০১. শ্রাবণ মাসের শেষ

“হে মানব সন্তান, সহ শৃঙ্খলে আবদ্ধ হইয়া তুমি মুক্তির স্বাদ পাইবে। ইহাই তোমার নিয়তি।“
(প্রাচীন শিলালিপি। মায়া সভ্যতা)

০১.

শ্রাবণ মাসের শেষ।

ভ্যাপসা গরম পড়েছে। গত পনেরো দিনে এক ফোঁটা বৃষ্টি হয়নি। সারাদিন ঝাঁঝালো রোদ যায়। সূর্য ডোবার পর গরম আরো বাড়ে। গরমে অতিষ্ঠ হয়ে যখন-তখন সাপ বের হয়ে পড়ে। এ পর্যন্ত দুজনকে সাপে কেটেছে।

জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল স্কুলের টিচার্স কমনরুমে সাপ নিয়ে গল্প হচ্ছিল। ইংরেজির মাহবুব স্যার কাল রাতে কিভাবে অল্পের জন্য বেঁচেছেন সেই গল্প করছেন। খুব আগ্রহ নিয়ে করছেন, তবে কেউ মন দিয়ে শুনছে৷ বলে মনে হচ্ছে না। মাহবুব সাহেব গল্প ভাল বলতে পারেন না। কিছু দূর বলার পরই খেই হারিয়ে ফেলেন, তখন গলা খাকাড়ি দিয়ে বলেন, বুঝলেন কি-না, বুঝলেন কি-না। গল্প আবার নতুন করে শুরু হয়। এইভাবে গল্প শুনে আরাম নেই। তারপরেও সবাই শুনছে, কারণ কিছু করার নেই। হেডস্যার সবাইকে ক্লাসের পরে থাকতে বলেছেন। খুব জরুরী।

জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল স্কুলের হেডমাষ্টার ফজলুল করিম এম, এ, (ডবল) বিটি (প্রথম শ্রেণী) কে সবাই সমীহ করে চলেন। ভদ্রলোকের বয়স পাঁচপঞ্চাশের মত। রোগা পাতলা মানুষ। হাঁটেন খানিকটা কুজো ভঙ্গিতে। হাঁটার সময় চোখ থাকে তার নিজের পায়ের পাতার উপর। সামনে কে আসছে বা কে পাশ দিয়ে যাচ্ছে তার চেয়েও তার পায়ের পাতা কোথায় পড়ছে তা তাঁর কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। কথা বলেন নরম গলায়। তবে প্রতিটি শব্দ খুব স্পষ্ট করে বলেন। ১৯৬৮ সালে হেডমাস্টার হিসেবে এই স্কুলে এসেছিলেন। এখনো আছেন। তার সবচে বড় গুণ এবং সবচে বড় ত্রুটি হচ্ছে স্কুলের বাইরে তিনি কিছু চিন্তা করতে পারেন না।

মাহবুব সাহেব গলা খাকাড়ি দিয়ে বলছেন, বুঝলেন কি-না গরমষ্টা কেমন পড়েছে কাল রাতে। বুঝলেন কি-না যাকে বলে তালপাকা গরম। রাতে ভাত হতে দেরি হচ্ছে, আমি আমার মেয়েটাকে বললাম, উঠোনে পাটি পেতে দে, বিশ্রাম করি। সে দিল। তারপর বললাম, দে মা, একটা বালিশও দে, শুয়ে থাকি। রান্না হলে ডেকে দিস। সে বেশ একটা বিছানার মত করে দিল। বুঝলেন কি-না আমি একটা তালপাখা নিয়ে শুতে গেছি, হঠাৎ দেখি বালিশের কাছে এক গোছা পাটের কোষ্ঠা। বুঝলেন কি-না আসলে সাপ। চাঁদের আলোয় পাটের কোষ্ঠার মত লাগছে। আমি তো আর সাপ যে সেটা জানি না। আমি শুয়ে পড়েছি, তখন একটা গন্ধ পেলাম। মিষ্টি গন্ধ।

আরবী ও ইসলামিয়াত শিক্ষক মওলানা ইরতাজ উদ্দিন হাই তুলতে তুলতে বললেন, মিষ্টি গন্ধ পেলেন কেন? সাপ কি সেন্ট মেখে এসেছিল।

এই কথায় সবার হেসে উঠা উচিত, কিন্তু কেউ হাসল না। দুএকজন অবশ্যি মুখ ফিরিয়ে হাসি চাপার চেষ্টা করল। এই স্কুলে মাহবুব সাহেবকে নিয়ে কেউ হাসাহাসি করে না। মওলানা ছাড়া আর কারো এত সাহস নেই। মাহবুব সাহেব ক্ষমতাবান ব্যক্তি। এবার চেয়ারম্যান ইলেকশনে দাঁড়াবেন এরকম শোনা যাচ্ছে। স্কুলে শুধু না, এই অঞ্চলে থাকতে হলেও তাকে তোয়াজ করে চলতে হয়। মওলানা নতুন এসেছেন তিনি এই ব্যাপারটা হয়। এখনো জানেন না কিংবা জানলেও না জানার ভান করছেন।

মাহবুব সাহেব কল্পনা করেননি তার এমন ভয়াবহ গল্প নিয়ে কেউ রসিকতা করবে। তিনি কিছুক্ষণ অবাক হয়ে মওলানার দিকে তাকিয়ে রইলেন। নিজেকে সামলালেন। তারপর শান্ত গলায় বললেন, মওলানা সাহেব, আপনি বোধহয় জানেন না ভাদ্র-আশ্বিন মাসে সাপের শরীরে গন্ধ। হয়, তখন সাপ খোলস ছাড়ে। অনেকটা বাসি বকুল ফুলের গন্ধের মত গন্ধ।

আমি জানতাম না, আমার ধারণা ছিল শীতকালে খোলস ছাড়ে। এই নিয়ে পরে আপনার সঙ্গে বাহাস করা যাবে, আপাতত গল্পটা শেষ করুন। সাপটা কি করল, খোলস ছাড়ার জন্যে আপনার কাছে গেল?

মাহবুব সাহেব মওলানার সাহস দেখে অবাক হলেন। তিনি কিছু বললেন না। ঠাণ্ডা চোখে তাকিয়ে রইলেন। তার মুখে থুথু জমে যাচ্ছে। তিনি মনে মনে বললেন, হারামজাদা মওলানা।

অংক-স্যার বিনয় বাবু পরিস্থিতি সামলাবার জন্যে বললেন, চা খাওয়া যাক, কি বলেন? হরিপদকে বলি চা-পাতা আর ভেলি গুড় নিয়ে আসুক। ভেলি গুড়ের চা ভাল হয়। কি বলেন আপনারা ডাকি হরিপদকে?

কেউ হ্যাঁ বা না কিছু বলল না। হা বললেই খরচ দেয়ার একটা প্রশ্ন চলে আসে। কে খরচ দেবে?

মাহবুব সাহেব পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা কুড়ি টাকার নোট বের করে টেবিলে রাখতে রাখতে বললেন, আনতে বলুন, চা আর একটা করে সিঙ্গাড়া। আমরা মানুষ কজন?

বিনয় বাবু উৎসাহের সঙ্গে বললেন, হেডস্যারকে নিয়ে বার বারটা সিঙ্গাড়া আনিতে বলি, কি বলেন?

মাহবুব সাহেব বললেন, আমাকে বাদ দিয়ে হিসাব করুন। আমি সিঙ্গাড়া-ফিঙ্গাড়া খাই না।

তিনি ভেবেছিলেন, সবাই একসঙ্গে বলে উঠবে, আপনি খাবেন না মানে? আপনাকে বাদ দিয়ে আমরা খাব না-কি? তিনি বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করলেন, কেউ কিছুই বলল না। গল্প অনেকটুকু বলা হয়েছে, বাকিটুকু শোনার প্রতিও কারো আগ্রহ নেই। মাহবুব সাহেবের ভুরু কুঞ্চিত। আশ্চর্য! একটা গল্পের শেষটুকু বলা যাবে না। আসল মজাইতো গল্পের শেষে

মওলানা সাহেব বললেন, চা আসুক, এরমধ্যে আসরের নামাজটা পড়ে ফেলি। সময়মত নামাজ পড়ার বদঅভ্যাস কি আর কারো আছে? থাকলে আসুন। জামাত ছাড়া নামাজ পড়ে আরাম পাওয়া যায় না।

মাহবুব সাহেব নিয়মিত নামাজ পড়েন। আসরের ওয়াক্ত শেষ হয়ে যাচ্ছে এটা তিনি লক্ষ্য করছেন কিন্তু এই ব্যাটার পেছনে নামাজ পড়ার অর্থ হয় না। যার উপর রাগ থাকে তার পেছনে নামাজ পড়া যায় না। নামাজ কবুল হয় না।

চারজন শিক্ষক উঠে দাড়ালেন। মাহবুব সাহেবের ক্ষীণ সন্দেহ হলতারা বোধহয় গল্পের হাত থেকে বাচার জন্যেই উঠে গেছে। নামাজটা উপলক্ষ্য। আসর ভেঙে গেল। ভাঙা আসরে গল্প বলার কোন মানে হয় না। কিন্তু মান রক্ষার জন্যে হলেও শেষ করা দরকার। মাহবুব সাহেব বিনয় বাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, চরম বিপদ গিয়েছিল, বুঝলেন, আরেকটু হলে মরেই যেতাম। সাপ ফণা তুলে ফেলেছিল।

বিনয় বাবু অনাগ্রহের সঙ্গে বললেন, ও আচ্ছা।

আমি নিজে কিছুই দেখিনি। আমার মেয়ে প্রথম দেখল, বুঝলেন কি-না সে এক বাটি মুড়ি নিয়ে আসছে। হঠাৎ এক চিৎকার–এইটা কি? এইটা কি? আমি তাকিয়ে দেখি সাপ ফণা তুলে আছে। হাতের খাবার সাইজের এক ফণা।

গল্পে আবার বাধা পড়ল। হরিপদ চা-সিঙ্গাড়া নিয়ে এসেছে। বিনয় বাবু ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন ভাগাভাগিতে। গরম গরম সিঙ্গাড়া, ধোঁয়া উড়ছে। এর স্বাদই অন্য রকম। মাহবুব সাহেবের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। একবার খাবেন না বলার পর আর খাওয়া যায় না। বিনয় বাবুকে দেখা যাচ্ছে পিরিচে তিনটা সিঙ্গাড়া আলাদা করছেন। মাহবুব সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, করছেন কি?

বিনয় বাবু বললেন, হেডস্যারকে দিয়ে আসি।

দিয়ে আসতে হবে না, এখানে এসে খাবেন। আর তিনটা সিঙ্গাড়া দিলেন কোন আন্দাজে? সবাইকে দুটা দিচ্ছেন। তাকেও দুটা দিন। যান খবর দিন। এতগুলি মানুষকে খামাখা কেন বসিয়ে রেখেছেন কে জানে। জরুরী মিটিং, আমি তো জরুরী কিছু দেখি না।

আপনাকে দেই। গরম সিঙ্গাড়া খেতে ভাল লাগবে। এরা জিনিসটা ভাল বানায়।

বললাম তো বাজারের খাবার খাই না।

হেডমাস্টার সাহেবকে আসতে দেখা যাচ্ছে। মাটির দিকে তাকিয়ে হন হন করে হাঁটা। মাহবুব সাহেব চারদিনের পুরনো খবরের কাগজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। হেডমাস্টার সাহেবের সাথে তাঁর ঠাণ্ডা লড়াই চলছে। এই মানুষটার মুখের দিকে তাকাতে ইচ্ছে করছে না।

মাহবুব সাহেব, খবর কি?

ভাল।

নাস্তা-পানির ব্যবস্থা হয়েছে দেখছি, সিঙ্গাড়া কি পরিমলের দোকানের?

বিনয় বাবু হাসিমুখে বললেন, জ্বি স্যার। তিনি হেডমাস্টার সাহেবের দিকে পিরিচ এগিয়ে দিলেন।

এই সিঙ্গাড়া একটা দুটো খেলে হয় না। গোটা দশেক করে খেতে হয়। বিনয় বাবু, হরিপদকে পাঠান তো, আরো কিছু আনুক।

তিনি পকেট থেকে কুড়ি টাকার নোট বের করলেন।

নামাজীরা নামাজ শেষ করে ফিরেছে। বিনয় বাবু খুশি-খুশি গলায় বললেন, হেডস্যার আরো কুড়ি টাকার সিঙ্গাড়া আনতে দিলেন। পারহেড খ্রী পিস।

ফজলুল করিম সাহেব চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, আপনাদের সবার জন্যে একটা সুসংবাদ আছে। এই জন্যেই আপনাদের এতক্ষণ আটকে রাখলাম। সুসংবাদটা কি আন্দাজ করুন দেখি?

মাহবুব সাহেব বিরস মুখে বললেন, আন্দাজ-ফান্দাজ আবার কি, কি বলতে চান বলুন। আমাদের সবারইতো কাজকর্ম আছে।

সরকার থেকে একটা স্যাংশান পাওয়া গেছে। সাত লাখ টাকা। কনস্ট্রাকশনের জন্য স্যাংশন। আজকেই চিঠি পেলাম। এইবার ইনশাল্লাহ পাকা বিল্ডিং হবে। হোস্টেল হবে। ঘটনাটা কিভাবে ঘটল তার শানে-নজুলটা আপনাদের বলি। শুনলে ভাল লাগবে সে এক ইতিহাস……।

মাহবুব সাহেব অত্যন্ত বিরক্তির সঙ্গে লক্ষ্য করলেন–সাপের গল্প কেউ আগ্রহ নিয়ে শুনছিল না, কিন্তু সাত লাখ টাকার গল্প চোখ বড় বড় করে কনছে।

ঢাকা গিয়েছিলাম এক বৎসর আগের কথা বলছি। শ্রাবণ মাসের শেষ। বায়তুল মোকাররমের সামনে দিয়ে হাঁটছি হঠাৎ শুরু হল বৃষ্টি–দৌড় দিয়ে একটা দোকানে ঢুকলাম। দোকানে এক লোেক কি যেন কিনছে। লোকটাকে চেনা চেনা লাগছে–আবার চেনাও যাচ্ছে না। আমি তাকাতেই সে বলল, আরে স্যার, আপনি। বলেই পা ছুঁয়ে সালাম। তার সঙ্গে ফুটফুটে দুটো মেয়ে। সে মেয়ে দুটোকে বলল, সালাম কর, সালাম কর। আমার শিক্ষক।

মেয়ে দুটো ইতস্তুত করছে। একালের শহুরে মেয়ে, এরা হুট করে পা ছুঁয়ে সালাম করে না। সে দিল ধমক, মারা দাঁড়িয়ে আছ কেন? সালাম কর, সালাম কর। আমার শিক্ষক।

মাহবুব সাহেব বিরক্ত মুখে বললেন, গল্প সংক্ষেপ করুন। আপনি দেখি সাত খন্ড রামায়ন শুরু করেছেন।

হেডমাস্টার সাহেব অপ্রতিভ হলেন না। তিনি হাসিমুখে বললেন, খুবই ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। পুরোটা শুনতে হবে।

–আমাকে ছাড়ল না। জোর করে গাড়িতে নিয়ে তুলল। বাসায় নিয়ে গেল। সে শিক্ষা দপ্তরের বিরাট অফিসার। জয়েন্ট সেক্রেটারী। যেদিন আমার সঙ্গে দেখা হয়েছে সেদিনই প্রমোশন পেয়েছে। প্রমোশন উপলক্ষে ঘরোয়া খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন–আমি তার মধ্যে বাইরের লোক। অনেক কথা হলো তার সাথে, স্কুলের কথা বললাম, স্কুলের ভগ্নদশার কথা বললাম। মনজুর বলল, স্যার দেখি কি করতে পারি। আমি তার কথায় তেমন গুরুত্ব দেইনি। সরকারী অফিসাররা দেখি শব্দটা প্রচুর বলে কিন্তু কিছু দেখে না। না দেখাটাই তাদের দস্তুর। মনজুর দেখেছে। আশ্চর্য ব্যতিক্রম।

বিনয় বাবু বললেন, সেক্রেটারী সাহেবের নাম মনজুর?

সেক্রেটারী না, জয়েন্ট সেক্রেটারী। মনজুর আহমেদ।

মওলানা বললেন, পাকা বিল্ডিং হচ্ছে এ তো অতি আনন্দের সংবাদ।

ফজলুল করিম সাহেব বললেন, আনন্দ মানে? মহানন্দ। দুপুরের ডাকে চিঠি পেয়েছি। পর পর তিনবার পড়লাম। তারপর দেখি, আমার চোখ দিয়ে আপনা আপনি পানি পড়ছে।

মাহবুব সাহেব বললেন, সরকারী টাকা হাতে না আসা পর্যন্ত বিশ্বাস নাই। আগে হাতে আসুক। পঞ্চাশ বস্তা গম সংস্থান হয়েছিল তিন বছর আগে, সেই গম কোথায়?

মাহবুব সাহেব উঠে দাঁড়ালেন।

ফজলুল করিম সাহেব বললেন, আরে বসুন না। খানিকক্ষণ গল্পগুজব করি–এরকম একটা সুসংবাদ পাওয়া গেল। রোজদিন তো এরকম ঘটে না।

কাজ আছে।

আরেকটা কথা তো আপনাদের বলা হয় নাই-আমাদের নতুন সায়েন্স স্যার চলে আসছেন। চিঠি পেয়েছি। এখানেও ভাগ্যের ব্যাপার আছে চেয়েছিলাম বিএসসি। পেয়ে গেছি এমএসসি। তাও যতি এমএসসি না। ফার্স্টক্লাশ পাওয়া এমএসসি। ভাল ভাল ছেলেপুলে না এলে স্কুলের উন্নতি হবে না।

মাহবুব সাহেব বললেন, এরা স্কুলে থাকবে না। চাকরি-বাকরি না পেয়ে স্কুলে ঢুকছে। নাই কাজ তো খই ভাজ-এর মত অবস্থা। যেই একটা কিছু পাবে স্কুলে পেচ্ছাব করে চলে যাবে।

ফজলুল করিম সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, অশালীন শব্দ ব্যবহার করে কথা বলবেন না। আমরা শিক্ষক মানুষ। কথাবার্তায় আমাদের খুব সাবধান হওয়া দরকার। খুবই সাবধান। শিক্ষকদের প্রতিটি শব্দ চিন্তা-ভাবনা করে বলতে হবে।

বিনয় বাবু বললেন, বৃষ্টি নামবে বলে মনে হয়। উঠে পড়া যাক, স্যার যদি অনুমতি দেন।

অবশ্যই, অবশ্যই। যান, বাড়ি যান।

স্কুল ফাঁকা হয়ে গেল। শুধু মওলানা থেকে গেলেন। মাগরেবের ওয়াক্ত হয়ে গেছে। তিনি মাগরেবের নামাজ শেষ করে তারপর যাবেন। তার অজু আছে। নতুন করে অজু করার প্রয়োজন নেই তবু বারান্দায় অজু করতে গেলেন। হেডমাস্টার সাহেব পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। মুখ হাসি হাসি। একজন আনন্দিত মানুষের মুখের দিকে তাকালেও আনন্দ হয়। মানুষটা আনন্দে ঝলমল করছে। আনন্দ শিশুদের ধর্ম। এই মানুষটার ভেতর শিশুভাব আছে। পর্যাপ্ত পরিমাণেই আছে। মওলানার একমাত্র আফসোস–মানুষটা নামাজের ধার ধারেন না। তিনি অজু করতে করতে একবার ভাবলেন হেডমাস্টার সাহেবকে সুযোগমত একবার নামাজের কথা বলে দেখবেন।

মওলানা সাহেব।

জ্বি স্যার।

শিক্ষক হবার সবচে বড় লাভ কি জানেন?

কি লাভ?

হঠাৎ হঠাৎ ছাত্র পাওয়া যায়। কৃতী ছাত্র। এদের দেখলেও আনন্দ হয়। কৃতী ছাত্র দেখলে এত ভাল লাগে। একটা কথা আছে–জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে জয় আশা করিবে শুধু ছাত্রের এবং পুত্রের নিকট পরাজয়কেই আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করিবে। মনজুরের কথাই ধরুন। জয়েন্ট সেক্রেটারী। সহজ ব্যাপার না।

তা তো স্যার ঠিকই।

আমি চিনতেই পারিনি। বয়স হয়ে গেছে। স্মৃতিশক্তি হয়েছে দুর্বল। মনজুর তার স্ত্রীকে নানান গল্প করছে, আমি শুধু শুনে যাচ্ছি। তার মেট্রিকের রেজাল্ট যখন হল, নাইনথ স্ট্যান্ড করেছে, তখন খবর পেয়ে আমি নাকি তাকে কোলে নিয়ে স্কুলের মাঠে একটা চক্কর দিয়েছি। আমার তো কিছুই মনে নেই…..

আপনার মনে থাকবে কেন? আপনি তো কত ছেলেকেই কোলে নিয়ে চক্কর দিয়েছেন। যাদের মনে রাখার তারা ঠিকই মনে রেখেছে।

শিক্ষকতা করে এই জীবনে বড়ই তৃপ্তি পেয়েছি। শেষ জীবনে স্কুলটাকে ঠিকঠাক করে যেতে পারলে মনে শান্তি পেতাম। এতদিনের পুরানো একটা স্কুল।

মওলানা সাহেবের নামাজের সময় যাচ্ছে। কিন্তু হেডস্যার এত আগ্রহ করে কথা বলছেন, তাকে ফেলে চলে যেতেও মায়া লাগছে।

নামাজের ওয়াক্ত হয়ে গেছে স্যার।

ও আচ্ছা, আচ্ছা। যান, নামাজ পড়ন। নামাজ পড়ন। স্কুলের জন্যেও দোয়া করবেন।

অবশ্যই করব, স্যার।

বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। হেডমাস্টার সাহেব প্রাইমারী সেকশানের দিকে যাচ্ছেন। বছরের প্রথম কালবোশেখির ঝড়ে প্রাইমারী সেকশানের খুব ক্ষতি হল। দুটা টিনের চালা উড়ে গেছে। খুঁজে এনে কোনমতে লাগানো হয়েছে। ফাঁক-ফোকর আছে। বৃষ্টি নামলেই ক্লাশের ভেতর পানি পড়ে। পাকা দালান হলে আর দেখতে হবে না। পাকা দালানে ছাত্ররা ক্লাশ করবে। স্কুলের বিশাল কম্পাউণ্ডের ভেতরে থাকবে ফুলের বাগান। এসেমব্লীতে ছাত্রছাত্রীরা লাইন ধরে দাড়াবে, জাতীয় সংগীত গাইবে–আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি। আহ, কি সুন্দর জাতীয় সংগীত! এত সুন্দর জাতীয় সংগীত কি আর কোন জাতির আছে?

স্কুল লাইব্রেরীটা ঠিকমত করতে হবে। কাচের আলমীরার ভেতর থরে থরে বই সাজানো থাকবে, দেয়ালে থাকবে মহাপুরুষদের ছবি। মহাপুরুষদের ছবির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেও মন পবিত্র হয়। মহাপুরুষদের ছবি জোগাড়ের চেষ্টা চালাতে হবে। রবীন্দ্রনাথ, টলস্টয়, আইনস্টাইন, মহাত্মা গান্ধী, শেখ মুজিব……

হেডমাস্টার সাহেব অফিস ঘরে ফিরে গেলেন। তিনি সন্ধ্যার পরেও খানিকক্ষণ অফিসে থাকেন। হরিপদ হারিকেন জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। হারিকেনের কাচের একটা কণা ভাঙ্গা। ধুঁয়া বেরুচ্ছে। সব কিছুরই ভগ্নদশী, তবে এই ভগ্নদশা থাকবে না। হেডমাস্টার সাহেব ঠিক করলেন, মনজুরকে চিঠি লিখে ধন্যবাদ জানাবেন। চিঠিটা আজই লিখে ফেলা দরকার। এইসব ব্যাপারে দেরি করতে নেই। তিনি গোটা গোটা হরফে ইংরেজিতে একটা চিঠি লিখলেন। তিনি ইংরেজির শিক্ষক। ইংরেজিতেই ভাল লিখতে পারেন। বাংলা তেমন আসে না। তাঁর চিঠির বাংলা তর্জমা অনেকটা এরকম–

আমার পুত্রপ্রতিম ছাত্র মনজুর আহমেদ
জয়েন্ট সেক্রেটারী। শিক্ষা দপ্তর।

তোমার অসীম বদান্যতায় আমি মুগ্ধ, ও অভিভূত। আমার জীবনে আজ একটি বিশেষ দিন–সরকারি অনুদানের চিঠি আজ আমার হস্তগত হয়েছে। পর পর তিনবার এই চিঠি পাঠ করার পর আজ আমি অশ্রুবর্ষণ করিয়াছি। এই অশ্রু সুখের ও আনন্দের মিলিত ফসল। আজ আমার মনে হইতেছে আমার দীর্ঘ দিনের শিক্ষাদান বিফল হয় নাই….। আমি তোমার মত দরদী ছাত্র তৈরি করিতে পারিয়াছি…।

 

মওলানা ইরতাজউদ্দিন হেডমাস্টার সাহেবের ঘরে উঁকি দিয়ে বললেন, স্যার এখনো যাননি?

একটা চিঠি লিখতে বসেছি। চিঠি শেষ করে উঠব। আপনার নামাজ হয়ে গেল?

জি স্যার।

বসুন তাহলে, চিঠিটা শেষ করি। চিঠির মুসাবিদাটা শুনে যান।

মওলানা বসলেন। হেডমাস্টার সাহেবের আনন্দময় মুখ দেখতে দেখতে তাঁর মন খুব খারাপ হয়ে গেল, কারণ তিনি জানেন জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল হাই স্কুলের শেষ ঘণ্টা বেজে গেছে। এই স্কুলের আয়ু আর অল্প কিছুদিন। স্থানীয় এলাকার মন্ত্রী রমিজ সাহেব এখন স্কুল দিচ্ছেন। পাকা দালান হবে। রাজমিস্ত্রীরা মাপজোখ করে কাজ শুরু করে দিয়েছে। নতুন স্কুলের পাশে জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল স্কুল টিকতে পারবে না। সাত লক্ষ টাকার অনুদান কাজে আসবে না। এই অনুদানের চেক স্কুলে এসে পৌছুবে না। আর পৌছুলেও ফেরত যাবে।

 

চিঠি শেষ হয়েছে। কপি করতে হবে। অফিস কপি রাখতে হবে। কার্বন পেপার নেই। কপির কাজ হাতে করা ছাড়া গতি নেই। বানান ভুল কি আছে? ভাল করে আরেকবার দেখতে হবে। চিঠি ছাত্রের কাছে যাচ্ছে–সে চিঠিতে বানান ভুল থাকলে হবে না। ছাত্ররা সব সহ্য করতে পারে, শিক্ষকদের বানান ভুল সহ্য করতে পারে না।

মওলানা সাহেব।

জ্বি স্যার।

আমার আরো খানিকটা দেরী হবে। আপনি না হয় চলে যান।

আমার তাড়া কিছু নেই–বসি।

আচ্ছা বসুন। একা একা কাজ করতেও ভাল লাগে না। আকাশের অবস্থা কি? বৃষ্টি হবে?

টিপ টিপ করে তো পড়ছে।

এই বছর ভাল বৃষ্টি হল, অতি বৃষ্টি। তবে অতি বৃষ্টি হওয়া ভালআপাতত ক্ষতি হলেও পরবর্তি সময়ে ফল হয় শুভ। মঙ্গল সব সময় অমঙ্গলের পেছনে থাকে।

ফজলুল করিম সাহেবের ভুরু কুঁচকে গেল। গল্প করতে করতে চিঠি কপি করতে যাওয়ার এই সমস্যা। বানান ভুল হয়েছে। হাতের লেখাও ভাল হয়নি, লাইন বাঁকা হয়ে গেছে। তিনি কাগজ ছিঁড়ে ফেলে নতুন করে লিখতে বসলেন।

মওলানা পাঞ্জাবীর পকেট থেকে ছবির ছড়া বের করেছেন। চুপচাপ বসে না থেকে সময়টা কাজে লাগানো যাক। বৃষ্টি পড়ছে। বড় বড় ফোঁটা পড়ছে। টিনের চালে বৃষ্টির ফোঁটায় কি সুন্দর ঝম ঝম শব্দ হচ্ছে। মওলানা বললেন, স্যার, আপনি কাজ করুন আমি বারান্দায় বসি।

আচ্ছা, আচ্ছা। বৃষ্টি মনে হয় জোরেসোরে পড়ছে।

জ্বি স্যার।

পাকা দালানটা হয়ে যাক–তাহলে ঝড় বৃষ্টিতে কিছুই হবে না। অল্প কিছু দিনের ব্যাপার।

জ্বি স্যার। আপনি কাজ শেষ করুন।

ফজলুল করিম সাহেব চিঠি শেষ করলেন। বৃষ্টি আরো বেড়েছে। বৃষ্টির ছাঁট আর ভেজা বাতাস ঘরে ঢুকছে। হারিকেনের শিখা দপ দপ করছে। নিভে যাবে কিনা কে জানে। ড্রয়ারে মোম আছে। ফজলুল করিম সাহেবের আরো কয়েকটা চিঠি লেখার ইচ্ছে আছে। তাঁর দুই মেয়েকে তিনি অনেক দিন চিঠি লেখেন না। ছোট মেয়ে থাকে সিরাজগঞ্জ, ডাক্তার। তার ভাল প্রাকটিস। সেও চিঠি লিখতে পারে না। এই মেয়ের তিনি বিয়ে দিতে পারেননি। মেয়েই রাজি হল না। বিয়ের কথা বার্তা হলেই শুকনো গলায় বলে,–

আমার বিয়ের ব্যবস্থা আমি নিজে করব বাবা। আমার বিয়ে নিয়ে তুমি কিছু ভাববে না।

মেয়েদের উচ্চ শিক্ষা দেবার এই এক সমস্যা। উচ্চ শিক্ষা স্বাধীন মতামত দেয়ার ক্ষমতা তৈরি করে দেয়। তার ফল সব সময় শুভ হয় না। তাঁর মেয়ের বেলায় হয়নি। মেয়ে বিয়ে করেনি। করবে বলেও মনে হচ্ছে না।

তাঁর বড় মেয়েকে তিনি যথাসময়ে বিয়ে দিয়েছিলেন। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর পরই বিয়ে। এর ফলও শুভ হয়নি। মেয়ের আর পড়াশোনা হয়নি। অথচ তার বড় মেয়েটাই ছিল পড়াশোনায় সবচেয়ে ভাল। মুক্তার মত হাতের লেখা। তিনি তার দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে এত সুন্দর হাতের লেখা কোন ছাত্রের দেখেননি। বড় মেয়ে এখন নিউ জার্সিতে থাকে। ঘর সংসার দেখে। তার স্বামী কাজ করে সেখানকার এক ব্যাংকে, ফাস্ট ন্যাশনাল ব্যাংক। স্ত্রী হাউস ওয়াইফ।

বৃষ্টির রাত হচ্ছে চিঠি লেখার জন্যে সবচে ভাল রাত। মেয়ে দুটিকে দুটা চিঠি লিখে ফেললে হয়। এত সকাল সকাল ঘরে গিয়ে করারও কিছু নেই। ফজলুল করিম সাহেব বাঁ পাশের তালাবন্ধ ড্রয়ার খুললেন। ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহারের জন্যে কাগজ, কলম, খাম ডাকটিকিট এই ড্রয়ারে থাকে। ব্যক্তিগত কাজে তো আর স্কুলের জিনিস ব্যবহার করা যায় না। শুধু স্কুলের জিনিস না, স্কুলের সময়ও ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করা যায় না।……

ফজলুল করিম সাহেব ড্রয়ার খুলে কাগজ কলম খাম বের করলেন। সাত লক্ষ টাকা অনুদানের ব্যাপারটা মেয়েদের জানানো উচিত। ওরা খুশি হবে……।

তিনি চিঠি লিখছেন। তার জন্যে একজন বারান্দায় অপেক্ষা করছে এটা তার আর মনে নেই। দুই মেয়েকেই তিনি দীর্ঘ চিঠি লিখলেন। দুটি চিঠিই ইংরেজিতে।

লিখতে সময় লাগল কারণ পছন্দের কোটেশন পাচ্ছিলেন না। তার দীর্ঘদিনের অভ্যাস মেয়েদের চিঠিতে মহাপুরুষদের বাণীর উদ্ধৃতি দেয়া। ছাত্র জীবনে একটি বই কিনেছিলেন Great Sayings.-বইটি এখনো আছে। চিঠি লেখার সময় খুব কাজে আসে। তেমন পছন্দের কোন কোটেশন খুঁজে পেলেন না। সেক্সপিয়ারের একটা পেলেন সেটা তেমন পছন্দ হল না। তবুও চিঠির শেষে পুনশ্চ দিয়ে লিখে দিলেন–

One Fire burns out anothers burning;
One pain is lessend by anothers anguish.
–Shakespeare (Remed and Juliet)

চিঠি শেষ করতে করতে এশার আজান হয়ে গেল। তিনি বারান্দায় এসে দেখেন–বারান্দায় জায়নামাজ পেতে মওলানা নামাজে দাঁড়িয়েছেন। অন্ধকার বারান্দায়, বাইরে ঝমঝম বৃষ্টি। এর মধ্যে সাদা পাঞ্জাবী পড়া লম্বা একজন নামাজ পড়ছে–দেখতে ভাল লাগে। নামাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ফজলুল করিম বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলেন।

 

একটাই ছাতা।

মওলানাকে বাজারে পৌঁছে দিয়ে সেই ছাতা দিয়ে হেডমাস্টার সাহেব তার ঘরে ফিরবেন। মওলানা খাকেন মজিদ মিয়ার কাপড়ের দোকান রূপসা ক্লথ হাউসে। এই অঞ্চলের সবচে বড় কাপড়ের দোকান। দোকানের পেছনে বিস্তর জায়গা। কয়েকটা খুপড়ি খুপড়ি ঘর। জায়গীর রাখার মত একটা খুপড়ি মওলানার। মজিদ মিয়া খুব আগ্রহ করে মওলানাকে রেখেছেন। তার বিনিময়ে মজিদ মিয়াকে কোরআন শরীফ পড়া শেখানোর কথা। বছর দুই হয়ে গেল এখনো কোরআন পাঠ শুরু হয়নি। মওলানা মনে করিয়ে দিলেই মজিদ মিয়া বলেন–ভাল দিন দেখে শুরু করতে হয়–দেখি রমজান মাসটা আসুক। রমজানে শুরু করব, রমজানেই কোরআন মজিদ শেষ করব, ইনশাল্লাহ। এই রমজানও পার হয়ে গেল, এখন সামনের রমজানের অপেক্ষা।

হেডমাস্টার সাহেবকে দেখে মজিদ মিয়া আনন্দিত গলায় বললেনস্যার, আসেন আসেন। ভাল দিনে এসেছেন। আজ আপনাকে ছাড়ব না। খানা খেয়ে যাবেন। বিরিয়ানী পাকাতে বলেছি।

বিরিয়ানী তো খাই না মজিদ সাহেব। পেটের অবস্থা ভাল না। তৈলাক্ত খাবার সহ্য হয় না।

একদিন খেলে কিছু হবে না। বসুন বসুন……

জি–না। আজ না আরেকদিন।

আর আরেক দিন। আপনাকে এখন পর্যন্ত চারটা ভালভাত খাওয়াতে পারলাম না–এই এক আফসোস-?

খাব, একদিন এসে খেয়ে যাব।

তাহলে বেলের শরবত খেয়ে যান, বেলের শরবত করতে বলছি।

এই সময় বেল পেলেন কোথায়?

আছে, ব্যবস্থা আছে। আপনাকে খাওয়ায়ে দিচ্ছি। মনে থাকবে–কই রে বেলের শরবত আন। আমার শ্বশুর বাড়ি সান্দিকোনা থেকে আনী। বরমেসে বেল।

অসময়ে বেলের শরবত খাওয়ার কোন ইচ্ছা ফজলুল করিম সাহেবের ছিল না। বাধ্য হয়ে বসলেন। এতে কিছুটা লাভ হল, তিনি তাঁর কাজের মেয়েটার জন্য একটা শাড়ি কিনলেন। মেয়েটাকে একটা শাড়ি দেয়া দরকার–মনে থাকে না। আজ চোখের সামনে শাড়ি বেচা-কেনা হচ্ছে দেখে মনে পড়ল।

মজিদ মিয়া মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, তারপর স্যার, বলেন স্কুলের খবরটা কি?

জ্বি খবর ভাল। সরকারি একটা অনুদান পেয়েছি। সাত লক্ষ টাকা…

তাই নাকি?

ফজলুল করিম সাহেব বেলের শরবত খেতে খেতে সরকারি অনুদানের ইতিহাসটা পুরোটা বর্ণনা করলেন। গল্প শুরু হলো ছাত্রের সঙ্গে দেখা হওয়া থেকে। মজিদ মিয়া এই গল্পে তেমন আগ্রহ বোধ করছিল না। তবু সে বেশ মন দিয়েই শুনল।

গল্পের শেষে হেডমাস্টার সাহেব তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, স্কুলটা এবার দাঁড়িয়ে গেল।

তাইতো দেখতাছি।

পাকা দালান হবে। হোয়াইট ওয়াশ করে দেব। দূর থেকে চোখে পড়বে….মওলানা বললেন, ইনশাআল্লাহ্ বলেন স্যার। প্রতিটি সৃৎ নিয়তের শেষে ইনশাআল্লাহ্ বলতে হয়। নবী-এ-করিম একবার ইনশাআল্লাহ্ না বলায় আল্লাহ পাক নারাজ হয়েছিলেন–কোরআন শরীফে এই বিষয়ে আয়াত নাজেল হয়েছে।

ফজলুল করিম পর পর দুবার বললেন,–ইনশাআল্লাহ্, ইনশাআল্লাহ।

বৃষ্টি আরো বেড়েছে। হেডমাস্টার সাহেবকে পৌঁছে দেবার জন্যে মজিদ মিয়ার নিজস্ব রিকশা চলে এসেছে। রাস্তা ঘোর অন্ধকার। মওলানা সাহেব তার টর্চ লাইট দিয়ে দিয়েছেন। ব্যাটারী ডাউন হয়ে আছে। টর্চ জ্বালালে চারদিকের অন্ধকার আরো গাঢ় মনে হয়। তাঁকে কাঠেরপুল পার হয়ে মগরা নদীর ঐ পারে যেতে হবে।

রিকশা নিয়ে এই অন্ধকারে কাঠের পুলে ওঠা দুরুহ ব্যাপার, পিছল কাঁচা রাস্তা থেকে খাড়াখাড়ি টেনে অনেকদূর উঠতে হয়। পুলের উপর দিয়ে যখন রিকশা যায় মচমচ শব্দ হয়। মনে হয় এই বুঝি কাঠের কোন একটা টুকরা ভেঙে পড়ে গেল।

দেশের কত পরিবর্তন হল–নীলগঞ্জে কিছু হচ্ছে না। নীলগঞ্জ থেমে আছে।

কাঠেরপুলের কাছাকাছি এসে ফজলুল করিম সাহেব বললেন,বাবা আমি রিকশা থেকে নেমে যাই–তুই টেনে তোল।

স্যার, আফনে টাইট হইয়া বইয়া থাকেন, আল্লাহ মালিক।

রিকশাওয়ালা ঝড়ের গতিতে রিকশা টেনে পুলের উপর তুলে হাঁপাতে লাগল। ফজলুল করিম সাহেব ঠিক করে ফেললেন এইবার শহরে বাসা নেবেন। আর পুল পাড়ি দেয়া না। যদিও তিনি জানেন শেষ পর্যন্ত কোনটাই করা হবে না। শহরের বাইরে মগরা নদীর পশ্চিম পাড়ের এই বাসাবাড়ি ছেড়ে দেয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব না। গাছ গাছালিতে ছাওয়া ছোট্ট ছিমছাম বাড়ি, যার কাছাকাছি এলেই মন ভাল হয়ে যায়। টমাস হার্ডির উপন্যাসটার কথা। মনে পড়ে–Far from the mading crowd.

রিকশাওয়ালা এখনো ধাতস্থ হয়নি–লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস নিচ্ছে। ফজলুল করিম সাহেবের খুব মায়া লাগছে। তিনি রিকশা থেকে নেমে কাঠের পুলের রেলিং ধরে দাঁড়ালেন। মাথায় ছাতা ধরা নেই–পা ভিজে যাচ্ছে, ভিজতে ভাল লাগছে। রিকশাওয়ালা বলল, এই বচ্ছর বিষ্টি বাদলা হয় নাই, কিন্তু পানির কি টান দেখছেন স্যার? পুল কাঁপতাছে।

পাহাড়ি পানি। পাহাড় থেকে নামে–বৃষ্টির সঙ্গে এর সম্পর্ক নাই।

টান যেবায় বাড়ছে পুল ভাঙ্গল বইল্যা।

ফজলুল করিম কিছু বললেন না। পানির টান অনুভব করার চেষ্টা করলেন। কাঠের এই পুলটিও জীবনকৃষ্ণ বাবু বানিয়েছেন। পুল ভেঙে গেলে জীবনকৃষ্ণ বাবুর একটি স্মৃতি নষ্ট হবে। সব চলে গেলেও স্কুল থাকবে। স্কুলের সঙ্গে তিনিও থাকবেন। মহাপুরুষেরা কোন না কোনভাবে থেকেই যান। তবে জীবনকৃষ্ণ বাবুকে মহাপুরুষ বলাটা বোধ হয় ঠিক হচ্ছে না।

স্যার, উঠেন।

নামার সময় সাবধানে নামবে।

ঝড়ের গতিতে রিকশা নামছে। উঁচু নিচু রাস্তা। প্রবল ঝাঁকুনি হচ্ছে। একবার মনে হল তিনি বোধহয় ছিটকে পড়েই যাবেন।

ইউনিয়ন বোর্ডের রাস্তা ছেড়ে রিকশা এবার কাঁচা রাস্তায় নেমেছে। চাকা থেকে ছপছপ শব্দ হচ্ছে। রাস্তায় পানি জমে গেছে।

স্যার, মনে লইতাছে, এই বছর বান হইব।

হতে পারে। প্রতি দুবছর পর পর বন্যা হয়। গত দুবছর বন্যা হয় নি।

ফজলুল করিম সাহেবের বাড়ি দেখা যাচ্ছে। বাইরের উঠোনে রেশমী হারিকেন জ্বালিয়ে রেখেছে। হারিকেনে এত আলো হয়? চারিদিকের সুপারি গাছ পর্যন্ত চোখে পড়ছে।

ফজলুল করিম সাহেবের মন ভাল হয়ে গেল। তিনি জানেন–রেশমী ঘর বাড়ি ঝকঝক করে রেখেছে। উঠোনে জ্বলন্ত হারিকেনের পাশে জলচৌকি। জলচৌকির পাশে বালতি ভর্তি পানি আর একটা মগ। তার পাশেই সাবানদানীতে সাবান। হাত পা ধুতে ধুতেই শুকনা একটা গামছা নিয়ে রেশমী দাঁড়াবে। এই মেয়েটা বোধহয় মনের কথা বুঝতে পারে। সে তাকে তখনই খেতে ডাকবে যখন তিনি ক্ষুধার্ত। খেতে বসে দেখবেন–যে সব খাবার তিনি খেতে চেয়েছেন সেগুলিই রান্না করা হয়েছে। মাঝে মাঝে রাতে তাঁর চা খেতে ইচ্ছা করে। রেশমী সেই সব রাতেই চা বানায়। তার চা খেতে ইচ্ছা করছে না অথচ রেশমী চা বানিয়ে এনেছে এরকম কখনো হয়নি।

রেশমী উদ্বিগ্ন মুখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। ফজলুল করিম সাহেবকে দেখে তার উদ্বেগ কিছুটা কমল। সে ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল।

রেশমীর বয়স তেইশ চব্বিশ। হালকা পাতলা গড়নের জন্যে তাকে আরো কম দেখায়। গায়ের রঙ শ্যামলা। তার চেহারা খুবই সাধারণ, কিন্তু চোখে অসহায় ভাব আছে বলে ফজলুল করিম সাহেব যতবারই তার দিকে তাকনি ততবারই তার খুব মায়া লাগে।

রেশমী বলল, কাঠের পুলটা না-কি ভাইঙ্গা গেছে?

না-তো।

আমি খুব চিন্তার মইধ্যে ছিলাম।

না, পুল ভাঙ্গে নাই। পুলের উপর দিয়েই তো আসলাম।

এই দিকে রটনা পুল ভাঙ্গছে। একটা গরুর গাড়ি পুল ভাইঙ্গা নিচে পরছে।

তিনি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। মানুষ গল্প তৈরী করতে পছন্দ করে। পুল ভাঙ্গেনি অথচ পুল ভাঙ্গার গল্প তৈরী হয়ে গেছে। কেউ এসে চাক্ষুষ দেখে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করছে না।

ফজলুল করিম সাহেব জলচৌকির উপর উঠে দাঁড়ালেন। হাত পা ধুবেন। জলচৌকির পাশেই কাঠের বৌলাওয়ালা খড়ম সাজানো। রেশমীর কাজে কোন রকম খুঁত নেই। তিনি বালতি থেকে মগ ভর্তি পানি নিলেন। পায়ে পানি ঢালতে যাবেন। রেশমী এসে হাত থেকে মগ নিয়ে নিল।

আপত্তি করা অর্থহীন, রেশমী পায়ে পানি ঢালতে দেবে না। কখনো দেয়। পায়ে পানি ঢালার কাজটা সে খুব আগ্রহের সঙ্গে করে।

ফজলুল করিম সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। রেশমী এক হাতে পায়ে পানি ঢালছে। অন্য হাতে কাদা মুছে দিচ্ছে। রেশমীর পিঠ দেখা যাচ্ছে। তার মুখটা শ্যামলা হলেও পিঠতো বেশ ফর্সা দেখাচ্ছে। তার মাথার চুল বাঁধা। এই মেয়েটির চুল খুব লম্বা। ফজলুল করিম সাহেবের শরীর কেমন ঝিম ঝিম করতে লাগল। তিনি চেষ্টা করেও রেশমীর ফর্সা পিঠ থেকে চোখ সরাতে পারছেন না। তিনি বুঝতে পারছেন কাজটা ঠিক হচ্ছে না। ভুল হচ্ছে। অন্যায় হচ্ছে।

রেশমী।

জি।

সাত লাখ টাকা স্কুলের জন্যে পাওয়া গেছে। সরকারি অনুদান। আমার এক ছাত্রের কথা তোমাকে বলেছিলাম না? জয়েন্ট সেক্রেটারী, ও-ই ব্যবস্থা করে দিয়েছে।

ভাল তো।

হ্যাঁ, ভাল। অনেক দিনের ইচ্ছা স্কুলটা পাকা করা। স্কুল ঘর পাকা হবে। ছাত্রদের হোস্টেল থাকবে। টিউব ওয়েল বসানো হবে…….

পা ধোয়ানো হয়েছে। জলচৌকি থেকে নামার সময় ফজলুল করিম সাহেব রেশমীর কাঁধে হাত রেখে নামলেন। এমন না যে তিনি ঢলে পড়ে যাচ্ছিলেন। কাঁধে হাত রেখে তিনি নিজেই লজ্জায় এবং সংকোচে এতটুকু হয়ে গেলেন। রেশমীর কোন ভাবান্তর হল না–যেন এটাই স্বাভাবিক।

খেতে বসে ফজলুল করিম সাহেব অনর্গল কথা বলে যেতে লাগলেন। এটা নতুন কিছু না–রেশমীর সঙ্গে তিনি প্রায়ই গল্প করেন। রেশমী চুপচাপ শুনছে। তার সব গল্পই রেশমীর আগের শোন–একবার না, অনেকবার শোনা–কিন্তু রেশমী এমনভাবে তাকিয়ে আছে যে মনে হচ্ছে সে এই প্রথমবার শুনছে।

 

বুঝলে রেশমী, ১১ই মে নাইননি সেভেন্টি ওয়ান, পাক আর্মি হঠাৎ নীলগঞ্জ এসে উপস্থিত। চারদিকে ছছাটাছুটি হৈ চৈ পড়ে গেল। এখন যে মন্ত্রী আছেন সিরাজ সাহেব তাঁর বাবা মফিজ তালুকদার তখন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান। মিলিটারী গিয়ে উঠল তাঁর বাড়িতে। আমরা সবাই আতংকে অস্থির–কি হয়, কি না হয়। হিন্দু যারা ছিল আগেই চলে গেছে। আমাদের স্কুলের বিনয় বাবু শুধু ছিলেন। তাকে ধরে নিয়ে গেল। তাঁর বাড়িতে মরা কান্না……।

গল্পের মাঝখানে ফজলুল করিম সাহেবের মনে হল–রেশমীর জন্যে তিনি একটা শাড়ি কিনেছিলেন। শাড়িটা রিকশা থেকে রাস্তার কোথাও পড়ে গেছে। নতুন শাড়ি পেলে মেয়েটা খুশি হত। একটা ভুল হয়ে গেল। বিরাট ভুল।

রেশমী।

জ্বি।

বিছানা কর, শুয়ে পড়ব।

গল্পটা শেষ করেন।

আরেক দিন। আজ আর ইচ্ছা করছে না। তুমি বিছানা করে দাও।

খাওয়া দাওয়া করবেন না।

না। শরীরটা ভাল না। উপোস দেব। পঞ্চাশের পর মাঝে মাঝে উপোস দেয়া লাগে।

 

ফজলুল করিম সাহেব ঘুমুতে গেলেন। রেশমী মশারি খাটিয়ে দিল। বিছানার চারদিকে মশারি খুঁজে দিল। পাতলা একটা চাদর গায়ে জড়িয়ে দিল। মেয়েটা কত অসংকোচেই না তার গায়ের উপর ঝুঁকে আছে। করিম সাহেবের নাক ঘেঁষে রেশমীর শাড়ির আঁচল, ফজলুল করিম সাহেব চোখ বন্ধ করে ফেললেন–রেশমীর দিকে তাকিয়ে থাকতে তার এখন কেমন জানি ভয় লাগছে। মেয়েটা গায়ে চাদর জড়াতে এত সময় নিচ্ছে কেন?

খালুজান, হারিকেন জ্বালা থাকুক–সাপের খুব উপদ্রব।

থাকুক, জ্বালা থাকুক।

জ্বলন্ত হারিকেনের দিকে তাকিয়ে থাকতে অনেকদিন পর ফজলুল করিম সাহেব ভয়ংকর সেই স্বপ্ন আবারও দেখলেন। একটা কালো লম্বা লোক তাকে কানে ধরে নিয়ে দৌড়াচ্ছে। তাঁর নিজের গায়ে কোন কাপড় নেই। তিনি সম্পূর্ণ নগ্ন। তিনি চক্কর দিচ্ছেন জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল স্কুলের কম্পাউণ্ডের চারদিকে। চক্কর দিচ্ছেন তো দিচ্ছেনই। তাঁর স্ত্রী দুই মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে এই দৃশ্য দেখছে। তারা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। এই অঞ্চলের আরো অনেকেই আছে। কেউ অবশ্যি হাসছে না। এমন অজর দৃশ্য সবার হাসা উচিত, কিন্তু হাসছে না।

গোঁ গোঁ শব্দ করতে করতে তার ঘুম ভাঙ্গল। তিনি দেখলেন রেশমীর এক হাতে পাখা, সে প্রবল বেগে পাখার বাতাস করছে। ফজলুল করিম সাহেব ক্ষীণ গলায় বললেন–স্বপ্নটা আবার দেখলাম। পানি দাও, পানি খাব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *