নেপোর বই – লীলা মজুমদার
এটা কিন্তু সত্যিকার নেপোর বই নয়। আসল বইটিকে নেপো নিয়ে চলে গিয়েছিল। পরে যখন পাওয়া গেল, দুমড়োনো, মুচড়োনা, আঁচড়ানো, কামড়ানো, খিমচোনো, কাদামাখা, গলো কালো থাবার দাগ লাগা, কোনো কাজেই লাগে না। কিছু পড়া যায় না, মাঝে মাঝে খোবলানো ছাদা। ভাগ্যিস তাতে কিছু লেখা ছিল না, নইলে হয়েছিল আর কী। শুধু মলাটটাই খোলা ছিল আর তাই দিয়েই গুপি এই বালি কাগজের খাতাটাকে বাঁধিয়ে দিয়েছে। হলদে মলাট, তার ওপর বেগনি কালি দিয়ে লেখা নেপোর বই। নইলে নেপো কিছু এমন সৎ বেড়াল নয় যে ওর নামে বইয়ের নাম রাখব। সৎ হলে আর ওর ল্যাজটা সে যাক গে। মোট কথা ভজুদা বলেছিলেন বইয়ের নাম রাখতে পানুপুরাণ।
আমার নাম পানু, আমার বয়স বারো। সাত মাস আগে বাস থেকে পড়ে গিয়ে আমার শিরদাঁড়ার হাড় জখম হয়েছিল। সেই থেকে আমি হাঁটতে পারি না। তবে একটু একটু করে গায়ে জোর পাচ্ছি আর ডাক্তারবাবু বলেন আমি নাকি চেষ্টা করলেইহাঁটতে পারব, কিন্তু আসলে তা পারিনা। আমার একটা দু-চাকাওয়ালা ছোটো গাড়ি আছে, দাদু করিয়ে দিয়েছেন, তাতে করে আমি বাড়িময় ঘুরে বেড়াই। তাতে বসেই আমি আমাদের তিন তলার ফ্ল্যাটের প্রত্যেকটি জানলা দিয়ে রাস্তা দেখি। তা যদি না দেখতাম তা হলে আর এ বই লিখবার দরকারই হত না। কিছু টেরই পেতাম না।
বেশিরভাগ সময় আমি নিজের ঘরে থাকি আর নিজের জানলা দিয়ে দেখি। আমার ঘরে দুটো। জানলা। একটার নীচে, বাইরে কার্নিসের উপর লম্বা টিনের টবে বড়ো মাস্টার আমাকে গাছ-গাছলা করতে শিখিয়েছেন। অদ্ভুত চেহারার সব কাঁটাগাছ, কী সুন্দর ফুল ফোটে। অথচ রোদ লাগলেও মরে না, গরমের সময়ও শুকোয় না। রোজ ভোরে ঘুম থেকে উঠে গুনে এক মগ জল দিতে হয়।
অন্য জানলার নীচে ভজুদার টব, তাতে ধনে পাতা, রসুন, কাঁচালঙ্কা, টোমাটো ফলাই। বড়ো মাস্টারের পোড়া বউও নাকি ওঁদের ছাদের কোণে জলের ট্যাঙ্কের পাশে গাছ গজায়, বেল, জুই, রজনীগন্ধা; কুমড়ো গাছে কুমড়ো হয়, মাটির হাঁড়ির তলা ফুটো করে তাতে পুঁই ডাটা হয়। বউকে কেউ নাকি চোখে দেখেনি। তবে দূর থেকে জানলা দিয়ে ওর ঘোমটাপরা মাথা দেখতে পাই। আগে নাকি বউ পরমাসুন্দরী ছিল, দূর থেকে লোকে তাকে দেখতে আসত। তারপর আধখানা মুখ পুড়ে কালি হলে পর আর কারো সামনে বেরোয় না। তাই নিয়ে বড়ো মাস্টার কত দুঃখ করেন। বলেন, সংসারের সব-ই অসার।
বড়ো মাস্টার প্রত্যেক রবিবার বিকেলে আমাকে গল্প বলতে আসেন। ওই সময় আমাদের বাড়ির সবাই বেড়াতে চলে যায়, খালি রামকানাই থাকে। সে আমাদের জন্যে চা আর মাছের কচুরি, মেটুলির ঘুগনি, এইসব করে দেয়। আটটার সময় বাড়ির লোকেরা ফিরে এলে, বড়ো মাস্টার বাড়ি যান।
পাশেই বাড়ি; আসলে ছাপাখানা। আমাদের বাড়ির গলি দিয়ে মাপলে আট ফুট তফাতে। একটা ঘোরানো লোহার সিঁড়ি ও-বাড়ির চার তলা থেকে পাকিয়ে পাকিয়ে এক তলা অবধি নেমে গেছে। সেটা থেকে মাপলে আরও কাছে। গুপি বলে আমাদের ঘোরানো সিঁড়ি থেকে রং মিস্ত্রিদের একটা তক্তা ফেলে ও নাকি ওদের ঘোরানো সিঁড়িতে গিয়ে উঠতে পারে। তবে বড়ো মাস্টার থাকেন পাঁচ তলার উপরে ছাদের কোণে দুটো ঘরে, ঘোরানো সিঁড়ি অত দূর ওঠে না। বড়ো মাস্টার ছাপাখানার ভিতরের সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামা করেন।
ওইখানে উনি প্রুফ দেখেন, তাই ঘর পান। সন্ধ্যে বেলায় ছাপাখানার বড়ো সাহেবরা চলে গেলে, তাদের গাড়ির শেডে মাস্টারের নাইট স্কুল বসে, তার জন্যে সামান্য মাইনে পান। কষ্টেসৃষ্টে দিন চলে, বড়ো মাস্টার বলেছেন। অথচ এককালে কী বড়োলোকমিটাই-না করেছেন। শুনে কষ্ট হয়।
রবিবার ছাড়া রোজ সকালে ভজুদা এসে আমাকে তিন ঘণ্টা পড়ান, আটটা থেকে এগারোটা। ক্লাসের বই নিয়ে ঠেসে পড়ান, ইংরিজি, অঙ্ক, বাংলা, ইতিহাস, ভূগোল, হিন্দি, স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান। কী জানেন ভজুদা। ছবি-দেওয়া মোটা মোটা বই এনে আশ্চর্য সব ছবি দেখান। মরুভূমির বালিতে চাপাপড়া হেলিওপোলিসের রাস্তার প্রাচীন কালের রথের চাকার দাগ, আরো কত কী!
ভজুদা খুব ভালো, কিন্তু বেজায় কড়া। আমি তো বাড়িতে বসেই বার্ষিক পরীক্ষা পাস করে উপরের ক্লাসে উঠেছি। এ-বছর সাতজন নতুন নতুন ছেলে ভরতি হয়েছে আমাদের ক্লাসে। তাদের কাউকে অবিশ্যি এখনও দেখিনি, গুপির কাছে সব খবর পেয়েছি।
গুপি আমার বন্ধু। প্রত্যেক রবিবার আর ছুটির দিনে সে আমাকে দেখতে আসে। বড়ো মাস্টারের গল্প শোনে, অদ্ভুত সব গল্প। ওঁর সত্যিকার অভিজ্ঞতার কাহিনি। বর্মার গল্প; প্রশান্ত মহাসাগরে আশ্চর্য সব দ্বীপের গল্প, যার কথা কেউ জানে না; সমুদ্রে ঝড়ের গল্প, জাহাজডুবির গল্প, যুদ্ধের গল্প, ভয়ংকর সব অগ্নিকাণ্ডের গল্প; উত্তর মেরু দক্ষিণ মেরুর কথা। মেক্সিকো, ব্লেজিল, কোথায় যাননি বড়ো মাস্টার, ব্যাবসার খাতিরে! তারপর বউ পুড়ল, মাস্টারের বাঁ ঠ্যাং কাটা গেল, ঘোঘারাঘুরি ঘুচল। একদিন যে মানুষ লক্ষ লক্ষ টাকার কারবার করত, আজ সে সামান্য কটা টাকার জন্যে সরকারি ছাপাখানায় কপালে এক জোড়া ম্যাগনিফাইং চশমা এঁটে প্রুফ দেখে আর সন্ধ্যে বেলা নাইট স্কুল চালায়।
এই অবধি বলে, পা ঠুকে বড়ো মাস্টার হেসে বললেন, তাতে কোনো দুঃখ নেই, একটু সময় পেলেই নিজের জীবনের সত্যিকার অভিজ্ঞতাগুলো লিখে ফেলব। প্রকাশকরা দু-পাতা পড়লেই লুফে নেবে। তখন আমার আবার লাখপতি হওয়া ঠেকায় কে! তোকেও কিছু টাকা দেব।
মাস্টারের বাঁ ঠ্যাং হাঁটুর নীচে থেকে কাটা। তার জায়গায় চামড়ার স্ট্র্যাপ আর বগলেস দিয়ে একটা কাঠের ঠ্যাং আঁটা। দেখতে অনেকটা টেবিলের পায়ার মতো। মাঝে মাঝে গল্প বলতে বলতে বেশি হাত পা ছুড়লে সেটা ফস করে বেরিয়ে আসে। অনেক কষ্টে আবার পরাতে হয়; আমরা সাহায্য করি, মাস্টার ঘেমে নেয়ে ওঠেন। নাকি বড় লাগে। অনেক দিন আগে নাকি প্রশান্ত মহাসাগরে বাকি পাটা হাঙরে খেয়েছিল। অনেক কষ্টে দু-মাইল সাঁতরে তবে প্রাণে বেঁচেছিলেন। তা-ও বাঁচতেন না; ভাগ্যক্রমে হঠাৎ শোঁ শোঁ করে সাইমুন ঝড় উঠল, তিন তলার সমান ঢেউ আছড়ে পড়তে লাগল! প্রাণের ভয়ে শিকার ছেড়ে হাঙর সমুদ্রের তলায় ডুব দিল। অবিশ্যি ঠ্যাংটা সঙ্গে নিতে ভুলল না। বড়ো মাস্টার খোলামকুচির মতো ঢেউয়ের সঙ্গে উঠতে পড়তে লাগলেন।
ভাগ্যিস একটা বড়ো তেল ট্যাঙ্কারের দয়ালু কাপ্তেন ঠিক সেই সময় তাঁকে দেখতে পেয়ে, পঞ্চাশ মণ তেল ঢেলে ঢেউ শান্ত করে, তাকে জাহাজে টেনে তুলেছিলেন, নইলে সেযাত্রা হয়ে গিয়েছিল আর কী! এ ঠ্যাংটা আসলে ওই জাহাজেরই রান্নাঘরের একটা ভাঙা টেবিলের পায়া। নাবিকদের দয়ার স্মৃতিচিহ্নস্বরূপে মাস্টার ওটাকে এখনও রেখেছেন। নইলে ছাপাখানার বড়ো সাহেবের চিঠি নিয়ে গেলে সস্তায়, এমনকী হয়তো বিনি পয়সাতেই, কত ভালো ভালো ঠ্যাং কিনতে পাওয়া যায়, অ্যালুমিনিয়মের কাঠামোর উপর রবার দিয়ে প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি। সত্যিকার পা থেকে দেখতে কোনো তফাত নেই। বরং ঢের ভালো, আলপিন ফুটলেও টের পাওয়া যায় না। তবে এই টেবিল-পায়ার ঠ্যাংটাই-বা মন্দ কি? বন্ধুদের দান!
এই বলে বড়ো মাস্টার আমার যন্ত্রপাতির বাক্স থেকে লম্বা একটা পেরেক নিয়ে কেঠো পায়ের গোড়ালির কাছে হাতুড়ি দিয়ে ঠুকে নিলেন। নাকি বোলতায় গর্ত করেছিল। পরে মাস্টার কেঠো পায়ের গুলির কাছে ছোটো একটা দেরাজ করে নেবেন; তাতে পয়সাকড়ি রাখবেন, কাকপক্ষীও টের পাবে না। যা পকেটমারের দাপট আজকাল! বড়ো মাস্টার চলে গেলে গুপি পকেট থেকে কাগজে-মোড়া একটা মলাট-ছেঁড়া বই বের করল। বইটার নাম পুষ্পক থেকে প্লেন। গুপির ছোটোমামার বই। অনেক কষ্টে জোগাড় করা। আশ্চর্য সব বই আনে গুপি। মঙ্গলের মানুষ, বুধে বিপত্তি, চন্দ্রনাথের চন্দ্রযাত্রা, এইসব। একটা টাইমমেশিনের বই এনেছিল; ওই মেশিনে চেপে অতীতে ভবিষ্যতে যে সময়ে ইচ্ছা যাওয়া-আসা যায়। পড়ে গায়ে কাঁটা দিয়েছিল। তা ছাড়া কলের মানুষের গল্প আনে, তাদের রোবো বলে।
এইসবই আমাদের ভালো লাগে। আমরা বড়ো হয়ে প্রথমেই চাঁদে যাব। গুপির ছোটোমামা নাকি চাঁদে জমি কিনবেন। সেখানে ছোটো একটা বাড়ি করবেন, তাতে মেশিনে রান্না হবে। তাহলে তো আমাদের সেখানে গিয়ে কোনো অসুবিধাই হবে না। খালি তার আগে আমার পা দুটোকে সারিয়ে নিতে হবে। এদিকে ছোটোমামা বি.এসসি. পাস করেই মহাকাশযান বানাতে শিখবেন। এখন থেকেই তার জন্যে টিন, অ্যালুমিনিয়ম, রবার, বন্টু এইসব জমাচ্ছেন।
০২.
এর মধ্যে আবার গুপির জন্মদিন করা গেল। আমার ঘরে; ভজুদা আর বড়ো মাস্টারমশাইকে নেমন্তন্ন করা হল। সেদিন ছিল রবিবার, আমাদের বাড়ির সবাই বিকেলে চা খাবার পর অন্যান্য রবিবারের মতো দাদুর বাড়ি চলে গেল। খুব ভালো চা হয়েছিল; কোকা-কোলা, ছাঁচি পান, মাংসের শিঙাড়া, আলু নারকেলের ঘুগনি, আইসক্রিম। গুপিদের বাড়িতে কারো জন্মদিন হয় না। গুপির দাদু বলেন জন্মদিন করলেই নাকি লোকেরা মারা যায়। অথচ ওঁরা কারো জন্মদিন করেন না, তবু ওঁদের পূর্বপুরুষেরা কেউ বেঁচে নেই। তার মানে জন্মদিন না করলেও লোকেরা মরে।
ভজুদার কাজকর্ম সেরে অনেক দেরি করে আসার কথা। প্রথমে গুপি এসেই চাঁদের যাত্রী বলে দু-টাকা দামের একটা চমৎকার বই আমার হাতে দিল। আমি ওই বইটা আর বালিশের তলা থেকে দুটো টাকা নিয়ে গুপিকে দিলাম। ওর জন্মদিনের উপহার। প্রথম পাতায় লিখে দিলাম, চাঁদের যাত্রীকে জন্মদিনে চাঁদের যাত্রী দিলাম, ইতি, চাঁদের যাত্রী। বেশ হল-না?
গুপির ঠাকুরদা এসব বইয়ের উপর হাড়ে চটা। তিনি একসময় জাহাজে চাকরি করতেন। গুপি বলে পৃথিবীতে হেন সাগরতীর নেই যেখানে ওর ঠাকুরদা যাননি। এমনসব অদ্ভুত জিনিস তাঁর নিজের চোখে দেখা যে তিনি আর কল্পনায় বিশ্বাস করেন না। অবিশ্যি অত বড়ো চাঁদকে কিছুকল্পনার জিনিস বলা যায় না। আবহমান কাল থেকে লোকে তাকে দেখে আসছে, তার টানে সমুদ্রে জোয়ার উঠছে; রাশিয়ানরা আমেরিকানরা সেখানে রকেট নামিয়েছে পর্যন্ত; এইসব ছবি দিয়েই চন্দ্রযাত্রী বইটার পাতার পর পাতা ভরতি। যেখানে গাড়ি-ঘোড়া নামানো যায়–আর রকেটকে গাড়ি-ঘোড়া ছাড়া আজকাল আর কী বলা যায়? যেখানকার ডাঙায় যন্ত্র নামিয়ে ফোটো তুলে পাঠানো যায়, সে এই পৃথিবীটার চেয়ে কোন দিক দিয়ে বেশি কাল্পনিক হল তা ভেবে পাওয়া যায় না। মোটেই পৃথিবীর সব জায়গার ফোটো তোলা হয়নি।
সমস্ত বইটা গুপি এরমধ্যে একবার পড়ে ফেলেছে। অদ্ভুত জীবনযাত্রা ওখানকার। নাকি মহাকাশ-ট্রাকে করে মাটি নিয়ে গিয়ে তবে ধান-গম ফলাতে হবে। তাও সম্ভবত মাটির নীচে খেত বানিয়ে। সূর্যর এমনি তেজ যে দিনের তাপমাত্রা + ২০০ ডিগ্রি আর রাতের–২০০ ডিগ্রি! সব ঝলসিয়ে জমিয়ে শেষ করে দেবে। যদি-না মাটির তলায় ফসল ফলানো হয়। এক ফোঁটা জল নেই, দু-ভাগ হাইড্রোজেন আর এক ভাগ অক্সিজেন মিলিয়ে জল তৈরি করতে হবে। সে একেবারে বোতলে-পোরা বিশুদ্ধ জল, খেলে কারো অসুখ করবে না। অক্সিজেনও ওখানে পাওয়া যাবে না, সম্ভবত হাইড্রোজেনও না। সব পৃথিবী থেকে নিয়ে যেতে হবে। বাঁচতে হলে সবাইকে বোতল-ভরা অক্সিজেন শুকতে হবে। গুপির ছোটো মামা তার মস্ত ব্যাবসা করে, দেখতে দেখতে ফেঁপে উঠবেন। আগেই বলেছি যারা প্রথম চাঁদে জমি কিনবে, গুপির ছোটো মামা তাদের মধ্যে একজন। এই ব্যাপারে তিনি আমেরিকায় এরই মধ্যে একটা দরখাস্ত পর্যন্ত দিয়ে রেখেছেন। প্যান্-আম্ নাকি টিকিট বিক্রি করবে।
অবিশ্যি ওঁদের বাড়িতে এ-বিষয়ে কেউ এখনও কিছু জানে না। কারণ গত বছর সামান্য কয়েকটা নম্বরের জন্যে বি.এসসি. পাস করতে না পারায়, বাড়িতে তাকে উদয়াস্ত যা নয় তাই শুনতে হয়। তাতে অবিশ্যি তার চাঁদের ব্যাবসা কিছু উঠে যাচ্ছে না, ছোটো মামা গুপিকে বলেছেন, পরে এরাই কত খোশামোদ করবে।
গুপি বইটাতে হাত বুলোতে বুলোতে বলল, আমরাও ওই ব্যাবসায় ঢুকে পড়ব। ছোটো মামার চাঁদের বাড়িতে থাকব, মেশিনের সাহায্যে ওর কাজ-টাজ করে দেব। তুই তো খুব ভালো মাংস রেঁধেছিলি সেবার যখন ডায়মন্ড হারবারে পিকনিক হয়েছিল। আর দ্যাখ, নেপাকেও নিয়ে যাওয়া যাক। দেখিস কেমন দেখতে দেখতে এই বিরাট বাঘের মতো হয়ে যাবে। ওখানে বাতাসের প্রেসার নেই বলে সবাইকে প্রেসার সুট পরতে হবে। নেপোকে পরাব না। বাতাসের চাপ না থাকায় ব্যাটা এই এত উঁচু হয়ে উঠবে, বেশ আমাদের বাড়ি পাহারা দেবে। ওদিকে প্যান্টের মধ্যে পুরে লুকিয়ে নিয়ে যেতে পারব, কেউ টেরও পাবে না। নইলে বেড়ালদেরও চাঁদে যেতে মোটা টাকা দিয়ে টিকিট কিনতে হবে।
বড়ো মাস্টার সঙ্গে করে তার নতুন ছোটো মাস্টারকে নিয়ে এসেছিলেন। রোগা, ফর্সা, খোঁচা খোঁচা দাড়ি, পাতলা চুল, নাকি সবে টাইফয়েড থেকে উঠেছেন। দু-জনে হাঁ করে গুপির কথা শুনছিলেন আর একটার পর একটা অনেকগুলো মাংসের শিঙাড়া খাচ্ছিলেন। ভজুদা তখনও আসেননি।
গুপি বলে চলল, ওখানে খুব রোবো ব্যবহার হবে। তারাই চাষ করবে, কারখানায় কাজ করবে। নইলে অত অক্সিজেন কে জোগাবে? তা ছাড়া রোবোদের খিদেও হয় না, অসুখও হয় না, ভারি সুবিধা। নইলে চাদে গোরু-মোষ নিয়ে গেলে, সেগুলো তো দেখতে দেখতে আট নয় ফুট উঁচু হয়ে উঠবে। তাদের খাবার জোগাতেই ট্যাক গড়ের মাঠ হবে। মাটির তলায় বাঁধা থাকবে, গোয়ালে অক্সিজেন ভরা থাকবে। রোবোরা তাদের দুইলে মন মন দুধ পাওয়া যাবে। কে জানে ছোটোমামাও হয়তো একটা গোরু কিনে ফেলতে পারে। পায়েস আর রসগোল্লা করাটা ইতিমধ্যে শিখে নিস, পানু।
বড়ো মাস্টার একটু চা খেয়ে গলাটা ভিজিয়ে এতক্ষণে কথা বললেন, অত অক্সিজেন কোথায় পাবে?
গুপি খুব হাসতে লাগল, ছোটোমামা বলেছে যেসব কারবন ডাই-অক্সাইড আমরা নিশ্বাস ফেলব, সেগুলোকে আবার অক্সিজেন বানাবার ব্যবস্থা হচ্ছে শিগগির। একরকম গাছের সাহায্যে।
নতুন মাস্টার এবার বললেন, কিন্তু বন্ধ বালতিতে দুধ দুইতে হবে, নইলে ছলকিয়ে সব বেরিয়ে আসবে। হাওয়ায় চাপ নেই তো!
বড়ো মাস্টার মাথা নাড়তে লাগলেন। উনিও গুপির ঠাকুরদার সঙ্গে একমত। এই পৃথিবীটারই সব কিছু দেখার সময় হয় না, তা আবার চাদে যাওয়া। গুপি বিরক্ত হয়ে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। আমি বললাম, চাদে যাওয়াটাই আসল কথা নয়, মাস্টারমশাই। চাঁদটা হবে একটা ছোটো স্টেশন। সেখানে মহাকাশের আপিস থাকবে; ওইখানে অন্যান্য গ্রহে যাবার টিকিট কাটা যাবে। কারখানা থাকবে, মহাকাশযান মেরামত হবে। চাদে আমরা চিরকাল থাকব না।
মাস্টারমশাই হঠাৎ গুপির দিকে তাকিয়ে বললেন, বর্মা গিয়েছ কখনো? গুপি মাথা নাড়ল। মাস্টার বললেন, আমি বর্মায় থাকতাম। সালওয়েন নদীর ধারে সেগুন কাঠের মস্ত ব্যাবসা ছিল। আমার বাবা অনেক টাকা করেছিলেন। আমাদের নিজেদের এরোপ্লেন ছিল, নৌকো ছিল, মাঝসমুদ্রে যাবার বড়ো বড়ো মোটরবোট ছিল। সমুদ্রের ঝড় দেখেছ কখনো?
গুপি একটা চেয়ারে বসে পড়ে, সেটাকে টেনে মাস্টারের খুব কাছে নিয়ে গেল। ততক্ষণে আমাদের খাওয়া শেষ হয়ে গেছে, বাড়ির সবাই দাদুর বাড়ি চলে গেছে। ক্রমে অন্ধকার হয়ে আসছে, তবুআমার ঘরে আলো জ্বালা হয়নি, ভজুদাও আসেননি, মাস্টার বললেন, একবার দারুণ ঝড়ে পড়েছিলাম। তখন আমার কুড়ি বছর বয়স। রেঙ্গুনের কলেজ থেকে সবে বি.এ. পাস করে বেরিয়েছি। মাঝিদের সঙ্গে মাঝসমুদ্রে মাছ ধরতে গেছিলাম। ওখানে ওরা প্রকাণ্ড সব মাছ ধরে, এক মন, দেড় মন, পর্যন্ত। সমুদ্রের জলটা এত পরিষ্কার যে অনেক নীচে অবধি দেখা যায়। কোথাও কোথাও তলা অবধি দেখতে পাচ্ছিলাম। হয়তো সমুদ্রের নীচে সেখানে চড়া পড়েছিল। সূর্যের আলো সেখানে ফিকে সবুজ হয়ে পৌঁছোচ্ছিল। দেখলাম বড়ো বড়ো সমুদ্রের আগাছা, জলের নীচে বালির উপর একটু একটু দুলছে। মাঝে মাঝে ঝাকে ঝাকে ছোটো রঙিন মাছের দল ভেসে যাচ্ছে। থেকে থেকে বড়ো বড়ো কালো ছায়ার মতো কী যেন এগিয়ে আসছে। তাই দেখে মাঝিরা কথা বন্ধ করে একেবারে চুপ; নোঙর-ফেলা নৌকোটাও স্থির, শুধু ঢেউয়ের দোলায় একটু একটু দুলছে। একবার মনে হল জলের নীচে মস্ত একটা চোখ আমার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। বুক্টা টিপ ঢিপ করে উঠল। গাটাও কেমন শিরশির করতে লাগল। তখনও আমার দুটো ঠ্যাং ছিল না। এখন আর কেয়ার করি না।
মাঝিদের দিকে তাকিয়ে দেখি, তারাও কেমন ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। নোঙর তুলে, ডাঙায় ফেরার দিকে তাদের মন। নাকি ঝড় উঠছে। দেখতে দেখতে হাওয়া পড়ে গেল, পশ্চিম দিকে মেঘ জমা হতে লাগল। তার পরেই সূর্যটা একেবারে মুছে গেল। দোতলার সমান উঁচু কালো ঢেউ আমাদের উপর লাফিয়ে পড়তে লাগল। ছোট্ট একটা খেলনার মতো আমাদের নৌকোও একবার ঢেউয়ের মাথায় ওঠে, তার পরেই ঝপাস করে পড়ে। মাঝিরা ওস্তাদ, তারা ঠিক হয়ে রইল। পরে জানতে পেরেছিলাম যে ঢেউয়ের ঝাপটা খেতে খেতে শেষপর্যন্ত তারা পরদিন ভোরে আধমরা অবস্থায় নিরাপদ ডাঙায় পৌঁছোতে পেরেছিল। কিন্তু ঝড়ের গোড়ার দিকেই একটা মস্ত ঢেউ আমাকে ভাসিয়ে নিল।
খানিকটা হাঁসফাঁস করলাম, তারপর আর কিছু মনে নেই। যখন জ্ঞান হল দেখি মহাসাগরের মাঝখানে একটা অজ্ঞাত দ্বীপের বালির তীরে পড়ে আছি। সে কী দ্বীপ! সত্যি বলছি তোদের, পৃথিবীতে যদি কোথাও স্বর্গ থাকে, তবে সে সেইখানে। মানুষের বাস নেই; বনমানুষেরা উঁচু গাছে রাত কাটায়। শিম্পাঞ্জিকে বনমানুষ বলে তা জানিস তো? আর গাছে গাছে যত ফুল তত ফল। কত যে পাখি তার ঠিকানা নেই। উড়ে এসে কাঁধে বসে, হাত থেকে ফল খায়। ঘাসের উপর খরগোশরা লাফিয়ে বেড়ায়, আমাকে দেখে এতটুকুও ভয় পায় না। দলে দলে হরিণ চরে বেড়ায়। গাছের কোটরে এত বড়ো বড়ো মৌচাক।
সারাদিন গাছের পাতার মধ্যে সমুদ্রের হাওয়ার শব্দ, পাখির গান, ঝরনার জল পড়ার আওয়াজ। চোখের সামনে ঝাঁকে ঝাঁকে প্রজাপতি ওড়ে; তার পিছনে হলদে বালির তীরে সমুদ্রের সবুজ ঢেউ সারাক্ষণ আছড়ে পড়ে।
মাস্টারমশাইয়ের কথা শুনতে শুনতে আমার চোখের সামনে থেকে অন্ধকারে-ভরা নিজের ঘরটা কোথায় মুছে গেল, ফুটপাথের চায়ের দোকানের ধোঁয়া ধোঁয়া গন্ধ আমার নাক অবধি পৌঁছোল না, গা শিরশির করতে লাগল। গুপি ব্যস্ত হয়ে বলল, তারপর সেখান থেকে ফিরে এলেন কী করে? কেন এলেন? ই-স্, সেখানে নিশ্চয় গাছে চড়লেই পাখির ডিম! আর হরিণ মারা আর খাওয়া। আচ্ছা, মাস্টারমশাই খরগোশের মাংসও–।
মাস্টারমশাই হঠাৎ কর্কশ গলায় বললেন, চুপ!– ঢিল ছুঁড়ে একটা সবুজ পায়রাকে জখম করেছিলাম। মাটিতে পড়ে সেটা ছটফট করছিল; চোখের কোনা দিয়ে একটু রক্ত গড়াচ্ছিল। অমনি শিম্পাঞ্জির দল আমার ঘাড়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, একটা নারকোল গাছের গুঁড়ি পড়েছিল, তাতে আমাকে চাপিয়ে, ঠেলে ঠেলে ঢেউ পার করে দিয়ে এল। ভাটার টানে কোথায় যে ভেসে গেলাম তার ঠিক নেই। ভাগ্যিস একটা জাপানি সদাগরি জাহাজের চোখে পড়ে গেলাম, নইলে সেযাত্রা হয়েছিল আর কী! মাস্টারমশাই হঠাৎ কাঠের পা ঠুকে উঠে পড়লেন।
গুপি বলল, এক্ষুনি চলে যাবেন না, মাস্টারমশাই, কী করে বর্মা ছেড়ে চলে এলেন, বউঠানের কী করে মুখ পুড়ল, সেসব কথা–
মাস্টারমশাই বেজায় রেগে গেলেন। আমাকে বললেন, তোরা বড়ো বেশি কথা বলিস। অন্য লোকের দুঃখ কষ্ট নিয়ে খুব মজা পাস, না?
আমি বললাম, না মাস্টারমশাই, না। আমাদেরও দুঃখ হয়, মজা পাই না।
মাস্টারমশাই বললেন, আচ্ছা আচ্ছা, থাক এখন। আরেক দিন বলব। উঠি। আমার নাইট স্কুলের ছেলেরা এক্ষুনি আসবে। মিটিং আছে। তলাপাত্র রইল, ওর সঙ্গে গল্প কর।
মাস্টারমশাই চলে গেলেই ছোটো মাস্টার মোড়া থেকে উঠে সেই চেয়ারে বসে বললেন, আমার কাছে মহাকাশযাত্রা সম্বন্ধে অনেক ভালো ভালো ইংরিজি বই আছে।
গুপি হঠাৎ মুখের উপর আঙুল রেখে বলল, চুপ করে শুনুন! ওইযে ঠক্ঠক্ঠক্ শব্দ শুনতে পাচ্ছেন না? স্পেসশিপ বানাচ্ছে।
ছোটো মাস্টার চমকে গিয়ে আর একটু হলে চেয়ার থেকে পড়ে যাচ্ছিলেন। আমি বললাম, আঃ গুপি! সবাইকে সব কথা বলা কেন?
কিন্তু ছোটো মাস্টারও কিছুতেই ছাড়বেন না, কী স্পেসশিপ, কে বানাচ্ছে বলতেই হবে! আমাকে না বলার কারণ নেই। আমি তো আর কাউকে বলতে যাচ্ছি না!
তখন আমি বললাম, সরকারি ছাপাখানার ওপাশে চার বছর ধরে ওই যে মস্ত বাড়িটা তৈরি হচ্ছে, গুপি বলে ওখানে মহাকাশযান তৈরি হচ্ছে।
ছোটোমাস্টার তো অবাক। সে কী? শুনলাম ওটা ঠান্ডাঘর। ওখানে আলু পেঁয়াজ জমা থাকবে। ও-পাশেই গঙ্গা। লম্বা চোঙাপথ দিয়ে একেবারে জাহাজের খোলে মাল বোঝাই হয়ে বিদেশে যাবে। বড়ো মাস্টার তো তাই বললেন।
গুপি কাষ্ঠ হেসে বলল, ঠান্ডাঘর করতে কখনো চার বছর লাগে?
০৩.
ঠিক এই সময় কলেজের বিকেলের ক্লাস সেরে ভজুদা এসে উপস্থিত হলেন। মুখে শুধু এক কথা। ওঁদের কলেজের প্রিন্সিপালের নতুন গাড়ি দিনদুপুরে, কলেজের গেটের ভিতর থেকে, একরকম দরোয়ানের নাকের ডগার তলা দিয়ে চুরি গেছে। এই অবধি শুনে ছোটো মাস্টার সুড়সুড় করে সরে পড়লেন। -বাবাও তখনি বাড়ি এলেন। সিঁড়িতে ছোটো মাস্টারের সঙ্গে দেখা।
ঢুকেই বাবা আমাকে বললেন, কে ওই স্লিপারি কাস্টমারটি? সোজা তাকায় না কেন?
মা-ও বললেন, যাকে তাকে ঘরে ঢোকাস নি বাবা, কতবার বলেছি।
আমি রেগে গেলাম, কিন্তু কিছু বলার আগেই গুপি আস্তে আস্তে বলল, না মাসিমা, উনি ভালো লোক, বড়ো মাস্টারমশাইয়ের নতুন অ্যাসিস্টেন্ট। ওঁর নাম তলাপত্র, এম. এ. পাস।
বাবা বসে পড়ে বললেন, কোত্থেকে ধরে আনে এসব লোক? যেভাবে মাথা নীচু করে পাশ কাটিয়ে হন হন করে নেমে গেল, আমি ভাবলাম নির্ঘাত কিছু সরিয়েছে। কেমন আছ, ভজু?
আমি বললাম, ভজুদাদের প্রিন্সিপালের নতুন গাড়ি হাওয়া।
বাবা চমকে উঠলেন! আরে, তোর মেজোকাকুর গাড়িও যে পোস্টাপিসের সামনে থেকে ঠিক সাত মিনিটের মধ্যে ডিস্যাপিয়ার্ড!
মা বললেন, কাল সন্ধ্যে বেলায় গেছে আর আজ দুপুরে চিড়িয়া মোড়ে পাওয়া গেল। সুখের বিষয়, পাঁচটা টায়ার, ব্যাটারি, যন্ত্রপাতির বাক্স আর হেডলাইট ছাড়া কিছু হারায়নি। থানার ওঁরা বলেছেন, পুরোনো হলে নাকি এইভাবে পাওয়া যায় আর নতুন হলে বেমালুম উধাও। আসবে ঠাকুরপো একটু বাদেই, তার কাছেই শুনো সব কথা।
বাবা কাষ্ঠ হেসে বললেন, স্রেফ বিদেশে পাচার। বিদেশ তো এখন বেশি দূর নয়। পদ্মাও পার হতে হয় না। তারপর ভজুদার কাছে শুনলাম যে এই গাড়ি চুরির ব্যাপারেও একটা ভালো দিক আছে। গড়ে নাকি এই কলকাতা শহর থেকেই রোজ একটা করে গাড়ি চুরি থানায় রিপোর্ট হয়। বেশ কয়েক হাজার বেকার লোক এই দিয়ে করে খাচ্ছে। সেটাকে খুব খারাপ বলতে পারলাম না। তবু একটু সাবধানে থাকাই ভালো। ভাগ্যিস দাদুর দেওয়া আমার এই দু-চাকার গাড়িটা তিনতলা থেকে নামে না। তবু আজ রাত থেকে ওটাকে আমার পায়ের বুড়ো আঙুলের সঙ্গে সুতো দিয়ে বেঁধে রাখব। এতটুকু টান পড়লেই চোর বাছাধন হাতে-নাতে ধরা পড়বেন। হতে পারে আমি চলতে পারি না, কিন্তু হাতে আমার খুব জোর। তা ছাড়া রাতে আমার ঘরে রামকানাই শোয়। সে রোজ ভোরে উঠে আদা দিয়ে ছোলা ভিজে খেয়ে, আধ ঘণ্টা বুকডন করে আর মুগুর ভাজে। খুব ঘামে।
গুপি বাড়ি যাবার জন্য উঠেছিল এমন সময় মেজোকাকু একজন মোটা বেঁটে লোককে নিয়ে উপস্থিত। লোকটাকে আগেও কাকুর বাড়িতে দেখেছি। ওঁর নাম নিতাই সামন্ত। ডাক নাম কানু। মেজোকাকু বলছেন নাকি উঁদে ডিটেকটিভ, ওঁর ভয়ে অনেক ঘাটে বাঘে গোরুতে একসঙ্গে জল খায়। গাড়ি চুরির কথায় বললেন, ওরা জানে না, কিন্তু ওদেরও এবার দিন হয়ে এসেছে। যে সে নয়, এবার বাছাধনরা বিনু তালুকদারের পাল্লায় পড়েছে। দিল্লির পুলিশের বিখ্যাত গোপন গোয়েন্দা বিনু তালুকদার। এদিকে অক্সফোর্ড থেকে বি.এ. পাস। নিজের চোখে না দেখলেও শুনেছি দেখে নাকি মনে হয় রোগা লিকলিকে নিরীহ মাস্টারমশাই, ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানে না। ওদিকে স্রেফ ম্যাজিশিয়ান!
গুপি বলল, ও মোটর চোরদের ধরে দেবে?
–দেবে না তো কী! তাদের ঘাঁটিসুদ্ধ বের করে দেবে। এবার আর ছাড়ান-ছোড়ন নয়। তালুকদার বলে গাড়িগুলো একবার গেল তো গেল! যতক্ষণ না চোররা ইচ্ছা করে পথের ধারে ফেলে রাখছে, ততক্ষণ তাদের কোনো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় না। তার মানে এইখানে এই কলকাতা শহরের মধ্যেই ওদের কোনো লুকোনো আস্তানা আছে। সেখানে চোরাই গাড়ির রং পালটানো হয়, নম্বর বদলানো হয়, চেহারা এমনি করে দেওয়া হয় যে তাদের আসল মালিকের নাকের সামনে দিয়ে চলে গেলেও মালিকরা টের পায় না। শুধু তাই নয়, যারা এই চোরাই ব্যাবসার পাণ্ডা তারাও ভোল বদলে এমনি ভালো মানুষ সেজে থাকে যে তাদেরও চেনা যায় না। এখানে ওখানে ভালো ভালো চাকরি-বাকরি করে, গাড়ি হাঁকায়। মাঝে মাঝে ওদের নিজেদের গাড়িও চুরি যাওয়া বিচিত্র নয়। একটা পান দিন তো।
এই বলে নিতাই সামন্ত খুব হাসতে লাগলেন। তারপর পান খেয়ে আরও বলতে লাগলেন।
এবার হয়েছে যেমন কুকুর তেমনি মুগুর। বিনুর দলের টিকটিকিরাও শহরের চারিদিকে চারিয়ে আছে। তাদের টিকিটি চিনবার জো নেই কারো। চোরাচড় ধরবার জন্যে তারা চোরছ্যাঁচড় সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে! একেবারে ওদের দলের ভেতরে সেঁদিয়ে তারা সমস্ত ব্যাপারটাকে নস্যাৎ করে দেবে!
মেজোকাকু জানলার কাছে দাঁড়িয়ে বললেন, এখানকার আশে-পাশেই কোথাও ওদের ঘাঁটি হয়তো। ওই তো গঙ্গার ঘাটে মালবোঝাই নৌকোর ভিড়। ওই কয়লা আর খড়ের তালের মধ্যে দিব্যি একটা করে আস্ত মোটর খুঁজে পাচার করে দেওয়া যায়। আরে, আমারই যে–এই অবধি বলে আমার আর গুপির দিকে তাকিয়ে মেজোকাকু চুপ করলেন।
নিতাই সামন্ত তাড়াতাড়ি বললেন, এইরকম জায়গাতেই আইনভঙ্গকারীরা থাকে! উঃ, তাদের মধ্যে দিব্যি আছেন, দাদা, জানলায় একটা শিক পর্যন্ত নেই!
বাবা একটু অপ্রস্তুত হলেন, ইয়ে তিনতলার উপর সে-রকম–
শুনে নিতাই সামন্তর সে কী কাষ্ঠ হাসি! ওই আনন্দেই থাকুন, স্যার! আপনার বাড়িটাকে চোরদের সোনার খনি বানিয়ে রাখুন! জানেন, ওরা টিকটিকির মতো দেয়াল বেয়ে ওঠানামা করে! ভাবলেও গায়ে কাঁটা দেয়। আচ্ছা ওই সরকারি ছাপাখানার শেডে ওরা কারা গুলতানি করছে?
আমি বললাম, বড়ো মাস্টারের নাইট স্কুলের ছাত্ররা রবিবার ওখানে মিটিং করে।
নিতাই সামন্ত তো অবাক! তাইনাকি! বাঃ, বেড়ে আছে তো, দিনের বেলায় ছাপাখানায় ভালো মাইনের চাকরি, তেওয়ারির দোকানে চার বেলা পাতপাড়া, সন্ধ্যে বেলায় মিটিং আর রাতে– এই বলে নিতাই সামন্ত উঠে পড়লেন।
মেজোকাকুও উঠলেন, চলি রে পানু, নিতাইয়ের আবার নাইট ডিউটি আছে।
ওঁরা দরজার কাছে যেতেই বাবা গুপিকে বললেন, কী রে, তোর বাড়িঘর নেই নাকি? যা, ওদের সঙ্গেই যা। তারপর দমাস দমাস করে আমার জানলা দুটো বন্ধ করে ছিটকিনি এঁটে দিলেন। হাসি পেল। যে-কেউ ইচ্ছা করলেই পাশের বাড়ির ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে রাস্তা থেকে উঠে এসে, একটা তক্তা ফেলে আমাদের ঘোরানো সিঁড়িতে উঠতে পারে। রাতে রান্নাঘরের দরজা বন্ধ থাকে বটে, কিন্তু কার্নিশ দিয়ে দু-হাত হাঁটলেই আমাদের পিছনের বারান্দায় ওঠা যায়। তারপর দরজার খড়খড়ির ভিতর দিয়ে হাত গলিয়ে খাবার ঘরের দরজা খুলে ফেলা যায়। রামকানাই নিজে একবার দেরি করে ফেলে, বাইরে বন্ধ হয়ে গিয়ে ওইরকম করে এসেছিল।
পরদিন ভজুদার কাছে কথাটা তুলোম, ভজুদা, রাতে রোজ ঠক ঠক শব্দ শুনি।
ভজুদা চোখ পাকিয়ে বললেন, ভূতে বিশ্বাস আছে নাকি?
-না না, ভূত না, কিন্তু কিছু হয়তো তৈরি হচ্ছে ওখানে।
–কোথায়?
–ওই ছাপাখানার পিছনে, নতুন ঠান্ডাঘরে।
–ও তো এখনও শেষই হয়নি। সব বিষয়ে যুক্তি দিয়ে ভাবতে চেষ্টা করবে।
–না ভজুদা, ভিতরটা হয়ে গেছে, শুধু সামনের দিকটাই চার বছর ধরে তৈরি হচ্ছে। গুপি বলে–।
ভজুদা বললেন, লেখো, একটা বাঁদর একটা তেলতেলা বাঁশ বেয়ে এক মিনিটে কী হল?
–ভজুদা, বড়ো মাস্টারমশাই নাকি ভূত দেখেছেন। এখানে সব্বাই ভূতের ভয় পায়। সন্ধ্যার পর কেউ ঘাটের গলির দিকে যাবে না। রেলের লাইনে পা দেবে না। রামকানাই বলেছে রাতে ও-লাইনে যেসব গাড়ি আসে, তারা কোনো মালগুদোম থেকে আসে না।
ভজুদা বিরক্ত হয়ে উঠলেন, তাহলে কি বুঝতে হবে যে শুধু মানুষগুলো মলেই ভূত হয় না, রেলগাড়িদেরও ভূত হয়? নাও, চটপট অঙ্কটা টুকে ফেলো। তা ছাড়া একটু হাঁটাচলা করতে অভ্যাস করো এবার। যত সব আজগুবি চিন্তা! ভূতফুত নেই। এক্সারসাইজ করলেই টের পাবে।
অঙ্ক কষা হয়ে গেলে বললাম, আচ্ছা, ভূত না থাকতে পারে, কিন্তু তাই বলে যে কেউ লুকিয়ে স্পেসশিপ বানাবে না, তাই-বা কী করে বলা যায়?
ভজুদা অবাক হয়ে আমার দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে রইলেন। তারপর বললেন, এ বিষয়ে কয়েকটা বৈজ্ঞানিক বই এনে দেব। তাহলেই বুঝবে যে স্পেসশিপ চাট্টিখানিক কথা নয় যে গুদাম ঘরে লুকিয়ে বসে রাতে হাতুড়ি পিটে অমনি বানানো যাবে। আর বড়ো মাস্টার ভূত দেখেছেন না হাতি দেখেছেন। ওসবে কান দিতে হয় না। ভজুদা চলে গেলে মনে হল কথাটা না তুললেই পারতাম। গুপি বারণ করেছিল।
সব শুনে, পরের রবিবার বড়ো মাস্টার বললেন, ভূত নেই বলেছে ভজু? চব্বিশ বছর বয়স হতেই সব জেনে ফেলেছে নাকি? আমার আটষট্টি বছর বয়স। যতই দিন যায় ততই বুঝি কিছুই জানা হয়নি, আসল জিনিসই সব বাকি আছে। শোন তবে। জয়ন্তিয়া পাহাড়ের নাম শুনেছিস? এখনকার জয়ন্তিয়া কীরকম জানি না, কেঠো পা নিয়ে কোথায়ই-বা যেতে পারি বল? তবু মনে হয় মাঝে মাঝে দুটো পায়ের তলায় যেন জয়ন্তিয়া পাহাড়ের স্প্রিংয়ের মতো ঘাস এখনও টের পাই। মাইলের পর মাইল শুধু ঘাস আর বড়ো বড়ো পাথর। পাথরের যে দিকটাতে রোদ পড়ে না, সেদিকে নরম নরম শ্যাওলা হয়ে থাকে। তাতে শীতের আগে ছোট্ট ছোট্ট হলদে আর গোলাপি ফুল ফোটে, খুদে খুদে ফল ধরে। ঘাসজমির পাশেই হয়তো বাঁশ বন। সে-রকম বাঁশ বন তোরা দেখিসনি। গাঢ় কালচে সবুজ, আমার পায়ের তিনগুণ মোটা গুঁড়ি থেকে সরু হতে হতে ষাট ফুট উঁচুতে উঠে, কচি কলাপাতা রঙের একগুছি পাতা আর কড়ে আঙুলের মতো সরু একটা কুঁড়িতে গিয়ে শেষ হয়েছে। গুঁড়ির পায়ে পুরু একটা খাপের মতো জড়ানো। তাতে মিহি রোঁয়া, ছুঁলেই আঙুলে লেগে যায় আর জ্বালা করতে থাকে। তার পাশে দিনরাত ঝর ঝর করে পাহাড়ের অনেক উঁচু থেকে জল পড়ে।
পাহাড়ের উপরে দেবদারুর বন। একবার আমার বন্ধু হরিদাস আমাকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিল। সবুজ পায়রা শিকার করার ইচ্ছা তার। ওখানকার লোকরা অনেক বারণ করেছিল, ও পাহাড়ে নাকি কেউ চড়ে না; পাহাড়ের দেউ ভারি রাগী; কেউ তাঁর জানোয়ার মারলে তাকে নাকি হাতে-নাতে সাজা দেন। জিনিস বইবার জন্যে পর্যন্ত একটা লোক পাওয়া গেল না। শেষটা নিজেরাই ব্যাগে করে খাবার, জলের বোতল, টোটা আর কাঁধে বন্দুক নিয়ে চললাম। সারাদিন ঘুরে ঘুরে একটা চড়াই পাখি পর্যন্ত দেখতে পেলাম না। হরিদাসের কী রাগ। এ বনে জানোয়ার গিজগিজ করে, পাহাড়ের তলা থেকে ঝাকে ঝাকে সবুজ পায়রা উড়তে দেখা যায়, অথচ একটা কাঠবেড়ালি পর্যন্ত দেখা গেল না। বিরক্ত হয়ে আমাকে বলল, তুমি বড়ো খড়মড় করে হাঁট, তারিশব্দে জানোয়ার পালায়। শেষে ক্লান্ত হয়ে বনের মধ্যে ছোটো একটা ঝিলের ধারে বসে খাওয়া-দাওয়া করলাম। তারপর হরিদাস শুয়েই ঘুমিয়ে পড়ল। আমার কেমন বুকে ঢিপঢিপ করছিল, চোখে আর ঘুম আসছিল না।
এখানে বনের গাছগুলো যেন অন্য ধরনের, বড়ো বেশি ঘন, পাতাগুলো বড়ো বেশি বড়ো। হঠাৎ চমকে দেখলাম বড়ো বড়ো গাছের গুঁড়ির সঙ্গে মিলিয়ে আছে অনেক হাতির পা; তাদের মস্ত কান নাড়াও দেখতে পেলাম। তাকিয়ে তাকিয়ে আমার গায়ে কাঁটা দিতে লাগল। জঙ্গলের ভেতরকার অন্ধকারে যেই চোখ সয়ে গেল, দেখি হাজার হাজার জানোয়ারের ভিড়, ছোটো বড়ো মাঝারি, বাঘ, ভালুক, হরিণ, ভাম, খরগোশ। গাছের ডালে ডালে পাখি। অথচ এতটুকু শব্দ নেই। হাতি দেখেই বন্দুক তুলে নিয়েছিলাম। এবার সেটা হাত থেকে খসে ঝিলের জলে পড়ে গেল। চারদিকে কেমন একটা থমথমে ভাব। তারি মধ্যে হরিদাস উঠে বসে, পাগলের মতো এপাশে-ওপাশে তাকিয়ে দেখে, বন্দুক সেইখানেই ফেলে রেখে উলটো দিকে টেনে দৌড়। ওই যে একটু শব্দ, একটু নড়াচড়া, অমনি দেখি চারদিক ভো ভা, কেউ কোথাও নেই। আমার শরীর কাপছিল, তবু এক-পা দু-পা করে বনের মধ্যে গিয়ে ঢুকলাম। গাছের নীচে পা দিতেই একটু হাওয়ায় ডালপালা দুলে উঠল আর আমার গায়ে মাথায় টুপটাপ করে সাদা সাদা বড়ো বড়ো ফুল। ঝরে পড়তে লাগল। অমনি আমার সব ভয় দূর হল। দেখলাম বনের মধ্যে একেবারে অন্ধকার নয়, গাছের ফঁক দিয়ে পড়ন্ত রোদ ঢুকছে। কী জানি মনে হল, দু-মুঠো ফুল কুড়িয়ে, বনের দেউকে মনে করে একটা গাছের গুঁড়িতে ছড়িয়ে দিলাম।
তারপর লম্বা লম্বা পা ফেলে পাহাড় থেকে নেমে এলাম। কত হরিণ, কত পাখি, কত সবুজ পায়রা দেখলাম, দিনের শেষে বাসায় ফিরছে। ডেরায় ফিরতেই দেখি হরিদাস তল্পিতল্পা বেঁধে যাবার জন্যে তৈরি। বললে, জায়গাটা সত্যি ভালো না! সেইদিনই ফিরে এলাম।
মাস্টারমশাই থামলে গুপি বলল, এ আবার কীরকম ভূতের গল্প?
বড়ো মাস্টার হেসে বললেন, ভূতের গল্পের আবার এ-রকম সে-রকম হয় নাকি? যেমন দেখেছিলাম, বললাম। তলাপাত্রকে কেমন লাগল?
আমি বললাম, ভালো। কিন্তু বাবা বললেন সোজা তাকায় না কেন? মা বললেন– যাকে-তাকে ঘরে ঢুকতে দিস না। আচ্ছা, মাস্টারমশাই, আমার পা দুটোতে কি কোনো তফাত দেখতে পাচ্ছেন? আমি স্বপ্নে খুব দৌড়োই।
মাস্টারমশাই বললেন, সে আর এমন কী। আমার নেই-পাটাতে যখন চুলকোয়, তখন কী করে আরাম পাই বল দিকিনি?
গুপি তখন কথা পালটে বলল, জানেন মাস্টারমশাই, মহাকাশযানগুলো যখন অনেক উপরে, অনেক দূরে চলে যায় তখন আর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি কাজ করে না। কোনো জিনিস নীচের দিকে যায় না, সব উপরে উঠতে থাকে। আমার চন্দ্রযাত্রার নতুন বইটাতে আছে যাত্রীরা যদি নানান উপায়ে নিজেদের নীচে আটকিয়ে না রাখে, তাহলে সবাই বেলুনের মতো উড়ে আকাশযানের ছাদের কাছে ঝুলে থাকবে।
বড়ো মাস্টার মহাকাশযাত্রার কথা শুনলে চটে যান। বিরক্ত হয়ে বললেন, নিশ্বাস ফেলবার বাতাস নিয়ে যেতে হয়-না বোতলে ভরে? যাত্রীরা উড়ে বেড়াবার জায়গা কোথায় পাবে?
গুপি বলল, আমার চন্দ্রযাত্রার বইয়ের লোকরা একরকম আগাছা নিয়ে গেছিল, তারা যাত্রীদের নিশ্বাস-ফেলা কার্বন ডাই-অক্সাইডগুলোকে আবার অক্সিজেন বানিয়ে দিত। ওই আগাছার নাম ডাক-উইড। বোতলে করে কত বাতাস নেবে? আর শুধু চাদে গেলেই তো হল না, চাঁদটা খালি একটা টিকিট কাটার স্টেশনের মতো।
বড়ো মাস্টার উঠে পড়ে, ঠুক ঠুক করে কাঠের পা ঠুকতে ঠুকতে যেই এক পা পেছু হটেছেন অমনি ই–য়া–য়া–ও করে সে কী বিকট চিৎকার! তাকিয়ে দেখি কেঠো পা ঠিক পড়েছে নেপোর বেঁড়ে ল্যাজের ডগায়! পাটা তুলতেই এক ঝিলিক বিদ্যুতের মতো নেপো জানলা টপকে ধনে পাতার গাছ মাড়িয়ে কার্নিশ পেরিয়ে, পাশের ফ্ল্যাটের কালো মেমের জানলা গলে হাওয়া!
মাস্টারমশাই কাঁপতে কাঁপতে আবার চেয়ারে বসে পড়লেন। মুখটা একেবারে সাদা, চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে, ভাঙা গলায় বললেন, নেপোর গলা থেকে ওই শব্দ বেরুল! আশ্চর্য! ওকে একটু ধরা যায় না?আর ধরা! ততক্ষণে মেমের রান্নাঘর থেকে ঝনঝন কাঁও ম্যাও, তারপর সব চুপ।
০৪.
তার পরের রবিবারে গুপি এসেই বলল, একটা মুশকিল হচ্ছে স্পেস-স্টেশনটাকে নিয়ে। ছোটোমামা বলছে নাকি মাধ্যাকর্ষণের এলাকা ছাড়বামাত্র ওটাকে তিন সেকেন্ডে এক বার করে পাক খেতে হবে। নইলে ধপাস করে পড়ে যাবে। তা হলে তো জিনিসপত্র ভেঙেচুরে মাথায় মাথায় ঠোকাঠুকি খেয়ে একাকার হবে। মহাকাশযানগুলোই-বা সারানো হবে কী করে? আমি আঁতকে উঠলাম।
অ্যাঁ, তাহলে আমাদের বাতাসের বোতলের ব্যাবসার কী হবে? ডাক-উইড দিয়ে যে অক্সিজেন তৈরি হবে তাকে রাখব কীসে?
গুপি বিরক্ত হয়ে বলল, এই বিদ্যে নিয়ে হয়েছে তোর চন্দ্রযাত্রা! বাতাসের বোতল পাতলা প্লাস্টিকের হবে, তাও জানিস না? কাচ তো বেজায় ভারী। কিন্তু মিনিটে কুড়ি বার ঘোরালে বাতাস থেকে মাখন-টাখন না উঠলে বাঁচা যায়। ছোটোমামা এই নিয়ে এত বেশি ভাবছে যে এবারও পরীক্ষায় কী হয় কে জানে।
ছোটো মাস্টার সেদিন আগেই এসেছিলেন। জানলার ধারে দাঁড়িয়ে ধনে পাতা চিবুচ্ছিলেন আর তেওয়ারির দোকানের বুড়িকে অবাক হয়ে দেখছিলেন। এবার তিনি হঠাৎ পকেট থেকে সবুজ মলাটের একটা বই বের করে বললেন, ছোটোমামাকে ভাবতে বারণ কর। বরং পড়াশুনো করুক। এই বইতে লেখা আছে কী করে কলকজার সাহায্যে বাইরের খোলটা পাক খাবে, অথচ ভিতরকার জিনিসপত্র শূন্যে ঝুলে থাকবে, এতটুকু নড়বে না। এই দেখ ছবি, এই লোকগুলো সাত ঘণ্টা পাক খেয়েছে, মাখন-টাখন কিচ্ছু ওঠেনি।
তারপর গুপি আমার দিকে ফিরে বলল, ও কী, তোর চোখ লাল কেন?
রামকানাই মাছের কচুরি এনেছিল। আমার গোল টেবিলে সেগুলোকে নামিয়ে রেখে, ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলল, লাল হবে না তো কী। দু-দিন ধরে পাতি বেড়ালের শোকে কান্নাকাটি হয়েছে যে!
তাই শুনে গুপি আর ছোটো মাস্টার দু-জনেই অবাক। সে কী! নেপোর সাংঘাতিক কিছু হয়েছে নাকি? রামকানাই বলল, হবে আবার কী! পেয়ারের বেড়াল হাওয়া। আজ তিন দিন সে বাড়ি আসেনি।
ছোটোমাস্টার বললেন, গেল কোথায়?
শুনে রামকানাইয়ের কী হাসি! গেছে কার বাড়ির পাতকুড়ুনি খেতে।
ভারি রাগ হল। চেঁচিয়ে বললাম, মোটেই না। নেপো কারো পাতকুড়ুনি খায় না। বিদঘুঁটে ওকে ভুলিয়ে নিয়ে গেছে।
ছোটো মাস্টার বললেন, বিদঘুটে আবার কে? আমি কিছু বলার আগেই রামকানাই সর্দারি করে বলল, ওই যে নটে-কান কেঁদো হুলো তা ছাড়া আবার কে! শুধু কি ডাস্টবিন ঘেঁটে ওর অমন গতর হয়েছে নাকি? গোলগাল বেড়াল দেখলেই তাকে ভুলিয়ে অন্ধকার গলিতে নিয়ে গিয়ে কপ। নেপো হতভাগাকে পইপই করে মানা করেছি, ওর সঙ্গে মিশিস নে, তা কে কার কথা শোনে। এখন বোঝ ঠ্যালা! কোথায় ঠ্যাং ছড়িয়ে রামকানাই চুপ করল।
আমি বললাম, এই পাড়া থেকে গত ছয় মাসে একত্রিশটা বেড়াল নিখোঁজ। কালো মেমের হলদে ট্যাবি পর্যন্ত। বিদঘুঁটে কিছু অত বেড়াল খায়নি। আর খায়ই যদি তো আমার নতুন খাতা নিয়ে গেছে কেন?
ছোটো মাস্টার বললেন, নিতাই সামন্তকে বললে হয় না? যে অত চোরাই গাড়ি খুঁজে দেবে, সে একটা সামান্য বেড়াল খুঁজে দিতে পারবে না?
একথা আমার আগে মনে হয়নি।
গুপি বলল, আমার ছোটোমামাকেও বললে হয়, তার খুব বুদ্ধি। সে বলেছে চাদে মাটি নিয়ে যেতে হবে। ওখানকার মাটিতে ফসল হবে না। তা ছাড়া কেঁচোও নিয়ে যেতে হবে। তারা তলার মাটি উপরে তোলে। তাহলে বেশি ভারী ভারী ট্রাক্টর নিতে হবে না।
বড়ো মাস্টার ঠিক সেই সময় এসে ঘরে ঢুকলেন। বড়ো দেরি হয়ে গেল, পানু। ওই রাখেশ আর বকু ভূতের ভয়ে আজ কিছুতেই বাড়ি থেকে বেরুবে না! শেষপর্যন্ত নিজে গিয়ে টেনে বের করে আনতে হল। নাকি মোড়ের ওই কোম্পানির আমলের গুদোম বাড়ির দেয়াল থেকে ভূত নামতে অনেকে দেখেছে। সাহেব মেম ভূত। সেজেগুঁজে, নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে চলে যায়, কারো দিকে তাকায় না।
গুপি বলল, কিছু বলে না তো ওরা ভয় পায় কেন?
বড়ো মাস্টার বললেন, সে কথা কে বলে!
ছোটো মাস্টার বললেন, পানুর অমন ভালো বেড়ালটাকে পাওয়া যাচ্ছে না।
–তাই নাকি? রামকানাইকে দিয়ে পাড়া খোঁজাও। ওই চীনে হোটেলের পেছনে ঠান্ডাঘরের কাঠের সিঁড়িতে রোজ রাতে বেড়ালদের সভা বসে, আমি নিজের চোখে দেখেছি। তাদের মধ্যে নেপো আছে কি না একবার দেখে আসুক।
রামকানাই ঝুরিভাজা এনেছিল। সে বললে, সে কি আর বাকি রেখেছি, মাস্টারবাবু। সিঁড়িতে থিকথিক করছে বেড়াল; কোন সময় হোটেল থেকে চিংড়ি মাছের খোলা বাইরে পড়ে সেই আশাতেই বসে আছে। কিন্তু তার মধ্যে নেপো নেই। তিনি কাঁটা কি খোলা খান না। পানুদাদা মাছ বেছে দিলে তবে তিনি মুখে তোলেন।
বড়ো মাস্টার চেয়ারে বসে বললেন, খায় না আবার! তেমন অবস্থায় পড়লে, না খায় এমন জিনিস থাকে না। একবার আমরা বড়ো বোট নিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের ছোটো ছোটো দ্বীপে গুয়ানো খুঁজছিলাম। সমুদ্রের পাখিদের ময়লা জমে থাকে, তাকেই গুয়ানো বলে, বাজারে চড়া দামে বিক্রি হয়।
একটা ছোট্ট দ্বীপে উঠছি, সমুদ্রের তীরে অনেকটা বালি, দ্বীপটা কিন্তু পাথরে তৈরি, ওপরটা চ্যাপটা। পাথরের খাঁজে খাঁজে যেখানে মাটি একটু পুরু, সেখানেই বেঁটে বেঁটে গাছপালা, ঝরনাও আছে নিশ্চয়। ভাবলাম এখানে নোঙর করে দু-দিন বিশ্রাম করা যাবে। দেখে মনে হল মাছের আর পাখির ডিমের অভাব হবে না। নৌকোর ক্যাপ্টেন আর আমি আর আমার পোষা বেড়াল ম্যাও আগে নামলাম। আমরা দেখে এলে অন্যেরা নামবে।
তবে অনেকেরই খুব রাগ, ম্যাও নামছে অথচ তাদের অপেক্ষা করতে হচ্ছে? যাই হোক, আমরা বালি পেরিয়ে হাঁচড়পাঁচড় করে দ্বীপের পাথুরে গা বেয়ে উঠতে লাগলাম। দেখতে দেখতে নৌকো আমাদের চোখের আড়াল হয়ে গেল।
আগে আগে ক্যাপ্টেন, তারপর আমি, আমার কাঁধে ম্যাও বসে। ক্যাপ্টেন বলল, দ্বীপটা যেন একটু অদ্ভুত ঠেকছে। পাখির ডাক নেই কেন? সত্যি, এমন চুপচাপ দ্বীপ কখনো দেখিনি। সমুদ্রের শব্দ ছাড়া কিছু শোনা যায় না। গুয়ানো ছেড়ে দিলাম, একটা জন্তুজানোয়ার বা পাখি, কিছু দেখতে পেলাম না। তার উপর ম্যাও ঘাড়ের লোম ফুলিয়ে কেবলি রেগে গরগর করতে লাগল।
যাকে গাছগাছড়া ভেবেছিলাম তাও দেখলাম কাটাঝোঁপ ছাড়া কিছু নয়। অনেক খুঁজে ছোট্ট একটা ঝরনা পেলাম। আর একটু রোদ উঠলে কী সাংঘাতিক গরম হবে ভেবে তাড়াতাড়ি পাথর। বেয়ে নামতে লাগলাম। ওই ন্যাড়া পাথর তেতে উঠলেই হয়েছে আর কী! খানিকটা পথ বাকি থাকতে অবাক হয়ে চেয়ে দেখি সমুদ্রের তীর চঁছাপোছা, দূরে জলের উপর একটা কালো দাগ ক্রমে ছোটো হতে হতে শেষটা মিলিয়ে গেল। নাবিকদের নামতে দেওয়া হয়নি বলে তারা রেগেমেগে আমাদের ফেলে চলে গেছে।
হতাশ হয়ে যেখানে ছিলাম, বসে পড়লাম। অমনি ম্যাও এক লাফে আমার ঘাড় থেকে নেমে, রেগে তিনগুণ বড়ো হয়ে গর-র করতে লাগল। দেখি পাশেই একটা গুহার মুখ।
রোদ থেকে আশ্রয়ের আশায় ঢুকে পড়লাম তার ভিতর। খানিকদূর গিয়ে ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে এখানে ওখানে জোড়া জোড়া চোখ জ্বলছে। টর্চের আলো ফেলে দেখি পাথরের থাকে থাকে বেড়াল। কালো, হলদে, সাদা, ছাই, পাটকিলে। বোধ হয় ম্যাওকে দেখেই, তারা সব উঠে দাঁড়িয়ে, চার পা এক জায়গায় জড়ো করে, পিঠ কুলোর মতো বাঁকিয়ে, পাথরের উপর নখ ঘষতে লাগল। তার খড়খড় শব্দে আমাদের গায়ে কাঁটা দিল। ম্যাও একেবারে কাঠ!
কোনোমতে হোঁচট খেতে খেতে পড়িমরি করে গুহা থেকে বেরিয়ে বাঁচলাম। অবাক হয়ে দেখি আমাদের নৌকো আবার ফিরে আসছে। আমরা নীচে পৌঁছোবার আগেই ম্যাও গিয়ে নৌকোয় উঠে পাটাতনের তলায় গুটিসুটি হয়ে বসে পড়ল। বেড়ালের খাদ্যের কথাই যদি বল, ওই দ্বীপে তারা খেত কী? পাখি নেই, প্রাণী নেই, গাছপালা নেই। হয়তো পরস্পরকেই
ছোটো মাস্টার বললেন, না, না, নিশ্চয় সমুদ্রের মাছ ধরে খেত। ঢেউয়ের সঙ্গে যেসব ঝিনুক, শামুক, তারামাছ, সমুদ্রের ঘোড়া, জেলিফিস এসে বালির উপর পড়ে, তাও খেত।
বড়ো মাস্টার বললেন, পরে শুনেছিলাম, এক জাহাজের ক্যাপ্টেনের দুটো বেড়াল ছিল। তাদের উৎপাতে টেকা দায় হয়ে উঠেছিল বলে নাবিকরা লুকিয়ে ওদের ওখানে ফেলে দিয়ে গেছিল। ওরা নাকি টিনের মাছ ছাড়া কিছু খেত না। এদিকে নাবিকরা শুকনো মাংস পেত। ওইসব বেড়াল নিশ্চয় তাদেরই বংশধর।
ঠিক এই সময় ঠান্ডাঘরের দিক থেকে খুব জোরে কতগুলো ঠকঠক শব্দ, তার পরেই এমনি ঝঝন্ যে কান ঝালপালা হয়ে গেল। বড়ো মাস্টার ব্যস্ত হয়ে উঠে পড়লেন। কী জানি ওঁর বাড়িতেই কিছু হল না তো। পঙ্গু বউ একলা আছে।
ছোটো মাস্টার বললেন, বরফ ফাটলে ওইরম শব্দ হয়। রাখেশ আর তার বন্ধুরা বলছিল যে ঘর এত বেশি ঠান্ডা করে ফেলেছে যে কয়েকটা পেঙ্গুইন পাখি দেখা দিয়েছে।
গুপি বলল, ওরা তো ভূতও দেখে।
সেদিন সবাই একটু তাড়াতাড়ি চলে গেল। রামকানাই ঘরে এসে বলল, তিনজনে এসে পঁচিশটা কচুরি সাঁটাল, অথচ বেড়ালের একটা গতি করতে পারল না। আমার কিন্তু বুড়ি মেমকেই সন্দেহ হয়।
আমি বললাম, ওর বেড়াল-ও তো গেছে। তুমি সবাইকে সন্দেহ কর।
–সবাইকে সন্দেহ না করেই-বা করি কী। তুমি তো তেওয়ারির দুঃখে গলে যাও। আহা, বেচারা, রোদে-বৃষ্টিতে চাটাইয়ের ছাউনির নীচে বসে চা জলখাবার তৈরি করে আর বিক্রি করে। রাতে শোবার একলা ভালো জায়গা পায় না, হেনা তেনা কত কী বল। জান, ওই চারতলা ঠান্ডা ঘরটির মালিক কে? ওই তেওয়ারি ছাড়া আর কেউ নয়। তোমার বাবাকে তেওয়ারি কিনে ফেলতে পারে, তা জান?
ভীষণ রেগে গিয়ে গড়বড় করে গাড়িটা চালিয়ে জানলার কাছে গেলাম। দেখলাম বুড়ি ভিকিরি তেওয়ারির সঙ্গে কী নিয়ে ঝগড়া করছে। রামকানাই-ও জানলার ধারে এসে বলল, ওই আরেক জন। আমার হাতে দিয়ে ওর জন্যে কত পয়সাই-না পাঠিয়েছ তুমি। তোমার মার কাছ থেকে চেয়ে খদ্দরের চাদর পর্যন্ত ওকে দিয়ে আসতে হয়েছে। আর তেওয়ারি তো প্রত্যেক দিন সন্ধ্যে বেলায় দোকান বন্ধ করার আগে, শালপাতার ঠোঙা ভরে ওকে ঝড়তিপড়তি খাবার দেয়। তাই নিয়েই আবার ঝগড়া করে বুড়ি। আর ওই যে মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে অনেক রাতে একটা বুড়ো ভিক্ষে করে, চোখে দেখে না। মুখে কথা নেই, শুধু হাতটা পেতে দেয়। ওকে দেখে সকলের দয়া হয়, সবাই পয়সা দেয়। দু-জনার তফাতটা দেখেছ তো?
আমি বললাম, তা দেখেছি। তাই বলে ঝগড়াটি বুড়িকে চাদর দেবনা কেন? ওর-ও তো ঠান্ডা লাগে।
রামকানাই বলল, তা লাগে বই কী। তা ছাড়া ঝগড়াটে বুড়ি আর ভালোমানুষ বুড়ো একই লোক।
০৫.
শুনে আমি হাঁ। তাকিয়ে দেখি বুড়ি তেওয়ারির নিজের ভাগ থেকে আরো দুটো পুরি নিয়ে, ঝগড়া শেষ করে, খাবারগুলোকে কেঁচড়ে বেঁধে, তরতর করে ঠান্ডাঘরের বাঁশের ভারা বেয়ে উপরে উঠে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল! ভারায় চড়ার আগে এক বার চারদিকে চেয়ে দেখল। মুখের উপর রাস্তার আলো এসে পড়ল। অবাক হয়ে দেখলাম রামকানাই ঠিকই বলেছে। মোড়ের মাথার বুড়োর আর ঝগড়াটি বুড়ির মুখ অবিকল এক।
বললাম, রামকানাইদা, ওরা তো যমজও হতে পারে।
রামকানাই কাষ্ঠ হেসে বলল, তাহলে দুজনকে একসঙ্গে দেখা যায় না কেন? না পানুদা, পৃথিবীতে কাকেও বিশ্বাস হয় না। বিশেষ করে তোমাদের নতুন বন্ধু ওই ছোটো মাস্টারটিকে তো নয়ই। এদিকে তলাপাত্র বলতে বুড়ো মাস্টার অজ্ঞান! ওঁর কপালে দুঃখ আছে বলে রাখলাম।
এই বলে রামকানাই দরজা খুলে দিতে গেল। বাবা-মা নেমন্তন্ন খেয়ে ফিরে এসেছেন। সঙ্গে আবার কাকু আর নিতাই সামন্তও এসেছিলেন। নিতাই সামন্তকে আজকাল এই পাড়ায় রাতে ডিউটি দিতে হয়, তাই এক পেয়ালা গরম চা না হলে চলে না। এক পেয়ালা মানেই দুই পেয়ালা আর গোটা দুই পান।
আমি গাড়ি চালিয়ে বসবার ঘরে গিয়ে ওদের কথাবার্তা শুনতে লাগলাম। খালি বিনু তালুকদারের অদ্ভুত বুদ্ধির গল্প। বিনু তালুকদারের চেহারা নাকি দিল্লির দু-একজন বড় কর্তা ছাড়া, কেউ দেখেনি। তার টিকটিকিদেরও কেউ চেনে না। এখানকার পুলিস বিভাগের কেউ তো নয়ই। নিতাই সামন্ত এক টিপচুন দাঁতে লাগিয়ে বললেন, কে জানে মশাই, ওই যে-লোকটাকে সন্দেহ করে আজ এই রাতের অন্ধকারে, ভূতের গলিতে যাচ্ছি, সে-ই হয়তো বিনু তালুকদারের গুপ্ত গোয়েন্দা, ছদ্মবেশে বেড়াচ্ছে। আমার অবিশ্যি ভূতের ভয় নেই। কারণ প্রথমত ভূত আছে বলেইবিশ্বাস করি না। দ্বিতীয়ত আমার হাতে গুরুদেবের দেওয়া অব্যর্থ মাদুলি বাঁধা আছে। ভূতে আমার কিছু করতে পারবে না।
নিতাই সামন্ত চলে গেলে পর বাবা বললেন, ওই গুপিটার পাল্লায় পড়ে তুই-ও যেন পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে শুধু চাদে যাবার জোগাড়যন্ত্র করিস না। চাঁদে গেলেই হল আর কী!
আমি বললাম, না, বাবা, শুধু চাঁদে যাওয়া নয়, চাঁদ থেকে আরও দূরে যাওয়া হবে। ওটা হল প্রথম স্টেশন, ওখানেই নাকি টিকিট কাটতে হবে, গুপির ছোটোমামা বলেছেন।
শুনে বাবা তো হেসেই কুটোপাটি। আর ছোটোমামা! আরে তোদের গুপির ছোটোমামা তো ফেরারি আসামি! একবাক্স স্কুরু-ট্রু নিয়ে হাওয়া। লিখে রেখে গেছে যে সামান্য বি.এসসি. পাস করে তার কিছু হবে না। সে চাঁদে যাওয়ার চেষ্টায় আছে।
আমার কান্না পেল। তাহলে গুপিকে আমাকে না নিয়েই ছোটোমামা চাঁদে চলে গেলেন নাকি? জমি-টমি কিনে রেখেছেন বোধ হয়, কিন্তু
বাবা এত বেশি হাসতে লাগলেন যে থামতে হল। বাবা বললেন, না, না, অত ভাবনার কারণ নেই। চোঁয়াঢেকুর ওঠাতে সে আবার ফিরে এসেছে।
সঙ্গেসঙ্গে আবার সেই ঝনঝন শব্দ। আমি বললাম, বরফ ফাটছে। ওখানে পেঙ্গুইন গজিয়েছে।
বাবা এমনি আশ্চর্য হয়ে গেলেন যে হাসি থেমে গেল। আমি যদি হাঁটতে পারতাম, একদিনও বাড়িতে থাকতাম না।
আরও সাত দিন কেটে গেল, নেপোর কোনো পাত্তা নেই। মেজোকাকু বললেন, একটা পার্সিয়ান ক্যাট এনে দিই, কী বলিস? বাড়ি ছেড়ে এক পা নড়বে না, এই বড়ো সাইজের, ছাই রঙের গা, নীল চোখ। বেড়ালকে বেড়াল, কুকুরকে কুকুর। পাতি বেড়াল কেউ পোষে নাকি?
খুব দুঃখ হল। বললাম, কেন পুষবে না? আমাদের এই বাড়িতে আটটা ফ্ল্যাট, প্রত্যেকের একটা করে বেড়াল ছিল। এখন অবিশ্যি সবার নেই। তিন নম্বর, চার নম্বর আর সাত নম্বরের বেড়ালও অদৃশ্য হয়ে গেছিল, তবে তারা ফিরে এসেছে। বিদঘুঁটে তাদের খায়নি, রামকানাই যাই বলুকনা কেন।
ছোটো মাস্টার বললেন, এ তো ভারি ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। আপনার বন্ধু নিতাই সামন্ত এই নিয়ে একটু তদন্ত করতে পারেন।
মেজোকাকু চটে গেলেন, রেখে দিন ওসব বাজে কথা। সে এখন নিজের কাজ ফেলে বেড়ালের পিছন ঘুরুক আর কী!
বড়ো মাস্টারমশাই না থাকলে ছোটো মাস্টারের বেজায় সাহস বেড়ে যায়। তিনি বললেন, আহা, এমনও তো হতে পারে যে গাড়ি চুরি আর বেড়াল চুরি দুটো আলাদা ব্যাপার নয়?
মেজোকাকু অবাক হয়ে ছোটো মাস্টারের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ঠিক সেই সময় বড়ো মাস্টার এসে ঢুকলেন। মেজোকাকু তাকে তলাপাত্রের মন্তব্যটা বলে খুব হাসতে লাগলেন।
বড়ো মাস্টারমশাই বেশ গম্ভীর মুখেই বললেন, তাহলে বুঝতে হবে কি যে এখনও নেপোকে পাওয়া যায়নি আর তলাপাত্রের মতে চোরাই গাড়ি আর হারানো বিল্লি একসঙ্গে পাওয়া যাবে? তা কিন্তু কিছুই বলা যায় না। হয়তো চোরাই গাড়ির গোপন কারখানায় ইঁদুরের উপদ্রবে টেকা যাচ্ছিল না বলে ওরা বেড়াল আমদানি করছে। কী বলো তলাপাত্র?
তলাপত্র লজ্জা পেয়ে মাথা নীচু করে চুপ করে রইল। বড়ো মাস্টার বললেন, তা হলে শোনো। বর্মায় একবার দেখা গেল যখনি–
এইটুকু বলেছেন, এমনি সময় হন্তদন্ত হয়ে গুপি এসে উপস্থিত। তার চোখমুখ দেখে বুঝতে পারলাম। একটা কিছু হয়েছে। সে ভীষণ উত্তেজিতভাবে বলল, ছোটো মাস্টারমশাই, আপনি ঠিকই বলেছিলেন। এক্ষুনি দেখলাম দু-তিনজন লোক জালে জড়িয়ে ছোটো ছোটো জ্যান্ত মাছ নিয়ে ঠান্ডাঘরের গলিতে ঢুকল। ওখানে যে পেঙ্গুইন গজিয়েছে সে বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ নেই।
বড়ো মাস্টার অবাক হয়ে বললেন, কী বলেছে তলাপাত্র? ঠান্ডাঘরে পেঙ্গুইন গজিয়েছে? মাছ গজায়নি?
তলাপাত্র আস্তে আস্তে বললেন, না স্যার, জল ছাড়া মাছ বাঁচবে কী করে?
বড়ো মাস্টার আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় বাবা-মা ফিরে এলেন। আরে গুপি, তুই এখানে? এদিকে যে তোর ছোটোমামাটি এবার সত্যি ফেরারি হয়ে গেছে সে খবর রাখিস?
বাবা খুব হাসতে লাগলেন। কিন্তু আমাদের হাত-পা জমে বরফ। ছোটোমামা ফেরারি হলে আমাদের চাঁদে যাওয়ার কী হবে? বাবা একটা চেয়ারে বসে পড়ে বললেন, সে এক কাণ্ড, মশাই। বইয়ের সঙ্গে চাঁদু ছোকরার সম্বন্ধ নেই, খালি অলিগলিতে ঘুরবে আর যত রাজ্যের রাবিশ কিনে আনবে। যত সব মলাট-ছেঁড়া বাজে বই আর জংধরা লোহার টুকরো। নিজের ঘরটাকে ছাদ অবধি বোঝাই করে ফেলছে। তারপর কাল একেবারে বাঘের সঙ্গে মুখোমুখি! বাছাধন বাজারের থলি বোঝাই পেরেক শেকল ইত্যাদি নিয়ে বাড়িতে ঢুকছেন। তাও সোজা পথে না, জলের পাইপ বেয়ে। আর পেছন থেকে বেল্টখামচে ধরেছেন প্রাণেশবাবু!
বড়োমাস্টার বললেন, তিনি কে?
-কে আবার, ছোটোমামার বাবা, অর্থাৎ গুপির দাদু! বুড়ো তো চটে কই। হতভাগা কিছুতেই পড়বে না! পাছে পালায় তাই ঘরের শেকল তুলে দিয়েছিলেন, জানলা দিয়ে বেরিয়ে পাইপ বেয়ে পালাল!! ছেলের হাত থেকে থলি পড়ে পেরেক ছড়িয়ে একাকার। তাই দেখে বুড়োর হাতও হয়তো একটু ঢিলে হয়েছিল, অমনি হ্যাঁচকা টানে বেল্ট ছিঁড়ে ছোকরা পগার পার! সারা রাত সারা দিন গেছে ছেলের দেখা নেই। ও-বাড়িতে কান্নাকাটি পড়ে গেছে। তুই বলতে চাস, তুই কিছু জানিস না, গুপি?
গুপি তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে বলল, আমি কী করে জানব? আমরা থাকি হেদোর কাছে আর দাদুরা বাদুড়বাগানে। যাই, অনেকগুলো হোমটাস্ক করতে হবে। এই বলে দৌড়।
গুপি চলে গেলে বাবা বললেন, ওই দুষ্টু মামা আর তার এমন ভালো ভাগনে! গুপির মতো হতে চেষ্টা করিস পানু। তারপর মেজোকাকুকে বললেন, আসল কথাই বলতে ভুলে গেলাম। চাদুর ঘর সার্চ করা হয়েছে, যদি কোথায় গেল তার কোনো ক্ল পাওয়া যায়। লোহার স্কুপের নীচে থেকে দুটো ভাঙা মোটর গাড়ির নম্বর প্লেট পাওয়া গেছে। দুটোই চোরাই মোটরের নম্বর প্লেট।
মেজোকাকু বললেন, সে কী! কী করে জানলে?
–আরে, চাঁদুর মা এমন কান্নাকাটি লাগিয়ে দিয়েছেন যে শেষপর্যন্ত বুড়ো থানায় গিয়ে ছেলে হারানো ডাইরি করে এলেন। সেখানে সবাই হেসেই কুটোপাটি, হারিয়েছে আবার কী, পেলিয়েছে বলুন। ওইখানেই তোর বন্ধু নিতাই সামন্তর সঙ্গে দেখা। সে-ই ঘর সার্চ করে নম্বর প্লেট বের করেছে আর ফর্দ মিলিয়ে দেখেছে দুটোই হারানো গাড়ির নম্বর প্লেট। কাজেই সঁদুর পেছনে এবার হুলিয়া লেগেছে। শুধু যে ঘর-পালানো ছেলে তা তো নয়, একেবারে ফেরারি আসামি। ধরা পড়লেই হাতে হাতকড়া।
শুনে সবাই থ। বাবা একটু হেসে, উঠে গেলেন। তখন আমি বললাম, তা হতে পারে না। আমরা চাদে যাব বলে ছোটোমামা স্পেসশিপ বানাবেন, তাই পেরেক-টেরেক জমা করছেন। ওসব জিনিস উনি নিজের টিপিনের পয়সা দিয়ে সের দরে কেনেন। কোথা থেকে ওগুলো কিনেছেন বের করতে পারলেই গাড়িচোরও বেরিয়ে পড়বে।
মেজোকাকু বললেন, তাহলে কোথা থেকে কিনেছে সেটা জানা দরকার। অর্থাৎ ওকে ধরা দরকার। যাই, দেখি নিতাই কী বলে।
মেজোকাকু চলে গেলে বড়ো মাস্টারমশাই বললেন, ও কী পানু, অত মনমরা কেন? ওই ছেলেকে ধরবে নিতাই সামন্তরা? তাহলেই হয়েছে! ওদের ও এক হাটে কিনে আরেক হাটে বেচে আসতে পারে। তোমাদের চাদে যাওয়ার কোনো অসুবিধাই হবে না। অবিশ্যি চাঁদে যাওয়াটা আমি কোনোদিনই সমর্থন করব না। তা ছাড়া পায়ের এক্সারসাইজগুলো করছ তো? নইলে চাদে যাবেই-বা কী করে? কী বললে তলাপাত্র, মুখ তুলে কথা বল না কেন? তোমাকে তো আর আমি খেয়ে ফেলব না!
ছোটো মাস্টারমশাই ভয়ে ভয়ে বললেন, ওই যে বর্মার গল্পটা
–কোনটা? ওই ফুঙিদের মাছের গল্পটা?
-না, না, ওই যে যখনই কী হয় তখনই আরেকটা কী হয়—
বড়ো মাস্টার খুব হাসলেন, ও সেইটে। বুঝলে পানু, বি.এ. পাস করিয়ে, বাবা আমাকে কিছুদিন রেঙ্গুনে রেখেছিলেন। ওখানে আমাদের একটা আপিস ছিল। আপিসটা দেখতে ছোটো, একটা এত সরু গলির মধ্যে যে তার ভিতর মোটর গাড়ি ঢুকত না। কিন্তু সেখানে লক্ষ লক্ষ টাকার আমদানি-রপ্তানি কারবার হত। লোক গিজগিজ করত গলিটিতে। একদিনে এত কোটি কোটি টাকার লেন-দেন বর্মায় আর কোথাও হত না। আমাদের থাকার জায়গা ছিল ওপর তলায়। পাশাপাশি দুটি বেশ বড়ো ঘর, রান্নাঘর, স্নানের ঘর। তা তোমাদের বউঠান কিছুতেই একা বেরুবে না, সবটাতেই তার বেজায় সন্দেহ। বুঝলাম লোক রাখতেই হবে, এবং যত পুরোনো লোক হয় ততই ভালো। দুঃখের বিষয়, লোকরা যেই একটু পুরোনো হয়, রাধাবাড়ায় হাত পাকায়, অমনি বলা নেই কওয়া নেই কোথায় উধাও হয়। তারপর কিছুদিন ভারি অসুবিধা, লোক পাওয়া যায় না! তোমাদের বউঠান রাঁধে খাসা, কিন্তু হাটবাজার আমাকে করতে হত। এদিকে কাজের এতটুকু ক্ষতি হলেই, বাবা হয়তো রেগেমেগে ত্যাজ্যপুত্র করে দেবেন।
এবাড়ি-ওবাড়ি জিজ্ঞাসা করে টের পেলাম, শুধু আমাদের বাড়িতে নয়, সব বাড়ির ওই এক অবস্থা। মাস তিনেক ওইভাবে চলে, তারপর আস্তে আস্তে আবার লোক পাওয়া যায়। ভাবলাম এ-দেশের ওই রকমই ব্যাপার, এরা ছয় মাস কাজ করে তো তিন মাস দেশে বসে খায়।
দু-বছর এইভাবে চলল, তারপর সালওয়েন নদীতে মানপু বলে একটা ছোটো জায়গায় যেতে হল। একাই গেলাম, পরিবার নিয়ে যাওয়া নিরাপদ নয়, বেজায় ডাকাতের উপদ্রব। পৃথিবীতে যেখানেই যাওয়া যাক না কেন, একটা-না-একটা ঝামেলা থাকে। ওইখানে আমাদের কাঠগুদোম ছিল, বন্দুকধারী পাহারাওয়ালা রাখতে হত, নিজেদেরও যথাসম্ভব সতর্ক থাকতে হত। ডাকাতির ঢেউ আসত। মাস তিনেক খুব ডাকাতি, তারপর ছয় মাস সব চুপচাপ। তারপর আবার ডাকাতি। আমরাও তাই বুঝে কাজ গুছিয়ে নিতাম, ওই ছয় মাসের মধ্যে টাকাকড়ির লেন-দেন সেরে ফেলতে চেষ্টা করতাম। রেঙ্গুনের চাকর পালানোর আর মানপুর ডাকাতির কোনো সম্বন্ধ আছে কেউ সন্দেহও করতাম না। বছর পাঁচেক বাদে রেঙ্গুনে একজনদের চাকর হঠাৎ মারা গেলে, তার জিনিসপত্রের মধ্যে এমন সব চোরাইমাল বেরুল যাতে আর কোনো সন্দেহই রইল না যে যারা ছয় মাস ভালোমানুষ সেজে রেঙ্গুনে লোকের বাড়িতে কাজ করত, তারাই মানপুতে তিন মাস দুর্ধর্ষ ডাকাতি করত। কাজেই কীসের সঙ্গে কীসের সম্বন্ধ আছে কিছুই বলা যায় না। চলো হে তলাপাত্র, তোমাকে ভূতের গলিটা পার করে দিয়ে আসি।
ওঁরা চলে যাবার আধ ঘণ্টা পরে রামকানাই আমার জন্যে হরলিক্স নিয়ে এল। মুচকি হাসতে হাসতে বলল, যত সব বিদ্যেদিগগজ হয়েছেন।
আমি বললাম, কী যে বল, রামকানাই, বড়ো মাস্টার কত দেশ ঘুরেছেন, কতরকম দেখেছেন।
রামকানাই বলল, মুখে যত বউয়ের উপর দয়া, আর ওদিকে একবার তাকিয়ে দেখো-না। দু-মুখো সাপ। আজ আমি কিন্তু রাতে তোমার ঘরে শোব না, যাত্রা দেখতে যাব। ভয় করে তো বুড়ো মাস্টারকে ডাকতে পার। বড়ো মাস্টারমশাইকে ভক্তি করি বলে রামকানাইয়ের যত রাগ।
তবু ওঁদের জানলার দিকে তাকিয়ে একটু আশ্চর্য না হয়ে পারলাম না। এত দূর থেকে কথা শোনা যায় না, শুধু ছায়ার মতো দেখা যায়। মনে হল বকবার আঙুল তুলে মাস্টারমশাই বউকে শাসাচ্ছেন। বড়ো কষ্ট হল।
সে-রাতে আর কিছুতেই ঘুম আসছিল না। বার বার উঠে বসে জানলা দিয়ে দেখছিলাম, বড়ো মাস্টারমশাইয়ের ঘরে তখনও আলো জ্বলছে আর বড়ো মাস্টারমশাই ঘরময় অস্থিরভাবে পাইচারি করছেন। একবার তন্দ্রামতো এসেছিল, চমকে জেগে উঠলাম। কে ঠোঁট চেপে শিস দিচ্ছে শ শ ট শ শ ট। এ তো গুপির আর আমার গোপন সংকেত। এত রাতে গুপি কী করে এল? হাতে ভর দিয়ে এক লাফে গাড়িটাতে চড়ে জানলার কাছে গিয়ে দেখি যা ভেবেছি ঠিক তাই। গুপি ছাপাখানার ঘোরানো সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে, কাঁধে একটা তক্তা। আমি ইশারা করে ডাকতেই তক্তাটা যথাস্থানে ফেলে স্বচ্ছন্দে ফাঁকটুকু পার হয়ে আমাদের ঘোরানো সিঁড়িতে এসে উঠল। বাবা! ওই তিন তলার উপরে সরু তক্তার উপর দিয়ে ওকে ঘঁটতে দেখে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ! আমাদের সিঁড়িতে উঠে আবার ঝুঁকে তক্তাটাতে টান দিল। দেখি এ মাথাটা আমাদের রেলিংএর সঙ্গে বেঁধে ফেলেছে। ওইখানেই তক্তাটা ঝুলতে লাগল।
আমার শোবার ঘরের পাশেই খাবার ঘর, তার বাইরে সরু বারান্দা। কার্নিশ বেয়ে দুই হাত হেঁটে সেই বারান্দায় উঠতে গুপির পাঁচ মিনিটও লাগল না। আমি খাবার ঘরের দরজার নীচু ছিটকিনিটা খুলে দিলাম। গুপি ঠোঁটের ওপর একটা আঙুল রেখে আস্তে আস্তে আমার ঘরে এল। খাবার ঘরের পর বসবার ঘর, তার ওপাশে মা-দের ঘর।
তবু আমার দরজাটা ভেজিয়ে দিলাম। গুপি বলল, বাড়িতে বলে এসেছি তোর এখানে খাব শোব।
খাবার কোথায় পাব? ডুলিতে পাঁউরুটি থাকতে পারে।
–আরে দূর, ছোটোমামার কাছে খেয়ে এলাম এক্ষুনি। পরোটা কাবাব ক্ষীরের সন্দেশ।
এমনি চমকে গেলাম যে জিব কামড়ে ফেললাম। গুপি বলল, এসব কথা কাউকে বলবি না। ছাপাখানার ওই যে ঘোরানো সিঁড়ির মাথায় দরজা দেখছিস, ওটা ছোটোমামার ঘর। ছোটোমামা ছাপাখানার বদলি নাইট ওয়াচম্যানের চাকরি পেয়েছে। এই বলে গুপি মুখ চেপে বেজায় হাসতে লাগল। সবাই জানে ও আগের পাহারাওয়ালার ছোটো ভাই।
একটু পরেই আমার আরাম কেদারায় কুশন মাথায় দিয়ে শুয়ে পড়ে গুপি বলল, দাড়ি পরে কী অদ্ভুত দেখাচ্ছে সে আর কী বলব। নকল দাড়ির নীচে সত্যি দাড়ি গজাচ্ছে। এই দু-দিনেই চমৎকার খোঁচা খোঁচা বেরিয়েছে। কিন্তু ভুলে যাস না যে ওর প্রাণ তোর হাতে। এই বলেই পাশ ফিরে গুপি দিব্যি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ল।
আমারও গায়ের রক্ত গরম হয়ে উঠেছিল! আমাকেও গুপির আর ছোটোমামার উপযুক্ত হয়ে উঠতে হবে। আস্তে আস্তে পা-দুটোকে গুটোতে চেষ্টা করতে লাগলাম। আশ্চর্য হয়ে টের পেলাম, অন্য দিন কিছু হয় না, আজ কিন্তু পায়ের গুলিটাকে বেশ শক্ত করতে পারছি।
শুয়ে শুয়ে ভাবলাম, কাল সকালে গুপিকে দেখে মা কী বলবেন। নিশ্চয় জানতে চাইবেন কোথা দিয়ে এসেছে! ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম থেকে উঠে দেখি সাতটা বেজেছে, রামকানাই আমার হরলিক্স এনেছে, গুপির কোনো চিহ্ন নেই। পরে জানলার কাছে গিয়ে দেখি তক্তাটাও নেই! তবে স্বপ্ন যে নয়, তার প্রমাণ গুপি তার ছেঁড়া চটি ফেলে, আমার আস্ত চটি পরে চলে গেছে। যাক গে, আমার চটিই-বা কী, আর জুতোই-বা কী! আমি তো দু-পায়ে ল্যাংড়া। একথা ভেবে বেজায় কান্না পাচ্ছিল। ভাগ্যিস রামকানাই ঠিক সেই সময় গরম গরম তিনকোনা পরোটা আর কাল রাতের বাকি দুটো মাংসের আলুচপ এনে হাজির করল, তাই মনটা আবার ভালো হয়ে গেল।