সদানন্দ সাধুর আশ্রমের তিনদিকটা তপোবনের মতো। বাকি দিকটাতে একটা নদী আছে। আশ্রম ঘিরিয়া অবশ্য তপোবনটি গড়িয়া ওঠে নাই, স্থানটি তপোবনের মতো নির্জন আর শান্তিপূর্ণ দেখিয়াই আশ্রম গড়িয়া তোলা হইয়াছে। আশ্রমের বয়স আর কত হইবে, বছর পাঁচেকের বেশি নয়। তপোবনের বড় বড় গাছগুলির কোনো কোনোটা হয়তো শতাব্দীরও বেশি সময় ধরিয়া নিবিড় ছায়া বিলাইয়া আসিতেছে।
তপোবনের সমস্তটা আশ্রমের সম্পত্তি নয়। দলিলপত্রের হিসাবে দেখা যায়, আশ্রমের ভূমির পরিমাণ শখানেক বিঘার কাছাকাছি। তপোবন আরো বিস্তীর্ণ—উত্তরে বাসুপুরের গা-ঘেঁষা প্রকাণ্ড কলাবাগান এবং দক্ষিণে সাতুনার বাণীপাড়া পর্যন্ত এলোমেলোভাবে ছড়ানো আরো বড় আমবাগানটা ধরিলে আশ্রমের ভূমির দশ-বার গুণ। তবে দলিলপত্র ছাড়া আশ্রমের সীমানা ভালো। করিয়া কোথাও দেখানো নাই কিনা, তাই বন, উপবন, আমবাগান, কলাবাগান, সমস্তই আশ্রমের তপোবন বলিয়া মনে হয়।
নদী পূর্বদিকে।
একটি শাখানদীর এই উপশাখাঁটিকে স্থানীয় লোক আদর করিয়া ডাকিত রাধা বলিয়া, বোধহয়, আদরের আতিশয্যেই একটা ইকার জুটিয়া এখন হইয়াছে রাধাই।
বড় আশ্চর্য নদী। প্রতিবছর বাঁচে আর মরে। আকাশে যেই কালো মেঘ জমিয়া থমথম করে, লোকে জল আটকানোর জন্য চালের ফুটা আর ছাতির ফুটা মেরামত না করিয়া আর উপায় খুঁজিয়া পায় না, রাধাই নদীতে অমনি দেখা দেয় ঘোলা জলের স্রোত। কমাস ধরিয়া রোদে যে বালি তাতিয়াছে, সে বালি যায় ঢাকিয়া, স্থানে স্থানে যে আবদ্ধ জল পচিয়া উঠিতেছিল, সে জল যায় ভাসিয়া। সকলে অবাক হইয়া একবার তাকায় আকাশের দিকে, একবার তাকায় রাধাই নদীর দ্রুতবর্ধনশীল জীবনসঞ্চারের দিকে। বড় রহস্যময় মনে হয় ব্যাপারটা সকলের কাছে। বৃষ্টি আর হইয়াছে কতটুকু, কদিনের ছাড়া ছাড়া বর্ষণে পথঘাট ভালো করিয়া ভেজে নাই পর্যন্ত। কোনো পুকুরে জল বাড়ে নাই, কোনো ডোরায় জল জমে নাই। রাধাই এত জল পাইল কোথায়?
দূরদেশে কোথায় ইতিমধ্যে প্রবল বর্ষা নামিয়াছে, কোন্ বড় নদী সেই জল বহিয়া আনিয়া কোন্ শাখানদীকে দিয়াছে, আর কোন্ শাখানদীর দানে তাদের এই নদীতে দেখা দিয়াছে নবযৌবনের আবির্ভাব, এত সব রহস্যের সন্ধান কজনে আর রাখে। চোখের সামনে মরা নদীকে বচিতে দেখিয়া সকলে বিস্মিত হয়।
নদীর একেবারে ধারে প্রকাণ্ড চালাটায়.বিকালের দিকে সাধুজীর দর্শনকামীদের সমাগম হয়। আশ্রমের সকলে তো উপস্থিত থাকেই, কাছাকাছি গ্রাম হইতে অনেকে আসে, দূরের গ্রাম ও শহর হইতেও আসে। সদানন্দ সকলকে দর্শনও দেয়, দর্শনের মনোমত ব্যাখ্যাও শোনায়।
এবার যেদিন প্রথম রাধাই নদীর বুকে স্রোত দেখা দিল, সেদিন অহিংসা ও প্রেমের কথা। বলিতে বলিতে সদানন্দ হঠাৎ আনমনে চুপ করিয়া গেল। নদীর স্রোতের দিকে পলকহীন চোখে এমনভাবে চাহিয়া রহিল যে, কারো বুঝিবার উপায় রহিল না, অন্যমনস্ক সে ইচ্ছা করিয়া হইয়াছে। আজ কথা জমিতেছিল না। যার কথা মনের মধ্যে কাটার মতো বেঁধে, মধুর মতো মাখা হইয়া যায়, মধুপের মতো গুঞ্জন করে, শুনিতে শুনিতে থাকিয়া থাকিয়া হয় রোমাঞ্চ, আজ যেন তার কথায় জোর নাই, সুর নাই—নিছক কতকগুলি নীরস, ভেতা শব্দমাত্র পরিবেশন করিতেছে। অস্বস্তিবোধ করিতে করিতে এতক্ষণে কারণটা টের পাইয়া সকলে স্বস্তিলাভ করে। তাই বটে, সাধুজী আজ অন্যমনস্ক হইয়া আছেন। কথায় সাধুজীর মন নাই।
পুরুষরা চুপ করিয়া রহিল, মেয়েদের মধ্যে শোনা গেল ফিসফিস কথার গুঞ্জন। এখানে মেয়ে-পুরুষের বসিবার পৃথক ব্যবস্থা নাই, সদানন্দ পুরুষ ও নারীর পার্থক্য স্বীকার করে, পৃথক রাখিবার প্রয়োজন স্বীকার করে না। এই সভায় যারা বসে, তাদের মধ্যে যেমন ছোট-বড় নাই, আপনপর নাই, তেমনি মেয়ে-পুরুষও নাই। অন্তত, সাধুজীর তাই নির্দেশ। তবু, মেয়েরা দল বাঁধিয়া একপাশে তফাতে সরিয়া বসে, ব্যবধানটা ঘুচাইবার চেষ্টাও পুরুষদের মধ্যে কখনো দেখা যায় না। চালার নিচে স্থানাভাব ঘটিলেও নয়।
চালার কাছে খানিকটা জায়গা গাছপালা কাটিয়া পরিষ্কার করিয়া দেওয়া হইয়াছে, এখানে গাছের ছায়া নাই। তপোবনের মাথা ডিঙাইয়া বাকাভাবে রোদ আসিয়া মেয়েদের বসিবার জায়গায় পড়িয়াছে, বড় তেজ এখানকার রোদের। ঘামে সকলে ভিজিয়া গিয়াছে, তবু সরিয়া ছায়ায় গিয়া বসিবার সাহস কারো নাই। একটি কমবয়সী বিধবা, গায়ের রংটা যার আশ্চর্যরকমের ফর্সা, মুখখানা সিঁদুরের মতো রাঙা করিয়া চোখ বুজিয়া পাশের ঘোমটা-টানা বৌটির গায়ে নির্লজ্জ ভঙ্গিতে হেলান দিয়া আছে। হয় মূৰ্ছা গিয়াছে, নয় যাওয়ার উপক্রম করিয়াছে।
আনমনে নদীর দিকে চাহিয়া থাকিতে থাকিতেই সদানন্দ বলিল, মেয়েদের গায়ে রোদ লাগছে বিপিন।
বিপিন সদানন্দের বন্ধু, শিষ্য এবং আশ্রমের জেনারেল ম্যানেজার। একদিন সে সদানন্দের। নাম ধরিয়াও ডাকিত, হাসিতামাশাও করিত। আজো অন্তরালে করিলে কিছু আসিয়া যায় না, কিন্তু দশজনের সামনে আনমনে হঠাৎ ভুল করিয়া বসিবার ভয়ে প্রকাশ্যেঅপ্রকাশ্যে সব সময়েই
সে শিষ্যত্বের খোলসটা বজায় রাখিয়া চলে।
বিপিন হাতজোড় করিয়া বলিল, কি করব প্ৰভু?
ছায়ার ব্যবস্থা করে দাও।
দিই প্রভু।
হোগলার বেড়া আনিয়া চালার খুঁটিতে ঠেস দিয়া দাড় করাইয়া বিপিন অল্পক্ষণের মধ্যেই ছায়ার ব্যবস্থা করিয়া দিল। আগেও কদিন মেয়েরা রোদে কষ্ট পাইয়াছে, রৌদ্র নিবারণের এমন সহজ উপায় থাকিতে আগে কেন এ ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয় নাই, কে তা অনুমান করিবে! হয়তো কারো খেয়াল হয় নাই-সদানন্দেরও নয়। হয়তো তফাতে জমাট বাঁধিয়া বসিবার জন্য মেয়েদের উপর সদানন্দের রাগ হইয়াছিল, তাই কদিন তাদের রোদে ভাজা ভাজা করিয়া শাস্তি দিয়াছে। আজ বিধবা মেয়েটির রাঙা মুখখানা দেখিয়া মায়া হইয়াছে। কিন্তু, রাগ কি সদানন্দের। আছে? শাস্তি কি কারোকে সে দেয়? মায়া কি তার হয়? শুধু তাকে দৰ্শন করিয়া আর তার দর্শনের ব্যাখ্যা শুনিয়া কে তা অনুমান করিতে পারিবে!
মেয়েরা ছায়া পাওয়ামাত্র সদানন্দ মুখ ফিরাইল। মেয়েদের মৃদুগুঞ্জন সঙ্গে সঙ্গে থামিয়া গেল। প্রেম ও অহিংসা সম্বন্ধে না জানি সাধুজী এবার কি বলিবে!
নদীতে এবার অনেক আগে জল এল, না বলাই?
কোথায় প্রেম ও অহিংসা, কোথায় রাধাই নদীতে জল আসা, কোথায় শতরঞ্চি-জোড়া ভদ্রলোকের ভিড়, কোথায় এককোণে মাটির আসনে সাতুনার মূখ দোকানদার বলাই। বলাই নামে এক জন যে আসিয়া আসরের একপাশে বসিয়াছে, তাই বা এতক্ষণে কজনে খেয়াল করিয়াছিল? বলাই কৃতার্থ ও নির্বাক হইয়া রহিল।
তার হইয়া জবাব দিল শ্রীধর। অনেক বয়স হইয়াছে শ্রীধরের, ষাটের কাছাকাছি। সাতুনায় সে সম্পন্ন গৃহস্থ, তিন তিনটা রোজগেরে ছেলে লইয়া মস্ত সংসার পাতিয়াছে। রামায়ণ মহাভারত পাঠ করিতে সে অদ্বিতীয়। সুতাবাধা চশমা আঁটিয়া প্রতিদিন সন্ধ্যার পর বাড়িতে সে রামায়ণ, মহাভারতের বাছাবাছা অংশ পাঠ করে, মাঝে মাঝে থামিয়া অতি সরল ও সহজবোধ্য কাহিনীর রসালো ব্যাখ্যা করিয়া শোনায়। তার বাড়িতে প্রায়ই এ রকম সভা বসে—তবে এত বড় নয়। আর সে সভায় ভদ্রলোক আসে না, সে শুধু চাষী-মজুর, তেলি-তাতি-কামার-কুমারের সভা।
বিপিনের অনুকরণে হাত জোড় করিয়া শ্ৰীধর বলিল, চারবাদলা নেমে গেছে, আজ্ঞা।
চারবাদলা নামার সঙ্গে রাধাই নদীতে জল আসার সম্পর্ক কি? চারবার বৃষ্টি হইয়া গেলেই রাধাই নদীতে জল আসে। চিরদিনই নিয়ম। টিপ টিপ করিয়া দু-চার ফোঁটা জলই পড়কে আর ঝম্ ঝম্ করিয়া সৃষ্টি-ভাসান বাদলাই নামুক, চারবার বর্ষণ হইয়া গেলে নদীতে জল আসিবেই আসিবে। সদানন্দ মৃদু হাসে। জবাব দিয়াছে শ্রীধর, কিন্তু স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলকে তিরস্কার করিয়া বলে, এ সব ধারণা পোষণ করা কেন, এ ধরনের সব কুসংস্কার?
সাধুজীর স্নেহমধুর আবেগভরা ধমক শুনিয়া মনে হয়, আর যে সব কুসংস্কার তাদের আছে, সে সব যেন কিছু নয়, এটাই তাদের কুসংস্কারের চরম। মনে মনে এই কুসংস্কার পুষিয়া রাখিয়া ইহকাল পরকাল সব তারা নষ্ট করিয়াছে।
তারপর শুষ্ক নদীতে হঠাৎ স্রোত দেখা দিবার কারণ সে ব্যাখ্যা করে। ব্যাখ্যা করিতে করিতে আসে রহস্যময়ী প্রকৃতির কথা। প্রকৃতির আসল রহস্য কোথায়, মানুষ যে তার সন্ধান জানে না, এ কি সহজ আফসোসের কথা! অজানার মধ্যে মানুষ প্রকৃতির রহস্যকে খুঁজিয়া মরে রাধাই নদীতে জলসঞ্চারের কারণ না জানায় ভাবে, এই বুঝি তবে প্রকৃতিদেবীর দুর্বোধ্য লীলার অভিব্যক্তি। জানামাত্র যখন অজানার সমস্ত রহস্যের আবরণ খসিয়া যায়, অজানার জন্য মাথা ঘামানো কেন? জানার মধ্যে যে যতটুকু জানে তারই মধ্যে, প্রকৃতির সবটুকু রহস্যের খনি নিহিত থাকে। রাধাই নদীতে জলস্রোত আসিবার কারণ নাই বা জানিলে, জলস্রোত যে আসিয়াছে, এটুকু তো জান? এই জানাটুকুর মধ্যে সন্ধান কর, রহস্যানুভূতির অজ্ঞাত জগতের দিগন্তে আত্মজ্ঞানের ছায়া নিরবচ্ছিন্ন অস্তিত্বের সঙ্কেতে তোমায় সাড়া দিতেছে দেখিতে পাইবে।
সকলে মশগুল হইয়া শোনে। এতক্ষণে আসর জমিয়াছে। শুধু সদানন্দের বলিবার কৌশলে প্রত্যেকের মনে হয়, দুর্বোধ্য কথাগুলি যেন জলের মতো বুঝিয়া ফেলিয়াছে। কি বুঝিয়াছে এ কথা কেউ ভাবে না, বুঝিতে পারিয়াছে, এই ধারণার উন্মাদনায় বিভোর হইয়া থাকে। বিপিনের শীর্ণ ম্লান মুখে আনন্দের ছাপ পড়ে। আজ প্রণামী জুটিবে ভালো।
মাঝে মাঝে দু-একজন নতুন শ্রোতা আসিয়া চুপিচুপি আসরের একপাশে বসিয়া পড়িতেছিল। দেরি হওয়ায় তারা গ্রাম হইতে ব্যস্তসমস্ত হইয়া ছটিয়া আসিয়াছে, কিন্তু তপোবনে ঢুকিবার পর আর তাদের ব্যস্ততা নাই। সমস্ত তপোবন পার হইয়া চালায় পৌঁছিতে হয়, সেই অবসরে তপোবন তাদের শান্ত করিয়া দিয়াছে। না, তাড়াহুড়া করিবার কিছু নাই। সাধুজীর কথা যদি শেষ হইয়া যায়, তাতেই বা কি? আরেকদিন সময়মতো আসিলেই হইবে। সদানন্দের কথা শুনিবার আগ্রহে যারা ছুটিয়া আসে, তাদের সকলের মনেই তপোবন কম-বেশি প্রায় এই রকম প্রভাব বিস্তার করে, সমস্ত অধীনতা যেন জুড়াইয়া যায়, আশা-আকাঙার তীব্রতা থাকে না। পতঙ্গ যেমন মধুতে ড়ুবিয়া চাপল্য হারায়, তপোবনের উদ্ভিদগুলির রক্ষণাবেক্ষণে যে নিবিড় শান্তি আছে, তার অদৃশ্য ঘনত্বের কবলে আসিয়া পড়ামাত্র মানুষের মনের বিভিন্ন গতিগুলি তেমনি সংযত হইয়া যায়।
তবে সকলের নাগাল পোবন পায় না। কত অন্যমনস্ক জীব আছে জগতে, কত মন ইন্দ্রিয়ের মৃদুতর উপচারগুলি নির্বিচারে প্রত্যাখ্যান করে, কত মানুষ নিজে চারিদিকে লইয়া বেড়ায় দুর্ভেদ্য আবরণ।
আট বেয়ারার হুম্ হুম্ শব্দে তপোবনকে কিছুক্ষণের জন্য নিছক জঙ্গলে পরিণত করিয়া একটি পালকি একেবারে আশ্রমের ভিতরে আসিয়া থামিল, সদানন্দের তিনমহাল কুটিরের সামনে। আসর বসিবার চালা হইতে সদানন্দের কুটির বেশি তফাতে নয়, একটা বাঁশঝাড় এবং কয়েকটা জাম ও বকুলগাছের জন্য চোখে পড়ে না।
না দেখিয়াও অনুমান করা গেল, কে আসিয়াছে। মহীগড়ের রাজা ছাড়া আট বেয়ারার পালকিতে আর যারাই চাপুক, আশ্রমে তারা আসে না। সদানন্দের কথা বন্ধ হইয়া গিয়াছিল। বিপিন ব্যস্ত হইয়া নিবেদন করিল, রাজাসাহেব দর্শনলাভ করতে এসেছেন প্রভু।
এখানে আসতে বল।
এখানে প্রভু?
সদানন্দের আকস্মিক বিদ্রোহ বিপিন প্রত্যাশা করে না, মুখে অনেকগুলি রেখা সৃষ্টি করিয়া সে চাহিয়া রহিল। হোক গুরুদক্ষিণা, আশ্রমের ভূমি তো রাজাসাহেবের দান, নিজে সে আশ্রমে পায়ের ধুলা দিয়াছে তাই কি যথেষ্ট নয়? তার প্রজাদের এই আসরে তাকে ডাকিয়া আনার তো কোনো মানে হয় না। যার কলমের এক খোঁচায় আশ্রম উঠিয়া যাইতে পারে, সে শিষ্য হইলেও তাকে একটু, খুব সামান্য একটু খাতির করিলে দোষ কি?
রাধাই নদীর ঘোলাটে জলস্রোতই যেন আজ সদানন্দকে আনমনা করিয়া দিতেছে। বিপিনের প্রশ্নের মানে বুঝিতে দুবার শুনিতে হয় না, মুখের রেখা, চোখের দৃষ্টির মানে বুঝিতে দুবার চাহিতে হয় না। আনমনা হইয়া না বোঝার ভান করাই সবচেয়ে সহজ।
হ্যাঁ, বল গে, আমি এখানে আছি।
বহুকাল শিষ্যত্বের অভিনয় করিতে করিতে কিভাবে যেন বিপিনের সংযম অভ্যাস হইয়া গিয়াছে। তাছাড়া মানুষটা সে বড় চালাক, ভাবিয়া চিন্তিয়া ফন্দি না আঁটিয়া কখনো সে কিছু করে না, যদি বা করে, অন্তরালে করে। জীবনের সমস্ত অসংযম তার গোপনীয়। সদানন্দের বোকামিতে রাগে গা জ্বলিয়া গেলেও তাই সে শুধু বলিল, প্ৰভু?
সদানন্দ চুপ। আনমনে কথা বলার চেয়ে নীরবে আনমনা হওয়া ঢের সহজ। একটু অপেক্ষা। করিয়া বিপিন কুটিরের দিকে চলিয়া গেল। আর ফিরিয়া আসিল না। সূর্য নামিয়া গেল তপোবনের গাছের আড়ালে, মেয়েদের মধ্যে চাঞ্চল্য দেখা দিল, সকলকে পা ছুঁইয়া প্ৰণাম করিবার ও প্রণামী দিবার অনুমতি দিয়া সদানন্দ ঠায় বসিয়া রহিল রক্তমাংসের দেবতার মতো। দেবতার মতোই তার মূৰ্তি, বটতলার ছবির মহাদেবের ছাচে ঢালিয়া যেন তার সৃষ্টি হইয়াছে। আসন করিয়া বসায়, ভঁড়ি গিয়া প্রায় ঠেকিয়াছে পায়ে এবং তাতেই যেন মানাইয়াছে ভালো। নয় তো এই বৃষস্কন্ধ বিশালদেহ। পুরুষের চওড়া বুক আর পেশীবহুল সুডৌল বাহু দেখিয়া মনে হইত, দেহের শক্তি ভিন্ন আর বুঝি তার কিছু নাই। কথায় তাহা হইলে মানুষ মুগ্ধ হইত কিনা, কারো ভক্তি জাগিত কিনা সন্দেহ। মাথায় জটা নাই বলিয়াই ভক্তেরা অনেকে মনে মনে আফসোস করে। যার সৌম্য, প্রশান্ত মূর্তি স্থৈর্যের নিখুঁত প্রতীক, জটা ছাড়া কি তাকে মানায়?
সদানন্দের কুটিরের সদর আর কিছুই নয়, বড় একখানা ঘর। মেঝে লাল সিমেন্ট করা, দেয়াল গেরুয়ারঙের বাদামি ভাবটা একটু প্রকট। আশ্রমের ছোট-বড় সমস্ত ঘরই এই ধরনের, উপরে ছাউনি ছাড়া বাকি সব চুনসুরকি ইটকাঠের ব্যাপার। কিন্তু বিপিনের ভাষায় এগুলি সব কুটির।
সদরের ঘরখানায় কতকটা বৈঠকখানার কাজ চলে, মাঝে মাঝে ভক্ত ও দর্শনার্থীদের ছোটখাটো সভাও বসে। তবে সে সভা হয় অনেকটা ঘরোয়া মজলিসের মতো, সকলে অনেক বিষয়ে স্বাধীনতা পায়। সদানন্দকে যেমন ব্যক্তিগত সুখদুঃখ দ্বিধা-সন্দেহ নিবেদন করা চলে তেমনি চলে নিজেদের মধ্যে ঘরোয়া আলাপ-আলোচনা, এমন কি উঁচু গলায় তফাতের মানুষকে জিজ্ঞাসা পর্যন্ত করা চলে, কেমন আছ ভায়? শিষ্য ও ভক্তের ব্যক্তিত্বকে এখানে সদানন্দ প্রশ্রয় দেয়, নদীর ধারে আটচালার নিচে এদের সঙ্গে তার যে ব্যবধানটা থাকে প্রায় দেবতা ও অধঃপতিতের, এখানে সেটা হয় অবতার ও মানুষের। কত তুচ্ছ বিষয়েই মাথা ঘামায় সদানন্দ, কত তুচ্ছ মানুষের কত তুচ্ছ পারিবারিক জীবনের কত তুচ্ছ খবরই যে জানিতে চায়। আগ্রহ দেখায় না বটে, দুঃসংবাদে বিচলিত হয় না, সুসংবাদে খুশিও হয় না, তবু নির্বিকার সহিষ্ণুতার সঙ্গে কান পাতিয়া সব কথা তো শোনে, মুখ ফুটিয়া তো বলে তাই নাকি অথবা বেশ বেশ।
সদর পার হইয়া আসিলে অন্দরের উঠান, ফুলের চারায় ও ফলের গাছে বাগানের মতো। একপাশে প্ৰকাণ্ড একটা বাধানো ইদারা, জল বড় মিষ্টি আর ঠাণ্ডা। গরমের দিনে সূর্য যখন মাথার উপরে থাকে আর ইদারার নতুন সিমেন্ট করা গোলাকার চওড়া বাঁধটা হইয়া থাকে আগুন, হামাগুড়ি দিয়া একটিবার শুধু ক্ষণেকের জন্য ভিতরে উঁকি দিলে মনে হয়, জলে ড়ুবিয়া মরাই বুঝি ভালো : পূর্ণিমার চাঁদের আলোতেও অত নিচের জল তো দেখা যায় না, গরমের দিনে-রাত্রে তাই যেভাবেই হোক মরার সাধ জাগানোর জন্য খালি গায়ে ঠাণ্ডা সিমেন্টে গা এলাইয়া দিতে সাধ যায়। ফুরফুরে হাওয়া থাক, অথবা দারুণ গুমোট হোক, রাশি রাশি ফুলের ঘন মিশ্রিত গন্ধে প্রথমে মন কেমন করিয়া ঘুম আসিয়া পড়ে, এইটুকু যা অসুবিধা। একদিনও কি সদানন্দ পুরা একটা ঘণ্টা জাগিয়া থাকিতে পারিয়াছে।
উঠানের একদিকে সদর, বাকি তিনদিকেই প্রায় ঘর কোনো ঘরের সামনে বারান্দা আছে, কোনো ঘরের সামনে নাই। অন্দর পার হইয়া নদীর দিকে অন্তঃপুর। অন্তঃপুরেও উঠান আছে, তবে অন্দরের উঠানটির তুলনায় আকারে অনেক ছোট আর আগাগোড়া সিমেন্ট করা। না আছে ফুলের চারা, না আছে ফলের গাছ, শুধু ঝকঝকে তকতকে মাজাঘষা পরিচ্ছন্নতা। এক কোণে কেবল একটা তালগাছ আকাশে মাথা তুলিয়াছে, হঠাৎ দেখিলে মনে হয় বুঝি জীবন্ত কিছু চিরদিনের জন্য সদানন্দের অন্তঃপুরে বন্দি হওয়ায় ব্যাকুল আগ্ৰহে মাথা উঁচু করিয়া বাহিরের জগতে উঁকি দিতেছে। গাছটায় ফল ধরে না, কোনোদিন নাকি ধরিবেও না।
অন্তঃপুরে ঢুকিবার একটি খিড়কি পথ আছে, নদীর দিকে প্রাচীরের গায়ে বসানো ছোট একটি দরজা। ঘরের জানালা দিয়া সারাদিন সদানন্দ আজ রাধাই নদীতে জলের আবির্ভাব দেখিয়াছিল, তারপর খিড়কির দরজায় বাহির হইতে শিকল তুলিয়া দিয়া গিয়াছিল আটচালা সভায়। এখন মন্থরপদে ফিরিয়া আসিয়া শিকলতোলা দরজার দিকে পিছন ফিরিয়া খানিকক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিল, বাহিরের মায়া-মদপায়ী মাতালের মতো উঁড়ির উপর দুটি হাত রাখিয়া সামনে-পিছনে একটুখানি টলিতে টলিতে। বিড়বিড় করিয়া কি যে বলিতে লাগিল, নিজের কানেই তা গেল না। নিজের কথা শুনিবার স্পৃহাও আর নাই। মনে তার শান্তি নাই কেন, এত মানুষকে সে শান্তি বিলাইতেছে? এত ক্ষোভ কেন তার, এমন আকস্মিক ক্রোধের সঞ্চার? কারো সে ক্ষতি করে নাই, কারো উপরে তার হিংসা নাই, বিদ্বেষ নাই—বিপিনের কাণ্ডে মাঝে মাঝে রাগও হয়, ঘৃণাও জাগে বটে, কিন্তু বিপিনকে সে ভালোই বাসে, এ জগতে বিপিন তার সবচেয়ে আপন, একমাত্র প্রাণের বন্ধু। এমন জ্বালাভরা অস্থিরতা তবে সে বোধ করে কেন? ভাবিতে ভাবিতে বাহিরের মায়ার নেশা যেন গাঢ় হইয়া আসে, আশ্রমে ঢুকিতে অনিচ্ছা বাড়িয়া যায়। শিকল খুলিয়া সদানন্দ তাই গায়ের জোরেই অন্তঃপুরে ঢুকিয়া পড়ে, সশব্দে ভিতর হইতে খিল বন্ধ করিয়া দেয়।
উঠানের তালগাছে ঠেস দিয়া একটি স্ত্রীলোক দাঁড়াইয়া আছে দেখিয়া সদানন্দের বিরক্তির সীমা থাকে না। রাগ করিয়া বলে, কে গা তুমি? কি করছ এখানে?
চুপ। আমি কেউ না।
কথাগুলি জড়ানো কিন্তু গলাটি মিষ্টি—অল্পবয়সী মেয়ে। দক্ষিণের বড় ঘরের বারান্দায় আর পশ্চিমের ঘোট ঘরখানার বোয়াকে দুটি লণ্ঠন জ্বলিতেছে, মেয়েটির গায়ে আলো পড়িয়াছিল যথেষ্ট। সদানন্দ চাহিয়া দেখে নাই, নতুবা বুঝিতে পারিত মেয়েটি আশ্রমের কেউ নয়। এত কমবয়সী। মেয়েও আশ্রমে কেউ থাকে না, আশ্রমে মেয়েদের বেশভূষাও এরকম নয়।
কাণ্ডটা বিপিনের, বুঝিতে পারিয়া সদানন্দের বিরক্তি আরো বাড়িয়া গেল। আগে হইতে কিছু না জানাইয়া বিপিন যে কোথা হইতে এরকম এক একটি খাপছাড়া মেয়েকে আশ্রমে আনিয়া হাজির করে। গত বৈশাখের মাঝবয়সী স্ত্রীলোকটিকে ধরিলে এটি বিপিনের সাত নম্বরের ম্যাজিক। পালকিতে তবে মহীগড়ের রাজাসাহেব আসে নাই, আসিয়াছেন ইনি। বৈশাখের ব্যাপারে সদানন্দ ভয়ানক রাগ করায় বিপিন প্রতিজ্ঞা করিয়াছিল, আর এসব ঘটিবে না, কোনোদিন নয়। কমাসের মধ্যেই বিপিন প্রতিজ্ঞার কথাটা তাহা হইলে ভুলিয়া গিয়াছে। ভুলিয়া যাওয়ার আগে একটু আভাস দেওয়াও দরকার মনে করে নাই, তাকে যে কথা দিয়াছিল, সেটা মানিয়া চলা সম্ভব হইবে না। দুঃখে অপমানে নিজেকে সদানন্দের একান্ত অসহায় বলিয়া মনে হয়। বিনামূল্যে কিনিয়া বিপিন যেন তাকে ক্রীতদাস করিয়া ফেলিয়াছে। কিন্তু এবার সে ছাড়িবে না, এবার একটা চরম বোেঝাপড়া করিতে হইবে বিপিনের সঙ্গে।
খুব বেশি বিব্রতবোধ না করিলে, অন্তঃপুরের উঠানে খাপছাড়া নিঃসঙ্গ তালগাছটার গুঁড়িতে মেয়েটাকে ঠেস দিয়া দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়া সদানন্দের হয়তো মনে হইত, মন্দ মানায় নাই। কবে কে দা, কুড়াল কিছু একটা অস্ত্ৰ দিয়া আঘাত করিয়াছিল গাছটার গুঁড়িতে, সেই ক্ষতের চিহ্ন, মাটি ঘেঁষিয়া কয়েকটা সরু সরু শিকড়ের ইঙ্গিত, সিমেন্টে বিপিন কবে আনমনে পানের পিক ফেলিয়াছিল তার প্রায় মুছিয়া যাওয়া দাগ, হাত দেড়েক তফাতে নর্দমার কাছে এক বালতি জল আর একটা ঘষামাজা ঘটি আর এই আবেষ্টনীর মধ্যে অতিরিক্ত একটি মেয়ে।
কিন্তু রাগে সদানন্দ অন্ধকার দেখিতেছিল।
রাগ চাপিয়া কোনোরকমে সে বলিল, এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন বাছা, ঘরে গিয়ে বোসো? আমি যদি এখানে দাঁড়িয়ে থাকি, তোমার কি?
জড়ানো সুরে কথাগুলি বলিয়া গাছের আশ্রয় ছাড়িয়া সদানন্দের ঝকঝকে তকতকে সিমেন্ট করা উঠানে হিলতোলা জুতা চুকিয়া মেয়েটি আগাইয়া আসিল কাছে, খপ করিয়া ধরিয়া ফেলিল সদানন্দের হাত। হয়তো টাল সামলানোর জন্য।
তুমি সাধুজী, না?
মুখে তীব্ৰ মদের গন্ধ। যে গন্ধে সদানন্দের চিরকাল বমি আসে। জবাব না পাইয়াও আহ্বাদে মেয়েটি যেন গলিয়া গেল, দুহাতে সদানন্দের গলা জড়াইয়া গদগদ হইয়া বলিল, শোন, আমি কেউ নয়, বললাম না এক্ষুনি তোমাকে, তা সত্যি নয়। আমি মাধবী, মাধবীলতা—লতাটা কেটে বাদ দিয়েছি একদম।।
বলিয়া খিলখিল করিয়া মাধবীর কি হাসি! গলায় জড়ানো হাতের বাঁধন খুলিয়া সদানন্দ তাকে। ঠেলিয়া দিয়া ঘরে চলিয়া গেল। পড়িয়া গিয়া আঘাতের ব্যথায় মাধবীলতা কেঁপাইয়া ফোপাইয়া কাঁদতে লাগিল।
মাধবীলতার কান্না শুনিয়া পূর্বের ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিল বিপিন আর সাহেবী। পোশাকপরা একটি যুবক। দুজনে ধরাধরি করিয়া মাধবীলতাকে লইয়া গেল ঘরে। মাধবীলতা কাঁদিতে কাঁদিতে কেবলি নালিশ করিতে লাগিল, সাধুজী আমায় (মেরেছে) ঠেলে ফেলে দিয়েছে। আমি এখানে থাকব না, আমায় নিয়ে চল।
আটবেয়ারার পালকি চাপিয়া মহীগড়ের রাজা আজ আসে নাই। আসিয়াছে রাজপুত্র। মাধবীলতাকেও সঙ্গে আনিয়াছে সে-ই। আনিয়াছে পালকির মধ্যে এককোণে লুকাইয়া। একেবারে অন্দরে ঢুকিয়া পালকি থামিয়াছে, রাজাসাহেব স্বয়ং রানীসাহেবকে সঙ্গে করিয়া আশ্রমে আসিলে যেখানে থামে। রাজপুত্রের গায়ে ভর দিয়া মাধবীলতা অন্তঃপুরে প্রবেশ করিয়াছে।
অন্দর তখন একরকম কঁকাই ছিল, তবু মহীগড়ের রাজার বদলে রাজপুত্র আর রানীর বদলে মাধবীলতার আগমন কারো নজরে পড়িয়াছে কিনা বলা শক্ত। এ রকম অবস্থায় তাকে আশ্রমে কয়েকদিনের জন্যও রাখা সঙ্গত হইবে কিনা, বিপিন ও রাজপুত্রের মধ্যে এতক্ষণ সেই পরামর্শই চলিতেছিল। বিপিন বার বার অনুযোগ দিয়া বলিতেছিল, এরকম প্রকাশ্যভাবে মাধবীলতাকে আশ্রমে আনা সত্যই বড় অন্যায় হইয়াছে রাজপুত্রের। আগে একটা খবর যদি সে পাঠাইত বিপিনকে, বিপিন সব ব্যবস্থা করিয়া দিত, এতটুকু হাঙ্গামাও হইত না, রাজপুত্রের ভাবনারও কিছু থাকিত না।
রাজপুত্রের নাম নারায়ণ। দীর্ঘ বলিষ্ঠ সুদৰ্শন চেহারা, মাঝে মাঝে মুখে অনাচারের যে ছাপটুকু পড়ে, সেটা স্থায়ী হয় না, দুদিন বিশ্রাম করিলেই মুছিয়া যায়, মুখে আবার স্বাস্থ্যের অমলিন জ্যোতি ফুটিয়া ওঠে। এমন মুখখানা উত্তেজনা ও ভয়ে অস্বাভাবিক রকম পাণ্ডুর দেখাইতেছে, চাউনি দেখিলেই টের পাওয়া যায়, মানুষটা এখন বিহ্বল।
বিপিনের অনুযোগর জবাবে সেও অনেকবার বলিয়াছে, কি করব বলুন, এমন একগুঁয়ে বলবার নয়। সব ব্যবস্থা ঠিক করে ফেলেছিলাম, ওর জন্যেই সব ভেস্তে গেল। শেষ মুহূর্তে কোথায় যাই, তাই এখানে ছুটে এলাম।
বিপিন তখন আশ্বাস দিয়া বলিয়াছে, যাক কি আর হবে, ভাববেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে।
মাধবীলতাকে শান্ত করিতে বেশি সময় লাগিল না, ছোট ঘরখানায় চৌকির উপর বিছানো ময়ূর-আঁকা মাদুরে সে গুম্ খাইয়া বসিয়া রহিল। রাজপুত্র নারায়ণ তখন পুবের ঘরে আসিয়া সদানন্দকে প্রণাম করিল। সদানন্দ কোনোদিন কাহাকেও আশীর্বাদ করে না, বিড়বিড় করিয়া মুখে একটা আওয়াজ করে মাত্র। আজ তাও করিল না।
ঘরের আলোটা সদানন্দ কমাইয়া দিয়াছিল, বিপিন বাড়াইয়া দিল। দেখা গেল, নারায়ণের মুখের পাংশু বিবৰ্ণ ভাবটা বড় বেশিরকম স্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে। সদানন্দকে সে কোনোদিনই বিশেষ খাতির করে না, ভয় ভক্তি করার দরকারও কোনোদিন বোধ করে নাই। আজ তার সবটুক তেজ আর বেপরোয়া ভাব উবিয়া গিয়াছে।
বিপিন নিবেদন করিল, রাজাসাহেব আসেন নি প্রভু। নারায়ণবাবু একটি নিরাশ্রয় মেয়েকে আশ্রমে ভর্তি করে দিতে এনেছেন। মেয়েটির কেউ নেই প্রভু।
থাকবার ব্যবস্থা করে দাও। আর তোমরা যাও বিপিন।
আসনে বসবেন প্রভু?
যেতে বললাম যাও না বিপিন, আমায় একটু একা থাকতে দাও।
বিপিনের মুখ দেখিয়া রাগ বোঝা যায় না, কেবল তার কপালে কয়েকটা রেখার সৃষ্টি হয় আর চোখের পলক পড়া অনিয়মিত হইয়া যায়। নারায়ণকে সঙ্গে করিয়া বিপিন ঘর হইতে চলিয়া গেল। ঘণ্টা দুই পরে সে যখন আবার ঘরে ফিরিয়া আসিল, সদানন্দ ঘুমের ভান করিয়া খাটের উপর গদির বিছানায় পড়িয়া আছে। গায়ে ঠেলা দিয়াও তার ঘুম ভাঙাইতে না পারিয়া চাপা গলায় তাকে একটা কুৎসিত গাল দিয়া বিপিন চলিয়া গেল। সদানন্দের বড় ক্ষুধা পাইয়াছিল, সেবার ব্যবস্থাটাও আজ একটু বিশেষ রকমের হইয়াছে, কাছাকাছি একটা গ্রাম হইতে মেয়ের বিবাহ উপলক্ষে কে যেন। আজ নানারকম সুখাদ্য পাঠাইয়া দিয়াছে আশ্রমে। বিপিনের সঙ্গে বোঝাপড়ার ভয়ে না খাইয়াই। আকাশপাল ভাবিতে ভাবিতে সদানন্দ এক সময় ঘুমাইয়া পড়িল।
ঘুম ভাঙিল খুব ভোরে, ভালো করিয়া তখনো চারিদিক আলো হয় নাই। পাশ না ফিরিয়াই বোঝা গেল কে যেন পিঠের সঙ্গে মিশিয়া শুইয়া আছে। মশারি ফেলিতে সদানন্দের মনে ছিল না, কে যেন মশারি ফেলিয়া সযত্নে গুঁজিয়া দিয়াছে। উঠিয়া বসিয়া সদানন্দ একদৃষ্টে চাহিয়া রহিল। মাধবীলতার শুইবার ভঙ্গিটি মনোরম নয়, তাছাড়া তার নিজের দেহের উপর মাঝরাত্রি পর্যন্ত তার নিজেরই ছটফটানির ঝড় বহিয়া গিয়াছে। কিন্তু এদিকে সদানন্দও প্রায় একযুগ হইল, সকালে ঘুম ভাঙিয়া পিঠের সঙ্গে মেশা কুণ্ডলীপাকানো পুঁটুলির মতো নারীদেহ চাহিয়া দেখে নাই। হঠাৎ চোখ ফিরাইতে পারিল না।
তাছাড়া বিপিন যে মাধবীলতাকে আশ্রমে আনিয়াছে, এ অপমানের জ্বালা আছে প্রতিকার নাই, প্রতিকারহীন অপমানের আছে শুধু প্রতিশোধের কামনা। বিপিন যে কতদূর ছোটলোক, এই চিন্তার ছেদ দিয়া ছাড়া ছাড়া ভাবে সদানন্দ ভাবিতে থাকে, আহা মেঘলা ভোরে মেয়েটি শীতে কেমন জড়োসড়ো হইয়া গিয়াছে, দ্যাখ। গরমে নিজের দেহ যে ঘামে ভিজিয়া গিয়াছে, এটা সদানন্দের খেয়ালও হয় না। শীতের জন্যই মাধবীলতার এমন অদ্ভুত শোয়ার ভঙ্গি, এই অকাট্য যুক্তির কাছে গরমের অনুভূতি হার মনে। এইভাবে মাধবীলতাকে দেখিতে দেখিতে মনের আকাশপাতাল আলো-অন্ধকার কিভাবে যেন ধীরে ধীরে ঝাপসা হইয়া কোথায় মিলাইয়া গেল, অতীত হইতে ভবিষ্যতের দিকে প্রবাহিত হওয়ার বদলে সময় বর্তমানকে কেন্দ্ৰ করিয়া পাক খাইতে খাইতে আবর্ত রচনা করিতে লাগিল। মনটা বিদ্ৰোহ করিয়া বসিল সদানন্দের, একবার চাহিল রুদ্ধ দরজার দিকে, একবার চাহিল জানালা দিয়া খানিক তফাতে রাধাই নদীর দিকে, তারপরে দুহাত বাড়াইয়া পুতুলের মতো মাধবীলতাকে তুলিয়া লইল বুকে।
তখন অবশ্য মাধবীলতার ঘুম ভাঙিয়া গেল। কিন্তু সে কিছুই বলিল না। পুতুলটি যেন অন্য কেউ, এমনিভাবে কৌতূহলী চোখ মেলিয়া মহাপুরুষ নামে বিখ্যাত প্রৌঢ়বয়সী দৈত্যটির পুতুলখেলার মুখভঙ্গি দেখিতে লাগিল।