অধ্যায় ১
সংঘাতের ভিত্তি
ধর্ম ও বিজ্ঞান সমাজজীবনের দুটো দৃষ্টিকোণ। এর মধ্যে প্রথমটি গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রাচীন সময়ের নিরিখে। এই প্রাচীন সময়টা সে-সময় যখন থেকে আমরা মানুষের মানসিক ইতিহাসের খবর রাখছি। অন্যটির শুরু গ্রীক এবং আরবদের মধ্যে বিজ্ঞানের ঝলক দিয়ে। বিজ্ঞানের এই ঝলক হঠাৎ ষোলো শতকে গুরুত্ব পেয়ে যায়। এটা এখন আমাদের ধ্যান-ধারণা প্রভাবিত করছে। প্রভাবিত করে চলেছে সেই সব প্রতিষ্ঠানকে যেগুলোর সঙ্গে আমরা যুক্ত রয়েছি। ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে সুদীর্ঘ সংঘাত চলছে। এ-সংঘাতে গত কয়েক বছর ধরে বিজ্ঞান অনিবার্যভাবে জয়ী হয়েছে। কিন্তু রাশিয়া এবং জার্মানিতে নতুন ধর্মের উত্থানে এই বিষয়টা আর আগের মতো নেই। এই নতুন ধর্মের পিছনে বিজ্ঞান-প্রদত্ত মিশনারী কার্যাবলীর প্রাধান্য। এর ফলে বিজ্ঞানের বিজয়ের বিষয়টাকে পুনরায় সংশয়ের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। যেমনটা হয়েছিল বিজ্ঞানের ঐতিহাসিক কাল শুরুর সময়ে। এই কারণে সংঘাতের ভিত্তি এবং চিরাচরিত ধর্ম কর্তৃক শুরু-করা যুদ্ধের ইতিহাসটাকে আর একবার বুঝে নেবার গুরুত্ব বেড়েছে।
বিজ্ঞান হলো পর্যবেক্ষণজাত আবিষ্কারের প্রচেষ্টা। এই পর্যবেক্ষণ যুক্তিবিচারের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। যুক্তিগুলো এমন, প্রথমে বিশ্ব সম্পর্কে নির্দিষ্ট ঘটনা জানা। এরপর একটা ঘটনার সঙ্গে অন্য একটা ঘটনার নিয়মসূত্র বুঝে নেওয়া। এই বোধ থেকে ভবিষ্যৎ সংঘটনের আগাম ঘোষণা রাখা। বিজ্ঞানের এই তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণের সঙ্গে যুক্ত থাকে বিজ্ঞানের প্রয়োগগত দিক। এই দিকটা বৈজ্ঞানিক জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে আরাম ও বিলাসিতার ব্যবস্থা করে। প্রাক্-বিজ্ঞানের আগের সময়ে এসব বাস্তবে অসম্ভব ছিল। কঠিন চেষ্টায় এর কিছু ব্যবস্থা করা সম্ভব হলেও সেটা ছিল অঢেল খরচসাপেক্ষ। ফলে এই আরাম ও বিলাসিতার দিকটা বিজ্ঞানকে বিশাল গুরুত্ব প্রদান করেছে। যারা বিজ্ঞানী নন, এই গুরুত্বটা বুঝেছেন তারাও। সামাজিক বিবেচনায় ধর্ম বিজ্ঞানের চেয়ে একটি অধিকতর জটিল বিষয়। প্রতিটি বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ধর্মের তিনটি উপাদান রয়েছে। এক, একটা গীর্জা। দুই, ধর্মবিশ্বাসের একটি সূত্রাবলী। তিন, ব্যক্তিগত নৈতিকতার একটি সংহিতা। আপেক্ষিক গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয় তিনটি বিভিন্ন সময় ও স্থানসাপেক্ষে খুবই ভিন্ন ভিন্ন ধরনের হয়েছে। গ্রীস এবং রোমের প্রাচীন ধর্মকে স্টোইকদের(১) দ্বারা নৈতিক করে না তোলা পর্যন্ত ব্যক্তি নৈতিকতার বিষয়ে এই দুই ধর্মের বেশি কিছু বলার ছিল না। ইসলামের জাগতিক রাজাধিরাজের তুলনায় গীর্জা গুরুত্বহীন। আধুনিক প্রোটেস্টান্ট মতবাদে ধর্মবিশ্বাসের কঠোর অনমনীয়তাকে শিথিল করার ঝোঁক দেখা গেছে। সে যাই হোক, এই তিনটি উপাদানের তারতম্য সত্ত্বেও সামাজিক ঘটনার হিসাবে ধর্মে এসব উপাদানসমূহ থাকা আবশ্যিক। আর এখানেই বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্মের সংঘাত। একটি পুরোপুরি ব্যক্তি বিশ্বাসের ধর্মজাত সুস্পষ্ট ঘোষণাকেও বিজ্ঞান অপ্রমাণ করতে পারে। তবুও এই ধরনের ঘোষণাজাত বিশ্বাস সুদৃঢ় বৈজ্ঞানিক যুগেও টিকে থাকতে পারে।
ধর্মবিশ্বাস হলো ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে বৌদ্ধিক সংঘাতের উৎস। কিন্তু সংঘাতের তিক্ততার কারণ ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে গীর্জা এবং নৈতিক সংহিতার সম্পর্ক। যারা ধর্মবিশ্বাসকে প্রশ্ন করেছেন তারা গীর্জার কর্তৃত্বকে দুর্বল করেছেন। এতে গীর্জার মানুষদের আয়ে টান পড়েছে। অধিকন্তু, এই প্রশ্নকারীদের নৈতিকতা বিনষ্টকারী হিসাবে ভাবা হয়েছে। কারণ ধর্মবিশ্বাস থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নৈতিক কাজকর্ম করেছেন গীর্জার ব্যক্তিবর্গ। সুতরাং বিজ্ঞানপন্থীদের বৈপ্লবিক শিক্ষায় ধর্মনিরপেক্ষ শাসকগণ এবং গীর্জার ব্যক্তিবর্গের আতঙ্কিত হবার যথেষ্ট কারণ ছিল।
যাই হোক, আমরা সাধারণভাবে বিজ্ঞান, এমনকি সাধারণভাবে ধর্মের বিষয় আশয় নিয়েও এখানে আলোচনা করব না। আমরা কথা বলব সেইসব বিষয় নিয়ে যেগুলো অতীতে এবং বর্তমান সময়েও উভয়ের মধ্যে সংঘাতের কারণ হয়েছে। এ ব্যাপারে খ্রিষ্টজগৎ যতটা সংশ্লিষ্ট তাতে বলা যায় যে, এই সংঘাত দু’ধরনের। কখনও কখনও বাইবেলের মূল রচনা কোনো ঘটনার বিষয়গত ঘোষণা রাখে। উদাহরণে বলা যায়, বাইবেলের এই ঘটনার কথা যেখানে বলা হয়েছে, খরগোশ জাবর কাটে। এই ঘোষণা বিজ্ঞান যখন পর্যবেক্ষণের পথে বাতিল করে তখনই বিশ্বাসীর মনে সমস্যা তৈরি হয়। কারণ বেশির ভাগ খ্রিষ্টান বিশ্বাস করতেন যে, বাইবেলের প্রতিটি শব্দ ঐশ্বরিকভাবে অনুপ্রাণিত। এই বিশ্বাসে তারা দৃঢ় থাকতেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না বিজ্ঞান তাঁদের অন্যভাবে বিশ্বাস করতে বাধ্য করত। বাইবেলের সংশ্লিষ্ট ঘোষণা যার কোনো অন্তর্নিহিত ধর্মীয় গুরুত্ব নেই সেগুলোর ব্যাখ্যা দেওয়া অসুবিধাজনক নয়।
অথবা এই সিদ্ধান্তের কথা বলেও বিতর্ক এড়ানো যায় যে, বাইবেল হলো কেবলমাত্র ধর্মীয় ও নৈতিক বিষয়ের ব্যাপারে কর্তৃত্বসম্পন্ন। কিন্তু প্রবল সংঘাত তখনই দেখা দেবে যখন বিজ্ঞান কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ খ্রিষ্টীয় অনুশাসন অথবা কতিপয় দার্শনিক মতবাদ নিয়ে বিতর্কে যাবে। কারণ এইসব অনুশাসন ও দার্শনিক মতবাদকে ধর্মতাত্ত্বিকগণ সনাতন বিশ্বাসের পক্ষে