সেইন্ট অ্যান্ড মিলারের চাকরিটা জুন মাসে ছেড়ে দিল শ্যাম।
চাকরি ছাড়ার কারণটা তেমন গুরুতর কিছু ছিল না। তার ড্রইংয়ে একটা ভুল থাকায় উপরওয়ালা হরি মজুমদার জনাস্তিকে বলেছিলেন, বাস্টার্ড। মজুমদার শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে গালাগাল দেয়। তা ছাড়া এতকাল শ্যাম হরি মজুমদারের অনেক হাবভাব, কথাবার্তা নকল করে আসছিল। মাঝে মাঝে বেয়ারা এবং দু-একজন শিক্ষানবিশ ড্রাফটসম্যানকে সে মজুমদারের মার্কামারা গালাগালগুলো একই ভঙ্গিতে এবং সুরে উপহার দিয়েছে। এবং এমনকী তার এ রকম বিশ্বাস এসে যাচ্ছিল যে, পুরনো এইসব গালাগালগুলো বহু ব্যবহারে শক্তিহীন হয়ে গেছে, এগুলোর আর তেমন জোর বা তেজ নেই। আরও কিছু নতুন রকমের গালাগাল আবিষ্কৃত না হলে আর চলছে না।
তবু মজুমদারের কথাটা কানে এলে দু-এক দিন একটু ভাবল শ্যাম। মাঝে মাঝে অন্যমনস্কভাবে ‘টাই’-এর ‘নট’ নিয়ে নাড়াচাড়া করল, বাথরুমে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মুখের দিকে অর্থহীনভাবে চেয়ে রইল, আচ্ছা না মেরে ঘরে শুয়ে রইল সন্ধেবেলায়। মন-খারাপ তবু ছাড়ল না তাকে। সে নিজেকে বোঝাল যে গালাগালটা আসলে কিছুই না। মজুমদার শব্দের অর্থ ভেবে গাল দেয় না, সে শুধু ওইসব শব্দ উচ্চারণ করে রাগ প্রকাশ করে মাত্র। শ্যাম নিজেও তো কতবার কতজনকে ও রকম গাল দিয়েছে; যা নিজেই সে লোককে দিয়েছে তা ফিরে পেতে আপত্তি হবে কেন? আর, এচাকরি কিছু দিনের মধ্যেই সোনার ডিম পাড়বে। ইতিমধ্যেই সে বাজার ঘুরে ফ্রিজিডেয়ার, রেডিয়োগ্রাম এবং পুরনো ছোট্ট মোটরগাড়ির দাম জানবার চেষ্টা করেছে, বড়লোকদের নিরিবিলি পাড়ায় দুই বা তিন ঘরের ছিমছাম একটা ফ্ল্যাটের সন্ধানেও ছিল সে। তবু বড় অসহায় বোধ করল শ্যাম। চাকরি ছাড়ার কথা সে ভাবতেও পারে না, কারণ এতদিনে এ-চাকরি তাকে উচ্চাশাসম্পন্ন করে তুলেছে।
তবু আস্তে আস্তে শ্যামের ক্লান্তি বেড়ে চলল। শিস্ দিয়ে রাস্তায় হাঁটা, রবিবারে শ্যাম্পু, ছুটির দুপুরে ঘুম–এসবের ভেতর আর তেমন আনন্দ নেই। মাঝে মাঝে যে-সব বড় রেস্তরাঁ বা বার-এ সে সময় কাটাত সেসব জায়গায় যেতেও তার অনিচ্ছা দেখা দিল। অবসর সময়ে ভয়ংকর অবসাদ আর মাথাধরা নিয়ে সে ঘরেই শুয়ে থাকতে লাগল। রাতেও ভাল ঘুম হয় না। দুদিন সে মাঝরাতে উঠে স্নান করল, তারপর সিগারেটের পর সিগারেট জেলে সারাটা শেষরাত ঘরময় পায়চারি করে বেড়াল। সে খুব ভাবপ্রবণ ছিল না কোনও দিন, গভীর চিন্তাও তার অপছন্দ ছিল, হুল্লোড় ছাড়া বাঁচা যায় না এমন বিশ্বাসই সে এতকাল পুষে এসেছে। কিন্তু ক্রমে বুঝতে পারল একটি গালাগাল থেকে একটি ভূত বেরিয়ে এসে তার মাথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর-একটা বদ-অভ্যাস দাঁড়িয়ে গেল তার—কেবলই সে আয়নায় মুখ দেখে। দাড়ি কামানোর ছোট্ট হাত-আয়নাটা সে প্রায় সারাক্ষণ কাছে রাখে। বার বার মুখ দেখে। একদিন সে সবিস্ময়ে আয়নায় লক্ষ করল যে, তার ঠোঁট নড়ছে। সে উৎকর্ণ হয়ে শুনল যে, সে বে-খেয়ালে আপনমনে উচ্চারণ করে চলেছে, বাস্টার্ড। বাস্টার্ড। খুব ভয় পেয়ে গেল শ্যাম, পাগল হয়ে যাচ্ছি না তো!
অবশেষে জুন মাসের এক ভয়ংকর গ্রীষ্মের মাঝরাতে উঠে টেবিলল্যাম্প জ্বেলে সে তার ইস্তফাপত্রটি লিখে ফেলল। আর-একটা চিঠি লিখল মাকে… আমার চাকরি গিয়াছে। আমার উপর আর খুব ভরসা করিও না। অন্তত আরও দু-তিন মাস তোমাদের কষ্ট করিয়া চালাইতে হইবে… ইত্যাদি। চিঠি লিখবার পর সেই রাতে তার গভীর ঘুম হল।
শৌখিন জিনিসপত্রের মধ্যে তার ঘরে ছিল ভাড়া করা একটা ওয়ার্ডরোব আর একটা বুক-কেস। রূপশ্রী ফার্নিচার্স থেকে নোক এসে একদিন ঠেলাগাড়িতে তুলে সেগুলো নিয়ে গেল। মেঝের ওপর তূপাকৃতি বই, ওয়ার্ডরোব আর বুক-কেসের দুটো চৌকো দাগ থেকে চোখ তুলে ঘরটাকে বেশ বড় বলে মনে হল তার। অনেক সুস্থ বোধ করল সে। ভারমুক্ত। হিসেব করে দেখল ফার্ম থেকে সে প্রভিডেন্ট ফান্ডের যে টাকা পাবে তাতে ঘরটা আরও কিছু দিন রাখা যাবে। দক্ষিণ-খোলা সুন্দর ঘরটি তার, সঙ্গে মান-ঘর।
সুতির জামাকাপড় পরা অনেক দিন হয় ছেড়ে দিয়েছিল শ্যাম। তার বেশির ভাগই টেরিলিন, ট্রপিকাল বা সিল্কের শার্ট-প্যান্ট। বিদেশি টাইও ছিল কয়েকটা। ট্রাঙ্ক আর সুটকেস খুলে সেগুলোর দিকে কৌতুকের চোখে চেয়ে দেখল সে। এখন আর এসব পরার মানে হয় না। খুঁজেপেতে সে ট্রাঙ্কের তলা থেকে পুরনো কয়েকটা সুতির শার্টপ্যান্ট বের করল। প্যান্টের ঘের আঠারো ইঞ্চি, শার্টের কলার অনাধুনিক। সেগুলো পরে নিজেকে বেঢপ মনে হচ্ছিল তার। হাসি চেপে সে সেই পোশাকে চাকরি খুঁজতে বেরোল।
চাকরি? হ্যাঁ, হতে পারে। তার মতো অভিজ্ঞ, অথচ তরুণ লোকের চাকরি আটকাবে না। তবে, একটু দেরি হবে। আর হ্যাঁ, সে হরি মজুমদারের ফার্ম ছাড়ল কেন? কোনও গোলমাল হয়েছিল? কী ধরনের গোলমাল! অত বড় ইঞ্জিনিয়ার, শেল ডিজাইনে যার জুড়ি নেই! তা ছাড়া দেশি ফার্ম দেশের অহংকার! অমন লোকটাকে ছাড়ল কেন সে?
ক্রমে শ্যাম বুঝল এইসব ফার্মগুলোতে নালী ঘায়ের মতো মজুমদারের খ্যাতি ছড়িয়ে গেছে। মাস তিনেক পর আবার সামান্য ক্লান্তি ও মাথাধরা পেয়ে বসল তাকে। একদিন ভিড়ের এক চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খেতে খেতে বিকেলের মরা আলোর দিকে চেয়ে সে বিড়বিড় করে বলল, আমি শেষ হয়ে গেছি। পরমুহূর্তেই চমকে উঠে সে দ্রুত এলোপাথাড়ি হাঁটতে লাগল।
আর-একদিন সে হাত-আয়নাটা মুখের সামনে ধরে জিরাফের মতো গলা বাড়িয়ে ডান হাতের চকচকে একটা সুন্দর ব্লেড কণ্ঠনালীর ওপর রাখল। সামান্য একটু চাপ দিল। বড় আরাম! কিছুক্ষণ পর সরু রক্তের কয়েকটা রেখা তার গেঞ্জির ওপর নেমে বুক ভাসিয়ে দিল। ব্লেডটা ছুড়ে ফেলে সে হেসে আপনমনে বলল, ধ্যৎ, বড্ড নাটুকে। তারপর তোয়ালে দিয়ে গলা মুছে ডেটল লাগাল। জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখল, রাস্তায় জীবন্ত মানুষজন চলাফেরা করছে। ক্ষতের ওপর ভেজা তুলো চেপে সে চোখ বুজল। আঃ! বড় আরাম।
তার দুটি শৌখিনতা ছিল। টেলিফোন করা, আর সকালে রোজ দাড়ি কামান। অফিসে তার টেবিলে যখন নিজস্ব টেলিফোন থাকত তখন সে একটু অবসর পেলেই প্রায় অকারণে একে-ওকে-তাকে ফোন করত। কতজনকে যে সে তার ফোনের নম্বর দিয়েছিল তার ইয়ত্তা নেই। টেলিফোনে লোকের গলা শুতে, আর টেলিফোনের জন্যই তৈরি করা কৃত্রিম গলায় কথা বলতে তার ভাল লাগত। চাকরি যাওয়ার ছ’ মাসের মধ্যে সে টেলিফোন করল মাত্র দুটি। প্রথমটা করল কলেজ স্ট্রিট ওয়াই এম সি এ থেকে তার অফিসে, প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকাটা কবে পাওয়া যাবে তা জানতে। দ্বিতীয়টা করল শিয়ালদার স্বয়ংক্রিয় বুথ থেকে ইতুকে, যার সঙ্গে তার প্রথম পরিচয় দক্ষিণ কলকাতার এক রেস্তরাঁয়, এবং যাকে কয়েকবারই সে তার শোওয়ার ঘরে নিয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত তাদের মেলামেশাটা, যা ঠিক প্রেম নয়, তা বিয়েতে একটা রফায় পৌঁছুতে পারত। তাদের এ রকম কথাবার্তা হল।
শ্যাম, ইতু! কেমন আছ?
ইতু, ভাল না। তোমার দেখা নেই দু’ মাস!
আমার খোঁজ করেছিলে?
হ্যাঁ, অফিসে প্রায় মাস দুই আগে টেলিফোন করেছিলুম।
ওরা কী বলল?
বলল, তোমাকে…তোমাকে ছাড়িয়ে দিয়েছে।
শ্যাম একটু ভেবে বলল, কথাটা ঠিক নয়। আমিই ছেড়ে দিয়েছি।
কেন?
হি কল্ড মি নেন।
হুঁ।
দি বস, দি বাস্টার্ড।
ইতু একটু চুপ থেকে বলল, এত দিন কী করছিলে? চাকরির খোঁজ!
হুঁ।
কিছু পেলে? বেটার কিছু?
ন্ন্ন্নাঃ।
এখন কী করবে?
শ্যাম মৃদু হাসল, ভাবছি বিয়ে করলে কেমন হয়। ইটস্ হাই টাইম।
বেশ তো! কাকে?
তুমি রাজি আছ?
হুঁউ। এক্ষুনি। বলতে বলতে ইতুর গলায় খুব আবেগ এসে গেল, মহীয়সী মহিলার মতো শোনাল তার গলা, শ্যাম, আমিও ছোটখাটো একটা চাকরি করি, তা ছাড়া আমার কিছু গয়না আছে। আমাদের দু’জনের…
শুনতে শুনতে শ্যাম খুব ধীরে ধীরে কান থেকে ফোনটা নামিয়ে আনল, তারপর ঘুমন্ত বাচ্চাকে মা যেভাবে শোওয়ায় সেইরকম সন্তর্পণে ক্যাডেলে রেখে দিল ফোনটা।
আজকাল প্রায়ই শ্যামের মুখে দাড়ি বেড়ে যায়। সেই চাপা চিবুক, গভীর খাঁজওয়ালা সুন্দর থুতনি, ঝকঝকে মুখে সামান্য নিষ্ঠুরতা—যা তাকে আকর্ষণীয় করে তুলত, তা মাত্র কয়েক দিনের নাকামানো দাড়ির তলায় চাপা পড়ে যায়। বড় নিরীহ ও অসহায় দেখায় তাকে। কার্যকারণসূত্র জানে না শ্যাম, তবু তার মনে হয় দাড়ি কামানো না থাকলে চোখ দুটোকেও কেমন যেন একটু ঘোলাটে আর অনুজ্জ্বল দেখায়।
সময় কাটে না বলে শ্যাম মাঝে মাঝে বাসে উঠে টার্মিনাস থেকে টার্মিনাস পর্যন্ত ঘুরে আসে। সুন্দর সময় কেটে যায়। একদিন বালিগঞ্জ থেকে শ্যামবাজারের বাসে উঠেছিল শ্যাম। ভবানীপুরে বাস বিকল হল। বিরক্ত না হয়ে শ্যাম ধীরে সুস্থে নেমে পড়ল। ঘড়িতে সময় দেখল, আড়াইটে। সামনেই একটা ফাঁকা সিনেমা হল। ছবির নামটাও পড়ল না শ্যাম, বাইরের আঁকা ছবিগুলোর দিকে ফিরেও তাকাল না, টিকিট কেটে ঢুকে পড়ল। নিশ্চিত ফ্লপ ছবি, লোকে দেখছে না। আধো অন্ধকার হলের ভিতরে পা দিতেই একটি টর্চের আলো আর একটা ভুতুড়ে হাত এগিয়ে আসে। নিশ্চিন্ত মনে টিকিটটা লোকটার হাতে গুঁজে দেয় শ্যাম, তারপর তার পিছু পিছু চলতে থাকে। সিট দেখিয়ে লোকটা ফিরে যাচ্ছিল, শ্যাম ডাকল, মানুমামা না? টর্চ হাতে লোকটা চমকে ফিরে তাকাল, আরে! শ্যাম! এই সিনেমা হলেই যে মানুমামা কাজ করে তা শ্যাম বার বারই ভুলে যায়। মনে পড়ে, বেশ কিছুদিন আগে সে বৃন্দা নামে একটি মেয়ের সঙ্গে এখানে ছবি দেখতে এসেছিল একদিন, মানুমামার কথা তার খেয়াল ছিল না। সেদিনও মানুমামা সিট দেখিয়ে দিয়েছিল। বুদ্ধিমান মানুমামা সেদিন তাকে চিনবার বা তার সঙ্গে কথা বলবার কোনও চেষ্টা করেনি। তবু সারাক্ষণ ভয়ে কাঁটা হয়ে ছিল শ্যাম। বিরক্ত হয়ে ভেবেছিল আর কোনওদিন এই হলে আসবে না। কিন্তু এখন এবার সে আধো অন্ধকারে টর্চ-হাতে মানুমামার দিকে সহজ চোখে তাকিয়ে হেসে বলল, কেমন আছ মামু? তারপর কী ভেবে হঠাৎ অনভ্যাসজনিত দ্বিধা ত্যাগ করে নিচু হয়ে মানুমামাকে প্রণাম করল। অন্তত বিশজন লোক এই দৃশ্য দেখল। খুশি হয়ে মানুমামা বলল, তোকে চেনাই যায় না, রোগা হয়ে গেছিস, গালে একগাল দাড়ি, কী হয়েছে? অমায়িক একটু হাসল শ্যাম, তারপর অবলীলায় বলল, গারদ থেকে বেরোলুম। মানুমামা চমকে ওঠে, কী গারদ? শ্যাম আস্তে করে বলে, পাগলা। মানুমামা একটু ইতস্তত করে, চাকরিটা? শ্যাম বলে, গেছে। মানুমামা দরজার দিকে চেয়ে ব্যস্ত হয়ে বলল, তুই বোস। আমি পরে এসে কথা বলে যাব। শ্যাম বসল, এবং আপনমনে হাসল। মিথ্যেটুকুর জন্য সামান্য ঘেন্না হচ্ছিল তার, তবু কে জানে হয়তো মানুমামা খুশিই হল। আত্মীয়স্বজনদের সে বরাবর এড়িয়ে চলে, তারাও তাকে ঘটায় না। তার কোনও অমঙ্গল ঘটলে এরা কেউ কেউ খুশি হতে পারে। ইন্টারভালের পর হল অন্ধকার হয়ে গেল, সে একসময়ে চমকে উঠে টের পেল তার ডান হাতে কে যেন একটা ভরতি ঠোঙা গুঁজে দিচ্ছে। চেয়ে দেখল মানুমামা, বাদাম-চানাচুরের ঠোঙাটা তার হাতে গুঁজে দিয়ে সিটের পাশেই প্যাসেজে উবু হয়ে বসে হাসছে। সে তাকাতেই বলল, আমার বড় ছেলে বিশুটাকে একদিন তোর কাছে পাঠাব। ওর সঙ্গে আমাদের বাসায় চলে আসবি। আমাদের গড়িয়ায় মস্ত বড় এক তান্ত্রিক আছে, সব অসুখ সারিয়ে দেন, তোকে দেখিয়ে দেব। শ্যাম মৃদু হেসে বলল, দেখা যাবে। মানুমামা ভূতের মতোই হলের অন্ধকারে নিঃশব্দে মিলিয়ে গেল। শ্যাম গালের দাড়িতে হাত বোলায়। তার জামাকাপড় নোংরা, চোখ ঘোলাটে। কে জানে হয়তো তার দুর্দশা দেখে মানুমামা খুশি হয়নি। কাজেই মানুমামার ভুলটা ভেঙে দেওয়া দরকার মনে করে সে হঠাৎ ঘাড় ফিরিয়ে অন্ধকারে আন্দাজে ‘মামুউ’ বলে ডাক দিল। সঙ্গে সঙ্গে পিছন থেকে তার কাঁধের ওপর একখানা ভারী হাত এসে পড়ল, আস্তে, দাদা! সামান্য হাসির শব্দ। ক্ষীণ অস্পষ্ট একটা গলাও শোনা গেল, মামাকে পরে খুঁজবেন, এখন ছবি দেখুন। শ্যাম আস্তে করে বলল, শালা! তারপর চুপ করে অর্থহীন চোখে ছবি দেখতে লাগল। ভেবে দেখল, এখন মামুর ভুল ভাঙতে গেলে আরও গোলমাল হয়ে যাবে। আরও ভেবে দেখল যে, কয়েকদিনের মধ্যেই তার অনেক আত্মীয়স্বজন জেনে যাবে যে, সে পাগল হয়ে গেছে বা গিয়েছিল। অন্ধকারে আপনমনে নিঃশব্দে হাসল শ্যাম, তারপর সিটের পিছনে মাথা হেলিয়ে আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ল।
.
চাকরি যাওয়ার পর থেকে যে পাইস হোটেলে দু’বেলা খাচ্ছিল শ্যাম, সেখানে সুবোধ মিত্রের সঙ্গে আলাপ। একদিন রাতে মুখোমুখি খেতে বসে মিত্র বলল, কী মশাই, সংসার-টংসার ছাড়ার মতলব আছে। নাকি? দাড়িফাড়ি না কামালে যে বড় উদাসীন দেখায় আপনাকে!
শ্যাম মৃদু হাসে, সংসার কোথায় যে ছাড়ব?
মিত্র বলে, কেন, আপনার তো মা-বাবা আছেন! তাদের জন্য এবার একটি ডবকা দেখে দাসী এনে ফেলুন।
সে তো আপনিও আনতে পারতেন।
মিত্রকে হঠাৎ খুব গম্ভীর দেখাল। একটু চুপ করে থেকে শ্বাস ছেড়ে বলল, আমার জীবনে একটা ট্রাজেডি আছে মশাই। বলে আবার খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে মিত্র মৃদু হেসে গলা নামিয়ে বলল, আমার মশাই, একটা লাভ অ্যাফেয়ার ছিল। সে মেয়েটা তার বিয়ের পর অনেক কেঁদেকেটে আমাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিল যেন বিয়ে না করি। তখন সেন্টিমেন্টের বয়স, তাই প্রতিজ্ঞা করেছিলুম। কিন্তু এখন…মিত্র খাস ছেড়ে বলল, এখন ভাবি কী-সব বোকামি! এ-সব প্রতিজ্ঞার কোনও দাম নেই, কী বলেন?
শ্যাম মোলায়েম গলায় বলে, দূর দূর…
মিত্র নিশ্চিন্ত গলায় বলে, কী জানি মশাই, এখনও কেমন যেন খচখচ করে মনে মধ্যে—
শ্যাম বিস্মিত গলায় বলে, শব্দ হয়?
অ্যাঁ? অন্যমনস্ক মিত্র কথাটা খেয়াল করল না।
শ্যাম মাথা নেড়ে বলল, কিছু না।
হঠাৎ আগ্রহে ঝুঁকে পড়ে মিত্র বলল, আমার বয়স তেত্রিশ। আমরা মশাই ময়মনসিংহের মিত্র। ঝাড়া হাত পা, একটি বোন ছিল, কাচড়াপাড়ায় বিয়ে দিয়েছি, ছোটভাই সাহারাণপুরে ফিটার, ভাল ফুটবল খেলত। ছিলুম মা আর আমি। তা মা মারা গেলে একটি চাকর রেখে চালাচ্ছিলুম, সে চুরি করতে শুরু করায় তাকে ছাড়িয়ে দিয়ে এই হোটেলে জুটেছি, কিন্তু এখন মশাই পেটে সইছে না। তা ছাড়া মা মরে গিয়ে বাসাটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে… বলে একটু দুঃখের হাসি হাসল মিত্র, আমার মশাই দাবি-দাওয়া নেই। একটু দেখবেন তো…।
এত কথা শুনছিল না শ্যাম। মিত্রের বয়সের কথায় তার মন আটকে ছিল। মিত্রের বয়স তেত্রিশ। তার সন্দেহ হল যে, বিয়ের লোভে মিত্র অন্তত সাত-আট বছর বয়স কমিয়ে বলছে।
মিত্রের এঁটো ডান হাত শুকিয়ে কড়কড়ে হয়ে এসেছিল। সেদিকে তাকিয়ে হঠাৎ ঘেন্নায় লাফিয়ে উঠল শ্যাম, বলল, দেখব। তারপর আঁচাতে গিয়ে বেসিনের ওপর আয়নায় নিজের মুখখানা এক পলকে দেখে নিল সে। তেলতেল করছে তার মুখ, অযত্নে বেড়ে ওঠা দাড়ি, অনেক দিন তেল বা শ্যাম্পু না দেওয়া রুক্ষ চুলে তাকে পাগলাটে দেখায়। হাত-আয়নায় রোজ সে মুখ দেখে, কিন্তু এই বড় আয়নায় তাকে অন্য রকম দেখায়। তার মনে হয়, তার দু চোখে এক ধরনের পরিবর্তন এসে যাচ্ছে।
আঁচিয়ে এসে মৌরি মুখে দিয়ে সে বেরিয়ে পড়ল। ডিসেম্বরের শীতরাত্রির ফুটপাথে সে কয়েকটা ঘুমন্ত ঘেয়ো কুকুরকে ডিঙিয়ে গেল, পেরিয়ে গেল গাড়ি-বারান্দার তলায় শুয়ে থাকা জড়োসড়ো কয়েকটা ভিখিরিকে, যেতে যেতে বাড়ির দেয়ালগুলোতে হাত রেখে শিস দিল সে। সামনেই একটা পার্ক—শীত আর ঘন কুয়াশায় জমে আছে। রেলিং টপকে সে ভিতরে ঢুকল। বেঞ্চিগুলি কঁকা পড়ে আছে। শ্যাম বসে সিগারেট ধরায়। পায়ের স্যান্ডেল ঘাসের শিশিরে ভিজে গেছে, পা বেয়ে শিরশির করে উঠে আসছে শীত, কুয়াশায় দম-চাপা ভাব আর কাঠ কিংবা কয়লার ধোঁয়ার গন্ধ। শ্যাম নিশ্চিন্ত। মনে বসে থাকে, ঘড়ির দিকে তাকায় না, তার মন গুনগুন করে ওঠে—-উদাসীন, বড় উদাসীন দেখায়। তোমাকে শ্যাম!
আকাশে তারা না, মেঘ না, কিছুই দেখা যায় না। শুধু ধোঁয়ার মতো কুয়াশা তাকে ঘিরে ধরে। বহুদূর দিয়ে মন্থর বিষণ্ণ ট্রাম চলে যাওয়ার শব্দ হয়, টুপটাপ করে অন্ধকারে কোথাও গাছের পাতা কি শিশির ঝরে পড়ে। দূরে কোনও ল্যাম্পপোস্টের ক্ষীণ আভা লেগে কুয়াশা সামান্য হলদে হয়ে আছে, এত ক্ষীণ সেই আলো যে, তাতে শ্যামের ছায়াও পড়ে না। শ্যামের মনে হয়, জীবনের সবচেয়ে সুসময় এইটাই যা সে পেরিয়ে যাচ্ছে। ভেবে দেখলে এখন তার মন উচ্চাশার হাত থেকে মুক্ত। তার চাকরি যাওয়ার পর ছ’ মাস কেটে গেছে। হাতের জমানো টাকা ফুরিয়ে আসছে ক্ৰমে। তবু তার কোনও উদ্বেগ নেই। কোনও দুশ্চিন্তাই সে বোধ করছে না। তার পরনে ধুতি-শার্ট আর কবেকার পুরনো একটা এন্ডির চাদর। ছ’ মাস আগে এ-পোশাকে বেরোনোর কথা তার কল্পনায়ও আসত না। দুপুরে তার অফিসে ছিল বাঁধা লাঞ্চ, রাত্রে খাওয়ার স্থিরতা ছিল না তার কোম্পানির মক্কেলদেরই কেউ না কেউ তাকে বড় হোটেলগুলিতে নিয়ে যেত। না, সে সৎ ছিল না, এখনও তার সততার প্রতি কোনও মোহ নেই। ইচ্ছে করলে এবং প্রয়োজন হলে এখনও সে যে-কোনও কাজ করতে পারে, যে-কোনও পাপও। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, এখন আর তার ইচ্ছাগুলির কোনও জোর নেই, না আছে কোনও স্পষ্ট প্রয়োজনবোধ। কী করে, কখন কবে তার উচ্চাশাগুলি নষ্ট হয়ে গেছে, কীভাবেই বা কেটে গেছে উদ্বেগ তা সে টেরও পায়নি। নিজেকে বড় উদাসীন মনে হয় তার। হঠাৎ সুবোধ মিত্রের কথা মনে পড়লে সে ‘আঃ শব্দ করে অন্ধকারেই আপনমনে হেসে উঠল। চল্লিশে এসে মিত্র কাঙালের মতো বিয়ের কথা পাড়ছে এলোপাথাড়ি, পাইস হোটেলে মুখোমুখি খেতে বসে। ইচ্ছে করে মিত্রের কাছে গিয়ে সে তার প্রেমের কাহিনীগুলি শুনিয়ে আসে। হ্যাঁ মশাই, সে-সব মেয়ে কথা আপনি ভাবতে পারবেন না। বৃন্দাকে প্রথম দেখি পার্ক স্ট্রিটের এক রেস্তরাঁয়, সঙ্গে ভালমানুষ গোছের একটি প্রেমিক ছেলে। দু’বার, ঠিক দু’বার সে তাকিয়েছি আমার দিকে—ঈশ্বরকে ধন্যবাদ—যে দিক থেকে আমার মুখশ্রী সবচেয়ে ভাল দেখায়, সেই দিকটাই ফেরানো ছিল তার দিকে; যা মশাই, বাঁ দিক থেকেই আমাকে সবচেয়ে সুন্দর দেখায়। আমি তারপর সোজা উঠে গেলুম তাদের টেবিলের কাছে, বৃন্দার দিকে চোখ রেখে আমি ছেলেটার দিকে হাত বাড়ালুম—দেশলাইটা। বিরক্তির সঙ্গেই বোধহয় ছেলেটি দেশলাই এগিয়ে দিলে। অপ্রয়োজনে সিগারেট ধরাতে ধরাতে আমি বৃন্দার দিকে চেয়ে একটু হেসেছিলাম। সেই হাসি আমি শিখেছিলুম কলকাতার সবচেয়ে সেরা বদমাশদের কাছ থেকে। অনেক বার ও রেস্তরাঁ ঘুরে তা আমাকে শিখতে হয়েছিল। তার পরদিন বৃন্দা সেই রেস্তরাঁয় এসেছিল একা। কী করে সে তার প্রেমিক সঙ্গীটিকে কাটিয়ে এসেছিল তা আমি আজও জানি না। হ্যাঁ মশাই, তারপর বৃন্দাকে অনেক দূর নিয়ে যেতে পেরেছিলুম। কিংবা মাধবীর কথা ধরা যাক–যাকে আমি প্রথম দেখি এক ফিল্ম ক্লাবের শোতে। যার নীল রঙের প্লিমাউথ গাড়িটাকে আমার ভাড়াটে ট্যাক্সি বাঘের মতো তাড়া করেছিল। তারপর মাধবীকেও একদিনা মশাই, তারপর মাধবীও একদিন বলেছিল—দিন দিন তুমি কী হয়ে যাচ্ছ শ্যাম, তুমি ইতরের মতো তাকাতে শিখেছ বলতে বলতে সে তার নরম মেরুদণ্ড পিছনে হেলিয়ে। ভেঙে দিয়েছিল সবুজ ডিভানে। তবু বলি, আমার মন ছিল হাঁসের শরীর। আমার শরীরের ভিতরে ছিল বিশুদ্ধ বাতাস, আর উজ্জ্বল রক্ত। কোনও দিন কখনও কোনও মেয়ের জন্য আমি হাঁটু ভেঙে প্রার্থনায় বসিনি। বলিনি—দয়া করে আমাকে ভালবাসো। কেননা তার দরকার ছিল না। শুধু ওই মেয়েটি, ওই আটপৌরে ইতু কোনও দিনই বিয়ে করার কথা ভুলতে পারল না। যেমন পারেননি আপনি। কেমন সেই মেয়ে যার প্রেমে আপনি চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত টিকে গেলেন। প্রেমের নামে আমি মশাই শিস দিই, আমার চোখ ইতর হয়ে যায়, আমার ঠোঁটে ফুটে ওঠে সেই হাসি। আমি প্রেম ওইরকম বুঝি মশাই। আমার কেবল ভয় ওই আটপৌরে মেয়েদের, চার দিন কথা বলার পর যারা পাঁচ দিনের দিন মিনমিন করে বলে, বাবা বলছিল, ছেলেটাকে একবার নিয়ে আসিস তো খুকি, দেখব। হাগো মিত্তিরমশাই, আপনার জুলিয়েটটি কেমন ছিল? ওই রকম আটপৌরে তো, শেষ পর্যন্ত দেখুন এত বয়সেও আপনাকে হাফ-সন্ন্যাসী করে রেখে গেছে! বিয়ে করবেন? তা আপনার কপালে ওইরকম আটপৌরেই জোটার সম্ভাবনা, যে আর-একজন সন্ন্যাসী বানিয়ে আপনার ঘর করতে আসবে নিশ্চিন্ত মুখে। তার সেই প্রেমিকের স্মৃতি তার চন্দনের হাতবাক্স বা গোপন চিঠির মতো, মাঝে মাঝে পানের বাটার সামনে বসে না ছেলে মানুষ করতে করতে মনে মনে নেড়েচেড়ে দেখবে। ঈশ্বর! আমার ভাগ্য ভাল যে, আমার শরীরের ভিতরে এখনও রয়েছে বিশুদ্ধ বাতাস, আর উজ্জ্বল রক্ত। কখনও কোনও মেয়ের জন্য আমি হাঁটু গেড়ে বসিনি প্রার্থনায়। আমার মন মশাই, হাঁসের শরীর। হ্যাঁ, চমৎকারভাবেই আমি এতকাল মেয়েদের ব্যবহার করে এসেছি। আঁচলের গেরোয় বাঁধা পড়িনি। আমি নিষ্কলঙ্ক ও বিশুদ্ধ। আজ আমার দুরবস্থা দেখে ভাববেন না। সেই তরমুজ বিক্রেতার কথা ভেবে দেখুন, যে বলেছিল, আমরা কি ভগবানের হাত থেকে কেবল ভালটাই গ্রহণ করব, মন্দটা নয়? তা আমার অবস্থা এমন কিছু খারাপও নয়। চাকরি নেই, কিন্তু যে-কোনও সময়ে চাকরি হয়ে যেতে পারে। দরকার একটু ঘোরাঘুরির উৎসাহ। দাড়িটা যদি কামাই, ছ’ মাস আগেকার প্যান্ট-শার্ট-টাই যদি গায়ে দিই, আর চোখের সেই অভ্যস্ত চাউনি আর হাসিটা যদি দু-একদিন অভ্যেস করে নিই, তবে অল্পদিনেই আবার আমার চারদিকে চাঁদের জেল্লা লেগে যাবে। হায়, শুধু কেবল কেন যেন উৎসাহ পাই না আর! আঃ, আমার হাই উঠছে।
বাস্তবিক শ্যামের হাই উঠছিল। কুয়াশা আরও একটু ঘন হয়েছে। তার শীত করতে থাকে। দূরে কোথাও ফুটপাথে পাহারাওলার লাঠি ঠোকার আওয়াজ হচ্ছে। ঘড়ি এই আলো-আঁধারিতে দেখা যায়, সে সময় আন্দাজ করার চেষ্টা করল। বুঝতে পারল না। কুকুর কাঁদছে, শোনা যাচ্ছে ক্ষীণ কণ্ঠের একটু গান। শ্যাম উঠে পড়ল।
সেই রাত্রে শ্যাম ছোট হাত আয়নায় তার মুখখানা পবিত্র গ্রন্থের মতো পাঠ করল রাত জেগে জেগে। উদাসীন! বড় কি উদাসীন দেখায় আমাকে! ভাবতে ভাবতে শ্যাম হেসে উঠল। গড়িয়ে পড়ল বিছানায়। তারপর অতর্কিতে ঘুমিয়ে পড়ল আলো না নিভিয়ে।
শীত এসে গেছে। কলকাতার স্বল্পস্থায়ি শীত। বাতাসে শৌখিন ঠান্ডা ভাব। রোজ সকালে অল্প কুয়াশা হয়, রোদেব রং থাকে লাল। আগে যখন সাড়ে আটটায় অফিসে যাওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়তে হত, সেই তখনকার পুরনো অভ্যাসমতোই সকালে ঘুম ভেঙে যায় শ্যামের। ভোরের জানালার দিকে সে এক পলক চেয়ে দেখে, তারপর আবার চোখ বুজে বালিশ আঁকড়ে ধরে, চোখের ওপর লেপ টেনে আলো ঢেকে দেয়। শরীরের ভিতরে জ্বরভাব, শীত আর সামান্য মাথাধরা নিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। শরীর তাজা রাখার জন্য সে আগে ভোরে উঠে সামান্য ফ্রি-হ্যান্ড ব্যায়াম করত, কয়েকটা বেন্ডিং, আর। তিন-চারটে আসন। সে কথা ভাবতেই এখন ক্লান্তিতে হাই ওঠে তার। চোখ বুজে সে পুরনো শ্যামকে দেখতে পায়। দেখে, সে মেঝেতে ব্যাঙের মতো হাত-পা ছড়িয়ে ডন মারছে, কখনও নিচু হয়ে পায়ের বুড়ো আঙুল ছোঁয়ার চেষ্টা করছে, কখনও বা বাতাসে ঘুষি ছুঁড়তে ছুঁড়তে অদৃশ্য প্রতিপক্ষকে তাড়া করে ফিরছে ঘরময়। সেই ঘুষিতে একবার রূপশ্রী ফার্নিচার্সের ওয়ার্ডরোবটার একটা পাল্লা চোট খেয়েছিল, আর দেয়ালের দুর্বল একটা জায়গার চুনবালি খসে পড়েছিল বলে বড় খুশি হয়েছিল শ্যাম। পুরনো সেই শ্যামের শরীর নিয়ে এইসব অর্থহীন নাড়াচাড়া মনে কবে সে হাসে, তারপর দেয়ালের দিকে পাশ ফিরে শোয়। শরীরের ওপর বড় মায়া ছিল শ্যামের, সবসময়ে নিজেকে সে চোখে চোখে রাখত। সে খুব সতর্কভাবে রাস্তা পার হত, সুন্দর ভঙ্গিতে সিঁড়ি বেয়ে উঠত কিংবা নামত, সন্দর ভঙ্গিতে টেলিফোন তুলে নিত কানে— সবকিছুতেই তখন বড় মনোযোগ ছিল তার। যেন কখনও কোনও সময়েই তাকে। কুৎসিত না দেখায়।
লেপের ভিতরে একটা খোদল তৈরি করে শুয়ে থাকে শ্যাম। আস্তে আস্তে বেলা গড়িয়ে যায়। খোঁদলের ভিতর তার নিশ্বাস আর গায়ের তাপ জমে ওঠে। মুখের ঢাকা সরালে চোখে আলো এসে লাগে। এরকম অবস্থায় একসময়ে তাকে বিছানা ছাড়তেই হয়। উঠে সে স্নান করে নেয়, সিগারেট ধরিয়ে ঘরময় পায়চারি করে। মাঝে মাঝে এক কাপ চা খেতে ইচ্ছে করে। ঘরেই রয়েছে তার চায়ের সরঞ্জাম কেরোসিন স্টোভ, কেটলি, চা, চিনি, দুধের কৌটো। চাকরির সময়ে সে সকালের সামান্য অবসরেই চা তৈরি করত, ডিম সিদ্ধ করে খেয়ে নিত। এখন আর তার অত সময় নেই। গত কয়েক মাসে কৌটোর চায়ে ছাতা ধরেছে বোধহয়, হয়তো পচে গেছে টিনের দুধ–সে খুলে দেখেনি। এখন ইংরিজি খবরের কাগজখানা মেঝেয় পায়ের নীচে লুটোপুটি খায়, আগে সেখানার কদর ছিল—সকালে আগাপাশতলা চোখ বুলোত, রাত্রে ফিরে কখনও কখনও ভাল করে খুঁটিয়ে পড়ত।
বেলা আর-একটু বাড়লে সে হোটেলের দিকে বেরিয়ে পড়ে। তারপর সোজা চলে যায় দুপুরের ফাঁকা কোনও বাস বা ট্রাম টার্মিনাসে বা স্টপে। চেনাশোনা লোকের সঙ্গে বড় একটা দেখা হয় না। হলেও শ্যাম এড়িয়ে যেতে পারে। তার গালে দাড়ি, চুল বড় বড়, এবং ভাগ্যক্রমে সে অনেকটা রোগা আর কালো হয়ে গেছে, হাঁটাচলার ভঙ্গিও পালটে ফেলেছে অনেকটা, তা ছাড়া সে ভেবেচিন্তে একটা রোদ-চশমা কিনে নিয়েছে। সব মিলিয়ে খুবই সহজ ও স্বাভাবিক তার ছদ্মবেশ। এই আড়াল থেকে সে মাঝে মাঝে দু-একজন চেনা মানুষকে অসতর্ক অবস্থায় দেখে নেয়। একদিন মাধুকে দেখল শ্যাম। দিব্যি মোটাসোটা হয়েছে মাধু, চর্বিতে থলথল করছে শরীর, এই শীতেও ঘামছে। ঘামে আর চর্বিতে নাকের ভারী চশমাটা পিছলে নেমে এসেছে অনেকটা। পায়ের একটা স্যান্ডেলের স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে গেছে, সেই ছেড়া চটি হাতে নিয়ে খুবই বিপন্ন আর চিন্তিত মুখে ট্রামের সিটে বসে আছে মাধু। আরও লক্ষ করল শ্যাম মাধুর গায়ে নতুন মটকার পাঞ্জাবি, ধোয়া ধুতি পরনে, কঁাধে শাল আর শালের নীচে শান্তিনিকেতনি ঝোলা ব্যাগ। বছরখানেক আগে যখন দেখা হত, তখন বাইরে মফসসলের কোথাও মাস্টারি করত মাধু, তখন ওর মায়ের ক্যান্সার, প্রায়ই কলকাতায় ছোটাছুটি করতে হত। শ্যামকে কতবার বলেছে মাধু— আমাকে কলকাতায় একটা চাকরি জুটিয়ে দে শ্যাম, মফসসলে লাইফ নেই। তা ছাড়া আমার মায়ের ক্যান্সার…। বিশুষ্ক আর উদভ্রান্ত দেখাত মাধুকে, শ্যামের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশতে পারত না, চাকরবাকরের মতো ব্যবহার করত। মৃদু হেসে তাই মাধুকে এড়িয়ে যেত শ্যাম। ভিড়ের ভিতরে রড ধরে দাঁড়িয়ে বিকেলের ট্রামে মাধুকে ভাল করে লক্ষ করছিল শ্যাম। মাধুকে বেশ তৃপ্ত দেখাচ্ছিল শুধু স্ট্র্যাপ-ছেড়া চটিটার জনেই যা একটু চিন্তিত বোধ হয়। ধার দিয়ে শ্যামের মনে থাকে না, ধার নিয়েও নয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, আজ তার হঠাৎ মনে পড়ে গেল মাধুর কাছে তার পঁচিশটা টাকা পাওনা আছে। মনে হচ্ছে, মাধুর অবস্থা এখন ভালই। মাধুর কাছে টাকাটা চেয়ে বসলে কেমন হয়? ভাবতেই হাসিতে তার গা শিরশির করে উঠল। একট্রাম ভিড়ের মধ্যে বেশ গলা ছেড়েই টাকাটার কথা বলা যাবে। ভেবে ভিড়ের মধ্যে ঠেলেঠুলে সামান্য এগিয়ে গিয়েছিল শ্যাম, হঠাৎ মাঝপথে থেমে সে নিশ্বাসের সঙ্গে গালাগাল দিল— শালা হারামি, বিট্রেয়ার। কেন না মাধুর পাশে জানালার ধার ঘেঁষে বসে আছে সুন্দর কটকি ছাপের শাড়ি-পরা অল্পবয়সি একটি বউ-মাধুর বউ সন্দেহ নেই। ভিড়ে এতক্ষণ বউটি আড়াল ছিল। জানালার কাঠে কনুইয়ের ভর, হাতের চেটোয় রেখেছে মুখ, সে মুখ। জানালার দিকে ফেরানো। শ্যাম গলা বাড়িয়ে দেখছিল। খেয়াল ছিল না, তার খোঁচা দাড়ির ঘষা লাগল মোটামতো একটা লোকের ঘাড়ে। লোকটা মুখ ফিরিয়ে নীরবে চোখ দিয়ে একটা ধমক দিলে শ্যাম সামান্য পিছিয়ে আসে। বস্তুত মাধুর মা যে আর বেঁচে নেই তা মাধুর তৃপ্ত মুখচোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। আর ওই বউটা বোধহয় মাধুর মায়ের শেষ ইচ্ছে। ছেলের বউ না দেখে মরবেন না এরকম একটা বায়না ধরেছিলেন বলেই বোধহয় মাধু তাড়াহুড়ো করে বিয়েটা করে ফেলেছে। নইলে ওর যা রোজগার তাতে বিয়ে করার কথা নয়। অবশ্য মা মরে গিয়ে থাকলে এখন মাধুর খরচ কিছুটা বাঁচছে। কে জানে, হয়তো মা মরে যাবে হিসেব করেই সামান্য ঝুঁকি নিয়ে বিয়েটা করেছে ও। শ্যাম আবার মনে মনে বলল, শালা বিট্রেয়ার। অকারণেই মাধুর ওপর তার রাগ হচ্ছিল। ঠান্ডা মাথায় সে ভেবে দেখল এখন মাধুকে দু’ভাবে বিপদে ফেলা যায়। সোজা ওর কাছে গিয়ে বলা যায়, আরে মাধু!
ভীষণ চমকে উঠে তাকে দেখে অস্বস্তির হাসি হাসবে মাধু, শ্যাম! ইস, তোকে চেনাই যায় না! তারপর…?
তুই একটু মুটিয়েছিস। বলেই হেসে চোখের ইঙ্গিত করবে শ্যাম, বউটিকে দেখিয়ে ভ্রূ নাচাবে, কে?
এঃ হেঃ, তোকে খবর দিইনি বুঝি! এ হচ্ছে মাধুরী, আমার বউ। তারপর প্রায় জলে পড়ে গিয়ে বউয়ের দিকে মুখ নামিয়ে বলবে, মাধুরী, এই শ্যাম, আমার বন্ধু। এর কথা, তারপর শ্যামের দিকে ফিরে বলবে, তোর অফিসে কিন্তু খবর দিতে গিয়েছিলুম। ওরা বলল তোর চাকরি গেছে।
ব্যস, ওটুকুতেই শ্যাম ওকে অপমান করার যথেষ্ট কারণ পেয়ে যাবে। সকলের সামনে ও তার চাকরি যাওয়ার কথা কেন বলল? তখন সে মৃদু হেসে বলবে, হ্যাঁ, গেছে। বড় কষ্টে আছি ভাই। তারপর গলা সামান্য খাটো করবে শ্যাম এমনভাবে, যেন বউটি এবং কাছাকাছি কয়েকজন শুনতে পায়, মাধু, তোর কাছে যে টাকাটা পাওনা আছে—
মাধু, বিপন্ন মুখে, কোনটা বল তো!
ওই যে রে শালা, গত শীতে এক রাতে মাল খাবি বলে নিয়েছিলি! মনে নেই? বলতে বলতে শ্যাম লক্ষ করবে বউটি নড়ে উঠল একটু।
মাধু ভীষণ ভয় পেয়ে বলবে, আমি?
হ্যাঁ রে শালা, এক শনিবার, তুই রেসের মাঠে পঁয়ষট্টি টাকা হেরে গেলি! পবননন্দন আর টিটানির ওপর ডাবল ধরেছিলি–মনে নেই। তারপর খালাসিটোলা—
জীবনে মদ খেয়েছে মাধু–এমন মনে হয় না। তবু শ্যাম জানে এসব কথা চাপা দেওয়ার জন্যেই কাষ্ঠহাসি হেসে মাধু বলবে, ওঃ হ্যাঁ, হ্যাঁ, শ্যাম, কী রোগা হয়ে গেছিস! একদিন আয় না, কলকাতাতেই বাসা করেছি এখন, এখানেই চাকরি।
সঙ্গে সঙ্গে শ্যাম বলবে, যাব। ঠিকানাটা–?
বিমর্ষ মুখে মধু ঠিকানা বলে যাবে, বলবে, টুইশ্যানির জ্বালায় ঘরে থাকা যায় না রে ছুটির দিনে আসিস। আগে খবর দিবি, নইলে সিনেমা-টিনেমায় হয়তো গেলুম—
বস্তুত ঠিকানা দিয়ে মাধু আর-এক ধরনের বিপদে পড়বে। মৃদু বিষের মতো সেই বিপদ। কেননা মাধু দেখেছে কেমন কৃতিত্বের সঙ্গে অনায়াসে মেয়েদের ব্যবহার করে শ্যাম! তা ছাড়া শ্যামের না আছে বাছবিচার, না আছে ধর্মবোধ। ঠিকানা দিয়ে তার সেই ভয় হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে বউটি ঠিকঠাক সতী হলেও কোনও লাভ নেই। বউকে বিশ্বাস করবে এমন মনের জোর মাধুর কোথায়?
এ-সব কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ আপন মনে হেসে উঠল শ্যাম। কাছাকাছি লোকেরা তার দিকে চেয়ে দেখল। মাধু নেমে গেল কালীঘাটে, গোয়ালন্দের স্টিমারের মতো ভিড় ঠেলতে ঠেলতে এক হাতে সসংকোচে ধরে থাকা ছেড়া চটি, পিছনে বউ। তার দিকে ফিরেও তাকাল না। বউটির ঘোমটাব পাড় শামের থুতনি ছুঁয়ে গেল। নেমে দাঁড়াতে একটু গলা বাড়িয়ে দেখল শ্যাম–বউটা মাধুর সমান লম্বা। স্টপ ছেড়ে যাচ্ছে ট্রাম, এ সময়ে শ্যামের মনে হল, একটা কিছু করলে হত। তার সামান্য আফসোস হচ্ছিল। তার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সেই মোটা লোকটা। শ্যামের ইচ্ছে হচ্ছিল তার ঘাড়ে আর-একবার দাড়ি ঘষে দেয়। তারপর একসময়ে সে মনে মনে মাধুকে মুক্তি দিয়ে বলল, তুই আরও সুখী হয়ে যা মাধু, তুই আরও মোটা হয়ে যা। তোকে পঁচিশ টাকা ছেড়ে দিলুম। আশীর্বাদ করছি, তোকে যেন বেশি হাঁটতে না হয়, যেন কাছাকাছিই তুই একটা মুচি পেয়ে যাস। মনে মনে এই কথা বলে খুব তৃপ্তি পেল শ্যাম।
আর-একদিন হঠাৎ ডবলডেকারে কলেজে স্ট্রিট পেরিয়ে যেতে যেতে দোতলা থেকে শ্যাম একঝলক দেখতে পেল আরপুলি লেনের মুখে দেয়ালে ঠেস দিয়ে মিনু দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে একটা শেয়াল রঙের পুলওভার, পরনে কালো চাপা একটা প্যান্ট, পায়ে হকিবুট। বুকের ওপর আড়াআড়ি হাত, একটা হাঁটু ভাজ করা পা পিছনের দেয়ালে তোলা, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে মিনু। হঠাৎ দেখলে মনে হয় ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু শ্যাম জানে মুহূর্তেই ওই ভঙ্গি মিনু বদলে ফেলতে পারে, শরীরের ভাঁজ খুলে যখন সোজা হয়ে দাঁড়ায় তখন তার কালো লম্বা চেহারাটা লকলক করে ওঠে। একঝলক মিনুকে ওইভাবে দেখে শ্যামের মন মিনু’ বলে চেঁচিয়ে উঠেছিল। নামবার জন্যে সে তাড়াতাড়ি উঠতে যাচ্ছিল। তারপর দেখল বাসে বেজায় ভিড়, নামতে নামতে সে আরও দুটো স্টপ ছাড়িয়ে যাবে। অরপর পিছু হঠে এসেও যে মিনুকে ওইখানে পাওয়া যাবেই তার কোনও স্থিরতা নেই। তা ছাড়া, দেখা হলেও সবসময়ে লাভ হয় না। হাতে কাজ থাকলে তাকে চিনবেই না মিনু। অল্প একটু হেসে হয়তো বলবে, “আরে শ্যাম! কেমন আছিস?’ তারপর ঘুম-ঘুম স্বপ্নের মতো উদাসীন চোখে তার দিকে চেয়ে থাকবে খানিকক্ষণ, বলবে ‘আঃ শ্যাম, আজ তুই কেটে পড়, আমার কাজ আছে।’ কী কাজ!’ মাথায় সামান্য আঙুল চালিয়ে ঠান্ডা গলায় বলবে মিনু, ‘ঝামেলা হবে এক্ষুনি। তুই কেটে পড়।’ এ-সব কথা। যখন বলে মিনু তখন তার গলার স্বরে এক ধরনের চমক লক্ষ করেছে শ্যাম। হঠাৎ মনে হয় মিনুর গলায়। মাইক্রোফোন লাগানো আছে। স্বর খুব উঁচু নয়, তবু মনে হয় তা খুব গভীর কুয়োর ভিতর থেকে আসছে। ওই স্বর শুনে যে-কোনও লোকের বুকের ভিতর গুরগুর করে উঠতে পারে।
মিনুর সঙ্গে একবার দেখা বছর আট-দশ আগে। তখন শ্যাম ছোট্ট একটা কোম্পানিতে দু’শো টাকার একটা সামান্য কাজ করে। এক তারিখে মাইনে পেয়ে সে ভিড়ের বাসের দরজায় ঝুলে ফিরছিল। কালীঘাটের স্টপে বাস থেমে ছাড়ার মুহূর্তে শ্যাম অস্পষ্টভাবে শুনতে পেল কেউ তার নাম ধরে ডাকছে। বাস ছেড়ে দিল। কিন্তু শ্যাম টের পেল ভিড়ের মধ্যে লোহার মতো শক্ত একখানা হাতের পাঞ্জা তার কনুইয়ের ওপর চেপে ধরেছে। পরমুহূর্তেই সেই হাতখানা তাকে বাসের হাতল থেকে ছিঁড়ে আনল। কার মাথায় শ্যামের দাঁত ঠুকে গেল, আর একখানা কনুই লাগল বুকে। দরজার লোকেরা চেঁচিয়ে উঠেছিল, বাসটা থামতে থামতেও থামল না। বাতাস আঁকড়ে ধরার চেষ্টায় শূন্যে হাত তুলে টাল খেয়ে ঘুরে ফুটপাথে আছড়ে পড়ে যাচ্ছিল শ্যাম। কিন্তু যে তাকে ধরেছিল সে তাকে পড়ে যেতে দিল। দাড় করিয়ে দিল। ব্যথায় চোখে জল এসে গিয়েছিল শ্যামের, মাথার ভিতরে ধোঁয়াটে ভাব। তাই সে কিছুক্ষণ বুঝতেই পারল না যে, কে তাকে টেনে নামিয়েছে। তারপর অবশেষে সে মিনুকে দেখতে পেল। শীতকালে মিনুর সেই মার্কামারা পোশাক—শেয়াল রঙের পুলওভার আর কালো চাপা প্যান্ট। মিনু হাসছে। দু’-একজন চলতি লোক দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, তাই মিনু তার হাত ধরে একটু দূরে নিয়ে গেল।
মুখোমুখি দাঁড়ালে মিনু তার দীর্ঘ লোহাব রডের মতো শক্ত ডান হাতখানা বাড়িয়ে শ্যামের কাঁধে আলতোভাবে রেখে নিঃশব্দে হাসল, তোর লেগেছে শ্যাম? শ্যাম মৃদু হেসে মাথা নাড়ল, না। আবার নিঃশব্দে হেসে ডান হাতখানা খুব ধীরে ধীরে তার কাধ থেকে সরিয়ে নিয়ে প্যান্টের পকেটে রাখল। তারপর চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল অনেকক্ষণ। তার দাঁড়ানোর ভঙ্গি দেখে মনে হয় দু পা মাটিতে পুঁতে দাঁড়িয়ে আছে, একটুও নড়ানো যাবে না। এমনিতে মিনুর চোখ সুন্দর–টানা, ভাসা ভাসা। চোখের পাতায় অর্ধেক ঢাকা আধ-ঘুমন্ত চোখে উদাসীন বিবাগ নিয়ে চার দিকে চেয়ে দেখে। কিন্তু যখন কখনও হঠাৎ ভ্রূ কুঁচকে গম্ভীর মিনু তাকায়, তখন এক পলকে ওর চেহারা পালটে যায়। দয়াহীন, নিষ্ঠুর মিনুকে তখন আর চেনা যায় না। অল্প – কোচকানোর ভিতর দিয়ে মিনু প্রায় ম্যাজিক দেখাতে পারে। শ্যাম তখন ভাল ছেলে। তাই সামান্য অস্বস্তি নিয়ে মিনুর সেই শান্ত, আধখোলা, আধ-ঘুমন্ত চোখের দিকে চেয়ে রইল। সে স্পষ্টই বোঝাতে চেয়েছিল। আমি খুশি হইনি…তোকে দেখে খুশি হইনি মিনু।
অনেকক্ষণ চিন্তিতভাবে শ্যামের মুখের দিকে চেয়ে থেকে হঠাৎ মিনু বলল, আজ এক তারিখ, তোর কাছে আজ অনেক টাকা আছে, না? শ্যাম বুঝতে পারছিল ছেলেবেলার পুরনো বন্ধুর সঙ্গে একটু কথা বলার জন্যই যে মিনু তাকে বাস থেকে টেনে নামিয়েছে তা নয়। মিনুর সঙ্গে দেখা হলে শ্যাম যে খুশি। হয় না তা বোধহয় মিনু জানে। বস্তুত তাদের আর বন্ধু বলা যায় না। শ্যাম তাই মিনুর মুখের দিকে। তাকিয়ে কিছু আন্দাজ করার চেষ্টা করছিল। অকারণেই একটা ভয় পেয়ে বসছিল তাকে। বিকেলের রাস্তায় অনেক লোক রয়েছে তাদের চার পাশে, তবু শ্যামের নিজেকে বড় একলা মনে হচ্ছিল। মিনুকে কী ভীষণ ঢ্যাঙা আর কালো দেখাচ্ছে! শ্যাম মিনুর মুখের দিকে চোখ রেখে অল্প মাথা নেড়ে বলল, আজ মাইনে পেয়েছি।
মিনু দু’ পকেটে হাত রেখে কাধ দুটো অল্প তুলে আবার নিঃশব্দে হাসল, জানতুম। তাই তোকে ও-বাসটায় যেতে দিলুম না। বাসটা গরম ছিল। গরম’ কথাটার অর্থ শ্যাম যে একেবারে বোঝে না তা নয়। তবু চুপ করে চেয়ে রইল। মিনু সস্নেহে হেসে বলল, ও বাসে যে ছোকরারা ছিল তারা আমার চেনা, ওদের হাত খুব পরিষ্কার, তুই টেরও পেতিস না। শুনে শ্যাম চকিতে তার পকেট দেখবার জন্য হাত বাড়াতেই মিনু হাত তুলে হাসল, ভয় নেই। সব ঠিক আছে। আমি দেখে নিয়েছি। মিনুর অলস, নিস্তেজ উদ্দেশ্যহীন চোখের দিকে চেয়ে শ্যাম হেসে ফেলল, ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি। কী চোখ তোর? বস্তুত তখন শ্যামকে দেখছিল না মিনু, কিছুই দেখছিল না। তবু শ্যাম বুঝেছিল মিনু কতদুর দেখে, কতদূর দেখতে পায়। মিনু হাসে, ফিকে নিঃশব্দ হাসি। সে-হাসিতে কোনও ইচ্ছে বা প্রাণ নেই। শ্যাম হঠাৎ টের পাচ্ছিল, যদিও তার টাকা কটা মিনুর জন্যই আজ বেঁচে গেল, তবু তার ভিতরে এতটুকু কৃতজ্ঞতাবোধ জাগছে না। মিনুকে সত্যিই আর ভালবাসে না বলে শ্যাম মনে মনে লজ্জা পেল। এ উচিত নয়, এ রকম হওয়া উচিত নয়। এই বিশ্রী ঠান্ডা সম্পর্ক কাটিয়ে দেওয়ার জন্য সে তাড়াতাড়ি বলল, মিনু, চা খাবি? চল, তোর সঙ্গে অনেককাল কথাবার্তা হয় না।
শ্যামের কথা শুনছিল না মিনু। সে হঠাৎ শ্যামকে ভুলে গিয়ে উপেক্ষা করে চকিতে ঝলসানো চোখে ডাইনে বাঁয়ে আর পিছু ফিরে কী যেন বিদ্যুৎগতিতে দেখে নিল। পরমুহূর্তেই আবার অলস ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে হাসল মিনু, পুলওভারটা টেনে কোমরের চওড়া বেল্টের যে সামান্য অংশ দেখা যাচ্ছিল তা ঢেকে দিল। বলল, আমি একা নই শ্যাম, আমার সঙ্গে তোক আছে। শ্যামের বুকের ভিতরে আবার গুরগুর শব্দ হচ্ছিল। মিনুর পিছনে হলদে রঙের গির্জা বাড়ি, সামনেই বাসস্টপে লোকের ভিড়, একটু সামনে একটা পার্ক শীতের নিষ্পত্র গাছে কাক বসে আছে, ধুলো-ময়লা মাখা ক্লান্ত মানুষেরা হেঁটে যাচ্ছে। এর মধ্যে কোথায় রয়েছে মিনুর লোকেরা, তা ভেবেও পেল না শ্যাম। সে জিজ্ঞেস করল, কোথায় তোর লোক? মিনু আবার হাসে, ভিড়ের মধ্যে মিশে আছে, তুই দেখতে পাবি না। তার চেয়ে চল, তোকে এগিয়ে দিই, একটা ঠান্ডা বাসে উঠে চলে যাবি। শ্যাম বুঝতে পারছিল মিনুর একটা আলাদা সমাজ আছে, যেখানে সে শ্যামের মতো নীতিপরায়ণ লোকদের একেবারেই পাত্তা দেয় না। সেখানে সে মিনুর কাছে শিশু। ছেলেবেলায় মিনুর সঙ্গে তার কত গোপন কথার অংশীদারী ছিল। আর এতদিনে তার এবং এই প্রায়-অচেনা মিনুরও আরও কত গোপন কথা তৈরি হয়ে গেছে, যার খবর কেউই আর রাখে না। তবু শ্যাম চলে যেতে পারছিল না। তার মনে হল মিনুকে আরও কিছু ভাল কথা বলা দরকার যাতে মিনুর ভাল হয়। সে বলল, মিনু, তোর সঙ্গে আমার একটু কথা আছে। মিনু ভ্রূ কুঁচকে বলে, কী কথা! শ্যাম বিকারহীন গলায় বলে, আছে। মিনু ওর দুটি চোখের গভীর পর্যন্ত দেখে নিয়ে বলল, ঠিক আছে। একদিন তোর বাসায় যাব। মাংস রাঁধব দু’জনে। তারপর সারা দুপুর তোর কথা শোনা যাবে। শ্যাম মিনুকে দেখছিল না, সে লক্ষ করল অদূরে রাস্তার মোড়ে গির্জার বাইরে রেলিঙে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে দুজন লোক পাশাপাশি। তারা একবারও মিনু বা তার দিকে তাকাল না, নিঃশব্দে যেন হাওয়ার ভিতর থেকে হঠাৎ বেরিয়ে এসে ওইখানে দাঁড়াল। তারা সিগারেট ধরিয়ে উদাসীন চোখে রাস্তার দিকে চেয়ে রইল। তাদের পরনে সাধারণ ধুতি আর শার্ট, শার্টের হাতা গোটানো। হঠাৎ দেখে কিছুই মনে হয় না, সাধারণ চেহারার দুটি লোক। কিন্তু কেন যেন ওদের দাঁড়ানোর ভঙ্গি বা তাকানোর নিস্পৃহতা দেখে শ্যামের মনে হয়— এরা বড় নিষ্ঠুর। মিনুর সঙ্গে এদের কোথাও মিল আছে। ওদের ওই অলস ভঙ্গি লোককে দেখানোর জন্য। আসলে কোনও কোনও কাজে ওরা ভয়ংকর রকমের নিপুণ। হঠাৎ শ্যাম মিনুর দিকে চেয়ে হাসল, তোর সঙ্গে কজন লোক মিনু? ওই দু’জন তো! বলে আঙুল তুলে লোক দুটোকে দেখায় শ্যাম। তড়িৎগতিতে মিনু তার দীর্ঘ শক্ত হাতে শ্যামের হাত টেনে সরিয়ে দিয়ে বলে, আঙুল দেখাস না। সামান্য চঞ্চল দেখায় মিনুকে, তবু সে মুখে হাসি টেনে বলে, ওই দু’জন। আরও চারজন আছে। তোর বেশ চোখ আছে শ্যাম! কিন্তু এবার তুই বাড়ি যা। শ্যাম সামান্য মজা পেয়ে হেসে উঠে বলল, সঁড়া, মিনু। তারপর যেন মিনুর দেওয়া কোনও ধাঁধার উত্তর খুঁজছে ঠিক এভাবে সাবধানে চারদিকে তাকাতে তাকাতে বলে, আরও চারজনকে আমি ঠিক খুঁজে বের করব। মিনু শক্ত হাতে তার কাধ ধরে বলল, তোকে খুঁজতে হবে না, আমার সঙ্গে একটু হেঁটে আয়, দেখিয়ে দিচ্ছি। বলে তার দিকে পিছু ফিরে মিনু হেঁটে যেতে লাগল দীর্ঘ শ্লথ পায়ে। শ্যাম পিছু নিল। দু-চার পা হেঁটেই মিনু দাঁড়াল, পিছু ফিরে শ্যামকে বলল, দ্যাখ! শ্যাম মিনুর পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল, কোথায়! মিনু মাখা হেলিয়ে রাস্তার ওপারে ফুটপাথটা দেখিয়ে বলল, ও পাশে চায়ের দোকানটার সামনে দ্যাখ দুটো ছেলে দাঁড়িয়ে আছে, একজন বেঁটে, গায়ে সুরকি রঙের পুলওভার, প্যান্টের পকেটে হাত, অন্যজন লম্বা চওড়া স্বাস্থ্যবান, গায়ে গোল-গলা গেঞ্জি, পরনে আমার মতো কালো প্যান্ট। শ্যাম আস্তে আস্তে বুঝতে পারে বিশেষ কারও জন্যে এই ফাঁদ পাতা হয়েছে। তার হাত পা অবশ হয়ে আসে, তবু প্রাণপণে নিজের গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে বলল, আর দু’জন? মিনু লম্বা মাপা পায়ে সরে গেল, এদিকে আয়। যেভাবে লোকে নিজের ঘরবাড়ি নতুন অতিথিকে দেখায় তেমন স্বাভাবিক ভঙ্গি তার। পার্কটার কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে মিনু দেখাল পার্কের গায়ে একটা গলি। নিঃশব্দে আবার হাসে মিনু, যাকে ধরা হচ্ছে আজ সে ওই গলিতে থাকে। গলির মুখে দ্যাখ একটা ট্যাক্সি, মিটার ডাউন করা। পিছনের সিটে একজন, তাকে এখান থেকে ভাল দেখা যাচ্ছে না। গভীর শ্বাস টেনে শ্যাম বলে, আর একজন? মিনু মাথা নাড়ে, আর একজন এখানে নেই, সে আমাদের মক্কেলকে নিয়ে আসতে গেছে। ভুলিয়ে-ভালিয়ে আনবে। শ্যামের মাথার ভিতরটা ধোঁয়াটে লাগে, থরথর করে কাঁপে তার পা। মনে হয় এইখানে এই ভিড়ের মধ্যে মিনু অলক্ষ্যে এক স্টেজ খাড়া করেছে, যেখানে এক্ষুনি একটা নাটক হবে কিংবা নাটকও নয়, কেননা মিনুর এইসব ব্যাপারে নিশ্চিত কিছু সত্যিকারের রক্তপাত ঘটে যায়। তবু কাষ্ঠ-হাসি হেসে সে বলে, মিনু, তোরা কাকে ধরছিস? মিনু হাসে না আর; তার ঐ সামান্য কেঁাচকানো, তীব্র চোখ, তবু তাকে এই মুহূর্তে খুব ভয়ংকর দেখায় না। যেন বা খানিকটা অসহায়ের মতো ঠোঁট উলটে বলে, কী জানি! তাকে চিনিও না। শ্যাম যেন আপন মনেই নিজেকে প্রশ্ন করে, তবে? মিনু তার কপালের ওপর একটা চুলের ঘুরলি আঙুলে জড়ায়, কেমন অন্যমনস্ক এবং আবার উদাসীন দেখায় তাকে। কিছুক্ষণ পরে সে শ্যামের দিকে। চেয়ে বলে, বাড়ি যা শ্যাম। আবার দেখা হবে। শ্যাম কোনও কথা না বলে মিনুর দিকে পিছন ফিরে হাঁটতে থাকে, কিছুদূর গিয়ে কেমন চমকে সে ফিরে তাকায়, মিনু তার দিকে চেয়ে আছে। অস্বস্তির চোখ। শ্যাম ফিরে আসে আবার, মিনু, এই দু’জন তোর বন্ধু? যেন বা সে প্রশ্ন করতে চায়—এই দু’জন মিনুর কেমন বন্ধু, যেমন বন্ধু সে একদিন মিনুর ছিল! মিনু সকৌতুকে তার দিকে চেয়ে দেখে, তারপর মাথা নেড়ে জানায়, হ্যাঁ। শ্যামের কেমন বমি বমি করছিল, সব কিছু ভাল করে লক্ষ করার মতো মনের অবস্থা ছিল না, তবু সে লক্ষ করল মিনুর মুখে-চোখে একটা অসহায় দ্বিধার ভাব। শ্যাম মাথা নেড়ে মিনুকে জানাল যে, সে বুঝতে পেরেছে। তারপর বলল, আচ্ছা মিনু, চলি। মিনু আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে, আচ্ছা। শ্যাম বলে, তা হলে একদিন আসছিস তো! ছুটির দিনে আসিস। মিনু মাথা নাড়ে আবার, হ্যাঁ। তারপর হেসে ঠাট্টার ছলে বলে, যদি তত দিন থাকি। এই কথাটুকুই যেন ধাক্কা দিয়ে শ্যামকে মিনুর কাছ থেকে সরিয়ে দেয়। সে দ্রুত বাস-স্টপের দিকে হাঁটতে থাকে। পিছু ফিরে আর তাকায় না।
গির্জার রেলিঙের গায়ে হেলান দিয়ে সেই রকম উদাসীন ভঙ্গিতেই লোক দু’টো দাঁড়িয়ে আছে। তারা দুজনেই অবহেলার চোখে শ্যামকে এক পলক দেখে নেয়। শ্যাম তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, বাসস্টপে এসে দাঁড়ায় গা-ঘেঁষা এক পাল লোকের ভিড়ের মধ্যে। শীত নেই তেমন, তবু শ্যামের হাত-পা-ঘাড়ে কেমন ঠান্ডা লাগছিল। বুকের ভিতরে সেই দুড়দুড় শব্দ— কে যেন দৌড়ে যাচ্ছে, কে যেন পালিয়ে যাচ্ছে বুকের ভিতরে। তার স্বাসকষ্ট হতে থাকে। তখন মাঝে মাঝে শ্যামের এ রকম হত। বুক কাঁপা তার পুরনো রোগ। বাসস্টপের ভিড়, পিছনে দোকানের আলো, ডান দিকে বাঁ দিকে কয়েকটা ম্যাড়ম্যাড়ে গাছ–সবকিছুই বড় নিষ্প্রাণ। এই তো একটু আগে সে অফিস থেকে বেরিয়েছে, ভিড়ে ঠেলাঠেলি করে বাসে উঠেছে, তারপর মিনু তাকে টেনে নামালততক্ষণ পর্যন্ত সবকিছু স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু এখন হাতে পায়ে জড়ানো শীত, কাঁপা বুক আর অনিশ্চিত একটা উদ্বেগের ভিতর দাঁড়িয়ে থেকে তার হঠাৎ মনে হচ্ছিল, বাস্তবিক এ-শহর তার চেনা নয়। যেমন তার চেনা নয় তার ছেলেবেলার বন্ধু মিনু কিংবা তার দুজন সঙ্গী।
মিনুর জন্যেই সেদিনকার বিকেলটা তার বিস্বাদ হয়ে গিয়েছিল। বাসে উঠবার পরও সে সতর্ক হবার চেষ্টা করেনি। হ্যান্ডেল ধরে ঝুলছিল, টের পাচ্ছিল তাকে ঘিরে অনেক হাত, কোনটার কোন উদ্দেশ্য তা বুঝবার চেষ্টাও করেনি সে।
তারপর অনেক দিন ভিড়ের ভিতরে সন্ত্রস্ত চোখে সে চেয়ে থেকেছে। মনে হয়েছে, এদের ভিতরে রুক্ষ চেহারার দয়াহীন কিছু লোক গা ঢাকা দিয়ে ধারালো কঠিন চোখে তাকে লক্ষ রাখছে। দৌড় দৌড়— বুকের ভিতরে সেই শব্দ শোনা যেত। যেন অদূরেই কোথাও মিনুর সেই ছয়জন সঙ্গী বাতাসের সঙ্গে মিশে নিঃশব্দে অপেক্ষায় আছে। অথচ সে জানত যে, এ-ভয় অকারণ। বস্তুত এতই। নিরীহ, নিরামিষ তার জীবন যে, সে কারও ভয়ংকর কোনও ক্ষতি করারও ক্ষমতা রাখে না। তবে কী কারণে তার ওপর ভয়ংকর প্রতিশোধ নেওয়া হবে?
তেইশ-চব্বিশ বছর বয়সের সেই ভিতু অথচ দয়ালু শ্যামের সঙ্গে কারও কোনও দিনই আর দেখা হবে না। মনে পড়তেই শ্যাম নিজেও মৃদু একটু হাসল, স্টেটবাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সে ভিড়ের মধ্যে যেন সেই শ্যামকে হেঁটে যেতে দেখল, দেখল শ্যাম মোড়ের ভিখিরির বাটিতে ফেলে দিচ্ছে একটা-দুটো পয়সা, ঠনঠনে পেরিয়ে যাওয়ার সময় সবার অলক্ষ্যে একটু মাথা নিচু করে দ্রুত একবার হাত দুটো জোড় করেই সরিয়ে নিচ্ছে, কিংবা বাসের দরজায় ধরা পড়েছে পকেটমার সেই ভিড় থেকে দ্রুত পায়ে পালিয়ে যাচ্ছে নিরাপদ গলির মধ্যে। ভাবতে ভাবতে শ্যাম মৃদু হেসে মনে মনে বলল, ওঃ শ্যাম দি কাইন্ডহার্টেড!
অনেককাল মিনুর সঙ্গে আর দেখা হয় না। কারণ, ক্রমে ক্রমে শ্যামের চাকরি গেল পালটে, তার চলাফেরা সীমাবদ্ধ হয়ে গেল কয়েকটা বাছাই করা রাস্তায়, অফিস-রেস্তরাঁ বার কিংবা দক্ষিণের ভাল পাড়ায় তার ছোট্ট একটেরে ঘরটা–এইটুকুর মধ্যেই সুখে আটকে ছিল শ্যাম। আর মিনু ঘুরে বেড়ায় নোংরা গলিখুঁজি, চোরা চায়ের দোকান, চোলাই কিংবা জুয়ার আড্ডায়, পারুল কিংবা চাপার ঘরে। কাছাকাছিই ছিল তারা; তবু দুটো আলাদা শহরে। একটার ভিতরে আর-একটা কিংবা আরও অনেকগুলো কলকাতা পোরা আছে। তারা দুজনেই যে এক শহরে বাস করে, তা নয়। যেমন স্টেটবাসের ডান ধারে বসে সে একরকম দেখছে, বাঁ ধারে বসলে দেখাত অন্য রকম, পাঁচতলার ছাদ থেকে যেমন দেখা যায়, ম্যানহোলের ভিতর থেকে মাথা তুলে দেখলে তেমন নয়। আসলে দিকের তফাত, উঁচু কিংবা নিচু থেকে দেখার তফাত, এক-এক রকম কলকাতা অন্য রকমের কলকাতার ভিতরে ঢুকে আছে। তার ইচ্ছে করছিল এখন গিয়ে একবার মিনুর মুখোমুখি দাঁড়ায়। তার কাঁধে চাপড় মেরে বলে, আঃ হাঃ মিনু! কেমন আছিস গুরু? তারপর গলা নামিয়ে বলে, আমাকে দলে নিবি গুরু? দেখিস শালা, আমি দু’হাতে চালাব মেশিন কিংবা পাঞ্চ, তলপেটে ছোরা ঢোকাব যেন মাখনে, দেখে নিস গুরু কেমন পকাপক চলে সোডার বোতল! তারপর গিয়ে বসে গোপন আস্তানায় চায়ের দোকানের পিছনে অন্ধকার অলিগলির মধ্যে, যেখানে ভয়ংকর সব যুবতীদের ছবিওলা ক্যালেন্ডার ঝোলে দেয়ালে, আর ভোমা নীলমাছি উড়বার শব্দ। সমানে সমানে মিনুর মুখোমুখি বসে অন্তরঙ্গ সুরে মিনুকে বলতে ইচ্ছে করে, কী চলবে গুরু? ঝিট্ না অ্যান্টিক? শ্যাম জানে এ-ভাষা বুঝে নেবে মিনু, কেননা এ মিনুদেরই ভাষা–ঝিট মানে গাঁজা, আর অ্যান্টিক হচ্ছে চোলাই। নেশা জমে এলে আস্তে আস্তে মাথা নাড়বে শ্যাম, না গুরু, তুই ঢকে গেছিস। তোর বয়স শুরু হয়ে গেছে। আমার চেয়ে তুই বছর ছয়েকের বড়, আমার এখন বত্রিশ বোধহয়। তা হলে তোর। যাকগে শালা, এখন কী চলছে তোর? ছিনতাই, না এক-দু’শোর কেপমারি? বোর্ডে ধেড়িয়েছিস? চাপার ঝাপিতে কত গেছে রে শালা! ওরা তো ক্যাশমেমো দেয় না, দিলে ক’হাজারে দাঁড়াত গুরু? ভাবিস না, ভাবিস না মিনু, আমি তোর দিনকাল ফিরিয়ে আনব। উঠতি ছোকরার মতো আমার রক্ত গরম, বুড়োর মতো ঠান্ডা মাথা, গোয়েন্দার মতো চোখ। যে-কোনওভাবে বাঁচতে বা যে-কোনওভাবে মরতে আমি তৈরি–আঃ গুরু, কী বলব তোকে, একটা উইক পয়েন্টে আমি মার খেয়ে গেছি জোর, মা বাপ তোলা একটা গালাগাল আমি সইতে পারলুম না—
পাশের লোকটি সামান্য ঝুঁকে পড়ে বলল, কিছু বলছেন?
ভয়ংকর চমকে উঠল শ্যাম। বুঝতে পারল, সে বে-খেয়ালে হঠাৎ কথা বলে উঠেছিল। বাসের সামনের বা পিছনের সিটের দু-একজন তার দিকে ফিরে দেখল। বিবেকানন্দ রোডের কাছে ভিড় ঠেলে নেমে গেল শ্যাম।