উঠিছে দানবরাজ নিদ্রা পরিহরি
ইন্দ্রালয়ে, শশব্যস্তে নানাদ্রব্য ধরি,
দানব, গন্ধর্ব, যক্ষ ছুটিয়া বেড়ায়,
গৃহ পথ রথ অশ্ব সত্বর সাজায়;
সাজায় সুন্দর করি পুষ্পমাল্য দিয়া,
গবাক্ষ গৃহের দ্বার শোভা বিন্যাসিয়া;
উড়ায় প্রাসাদ-চূড়ে দানব-পতাকা–
শিবের ত্রিশূল-চিহ্ন শিবনাম আঁকা।
ঘন করে শঙ্খধ্বনি; ঘন ভেরীনাদ;
চারিদিকে স্তব্ধ শব্দ ঘন ঘোর হ্রাদ।
শিখরে শিখরে বাজে দুন্দুভি গভীর,
ঘন ঘন ধনুর্ঘোষে গগন অস্থির।
ইন্দ্রালয় বিলোড়িত দানবের দাপে;
জয়শব্দে চরাচর মেরুশীর্ষ কাঁপে।
বাসবের বাসগৃহ গগন যুড়িয়া,
হিমাদ্রিভূধর তুল্য আছে বিস্তারিয়া।
স্ফটিকের আভা তায় ফুটিয়া পড়িছে,
হিমানীর রাশি যেন আকাশে ভাসিছে।
দ্বারদেশে ঐরাবত হস্তী সুসজ্জিত,
সসজ্জিত পুষ্পরথ দ্বারে উপস্থিত।
ইন্দ্রপুরীশোভাকর সভার ভবন,
কুবের সাজায় আনি বিবিধ ভূষণ,
সারি সারি মণিস্তম্ভ সাজাইয়া তায়,
সাজাইছে পুষ্পদাম চন্দ্রাতপ-গায়।
হায় রে সে ইন্দ্রাসন বসিত যাহাতে
বাসব অমরপতি, রাখিছে তাহাতে
মন্দার-পুষ্পের গুচ্ছ করিয়া যতন,
দানব আসিয়া ঘ্রাণ করিবে গ্রহণ।
ইন্দ্রের মুকুট দণ্ড আনি দ্রুতগতি
রাখিছে আসন পার্শ্বে ভয়ে যক্ষপতি,
সভাতলে বাদ্যযন্ত্র প্রস্তুত করিয়া
তটস্থ কিন্নরগণ দেখিছে চাহিয়া।
আতঙ্কে প্রবেশ-দ্বারে;–বিদ্যাধরী যত–
উর্বশী মেনকা রম্ভা ঘৃতাচী বিনত–
বসন-ভূষণ পরি সকলে প্রস্তুত,
কেবল নর্তন বাকী বাদন-সংযুত।
সমবেত সভাতলে করি যোড়কর,
অপ্সরা, কিন্নর, যক্ষ, সিদ্ধ, বিদ্যাধর।
সমবেত দৈত্যবর্গ সুদীর্ঘ শরীর–
হেনকালে শঙ্খধ্বনি হইল গম্ভীর;
অমনি সুযন্ত্রে বাদ্য বাজিল মধুর;
অমনি অপ্সরা-পায়ে বাজিল নূপুর;
পূরিল সুধার ঘ্রাণে সভার ভবন;
বহিল অমরপ্রিয় সুরভি পবন।
প্রবেশিল সভাতলে অসুর দুর্জয়;
চারিদিকে স্তুতিপাঠ জয় শব্দ হয়।
ত্রিনেত্র, বিশালবক্ষ, অতি দীর্ঘকায়,
বিলম্বিত ভুজদ্বয়, দোদুল্য গ্রীবায়
পারিজাত-পুষ্পহার বিচিত্র শোভায়।
নিবিড় দেহের বর্ণ মেঘের আভাস;
পর্বতের চূড়া যেন সহসা প্রকাশ,
নিশান্তে গগনপথে ভানুর ছটায়!–
বৃত্রাসুর প্রকাশিল তেমনি সভায়।
ভ্রুকুটি করিয়া দর্পে ইন্দ্রাসন ’পরে
বসিল, কাঁপিল গৃহ দৈত্য-দেহভরে।
মন্ত্রীরে সম্ভাষি দৈত্য কহিলা তখন;–
“সুমিত্র হে! ভীষণেরে করহ প্রেরণ
অচিরে অবনীতলে, নৈমিষ-কাননে;
ভ্রমে শচী সে অরণ্যে সুররামা সনে;
আসুক স্বরগপুরে অমরী সকলে,
যে বিধানে পারে কহ আনিতে কৌশলে।
কৌশলে না সিদ্ধ হয় প্রকাশিবে বল;
ঐন্দ্রিলা অভিলাষ করিব সফল।
বড় লজ্জা দিয়া কাল ঐন্দ্রিলা আমারে–
শচী ভ্রমে স্বতন্তরা না সেবি তাহারে।
সুমিত্র, সত্বর কার্য কর সম্পাদন,
ভীষণে নৈমিষারণ্যে করহ প্রেরণ।”
দৈত্যেন্দ্র-বচনে মন্ত্রী কহিলা সুমিত্র;–
“মহিষী-বাঞ্ছিত যাহা কিবা সে বিচিত্র!
আজ্ঞা তব শিরোধার্য দনুজের নাথ,
নৈমিষ-অরণ্যে দৈত্য যাবে অচিরাৎ।
নিবেদন আছে কিছু দাসের কেবল,
আদেশ পাইলে পদে জানাই সকল।।”
দৈত্যেশ কহিলা–“মন্ত্রি, কহ কি কহিবে,
অবিদিত বৃত্রাসুরে কিছু না থাকিবে।।”
কহিল সুমিত্র, “তবে শুন দৈত্যনাথ,
অমর পশিছে স্বর্গে করিতে উৎপাত;
কহিলা প্রহরী যারা ছিলা গত নিশি,
দেখেছে দেবের জ্যোতিঃ প্রকাশিছে দিশি।
অতি শীঘ্র বোধহয় দেবতা সকল,
রণ-আশে প্রবেশ করিবে স্বর্গস্থল।
এ সময় ভীষণেরে প্রেরণ উচিত
হয় কি না দৈত্যপতি ভাবিবে বিহিত,
সামান্য বিপক্ষ নহে জান দৈত্যপতি,
কঠোর সে অমরের যুদ্ধের পদ্ধতি।
দিবারাত্রি ক্ষণকাল নহিবে বিশ্রাম,
দুর্দম বিক্রমে সবে করিবে সংগ্রাম,
যত যোদ্ধা দানবের হবে প্রয়োজন,
এ সময়ে উচিত কি ভীষণে প্রেরণ?”
শুনিয়া হাসিলা বৃত্রাসুর দৈত্যেশ্বর
কহিলা, “প্রলাপ না কি কহ মন্ত্রিবর?
আসিবে সমরে ফিরে অমর আবার;
এ অযথা কথা মন্ত্রি রচিত কাহার?
দানবের ভয়ে স্বর্গ পৃথিবী ছাড়িয়া,
লুক্কায়িত আছে সবে পাতালে পশিয়া!
সাধ্য কি দেবের পুনঃ হয় স্বর্গমুখ,
যাক্ কত কাল আরো ঘুচুক সে দুখ।
দৈত্যের প্রহার অঙ্গে যে করে ধারণ,
ফিরিবে না যুদ্ধে আর কখন সে জন।
বৃত্রাসুর থাকিতে, সে সৈন্য দেবতার
স্বর্গের দিকেও কভু চাহিবে না আর।
বোধ হয় প্রতিহারী, রক্ষক যাহারা,
অন্য কিছু শূন্যপথে দেখেছে তাহারা–
হয় কোন উল্কা কিংবা নক্ষত্র-পতন,
নিদ্রাঘোরে শূন্যপরে করেছে দর্শন।”
কহিলা সুমিত্র, “দৈত্যপতি, অন্যরূপ
বলিলা প্রহরিগণ, কহিয়া স্বরূপ।
গগনমার্গেতে দেব-অঙ্গের আভাস
দেখিয়াছে স্থানে স্থানে জ্যোতির প্রকাশ।
রক্ষক-প্রধানে ডাকি জিজ্ঞাসা করিলে,
বিদিত হইবে সর্ব স্বকর্ণে শুনিলে।”
দৈত্যেশ-আদেশে আসে রক্ষক-প্রধান
দাঁড়াইল সভাস্থলে পর্বত-প্রমাণ।
কহিলা দানবপতি, “কহ, হে ঋক্ষভ,
কি দেখিলা গত নিশি কিবা অনুভব?”
কহিলা ঋক্ষভ দৈত্য, “শুন দৈত্যনাথ,
ত্রিযামা রজনী যবে হেরি অকস্মাৎ,
দিকে দিকে চারিধারে ঈষৎ প্রকাশ,
জ্যোতির্ময় দেহ যেন উজলে আকাশ!
নক্ষত্র উল্কার জ্যোতিঃ নহে সে আকার;
জানি ভাল দেব-অঙ্গ-জ্যোতি যে প্রকার।
ভ্রম না হইল কভু ক্ষণকাল তায়,
চিনিলাম দেব-অঙ্গ-জ্যোতি সে আভায়।
ফুটিতে লাগিল ক্রমে ক্রমে দশদিকে,
যতক্ষণ অন্ধকার অংশুতে না মিশে।
দেখিলাম কত হেন সংখ্যা নাহি তার,
উঠিছে আকাশ-প্রান্তে ঘেরি চারিধার;
বহু দূরে এখন (ও) সে জ্যোতির উদয়–
দেবতা তাহারা কিন্তু কহিনু নিশ্চয়!”
বৃত্রাসুর জিজ্ঞাসিলা ঘুচাতে সন্দেহ
“ইন্দ্রের কোদণ্ডনাদ শুনিলা কি কেহ?
ইন্দ্র যদি সঙ্গে থাকে অবশ্য সে ধ্বনি
শুনিতে পাইত স্বর্গে সকলে তখনি!”
কহিলা ঋক্ষভ, “অন্য দানব যতেক,
ইন্দ্রের কোদণ্ডধ্বনি না শুনিলা এক!”
তখন দানব-ইন্দ্র বৃত্রাসুর কয়–
“দেবতা আসিছে সত্য কিবা তাহে ভয়?
একবার অস্ত্রাঘাতে পাঠাই পাতাল,
এইবার একেবারে ঘুচাব জঞ্জাল।
ইন্দ্র সঙ্গে নাই, যুদ্ধে পশিছে দেবতা,
বাতুল হয়েছে তারা কি ঘোর মূর্খতা!
সঙ্কল্প করিনু অদ্য শুন দৈত্যকুল,
সঙ্কল্প করিনু হের স্পর্শিয়া ত্রিশূল–
সূর্যেরে রাখিব ক’রে রথের সারথি,
চন্দ্র সন্ধ্যামুখে নিত্য যোগাবে আরতি,
পবন ফিরিবে সদা সম্মার্জনী ধরি,
অমরার পথে পথে রজঃ স্নিগ্ধ করি।
বরুণ রজক-বেশে অসুরে সেবিবে,
দেবসেনাপতি স্কন্দ পতাকা ধরিবে,
নির্ভয়ে সকলে নিজ নিজ স্থানে যাও,
সুমিত্র, নৈমিষারণ্যে ভীষণে পাঠাও।”
কহিয়া এতেক বৃত্রাসুর দৈত্যপতি,
সভা ভাঙ্গি সুমেরুর দিকে কৈলা গতি।
এখানে ত্রিদিব জুড়ে ছুটিল সংবাদ,
স্বর্গপুরী পূর্ণ করি হয় সিংহনাদ।
বাজিল দুন্দুভিধ্বনি শিখরে শিখরে,
কোদণ্ড-টঙ্কারে যেন গগন শিহরে।
প্রাচীরে প্রাচীরে উড়ে দৈত্যের পতাকা,
শিবের ত্রিশূল-চিহ্ন শিবনাম আঁকা।
মহা কোলাহলে পূর্ণ হৈল সর্বস্থল,
সাজিল দানবসাজে দানব সকল।
বৃত্রাসুর-পুত্র বীর রুদ্রপীড় নাম,
সুধন্য দানব-কুলে, দেখিতে সুঠাম।
ভূষিত ললাটদেশ, বিশাল উরস,
বাল্যকাল হ’তে যার অসীম সাহস,
সজ্জিত মাণিকগুচ্ছ কিরীট-শীরষে,
দেবতা আসিছে যুদ্ধে শুনিয়া হরষে,
সুমিত্রের করে ধরি, কত সে উল্লাস,
উৎসাহ-হিল্লোলে ভাসি করিল প্রকাশ,
মহাযোদ্ধা বৃত্রপুত্র, পূর্বের সমরে,
লভিলা বিপুল যশঃ যুঝিয়া অমরে।
আবার আসিছে যুদ্ধে দেবতা সকল,
শুনিয়া উৎসাহে মত্ত হৈলা মহাবল।
চলিলা মন্ত্রীর সহ আপন আলয়ে,
আন্দোলিয়া নানা কথা যুদ্ধের বিষয়ে।
স্বর্গদ্বারে দ্বারে চলে দৈত্য মহারথী,
হর্যক্ষ বিপুলবক্ষে পূর্বে কৈলা গতি।
ঐরাবণী বল যার ঐরাবণ প্রায়,
পশ্চিমে চলিলা বেগে নদী যেন ধায়।
শঙ্খধ্বজ দৈত্য–যার শঙ্খের নিনাদে
অমর কম্পিত হয়–উত্তর আচ্ছাদে।
দক্ষিণেতে সিংহজটা–সিংহের প্রতাপ
চলিলা দুর্ধর্ষ দৈত্য ভয়ঙ্কর দাপ।
স্বর্গের প্রাচীর ক্রমে দৈত্য কোটি জন–
ভীষণ–নৈমিষারণ্যে করিলা গমন।