বলপয়েন্ট – হুমায়ুন আহমেদ
আমার পুত্র নুহাশকে কে যেন জিজ্ঞেস করল, তুমি বড় হয়ে কি বাবার মতো লেখক হতে চাও? নুহাশ বলল, না।
কেন না?
নুহাশ গম্ভীর গলায় বলল, লেখক হলে খুব বেশি হাঁটাহাঁটি করতে হয়। সে সবসময় আমাকে দেখেছে লিখতে শুরু করেছি, কিছুক্ষণের মধ্যেই লেখা বন্ধ করে বারান্দায় হাঁটছি। আবার লিখছি আবার হাঁটছি। সে ধরেই নিয়েছে হাঁটাহাঁটি লেখালেখিরই একটা অংশ। বাংলা একাডেমীর লেখক প্রকল্পের একজন আমাকে আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, আপনার লেখালেখির প্রধান অনুপ্রেরণা কী? আমি গম্ভীর গলায় বললাম, হন্টন।
একবার সাঁতারে চ্যাম্পিয়ন একজনকে জিজ্ঞেস করা হলো, আপনি এত ভালো সাঁতার কোথায় শিখেছেন? চ্যাম্পিয়ন বললেন, টিউবওয়েলে শিখেছি।
টিউবওয়েলে সাঁতার শিখলেন কীভাবে?
আমাকে কল চেপে বালতির পর বালতি পানি তুলতে হতো। সেটা করতে গিয়ে হাতের মাসল শক্ত হলো। সেখান থেকে সাঁতার।
আমার বেলাতেও কি তাই? হাঁটতে হাঁটতে পা শক্ত। যে কারণে দীর্ঘ সময় মাটিতে বসে থাকতে পারি। সমস্যা হয় না।
চেয়ার-টেবিলের যুগে আমি লিখি মেঝেতে বসে। তারাশঙ্করের আত্মজীবনীতে পড়েছি, তিনি মেঝেতে বসে টুলবক্সের মতো ছোট্ট জলচৌকিতে লিখতেন। জলচৌকির ডালা খোলা যেত। ডালার ভেতর থাকত কাগজ এবং কলম। আমার অনুপ্রেরণা তারাশঙ্কর না। চেয়ার-টেবিলে বসে লেখার সময় নিজেকে কেমন যেন অফিসের কর্মচারী মনে হয়। মেঝেতে ছোট্ট একটা জলচৌকি অনেক আপন, অনেক ঢিলেঢালা।
তবে কবি হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার আপ্রাণ চেষ্টার সময় আমি অফিসার অফিসার ভঙ্গিতে সোফায় বসে লিখেছি। সেবছরই আমাদের নতুন সোফা কেনা হয়েছে। তখনো আমার নিজের লেখার জলচৌকি হয় নি। লেখালেখির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মেঝেতে বসে করার চিন্তাও মাথায় নেই।
দেড় থেকে দু’ঘণ্টা কঠিন পরিশ্রম করে আমি বারো লাইনের একটা কবিতা (না-কি পদ্য) প্রসব করে ফেললাম। ঘটনার সমাপ্তি এখানে হলেই ভালো হতো, তা হলো না। খাম ডাকটিকিট কিনে আনলাম। দৈনিক পাকিস্তান-এর মহিলা পাতার সম্পাদিকাকে একটা চিঠি লিখলাম—
প্রিয় আপা,
সালাম জানবেন। আমার নাম মমতাজ আহমেদ শিখু।
আমি একটি কবিতা পাঠালাম…
মমতাজ আহমেদ আমার ছোটবোনের নাম। সে তখন ক্লাস টেনে পড়ে। আমার ধারণা হয়েছিল, ক্লাস টেনে পড়া একটি কিশোরীর কবিতা হিসাবে আমার কবিতাটা চলতে পারে।
কী সর্বনাশ! পরের সপ্তাহেই কবিতাটা ছাপা হয়ে গেল। আমার যারা পাঠক, তারা কিন্তু জীবনের প্রথম লেখা কবিতাটার দু’টা লাইনের সঙ্গে পরিচিত, কারণ এই দুটা লাইন আমি আমার দ্বিতীয় উপন্যাস শঙ্খনীল কারাগার-এ ব্যবহার করেছি।
দিতে পারো একশ ফানুস এনে
আজন্ম সলজ্জ সাধ একদিন আকাশে কিছু ফানুস উড়াই।
প্রথম কবিতা ছাপা হয়ে যাওয়া কবির জন্যে বিরাট ব্যাপার। আমি সোফায় বসে কাব্যচর্চা করতেই থাকলাম এবং দৈনিক পাকিস্তান এ বেশ কিছু মমতাজ আহমেদ শিখুর কবিতা ছাপা হয়ে গেল। আল্লাহপাকের অসীম করুণা, কবিতা নামক সেইসব আবর্জনার এখন আর কোনো অস্তিত্ব নেই।
লেখায় সামান্য ভুল করলাম। মমতাজ আহমেদ শিখু নামে প্রকাশিত কবিতা আমার প্রথম কবিতা না। স্বনামে স্কুল-ম্যাগাজিনে প্রথম কবিতা ছাপা হয়েছে। ঈশ্বর-বিষয়ক অতি উচ্চশ্রেণীর ভাব-বিষয়ক ইংরেজি কবিতা। কবিতার নাম ‘God’। কবিতাটা ছাপা হয়েছে কবির ছবিসহ। ছবির নিচে লেখা Humayun Ahmed Class X Section B. কবিতার প্রথম কয়েকটি লাইন মনে আছে—
Let the earth move
Let the sun shine
Let them to prove
All are in a line
Move এর সঙ্গে prove এর অন্তর্মিল। Shine এর সঙ্গে line,
মাইকেল মধুসূদন হবার চেষ্টা থেকে যে ইংরেজি কবিতা রচিত হলো, তা কিন্তু না। স্কুল-ম্যাগাজিনের দায়িত্বে যে স্যার ছিলেন, তাঁকে আমি বাংলায় গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনী সবই লিখে জমা দিয়েছি। প্রতিটি রচনা পড়েই তিনি বলেছেন, মোটামুটি অখাদ্য। যাই হোক, তোর যখন এত আগ্রহ, তুই বরং ইংরেজিতে যা ইচ্ছা লিখে নিয়ে আয়, ছেপে দেব। ইংরেজি সেকশানে কোনো লেখা জমা পড়ে নি।
স্কুল-ম্যাগাজিন প্রকাশিত হবার কয়েকদিন পরের ঘটনা। আমাদের ক্লাসের ইংরেজির শিক্ষক (স্যারের নাম মনে করতে পারছি না) এক কপি স্কুল-ম্যাগাজিন হাতে ক্লাসে ঢুকলেন, এবং আমাকে মহালজ্জায় ফেলে আমার লেখা কবিতা পড়ে শোনালেন। তিনি তার ছাত্রের ইংরেজি কাব্য প্রতিভায় মুগ্ধ। কবিতা পাঠ শেষ হবার পর তিনি বললেন, হুমায়ূন, তুই ইংরেজি কবিতা লেখার চর্চা ছাড়বি না। আমি দোয়া দিলাম। খাস দিলে দোয়া দিলাম।
আমাদের ইংরেজি স্যার নিশ্চয়ই এখন জান্নাতবাসী। ইংরেজি কাব্য রচনায় স্যারের দোয়া কাজে লাগে নি। কিন্তু পুরোপুরি ব্যর্থ হয় নি। ইংরেজি কবিতা না লিখলেও কিছু গদ্য তো লিখেছি! যদিও একজন গদ্যকার কবির পদধূলিরও নিচে থাকেন। সমারসেট মমের একটি উদ্ধৃতি দেই।
The crown of literature is poetry. It is its end and aim. It is the sublimest activity of the human mind. It is the achivement of beauty and delicacy. The writer of prose step aside when the poet passes.
শেষ লাইনটা ভয়াবহ—’একজন কবি যখন যাবেন তখন একজন গদ্যকার পথ ছেড়ে দিয়ে একপাশে দাঁড়াবেন।’
এত সম্মান কবিদের!
আমার কবিতা (?) রচনা চলতেই থাকল। আমার একজন সহপাঠী বন্ধু (এখনকার বিখ্যাত কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা) চটি একটা কবিতার সংকলন নিজ খরচায় বের করলেন। সেখানেও তিনি আমার একটা কবিতা (নিতান্তই দয়াবশত) ছাপলেন। কয়েকটা লাইন এখনো মনে আছে—
রঙিন সুতার ছিপ ফেলে এক প্রজাপতি
ধরতে গিয়ে
উল্টে পড়ে এই উঠোনেই।
মাগো, তোমার খুন হয়েছে বিশ বছরের যুবক ছেলে…
আমার কাব্যরোগ পুরোপুরি কীভাবে সারল সেই গল্প বলি। আমার কাব্যরোগের প্রধান এবং একমাত্র চিকিৎসকের নাম হুমায়ূন কবির (কুসুমিত ইস্পাতের কবি, দেশ স্বাধীন হবার পর আততায়ীর হাতে নিহত)। আমি তার কাছে তিনটা টাটকা কবিতা নিয়ে গেছি। টাটকা, কারণ গত রাতেই লেখা। চব্বিশ ঘণ্টা পার হয় নি। বাসি হবার সময় পায় নি। কবিতা বাসি হতে বাহাত্তর ঘণ্টা লাগে।
অধ্যাপক হুমায়ূন কবির বললেন, কী চাই?
আমি অতি বিনয়ের সঙ্গে বললাম, তিনটা কবিতা নিয়ে এসেছি।
তাঁর কাছে কবিতা নিয়ে যাবার কারণ তখন বাংলা একাডেমী ঠিক করেছে গল্প, প্রবন্ধ এবং কবিতার তিনটি আলাদা সংকলন বের করবে। সংকলনগুলিতে প্রধান লেখকদের লেখা যেমন থাকবে, অপ্রধানদেরও থাকবে। অধ্যাপক হুমায়ূন কবির কবিতা সংকলনটির সঙ্গে যুক্ত। তার কৃপায় যদি বাংলা একাডেমী সংকলনে স্থান পাওয়া যায়। হুমায়ূন কবির বললেন, আপনার কবিতা কি কোথাও ছাপা হয়েছে?
আমি বললাম, জি-না।
ছন্দ সম্পর্কে কোনো জ্ঞান আছে?
জি-না।
অন্যের কবিতা পড়েন?
জি-না।
তিনবার জি-না শোনার পর তিনি ছোট্ট একটি বক্তৃতা দিলেন। বক্তৃতা শুনে মনে খুব কষ্ট পেলেও তার প্রতিটি কথাই ছিল সত্যি। অবশ্যই কবিতা কোনো সস্তা বাজারি বিষয় নয়। কবিতা লিখতে যে মেধা এবং মনন লাগে, তার জন্ম এই ভুবনে না। কবিতার ছন্দ শিখতেই লাগে দশ বছর।
আমি ভগ্নহৃদয়ে তিনটা টাটকা কবিতা নিয়ে মহসিন হলে ফিরলাম। তিনটা কবিতাই বহুখণ্ডে ছেঁড়া হলো। রোগমুক্তির আনন্দ নিয়ে আমি Chemistry-র বই খুলে বসলাম। পড়াশোনা ঠিকমতো করতে হবে, ভালো রেজাল্ট করতে হবে। একসময় সংসারের হাল ধরতে হবে। আমার মতো দরিদ্র পরিবারের একটি ছেলের মহান কাব্যরোগ মানায় না। আমি কবিতা লেখা পুরোপুরি ছেড়ে দিলাম।
‘বলপয়েন্ট’-এর প্রথম কিস্তি এই পর্যন্ত লিখেছি। এইটুকুই ছাপা হবার কথা। পড়তে দিয়েছি শাওনকে। সে বলল, তুমি তো ভুল কথা লিখেছ। তুমি গদ্যলেখক সেটা ঠিক, কিন্তু সারাজীবনই তো প্রচুর কবিতা লিখেছ, গান লিখেছ।
আমি বললাম, এইসব ফালতু ফরমায়েশি জিনিস।
শাওন বলল, আমার সঙ্গে পরিচয়ের সময় প্রায়ই আমাকে চার লাইন, ছয় লাইনের কবিতা লিখে পাঠাতে। সেগুলি তো ফালতু না।
আমি বললাম, সেগুলি তোমাকে উদ্দেশ করে লেখা বলেই তোমার কাছে ফালতু কখনোই মনে হবে না। আসলে ফালতু।
শাওন স্যুটকেস খুলে একটা চিরকুট বের করে বলল, এখানের আTটা লাইন কি ফালতু?
আমি লাইনগুলি হুবহু তুলে দিলাম। পাঠক বিচার করবেন।
আমাকে নিয়ে নানা গল্প আছে
সেই গল্পে আছে একটা ফাঁকি
বিরাট একটা বৃত্ত এঁকে নিয়ে
ভেতরে নাকি আমি বসে থাকি।
কেউ জানে না শাওন, তোমাকে বলি
বৃত্ত আমার মজার একটা খেলা
বৃত্ত-কেন্দ্রে কেউ নেই, কেউ নেই
আমি বাস করি বৃত্তের বাইরেই।
০২.
You can divorce your spouse, you can fire your secretary, abandon your children. But they remain
your coauthors forever.
–Ellen Goodman
স্যার, আপনি প্রথম লেখালেখি শুরু করেন কখন?
যখন আমি ক্লাস ওয়ানে পড়ি তখন অ আ লেখা শুরু করি।
এই লেখার কথা বলছি না স্যার। ক্রিয়েটিভ রাইটিং।
ক্রিয়েটিভ রাইটিংও ক্লাস ওয়ানেই শুরু করি। আমি ‘ক’ লিখতাম উল্টো করে। দেখতে অনেকটা ‘ঘ’য়ের মতো। একে নিশ্চয়ই তুমি ক্রিয়েটিভ রাইটিং বলবে!
স্যার, প্রথম যে গল্প লিখেছেন সেটার কথা বলুন।
আমার প্রথম লেখা গল্পটা অন্যের লেখা।
বুঝতে পারছি না। একটু যদি বুঝিয়ে বলেন।
নিজের নামে চিটাগাং কলেজিয়েট স্কুলের ম্যাগাজিনে যে গল্প ছাপা হয়েছিল, সেটা আমার বাবার লেখা।
ওনার লেখা গল্প চুরি করে আপনি স্কুল ম্যাগাজিনে দিয়েছেন!
তোমার প্রশ্নের জবাব আর দিতে ইচ্ছা করছে না। এখন বিদায়!
তাহলে আমি কী লিখব?
তোমার যা ইচ্ছা লেখো।
কথোপকথন হচ্ছে আমার সঙ্গে মাহফুজ আহমেদের। সে তখনো বিখ্যাত নায়ক হয় নি। পূর্ণিমা নামের একটা পত্রিকায় কাজ করত। হঠাৎ তার ইচ্ছা হলো ‘এক হাজার একটি প্রশ্নে হুমায়ুন আহমেদ’ নামে বই লিখবে। আমার শহীদুল্লাহ হলের বাসায় রোজ অসময়ে এসে বসে থাকে। প্রশ্নে প্রশ্নে মহাবিরক্ত করে। শেষের দিকে তাকে আমি বললাম, একটা কাজ কর, নিজেই প্রশ্ন করে নিজেই উত্তরগুলো দিয়ে দাও। আমি কিছুই বলব না। মাহফুজ আহমেদ নিষ্ঠার সঙ্গে এই কাজটা করে বই বের করে ফেলল। বইয়ের কয়েকটা এডিশনও হয়ে গেল।
মাহফুজকে আমার প্রথম লেখা গল্পের ইতিহাস বলা হয় নি।
এখন বলি। পড়ি ক্লাস সেভেনে, স্কুল-ম্যাগাজিনে গল্প দিতে হবে। একটা ভূতের গল্প লিখেছি। বাবা বললেন, দেখি কী লিখেছিস।
আমি বাবার হাতে গল্প দিলাম। তিনি বললেন, অনেক কারেকশন লাগবে। কলম দে।
কলম দিলাম। বাবা গল্প কাটাকাটি করে ছেঁড়াবেড়া করে দিয়ে বললেন, কপি করে আন।
আমি কপি করে তার কাছে দিলাম তিনি আবারো শুরু করলেন কাটাকুটি। তৃতীয় দফায় কাটাকুটির পর যা অবশিষ্ট রইল, সেটা আর যাই হোক আমার গল্প না। আমার গল্পে একজন বুড়ো মানুষের হুঁকা টানার কথা ছিল। সেখানে কলকের বিষয়ে কোনো কথা নেই। বাবা কলকের দীর্ঘ বর্ণনা দিলেন। তার দিয়ে মোড়া, কোণ সামান্য ভাঙা ইত্যাদি। আমি সেই গল্পই জমা দিলাম। গল্প ছাপা হলো। বাবা পুত্র-প্রতিভায় মুগ্ধ হলেন। অফিসে স্কুল-ম্যাগাজিন নিয়ে যান। কলিগদেরকে ছেলের গল্প পড়ে শুনিয়ে নিজেই বলেন–অসাধারণ!
