সারাদিন মাল্যবানের মনেও ছিল না; কিন্তু রাতের বেলা বিছানায় শুয়ে অনেক কথার মধ্যে মনে হল বেয়াল্লিশ বছর আগে ঠিক এই দিনেই সে জন্মেছিল—বিশে অঘ্রাণ আজ।
জীবনের বেয়াল্লিশটি বছর তাহলে চলে গেল।
রাত প্রায় একটা। কলকাতার শহরে বেশ শীত, খেয়ে-দেয়ে কম্বলের নীচে গিয়েছে সে প্রায় গোটা দশেকের সময়; এতক্ষণ ঘুম আসা উচিত ছিল, কিন্তু এল না; মাঝে মাঝে কিছুতেই চোখে ঘুম আসে না। কলেজ স্ট্রিটের বড়ো রাস্তার পাশেই মাল্যবানের এই দোতলা ভাড়াটে বাড়িটুকু; বাড়িটা দেখতে মন্দ নয়—কিন্তু খুব বড়ো-সড়ো নয়, পরিসর নেহাৎ কমও নয়। ওপরে চারটে ঘর আছে—তিনটে ঘরেই অন্য ভাড়াটে পরিবার থাকে—চিক দিয়ে ঘেরাও করে নিজেদের জন্য তারা একটা আলাদা ব্লক তৈরি করে নিয়েছে—নিজেদের নিয়েই তারা স্বয়ংতুষ্ট—এ-দিককার খবর বড়ো একটা রাখতে যায় না।
ওপরের বাকি ঘরটি মাল্যবানদের স্ত্রী উৎপলা ঘরটিকে গুছিয়ে এমন সুন্দর করে রেখেছে যে দেখলে ভালো লাগে। ধবধবে দেয়ালের গোটা কয়েক ছবি টাঙানো; একটা ব্রোমাইড এনলার্জমেন্ট: প্রৌঢ়ের, উৎপলার বাবার হয়তো, তার মার একটা অয়েল-পেন্টিং, মাল্যবানের শ্বশুর পরিবারের আরো কয়েকটি লোকের ফটোগ্রাফ কয়েকটা হাতে-আঁকা ছবি (কে এঁকেছে?)-ঘরের ভেতর একটা পালিশ মেহগনি কাঠের খাট, খাটের পুরুর গদির ওপর তোশকে বকপালকের মতো সাদা বিছানার চাদর সব সময়ে ছড়িয়ে আছে। দুজন মানুষ এই বিছানায় শোয় : উৎপলা (তাকে পলা ডাকে তার সমবয়সীরা আর বড়রা প্রায় সকলেই) আর তার মেয়ে মনু। মেয়েটির বয়স প্রায় নয় বছর। মাল্যবান ও উৎপলার এই বারো বছরের দাম্পত্য জীবনের মধ্যে এই একটি মেয়েই হয়েছে। কোনো দিন আর-কিছু হবে না যে তাও ঠিক। দোতলার এই ঘরটি বেশ বড়ো, মেঝে সব সময়েই ঝকঝকে, এক টুকরো কাগজ, ফিতে, সেফটিপিন, পাউডারের গুঁড়ি পড়ে থাকে না কখনো; ঘরের ভেতর টেবিল চেয়ার সোফা কৌচ রয়েছে কতকগুলো। সবি বেশ পরিপাটি নয়, ছিড়ে গেছে, ময়লা হয়ে গেছে, কিন্তু উৎপলার যত্নের গুণে খারাপ দেখাচ্ছে না। এক কোণে একটা অর্গান রয়েছে; তারি পাশে একটা সেতার আর একটা এস্রাজ; উৎপলার আলোর জিনিস; গাইতে ভালোবাসে, বাজাবারও সাধ খুব, প্রায়ই গুনগুন করে সব সকর্মর্তার ভেতর কোনো না কোনো একটা সুর ভাঁজছে, মাঝে মাঝে কীর্তনের সুরও; এক-এক সময় বিশেষত বাথরুমে ধারাস্নানের সময়, বেশ জোরে গান গায় পলা। গান-টান মাল্যবান কিছুই জানে না, কিন্তু অনেকক্ষণ পর্যন্ত খুব সহিষ্ণুভাবে স্ত্রীর ষড়জ ঋষভ গান্ধার টান্ধার সহ্য করে যাওয়াই তার অভ্যাস, না হলে তা হয়ে উঠবে দুষ্ট সরস্বতী, তখন রক্ষা থাকবে না আর। কিন্তু তবুও বড়ো একঘেয়ে লাগে তার, স্ত্রীর গান বলেই নয়, পৃথিবীর সমস্ত গান বাজনার ওপর অত্যন্ত হতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে তার মন; কী করবে যে সে কিছুই ঠিক পায় না। মুখ চূণ করবে, সঙ্গে সঙ্গেই কান ঝাঁঝাঁ করবে চোখ জ্বলে উঠবে উৎপলার তাকে থামতে বললে, গান থামাতে বললে। এম্নিতেই বৌয়ের বিশেষ স্নেহশ্রদ্ধার মানুষ নিজেকে সে করে তুলতে পারেনি। মাল্যবানের স্বভাব ফটফটে ফিটকিরির মত। সে নিজের মনে থাকা মানুষ; মানুষকে ক্ষমা করে যাওয়া অভ্যাস, অযথা হৈ রৈ হিংসার ছোব ভালো লাগে না তার। শান্তি ভালোবাসে; নিজের সুখ-সুবিধে অনেকখানি ছেড়ে দিয়েও। গানের সম্পর্কে সে স্ত্রীকে কোনোদিন কিছু বলে না বড়ো-একটা; বেশি ঝালাপালা বোধ করলে অবিশ্যি গান খুব ভালো করে শিখতে হয়, অনেকে খুব মন খুলে গায়, ভালো লাগে; মন খুলেছে বলে ভালো লাগে এরকম এক-আধটা ইশারায় অনুযোগ জানায় মাল্যবান। এ-ধরনের ইঙ্গিতের জন্য স্ত্রীর কাছ থেকে সে সত্যিই শাস্তি পায়; কাজেই পারতপক্ষে স্ত্রীকে কিছুই বড়ো একটা বলতে যায় না। নিজে মাল্যবান গানমুজরো না ভালোবাসে তা নয়। যখন সে কলকাতার চাকরিতে বাঁধা পড়েনি, পাড়াগাঁয়ে ছিল, সেই ছোটবেলায় এক-এক দিন শীতের শেষরাতে বাউলের গান শুনতে তার খুব ভালো লাগত; কোনো দুর হিজলবনের ওপার থেকে অন্ধকারের মধ্যে সে সুর ভেসে এসে তার কিশোর আঁতে ব্যথা দিয়ে যেত। কত দিন—যখন দিন শেষ হয়—দাণ্ডাগুলি খেলে যখন সে কাচা-কাচা কালিজিরা ধানশালি রূপশালির ক্ষেতের আলপথ দিয়ে বাড়ি ফিরছে, ভাটিয়াল গান শুনে মনটা তার কেমন করে উঠত যেন। সারা দিনের সমস্ত কথা কাজ অবসন্ন শোল বোয়ালের মতো দীঘির অতলে তলিয়ে যেত যেন, ঝিরঝির ফটিক-ফটিক ঝিক-ঝিক ঝর-ঝর করে উঠত ওপরের জল : যে জল গানের মতো, যে-গান জলের মতো চারদিককার খেজুরছড়ি, নারকোলঝিরঝিরি ঝাউয়ের শনশনানি ছায়া অন্ধকার একটি তারার ভেতর; এক কিনারে চুপ করে বসে থাকত সে। বাপ-মাকে ফাকি দিয়ে কত রাত সে যাত্রা শুনতে গেছে—তারপর সেই সব গানের সুর এমন পেয়ে বসেছে তাকে যে পরীক্ষার পড়া মুখস্থ করতে করতে এক-একবার টেবিলের ওপর মাথা রেখে অনেকক্ষণ নিঝঝুম হয়ে পড়ে থাকত; কোথাও মেঘ নেই, বৈশাখ আকাশের বিদ্যুচমকানির মতো ভরে যেত মন এ-কাণার থেকে সে-কাণায়; বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে উঠবার পূর্বাভাসের মতো; কিন্তু তার আগেই সে মাথা খাড়া করে অন্য পৃথিবীতে চলে যেতে চেষ্টা করত, ফোঁপাতে যেত না। মণিভুপকণ্ঠ চক্রবর্তী বলে একজন ভদ্রলোক ছিলেন—সত্যিই কি তার নাম মণিভূপকণ্ঠ?—কী মানে এই নামের?—কিন্তু তবুও সকলেই তো তাকে এই নামে ডাকৃত; মণিভূপের গানের কথা মনে পড়ে; শমনহরা বোস-ঝুনুঝুন বোস-চৌধুরাণী নামেই বেশি খ্যাত—তার গান; সে সব দিন কোথায় গেছে যে আজ। পাড়ায়-পাড়ায় গানের বৈঠকের লোভে পড়াশুনো ফেলে যেন্নি সে আসরের এক কিনারে গিয়ে বসেছে, ওমি কাকা তাকে কানে টেনে-হিচড়ে বাসায় নিয়ে গেছেন; তবুও তার মায়ের সঙ্গে ষাট করে ফের আবার পালিয়ে যেতে ইতস্তত করেনি সে।
পলাকে এ-সব কথা কোনো দিন বলেনি মাল্যবান।