০১-০৫. ছোটোবেলায় পাহাড়ের দেশে থাকতুম

বকধার্মিক – লীলা মজুমদার

০১.

ছোটোবেলায় পাহাড়ের দেশে থাকতুম। সেখানে বাড়ির পেছনে ঢালুর নীচে নুড়ি পাথরের ওপর দিয়ে ছলছল করে পাহাড়ি নদী বয়ে যেত। সরল গাছের বনের মধ্যে দিয়ে হু হু করে হাওয়া বইত। রাতে নদীর ধারে ধারে ঝোপেঝোপে হাজার হাজার জোনাকি জ্বলত।

ছোটো শহর; চা-বাগানের সাহেবরা অনেকে সেখানে বাড়ি নিয়ে মাঝে মাঝে থেকে যেত। ইস্কুল, ক্লাব, হাসপাতাল, আপিস, আদালত, ব্যাঙ্ক, জেলখানা সবই ছিল। তবু লোকে বলত এখানে কখনো কিছু হয় না। বাড়ির দরজা খুলে রেখেই বেড়াতে বেরুত, সই না নিয়ে টাকা ধার দিত, নগদ পয়সা দিয়ে কেউ কিছু কিনত না, মাস কাবারে মাইনে পেলে যে যার ধার শোধ করে দিত।

সবাই সবাইকে চিনত সেখানে; কাউকে বলত খুড়ো, কাউকে বলত দাদা। ম্যাজিস্ট্রেটকে সবাই ভয় করত; দারোগাবাবু, পোস্টমাস্টার ইস্কুলের হেডমাস্টারকে খাতির দেখাত; হাসপাতালের ডাক্তারবাবুকে ভালোবাসত।

সবাই সবাইকে চিনত সেখানে; মাঝে মাঝে ঝগড়াঝাটিও হত, তবু কারো বাড়িতে কোনো কারণে খাওয়া-দাওয়া হলে, পাড়াসুদ্ধ সকলের ডাক পড়ত।

তখন দিনকাল ছিল ভালো, ঘিয়ের সের টাকা-টাকা, দুধ ছিল টাকায় সাত সের, মিলের কাপড় তিন টাকা জোড়া। তবু জেলখানা খালি থাকত না। কোথায় কে জুয়ো খেলেছে, নেশা করেছে, গাঁট কেটেছে, তাদের ধরে এনে, হাজতে জিম্মা করে দেওয়া হত। তাদেরই বলা হত দাগি চোর; ছাড়া পেয়ে পথ দিয়ে হেঁটে গেলে, লোকে তাদের আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিত। মাথা নীচু করে হাঁটত তারা।

সেই সময়কার কথা।

হঠাৎ একদিন সব পালটে গেল। তার আগের দিন সন্ধ্যে বেলা পর্যন্ত কোনো কিছু জানা নেই, যেমনকে তেমন সব চলেছে। সকাল বেলাও নাপিতরা রোজকার মতো খেউরি করতে বেরিয়ে, এ-বাড়ির খবর ও-বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে।

আপিস যাবে বলে আমাদের পাড়ার জগদীশদা স্নান সেরে চুল আঁচড়াচ্ছে, এমনি সময় ওর পিসিমা আলমারি খুলে একটা সোনার কৌটো বের করে বললেন, এটাকে কখনো দেখেছিস? এর ইতিহাস শুনেছিস?

জগদীশদা তো থ! গোল গোল চোখ করে বলল, ইস্, পিসিমা, অ্যাদ্দিন কোথায় রেখেছিলে এ-জিনিস? পেলে কোথায়?

পিসিমা কাষ্ঠ হেসে বললেন, এত ভালো জিনিস এ পাপের সংসারে কি আর সদুপায়ে পাওয়া যায় ভেবেছিস? আমার বাবা এটাকে জুয়ো খেলায় জিতেছিলেন।

 জগদীশদা হাত বাড়িয়ে বললে, দেখি, দেখি কীরকম জিনিস। আরে এ যে নস্যির কৌটো দেখছি। বাবা! সোনা দিয়ে গড়া, তার ওপর লাল সবুজ পাথর বসানো! কিন্তু ঢাকনির মাঝখানে ছাদা কেন, পিসিমা? নস্যি পড়ে যাবে যে!

পিসিমা বললেন, আরে ওইখানে যে স্ক্রুপ দিয়ে একটা হিরের প্রজাপতি বসানো ছিল।

জগদীশটা বললে, কই, কই সেটা?

পিসিমা একটু চুপ করে থেকে বললেন, কী জানি।

জগদীশদা তখন খানিকটা বিরক্ত হয়ে বলল, তোমার কাছে এত দামের জিনিস আছে, তবু, তুমি কেন আমি মাইনে পেলেই খালি খালি টাকা দাও টাকা দাও করো?

পিসিমা তো অবাক!

ওমা, সেকি আমার নিজের জন্যে বলি রে? সব তো প্রায় তুই-ই খাস। আর এটাকেও কি আমার নিজের জন্যে রেখেছি নাকি? তোর বউ এলে, এতে সিঁদুর ভরে তাকেই দেব মনে করেছি।

জগদীশদা ফুটো দেখিয়ে বললে, কিন্তু ওইখান দিয়ে সিঁদুর পড়ে যে বউয়ের শাড়িতে মেখে একাকার হবে। প্রজাপতিটা কই?

পিসিমা তার কোনো উত্তর না দিয়ে, দেরাজ থেকে ছোট্ট এক টুকরো লাল শালু বের করে, তাই দিয়ে কৌটোটাকে বেশ করে মুড়ে, জগদীশদার হাতে দিলেন।

দ্যাখ, এটাকে আর বাড়িতে রাখতে সাহস হচ্ছে না, তুই বরং আপিসে টিফিনের ছুটি হলে, ওটা ব্যাঙ্কেই জমা দিয়ে দে। খুব সাবধানে রাখিস কিন্তু, এর দাম শুধু টাকাপয়সা দিয়ে নয়। কে জানে এর জন্যে হয়তো আমার বাবা বেচারিকে নরক ভোগ করতে হচ্ছে। সে যাক গে; কিন্তু খবরদার, ব্যাঙ্কের লোহার দেরাজে তালাচাবি বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত, এক মিনিটের জন্যেও একে হাতছাড়া করবি নে।

জগদীশদা পুঁটলিটাকে প্যান্টের পকেটে পুরতে পুরতে বলল, আচ্ছা, আচ্ছা, আর বলতে হবে না। আমার বউকেই দেবে তো ঠিক? শেষটা?

পিসিমা চটে গেলেন।

তোর বউকে দেব না তো আবার কাকে দেব? তুই ছাড়া আর তিন কুলে কে আছে রে আমার?

জগদীশদা কাগজপত্র গুছোতে গুছোতে হেসে বলল, থাকলে তো আমি বাঁচতুম!

পিসিমার মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। না রে জগদীশ, হাসিঠাট্টার কথা নয়। শুনেছি যার কাছ থেকে বাবা ওটাকে জিতেছিলেন, সে নাকি প্রতিজ্ঞা করেছিল, যেমন করেই হোক, নাতনির বিয়েতে ওইটেকেই যৌতুক দেবে। তুই বলিস কী রে জগদীশ, অ্যাদ্দিনে তার বিয়ের বয়েস হয়ে গেছে। ওটাকে আর বাড়িতে রাখা নয়।

তারপর দুগগা দুগগা বলে জগদীশদাকে রওনা করে দিতে দিতে আরও বললেন, দ্যাখ দিকিনি অন্যায়টা! কী এমন দোষ করেছিলেন বাবা বেচারি? যারা জুয়ো খেলবে তারাও যদি একটু-আধটু জোচ্চুরি করতে না পেল, তা হলে জোচ্চুরিটা করবে কে, তুই-ই বল? তাই বলে অমন কথা! কম পাজি তো নয় লোকটা!

আপিসে সেদিন খুবই কাজের তাড়া ছিল, তবু তারই মধ্যে, থেকে থেকে জগদীশদা প্যান্টের পকেট চাপড়ে বার বার দেখেছিল কৌটো ঠিক আছে। অথচ ব্যাঙ্কে গিয়ে, পকেট থেকে পুটলি বের করে জগদীশদার চক্ষুস্থির! কোথায় গেল সেই শালুতে-মোড়া ঢাকনিতে দাওয়ালা সোনার কৌটো! এ যে একটা ন্যাকড়ায় জড়ানো কিমামের শিশি!

তারপর হাঁক-ডাক, থানা-পুলিশ, খানাতল্লাশি। কিন্তু কিছুতেই আর কিছু হল না। সোনার কৌটো কর্পূরের মতো উড়ে গেল।

এ-সমস্ত ঘটনা পরে জগদীশদার নিজের মুখ থেকে শোনা।

আর শুধু কি সোনার কৌটো? সেদিন থেকে আমাদের ছোটো শহরে, যেখানে কখনো কিছু ঘটে না বলে লোকে আক্ষেপ করত, সেখানে যেন ভোজবাজি শুরু হয়ে গেল। সে চোখে না দেখলে বিশ্বাস করবার কথা নয়। যেখানে আগে সবাই দরজা খুলে বেড়াতে যেত, সেখানে আর কারো কিছু রাখবার উপায় রইল না। যার যা ভালো জিনিস, সব বেমালুম চুরি হয়ে যেতে আরম্ভ হয়ে গেল!

অদ্ভুত সব ব্যাপার! বিশেষ করে স্কুল পাড়ায়, যেখানে আমরা থাকতুম। আমাদের শহরটা ছোটো হলেও, পাড়াগাঁর মতো নয়। বলেছিই তো আপিস, আদালতে, থানা, জেলখানা, ছেলেদের ইস্কুল, মেয়েদের ইস্কুল, হোটেল, ক্লাব, হাসপাতাল, ব্যাঙ্ক কিছুরই অভাব ছিল না। রেলগাড়ি অবিশ্যি ওইসব পাহাড়ে দেশে যাতায়াত করত না, কিন্তু মস্ত একটা মোটর-আপিস ছিল, সেখানে মেলা লোজনও কাজ করত।

জগদীশদার কৌটো যাবার পরদিনই আমাদের স্কুলের বড়দিদিমণির সেলাইকটা গেল। তারপর দু-চার দিন পর পর, গুপেদের হেডমাস্টারের টাইপরাইটার, ব্যোমকেশবাবুর দু-দুটো ছাগল, আর পোস্টমাস্টারের সাইকেল উধাও!

সেখানেই থামল না। আমাদের কালেক্টর গুপ্ত সাহেবের দেয়ালঘড়ি, গ্রামোফোন আর বারান্দায়-ঝোলানো দশ রকমের অর্কিড ফুলের গাছ লোপাট! এমনকী সেগুলোকে পাহারা দেবার জন্যে গুপ্ত সাহেব যে হলুদ রঙের ডালকুত্তো কিনেছিলেন, যার ভয়ে বাড়ির লোকেরা পর্যন্ত কেউ নীচু হত না, কারণ নীচু হলেই পেছন দিক থেকে তেড়ে এসে একাকার করত সে কুকুরটা পর্যন্ত নেই।

পুলিশে আর কী করবে? শোনা গেল থানার বড়ো ঘণ্টাটা আর পুলিশদের চব্বিশটা পেতলের লোটাও নাকি পাওয়া যাচ্ছে না।

প্রথম প্রথম এসব শুনলে আমাদের দারুণ মজা লাগত, কিন্তু শেষটা যখন আমাদের বাড়ি থেকে, আমাদের ভালো কাপড়জামাসুদ্ধ বড়ো কালো তোরঙ্গটা অদৃশ্য হয়ে গেল, তখন মোটেই হাসির কথা হল না।

সবাই ভারি সাবধানে চলাফেরা করতে লাগল। কিন্তু হলে হবে কী? চোররা আরও সেয়ানা। ডাক্তারবাবু বললেন, আর সেয়ানা হবে নাই-বা কেন? বোকা হলে তো সৎপথেই থাকত!

এমন কথা শুনে মা-জ্যেঠিমারা খুব বিরক্ত হয়েছিলেন।

তারপর কত কাল কেটে গেছে, তবু এখনও সেসব কথা ভাবতে আশ্চর্য লাগে। আমার জ্যাঠতুতো ভাই নেপু বলেছিল যে পিসির কাছে তাড়া খেয়ে, জগদীশদা নাকি তিনজন সাক্ষী ডেকে, তামা-তুলসী-গঙ্গাজল ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিল যে চোর সে ধরবেই, সে যেমন করেই হোক। তাই নিয়ে রাত্রে ওরা লুচি মুরগি বেঁধে খাওয়া-দাওয়া করেছিল; তাই আর এখন কথার নড়চড় হবার জো নেই।

সেসময় শহরের মধ্যে যেখানেই যাও-না কেন, সবখানেই ওই এক কথা, কে নিল, কে নিল, কেমন করে নিল, কোথায় রাখল।

আমাদের স্কুলের মেয়েরাও টিফিনের সময় রোজই খুব জটলা করত। একদিন ইন্দুদি দেখলুম খালি হাতে ক্লাসে ঢুকলেন। এসেই বললেন, মেয়েরা, তোমরা সময় থাকতে সাবধান হও। পরে আপশোস করে কোনো লাভ হবে না।

শুনেই তো আমরা যে যার চুড়ি, বালা, গলার হার আর কানের ইয়ারিং খুলে, ইহুদির ডেস্কে চাবি বন্ধ করে ফেললুম। তারপর টিফিনের সময় সবাই মিলে ডালিম গাছের নীচে খাবারটাবার খেলুম, গালগল্প করলুম। ফিরে এসে যখন ডেস্ক খোলা হল, দেখা গেল, ওমা কী সর্বনাশ, গয়নাগাটি হাওয়া!

আমাদের নতুন বড়ো দিদিমণি, লাবণ্যদি তাই নিয়ে মহা গোলমাল করলেন। ইন্দুদি কেঁদেকেটে একাকার; বাড়িতেও বকাবকি। থাক, সেসব কথা ভেবে কোনো লাভ নেই।

রাত্রে খেতে বসে, নেপুর যেমন স্বভাব, ফোঁপরদালালি করে বলল, আমাদের অপূর্বদা বলেছিলেন, এ-সমস্ত কোনো ফন্দিবাজ মেয়েচোরের কাজ। এতটা নীচ, ছোটোলোক আর ধূর্ত হওয়া শুধু স্ত্রীলোকেরই সাজে।

রাগে আমার গা জ্বলে গেছিল। কিন্তু আমাকে আর কিছু বলতে হয়নি। মা, জ্যেঠিমা আর অরুণা বউদি বাছাধনকে আচ্ছা করে দু-কথা শুনিয়ে দিয়েছিলেন।

সত্যি, ওদের ওই অপূর্বদাটি একটি দেখবার মতো জিনিস। ইয়া লম্বা-চওড়া, তার ওপর গা ময় পাকানো পাকানো দড়ির মতো সব মাল, এই কুটি কুটি ছোট্ট করে চুল কাটা, কিন্তু কান পর্যন্ত টানা গোঁফ! নেপুটাকে একরকম অপূর্বার চেলাই বলা যায়, নেহাত গোঁফটা গজায়নি।

জ্যেঠিমা নেপুকে বললেন, পাকামো রাখ, ওই অতবড়ো তোরঙ্গ, গ্রামোফোন সরানো মেয়েমানুষের কাজ না আরও কিছু! ওসব পাচার করতে একটা ষণ্ডামার্কা পুরুষ মানুষের দরকার।

অরুণাবউদি বললেন, আর তার গোঁফ থাকলে তো কথাই নেই!

নেপু রেগে চটে পাতে দু-খানা গোটা হাতের রুটি ফেলেই উঠে চলে গেল।

বড়দা একটু হেসে বউদিকে বললেন, ওরকম বলতে হয় না। নেপুরা তা হলে তোমার নামে মানহানির মামলা করবে!

যাই হোক, চারিদিকে কতরকম জল্পনা-কল্পনাই চলতে লাগল, তার ঠিক নেই। শেষপর্যন্ত এমন হল যে সবাই সবাইকে সন্দেহ করতে লাগল।

একদিন ডাক্তারবাবুর গাড়ি থামিয়ে নতুন পুলিশ ইন্সপেক্টর ওঁর ব্যাগ তল্লাশি করলেন। ডাক্তারবাবু হাঁ হাঁ করে তুলোর প্যাকেট সরিয়ে রাখাতে, সন্দেহজনক লোকদের তালিকায় ওঁর নামটাও লিখে রাখলেন। পরে অবিশ্যি দারুণ পেটব্যথা হওয়াতে ডাক্তারবাবুর পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিলেন।

সে যাক গে, এইভাবে বেশ দু-তিনটে মাস কেটে গেল, একটা জিনিস বা একটা লোক ধরা পড়ল না।

০২.

বলেছি তো আমাদের শহরটা ছিল পাহাড়ে, দারুণ শীত পড়ত সেখানে। রাতে লেপ গায়ে দিয়ে শুয়ে শুয়ে শুনতুম বাড়ির পেছনে, ছোটো নদীর ওপারে, সরকারি জঙ্গলের মধ্যে শীত লেগে হুতুমপ্যাঁচা ডাকছে। দূরে দূরে থেকে থেকে ক্যা-হুঁয়া ক্যা-হুঁয়া বলে শেয়াল চাঁচাত। বাড়ির টিনের ছাদ সারাদিন রোদে তেতে, রাতের ঠান্ডায় মটমট করত।

কিন্তু এসব শব্দের চেয়েও স্পষ্ট শুনতে পেতুম কারা যেন বাড়ির বাইরে হেঁটে বেড়াচ্ছে।

একদিন রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর, ছুটে বেরিয়ে গিয়ে এক ব্যাটার গলা টিপে ধরেও ছিলেন। সে কিন্তু মহা কাও ম্যাও লাগাল, সে নাকি বাবার বন্ধু গোপেনবাবুর নতুন চাকর, কী চিঠি নিয়ে এসেছে। বেরও করে দিল একটা চিঠি, শেষপর্যন্ত তাকে ছেড়ে দিতে হল।

সত্যিকার চোর আর কেউ চোখেও দেখল না। অথচ কমিশনার সাহেবের বাগানের সমস্ত আলু গাছ রাতারাতি কে উপড়ে নিয়ে চলে গেল। তাতে আলু কত! এক-একটা গাছেই কুড়ি-বাইশটা করে। এরজন্য থানার ইশ্চার্জ কোন অজ পাড়াগাঁয়ে বদলি হয়ে গেলেন, কিন্তু চোর ধরা পড়ল না।

তাঁর বদলে যিনি এলেন, তিনি এসেই শহরে নতুন যারা আসছে আর পুরোনো যারা বেরিয়ে যাচ্ছে, সবাকার নাম ধাম পেশা টুকে রাখলেন।

প্রতি বছর এই সময় শীতের মুখে, জগদীশদার পিসিমার গুরুদেব এসে দশ-বারো দিন লুচি-পাঁঠা-ক্ষীরসর খেয়ে মোটা হয়ে, দু-খানি নতুন কম্বল নিয়ে চলে যান। এ-বছর যেই-না টিকিসুদ্ধ দেখা দিয়েছেন, অমনি কাঁক করে পুলিশরা ধরেছে তাকে।

আমাদের ক্লাসের সবচাইতে ভালো মেয়ে পুঁটি, জগদীশদাদের পাশের বাড়িতে থাকে। সে বললে গুরুদেবকে ধরাতে পিসিমার সে কী রাগ!

আমার অমন সোনার ডিবে গেল, বলে তারই শোকে মলাম! আবার কি না শ্রীভগবানকে ফাটকে দিয়েছে! এমন দেশে চুরি হবে না তো হবে কোথায় শুনি! দেখো, কেউ ধরা পড়বে না, কিছু পাওয়া যাবে না, আমার সোনার ডিবেও না। হাউ হাউ।

যখন সত্যি সত্যি বেশ কিছুদিন কেটে গেল, তখন একদিন কমিশনার সাহেবের বাড়িতে সকলের নেমন্তন্ন হল। বাগানের মধ্যিখানের খোলা জায়গাটিতে ছেঁড়া শতরঞ্জি পেতে বসিয়ে, চা আর আলুভাজা খাইয়ে দেওয়া হল। তারপর সকলে মিলে ঠিক করা হল যে এ আর একা পুলিশের কম্ম নয়, শহরসুদ্ধ সবাইকে কাজে নেমে যেতে হবে।

মিটিং করতে করতে সন্ধ্যে হয়ে এল, দাঁড়কাকরা গাছে ফিরে এল, সুয্যি ডোবার সঙ্গেসঙ্গে অন্ধকার নেমে এল।

বাড়ি ফেরবার পথে বাবা শশীবাবুর দোকান থেকে একটা লম্বা খাতা কিনে, ঘরে ঢুকেই আমার নতুন সবুজ কলমটা চেয়ে নিয়ে, চোর ধরবার লোকজনদের নাম লিখতে বসে গেলেন। কলমটা দিয়ে আবার গলগল করে কালি বেরুত, সেসব নতুন খাতায় মেখেটেখে একাকার, বাবা তো রেগে কাই!

শেষটা পেনসিল দিয়ে লিখতে হল। নেপু আর আমি স্কুলে নাম দেব বলে আমরা ছাড়া আর সকলের নাম ১নং ২নং করে লেখা হল।

আমাদের শংকর ঠাকুর নাম লিখিয়ে সটান নিজের ঘরে গিয়ে বাক্স-প্যাটরা বাঁধতে লেগে গেল। বলে, আজ নাম লিগিলু কাল ধরি নিলু! আধ ঘণ্টা ধরে মা আর জেঠিমা ওকে বোঝাতে লাগলেন। পরে অবিশ্যি খুশি হয়ে মাছকাটা বঁটি নিয়ে শুল।

পরদিন নেপু ইস্কুল থেকে ফিরেই বলল, অপূর্বারা প্রমাণ পেয়েছেন এসব কোনো মেয়ের কাজ, তোদের মাস্টারনিদের সাবধান হতে বলিস।

আমিই-বা ছেড়ে দেব কেন, একটা মানসম্মান আছে তো? কাজেই বললুম, যার বিশে ডাকাতের মতো চেহারা তাকে অত কথা বলতে বারণ করিস।

নেপু রাগে ফুলতে ফুলতে বলল, তোদের লাবণ্যদিদিকে ওয়ার্ন করে দিস। আমিও রেগে বললুম, অপূর্ব লোকটাকে উইল লিখে রাখতে বলিস। এই কথাবার্তা থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে মেয়েদের ইস্কুল আর ছেলেদের ইস্কুলের মধ্যে কী দারুণ রেষারেষি চলছিল।

নেপু হল আবার ওদের দলের সাবক্যাপ্টেন। গলায় একটা দড়ি দিয়ে একটা বাঁশি ঝুলিয়ে বাড়ি এল। দেখে হেসে বাঁচি নে। ওদিকে আমাদের ইস্কুলেও রীতিমতো কাজ শুরু হয়ে গেছে, ছোটো ছোটো দল বানিয়ে ফেলা হয়েছে। আমি একটা দলের অধিনেত্রী হয়েছি। একটা লাল রেশমি ফিতের ব্যাজও পেয়েছি, আমার পেনসিল-বাক্সে সেটা লুকিয়ে রেখেছি। নেপুকে দেখাতে ভারি বয়ে গেছে। বাবা! যা হিংসুটে ছেলে, এক্ষুনি তাই নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করবে।

এ সবের মধ্যে আবার শীত পড়ে গেল। নাসপাতি গাছের পাতাগুলো সব লালচে হয়ে ঝরে পড়ে গেল। আর তারইসঙ্গে আমাদের বাৎসরিক পরীক্ষাও এসে গেল। নেপুরা শুনলুম দল বেঁধে ওদের হেডমাস্টারমশায়ের কাছে গেছল, নাকি চোর ধরার হাঙ্গামার জন্য ভালো করে পড়া তৈরি হয়নি, বড়োদিনের ছুটির পর পরীক্ষাটা হোক। তাড়া খেয়ে বাবুরা ফিরে এসেছিলেন। ওদিকে চোর ধরার নাম নেই, এদিকে তাই নিয়ে বড়াই কত! আমরাও যে পরীক্ষা পেছোবার কথা ভাবিনি তা নয়, কিন্তু নেপুদের অবস্থা দেখে কথাটা আর পাড়িনি।

 সেকালে বাৎসরিক পরীক্ষার পর বারো দিন বড়দিনের ছুটি থাকত। ভেবেছিলুম তারমধ্যে কাজ হাসিল করতে পারলে কী মজাটাই-না হয়।

বাড়িতেও এইসব ব্যাপার নিয়ে বেশ একটা আলোড়ন চলত। বাবা তো খাতায় মা জেঠিমাদের নাম লিখে নিয়েছিলেন। সন্ধ্যে বেলায় জগদীশদার পিসিমা প্রায়ই একটা মোষের মতো রঙের আলোয়ান গায়ে দিয়ে আমাদের বাড়িতে আসতেন। জেঠিমাদের বলে-কয়ে বাবার খাতায় তিনিও নিজের নামটা লিখিয়ে নিলেন।

তখন মা জেঠিমাদের কাজ সারা হয়ে যেত, সবাই হাতমুখ ধুয়ে চুল-টুল বেঁধে, একটা করে নীল আলোয়ান জড়িয়ে, জেঠিমার শোবার ঘরের তক্তপোশের ওপর গোল হয়ে বসতেন। আজকাল বড্ড শীত পড়ে গেছে, বাগানে আর বসা চলে না।

কতরকম জল্পনাকল্পনাই-না চলত ওঁদের। কোথায় কবে কী চুরি-ডাকাতি হয়েছিল তার গল্প শুনে শুনে আমাদের গা শিরশির করত। আবার মাঝে মাঝে বাইরে একটা পাতা খসার শব্দ শুনেই চমকে চমকে উঠতেন সবাই। ও দিদি! ও আবার কেমনধারা আওয়াজ!

জেঠিমার তো অন্ধকার হলে পর জানালার কাচ দিয়ে বাইরে তাকাতেই ভয় করে, উনি আবার চোর ধরবেন! অথচ বয়সে বড়ো বলে উনিই হলেন ক্যাপ্টেন! মাকে ডেকে বলতেন, মেজোবউ, যা, দেখে আয় কীসের শব্দ।

আমার মা বন্ধ জানালার পরদাটা আঙুল দিয়ে একটু সরিয়ে টুক্ করে এক বার দেখেই বলতেন, কই, কিছু না তো! পাতা খসার আওয়াজ হবে হয়তো।

একদিন ওইরকম জানালার কাছ থেকে ফিরে এসেই জগদীশদার পিসিমাকে বলে বসলেন, তুমি তো দিদি, সব জানো। তবে কেন পুলিশের কাছে কথাটা খুলে বলছ না? ওই যার কাছ থেকে তোমার বাবা জুয়ো খেলে সোনার কৌটো জিতেছিলেন, তুমিই তো বলেছ যে সেই লোকটা প্রতিজ্ঞা করেছে নাতনির বিয়েতে ওই কৌটো দেবেই দেবে। তবে কেন তাকে ধরিয়ে দিচ্ছ না?

মার কথা শুনে বাকি সবাই কাঠ! পিসিমা ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, আরে, কী যে বলিস পাগলের মতো! সে কি আর আছে যে ধরিয়ে দেব? কোন্ কালে মরে সগগে গেছে। পৃথিবীর নিয়মই হল হাড় পাজিরা বেশিদিন কষ্ট ভোগ করে না।

তাই শুনে আমার মা বললেন, আহা, তাকে না পাও, তার ছেলেকে তো জেলে দিতে পারো। সে-সুষ্ঠু তো আর মরে যায়নি!

 পিসিমা বললেন, গেছে রে গেছে। পাজির গুষ্টি, সব কটা সগগে গেছে। এক আছে ওই নাতি-নাতনি গুটি কতক! সব কটা নাকি সমান দুষ্টু!

জেঠিমা বললেন, সে কী! তাদের তুমি চেন নাকি?

 চেনবার কিছু দরকার করে না। ও-বংশের কেউ ভালো হতে পারে না, তাই বলছি। আরে বাবা বেচারি নাহয় একটু জোচ্চুরিই করেছিলেন, তাতে কী আর এমন হয়েছেটা তাই তোরা বল? কত লোকে তো অমন করে! অথচ সে-বুড়ো হতভাগা এমনি করতে লাগল যেন বাবা বেচারি কী অন্যায়টাই-না করেছেন! শেষপর্যন্ত বেচারাকে কলকাতা ছেড়ে, নাম ভাঁড়িয়ে, এখানে এসে শেষবয়সে ভগবানের নাম করে দিন কাটাতে হয়েছিল!

মা আবার জিজ্ঞেস করলেন, তা ওইসব নাতি-নাতনিদের–তাহলে হাজতে পোরা হচ্ছে না কেন?

পিসিমা রেগেমেগে এবার উঠেই পড়লেন।

কী জ্বালা, তুই তো ভারি বোকা দেখতে পাচ্ছি! পুলিশকে কৌটো হারানোর কথা বলি আর কী! তারপর বাবার জোচ্চুরির কথাটাও ফাঁস হয়ে যাক, তাতে ভালোটা কী হবে শুনি? তবেই আর কৌটো পাওয়া গেছে। তা ছাড়া তাদের ঠিকানাও জানি নে।

পিসিমা এবার সত্যি বাড়ি যাবার জন্যে আলোয়ানটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিলেন। যেতে যেতে আবার চাপা গলায় বললেন, জগদীশ একটা নতুন চাকর রেখেছে।

মা-জেঠিমারা আঁতকে উঠে বললেন, না, না, দিদি, আজকাল চারিদিকে যে কাণ্ড হচ্ছে, এ-সময় অচেনা লোক না রাখাই ভালো।

পিসিমা হেসে বললেন, তোদের যেমন বুদ্ধি! আরে, আসলে ও হল গিয়ে একটা পাকা গোয়েন্দা। টিকটিকি গো। চাকর সেজে তদন্ত করছে। কই, শঙ্করা আমাকে একটু এগিয়ে দিয়ে আসুক তাহলে।

পরদিন টিকটিকিটাকে নিজের চোখে দেখলাম পর্যন্ত। জগদীশদাদের বসবার ঘরের জানলায় পরদা টাঙাচ্ছে।

কী চালাক দেখতে সে আর কী বলব! কে বলবে গোয়েন্দা, স্রেফ একটা চোরের মতো দেখতে! খুদে খুদে করে চুল ছাঁটা, থ্যাবড়া নাক, ছোট্ট ছোট্ট চোখ নাক ঘেঁষে রয়েছে, পাশ দিয়ে তাকায়, কুচকুচে কালো গায়ের রং আর এই এই হাতের পায়ের গুলি! আবার পরেছে হাতকাটা গেঞ্জি আর কালো হাফপ্যান্ট।

পিসিমা দেখলুম লোকটার ওপর হাড়ে চটা। মাকে বললেন, বকরাক্ষসের সঙ্গে ব্যাটার কোনো তফাত নেই। সারাদিন খালি খাই খাই। কোনো কিছু তুলে রাখবার জো নেই! কী জানি বাবা, সারাক্ষণ যদি গিলবেই তো চোর ধরবে কখন?

লোকটা দেখলুম ততক্ষণে পরদা টাঙানো শেষ করে, রান্নাঘরের সিঁড়ির ওপর বসে এই বড়ো এক ঠোঙা মুড়ি, কাঁচালঙ্কা আর কঁচাপেঁয়াজ দিয়ে মেখে বেশ একমনে খাচ্ছে। এমন সময় জগদীশদা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে বলল, গুটে কোথায়? এই ব্যাটা, তুই এখানে বসে মুড়ি গিলছিস আর মাইনে খাচ্ছিস, ওদিকে অপূর্ববাবুরা তো সব বের করে ফেলল!

গুটে মুখে আরেক মুঠো মুড়ি পুরে বলল, কী যে বলেন! চোর ধরবে ওই স্টুপিডটা? ধরে যদি এই শম্মাই ধরবে, কিন্তু একটু না খেলে খাটব কী করে?

ততক্ষণে পিসিমা-জেঠিমারা জগদীশদাকে ঘিরে ফেলেছেন।

কী সর্বনাশ! ওমা, অপূর্বটারও পেটে এত বুদ্ধি! বাইরে দেখতে ওই ভালোমানুষ! তা ক-টাকে ধরল? তাদের সব ফাঁসি হবে বোধ হয়?

জগদীশদা রেগে উঠল।

চুরির জন্যে ফাঁসি হয় কখনো! যা বুদ্ধি তোমাদের? চোর ধরা অত সহজ নাকি?

হয়েছে এই যে অপূর্বরা খেলার মাঠের ওপারের জঙ্গলে গিয়ে দেখে চারিদিকে ছড়ানো রয়েছে শুধু হাড় আর চিবোনো মুণ্ডু কী হল, অমন হাঁ হয়ে গেলে কেন? ব্যাটারা সেখেনে গিয়ে মহা ফিস্টি দিয়েছে, মেলা মুরগি বেঁধে খেয়েছে। সম্ভবত সব চুরি করা। চারদিকে শুধু হাড় আর লুচির ঝোড়া আর রসগোল্লার হাঁড়ি। কীরকম সাহস বেড়ে গেছে ভেবে দেখো! বলতে গেলে একেবারে আমাদের দোর গোড়ায় বসে ভোজ মেরেছে আর ফন্দি এঁটেছে! এবার কী হয় কে জানে! আচ্ছা, পিসিমা, তুমি কি সেই সব।

আর বলতে হল না। পিসিমা বিষম রেগে চেঁচিয়ে উঠলেন, চোপ, ইডিয়েট! হাটের মাঝে হাঁড়ি কি না ভাঙলেই নয়!

গুটেটা একেবারে পিসিমার ঘাড়ের কাছে এসে, হাঁ করে সব কথা শুনছিল। পিসিমা বিরক্ত হয়ে নাকে কাপড় দিয়ে বললেন, কাঁচা পেঁয়াজ গিলে এসে আমার নাকের কাছে কি নিশ্বাস না ফেললেই নয়, বাছা?

গুটে একটু সরে দাঁড়িয়ে জগদীশদাকে বললে, দেখুন জগদীশবাবু, আমাকে সবকথা খুলে না বললে কিন্তু চলবে না। তা না হলে আমি তদন্ত করব কী করে?

জগদীশদা বললে, আচ্ছা, আচ্ছা, সে হবে খন। তুমি এখন এসো তো।

গুটে কিছুতেই নড়বে না, বলে, আর দেখুন, নাহয় চাকরির খাতিরে চাকর সেজেই রয়েছি। তাই বলে আপনার পিসিমার কি উচিত হয় আমার সঙ্গে সত্যিকার চাকরের মতো ব্যবহার করাটা? দেখুন, একবার আমার হাতের দশাটা দেখুন। সেই যে সকাল থেকে আমার পেছনে লেগেছেন, এক মিনিটের জন্যে বিরাম নেই! এমন করলে কী করে পারি তাই বলুন?

জগদীশদা পিসিমাকে বললে, আচ্ছা পিসিমা, সব জান, তবু এ-রকম কেন কর বলে দিকিনি! চোর ধরতে পারলে সরকার থেকে পাঁচশো টাকা পুরস্কার পাওয়া যাবে তা জান? তোমার হরিদ্বার যাবার খরচটা উঠে যাবে।

 পিসিমা কিছুতেই বোঝেন না। না বাপু। আমি যাই হরিদ্বারে, আর তোমার গুটে গুণধর বাকি গয়নাগুলো–। জগদীশদা ছুটে গিয়ে মুখ চেপে ধরল।

গুটে আরেকটু এগিয়ে এল।

কী কী গয়না, মাঠাকরুন? কোথায় রেখেছেন সেগুলো? আহা, কিছুই যদি না বলেন তো সেসব রক্ষে করব কী করে?

বাকিরা এতক্ষণ হাঁ করে সব শুনছিলেন। পিসিমা কোনো জবাব দিচ্ছেন না দেখে, একটু রাগ করে জেঠিমা বললেন, চলো তোমরা, এখানে আর নয়। দেখছ না, আমরা আছি বলে এঁদের কথাবার্তার অসুবিধে হচ্ছে। তা দিদি, তোমাদের ওইসব জুয়োখলার জিনিসের ওপর আমাদের কোনো লাভ নেই। আমার বাবা আমাকে আশি ভরি সোনার গয়না দিয়েছিল, সেই আমার যথেষ্ট। আমি মলে অদ্দেক পাবে মণির বউ আর অদ্দেক পাবে নেপুর বউ। তা সেসব এমনি লুকিয়ে রেখেছি যে আমি নিজে বের করে না দিলে, চোররা কেন, এরাও তার সন্ধান পাবে না। হ্যাঁ।

এই বলে জেঠিমা আমাদের একরকম টানতে টানতে বাড়ি নিয়ে এলেন। আমার একটুও আসতে ইচ্ছে করছিল না। চোর ধরতে হলে কথায় কথায় রেগে অকুস্থল ছেড়ে চলে যাওয়াটাও কিছু কাজের কথা নয়।

বাড়ি এসে দেখি নেপুটা ভারি লাফাচ্ছে!

পুলিশের লোকেরা কিছু পায়নি, অথচ আমাদের অপূর্বদা কত হাড়গোড় সংগ্রহ করেছেন!

শুনে বেজায় হাসি পেল। তাও যদি নরকঙ্কাল হত! মুখে শুধু বললুম, রেখে দে তোদের অপূর্বদার আস্ফালন! কে ওখানে পিকনিক করেছে, তাই দেখে কর্তা নেচে-কুঁদে একাকার!

নেপু চটে লাল।

কেউ পিকনিক করে না ওই বনের মধ্যে। এটা তুই ভালো করেই জানিস। সবাই জানে ওখানে ভূতের ভয়। বাইরের লোক না হলে ওখানে কেউ খাওয়া-দাওয়া করবে না, এটা তুইও বেশ জানিস। ওসব তোর হিংসের কথা। তোদের লাবণ্যদিদির দিনই কাবার হয়ে যায় চোখে কাজল লাগাতে আর কপালে টিপ পরতে, ও আবার চোর ধরবে! জানিস, কাল সকালে পুলিশের সাহায্যে ওই বন গোরুখোজা করা হবে। সরু চিরুনি দিয়ে আঁচড়ানো হবে। ভূতের বাড়িটা পর্যন্ত একেবারে চষে ফেলা হবে!

বুকটা ধড়াস করে উঠল। কাল সকালে লাবণ্যদিদিদের সঙ্গে আমাদের ইস্কুলের দলও যে চোর। খুঁজতে বনে যাবে!

০৩.

ওই পাহাড়ে দেশের সে দারুণ শীতের কথা আর কী বলব! একেবারে হাড়ের ভেতরে ঢুকে যেত। রাত্রে শুতে যাওয়াই ছিল এক ব্যাপার! ঠান্ডার চোটে বালিশ বিছানা মনে হত ভিজে সপসপে। একটা গরম জলের ব্যাগ দিয়ে বিছানা গরম করে নিয়ে তবে-না শোয়া যেত। আর সকালে ওঠা? সে যে আরও কষ্ট। লেপের ভেতর থেকেই গরম জামা এঁটে, গরম মোজা পায়ে দিয়ে উঠতে হত।

ওদিকে সন্ধ্যে সাতটা না হতেই যেন দুপুর রাত! পথে-ঘাটে জনমানুষ নেই। আমাদের বাড়িতে ইলেকট্রিক আলো ছিল না। আমরা ছেলেপুলেরা এক ঘরে শুতাম আর তারি পাশের ঘরে জেঠিমারা শুতেন। মাঝখানকার দরজা খোলা থাকত, সেখানে টিমটিম করে একটা লণ্ঠন জ্বলত।

মাঝে মাঝে ভালো ঘুম হত না। জল তেষ্টা পেত। কিন্তু উঠতে যত-না শীত করত, তার চেয়ে বেশি ভয় করত।

অথচ নেপুর কাছে কিছু বলবার জো ছিল না, অমনি পরদিন তাই নিয়ে সব বাড়িয়ে বাড়িয়ে পাঁচরকম কথা বলবে। শেষে লাবণ্যদি লতিকাদিদের অবধি টেনে আনবে। কী দরকার বাবা।

সেদিন অনেক রাতে ঘুম ভাঙতেই দেখি ঘুরঘুট্টে অন্ধকার। আমার তো গায়ের রক্ত হিম। কান খাড়া করে থাকতাম। ওদিকে গলা শুকিয়ে তক্তা, জেঠিমাকে ডাকি কী করে?

তার ওপর মনে হল কারা যেন কাছেই কোথাও ফিসফিস করে কথা বলছে; কে যেন দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল, খস করে সরে গেল। কারা যেন বাড়ির আশেপাশে পা টিপে টিপে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

আর একটু হলে ভয়ের চোটে মরেই গিয়েছিলুম আর কী, এমন সময়ে ওধারের দরজা খুলে, লণ্ঠন হাতে জ্যাঠামশাই এসে ওঘরে ঢুকলেন।

জেঠিমা বললেন, ধরলে নাকি?

জ্যাঠামশাই যেন বিরক্ত হয়ে উঠলেন।

এ কি ক্রিকেট বল নাকি যে ধরব? না না, ওসব তোমার মিছে ভয়। ভজহরি এসেছিল, বললে আমাদের আপিসের পিন্টো সাহেবের বাড়িতে সার্চ হয়েছে। এদানীং যেসব জিনিস চুরি গেছে তার কোনোটাই পায়নি বটে, কিন্তু গত কুড়ি বছরের মধ্যে আমাদের আপিসের যা কিছু হারিয়েছে সব নাকি বেরিয়েছে।

জেঠিমা বললেন, তা ভজহরি এসেছিল কেন?

না, ইয়ে কী বলে, ওই পিন্টোর মেম একটু রাগী প্রকৃতির কি না, তাই সার্চ করতে যারা যারা গেছল, তাদের সবাইকে আইডিন লাগাতে হচ্ছে। কিন্তু ভজহরিরা তো অ্যালোপ্যাথিক লাগাবে না, তাই আমার কাছে এসেছিল আর্নিকা নিতে।

জেঠিমা নাক অবধি লেপ টেনে বললেন, শখও আছে বাবা! এই শীতে আর্নিকার খোঁজ কচ্ছে!

জ্যাঠাইমশাই জুতো ছাড়তে ছাড়তে বললেন, তোমার বাপের বাড়ির কেউ তো আর হোমিয়োপ্যাথির মর্ম বুঝল না, তাই ওইরকম বল। তবে এও আমি বলে রাখলাম, যদি ঠিক ঠিক ওষুধটি পড়ে, একেবারে ধন্বন্তরি!

এইরকম আরও কী কী সব কথাবার্তা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লাম।

কাল ছুটি। লাবণ্যদি লতিকাদি আমাদের দলের সাতজন খুব সাহসী মেয়ে নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে বেড়াতে যাবেন, একেবারে ভূতের বাড়ি অবধি দেখে আসবেন।

সকাল থেকে সবার মুখে পিন্টো সাহেবের পেজোমি ছাড়া আর অন্য কথা নেই। নেপুর সবটাতেই কিছু বলা চাই, এঘরে এসে বলল, আরে, শুধু পিন্টো কেন, অনেক ওস্তাদের বাড়ি সার্চ করলেই অনেক কিছু বেরুবে।

বলে এমন বিশ্রী করে হাসতে লাগল যে আমার আর বুঝতে বাকি রইল না যে লাবণ্যদিদিদের কথা বলছে।

তবু ওকে কিছু না বলে, মাকে বলে শংকরকে নিয়ে লাবণ্যদির বাড়ি চলে গেলুম।

কী সুন্দর বাড়ি লাবণ্যদির আর রেখেছেন কী চমৎকার করে সাজিয়ে! দরজা জানলায় গোলাপি পরদা, সিঁড়ির দু-পাশে ছোটো ছোটো টবে কত ফুল! সদর দরজা খোলা, ভেতরে বড়ো বড়ো দুটো পেতলের ফুলদানি চকচক করছে।

 আর লাবণ্যদি নিজেও যে কী সুন্দর দেখতে, সে আর কী বলব। মাথায় কত লম্বা, রংটা খুব ফর্সা না হলেও কেমন মোলায়েম, আর একমাথা কালো কোঁকড়া চুল। নীল একটা শাড়ি পরেছেন, কোমরে দিব্যি করে আঁচলটা জড়িয়েছেন।

আমাকে দেখেই বললেন, বাঃ, এসে পড়েছ, ভালোই হল! সেখানেই খাওয়া-দাওয়া হবে বলে এসেছ তো?

শংকরদা অমনি সর্দারি করে বলে উঠল, দিদিমণি কিন্তু মোটে ঝাল খায় না মা। ঝাল খেলেই দিদিমণির পেট

এমন রাগ হল, খুব কষে ধমক দিলুম, বললুম, আচ্ছা, আচ্ছা, তোকে আর এর মধ্যে নাক গলাতে হবে না। তোর এখানে আর থাকবার দরকার নেই, তুই বাড়ি যা।

কিন্তু সে কিছুতেই যেতে চায় না, মা নাকি সঙ্গে যেতে বলে দিয়েছেন। কী মুশকিল! আমাদের সঙ্গে বাইরের লোক গেলেই-বা চলবে কী করে? দেখলুম লাবণ্যদিদির কী বুদ্ধি! চট করে বললেন, তুমিও যাচ্ছ, ভালোই হল। আচ্ছা বেশ, তাহলে আমাদের দশ জনের খাবারের টিন আর জলের বোতলগুলো তুমিই বয়ে নিয়ে চলো।

তাই শুনে শংকরের সব উৎসাহ উড়ে গেল। সে বললে, না দিদি, আমার আবার পায়ে গুপো, অত পারবনি। তা ছাড়া আপনারাই যখন রইছেন, আমার আবার যাবার দরকারটা কী? বাড়িতে মেলা কাজও জমে রয়েছে।

কথা শেষ হবার আগেই শংকর রওনা দিল। লাবণ্যদিও খুশি হয়ে বললেন, দেখলে তো? ও ধমকধামকে কিছু লাভ হয় না, প্যাঁচ কষতে হয়।

তারপর আর কী! সবাই খেলার মাঠ পার হয়ে জঙ্গলের মধ্যে গিয়ে ঢুকলাম।

যেই-না ঢুকলাম অমনি চারদিক ছায়া-ছায়া ঠান্ডা-ঠান্ডা হয়ে গেল। নাকে কেমন একটা বুনো গাছপালার সোঁদা গন্ধ আসতে লাগল। অন্য আওয়াজ-টাওয়াজ সব কোথায় মিলিয়ে গেল, কানে আসতে লাগল শুধু বনের নিজের হাজাররকম সরসর, খসখস, মটমট, ঝিরঝির, ঝরঝর শব্দ।

কারো মুখে বেশি কথা নেই। প্রত্যেকেরই কাঁধে ঝোলানো একটা থলি, তাতে খাবার-দাবার, জলের বোতল, আইডিন, এই সব। সঙ্গে লতিকাদি, দেখতে লাবণ্যদির মতো সুন্দর না হলেও, দারুণ গায়ে জোর। শুনেছি একদিন রাতে ওঁর ঘরে চোর ঢুকেছিল, তাকে ছাতা দিয়ে এমনি পিটেছিলেন যে, চুরি তো সে করতে পারেইনি, উপরন্তু অন্য জায়গা থেকে আনা মেলা জিনিসপত্র ফেলে কোনোমতে পালিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছিল।

লতিকাদি আজ আবার সেই গল্প আমাদের বলে বললেন, ভাগ্যিস পালিয়েছিল ব্যাটা! নইলে সেদিন যা রেগে গেছলাম, একটা এসপার-ওসপার না করে ছাড়তাম না। সম্ভবত ওসপার। মেয়েরা, তোমরাও ওইরকম করবে। এখন নাও তো, প্রত্যেকে শক্ত দেখে একটা করে গাছের ডাল ভেঙে নাও তো। দেখাই যাক না, চোরদেরই একদিন, কী আমাদেরই একদিন।

তাই-না শুনে আমরাও আশেপাশের গাছ থেকে একটা করে নীচু ডাল ভেঙে নিয়ে, পাতাটাতা ছাড়িয়ে দিব্যি লগুড় বানিয়ে নিয়ে চললুম। ভাগ্যিস গুপেটা কাছে ছিল না, নইলে এই নিয়েই আবার কী না জানি বলত! হাড়গোড় ছড়ানো জায়গাটাও দেখলুম। ও বের করাতে অপূর্বার কোনো বাহাদুরি ছিল না, একেবারে পথের ওপর। কথাটা লাবণ্যদিকে না বলে পারলুম না।

জানেন লাবণ্যদি, ছেলেদের ইস্কুলের অপূর্বদা এই মুরগির হাড় দেখে কী যে কাণ্ড লাগিয়েছেন, সে আর কী বলব!

লাবণ্যদি ভুরু তুলে বললেন, অপূর্বদাটি কোন জন?

বললুম, ওই যে গুণ্ডা চেহারার গুঁফো লোকটা।

তাই শুনে মুখে রুমাল দিয়ে, লাবণ্যদি খুব খানিকটা হেসে নিলেন। সবসময় এত ভালো ব্যবহার করেন। আমরা আর রুমাল কোথায় পাই, মুখের ওপর হাত দিয়েই খুব হাসলাম।

হঠাৎ লতিকাদি ঠোঁটে আঙুল চেপে বললেন, শ—শ–শ! সাবধান! এই পথে খানিক আগেই অনেক লোক হেঁটে গেছে। ওই দেখো ঘাস মাড়ানো, এখন পর্যন্ত সব শুয়ে শুয়ে রয়েছে, খাড়া হবারও সময় পায়নি। ও বাবা! ওটা কী!

সমস্ত জঙ্গল কাঁপিয়ে একটা বিকট গমমম্ করে আওয়াজ হল।

লাবণ্যদির পর্যন্ত মুখ সাদা হয়ে গেল। কিন্তু কী সাহস তার! আমাদের বললেন, মেয়েরা, তোমরা আমার পেছন পেছন এসো। এ হয় বাঘ, নয় বন্দুক!

আমরা তখুনি লাইন বেঁধে, এর কাঁধে ও হাত রেখে এক জনের পেছন এক জন এগুতে লাগলাম। লতিকাদি সবার শেষে।

আবার গমগমমম করে আওয়াজ হল। লতিকাদি এক লাফে লাইনের শেষ থেকে মাঝখানে এসে ঢুকলেন। বললেন, শুনেছি সবার শেষেরটাকে সর্বদা বাঘ নেয়। আমায় নিলে, কে তোমাদের রক্ষা করবে?

মেয়েরা তখুনি ছত্রভঙ্গ হয়ে যাচ্ছিল। এমন সময় আমার চোখে পড়ল ঝোঁপের মধ্যে রামছাগলের পশ্চাদ্ভাগ।

ডালপালাতে শিং আটকে গেছে, লাফিয়ে ঝাঁপিয়েও কিছুতেই ছাড়াতে পারছে না, তাই হম্‌ম গমম্ করে ডাক ছাড়ছে!

মহা মুশকিল! কেউ ছাগলের কাছে যেতে চায় না। তখন লাবণ্যদি নিজের থলি থেকে মস্ত কলা বের করে, ছাগলের সামনে একটু তফাতে মাটির ওপর রাখলেন!

তাই দেখে রামছাগল এমনি জোরে এক ঝাঁপ দিল যে নিমেষের মধ্যে শিং ছেড়ে কলা সাবাড়! কী অদ্ভুত বুদ্ধি লাবণ্যদির!

আর একটু এগিয়েই দেখা গেল পথের মাঝখানে একটা পেন্টেলুনের বোতাম পড়ে। লতিকাদি বললেন, পুলিশদের বোতাম। তারা এর বেশি আর এগোয়নি।

লাবণ্যদি বললেন, নাও, ওটাকে যত্ন করে তুলে রাখো, একটু আগেই পড়েছে, পরিষ্কার ঝকঝক করছে, একটু শিশির পর্যন্ত লেগে নেই। তাই তো! বোতামটাকে তুলে যত্ন করে আমার থলিতে রাখলুম। বড়ো গোয়েন্দারা কখনো ছটো জিনিসকে অবহেলা করেন না।

তবে এও সত্যি যে আমার বুকটা একটু ঢিপঢিপ করছিল। আর আমাদের ক্লাসের মঞ্জির কথা আর কী বলব! ন্যাকার একশেষ! তার ওপর ওরা ভারি বড়োলোক, নিজেদের মোটর চেপে ইস্কুলে আসে বলে অহংকারে মাটিতে পা পড়ে না!

কত ঢঙ। রোজ নতুন নতুন শাড়ি পরা চাই, কানের গয়না বদলানো চাই, জুতোই আছে চার পাঁচ জোড়া!

আবার নিজে সঙ্গে করে টিফিন আনে না, ঠান্ডা খাবার খেতে নাকি ওর গা ঘিন্ ঘিন্ করে– কথাটা কাঁদের ঠেস দিয়ে বলা হত সে আর আমাদের বুঝতে বাকি থাকত না–ওর জন্যে রোজ একটা কোটপরা চাকর টিফিন ক্যারিয়ারে ভরে লুচি, চপ, সন্দেশ– এইসব নিয়ে আসে, আর ও আমাদের দেখিয়ে দেখিয়ে খায়! ঠিক হয়েছে! আজ জাদুকে নিজের খাবার নিজের কাঁধে ঝুলিয়ে, হাতে ডান্ডা নিয়ে, আমাদের সঙ্গে আসতে হয়েছে। তবু কিন্তু ন্যাকামির শেষ নেই!

উঃ! লতিকাদি! কী একটা আমার পায়ের ওপর দিয়ে সড়সড় করে চলে গেল যে!

আমি বললুম, ও কিছু না। সাপটাপ হবে-বা।

আর যায় কোথা!

ওঁ বাবা। ওঁ লাবণ্য দি!

বলে এক লাফে লাবণ্যদির পাশে। সেখানে আবার মাটিতে পা পড়বামাত্র ওরে বাবারে বলে সে কী চেল্লানি!

 কী জ্বালা! কী হল কী, তাই বল না!

 বলবে কী! ঠ্যাং চেপে মাটিতে বসে পড়েছে। আমরা অবাক হয়ে দেখি পা দিয়ে রক্তের গঙ্গা বয়ে যাচ্ছে। আর পায়ের ঠিক সেই জায়গাটার মাঝখানে একটা শিরার ওপর বিধে রয়েছে লাল-সবুজ পাথর-বসানো একটা সোনার পিন!

আমাদের কারো মুখে কথা নেই! ভয়ে ভয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলুম।

লাবণ্যদি কিন্তু তখুনি ওর পা থেকে পিনটা টেনে বের করে ফেলে, জায়গাটাকে বোতলের জল দিয়ে পরিষ্কার করে ধুয়ে, আইডিন লাগিয়ে, নিজের রুমাল দিয়ে বেঁধে ফেলেছেন।

অথচ তার কিছু দরকার ছিল না। আমাকে বললে, আমার সঙ্গে ব্যান্ডেজ ছিল, বেশ বেঁধে দিতে পারতুম।

আর মঞ্জির সে কী ঢঙ!

ও লাবণ্যদি, আপনি আমার পায়ে হাত দিলেন! দিন দিন আপনার পায়ের ধুলো দিন, নইলে আমার পাপ হবে!

ছোঃ! সাধে কি নেপুটা মেয়েদের ঘেন্না করে!

০৪.

যাই হোক, মঞ্জির পায়ে ব্যান্ডেজ বাঁধার পর আমরা সবাই লাবণ্যদিকে ঘিরে পিনটা দেখতে লাগলুম।

মোটেই পিন নয়, স্ক্রু-আঁটা একটা কানের ফুল; লাল-সবুজ পাথর থেকে আলো ঠিকরোচ্ছে।

আমরা বলতে লাগলুম, ইস্, এ-রকম তো কখনো চোখে দেখিনি! অমনি মঞ্জিটা বলে উঠল, ও আর এমন কী! আমার ঠাকুমার অমন মেলা আছে। তা ছাড়া হার আছে, বাজু আছে, রতনচূড় আছে, কানবালা আছে, বাউটি আছে–।

লাবণ্যদি কিছু না বললেও, লতিকাদি শেষটা বাধা দিয়ে বললেন, আচ্ছা, আচ্ছা ঢের হয়েছে, তোমাদের বড়োমানষির আর ফিরিস্তি দিতে হবে না!

আমিও আর থাকতে না পেরে বললুম, আমাদের বুড়ি ঝির-ও ও-রকম অনেক আছে।

অমনি লতিকাদি ধমক দিয়ে বললেন, তুমিও এবার থামো দিকিনি।

এতদিন পরে তবু চোরাই মালের একটা চিহ্ন পাওয়া গেল। আর একটা যখন পাওয়া গেল, বাকি বেরুতে কতক্ষণ! এসব ব্যাটাছেলেদের কম্ম নয়। আমার বাবাকে তো রোজ পাঞ্জাবির বোতাম খুঁজে দিতে হয়। অথচ তবু নেপুটার কী চাল!

সবাই বলতে লাগল, তা হলে অন্য জিনিসগুলোও কাছেই কোথাও লুকোনো আছে! এটা কী করে অসাবধানে পড়ে গেছে। ওই তো সামনে ভূতের বাড়ি, ওখানে থাকাও কিছুই আশ্চর্য নয়।

বিরাট বাড়ি। আশেপাশে বিশাল বিশাল শিশু গাছ। তাদের ঝোলানো পাতার ভেতর দিয়ে বাতাস বইছে– আর শিরশির করে শব্দ তুলছে। এখানে এত ঘন বন যে গাছের পাতার মধ্যে দিয়ে ভালো করে আলো আসে না, চারদিকটা সবুজ সবুজ, ভিজে ভিজে, গা ছমছম করে।

 বাড়িটাও প্রকাণ্ড, সারি সারি জানলার বেশির ভাগ ভেঙে ঝুলছে। দেওয়ালে পুরু হয়ে শ্যাওলা জমে গেছে, ফাটলে ফোকরে বেশ বড়ো বড়ো বট অশ্বত্থ গাছ গজিয়ে গেছে।

সদর দরজাটা হাঁ করে খোলা।

লাবণ্যদি সাহস দিয়ে বললেন, এত ভয়ও পাও তোমরা? আরে, এসব জায়গা তো পুলিশেই একবার দেখে গেছে। ওদের যত কাণ্ড, দরজাটাকে বন্ধ করে দিয়ে যায়নি পর্যন্ত। এখন ঘরে ঘরে বাঘ শেয়ালে আস্তানা গাড়ক।

লতিকাদি সবার পেছন থেকে বললেন, চলো, চলো, এত আস্তে কেন। ঘরের ভেতরেই নাহয় আরাম করে বসে খাওয়া-দাওয়া করা যাবে।

ঢুকে তো পড়লুম। খিদেও পেয়েছিল দারুণ। এঘর ওঘর করে খাবার জন্যে একটা ভালো জায়গা খুঁজে বেড়াচ্ছি, কেউ কেউ খিড়কিপুকুরে গেছে হাত-পা ধুতে।

হঠাৎ হাঁউমাউ! এ আবার কী জ্বালা! কে নাকি বারান্দার জমানো ধুলোতে পায়ের ছাপ দেখেছে। এমন ভীতুও হয় মেয়েরা!

লতিকাদি হঠাৎ দোতলায় ওঠবার সিঁড়ির কাছ থেকে সরে এসে বললেন, ওপরে লোক আছে।

আমরা তখুনি যে যাকে পারি জড়িয়ে ধরলুম। লাবণ্যদি বললেন, না, ও-রকম করলে চলবে কেন? চলো, ওপরে গিয়ে দেখে আসি। দেখতেই তো এসেছি।

গেলুম সবাই শেষপর্যন্ত। ওপরটা একটু আবছা মতন, জানলা অনেক বন্ধ রয়েছে। দুটো-একটা যা ভেঙে ঝুলছে, তারি মধ্যে দিয়ে একটু একটু আলো আসছে।

যেখানেই যাই, খালি মনে হয় একটু আগেই সেখানে কেউ ছিল, এখুনি সরে গেছে। যেদিকে তাকাই খালি মনে হয় সেদিক থেকে কেউ আমাদের দেখছিল, এখুনি চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে।

মাঝখানে একটা বড়ো ঘর, দু-পাশে দু-সারি খালি ঘর। তবু মনে হয় কেউ আমাদের আড়ালে রেখে রেখে, নিজে সরে থাকছে। সত্যি কথা বলতে কী, আমরা ভয়েই আধমরা, কারো মুখে কথাটি নেই।

হঠাৎ তাদের সঙ্গে একেবারে সামনাসামনি দেখা! নেপু আর তার অপূর্বদা। রাগে আমার গা জ্বলে গেল। অপূর্বদার পেছনে নেপুটা নিজের প্যান্ট আঁকড়ে কাচুমাচু মুখ করে দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখেই বলল, এই, সেপটিপিন আছে?

কতকটা তাই শুনে, কতকটা ভয় কেটে যাওয়াতে, মেয়েরা সবাই একসঙ্গে হিহি হোহোহা করে হেসে উঠল। আমার কিন্তু একটু মায়া করতে লাগল। একটা বড়ো সেপটিপিন দিলুম ওকে।

ততক্ষণে অপূর্বদা লাবণ্যদিদিদের সঙ্গে আলাপ পাকিয়ে নিয়েছেন– চালাক তো কম নন– এখন শুনলুম সব একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়ার কথা হচ্ছে।

শেষ অবধি দুদলে মিলে, সারাদিন ধরে সারা বাড়িটাকে তন্ন তন্ন করে খোঁজা হল, কিছু পাওয়া গেল না। কানের ফুলের কথা ওদের বলতে লাবণ্যদি মানা করে দিয়েছিলেন।

সন্ধ্যে লাগবার আগেই বাড়ি ফেরা হল। বাড়ি এসে শোবার ঘরে ঢুকেই, পকেট থেকে একটা জিনিস বের করে, পড়ার টেবিলের ওপর রেখে নেপু বললে, এই দ্যাখ, তোদের লাবণ্যদিদির কেরামতি দ্যাখ!

তাকিয়েই আমার পিলে চমকে গেল! টেবিলের ওপর আমাদের কুড়িয়ে পাওয়া সেই লাল-সবুজ পাথর-বসানো কানের ফুলটা জ্বলজ্বল করছে।

নেপুর হাত চেপে ধরে বললুম, বল শিগগির, কোথায় পেলি?

 নেপু বললে, কেন, ভূতের বাড়িতে কুড়িয়ে পেয়ে অপূর্বর্দার ব্যাগে রেখেছিলাম। তারপর খেয়েদেয়ে তোমরা যখন হাত ধুতে গেলে, তোমাদের পেয়ারের দিদিমণিটির ব্যাগ সার্চ করতে গিয়ে দেখি, যা সন্দেহ করেছিলাম ঠিক তাই। কখন ওটি অপূর্বদার ব্যাগ থেকে সরিয়ে নিজের থলিতে লুকিয়েছেন। আমি আবার ওটি উদ্ধার করলাম।

আমার হাত কাঁপছিল। চেঁচিয়ে বললুম, নেপু থাম!

বলে আমার থলি থেকে ওইরকম আরেকটা কানের ফুল বের করে সেটার পাশে রাখলুম। টেবিলের ওপর দুটিতে মিটমিট করতে লাগল।

নেপুর মুখটা বোয়াল মাছের মতো হাঁ হয়ে গেছে। অবাক হয়ে থেকে, শেষটা বললে, কোথায় পেলি রে?

বনের মধ্যে কুড়িয়ে পেয়েছিলুম। লাবণ্যদির থলিতে রেখেছিলুম। নিশ্চয় ওটি সরিয়েছিলেন। আমরা হাত ধুয়ে এলে পর, যখন তোরা হাত ধুতে গেলি, তখন অপূর্বর্দার ব্যাগ সার্চ করে আবার ওটি পেলুম। অপূর্বদা নিশ্চয় সরিয়েছিলেন।

খানিকটা চুপ থেকে আবার বললুম, অন্তত তাই তো মনে ভেবেছিলুম। এর মধ্যে কখন যে আবার জগদীশদার পিসিমা এসে পেছনে দাঁড়িয়েছেন তা টের পাইনি! হঠাৎ শুনি, ও মা! কোথায় যাব গো? এত ছোটো কিন্তু এত সাংঘাতিক কে জানত! আমরা বলি খাতায় লেখাচ্ছি। আর বনবাদাড়ে হাতড়ে মরছি, ওদিকে চোর বাছাধনরা ঘরের মধ্যে! ও শ্যামাদাস, ও হরিচরণ, ও বড়োবউমা, মেজোবউমা, কোথা গেলে সব, দেখোসে, কাণ্ড দেখে যাও!

মা জেঠিমা তখুনি দুড়দাড় করে ছুটে এলেন। পিসিমা কানের ফুল দুটোকে তুলে ধরে বার বার বলতে লাগলেন, ওমা, এই-না আমার মানিক-জোড়, এই-না আমার হারানিধি!

তারপর হঠাৎ এক হাতে নেপুর কান চেপে ধরে গর্জন করে উঠলেন, বল হতভাগা, কৌটো কোথায় রেখেছিস? ভালো চাস্ তো বল! উঃ, দেখে মনে হয় গাল টিপলে দুধ বেরুবে, এদিকে ভেতরে ভেতরে কালকেউটে!

কান ধরে ভীষণ এক নাড়া দিয়ে বললেন, দে শিগগির। নইলে আজ তোকে পুঁতেই ফেলব! এসব গয়নাপত্তরের জন্যে আমার পূজনীয় পিতৃদেব নরক ভুগছেন, তা জানিস্। ও কি আমি সহজে ছেড়ে দেব ভেবেছিস নাকি? বের কর বলছি– আঁক!

ইতিমধ্যে জেঠিমা হঠাৎ ছুটে এসে পিসিমার পিঠে বিরাশি ওজনের এক কিল বসাতেই, যেই না পিসিমা চমকে গিয়ে নেপুর কান ছেড়ে দিয়েছেন, অমনি নিমেষের মধ্যে সে তো হাওয়া!

আমি মাঝখানে পড়ে বার বার বলতে লাগলুম, ও জেঠিমা, ও পিসিমা, আমার কথা শোনোই-না, নেপু ওগুলো নেয়নি, আমরা কুড়িয়ে পেয়েছি!

কিন্তু কে কার কথা শোনে! জগদীশদা বোধ করি পিসিমার সঙ্গেই এসেছিল, ব্যাপার দেখে কেমন ঘাবড়ে গিয়ে এতক্ষণ কোনো কথাই বলতে পারছিল না। এবার ঢোক গিলে বললে, আঃ, পিসিমা! তুমি তো আচ্ছা ফ্যাসাদ বাধালে দেখছি! গুটে থেকে নেপু পর্যন্ত সবাইকে সন্দেহ করলে কী করে চলে!

কী কষ্টেই যে শেষ অবধি পিসিমাকে ঠান্ডা করা হল সে আর কী বলব।

নেপু সেই যে কেটে পড়ল আর তার দেখা নেই। শেষপর্যন্ত আমাকে সারাদিনের সব ঘটনা খুলে বলতে হল। মা পিসিমার হাতে কতকগুলো কচি কচি মটর শাকের গোছা গুঁজে দিতে দিতে বললেন, কী কী তোমার হারিয়েছে দিদি, বুঝলাম না। এই শুনি কৌটো গেছে, আবার এখন বলছ সোনার গয়নাও গেছে! কী জানি!

 পিসিমা মাথার ঘোমটা ফেলে দিয়ে সোজা হয়ে বসে বললেন, তবে কি আমি মিছে কথা বলছি নাকি, মেজোবউ? যার কৌটো গেছে তার কি গয়না যেতে নেই?

বলেই পিসিমার এমনি বুক ধড়ফড় শুরু হয়ে গেল যে তাকে ধরাধরি করে শোয়ানো হল আর শংকর ছুটে গিয়ে ওঁদের বাড়ি থেকে গুরুদেবের চরণামৃত এনে দিল তবে-না রক্ষে।

০৫.

সেকালে বড়োদিনের বারো দিন করে ছুটি থাকত। একে একে তার প্রায় সবগুলিই কেটে গেল। সে যে কী ভীষণ শীত সে আর বলা যায় না। দূরে দূরে পাহাড়ের মাথায় সাদা সাদা বরফ জমে থাকতে লাগল। ঘুম থেকে উঠে রোজ দেখতুম হিম জমে বরফ হয়ে গিয়ে চারদিক সাদায় সাদা। ছোটো ছোটো পাহাড়ে নদীগুলোর ওপর এক পরত বরফ খুদে খুদে ঢেউসুদ্ধ জমে রয়েছে।

তারপর একটু রোদ উঠলেই সব বরফ গলে যেত। তখন শুধু ডালপালা থেকে টুপটাপ জল পড়ত।

অন্য বছর এ-সময় অনেকেই পাহাড় থেকে নেমে যেতেন। চারদিক নিঝুম হয়ে যেত। আমরা ক-ঘর বারোমেসে বাসিন্দারা এখানে ওখানে টিমটিম করে বেড়াতুম। বিকেল হতে-না-হতেই সন্ধ্যে নেমে যেত, শীতের চোটে সবাই গিয়ে ঘরে উঠতুম।

এ-বছর কিন্তু সবই আলাদা রকমের হল। শহর ছেড়ে যেতে কাকেও অনুমতি দেওয়া হল না, পাছে সেইসঙ্গে চোরাই মালও পাচার হয়ে যায়।

গাছের পাতা সব লাল-হলুদ রং ধরে শেষটা খসে পড়ে গেছে। সবাই ছোটা ছোটো গোল গোল লোহার আংটা কিনে তাতে কাঠকয়লা জ্বেলে, সকাল-সন্ধ্যে হাত-পা সেঁকে আরাম করতে চায়।

এ-বছর আমাদের স্কুলের বোর্ডিং থেকে কেউ যাবার অনুমতি পায়নি। বাৎসরিক পরীক্ষাও হয়ে গেছে, নতুন বছরের পড়া শুরু হয়নি, কাজেই সবার হাতে দেদার অবসর। সেই সুযোগে এবার একটু আগে আগেই ইস্কুলের জন্মদিন করা হল।

খুব কষ্ট হল, শহরসুদ্ধ সকলের প্রায় নেমন্তন্ন হল, মেলা চাঁদা তোলা হল। বাইরে বড়ো ঠান্ডা, সেখানে কানাত ফেলে উৎসব করলে সকলে শীতে কষ্ট পাবে। তাই আমাদের মস্ত হল ঘরের স্টেজে লক্ষ্মীর পরীক্ষা অভিনয় হল।

হলের ও-পাশ দিয়ে একটা সরু লম্বা ঢাকা বারান্দা। তার অন্য মাথায় সাজের ঘর। দামি দামি কাপড়-চোপড়ে ঠেসে রয়েছে।

সেকালে ওখানে আর পোশাক ভাড়া করার ব্যবস্থা ছিল না, তা ছাড়া ভাড়াকরা পোশাক কেউ পরতও না। কাজেই যে যার বাড়ি থেকে ভালো ভালো সব গরদ, মাদ্রাজি, বেনারসি এনেছিল। অবিশ্যি গয়নাগাটি সব পেতলের আর কাচের। বাবা! ইন্দুদির ক্লাসের সেই ব্যাপারের পর থেকে কার বাড়ির লোকেরা আর মেয়েদের হাতে গয়না দেবে!

মঞ্জিরা কেউ কেউ বড়োমানষি দেখিয়ে জড়োয়া গয়না আনতে চেয়েছিল, কিন্তু ইন্দুদি তাই নিয়ে খুব রাগারাগি করাতে আর আনেনি।

সারাদিন ধরে ধুমধাম চলল। বেলা এগারোটা থেকে খেলাধুলো। বিকেলে বাগানে বক্তৃতা। লাবণ্যদি একটা সাদা রেশমি শাড়ি পরে ইস্কুলের জীবনী পাঠ করলেন। পরির মতো সুন্দর দেখাচ্ছিল। তারপর চা, মিষ্টি, কমলা লেবু খাওয়া হল। তখনকার দিনে জিনিসপত্র সস্তা ছিল। পয়সা পয়সা করে এই বড়ো বড়ো কমলা লেবু পাওয়া যেত।

নেপুদের দলও গেছল। ওদের অপূর্বদা দেখলুম সেজেগুঁজে এসে, গোঁফ নেড়ে নেড়ে লাবণ্যদির সঙ্গে ভারি ভদ্রতা করে এলেন! দেখেই আমার গা জ্বলে গেল। কানের ফুলের কথা এতদিনে পুলিশে ডাইরি পর্যন্ত হয়ে গেছে, তবুলজ্জা নেই। উলটে ওঁর দলের লোকেরা, অর্থাৎ নেপু ইত্যাদি বলে কি না, মেয়ে নইলে এত বোকা হয় কখনো, যে চুরি করবে এক জোড়া কানের ফুল, তার আবার একটা দুটো কোথায় পড়ে যাবে! আবার এসেছেন আমাদের ইস্কুলেই মুখ দেখাতে!

অভিনয় যেই-না শুরু হবার সময় কাছে এল, অমনি যে যেখানে ছিল সব হুড়মুড় করে গিয়ে জায়গা দখল করল। যারা জায়গা পেল না, তারা দেয়াল ঘেঁষে সারি সারি দাঁড়িয়ে পড়ল।

সকলের পরনে গরম জামা থেকে কেমন একটা ভিজে কম্বলের মতো গন্ধ বেরুতে লাগল। ভিড় আরও বেশি হত, কিন্তু প্রত্যেক বাড়িতেই দু-এক জনকে থেকে যেতে হয়েছে, পাহারা দেবার জন্যে।

সে যাই হোক গে, বিকেল থেকেই সাজঘরে মহা হইচই শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু যেই-না অভিনয় আরম্ভ হবে, আমাদের গানের ওস্তাদ সেতারে একটু টুং-টাং শব্দ তুলেছেন, অমনি সব ফাঁকা হয়ে গেল!

সবাই দৌড়োল রঙ্গমঞ্চের দিকে। উইংসের আড়াল থেকে, এদিক-ওদিক থেকে কেউ স্টেজ দেখছে, কেউ ভিড় দেখছে।

সাজঘরে রইলেন আমাদের বোর্ডিঙের বড়ো মাসিমা। ওঁর অভিনয় দেখবার এতটুকু আগ্রহ নেই। বলেন, কলকাতার বড়ো বড়ো থিয়েটারে কত নামকরা অভিনেত্রীদের দেখে এসেছেন, এখন আবার এসব কী দেখবেন!

দিব্যি বড়ো একটা আরামকেদারায় বসে, মোড়ার ওপর পা দুটি উঠিয়ে, নাকের ওপর চশমা লাগিয়ে, নাতনির জন্যে ক্রুশ দিয়ে লেস বুনতে লেগে গেলেন। ওদিকে কী হচ্ছে সে দেখবার বিন্দুমাত্র কৌতূহল নেই, মুখে গোটা দুই পান পুরে একমনে বুনছেন।

মিনিট দশেকও যায়নি, হঠাৎ মনে হল কে তাকে একদৃষ্টে দেখছে। চমকে যেইনা মুখ তুলেছেন, অমনি টুপ করে ঘরের আলো নিভে গেছে।

চ্যাঁচাবার জন্যে হাঁ করেছেন, অমনি কে একটা নতুন গামছা মুখের মধ্যে ঠুসে দিয়ে, মাথার চারদিকে দু-বার ঘুরিয়ে চেয়ারের পেছন দিকের সঙ্গে জড়িয়ে বেঁধে দিয়েছে।

বড়ো মাসিমার হাত-পা তো পেটের ভেতর সেঁদিয়েছে!

পরে সবাই মিলে জেরা করাতে বেরুল যে কেউ তাকে মারেনি, ছোঁয়নি। শুধু ভালো করে মুখ বেঁধে দিয়েছিল। পরে কে যেন গিঁটের ওপর একটু হাত দিতেই খসে পড়েছিল।

কিন্তু সে-সময় বড়ো মাসিমার মনে হয়েছিল দারুণ ষণ্ডা একটা লোক হাতে নিশ্চয় ঘন লোম, আর ওসবের লোকের সঙ্গে যে দু-দিকে ধার-দেওয়া বেঁটে ছুরি নেই, তাই-বা কে বললে!

মনে হয়েছিল সে একাও নয়, সঙ্গে হালকা ওজনের কে একটা ঘরময় ঘুর ঘুর করে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। হয়তো একটি ছোটো ছেলে। ডাকাতদের দলে নাকি ও-রকম থাকে একটা, তার কোমরে দড়ি বেঁধে, ফোকর-ফাটল দিয়ে ভেতরে গলিয়ে দেওয়া হয়, আর তারাও নিঃশব্দে গেরস্তর যথাসর্বস্ব পাচার করে দেয়।

লোকগুলো নাকি বড়োজোর ঘরে মিনিট পাঁচেক ছিল। তারি মধ্যে সব চেঁছেপুঁছে নিয়ে গেছে। একটু বাদেই মেয়েরা ড্রেস চেঞ্জ করতে এসে, বড়ো মাসিমাকে ওই অবস্থায় দেখে যত-না অবাক হল, কাপড়-চোপড় সব লোপাট হয়ে গেছে দেখে হাউমাউ করল তার চেয়ে বেশি!

আমার বন্ধু অনু সেজেছিল লক্ষ্মী। ভাগ্যিস প্রথম থেকেই তার মার বিয়ের বেনারসিখানা পরা ছিল, নইলে সেটিও যেত! আর আমরা ছিলুম কিনিবিনির দলে, অত পোশাক-আশাকের দরকারই ছিল না আমাদের; ক্ষিরি যখন ঝি তখন আমার ছেঁড়া চাদর জড়িয়ে; আর ক্ষিরি যখন রানি তখন চাদর খুলে লাল-নীল ঢাকাই কাপড়ে। কাজেই গেলুম বেঁচে।

কিন্তু মঞ্জি হয়েছিল ক্ষিরি। ওর বাবা সবচেয়ে বেশি চাঁদা দিয়েছিলেন, কাজেই আর কাকেও ক্ষিরি সাজানো যায় না। ওকে বারে বারে ড্রেস চেঞ্জ করতে হবে। পাছে কোনো গোলমাল হয়, তাই বোর্ডিং থেকে আলনা আনিয়ে, তাতে থাকে থাকে শাড়ি-জামা সাজিয়ে রেখেছিল। সে সব হাওয়া!

মঞ্জির বাড়িসুদ্ধ সকলের সে কী চাঁচামেচি!

পুলিশ এল। এসেই জগদীশদার পিসিমার কথায় গুটেকে খুঁজে বেড়াতে লাগল। কিন্তু সেও যে কোথায় গিয়ে গা ঢাকা দিল, তার আর কোনো পাত্তাই পাওয়া গেল না।

সবচেয়ে দুঃখিত হলেন লাবণ্যদি। গেটের কাছে কাঁদো কাঁদো মুখে বলতে লাগলেন, সবই আমার বুদ্ধির দোষে হয়েছে। সাজঘরের কাছে আরও লোক রাখা উচিত ছিল।

সবাই মিলে তখন তাকে নানাভাবে সান্ত্বনা দিতে লাগল।

হল না অভিনয়, যে যার বাড়ি ফিরে গেল কিন্তু সে রাত্রে ঘুমোয় কার সাধ্যি। পুলিশের খাতায় সবার নাম উঠেছে, বাড়ি বাড়ি সার্চ হচ্ছে।

জগদীশদাদের বাড়ি যখন গেছে, পিসিমা তাদের বেশ দু-কথা শুনিয়ে দিয়েছেন।

আসল চোরকে ধরবার নামটি নেই। আবার প্যান্ট পরে বেল্টএঁটে ভদ্দর লোকের বাড়ি গিয়ে গভীর রাতে হানা দাও ইত্যাদি!

জগদীশদা তো ভয়েই মরে, এই বুঝি পিসিমাকে ধরে নিয়ে যায়।

পরদিন বিকেলে বোর্ডিঙের বড়ো মাসিমা আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। জেঠিমার সঙ্গে ভারি ভাব। এসেই বললেন, দিদি, মনে যে কী দারুণ অশান্তি নিয়ে বেড়াচ্ছি সে আর কী বলব! সবকথা তো কাউকে বলিনি। ওই লোকগুলো খুব মন্দ নয়। যাবার সময় আমার কোলে এই দশটা টাকা ফেলে দিয়ে গেছল। গরিব মানুষ, হাতছাড়া করতে ইচ্ছে করছে না। নাতনিটার তো বিয়ে দিতে হবে।

এই বলে জেঠিমার সামনে দশটা টাকা রাখলেন। সাধারণ টাকা নয়, যদিও সেকালের টাকা এমন কিছু খারাপ ছিল না, রুপো দিয়ে তৈরি, বেশ ভারীই ছিল। এগুলো তার চাইতে অনেক বড়ো, খুব পুরোনো, কালো হয়ে যাওয়া, ওপরে মহারানি ভিক্টোরিয়ার ছাপ মারা।

 জেঠিমা অবাক হয়ে বললেন, আরে, এ তো যে-সে টাকা নয়। এ নিশ্চয় কারো জমানো টাকা হবে। এসব তো আজকাল চলবে না। ওরা এ কোথায় পেল?

চলবে না শুনে বড়ো মাসিমার মুখ ফ্যাকাশে।

মা বললেন, বাজারে না চললেও, ব্যাঙ্কেট্যাঙ্কে দিলে হয়তো এক টাকার জায়গায় পাঁচ টাকাই পাওয়া যাবে। এসব জিনিসের অনেক দাম। কোথায় পেল আমিও তাই ভাবি।

জগদীশদার পিসিমাও এসেছিলেন সেদিন, ঝুড়ি ঝুড়ি নালিশ নিয়ে। এতক্ষণ হাঁ হয়ে তাকিয়ে ছিলেন। হঠাৎ বলাকওয়া নেই, লাফিয়ে উঠে ঝড়ের মতো বেরিয়ে, সোজা বাড়ির পথ ধরলেন।

 পিসিমা চলে যেতেই, গোল গোল চোখ করে বড়ো মাসিমা জেঠিমাকে বললেন, তা দিদি ওনাকে আপনারা নিজের লোক মনে করতে পারেন। কিন্তু উনিও কিছু কম যান না। বলুন তো, অত সোনাদানা পেলেন কোথায় যে আজ কৌটো হারায়, কাল কানের ফুল হারায়? বাবার দেওয়া না হাতি! সে বুড়োকে আমার বেশ মনে আছে। আট হাত কাপড় পরে সারা শীতকাল কাটিয়ে দিত, নিরামিষ খেত, গয়লাকে পয়সা দিত না। ওর ঘরে অত সোনাদানা কেমন করে আসবে গা?

মা ব্যস্ত হয়ে বললেন, না না, উনি বোধ হয় খুব কিপটে ছিলেন। গয়নাগাটি তুলে রাখতেন, খরচপত্র করতেন না।

বড়ো মাসিমা তবু বলতে লাগলেন, বুড়ো চোখ বুজলে পর কাউকে ভালো করে ফলার করাল না পর্যন্ত। কোত্থেকে ওই জগদীশটাকে আনাল, শুনি নাকি ওর ভাইপো! কী জানি বাছা, কে যে চোর আর কে যে সাধু বুঝিনে।

মা আরও ব্যস্ত হলেন, দেখুন ওঁরা সত্যি ভালো লোক। কেবল যখন সাজঘরে অমন কাণ্ড হচ্ছিল, আমি নিজের চোখে দেখেছিলাম জগদীশ আর তার পিসিমা, আমার সামনে বসে জায়গা নিয়ে মহা খ্যাচাখেচি করছে! বিশ্বাস করুন ওঁরা এর মধ্যে নেই।

বড়ো মাসিমা উঠে বলেন, যাই, আমার আবার সন্ধ্যে বেলায় ডিউটি আছে।

দরজা অবধি গিয়ে আবার ফিরে এলেন।

ভাই, এই সন্ধ্যে বেলায় এখন আমার একটি একাটি টাকাগুলো নিয়ে যেতে ভয় করছে, তুমি বরং রেখে দাও।

মা যেন ঘাবড়াচ্ছেন দেখে, আমি বড়ো মাসিমার হাত থেকে টাকাগুলো নিয়ে আমার বইয়ের তাকে, বইয়ের পেছনে গুঁজে রেখে দিলুম।

বড়ো মাসিমা খুশি হয়ে বাড়ি চলে গেলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *