০১-০৫. নতুন খেলনাগুলো

মাকু — লীলা মজুমদার

নতুন খেলনাগুলোকে আলমারির মাথায় তুলে দিয়ে আম্মা বলল, তোমাদের বাপি বললে আর আমি কী করতে পারি বলো, কালিয়ার বন থেকে যে আস্ত কেউ ফেরে না, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই। কেন, আমার নিজের মামাতো পিসেমশাই গোরু খুঁজতে সেখানে গিয়ে, গোরু তো পেলই না, বরং সাত দিন সারা গা চুলকে সারা, সর্বাঙ্গে এই দাগড়া দাগড়া চাকায় ভরে গেল!

সোনা বলল, ধেৎ! বাপি বলেছে ও আমবাত। তা তোমাদের বাপি আমবাত জামবাত যা খুশি বলতে পারে, এককালে তো পেয়ারাকে পেয়ালা বলত, তবে পাড়াসুদ্ধ সকলে বলল ওকে চুলবুলিতে ধরেছে। শেষটা সাড়ে তিন টাকা খরচ করে, কালিয়া বনের দেউকে পুজো দিয়ে ঠান্ডা করে, তবে-না দাগ মিলিয়ে গেল। মোড়ল তো বলেছিল পিসেমশাইয়ের বাঁচার কথাই ছিল না নেহাত কানের কাছ দিয়ে ঘেঁষে কোনোমতে বেরিয়ে গেছে। এসব কথা যেন আবার মামণির কানে তুলো না।

পাশের বাড়ির তোতাদের আয়াও সেদিন সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল। সে বলল, নাহয় মার কানে না তুলল, তাই বলে তো আর কথাটা না-ই হয়ে যায় না। কে না জানে আমার ছোটো ভাই পানুয়া ওই বনেই নিখোঁজ হয়ে গেছে আজ পনেরো বছর হল। মার কানে না তুললেও তো আর পানুয়া ফিরে আসবে না!

 এই বলে আয়া আঁচলের খুঁট দিয়ে চোখ মুছে মুছে দেখতে দেখতে লাল করে ফেলল। তোতা বললে, আয়াদিদি, তোমার যেমন কথা! বাড়ির মাস্টারমশাই বলেছেন, তোমাদের পানুয়া মোটেই বনে নিখোঁজ হয়নি। মোড়লের সঙ্গে মারপিট করে, পেয়াদার ভয়ে ফেরারি হয়ে গেছে।

রাগে আয়ার তুলতুলে গাল দুটো শক্ত হয়ে উঠল, ছিঃ তোতা, মাস্টারমশাইয়ের কাছে আমাদের ঘরের কথা বলতে গেলে কী বলে! মেয়েদের একটু লজ্জা থাকা ভালো। আম্মা ওর পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, ওরা ওইরকম দিদি, বড্ড অলবচ্ছে, ওদের কি অত বুদ্ধি আছে!

আম্মা বাপির ছোটোবেলাকার ধাইমা, বাপি ওকে আইমা বলে ডাকত। সোনা যখন ছোটো ছিল, আইমা বলতে পারত না, বলত আম্মা; লজেঞ্জুসকে বলত দাদুচ, লেবুকে বলত দেবু। টিয়া এক বছরের ছোটো, দিদির দেখাদেখি সেও বলে আম্মা।

পুতুল তুলে রেখে আম্মা পা ছড়িয়ে মাটিতে বসে সুপুরি কুচোনোর আঁতি দিয়ে নারকোল কুচোতে লাগল। তোতাকে নিয়ে আয়া বাড়ি চলে গেলে পর সোনা একটা তিনঠেঙা টুল আনতেই, আম্মা সেটা হাত বাড়িয়ে কেড়ে নিল, চালাকি চলবে না, সোনা! ওসব খেলনা পিসির ছেলের জন্যে। জন্মদিনে এই এত খেলনা পেলে, ঠেলাগাড়ি, বেবিপুতুল, পেয়ালা-পিরিচ, সত্যিকার চামচ-কাঁটা, তা সেসব সাত দিন না পেরুতে ভেঙে নাশ করে দিলে! খবরদার যদি পিসির ছেলের খেলনাতে হাত দিয়েছ! যাও-না, বাগানে গিয়ে খেলা করো; নোনোর শেকল খোলা, দেখো তো সে পালিয়েছে কি না; আঃ, যাও-না, এখান থেকে, কাজের সময় গোল কোরো না।

টিয়া এক মুঠো নারকেল কুচো তুলে নিতেই আম্মা আরও রেগে গেল, হাঁ-হাঁ-হাঁ, নিয়ো না বলছি, এক কুচি নিয়েছ তো আমি তোমাদের মামণিকে বলে কেমন বকুনিটা খাওয়াই দেখো। এসব তোমাদের জন্যে নয়।

সোনা বলল, তাহলে কাদের জন্যে? বাপি মামণি মিষ্টি খায় না।

–আরও খাবার লোক আসছে গো, পিসি মিষ্টি খায়, পিসে খায়, ওদের খোকাও খায়। এখন সর দিকি, নারকোলচিড়ে হবে, ইচামুড়ো হবে, ক্ষীর ঘন করব।

সোনা বলল, বেশ, ওদের খাওয়াও, আমরা চাই না। টিয়া বলল, আমরা পুঁটলি নিয়ে কালিয়ার বনে চলে যাচ্ছি। আমার পুঁটলিতে মামণির পুরোনো পাউডারটা নিয়েছি।

সোনা বলল, চুপ, বোকা। আম্মার কালো সুতোবাঁধা স্টিল ফ্রেমের চশমা নাকের উপর নেমে এল, সেটাকে তুলে সে বলল, তাই যাও, কাজের সময় জ্বালিয়ো না, যাও-না দু-টিতে, মজাটা বোঝো গিয়ে।

সোনা-টিয়া হাসতে লাগল। কী ভয় দেখাচ্ছ? বাপি বলেছে বাঘ-ফাঘ নেই জঙ্গলে, সাহেব শিকারিরা কবে মেরে শেষ করে দিয়েছে। টিয়া বলল, খালি এই বড়ো বড়ো লাল-নীল বেগনি প্রজাপতিরা আর কাঠঠোকরা পাখি আছে, তারা ঝুঁটিমাথা নীচের দিকে করে গাছের গায়ে গর্ত খোঁড়ে।

দু-জনে পেছনের বারান্দার জালের দরজা খুলে বাইরে পা দিতেই আম্মা চাঁচাতে লাগল, ভালো হবেনা বলছি সোনা টিয়া, এমন দুষ্টু মেয়েও তো জন্মে দেখিনি, নিজের পিসির খোকা আসছে বলে হিংসায় জ্বলে পুড়ে খাক হল। যেয়ো না বলছি।

আম্মার চশমাটা এবার সত্যি নাক থেকে খসে মাটিতে পড়ে গেল। সেটাকে না তুলেই আম্মা চঁচাতে লাগল, বেশি বাড়াবাড়ি কোরো না, সোনা টিয়া, জঙ্গলে বাঘ না থাকতে পারে বাঘ আর এমন কী, তাকে গুলি করে মেরে ফেলা যায়, কিন্তু কালিয়ার বনের ভয়ংকরের গা থেকে গুলি ঠিকরে পড়ে, এ অনেকের নিজের চোখে দেখা।

জালের দরজার বাইরে থেকে সোনা টিয়া হি-হি করে হাসতে লাগল।

যাও গে, পিসির খোকাকে ওসব গাঁজাখুরি গল্প বলো, আমরা স্কুলে ভরতি হয়েছি, আমরা ভয় পাই না! এই বলে সোনা-টিয়া খিড়কি-দোরের খিল খুলে ফেলল। কী করবে আম্মা? বাড়িতে আরেকটা লোকও নেই, খালি ঠামু ঘর বন্ধ করে ঘুমুচ্ছে, ডাকলে বেদম চটে যাবে, বাপি মামণি পিকনিকে গেছে, ঠাকুর গেছে দোকানে, চাকরদের কারো টিকির দেখা নেই। আম্মার পায়ে গুপো, উঠতে বসতে কষ্ট হয়, তাড়াতাড়ি চলতে গেলে হাঁটুতে খিল ধরে, তাই ভাঙা গলায় সমানে সে চাঁচাতে লাগল, ও সোনা-টিয়া, যেয়ো না বলছি, কালিয়ার বনে আমার ঠাকুরদা হরিণ ধরতে ফঁদ পেতেছিল, তাতে কী পড়েছিল মনে নেই?

কে কার কথা শোনে, সোনা-টিয়া, খিড়কি দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে, বাইরে থেকে ছিটকিনি টেনে আম্মার বেরুনোর পথ বন্ধ করেই এক ছুট।

রাস্তাটা কিন্তু বড্ড ফাঁকা, সরু গলির এ-মাথা থেকে ও-মাথা অবধি কেউ নেই, দুপুরের রোদে পায়ের কাছে নিজেদের ছায়াগুলোকে জড়ো করে এনে গাছপালা ঝিমঝিম করছে।

সোনা দেখল টিয়া যেন পেছিয়ে পড়ছে। চুপ, পেছন দিকে তাকাতে হয় না।

টিয়ার হাত ধরে সোনা লম্বা লম্বা পা ফেলতে লাগল।

–কেন দেখতে হয় না?

–তাহলে–তাহলে প্যাঁ-প্যাঁ পুতুল পায় না। টিয়া ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল, পিসির খোকার নতুন প্যাঁ-প্যাঁ পুতুল এসেছে, আমাদের নেই! সোনা তার চোখ মুছিয়ে, গালে চুমু খেয়ে বলল, কালিয়ার বনে আমরা দুটো প্যাঁ-প্যাঁ পুতুল কিনব, কেমন?

গলির পর বড় রাস্তা, তারপর গির্জে, তারপর গোরস্থান। গোরস্থানের পর শুনশুনির মাঠ, আগে সেখানে ডাকাত পড়ত, তারপরেই দূর থেকে দেখা যায় ঘন নীল কালিয়ার বন। গোরস্থানের পাশ দিয়ে হনহনিয়ে যেতে হয়। তোতার আয়া বলেছে বিশুদাকে, কারা নাকি সুরে ডেকেছিল, সে ফিরেও তাকায়নি বলে বড়ো বাঁচা বেঁচেছিল!

 গোরস্থানের ফটকের কাছে ঝোলাঝালা কোটপেণ্টলুন পরা একটা অচেনা লোক, পিঠে একটা ঝুলি। সোনা-টিয়া পাশ কাটাতে যাবে, লোকটা পথ আগলে বলল, আমি ঘড়িওয়ালা, সারাদিন কিছু খাইনি, পুটলিতে কী খাবার আছে, প্লিজ দেবে?

সোনা-টিয়ার বড়ো দুঃখ হল; সোনা তাকে একমুঠো মুড়ি লজেঞ্জুস আর টিয়া একটা গোলাপি চিনিলাগা বিস্কুট দিল। চেটেপুটে তাই খেয়ে, ঝোলা কাঁধে লোকটা ওদের সঙ্গে চলল। সোনা বলল, তুমি ছেলেধরা নও তো? তাহলে আমার বাপি দোনলা বন্দুক দিয়ে তোমাকে শেষ করবে কিন্তু।

 সে বলল, আরে ছোঃ, ছোঃ, আমি ঘড়িওলা, ছেলে ধরব কী, আজকাল ছেলে দেখলে আমার পিত্তি জ্বলে যায়। তা কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনতে পারি কি?

টিয়া বলল, আমরা কালিয়ার বনে যাচ্ছি, সেখানে প্যাঁ-প্যাঁ পুতুল কিনব!

সোনা বলল, পিসির খোকা আসছে বলে খেলনা হচ্ছে, মিষ্টি তৈরি হচ্ছে, আমাদের আর কেউ চায় না।

–তা কালিয়ার বনে যেতে ভয় করছে না?

–না, আমরা যে স্কুলে ভরতি হয়েছি, ভয় পাই না।

–তাহলে আমার একটা কাজ করে দিতে পারবে? কালিয়ার বনে আমার মাকু আছে কি না একটু খোঁজ নেবে কি?

–কেন, মাকু দিয়ে কী করবে?

