০১. সকালবেলাতেই মৃত্যুসংবাদ

সকালবেলাতেই মৃত্যুসংবাদ।

 

টুথব্রাশে পেস্ট মাখাচ্ছি। অস্বস্তি নিয়েই মাখাচ্ছি—কারণ কার ব্রাশ ঠিক ধরতে পারছি না। এ বাড়িতে তিনটা সাদা রঙের টুথব্রাশ আছে যার একটা আমার। সেই একটা মানে কোনটা, আমি কখনো ধরতে পারি না। বাকি দুটার মালিক আমার দুবোন। এদের চোখের দৃষ্টি ঈগলের মতো তীক্ষ্ণ–এরা দূর থেকে বলতে পারে ব্রাশটা কার। এই কারণে দাঁত মাজার পর্বটা আমি সাধারণত অতি দ্রুত সেরে ফেলি। বোনদের চোখে পড়ার আগেই। এরা বড় যন্ত্ৰণা করে।

আজ আমার পরিকল্পনা ছিল ধীরে-সুস্থে সব কাজকর্ম করা। দাঁত মাজার পর্বে মিনিট দশেক সময় দেবার কথা ভাবছিলাম। সম্ভব হল না। মীরা এসে বলল, দাদা শুনেছিস, মেজো খালু সাহেব মারা গেছেন।

আমি অসম্ভব অবাক এবং দঃখিত হবার ভাব করলাম। যেন পৃথিবীর সবচে ভয়াবহ খবর এইমাত্ৰ শুনলাম। দুঃখের ভাবটাকে আরো জোরালো করার জন্যে কিছু একটা বলা দরকার। যেমন করুণ গলায় বলা, হোয়াট এ ট্রাজেডি কিংবা কী সর্বনাশ! এই দুটার মধ্যে কোনটা বলব ভাবছি, তখন মীরা তীক্ষ্ণ গলায় বলল, তুই আবার আমার ব্রাশ দিয়ে দাঁত ঘষছিল? যেন এটাই বর্তমান সময়ের গ্রেট ট্রাজেডি। মেজো খালু সাহেবের মৃত্যুসংবাদ চাপা পড়ে গেল। আমি উদাসীন ভঙ্গিতে বললাম, এটা তোর নাকি?

ব্রাশের গায়ে M লেখা দেখছি না? গতকালও আমার ব্রাশ দিয়ে দাঁত মাজলি। এইসব কী?

গতকাল তোর ব্রাশ দিয়ে দাঁত মাজলাম, তুই বুঝলি কী করে?

সিগারেটের গন্ধ থেকে বুঝেছি। ভক ভক করে সিগারেটের গন্ধ বের হয়।

মীরার দিকে তাকিয়ে মনে হল সে কেঁদে ফেলার একটা চেষ্টা করছে। আমার দুই বোন কাঁদার ব্যাপারে খুব এক্সপার্ট। অতি তুচ্ছ কারণে এবং সম্পূর্ণ অকারণে এরা কাঁদতে পারে। গত শুক্রবারে টিভি-র একটা নাটক দেখে এরা দুজনই এমন মায়াকান্না জুড়ে দিল যে, বড় চাচা ধমক দিয়ে বললেন—এসব হচ্ছে কী? এই, টিভি বন্ধ করে দে তো। এদের নিয়ে বড় যন্ত্রণা! আসলেই বড় যন্ত্ৰণা। একই চিরুনি দিয়ে সেও মাথা আঁচড়াচ্ছে, আমিও আঁচড়াচ্ছি, তাতে দোষ হচ্ছে না। ব্রাশের বেলায় একেবারে কেঁদে ফেলতে হবে।

আমি বললাম, কাঁদছিস কেন? কেঁদে ফেলার মতো কী হল?

মীরা জবাব না দিয়ে ছুটে বের হয়ে গেল। মীরা বয়সে আমার তিন বছরের ছোট। ওর এখন একুশ চলছে। যদিও চেহারায় খুকি খুকি ভাবটা রয়ে গেছে। শুধু চেহারায় না, স্বভাবেও। একদিন বাসায় এসেছে কাঁদতে কাঁদতে, কারণ এক রিকশাওয়ালা নাকি তাকে গালি দিয়েছে। বলেছে—এই ছেমরি। এক জন রিকশাওয়ালা কী করে মীরার মতো অত্যন্ত রূপবতী মেয়েকে এই ছেমরি বলতে পারে সে এক রহস্য। রূপবতীদের গালি দেয়া বেশ কঠিন। তাছাড়া মীরা শুধু রূপবতীই নয়, বাইরের লোকজনদের সঙ্গে তার ব্যবহারও খুব ভালো। কাজের লোক, রিকশাওয়ালা এদের সবাইকে সে আপনি করে বলে। তাকে কেন রিকশাওয়ালা গালি দেবে? মীরা অবশ্যি কিছুই বলল না। সারা বিকাল ফুঁপাল।

 

নাশতার টেবিলে মা বললেন, তোর মেজো খালু মারা গেছেন, শুনেছি? আমি নিস্পৃহ গলায় বললাম, হুঁ।

দুঃখিত, ব্যথিত হবার ভঙ্গিমার সামনে করলাম না। এক বিষয় নিয়ে দুবার অভিনয় করার কোন মানে হয় না।

মা বললেন, রাত তিনটার সময় মারা গেলেন। ঘুমুচ্ছিলেন, হঠাৎ জেগে উঠে বললেন, ফরিদা, একগ্লাস পানি দাও। ফরিদা পানি এনে দিল। পানি খেয়ে বললেন, মেয়েটাকে ঘুম থেকে ডেকে তোল। ফরিদা বলল, মেয়েকে ডাকার দরকার কি? তোর মেজো খালু বললেন, শরীরটা ভালো লাগছে না। তখন তাঁর খুব ঘাম হতে লাগল। তারপর….

মা নিপুণ ভঙ্গিতে মৃত্যু-সময়কার খুঁটিনাটি ব্যাপারগুলো বলতে লাগলেন। এতসব খুঁটিনাটি তিনি কোত্থেকে জোগাড় করলেন কে জানে। আমি লক্ষ করেছি, মৃত্যু বিষয়ক খুঁটিনাটি মেয়েরা খুব আগ্রহ করে বলে।

তোর খালুর ঘাম দেখে ফরিদা বলল, এত ঘামছ কেন? গরম লাগছে? তোর খালু বললেন, একটা ভেজা ভোয়ালে দাও……..

আমি মাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, এত খবর পেলে কোথায়?

মার চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে গেল। তাঁকে কোনো প্রশ্ন করলেই তিনি মনে করেন তাঁকে বিপদে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে। তখন অসম্ভব রেগে যান। এই ভোরবেলাতেই মাকে রাগিয়ে দেবার কোনো মানে হয় না। আমি আগের প্রশ্ন ধামাচাপা দিয়ে বললাম, বেচারা অল্পবয়সে মারা গেল। তুমি যাচ্ছ ও বাড়িতে?

মা আঁৎকে উঠে বললেন, সংসার ফেলে আমি যাব কী করে—তোর ছোট চাচীর আবার ব্যথা উঠেছে।

তাই নাকি?

সারারাতই তো ব্যথায় ছটফট করল। খবর রাখিস না নাকি? হাসপাতালে নিতে হবে মনে হয়। তোর ছোট চাচা বলছিল দুপুর নাগাদ ব্যথা না কমলে হাসপাতালে নিয়ে যাবে।

আমি শুকনা গলায় বললাম—ও।

ছোট চাচীর ব্যথা হচ্ছে নিত্যদিনকার একটা ব্যাপার। এই খবরে শুকনো ও ছাড়া কিছু বলা যায় না। ছোট চাচীর ব্যথা এবং ব্যথার সঙ্গে জড়িত কুঁ কাতরধ্বনির সঙ্গে আমরা এত পরিচিত যে, এখন এসব শুনলে মুখের ভাবভঙ্গির কোন পরিবর্তন হয় না। তবে ছোট চাচীর ব্যথা আমাদের নানান সময়ে নানান উপকার করে। এই যেমন আজ করছে। মা বলতে পারছেন—ছোট চাচীর ব্যথার কারণে তিনি যেতে পারছেন না। যে সমস্ত বিয়ের দাওয়াতে আমাদের যেতে ইচ্ছে করে না আমরা খবর পাঠাইছোট চাচীকে নিয়ে যমে-মানুষে টানাটানি চলছে। কী যে অবস্থা।

সংসারে এক জন সিরিয়াস ধরনের রোগী থাকার অনেক সুবিধা। খুব কাজে লাগে। অবশ্যি ছোট চাচীর ব্যথার সমস্যা না থাকলেও যে মা মেজো খালার বাসায় যেতেন তা মনে হয় না। ফরিদা খালা মার আপন বোন না। খালাতো বোন। যাকে মা খুবই অপছন্দ করেন। শুধু মা একা না, এই মহিলাকে কেউ দেখতে পারে না। সুন্দরী এক জন মহিলা, যে খুব চমৎকার করে কথা বলে, তাকে কেন সবাই এত অপছন্দ করে কে জানে। আমার কাছে ব্যাপারটা বেশ রহস্যময়ই মনে হয়। ভদ্রমহিলার কথাবার্তা ভালো। বেশ আদুরে ভঙ্গি আছে। বাসায় গেলে প্রচুর খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করেন। তবু কেউ তাঁকে দেখতে পারে না।

আসলে অপছন্দ করা উচিত মেজো খালুকে। ভদ্রলোক দেখতে কোলা ব্যাঙের মত। মুখের হাঁ-টা অনেক বড় বলে যখনই সেন তখনই আলজিত দেখা যায়। হাসির সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রলোকের ভুড়ি লাফালাফি করে। কুৎসিত দৃশ্য। স্বভাবটাও কুৎসিত। অসম্ভব কৃপণ। আটচল্লিশ বছর বয়সেই বাড়ি-গাড়ি করে হুলস্থূল করেছেন, অথচ হাত দিয়ে একটা পয়সা বের হয় না। আমার বড় বোন ইরার বিয়েতে এসেছিলেন। খালি হাতে। অবশ্যি এসেই বললেন, জামাইয়ের জন্যে একটা স্যুটের কাপড় কিনে রেখেছি। জামাইকে একবার পাঠিয়ে দেবেন, দরজির কাছে মাপ দিয়ে আসবে। শুধু শুধু স্যুটের কাপড় দেয়ার কোন অর্থ হয় না। খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি, কাপড়ের চেয়ে দরজির খরচ বেশি।

ইরার স্বামী-বেচারা এখনো সেই স্যুট পরতে পারে নি। নতুন জামাই তো আর ঐ বাড়িতে গিয়ে বলতে পারে না-খালুজান, স্যুটের মাপ দিতে এসেছি।

আমার ধারণা, মেজো খাল স্যটের কাপড়ের কথা বলে প্রচুর বিয়ে খেয়ে বেড়াচ্ছিলেন। বেঁচে থাকলে হয়ত আরো খেতেন।

না। এক জন মৃত মানুষ সম্বন্ধে এইসব ভাবা উচিত না। ভদ্রলোকের নিশ্চয়ই অনেক ভালো গুণ ছিল, আমরা যার খবর রাখি না। এক জন মৃত মানুষ সম্পর্কে ভালো ভালো কথা ভাবা দরকার। চায়ের কাপে চিনি মেশাতে মেশাতে অনেক চেষ্টা করলাম ভদ্রলোক সম্পর্কে ভালো কিছু মনে করতে। মনে পড়ল না।

চা শেষ করে উঠতে যাব, মা বললেন, সময় করে একবার ও বাড়িতে যাস তো। কেউ না গেলে খারাপ দেখায়।

আমি বললাম, আচ্ছা। আমাদের বাড়ির সিনিয়র মানুষদের কোনো কথাতেই আমি না বলি না। এতে সবার ধারণা হয়েছে যে, আমি এক জন অত্যন্ত বিনয়ী এবং ভদ্রছেলে, তবে কিঞ্চিৎ বোকা। বোকা না হলে কেউ কি আর সব কথাতেই হ্যাঁ বলে? অবশ্যি এম্নিতেও আমি আমার বুদ্ধিমত্তার তেমন কোন প্রমাণ দেখাতে পারি না। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বি.এ পাস করে বর্তমানে নাইট সেকশনে ল পড়ছি। কেন পড়ছি নিজেও জানি না। ল পাস করে কোর্টে গিয়ে ফাটাফাটি করব এই জাতীয় দিবাস্বপ্ন আমার নেই। পড়তে হয় বলে পড়া। শুনেছি লতে ভর্তি হয়ে থাকলে দুতিন বছর পর আপনা-আপনি ডিগ্রি হয়ে যায়। সেই ভরসাতেই আছি। বাড়ির অন্যদেরও আমার ব্যাপারে তেমন কোনো আগ্রহ নেই। আমার সম্পর্কে তাঁদের মনোভাব হচ্ছেকরুক যা ইচ্ছা, কোনো ঝামেলা তো করছে না। বেচারা আছে নিজের মতো।

আমাদের বাড়ির লোকজনদের কিছু পরিচয় দেয়া মনে হয় দরকার। এ বাড়ির সবচে সিনিয়র এবং সবচে নির্বোধ ব্যক্তি হচ্ছেন আমার বড় চাচা। বয়স তেষট্টি। দৈত্যের মতো শরীর। যাকে বলে বৃষ-স্কন্ধ। এখনো নিয়ম ধরে একসারসাইজ করেন। ভোরবেলা ছোলা এবং মধু খান। রাতে ঘুমুবার আগে যোগব্যায়াম করেন। তাঁর তিন মেয়ে। তিন জনই থাকে আমেরিকায়। বিয়ে করে বাড়ি-টাড়ি বানিয়ে সুখে আছে বলা যেতে পারে। বড় চাচী গ্রিনকার্ড না কী যেন পেয়েছেন। বছরের বেশিরভাগ সময় মেয়েদের সঙ্গে থাকেন। মাঝে মাঝে দেশে আসেন।

বড় চাচা ফিলসফিতে এম.এ। অধ্যাপনা করতেন। বর্তমানে অবসর জীবনযাপন করছেন। ফিলসফি বিষয়টাতেই সম্ভবত কোনো গণ্ডগোল আছে। এই বিষয় নিয়ে বেশিদিন পড়াশোনা করলেই লোকজন খানিকটা নির্বোধ হয়ে যায় বলে আমার ধারণা। বড় চাচা যেমন হয়েছেন। তবে নিজের সম্পর্কে তাঁর ধারণা অতি উচ্চ। ভালো খাওয়াদাওয়া তাঁর খুবই পছন্দ। যদিও গত দুমাস ধরে নিরামিষ খাচ্ছেন। কোথায় নাকি পড়েছেন, নিরামিষ খেলে শরীরে ইলেকট্রিসিটি তৈরি হয়। এখন সেই চেষ্টা করছেন। আমি একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, শরীরে ইলেকট্রিসিটি হলে লাভ কী? বড় চাচা তার উত্তরে এমন দৃষ্টিতে তাকালেন যার অর্থ–এই গাধা বলে কী!

শরীরে ইলেকট্রিসিটি তৈরি করা ছাড়াও সাধু-সন্ন্যাসীর অনুসন্ধানেও তিনি। বেশকিছু সময় ব্যয় করেন।

তিন ভাইয়ের দুনম্বর হচ্ছেন আমার বাবা। রোগা-পটকা বেঁটেখাটো এক জন মানুষ। অসুখ-বিসুখ তাঁর লেগেই আছে। সম্প্রতি রাতে চোখে কম দেখছেন। বড় চাচার চেয়ে বয়সে পাঁচ বছরের ছোেট। যদিও তাঁকে বড় চাচার চেয়ে অনেক বয়স্ক মনে হয়। ব্যাংকে মাঝারি ধরনের এক জন অফিসার কথাবার্তা একবারেই বলেন না। বাড়িতে যে সময়টা থাকেন তার সবটাই কাটান খবরের কাগজ পড়ে। বাড়িতে দুটো খবরের কাগজ রাখা হয়। আমার ধারণা, এই দুটো খবরের কাগজের প্রতিটি ছাপা শব্দ তিনি তিন চারবার করে পড়েন। আমার বাবা সম্পর্কে অতি সম্প্রতি আমি একটি তথ্য আবিষ্কার করেছি। পরে তা বলা যাবে।

এ বাড়ির সবচে সুপুরুষ, সবচে স্মার্ট এবং সবচে সাকসেসফুল মানুষ হচ্ছেন আমার ছোট চাচা। চোখের ডাক্তার। ভিয়েনা থেকে আই সার্জারিতে ডিগ্রি নিয়ে এসেছেন। এসেই দুহাতে পয়সা কামাচ্ছেন। চোখ উঠা রোগ ছাড়াও যে বাংলাদেশে চোখের এত রোগ আছে আমার জানা ছিল না। আমাদের এই তিনতলা বাড়ির পুরোটাই ছোট চাচার টাকায় করা। একতলায় তিনটা ঘর নিয়ে তাঁর চেম্বার। রোগী দেখেন যে ঘরে, সে ঘরে এয়ারকুলার লাগান। ডিসটেম্পার করা নীল দেয়ালের ঠাণ্ডা ঘর। পর্দার রঙ নীল। দেয়ালে দুটি ছবি আছে। দুটির বিষয়বস্তুও নীল। একটায় নীল সমুদ্র, একটায়। নীল আকাশ। এই প্রসঙ্গে ছোট চাচার বক্তব্য হচ্ছে—আমার এখন পিকাসোর মতো রু পিরিয়ড চলছে।

ছোট চাচার বিয়ে হয়েছে পাঁচ বছর হল। মেয়েটির নাম নিনি। যে সব মেয়ের নিনি জাতীয় নাম হয় তারা সাধারণত খুব হাইফাই ধরনের হয়ে থাকে। ছোট চাচীও তাই। পুতুলের মতো সুন্দর একটা মেয়ে, যাঁর ঠোঁট দুটো লিপিষ্টিক ছাড়া লাল টুকটুকে। বিয়ের ছমাসের মধ্যেই ছোট চাচী কী রোগ বাধালেন কে জানে দিনরাত কু কুঁ। শরীরে তীব্র ব্যথা। সেই ব্যথাও বেশ অদ্ভুত ধরনের, হেঁটে চলে বেড়ায়। কখনো ব্যথাটা হাতে, কখনো পায়ে, কখনো পেটে। আমি এমন অদ্ভুত অসুখ কখনো দেখিনি, কারো হয়েছে বলেও শুনি নি। সব রকম চিকিৎসা হয়েছে, এখন চলছে দ্বৈব চিকিৎসা। ছাগলের মতো দাড়িওয়ালা এক লোক বেতের টুপি মাথায় দিয়ে প্রতি মঙ্গলবার আসছে। ছোট চাচীর ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে কী সব ঝাড়ফুক নাকি করছে। আলোচনা শুনতে পাচ্ছি চাচীকে আজমীর শরীফে নিয়ে যাওয়া হবে। মনে হচ্ছে, চিকিৎসাশাস্ত্ৰ পুরোপুরি ফেল করেছে। তবে খুব লক্ষণীয় ব্যাপার হল, এই প্ৰচণ্ড অসুখবিসুখে তাঁর চেহারা বা স্বাস্থ্যের কোনো এদিক-ওদিক হচ্ছে না। আগে যেমন ছিলেন, এখনো তেমনই আছেন। বরং ঠোঁট এবং গাল দুই-ই আরো বেশি লালচে হয়েছে।

নাশতা শেষ করে সিগারেট হাতে বারান্দায় চলে এলাম। বারান্দা হল আমার মোকিং কর্নার। বারান্দা এবং ছাদ। বেশিরভাগ লোকই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে বা বসে সিগারেট টানতে ভালবাসে, আমার ভালো লাগে হেঁটে হেঁটে টানতে। সিগারেট অবশ্যি ধরানো গেল না। জ্বলন্ত সিগারেট চট করে লুকিয়ে ফেলতে হল। কারণ বাইরের বারান্দায় ছোট চাচা বিরক্তমুখে দাঁড়িয়ে। তাঁর সামনে নার্সের পোশাক পরা মিস নমিতা (কিংবা মিস সমিতা, এই মুহূর্তে নামটা ঠিক মনে পড়ছে না।) এই নার্সটির বয়স খুবই অল্প। চেহারা ভালো না। গায়ের রঙ ঘন কৃষ্ণবর্ণ। তবু ধবধবে সাদা নার্সের পোশাকে মেয়েটিকে চমৎকার লাগে। দ্বিতীয়বার তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। মিস নমিতা (অথবা সমিতা) এই বাড়িতে মাঝে মাঝে আসেন। ছোট চাচীর খুব বাড়াবাড়ি হলে তাঁকে আনা হয়। কাল রাতে নিশ্চয়ই বাড়াবাড়ি হয়েছে বলেই তাঁকে আনা হয়েছে। নিশ্চয়ই রাত জেগেছে। ঘন ঘন হাই তুলছে। জগতের কুৎসিততম দৃশ্যের একটি হচ্ছে মেয়েদের হাই ভোলা, তবে এই মেয়েটিকে হাই তোলা অবস্থাতে তেমন খারাপ দেখাচ্ছে না।

ছোট চাচা আমাকে দেখেই বললেন, যাচ্ছিস কোথায়?

আমি বললাম, মেজো খালুর বাসায়। বেচারা মারা গেছেন। শুনেছেন বোধহয়।

হুঁ, শুনেছি। আনফরচুনেট ডেথ। আমার একবার যাওয়া উচিত। দেখি বিকেলের দিকে যদি সময় পাই। বিকেলে আবার একটা মিটিং পড়ে গেল।

ছোট চাচা কৈফিয়ৎ দেবার ভঙ্গিতে কথা বলছেন। আমার কাছে কৈফিয়ৎ দেবার তো কোন দরকার নেই, তবু দিচ্ছেন কেন কে জানে। তিনি অকারণে খানিকক্ষণ খুক খুকও করলেন। নার্ভাস হলে তিনি এটা করেন। যে কোনো কারণেই হোক তিনি আজ খানিকটা নার্ভাস। আমি বললাম, যাই চাচা। তিনি বললেন, আয়, তোক খানিকটা এগিয়ে দেই। মগবাজার চৌরাস্তা পর্যন্ত। ওখান থেকে রিকশা নিয়ে যাবি।

গাড়িতে আমরা চার জন উঠলাম। ছোট চাচা ড্রাইভিং সিটে, আমি তাঁর পাশে। পেছনের সিটে সমিতা এবং ড্রাইভার কুদুস মিয়া। ড্রাইভার কুদ্দুস মিয়া এ বাড়িতে খুব সুখের চাকরি করছে। পুরো বেতন নিচ্ছে অথচ গাড়ি চালাতে হচ্ছে না। গাড়ি সব সময় ছোট চাচাই চালান। সে স্ট্যান্ডবাই হিসেবে পেছনের সিটে বসে বসে ঝিমায়।

গাড়ি বড় রাস্তায় পড়ামাত্র ছোট চাচা বললেন, সমিতা, তুমি কোথায় নামবে?

মেয়েটার নাম তাহলে সমিতা। নমিতা নয়। সমিতা মানে কী? কে জানে।

খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার, সমিতা এই প্রশ্নের জবাব দিল না। কেন জবাব দিল না কে জানো প্রশ্ন শুনতে না পেলে ভিন্ন কথা, কিন্তু যদি শুনে থাকে তাহলে জবাব দেবে না কেন? রহস্যটা কী? শাহবাগের মোড়ে এসে ছোট চাচা গাড়ি থামিয়ে বললেন, কুদ্দস, এক প্যাকেট সিগারেট এনে দাও তো।

কুদ্দুস নেমে গেল।

কদ্দসের সঙ্গে নামল সমিতা। শীতল গলায় বলল, আমি এইখানে নামব। বলেই গট গট করে চলে গেল। সালাম দিল না বা বলল না, স্যার যাই। এর মানেটা কী? কুদ্দুস সিগারেট কিনেছে কিন্তু ভাংতি দিতে পারছে না। তার হাতে পাঁচ শ টাকার একটা নোট। নোটটা নিয়ে এ-দোকান ও-দোকান করছে।

ছোট চাচা বললেন, টুকু, একটা সমস্যা হয়েছে। তোকে বলা দরকার।

আমি বললাম, কী সমস্যা?

তিনি বেশ সহজ গলায় বললেন, এই সমিতা মেয়েটাকে আমি বিয়ে করব বলে ভাবছি।

আমি বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বললাম, কবে?

সেটা এখনো ফাইনাল করি নি। কবে বিয়ে করব সেটা ইম্পৰ্টেন্ট নয়। বিয়ে করব সেটাই ইম্পৰ্টেন্ট।

বলেই ছোট চাচা গাড়ি স্টার্ট দিলেন। কারণ কুদ্দুস টাকার ভাংতি পেয়েছে। সে সিগারেট নিয়ে ফিরছে। আমি ক্ষীণ গলায় বললাম, বাড়ির কেউ জানে?

না। আমি বলব সবাইকে। লুকিয়ে রাখার মতো তো কিছু না।

ছোট চাচার গাড়ি উড়ে চলল। তিনি আস্তে গাড়ি চালাতে পারেন না। গাড়ি হু হু করে ছুটছে। আমি বসে বসে ঘামছি। কী সর্বনাশের কথা।

 

মেজো খালুরা একটি দুতলা বাড়ির একতলায় থাকেন। বাড়ির নাম নীল কুঠির। অবশ্যি কুটির বানানটা ভুল করে লেখা কুঠীর। ভুল নামের বাড়ির দিকে তাকালেই মনে হয় এই বাড়িতে ঝামেলা আছে।

নীল কুঠির মেজো খালুর নিজের বাড়ি নয়। ভাড়া বাড়ি। উত্তর শাহজাহানপুরে তিনি চমৎকার একতলা একটা বাড়ি বানিয়েছেন। এ মাসের শেষ শুক্রবারে তাঁদের নিজ বাড়িতে উঠার কথা ছিল। মেজো খালু সে সুযোগ পেলেন না। তাঁদের বাড়ির সবাই দীর্ঘদিন এই নিয়ে বলাবলি করবে। মেজো খালুর প্রসঙ্গ উঠলেই বলবে, আহা, বেচারা নিজের বাড়িতে একরাত কাটাতে পারল না। কী ক্ষতি হতত কয়েকটা দিন পরে মারা গেলো যেন আর কটা দিন পরে মারা গেলে এই মৃত্যু সহনীয় হত।

আমি লক্ষ করেছি সব মৃত মানুষকে নিয়ে একটানা-একটা অতৃপ্তির গল্প চালু থাকে। কেউ হয়তো মৃত্যুর আগের দিন বলেছিল, মা। খুব ঝাল দিয়ে পাবদা মাছ রাধ তো। খেতে ইচ্ছা করছে। মা রাঁধেন নি। এই দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে তিনি বেঁচে আছেন। আজ তিনি শুধু পাবদা মাছ না, কোনো মাছই খেতে পারেন না।

মৃত লোকের চেয়ে তার অতৃপ্তির ব্যাপারটি প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। মৃত মানুষটির কথা কেউ বলে না। তার অপূর্ণ সাধের গল্প করে। আচ্ছা, এমন কেউ কি আছে মৃত্যু। মুহূর্তে যার কোনো অপূর্ণ সাধ ছিল না? যে যাত্রা শুরু করে একজন পরিপূর্ণ পরিতৃপ্ত এবং সুখি মানুষ হিসেবে?

আমি দাঁড়িয়ে আছি নীল কুঠিরের গেটের বাইরে। আমার মনে উচ্চ শ্রেণীর সব ভাব আসছে। গেট খুলে ভেতরে ঢুকতে ইচ্ছা করছে না। সকালের সিগারেটটি খাওয়া হয় নি। সিগারেট ধরাবার একটা চমৎকার জায়গা। সিগারেট ধরালাম। এবং সুখ কী এই নিয়ে চিন্তা শুরু করলাম। এইসব চিন্তা-ভাবনার বুদ্ধি বড় চাচার কাছ থেকে পাওয়া। তিনি আমাদের আত্মার শক্তি বৃদ্ধি করার জন্যে এ জাতীয় ট্রেনিং ছেলেবেলায় দিয়েছেন—বুঝলি, যখন কিছু করার থাকবে না তখন চিন্তা শুরু করবি। ধর, সুন্দর একটা গাছ দেখলি, তখন কী করবি? নিজেকে প্রশ্ন করবি-গাছটা সুন্দর লাগছে কেন? সৌন্দর্য ব্যাপারটা কী?

বড় চাচার ট্রেনিঙে আমাদের আত্মার শক্তির কোন ক্ষতি-বৃদ্ধি হয়েছে কি-না আমি জানি না তবে খানিকটা ভ্যাবার মতো যে হয়েছি তাতে সন্দেহ নেই।

কে, টুকু না?

ফিলসফিক চিন্তা-ভাবনা থেকে সরাসরি ধুলা-কাদার পৃথিবীতে চলে এলাম। প্রশ্নকর্তার দিকে তাকালাম। যিনি প্রশ্ন করছেন তিনি মেজো খালুর বড় ভাই। পর্যটনের বড় অফিসার। পর্যটনের অফিসাররা সব সময় খানিকটা সেজেগুজে থাকেন। তাঁদের দেখলেই মনে হয় এই বুঝি বেড়াতে যাচ্ছে। হয় পিকনিকে, নয় বিয়েবাড়িতে। এই ভদ্রলোক নিজের ছোট ভাইয়ের মৃত্যুর খবর পেয়েও লাল টকটকে একটা টাই পরে এসেছেন। জুতা যেমন চকচক করছে, তাতে মনে হয় বুট পালিশওয়ালাকে দিয়ে পালিশ করানো। তিনি বিরক্ত মুখে বললেন, এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ভেতরে যা। এঁর সঙ্গে আমার এমন কোনো ঘনিষ্ঠতা নেই যে তিনি আমাকে তুই তুই করে বলবেন। আমি লক্ষ করেছি, আমার সমস্ত আত্মীয়স্বজন (নিকট কি দূরের) আমাকে তুই তুই করে বলেন এবং দেখা হওয়ামাত্র কোন একটা ফরমায়েস দিয়ে বসেন। সম্ভবত আমার চেহারায় চাকর চাকর একটা ভাব আছে।

মেজো খালুর বড় ভাই পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে সরু চোখে আমার দিকে তাকালেন। আমি পুরোপুরি নিশ্চিত, তিনি এখন বলবেন—চট করে এক প্যাকেট বেনসন নিয়ে আয় তো দেখবি যেন ড্যাম্প না হয়। সত্যি সত্যি ভদ্রলোক একটা এক শ টাকার নোট বের করে ইতস্তত করতে লাগলেন। আমি বললাম, কিছু আনতে হবে?

তিনি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। খুশি খুশি গলায় বললেন, তিন কেজি চিনি নিয়ে আয় তো। ঘরে এক দানা চিনি নেই, এদিকে লোকজন যারা আসছে, তাদের এটলিস্ট এককাপ চা তো অফার করা দরকার। এর নাম সামাজিকতা। মরেও রক্ষা নেই, সামাজিকতা চালিয়ে যেতে হবে। হোয়াট এ সোসাইটি।

তিন কেজি চিনি কিনলাম। পঁয়ত্রিশ টাকা করে তিন কেজির দাম নিল এক শ পাঁচ টাকা। আমি দোকানদারকে বললাম, আমার কাছে এক শ টাকাই আছে। আপনি কি পাঁচটা টাকা কম রাখতে পারেন?

দোকানদার বলল, একদাম। এমনভাবে বলল যাতে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, পাঁচ টাকা কমানোর প্রস্তাবে সে খুবই অপমানিত বোধ করছে। আমি বললাম, আপনি এক কাজ করুন, এখান থেকে পাঁচ টাকার চিনি কমিয়ে ফেলুন। দুই খাবলা চিনি নিয়ে নিন। দোকানদার মনে হল এতে আরো অপমানিত বোধ করল। এক ধরনের মানুষই আছে যারা কথায় কথায় অপমানিত বোধ করে। এদের যদি জিজ্ঞাসা করা হয়—ভাই কেমন আছেন? এরা অপমানে নীল হয়ে যায়। মনে করে, তাদের দারুণ অপমান করা হল। এই দোকানদার বোধহয় সেই পদের। সে চিনি কমাল না। প্যাকেট আমার দিকে বাড়িয়ে মুখঝামটার মতো একটা ব্যাপার করল। যেন তার পাঁচ লক্ষ টাকা লোকসান হয়ে গেছে। আমি মনে মনে হারামজাদা বলে বের হয়ে এলাম।

মা-বাড়ির দৃশ্য সচরাচর যা হয়, এ বাড়িতেও তাই। মেজো খালা কাত হয়ে একটা ইজিচেয়ারে পড়ে আছেন। তাঁর মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে, তবু একজন কে যেন প্রবল বেগে তালপাতার পাখায় তাকে বাতাস করছে। খালার মাথার সমস্ত চুল ভেজা। মনে হয় কিছুক্ষণ আগেই মাথা ধুইয়ে দেয়া হয়েছে। পরিচিত যে-ই আসছে, খালা খানিকক্ষণ তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন এবং বলছেন, আমি সহ্য করতে পারছি না। তোমরা আমাকে বিষ এনে দাও। আমি সহ্য করতে পারছি না।

আমার চট করে মনে হল খালাকে খানিকটা বিষ সত্যি সত্যি যদি এখন দেয়া হয় এবং বলা হয়—এই যে বিষ এনেছি, নিন। তাহলে ব্যাপারটা কেমন হবে? খালা এই মুহূর্তে প্রবল শোকের যে ছবি দেখাচ্ছেন তার কতটা খাঁটি? আমি নিশ্চিত, মাসখানিকের মধ্যে তিনি পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে যাবেন। ভিসিআর-এ ছবি দেখবেন। দুপুরে ঘুবেন। তরকারিতে লবণ কম হলে কাজের মেয়েটিকে বকাঝকা করবেন।

আমি তিন কেজি চিনির প্যাকেট নিয়ে খানিকটা দিশাহারার মত হয়ে গেলাম। কাকে দেব? বাড়ি গিজ গিজ করছে মানুষে। সবাই কথা বলছে। মেয়ে মহলের তিনভাগের একভাগ শব্দ করে কাঁদছে। কয়েকজন মৌলানাকে আনা হয়েছে, যারা অতি দ্রুত কোরান খতম দিচ্ছেন। থার্টি থ্রি আরপিএম-এর রেকর্ড ফোৰ্টি ফাইভে দেয়া। হয়েছে। এই বিরাট ঝামেলায় তিন কেজির প্যাকেট দেব কাকে?

খালুর বড় ভাইকে পাওয়া গেল। তিনি লাল টাই খুলে ফেলেছেন। তাঁকে সম্পূর্ণ অন্য রকম দেখাচ্ছে। সামান্য একটা টাই যে মানুষকে এতটা বদলে দিতে পারে, আমার জানা ছিল না। লাল রঙের কাপড়ের টুকরাটার উপর আমার ভক্তি হল।

চিনি এনেছ টুকু?

জ্বি।

গুড। মেনি থেংকস। ফেরত এসেছে কত?

ফেরত আসে নি। পঁয়ত্রিশ টাকা করে কেজি।

কি বলছ তুমি। ত্রিশ টাকা কেজি সব জায়গায়। দশ টাকা ফেরত আসার কথা!

ভদ্রলোক বিচিত্র দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। যে দৃষ্টির অর্থ হচ্ছে–দশটা টাকা তুমি ম্যানেজ করে নিলে এটা তো তোমার কাছ থেকে আশা করি নি।

তিনি বিরস মুখে বললেন, টেবিলের উপর রেখে দাও। আমি টেবিলের উপর প্যাকেটটা রাখলাম। ছোট একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বারান্দায় চলে এলাম। বারান্দায় মেজো খালাকে আনা হয়েছে। মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে। সম্ভবত অজ্ঞান হয়ে গেছেন। মেজো খালার অজ্ঞান হওয়া তেমন কোনো বিশেষ ব্যাপার না। অতি সামান্য ব্যাপারেই তিনি অজ্ঞান হন। আমাদের বাসায় এসে একবার তিনি গরমে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পানি ঢালার পর তাঁর জ্ঞান হল এবং তিনি বললেন, এয়ারকন্ডিশন ঘরে থেকে থেকে শরীরের সিস্টেমটাই নষ্ট হয়েছে। ঐ দিন গাউছিয়ায় গিয়েছিলাম, গরমে আর ভিড়ে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলাম। এক শাড়ির দোকানে নিয়ে শোয়াল। বিশ্রী কাণ্ডআমার হোট বোন মীরার ধারণা, মেজো খালার অজ্ঞানের ব্যাপারটা চমৎকার একটা অভিনয়-কলা। দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে এই অভিনয় তিনি প্রায় জায়গাতেই করেন এবং বেশ ভালোই করেন। এখানেও তাই বোধহয় হচ্ছে। মেজো খালার মাথায় পানি ঢালছে তাঁদের একমাত্র মেয়ে রিমি। রিমি তার মায়ের মতো রূপবতী হয় নি। খুবই সাদামাঠা ধরনের চেহারা, তবে এই মেয়েকে দেখলেই মনে একটা স্নিগ্ধ ভাব হয়। মনে হয় সে এইমাত্ৰ স্নান সেরে এসেছে। তার গলার স্বরও বেশ অদ্ভুত। যখন কথা বলে তখন মনে হয় অনেক দূর থেকে কথা বলছে। খুব কাছাকাছি থাকলেও তার গলার স্বরের জন্যে তাকে খুব দূরের মানুষ বলে মনে হয়। রিমি আমার সমবয়েসী। বয়সে আমার তিন মাসের বড়। সে ইউনিভার্সিটিতে সেকেন্ড ইয়ার অনার্স ফাইনাল দেবে। যদিও তার থাকার কথা এম. এ ক্লাসে। সেশন জট সব গুবলেট করে ফেলেছে। মেজো খালা চোখ খুললেন। রিমি পানি ঢালা বন্ধ করে উঠে এল। আমার সামনে এসে থমকে দাঁড়াল। নিচু গলায় বলল, টুকু, আমার সঙ্গে একটু আয় তো।

রিমির সঙ্গে আমার সম্পর্কে খানিকটা জটিলতা আছে। এই জটিলতার ব্যাপারটা পরে বলব।

রিমি আমাকে তার ঘরে নিয়ে এল। ঘরে ঢুকিয়েই দরজা ভিড়িয়ে দিল। এটা সে সব সময় করে। আমার সঙ্গে কথা বলার সময় হয় দরজা ভিড়িয়ে দেয়, নয় ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়। মেজো খালা এই ব্যাপারটা সঙ্গত কারণেই খুব অপছন্দ করেন। মেয়ের সঙ্গে এই নিয়ে তার কথা কাটাকাটিও হয়েছে। খালা অপছন্দ করেন বলেই রিমি এই কাজটা বেশি বেশি করে।

টুকু, চেয়ার টেনে বস।

আমি বসলাম। রিমি বলল, অসম্ভব কান্না পাচ্ছে। আমি এখন চিৎকার করে কাঁদব। তুই চুপচাপ বসে থাকবি।

আমি কিছু বললাম না। বসে রইলাম। রিমিকে দেখলে মনে হয় সে খুব গোছালো ধরনের মেয়ে। আসলে তা নয়। তার ঘর সব সময়ই এলোমেলো। রিমি কাঁদল না। আমি জানতাম সে কাঁদবে না। আমি এখন কাঁদব বলার পর কেউ কাঁদতে পারে না।

টুকু।

কি।

মার সঙ্গে বিয়ে না হয়ে অন্য যে কোনো একটা মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হলে বাবা আরো অনেক দিন বাচত।

এখন এসব কথা থাক।

আমি এই কথা শুধু আজই বলব, আর কোনোদিন বলব না। আর বলব শুধু তোকে, আর কাউকে না।

আমাকে বলার কোনো প্ৰয়োজন দেখছি না।

কথা বলিস না। তুই শুধু শোনে যা। হা হু কিছু করতে হবে না। শুধু শুনে যাবি আমার মা, বাবার জীবনটা একেবারে ভাজা ভাজা করে ফেলেছে। আমি যখন কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি, তখনকার একটা ঘটনা বললেই তুই সবটা বুঝতে পারবি।

আমার বুঝে দরকারটা কি?

কেন শুধু কথা বলছিস? শুনতে অসুবিধা কি? আমি যখন সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি, মরিয়ম নামের অল্পবয়েসী একটা কাজের মেয়ে ছিল। মেয়েটা দেখতে বেশ ভালো। একদিন রাতে আমরা সবাই খেতে বসেছি, বাবা বললেন, মরিয়ম, ফ্রিজ থেকে খুব ঠাণ্ডা একগ্লাস পানি দাও তো।

মা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, সব কাজের লোককে তুমি তুই তুই করে বল; মরিয়মকে তুমি করে বলছ কেন?

বাবা বিব্রত সুরে কী যেন বললেন। মা কঠিন গলায় বললেন, ওর সঙ্গে এত কী তোমার খাতির?

খাতিরের কী দেখলে?

ঐ দিন দেয়াশলাইয়ের খোঁজে তুমি রান্নাঘরে গেলে। দেয়াশলাইয়ের জন্যে কেন? দেয়াশলাই আনতে বললে কি ওরা এনে দিত না?

মেয়ের সামনে কী সব পাগলামি শুরু করলে?

সত্যি কথা বললে পাগলামি হয়ে যায়? তুমি আমাকে কী ভাব? আমি চোখেও দেখি না, কানেও শুনি না? তোমার ফষ্টিনষ্টি, ছোঁক ছোঁক আমি বুঝি না? আমি এখনও ফিডার দিয়ে দুধ খাই?

বাবা খাওয়া রেখে উঠে চলে গেল। ঘটনা এখানেও শেষ হল না। মা মরিয়মকে ডেকে শোবার ঘরে নিয়ে গেলেন। বাবা বিছানায় শুয়ে ছিলেন। ধড়মড় করে উঠে বসলেন। মা মরিয়মকে ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে দিয়ে বললেন, এইবার মনের সাধ মিটিয়ে ফষ্টিনষ্টি কর। এই বলেই তিনি ঘর থেকে বের হয়ে এসে ঘরে তালা লাগিয়ে দিলেন। পুরো ব্যাপারটা ঘটল আমার চোখের সামনে।

রিমি কাঁদতে শুরু করল। সে চিৎকার করে কাঁদবে বলেছিল। সত্যি সত্যি সে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল।

সে কাঁদবে না—আমার এই ধারণা ঠিক হল না। যতটুকু অবাক হবার দরকার আমি তার চেয়েও বেশি অবাক হলাম। আমার নিজের ধারণার বাইরে যখন কিছু ঘটে, তখন খুব অবাক হই। কারণ সচরাচর তেমন ঘটে না।

ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে একটি মেয়ে কাঁদছে—এই দৃশ্য চুপচাপ দেখা যায় না। আমি তাকে সান্ত্বনা দেবার জন্যে মাথায় হাত দিতেই সে ঝটকা মেরে হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, গায়ে হাত দিচ্ছিস কেন স্টুপিড? মেয়েদের গায়ে হাত দিতে ভাল লাগে?

খালার বাড়িতে অল্পকিছু সময় থাকব বলে এসেছিলাম। থাকতে হল রাত দশটা পর্যন্ত। মরা-বাড়ির শতেক ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে হল। ট্রাক আনা, গোরস্থানে খোঁজখবর করা।

এর মধ্যে একবার মেজো খালুর বড় ভাই আবার একটা এক শ টাকার নোট দিয়ে বললেন, টুকু, চট করে এক প্যাকেট বিদেশি ফাইভ ফাইভ নিয়ে আয় তো।

আমি উদাস গলায় বললাম, আমাকে দোকানদাররা খুব ঠকায়, পাঁচ দশ টাকা। বেশি নেবে, অন্য কাউকে দিয়ে আনালে হয় না?

আর কাউকে দেখছি না। তুই কাইন্ডলি যা।

আমি চকচকে এক শ টাকার নোটটা নিয়ে বের হয়ে এলাম। মনে হল আর ফিরে না গেলে কেমন হয়? ব্যাটাকে সামান্য শিক্ষা দেয়া। সে অপেক্ষা করে করে বিরক্ত হবে। টাকা যাওয়ার শোকে পাথর হয়ে যাবে। হোক। অবশ্যি আমার কপালে চোর অপবাদ জুটবে। জুটুক। কী আর করা। বড় রাস্তার মোড় পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরে এলাম। এতক্ষণ যখন ছিলাম, মৃত মানুষটাকে কবরে শোয়ানো পর্যন্ত থেকে যাই। আমি সিগারেটের বদলে তিন কেজি চিনি কিনে ফেললাম।

কই, সিগারেট এনেছ? দাও।

আমি বিস্মিত হবার ভঙ্গি করে বললাম, সিগারেট আনতে বলেছিলেন না কি? মাই গড। আমি তো আবার তিন কেজি চিনি নিয়ে এসেছি।

মেজো খালুর সাজুগুজু করা ভাই হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রইলেন। পরিষ্কার বুঝতে পারছি, রাগে তাঁর পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে।

আমি বদলে নিয়ে আসছি। আপনি চিন্তা করবেনো। ঐ দোকানেসিগারেটও আছে। ইন দি মিন টাইম আপনার যদি খুব সিগারেটের তৃষ্ণা হয় আমার কাছ থেকে একটা নিয়ে খেতে পারেন।

তুমি বদলে নিয়ে এস।

জ্বি আচ্ছা।

আমি ঠিক করে ফেললাম আধঘণ্টার মতো হাঁটাহাঁটি করে ফিরে যাব। খুব ভালোমানুষের মতো গলায় বলব, ফেরত নিল না। অনেক চেষ্টা করেছি। সোসাইটিটা নষ্ট হয়ে গেছে। কাউকেই বিশ্বাস করা যায় না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *