পারলাম না আমরা। ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার ঘরে হাজির হলো লিও। পরনে এখনো রাতের পোশাক। ওর ইচ্ছা, এখনি (খোলা হোক সিন্দুকটা।
বিশ বছর না ভোলা অবস্থায় আছে, বললাম আমি। আর কিছুক্ষণ থাকলে খুব একটা অসুবিধা হবে না। নাশতা সেরেই ওটা খুলবো আমরা।
ঠিক নটায়—একটু অস্বাভাবিক রকম কাঁটায় কাঁটায় নটায় আমরা নাশতা সারলাম। উত্তেজনায় টগবগ করছে আমাদের ভেতরটা। এমন কি জবের ভেতরেও সংক্রামিত হয়েছে উত্তেজনা। আমরা কেউই ঠিক স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। লিওর চায়ে চিনির বদলে এক টুকরো বেকন দিয়ে দিলাম আমি। আমার অত্যন্ত দামী একটা চায়ের কাপের হাতল ভেঙে ফেললো জব। সব মিলিয়ে অস্থির একটা অবস্থা।
অবশেষে, এঁটো বাসন পেয়ালা সরানো হলো টেবিল থেকে। আমার অনুরোধে জব সিন্দুকটা এনে রাখলো টেবিলের ওপর। তারপর ভাব দেখালো যেন চলে যাচ্ছে ঘর ছেড়ে, সিন্দুক বা তার ভেতরের জিনিসপত্র সম্পর্কে কোনো উৎসাহ নেই ওর।
একটু দাঁড়াও, জব, বললাম আমি। লিওর আপত্তি না থাকলে নিরপেক্ষ একজন সাক্ষী রাখতে চাই। তবে একটা কথা, আমাদের দুজনের অনুমতি ছাড়া মুখ খুলতে পারবে না।
নিশ্চয়ই, হোরেস কাকা, বললো লিও-কাকা ডাকতেই আমি শিখিয়েছি ওকে।
দরজা বন্ধ করে দাও, জব, বললাম আমি। আর টুকটাক জিনিস রাখার যে বাক্সটা আছে, ওটা নিয়ে এসো।
নির্দেশ পালন করলো জব। ভিনসি অর্থাৎ লিওর বাবা মৃত্যুর রাতে যে, চাবিগুলো দিয়ে গিয়েছিলো সেগুলো বের করলাম বাক্স থেকে। মোট তিনটে। সবচেয়ে বড় চাবিটা তুলনামূলকভাবে আধুনিক, দ্বিতীয়টা অতি প্রাচীন আর তৃতীয়টা—কি বলবো, কোনো কিছুর সাথে সাদৃশ্য নেই এর। রূপোর তৈরি নিরেট একটা টুকরোর মতো। টুকরাটার সঙ্গে আড়াআড়িভাবে লাগানো সরু একটা দণ্ড। হাতলের কাজ করে দণ্ডটা। শেষ মাথায় ছোট ছোট কয়েকটা খাঁজ। মোট কথা, চাবির চেহারা যে এমন হতে পারে তা আমাদের ধারণায় ছিলো না।
তৈরি তোমরা? বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞরা মাইন ফাটানোর আগে যেমন জিজ্ঞেস করে তেমন জিজ্ঞেস করলাম আমি।
কেউ কোনো জবাব দিলো না। বড় চাবিটা তুলে নিলাম। উত্তেজনায় মৃদু মৃদু কাঁপছে আমার হাত। খাঁজগুলোয় তেল মাখিয়ে ধীরে ধীরে তালায় ঢোকালাম চাবি। মোচড় দিতেই খুলে গেল তালা। একটু ঝুঁকে এলো লিও। দুহাতে সর্বশক্তিতে টেনে ওঠালো সিন্দুকের ভারি ডালাটা। কজাগুলোয় মরচে পড়ে গেছে। বলে শক্তি লাগলো বেশ। ডালাটা উঠে যেতেই দেখলাম ভেতরে আরেকটা বাক্স, ধুলোয় ছেয়ে আছে। কোনোরকম কষ্ট ছাড়াই সিন্দুকের ভেতর থেকে বের করে আনলাম সেটা।
আবলুস কাঠের বাক্স—অন্তত দেখে তাই মনে হলো আমার। প্রতিটা কোনা লোহার পাত দিয়ে মোড়া। কালের করাল গ্রাসে ক্ষয়ে গেছে জায়গায় জায়গায়।
এবার এটা, দ্বিতীয় চাবিটা ঢোকাতে ঢোকাতে বিড় বিড় করলাম আমি।
নিঃশ্বাস বন্ধ করে সামনে ঝুঁকলো লিও আর জব। যোরালাম চাবি। আমিই খুললাম এই বাক্সের ডালা। পরমুহূর্তে বিস্ময়ের একটা ধ্বনি বেরোলো আমার গলা দিয়ে। বাক্সটার ভেতর আরেকটা বাক্স। রূপোর। অত্যন্ত চমৎকার সূক্ষ্ম কারুকাজ করা।
বাক্সটা বের করে রাখলাম টেবিলের ওপর। অদ্ভুতদর্শন রূপোর চাবিটা এবার ঢুকালাম। এদিকে ওদিকে নানা ভাবে ঘুরিয়ে চাপ দিয়ে যেতে লাগলাম। ক্লিক করে এক সময় খুলে গেল তালাটা। আপনা আপনি খাড়া হয়ে গেল বাক্সের ডালা। বাদামী রঙের ফালি ফালি জিনিসে বাক্সটার কানা পর্যন্ত ঠাসা। দেখতে অনেকটা কাগজের মতো কিন্তু কাগজ নয়, নরম কোনো উদ্ভিদের আঁশ সম্ভবত। সাবধানে ওগুলো বের করে আনলাম। ওপর দিক থেকে প্রায় তিন ইঞ্চি খালি হয়ে গেল বাক্স। আধুনিক চেহারার সাধারণ একটা খাম চোখে পড়লো। ওপরে আমার প্রয়াত বন্ধু ভিনসির হাতে লেখা:
আমার পুত্র লিওর প্রতি।
চিঠিটা লিওর হাতে দিলাম। খামটার দিকে এক পলক তাকিয়েই সেটা টেবিলে নামিয়ে রাখলো ও। তারপর এমন একটা ভঙ্গি করলো, আমার বুঝতে অসুবিধে হলো না, বাক্সের অন্যান্য জিনিস দেখতেই বেশি আগ্রহী ও।
এরপর যে জিনিসটা আমি বের করলাম, সেটা একটা পার্চমেন্ট, সাবধানে পাকিয়ে রাখা। পাক খুলে দেখলাম, এটাও ভিনসির হাতে লেখা। ওপরে শিরোনাম: পোড়ামাটির ফলক-এর ওপর প্রাচীন গ্রীক অক্ষরে লেখা বক্তব্যের অনুবাদ। চিঠির পাশে নামিয়ে রাখলাম ওটা। তারপর বেরোলো আরেকটা পার্চমেন্ট; অনেক প্রাচীন, আগেরটার মতোই পাকিয়ে রাখা। জায়গায় জায়গায় হলুদ হয়ে গেছে। অত্যন্ত সাবধানে এটা খুললাম আমি। মনে হলো একই মূল গ্রীকের অনুবাদ এটাও। তবে ইংরেজিতে নয়, প্রাচীন ল্যাটিন অক্ষরে। লেখার ধরন ইত্যাদি দেখে মনে হলো, জিনিসটা সম্ভবত মোল শতকের প্রথম দিককার।
এটার ঠিক নিচেই পেলাম শক্ত এবং ভারি একটা জিনিস, হলদে রঙের লিনেনে জড়ানো। আলগোছে উঠিয়ে আনতেই দেখলাম আরেক প্রস্থ সেই আঁশ আঁশ জিনিসের ওপর বসানো ছিলো ওটা। ধীরে ধীরে, অত্যন্ত সতর্কতার সাথে জড়ানো লিনেনটা খুলে আনতেই বেশ বড় নোংরা-হলুদ রঙের একটা পোড়া মাটির ফলক বেরোলো। দেখেই বুঝলাম খুব প্রাচীন জিনিস। এক কালে সম্ভবত মাঝারি আকৃতির সাধারণ কোনো পাত্রের অংশ ছিলো। লম্বায় হবে সাড়ে দশ ইঞ্চি, চওড়ায় সাত, এবং প্রায় সিকি ইঞ্চির মতো পুরু। উত্তল দিকটায় খুদে খুদে প্রাচীন গ্রীক অক্ষরে কি যেন লেখা। জায়গায় জায়গায় অস্পষ্ট হয়ে গেছে অক্ষরগুলো। লম্বালম্বি একটা দাগ। দেখতে পেলাম ফলকটায়-বোধহয় ভেঙে গিয়েছিলো কখনো, পরে সংযোজক কোনো পদার্থ দিয়ে জোড়া দেয়া হয়েছে। ভেতরের দিকটাতেও অসংখ্য লেখা। কিন্তু এগুলো ভীষণ এলোমেলো আর অদ্ভুত। স্পষ্টতই বোঝা যায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনের হাতে লেখা। ভাষাও বিভিন্ন।
আর কিছু? উত্তেজিত গলায় ফিসফিস করে উঠলো লিও।
রূপোর বাক্সটার ভেতর হাতড়ালাম আমি। ছোট্ট একটা লিনেনের থলে পেলাম এবার। থলের ভেতর থেকে বেরোলো হাতির দাঁতের ওপর আঁকা খুবই সুন্দর একটা মিনিয়েচার (ছোট্ট ছবি), আর একটা ছোট্ট চকলেট রঙের গোলমোহর সেটার ওপর আঁকা কয়েকটা চিহ্ন। যার অর্থ, এ পর্যন্ত আমরা যতদূর উদ্ধার করতে পেরেছি: সুটেন সি রা, অনুবাদ করলে দাঁড়ায় রা অর্থাৎ সূর্যের রাজোচিত পুত্র। মিনিয়েচারের ছবিটা লিওর মায়ের। অপূর্ব সুন্দরী এক মহিলা। উল্টোপিঠে ভিনসির হাতে লেখা, আমার প্রিয়তমা স্ত্রী।
ব্যস, আর কিছু নেই, বললাম আমি।
বেশ, মিনিয়েচারটা নামিয়ে রাখতে রাখতে বললো লিও, এতক্ষণ গভীর মমতার সঙ্গে মায়ের ছবিটা দেখছিলো ও। এবার তাহলে বাবার চিঠিটা পড়া যাক।
খামের সীলমোহর ভেঙে চিঠিটা বের করলো ও। জোরে জোরে পড়তে শুরু করলো:
প্রিয় পুত্র লিও,-এ চিঠি যখন খুলবে, যদি ততদিন বেঁচে থাকো, পরিপূর্ণ যুবক হয়ে উঠবে তুমি। আর আমি, অনেক দিন আগে মরে যাওয়া বিস্মৃত এক মানুষ। তবু এটা পড়ার সময় মনে রাখবে, আমি ছিলাম, আমার সমস্ত অস্তিত্ব নিয়ে আমি ছিলাম, হয়তো এখনো আছি, এই কাগজ কলমের যোগসূত্রের মাঝ দিয়ে মরণ সাগরের এপার থেকে বাড়িয়ে দিচ্ছি হাত, কবরের নৈঃশব্দ পেরিয়ে আমার স্বর পৌঁছুচ্ছে তোমার কাছে। যদিও আমি মৃত, আমার কোনো স্মৃতিই আর অবশিষ্ট নেই তোমার মনে, তবু এই মুহূর্তে-যখন তুমি পড়ছো এটা, আমি আছি তোমার সাথে। তোমার জন্মের পর সামান্য সময়ের জন্যে একবার তোমাকে দেখেছিলাম। ব্যস ঐটুকুই, আর কখনো তোমাকে আমি দেখিনি। ক্ষমা কোরো আমাকে। এমন একজনের প্রাণের বিনিময়ে তুমি প্রাণ পেয়েছিলে যাকে আমি আমার সমস্ত হৃদয় দিয়ে ভালোবেসেছিলাম। এখনো সেই তিক্ত স্মৃতি আমি ভুলতে পারিনি। বেঁচে থাকলে হয়তো পারতাম, কিন্তু আমার নিয়তি তার। বিপক্ষে। অসহ্য শারীরিক এবং মানসিক যন্ত্রণা আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। তোমার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একটা ব্যবস্থা করতে পারলেই এর ইতি টানবো আমি। সেটা যদি ভুল হয়, ঈশ্বর যেন আমাকে ক্ষমা করেন। কিছুতেই আর এক বছরের বেশি বাঁচা চলবে না আমার।
যা ভেবেছিলাম! বললাম আমি, আত্মহত্যা করেছিলো ও!
জবাব দিলো না লিও। পড়তে লাগলো, নিজের সম্পর্কে অনেক কথা বললাম, এবার আসল কথায় আসা যাক। আমার বন্ধু হলি (ও যদি রাজি হয়, ওর ওপরই তোমাকে মানুষ করার ভার দিয়ে যাবে বলে ঠিক করেছি ) ইতিমধ্যে নিশ্চয়ই তোমাকে জানিয়েছে তোমার বংশের অসাধারণ প্রাচীনত্বের কথা। এই বাক্সে যেসব জিনিস আছে তাতেও তার সপক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ পাবে। আমার বাবা তার মৃত্যুশয্যায় আমাকে দিয়ে যান বাক্সটা। সেই মুহূর্ত থেকেই ব্যাপারটা শেকড় ছড়াতে শুরু করে আমার মনের ভেতর। আমার বয়স যখন মাত্র উনিশ, তখন আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, পোড়ামাটির ফলকে লেখা উপাখ্যানের সত্যতা যাচাই করবো। এলিজাবেথের আমলে আমাদের এক হতভাগ্য পূর্বপুরুষও সে চেষ্টা করেছিলেন, শোচনীয় পরিণতি হয়েছিলো তার। আমাকেও একই পরিণতি বরণ করতে হয়েছিলো। তবে আমার সৌভাগ্য, আমি ফিরে আসতে পেরেছিলাম এবং নিজের চোখে সব দেখে ফিরেছিলাম। আফ্রিকা উপকূলে, এখনো মানুষের পা পড়েনি এমন এক জায়গায়, জাম্বেসি নদী যেখানে সাগরে পড়েছে তার কিছু উত্তরে একটা অন্তরীপ আছে। তার শেষ প্রান্তে নিগ্রোর মাথার মতো দেখতে একটা চূড়া উঠে গেছে ওপর দিকে, লেখায় যেমন বর্ণনা আছে তেমন। ওখানে আমি নেমেছিলাম। স্থানীয় এক লোকের সাথে দেখা হয় আমার কিছু একটা অপরাধ করেছিলো লোকটা ফলে নিজের মানুষজন তাকে বিতাড়িত করে। সে আমাকে জানায়, ডাঙার ভেতর দিকে অনেক দূরে বিরাট বিরাট পাহাড় আছে, পেয়ালার মত চেহারা। অসংখ্য গুহা সেগুলোতে। বিস্তীর্ণ জলাভূমি ঘিরে। রেখেছে পুরো অঞ্চলটাকে। আমি আরো জানতে পারি, আরবীর এক উপভাষায় কথা বলে তারা। অদ্ভুত সুন্দরী এক শ্বেতাঙ্গিনী তাদের শাসন করে। কালে ভদ্রে কখনো সে দেখা দেয় তাদের সামনে। জীবিত বা মৃত সব কিছুর ওপর নাকি তার ক্ষমতা রয়েছে। দুদিন পরে আমি জানতে পারি, ঐ লোকটা মারা গেছে। জলাভূমি পেরোনোর সময় সংক্রামক জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলো। এই সময় খাবার এবং পানির তীব্র অভাবে পড়ি আমি, অদ্ভুত এক অসুখের লক্ষণও দেখা দেয়। কোনো রকমে আমি আমার ডাউ-এ (এক মাস্তুলঅলা এক ধরনের জাহাজ) ফিরে আসতে পেরেছিলাম। সে সময় আমারূজবস্থা রীতিমতো বিধ্বস্ত।
এরপর বেঁচে থাকার জন্যে কি দুঃসাহসিক কাণ্ড করতে হয়েছিলো আমাকে তার বর্ণনা নিঃপ্রয়োজন। মাদাগাস্কার উপকূলে বিধ্বস্ত হয় আমার ডাউ। কয়েক মাস পর এক ইংলিশ জাহাজ আমাকে উদ্ধার করে এড়েন-এ নিয়ে আসে। সেখান থেকে ইংল্যাণ্ডের পথে রওনা হই আমি। তখনো আমি সিদ্ধান্তে অটল, উপযুক্ত প্রস্তুতি নিতে যে কয়দিন লাগে অপেক্ষা করবো, তারপর আবার ফিরে যাবো সেখানে, রহস্যের শেষ দেখে ছাড়বো। ফেরার পথে গ্রীসে থামলাম। ওখানে পরিচয় হলো তোমার মায়ের সাথে। তাঁকে বিয়ে করলাম আমি। ওখানেই জন্ম হলো তোমার, এবং তোমাকে পৃথিবীর আলো দেখাতে গিয়ে মারা গেলেন তোমার মা। তারপর সেই অন্তিম অসুখে পড়লাম আমি, মরার জন্যে ফিরে এলাম দেশে। তখনও আমি আশা ছাড়িনি, যে রহস্য শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সযত্নে সংরক্ষণ করেছে আমার পূর্বপুরুষেরা সে রহস্য উন্মোচনের জন্যে আবার আফ্রিকা উপকূলে যাওয়ার আশা নিয়ে লেগে গেলাম আরবীর সেই বিশেষ উপভাষা শিখতে। কিন্তু লাভ হলো না, দ্রুত ভেঙে পড়লো আমার শরীর। এখানেই শেষ আমার কাহিনি।
কিন্তু তোমার জন্যে এখানেই শেষ নয়—বলতে পারো শুরু। আমার পরিশ্রমের ফল রেখে যাচ্ছি তোমার জন্যে, সে সাথে বংশানুক্রমে যেসব প্রমাণপত্র পেয়েছি সেগুলোও। আমার ইচ্ছা, এমন একটা বয়েসে এগুলো তোমার হাতে পড়ুক যে বয়েসে সবদিক বিবেচনা করে তুমি নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারবে, রহস্য অনুসন্ধানে বেরোবে কি বেরোবে না। তোমাকে আমি বিন্দুমাত্র প্রভাবিত করতে চাই না। তুমি নিজেই বিচার করে দেখ সব দিক। যদি মনে হয় তুমি বেরোবে তাহলে যাতে কোনোরকম অভাবে পড়তে না হয় সেজন্যে আমি ব্যবস্থা করে যাচ্ছি। আর যদি মনে করো পুরো ব্যাপারটাই গাঁজাখুরি, সেক্ষেত্রে তোমার প্রতি আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ, ধ্বংস করে ফেলবে পোড়ামাটির ফলক আর লেখাগুলো, যাতে ভবিষ্যতে এ বংশের আর কেউ আমার বা আমার পূর্বপুরুষদের মতো যন্ত্রণা ভোগ না করে। সেটাই সম্ভবত বুদ্ধিমানের কাজ হবে। মনে রাখবে, কোনো ভাবেই যেন অন্য কারো হাতে না পড়ে জিনিসগুলো।-বিদায়!
এভাবে আচমকা শেষ হয়ে গেল ভিনসির তারিখ, স্বাক্ষরবিহীন চিঠি।
কি বুঝলে, হলি কাকা? চিঠিটা টেবিলে নামিয়ে রাখতে রাখতে বললো লিও। রহস্যময় কিছু একটা আশা করছিলাম আমরা, এবং মনে হয় পেয়েছি, তাই না?
কি বুঝেছি জানতে চাইছো? বললাম আমি। আর কিছু বুঝি আর না বুঝি, তোমার বাপের মাথাটা যে নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো তা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না। বিশ বছর আগের সে রাতেই আমি সন্দেহ করেছিলাম।
ঠিক বলেছেন, স্যার! বললে জিব, সবজান্তার ভঙ্গি তার মুখে।
যা হোক, বললো লিও। এবার দেখা যাক, পোড়ামাটির ফলকটা কি বলতে চায়।
বাবার হাতে লেখা অনুবাদটা তুলে নিলো লিও। পড়তে লাগলো:
আমি, মৃত্যুপথযাত্রী আমেনার্তাস, মিশরের রাজকীয় ফারাও বংশের মেয়ে, দেবতারা যার সন্তুষ্টি কামনা করে এবং দানবরা যাকে ভয় করে সেই আইসিসের পূজারী ক্যালিক্রেটিসের (সৌন্দর্যের শক্তিশালী) স্ত্রী, আমার শিশুপুত্র টিসিসথেনেসকে (শক্তিমান প্রতিশোধগ্রহণকারী) বলছি আমি তোমার বাবার সাথে নেকনেবেস* এর আমলে মিশর থেকে পালিয়ে যাই। আমার ভালোবাসার কারণে তিনি তাঁর পুরোহিতের ব্রত ভঙ্গ করেন। জলপথে দক্ষিণ দিকে পালাই আমরা। দুবার বারো চাঁদ (অর্থাৎ দুবছর) সাগরে ভেসে বেড়ানোর পর উদীয়মান সূর্যের দিকে মুখ করে থাকা লিবিয়া (আফ্রিকা) উপকূলে পৌঁছাই, যেখানে এক নদীর তীরে বিশাল পাথর কুঁদে তৈরি করা হয়েছে ইথিওপিয়ানের মাথা। এই সময় ঝড়ে পড়ি আমরা। বিরাট এক নদীর ভিতর দিয়ে চারদিন একটানা ভেসে চলি ঝড়ের মুখে। আমাদের সঙ্গী-সাথীদের বেশিরভাগই মারা পড়ে-কেউ ডুবে, কেউ অসুখে। আমরা বেঁচে গেলাম। জংলী মানুষরা জনশূন্য অকর্ষিত জলাভূমির ওপর দিয়ে নিয়ে গেল আমাদের। সেখানে সামুদ্রিক পাখির ঝাঁক আকাশ ঢেকে ফেলে। দশদিন একটানা চলার পর একটা পাহাড়ের কাছে পৌঁছুলাম। পাহাড়ের ভেতরটা ফাঁপা। এককালে বিরাট এক নগর ছিলো সেখানে, এখন ধ্বংসস্তূপ। আর সেখানে আছে গুহা, অসংখ্য, কোনো মানুষ কখনো তার শেষ দেখেনি। আগন্তুকের মাথায় পাত্র বসিয়ে দেয় যে জাতি তাদের রানীর কাছে আমাদের নিয়ে গেল জংলীরা। মেয়ে মানুষটা জাদুকরী, দুনিয়ার তাবৎ জিনিস সম্পর্কে জ্ঞান রাখে সে। তার জীবন এবং সৌন্দর্য কোনোটাই কখনো নিঃশেষ হয় না। প্রেমের চোখে সে তাকায় তোমার বাবা ক্যালিক্রেটিসের দিকে, এবং আমাকে হত্যা করে বিয়ে করতে চায় তাঁকে। কিন্তু তোমার বাবা ভালোবাসতেন আমাকে, তাই ভয় পান ওর কথায়। ওকে বিয়ে করতে রাজি হলেন না উনি। এতে খেঞ্চে গেল সে, তার জাদুর প্রভাবে দুর্গম পথ পেরিয়ে বিশাল এক গহ্বরের কাছে যেতে বাধ্য করলো আমাদের। সেই গহ্বরের মুখে বৃদ্ধ দার্শনিককে মৃত পড়ে তে দেখলাম। আমাদেরকে অমর জীবনের ঘূর্ণায়মান স্তম্ভ দেখালো সে, সেখানে বজ্র গর্জনের মতো শব্দ শোনা যায়। আগুনের শিখার ভেতর গিয়ে দাঁড়ালো সে, বেরিয়ে এলো একটু পরে। দেখলাম, কিছুই হয়নি তার, বরং রূপ আরো বেড়ে গেছে। তারপর সে শপথ করলো, তার, মতোই অমর করে দেবে তোমার বাবাকে যদি তিনি আমাকে হত্যা করে তার কাছে আত্মনিবেদন করেন। সে নিজে আমাকে হত্যা করতে পারেনি, কারণ আমার দেশে প্রচলিত জাদুবিদ্যায় আমি পারদর্শী, সেই জাদুর প্রভাব কাটিয়ে আমাকে হত্যা করা সম্ভব ছিলো না ওর পক্ষে। তার সৌন্দর্য যেন দেখতে না হয় সেজন্যে চোখে হাত চাপা দিয়েছিলেন তোমার বাবা, তখন ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে ওঠে সে, জাদুর প্রভাবে হত্যা করে তাকে। এরপর তার শরীরের ওপর আছড়ে পড়ে কাঁদলো সে, বিলাপ করলো। তারপর ভয় পেয়ে যেখানে জাহাজ আসে সেই বিরাট নদীর মোহনায় পাঠিয়ে দিলো আমাকে। কয়েকদিন পর একটা জাহাজ আমাকে উদ্ধার করে অনেক দূর দেশে নিয়ে যায়, সেখানে আমি জন্ম দিই তোমাকে। তারপর অনেক ঘুরে অনেক কষ্টে অবশেষে পৌঁছাই এথেন্সে। পুত্র, টিসিসথেনেস, তোমাকে বলছি, ঐ মেয়েলোকটাকে খুঁজে বের করবে এবং জেনে নেবে জীবনের গোপন রহস্য, আর যদি পারো হত্যা করবে তাকে-পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেবে। যদি তুমি ভয় পাও বা ব্যর্থ হও, সেজন্যে তোমার সব উত্তরপুরুষদের উদ্দেশ্যে আমি বলে যাচ্ছি, যতদিন না তাদের ভেতর তেমন সাহসী কেউ জন্মায়, যে ঐ আগুনে স্নান করে এসে বসবে ফারাওয়ের আসনে, ততদিন যেন অব্যাহত থাকে চেষ্টা। এসব কথা আমি বললাম, হতে পারে অতীত বিশ্বাসের কথা, কিন্তু আমি জানি, আমি মিথ্যা বলি না।
ঈশ্বর ক্ষমা করুন ওঁকে, আর্তনাদের মতো কথা কটা বেরোলো জবের মুখ দিয়ে। এতক্ষণ হাঁ করে চমকপ্রদ কাহিনীটা শুনছিলো ও।
আর আমি, কিছুই বললাম না। প্রথমেই আমার মনে হলো, কাহিনীটা ভিসির বানানো নয় তো?-যদিও মনে মনে বুঝতে পারছি, এমন একটা কাহিনী বানানো প্রায় অসম্ভব। অতিমাত্রায় মৌলিক এ কাহিনী। সন্দেহ নিরসনের জন্যে তুলে নিলাম পোড়ামাটির ফলকটা। পড়তে শুরু করলাম, প্রাচীন গ্রীক বড় হরফে লেখা মূল লিপিটা। দেখলাম, ভিনসির অনুবাদের সাথে কোনো পার্থক্য নেই এর।
পোড়ামাটির ফলকটার এ পিঠে আরো কয়েকটা জিনিস চোখে পড়লো আমার। একেবারে ওপরে অনুজ্জ্বল লাল রঙে আঁকা একটা ছবি। কাজ করা। রূপোর বাক্সে যে গোলমোহরটা পেয়েছি তাতে যে ছবি আঁকা ঠিক সেরকম। পার্থক্য একটাই, এ ছবিটা উল্টো। অর্থাৎ ঐ মোহরে রং মাখিয়ে ছাপ দিয়ে আঁকা হয়েছে ছবিটা।
লিপির একদম নিচে ঐ একই অনুজ্জ্বল লাল-এ আঁকা একটা স্ফিংস-এর মাথা এবং কাঁধ। মর্যাদার প্রতীক দুটো পালক পরে আছে স্ফিংসটা।
ফলকের ডান পাশে লাল কালি দিয়ে লেখা কয়েকটা কথা: পৃথিবীতে, আকাশে এবং সাগরে কত বিচিত্র জিনিসই না আছে। নিচে নীল রং-এ সই করা, ডরোথি ভিনসি।
কিছুই বুঝলাম না। হতবুদ্ধি হয়ে ওল্টালাম ফলকটা। এ পাশে খুদে খুদে অক্ষরে অসংখ্য মন্তব্য আর স্বাক্ষর; গ্রীক-এ, ল্যাটিন-এ, ইংরেজিতে। প্রথমটার লেখক টিসিসথেনেস। গ্রীক বড় হরফে তার ছেলেকে উদ্দেশ্য করে লিখছে, আমি পারলাম না যেতে। টিসিসথেনেস, পুত্র ক্যালিক্রেটিসকে।
এই ক্যালিক্রেটিস (সম্ভবত গ্রীক রীতিতে দাদার নামে নাম রাখা হয়েছিলো। তার) বোধহয় বেরিয়েছিলো অনুসন্ধানে, কিন্তু ব্যর্থ হয়। তার হাতে লেখা অস্পষ্ট কথাগুলো দেখলাম: রওনা হয়েও ফিরে আসতে বাধ্য হলাম। দেবতারা আমার বিরুদ্ধে। ক্যালিক্রেটিস তার পুত্রকে।
এর পরের কতকগুলো লেখা একেবারে অস্পষ্ট হয়ে গেছে। দু’একটা শব্দ ছাড়া সেগুলোর কিছুই পড়তে পারলাম না। তারপর এক জায়গায় দেখলাম একটা স্বাক্ষর: লায়োনেল ভিনসি। এর ঠিক ডানে লেখা, জে.বি.ভি। এবং এর নিচে বিচিত্র হাতের লেখায় এক গাদা গ্রীক দস্তখত—প্রায় প্রত্যেকটার সাথে এই শব্দ কটা আছে: আমার পুত্রের প্রতি।
এর পর যে শব্দটা আমি পড়তে পারলাম, তা হলো রোম, এ. ইউ. সি. অর্থাৎ রোমে চলে এসেছে পরিবারটা। এরপর বারোটা ল্যাটিন স্বাক্ষর। এই বারোটার নটা নামই শেষ হয়েছে ভিনডেক্স অর্থাৎ প্রতিশোধগ্রহণকারী শব্দটা দিয়ে। সম্ভবত ল্যাটিন শব্দটা প্রথমে দ্য ভিনসি পরে শুধু ভিনসিতে রূপান্তরিত হয়।
রোমান নামগুলোর পর বেশ কয়েক শতাব্দীর ফাঁক। এই সময়ে কি হয়েছিলো, কার কাছে ছিলো ফলকটা, কোনো উল্লেখ নেই। ভিনসি বলেছিলো, পরিবারটা শেষ পর্যন্ত লোম্বার্ভিতে স্থিত হয়েছিলো এবং শার্লেমেনের সময় আলপস পেরিয়ে ব্রিটানিতে গিয়ে বসতি স্থাপন করেছিলো। এসব কথা ভিনসি কি করে জেনেছিলো জানি না। কারণ এ সম্পর্কে কোনো কথা বা, এ সময়ের কারো স্বাক্ষর নেই ফলকে।
এরপর দেখলাম অদ্ভুত একটা লিপি। ফলকটার ওপর মূল ল্যাটিন ভাষায় লেখা। রূপোর বাক্সে পাওয়া দ্বিতীয় পার্চমেন্টটায় ইংরেজির প্রাচীন রূপে রূপান্তর করা হয়েছে সেটা। মূল লিপিটা লিখছেন দ্য ভিনসি, ১৪৪৫ খ্রীষ্টাব্দে। তার ছেলে বা নাতি কেউ সম্ভবত করেছে পার্চমেন্টের অনুবাদটা।
সবশেষে এলো আর একটা জিনিস, আথেনার্তাস-এর মূল লিপির আর একটা অনুবাদ, মধ্যযুগীয় ল্যাটিনে করা।
সব তো শুনলে, পোড়ামাটির ফলকটা নামিয়ে রাখতে রাখতে বললাম আমি, এবার তোমার মত কি?
তোমার? স্বভাবসুলভ চটপটে গলায় জিজ্ঞেস করলো লিও।
পোড়ামাটির ফলকটা নিঃসন্দেহে খাঁটি। তবে ওর ওপর আমেনার্তাসের লেখাটা পাগলের প্রলাপ ছাড়া কিছু নয়। স্বামীর মৃত্যু এবং তার আগের ও পরের দুঃখ কষ্টে মাথা বিগড়ে গিয়েছিলো মহিলার।
তাই যদি হবে, বাবা যা যা দেখেছিলেন বা শুনেছিলেন সে সব কি?
নিছক কাকতালীয় ঘটনা। আফ্রিকা উপকূলে অনেক পাহাড় থাকতে পারে। যার একটা চূড়া মিগ্রোর মাথার মতো দেখতে, ওখানে এমন লোকও থাকতে পারে যারা জঘন্য আরবীতে কথা বলে, আর জলাভূমি তো থাকতেই পারে। তাছাড়া, একটা কথা, লিও, দুঃখ পেও না, ভিনসি যখন ঐ চিঠিটা তোমাকে লেখে,আমার বিশ্বাস ও-ও তখন সুস্থ মস্তিষ্কে ছিলো না। আমি নিশ্চিত, সব ফালতু কথা।-তুমি কি বলো, জব?
আমারও তাই ধারণা, স্যার, সব গাঁজাখুরি গপ্পো। আর যদি সত্যি হয়ও, নিশ্চয়ই মিস্টার লিও খামোকা ওসব বিপদ আর ঝামেলার ভেতর যাবেন না?
হয়তো তোমাদের দুজনের ধারণাই ঠিক, নিরুত্তাপ গলায় বললো লিও। আমি কোনো মত দিতে যাচ্ছি না। কিন্তু আমি, চিরতরে ইতি ঘটাতে চাই ব্যাপারটার। তোমরা কেউ যদি না যাও, আমি একাই যাবো।
লিওর মুখের দিকে তাকালাম আমি। স্থির প্রতিজ্ঞার ছাপ দেখলাম সেখানে। লিওর মুখের এই বিশেষ ভাবটা আমার পরিচিত। ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি—ওর মুখে এই ছাপটা পড়ার অর্থ, ও সিদ্ধান্তে অটল। এখন ও ভাঙবে তবু মচকাতে রাজি নয়। কিন্তু লিওকে একা ছেড়ে দেয়ার কথা আমি ভাবতেও পারি না। এই পৃথিবীতে ও আমার একমাত্র বন্ধন। আমার পৃথিবী বলতেই তো লিও—ভাই, সন্তান, বন্ধু-ও-ই আমার সব। ও যেখানে যাবে-যখন জানি বিপদের সম্ভাবনা আছে—আমাকেও যেতে হবে সাথে। কিন্তু অবশ্যই ওকে জানতে দেয়া চলবে না, আমার ওপর ওর প্রভাব কত বড়ো। সুতরাং ওর সাথে যাওয়ার জন্যে এবার একটা ছুতো খুঁজতে হবে আমাকে। নিরাসক্ত ভঙ্গিতে চুপ করে রইলাম আমি।
হ্যাঁ, বুড়ো (কখনো কখনো লিও এ নামে ডাকে আমাকে), আমি যাবো। অমর জীবনের ঘূর্ণায়মান স্তম্ভের দেখা যদি-ও পাই, তুঘোড় এক চোট শিকার তো হবে।
এই তো পেয়ে গেছি ছুতো! সঙ্গে সঙ্গে বললাম কথাটা।
শিকার! বললাম আমি। হ্যাঁ-হ্যাঁ, কথাটা তো ভাবিনি। নিশ্চয়ই ভয়ানক বুনো দেশটা, বড়সড় একটা দান মারা যাবে হয়তো। সারা জীবনের স্বপ্ন আমার, মরার আগে একটা বাফেলো মারবো। এবার সুযোগ পাওয়া গেছে। বুঝলে, লিও, ওসব অনুসন্ধান ইত্যাদি তুমিই চালিও, আমি শিকার করবো। তুমি যখন যাবেই, আমিও যাই, তোমার সাথে কয়েকটা দিন ছুটি কাটিয়ে আসি।
আগেই জানতাম, বললো লিও। এমন সুযোগ তুমি ছাড়তে পারবে না। কিন্তু, টাকা পয়সার কি হবে? বেশ মোটা একটা অঙ্ক তো লাগবে?
ও নিয়ে ভাবতে হবে না তোমাকে। গত বিশ বছর ধরে জমা হয়েছে তোমার আয়, আর আমার কাছেও আছে কিছু। তোমার বাবা যা দিয়ে গিয়েছিলো তার তিন ভাগের দুভাগই জমা হয়েছে। টাকা-পয়সা কোনো সমস্যাই না।
তাহলে আর দেরি কেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রওনা হওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়। শহর থেকে কয়েকটা বন্দুকও কিনতে হবে। ভালো কথা, জব, তুমি আসছো। নাকি? জীবনটা তো ঘরের কোণেই কাটিয়ে দিলে, এবার দুনিয়াটা একটু দেখ।
দুনিয়া দেখার শখ খুব একটা নেই আমার, নিরাসক্ত গলায় বললো জব।
তবে কিনা, আপনারা দুজন যাচ্ছেন, আপনাদের দেখাশোনার জন্যে তো কাউকে না কাউকে দরকার। বিশ বছর আপনাদের সেবা করেছি, এখনই বা করবো না কেন?
ঠিক, জব, বললাম আমি। খুব মজার কিছু দেখতে পাবে তা ভেবো না, তবে শিকার করতে পারবে ইচ্ছে মতো। আর হ্যাঁ, তোমাদের দুজনকেই বলছি এ নিয়ে কোনো কথাই যেন বাইরের কেউ জানতে না পারে, পোড়ামাটির। ফলকটার দিকে ইশারা করলাম আমি। মানুষ আমাদের পাগল ভাবুক তা আমি . চাই না।
——–
* মিশরের শেষ মিশরীয় ফারাও। খৃঃ পূঃ ৩৩৯ অব্দে ওকাস থেকে ইথিওপিয়ায় পালিয়ে যান। –সম্পাদক।
.
০৪.
প্রায় মাঝ রাত। সামনে বিস্তীর্ণ শান্ত সমুদ্র। পূর্ণ চাঁদের রূপালি আলোয় ঝিকমিক করছে। অনুকূল বাতাসে ফুলে হে আমাদের ডাউ-এর বিশাল পালটা। মৃদু দুলুনির সাথে তরতরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ডাউ সামনে বেশির ভাগ লোকই ঘুমিয়ে আছে। শ্যামলা রঙের শক্তপোক্ত এক আরব–নাম মাহমুদ—অলস ভঙ্গিতে ধরে আছে হালের দণ্ড। ডানদিকে তিন-চার মাইল দূরে অস্পষ্ট একটা রেখা। মধ্য আফ্রিকার পূর্ব উপকূল ওটা।
শান্ত রাত। এত শান্ত যে, ভাউ-এর সামনে ফিসফিস করে কথা বললে পেছন থেকে শোনা যায়। হঠাৎ চার দিক থেকে ভেসে এলো অস্পষ্ট অথচ গম্ভীর একটা আওয়াজ।
হালের দণ্ডটা শক্ত করে ধরলো আরব, একটা মাত্র শব্দ উচ্চারণ করলো, সিমবা (সিংহ)!
উঠে বসে কান খাড়া করলাম আমরা আবার। শোনা গেল ধীর; গম্ভীর আওয়াজটা। রোমাঞ্চিত হয়ে উঠলো আমাদের শরীর।
ক্যাপ্টেন যদি হিসেবে গোলমাল না করে থাকে, বললাম আমি। কাল
সকাল দশটা নাগাদ সেই রহস্যময় মানুষের মুওয়ালা পাহাড়ের কাছে পৌঁছে যাবো আমরা, তারপর শুরু হবে শিকার।
তারপর শুরু হবে খোজ, মুখ থেকে পাইপ সরিয়ে সংশোধন করে দিলো লিও। মৃদু হেসে যোগ করলো, প্রাচীন নগরীর ধ্বংসাবশেষ আর অমর জীবনের আগুন।
যত্তোসব পাগলামি, বিকেলে তো হালের ওই লোকটার সঙ্গে আলাপ করছিলে, কি বললো? ব্যবসার কারণে (সম্ভবত দাস ব্যবসা) জীবনের অর্ধেকটা, সময় ও আসা যাওয়া করছে এপথে, সেই মানুষ পাহাড়ের কাছে নেমেছেও একবার। ধ্বংস হয়ে যাওয়া শহর আর গুহার কথা কখনো শুনেছে ও?।
না, ও বলছে, পাহাড়ের ওপাশ থেকেই শুরু হয়েছে জলাভূমি, সাপ-খোপের আচ্ছা। যতদূর জানি, আফ্রিকার পুরো পূর্ব উপকূল জুড়েই আছে অমন জলাভূমি, তার মানে খুব বেশি চওড়া নয়।
ঐ আশাতেই থাকো-ম্যালেরিয়ার বাসা জায়গাটা! ঐ জায়গা সম্পর্কে কি ধারণা ওদের শুনেছো তো? কেউ যেতে রাজি নয় আমাদের সাথে। পাগল ভাবছে আমাদের। সত্যি কথা বলতে কি, আমার মনে হয় ঠিকই ভাবছে ওরা। সাধের ইংল্যাণ্ডে যদি ফিরে যেতে পারি বুঝবো অনেক পুণ্য করেছিলো পূর্বপুরুষেরা। ভেবো না আমার জন্যে বলছি কথাগুলো। আমার যা বয়েস তাতে এখন বাঁচলেই কি আর মরলেই কি? ভাবছি তোমার আর জবের কথা। সত্যি বলছি, বাবা, কাজটা বোকামি হবে।
হোক, হোরেস কাকা। এতদূর যখন এসেছি, চেষ্টা আমি করবোই। আরে! মেঘ জমেছে দেখছি! হাত তুলে ইশারা করলো ও।
সত্যিই তাই, আমাদের কয়েক মাইল পেছনে রাতের ধূসর আকাশের গায়ে কালো কালি লেপে দিয়েছে কে যেন।
হালের লোকটাকে জিজ্ঞেস করো তো,কি ব্যাপার।
উঠে এগিয়ে গেল লিও। ফিরে এলো প্রায় সঙ্গে সঙ্গে।
ও বলছে, দমকা ঝড় উঠতে পারে, তবে ভয়ের কিছু নাকি নেই, আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে যাবে ঝড়টা।
এই সময় ওপরে উঠে এলো জব। বাদামী রঙের শিকারির পোশাকে খুবই চৌকস দেখাচ্ছে ওকে। শুধু হ্যাটটা হাস্যকর ভঙ্গিতে ঝুলে আছে মাথার পেছনে।
আমি, স্যার, পেছনের ঐ তিমি নৌকায় (Whale boat) গিয়ে শুই, উদ্বিগ্ন গলায় বললো ও। আমাদের বন্দুক, গুলি-বারুদ, খাবার দাবার সব ওর ভেতর। ঐ কেলেভূতগুলোর চাউনি, এখানে খাদে নেমে এলো ওর গলা, একদম পছন্দ হচ্ছে না আমার। কেউ যদি ওতে উঠে দড়ি কেটে পালায় কিছু করতে পারবো না আমরা।
তিমি নৌকাটা আমরা তৈরি করিয়েছিলাম স্কটল্যাণ্ডের ডাণ্ডিতে। কাজে লাগতে পারে ভেবে সঙ্গে এনেছিলাম। যেখানে আমরা নামবো, আফ্রিকা উপকূলের সে জায়গাটা খুব দুর্গম, নানা আকারের ডুবো আধা ডুবো পাহাড়ে ভর্তি। দরকার পড়তে পারে ভেবে এমনিই আমরা সঙ্গে এনেছিলাম ওটা। এখন দেখছি আমাদের ধারণাই সত্যি। ক্যাপ্টেন জানিয়েছে জুবো পাহাড়ের কারণে ডাউ তীরের খুব একটা কাছে যেতে পারবে না। তার মানে ঐ তিমি নৌকায় করেই তীরে যেতে হবে আমাদের। চমৎকার জিনিসটা-ত্রিশ ফুট লম্বা, মাঝামাঝি জায়গায় পাল খাটানোর মাস্তুল, তলাটা তামার পাত দিয়ে মোড়া, কয়েকটা জল নিরোধী কুঠরিও আছে। আজ সকালে ক্যাপ্টেন যখন জানায় কাল বেলা দশটা নাগাদ জায়গা মতো পৌঁছে যাবে, তখনই আমরা আমাদের যাবতীয় জিনিসপত্র বোঝাই করে ফেলি ওতে। কাল সকালে হয়তো সময় পাওয়া যাবে না। অর্থাৎ এখন যে কোনো মুহূর্তে ছাড়বার জন্যে তৈরি নৌকাটা। সুতরাং জব যা বলেছে ঠিকই বলেছে।
বেশ, জব, বললাম আমি। প্রচুর কম্বল আছে ওতে। মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়োগে যাও।
আবার আগের জায়গায় এসে বসলাম আমরা। চমৎকার রাত। বসে বসে গল্প করতে লাগলাম আমি আর লিও। তারপর কখন ঝিমুনি লেগেছে, কখন ঘুমিয়ে গেছি কিছু টের পাইনি।
আচমকা তীব্র বাতাসের গর্জন আর জেগে ওঠা নাবিকদের প্রাণ কাপানো চিৎকার শুনে ঘুম ভেঙে গেল আমাদের। জলের ঝাঁপটা চাবুকের মতো এসে লাগছে চোখেমুখে। এক পলক আকিয়েই বুঝলাম এসে পড়েছে দমকা ঝড়। কয়েকজন নাবিক পাল নামানোর জন্যে ছুটে গেল দড়ি-দড়ার দিকে। কিন্তু তাড়াহুড়োয় আটকে গেল কপিকল। নামলো না পাল। আমি তড়াক করে লাফিয়ে উঠে শক্ত করে আঁকড়ে ধরলাম একটা রশি। মাথার ওপর নিকষ কালো আকাশ। কিন্তু আশ্চর্য, আমাদের সামনেটা এখনো পরিষ্কার, চাঁদ হাসছে।
হঠাৎ খেয়াল করলাম, বিশাল একটা ঢেউয়ের মাথায় চড়ে অনেক উপরে উঠে গেছে তিমি নৌকার কালো অবয়বটা। বিশাল ঢেউটা ক্রমশ এগিয়ে আসছে ডাউ এর দিকে। পলকের মধ্যে দেখলাম পুরো দৃশ্যটা। রশি আঁকড়ে ধরলাম আরো শক্ত করে। পরমুহূর্তে নোনা জলের নিচে চাপা পড়ে গেলাম আমি।
ঢেউটা চলে গেল। মনে হলো, না জানি কত মিনিট ধরে ছিলাম পানির নিচে আসলে কয়েক সেকেণ্ড মাত্র। উপরে তাকিয়ে দেখলাম, ঝড়ের দাপটে ছিঁড়ে খুঁড়ে গেছে বিশাল পালটা। মাস্তুলের মাথায় প্রকাণ্ড এক পাখির ডানার মতো ঝটপটিয়ে চলেছে।
এই সময় শুনলাম জবের চিৎকার, এদিকে আসুন, স্যার! নৌকায়!
পুরোপুরি দিশেহারা অবস্থার ভেতরেও অনুভব করলাম পেছনে ছুটে যেতে হবে আমাকে। বুঝতে পারছি ডুবে যাচ্ছে ডাউ-খোলের বেশিরভাগ পানিতে ভরে গেছে। প্রচণ্ড বাতাসে ভয়ানকভাবে এদিক ওদিক দুলছে তিম নৌকা! দেখলাম হালের কাছে দাঁড়ানো আরবটা লাফিয়ে পড়লো ওতে। আমিও ছুটে গিয়ে ধরলাম নৌকা বাঁধা রশিটা! সর্বশক্তিতে ডাউ-এর পাশে টেনে আনার চেষ্টা করলাম তিমি নৌকাটাকে। একটু কাছে আসতেই ওতে লাফিয়ে পড়লাম আমি। মাহমুদ তার কোমরের কাছ থেকে বাঁকা একটা ছোরা বের করে কেটে দিলো রশি। এক মুহূর্ত পরে দেখলাম তীব্র ঝড়ের মুখে ছুটে চলেছে তিমি নৌকা, ডাই-এর কোনো চিহ্ন নেই কোথাও।
হায়, ঈশ্বর, ডুকরে উঠলাম আমি। লিও কোথায়? লিও! লিও!
ভেসে গেছে, স্যার, ঈশ্বর তার মঙ্গল করুন? আমার কানের কাছে সুখ এনে। চিৎকার করলো জব।
তীব্র আক্ষেপে হাত দুটো মুঠো হয়ে গেল আমার। লিও ডুবে গেছে, আর আমি বেঁচে আছি শোক করার জন্য!
সাবধান! হাঁক ছাড়লো জব। আরেকটা আসছে!
মুখ ঘোরাতেই দেখলাম সত্যিই আরেকটা আসছে। ঢেউ! আগেরটার মতোই। বিশাল। দ্রুত এগিয়ে আসছে আমাদের ছোট্ট তিমি নৌকার দিকে। অবাক বিস্ময়ে আমি তাকিয়ে রইলাম সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্যের দিকে। ইতিমধ্যে চাঁদ প্রায় পুরো ঢাকা পড়ে গেছে মেঘের আড়ালে। এখনো যেটুকু বাকি আছে তা থেকে সামান্য আলো . এসে পড়েছে বিশাল ঢেউটার ওপর। হঠাৎ মনে হলো কিছু একটা যেন রয়েছে ওটার মাথায়।
এসে পড়েছে ঢেউটা! আর কয়েক গজ। তারপরই উঠে পড়বে নৌকার ওপর! পরমুহূর্তে জলের পাহাড় হুড়মুড় করে ভেঙে পড়লো আমাদের উপর। পুরো নৌকা ভর্তি হয়ে গেল পানিতে। কিন্তু বাতাস নিরোধী কুঠরিগুলোর জন্য এক। সেকেণ্ড পরেই রাজহাঁসের মতো ভেসে উঠলো ওটা। সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম বিক্ষুব্ধ ঢেউয়ের চূড়ায় জমে ওঠা ফেনার আড়াল থেকে সোজা আমার দিকে ধেয়ে আসছে। কি যেন! হাত বাড়িয়ে দিলাম আমি। পরমুহূর্তে অন্য একটা হাত আঁকড়ে ধরলো না আমার হাত। সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করলাম ঢেউয়ের প্রচণ্ড টান। কিন্তু ছাড়লাম! না হাতটা। দুসেকেণ্ড পর চলে গেল ঢেউ। আমরা নৌকার উপর হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে রইলাম।
পানি সেচুন, স্যার! চিৎকার করে উঠলো জব। বলতে বলতে পানি সেচার কাজে লেগে গেছে ও।
কিন্তু আমি ঠিক সে মুহূর্তে শুরু করতে পারলাম না পানি সেকাজ। কারণ এইমাত্র যাকে উদ্ধার করেছি তার মুখ দেখতে পেয়েছি অস্পষ্ট চাঁদের আলোয়। নৌকার খোলে আধশোয়া আধভাসা অবস্থায় পড়ে আছে, আর কেউ মালিও।
পানি সেচুন! পানি সেচুন! অবার হাঁক ছাড়লো জব, নয়তো ডুবে যাবো আমরা।
হাতল লাগানো বড় একটা টিনের গামলা নিয়ে পানি সেচক করলাম আমি। মাহমুদও একটা পাত্র নিয়ে হাত লাগিয়েছে। সমানে ফুঁসছে সমুদ্র। ফোয়ারার মতো পানির ঝাঁপটা এসে লাগছে আমাদের চোখে মুখে।
প্রাণপণে পানি সেচে চলেছি আমরা। এক মিনিট! তিন মিনিট! ছয় মিনিট। একটু একটু করে হাল্কা হচ্ছে নৌকা! আর কোনো ঢেউ এলো না আমাদের ওপর। আরো পাঁচ মিনিট কাটলো। নৌকার খোল প্রায় জলশূন্য করে ফেলেছি, এমন সময় ঝড়ের আর্তনাদ ছাপিয়ে গুরু গম্ভীর একটা আওয়াজ ভেসে এলো আমার কানে। সর্বনাশ! ঢেউয়ের গর্জন!
ঠিক সেই মুহূর্তে চাঁদ আবার বেরিয়ে এলো মেঘের আড়াল থেকে। স্নিগ্ধ আলোর বন্যায় প্লাবিত হয়ে গেল বিক্ষুব্ধ সাগর। সেই আলোয় দেখলাম, আমাদের প্রায় আধমাইল সামনে ফেনার সাদা একটা রেখা। তারপর খানিকটা জায়গা কালো অন্ধকার। তারপর আবার সাদা রেখা। নিঃসন্দেহে সারি বেঁধে এগিয়ে আসছে ঢেউ। ক্রমশ উঁচুম্মামে উঠছে গর্জনের আওয়াজ।
হাল ধরো, মাহমুদ! আরবীতে চিৎকার করে উঠলাম আমি। যেভাবেই হোক ফাঁকি দিতে হবে ওগুলোকে। বলতে বলতে ছোঁ মেরে একটা দাঁড় তুলে নিলাম, জবকেও ইশারা করলাম নিতে।
লাফ দিয়ে পেছনে চলে গেল মাহমুদ। হাল ধরলো। ইতিমধ্যে জবও তুলে নিয়েছে একটা দাড়। প্রাণপণে দাঁড় টানছি আমরা। এক মিনিটেরও কম সময়ের ভেতর দেখলাম, এসে গেছে ঢেউয়ের সারি। আমাদের ঠিক সামনে ঢেউয়ের প্রথম সারিটা, বাঁ অথবা ডানদিকেরগুলোর চেয়ে একটু ছোট। ঘাড় ফিরিয়ে ওটার দিকে ইশারা করলাম আমি।
ওখান দিয়ে পার করে নাও, মাহমুদ! চিৎকার করে বললাম।
অত্যন্ত দক্ষ মাঝি মাহমুদ। নিপুণভাবে পেরিয়ে গেল ঢেউয়ের প্রথম সারিটা। কিন্তু পরেরগুলোকে আর এড়াতে পারলো না। এক সঙ্গে অনেকগুলো ঢেউ প্রত্যেকটা বিশাল আয়তনের-একের পর এক বয়ে গেল আমাদের ওপর দিয়ে। সে এক অভিজ্ঞতা বটে। আমার শুধু এটুকু মনে আছে, হঠাৎ আবিষ্কার করলাম সাদা ফেনার সমুদ্রে ভাসছি আমরা। ডানে, বায়ে, সামনে, পেছনে, যেদিকে তাকাই শুধু ফেনা আর ফেনা। আর, প্রতি সেকেণ্ডে কতবার করে যে ওপরে উঠেছি আর নিচে নেমেছি বলতে পারবো না।
মাহমুদের দক্ষতার গুণে না ভাগ্যক্রমে জানি না, কিছুই হলো না আমাদের। মিনিট দুয়েক পর হঠাৎ একটা আছাড় খেলো নৌকা, তারপর দেখলাম অপেক্ষাকৃত শান্ত সাগরে ভাসছি আমরা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে খেয়াল করলাম, আধমাইল মতো দূরে আরেক সারি ঢেউ এগিয়ে আসছে। এর মধ্যে আবার জলে ভরে গেছে নৌকার খোল। করণীয় এখন একটাই—আবার প্রাণপণে পানি সেচতে শুরু করলাম আমরা।
ভাগ্য ভালো, ঝড় প্রায় থেমে গেছে। উজ্জ্বল আলো ছড়াচ্ছে চাদ। আধ মাইল বা তার কিছু বেশি দূরে একটা পাহাড়ী অন্তরীপ দেখতে পেলাম। দ্বিতীয় ঢেউয়ের সারিটাকে মনে হচ্ছে সেটারই প্রলম্বিত রূপ। সম্ভবত ওখানে একটা ডুবো বা আধা ডুবো পাহাড়ের সারি আছে। তাতে বাধা পেয়েই ঢেউয়ের সারিটা আরো ফেনাময় হয়ে উঠেছে। প্রাণপণে পানি সেচতে সেচতে এসব ভাবছি, এমন সময় পরম স্বস্তির সাথে লক্ষ্য করলাম, চোখ মেলেছে লিও। ওকে চুপ করে শুয়ে থাকতে বললাম, কারণ দ্বিতীয় ঢেউয়ের সারিটা এসে পড়েছে, এ সময় ওঠার চেষ্টা করলে আবার হয়তো ভেসে যাবে ও।
এক মিনিটও পার হয়নি, হঠাৎ চিৎকার করে আল্লাহকে ডাকলো আরবটা, আমিও কায়মনোবাক্যে স্মরণ করলাম ঈশ্বরকে। পরমুহূর্তে আবার ঢেউয়ের ভেতর পড়লাম আমরা। আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো এবারও, তবে আগের বারের মতো অত প্রচণ্ডভাবে নয়। মাহমুদের দক্ষ নৌচালনা আর বায়ুনিরোধী কুঠুরিগুলো বাঁচিয়ে দিলো আমাদের। কয়েক মিনিটের ভেতর খেয়াল করলাম স্রোতের মুখে ভেসে চলেছি আমরা, সোজা সেই অন্তরীপটার দিকে।
স্রোতের টানে তীরের দিকে আরও একটু এগোলো নৌকা। তারপর আচমকা থেমে গেল প্রায়। নিস্তরঙ্গ শান্ত জল চারপাশে। ভাঙার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, একটা নদীর মুখে এসে পড়েছি আমরা। ঝড় সম্পূর্ণ থেমে গেছে। আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার। শান্ত পানিতে ভাসছে নৌকা, গতিহীন। লিও কখন ঘুমিয়ে পড়েছে টের পাইনি কেউ। ভেজা কাপড়গুলো সেঁটে আছে ওর শরীরের সাথে। সামনের গলুইয়ে গিয়ে বসেছে জব মাহমুদ হাল ধরে আছে, আমি বসে আছি নৌকার মাঝামাঝি, লিওর কাছাকাছি।
রাত প্রায় শেষ। চাঁদ ডুবে গেছে। সাগরের মৃদু কল্লোল ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই প্রকৃতিতে। যতদূর চোখ যায় দৃষ্টি মেলে দিলাম। না, কোনো চিহ্ন নেই ডুবে যাওয়া ডাউ বা তার কোনো ধ্বংসাবশেষের। পুব দিকে চোখ পড়লো, ফর্সা হয়ে উঠছে আকাশ। একটু পরেই সূর্য উঠবে।
.
০৫.
ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে এলো চারদিক। রাঙা হয়ে উঠতে শুরু করেছে পুবের আকাশ। মৃদু স্রোতে একটু একটু করে এগিয়ে চলেছে নৌকা। পাহাড়ী অন্তরীপটার শেষ মাথায় চোখ পড়লো আমার। চমকে উঠলাম সঙ্গে সঙ্গে। অদ্ভুত দর্শন এক চূড়া। একটু আগে ওর পাশ দিয়ে এসেছি আমরা। তখন কিছু দেখতে পাইনি-হয়তো অন্ধকার ছিলো বলে, হয়তো দেখার মতো মানসিক অবস্থায় ছিলাম না বলে। চূড়াটা ওপর দিকে প্রায় আশি ফুট মতো চওড়া, গোড়ার দিকে একশো। দেখতে হুবহু নিগ্রোর মুখের মতো। পৈশাচিক একটা অভিব্যক্তি ফুটে আছে তাতে। দেখলেই গা শিউরে ওঠে। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম। না চোখের ভুল নয়, নিগ্রোর মুধুর মতোই—মোটাসোটা ঠোঁট, পুরুষ্টু গাল, থ্যাবড়া নাক, গোল মাথা। সত্যিই ভীষণ অদ্ভুত, এতে অদ্ভুত যে, কিছুতেই আমার বিশ্বাস হলো না, নেহায়েত প্রকৃতির খেয়ালেই তৈরি হয়েছে এমন একটা জিনিস। হয়তো মিসরের স্ফিংসের মতো এটাও তৈরি করেছিলো এ অঞ্চলের প্রাচীন কোনো জাতি। দুহাজার বছর আগে মিসরের রাজকন্যা, লিওর পূর্বপুরুষ ক্যালিক্রেটিসের স্ত্রী আমেনার্তাস দেখেছিলো এই পৈশাচিক চেহারা, দুহাজার বছর পরেও যদি কেউ আসে, নিঃসন্দেহে এমনটিই দেখতে পাবে, বদলাবে না কিছুই।
জব, ডাকলাম আমি। ওদিকে তাকাও, দেখ তো কি ওটা?
নৌকার এক কোনায় আরাম করে বসে ছিলো জব। ঘাড় ফিরিয়েই বিস্মিত কষ্ঠে চিৎকার করে উঠলো, ও, ঈশ্বর! এ কি?
ওর চিৎকারে জেগে উঠলো লিও।
আরে, অবাক গলায় বললো ও। আমার কি হয়েছে? হাত-পা সব শক্ত মনে হচ্ছে—ডাউ কোথায়? একটু ব্রাণ্ডি দাও আমাকে।
কপাল ভালো, বললাম আমি। আরো শক্ত হয়ে যাওনি। ডাউটা ডুবে গেছে। ওতে যারা ছিলো তারাও। আমরা চারজনই কেবল রক্ষা পেয়েছি, আর তোমার বেঁচে যাওয়াটা তো রীতিমতো অলৌকিক ঘটনা। ব্র্যাণ্ডি বের করার জন্যে একটা দেরাজ খুললো জব, এই ফাঁকে আমি লিওর কাছে বর্ণনা করলাম গত রাতের রোমাঞ্চকর ঘটনা।
এহ, অস্কুট গলায় বললো লিও। বড় বাঁচা বেঁচে গেছি তো!
ব্র্যাঙি এগিয়ে দিলো জব। নিতে নিতে মুখ তুললো লিও। তরপরই ওর চোখ গেল পাহাড় কুঁদে তৈরি বিশাল নিগ্রোর মাথার দিকে।
আরে! চিৎকার করে উঠলো ও, ঐ তো সেই ইথিওপিয়ানের মাথা!
হ্যাঁ।
তার মানে পুরো ব্যাপারটা সত্যি।
উহুঁ, ওটা এখানে আছে বলেই সব সত্যি এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। আমরা জানি, তোমার বাবা এটা দেখেছিলো। কিন্তু আমেনার্তাসের লেখায় যেটার কথা বলা হয়েছে এটাই যে সেটা তার কি প্রমাণ?
একটু হাসলো লিও। তুমি একটা অবিশ্বাসী ইহুদী, হোরেস কাকা। যাকগে, ব্যাপারটা সত্যি না মিথ্যে বেঁচে থাকলে আমরা দেখবো।
ঠিক, বললাম আমি। এখন নামার চেষ্টা করতে হবে। জব, বৈঠা ধরো, শেষে আরবীতে যোগ করলাম, মাহমুদ, নদীর মুখে ঐ বালুচরটার দিকে নৌকা চালাও।
নদীর মুখটা বিশেষ চওড়া মনে হলো না আমার কাছে, যদিও পাড়ের কাছ দিয়ে জমে থাকা কুয়াশার জন্যে প্রকৃত মাপ বুঝতে পারছি না। ধীর গতিতে এগিয়ে চলেছি আমরা সেদিকে। ভাগ্য ভালো ভাটা নয় এখন। পূর্ব আফ্রিকার নদীগুলো সম্পর্কে যা শুনেছি তাতে ভাটার সময় জাহাজ তো দূরের কথা নৌকা। পর্যন্ত ঢুকতে পারে না নদীতে।
যা হোক, মিনিট বিশেকের ভেতর আমরা পেরিয়ে গেলাম নদী মুখ। আমি আর জব দাঁড় টানছি, বাতাসেরও সাহায্য পাচ্ছি সামান্য। লিও এখনো বেশ দুর্বল, তাই ওকে বসে থাকতে বলেছি। বেশ খানিকটা উঠে এসেছে সূর্য, কুয়াশাও অনেক পাতলা হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে উষ্ণ হয়ে উঠছে প্রকৃতি। এখন বেশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে চারপাশ। খেয়াল করলাম, প্রায় আধ মাইলের মতো চওড়া হবে নদীর মোহনাটা। পাড়গুলো কাদায় ভর্তি করে সে কাদার ওপর শুয়ে আছে অসংখ্য কুমীর। মনে হচ্ছে বিদঘুটে চেহারার অজস্র কাঠের টুকরো যেন কে ছড়িয়ে রেখেছে।
প্রায় এক মাইল চলে আসার পর পাড়ের কাছে এক জায়গায় এক টুকরো শক্ত জমি দেখতে পেলাম। ওখানে নৌকা ভেড়ালাম আমরা। একটাও কুমীর দেখতে পেলাম না আশপাশে। ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিয়ে নেমে এলাম পাড়ে। গায়ের কাপড় চোপড় এবং নৌকার জিনিসপত্র সব কাল রাতে ভিজে একসা হয়েছিলো। প্রথমেই সেগুলো মেলে দিলাম রোদে শুকানোর জন্যে। তারপর ঝাকড়া পাতাওয়ালা একটা গাছের ছায়ায় বসে নাশতা সেরে নিলাম। নাশতা শেষ হতে না হতেই দেখলাম শুকিয়ে গেছে কাপড়গুলো। চারপাশটা ঘুরে ফিরে দেখতে হবে এবার।
প্রায় দুশো গজ চওড়া এবং পাঁচশো গজ লম্বা একটুকরো শুকনো জমির ওপর রয়েছি আমরা। এক দিক দিয়ে বয়ে যাচ্ছে নদী। বাকি তিন দিকে অন্তহীন জনশূন্য জলাভূমি। জলাভূমি এবং নদীর উপরিভাগ থেকে প্রায় পঁচিশ ফুট উঁচু জায়গাটা। দেখে মনে হয় মানুষের হাতে তৈরি।
এক কালে বোধহয় জাহাজঘাট ছিলো এখানে, বললো লিও।
পাগল, জবাব দিলাম আমি, একে জংলীদের রাজত্ব, তার ওপর এ রকম
জলা জায়গা, কোন্ গর্দভ এখনে জাহাজঘাটা বানাবে?
হয়তো আগে এখানে এমন জলা ছিলো না, হয়তো এখানকার লোকরা চিরকালই জংলী ছিলো না, পাড়ের খাড়া ঢালে এক জায়গয় তীক্ষ্ণ্ণ চেখে তাকিয়ে লিও বললো। ওখানে দেখ, পাথর মনে হচ্ছে না?
পাগল, আবার বললাম আমি। বললাম বটে কিন্তু লিওর সঙ্গে সাবধানে নেমে গেলাম জায়গাটায়।
কি মনে হয়? জিজ্ঞেস করলো ও।
এবার কোনো জবাব দিতে পারলাম না আমি। কারণ দেখলাম সত্যিই মাটির ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে চৌকো এক খণ্ড পাথর। বেশ বড় এবং শক্ত। ছুরির ডগা দিয়ে খোঁচা মেরে দেখলাম, একটুও দাগ পড়লো না।
জেটির মতোই তো মনে হচ্ছে, হোরেস কাকা, উত্তেজিত গলায় বললো লিও। বড় বড় জাহাজ ভিড়তো বোধহয়।
আবার বলতে চেষ্টা করলাম, পাগল, কিন্তু কথাটা আটকে গেল গলার কাছে। আমিও এখন বিশ্বাস করতে শুরু করেছি, সত্যিই হয়তো জাহাজঘাট ছিলো এখানে।
গল্পটা তাহলে নেহাত গল্প ছিলো না, হরেস কাকা, উত্তেজিত গলায় বললো লিও।
সরাসরি কোনো জবাব দিতে পারলাম না আমি। বললাম, আফ্রিকার মতো একটা দেশে এমন আশ্চর্য অনেক কিছুই থাকতে পারে। মিসরীয় সভ্যতার বয়স কত তা কে বলতে পারে? তারপর ব্যাবলনীয়রা ছিলো, ফিনিসিয়রা ছিলো, ছিলো পার্সিয়ানরা-এদের সবাই কম বেশি সভ্য ছিলো। এদের কারো উপনিবেশ বা বাণিজ্য ঘাঁটি হয়তো ছিলো এখানে, কে বলতে পারে?
ঠিক ঠিক। কিন্তু এতক্ষণ তো এ কথা মানতে চাইছিলে না তুমি।
এ কথার জবাব দেয়া যায় না। কথার মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার প্রয়োজন বোধ করলাম আমি। বললাম, বেশ, এখন কি করা যায় তাই বলো!
জানি এই মুহূর্তে এ প্রশ্নের জবাব দিতে পারবে না ও। ধীরে ধীরে জলাভূমির প্রান্তের দিকে এগিয়ে গেলাম আমরা। যতদূর চোখ যায় ধুধু করছে জল-কাদা। মাঝে মধ্যে নানা ধরনের জলজ উদ্ভিদ। অসংখ্য জলজ পাখিও দেখলাম, একবার উড়ছে একবার বসছে।
দুটো জিনিস পরিষ্কার, বুঝতে পারছি, আমি বললাম। প্রথমত এর ওপর দিয়ে যেতে পারবো না আমরা, বিস্তৃত জলাভূমির দিকে ইঙ্গিত করলাম, আর, দ্বিতীয়ত, এখানে যদি চুপচাপ বসে থাকি, নির্ঘাত অসুখে পড়তে হবে।
দিবালোকের মতো পরিষ্কার, স্যার, বললো জব।
হুঁ। তার মানে দুটো পথ আছে আমাদের সামনে। একটা, তিমি নৌকা করে কোনো বন্দরের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমানো-যদিও খুবই ঝুঁকিপূর্ণ কাজটা। আর অন্যটা, পাল তুলে বা দাঁড় টেনে এই নদী ধরে এগিয়ে যাওয়া এবং অপেক্ষা করা, শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে পৌঁছাই।
তোমরা কি করবে না করবে, জানি না, বললো লিও, আমি নদী ধরে এগিয়ে যাচ্ছি।
হতাশাসূচক অক্ষুট একটা ধ্বনি বেরোলো জবের গলা চিরে। আরবটাও বিড়বিড় করে উঠলো, আল্লাহ। আর আমি ভেবে দেখলাম, এই তিরিশ ফুটের তিমি নৌকায় সাগর পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করা আর নদী ধরে অজানা পথে এগিয়ে যাওয়া একই কথা। তাছাড়া মুখে স্বীকার না করলেও, ঐ বিশাল নিগ্রোর মাথা আর পাথরের জেটি দেখে মনে মনে লিওর মতো আমিও উৎসুক হয়ে উঠেছি, রহস্যের শেষ কোথায় দেখতে হবে। তবে ওপরে ওপরে ভাব দেখালাম, লিও যখন যাবেই, আমাদেরকেও যেতে হবে, ওকে তো আর একা ছেড়ে দেয়া যায় না।
সাবধানে নৌকায় মাস্তুল লাগালাম আমরা। রাইফেলগুলো বের করলাম। তারপর রওনা হয়ে গেলাম উজানের দিকে। ভাগ্য ভালো সাগরের দিক থেকে বাতাস আসছে। সহজেই পাল তুলে দিতে পারলাম। বাকি কাজ মাহমুদের। হাল ধরে রইলো সে।
.
দুপুর নাগাদ প্রচণ্ড হয়ে উঠলো সূর্যের তাপ। ঘেমে নেয়ে অস্থির আমরা। সেই সাথে জলাভূমি থেকে ভেসে আসছে তীব্র দুর্গন্ধ। সাবধান হওয়ার প্রয়োজন বোধ করলাম আমি। তাড়া এক ডোজ করে কুইনাইন গিলিয়ে দিলাম সবাইকে।
একটু পরেই বাতাস পড়ে গেল। দাড় টেনে এগোনোর কথা ভুলেও ঠাই দিলাম না মনে—একে নৌকাটা বেশ ভারি, তার ওপর এগোতে হবে স্রোতের উল্টোদিকে। সুতরাং আপাতত নৌকা ঘাটে বেঁধে অপেক্ষা করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
সামনে কিছু দূরে একটা খাড়ি মতো দেখে সেদিকে দাঁড় টানতে লাগলাম আমরা। নৌকা বাঁধার জন্যে খুব উপযোগী হবে জায়গাটা, সুতরাং দাঁড় টানার এই কষ্টটুকু স্বীকার করে নেয়া যায়। এমন সময় একটা জিনিস দেখে ফিসফিস করে, আমাকে ডাকলো লিও। আমি মুখ তুলতেই পাড়ের একটা জায়গার দিকে ইশারা করলো ও।
অসম্ভব সুন্দর একটা মর্দা হরিণ, নদীর কূলে দাঁড়িয়ে পানি খাচ্ছে। সামনের দিকে বাঁকানো বিরাট শিং। মেরুদণ্ডের শেষ প্রান্তে সাদা একটা ভোরা। নিঃশব্দে এক্সপ্রেস রাইফেলটা দিলাম লিওর হাতে, আমিও তুলে নিলাম আমারটা। ফিসফিস করে বললাম, ফস্কায় না যেন।
ফস্কাবে! মাথা খারাপ!
রাইফেল উঁচু করলো লিও। ইতিমধ্যে পানি খাওয়া শেষ করে মাথা তুলেছে হরিণটা।
গুড়ুম! ঘুরে দাঁড়িয়েই ছুটলো হরিণ। লাগাতে পারেনি লিও। গুড়ুম! এবার আমি, লক্ষ্যবস্তু ছুটন্ত। একলাফ দিয়ে মুখ থুবড়ে পড়লো হরিণটা।
তোমার চোখে বোধহয় ধাঁধা লাগিয়ে দিয়েছিলাম, কি বললো, লিও বাবু? বেশ একটু আত্মতুষ্টির ভঙ্গিতে বললাম আমি।
সে-রকমই মনে হচ্ছে, গরগরিয়ে উঠলো লিও। তারপর একটু হেসে যোগ করলো, স্বীকার করছি, হোরেস কাকা, টিপটা তোমার চমৎকার হয়েছে, আর আমারটা একেবারে জঘন্য।
ঝটপট নৌকা তীরে ভিড়িয়ে আমরা ছুটলাম হরিণটার দিকে। মেরুদণ্ডে লেগেছে গুলি, সঙ্গে সঙ্গে শেষ। পনেরো মিনিট বা কিছু বেশি সময় লাগলো ওটার চামড়া ছাড়িয়ে, নাড়ীভুড়ি ফেলে নৌকায় এনে তুলতে। তারপর আবার রওনা হলাম খাড়ির দিকে।
ছোটখাটো একটা হ্রদের মতো জায়গাটা। এর মাঝামাঝি জায়গায় নোঙর ফেললাম আমরা। জলাভূমির বিষাক্ত গ্যাসের ভয়ে তীরের কাছে যাওয়ার সাহস পেলাম না। ইতিমধ্যে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। রাতের খাওয়া সেরে নিয়ে ঘুমানোর আয়োজন করতে লাগলাম আমরা
সবেমাত্র কম্বল টেনে নিয়েছি গায়ে, এমন সময় টের পেলাম, হাজার হাজার রক্ত পিপাসু একগুঁয়ে মশা আক্রমণ চালিয়েছে আমাদের ওপর। ইয়া বড় বড় একেকটা। তাড়াতাড়ি কম্বল টেনে দিলাম মাথার ওপর।
মশার একটানা গুঞ্জন ছাড়া আর কোনো আওয়াজ নেই। হঠাৎ সিংহের গম্ভীর গর্জনে কেঁপে উঠলো চারদিক! তারপর আবার। এবার বোধহয় আরেকটা।
ভাগ্য ভালো, তীরের কাছে নোঙর ফেলিনি, কম্বলের নিচ থেকে মাথা বের করে বললো লিও। উহুঁ, মর, শালা! আমার নাকে একটা কামড় বসিয়ে দিয়েছে! আবার অদৃশ্য হয়ে গেল ওর মাথা।
কিছুক্ষণ পর চাঁদ উঠলো। একটু পরপরই নানা রকম গর্জনের শব্দ ভেসে আসছে কানে। তীর থেকে দূরে নিরাপদে আছি ভেবে নিশ্চিন্ত মনে শুয়ে রইলাম আমরা।
কি কারণে জানি না-কম্বলের নিচে থাকা সত্তেও মশার কামড় থেকে নিস্তার পাচ্ছি না বলেই হয়তো, মাথা বের করলাম। সঙ্গে সঙ্গে শুনলাম জবের ফিসফিসে গলা:
হায় হায়, দেখুন, স্যার!
আমরা সবাই দেখলাম, দুটো প্রশস্ত বৃত্ত-ক্রমশ আরো প্রশস্ত হতে হতে এগিয়ে আসছে নৌকার দিকে।
কি? জিজ্ঞেস করলাম আমি।
ঐ সিংহগুলো স্যার, স্পষ্ট আতঙ্ক ওর গলায়। আমাদের দিকে আসছে।
আবার ভালো করে দেখলাম। না কোনো সন্দেহ নেই, সিংহ। ওদের জ্বলজ্বলে হিংস্র চোখ দেখতে পাচ্ছি। হরিণের মাংস অথবা আমাদের গন্ধ পেয়ে এগিয়ে আসছে ক্ষুধার্ত জন্তুগুলো।
এর ভেতরে লাফিয়ে উঠে রাইফেল তুলে নিয়েছে লিও। আমি ওকে অপেক্ষা করতে বললাম, আগে আরো কাছে আসুক। আমাদের থেকে ফুট পনেরো দূরে একটা চরা মতো। পানির উপরিভাগ থেকে ইঞ্চি পনেরো নিচে। প্রথম সিংহটা ওটার ওপর উঠে গা ঝাড়া দিয়ে পানি সরালো। তারপর মুখ হাঁ করে গর্জে উঠলো। ঠিক সেই মুহূর্তে গুলি করলো লিও। সিংহটার খোলা মুখের ভেতর দিয়ে ঢুকে ঘাড়ের কাছ দিয়ে বেরিয়ে গেল বুলেট। সঙ্গে সঙ্গে মারা গেল ওটা। অন্য সিংহটা পূর্ণ বয়স্ক পুরুষ। সবেমাত্র সামনের পারা দুটো চরায় ঠেকিয়েছে সে; এমন সময় অদ্ভুত একটা ব্যাপার ঘটলো। তীব্র আলোড়ন উঠলো পানিতে। তড়াক করে লাফিয়ে উঠে পেছন দিকে তাকালো সিংহটা। আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে গর্জন করে দ্বিতীয় এক লাফে উঠে পড়লো চরে। কালো কি একটা যেন আটকে আছে তার পায়ে।
আল্লাহ্! চিৎকার করে উঠলোঁ মাহমুদ, কুমীরে ধরেছে ওটাকে!
এর পর যে দৃশ্য দেখলাম তাকে শুধু অসাধারণ বললে কম বলা হয়। সিংহটা চরে উঠে পড়তে পেরেছে আর কুমীরটা আধ দাঁড়ানো আধ সঁতরানো অবস্থায় বেচারার পেছনের পা কামড়ে ধরে সমানে পেছনে টেনে চলেছে। হিংস্রভাবে গর্জন করে চলেছে সিংহটা, সেই সাথে টানা-হাচড়া করে ছাড়াতে চেষ্টা করছে পা। হঠাৎ সিংহের হিংস্র একটা থাবা গিয়ে পড়লো কুমীরটার মাথায়। পা ছেড়ে দিয়ে খপ করে সিংহের কোমরের কাছটা কামড়ে ধরলো কুমীর। এই ফাঁকে সিংহও কামড়ে ধরতে পেরেছে কুমীরের গলা। তারপর শুরু হলো আসল ধস্তাধস্তি। সিংহের কোমর দুই চোয়ালের ফাঁকে আটকে ধরে ভয়ানকভাবে এপাশে ওপাশে ঝাকাচ্ছে কুমীর। আর তাকে আঁচড়ে কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করে দিতে চেষ্টা করছে। সিংহ।
কয়েক সেকেণ্ড পরেই দুর্বল হয়ে পড়লো সিংহটা। আচমকা এক ঝাঁকুনিতে কুমীরের পিঠের ওপর গিয়ে পড়লো ওর মাথা। তারপর শেষ একটা আর্তনাদ করে নিষ্পন্দ হয়ে গেল বেচারা। মিনিটখানেক স্থির হয়ে রইলো কুমীর। তারপর ধীরে ধীরে এক গড়ান দিয়ে চিৎ হয়ে গেল। সিংহের ক্ষতবিক্ষত শরীরটা এখনো আটকে আছে তার চোয়ালে। দুজনেই মরণ পণ করে লড়েছে, মরেছে দুজনেই।
চারপাশ আবার নিথর নীরব। একটানা মশার গুঞ্জনই কেবল শোনা যাচ্ছে। আবার কখন কি বিপদ উপস্থিত হয়, ঠিক নেই—মাহমুদকে পাহারায় রেখে শুয়ে পড়লাম আমরা।