–ওমা, তার ওপর যে আমার বড়ো মায়া। তার কাছ থেকে পালিয়ে পালিয়ে যে আমার গেটো ধরে গেছে। সোনা বলল, মায়া তো পালালে কেন? লোকটা অবাক হয়ে গেল।

–পালাচ্ছি প্রাণের ভয়ে। কিন্তু মায়া হবে না তো কী! সতেরো বছর ধরে তাকে তৈরি করেছি যে। খেতে খেতে ভেবেছি মাকুর পায়ে ক-টা গাঁট দেব, আর খাওয়া হয়নি। শুয়ে শুয়ে ভেবেছি মাকুর মাথায় পাকানো তারটি কোথায় বসাব, চকমকি পাথরটি কোথায় রাখব, আর ঘুম হয়নি।

সোনা বলল, ও ঘড়িওলা, মাকু কি তবে একটা ঘড়ি? ঘড়ির ভয়ে কেউ পালায়? ঘড়ি হাঁটতে পারে নাকি? লোকটা তাই শুনে হাঁ। ওমা বলে কী, ঘড়ি চলে না! অচল ঘড়ি চালু করাই যে আমার কাজ। তাছাড়া–। এই বলে ঘড়িওলা দুঃখ দুঃখ মুখ করে চুপ করল।

টিয়া ওর হাত ধরে বলল, বলো ঘড়িওলা, মাকুর কথা বলো। সে কীরকম ঘড়ি, তাই বলো।

ঘড়ি সে নয়, যদিও ঘড়ির কল দিয়ে ঠাসা।

–সে কি তবে কলের পুতুল? টিন দিয়ে তৈরি?

লোকটা রেগে গেল। দেখো, মাকু কথা বলে, গান গায়, নাচে, অঙ্ক কষে, হাতুড়ি পেটে, দড়ির জট খোলে, পেরেক ঠোকে, ইস্ত্রি চালায়, রান্না করে, কাপড় কাঁচে, সেলাই কল চালায়

–তবে কি চাকর?

ঘড়িওলা কাষ্ঠ হেসে বলল, চাকর নয়, বরং মুনিব হতে পারে। সব করতে পারে, শুধু বেশি হাসতে পারেনা আর কাঁদতে পারেনা। তাই আমার উপর রাগ, দিন-রাত খুঁজে বেড়াচ্ছে আমাকে, আমাকে ধরলেই হাসার কল, কাঁদার কল বসিয়ে নেবে। তাহলেই সে একটা আস্ত মানুষ হয়ে যাবে, রাজার মেয়ে বিয়ে করবে।

তাই শুনে সোনা-টিয়া এমনি অবাক হয়ে গেল যে হাত থেকে পুঁটলি দুটো ধুম করে মাটিতে পড়ে গেল। ঘড়িওলা চমকে গিয়ে বলল, পুঁটলিতে ধুম করে কী?

 সোনা বলল, ও কিছুনা, জ্যামের খালি টিন, কেরোসিনের বোতলের ফেঁদল আর রবারেনল। নিয়ে যাচ্ছি বনে, যদি কাজে লাগে। কোথায় পাবে রাজার মেয়ে?

 ঘড়িওলা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, বড়ো সাধ ছিল, নোটো মাস্টারের সার্কাস পার্টিতে মাকুতে-আমাতে খেলা দেখাব, আর আমাদের দুঃখ থাকবে না। তাই খেলা দেখতে নিয়ে গেছিলাম, সেই আমার কাল হল।

–কেন কাল হল?

– সার্কাসের জাদুকর বাঁশি বাজিয়ে জাদুর রাজকন্যে দেখাল, মাকু বলে ওই রাজকন্যে আমি বিয়ে করব। জাদুকরের কী হাসি, কলের তৈরি খেলনা, কাতুকুতু দিলে হাসে না, দুঃখ হলে কাঁদে না, সে বিয়ে করবে আমার ভেল্কির রাজকন্যে, পরিদের রানিকে! যা ভাগ! সেই ইস্তক মাকু আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, অথচ ওকে তৈরি করতেই আমার সব বিদ্যে ফুরিয়ে গেছে, হাসি-কান্না আমার কম্ম নয়।

সোনা বললে, কতদিন পালিয়ে বেড়াবে? বাড়ি যাবে না? তোমার মা নেই?

 ঘড়িওলা হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগল।

–আছে গো, আছে, সব আছে; বড়ো ভালো সরুচাকলি বানায় আমার মা, একবার খেলে আর ভোলা যায় না। কবে যে তাকে আবার দেখতে পাব!

টিয়া বললে, দুষ্টু মাকু থাকগে পড়ে, তুমি মার কাছে ফিরে যাও। এই বলে পুটলির কোনা দিয়ে টিয়া চোখ মুছল।

ঘড়িওলাও চোখ মুছল। তাই কি হয়, দিদি, মাকু যে আমার প্রাণ, ওকে নাগালের বাইরে যেতে দিই কী করে? ওর চাবি ফুরিয়ে গেলেই যে নেতিয়ে পড়বে, তখন চোর-ডাকাতে ওর কলকজা খুলে নিলেই মাকুর আমার হয়ে গেল।

কবে চাবি ফুরুবে?

–এক বছরের চাবি দেওয়া, তার সাড়ে এগারো মাস কেটে গেছে, আর পনেরো দিন। বলল, ওকে বের করে চোখে চোখে রাখবে?

সোনা বললে, সেলাই কল চালায় আর নিজের পেটের চাবিটা ঘুরিয়ে নিতে পারবে না?

 ঘড়িওলা ব্যস্ত হয়ে উঠল। পেটে নয়, দিদি, পেটে নয়, পিঠের মধ্যিখানে, গায়ে-বসা এত্তোটুকু চাবি, কানখুসকি দিয়ে ঘুরুতে হয়। নইলে মাকু যা দস্যি, কবে টেনে খুলে ফেলে দিত! ওখানে সে হাত পায় না, হাত দুটো ইচ্ছে করে একটু বেঁটে করে দিয়েছি।

কথা বলতে বলতে কখন তারা শুনশুনির মাঠ পেরিয়ে এসেছে, সামনে দেখে ঘন বন। বনের মধ্যে খানিক রোদ, খানিক ছায়া, পাখির ডাক, পাতার খসখস, বুনো ফুলের আর ধূপ কাঠের গন্ধ। ঘড়িওলা বললে, আমি আর যাব না, মাকু আমাকে দেখলে ঘেঁকে ধরবে, আমার ভয় করে। তোমরা স্কুলে ভরতি হয়েছ, ভয় পাও না, তোমরা যাও! আমি এখানে গাছের মাথায় পাতার ঘর বেঁধে অপেক্ষা করি। এই বলে ঘড়িওলা সোনা-টিয়ার ঘাড় ধরে একটু ঠেলে দিল।

০২.

ঠেলা খেয়ে প্রায় একরকম ঢুকেই গেছিল বনের মধ্যে সোনা আর টিয়া, এমনসময় ঘড়িওলা পেছন থেকে ডেকে বলল, চললে কোথা? হ্যাঁন্ডবিল নিতে হবে না? তা নইলে মাকুর বিষয়ে বিশেষ বিজ্ঞপ্তি জানবে কী করে? বলি, তাকে চিনতে হবে তো?

এই বলে ঝোলা থেকে একটা বড়ো মতো গোলাপি কাগজ বের করে, পাশের মাটির ঢিপির ওপর চড়ে গলা খাঁকরে পড়তে লাগল–

মাত্র পঁচিশ পয়সায়!
অদ্ভুত!    অত্যাশ্চর্য!!
মাকু দি গ্রেট!!!
অভাবনীয় দৃশ্য দেখে যান!
কলের মানুষ চলে ফেরে, কথা কয়, অঙ্ক কষে, টাইপ করে, সেলাইকল চালায়, হাতুড়ি পেটে, রান্না করে, মশলা বাটে, বাসন ধোয়, ঘর মোছে, হারানো জিনিস খুঁজে দেয়, নাচে, গায়, সাইকেল চাপে, দোলনা ঠেলে, পরীক্ষার প্রশ্নের জবাব দেয়!

এই অবধি পড়ে ঘড়িওলা মাটির ঢিপির ওপরে বসে মাকুর শোকে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগল! তাই দেখে টিয়াও মহা কান্না জুড়ে দিল। সোনা পড়ে গেল মুশকিলে, কাউকে কাঁদতে দেখলেই তার গলায় কেমন ব্যথা ব্যথা করে, অথচ তাহলে এদের দুজনকে থামায় কে? অনেক কষ্টে টিয়ার মুখে মুড়ি লজেঞ্জুস পুরে আর পুঁটলির গেরো দিয়ে ঘড়িওলার চোখ মুছে তাদের ঠান্ডা করে, সোনা বলল, কী, হয়েছে কী? সবটা পড়তে পারছ না বুঝি? ঘড়িওয়ালা মাথা নাড়ল। না,, বাকিটা লেখাই হয়নি। মাকু যেই পালিয়ে গেল, অধিকারী বলল, আর কালি খরচ করে কী হবে, ওকে আগে ধরে আনা হোক! আমার আর তাই বড়োলোক হওয়া হল না। এই বলে ঘড়িওলা দু-তিন বার ফোৎ ফোৎ করে নাক টেনে নিল।

সোনা অবাক হয়ে গেল। টিয়াও হ্যাঁন্ডবিল দিয়ে চোখ মুছে বলল, কেন পালিয়ে গেল?

তা পালাবে না? আমি যেই পালালাম, ও আমাকে খুঁজতে না বেরিয়ে ছাড়ে কি! এতটুকু এক কুচি লোহা, কী টিন, কী তামা, কী পিতল, কী সোনা, কী রুপো যাই থাকুন-না কেন, যতই-না লুকোনো জায়গায়, মাকু তাকে ঠিক খুঁজে বের করবে। ওর হাতের পায়ের নখের তলায় একরকম রাডারযন্ত্র লাগিয়ে রেখেছি যে! এখন নিজেই তাই টিনের বোতাম কেটে, হাতঘড়ি ফেলে, ঘড়ি সারাবার যন্ত্রপাতি ছেড়ে, কতকগুলো কাপড় আর কাগজ আর কাঠ নিয়ে ফেরারি হয়ে, ঘুরে বেড়াচ্ছি। একটা আলপিন তুলতে সাহস পাচ্ছি না।

এই বলেই হঠাৎ চমকে লাফিয়ে উঠল সে, নাঃ, এখানে বসে থাকা একটুও নিরাপদ নয়, কখন সে এসে-না জাপটে ধরে আবার ঘ্যানর ঘ্যানর শুরু করে,-পরিদের রানিকে বিয়ে করব, কঁদবার কল দাও, চোখ থেকে জল ফেলো! ভ্যালা গেরো রে বাবা! আর দেখো, সুন্দর লালচে কোকড়া চুল, ছাই রঙের চকচকে চোখ আর নাকের ডগায় কালো তিল দিয়ে মাকুকে চিনবে। কিন্তু সাবধান! তিলের নীচে টেপা সুইচ আছে।

এই বলেই এক ছুটে ঘড়িওলা শুনশুনির মাঠ পার হল। সোনা গোলাপি হ্যাঁন্ডবিলটা তুলে নিয়ে পুটুলিতে গুঁজে, টিয়ার হাত ধরে, আস্তে আস্তে বনের মধ্যে ঢুকল। কী ভালো বন, এই বড়ো বড়ো গাছগুলো মাথার ওপর তাদের ডালপালা দিয়ে সবুজ শামিয়ানা বানিয়ে রেখেছে। পাতার ফাঁক দিয়ে এখানে-ওখানে কুচিকুচি রোদ এসে পড়েছে, গাছগুলোর পায়ের কাছে শুকনো পাতা ঝরে পড়ে, দিব্যি সুন্দর গালচে তৈরি হয়েছে। ছোটো ছোটো ঝোপেঝাড়ে কত রঙের ফুল ফুটেছে, একটা মিষ্টি মিষ্টি সোঁদা গন্ধ নাকে আসছে, চারদিকটাতে কী ভালো একটা সবুজ আলো ছড়িয়ে আছে!

কিন্তু সোনা-টিয়াকে ফুল তুলতে দিল না। বলল, ফুল তুলতে গিয়ে দেরি করলে সন্ধ্যে হয়ে যাবে, নেকড়ে বাঘ বেরুবে।

টিয়া ফুল না তুলে পট করে একটা সবুজ পাতা ছিঁড়ল। সোনা অমনি পাতাটা কেড়ে ফেলে দিয়ে চোখ পাকিয়ে বলল, চুপ, কিচ্ছু বি না, যদি বিষ পাতা হয়। টিয়া একটা ছোট্ট নুড়ি তুলে ঝোঁপের মধ্যে ছুঁড়ে মারল। অমনি সোনা দিল এক ধমক, ঠিল খেয়ে যদি কেউটে সাপ ফোঁস করে ফণা তোলে!

টিয়া আবার ভ্যা করে কাঁদতে যাচ্ছিল, অমনি সোনা তার হাত ধরে দৌড়োতে লাগল– চল, চল, চাবি ফুরোবার আগে মাকুকে খুঁজে বের করতে হবে-না?মাকু কেমন নাচবে গাইবে, আমাদের জন্য গাছের ডালে দোলনা বেঁধে দেবে। দু-জনে দৌড়তে লাগল।

যতই বনের ভেতর যায়, ততই গাছপালা ঘন হয়ে আসে, আলো কমে যায়। দৌড়োতে দৌড়োতে শেষটা পায়ে ব্যথা ধরে গেল, ফ্রকে রাশি রাশি চোরকাটা ফুটল, জল তেষ্টা পেতে লাগল। এমনসময় সোনা-টিয়া দেখল গাছের নীচে টলটল করে বয়ে চলেছে এতটুকু একটা নদী। কী পরিষ্কার তার জল, তলাকার নুড়ি পাথর কেমন চকচক করছে দেখা যাচ্ছে, কী সুন্দর একটা ছলছল, ঝরঝর শব্দ কানে আসছে। নদীর ধারেই একটা বড়ো কালো পাথরে ঠেস দিয়ে সোনা-টিয়া বসে পড়ল।

ছোট্ট নদী, তাতে একহাঁটু জলও নেই। সোনা-টিয়া পুটলি নামিয়ে আশ মিটিয়ে হাতমুখ ধুল, পা ডোবাল, আঁজলা আঁজলা জল তুলে খেল, ফ্রক ও ইজের ভিজে একাকার! তারপর খিদে পেয়ে গেল। পুঁটলি খুলে ঠামুর ঘরের বড়ো পান খেল দুটো দুটো করে। কখন ঘুম পেয়ে গেছে খেয়াল নেই, কালো পাথরের আড়ালে পুটলি মাথায় দিয়ে দুজনার সে কী অসাড়ে ঘুম!

মটমট করে কাদের পায়ের চাপে কাঠকুটো ভাঙার শব্দে তবে ঘুম ভাঙল।

 চেয়ে দেখে নদীর ওপারে সরু নালামতো জায়গা বেয়ে জানোয়াররা জল খেতে আসছে। প্রথমে দুটো ঘোড়া, তাদের তাড়িয়ে আনছে টুপিপরা দুটো বাঁদর, তাদের পেছনে গলায় ঘন্টা বাঁধা একটা ছাগল, তার পেছনে পর পর দুটো মোটা মোটা কালো ভাল্লুক, তার পেছনে গোটা ছয় কোঁকড়ালোম ছোটা কুকুর, সবার শেষে রঙচঙে লাঠি হাতে আধখানা লাল আধখানা নীল পোশাক পরা সত্যিকার একটা সং।

নিমেষের মধ্যে জায়গাটা টুংটুং, কিচমিচ, ঘোঁৎ ঘোঁৎ, খেউ খেউ শব্দে একেবারে ভরপুর হয়ে উঠল। অবাক হয়ে সোনা-টিয়া উঠে দাঁড়িয়ে নদীর একেবারে কিনারায় এল। ঠিক সেই সময় চাপা গলায় কে বলল, স্স্-এই, পুটলি ফেলে গেলে পিঁপড়েতে খেয়ে ফেলবে। খাগড়াইগুলো খাসা। এই বলে একটা পরিষ্কার রুমাল বের করে লোকটা মুখ মুছে ফেলল।

 সোনা-টিয়ার গায়ে কাঁটা দিল। এই তবে মাকু! এ যে মাকু সে বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই। কেমন লম্বা সটাং চেহারা, গায়ের মাংসগুলো আঁটোসাঁটো, দেখেই বোঝা যাচ্ছে প্ল্যাস্টিক আর রবার দিয়ে তৈরি, মাথায় কোঁকড়া চুল, ছাই রঙের চোখ আর নাকের ডগায় এই মস্ত একটা কালো তিল। ঠিক ঘড়িওলা যেমন বলেছিল! নাঃ, একে আর ছাড়া নয়, কখন চাবি ফুরিয়ে যাবে তার ঠিক কী, শেষটা দুষ্টলোক হাত-পা কলকজা খুলে নিয়ে চলে যাবে, তখন ঘড়িওলা বেচারি আর মাকুর খেলা দেখিয়ে পয়সা করে, বড়োলোক হতে পারবে না।

টিয়া এসব কিছুই নজর করেনি, সে হাঁ করে জানোয়ারদের জল খাওয়া দেখছিল। নদীর কিনারা ধরে তারা সারি সারি মুখ নীচু করে অনেকক্ষণ জল খেল! কী সুন্দর একটা চকর-বকর গবর-গবর শব্দ হতে লাগল।

 তখন আলো কমে এসেছে, একটু বাদেই সূর্য ডুবে যাবে। জল খেয়ে মুখ তুলে সঙ তাদের দেখতে পেল। অমনি দুহাত দিয়ে মুখের চারদিকে চোঙা বানিয়ে ডেকে বলল, আমাদের অধিকারী মশাইকে দেখেছ? তোমরা কে?

মাকু কী একটা বলতে যাচ্ছিল, সোনা তার গা টিপে বলল, চুপ, কিছু বোলো না মাকু, চাবি ফুরুলেই তোমার হাত-পা খুলে নিয়ে যাবে! ধরা পড়ে দারুণ চমকে গিয়ে, কট করে মাকু মুখটা বন্ধ করে ফেলল। ভেতরে যে কজা দেওয়া সেটা বেশ বোঝা গেল।

সোনা নিজেই বলল, আমরা সোনা টিয়া, প্যাঁ-প্যাঁ পুতুল খুঁজতে এসেছি। ও আমাদের বন্ধু। তোমরা কে?

সং বলল, আমরা সার্কাসপার্টির আধখানা। অধিকারী মশাই মাঠের ভাড়া, তবুআর গ্যাসবাতির দাম না দিয়েই পালিয়ে গেছে, তাই আমরা তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। কত বড়ো প্যাঁ-প্যাঁ পুতুল চাও?

টিয়া দু-দিকে দু-হাত মেলে দিয়ে বলল, এই এত বড়ো। পিসির খোকার পুতুলের চেয়েও ঢের ঢের বড়ো।

সং বলল, তাহলে চলো আমার সঙ্গে। সোনা তো অবাক। তোমার কাছে আছে?

না, কিন্তু চেষ্টা করলে জোগাড় করতে পারি। আমাদের সার্কাসের জাদুকর কী না করতে পারে! খালি টুপির ভেতর থেকে পাতিহাঁস বের করে, চোখের সামনে ওই ছাগলটাকে হাওয়া করে দেয়, শূন্যে ফঁস দিয়ে পরিদের রানিকে নাবিয়ে এনে, একসঙ্গে জোড়া ঘোড়ায় চাপায়।

আড়চোখে একবার মাকুর দিকে তাকিয়ে সোনা বলল, চলো, আমরা তোমার সঙ্গে যাব। কিন্তু কী করে নদী পার হব, পাথর যে বড়ো পিছলা? তুমি এসে আমাদের পার করে দাওনা।

সং বলল, ও বাবা! সে আমি পারব না। তোমরা বেজায় ভারী।

সোনা বলল, না, না, আমরা একটা করে পা শূন্যে ঝুলিয়ে রাখব তাহলে আর ভারী লাগবেনা। পুঁটলি দুটো পরে নিয়ে যেয়ো।

সং কিন্তু কিছুতেই রাজি হল না। না, শেষটা, যদি আমার নতুন পেন্টেলুনের রং গলে বিতিকিচ্ছি হয়ে যায়। তার চেয়ে তোমাদের বন্ধুই তোমাদের পার করুক-না কেন? বেশ তো পুরুষ্টু আছে দেখতে পাচ্ছি।

 সোনা তাই শুনে ব্যস্ত হয়ে উঠল, না, না মাকু, জল লেগে যদি তোমার জোড়ার আঠা ধুয়ে যায়, তখন হাত-পা জলে ভেসে যাবে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।

মাকু একগাল হেসে বলল, কিছু ভয় নেই, হাত-পা আঠা দিয়ে জোড়া হবে কেন? সেরা কারিগরের হাতের কাজ; একসঙ্গে ছাঁচে ঢালাই করা। ওঠো আমার কোলে।

এই বলে মাকু টপ করে পুঁটলিসুদ্ধ দুজনকে দু-কোলে তুলে দিব্যি সুন্দর নদী পার হয়ে গেল। জন্তুরা এতক্ষণ যে-যার চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। এবার তারাও আগের মতো সারি বেঁধে বনের মধ্যে দিয়ে সরু পথ ধরে এগিয়ে চলল।

সবার পেছনে সং, তার পাশে সোনা-টিয়াকে কোলে করে মাকু। এই সময় টুপ করে সূর্যটা বোধ হয় ডুবে গেল, চারদিকে হঠাৎ ধাঁ করে অন্ধকার নেমে এল। সোনা-টিয়ার আর মাকুর কোল থেকে নামবার কথা মনে হল না। মাকু তো কলের মানুষ। তার মোটেই দুটো ধাড়ি ধাড়ি মেয়ে কোলে করলেও হাত ব্যথা করে না।

তবু কিন্তু মাকুর যেন একটু হাঁপ ধরে যাচ্ছে মনে হল, অমনি খচমচ করে সোনা টিয়া কোল থেকে নেমে পড়ল। এইখানে দম ফুরিয়ে গেলেই তো হয়ে গেল। কানখুশকিও আনা হয়নি যে আবার দম দিয়ে দেবে। তা ছাড়া অন্ধকারে চাবির ছাদাই-বা খুঁজে পাবে কী করে? তার ওপর একটু দূরেই আলো দেখা যাচ্ছিল। মাকু বলল, ও কী হল? নেমে পড়লে যে?

সোনা একবার টুক করে তার মুখটা দেখে নিয়ে বলল, কোলে উঠলে আমার পা কামড়ায়।

 টিয়া হঠাৎ ভ্যাঁ করে কেঁদে বলল, খাবার সময় হয়ে গেছে। সোনা এখন কী করে? পুটলির খাবার তো শেষ, ঝেড়ে দেখে খাগড়াগুলোর কিছু বাকি রাখেনি মাকু। টিয়ার চোখ মুছিয়ে চুমু খেয়ে সোনা বলল, না, না, কাঁদে না টিয়া। মাকু আমাদের জন্য খাবার এনে দেবে! দেবে না, মাকু?

মাকু বললে, সং, খাবার কোথায় পাওয়া যায়?

সং বললে, কেন, বটতলার সরাইখানায়। আমরা সবাই তো সেখানেই খাই। কিন্তু নগদ পয়সা দিয়ে খেতে হয়। সরাইওলা বাকিতে কিছু দেয় না, ওরনাকি বড্ড টাকার দরকার। তোমাদের পয়সা আছে তো খুকিরা?

সোনা বলল, আমার নাম সোনা, আমার দু-বছর, আর ওর নাম টিয়া, ওর পাঁচ বছর। আমার কাছে একটা পয়সা আছে; ও ছোটো, ও কোথায় পাবে?

সং তাই শুনে হো হো করে হাসতে লাগল। এক পয়সায় একটা কাঁচা লঙ্কাও দেয় যদি সরাইওলা, সেই যথেষ্ট! ব্যাটা টাকার জোঁক, কিন্তু রাঁধে খাসা!

টিয়া আবার বলল, খাবার সময় হয়ে গেছে। আমরা এখন খাই। সোনার গলার কাছটা আবার ব্যথা করতে লাগল। মাকু দু-জনার পিঠে দুটি হাত রেখে বলল, কোনো ভয় নেই। চলো, কী খাবার আছে দেখা যাক, আমি পয়সা দেব।

সোনা বললে, পয়সা কোথায় পেলে, মাকু? মাকু বললে, কেন, আমি করেছি, আমি অনেক পয়সা করি।

সোনা বলল, তুমি নাচ, গাও, সাইকেল চালাও, পরীক্ষার প্রশ্নের উত্তর দাও, আবার পয়সাও করতে পার?

 মাকু বললে, হুঁ, পয়সা করতে পারি, গোলমাল করতে পারি, হইচই করতে পারি। চলো, এবার বটতলায় সরাইখানায় গিয়ে কিঞ্চিৎ হইচই করা যাক।

সং যে কখন ওদের ফেলে হনহন করে এগিয়ে গেছে তা কেউ লক্ষ করেনি। মাকুও দু-জনার পুটলিসুদ্ধ হাত ধরে এবার আলোর দিকে এগিয়ে চলল। দূরে কোথাও হুতুমথুম হুতুমথুম করে প্যাঁচা ডাকতে লাগল, কিন্তু সোনা-টিয়ার একটুও ভয় করল না। এমনি করে একটু চলেই ওরা বটতলার সরাইখানায় পৌঁছে গেল।

০৩.

হোটেল বলে হোটেল! সে এক এলাহি ব্যাপার! গাছ থেকে খানকতক বড়ো বড়ো লণ্ঠন ঝুলছে; গাছের গোড়ায় তিনটি পাথর বসিয়ে প্রকাণ্ড উনুন হয়েছে, তার গনগনে আগুনের ওপর মস্ত পেতলের হাঁড়িতে টগবগ করে কী যেন ফুটছে, চারদিক তার সুগন্ধে মো-মো করছে। মাথার ওপর ডালপালার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো গলে আসে,শুকনো পাতা দিয়ে ঢাকা মাটিতে কোথাও ফুটফুট করছে, আবার কোথাও ঘন কালো ছোপ ছোপ ছায়া দেখা যাচ্ছে।

হোটলের ছিরি কত! বট গাছের নীচু নীচু ডালে রাজ্যের লোক সারি সারি পা ঝুলিয়ে বসে। এখান দিয়ে ওখান দিয়ে, মাঝখান দিয়ে রাশি রাশি ঝুরি নেমেছে, তাই মুখগুলো তাদের ভালো করে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু কাপড়-জামাগুলোকে কেমন যেন রং-বেরং অদ্ভুত মনে হচ্ছে। গাছের গুঁড়ির ওপর কাঁচা কাঠের তক্তা ফেলে খাওয়া-দাওয়া চলেছে। তার গন্ধে সোনা-টিয়ার জিবে জল এল।

হাতা হাতে হোটেলওলা, মুখভরা তার ঝুলো গোঁফ আর থুতনি ঢাকা ছাই রঙের দাড়ি, দেখে মনে হয় যেন ধোপার বাড়ি থেকে ফিরেছে। সোনা-টিয়ার বড়ো হাসি পেল। লোকটা কিন্তু বড়ো ভালো, ওদের দেখেই হাতা উঁচিয়ে ডাক দিল, এসো এসো, এইখানে বসে যাও, পেট ভরে খাবার খাও, নিজের হাতে বেঁধেছি।

সোনা-টিয়াকে গাছের ডালে তুলে দিতে হল, শূন্যে তাদের ঠ্যাং ঝুলতে লাগল, মাকুও ওদের পাশে জড়োসড়ো হয়ে বসল, তার প্রাণে যে বড়ো ভয়। টিয়া তার কানে কানে সাহস দিয়ে বলল, কোনো ভয় নেই, মাকু, দিদি সব ঠিক করে দেবে। তুমি আমার এই রুমালটা হাতে ধরে রাখতে পার। বড়ো বড়ো গোলাপ ফুলের নকশাকাটা ছোটো একটি রুমাল টিয়া পুটলি থেকে বের করে ওর হাতে গুঁজে দিল।

হোটেলওলা টিনের মগে জল এনে বলল, খাবার দিই? তার আগে হাত ধুয়ে ফেলো, কেমন?

মাকু হঠাৎ বললে, কী কী আছে?

হোটেলওলা চটে কাঁই! কী কী আছে আবার কী? রোজ রাতে যা থাকে তাই আছে, অর্থাৎ স্বর্গের সুরুয়া আর হাতের রুটি। একবার চেখে দেখলে অন্য কিছু খেতেও ইচ্ছে করবে না।

এই বলে তিনটে বড়ো কাঠের বাটিতে সুরুয়া আর শালপাতাতে এক তাড়া হাতরুটি নিয়ে এল।

সোনা বললে, আমাদের বেশি পয়সা নেই, আমাদের কম খেতে দিয়ো। টিয়া, কম করে খাস।

হোটেলওলা বলল, বালাই, ষাট! কম খেতে দোব কেন? পেট ভরে খাও, এত ভালো কেউ রাঁধতে পারে না, এ আমি নিজেই বলে দিলাম। নাও, ধরো, পয়সাকড়ি কিছু দিতে হবেনা, তোমরা বরং আমার হোটেলের কিছু কিছু কাজ করে দিয়ো, একা একা আর পেরে উঠি নে।

 টিয়া খুশি হয়ে গেল। আমরা পুতুলদের জন্যে কাদা দিয়ে ভাত বানাই। গাঁদা ফুলের পাতা দিয়ে দিদি মাছ রান্না করে।

হোটেলওলা হেসে বলল, তা খুব ভালো তো। কিন্তু এখানে তোমাদের রাঁধতে হবেনা, উনুনের নাগালই পাবে না, তোমরা খাবার জায়গা করবে, বাটি ধুয়ে দেবে, ঝটপাট দেবে, কেমন?

তারপর মাকুর দিকে ফিরে বলল, তুমিও কাজ করতে পারবে নাকি? টিয়া অমনি বলল, ও সব পারে, অঙ্ক কষতে পারে, সেলাই কল চালাতে পারে, পেরেক ঠুকতে পারে, ওর পেটে কল– উঃ! টিয়া ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল। মাকু ব্যস্ত হয়ে উঠল, কী হয়েছে টিয়া, ঘুম পেয়েছে?

সোনা বললে, না, না, টিয়া কাঁদে না, আয় তোকে চুমু খাই। ভুলে চিমটি কেটেছি রে। এই নে, খাবার খা।

টিয়া অমনি ফিক করে হেসে ফেলল। হোটেলওলা বলল, খাবে-দাবে, আমার গেছো-ঘরে শোবে, পয়সাকড়ি লাগবে না। গাছের ধারের ছোটো ঝরনায় চান করবে, কাপড় কাচবে, বাসন ধোবে, কেমন? আমিও বাঁচব, তোমরাও বাঁচবে। দিনে দিনে ব্যাবসা যেমন কেঁপে উঠছে, একা হাতে চলছে না।

এই বলে মুচকি হেসে হোটেলওলা ফতুয়ার পকেট চাপড়াল, অমনি ভেতর থেকে পয়সাকড়িও ঝনাৎঝনাৎ বেজে উঠল। সোনা-টিয়া ভয়ে ভয়ে দু-টুকরো হাতরুটি সুরুয়াতে ডুবিয়ে মুখে তুলল।

খাসা সুরুয়া, এত ভালো সুরুয়া সোনা-টিয়া জন্মে কখনো খায়নি। বাড়িতে যেদিন সুরুয়া হয় ওরা দু-জন মহা কাঁও-ম্যাও করে। এ অন্য জিনিস, মাকুও দু-হাতে বাটি তুলে লম্বা লম্বা টান দিতে লাগল। ওদের পাশেই কতকগুলো রোগা লোক চেটেপুটে সুরুয়া খেয়ে বলল, সাধে এর নাম হয়েছে স্বর্গের সুরুয়া! এমন সুরুয়া আর কেউ বানাক দেখি!আগের মালিক রাবিশ রাঁধত, সবাই রেগে যেত। হঠাৎ একদিন ভোল বদলে গেল, সবাই খুশি! অথচ মালিক এমনি চালাক যে কাউকে শেখাবে না। তার মানে সব শেখাবে, খালি শেষের পাটে লুকিয়ে লুকিয়ে কী যে মশলা ঢালে, সেটি কাউকে বলবে না।

আরেক জন হাতরুটি দিয়ে বাটির তলা মুছে, টুকরোটা মুখে ফেলে বলল, আজকাল কিন্তু এত ভালো রাঁধে যে নিজের হোটেলে নিজে খায়। আগে খেত না, বলত, ওসব খেয়ে যদি আমার ব্যামো হয়, তখন তোদের জন্য রাঁধবে কে শুনি?ওর জন্য তখন জাদুকর রোজ খিচুড়ি বানিয়ে দিত। এখন এখানেই খায়।

তাই শুনে হোটেলওলা হেসে বলল, তা আর খাব না? এত ভালো খাবার আর কোথায় পাব, সেইটে বল? তা ছাড়া, এ-রকম না করলে আমার পয়সা জমবে কী করে? জাদুকর কান মুচড়ে টাকা নিত না? এখন নিজের হোটেলে মিনিমাগনা থাকি খাই আর লাভের টাকা গুণে তুলি। টাকার যে আমার বড়ো দরকার!

তারপর ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে রোগা লোকেদের তাড়া দিতে লাগল, নে, নে, এবার ওঠ দিকি, শোবার আগে একবার খেল মকশো করতে হবেনা! শেষটা গায়ে এমনি গতর লেগে যাবে যে আর দড়াবাজির খেলা দেখাতে হবে না, এখন ওঠ দেখি সব।

অমনি ঝুপঝাপ করে যে-যার গাছের ডাল থেকে নেমে পড়ল। নিমেষের মধ্যে তক্তা তুলে গুঁড়ি হটিয়ে, তারা অনেকখানি ফাঁকা জায়গা করে নিল। সেখানে মগডাল অবধি উঁচু যেন সার্কাসের তাবুর ছাদ। সর সর সর করে জনা পাঁচেক ডালপালা বেয়ে উঠে পড়ল। ওপরে কোথায় যেন দড়িদড়া গোঁজা ছিল, দেখতে দেখতে টান করে দড়ি বাঁধা হয়ে গেল, তার দু-মাথা থেকে দুটো দোলনা ঝুলতে লাগল।

সোনা-টিয়া তো হাঁ, চোখ থেকে ঘুম কোথায় পালিয়ে গেল। মাকুকে খোঁচা দিয়ে বলল তারা, দ্যাখ, মাকু, দ্যাখ, মগডাল থেকে উলটো হয়ে ঝুলছে কেমন দ্যাখ রে! সত্যি সত্যি এক জনের হাত ধরে এক জন ঝুলে নিমেষের মধ্যে নীচের মাটিতে যারা ছিল তাদেরও টপটপ করে ওরা তুলে নিল। তারপর হোটেলওলা তাল দিতে লাগল আর দড়ির ওপর সে যে কত দৌড়, কত ঝাঁপ, কত ডিগবাজি, কত নাচ! চমকে গিয়ে জিব কামড়ে মাঝখানে টিয়া একটু কেঁদে নিল, তারপরে ওপর থেকে ঝুপঝাঁপ করে এক জনের পিঠে এক জন যেমনি নেমে পড়ল টিয়াও না হেসে পারল না।

খেলা শেষ হলে হোটেলওলা ওদের পাশে পা ঝুলিয়ে বসে পড়ে বলল, মকশো না করলে কি চলে? ওরা সার্কাসের লোক, বিদ্যে ভুলে গেলে খাবে কী? খুঁচিয়ে তাই অভ্যাস করাই। এবার চলো, গেছো-ঘরে শোবে চলো, চোখ তোমাদের জড়িয়ে আসছে।

ছোটো একটি হাইতুলে সোনা বলল, বাসন পোবনা? আমার তোমার চাকর-না? হোটেলওলা সোনাকে টপ করে কোলে তুলে বলল, তোমাদের যে এক বেলার চাকরি। দু-বেলা চাকর রাখার সংগতি কোথায় আমার? তারপর মাকুকে বলল, নাও, টিয়াকে নিয়ে চলো।

গাছের গায়ে সিঁড়ির মতো খাঁজ কাটা; আট-দশটা ধাপ উঠতেই ডালপালার মধ্যে কাঠের তক্তা দিয়ে কী সুন্দর ঘর। বাতাস বইলে দোলনার মতো দোলে; শুকনো পাতার ওপর নীল চাদর বিছানো; পুঁটলি মাথায় দিয়ে শোবামাত্র সোনা-টিয়ার ঘুমে চোখ বুজে এল। কিন্তু ঘুমের মধ্যে মাকু যদি পালায়; অন্ধকারে ঘোর জঙ্গলে, হঠাৎ চাবি ফুরিয়ে এলিয়ে পড়লে, শেয়ালে কিংবা খরগোশে যদি মাকুকে টেনে নিয়ে যায়? যেন মনে হল মাকু ঘুমিয়েছে, পুটলির মুখের বড়ো সেফটিপিন দিয়ে নিজের ফ্রকের সঙ্গে সোনা মাকুর জামার কোণটি এঁটে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। মাকুর রাতে পালানো বন্ধ হল।

দখিন হাওয়ার দোল খেয়ে খেয়ে সারারাত সোনা টিয়া ঘুম দিল, জাগল যখন সকাল বেলায় পাখির গানে কান ঝালাপালা হল আর ডালপালার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো চোখে এসে লাগল।

চোখ খুলেই সোনা দেখে সর্বনাশ হয়ে গেছে, সেপটিপিন দিয়ে ফ্রকের সঙ্গে আঁটা মাকুর জামাটা পড়ে আছে, কিন্তু মাকু নেই! মাকু, মাকু করে কেঁদে ফেলল সোনা। তাই শুনে মাকু, মামণি, বাপি, আর আম্মার জন্যে টিয়াও মহা কান্না জুড়ে দিল। কান্না শুনে গাছ বেয়ে মাকু, হোটেলওলা, সং আর সাতজন দড়াবাজির ওস্তাদ ওপরে উঠে এল। সং বলল, ধ্যেৎ, তোদের মতো বোকা তো আর দেখিনি। চাকরটা কি হাতমুখও ধোবেনা, খাবেদাবেও না নাকি? এক্ষুনি জাদুকরের জাদু হবে আর তোরা চাঁ ভ্যাঁ করছিস! এরা কী রে!

অমনি সোনা টিয়া লাফিয়ে উঠল, কোথায় জাদুকর, কখন খেলা হবে? মাকু বলল, তোমরা হাত-মুখ ধুয়ে, দুধরুটি খেয়ে উঠলে তারপর!

টিয়া বলল, আকাশ থেকে পরিদের রানিকে নামাবে?

সোনা বলল, চুপ, বোকা!

মাকু একটু যেন ঘাবড়ে গেল। বলল, আচ্ছা, চল তো নীচে।

সোনা মাকুর পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, না মাকু, না, পরিদের রানি ভালো না, আমরা দেখতে চাই না।

সং বলল, ওমা! চাই না আবার কী! একবার দেখলে মুভুটি ঘুরে যাবে, চল-না একবার। একবার একটি কলের মানুষ–

সোনা-টিয়া দু-জনে এইখানে দু-হাত দিয়ে সঙের কথা বন্ধ করে দিল। সং তো এমনি অবাক হল যে তার গাল থেকে দুটো বড়ো বড়ো আঁচিল খুলে পড়ে গেল। সেগুলোকে তুলে নিয়ে সঙ আবার যার যেখানে টিপে বসিয়ে দিল।

চাকরির কথা ভুলে গিয়ে সোনা-টিয়া খেতে বসে গেল, মাকু তাদের ডালের ওপর তুলে দিয়ে, কাজে লেগে গেল। সোনা-টিয়াকে ফিসফিস করে বলল, লোকের সামনে ওকে মাকু বলে ডাকিস নে, তাহলে ধরে নেবে।

আর সবাই কখন খেয়ে যে-যার নিজের কাজে চলে গেছে, বটতলার হোটেল খাঁ খাঁ করছে। মাকুকে হোটেলওলা বললে, ওরা খেতে বসুক, তুমি তিন জনের হয়ে খেটে দাও, কেমন? কী যেন নাম তোমার? তারপর সবাই মিলে জাদুকরের খেলা দেখা যাবে।

সোনা এক বার টিয়ার দিকে, এক বার মাকুর দিকে চেয়ে বলল, ওর নাম বেহারি। ও জাদুর খেলা দেখতে চায় না, টিয়া আর আমি দেখব, ও ঝরনায় বাসন ধোবে।

কিন্তু মাকু কিছুতেই রাজি হয় না, বলে, আমিও টপ করে কাজ সেরে নিয়ে জাদু দেখব। বেহারি বললে কেন?

টিয়া বলল, ছি, তাড়াতাড়ি করে বাসন ধোয় না, তাহলে ভেঙে যায়। বেহারি আমাদের বাড়িতে বাসন ধোয়।

মাকু বলল, কাঠের বাসন আবার ভাঙে নাকি? আমি খেলা দেখব, আকাশ থেকে পরিদের রানি নামানো দেখব। অমনি সোনা-টিয়ার সে কী কান্না। না, না, না, ও জাদু দেখবেনা। ও হোটেলওলা, ওকে যেতে বলল।

হোটেলওলা মহা ফাঁপরে পড়ে গেল। দ্যাখো, বাপু, বনের মধ্যে বাঁশতলায় আমি খরগোশ ধরবার ফাঁদ পেতেছি, সেখানে গিয়ে তুমি বরং খরগোশ পড়ল কিনা দেখে এসো। বুড়ো হাবড়া, নাই-বা দেখলে জাদুর খেলা!

অমনি সোনা জানতে চাইল খরগোশ ধরা কেন, কী হবে খরগোশ দিয়ে?

শুনে সঙের কী হাসি! কী আবার হয় খরগোশ দিয়ে? কালিয়া হবে। মালিকের রান্না খরগোশের কালিয়া একবার খেয়ে দেখো!

সোনা-টিয়ার দম বন্ধ হয়ে এল। চাপা গলায় টিয়া বললে, কীরকম খরগোশ! সাদা? লাল চোখ? বলেই দু-জনে দু-হাতে চোখ চেপে ধরে হাপুসনয়নে কাঁদতে বসে গেল। সং বললে, ভ্যালা রে দামোদর নদী! আরে না, না, সব খরগোশ কি আর সাদা হয়? কী বলো মালিক?

হোটেলওলা মাকুকে বললে, দ্যাখো, বেহারি, সাদা খরগোশ পেলে দু-টি এনো, এরা পুষবে; বাকি ছেড়ে দিয়ো। আর কালো কুচ্ছিত দুষ্টু খরগোশ পেলে আমাকে দিয়ো, কালিয়া রাঁধব। আহা, দুষ্টু কালো খরগোশের কালিয়া যে না খেয়েছে তার জন্মই বৃথা!

মাকু ওদের কানে কানে বলল, কোনো ভয় নেই, সাদা খরগোশ আমি সব ছেড়ে দেব। টিয়া বললে, সব ছাড়বে না মোটেই, দিদি আর আমি দুটোকে পুষব। আমারটার নাম গঙ্গা, দিদিরটার নাম যমুনা। সোনা বললে, দুৎ, আমারটার নাম গঙ্গা, তোরটার নাম যমুনা। এই বলে দিল টিয়ার কান ধরে এক টান! টিয়া কাদবে বলে হাঁ করেছে, ঠিক সেই সময় হট্টগোল করতে করতে ঝুড়ি-ঝোড়া দলবলসুদ্ধ জাদুকর এসে উপস্থিত। মাথায় লম্বা চোঙার মতো টুপি, গায়ে, চকরা-বকরা মাটি অবধি ঝোলা জামা, তার ঢলঢলে হাতা। সোনার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।

–ও টিয়া, ও টিয়া, জামার হাত থেকে কেমন বড়ো বড়ো রাজহাঁস বেরোয় দেখেছিলাম, মনে নেই? তারপর মাকুর দিকে ফিরে বলতে যাবে, রাজহাঁস বেরুনো দেখে যাও, মাকু, কিন্তু মাকু ততক্ষণে চলে গেছে।

জাদুকর গোছগাছ করছে, দু-চারজন দর্শকও এসে জুটেছে, এদিকে হোটেলওলা হন্তদন্ত হয়ে গাছের গোড়ায় কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে। সোনা জিজ্ঞেস করল, কী খুঁজছে বলোনা? টিয়া একবার বাপির গাড়ির চাবি খুঁজে দিয়েছিল। টিয়া খুশি হয়ে গেল। সেই যে আম্মার মশলার কৌটো খুঁজে দিয়েছিলাম মোড়ার তলা থেকে! অমনি আম্মার কথা মনে পড়াতে দু-জনার গলা টনটন করে উঠেছে। তাদের চোখে জল দেখে, হোটেলওলা বললে, ছি, কাঁদে না, আজ যে আমার জন্মদিন, আজ রাতে ভোজ হবে, ঘাসজমিতে সার্কাস হবে, তাই এরা এত মওড়া দিচ্ছে, তাও জান না?

শুনে সোনা টিয়া মহা খুশি। তার দাড়িতে চুমু খেয়ে ওরা বললে, তা হলে কী দেব তোমার জন্মদিনে?

টিয়া পুঁটলি খুলে একটা ছোটো কচি বের করে বলল, এইটা নাও, তোমার জন্মদিনে, মেহের সোনা–টিয়া।

সোনার চোখ গোল হয়ে গেল। ওমা, টিয়া কী দুষ্টু মেয়ে, এইটা-না মামণির নখ কাটার কাচি, মামণি যদি রাগ করে?

–ছি, টিয়া, মামণির কঁচি নেয় না। হোটেলওলাও ব্যস্ত হয়ে উঠল, না, না, কঁচি দিয়ে আমি কী করব?নখফক আমি আদপেই কাটি না। তার চেয়ে বরং আমার হারানো জিনিসটা খুঁজে দিয়ে কেমন? সেটা না পেলে আমার সর্বনাশ হয়ে যাবে।

ওরা ওকে ঘেঁকে ধরল, কী হারানো জিনিস বলল মালিক! হোটেলওলা বললে, এখন নয়, জাদু খেলার পর, দুপুরের রান্না চাপাব, তোমরা আলু সেদ্ধর খোসা ছাড়িয়ে দেবে, তখন বলব। এখন খেলা দেখো, নইলে ওরা মকশো করবেনা, তাহলে সব ভুলে যাবে, সার্কাশে খেলা দেখাতে পারবে না, খেতে পাবে না ওরা তখন। সবাই শুকিয়ে মরে যাবে। এই বলে দাড়ি দিয়ে মালিক একবার চোখ মুছে নিল।

সোনা বলল, সার্কাসের লোক তো বনের মধ্যে কেন? হোটেলওলা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, বলেনি বুঝি সং? নতুন তাবু কিনে, বড়ো ঝাড়বাতি কিনে, সকলের নতুন পোশর বানিয়ে চারদিকে নতুন খেলার বিজ্ঞাপন দিয়ে, খেলা শুরু হবার আগেই কোনো জিনিসের দাম না দিয়ে, কাউকে কিছু না বলে, ওদের অধিকারীমশাই যে পালিয়েছে! দোকানদাররা থানায় খবর দিয়েছে, জিনিসপত্র সব টেনে নিয়ে আটক করেছে, অধিকারীমশাই নিখোঁজ, তাই এদের নামেই পরোয়ানা বের করেছে, দেখা পেলেই ধরে নিয়ে ফাটকে দেবে। তাই এই জঙ্গলের মধ্যে ওরা গা-ঢাকা দিয়ে আছে। আমি খাওয়াই-দাওয়াই যেটুকু পারি মওড়া দেওয়াই, দুঃখী লোকদের সাহায্য করতে হয়।

আরও কী বলতে যাচ্ছিল হোটেলওলা! কিন্তু তখুনি পোঁও-ও করে জাদুকরের সাকরেদ বাঁশিতে টান দিল। আর সঙ্গেসঙ্গে মাটির ওপর জড়োকরা মোটা দড়িগাছা কিলবিল করে জ্যান্ত হয়ে উঠল।

জাদুকর তখন শূন্যে হাত ছুঁড়ে সুর করে বলল, তোমরা সবাই চুপ!

লাগ ভেল্কি লাগ
আকাশ পানে তাগ!
তাড় হাঁকড়া
পাখি পাকড়া
লাইম্মা পড়িস ঝুপ।

সঙ্গেসঙ্গে সাঁ করে দড়ির একটা মাথায় ঢিলে ফঁসের মতো লেগে সবসুদ্ধ মগডাল অবধি উঠেই আবার সোঁ করে নেমে এল। সোনা-টিয়া অবাক হয়ে দেখল, কোত্থেকে কখন একটা কালো টাট্ট ঘোড়া এসে দাঁড়িয়েছে কেউ দেখেনি, তারই পিঠে ঝুপ করে যখন দড়িগাছা নামল, টাটু ঘোড়ার সোনালি জিনের ওপর দাঁড়িয়ে স্বয়ং পরিদের রানি!

০৪.

সোনা-টিয়া হাঁ করে চেয়ে রইল। পরিদের রানির গোলাপি মুখে কী সুন্দর কালো কালো চোখ, মাথায় সোনালি চুল, পরনে রুপোলি পোশাক, কোমরে জাদুকরের দড়ি জড়ানো। যেই ঘোড়া মাথা নেড়েছে আর ঘণ্টার মালা ঝুমুর ঝুমুর বেজে উঠেছে, অমনি এক ঝাঁকি দিয়ে দড়ির ফঁস ঝেড়ে ফেলে পরিদের রানি দুই ঘোড়ায় পা রেখে নেচে উঠেছে। সে কী নাচ! নাচ দেখে গাছের উপর থেকে টুপটাপ করে রাশি রাশি ফুল ঝরে পড়তে লাগল আর জাদুকর সঙ্গে সঙ্গে লম্বা একটা চোঙার মতো বাঁশি বাজাতে লাগল। তারপর কখন এক সময় বাঁশি থামিয়ে জাদুকর আবার দড়ির ফাস তুলে নিয়ে ছুঁড়ে মারল। দড়ি গিয়ে পরিদের রানিকে জড়িয়ে ধরে, পাক খেতে খেতে তাকে সুদ্ধ আবার গাছের মগডাল অবধি উঠে গেল।

আর কিছু দেখা গেল না, শুধু এক রাশি লাল ফুলের সঙ্গে দড়িগাছা ছপাৎ করে আবার এসে মাটিতে পড়ল।

হোটেলওলা সোনা-টিয়ার কানে কানে বলল, এমন খেলা কেউ কখনো দেখেছে? আমাদের জাদুকর হল গিয়ে জাদুকরদের রাজা। চলো এবার রাঁধাবাড়ার কাজে লাগা যাক। এ-বেলায় মাছের স্টু-ভাত আর রাতের সুরুয়া এখনই তৈরি করে রাখতে হবে যে! মনে নেই আজ রাত্রে আমার জন্মদিনের ভোজে সকলের নেমন্তন্ন। ভুনিখিচুড়ি, হরিণের মাংসের কোর্মা আর পায়েস। সেইসঙ্গে সুরুয়া না দিলে ওরা আমাকে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে। উটি আবার লুকিয়ে করতে হয়, নিয়মটি কাউকে জানাবার মতো নয়।

বটতলার পেছন দিকে রান্না হয়, তারই পাশ দিয়ে সেই ছোটো নদীটি বয়ে চলেছে। তিনটে করে বড়ো বড়ো পাথর দিয়ে উনুন হয়েছে, তাতে কাঠের জ্বালে বিরাট বিরাট পেতলের হাঁড়া চাপানো হয়। সোনা-টিয়া সুরুয়া খাবার কাঠের বাটিগুলো নদীর জলে ভালো করে ধুয়ে সারি সারি উপুড় করে একটা চ্যাপটা পাথরের উপর সাজিয়ে রাখল। তারপর হোটেলওলার স্টুয়ের জন্য ছোট্ট ছোট্ট বুনো মটরশুটি ছাড়িয়ে দিল।

হোটেলওলা বলল, এগুলো এমনি হয়, কিনতে হয় না। আগে এখানে লোকের বসতি ছিল কি না, তখন তারা মটরের বিচি পুঁতেছিল, এখন ঝাড় বেঁধে আপনি হয়। গাছতলায় মিষ্টি শাঁকালু হয়, পালং শাক হয়, টমেটো হয়; ডুমুর গাছে ডুমুর হয়, শজনে গাছে শজনে হয়। বাকি জিনিস গ্রামের হাট থেকে কিনে আনতে হয়।

সোনা বললে, কে কিনে আনে?

হোটেলওলা বললে, কেন, সং তো হপ্তায় তিন বার গাঁয়ের পোস্টাপিসে যায়, সে-ই কতক আনে। আর কতক আমার ভাই লুকিয়ে দিয়ে যায়।

 –কেন সং হপ্তায় তিন বার পোস্টাপিসে যায়?

–ওমা, সে যে লটারির টিকিট কিনেছে, যদি একবার জিতে যায় তো একসঙ্গে অনেক টাকা পেয়ে বড়োলোক হয়ে যাবে। তাই খবর আনতে যায়। খুব সাবধানে যেতে হয়, কারণ ওরা যে। এখানে লুকিয়ে আছে থানার দারোগা একবার জানতে পারলে, সবসুদ্ধ পায়ে বেড়ি দিয়ে টেনে গারদে পুরবে।

এই বলে মাথায় হাত দিয়ে হোটেলওলা চুপ করে বসে রইল।

সোনা বলল, বলো হোটেলওলা, তোমার ভাই কেন লুকিয়ে-চুরিয়ে বনের মধ্যে আসে?

–তার বড়ো ভয়।

-কীসের ভয়?

–সকলের যে ভয় সেই ভয়, অর্থাৎ ধরা পড়ার ভয়। আর বেশি জিজ্ঞাসা কোরো না সোনা টিয়া, ছোটো মেয়েদের খুব বেশি জানতে চাওয়াটা মোটেই ভালো নয়।

এই বলে লাফিয়ে উঠে হোটেলওলা উনুনে-চাপানো সুরুয়ার হাঁড়ির ঢাকনি খুলে এই বড়ো একটা কাঠের হাতা দিয়ে নাড়তে লেগে গেল আর অমনি তার মুখ থেকে দাড়ি গোঁফজোড়া খুলে টপ করে হাঁড়িতে পড়ে সুরুয়ার সঙ্গে টগবগ করে ফুটতে লাগল। সোনা-টিয়া হাঁ হাঁ করে ছুটে এল, কিন্তু হোটেলওলা এক হাতে ওদের ঠেলে ধরে, অন্য হাতে সুরুয়া ঘুটতে লাগল। তার চাচা ছোলা ন্যাড়া মুখটাতে মুচকি হাসি দেখে সোনা-টিয়া অবাক!

উনুন থেকে লম্বা লম্বা জ্বলন্ত কাঠগুলোকে টেনে বের করে ফেলে, তাতে বালতি বালতি জল ঢেলে আগুন নিবিয়ে, কোমরের গামছা দিয়ে হাত-মুখ মুছে ফেলে, হোটেলওলা কাঠের হাতা দিয়ে সুরুয়া থেকে দাড়িগোঁফ তুলে, বালতির জলে ধুয়ে অমনি গাছের ডালে শুকুতে দিল। আর ট্যাক থেকে আরেক জোড়া দাড়িগোঁফ বের করে নিল। তারপর সোনা-টিয়ার দিকে ফিরে ফিক করে হেসে বলল, আগে কেউ আমার সুরুয়া মুখে দিলেই ওয়াক থুঃ বলে ফেলে দিত আর রোজ পয়সা ফেরত চাইত। তারপর একদিন দাড়িগোঁফ আচমকা সুরুয়ার মধ্যে পড়ে গিয়ে ওর সঙ্গে রান্না হয়ে গেল। আমি ভয়ে মরি, এবার ওরা আমার পিঠে চ্যালাকাঠ না ভেঙে ছাড়বে না! কিন্তু কী আর বলব, সেদিন সুরুয়া খেয়ে সবার মুখে সুখ্যাতি আর ধরে না, জাদুকর ওর নামই দিয়ে দিল স্বর্গের সুরুয়া– তোমরা যেন আবার দাড়িগোঁফের কথা কাউকে বোলো না, তাহলে আমাকে আর কেউ দেখতে পাবে না।

সোনা-টিয়া বলল, কেন, হোটেলওলা, দেখতে পাব না কেন?

–সে অনেক কথা, বললেও তোমরা বিশ্বাস করবে না। এখানে সবাই জানে আমি বটতলার হোটেলওলা, পয়সার কুমির। কিন্তু আসলে আমি যে কে, কেন টাকা জমাই তা কেউ জানে না। আমি গোঁফ দিয়ে মুখ ঢেকে লুকিয়ে থাকি সাধে? আমাকে চিনলে ওরা আমায় আস্ত রাখবে না! দাড়িটাকে কত ভয়ে ভয়ে শুকুতে দিতে হয়, তাও কেউ জানে না! ভাগ্যিস এই সময় ঘাসজমিতে জানোয়ারদের খেলা দেখতে সবাই যায়, নইলে আমাকে দেখতে পেতে না। এমনিতেই একটু পায়ের শব্দ শুনতে পেলেই আঁতকে উঠি!

ঘাসজমিতে জানোয়ারদের খেলার কথা শুনে সোনা-টিয়া কি আর সেখানে থাকে? শেষপর্যন্ত হোটেলওলাই ভিজে দাড়িগোঁফটি পকেটে পুরে ওদের কিছুটা পথ এগিয়ে দিল। এমন সময় দেখা গেল ভারী একটা হাঁড়িপানা মুখ করে মাকু আসছে। তারই কাছে সোনা-টিয়াকে ভিড়িয়ে দিয়ে হোটেলওলা রান্না শেষ, করতে ফিরে গেল।

–কই, আমাদের দুটো খরগোশ কই, মাকু?

-বাঁশঝাড়ে খরগোশ-টরগোশ দেখলাম না।

–তোমার চাবি ফুরিয়ে যাচ্ছে নাকি মাকু? হাঁড়িমুখ করেছ কেন?

 মাকু তো অবাক, সে কী, চাবি আবার ফুরুবে কী?

সোনা-টিয়ার কানে কানে বলল, দূর বোকা, চাবির কথা ও জানবে কী করে? ও ভাবেও সত্যি মানুষ!

মাকু ঘাড় ফিরিয়ে বলল, ছিঃ! কানে কানে কথা বলতে হয় না! অন্য লোকেরা তাহলে মনে দুঃখ পায়।

দুজনায় মাকুকে জড়িয়ে ধরে বলল, না মাকু না, তোমাকে আমরা খুব ভালোবাসি। ঘাসজমি কত দূরে?

-এই যে এসে পড়লাম, শব্দ শুনতে পাচ্ছ না?

সত্যিই কানে এল ঝমঝম ট্যাম-ট্যাম ভ্যাঁ-পু-পু-পু ভো। আনন্দের চোটে ওদেরও পাগুলো নেচে উঠল। তারপর গাছপালা পাতলা হয়ে এল, মস্ত ফঁকা সবুজ ঘাসজমি দেখা গেল।

তাই বলে সত্যি সবটা ফাঁকা নয় মোটেই। খানিকটা খোলা জায়গা ঘিরে গোল হয়ে ভিড় করে রয়েছে একদল মানুষ। এদেরই অনেককে কাল রাতে সোনা-টিয়া বটতলার হোটেলে খেতে দেখেছিল। সোনা-টিয়াদের দেখে সবাই হই হই করে উঠল, আজ রাতে-না মালিকের জন্মদিনের ভোজ? হোটেলের চাকররা তাহলে কেন সকাল বেলায় গায়ে ফুঁ দিয়ে বেড়াচ্ছে? কাজকর্ম নেই নাকি?

সোনা বলল, গায়ে ফুঁ দিইনি মোটেই।

টিয়া বলল, আমরা ছোটো, আমরা কি কাজ করতে পারি?

মাকু বলল, তা ছাড়া আমরা তো জানোয়ারদের খেলা দেখতে এসেছি।

যেই-না বলা অমনি ঢ্যামকুড়কুড় করে বাজনা বেজে উঠল আর ঘাসজমির এক পাশের চাটাইয়ের ঘরের দরজা খুলে দশটা কোঁকড়া চুল কুকুর পেছনের দু-পায়ে দাঁড়িয়ে, সামনের দু-পা দিয়ে লাল ফিতে বাঁধা করতাল বাজাতে বাজাতে বেরিয়ে এল। ট্যামকুড়-কুড় ট্যামকুড়-কুড় ট্যামকুড় কুড় ভ্যাঁপুভ্যাঁপুভ্যাঁপু– ভেঁপর ভেঁপর ভো! ব্যস, কুকুরেরা এক লাফ দিয়ে উঠে এক পায়ে পাঁই পাঁই করে ঘুরতে লাগল। আর অমনি টগর বগর টগর বগর করে চারটে বাঁদর টুপি মাথায় দিয়ে চারটে ঘোড়া হাঁকিয়ে উপস্থিত! সং এসে মাঝখানে দাঁড়িয়ে কতরকম খেলা দেখাল তার ঠিক নেই।

দেখতে দেখতে বেলা বাড়তে লাগল, খেলা যখন শেষ হল সূর্যটা প্রায় মাথার ওপর। আর দেরি করা নয়, ভিড় ঠেলে তিন জনে বটতলার দিকে পাঁই পাঁই ছুট। একা একা রাজ্যের কাজ নিয়ে হোটেলওলা না-জানি কত কষ্টই পাচ্ছে। মাঝপথে আবার এক কাণ্ড। ওরা দেখে একটা খাকি কোট-পেন্টেলুন পরা লোক, থলে কাঁধে, কোমরে লণ্ঠন বাঁধা, হাতে একটা লম্বা খাম নিয়ে ঝোপেঝাড়ে কাকে যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে। দেখেই তো সোনা-টিয়ার হয়ে গেছে, এবার আর মাকুর রক্ষা নেই, ওকে ধরে নিয়ে যেতেই যে লোকটা এসেছে সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। আবার দারোগার কাছ থেকে চিঠি এনেছে ভালো করে খুঁজবে বলে লণ্ঠন এনেছে, থলিতে ভরে নিশ্চয় বেঁধে নিয়ে যাবে! ঘড়িওলাই হয়তো ওকে জেলে পুরতে চায়!

আর কি সেখানে থাকা যায়? মাকুর দু-হাত ধরে টানতে টানতে সোনা-টিয়া মস্ত একটা ঝোঁপের আড়ালে গিয়ে লুকোল। ইদিক-উদিক তাকাতে তাকাতে বনের মধ্যে ঢুকে পড়লে পর, ওরা বেরিয়ে এক দৌড়ে একেবারে বটতলা। হোটেলওলা কার সঙ্গে যেন কথা বলছে। তার মাথা থেকে পা অবধি কালো কাপড়ে ঢাকা, দূর থেকে ওদের পায়ের শব্দ শুনেই লোকটি সুড়ুৎ করে বনের মধ্যে গা ঢাকা দিল।

–কে ওই লোকটা? ও হোটেলওলা, ও কেন এসেছে?

হোটেলওলা বলল, কে আবার লোক? লোক কোথায় দেখলে আবার? সেই তখন থেকে একলা একলা খেটে মরছি, গয়লা এক মন দুধ দিয়ে গেছে, সং পাঁচ সের বাতাসা কিনে এনেছে, রাতে ভুনিখিচুড়ি হবে, তার জন্য সুগন্ধি চাল, পেস্তা, বাদাম, কিশমিশ এনেছে, শিকারিরা হরিণের মাংস দিয়ে যাবে বলে গেছে, তাল তাল মশলা পড়ে আছে, কিন্তু কাজ করার মানুষরা সব তামাশা দেখতে গেছে।

এই বলে হোটেলওলা গাল ফুলিয়ে ঢোল বানিয়ে পাথরটার ওপর বসে পড়ল। মাকু আর কোনো কথা না বলে উনুনে দুটো চ্যালা কাঠ গুঁজে দিয়ে বিরাট দুধের কড়াইটা চাপিয়ে দিল। ওর গায়ের জোর দেখে সোনা-টিয়া অবাক। হোটেলওলা, ও মানুষ, তোমার গায়ে তো দেখছি পাঁচটা মোষের শক্তি, তা কাজে এত গাফিলতি কেন?

টিয়া বলল, ও যে কলের মা–। সোনা ওর মুখ টিপে ধরে বলল, চুপ, বোকা! মাকু আর হোটেলওলা অবাক হয়ে দু-জনার দিকে চেয়ে রইল। হঠাৎ টিয়া ভ্যা করে কেঁদে ফেলল। মাকুর চাবি ফুরিয়ে গেলে মাকু মরে যাবে। আমাদের ভাত খাবার সময় হয়ে গেছে, আঁ আঁ আঁ!

হোটেলওলা আর মাকু দু-জনে ছুটে এসে ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে, বাতাসা খাইয়ে টিয়ার কান্না থামিয়ে ওদের স্নানের জোগাড় করতে চলে গেল। গাছ-ঘর থেকে সাবান এল, গামছা এল, রান্নার তেল থেকে তেল ঢেলে গায়ে মাখা হল। তারপর হোটেলওলা পায়েস রাঁধতে বসল। ছোটো নদীর জলে ওরা স্নান করল, মাকু গামছা দিয়ে গা মুছিয়ে দিল। পুঁটলি থেকে পাউডার বের করে ওরা মুখে সাদা করে মেখে নিল, আম্মার ভাঙা চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ে, মাকুকে বলল, ভাত দাও।

অমনি হোটেলওলা আর মাকু গাছের গুঁড়ি সোজা করে, তার ওপর তক্তা পেতে টেবিল বানিয়ে ফেলল। কানা-তোলা কাঠের থালায় সোনা-টিয়াকে স্টু-ভাত এনে দিল।

চারিদিকে পায়েসের গন্ধে মো-মো করছে, আর দলে দলে সার্কাসের লোকেরা খাবার জন্যে হন্তদন্ত হয়ে এসে হাজির। হোটেলওলা পায়েসের কড়াইয়ের ওপর বারকোশ চাপা দিয়ে বলল, এ বেলা খালি স্টু-ভাত, কই, পয়সা দেখি। পায়েস আর ভুনিখিচুড়ি মাংস ওবেলা পাবে, মাগনা– বিনি পয়সায়।

 চারিদিকে খালি চাকুমচুকুম, তারি মধ্যে উঠি-পড়ি করে সং এসে হাজির। তার চুল সব খাড়া, চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে, ফোঁসফোঁস নিশ্বাস পড়ছে, জামাকাপড়ে ধুলোবালি শুকনো পাতা। ধপাস করে একটা গাছের গুঁড়িতে বসে পড়ে সে বললে, সর্বনাশ হয়েছে, সব বোধ হয় জানাজানি হয়ে গেল। বনে পেয়াদা সেঁদিয়েছে!

সঙ্গেসঙ্গে যে-যার থালা-বাটি নিয়ে দুড়দাড় করে কোথায় যে গা ঢাকা দিল কে বলবে। নিমেষের মধ্যে বটতলা ভো-ভা, ভিড়ের সঙ্গে মাকুও হাওয়া! জিনিসপত্র যেখানকার যেমন পড়ে রইল, হোটেলওলা সোনা-টিয়াকে নিয়ে তরতর করে গাছ-ঘরে গুম হল।

০৫.

গেছো-ঘরে শুধু চুপচাপ বসে থাকা, নিশ্বাস বন্ধ করে, কান দুটোকে খাড়া করে। কিছু দেখা যায় না, গাছের পাতার ঘন ঝালর গেছো-ঘরকে আড়াল করে নিরাপদে রাখে। সোনা-টিয়াও কিছু দেখতে পায় না। খালি মনে হয় নীচে কেউ পট পট মট মট করে হেঁটে বেড়াচ্ছে, ছোঁক ছোঁক করে শুকছে। খিদেয় ওদের পেট চোঁ চোঁ করে।

একটু পরে লক্ষ করে গেছো-ঘরের দেয়াল ঘেঁষে এক পাশে কালো চাদর মুড়ি দিয়ে কে শুয়ে আছে, ভয়ে সোনা-টিয়ার হাত-পা ঠান্ডা হয়! এই সেই কালিয়ার বনের ভয়ংকর নয় তো, যার গা থেকে বন্দুকের গুলি ঠিকরে পড়ে যায়? হোটেলওলার দু-হাঁটুতে মুখ গুঁজে দু-জনে কাঠ হয়ে পড়ে থাকে। হোটেলওলা ওদের পিঠে হাত বুলিয়ে অভয় দেয়।

গেছো-ঘরের কেঠো মেঝের ফুটোতে চোখ লাগিয়ে হোটেলওলা দেখে কেউ কোথাও নেই, সব নিরাপদ। কালো মানুষটাকে ঠেলা দিয়ে বলে, পেছন পেছন রাজ্যের বিপদ টেনে নিয়ে আসিস কেন?

কালো-কাপড় রেগে যায়, চাদর ফেলে উঠে বসে বলে, তা আসব না? আমি না এলে রোজ রোজ কে তোমার গোঁফ-দাড়ি সরবরাহ করবে শুনি?

টিয়া বললে, কেন, সং করবে। ও তো রোজ পোস্টাপিসে যায়!

লোকটি চটে গেল। রেখে দাও তোমাদের ন্যাকা সঙের কথা। কবে এক টাকা দিয়ে লটারির টিকিট কিনে বসে আছে, তাই দিয়ে নাকি সে বড়লোক হবে! এদিকে গুণের তার অন্ত নেই। যেই পোস্টমাস্টার ছোটো জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলে, কই, না তো, খবরের কাগজে লটারির কথা লেখেনি তো! অমনি ডুকরে কেঁদে পিটটান দেয়! ও কী দাদা, হল কী?

হোটেলওলা হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে গেছো-ঘরে খোঁজাখুঁজি লাগিয়ে দিল। সোনা বলল, কী হারিয়েছে তাই বলোনা, টিয়া খুব ভালো খুঁজে দেয়। মামণির চাবি খুঁজে দিয়েছিল।

টিয়া অমনি ভ্যাঁ করে কেঁদে বলল, মামণির কাছে যাব। আমার খিদে পেয়েছে! কান্না দেখে হোটেলওলা আর কালো লোকটা সোনা-টিয়াকে কোলে করে নামিয়ে এনে আবার খাবারের বাটির সামনে বসিয়ে দিল। এতক্ষণে সোনা-টিয়া চিনতে পারল–ওই-না ঘড়িওলা! আঁ, ঘড়িওলা, তুমি কেন এলে? তোমাকে দেখলে কাদার কলের জন্য চেপে ধরবে-না?

ঘড়িওলা বললে, এই, চুপ, চুপ!

কথাটা অবিশ্যি হোটেলওলার কানে যায়নি, সে নীচে নেমেই আবার কী যেন খুঁজতে আরম্ভ করেছে! খানিক বাদে ফিরে এসে মাথায় হাত দিয়ে গাছের গুঁড়িতে বসে পড়ল। সর্বনাশ হয়েছে, সং তার লটারির টিকিটের আধখানা আমাকে রাখতে দিয়েছিল, কানে খুঁজে রেখেছিলাম, কোথায় পড়ে গেছে। এখন সেটিকে কিছুতে যদি খেয়ে ফেলে থাকে, তবেই তো গেছি! ও টিয়া, সত্যি খুঁজে দেবে তো?

টিয়া বলল, দেব, দেব, খেয়ে-দেয়ে, হাত-মুখ ধুয়ে, খুঁজে দেব। ঘড়িওলা বনের মধ্যে কেন এলে?

হোটেলওলা বলল, বাঃ, তা আসবে না? ও যে আমার ছোটো ভাই, নইলে দাড়ি আনবে কে? তা ছাড়া ওকে কলের পুতুল খুঁজে বেড়াতে হয়, এদিকে নিজের দেখা দেবার জো নেই। তার খাটনি কত? মাঝে মাঝে স্বর্গের সুরুয়া খেয়ে না গেলে পারবে কেন?

টিয়া বলল, কিন্তু–কী

সোনা হাত দিয়ে তার মুখ চেপে ধরল, এই, চুপ, চুপ।

 হোটেলওলা আবার উঠে টিকিট খুঁজতে লাগল।

ঘড়িওলা বলল, আর পারি নে! বলি, তোফা আছ এখানে আমার দাদার আস্তানায়, মাকুর হদিশ পেলে? তা ছাড়া তোমাদের সঙ্গে বেহারি বলে যে লোকটা এসেছে, আশা করি তার কাছে আবার হাঁড়ির কথা ভাঙনি?  

টিয়া সত্যি কথাই বলল, বেহারি আমাদের চাকর, আমাদের বাড়িতে বাসন ধোয়। মাকুকে পেলে কী করবে? হাসি-কান্নার কল এনেছ?

ঘড়িওলা রেগে গেল। রাখো তোমাদের হাসি-কান্নার কল। তা ছাড়া একটু একটু হাসতে পারে মাকু, ঠোঁটের কোণের কজা খুললেইমুখটা হাসি-হাসি দেখায় আর কান্নার কলটল করা আমার কম্ম নয়। আমার পয়সাকড়ি বিদ্যে বুদ্ধি সব গেছে ফুরিয়ে। এবার মাকুকে একবার পেলে হয়, সটান থানায় দিয়ে দেব। আর ফেরারি হয়ে ঘুরতে ভালো লাগে না। মা-র জন্য মন কেমন করে।

অমনি টিয়া বলল, আমারও মামণি, বাপি, আম্মা, ঠামু আর নোনোর জন্যে মন কেমন করে? বলেই ভ্যাঁ করে কান্না জুড়ল। তাই দেখে ঘড়িওলা বেজায় বিরক্ত, কথায় কথায় অত চোখের জল কীসের গা? দামোদর নদী নাকি! এত করে বললাম–মাকুকে খুঁজে দাও, হ্যাঁন্ডবিল পর্যন্ত দিলাম, অথচ খোঁজার নামটি নেই!

টিয়া চটে গিয়ে কান্না থামিয়ে সবে বলেছে, মাকু তো–, অমনি সোনা তার ঠ্যাং ধরে টেনে গাছের ডাল থেকে নীচে নামিয়ে আনল, গুঁড়িতে মাথা ঠুকে আলু হল, এবার কান্না থামতে পাঁচ মিনিট।

কান্না থামলে ঘড়িওলা আবার বললে, মাকুর চালাকি এবার বের করছি, কতকগুলো চাকা আর স্প্রিং আর চকমকি ইত্যাদির তেজ দেখো-না! এবার সব যন্ত্রপাতি খুলে আলাদা আলাদা থলেয় পুরে বাছাধনকে—

হোটেলওলা শেষের কথাগুলি শুনে অবাক হয়ে গেল।

–কেন গো, মাকু না তোমার প্রাণের কলের পুতুল, মানুষ থেকে যার কোনো তফাত নেই, অথচ মানুষের চেয়ে যে শতগুণে ভালো, যেমনটি বানিয়েছ তেমনটি করে, আমাদের ছেলেপুলের মতো তাঁদড় নয়– আজ আবার উলটো কথা শুনি কেন?

ঘড়িওলা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, এখন আর তা নয়, দাদা, যেমনটি ভেবে বানিয়েছিলাম, এখন আর তা নেই। কলের মধ্যে কী যেন অন্য শক্তি গজিয়ে গেল, মাকু এখন ইচ্ছেমতো চলে বলে, আমার বড়ো-একটা তোয়াক্কা রাখে না। আমার প্ল্যানমতো যদি চলত, এমন বেমালুম অদৃশ্য হয়ে যেতে পারত কখনো? অবশ্যি আমিও মোটেই চাইনে যে সে আমাকে খুঁজে পায় অমনি তো কাদার কল করে আর তিষ্ঠুতে দেবে না। নেহাত এত দিনেও তোমরা কেউ তাকে দেখতে পাওনি বলেই বুঝেছি এ-বনে সে নেই, তাই দু-দণ্ড বসে গল্প করছি! ব্যাটাকে পেলে ভ্রু ড্রাইভার দিয়ে ওর গায়ের কোনো দু-টুকরো একসঙ্গে রাখব না। সোনা-টিয়া শিউরে উঠল।

হোটেলওলা বলল, এত রাগ কীসের?

–হবে না রাগ? সতেরো বছর ধরে, বাড়িঘর ছেড়ে, মার রান্না ছেড়ে, ঘড়ির কারখানায় যে পড়ে রইলাম সে তো শুধু মাকুর জন্যই। নইলে ম্যানেজার আমাকে উদয়াস্ত খাঁটিয়ে ঘড়ির ঘরের তাকের নীচে শুতে দিয়েছে আর ছাইপাঁশ খেতে দিয়েছে। তাইতেই আমি সারারাত জেগে গুদোমে পড়ে-থাকা রাজ্যের পুরোনো বিলিতি ঘড়ির কলকজা খুলে নিয়ে, ওর পেটে পুরতে পেরেছি। ফালতু পড়ে ছিল যে জিনিস, মরচে ধরে নষ্ট হচ্ছিল, কেউ দেখছিল না, এখন শুনছি তারি দাম নাকি পাঁচ হাজার টাকা! ওই পাঁচ হাজারের জন্য আমার নামে হুলিয়া বেরিয়েছে। এবার চাবি ফুরুলেই দেব পুতুলটাকে যার জিনিস তাকে ফিরিয়ে, ধুয়ে খাক, আমার কী?

এই বলে ঘড়িওলা দু-বার চোখ মুছল। হোটেলওলা বলল, অত ভাবনা কীসের বুঝি না। ছ-মাস মাকুর খেলা দেখালে অমনি তোর কত পাঁচ হাজার উঠে আসবে, তখন পাঁচের বদলে সাত হাজার দিয়ে কলকজাগুলো কিনে নিতে পারবি!

ঘড়িওলা হাত-পা ছুঁড়ে চাচাতে লাগল, কোন চুলোয় খেলা দেখাবটা শুনি? রঙ্গমঞ্চটা কোথায়? সার্কাসপার্টি নিখোঁজ, অধিকারী ফেরারি, না আছে তাবু না আছে গ্যাসবাতি, পালোয়ানরা সব জন্তুজানোয়ার নিয়ে বনের মধ্যে সেঁধিয়েছে। ওকথা আর মুখে এনো না কাপ্তেন–।

মালিক তাকে কাছে ডেকে বোঝাতে লাগল, এই সুযোগে টিয়ার হাত ধরে পা টিপে টিপে সোনা বনের মধ্যে ঢুকে পড়ল। মাকুকে সাবধান করে দিতে হবে।

টিয়া বললে, মাকু যদি কথা না শোনে?

সোনা গম্ভীর হয়ে গেল, মাকুকে বাঘ ধরার ফাঁদে ফেলে দেব আর উঠতেও পারবে না, কেউ খুঁজেও পাবে না!

টিয়ার কান্না পেল, আর যদি বেরুতে না পারে? শেষটা যদি খেতে না পেয়ে—

চুপ, টিয়া চুপ। ঘড়িওলা চলে গেলে জাদুকর দড়ি দিয়ে মাকুকে তুলে আনবে। ছি, কাঁদে না, আজ-না মালিকের জন্মদিন? সঙের লটারির টিকিটের আধখানা খুঁজে দিতে হবে-না? আজ যে জানোয়ারদের খেলা হবে, মালিকের জন্মদিন বলে কত রান্নাবান্না হচ্ছে দেখলে না?

টিয়া ঢোক গিলে বলে, বড়ো গর্তে ফেলবে না ছোটো গর্তে ফেলবে। মাকুর লাগবে না?

সোনার হাসি পায়, কলের পুতুলের আবার লাগে নাকি? লাগলে লোকেরা কাঁদে, মাকুর কাদার কলই নেই তো কঁদবে কী?

টিয়া বললে, তা হলে বড়ো গর্তেই ফেলে দাও, নইলে যদি আবার বেরিয়ে এসে বলে, এই যে আমি মাকু, আমাকে কাদার কল দাও!

সোনা একটু চুপ করে থেকে বলল, আমি মাকুকে কাঁদার কল দেব। মাকু আমাদের জন্য প্যা-পা পুতুল জাদুকরের কাছ থেকে এনে দেবে আর আমি ওকে কাদার কল দেব না?

টিয়া তো অবাক, আছে তোমার কাছে?

সোনা বুক ফুলিয়ে বললে, নেই, কিন্তু বানিয়ে দেব। ওর মুন্ডু খুলে তার ভেতরে কাঁদার কল বসিয়ে দেব। মাকু তখন তোর মতো ভ করে কাদবে!

বলতে বলতে সত্যি সত্যি দু-জনে বাঘধরার বড়ো ফাঁদের কাছে এসে গেল। অনেক দিনের পুরোনো ফাঁদ। বনে যখন বসতি ছিল তখন গাঁয়ের লোকরা বাঘ ধরবার জন্য করেছিল। জাদুকর বলেছিল, বাঘ মোটেই নয়, বুনো শুয়োরে ওদেরশস্য খেয়ে ফেলে নষ্ট করত, তাদের ধরবার ফাঁদ এগুলো। মাটিতে দু-মানুষ গভীর গর্ত খুঁড়ে তার ওপরে কাঠকুটো লতা-পাতা দিয়ে ঢেকে রাখত, শস্য খেতে এসে তার মধ্যে শুয়োর পড়ে যেত আর শস্য খাওয়া ঘুচত। তাই শুনে শুয়োরের জন্য টিয়া একটু কেঁদেও নিল।

এখন ফাঁদের মুখটা লতাপাতা গজিয়ে ঢেকে গেছে, না দেখে কেউ পা দিলে ঘপাৎ করে পড়ে যাবে।

তাই যেখানে যেখানে ফাঁদ পাতা, সেখানে হোটেলওলা একটা করে বাঁশের খুঁটি পুঁতে রেখেছে, লোকে যাতে দেখতে পেয়ে সাবধান হয়। সার্কাসের জানোয়ারদের জন্যই বেশি ভয়।

সোনা একবার এদিক-ওদিক দেখে নিয়ে, বড়ো ফাঁদের কিনারা থেকে বাঁশের খুঁটি উপড়ে ফেলে দিল। এর মধ্যে মাকুকে ফেলতে হবে; তা হলে আর কেউ তাকে খুঁজে পাবে না, যতক্ষণ-না সোনা-টিয়া দেখিয়ে দেয়। আর ভয় নেই।

টিয়া বলে, দিদি, যদি ওর মধ্যে সাপ থাকে, কাঁকড়াবিছে থাকে, মাকুকে যদি কামড়ায়?

 চুপ, টিয়া, চুপ, কথায় কথায় অত কান্না আবার কী! মাকু তো কলের পুতুল, সাপ বিছে ওর কী করবে?

তবু টিয়ার কান্না পায়। সে কেঁদে বললে, আমি কলের পুতুলকে ভালোবাসি, প্যাঁ-প্যাঁ পুতুল কোথায়, মামণি বাপি কোথায়?

তাই শুনে সোনাই-বা করে কী, দু-জনে মহা কান্না জুড়ে দিল। কখন যে বড়ো চিঠি হাতে করে পেয়াদা এসে হাজির হয়েছে ওরা টেরই পায়নি। পেয়াদা হাঁক দিল, ও খুকিরা, এ-বনে যারা থাকে তারা কোথায় গেল বলতে পার? সেই ইস্তক খুঁজে খুঁজে হয়রান হচ্ছি, অথচ কারো টিকির দেখা পাই নে। এ চিঠি যথাস্থানে না পৌঁছেলে আমার চাকরি থাকবে না। বলি, কথা শুনতে পাচ্ছ?

পেয়াদা এসেছে ঘড়িওলাকে ধরতে, মাকুকে ধরতে, সার্কাসের লোকদের ধরতে, আর কি সোনা-টিয়া সেখানে থাকে! দৌড়, দৌড়! পেয়াদাও সমানে চাঁচাতে লাগল, শোনো, শোনো, বটতলায় কারা খাওয়া-দাওয়া করে? ও খুকিরা, কথার উত্তর দাও-না কেন? দাঁড়াও, তোমাদের ধরছি!

এই বলে যেই-না পেয়াদা ওদের পেছনে দৌড়েছে, সে কী মড়মড় হুড়মুড়! পেয়াদা পড়েছে ফঁদে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *