স্বাতীর দরজায় টুক টুক করে দুবার টোকা পড়ল।
স্বাতী চাদরে মুখ ঢেকে ছিল, চাদরের ভেতর থেকেই বলল–কে? নাজমুল সাহেব দরজার বাইরে থেকে বললেন, শুভ জন্মদিন মা। স্বাতী বলল, থ্যাংক য়্যু। সে চাদরের ভেতর থেকে বের হলো না, দরজা খুলল না। নাজমুল সাহেব চলে গেলেন না। দরকার পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। তিনি ফুল নিয়ে এসেছিলেন। মেয়ের একুশ বছরে পা দেয়ার জন্য একুশটা ফুল। ফুলদানিতে ফুলগুলো সুন্দর করে সাজানো। মেয়ের পড়ার টেবিলে ফুলদানি রাখবেন, মেয়ের কপালে চুমু খাবেন–এই হলো তার পরিকল্পনা। কোনো একটা সমস্যা হয়েছে। স্বাতী দরজা খুলছে না। নাজমুল সাহেব আবার দরজায় টোকা দিলেন। স্বাতী বলল, আমি এখন দরজা খুলক না বাবা! সারা রাত আমার ঘুম হয় নি। আমি এখন ঘুমুচ্ছি।
ঘুমুচ্ছিস না, তুই জেগে আছিস। দরজা খুলে দে।
না। তুমি তোমার গিফট দরজার বাইরে রেখে যাও।
ইজ এনিথিং রং মা?
নো। নাথিং ইজ রং।
নাজমুল সাহেব উদ্বিগ্ন বোধ করছেন। নাথিং ইজ রং বলার সময় তার মেয়ের গলা কি ভারী হয়ে গেছে? গলাটা কাঁদো-কাঁদো শুনিয়েছে? তিনি চিন্তিত মুখে ফুলদানি হাতে ফিরে যাচ্ছেন। তাকে এবং তাঁর গোলাপগুলোকে লজ্জিত বলে মনে হচ্ছে।
একতলার বারান্দায় স্বাতীর মা রওশন আরা বসে আছেন। ছোট্ট নিচু টেবিলের তিন দিকে তিনটা বেতের চেয়ার। মেয়ের জন্মদিনের ভোরবেলা একসঙ্গে চা খাওয়া হবে। তার সামনে টি-পট ভর্তি চা। ঠাণ্ডা যেন না হয় সে জন্য টি-কোজি দিয়ে চায়ের পট ঢাকা। টি-কোজিটা দেখতে মোরগের মতো। যেন ট্রের উপর একটা লাল মোরগ বসে আছে। মোরগটা এত জীবন্ত–মনে হয় এক্ষুনি বাগ দেবে। তার গায়ের পালক, সত্যিকার পালকে তৈরি। তার পুঁতির লাল চোখ সত্যিকার চোখের মতোই জ্বলে। এই মোরগ রওশনের আরার খুব পছন্দ। শুধু বিশেষ বিশেষ দিনেই তিনি মোরগটা বের করেন। আজ একটা বিশেষ দিন–তার মেয়ে একুশে পা পিয়েছে। তার জন্ম এপ্রিলের চার তারিখ ভোর ছটা দশ। এখন বাজছে ছটা কুড়ি।
নাজমুল সাহেবকে ফুলদানি হাতে ফিরে আসতে দেখে রওশন আরা অবাক হয়ে তাকালেন। নাজমুল সাহেব বিব্রত মুখে বললেন, ও ঘুমুচ্ছে।
রওশন আরা বললেন, ঘুমুবে কেন? একটু আগেই তো শুনলাম গান বাজছে?” রাতে ঘুম হয় নি। এখন বোধহয় শুয়েছে।
রওশন আরার ভুরু কুঁচকে গেল। রাতে ঘুম হয় নি কথাটা ঠিক না। তিনি রাতে একবার মেয়ের ঘরে ঢুকেছিলেন। স্বাতী ভেতর থেকে তালাবন্ধ করে শোয়। তবে রওশন আরার ঘরে ঢোকায় কোনো সমস্যা হয় না। তাঁর কাছে একটা লুকানো চাবি আছে। তিনি প্রায় রোজই গভীর রাতে তালা খুলে একবার ঢোকেন। ঘুমন্ত মেয়েকে দেখে চলে আসেন। স্বাতীর পাঁচ বছর বয়স থেকেই তিনি এই কাজটা করে আসছেন। পাঁচ বছর বয়সে মেয়ে প্রথম আলাদা ঘরে ঘুমুতে গেল। তখন দরজা খোলা থাকত। যখন-তখন ঘরে ঢোকা যেত। তারপর স্বাতী ঘরে চাবি দিতে শিখল। স্বাতী চোখ বড় বড় করে বলল, খবরদার মা, আর আমাকে বিরক্ত করবে না। যখন তখন আমার ঘরে আসবে না। আমার ভালো লাগে না।
রাতে ঘর বন্ধ করে ঘুমুতে ভয় লাগবে না তো বাবু?
খবরদার, আমাকে বাবু ডাকবে না।
ভয় লাগবে না তো ময়না সোনা?
ময়না সোনাও ডাকবে না।
কী ডাকব তাহলে? যা
নাম তা-ই ডাকবে। স্বাতী! স্বাতী নক্ষত্র!
রওশন আরা বললেন, আচ্ছা এখন থেকে শুধু নাম ধরেই ডাকব। এখন তুই বলতো মা, দরজা তালাবন্ধ করে ঘুমুতে ভয় লাগবে না?
লাগবে, তবু আমি দরজা বন্ধ করে ঘুমুব।
আচ্ছা ঠিক আছে।
স্বাতী দরজা ভেতর থেকে লক করেই ঘুমোয়। তিনি দরজা খুলে ভেতরে ঢোকেন। কাল রাতেও ঢুকেছেন। মেয়ে তখন গভীর ঘুমে। গায়ে দেবার চাদরটা খাটের নিচে। ঠাণ্ডায় সে কুঁকড়ে আছে অথচ মাথার উপরের ফ্যান ফুল স্পিডে ঘুরছে। তিনি একবার ভাবলেন, ফ্যান বন্ধ করে দেবেন। সেটা করা ঠিক হবে না, মেয়ে বুঝে ফেলবে কেউ একজন রাতে তার ঘরে ঢুকেছিল। তিনি ফ্যানের স্পিডটা কমিয়ে দিলেন। ফ্যানের কাঁটা পাঁচ থেকে দুই-এ নামিয়ে আনলেন। চাদরটা খাটের নিচ থেকে তুলে পায়ের কাছে রেখে দিলেন। তাঁর খুব ইচ্ছা করছিল ঘুমন্ত মেয়ের কপালে আলতো করে চুমু দেন। ভাগ্য ভালো এই ভুল করেন নি। এই বয়সের মেয়েরা ঘুমুলেও তাদের শরীর জেগে তাকে। সামান্য স্পর্শেও এরা কেঁপে ওঠে। ধড়মড় করে উঠে বসে। ভীতগলায় চেঁচিয়ে বলে–কে? কে?
রওশন আরা স্বামীর দিকে তাকিয়ে চিন্তিত মুখে বললেন, ওর সমস্যাটা কী?
নাজমুল সাহেব চায়ের টেবিলের পাশে ফুলদানি রাখতে রাখতে বিব্রত ভঙ্গিতে হাসলেন। রওশন আরা বললেন, তোমাকে চা দিয়ে দেব?
না থাক। দেখি ও যদি ওঠে।
তোমাকে এ-রকম চিন্তিত লাগছে কেন?
নাজমুল সাহেব নিচু গলায় বললেন, মনে হচ্ছে স্বাতী কাঁদছে। চাদরে মুখ ঢেকে কাঁদছে।
সে-কি!
নাও হতে পারে। আমার মনে হলো ওর গলার স্বরটা চাপা চাপা। তুমি গিয়ে দেখবে?
রওশন আরার যেতে ইচ্ছা করছে না। স্বামীর সঙ্গে অনকদিন থেকে একটা ব্যাপার ঠিক করা আছে। বার্থ ডে উইশ একেক বছর একেকজন করবে। প্রতিবারই নতুন কিছু করা হবে যেন মেয়ে চমকে ওঠে। গত বছর তিনি এই দিনে তোর ছটা দশ মিনিটে বলেছেন–শুভ জন্মদিন মা। জন্মদিনের উপহার হিসেবে নিয়ে গিয়েছিলেন চল্লিশ ক্যারেটের গোল্ডেন টোপাজ। হাঁসের ডিমের মতো পাথর। ধবধবে সাদা চিনামাটির প্লেটে পাথরটা সাজিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। মনে হচ্ছিল এক খণ্ড সূর্য যেন সাদা প্লেটে ঝকমক করছে। স্বাতী আনন্দে আত্মহারা হয়ে চেঁচিয়েছে–এটা কী মা? এটা কী?
গোল্ডেন টোপাজ।
পেলে কোথায় তুমি?
তোর মামাকে দিয়ে নেপাল থেকে আনিয়েছি। তোর জন্মদিনের উপহার। পছন্দ হয়েছে মা?
এত সুন্দর একটা উপহার তুমি আমাকে দেবে আমার পছন্দ হবে না। আমার তো মা মনে হচ্ছে আমি কেঁদে ফেলব।
রওশন আরা তৃপ্তির হাসি হাসতে হাসতে বললেন, কেঁদে ফেলতে ইচ্ছা করলে কেঁদে ফেল।
এই পাথরটা দিয়ে আমি কী করি বলতো মা?
লকেট বানিয়ে গলায় পরতে ইচ্ছা করছে?
আমার খেয়ে ফেলতে ইচ্ছা করছে।
মেয়ের আনন্দ দেখে রওশন আরার চোখে পানি এসে গেল। এ-বছর নাজমুল সাহেব এ-রকম সুন্দর কিছু যোগাড় করেন নি তবে তার উপহারটাও কম সুন্দর না। একুশটা গোলাপ তিনি একুশ রকমের যোগাড় করেছেন। সাদা গোলাপ আছে, কালো গোলাপ আছে, ঈষৎ নীল গোলাপ আছে, একটা গোলাপ আছে ডালিয়ার মতো বড়, আর একটা তারা ফুলের চেয়েও ছোট-নাকছাবি হিসেবে নাকে পরা যায় এমন। মেয়ের চিঙ্কার এবং উল্লাস দেখবেন এই আশায় নাজমুল সাহেব পরিশ্রম করে গোলাপগুলো সংগ্রহ করেছেন। মেয়ে দরজা খোলে নি।
রওশন আরা স্বাতীর দরজার পাশে দাঁড়িয়ে নরম গলায় বললেন, দরজা খোল মা।
স্বাতী বলল, তোমার কাছে তো চাবি আছে তুমি খুলে ফেলো।
তোর সঙ্গে চা খাওয়ার জন্য আমরা দুজন নিচে বসে আছি।
এখন ঘর থেকে বেরুতে ইচ্ছা করছে না।
তোর কী হয়েছে?
দারুণ মন খারাপ লাগছে।
কেন?
জানি না কেন।
হাত-মুখ ধুয়ে নিচে আয়। ভালো লাগবে। তোর বাবা তোর জন্য একুশ রকমের গোলাপ যোগাড় করেছে। বেচারা একুশ রকমের গোলাপ যোগাড় করতে গিয়ে খুব কষ্ট করেছে। একদিনে তো সব যোগাড় হয় না। একেকটা করে যোগাড় করেছে, লবণ পানিতে ডুবিয়ে, পলিথিনে মুড়ে ডীপ ফ্রিজে রেখে দিয়েছে।
আমি যদি আরও দশ বছর বাঁচি তাহলে বাবার খুব কষ্ট হবে। একত্রিশটা বিভিন্ন রকমের গোলাপ পাওয়া তো সহজ কথা না।
স্বাতী।
কী মা?
বের হয়ে আয়।
আসছি। পনেরো মিনিটের মধ্যে আসছি। তোমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না মা। তুমি বাবার কাছে যাও। আমি সেজেগুজে নিচে নামব।
নাজমুল সাহেব উদ্বিগ্ন চোখে তাকালেন। রওশন আরা বললেন, ও আসছে।
ব্যাপারটা কী?
কোনো ব্যাপার না। মন খারাপ আর কি! মানুষের মন খারাপ হয় না?
উৎসব-টুৎসবের দিন মন খারাপ বেশি হয়। তোমাকে একটু চা দেব?
না, ও আসুক।
ওর মনে হয় আসতে দেরি হবে। সেজেগুজে আসছে। তোমার তো আবার ঘুম থেকে উঠেই চা খাবার অভ্যাস।
একদিন অভ্যাসের হেরফের হলে কিছু হবে না। আমার কেন জানি দুশ্চিন্তা লাগছে। মেয়েটার কী হয়েছে বলতো?
হবে আবার কী? কিছু হয় নি। একা একা থাকে তো, এজন্যই মুডি ধরনের হয়েছে। কয়েকটা ভাইবোন থাকলে হেসে-খেলে, ঝগড়াঝাটি করে বড় হতো, তাহলে কোনো সমস্যা হতো না।
ওর বিয়ে দিয়ে দিলে কেমন হয়? স্বামীর সঙ্গে হইচই করবে, গল্প করবে, ঝগড়াঝাটি করবে। ভালো একটা ছেলে দেখে…
কোথায় পাবে ভালো ছেলে?
ভালো ছেলে পাওয়া সমস্যা তো বটেই।
একজন কাউকে ধরে আনলেই যে তোমার মেয়ের পছন্দ হবে, কে তুলল?
নাজমুল সাহেব চিন্তিত মুখে মাথা নাড়লেন। নিশ্বাস ফেলে বললেন, ওর পছন্দের কেউ আছে?
না। থাকলে জানতাম। ওর পছন্দের কেউ নেই।
থাকলেও তোমাকে হয়তো সে বলবে না।
রওশন আরা বললেন, অবশ্যই বলবে। আমাকে না বলার কী আছে?
মায়েরা সব সময় একটা ভুল করে। মায়েরা মনে করে তার মেয়ে যেহেতু তার অংশ সেহেতু মেয়ে তার জীবনের সব কথা মাকে বলবে। ব্যাপারটা সে রকম না। তুমি কি তোমার সব গোপন কথা তোমার মাকে বলেছ?
প্রয়োজনের কথা সবই বলেছি।
তার পরেও অনেক অপ্রয়োজনীয় কথা থেকে গেছে।
আজেবাজে ব্যাপার নিয়ে তর্ক করতে ভালো লাগছে না। চুপ করে থাকো।
আচ্ছা যাও চুপ করলাম। খবরের কাগজ এসেছে?
এত সকালে তো খবরের কাগজ আসে না। তুমি শুধু শুধু জিজ্ঞেস করছ কেন?
তোমাকে রাগিয়ে দেবার জন্য জিজ্ঞেস করছি। তুমি যে কত অল্পতে রেগে যাও তা তুমি জানো না। যাতে জানতে পারে সে জন্য ছোটখাটো দুএকটা ব্যাপার করে তোমাকে রাগাই।
রওশন আরা টি-পট নিয়ে উঠে গেলেন। চা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। নতুন এক পট চা বানাবেন। ঘরে বেশ কয়েকজন কাজের মানুষ আছে, তারপরেও রান্নাবান্নার সব কাজ তিনি নিজে করেন। রান্নাবান্নার ব্যাপারে তাঁর সামান্য শুচিবায়ুর মতো আছে।
কুড়ি মিনিট পার হয়ে গেছে স্বাতী নিচে নামছে না। রওশন আরা আবার উঠে গেলেন। স্বাতীর ঘরের দরজা খোলা। সে সাদা ফুল দেয়া নীল রঙের সিল্কের শাড়ি পরেছে। চুল আঁচড়াচ্ছে। তার মুখ হাসি হাসি। স্বাতী বলল, মা-বাবা কি বারান্দায় বসে আছে?
হ্যাঁ।
বাবাকে চমকে দেয়ার একটা ব্যবস্থা করি। তুমি বাবাকে বলো যে, আমি বিছানায় শুয়ে কাদছি। বাবা আমার খোঁজে আসবে। এর মধ্যে আমি করব কি কোলবালিশটা চাদর দিয়ে ঢেকে রাখব। মনে হবে আমি শুয়ে আছি। বাবা চাদর টেনে তুলতে যাবে আমি পেছন থেকে বাবার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ব। কেমন হবে মা?
ভালোই হবে।
ড্রাইভার চাচা এসেছে মা?”
এসেছে বোধহয়।
ড্রাইভার চাচার হাত দিয়ে আমি আমার বান্ধবী লিলিকে একটা চিঠি পাঠাব। চিঠি লিখে রেখেছি। ড্রাইভার চাচার হাতে পাঠিয়ে দাও।
এখন পাঠাব? সাতটাও বাজে নি।
লিলি খুব ভোরে ওঠে মা।
আচ্ছা পাঠিয়ে দিচ্ছি।
লিলিকে আসতে বলেছি। জন্মদিন উপলক্ষে আমরা দুজন সারাদিন হইচই করব। চিড়িয়াখানায় গিয়ে বাঁদর দেখব।
চিড়িয়াখানায় বাঁদর দেখতে হবে কেন?
বাঁদরের জন্যই তো মানুষ হয়ে জন্মাতে পেরেছি। এজন্য বাঁদরদের থ্যাংকস দিয়ে আসব।
রওশন আরা স্বস্তিবোধ করছেন। স্বাতী স্বাভাবিক অবস্থায় চলে এসেছে। তিনি চঠি হাতে নিচে নামছেন। স্বাতী আগের পরিকল্পনা ভুলে গিয়ে মার পেছনে নেমে আসছে। সিঁড়ি পর্যন্ত আসতেই নাজমুল সাহেব বললেন, মাই লিটল ড্যান্সার, আমার ছোট্ট নর্তকী, হ্যাপি বার্থ ডে। শুভ জন্মদিন।
স্বাতী সিঁড়ির মাঝামাঝি থেকে প্রায় উড়েজেসছে। নাজমুল সাহেব চট করে উঠে দাঁড়ালেন। তার এই মেয়েটার অভ্যাস হচ্ছে বেশ অনেকখানি দূর থেকে গায়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়া। ছোট বেলাতেই মেয়ের এই ঝাঁপিয়ে পড়া সামলাতে পারতেন না। এখন মেয়ে বড় হয়েছে, তারও বয়স হয়েছে। তাঁর ভয় হচ্ছে মেয়েকেসুদ্ধ তিনি না গড়িয়ে পড়ে যান। মেয়েকে এভাবে ছুটে আসতে দেখলেই অনেকদিন আগের একটা ছবি তার মনে হয়।
স্বাতী তখন ক্লাস টু-তে পড়ে। স্কুলের প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশন অনুষ্ঠান। স্বাতী সেখানে নাচবে। সে একা না, তার সঙ্গে নটি মেয়ে আছে। নাচের নাম–এসো হে বসন্ত। তারা সবাই হলুদ শাড়ি পরেছে। মাথায় ফুলের মুকুট। গলায় ফুলের মালা।
নাজমুল সাহেব মুগ্ধ দর্শক। দর্শকদের সঙ্গে প্রথম সারিতে বসে আছেন। খুব আফসোস হচ্ছে কেন ক্যামেরা নিয়ে এলেন না। নাচের শুরুতেই একটা ঝামেলা হয়ে গেল–স্বাতীর মাথা থেকে ফুলের মুকুট পড়ে গেল। দর্শকরা হেসে উঠেছে। স্বাতী মুকুট কুড়িয়ে মাথায় পরার চেষ্টা করছে। অন্যরা নেচে যাচ্ছে। তিনি লক্ষ করলেন স্বাতীর চোখে পানি। সে এক হাতে পানি মুছল। তারপর মুকুটটা ঠিক করল। ঠিক করে আবার নাচ শুরু করতে গেছে–আবার মুকুট পড়ে গেল। দর্শকদের হাসির স্বরগ্রাম আরও উঁচুতে উঠল। স্বাতী আবারও মুকুট কুড়িয়ে পরতে শুরু করল। এবার মুকুটটা পড়ল উল্টো করে। নাচের চেয়ে ছোট মেয়েটির কাণ্ডকারখানায় দর্শকরা অনেক বেশি মজা পাচ্ছে। তাদের হাসি আর থামছে না। স্বাতী কাঁদছে। সে চোখের পানি মুছে আবার নাচতে গেল। ততক্ষণে নাচ শেষ হয়ে গেছে। স্বাতী বাবার দিকে তাকিয়ে উঁচু গলায় ডাকল, বাবা!
নাজমুল সাহেব স্টেজের দিকে এগিয়ে এলেন আর তখন এই মেয়ে আচমকা স্টেজ থেকে তাঁর উপর লাফিয়ে পড়ল। তিনি এই ধাক্কা সামলাতে পারলেন না। মেয়েকে নিয়ে মেঝেতে পড়ে গেলেন।
আজও মেয়ে সেদিনের মতোই ঝাঁপিয়ে পড়ল। আজও তিনি সেদিনের মতোই গাঢ় গলায় বললেন, মাই লিটল ড্যান্সার। মাই লিটল ড্যান্সার। আমার ছোট্ট নর্তকী হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ।
রওশন আরার একটু মন খারাপ রাগছে। কারণ, ঝাঁপিয়ে পড়ার এই ব্যাপারটি স্বাতী শুধু তার বাবার সঙ্গেই করে। তাঁর সঙ্গে করে না।
তিনি চিঠি হাতে ড্রাইভারে খোঁজে গেলেন। ড্রাইভার এখনও আসে নি। আজ শুক্রবার ছুটির দিন। ছুটির দিনে ড্রাইভার দশটার আগে আসে না। খাম বন্ধ চিঠি। আঠা এখনও শক্ত হয়ে লাগে নি। খাম খুলে চিঠি পড়ে দেখলে কেমন হয়? ব্যাপারটা অন্যায়। বড় ধরনের অন্যায়। তবু মাদের এসব অন্যায় করতে হয়। তিনি একটু আড়ালে গিয়ে চিঠি পড়লেন। স্বাতী লিখেছে–
প্রিয় লিলি ফুল,
আজ যে আমার জন্মদিন তোর কি মনে আছে? তুই কি পারবি আসতে? ছুটির দিনে তোকে বাড়ি থেকে বের হতে দেয় না উঠা জানি। তবু একবার চেষ্টা করে দেখ। তোর বাবাকে বল টিউটোরিয়াল পরীক্ষার জন্য আমার সঙ্গে ডিসকাস করে পড়া দরকার। ও আচ্ছা ভুলেই গেছি তুই তো আবার সত্যবাদী! মিথ্যা বলতে পারিস না। তাহলে বরং সত্য কথাই বল। বল–আমার বান্ধবীর জন্মদিন। শুধু তাকে শুভ জন্মদিন জানিয়ে চলে আসব। মাত্র এক ঘণ্টার ভিসা দিন।
লিলি তোর আসা খুব দরকার। আমি ভয়ঙ্কর একটা অন্যায় করেছি। অন্যায়টা চাপা দেয়ার জন্য এখন আমাকে আরও কয়েকটা ছোটখাটো অন্যায় করতে হবে। তোর সঙ্গে আলাপ করা দরকার।
ইতি স্বাতী নক্ষত্র
রওশন আরা চিঠিটা দুবার পড়লেন। তাঁর মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। তিনি কাঁপা কাঁপা হাতে খাম বন্ধ করলেন। ফিরে এলেন চায়ের টেবিলে। স্বাতী ঝলমলে মুখে কাপে চা ঢালছে। রওশন আরা বললেন, ড্রাইভার এখনও আসে নি। আজ শুক্রবার তো দশটার আগে আসবে না।
স্বাতী বলল, দশটার সময় পাঠিও। আর শোনো মা, চিঠিতে কী লেখা সেটা পড়ে তুমি এমন হকচকিয়ে গেছ কেন? ইন্টারেস্টিং কিছু না লিখলে লিলি আসবে না। ওকে আনার জন্য এসব লিখেছি।
নাজমুল সাহেব বললেন, কী নিয়ে কথা হচ্ছে?
স্বাতী বলল, বাবা তুমি বুঝবে না। মাতা ও কন্যার মধ্যে কথা হচ্ছে। মা চা দি তোমাকে?
রওশন আরা বললেন, দে।
রওশন আরা মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। তার মেয়ে তাঁকে ঠিক কথা বলে নি। কিছু-একটা হয়েছে। ভয়ঙ্কর কিছু।