আমার মার গল্প লেখার শখ ছিল। তার কয়েকটি গল্প আল ইসলাহ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। সমস্যা একটাই, সব গল্পই বাবা এমনভাবে কাটাকুটি করেছেন যে, গল্পগুলি মূলত তাঁরই হয়েছে। মার গল্প হয় নি।
কিছুদিন আগে আমার মা’র আত্মজীবনীমূলক একটি রচনা জীবন যেখানে যেমন সময় প্রকাশন প্রকাশ করেছে। বইটির সাতটি মুদ্রণও হয়েছে। বাবা বেঁচে থাকলে কাটাকুটির পর এই বইয়ের কী গতি হতো কে জানে।
সাহিত্য কী হবে, কেমন হবে, এই বিষয়ে বাবার নিজস্ব ধারণা ছিল। তাঁর কাছে সাহিত্য কঠিন সাধনা এবং কঠিন পরিশ্রমের বিষয়। সঙ্গীতশিল্পীকে যেমন রোজ রেয়াজ করতে হয়, যে সাহিত্য করবে তাকেও রোজ রেয়াজ করতে হবে। এই রেয়াজ হচ্ছে, কবিতা মুখস্থ করতে হবে। বাবা গীতাঞ্জলি থেকে বেছে তার পুত্রকন্যাদের কবিতা ঠিক করে দিতেন। এইসব কবিতা মুখস্থ করে তাঁকে শোনাতে হবে। জাফর ইকবালের ভাগে পড়ল ‘প্রশ্ন’ কবিতা। আমার ছোটবোনের ভাগে পড়ল—‘আমি চঞ্চল হে সুদূরের পিয়াসী’। আমি যেহেতু বড় ছেলে, আমার ভাগে পড়ল—-‘এবার ফেরাও মোরে’, ১২৮ লাইনের একটা কবিতা। কবিতাটা বিএ ক্লাসে তাঁর পাঠ্য ছিল। খুবই প্রিয় কবিতা।
আমার দুই ভাইবোনই মেধাবী। তারা দ্রুত কবিতা মুখস্থ করে বাবাকে শুনিয়ে এক আনা করে পুরস্কার পেল। আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল, অতি কঠিন এই কবিতা কিছুতেই মুখস্থ হয় না। আমার বয়স তখন কত? নয় বছর, ক্লাস ফোরে পড়ি।
রবীন্দ্রনাথ আমার জীবনে বিভীষিকার মতো উপস্থিত হলেন। এই বিশেষ কবিতাটি তিনি কেন লিখেছেন? এর অর্থ কী?–কিছুই জানি না। কবিতা মুখস্থ করার চেষ্টা করি। কোনো লাভ হয় না। সব জট পাকিয়ে যায়।
বার্ষিক পরীক্ষার পর স্কুলে অনুষ্ঠান হয়। সেইসব অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া আমাদের ভাইবোনদের জন্যে পিতৃআদেশে বাধ্যতামূলক। আমাকে কবিতা আবৃত্তিতে নাম দিতে হলো। কবিতার নাম ‘এবার ফেরাও মোরে’। কবি শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কী সর্বনাশ!
কবিতা আবৃত্তির সময় উপস্থিত হলো। আমাকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হলো। দর্শকের সারিতে হাসিমুখে আমার বাবা উপস্থিত। পুত্র-প্রতিভায় মুগ্ধ হবার জন্য তৈরি।
আমি কবিতার নাম এবং কবির নাম বলে মুখ ভোঁতা করে দাঁড়িয়ে আছি। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি। একটি লাইনও মনে পড়ছে না। কেঁদে ফেলা ঠিক হবে কি-না তাও বুঝতে পারছি না। হঠাৎ স্পষ্ট শুনলাম আমার কানের কাছে কে যেন শান্ত গলায় বলল, ‘সংসারে সবাই যবে সারাক্ষণ শতকর্মে রত’।
আরে এটাই তো কবিতার প্রথম লাইন। আমি গড়গড় করে বলে যাচ্ছি। যেখানেই আটকানোর আশঙ্কা সেখানেই কেউ একজন বলে দিচ্ছে।
বালক বয়সে ব্যাপারটা অতি বিস্ময়কর মনে হয়েছিল। এখন জানি এটা মস্তিষ্কের একটা খেলা। পুরো কবিতাটাই অবচেতন মনে জমা করা আছে। অবচেতন মস্তিষ্ক চেতন মস্তিষ্ককে সময়মতো তথ্য পৌঁছে দিচ্ছে। প্রকৃতি রহস্যময় আচরণ করলেও প্রকৃতি রহস্য পছন্দ করে না।
বালকের মুখে অতি দীর্ঘ এই কবিতায় আমাদের হেড স্যার মুগ্ধ হয়ে একটা বিশেষ পুরস্কার ঘোষণা করলেন। আমার হাতে ঢাউস এক বই ধরিয়ে দিলেন। খুলে দেখি এ টি দেবের ইংলিশ টু বেঙ্গলি ডিকশনারি। আমার চোখে পানি আসার উপক্রম হলো। ডিকশনারি দিয়ে আমি কী করব? অন্যরা কত সুন্দর সুন্দর পুরস্কার পেয়েছে—গল্পের বই, থালাবাটি, চায়ের কাপ। আর আমার হাতে কিনা ডিকশনারি?
রবীন্দ্রনাথ আরো একবার আমার ঘাড়ে ভর করলেন। আমি তখন চিটাগাং কলেজিয়েট স্কুলে ক্লাস সেভেনে পড়ি। স্কুলে বড় করে অনুষ্ঠান হবে। স্বয়ং শিক্ষামন্ত্রী উপস্থিত থাকবেন। সাজ সাজ রব। অনুষ্ঠান পরিচালনা করছেন হরলাল রায় স্যার। তিনি আমাকে ডেকে বললেন, তুই রবীন্দ্রনাথের একটা কবিতা আবৃত্তি করবি। আজি হতে শতবর্ষ পরে। কবিতা মুখস্থ করে আয়, কীভাবে আবৃত্তি করতে হবে আমি শিখিয়ে দেব।
কবিতা মুখস্থ হয়ে গেল। স্যার আবৃত্তি শিখিয়ে দিচ্ছেন। শিক্ষামন্ত্রী যেখানে বসে থাকবেন সেদিকে আঙুল তুলে বলবি ‘কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি?’ দুই হাত অঞ্জলির মতো করে বলবি ‘পারিব কি পাঠাইতে তোমাদের করে?’ যে জায়গায় আছে—‘আজিকার কোনো ফুল’ সেখানে আঙুল এরকম করে একটা মুদ্রা করবি। এই মুদ্রার নাম পদ্মমুদ্রা (শাওন বলল, পদ্মমুদ্রা বলে কোনো মুদ্রা নেই। আলাপদ্ম মুদ্রা আছে। আমার ধারণা আলাপদ্মই বাংলায় পদ্ম)।
আমার কাছে আবৃত্তির পুরো বিষয়টাই অস্বাভাবিক লাগল। হরলাল রায় স্যারকে এটা বলার সাহস হলো না।
সৌভাগ্যের বিষয় শিক্ষামন্ত্রী এলেন না। আমাদের আয়োজন জৌলুসহীন হয়ে গেল। অনুষ্ঠানের রাতে স্টেজে উঠে দেখি বাবা এসেছেন। পুত্রের প্রতিভা দেখার জন্যে গভীর আগ্রহ নিয়ে বসে আছেন। শিক্ষামন্ত্রী যেহেতু নেই আমি বাবার দিকে আঙুল তুলে বললাম, ‘কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি?’ বাবা নড়েচড়ে বসলেন।
বাবা বাসায় ফিরে মাকে বললেন, তোমার বড় ছেলে এমন সুন্দর কবিতা আবৃত্তি করেছে, ওকে পুরস্কার হিসাবে দশটা টাকা দিয়ে দাও। সংসার খরচের সব টাকা থাকে মা’র কাছে। টাকা দিতে হলে তাকেই দিতে হবে। দশ টাকা তখন অনেক টাকা। আমি দীর্ঘদিন ঘ্যানঘ্যান করার পর মা’র কাছ থেকে দু’টাকা আদায় করতে পারলাম। সেই টাকায় সঙ্গে সঙ্গে চারটা স্বপন কুমার সিরিজের বই কিনে আনলাম। প্রতিটি বইয়ের দাম আট আনা। এই প্রথম রবীন্দ্রনাথের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা বোধ করলাম।
এক যুগ আগে কী একটা কাজে চিটাগাং গিয়েছি। খোঁজ নিয়ে জানলাম হরলাল রায় স্যার জীবিত। রিটায়ার করেছেন। শরীর দুর্বল। দিনরাত শুয়েই থাকেন।
ঠিকানা জোগাড় করে তাকে দেখতে গেলাম। পা স্পর্শ করে বললাম, স্যার আমি হুমায়ূন। স্যার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, তুই হুমায়ূন না রে ব্যাটা। তুই হুমায়ূন আহমেদ। বলেই হৈচৈ শুরু করলেন, কে এসেছে দেখ। কে এসেছে দেখ। সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখে পানি এসে গেল। মনে হলো আমার মানবজন্ম সার্থক। (আমি অকৃতী অধম বলেও তো কিছু কম করে মোরে দাও নি। যা দিয়েছ তারই অযোগ্য ভাবিয়া কেড়েও তো কিছু নাও নি। )
পৃথিবীতে কিছু ব্যাধি আছে যার ওষুধ নেই। যেমন ক্যানসার, পাঠব্যাধি। পাঠব্যাধিতে আক্রান্তজনকে কিছু-না-কিছু পড়তেই হবে। পড়ার কিছু না থাকলে মনে হবে, মরে যাই। অতি অল্পবয়সে আমি এমন এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলাম। প্রচণ্ড পড়ার ক্ষুধা। পড়ার বই নেই। বাবার সমস্ত বই তালাবন্ধ। কারণ সবই বড়দের বই। পড়ার বয়স হয় নি।
আমাদের শৈশবে পড়ার বইয়ের বাইরের সব বইয়ের সাধারণ নাম আউটবুক। ছাত্রদের জন্যে আউট বুক সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কারণ আউট বুক দুটো কাজ করে—
সময় হরণ করে। চরিত্র হরণ করে।
.
আমরা তখন থাকি সিলেটের মীরাবাজারে। আমাদের সঙ্গে এক চাচা এবং এক মামাও থাকেন। তারা সিলেট MC কলেজের ছাত্র। তাদের প্রধান কাজ প্রতি বছর ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেওয়া এবং ফেল করা। মাঝে মাঝে তারা গল্প উপন্যাসের বই নিয়ে আসেন এবং এমন এমন জায়গায় লুকিয়ে রাখেন যে, খুঁজে বের করতে শার্লক হোমস লাগে।
একদিন খুঁজে পেয়ে গেলাম। তারা বই লুকিয়ে রাখেন বালিশের ওয়ারের ভেতর। একদিন সেখান থেকে একটা বই উদ্ধার করলাম। বইয়ের নাম দুটি বৃন্তে একই ফুল। মলাটে গাছের দুই শাখায় নয়নতারা ফুলের মতো ফুল। ফুলের ভেতরে দু’টা মেয়ের মুখ। খাটের নিচে বসে লুকিয়ে বই পড়ে ফেললাম। কাহিনী হচ্ছে, দুই বোন একই সঙ্গে এফ এ ক্লাসে পড়ছে এমন একটি ছেলের প্রেমে পড়েছে। দুটি মেয়ের চোখেই বিজলি জ্বলে। বিজলি একটা ভয়াবহ জিনিস। বিজলির পরপরই বজ্রপাত। এই বিজলি মেয়ে দুটির চোখে কেন জ্বলে কিছুই। বুঝলাম না।
এ ছাড়াও ব্যাপার আছে, মেয়ে দুটির বুকে বুনোফুল প্রস্ফুটিত হবার জন্যে অপেক্ষায়। বুকে ফুল কীভাবে ফুটবে সেটা আরেক রহস্য।
খাটের নিচে বসে আমি নিষিদ্ধ বই পড়ছি, খবরটা প্রকাশিত হয়ে পড়ল। মা তালপাতার পাখা দিয়ে মেরে কঠিন শাস্তি দিলেন। আমার এই গুরুতর অপরাধ উচ্চ আদালতে (বাবার কাছে) পেশ করলেন। বাবা তার পরদিনই আমাকে কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদে নিয়ে গেলেন। লাইব্রেরির সদস্য করে দিলেন। আমি নিশ্চিত ছিলাম সেই বিশাল লাইব্রেরির সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। হঠাৎ প্রকাণ্ড একটা জানালা আমার সামনে খুলে গেল। জানালা দিয়ে আসা অলৌকিক আলো আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল।
০৩.
Everyone who works in the domain of fiction is a bit crazy. The problem is to render this
craziness interesting.
–Francois Truffaut.
‘সুনীল সাগর’ বাক্যটা সুন্দর। ‘স’-এর অনুপ্রাস আছে। বাক্যের দু’টা শব্দই তিন অক্ষরের বলে প্রচ্ছন্ন ছন্দের দোলা আছে। বাক্যটি সাগরের গুণ প্রকাশ করছে। ‘সুনিলিত সাগরিত’ বাক্যটায় কী বোঝাচ্ছে। সম্পূর্ণ অর্থহীন একটা বাক্য না? বছর ত্রিশ আগে আমরা ঠিক করলাম, একটা পারিবারিক দেয়াল পত্রিকা প্রকাশ করব। দেয়াল পত্রিকার নাম হবে ‘সুনীল সাগর’। আমি সেই নাম পাল্টে নাম দিলাম ‘সুনিলিত সাগরিত’। সম্পূর্ণ অর্থহীন নাম।
আমি প্রধান সম্পাদক। জাফর ইকবাল, আহসান হাবীব ছিল পত্রিকার অঙ্গসজ্জার দায়িত্বে। পনেরো দিন পর পর ঢাউস এক কাগজে সবার লেখা ছাপা হতো। কেউ বাদ যেত না। সুনিলিত সাগরিত পত্রিকাটি আমাদের পারিবারিক ধারাবাহিক ইতিহাস। আমার নিজের লেখালেখির ইতিহাস। আমার দুই ভাইয়ের লেখালেখিরও ইতিহাস। দুই বোন সুফিয়া ও শিখুও ভালো লিখত। তারা কেন জানি এই পারিবারিক পত্রিকার বাইরে নিজেদের প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকল।
দেয়াল পত্রিকার প্রকাশনা অতি সঙ্গত কারণেই ছিল অনিয়মিত। একটা পর্যায়ে প্রকাশনা হয়ে দাঁড়াল পারিবারিক বিশেষ বিশেষ ঘটনানির্ভর। পরিবারের একজন সদস্যের বিয়ে হচ্ছে, সেই উপলক্ষে প্রকাশনা। কেউ প্রথমবারের মতো দেশের বাইরে যাচ্ছে বা কারো প্রথম সন্তানের জন্ম হচ্ছে, সেই উপলক্ষে বিশেষ সংখ্যা। সুনিলিত সাগরিতের সর্বশেষ সংখ্যাটি বের হয় আমার বড় মেয়ে নোভা। আহমেদের বিয়ে উপলক্ষে। পরিবারের বাইরের কারো লেখাই এখানে প্রকাশের নিয়ম নেই। কিন্তু আমার খুব ইচ্ছা ছিল ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নোভাকে আশীবাদ জানিয়ে যে চারটি লাইন লিখেছিলেন তা পত্রিকায় ঢোকানো। তা সম্ভব হয় নি। সংসার ছেড়ে বাইরে চলে আসার কারণে পত্রিকাটির ওপর আমার কোনো। নিয়ন্ত্রণ ছিল না। আমি নিজে যে লেখাটি লিখেছিলাম সেটিও প্রকাশ হবে কিনা তা নিয়েই শঙ্কিত ছিলাম।
আমি আমার বড় মেয়ের বিয়েতে বিশেষ কোনো উপহার দিতে চেয়েছিলাম। শাড়ি, গয়না, ফ্রিজ, টিভির বাইরে কিছু। কী দেয়া যায় কী দেয়া যায়? নোভার অতি প্রিয় লেখকের নাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। নোভার বিয়ের আসরে তার প্রিয় লেখককে উপস্থিত করলে কেমন হয়? এই উপহারটি হয়তো তার পছন্দ হবে।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং তার স্ত্রী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়কে নিমন্ত্রণ জানালাম। তাদের বললাম, মেয়ের বিয়েতে gift হিসেবে তাদের প্রয়োজন। আমাকে অবাক করে দিয়ে দুজনেই চলে এলেন। এয়ারপোর্টে থেকে সরাসরি বিয়ের আসর বিডিআর-এর দরবার হলে উপস্থিত হলেন। নোভা তার বরকে নিয়ে স্টেজে বসে ছিল। বিয়ের এবং উৎসবের উত্তেজনায় সে খানিকটা দিশেহারা। আমি বললাম, মা, তোমার বিয়ের গিফট দেখে যাও। নোভা তার অতি প্রিয় লেখককে বিয়ের আসরে উপস্থিত দেখে চমকে উঠল।
পাঠক কি ধরতে পেরেছেন মানুষকে চমকে দেয়ার একটা প্রবণতা আমার মধ্যে আছে? সৃষ্টিশীল সমস্ত কর্মকাণ্ডে চমক একটি বিশেষ জায়গা দখল করে আছে। আমরা কখন চমকাই? সচরাচর ঘটে না তা ঘটতে দেখলে চমকাই।
একজন Fiction writer চমকের ব্যাপারটি কিন্তু তার মাথায় রাখেন, কেউ অবচেতনভাবে এই কাজটি করেন, আবার কেউ সচেতনভাবেই করেন। যেমন জর্জ বার্নাড শ। লেখালেখির সময় সচেতন এবং অবচেতনভাবে অনেক কিছু করতে হয় বলেই এই কর্মটি অতীব জটিল।
Writing is a dog’s life, but the only
life worth living.
–Gustave
Flauvert.
