সানাউল্লাহ কৃষি ব্যাংকের ম্যানেজার হিসেবে রিটায়ার করেছেন। অতীশ দীপঙ্কর রোডে একটা টিনশেড বাড়িতে একা থাকেন। সবাইকে বলে বেড়ান–সুখে আছিরে ভাই, মহাসুখে আছি। ব্যাংকের হিসাব মিলানোর ঝামেলা নাই, হাজিরা দেবার ঝামেলা নাই। পায়ের ওপর পা তুলে সুখে জীবনপাত। আমার মতো সুখী বাংলাদেশে আরো আছে বলে মনে হয় না।
তার কাজের ছেলের নাম রফিক। সে বাজার করে, রান্না করে এবং রাতে খাবার পর সানাউল্লাহর সঙ্গে ডিভিডি প্লেয়ারে হিন্দি ছবি দেখে। তিনি রফিককেও প্রায়ই বলেন, রফিক, এর নাম সুখ। ইংরেজিতে বলে হ্যাপিনেস। দিনের শেষে আরাম করে ছবি দেখা, রাত দশটায় ঘুমুতে যেতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। প্রয়োজনে এক রাতে পরপর তিনটা ছবি দেখতে পারি। কিংবা সন্ধ্যাবেলা ঘুমিয়ে পড়তে পারি। পারি না?
পারেন স্যার।
মনে কর এক রাতে আমরা অমিতাভ বচ্চনের তিনটা ছবি দেখলাম। রাতটার নাম দিলাম অমিতাভ নাইট। নাইট মানে রাত। অমিতাভের রাত। কেমন হয়?
রফিক সব দাঁত বের করে বলল, ভালো হয় স্যার। বুড়া ভালো পাঠ গায়। উনার তিনটা বই কবে দেখব স্যার?
আগামীকাল রাতেই দেখা যেতে পারে। আগামীকাল হচ্ছে শুক্রবার। উইক এন্ডের শুরু। যদিও আমার জন্যে প্রতিদিনই উইক এন্ড। বিশেষ খাবার দাবারের ব্যবস্থা কর। পোলাও আর খাসির মাংসের রেজালা।
সাথে ইলিশ মাছের ভাজি দিব স্যার?
দিতে পারিস। পোলাও আর ইলিশ এক সূতায় গাঁথা মালা।
শুক্রবার সকালে রফিক বাজারের টাকা এবং ডিভিডি প্লেয়ার নিয়ে পালিয়ে গেল। অমিতাভের তিনটা সিডি তিনি আলাদা করে রেখেছিলেন। সেগুলিও নিয়ে গেল।
সানাউল্লাহ বললেন, ভেরি স্টুপিড বয়। সানাউল্লাহ সুপিডের চেয়ে খারাপ কোনো গালি দিতে পারেন না। রফিককে স্টুপিড় গালি দিয়েও তার একটু মন খারাপ হলো। কারণ রফিককে তিনি পছন্দ করতেন। পছন্দের মানুষকে গালাগালি করা ঠিক না। রফিক একটা খারাপ কাজ করেছে বলে তিনিও করবেন তা কেমন করে হয়?
সানাউল্লাহ ভালো ঝামেলায় পড়লেন। রাতে তাজ রেস্টুরেন্টে খেতে গেলেন। অতিরিক্ত মসলা এবং ঝাল দেয়া খাবার। মোটেও ভালো লাগল না।
বাসায় ফিরে তিন চামচ চিনি খেলেন, তাতেও মুখের ঝাল দূর হলো না। তিনি ফ্যান ছেড়ে হা করে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে রইলেন। যদি ফ্যানের বাতাসে ঝাল ভাব কিছু কমে। এই সময় এক কান্ড হলো। তার খাটের নিচে খচমচ শব্দ হতে লাগল। তিনি নিচু হয়ে তাকালেন। অবাক হয়ে দেখলেন, ছয় সাত বছরের একটা বাচ্চা চুপচাপ বসে আছে। মায়াকাড়া চেহারা। বড় বড় চোখ। দীর্ঘ আঁখি পল্লব। মাথাভর্তি কোঁকড়ানো চুল। গায়ের রঙ স্ফটিকের মতো সাদা।
তিনি অবাক হয়ে বললেন, তুই কেরে?
ছেলেটা ফিস ফিস করে বলল, আস্তে কথা বলুন। ঘুম ভেঙে যাবে তো।
কার ঘুম ভাঙবে?
আমার বোনের। ওর নাম ডমরু।
তিনি খাটের নিচে ছেলেটি ছাড়া কাউকে দেখলেন না। অবাক হয়ে বললেন, ড়ুমরু কই?
ছেলেটি বলল, ও ভূত তো, এইজন্যে ওকে দেখছেন না।
তুই কী?
আমিও ভূত। আমার নাম হম। আমাকে দেখতে পাচ্ছেন কারণ আমি বড়। মানুষের বেশ ধরতে শিখেছি। ও এখনো শিখে নি। আপনার ঘরে কি মধু আছে?
মধু কী করবি?
খাব।
মধু তো নাই। চিনি দেব? চিনি খাবি?
এক চামচ দিন।
তোর বোনটা কী করছে?
ও ঘুমাচ্ছে। জ্বর এসেছে তো, এইজন্যে ঘুমাচ্ছে।
সানাউল্লাহ বললেন, ভূতদের জ্বর হয়?
হমড়ু বলল, জ্বর হয়, সর্দিকাশি হয়। যান এক চামচ চিনি নিয়ে আসুন, ক্ষিধে লেগেছে।
সানাউল্লাহ রান্নাঘরের তাকে চিনি খুঁজতে গিয়ে থমকে গেলেন। তিনি এইসব কী করছেন? ভূত আসবে কোত্থেকে? কারোর বাচ্চাছেলে রাগ করে বাসা থেকে পালিয়ে তার ঘরের খাটের নিচে বসে আছে। এই সহজ জিনিসটা না বুঝে তিনি ভূত বিশ্বাস করে বসে আছেন। তিনি পরপর দুবার বললেন, সানাউল্লাহ, তুমি স্টুপিড। তুমি হচ্ছ, এ ভেরি স্টুপিড ম্যান।
তারপরেও তিনি রান্নাঘর থেকে বড় তরকারির চামচভর্তি চিনি নিয়ে ফিরলেন। মানুষের বাচ্চা হোক, ভূতের বাচ্চা হোক, খেতে চেয়েছে খাক।
সানাউল্লাহ চিনি নিয়ে শোবার ঘরে এসে দেখেন খাটের নিচে কেউ নেই। তাহলে একটু আগে যা দেখেছেন সবই ভুল। সানাউল্লাহ এদিক ওদিক তাকিয়ে ডাকলেন, এই এই।
সঙ্গে সঙ্গে খাটের নিচে ছেলেটাকে দেখা গেল। সে হামাগুড়ি দিয়ে বেরু হয়ে 51
কই ছিলি?
এখানেই ছিলাম। মানুষের বেশ ধরে বেশিক্ষণ থাকতে পারি না।
সানাউল্লাহ বললেন, নে চিনি খা।
বাচ্চাটা চিনির চামচ নিয়ে খাচ্ছে। চিনির কিছু দানা মেঝেতে পড়ে গিয়েছিল। সেগুলিও সে তুলে মুখে দিল।
সানাউল্লাহ বললেন, বোনটাকে দে।
ও চিনি খেতে পারে না, শুধু মধু খায়।
সানাউল্লাহ বললেন, সারারাত না খেয়ে থাকবে?
অসুবিধা নাই।
সানাউল্লাহ বললেন, অসুবিধা নাই মানে? ফাজিল ছেলে। ছোটবোন না খেয়ে থাকবে! নিজে তো গবগ করে চিনি খাচ্ছিস। লজ্জা নাই।
এখন করব কী বলুন? সানাউল্লাহ প্যান্ট খুঁজতে লাগলেন। দোকানে যাবেন। মধু পাওয়া যায় কিদেখবেন। এত রাতে দোকান খোলা থাকার কথা না। তারপরেও চেষ্টা তো নিতে হবে। সানাউল্লাহ বললেন, তোর নাম কী যেন বললি, হমডু না?
হমডু।
তোরা এখানে এসেছিস কীভাবে?
মা রেখে গেছে।
সানাউল্লাহ বললেন, তোর মা গেছে কই?
বাবার খোঁজে গেছে। বাবা রাগ করে দেশান্তরী হয়েছে। মা গেছে তাকে খুঁজে আনতে। মা আমাদের বলেছে, তোরা ঐ বাড়িতে থাক। উনি লোক ভালো।
আমার কথা বলল?
হুঁ।
আমাকে চিনল কীভাবে?
আমরা তো আপনার বাসার সামনের কাঁঠাল গাছে থাকতাম। মনে নাই। একদিন পা পিছলে কাঁঠাল গাছের সামনে ধুম করে পড়ে গেলেন। পা কেটে গেল। ঐদিন বাবা আপনাকে পেছন থেকে ধাক্কা দিয়েছিল। আমার বাবা একটু দুষ্টু আছে।
তোর বাবা-মার ঝগড়া কী নিয়ে?
বাবা দুষ্টু যে এই নিয়ে ঝগড়া। মা বলতো, যার আশ্রয়ে থাক তাকে যখন তখন ধাক্কা দিয়ে ফেলে দাও এটা কেমন কথা!
শেষে বাবা রাগ করে বলল, যা দেশান্তরী হব।
তোরা অপেক্ষা কর। দেখি মধু পাই কি-না। এত রাতে দোকান তো সব বন্ধ।
হম বলল, ওষুধের দোকান সারারাত খোলা থাকে। ওষুধের দোকানে মধু পাবেন।
সানাউল্লাহ ভূত ছেলের বুদ্ধি দেখে চমৎকৃত হলেন। ওষুধের দোকানে মধু পাওয়া যায় এটা তার মাথাতেই আসে নি।
তিনি মধু কিনলেন। বাসায় ফিরে মধুর কৌটা খাটের নিচে রেখে চিন্তিত হয়েই ঘুমুতে গেলেন। খাটের নিচে কাউকে দেখা গেল না। সানাউল্লাহ নিশ্চিত, একটু আগে যা দেখেছেন সবই চোখের ভুল। একটা বয়সের পর মানুষ ভুলভাল দেখা শুরু করে। মনে হয় তার সেই বয়স হয়েছে। তিনি কান খাড়া করলেন। খাটের নিচে চকচক শব্দ হচ্ছে। চেটে মধু খাবার শব্দ। তাঁর নিজের খাটের নিচে দুটা ভূতের বাচ্চা বিশ্বাস করা যাচ্ছে না, আবার মধু খাবার চকচক শব্দও অবিশ্বাস করা যাচ্ছে না।
সানাউল্লাহর ঘুম যখন আসি আসি করছে তখন অস্ট্রেলিয়া থেকে তাঁর মেয়ে জাবিন টেলিফোন করল।
বাবা! কয়েকবার তোমাকে টেলিফোন করেছি, তুমি টেলিফোন ধরো নি।
সানাউল্লাহ বললেন, মধু কিনতে গিয়েছিলামরে মা। ভুলে মোবাইল ফেলে গিয়েছিলাম।
তোমার ডায়াবেটিস, তুমি মধু কিনবে কেন?
নিজের জন্যে না-রে মা। ডমরুর জন্যে। সে মধু ছাড়া কিছুই খায় না।
ডমরু কে?
ডমরু হলো হমডুর ছোটবোন।
এরা কারা?
সানাউল্লাহ বললেন, এদের আলাপটা আজকে থাকুক। আরেকদিন করি।
জাবিন বলল, আরেকদিন করতে হবে কেন? আজই কর। এরা কে?
হমড়ু ডমরুর মা কয়েকদিনের জন্যে আমার এখানে এদের রেখে গেছে। পরে নিয়ে যাবে।
বিড়ালের বাচ্চা?
প্রায় সেরকমই।
প্রায় সেরকম বলছ কেন? ঠিক করে বলো তো।
সানাউল্লাহ অস্বস্তির সঙ্গে আমতা আমতা করতে করতে বললেন, ভুতের বাচ্চা।
ভূতের বাচ্চা?
হুঁ।
তুমি ভূতের বাচ্চার জন্যে মধু কিনতে গিয়েছিলে?
হুঁ। মা রাখি, পরে কথা হবে।
না, টেলিফোন রাখবে না। এখনই শুনব। ভূতের বাচ্চা দুটা এই মুহূর্তে কোথায়?
আমার খাটের নিচে আছে।
তুমি ওদের দেখতে পাচ্ছ?
ভাইটাকে দেখতে পাই। বোনটা ছোট, দেখতে পাচ্ছি না। বেচারীর আবার জ্বরও এসেছে।
জাবিন থমথমে গলায় বলল, তুমি কি আজ ঘুমের ওষুধ খেয়েছ?
না।
শোবার আগে একটা ঘুমের ওষুধ খাবার কথা না?
হ্যাঁ।
অজি দুটা ট্যাবলেট খেয়ে আরাম করে ঘুমাবে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই ডাক্তারের কাছে যাবে। থরো চেকআপ করবে। তোমার ঘরে ভূতের বাচ্চা, এই কথাও অবশ্যি ডাক্তারকে জানাবে। মনে থাকবে বাবা?
হ্যাঁ মনে থাকবে।
আমি কাল রাতে আবার টেলিফোন করব। বৰা, গুড নাইট।
গুড নাইট মা।
সানাউল্লাহ মেয়ের কথা মতো দুটা ঘুমের ট্যাবলেট (হিপনল, দশ মিলিগ্রাম) খেলেন। একগ্লাস পানি খেলেন। ঘুমের ওষুধ খাবার সঙ্গে সঙ্গে বিছানায় যেতে নেই। পনেরো বিশ মিনিট অপেক্ষা করতে হয়। তিনি ফ্রিজ থেকে একগ্লাস ঠাণ্ডা পানি এনে বিছানায় বসলেন। চুকচুক করে পানি খাবেন। ঝিমুনি আসার জন্যে অপেক্ষা করবেন। এই ফাঁকে মড়ুর সঙ্গে কিছু গল্পগুজব করা যায়। তবে হড়ু মরুর বিষয়টা পুরোপুরি তার মাথার কল্পনাও হতে পারে। তার আপন ফুপা ফজলু চোখের সামনে কালো রঙের একটা কুকুর দেখতেন। কুকুরটী অন্ধ। তার লেজটা না-কি কাটা। কুকুর দেখামাত্র তিনি আতঙ্কে অস্থির হয়ে পড়তেন। বিকট চিৎকার করতেন, আসছে! আবার আসছে! আমার হাতে একটা লাঠি দে। তাড়াতাড়ি, তাড়াতাড়ি। শেষ পর্যন্ত তাঁর মৃত্যুও হয় কুকুরের ভয়ে। কুকুরটা নাকি তার গলা কামড়ে ধরেছিল। অনেক চেষ্টা করেও তাকে ছাড়াতে পারেন নি। গোঁ গোঁ করতে করতে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মৃত্যু।
সানাউল্লাহ পানির গ্লাসে চুমুক দিয়ে ডাকলেন, হমডু!
হমড়ু সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল, হুঁ।
সানাউল্লাহ বললেন, হুঁ কিরে ব্যাটা? বল জি। ভূতের বাচ্চা বলে আদবকায়দা জানবি না? তোর বোনের জ্বর কমেছে?
না। জ্বর আছে।
মধু খেয়েছে?
হুঁ।
ঠাণ্ডা মেঝেতে শুয়ে জ্বর আবার আসতে পারে। একটা চাদর দেই। চাদরে ঘুমাও।
না।
তোদের ঘুমের ব্যাপারটা কী রকম? তোরাও কি আমাদের মতো রাতে ঘুমাস?
আমরা দিনে ঘুমাই। রাতে জেগে থাকি।
মানুষরা যেমন ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখে তোরা দেখিস?
হঠাৎ হঠাৎ দেখি।
কী রকম স্বপ্ন? ভয়ের না আনন্দের?
ভয়ের।
সানাউল্লাহ বললেন, মানুষ দুঃস্বপ্ন দেখে বদহজম থেকে। খাওয়াদাওয়ার অনিয়ম হলেই দুঃস্বপ্ন। আমার এক ডাক্তার বন্ধু আছেন— আবু করিম। উনি বলেছেন। বড় ডাক্তার। কাল যাব তার কাছে। দেখি তোর বোনের জ্বরের জন্যে কোনো ওষুধ আনা যায় কি-না।
হমড়ু বলল, কে টেলিফোন করেছিল?
সানাউল্লাহ বললেন, আমার মেয়ে জাবিন।
আপনার একটাই মেয়ে?
হুঁ। অস্ট্রেলিয়ায় থাকে।
অনেক দূর?
হুঁ। মেয়ে ডাক্তারি করে, আর মেয়ের জামাই একটা ইনজিনিয়ারিং ফার্মে কাজ করে।
হমডু বলল, ওদের ছেলেমেয়ে নেই?
সানাউল্লাহ বললেন, জাবিন পড়াশোনা করছে তো এইজন্যে বাচ্চা নিচ্ছে না। পড়াশোনা শেষ করেই বাচ্চা নিবে। তখন আমিও চলে যাব। শেষ বয়সে নাতীনাতনীর সঙ্গে থাকা খুবই আনন্দের। জাবিন চেষ্টা করছে আমার যেন ইমিগ্রেশন হয়। কাগজপত্র জমা দিয়েছে।
হমডু বলল, ইমিগ্রেশন কী?
সানাউল্লাহ বললেন, অন্যদেশে থাকার অনুমতি। তোদের তো এই সমস্যা নেই। যখন যেখানে ইচ্ছা চলে যেতে পারিস, তাই না?
হমডু বলল, হুঁ।
সানাউল্লাহ ধমক দিয়ে বললেন, হুঁ কী? বল, জি।
হমডু বলল, জি।
সানাউল্লাহর ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসতে শুরু করেছে। তিনি পানির গ্লাস শেষ করে বালিশে মাথা ছোঁয়াতেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলেন। খাটের নিচে চুকচুক শব্দ হচ্ছে। শব্দটাও শুনতে ভালো লাগছে।