প্রয়োজনীয় বলে মনে করেন। বিশদভাবে বলতে গেলে, প্রথম দিকে ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে সংঘাতটা ছিল কোনো ঘটনা বিষয়গত ঘোষণার যৌক্তিকতা নিয়ে। পরে এই সংঘাত খ্রিষ্টান ধর্মশিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়ল। বর্তমান সময়ের ধর্মবাদী নারী-পুরুষ এমন অনুভবে পৌঁছেছেন যে, মধ্যযুগের খ্রিষ্টজগতের বহু ধর্মমত এখন অপ্রয়োজনীয়। বস্তুত ধর্মীয় জীবনের পথে একটা বাধা। কিন্তু বিজ্ঞান যে-বিরোধিতার মোকাবিলা করেছে সেটা আমাদের বুঝতে হবে। এটা বুঝতে হলে অবশ্যই আমাদের ধারণার পদ্ধতির মধ্যে ঢুকতে হবে যা এই বিরোধিতাকে দৃশ্যত যুক্তিগ্রাহ্য করেছে। ধরা যাক, একজন ব্যক্তি জনৈক পাদরিকে প্রশ্ন করলেন, কেন তার খুন করা অনুচিত। পাদরির উত্তর, কারণ তোমার ফাঁসি হবে। এই উত্তরটা অপর্যাপ্ত মনে হবে দুটো কারণে। প্রথমত, ফাঁসি দিতে হলে তার সংগত কারণটা জানতে হবে।
দ্বিতীয়ত, পুলিশি ব্যবস্থাটা এতটাই অনিশ্চিত যে, বহুসংখ্যক খুনি দিব্যি শাস্তি এড়াতে পারে। বিজ্ঞানের আবির্ভাবের আগে অন্য একটা উত্তর সবার কাছেই সন্তোষজনক মনে হত। সে-উত্তরের কথা, খুন করাটা ‘টেন কম্যান্ডমেন্টে নিষিদ্ধ। এই ‘টেন কম্যান্ডমেন্ট সিনাই পাহাড়ে ঈশ্বর কর্তৃক মোজেসের প্রতি উদ্ঘাটিত হয়েছিল। যে-অপরাধী পার্থিব বিচার এড়িয়ে গেল সেও কিন্তু ঈশ্বরিক রোষ থেকে রেহাই পাবে না। এই রোষ এই নির্দেশ দিয়েছে যে, অনুতাপহীন খুনিরা ফাঁসির চেয়েও ভয়ঙ্কর শাস্তি অনন্তকাল ধরে পেতে থাকবে। এই যুক্তিটা অবশ্য বাইবেল-কর্তৃত্বের উপর নির্ভরশীল। এটা যথাযথ রক্ষিত হতে পারে যদি বাইবেলকে সামগ্রিকভাবে গ্রহণ করা হয়। বাইবেল যখন বলে যে, পৃথিবী ঘোরে না, তখন কিন্তু গ্যালিলিওর যুক্তি সত্ত্বেও বাইবেলের ঘোষণাতে অবশ্যই বিশ্বস্ত থাকতে হয়। অন্যথা করলে খুনিদের এবং অন্যান্য দুষ্কৃতকারীদের উৎসাহ দিতে হয়।
যদিও এখন অল্প সংখ্যক মানুষও এই যুক্তি গ্রহণ করবেন না তবুও একে অবাস্তব বলে বিবেচনা করা যাবে না। এবং যারা এই যুক্তির পথে কাজ করেছে তাদেরও নৈতিকভাবে নিন্দা করা যাবে না।
শিক্ষিত মানুষের মধ্যযুগীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে একটা যুক্তিসিদ্ধ ঐক্য ছিল। সেটা এখন হারিয়ে গেছে। আমরা টমসা অ্যাকুইনকে(২) সেই ধর্মমতের কর্তৃত্বপূর্ণ প্রবক্তা হিসাবে ভাবতে পারি, যার ধর্মমতকে বিজ্ঞান আক্রমণ করতে বাধ্য হয়েছিল। তিনি মনে করতেন খ্রিষ্টধর্মের কতিপয় মৌলিক সত্যকে সমর্থনহীন যুক্তি দ্বারা প্রমাণ করা যায়। এ প্রমাণে উদ্বাটনের ঘটনারও সাহায্যেও নিতে হয় না। বলা বাহুল্য, রোমান ক্যাথলিক চার্চ আজও এই মতের অনুসারী। এসবের মধ্যে একটি হলো সর্বশক্তিমান এবং কল্যাণময় স্রষ্টার অস্তিত্ব। তার অসীম ক্ষমতা এবং হিতৈষণার জন্যই তিনি তাঁর