লেখকের জীবন হলো কুকুরের জীবন, কিন্তু এই একমাত্র
অর্থবহ জীবন। অধ্যাপনা ছেড়ে আমি একসময় কুকুরের জীবন বেছে নেব তা কখনো ভাবি নি। এক দুপুরের কথা। বয়স উনিশ। মন আবেগে পূর্ণ। ইউনিভার্সিটি ছুটি হয়েছে। ছুটি কাটাতে বরিশালের পিরোজপুরে গিয়েছি। একগাদা chemistry বই নিয়ে গেছি। আগামীকাল থেকে পড়তে শুরু করব, এই ভেবে ভেবে সময় কাটাচ্ছি। বইয়ের পাতা খোলা হচ্ছে না। বিকালে কেমন যেন অস্থির লাগে। আমি হাঁটতে বের হই। হুলারহাটের দিকে এগুতে থাকি। প্রথমেই একটা কবরখানা পড়ে। গাছপালায় ঢাকা এমন সুন্দর একটা জায়গা। একদিন কবরখানার ভেতরে ঢুকলাম। অবাক কাণ্ড, কবরখানার ভেতর টলটলে পানির ছোট্ট একটা পুকুর। পুকুরের পাশে শ্যাওলা ধরা এক কামরার মসজিদ ভাঙা ঘাট। ভাঙা ঘাটে অতি বৃদ্ধ একজন (সম্ভবত মসজিদের ইমাম, কবরখানার কেয়ারটেকার) আমাকে দেখে বললেন, কী চান বাবা।
আমি বললাম, কিছু চাই না।
কবরখানায় ঘুরতেছেন কেন?
বেড়াচ্ছি।
বাবা, এইটা কি কোনো বেড়ানোর জায়গা? আছরের ওয়াক্ত হয়েছে, আসেন নামাজ পড়ি।
আমি বললাম, আমার অজু নাই।
পুকুরে পানি আছে। অজু করেন।
বৃদ্ধ কঠিন চোখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। একবার ইচ্ছা করল দৌড়ে পালিয়ে যাই। কেন জানি সাহসে কুলাল না। বৃদ্ধ অজু করে উঠে দাঁড়িয়েছেন। অপেক্ষা করছেন আমার জন্যে।
অজু কীভাবে করতে হয় জানেন?
জানি।
অজুর দোয়া জানেন?
জি-না।
থাক, দোয়া লাগবে না। অজু করে আসেন। একত্রে নামাজ পড়ি।
আমি অজু করলাম এবং বৃদ্ধকে নিয়ে অন্ধকার মসজিদে ঢুকলাম। আসরের নামাজের দোয়া মনে মনে পড়তে হয়। বৃদ্ধ কিন্তু শব্দ করে পড়ছেন। সূরা ফাতিহার পর তিনি অতি দীর্ঘ একটা সূরা পাঠ করতে শুরু করলেন। ভয়ে আমি অস্থির হয়ে গেলাম। দ্রুত অন্ধকার নামছে। চারদিকে কবর। পুকুরের পানিতে কেউ সাঁতরাচ্ছে এমন শব্দ হচ্ছে। নামাজের শেষে তিনি দীর্ঘ দোয়ায় বসলেন। এই দোয়া কোনোদিন শেষ হবে আমার এরকম মনে হলো না। নামাজে সালাম ফেরানোর একটা ব্যাপার আছে। একবার ডানে একবার বামে সালাম দিতে হয়। এই অতি বৃদ্ধ মাওলানা দোয়ার মধ্যেও কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে দিয়ে সালাম ফেরাচ্ছেন। পাগল না তো?
ঠিক মাগরেবের আগে আগে বৃদ্ধ দোয়া শেষ করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, যান বাড়িত যান।
আমি বললাম, আপনি একা একা এখানে থাকেন?
হুঁ।
একাই নামাজ পড়েন?
বৃদ্ধ বললেন, একাই নামাজ পড়ি। তবে মাগরেব এবং এশার ওয়াক্তে অনেক জিন আমার সঙ্গে নামাজ পড়ে। সূরা পাঠে ভুল করলে তারা লোকমা দেয়।
আমি দ্রুত বের হয়ে এলাম। মাগরেবের ওয়াক্তের বাকি নাই। জিনরা সম্ভবত আসতে শুরু করেছে।
আমার বৈকালিক ভ্রমণে পিরোজপুর গোরস্থান একটি বিশেষ জায়গা দখল করে ফেলল। প্রায়ই সেখানে যাই, কবরের গায়ে লেখা নামগুলি পড়ি। বৃদ্ধ কেয়ারটেকারকে দেখি কবর পরিষ্কার করছেন। ঝোপঝাড় কাটছেন। তিনি আর কখনো আমাকে নামাজ পড়তে ডাকেন নি। তাঁর সঙ্গে আমার কথাবার্তা তেমন হতো না। একদিন শুধু বললেন, আপনার কোনো আত্মীয়স্বজন কি এখানে আছেন।
আমি বললাম, না।
তাহলে রোজ আসেন কেন?
আমি চুপ করে রইলাম। জবাব দিতে পারলাম না। বৃদ্ধ বিড়বিড় করে বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাপাকের কোনো ইশারা আছে বইল্যাই আপনে আসেন।
জানি না কাকতালীয় ব্যাপার কি-না, মিলিটারির হাতে নিহত আমার বাবার কবর হয় এই পিরোজপুরের গোরস্থানেই।
কবরস্থান-বিষয়ক অংশটি বিস্তারিত লেখার একটা কারণ আছে। আমি একদিন কবরস্থান থেকে ফিরেই প্রথম উপন্যাস লেখায় হাত দিই। সন্ধ্যাবেলা আয়োজন করে Chemistry-র বই বের করে পড়তে বসি। খাতায় লেখি—The term ‘macromolecule’ was first suggested by Staudinger.
এইটুকু লিখেই পরের লাইনে লিখলাম বাস থেকে নেমে হকচকিয়ে গেলাম।
Macromolecule-এর সঙ্গে বাসের কোনোই সম্পর্ক নেই। তারপরেও কেন লিখলাম!
বাইরে তখন বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বাসার সামনে বিশাল পুকুর। পুকুর থেকে ঝুপ ঝুপ বৃষ্টির শব্দ আসছে। পিরোজপুর শহরে বৃষ্টি হওয়া মানেই কারেন্ট চলে যাওয়া। আমি সিরিয়াসলি পড়ছি ভেবেই আমার সামনে হারিকেন দেয়া হয়েছে। আমার মাথার ভেতর একের পর এক লাইন আসছে। এক ধরনের অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে আমি লিখতে শুরু করেছি আমার প্রথম উপন্যাস—শঙ্খনীল কারাগার।
বৃষ্টিতে ভেসে গেছে সব। রাস্তায় পানির ধারা স্রোত। লোকজন চলাচল করছে না, লাইটপোস্টের বাতি নিবে আছে। অথচ দশ মিনিট আগেও যেখানে ছিলাম সেখানে বৃষ্টির নামগন্ধ নেই। শুকনা খটখট করছে চারদিক। কেমন অবাক লাগে ভাবতে, বৃষ্টি এসেছে, ঝুপ ঝুপ করে একটা ছোট্ট জায়গা ভিজিয়ে চলে গেছে। আর এতেই আশৈশব পরিচিত এ অঞ্চল কেমন ভৌতিক লাগছে। হাঁটতে গা ছমছম করে।
শঙ্খনীল কারাগার আমার প্রথম লেখা উপন্যাস, যদিও প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস নন্দিত নরকে। আমার পরম সৌভাগ্য, আমার বাবা শঙখনীল কারাগার উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি পড়ে যেতে পেরেছেন। সেই গল্প আরেকদিন করব।
০৪.
উনিশ বছর বয়সের অনেক তরুণ-তরুণী উপন্যাস লিখেছে। এটা এমন কোনো উল্লেখযোগ্য ব্যাপার না। যেটা উল্লেখ করার মতো সেটা হচ্ছে, আমি লিখেছি খুব দ্রুত। তিন রাতের বেশি সময় লেগেছে বলে আমার মনে হয় না। উপন্যাস শেষ করেছি মধ্যরাতে। শেষ করার পর পর মনে হয়েছে–ইশ, কাউকে যদি পড়াতে পারতাম! এমন সুন্দর একটা গল্প। কেউ জানবে না?
সুন্দর একটা গল্প বলেছি এটা বুঝতে পারছিলাম। লেখার সময় প্রতিটি চরিত্র চোখের সামনে ভাসছিল। রাবেয়া আপা অনেকবার আমার সামনে দিয়ে হেঁটে গেছেন, প্রতিবারই তার কাঁচের চুড়ির শব্দ শুনেছি। কিটকি গায়ে চমৎকার সেন্ট মাখে। যতবার কিটকির কথা লিখেছি, ততবারই সেন্টের গন্ধ পেয়েছি। উপন্যাসের কিছু কিছু জায়গা লেখার সময় টপটপ করে চোখ দিয়ে পানি পড়েছে।
গল্প ভালো লিখেছি বুঝতে পারছি, কিন্তু উপন্যাস কি হয়েছে? উপন্যাস লেখার নিশ্চয়ই অনেক নিয়মকানুন আছে। আমি তো কিছুই জানি না।
উপন্যাস লেখার বিষয়ে সমারসেট মম বলেছেন—There are three rules for writing the novel. Unfortunately no one knows what they are.
তিন মাসের জন্য লেখালেখি শেখার একটা স্কুলে আমি ক্লাস করেছিলাম। আমার আগে সেই স্কুলে পশ্চিমবঙ্গের আরেক ঔপন্যাসিকও ক্লাস করেছেন। তাঁর নাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। স্কুলটা হলো আমেরিকার আইওয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির ক্রিয়েটিভ রাইটিং ফ্যাকাল্টি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সেই স্কুল থেকে কিছু শিখতে পেরেছিলেন কি-না আমি জানি না। আমি কিছুই শিখতে পারি নি।
মনে আছে একদিন আমাদের শিক্ষক Idea বিষয়ে এক ঘণ্টার ক্লাস নিলেন। তিনি বললেন, কীভাবে Idea লালন করতে হয়। Idea-র পূর্ণতার জন্য সময় দিতে হয়।
তারপর idea-কে প্রকাশের উপায়গুলো নিয়ে ভাবতে হয়।
আমি মহাবিরক্ত হয়ে উসখুস করছি। শিক্ষকের সেটা চোখ এড়াল না। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ডক্টর আহমেদ (সব ছাত্রের নাম তিনি জানতেন), আইডিয়া বিষয়ে তোমার কি কিছু বলার আছে?
আমি উঠে দাঁড়ালাম এবং পরিষ্কার গলায় বাংলায় বললাম,
শিল্পীর শিরে কিলবিল করে আইডিয়া
উইপোকা বলে, চল ভাই তারে খাই
গিয়া।
শিক্ষক বললেন, What does it mean?
আমি ইংরেজিতে অনুবাদ করে তাকে শোনাব, উইপোকার ইংরেজি কিছুতেই মাথায় আসছে না। শেষটায় বললাম
Creative person’s head is full
with ideas
Little bugs say, let us eat them.
তিনি হতাশ গলায় বললেন, এখনো বুঝতে পারছি না।
আমি বললাম, আইডিয়া হলো ক্ষুদ্র পোকাদের আহার। এর বেশি কিছু না।
পুরনো কথায় ফিরে যাই। প্রথম উপন্যাস ভূমিষ্ঠ হয়েছে। এখন কী করা যায়? আমি বাবার অফিসের ফাইলের নিচে গোপনে রেখে চলে এলাম। বাবা ফাইল দেখতে দেখতে পাণ্ডুলিপি পেয়ে যাবেন। এবং অবশ্যই আগ্রহ নিয়ে পড়বেন।
বাবার অফিস ছিল আমাদের বাসারই একটা কামরা। ফাইলপত্রে ঠাসা একটা ঘর। বাবার মাথার ওপর বিশাল এক টানা পখি। রশিদ নামের একজন ছিল সরকারি পাংখাপুলার। তার কাজ মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে আধো ঘুম আধো জাগরণ অবস্থায় যন্ত্রের মতো পাখার দড়ি টেনে যাওয়া। অয়োময় নাটক লেখার সময় আমি একটি পাংখাপুলারের চরিত্র এনেছিলাম। বাবার পাংখীপুলার রশিদের প্রচ্ছন্ন ছায়া হয়তো তার মধ্যে ছিল।
আমি রশিদকে গোপনে বলে এলাম, যদি দেখো বাবা ফাইল বাদ দিয়ে নীল রঙের একটা খাতা পড়তে শুরু করেছেন তাহলে আমাকে খুবর দেবে। রশিদ দাঁত বের করে বলল, নিশ্চিন্ত থাকেন।
টেনশান নিয়ে আমি অপেক্ষা করছি। রশিদ কোনো খবর দিচ্ছে না। দুপুরে খাবার সময় বাবাকে ভেতরে এসে খেতে বলা হলো। বাবা বললেন, দেরি হবে। এই সময় রশিদ এসে আমাকে চোখ টিপ দিয়ে বলল, নীল খাতা! আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল।
একসময় বাবা এসে গম্ভীর ভঙ্গিতে দুপুরের খাবার শেষ করলেন। আমার লেখা বিষয়ে কোনো কথা বললেন না। সন্ধ্যাবেলা মাগরেবের নামাজ শেষ করে মা’কে ডেকে বললেন, আল্লাহপাক তোমার বড় ছেলেকে লেখক বানিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। শুকুর আলহামদুলিল্লাহ।
আমার জন্য আরো বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। বাবা রাতে আমার হাতে একতোড়া কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বললেন, এখানে একটা নাটক আছে। রেডিও নাটক। আমি লিখেছি। নাম—কত তারা আকাশে। ঢাকা বেতারের একজন। প্রডিউসারের বাড়ি পিরোজপুরে। তার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তিনি বলেছেন, নাটক ভালো হলে প্রচারের ব্যবস্থা করবেন। তুই নাটকটা পড়ে দেখ। কোনো পরিবর্তন লাগলে করে ফেলবি।
আমি মহানন্দে নাটক কাটাকাটি করতে লাগলাম। একসময় জিনিস যা দাঁড়াল, তাকে আর বাবার লেখা নাটক বলা যায় না। বাবা নাটক পড়ে বললেন, অসাধারণ জিনিস দাঁড় হয়েছে। নাটক জমা দেয়া হলো। প্রডিউসার সাহেব আশ্বাস দিলেন, প্রচার হবে, তবে দেরি হবে।
দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হবার কারণে সব এলোমেলো হয়ে গেল। পিতাপুত্রের যৌথ নাটক প্রচার হলো না।
ছুটি শেষ হয়ে গেল। আমি বাক্সভর্তি কেমিস্ট্রি বই নিয়ে ঢাকায় ফিরলাম। শঙ্খনীল কারাগারের পাণ্ডুলিপি ফেলে এলাম। পাণ্ডুলিপি সঙ্গে রাখার কিছু নেই। বই হিসাবে শঙ্খনীল কারাগার প্রকাশিত হবে, পাঠক পড়বে, কোনো একদিন বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় সেই উপন্যাস নিয়ে চলচ্চিত্র বানাবে। সেই চলচ্চিত্র দেশে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের সম্মান পাবে, মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে পাবে Honourable mention—এইসব কিছুই ঊনিশ বছরের যুবকটি জানত না।
স্বাধীনতার ত্রিশ বছর পর মা এবং ভাইবোনদের নিয়ে পিরোজপুরে বাবার কবর জিয়ারত করতে গেলাম। মা এবং ভাইবোনরা খুব কান্নাকাটি করল। অদ্ভুত কোনো কারণে আমার চোখে পানি এল না। তাদের বাসায় রেখে সন্ধ্যাবেলা আমি আবার কবরস্থানে গেলাম। আমার সঙ্গে দু’টা বই নন্দিত নরকে, তোমাদের জন্যে ভালোবাসা। নিতান্তই ছেলেমানুষের মতো বই দুটা কবরের ঝোপঝাড়ের ভেতর রেখে অনেকক্ষণ কাঁদলাম। মনে মনে বললাম, নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে রয়েছ নয়নে নয়নে।
বাবার কবরে শ্বেতপাথরে এই দু’টা লাইনই লেখা।
প্রায়ই ভাবি, আমার নিজের কবরে এপিটাফ হিসেবে কী লেখা থাকবে? লেখাটা কি আমিই লিখব? নাকি অন্য কেউ আমার হয়ে লিখে দেবে?
গায়ক আব্বাসউদ্দিনের কবর আজিমপুর গোরস্থানে। সেখানে এপিটাফ হিসাবে তার অতি বিখ্যাত গানের চরণ লেখা
বন্ধু কাজল ভ্রমরা রে
কোন দিন আসিবেন বন্ধু
কয়া কয়া যাও
যে ক’বার দেখেছি মনের ভেতরে গান গুনগুন করে উঠেছে।
এমন সুন্দর কোনো কিছু কেউ কি লিখবে আমার জন্য? কোনো পত্রিকা কি কোনো শোকগাথা প্রচার করবে? তারা কী লিখবে?
William Faulkner বলেছেন, একজন লেখকের obituary হওয়া উচিত এক লাইনের।
He wrote books, then he died.
মানুষটা বই লিখেছে, তারপর মারা গেছে।
বাহ্ চমৎকার। এর চেয়েও সুন্দর একটা কথা লিখি?
আমার প্রিয় লেখক Jorge Luis Borges বলেছেন—When writers die they become books, which is after all, not too bad an incarnation.
মৃত্যুর পর লেখকরা বই হয়ে যান।
এরচেয়ে ভালো আর কী হতে পারে?
পুনশ্চ : আমি যে পিতৃভক্ত ছেলে এই তথ্যটা নিশ্চয়ই ইতোমধ্যে পাঠকরা জেনেছেন। অতি সঙ্গত কারণে প্রশ্ন উঠতে পারে, এমন পিতৃভক্ত একজন ছেলে ত্রিশ বছর পর বাবার কবর দেখতে যায় কীভাবে? ঢাকা থেকে পিরোজপুর যেতে আট ঘণ্টা লাগে।
প্রশ্নটার জবাব আমার কাছে নেই।
সবার ব্যস্ততা। কেউ সময় বের করতে পারে না। কত কিছু। আমরা জটিল আধুনিক এক জগতে বাস করি।
তারপরেও ত্রিশ বছর পর হঠাৎ সবাইকে জড়ো করে কেন কবরস্থানে গেলাম গল্পটা বলা দরকার। এই গল্পে সামান্য Supernatural touch আছে।
বাংলাদেশের বিভাগীয় শহরগুলোতে সবুজ সাথী নামের প্রেসক্রিপসন নাটক নিয়ে অনুষ্ঠান হচ্ছে। এই সিরিয়ালটির লেখক এবং পরিচালক যেহেতু আমি, আমাকেও প্রতিটি অনুষ্ঠানে থাকতে হচ্ছে। খুলনার অনুষ্ঠান শেষ করে আমরা যাচ্ছি বরিশালে। গাড়ি করে যাচ্ছি। আমার সঙ্গে আছেন আসাদুজ্জামান নূর, জাহিদ হাসান এবং অভিনেত্রী-গায়িকা শাওন। ত্রিশ বছর পর এই অঞ্চলে প্রথম যাত্রা। সবকিছু বদলে গেছে। আমি যাচ্ছি ঘুমুতে ঘুমুতে। হঠাৎ ঘুম ভাঙল। আমি প্রায় চেঁচিয়ে বললাম, ড্রাইভার সাহেব, গাড়ি থামান। গাড়ি থামান।
আসাদুজ্জামান নূর বললেন, সমস্যা কী, শরীর খারাপ লাগছে?
আমি বললাম, শরীর খারাপ না, তবে কেমন জানি লাগছে। মনে হচ্ছে আমি অতিপরিচিত জায়গায় এসেছি।
গাড়ি থামল। আমি ঘোরলাগা অবস্থায় গাড়ি থেকে নামলাম। কিছুই চিনতে পারছি না। খুলনা-বরিশাল হাইওয়ের একটি অংশে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। আমি বিব্রত ভঙ্গিতে বললাম, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে খুব কাছে কোথাও আমার বাবার কবর।
জাহিদ বলল, কী বলেন হুমায়ূন ভাই?
শাওন বলল, উনি যখন বলছেন তখন একটু খুঁজে দেখলে হয়।
বেশি খোঁজাখুঁজি করতে হলো না। একজন বলল, সামান্য পেছনে গেলেই পিরোজপুর গোরস্থান। আমি সবাইকে নিয়ে গোরস্থানে ঢুকলাম। আমরা কবর জিয়ারত করলাম। শাওন বলল, আমি আমার জীবনে অতি রহস্যময় একটা ঘটনা দেখলাম। ছেলে পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে দেখে বাবা ছেলেকে ডেকে পাঠালেন।
সব ঘটনার পেছনেই বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা থাকে। আমার হঠাৎ ঘুম ভেঙে গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়ার পেছনেও নিশ্চয়ই কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে। থাকলেও আমি তা জানি না।
বরিশালের অনুষ্ঠান শেষ করে ঢাকায় ফিরেই আমি সব ভাইবোন এবং মাকে নিয়ে পিরোজপুর গোরস্থানে এসে উপস্থিত হলাম,
০৫.
When I’m writing I’m always aware
that this friend is going to like this, or that another friend is going to
like that paragraph or chapter, always thinking of specific people. In
the end all books are written for your friends.
–Gabriel Garcia
Marquoz
ঢাকা শহরে একজন ‘হন্টন পীর’ আছেন। তাঁর একমাত্র কাজ সারাদিন হাঁটা। একা হাঁটেন না। ভক্তদের নিয়ে হাঁটেন। একজন বাবার মাথায় ছাতা ধরে থাকে। একজনের হাতে থাকে পানির বোতল। অন্য একজনের হাতে কলার কাদি। বাবা খুব সম্ভব কলার ভক্ত। আমি বেশ কয়েকবার দূর থেকে এই হন্টন বাবাকে লক্ষ করেছি। একবার মিনিট পাঁচেক বাবার আশেপাশেই ছিলাম। উদ্দেশ্য বাবার ঘটনাটা কী জানা। বাবার জনৈক ভক্ত আমাকে চিনে ফেলে অবাক হয়ে বলল, আপনি বাবার কাছে কী চান? আমি বললাম, গল্প চাই!
আমি আমার যৌবনে হন্টন পীরের মতো একজনকে পেয়েছিলাম। আমরা দলবেঁধে তার পেছনে হাঁটতাম। তিনি যদি কিছু বলতেন মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। গভীর রাতে নীলক্ষেত এলাকায় তিনি হাঁটতে হাঁটতে আবেগে অধীর হয়ে দুই হাত তুলে চিৎকার করতেন। ‘আমার বাংলাদেশ! আমার বাংলাদেশ!’ আমরা গম্ভীর মুগ্ধতায় তার আবেগ এবং উচ্ছ্বাস দেখতাম। তাঁর নাম আহমদ ছফা। আমাদের সবার ছফা ভাই।
ছফা ভাই ছিলেন আমার Mentor. এই ইংরেজি শব্দটির সঠিক বাংলা নেই। Mentor এমন গুরু যার প্রধান চেষ্টা শিষ্যকে পথ দেখিয়ে উঁচুতে তোলা। ছফা ভাই শুধু যে একা আমার Mentor ছিলেন তা না, অনেকেরই ছিলেন।
দেশ সদ্য স্বাধীন হয়েছে। শিশু রাষ্ট্র জন্মের যন্ত্রণায় তখনো ছটফট করছে। আর ছফা ভাই ছটফট করছেন আবেগে এবং উত্তেজনায়। কত অদ্ভুত অদ্ভুত পরিকল্পনা তার মাথায়। দেশকে শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীতে এভারেস্ট শিখরের কাছাকাছি নিয়ে যেতে হবে। দেশ মেধা এবং মননে পৃথিবীর সব রাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাবে। ইত্যাদি।
ছফা ভাই এমন একজন মানুষ যিনি তার উত্তেজনা নিমিষে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারেন। আমরাও ছফা ভাইয়ের মতোই উত্তেজিত হই। কল্পনায়। ভাসে ভবিষ্যতের অপূর্ব বাংলাদেশ।
ছফা ভাই সাপ্তাহিক একটা পত্রিকা বের করে ফেললেন। নিজেই সম্পাদক, মুদ্রাকর এবং প্রধান লেখক। তিনি আমাকে ডেকে বললেন, গল্প লেখা শুরু করে দাও। রোজ রাতে একটা করে গল্প লিখতে হবে। আমার পত্রিকায় নিয়মিত গল্প ছাপা হবে। ছফা ভাইয়ের কথা মানেই আদেশ। আমি রাত জেগে গল্প লিখে ফেললাম। আজ আর সেই গল্পের নাম মনে নেই। গল্প কী লিখেছিলাম তাও মনে নেই। ছফা ভাইয়ের পত্রিকাটার কথাও মনে নেই। দুই-তিন সংখ্যা প্রকাশিত হওয়ার পর পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়। ছফা ভাই তখন দারুণ অর্থকষ্টে। থাকার জায়গা নেই। ক্ষীণ সম্ভাবনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলে সিট পাবেন। পাচ্ছেন না। একদিন আমি ছফা ভাইকে ভয়ে ভয়ে বললাম, হলে সিট পাওয়া পর্যন্ত আমাদের বাসায় কি থাকবেন?
আমার মা তখন বাবর রোডে মুক্তিযুদ্ধে শহীদের স্ত্রী হিসাবে একটা বাড়ির দোতলাটা বরাদ্দ পেয়েছেন। সেখানে না আছে পানির ব্যবস্থা, না আছে কিছু। ছফা ভাই আমাদের সঙ্গে থাকতে রাজি হলেন। আমরা তাঁকে সবচেয়ে বড় কামরাটা ছেড়ে দিলাম। মা তার নিজের সন্তানদের যে মমতায় দেখেন, একই। মমতা ছফা ভাইয়ের দিকেও প্রসারিত করলেন।
ছফা ভাই বাইরে-বাইরেই থাকতেন, রাতে এসে শুধু ঘুমাতেন। বেশির ভাগ সময় বাইরে থেকে খেয়ে আসতেন। অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হয়ে যাওয়া পরিবারটির ওপর বাড়তি চাপ হয়তো দিতে চান নি।
প্রতিদিন বাসা থেকে বের হওয়ার সময় ছফা ভাই কিছু সময় মা’র সঙ্গে কাটাতেন। গত রাতে যেসব স্বপ্ন দেখেছেন তা মাকে বলতেন। মার দায়িত্ব স্বপ্ন ব্যাখ্যা করা। আমার ধারণা, ছফা ভাই স্বপ্নগুলি বলতেন বানিয়ে বানিয়ে। স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে চেয়ে মাকে খুশি করাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। আমার এরকম ধারণা হওয়ার কারণ হলো, ছফা ভাইয়ের স্বপ্নগুলিতে ডিটেলের কাজ খুব বেশি থাকত। স্বপ্নে এত ডিটেল থাকে না। একটা স্বপ্ন বললেই পাঠক বুঝতে পারবেন
কাকিমা, কাল রাতে স্বপ্নে দেখলাম দুটা কাক। একটা বড় একটা ছোট। ছোট কাকটার একটা নখ নেই। তার স্বভাব চড়ুই পাখির মতো। তিড়িং বিড়িং করে সে শুধু লাফায়। বড়টা শান্ত স্বভাবের। সে একটু পর পর হাই তোলার মতো করে। তাদেরকে ধান দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারা কেউ ধান খাচ্ছে না। ধানগুলি ঠোঁটে করে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিচ্ছে। এখন কাকিমা, বলুন, স্বপ্নটার অর্থ কী? আমি বিরাট চিন্তায় আছি।
বলতে ভুলে গেছি, আমার প্রথম উপন্যাস নন্দিত নরকে কিন্তু এর মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। ব্যবস্থা করে দিয়েছেন ছফা ভাই। খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানির খান সাহেবকে পাঠিয়ে এই কাজটা করা। তখন তিনি লেখক শিবির নামক সংগঠনের প্রধান। তিনি লেখক শিবির থেকে নন্দিত নরকে উপন্যাসকে বছরের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস হিসাবে পুরস্কারও দিয়ে দিয়েছেন। আমি অতি তরুণ ঔপন্যাসিক। আমার ওপর ছফা ভাইয়ের অনেক আশা। তার ধারণী, আমি অনেকদূর যাব। তিনি চেষ্টা করছেন আমার অনেকদূর যাত্রার পথ যেন সুগম হয়।
ছফা ভাই ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলে সিট পেলেন। তিনি উঠে এলেন হোস্টেলে। আমি থাকি মুহসীন হলে। নিয়ম করে আমি এবং আমার বন্ধু আনিস সাবেত প্রতি রাতে তাঁর কাছে যাই। গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা হয়। আড্ডা মানে ছফা ভাই কথা বলেন, আমরা দুজন শুনি। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে কথা। তিনি মহাকবি গ্যাটের রচনার বাংলা অনুবাদে হাত দিয়েছেন। অনুবাদ পড়ে শোনান।
একবার তাঁর ঘরে গিয়ে দেখি, তিনি বিশাল এক বাদ্যযন্ত্র কিনেছেন। সেকেন্ডহ্যান্ড জিনিস। দেখতে নিচু আলমারির মতো। ছফা ভাই জানালেন, প্রতি রাতেই তাঁর মাথায় নানা ধরনের সুর আসছে। সুর ধরে রাখার জন্যই এই বাদ্যযন্ত্র।
আমি বললাম, ছফা ভাই! আপনি বাজাতে পারেন?
ছফা ভাই বললেন, অবশ্যই পারি।
তিনি বাদ্যযন্ত্রটার রিড টিপতে লাগলেন। বিচিত্র শব্দ হচ্ছে। তিনি পায়ে তাল দিচ্ছেন এবং মাথা নাড়ছেন।
এই সময় তিনি গান লিখতে শুরু করলেন। গান লিখে সঙ্গে সঙ্গে সুর দিয়ে দেন। আমি এবং আনিস সাবেত অবাক হয়ে সেই সঙ্গীত শুনি।
হঠাৎ একদিন শুনি ছফা ভাই দেশে নেই। গাদ্দাফির নিমন্ত্রণে লিবিয়া চলে গেছেন। লিবিয়ায় বেশ কিছুদিন কাটিয়ে দেশে ফিরলেন। তাঁর মাথায় রঙিন গোল টুপি। আমাদের জানালেন, গাদ্দাফি নিজের হাতে তার মাথায় এই টুপি পরিয়ে দিয়েছেন। তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে গাদ্দাফির গ্রিন বুক অনুবাদের। ছফা ভাইয়ের অনেক কথাই কল্পনারাজ্যের। তবে এই কথাটা হয়তো ঠিক। ছফা ভাইয়ের হাতে টাকাপয়সার নড়াচাড়া দেখা গেল। তিনি একটা প্রেস কিনে ফেললেন। কিছুদিনের মধ্যেই সেই প্রেস উঠেও গেল। ছফা ভাই কাঁধে একটা টিয়া পাখি নিয়ে ঘুরতে লাগলেন। তিনি নাকি টিয়া পাখির অনেক কথা বুঝতে পারেন।
একটা পর্যায়ে আমার ক্ষীণ সন্দেহ হওয়া শুরু হলো যে, তিনি যে জগতে বাস করেন তা সম্পূর্ণই তাঁর নিজের। বাস্তব জগৎ থেকে অনেকটা দূরের। তাঁর রিয়েলিটি এবং আমাদের রিয়েলিটি এক নয়।
কারো যখন মোহভঙ্গ হয় তখন অতি দ্রুতই হয়। আমি তার বলয় থেকে সরে গেলাম। আনিস সাবেত পিএইচডি করার জন্য আমেরিকা চলে গেলেন। ছফা ভাই তার জন্য নতুন বলয় তৈরি করলেন। তিনি শূন্যস্থান পছন্দ করেন না।
ছফা ভাইকে নিয়ে আমার অসংখ্য স্মৃতি আছে। তার ওপর দুশ’ পাতার একটা বই আমি অবশ্যই লিখতে পারি। এখানে একটি স্মৃতি উল্লেখ করছি। ১৯৮৫ বা ৮৬ সালের কথা। এতদিন লেখালেখির জগতে থেকেও ছফা ভাই বাংলা একাডেমী পুরস্কার পান নি। আমি পেয়েছি অথচ ছফা ভাই পান নি, খুবই লজ্জিত বোধ করি। কীভাবে কীভাবে আমি তখন বাংলা একাডেমীর কাউন্সিলারদের একজন। পুরস্কার কমিটিতে আছি। আমি জোরালোভাবে ছফা ভাইয়ের পুরস্কারের ব্যাপারটা বললাম। যথারীতি তা নাকচও হয়ে গেল। আমি ছফা ভাইয়ের জন্য সুপারিশ করেছি—এই খবর ছফা ভাইয়ের কানে পৌঁছল। তিনি আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি তার বাসায় উপস্থিত হলাম। তিনি বললেন, হুমায়ুন, আপনার এত বড় স্পর্ধা যে আপনি আমার জন্য সুপারিশ করেন!
আমি চেয়ারে বসেছিলাম। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে ক্ষমা প্রার্থনা করলাম।
ছফা ভাই বললেন, আমি বসতে না বলা পর্যন্ত এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকবেন।
আমি বললাম, জি আচ্ছা।
আপনি আর কখনোই আমার বাসায় আসবেন না।
আমি বললাম, জি আচ্ছা।
ছফা ভাইয়ের সঙ্গে এটাই সম্ভবত আমার শেষ দেখা। ভুল বললাম, আনিস সাবেত ক্যান্সারে মারা যাওয়ার সংবাদ দিতে আমি আরো একবার তাঁর কাছে গিয়েছিলাম। তিনি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকার পর ‘আনিসরে’ ‘আনিসরে’ বলে চিৎকার করে কাঁদলেন।
কান্না বন্ধ হবার সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাঁর নিজের ভুবনে ঢুকে গেলেন। চলে গেলেন রিয়েলিটির বাইরে। আনিস সাবেত ট্রাস্টি বোর্ড করতে হবে। সেই ট্রাস্টি দুস্থ লেখকদের বৃত্তি দেবে। দরিদ্র লেখকদের বই প্রকাশনার দায়িত্ব নেবে। ট্রাস্ট ফান্ড একটা আধুনিক স্কুল করবে টোকাইদের জন্য।
তিনি কাগজ-কলম নিয়ে বসে গেলেন ট্রাস্টি বোর্ডের পরিচালক কারা কারা থাকবেন তাদের নাম লেখার জন্য। ট্রাস্টি বোর্ডের নীতিমালাও লিখতে হবে। তাঁকে দারুণ উত্তেজিত মনে হলো। তিনি লিখছেন, আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছি অন্যভুবনের মানুষটিকে।
আমাকে নিয়ে ছফা ভাইয়ের অনেক স্বপ্ন ছিল। আমি তাঁর কোনোটাই পূরণ করতে পারি নি। এত মেধা আমার ছিল না। প্রতিটি মানুষের আলাদা আলাদা বৃত্ত থাকে। কেউ সেই বৃত্তের বাইরে যেতে পারে না। আমিও পারি নি। ছফা ভাই নিজেও পারেন নি। তাকে বন্দি থাকতে হয়েছে নিজের বৃত্তেই।