মানুষের মৃত্যু অবশ্যই হয়,
কিন্তু মৃত্যুর তাৎপর্য ভিন্ন।
প্রাচীন চীনে
সিমা ছিয়েন নামক একজন সাহিত্যিক
বলেছিলেন
“মানুষের মৃত্যু অনিবার্য, কিন্তু তার তাৎপর্য
হবে থাই পাহাড়ের চেয়েও ভারী বা বেলে হাঁসের
পালকের চেয়েও হাল্কা।”
০১.
সিরাজগঞ্জ শহরের কালিবাড়ি রোডে, মমতাদের বাড়ির প্রাঙ্গণে, পেয়ারা গাছ তলায় শববাহকেরা যখন আবু ইব্রাহীমের লাশসহ খাটিয়া কাঁধে তুলে নেয় এবং প্রাঙ্গণ ত্যাগ করে জুমা মসজিদের দিকে যেতে থাকে তখন আবু ইব্রাহীমের পৃথুলা বিধবা স্ত্রী মমতার এই শোক এবং নির্মম বাস্তবতার ভেতর বহুদিন পূর্বের এক রাত্রির কথা মনে পড়ে। সেদিন গভীর রাতে ঢাকার বেইলি রোডের সরকারি কলোনিতে আবু ইব্রাহীম মমতাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে ব্যালকোনিতে নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলেছিল সারস পাখির ঝাঁক উইড়া যাইতাছে, শোনো। কালিবাড়ি সড়কের উপর দিয়ে যখন শববাহক এবং অনুগমনকারীরা উচ্চস্বরে কলেমা তৈয়বা পড়তে পড়তে অগ্রসর হয় তখন মমতার কেন যেন সেই রতিটির কথা মনে পড়ে যায় এবং তার হৃদয় বিদীর্ণ হয় এবং বর্ষার যমুনার মতো তার দুচোখ ভেসে যায়। আর সেই রাতে, যে রাতে বেইলি রোডের উপর দিয়ে সারস উড়ে গিয়েছিল, ঘুমের উষ্ণ আরামবঞ্চিত মমতা ক্ষুব্ধ হয়েছিল এবং একটি বাক্য উচ্চারণ করেছিল, যে বাক্যটি এর পর আমরা বহুবার মমতার মুখে উচ্চারিত হতে শুনব এবং পরিণামে আমাদের হয়তো এ রকম মনে হবে যে, মমতা আবু ইব্রাহীমকে যে নামে অভিহিত করেছিল, সে বস্তুত তাই ছিল। সে রাতে আবু ইব্রাহীমকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে পুনরায় ন্দ্রিায় ফিরে যাওয়ার আগে মমতা তাকে বলেছিল, তুমি একটা পাগল। আসলে মানুষ কি কখনো পাগল হয়, অথবা পাগল না হয়ে কি মানুষ পারে? মমতা নিদ্রায় ফিরে যাওয়ার পর সে রাতে আবু ইব্রাহীম তার কোয়ার্টারের বারান্দায় দাড়িয়ে থেকে অনেক রাত পর্যন্ত নিদ্রিত ঢাকার উপর দিয়ে দূরাগত পাখিদের উড়ে যাওয়ার ধ্বনি শোনে। পরদিন মমতা এবং বিন্দু এমন এক অবস্থায় সৃষ্টি করে যে, এই দুই নারীর প্রসঙ্গে আবু ইব্রাহীমকে জড়িত হতে হয় এবং এর ফলে মমতা এবার তাকে কেবল পাগল বলেই ছেড়ে দেয় না। মমতার সঙ্গে আমরা যখন আবু ইব্রাহীমকে দেখি তখন তাকে অনেক সময় মনে হয় গ্রিক ট্র্যাজিডির সেই সব নায়কদের মতো যারা তাদের পরিণতি মেনে নেয় এবং বহন করে চলে। আবু ইব্রাহীমের চোখের তারায়, শীর্ণ মুখের ব্যতিক্রমী উদ্ভাসিত হাসিতে এক চাঞ্চল্যের ইঙ্গিত লক্ষ করা যায়, যে চাঞ্চল্যকে সে প্রশ্রয়হীনতার নিগড়ে বেঁধে রাখে। মমতাকে নিয়ে তাই তার অতৃপ্তি ছিল না এবং মমতাও সুখী ছিল স্বামী, সন্তান এবং সংসার নিয়ে। এ রকম ছিল শীর্ণ, বাঅয় এবং গ্রামের আবু ইব্রাহীম এবং স্থূলকায়া, ফর্সা এবং ছোট শহরের মমতার যৌথ জীবন এবং বেইলি রোডের কলোনির উপর দিয়ে সারস পাখি উড়ে যাওয়ার পরদিন বিকেলে মমতা তাকে শুধু পাগল বলে ছেড়ে দেয় না, সে তাকে চামার বলে গাল দেয়। সে দিন দুপুরের পর আবু ইব্রাহীম একটু ঘুমায় এবং ঘুম থেকে উঠে সে দেখে যে, মমতা, তার মেয়ে বিন্দুকে বকাঝকা করছে। সে কিছুক্ষণ এসব শোনে তারপর উঠে বাথরুমে যায়। মুখ ধুয়ে ফিরে এসে সে দেখে যে, এসব কলোনির বাড়িগুলোর ভেতরে রান্না করার জন্য যে এক চিলতে কংক্রিটের স্লাব পাতা আছে তার পাশে বিন্দু দাঁড়িয়ে, ওর মাথাটা স্লাবের ওপর হাতের তালুর ভেতর গুজে দেওয়া। খুব নিঃশব্দে সে ফোঁপাচ্ছে। আবু ইব্রাহীম তোয়ালে দিয়ে মুখ মোছে এবং তখন মমতার হঠাৎ খেয়াল হয় যে, আবু ইব্রাহীম দাড়িয়ে দাঁড়িয়ে তোয়ালে দিয়ে ভেজা চোয়াল রগড়াচ্ছে আর বিন্দু তারই সামনে দাঁড়িয়ে ফোঁপাচ্ছে, এটা দেখে মমতা সঙ্গতকারণেই বিচলিত হয়।
এই মেয়ে কান্না থামা!
কি হইছে?
মমতা আবু ইব্রাহীমের কথার উত্তর দেয় না। তখন এক ধরনের নরম শব্দ এবং মিষ্টি গন্ধে ঘর ভরে যায়, চুলোর উপর দুধ উতলে পড়তে থাকে। এই সুযোগে মমতা আবু ইব্রাহীমের প্রশ্নের সম্মুখ থেকে দ্রুত সরে গিয়ে দুধের হাড়ির উপরকার ছেনি সরিয়ে দেয়, ফুসে ওঠা দুধের ভেতর ফু দিয়ে উতলানো আটকায়। আবু ইব্রাহীম তখন বাইরে ব্যালকোনিতে এসে দাঁড়ায়, দেখে, বেইলি রোডে বিকেল নামছে। তাদের কাজের মেয়েটি বাইরে গিয়েছিল, এ সময় সে ফিরে এলে মমতা তাকে নিয়ে পড়ে। আবু ইব্রাহীম ক্ষয় হয়ে আসা দিনের আলোর দিকে চোখ রেখে স্ত্রীর কণ্ঠ শোনে এবং তখন তার চেহারার দিকে দৃকপাত করলে আমাদের পুনরায় গ্রিক ট্র্যাজিডির নায়কদের কথা মনে পড়বে, যারা নিয়তিকে বহন করে যায়। অন্যদিকে অন্যপ্রান্তে যে রমণীটি, যার নাম এখানে মমতা, তার মুখের দিকে তাকালে তার চোখের আলো এবং গ্রীবা ভঙ্গিতে আমরা এক ধরনের স্থিরতা দেখতে পাব, যে স্থিরতা দিয়ে নারী সংসার গড়ে এবং সংসারের প্রান্তে চপলমতী স্বামী ও অর্বাচিন সন্তানকে ধরে রাখে। মমতা তাদের কাজের মেয়ে কাজলিকে বকাঝকা করে।
এতক্ষণ লাগে তর একটা সদাই আনতে?
কাজলি একটি উত্তর দেয় এবং তা মমতার কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না।
মুখে মুখে তর্ক করিস না, বাইরে একবার গেলে তো আর ফিরতে ইচ্ছা করে।
আবু ইব্রাহীম বারান্দায় দাঁড়িয়ে স্ত্রী এবং কাজের মেয়ের মধ্যকার এসব কথা শোনে তা বলা যায় না; সে বলে যে সে এগুলো এখন আর শোনে না। সে কলোনির পাশের রাস্তা দিয়ে অসংখ্য গাড়ি গড়িয়ে যেতে দেখে, দেখে সূর্য নিচু হয়ে গাছপালার মাথা ছোয়। তখন সে আবার পোড়া দুধের গন্ধ পায় এবং কিছু একটি পতনের ধাতব শব্দ শোনে। এবার মমতা বেইলি রোডের এ অসম্ভব ছোট বাসাগুলোর ওপর চটে, তারপর এ অল্প এবং সংকীর্ণ জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা বিন্দুর ওপর তার এই রাগ স্থানান্তরিত হয়।
মেয়েটা এ চিপার ভিতর দাঁড়ায়া ঢং শুরু করছে। এই মেয়ে, বিন্দু—
আবু ইব্রাহীম তখন ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখে, বিন্দু ওর মার তাড়া খেয়ে বাইরের ঘরে একটি বেতের চেয়ারের উপর এসে বসে এবং উপুড় হয়ে হাঁটুর কাছে, করতলের ভেতর মুখ গুঁজে রাখে। আবু ইব্রাহীম ঘরে ঢুকে সুইচ টিপে বাতি জ্বালে। বিন্দু দু ভাঁজ হয়ে বসে থাকে, মমতা রাতের রান্নার আয়োজন করে, তখন আবু ইব্রাহীম পুনরায় জানতে চায় বিন্দুর কি হয়েছে এবং মমতা উত্তর না দিলে সে বিন্দুর পাশে গিয়ে বসে।
কি হইছে তর বিন্দু?
বিন্দু ও মমতার মতোই কিছু বলে না।
কি হইছে, এই বিন্দু?
বিন্দু কথা বলে না, ওর মুখটা হাঁটুর ওপর করতলের ভেতরে রাখা, ঘাড়ের এক পাশ দিয়ে কালো চুল এলিয়ে থাকে। আবু ইব্রাহীমের কথা মমতার কানে যায়, এবার সে এগিয়ে আসে, বলে, লাই পাইতে পাইতে একদম মাথায় উইঠা গেছে।
হইছেটা কি?
স্কুল থেকে আইসাই বাহানা ধইরছে সোমাগোরে সঙ্গে যাইব।
কই?
কি জানি কই, বড় হইতাছে আর বেয়াড়া হইতাছে।
আবু ইব্রাহীমের এই মেয়েটির বয়স তখন ছিল দশ বছরের মতো, সে সিদ্ধেশ্বরী স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ত, কিন্তু গায়ে পায়ে সে খুব একটি বড় ছিল না। ওর বালিকা মুখটিতে কাঁচা শৈশবের যাবতীয় রং লেপা ছিল, শরীরের বাদামি রঙে ছিল রেশমের পেলবতা। তখন আবু ইব্রাহীমের মমতার কথা মনে পড়ে, মমতা বলে যে, বিন্দু বড় হয়ে গেছে। সে বিন্দুর দিকে তাকায় এবং মাথার উপর। হাত রাখে এবং তখন বিন্দু আবার ফোঁপাতে শুরু করে।
ও স্কুল থেইকা ফিরা খাইছে?
না।
মেয়েটা স্কুল থেইকা ফিরা খায় নাই আর তুমি ওর ওপর হম্বিতম্বি কইরতাছ?
তোমার মেয়ের উপুড় হম্বিতম্বি করা লাগে না। আমি খালি কইছি যে, যাওয়া লাইগব না; ব্যস, অমনি শুরু কইরা দিল অত্যাচার।
ওকে নিয়া যায়া খাওয়াও।
পেটে খিদা লাইগলে এমনিই খাইবনি, সাধা লাইগব না।
আবু ইব্রাহীম বিন্দুকে সোজা করে বসায়। সোজা হয়ে বিন্দু করতল দিয়ে মুখ ঢেকে রাখে। আবু ইব্রাহীম ওর হাত সরিয়ে দেয়; দেখে যে, বিন্দু কাঁদে না, তবে ওর নাক এবং ঠোঁট একটু একটু কাপে; ওর চোখের কোণ ভেজা এবং চোখ বন্ধ। বিন্দুর মুখের সামনের দিকের দাঁত ছিল একটু বড়। একটুক্ষণ পর ফোঁপানো বন্ধ করে সুস্থির হলে ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে তার দাঁত বেরিয়ে আসে।
কই যাইবার চাইছিলি?
বিন্দু তার কথার উত্তর দেয় না, হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছে, চোখ বন্ধ রেখেই শিথিল হয়ে বসে থাকে। বিন্দুর দিকে আবু ইব্রাহীম তাকায় এবং ভাবে, এই মেয়েটি মমতার পেটে জন্মেছে, মেয়েটি তার।
আমার সঙ্গে বেড়াইবার যাবি?
বিন্দু চোখ খোলে না, নির্লিপ্তর মতো বসে থাকে।
চল, তক বেড়ায় নিয়া আসি। যা ভাত খায়া স্যান্ডেল পায় দিয়ে আয়।
বিন্দু চোখ খুলে আবু ইব্রাহীমের দিকে তাকায় এবং সে মুখ দেখে তার মনে হয় না যে, বিন্দু বালিকা মাত্র এবং কোনো নরম কথা বলে তাকে ভোলানো চলে;
তবু সে বলে, যা খায়া আয়; চল বেড়ায়া আসি।
বিন্দু উঠে গিয়ে স্যান্ডেল পরে আসে।
খাইলি না? না খাইলে যামু না।
বিন্দু চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
কিরে!
বিন্দুর চেহরায় তখন নির্লিপ্ততার গাম্ভীর্য পুনরায় ফিরে এলে আবু ইব্রাহীম বিন্দুর কাছেও হার মেনে নেয়, সে প্যান্ট-শার্ট পরে বিন্দুকে নিয়ে বের হয়। তারা প্রথমে শাহবাগ গিয়ে বসে, সেখানে সে বিন্দুকে আইসক্রিম কিনে দেয়। বিন্দু কোন-আইসক্রিমের শেষ অংশটুকু মুখে পুরে দিয়ে ফ্রকে হাত মুছে ফেলে।
জামায় হাত মুছিস ক্যান? জামা ময়লা হয় না?
মনে হয় যেন বিন্দু তার কথা শোনে নাই; সে বলে, ফাইন লাগে।
ফাইন মানে কি?
ফাইন মানে ভালো। শারমিন সব সময় বলে ফাইন। শারমিনের আব্বাও বলে ফাইন।
শারমিন কে?
আমার বান্ধবী।
অর আব্বাকে তুই কৈ দেখলি?
ওদের বাসায়, আমাদের স্কুলের পাশেইতো ওদের বাসা।
শারমিনের আব্বাক খুব ভালো লাগে তর?
না, পচা!
যুদি কয়, এই খুকু তুমি আমাদের বাসায় থেকে যাও, তোমাকে অনেক আইসক্রিম দেব, সুন্দর জামা দেব; তুই থাকবি না?
না।
কেন?
শুভ কানবে না!
শুভ যুদি না কান্দে?
না, আমার আব্বু-আম্মু আছে না!
তর আব্বু আছে নাকি?
বিন্দু তখন হাসে এবং বলে হু, আছে।
আর একটা আইসক্রিম খাবি?
বিন্দু হাসে। দ্বিতীয় আইসক্রিমটা সে দ্রুত শেষ করে।
আর একটা খাবি?
বিন্দুকে দ্বিধান্বিত দেখায়। আবু ইব্রাহীম বলে, কিরে খাবি আর একটা?
হু।
মাইর খাবি, মাইর। এত আইসক্রিম খাইলে সব দাঁত পইড়া যাইব, ফোকলা হয়া যাবি। চল, ওঠ।
আবু ইব্রাহীম বিন্দুর হাত ধরে রাস্তার পাশে দাঁড়ায়, সে বাসায় ফিরতে চায়, কিন্তু বিন্দু ফিরতে চায় না।
আর একটু পরে আব্বু। চলো না একটু হাঁইটা বেড়াই।
আবু ইব্রাহীম মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে জাদুঘর পার হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে হাঁটে। বিন্দু তার পায়ে পায়ে জড়িয়ে এগোয়। চওড়া কালো রাস্তা উজ্জ্বল বাতির নিচে নিঃসঙ্গ কিন্তু সুন্দর দেখায়, এর খোলামেলা ভাব এবং সরলরৈখিক প্রবাহ আবু ইব্রাহীমের ভালো লাগে। পাবলিক লাইব্রেরী এবং আর্ট কলেজ পার হয়ে তারা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের গেটের কাছে এসে থাকে, আবু ইব্রাহীম তাকায় এবং দেখে ভেতরটা ছায়া ছায়া অন্ধকার; তার মনে হয়, এই সেই পথ, এই সেই প্রাঙ্গণ। মসজিদের দক্ষিণ পাশের ঝাঁকড়া আম গাছটি নিকষ কালো দৈত্যের মত দাঁড়িয়ে আছে, সে দিকে তাকিয়ে তার অচৈতন্যের ভেতর থেকে চেতনা মর্মরিত হয় এবং তার মনে পড়ে যায় যে, এই খানে সে একদা হারিয়েছিল এবং এখান থেকেই নিজেকে খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল একদা। এই আলো এবং অন্ধকারে জড়িয়ে ছিল সে, তারপর কত বছর তার পার হয়ে গেছে, কত দিন হৃদয়ের কাছটিতে সে আসেনি। এখন সে ঢাকাতেই থাকে, তবু যেন কত দূরে থাকে এবং এই এলাকায় তার আসা হয় না। এখন সে ক্রমাগত নিজেকে হারায়, মনে হয় যেন মুত্যার দিনটি পর্যন্ত তার এই হারানোর পালা চলে। বিন্দু তার গায়ের সঙ্গে লেপ্টে দাঁড়ায় এবং বলে, চলো আব্বু ফিরা যাই।
কিন্তু এবার আবু ইব্রাহীম বিন্দুর কথা শোনে না, সে বিন্দুকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরীর সামনে আসে এবং দেখে, সব কিছুই প্রায় বদলে গেছে; জামরুল আর লিচু গাছ নেই, চারদিকে সব নূতন দালান। এখানে অনেক কিছুই তার অচেনা, তবু তার মনে হয় যেন এখানে সে অপরিচিত নয়; লাইব্রেরীর এই বারান্দা, মধুর ভুতুড়ে ক্যান্টিন, কলা ভবন, সবখানেই তার পায়ের চিহ্ন আছে; এই পথ, মাটি, ঘাসের বুকে তার স্মৃতির ধুলো আছে এবং এখনো লাইব্রেরীর পিছনের চত্বরে পাম গাছের কাছে ঘাসের উপর দীর্ঘশ্বাসের মতো বাতাস বয়ে যায়। বিন্দুর ভালো লাগছে না বুঝতে পেরে সে লাইব্রেরীর লম্বা বারান্দার দক্ষিণের প্রান্তে বিন্দুকে হাতের ভেতর নিয়ে দাঁড়ায়, যেন সে ভাবে যে, কাঁধের ওপর হাতের ছোঁয়া পেলে তাঁর এই ভালোলাগার রহস্য বিন্দুর কাছে প্রকাশিত হবে।
কিরে বিন্দু?
উ।
হয়রান হয়া গেছিস?
চলো না চইলা যাই।
বসপি এইখানে?
না, চলো চইলা যাই।
আবু ইব্রাহীম বারান্দার প্রান্তে পা নামিয়ে বসে, তার কন্যাটি তার দু হাঁটুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকে। সামনের ঝাকড়া কড়ই গাছ, ছাত্রদের জটলা এবং দূরে রোকেয়া হলের দিকে তাকিয়ে আবু ইব্রাহীম তার ডান হাতটি বিন্দুর কাঁধের উপর থেকে সরিয়ে বারান্দার শানের উপর রাখে। তার করতল পাথরের ভালোবাসা স্পর্শ করে।
এইটা কি জানিস?
উ?
জানিস এইটা কি?
কোনটা?
এইটা ইউনিভার্সিটি।
বিন্দুকে তখন সে পাশে বসায়।
এইটা সব থেইকা বড় ইস্কুল।
এইখানে কারা পড়ে।
ম্যাট্রিক পাস কইরা, তারপর আই এ পাস কইরা, তারপর ইখানে আসে পইড়বার নেইগা।
হু, জানি। এখানে তুমি পইড়ছ না?
আবু ইব্রাহীম হাত দিয়ে বিন্দুকে বেষ্টন করে, তার গলার স্বর গাঢ় হয়ে আসে।
হে, আমি এইখানে পইড়তাম।
তখন তুমি ছোট আছিলা?
হু, আমি তখন ছোট আছিলাম।
আমি জানি, তখন তো তোমার বিয়াই হয় নাই।
যাহ, কে কইলো তক বিয়াই হয় নাই?
হইছিল?
হু।
আম্মুর সঙ্গে?
হু।
যাহ, তুমি মিথ্যা কথা বলো।
বিন্দুর সঙ্গে সে আর পেরে ওঠে না এবং সে পুনরায় হারে, তারপর তারা দক্ষিণের গেট দিয়ে বের হয়ে, রিকশায় চেপে বাসায় ফিরে আসে। তখন মমতা শুভকে পড়াচ্ছিল। বিন্দু গিয়ে তাদের সামনে বসে এবং তার আলু চপ এবং দুটো আইসক্রিম খাওয়ার কথা ঘোষণা করে। বিন্দুর কথা শুনে শুভ প্রথমে গ্রাহ্য করতে চায় না, তারপর সে ব্যাপারটি বোঝে এবং চুপ মেরে যায়।
কিরে, পড়িস না?
বিন্দু আইসক্রিম খাইছে।
ভালো কইরছে, চুপ, পড়।
শুভ পড়তে রাজি হয় না। আবু ইব্রাহীম বলে, পইড়ানে, তক কাইল নিয়া যামুনি।
আবু ইব্রাহীমের এই কথায় মমতা রেগে যায়, বলে, মেয়েটার মাথা খাইছ, এবার ছাওয়ালটার খাও।
বাজে কথা কয়ো না।
এত রাইত পর্যন্ত এই বাচ্চা মেয়ে নিয়া কেউ ঘুইরা বেড়ায়?
ইউনিভার্সিটিতে গেছিলাম।
ওইখানে কি? কিরে ছেলে, তুই পড়বি না?
এমনি, দুইজন মিলা ঘুইরা বেড়াইলাম।
শুভ আর পড়ে না। বিন্দু হাই তোলে, ওর চোখে ঢুলুনি দেখা দেয়। মমতা বলে, পাগলামি!
পাগলামি কি?
এইটা কোনো বেড়ানের জায়গা হইল?
তুমি কি বুইজবা!
আমিতো কিছুই বুজি না!
খুব বোঝ!
সব সময় গণ্ডগোল লাইগা থাকে, গুণ্ডামির আডডাখানা; আর উনি গেছেন কঁচি মেয়ের হাত ধইরা ওইখানে হাওয়া খাইতে।
আবু ইব্রাহীম চুপ করে যায়, শুভ আর পড়ে না, বিন্দু ঝিমোয়। তখন মমতা কাজলিকে ডেকে ভাত দিতে বলে। বিন্দুর দিকে তাকিয়ে আবু ইব্রাহীম বুঝতে পারে যে, তাকে বেশি হাঁটানো হয়ে গেছে। সে বিন্দুর কানের পাশে দিয়ে চুলের ভেতর হাত ঢুকিয়ে দিলে, বিন্দু তার করতলের ভেতর মাথার ভার ছেড়ে দেয়। সে দেখে, বিন্দুর চোখ বন্ধ, সামনের দাঁত বেরিয়ে আছে এবং সে বলে, আমি বিন্দুকে ইউনিভার্সিটিতে পড়ামু।
মমতা তখন জানত না যে, আবু ইব্রাহীমের কোনো স্বপ্নই সফল হবে না, তার সব কথাই অর্থহীন থেকে যাবে, কারণ মৃত্যু বড় দ্রুত এসে তাকে স্বপ্নচারিতা থেকে অপসারিত করবে। তাই তখন মমতা শুভর বই-খাতা গোছাতে গোছাতে আবু ইব্রাহীমের কথা শুনে ঠোঁট টিপে বলে, তোমার যে কোনখানে লাগে আমি জানি!
এরপর সে রাতে আবু ইব্রাহীমের সঙ্গে মমতার ভালোমতো একটি বচসা হয়। আবু ইব্রাহীমের মৃত্যুর পরে প্রায় দু বছর, প্রতিটি দিন মমতার অতীতের এইসব দিনের কথা মনে পড়তে থাকে। সেদিন রাতে ঝগড়ার পর মমতা প্রচুর কাঁদে এবং আবু ইব্রাহীম, কাজলি খাবার দিলে খেয়ে শুভকে নিয়ে ভেতরের ঘরে শুয়ে পড়ে। মমতা না খেয়ে জেগে থাকে এবং তার সঙ্গে জেগে থাকে বিন্দু। আবু ইব্রাহীম যখন তন্দ্রাচ্ছন্ন হয় তখন তার মনে হয় যেন ঘুমের ভেতর সে কার কণ্ঠ শুনছে এবং তারপর সে বুঝতে পারে যে, সে ঘুমায়নি এবং সে যার কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছে সে হচ্ছে বিন্দু। সেই রাতে আবু ইব্রাহীম তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় মা এবং মেয়ের মধ্যকার রহস্যময় এবং সম্পর্কের বিষয়ে অবহিত হয়। সে বিষয়ে বাইরে থেকে পুরুষ কিছুই বুঝতে পারে না। সে শুনতে পায় পাশের ঘরে বিন্দু ‘আম্মু’ ‘আম্মু’ করে মমতাকে সাধে এবং সে রাতে, তখন পাশের ঘরে মমতা আর বিন্দুকে রেখে আবু ইব্রাহীম শুভকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
এই জিনিসটি আমাদের প্রায়ই মনে হবে যে, আবু ইব্রাহীম একজন অসুখী লোক ছিল; কিন্তু অন্য কখনো, তাকে যখন আমরা উদ্ভাসিত হাসি অথবা পত্নী প্রণয়ের ভেতর দেখব তখন আমাদের হয়তো মনে হবে যে, আমাদের সিদ্ধান্ত হয়তো শেষ সত্য নয়। আমরা এই জিনিসটি জানি যে, একটি ব্যর্থ প্রণয়ের বিষণতা এবং যৌবনে লালিত রাজনৈতিক আদর্শ অর্জনের পথ থেকে সরে আসার গ্লানিবোধ তার ছিল। একটি মেয়ে ছিল; যার নাম ছিল হেলেন এবং যে তার সহপাঠী ছিল, সে আবু ইব্রাহীমের অগ্নিস্নানের ব্যবস্থা করেছিল। আমরা জানি যে, আবু ইব্রাহীমের ডাইরি লেখার অভ্যাস ছিল এবং তার সেই সব দিনপঞ্জি পাঠ করলে আমরা দেখতে পাব তার কি কি ভালো লাগে না তার তালিকা মমতা হেলেনের বিষয়টি জানত, আবু ইব্রাহীম তাকে বলেছিল। তাছাড়া আবু ইব্রাহীমের ডাইরি লুকিয়ে পড়ার অভ্যাসও ছিল তার। ১৯৬৭ সনের পুরনো এক ডাইরিতে একদিন আবু ইব্রাহীম হেলেনের সঙ্গে তার সাক্ষাতকার এভাবে বর্ণনা করেছিল যে, কয়েকদিন হেলেন ক্লাসে না আসায় তাকে দেখার জন্য আবু ইব্রাহীমের মন বড় উতলা হয়; তারপর হেলেনের প্রত্যাবর্তনের পর তাকে দেখে তার সঙ্গে কথা বলে, আবু ইব্রাহীমের অস্তিত্ব শেষ হয়ে যেতে চায়; তার অন্ত বেদনায় ভরে থাকে। হেলেন আবু ইব্রাহীমকে আঘাত করেছিল কিনা তা আমরা জানতে পারি না, তবে আমরা এটা আবু ইব্রাহীমের লেখা থেকে বুঝতে পারি যে, হেলেন তার আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করে নাই এবং সে ব্যর্থ প্রেমের কাঙালপনা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে ছ বছর ঘুরে বেড়িয়েছিল এবং মহসীন হলের তিনতলার সংকীর্ণ কক্ষে রাতের বেলায় বসে দিনপঞ্জির এইসব বর্ণনা লিখেছিল। মহসীন হলে তখন তার রুমে অনেক বই ছিল এবং এইসব বই এর একটি ছিল মাও সেতুঙের লেখা পাঁচটি প্রবন্ধের একটি ক্ষুদ্র সঙ্কলন। এখন প্রথম পৃষ্ঠায় আবু ইব্রাহীমের নাম লেখা এই বইটি খুঁজে বের করতে পারলে আমাদেরকে পাতা উল্টে যেতে হবে এবং আমরা তা করলে দেখব যে, এই পুস্তিকায় কানাডীয় চিকিৎসক ডাক্তার নরম্যান বেথুনের মৃত্যু সম্পর্কে একটি ছোট প্রবন্ধ আছে এবং এই প্রবন্ধের এক স্থানে ডাক্তার বেথুনের মৃত্যুর মহিমা মাও সেতুং বর্ণনা করেছেন এভাব যে, কিছু কিছু মৃত্যু আছে হাসের পালকের মতো হাল্কা, আর অন্য কিছু মৃত্যু আছে স্থায়ী পাহাড়ের মতো ভারী। আমরা দেখব যে, লাল কালি দিয়ে এই বাক্যের নিচে রেখা টানা আছে এবং সহজেই বুঝতে পারব যে, এই কাজটি আবু ইব্রাহীম করেছে। আবু ইব্রাহীমের যখন মৃত্যু ঘটবে তখন মৃত্যুর বিষয়ে তার বহুদিন আগেকার ভাবনার কথা আমাদের স্মরণে থাকলে আমাদের মনে হবে যে, আমরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছি; তার মৃত্যুর কোনো মানে আমরা খুঁজে পাব না। হাসের পালকের চাইতেও হাল্কা এবং তুচ্ছ এক মৃত্যুর ভেতর তাকে আমরা পতিত হতে দেখব। মৃত্যু আবু ইব্রাহীমের বড় অপ্রিয় প্রসঙ্গ ছিল এবং তার অন্য অপ্রিয় বিষয় ছিল তার চাকরি। সে তার ডাইরিতে বহুবার লেখে যে, চাকরি করতে তার ভালো লাগছে না। কিন্তু অপছন্দ হলেও চাকরি সে ত্যাগ করেনি, কারণ, খারাপ লাগার ভেতরই একই সঙ্গে সে জানত যে, চাকরিটি না থাকলে তার জীবন বিপর্যন্ত হবে। এই সময়, সচিবালয়ে এগারো বছর চাকরি করার পর তার পুনরায় মনে হয় যে, এর কোনো অর্থ হলো না; সে নিজেকে অপচয়িত দেখতে পায়। তখন সে দুপুর বেলা তার ঘনিষ্ঠতম সহকর্মী সিদ্দিক হোসেনকে ফোন করে গল্প করে।
কি খবর?
এই।
ব্যস্ততা গেল? সামারি তৈরি শেষ হইছে?
এই মাত্র টাইপ করতে দিলাম।
চলো ঘুইরা আসি।
সিদ্দিক হোসেন তখন অর্থ বিভাগে কাজ করত, আবু ইব্রাহীম তার শাখা সহকারীকে সে কোথায় যাচ্ছে বলে বেরিয়ে যায়। সিদ্দিক হোসেনের রুমে বসে তারা প্রত্যেক দিনের মতো তাদের সিনিয়র অফিসারদের নিয়ে কথা বলে এবং তাতে প্রশংসাসূচক কিছু থাকে না। তারপর তারা কিছুক্ষণ চুপ হয়ে থাকে এবং সিদ্দিক হোসেনের তিন তলার এই অফিস রুমের জানালা দিয়ে কৃষ্ণচূড়া আর ইউক্যালিপটাস গাছ আবু ইব্রাহীমের চোখে পড়ে। সারস পাখির ডাক শোনানোর জন্য মধ্যরাতে ঘুম থেকে ডেকে তোলায় মমতা একদা আবু ইব্রাহীমকে পাগল বলেছিল। সিদ্দিক হোসেনের অফিস রুমে এই দিন সিদ্দিক হোসেনও তাকে পাগল বলে। কৃষ্ণচূড়া গাছের লাল ফুলের দিকে তাকিয়ে আবু ইব্রাহীমের নিশ্চয়ই ভালো লাগে, কারণ সে বলে যে, সেক্রেটারিয়েটের ভেতর কৃষ্ণচূড়া গাছ লাগিয়ে ভরে ফেলা উচিত। তার এই কথা শুনে সিদ্দিক হোসেন হাসে এবং সিগারেটের ধোয়া ছেড়ে বলে, তুমি একটা পাগল।
কেন?
কারণ তুমি পাগল। সামারি বানাচ্ছ কার জন্য? প্রেসিডেন্ট?
ক্যাবিনেট।
তোমার শ্বশুর আসছে?
হ্যাঁ। ঘরে জায়গা নাই, এর ভিতর কি যে অবস্থা।
কবে আসছে?
কাইল।
কি হইছে?
প্রোস্টেট গ্লান্ড ফুলছে। অপারেশন করাইতে হবে।
চা খাইবা?
থাক। সিদ্দিক হোসেন ঘণ্টা বাজিয়ে পিয়নের জন্য অপেক্ষা করে, কিন্তু কেউ আসে। কেউ নাই, সে বলে, সব ঘুইরা বেড়াইতাছে, ধান্দা করতাছে।
আসলেই এত কম কাজ করি আমরা।
যে টাকা দেয়, বেশি করি।
তখন আবু ইব্রাহীম তার পুরনো এবং বহুল ব্যবহৃত বাক্যটি পুনরায় উচ্চারণ করে, এই চাকরি আর ভালো লাগে না।
চলো ঘুইরা আসি বাইরে থেইকা।
কোথায়?
চলো না।
তখন সিদ্দিক হোসেনের টেলিফোন নম্বরে আবু ইব্রাহীমের ফোন আসে। তার উপসচিব সামারিটি কতদূর হলো জানতে চায় এবং সে তাকে বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত করে, বলে, সামারিটা স্যার টাইপ হচ্ছে, আর আরো দুটো ফাইল আপনাকে দিয়েছি। টেলিফোনে কথা বলা শেষ হলে সে সিদ্দিক হোসেনকে বলে, স্যার, ফাইল, পুটআপ, এগুলো কি এবং কেন?
তুমি বল।
বলতে পারব না।
তুমি কি হতাশ?
বলতে পারব না।
তুমি কি তোমার ভবিষ্যত চিন্তায় আতঙ্কিত?
বলতে পারব না।
কি বলতে পার তুমি?
ভালো লাগছে না!
বাদ দাও, চলো ঘুরে আসি।
আমার কাজ আছে যে!
ভালো লাগে না তবু এত কাজের চিন্তা কর কেন?
আমার বৌ-পোলাপান আছে যে!
চলো চলো, এক্ষুণি আইসা পড়ব, ম্যাক্সিমাম আধঘণ্টা।