সৃষ্ট জীবনের তাঁর ঈশ্বরিক বিধানের জ্ঞানহীন অবস্থায় রাখতে পারেন না। তাঁর অভিলাষকে মান্যতা দেবার জন্য প্রয়োজনীয় মাত্রায় এই জ্ঞান থাকতে হবে সৃষ্ট জীবদের। সুতরাং একটি স্বর্গীয় উদ্ঘাটনের বিষয় অবশ্যই থাকতে হবে। এই বিষয়টি স্পষ্টতই বাইবেলে এবং গীর্জার সিদ্ধান্তের মধ্যেও রয়েছে। এই বিষয়টা প্রতিষ্ঠিত হলে আমাদের আর যা যা জানতে হবে সে-সবের ধারণা পাওয়া যাবে ধর্মগ্রন্থ এবং খ্রিষ্টজগতের গীর্জা পরিষদের ঘোষণা থেকে। এখানে গোটা যুক্তিটা হেতুবাক্য থেকে অবরোহত(৩) পদ্ধতিতে এগোয়। খ্রিষ্ট দেশগুলোর প্রায় সব মানুষ এই হেতুবাক্য আগেই গ্রহণ করে বসে আছেন। এই যুক্তিটা আধুনিক পাঠকদের কাছে কখনো-সখনো ত্রুটিপূর্ণ মনে হতে পারে। তবুও এই যুক্তির ভ্রান্তিটা সম-সাময়িক সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষিত মানুষের কাছে স্পষ্ট নয়।
এখন যুক্তিগ্রাহ্য একতা একই সময়ে একটা শক্তি এবং একটা দুর্বলতা। এটা শক্তি এই কারণে যে, যিনি যুক্তির একটা ধাপ গ্রহণ করবেন তাকে অবশ্যই পরের ধাপগুলোও গ্রহণ করতে হবে। এটার দুর্বলতার কারণ হলো এই যে, যিনি পরের ধাপের যে-কোনো একটা যুক্তি বর্জন করবেন, তাঁকে আগের যুক্তিসমূহের অন্তত কতিপয় আবশ্যিকভাবে বর্জন করতে হবে। গীর্জা তাই বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ক্ষেত্রে একইসাথে শক্তি এবং দুর্বলতা দেখিয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে গীর্জার অনুশাসনের যুক্তিগ্রাহ্য সংলগ্নতা থেকে। যে-পথে বিজ্ঞান তার বিশ্বাসে পৌঁছোয় সেটা মধ্যযুগীয় ধর্মতত্ত্বীয় বিশ্বাস থেকে পুরোপুরি আলাদা। অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে যে, সাধারণ নীতি থেকে শুরু করে অবরোহ পদ্ধতিতে এগোনোটা বিপজ্জনক।
বিপদটা উভয় দিকের। কারণ নীতিগুলো অসত্য হতে পারে। এবং এই নীতিগুলোর ওপর দাঁড়িয়ে যুক্তিবিন্যাস ভ্রান্ত হতে পারে। বিজ্ঞান বড়ো ধরনের ধরে-নেওয়া মত থেকে শুরু করে না। সে শুরু করে নির্দিষ্ট ঘটনা থেকে। এই ঘটনাগুলোর পর্যবেক্ষণ অথবা পরীক্ষণ থেকে পাওয়া এ-ধরনের কতিপয় ঘটনা থেকে সাধারণ নিয়মে পৌঁছোয় বিজ্ঞান। এটাও ঠিক যে, আলোচিত ঘটনাগুলো হলো দৃষ্টান্ত। এই নিয়মটা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করা হয় না। কিন্তু এটা কাজ করার একটা প্রকল্প হিসেবে গ্রহণ করা হয় মাত্র। এটা যদি সত্য হয়, তাহলে এখনও অদেখা কতিপয় ঘটনা কোনো কোনো পরিস্থিতিতে ঘটবে। যদি দেখা যায় যে, এগুলো অবশ্যই ঘটছে তাহলে প্রকল্পটি প্রতিষ্ঠিত হয়। না ঘটলে প্রকল্পটি পরিত্যক্ত হয়। এবং একটি নতুন প্রকল্প অবশ্যই আবিষ্কার করতে হয়। যাই হোক, অনেক ঘটনাই প্রকল্পের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এতে অবশ্য এটা বলা যায় না যে, প্রকল্পটা সুনিশ্চিত হলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই প্রকল্পকে খুবই সম্ভাবনাপূর্ণ বলে মনে করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে এটাকে আর প্রকল্প না বলে আমরা তত্ত্ব বলতে পারি। নানা ধরনের তত্ত্ব যার প্রতিটি প্রত্যক্ষভাবে ঘটনার উপর দাঁড়াতে পারে এমন হলে এগুলো নতুন এবং আরও সাধারণ প্রকল্পের ভিত্তি হতে পারে। এগুলো সত্য হলে এভাবে আরও এগোনো যায়। এবং এই সাধারণীকরণের প্রক্রিয়াগুলোকে সীমিত করা যায় না। কিন্তু মধ্যযুগীয় চিন্তা-চেতনার সাধারণ নীতিগুলোই ছিল শুরু করার বিষয়। বিজ্ঞানে কিন্তু সাধারণ নীতি হলো শেষ সিদ্ধান্ত। শেষ সিদ্ধান্ত বলতে একটা নির্দিষ্ট সময়ের সিদ্ধান্ত। পরবর্তী ধাপে এইসব সিদ্ধান্ত দৃষ্টান্ত হিসাবে ধরা হবে অন্য কোনো আরও বৃহত্তর নিয়মের ক্ষেত্রে।
একটা ধর্মমত বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব থেকে আলাদা। এই ভিন্নতা তৈরি হয় ধর্মতত্ত্বের চিরন্তন এবং চরম সত্যকে স্পষ্টরূপে প্রকাশের দাবিতে। পক্ষান্তরে, বিজ্ঞান সর্বদা পরীক্ষণমূলক। বিজ্ঞানের প্রত্যাশা এই যে, আজ কিংবা কাল এর বর্তমান তত্ত্বের রূপান্তর প্রয়োজন হতে পারে। বিজ্ঞান এ-সম্পর্কেও সচেতন যে, এর পদ্ধতিটা যৌক্তিকভাবে একটা পরিপূর্ণ এবং চূড়ান্ত প্রমাণে পৌঁছতে সক্ষম। কিন্তু এগিয়ে-থাকা বিজ্ঞানে প্রয়োজনীয় পরিবর্তনগুলো এমন যা আর একটু বেশি অভ্রান্ততার দিকে নিয়ে যাবে। অবশ্য পুরানো তত্ত্বগুলো প্রাথমিক মূল্যায়নের কাজে লাগাবে। নতুন পর্যবেক্ষণের সূক্ষ্মতার সম্ভাব্য ক্ষেত্রে পুরানো তত্ত্ব আর কাজে লাগানো যাবে না। অধিকন্তু, পুরানো তত্ত্বের নির্দেশে প্রায়োগিক আবিষ্কার নিদর্শন হিসাবে থাকতে পারে। এই নিদর্শন হলো, একটা সময় পর্যন্ত পুরানো তত্ত্বগুলো বাস্তব সত্য ছিল। বিজ্ঞান তাই চরম সত্যের সন্ধানকে পরিত্যাগ করে। এর বিকল্প হিসাবে টেকনিক্যাল বা প্রায়োগিক সত্যের কথা বলে। এই টেকনিক্যাল সত্যটা যে-কোনো তত্ত্বের হতে পারে যে-তত্ত্ব সফলভাবে আবিষ্কারের কাজে প্রয়োগ করা যায় কিংবা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আগে থেকেই বলা যায়। এই টেকনিক্যাল সত্যটা একটা তারতম্যের বিষয়। একটা তত্ত্ব যা থেকে বেশি বেশি সফল আবিষ্কার সম্ভব হয় এবং ভবিষ্যদ্বাণী করা যায়, সেটাতো কম আবিষ্কারের তত্ত্ব থেকে বেশি সত্য। জ্ঞান’ তখন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মনের আয়না আর থাকে না। এটা পদার্থের কৌশলী ব্যবহারের একটা বাস্তব হাতিয়ার হয়ে ওঠে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির এইসব তাৎপর্য পথিকৃগণের কাছে প্রতিভাত হয়নি। এইসব পথিকৃত্মণ সত্য সন্ধানের একটা নতুন পদ্ধতির অনুশীলন করেছেন। তবুও এঁরা সত্যকে চরম বলে ভেবেছিলেন যেমনটা এঁদের ধর্মতাত্ত্বিক বিরোধীরা বুঝেছিলেন। মধ্যযুগীয় দৃষ্টিভঙ্গি এবং আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ তফাৎ হলো কর্তৃত্বের প্রশ্নটা। স্কুল-মেনদের(৪) কাছে বাইবেল, ক্যাথলিক বিশ্বাসের আপ্তবাক্য এবং (প্রায় সমানভাবে) অ্যারিস্টটলের শিক্ষা ছিল যে-কোনো প্রশ্নের উর্ধ্বে। মৌলিক চিন্তা এবং এমনকি ঘটনার পর্যবেক্ষণও এই দূরকল্পনাভিত্তিক ধারণার নিত্যতার নির্ধারিত সীমা যেন না ছাড়িয়ে যায়। স্কুল মেনরা-এ-বিষয়ে সর্তক থাকতেন। পৃথিবীর উপরের গোলকে মানুষ আছে কিনা, জুপিটারের উপগ্রহ রয়েছে কিনা এবং কোনো বস্তু তার ভরের সমানুপাতিক হারে পতিত হয় কিনা, এসব প্রশ্ন পর্যবেক্ষণে ঠিক করা যাবে না। এসবের বিবেচনা হবে অ্যারিস্টটল কিংবা ধর্মশাস্ত্রের অবরোহী সিদ্ধান্ত থেকে। ধর্মতত্ত্ব এবং বিজ্ঞানের সংঘাত আসলে কর্তৃত্ব আর পর্যবেক্ষণের দ্বন্দ্ব। বিজ্ঞানের অনুগামীরা এটা বলেননি যে, প্রপজিশন বা যৌক্তিক বাক্যগুলো বিশ্বাস করতে হবে কারণ কোনো গুরুত্বপূর্ণ কর্তৃত্ব এসব সত্য বলে বলেছেন। পক্ষান্তরে, এরা মানুষের চেতনার সাক্ষ্যের প্রতি আবেদন রেখেছেন। সেইসব মতবাদে আস্থা রেখেছেন, যেগুলোর ভিত্তি ছিল ঘটনার উপর। এই মতবাদগুলো এমনই যা যে-কেউ চাইলে প্রয়োজনীয় পর্যবেক্ষণ করে নিতে পারেন। নতুন পদ্ধতি তাত্ত্বিক এবং প্রায়োগিকতার এত বিপুল সফলতা পেল যে, ধর্মতত্ত্বও ধীরে ধীরে বাধ্য হলো বিজ্ঞানের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে। অস্বস্তিকর বাইবেলের ব্যাখ্যা দিতে হলো রূপকার্থে কিংবা প্রতীকী হিসাবে।
প্রোটেস্টান্টরা কর্তৃত্বের আসনের স্থানান্তর ঘটালেন। প্রথমে গীর্জা এবং বাইবেল এই দুটো থেকে সরে এসে শুধুমাত্র বাইবেলে দাঁড়ালেন। এবং তারপর ব্যক্তিক আত্মাতে চলে গেলেন। ধীরে ধীরে এটা স্বীকৃত হতে থাকল যে, ধর্মীয় জীবন কেবল ঘটনা নিয়ে ঘোষণার উপর নির্ভর করে না। উদাহারণ হিসাবে এল, আদম ও ইভের ঐতিহাসিক অস্তিত্বের কথা। এভাবে ধর্ম বাইরের আরক্ষা ব্যবস্থা সমর্পণ করে নগরদুর্গ যথাযথ সুরক্ষা করতে চাইলো। এই প্রয়াস সফল হবে কী হবে না, সেটাই এখন দেখার।
যাই হোক, ধর্মীয় জীবনের একটা দৃষ্টিকোণ খুবই আকাঙ্ক্ষিত। এটা আবার বিজ্ঞানের আবিষ্কার-নিরপেক্ষ। কথাটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রকৃতি নিয়ে। এটা নিয়ে আমরা যাই বিশ্বাস করতে চাই না কেন, এই দিকটা কিন্তু টিকে যেতে পারে। ধর্ম কেবল ধর্মবিশ্বাস আর গির্জার সঙ্গেই যুক্ত নয়। এটা কিন্তু সেইসব মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গেও যুক্ত হয়ে যায় যারা এর গুরুত্বটা উপলব্ধি করেন। সন্তদের জীবনে এবং প্রতীকী ধারণার মধ্যে কতিপয় আপ্তবাক্যে বিশ্বাস এবং মানবজীবনের উদ্দেশ্যের উপলব্ধি যুক্ত হয়ে বিরাজ করে। একজন মানুষ যিনি মানবভাগ্যের সমস্যা গভীরভাবে উপলব্ধি করেন, মানবজাতির দুঃখকষ্ট লাঘব করতে চান, এবং আশা করেন যে ভবিষ্যৎ এই মানবপ্রজাতির জন্য সর্বোৎকৃষ্ট সম্ভাবনা নিয়ে আসবে, আজকাল প্রায়ই এই ধরনের মানুষের ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি থাকার কথা বলা হয়। এই মানুষটি ঐতিহ্যগত খ্রিষ্টীয় বিশ্বাস যত কমই গ্রহণ করুন না কেন, তাতে তার সম্পর্কে উপরের ধারণা বদলায় না। ধর্মটা অনুভূতির পন্থা নয়, কেবল একগুচ্ছ বিশ্বাস হয়ে থাকলে বিজ্ঞানও একে স্পর্শ করতে পারে না।
সম্ভবত অনুশাসনের ঘাটতি মনোস্তাত্ত্বিকভাবে এই ধরনের উপলব্ধিকে সাময়িকভাবে অসুবিধার মধ্যে ফেলে। এর কারণ ধর্মতাত্ত্বিক বিশ্বাসের সঙ্গে এটা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। কিন্তু এই অসুবিধাটাকে চিরকাল সহ্য করার প্রয়োজন নেই। বস্তুত বহু মুক্তচিন্তাবিদ তাদের জীবনে এটা দেখিয়েছেন যে, এই ধরনের উপলব্ধির সঙ্গে ধর্মবিশ্বাসের আবশ্যিক সংযোগ নেই। কোনো যথার্থ উল্কর্ষ ভিত্তিহীন বিশ্বাসের সঙ্গে অলক্ষ্মভাবে যুক্ত নয়। ধর্মতত্ত্বীয় বিশ্বাসগুলো ভিত্তিহীন হলে ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে যেগুলো ভালো সেগুলোর সুরক্ষার জন্য ওসবের প্রয়োজন নেই। অন্যভাবে ভাবাটা হলো, আমরা যা আবিষ্কার করতে পারি সেটা নিয়ে ভয়ের মধ্যে থাকা। এবং এই ভয় বিশ্বকে বোঝার ক্ষেত্রে আমাদের চেষ্টাকে ব্যাহত করবে। কিন্তু এটা হলো একমাত্র পরিমাপের বিষয় যার মধ্য দিয়ে আমরা এই ধারণায় পৌঁছেই যে, সত্যিকারের প্রজ্ঞা বাস্তবে সম্ভব।
——–
১. স্টোইক মানে নিস্পৃহবাদী। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ সালে এথেন্সের একটি দার্শনিক মতবাদ ছিল স্টোইকবাদ। জেনো এই দার্শনিক মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা। এই মতবাদের কথা, নাগরিকের সঙ্গে রাষ্ট্রের যে-সম্পর্ক তার চেয়ে ধর্মজীবনে আত্মার সঙ্গে ঈশ্বরের সম্পর্ক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অনুবাদক
২. ইনি মধ্যযুগের রাষ্ট্রীয় দর্শনের ইতিহাসে খ্রিষ্টধর্মীয় যাজক চিন্তাবিদ। কে বড়, ধর্ম না রাষ্ট্র? পোপ না রাজা? এ প্রশ্নে মধ্যযুগে রাস্ট্রীয় দর্শণ বিকাশলাভ করে–অনুবাদক
৩. অবরোহী অনুমানের বিচার্য বিষয় হলো হেতুবাক্য যা আছে (সত্য কিংবা মিথ্যা যাই হোক না কেন,) তার ভিত্তিতে অনুমিত সিদ্ধান্ত গৃহীত হতে পারে কি না।–অনুবাদক
৪. মধ্যযুগের ইউরোপের চাৰ্চস্কুল ছিল। চার্চ নিয়ন্ত্রিত এসব স্কুলে দর্শন এবং ধর্মতত্ত্ব শেখানো হতো। এইসব স্কুলের পণ্ডিতদের প্রধান কাজ ছিল ধর্মের বিশ্বাস ও বিধিনিষেধকে যুক্তির সাহায্যে সত্য বলে প্রমাণ করা। এইসব স্কুলের সঙ্গে যুক্ত সবাইকে স্কুল মেন বলা হয়েছে।-অনুবাদক