০১. সময় ১৯০৫

উৎসর্গ

মেহের আফরোজ শাওন

পরম করুণাময় ত্ৰিভুবনের শ্রেষ্ঠ উপহার তাকে দিয়েছেন। তার কোলভর্তি নিষাদ নামের কোমল জোছনা। আমার মতো অভাজন তাকে কী দিতে পারে? আমি দিলাম। মধ্যাহ্ন। তার কোলে জোছনা, মাথার উপর মধ্যাহ্ন। খারাপ কী?

ভূমিকা

আমার সর্বকনিষ্ঠ ভ্রাতা তার নিজের লেখালেখির একটা নাম দিয়েছে- ‘আবজাব’। সে যা-ই লেখে তা-ই নাকি আবজাব! আমি আমার লেখার আলাদা কোনো নাম দিতে পারলে খুশি হতাম। যেমন খুশি সাজো’র মতো যেমন খুশি লেখা। আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সে-রকমই। আমি লিখি নিজের খুশিতে। আমার লেখায় সমাজ, রাজনীতি, কাল, মহান বোধ (!) এইসব অতি প্রয়োজনীয় (?) বিষয়গুলি এসেছে কি আসে নি তা নিয়ে কখনো মাথা ঘামাই নি। ইদানীং মনে হয়— আমার কোনো সমস্যা হয়েছে। হয়তোবা ব্রেনের কোথাও শর্ট সার্কিট হয়েছে। যে-কোনো লেখায় হাত দিলেই মনে হয়- চেষ্টা করে দেখি সময়টাকে ধরা যায় কি-না। মধ্যাহেও একই ব্যাপার হয়েছে। ১৯০৫ সনে কাহিনী শুরু করে এগুতে চেষ্টা করেছি। পাঠকরা চমকে উঠবেন না। আমি ইতিহাসের বই লিখছি না। গল্পকার হিসেবে গল্পই বলছি। তারপরেও…

হুমায়ূন আহমেদ
নুহাশপল্লী, গাজীপুর

০১.

হরিচরণ সাহা তার পাকাবাড়ির পেছনে পুকুরঘাটে বসে আছেন।

তাঁর বয়স পঞ্চাশ। শরীর শক্ত। গড়পড়তা মানুষের তুলনায় বেশ লম্বা বলেই হাঁটার সময় কিংবা বসে থাকার সময় ঝুকে বসেন। তাঁকে তখন ধনুকের মতো দেখায়। তার মাথাভর্তি ধবধবে শাদা চুল। হঠাৎ হঠাৎ তিনি চুলে কলপ দেন, তখন তাকে যুবাপুরুষের মতো দেখায়। তার পরনে শান্তিপুরী ধুতি। গরমের কারণে ধুতি লুঙ্গির মতো পরেছেন। খালি গা। তাঁর গাত্ৰবৰ্ণ শ্যামলা। আজ কোনো এক বিচিত্র কারণে তাকে ফর্সা দেখাচ্ছে।

সকাল দশটার মতো বাজে। এই সময়ে হরিচরণ সোহাগগঞ্জ বাজারে তার পাটের আড়তে বসেন। বাজারে তার তিনটা ঘর আছে। পাটের আড়াতের ঘর। তুলনামূলকভাবে ছোট। এই ঘরের গদিতে বসতেই তাঁর ভালো লাগে। এখান থেকে নদীর একটা অংশ দেখা যায়। নদীর নাম বড়গাঙ। বর্ষায় এই নদী কানায় কানায় পূর্ণ থাকে। বড় বড় লঞ্চ নিয়মিত আনাগোনা করে। তারা কারণে অকারণে ‘ভো’ বাজায়। সেই শব্দ শুনতেও তার ভালো লাগে। আজ বাজারে যাচ্ছেন না, কারণ তার মন সামান্য বিক্ষিপ্ত। পুকুরঘাটে কিছুক্ষণ বসে থাকলে মন শান্ত হবে- এই আশায় তিনি বসে আছেন। ঘাট বাধানো। তিনি নিজেই গৌরীপুর থেকে কারিগর। এনে ঘাট বাঁধিয়েছেন। কারিগরের কাজ তাঁর পছন্দ হয়েছে। ঘাটের ধাপ সে যথেষ্ট পরিমাণে চওড়া করেছে। ভদ্রমাসের গরমে অতিষ্ঠ হলে তিনি এই ঘাটে এসে শুয়ে থাকেন। ঠাণ্ডা পাথরের স্পর্শ বড় ভালো লাগে। পাথরের গা থেকে এক ধরনের গন্ধ এসে তার নাকে লাগে। পাথরের কোনো গন্ধ থাকে না, কিন্তু এই গন্ধ কীভাবে আসে? বিষয়টা নিয়ে তিনি মাঝে মাঝে চিন্তাও করেন।

এখন আষাঢ় মাসের শুরু। গতরাতে বিরামহীন বৃষ্টি পড়েছে বলে আজ আবহাওয়া শীতল। আষাঢ় মাসের কড়া রোদ অবশ্যি আছে। সেই রোদ তাকে স্পর্শ করছে না। ঘাটের সঙ্গে লাগোয়া বাদাম গাছ তাকে ছায়া দিয়ে আছে। এই গাছের পাতা কাঠগোলাপের পাতার মতো ছায়াদায়িনী।

হরিচরণের মনের বিক্ষিপ্ত ভাব কমল না, বরং বাড়ল। এই সঙ্গে তার সামান্য শ্বাসকষ্ট শুরু হলো। শ্বাসকষ্টের উপসর্গ কিছুদিন হলো শুরু হয়েছে। মন-মেজাজ ঠিক না থাকলেই শ্বাসকষ্ট হয়। ঘুমের অসুবিধা হলে শ্বাসকষ্ট হয়। কালরাতে তাঁর ঘুমের কোনো অসুবিধা হয় নি। সারারাত টিনের চালে বৃষ্টি পড়েছে। শীত শীত ভাব ছিল। তিনি পাতলা সুজনি দিয়ে নিজেকে ঢেকে রেখে সুখনিদ্রায় গেছেন। তবে ঘুমের কোনো এক পর্যায়ে অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখেছেন। স্বপ্নটাই তার মন বিক্ষিপ্ত হবার একমাত্র কারণ।

স্বপ্নে তিনি চার-পাঁচ বছর বয়সি একটি শিশুকে কোলে নিয়ে ঘুরছেন। শিশুর মাথায় সোনার মুকুট। তার গাত্রবর্ণ ঘন নীল। স্বপ্নে তার কাছে মনে হলো, শিশুটি তারই সন্তান। আবার এও মনে হলো, এই শিশু শ্ৰীকৃষ্ণ। তাঁর নিজের সন্তান শ্ৰীকৃষ্ণ হতে পারে না— স্বপ্নে এটা মনে হলো না। কোলের শিশুটি একসময় বলল, ব্যথা। তিনি বললেন, কোথায় ব্যথা? সে তার হাত দেখাল। হাতটা কনুইয়ের কাছে কাটা, সেখান থেকে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছে। রক্তের রঙও নীল। তিনি রক্ত বন্ধ করার জন্যে খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তখন ঘুম ভাঙল। তাঁর বিস্ময়ের সীমা রইল না। হরিচরণের কোনো ছেলেমেয়ে নেই। প্রথম যৌবনে একটা মেয়ে হয়েছিল। তিন বছর বয়সে মেয়েটা দিঘিতে ড়ুবে মারা যায়। পুরোহিতের কী এক বিধানে মেয়েটাকে দাহ করা হয় নি। মুসলমানদের মতো কবর দেয়া হয়েছে। যেখানে কবর দেয়া হয়েছে সেখানে তিনি একটা শিউলি গাছ লাগিয়েছিলেন। সেই গাছ আজ এক মহীরুহ। এই অঞ্চলে এত বড় শিউলি গাছ আছে বলে তিনি জানেন না। তার মেয়ের নামও ছিল শিউলি। এই গাছ বৎসরের পর বৎসর হলুদ বেঁটার শাদা ফুল ফুটিয়েই যাচ্ছে।

প্রথম সন্তানের মৃত্যুর পর দীর্ঘদিন কোনো সন্তানাদি না হওয়ায় তিনি আরেকটি বিবাহ করেন। সেই ঘরেও কোনো সন্তান হয় নি। হরিচরণের দুই স্ত্রীই গত হয়েছেন। তাঁর বিশাল পাকাবাড়ি এখন শূন্য। পাকাবাড়িতে তিনি এখন বাসও করেন না। পাকাবাড়ির দক্ষিণে টিনের দোচালা বানিয়েছেন। টিনের ঘর রাতে দ্রুত শীতল হয়, ঘুমাতে আরাম। বর্ষায় টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ হয়। সেই শব্দ তার কানে আরাম দেয়।

অম্বিকা ভট্টাচাৰ্যকে আসতে দেখা যাচ্ছে। হরিচরণ স্বপ্ন বিষয়ে তার সঙ্গে আলাপ করতে চান বলে খবর দিয়েছেন। অম্বিকা ভট্টাচার্য এই অঞ্চলের একমাত্র ব্ৰাহ্মণ। শাস্ত্ৰ জানেন। পূজাপাঠ করেন। তাঁর বয়স হরিচরণের চেয়ে কম হলেও তিনি বুড়িয়ে গেছেন। শরীর থলথলে হয়েছে। হাঁটেন কুজো হয়ে লাঠিতে ভর দিয়ে। তাঁর বাড়ি হরিচরণের বাড়ি থেকে খুব দূরে না, দশ-বারো মিনিটের পথ। এই পথ পাড়ি দিয়েই তিনি ক্লান্ত । ঘাটের পাশে তাঁর জন্যে রাখা কাঠের চেয়ারে বসতে বসতে তিনি বললেন, আগে জল খাওয়াও, তারপর কথা।

জলের সঙ্গে কিছু মিষ্টান্ন দিব?

অবশ্যই। মিষ্টান্ন বিনা জলপান নিষেধ, জানো না? সামান্য গুড় হলেও মুখে দিতে হয়। তবে ফল নাস্তি। জলপানের পরে ফল খাওয়া যাবে না।

অম্বিকা ভট্টাচার্য মুখ গভীর করে হরিচরণের স্বপ্নবৃত্তান্ত শুনলেন। কিছু সময় চুপ করে থেকে বললেন, স্বপ্নটা ভালো না।

হরিচরণ বললেন, ভালো না কেন?

অম্বিকা ভট্টাচার্য বললেন, উঁচু বংশের কেউ যদি দেবদেবী কোলে নেয়া দেখে, তাহলে তার জন্যে উত্তম। সৌভাগ্য এবং রাজানুগ্রহ। নিম্নবংশীয় কেউ দেখলে তার জন্যে দুৰ্ভাগ্য। সে হবে অপমানিত। রাজরোষের শিকার। তার ভাগ্যে অর্থনাশের যোগও আছে।

বলেন কী!

শাস্ত্ৰমতে ব্যাখ্যা করলাম। তোমার পছন্দ না হলেও কিছু করার নাই। যাহা সত্য তাহা সত্য। তাছাড়া তুমি দেবগাত্রে রক্তপাত দেখেছ, এর অর্থ আরো খারাপ।

কী খারাপ?

রক্তপাত হয় এমন কোনো রোগ-ব্যাধি তোমার হতে পারে। যেমন ধর, যক্ষ্মা। শান্তি সস্থায়নের ব্যবস্থা কর। বিপদনাশিনী পূজার ব্যবস্থা কর। অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর।

হরিচরণ বিস্মিত হয়ে বললেন, আমি কী অপরাধ করলাম?

অম্বিকা বললেন, দেবতা শ্ৰীকৃষ্ণকে কোলে নিয়ে ঘুরেছ, এটাই অপরাধ। অপরাধ দুই প্রকার। জ্ঞান অপরাধ, অজ্ঞান অপরাধ। তুমি করেছ অজ্ঞান অপরাধ।

ও আচ্ছা।

অম্বিকা ভট্টাচাৰ্য উঠে দাঁড়াতে দাড়াতে বললেন, পূজা কবে করতে চাও আমাকে জানাবে। যত শীঘ্ৰ হয় তত ভালো। আগামী বুধবার ভালো দিন আছে। চাঁদের নবমী।

হরিচরণ বললেন, পূজা বুধবারেই করবেন। খরচপাতি যেরকম বলবেন সেরকম করব।

ভালো। ঐদিন তুমি উপবাস করবে। নিরন্তু উপবাস। জলপানও করবে না। সন্ধ্যাবেলা পূজা হবে। পূজার পর উপবাস ভঙ্গ করবে।

হরিচরণ হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন।

বেলা বেড়েছে। সকালে আকাশ মেঘমুক্ত ছিল। এখন মেঘ করতে শুরু করছে। দিঘির পানি এতক্ষণ নীল ছিল, এখন কালচে দেখাচ্ছে। বড় কোনো মাছ ঘাই দিল। হরিচরণ কৌতূহলী হয়ে তাকালেন। পুকুরে অনেক বড় বড় মাছ আছে। হরিচরণের বর্শি বাইবার শখ আছে। অনেকদিন বর্শি নিয়ে বসা হয় না। আজ কি বসবেন? মুকুন্দ ঘরেই আছে। তাকে বললেই সে নিমিষের মধ্যে চাড় ফেলার ব্যবস্থা করবে। পিঁপড়ার ডিম এনে দিবে। পিপড়ার ডিম বড় মাছের ভালো আধার। হরিচরণের মনে হলো, হুইল বর্শি নিয়ে বসলেই স্বপ্নটা মাথা থেকে দূর হবে। স্বপ্ন নিয়ে এত অস্থির হবার কিছু নাই। স্বপ্ন অস্থির মস্তিষ্কের ফসল। অস্থিরমতিরাই স্বপ্ন দেখে। আলস্য অস্থিরতা তৈরি করে। বর্শি বাওয়াও এক ধরনের আলস্য, তারপরেও দৃষ্টি কাজে ব্যস্ত থাকে। ফাৎনার দিকে তাকিয়ে থাকাও এক ধরনের কাজ। মুকুন্দকে ডাকতে গিয়ে হঠাৎ তাঁর দৃষ্টি আটকে গেল। চার-পাঁচ বছর বয়সি একটা ছেলে পেয়ারা বাগানে একা হাঁটাহাঁটি করছে। ছেলেটা তার দিকে পেছন ফিরে আছে বলে তিনি তার মুখ দেখতে পাচ্ছেন না।

ছেলেটার গাত্ৰবৰ্ণ গৌর। খালি গা। পরনে লালরঙের। হাফপ্যান্ট। ঘন সবুজের ভেতর তা লালপ্যান্ট ঝকমক করছে। তিনি ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থেকেই উঁচু গলায় মুকুন্দকে ডাকলেন। ছেলেটা চট করে তাঁর দিকে তাকাল। তিনি মোহিত হয়ে গেলেন। কী সুন্দর চেহারা! বড় বড় চোখ। চোখভর্তি মায়া। খাড়া নাক। চোখের ঘন পল্লব এতদূর থেকেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তিনি হাত ইশারায় ছেলেটাকে ডাকলেন। সে কিছুক্ষণ ইতস্তত করে পায়ে পায়ে আসতে লাগল। তবে পাশে এসে দাঁড়াল না। একটু দূরে জামগাছের নিচে থমকে দাঁড়াল।

মুকুন্দ তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তিনি মুকুন্দকে বললেন, বর্শি বাইব, ব্যবস্থা কর।

মুকুন্দ বলল, জে আজ্ঞে।

এই ছেলেটা কে?

সুলেমানের পুলা।

মুসলমান?

জে আজ্ঞে।

সুলেমানটা কে?

কাঠমিস্ত্রি। আপনের ঘরের দরজা সারাই করল।

ছেলেটা তো দেখতে রাজপুত্রের মতো!

ছেলে হইছে মায়ের মতো। মায়ের রূপ দেখার মতো। বেশি রূপ হইলে যা হয়। জিনে ধরা। জংলায় মংলায় একলা ঘুরে। গীত গায়। আমরার বাগানে মেলা দিন আসছে।

আমি তো দেখি নাই।

জিনে ধরা মেয়ে। চউক্ষের পলকে সাইরা যায়। দেখবেন ক্যামনে।

ঠিক আছে তুমি যাও। পিঁপড়ার ডিম আর কী কী লাগে ব্যবস্থা কর। পুকুরে চাড় ফেল। সারারাত বৃষ্টি হয়েছে, মাছ আধার খাবে না। বৃষ্টি হলেই মাছ আধার খাওয়া বন্ধ করে। কী কারণ কে জানে।

মুকুন্দ দ্রুত চলে গেল। হরিচরণ আবার তাকালেন ছেলেটার দিকে। মাটি থেকে কী যেন কুড়িয়ে মুখে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে কালোজাম। কিন্তু জােম এখনো পাকে নি। গাছের নিচে পাকা জাম পড়ে থাকার কথা না। হরিচরণ এইবার গলা উচিয়ে ছেলেটাকে ডাকলেন, খোকা, এদিকে আস।

ছেলেটা ছোট ছোট পা ফেলে আসছে। দূর থেকে তাকে যতটা সুন্দর মনে হচ্ছিল এখন তার চেয়েও সুন্দর লাগছে। তার কপালের একপাশে কাজলের ফোঁটা। তার মা নজর না লাগার ব্যবস্থা করেছেন। ঠিকই করেছেন। নজর লাগার মতোই ছেলে। বয়স কত হবে?

কী নাম তোমার?

ছেলে জবাব দিল না।

নাম বলবে না?

সে না-সূচক মাথা নাড়ল।

কী খাচ্ছ?

ছেলে হা করে তার মুখ দেখাল। মুখের ভেতর জামের লাল একটা বিচি। তিনি বললেন, সন্দেশ খাবে?

ছেলেটা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। তিনি ডাকলেন, মুকুন্দ! মুকুন্দ!

মুকুন্দ আশেপাশে নেই। সে পিপড়ার ডিমের সন্ধানে চলে গেছে। পাকা বাড়িতে বৃদ্ধা মায়ালতা থাকেন। হরিচরণের দূরসম্পর্কের বিধবা জেঠি। তিনি কানে শোনেন না। শুনলেও ঘর থেকে বের হবেন না। রান্নার জন্যে একজন ঠাকুর আছে। সে বাজারে গেছে মাছের সন্ধানে। হরিচরণ বললেন, তুমি এখানে দাঁড়িয়ে থাক। কোথাও যাবে না। আমি সন্দেশ নিয়ে আসছি।

ছেলেটা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। হরিচরণের প্রচণ্ড ইচ্ছা করছে ছেলেটাকে কোলে নিতে। কোলে নেবার জন্যে সময়টা ভালো। আশেপাশে কেউ নেই। কেউ দেখে ফেলবে না। তিনি এক মুসলমান কাঠমিস্ত্রির ছেলে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন— এই দৃশ্য হাস্যকর। ধর্মেও নিশ্চয়ই বাধা আছে। যবনপুত্ৰ অস্পৃশ্য হবার কথা। ব্ৰাহ্মণ, ক্ষত্ৰিয়,বৈশ্য, শূদ্ৰ। শূদ্রের নিচে যবনের অবস্থান।

হরিচরণ সন্দেশ এবং এক গ্রাস পানি হাতে ফিরলেন। ছেলেটা যেখানে দাড়িয়ে থাকার কথা সেখানে নেই। জামতলাতেও নেই। পেয়ারা বাগানেও নেই। দিঘির পানিতে ড়ুবে যায় নি তো? তাঁর বুক ধ্বক করে উঠল। তিনি দিঘির দিকে তাকালেন। দিঘির জল শান্ত। সবুজ শ্যাওলার যে চাদর দিঘি। জুড়ে ছড়িয়ে আছে সে চাদরে কোনো ভাঙচুর নেই।

ছেলেটার নাম জানা থাকলে তাকে নাম ধরে ডাকা যেত। তিনি নাম জানেন না। এই কাজটা ভুল হয়েছে। দুটা পিঁপড়া যখন মুখোমুখি হয় তখন তারা কিছুক্ষণ আলাপ আলোচনা করে। বেশিরভাগ সময়ই মানুষরা এই কাজ করে না। একজন আরেকজনকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। তিনি পেয়ারা বাগানের দিকে গেলেন। পেয়ারা বাগানের পরই ঘন বেতবোপ। ছেলেটা বেতঝোপের ওপাশে যায় নি তো?

সেখানেও তাকে পাওয়া গেল না। আকাশের মেঘ ঘন হয়েছে। যে-কোনো মুহুর্তে বৃষ্টি নামবে। হরিচরণ ঘাটের কাছে ফিরে গেলেন। তার হাতে সন্দেশ। সন্দেশ থেকে অতি মিষ্টি গন্ধ আসছে। দারুচিনির গন্ধ না-কি? সন্দেশে গরম মসল্লা দেয়া নিষেধ। দেবীর ভোগে সন্দেশ দেয়া হয়। সেই সন্দেশ বিশুদ্ধ হতে হয়। এলাচ দারুচিনি দিয়ে বিশুদ্ধতা নষ্ট করা যায় না। তাহলে গন্ধটা কিসের? দুধের গন্ধ? ঘন দুধের কি আলাদা গন্ধ আছে?

বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আষাঢ় মাসের বড় বড় ফোঁটার বৃষ্টি। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁকে ভিজিয়ে দেবে। দৌড়ে ঘরে যেতে ইচ্ছা করছে না। তিনি বৃষ্টিতে ভিজছেন। এই বয়সে বৃষ্টিতে ভেজার ফল শুভ হবে না। তারপরেও তিনি ঘাট ছাড়তে পারলেন না। তার কাছে মনে হলো, কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখবেন ছেলেটা ভিজতে ভিজতে আসছে।

মুকুন্দ কলাপাতার ঠোঙ্গায় পিপড়ার ডিম নিয়ে এসেছে। সে অবাক হয়ে বলল, বিষ্টিত ভিজেন? অসুখ বাধাইবেন। ঘরে যান।

হরিচরণ বললেন, যাব একটু পরে। তুমি সন্দেশ দুটা ঐ ছেলেটারে দিয়া আসি।

কোন ছেলে?

কাঠমিস্ত্রির ছেলে। আজ আর বর্শি নিয়ে বসব না।

মুকুন্দ অনিচ্ছার সঙ্গে যাচ্ছে। ভিজতে ভিজতে যাচ্ছে। তার এক হাতে পিপড়ার ডিম অন্য হাতে সন্দেশ। মাছ ও মানুষের খাদ্য। হরিচরণ হঠাৎ ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললেন, ডিমগুলির জন্যে তার খারাপ লাগছে। এই ডিম থেকে আর কোনোদিন পিঁপড়ার জন্ম হবে না। তারা পৃথিবীর অতি আশ্চর্য রূপ-রস-গন্ধের কিছুই জানবে না। বড়ই আফসোসের কথা। তিনি কি মুকুন্দকে বলবেন ডিমগুলি যেখান থেকে এনেছে সেখানে ফিরিয়ে দিয়ে আসতে? হয়তো এখনো সময় আছে। জায়গামতো পৌঁছে দিলে কিছু ডিম থেকে পিঁপড়া জন্মাবে।

মুকুন্দ অনেকদূর চলে গেছে, এখন ডাকলে সে শুনতে পাবে না। তবু তিনি ডাকলেন, মুকুন্দ! মুকুন্দ!

মুকুন্দ শুনতে পেল না। কিন্তু কেউ একজন হাসল। হরিচরণ চমকে হাসির শব্দ যেদিক থেকে আসছে সেদিকে তাকালেন। কী আশ্চর্য, লাল প্যান্ট পরা ছেলেটা। সে দিঘির অন্যপ্রান্তে। পাড় বেয়ে পানির দিকে নামছে। বৃষ্টির পানিতে দিঘির পাড় পিচ্ছিল হয়ে আছে। ছেলেটা কি একটা দুর্ঘটনা ঘটাবে? পা পিছলে। পানিতে পড়ে যাবে? তিনি ডাকলেন, এই, এই— উঠে আস। উঠে আস বললাম। এই ছেলে, এই!

ছেলেটা তাঁকে দেখল। কিন্তু তার দৃষ্টি দিঘির সবুজ পানিতে। তার হাতে কাদামাখা পেয়ারা। সে পেয়ারা পানিতে ধুবে। তিনি উঁচু গলায় আবারো ডাকলেন, এই ছেলে- এই। তখনি ঝাঁপ করে শব্দ হলো। কিছুক্ষণ ছেলেটির হাত পানির উপর দেখা গেল। তারপরেই সেই হাত তলিয়ে গেল। হরিচরণ পুকুরে ঝাঁপ দিলেন।

হরিচরণ কীভাবে দিঘির অন্যপ্রান্তে পৌঁছলেন, কীভাবে ছেলেটাকে পানি থেকে তুললেন তা তিনি জানেন না। শুধু এইটুকু জানেন- পানি থেকে তোলার পর দেখা গেল, ছেলেটার ডানহাত অনেকখানি কেটেছে। সেখান থেকে গলগল করে রক্ত পড়ছে। স্বপ্নে শ্ৰীকৃষ্ণের হাত কেটে এইভাবেই রক্ত পড়ছিল। তিনি বিড়বিড় করে বললেন, ও বাবু! বেঁচে আছিস তো! বলেই পুকুরপাড়ে জ্ঞান হারালেন।

তাঁর জ্ঞান ফিরল নিজের খাটে গভীর রাতে। তাঁর চারপাশে মানুষজন ভিড় করেছে। নেত্রকোনা সদর থেকে এলএমএফ ডাক্তার সতীশ বাবু এসেছেন। তিনি বুকে স্টেথিসকোপ ধরে আছেন। পাশের ঘর থেকে বৃদ্ধা মায়ালতার কান্না শোনা যাচ্ছে। বৃদ্ধ কারণে অকারণে কঁদে। হরিচরণ বললেন, ছেলেটা কি বেঁচে আছে?

মুকুন্দ বলল, বেঁচে আছে।

ছেলেটার নাম কী?

জহির।

জহির তাহলে বেঁচে গেছে?

জে আজ্ঞে।

হরিচরণ বললেন, ঠাকুরঘরের তালা খোল। ঘরে বাতি দাও। ঠাকুরঘরে যাব।

মুকুন্দ বিনীতভাবে বলল, সকালে যান। এখন শুয়ে থাকেন। আপনার শরীর অত্যধিক খারাপ।

ঠাকুরঘরের তালা খোল।

গভীর রাতে ঠাকুরঘরের দরজা খোলা হলো। প্ৰদীপ জ্বালানো হলো। ছোট্ট ঘর। শ্বেতপাথরের জলচৌকিতে কষ্টিপাথরের রাধা-কৃষ্ণ। কৃষ্ণ বাঁশি ধরে আছেন। তাঁর কাধে মাথা রেখে লীলাময় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন শ্ৰী রাধিকা।

হরিচরণ পদ্মাসন হয়ে বসলেন। মুকুন্দকে বললেন, ছেলেটাকে নিয়ে আস, আমি একটু দেখব।

ঠাকুরঘরে নিয়ে আসব? কী বলেন এইসব!

হ্যাঁ, ঠাকুরঘরে নিয়ে আসা। সে আমার কোলে বসবে।

মুসলমান ছেলে তো!

হোক মুসলমান ছেলে।

জহিরের মা জহিরকে কোলে নিয়ে এসেছে। সে তার সবুজ শাড়ি দিয়ে ছেলেকে ঢেকে রেখেছে। তার চোখে উদ্বেগ। বাড়িতে এত লোকজন দেখে হ’কচাকিয়ে গেছে। হরিচরণ উঠানের জলচৌকিতে বসেছেন। তাঁর নিঃশ্বাসে কষ্ট হচ্ছে। শরীর ঘামিছে। তিনি জহিরের মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, মাগো! আপনার ছেলে কি ভালো আছে?

জহিরের মা জবাব না দিয়ে ছেলেকে আরো ভালো করে শাড়ি দিয়ে ঢাকল। হরিচরণ বললেন, আমার এখানে ডাক্তার আছে। ছেলেকে দেন, ডাক্তার দেখুক।

আমার ছেলে ভালো আছে।

হরিচরণ মেয়েটির কণ্ঠস্বর শুনেও মুগ্ধ হলেন। কী সুরেলা কণ্ঠ! ঈশ্বর যার প্রতি করুণা করেন। সর্ব বিষয়েই করেন। মেয়েটি খালি পায়ে উঠানে দাড়িয়ে আছে। হরিচরণের মনে হলো, মেয়েটির পায়ের কারণেই উঠান ঝলমল করছে। এত রূপবতী কেউ কি এর আগে উঠানে এসে দাঁড়িয়েছে?

মাগো! আপনার ছেলেকে আমার কোলে দেন। আপনার ছেলে কোলে নিয়ে আমি একটা প্রার্থনা করব।

হরিচরণ ঠাকুরঘরে বসে আছেন। তাঁর কোলে জহির। জহির ঘুমাচ্ছে। শান্তির ঘুম। হরিচরণ হাতজোড় করে বললেন, হে পরম পিতা। হে দয়াময়। আজ রাতে আমি তোমার কাছে একটা প্রতিজ্ঞা করতে চাই। আমি আমার এক জীবনে যা উপার্জন করেছি, সবই জনহিতকর কার্যে দান করব। আমি যেন আমার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে পারি এইটুকু শুধু তুমি দেখবে। আমি পৃথিবীতে নগ্ন অবস্থায় এসেছিলাম, পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় বিদায় নিব।

হরিচরণের চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল।

পরদিন সকালেই একটি মুসলমান ছেলেকে ঠাকুরঘরে প্রবেশ করানোর অপরাধে হরিচরণকে সমাজচ্যুত করা হলো। সোনাদিয়ার জমিদার শশাংক পালের বৈঠকখানায় সমাজপতিদের বৈঠক বসল। বৈঠকের প্রধান বক্তা ন্যায়রত্ন রামনিধি চট্টোপাধ্যায়। তিনি শাস্ত্ৰ ভালো জানেন। তাঁকে আনা হয়েছে শ্যামগঞ্জ থেকে। শশাংক পাল ঘোড়া পাঠিয়ে আনিয়েছেন। ধর্মবিষয়ক অনাচার তিনি নিতেই পারেন না। ন্যায়রত্ন রামনিধি চট্টোপাধ্যায় কঠিন কঠিন কথা বললেন। মহাভারতের কিছু কাহিনীও বললেন যার সঙ্গে হরিচরণের সমস্যার কোনো সম্পর্কই নেই। সুশোভনার গর্ভে পরিক্ষীতের তিন পুত্ৰ— শল, দল এবং বলের গল্প। শল রাজা হয়েছেন, তিনি ব্ৰাহ্মণ বামদেবের কাছ থেকে দুই ঘোড়া ধার হিসেবে নিয়ে এসেছেন। হরিণ শিকারের জন্যে। হরিণ শিকার হলো কিন্তু রাজা শল দুই ঘোড়া ফেরত পাঠালেন না। বামদেব যখন ঘোড়া ফেরত চাইলেন, তখন রাজা শল বললেন, আপনার ঘোড়ার প্রয়োজন কী? বেদই তো আপনার বাহন।

গল্প শেষ করে ন্যায়রত্ন কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ রেখে চোখ খুলে বললেন, হরিচরণের সর্বনিম্ন শাস্তি সমাজচ্যুতি।

অম্বিকা ভট্টাচাৰ্য ক্ষীণস্বরে প্রায়শ্চিত্যের কথা বলে ধমক খেলেন।

ন্যায়রত্ব বিরক্ত গলায় বললেন, তুমি পূজারি বামুন শাস্ত্ৰ জানো না বলে প্ৰায়শ্চিত্যের কথা বললা। ঠাকুরঘর যে অপবিত্র করেছে তার আবার প্রায়শ্চিত্য কী?

অম্বিকা ভট্টাচার্য বললেন, ঠিক ঠিক। এই বিষয়টা মাথায় ছিল না।

ন্যায়রত্ন রামনিধি বললেন,

কালী করালী চ মনোজবা চ
সুলোহিতা যা চ সুব্ধূমাবর্ণ।
স্ফুলিঙ্গিনী বিশ্বরুচি চি দেবী
লেলায়মানা ইতি সপ্তজিহবাঃ।

অম্বিকা ভট্টাচাৰ্য আবারো বললেন, ঠিক ঠিক।

ন্যায়রত্ন রামনিধি বললেন, ব্যাখ্যা করব?

অম্বিকা ভট্টাচার্য বললেন, আমি প্রয়োজন দেখি না। বিধান শুধু বলে দেন।

ন্যায়রত্ন রামনিধি বললেন, বিধান আগে একবার বলেছি। আরেকবার বলি। বিধান হলো, হরিচরণ সমাজচ্যুত। হরিচরণের সঙ্গে যারা বাস করে তারাও সমাজচ্যুত। তবে তাদের জন্যে প্ৰায়শ্চিত্যের সুযোগ আছে। তারা টাটকা গোবর ভক্ষণ করে এবং সাধ্যমতো দান করে শুদ্ধ হতে পারে। অন্যথায় তাদের সবার জন্য ধোপা-নাপিত বন্ধ। সামাজিক আচার বন্ধ।

হরিচরণ হতাশ চোখে তাকিয়ে আছেন। হরিচরণের পেছনে হাতজোড় করে মুকন্দি দাঁড়িয়ে আছে। সে সামান্য কাঁপছে। তার চোখ ভেজা। মুকন্দের শব্দ করে কাদার ইচ্ছা। সে ভয়ে কাঁদতে পারছে না। ন্যায়রত্ন বললেন, হরিচরণ, তুমি কিছু বলতে চাও?

হরিচরণ না-সূচক মাথা নাড়লেন।

অম্বিকা ভট্টাচার্য বললেন, হরিচরণের ঘরে রাধা-কৃষ্ণ আছে। ঠাকুর পূজা হয়। এর কী বিধান?

ন্যায়রত্ন বললেন, মূর্তি সরিয়ে নিতে হবে। গাভী যদি থাকে গাভী নিয়ে নিতে হবে। সে গাভী সেবা করতে পারবে না।

হরিচরণ বললেন, অন্য জাতের মানুষও গাভী পালন করে। আমার জাত গিয়েছে, আমি গাভী পালন করতে পারব না কেন?

শশাংক পাল হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বললেন, ভালো যুক্তি। অতি উত্তম যুক্তি।

ন্যায়রত্ন বললেন, ধর্ম যুক্তিতে চলে না। ধর্ম চলে বিশ্বাসে। ধর্মের সপ্ত বাহনের এক বাহন বিশ্বাস।

শশাংক পাল বললেন, এইটাও ভালো যুক্তি।

ন্যায়রত্ন বললেন, ধর্ম থেকে যে পতিত তার স্থান পাতালের রসাতলে। পাতালের সাত স্তর, যেমন— অতল, বিতল, সুতল, তলাতল, মহাতল, রসাতল ও পাতাল। রসাতল হলো পাতালের ষষ্ঠ তল। এই তলে যে পতিত, তার গতি নাই।

হরিচরণ বললেন, পাতালের সপ্তম তলে কার স্থান?

মাতৃহন্তার স্থান। যাই হোক, তোমার সঙ্গে শাস্ত্ৰ আলোচনায় আমি যাব না। আমার বিধান আমি দিলাম। তুমি ধন্যবান ব্যক্তি। প্রয়োজনে কাশি থেকে নতুন বিধান নিয়া আসতে পার।

হরিচরণ বললেন, আমি কোনো বিধান আনিব না। আপনার বিধান শিরোধার্য।

শশাংক পাল ইকোয় লম্বা টান দিয়ে বললেন, যাগযজ্ঞ করে কিছু করা যায় না? সপ্তাহব্যাপী যাগযজ্ঞ, নাম সংকীর্তন। হরিচরণ বিত্তবান। সে পারবে।

ন্যায়রত্ন কঠিন গলায় বললেন, না। এই বিষয়ে বাক্যালাপে সময় নষ্ট করা অর্থহীন।

শশাংক পাল বললেন, এটাও ঠিক কথা। তুচ্ছ বিষয়ে সময় হরণ।

 

হরিচরণ জাতিচ্যুত হলেন সকালে। দুপুরের মধ্যে তাঁর ঘর জনশূন্য হয়ে গেল। মুকন্দ চোখের জল ফেলতে ফেলতে বিদায় হলো। তাকে তিনি দুটো দুধের গাই দিয়ে দিলেন। রান্নাবান্নার জন্যে যে মৈথিলি ঠাকুর ছিল, সে চুলা ভেঙে চলে গেল। নিয়ম রক্ষা করল। পতিতজনের ঘরের চুলা ভেঙে দেয়া নিয়ম। যেকোনো একটা ঘরের চালাও তুলে ফেলতে হয়। আত্মীয়স্বজনরা সেই চালা মাড়িয়ে চলে যাবে। হরিচরণের আত্মীয়স্বজন কেউ নেই বলে চালা ভাঙা হলো না।

বৃদ্ধা মায়ালতাকে সন্ধ্যার মধ্যে তিনি নৌকায় কাশি পাঠাবার ব্যবস্থা করলেন। মায়ালতা সঙ্গে করে কষ্টিপাথরের রাধাকৃষ্ণ মূর্তি নিয়ে গেলেন। বিদায়ের সময় হরিচরণ জেঠিমা’কে শেষ প্ৰণাম করতে গেলেন। মায়ালতা আঁৎকে উঠে বললেন, খবরদার পায়ে হাত দিবি না। তুই ড়ুবছস, আমারে ড়ুবাইস না। মায়ালতার বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে হরিচরণের বিশাল বাড়ি হঠাৎ খালি হয়ে গেল।

সন্ধ্যা মিলাতে না মিলাতেই বৃষ্টি শুরু হলো। বৃষ্টির সঙ্গে দমকা বাতাস। হরিচরণ পাকা দালানের একপাশে বেতের ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে বৃষ্টি দেখছেন। তামাক খেতে ইচ্ছা করছে, তামাক সাজাবার কেউ নেই। তামাক নিজেকেই সাজাতে হবে। ঘর অন্ধকার। সন্ধ্যার বাতি জ্বালানো প্রয়োজন। কোথায় হারিকেন কোথায় কেরোসিন তিনি কিছুই জানেন না।

বাড়ির পেছনে ছপছপ শব্দ হচ্ছে। ভূত-প্ৰেত কি-না কে বলবে! ভূতপ্ৰেতরা শূন্যবাড়ির দখল নিয়ে নেয়— এমন জনশ্রুতি আছে। হাসনাহেনার ঝোপের কাছে সরসর শব্দ হচ্ছে। সাপ বের হয়েছে না-কি? শূন্যবাড়িতে ভূত প্রেতের সঙ্গে সাপও ঢোকে। বাড়ি পুরোপুরি জনশূন্য হলে আসে বাদুড়। তারা মহানন্দে বাড়ির কড়ি বর্গ ধরে মাথা ঝুলিয়ে দুলতে থাকে। যে বাড়িতে সাপ ও বাদুর সহবাস করে সেই বাড়ির মেঝে ফুড়ে অশ্বখ গাছের চারা বের হয়। বাড়িও তখন হয়। পতিত।

মানুষের যেমন প্ৰাণ আছে, বসতবাড়িরও আছে। পতিতবাড়ি হলো প্রাণশূন্য বাড়ি।

ঢং করে কাসার পাত্র রাখার শব্দ হলো। হরিচরণ চোখ বন্ধ করে ছিলেন। চোখ মেলে চমৎকৃত হলেন। জহিরের মা ঘোমটা দিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে। বৃষ্টিতে সে পুরোপুরি ভিজে গেছে। সে এখনো দাঁড়িয়ে আছে বৃষ্টিতেই। বৃষ্টিতে ভিজে মনে হয় মজা পাচ্ছে। জুলেখা কাসার থালাভর্তি করে খাবার এনেছে। চিড়া, নারিকেল কোড়া, এক গ্লাস দুধ এবং দুটা কলা। হরিচরণ বললেন, মাগো আজি আমি কিছু খাব না। উপাস দিব।

জুলেখা স্পষ্ট গলায় বলল, আপনি না খেলে আমিও খাব না। আমি এইখানে বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়ায়ে থাকব।

হরিচরণ হাত বাড়িয়ে দুধের গ্লাস নিলেন।

জুলেখা বলল, ঘর অন্ধকার। বাতি দিতে হবে। হারিকেন কোন ঘরে?

হরিচরণ বললেন, কিছুই তো জানি না।

আপনার সঙ্গে কি কেউ নাই?

না।

আপনি চিন্তা করবেন না। আমি আপনার সব কাজকর্ম কইরা দিব।

প্রয়োজন নাই। তুমি মেয়েমানুষ— এখানে যদি আসো, লোকে নানান কথা বলবে।

আপনি আমারে মা ডেকেছেন। মা ছেলের কাছে আসবে, এতে দোষ নাই।

তোমার ছেলে কোথায়?

ছেলে বাপের সাথে বিরামদি। হাটে গেছে। রবারের জুতা কিনবে।

জুলেখা অন্ধকার ঘরে হারিকেন খুঁজছে। এক ঘর থেকে আরেক ঘর যাচ্ছে। এমনভাবে যাচ্ছে যেন এটা তার নিজের বাড়িঘর। মেয়েটা আবার গুনগুন করে গানও করছে–

কে বা রান্ধে
কে বা বাড়ে
কে বা বসে খায়।
কাহার সঙ্গে শুইয়া থাকলে
কে বা নিদ্ৰা যায়?

মনায় রান্ধে
তনায় বাড়ে
আতস বসে খায়
সাধুর সঙ্গে শুইয়া থাকলে
সুখে নিদ্ৰা যায়।

কী মিষ্টি মেয়েটার গলা! যেন সোনালি বর্ণের কাঁচা মধু ঝরে ঝরে পড়ছে।

বৃষ্টি থেমে গেছে। শত শত জোনাকি বের হয়েছে। ঝাঁক বেঁধে উড়ছে। শিউলি গাছ জোনাকিতে ঢেকে গেছে। তারা একসঙ্গে জুলছে, একসঙ্গে নিভছে। কী মধুর দৃশ্য! হরিচরণের হঠাৎ তার মেয়ের কথা মনে পড়ল। মেয়েটা বেঁচে থাকলে কত বড় হতো? সে দেখতে কেমন হতো? চেহারা মনে পড়ছে না। মাথাভর্তি কোঁকড়া চুল ছিল এটা মনে পড়ছে। কোঁকড়া চুল অলক্ষণ। কারণ দেবী অলক্ষীর মাথায় চুল ছিল কোঁকড়া। তিনি স্ত্রীকে সান্ত্বনা দেবার জন্যে অনেকবার বলেছেন- শৈশবের কোঁকড়া চুল বয়সকালে থাকে না। মেয়েটা জীবিত থাকলে এতদিনে নিশ্চয়ই বিয়ে হয়ে যেত। বাবার দুঃসংবাদ শুনে সে কি ছুটে আসত? না-কি তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাকে আটকে দিত? শাস্ত্র বিধান কী বলে? পতিত পিতার সন্তানরাও কি পতিত?

বাবা! আমি যাই?

হরিচরণ চমকে উঠলেন। কিছুক্ষণের জন্যে হলেও তাঁর মনে ভ্রান্তি তৈরি হয়েছিল। মনে হয়েছিল। শিউলি কথা বলছে।

দাঁড়িয়ে আছে জুলেখা। তার মুখ হাসি হাসি। সে হারিকেন খুঁজে পেয়েছে। তিনটা ঘরে হারিকেন জ্বলছে। শুধু বারান্দায় আলো দেয়া হয় নি। হরিচরণ বললেন, গান কোথায় শিখেছি মা?

জুলেখা লজ্জিত গলায় বলল, বাপজানের কাছে। আমার ব্যাপজান বাউল। উনি মালজোড়া গান করেন।

মালজোড়া গান কী?

প্ৰশ্ন-উত্তর। এক বাউল প্রশ্ন করে আরেকজন উত্তর দেয়। মালজোড়া গানে আমার ব্যাপজানের সাথে কেউ পারত না।

উনি কি মারা গেছেন?

জে না। বাড়ি থাইকা পালায়া কোথায় জানি গেছে, আর আসে নাই। দশ বছর হইছে। মনে হয়। বিয়াশাদি কইরা নয়া সংসার পাতছে।

জুলেখা খিলখিল করে হাসছে যেন বাবার নতুন সংসার পাতা আনন্দময় কোনো ঘটনা।

হরিচরণ বললেন, মাগো! তোমার কণ্ঠস্বর অতি মনোহর। একদিন এসে আমারে গান শুনাবে।

জুলেখা নিচু হয়ে হরিচরণকে কদমবুসি করল।

 

সময় ১৯০৫। তখন ময়মনসিংহ জেলার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট খাজা সলিমুল্লাহ (ঢাকার নবাব)। ভারতবর্ষ ইংরেজ শাসনের অধীন। ভারতবর্ষের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা তখন লর্ড কার্জন। তিনি বঙ্গভঙ্গের ঘোষণা দিয়েছেন। বঙ্গভঙ্গ অনুযায়ী আসাম, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী নিয়ে হবে পূর্ববঙ্গ। ঢাকা হবে রাজধানী, চট্টগ্রাম বিকল্প রাজধানী। ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়। ভারতবর্ষের হিন্দু সমাজ ফুঁসে উঠে। বাংলা ভাগ করা যাবে না।

ঢাকায় নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হবে- এটিও হিন্দুসমাজ নিতে পারছিল না। পূর্ব বাংলা চাষার দেশ, তারা বিশ্ববিদ্যালয় দিয়ে কী করবে?

হিন্দু-মুসলমান বিরোধ তখন বাড়ছে। সেই বিরোধ মেটাবার জন্যে অনেকেই এগিয়ে আসছেন। সেই অনেকের মধ্যে একজন হলেন ঠাকুরবাড়ির এক কবি, নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি রাখিবন্ধন অনুষ্ঠান করলেন। সবাই সবার হাতে রাখি বেঁধে দেবে। কারো মধ্যে কোনো হিংসা-দ্বেষ থাকবে না।

রাশিয়ায় তখন জারতন্ত্র। শেষ জার নিকোলাই আছেন ক্ষমতায়। তার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়েছে। লেনিন জার্মানিতে। তিনি তখনো রাশিয়ায় পৌঁছেন নি। ম্যাক্সিম গোর্কি নামের এক মহান লেখক একটা উপন্যাসে হাত দিয়েছেন। উপন্যাসের নাম “মা”।

সেইসময়ে ইউরোপের অবস্থাটা একটু দেখি। সুইজারল্যান্ডের বার্ন শহরে বাইশ বছর বয়সি এক পেটেন্ট অফিসের কেরানি পদার্থবিদ্যার উপর তিন পাতার এক প্রবন্ধ লিখে পাঠিয়েছেন— Annals of Physics-এ। আলো সম্পর্কে তার নিজের চিন্তাধারা প্ৰবন্ধটিতে বলা হয়েছে। প্ৰবন্ধটি পড়ার পর জার্নালের সম্পাদক নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মার্কস প্ল্যাংক মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। তিনি বুঝতে পারছেন পদার্থবিদ্যার এতদিনকার সব চিন্তাভাবনার অবসান হতে যাচ্ছে। আসছে নতুন চিন্তা। শুদ্ধতম চিন্তা। বাইশ বছর বয়সি পেটেন্ট ক্লার্কের নাম আলবার্ট আইনষ্টাইন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *