০১. স্পীডোমিটারের কাঁটা সত্তর থেকে আশিতে

ভূমিকা

আমি প্রায়ই কিছু অদ্ভুত চরিত্র নিয়ে ভাবি। এমন কিছু চরিত্র যাদের কখনো কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। অবশ্যি এ ধরনের চরিত্র নিয়ে কিছু লিখতে ভরসা হয় না। কারণ আমি জানি লেখা মাত্র আমাকে অসংখ্য প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। পাঠক পাঠিকা জানতে চাইবেন, লোকটা কে? সে কোত্থেকে এসেছে? ব্যাপারটা কি? কি হচ্ছে? আমি এসব প্রশ্নের জবাব জানি না। অবশ্যি সব প্রশ্নের জবাব যে জানতেই হবে তারও তো কোনো কথা নেই। এই ভেবেই শেষ পর্যন্ত লিখে ফেললাম। লেখার খসড়া একটি ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। পুস্তকাকারে পরিপূর্ণ লেখাটি প্রকাশিত হলো। কেউ গুরুত্বের সঙ্গে এই লেখাটি বিবেচনা না করলেই খুশী হবে।

হুমায়ূন আহমেদ ১লা বৈশাখ ১৩৯৮

 

০১.

মতিন সাহেব গাড়ির একসিলেটর আরো খানিকটা নামিয়ে দিলেন। স্পীডোমিটারের কাঁটা সত্তর থেকে আশিতে চলে এল। ময়মনসিংহ-ঢাকা হাইওয়ে। ফাঁকা রাস্তা, ঘন্টায় আশি কিলোমিটার কিছুই না। মতিন সাহেবের ছোট মেয়ে মিতু পেছনের সীটে বসে আছে। তার হাতে সত্যজিৎ রায়ের সোনার কেল্লা। রওনা হবার সময় সে পড়তে শুরু করেছে–এখন আর অল্প কিছু পাতা বাকি। মনে হচ্ছে ঢাকায় পৌঁছবার আগেই সে বইটা শেষ করতে পারবে। গাড়ি শালবনের ভেতর ঢুকল। মতিন সাহেব গাড়ির স্পীড আরো খানিকটা বাড়িয়ে। দিলেন। স্পীড বাড়াতে শুরু করলে নেশার মত হয়ে যায়। শুধু বাড়াতেই ইচ্ছা করে। মিতু বই বন্ধ করে মিষ্টি গলায় ডাকল, বাবা।

মতিন সাহেব হাসিমুখে বললেন, কি মা?

ঢাকায় পৌঁছতে আর কতক্ষণ লাগবে?

পঁয়তাল্লিশ মিনিট, গিভ এণ্ড টেক টেন মিনিটস।

গিভ এণ্ড টেক টেন মিনিটস মানে কি বাবা?

তিনি প্রশ্নের জবাব দিতে পারলেন না। আচমকা আতংকে জমে গেলেন। রাস্তার মাঝামাঝি একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। সরে দাঁড়ানোর কোন লক্ষণ দেখাচ্ছে না। যে গাড়ি ঘণ্টায় নব্বই কিলোমিটার যাচ্ছে তাকে মুহূর্তের মধ্যে। থামানো সম্ভব নয়। লোকটির পাশ কেটে বেরিয়ে যাবার মত জায়গা কি আছে? মতিন সাহেব একই সঙ্গে হর্ন এবং ব্রেক চাপলেন। চাপা গলায় বললেন, ও মাই গড়। ও মাই গড।

ধ্বক করে শব্দ হল।

লোকটি গাড়ির মাডগার্ডে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়ল রাস্তার এক পাশে। গাড়ি তাকে ছাড়িয়ে ত্রিশ গজের মত এগিয়ে পুরোপুরি থামল। মতিন সাহেব ইগনিশন সুইচ বন্ধ করে মাথা ঘুরিয়ে তাকালেন মেয়ের দিকে।

মিতুর মুখ আতংকে শাদা হয়ে আছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। পাতলা ঠোট কালচে দেখাচ্ছে। মিতু ফিস ফিস করে বলল, বাবা লোকটা কি মারা গেছে? মতিন সাহেব পকেট থেকে রুমাল বের করে কপাল মুছতে মুছতে বললেন, আমার তাই ধারণা।

এখন আমরা কি করব বাবা?

কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকব।

তিনি গাড়ির গ্লোব কম্পার্টমেন্টে সিগারেটের জন্যে হাত বাড়ালেন। তাঁর মনে পড়ল দুমাস আগে সিগারেট ছেড়ে দিয়েছেন। গ্লোব কম্পার্টমেন্টে একটা টর্চলাইট ছাড়া কিছুই নেই। তিনি চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। এ রকম একটা ঘটনা ঢাকা শহরে ঘটলে কি হত দ্রুত ভাবার চেষ্টা করছেন। এতক্ষণে হাজারখানিক লোক জমে যেত। গাড়ির কাচ ভাঙ্গতো। তাকে এবং মিতুকে গাড়ি থেকে টেনে নামাতো। কিছু লোক একত্র হলে এক ধরনের হিংস্রতা আপনা আপনি জেগে ওঠে। মুহূর্তের মধ্যে ভয়ংকর সব কাণ্ড ঘটে।

মতিন সাহেব গাড়ির দরজা খুললেন। মিতু ভীত গলায় বলল, কোথায় যাচ্ছ বাবা?

লোকটাকে দেখে আসি। আমার ভয় লাগছে। ভয়ের কিছু নেই।

তিনি লক্ষ্য করলেন, তাঁর নিজেরই ভয় লাগছে। গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। মুখে থুথু জমা হচ্ছে। প্রচণ্ড ভয় পেলে শরীরের হরমোনাল ব্যালান্স নষ্ট হয়। বমি ভাব হয়, মুখে থুথু জমতে থাকে।

মিতু ক্ষীণ গলায় বলল, তাড়াতাড়ি এসো বাবা। আমার কেমন জানি লাগছে। তিনি এগিয়ে গেলেন। লোকটি মরে গিয়ে থাকলে কি করবেন বুঝতে পারছেন না। এখানে ফেলে রেখে যাবেন? নাকি তাঁর বাচ্চা মেয়ের পাশে রক্তমাখা একটা ডেডবডি নিয়ে ঢাকার দিকে রওনা হবেন। মিতুর জন্যে তা হবে ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। সেই অভিজ্ঞতার জন্যে তাঁর মেয়ে এখনো তৈরী নয়। শুধু তাঁর মেয়ে নয়, তিনি নিজেও তৈরী নন। মতিন সাহেব এক দলা থুথু ফেললেন।

 

মতিন সাহেব লোকটির পাশে দাঁড়াতেই সে উঠে বসল। মাথা উঁচু করে তাকাল। লোকটির চোখ পিট পিট করছে। সূর্যের আলো পড়েছে তার চোখে। সে ভালমত তাকাতে পারছে না। মতিন সাহেব পুরো হকচকিয়ে গেলেন।

লোকটি বেঁচে আছে–তা এখনো মতিন সাহেবের কাছে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য হিসেবে ধরা পড়ছে না। তবে বেঁচে আছে তাতে দেখাই যাচ্ছে। এই তো লোকটার গায়ের নীল হাফশার্টে রক্তের ছোপ। কালো রংয়ের প্যান্টের হাঁটুর কাছটা ছেড়া। মতিন সাহেব বিস্মিত গলায় বললেন, আপনি বেঁচে আছেন?

সে লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসল, যেন বেঁচে থাকার অপরাধে সে অপরাধী। মরে গেলেই যেন ব্যাপারটা শোভন এবং সুন্দর হত।

আপনি কি উঠে দাঁড়াতে পারবেন?

জ্বি।

লোকটি উঠে দাঁড়াল। তার হাঁটুর কাছেও অনেকখানি কেটেছে–চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছে।

থ্যাংক গড় যে, আপনি বেঁচে আছেন। এখানে দাঁড়িয়ে থাকুন। আমি গাড়ি ব্যাক করে আনছি। আপনাকে একজন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।

লাগবে না।

ডাক্তার পরীক্ষা করে দেখুক। আপনার তো বেঁচে থাকারই কথা না।

সে হাসল। মতিন সাহেব লোকটির দিকে ভাল করে তাকালেন। অসম্ভব রোগা লম্বা একজন মানুষ। অতিরিক্ত রকমের ফর্সা। হাতের নীল শিরা চামড়া ভেদ করে ফুটে রয়েছে। সরল ধরনের লম্বাটে মুখ। চোখে এক ধরনের শান্ত ভাব আছে, যা শুধুমাত্র পশুদের চোখেই দেখা যায়।

গাড়িতে উঠেই লোকটি ঘুমিয়ে পড়ল। এটা ভাল লক্ষণ না। প্রচণ্ড আঘাতে মস্তিষ্কে রক্তপাত হলে ঘুম পায়। সেই ঘুম সচরাচর ভাঙ্গে না। ঘুমুতে ঘুমুতে কমায় চলে যায়। কমা থেকে মৃত্যু।

মিতু ফিস ফিস করে বলল, বাবা উনি কি ঘুমুচ্ছেন?

হ্যাঁ মা।

উনার কিন্তু খালি পা।

তিনি তাকিয়ে দেখলেন সত্যি সত্যি খালি পা। পায়ে নিশ্চয়ই স্যাণ্ডেল ছিল–ছিটকে পড়েছে। লোকটিকে গাড়িতে ওঠানোর সময় খেয়াল হয়নি। এখন স্যাণ্ডেলের জন্যে আবার ফিরে যাবার কোন অর্থ হয় না।

মিতুর মুখ থেকে ফ্যাকাশে ভাব এখনো দূর হয়নি। তার বয়স দশ। এ বছর ক্লাস ফাইভে উঠেছে। তার ক্ষুদ্র জীবনে এমন ভয়ংকর ঘটনা আর ঘটেনি। সে সোনার কেল্লা বইটা তার চোখের সামনে ধরে রেখেছে কিন্তু বই-এ মন দিতে পারছে না।

বাবা!

কি মা।

আমার কেমন জানি ভয় ভয় লাগছে।

কিসের ভয়?

মনে হচ্ছে উনি মরে গেছেন।

আরে দূর। তুমি চুপচাপ বই পড়তে থাক। আমি বরং গান দিয়ে দি। দেব?

দাও।

ভল্যুম অনেকখানি বাড়িয়ে মতিন সাহেব ক্যাসেট চালু করলেন। তিনি ভেবেছিলেন গানের শব্দে লোকটি জেগে উঠবে। তা হল না। লোকটি সীটে হেলান দিয়ে পাথরের মত পড়ে আছে। মতিন সাহেবের মনে হল মিতুর কথাই হয়ত সত্যি–লোকটি মরে গেছে। ক্যাসেটে গান হচ্ছে। মতিন সাহেব মন দিয়ে গানের কথা শুনতে লাগলেন। কোন কিছুতে নিজেকে ব্যস্ত রাখা।

‘সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে, শোনো শোনো পিতা
কহো কানে কানে শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গল বারতা।
ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাঁচিয়ে সদাই ভাবনা
যা কিছু পায় হারায়ে যায়, না মানে সান্ত্বনা।।’

মিতু ফিস ফিস করে বলল, বাবা।

কি মা?

লোকটা মরে গেলে আমরা কি করব?

আমরা তার আত্মীয়-স্বজনকে খবর দেব।

তোমাকে পুলিশে ধরবে না?

না। এটা একটা এ্যাকসিডেন্ট।

আমার মনে হচ্ছে পুলিশ তোমাকে ধরে নিয়ে যাবে। ভয় লাগছে বাবা।

ভয়ের কিছু নেই। লোকটা মরে নি।

মতিন সাহেব আড় চোখে তাকালেন। লোকটি নড়ছে না। নিঃশ্বাস ফেলছে বলেও মনে হচ্ছে না। সম্ভবত মারা গেছে। প্রথমেই তাকে একজন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত। তিনি গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিলেন। স্পীডোমিটারের কাঁটা আবার নব্বই এর কাছাকাছি চলে এল।

 

না লোকটি মরেনি।

ডাকামাত্র উঠে বসল। হেঁটে হেঁটে ঢুকল ডাক্তারের চেম্বারে। ডাক্তার জাকির হোসেন মতিন সাহেবের বন্ধু। তিনি দেখেটেখে বললেন, তেমন কিছু না। দু-এক জায়গা ছিঁড়ে গেছে। ওয়াশ করে ব্যাণ্ডেজ লাগিয়ে দিচ্ছি। হাঁটুতে স্টীচ লাগবে। দ্যাটস ইট।

মতিন সাহেব চিন্তিত গলায় বললেন, মাথায় চোট পেয়েছে কিনা দেখবেন? সারা রাস্তা ঝিমুতে ঝিমুতে এসেছে।

ডাক্তার সাহেব সহজ গলায় বললেন, মাথায় চোট পেয়েছে বলে মনে হয় না। চোখের মণি ডাইলেটেড হয়নি। রিফ্লেক্স এ্যাকশন ভাল। লম্বা ঘুম দিলে ঠিক হয়ে যাবে। একটা পেইন রিলিভার দিয়ে দিচ্ছি–ব্যথা বেশী হলে খেতে হবে। প্রেসক্রিপশন লিখতে গিয়ে ডাক্তার নাম জিজ্ঞেস করলেন। লোকটি বিব্রত চোখে তাকাল। যেন খুব অস্বস্তি বোধ করছে।

বলুন, নাম বলুন।

আমার কোন নাম নেই।

নাম নেই মানে?

লোকটি মাথা নিচু করে ফেলল। আড় চোখে তাকাল মতিন সাহেবের দিকে। তার চোখে চাপা সংশয়। মতিন সাহেব খানিকটা হকচকিয়ে গেছেন। তাকাচ্ছেন মিতুর দিকে। ডাক্তার সাহেব বললেন, আপনি কি নাম মনে করতে পারছেন না?

না।

আপনার পরিচিত কারোর নাম মনে আছে?

লোকটি মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, এই মেয়েটার নাম মিতু।

এই মেয়ে ছাড়া অন্য কারোর নাম মনে পড়ছে না?

না।

আপনি কি করেন বলুন তো?

কিছু করি না।

কিছু নিশ্চয়ই করেন–এখন মনে করতে পারছেন না, তাই না?

জি।

আচ্ছা, এ্যাকসিডেন্টের পরের ঘটনা মনে আছে?

আছে।

দু-একটা বলুন তো শুনি।

মিতু তার বাবার সঙ্গে কথা বলছিল। গান হচ্ছিল।

কি গান?

লোকটি মতিন সাহেবকে পুরোপুরি চমকে দিয়ে গানের প্রতিটি লাইন বলে গেল। মতিন সাহেব যেমন চমকালেন ডাক্তার তেমন চমকালেন না। সহজ গলায় বললেন, সাময়িক এ্যামনেশিয়া। শকটা কেটে গেলে ঠিক সয়ে যাবে। ভাল মত রেস্ট হলেই স্মৃতি ফিরে আসবে। ঘুমের ওষুধ দিয়ে দিচ্ছি। দশ মিলিগ্রাম করে ফ্রিজিয়াম ঘুমুতে যাবার এক ঘন্টা আগে খেতে হবে।

ডাক্তার লোকটির দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার কি বমি ভাব হচ্ছে?

জি না।

মাথা ঘুরছে?

ঘুরছে না তবে–কেমন যেন লাগছে।

আচ্ছা বসুন, এখানে আমি আপনার ব্লাড প্রেসার মাপি।

মতিন সাহেব ডাক্তারের চেম্বারের বাইরে চলে এলেন। তাঁকে একটা সিগারেট খেতেই হবে। মিতু তার পেছনে পেছনে এল। রাস্তার পাশের সিগারেটের দোকান থেকে সিগারেট কিনলেন। মুখে এখনো থুথু জমা হচ্ছে। একটা মিষ্টি পান কিনলেন। মিতুর দিকে তাকিয়ে বললেন, পান খাবিরে মিতু?

খাব। মিষ্টি পান।

মিতু পান মুখে দিয়ে বড়দের মত পিক ফেলে বলল, লোকটাকে এখন আমরা কি করব?

বুঝতে পারছি না। ভাবছি একটা শার্ট এবং প্যান্ট কিনে দেব। শ দুএক টাকা দিয়ে দেব। ও বাড়ি চলে যাবে।

বাড়িতে চেনে না। যাবে কি ভাবে?

তুই কি করতে বলছিস?

কয়েকদিন আমাদের বাসায় থাকুক। তুমি খোঁজ করে তার আত্মীয়-স্বজন বের কর।

এটাও করা যেতে পারে।

মতিন সাহেব চেম্বারে ঢুকলেন। লোকটি খুশী খুশী গলায় বলল, আমার ব্লাড প্রেসার স্বাভাবিক। হার্ট বিটও স্বাভাবিক।

মতিন সাহেব বললেন, সব কিছু স্বাভাবিক হলেই ভাল।

তিনি লোকটিকে বাসায় নিয়ে এলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *