যজুর্বেদ-সংহিতা
[শুক্লযজুর্বেদ — তৈত্তিরীয়-সংহিতা]
ভাষ্যানুক্রমণিকার বঙ্গানুবাদ
সর্বপ্রকার পুরুষার্থসিদ্ধির নিমিত্ত বৃহস্পতি প্রমুখ দেবতাবৃন্দ প্রারম্ভে যে দেবতাকে বন্দনা করিয়া কৃতকৃতার্থ হয়েন, সেই গজাননকে আমি নমস্কার করি।
বেদসমূহ যাঁহার নিশ্বস-স্বরূপ, যিনি বেদ-সমূহ হইতে অখিল জগৎকে নিৰ্মাণ করিয়াছেন, আমি সেই বিদ্যাতীর্থ মহেশ্বরকে বন্দনা করিতেছি।
সেই মহেশ্বরের করুণাপ্রভাবে, তাঁহার স্বরূপ ধারণে অর্থাৎ মহেশ্বরতুল্য প্রভাবশালী হইয়া, মহীপতি বুক্ক, বেদার্থপ্রকাশের নিমিত্ত মাধবাচাৰ্য্যকে (সায়ণাচাৰ্য্যকে) আদেশ করেন।
পূৰ্ব্ব-মীমাংসা, উত্তর-মীমাংসা প্রভৃতি অতি যত্নপূৰ্ব্বক ব্যাখ্যা করিয়া, কৃপালু মাধবাচাৰ্য্য বেদার্থ-প্রকাশে বিনিযুক্ত হইয়াছিলেন।
ব্রাহ্মণ, কল্পসূত্র, মীমাংসাদ্বয় এবং ব্যাকৃতি প্রভৃতি উদাহরণাদি সহকারে ব্যাখ্যা করিয়া তৎসাহায্যে তিনি বেদসমূহের অর্থ স্পষ্টীকৃত করিয়াছিলেন।
যদি বল-বেদ কি? তাহার লক্ষণই বা কি? তাহার বিষয় সম্বন্ধ প্রয়োজন অধিকারীই বা কে? তাহার প্রমাণই বা কিরূপে সিদ্ধ হয় এতৎসমুদায়ের অসদ্ভাবহেতু বেদ ব্যাখ্যানযোগ্য হইতে পারে না। এতদ্বিষয়ে প্রমাণ; যথা-ইষ্ট-প্রাপ্তির এবং অনিষ্ট-পরিহারের অলৌকিক উপায়-পরম্পরা যে গ্রন্থের দ্বারা সম্যক্ বিজ্ঞাপিত হয়, তাহাই বেদ। অলৌকিক পদে প্রত্যক্ষ ও অনুমান উভয়বিধ প্রমাণ অপেক্ষিত হয়। পরিদৃশ্যমান্ কচন্দনবনিতা প্রভৃতি হইতে যে ইষ্ট-প্রাপ্তি এবং ওষধ-সেবনাদি দ্বারা যে অনিষ্ট-পরিহার, তাহা অনুমানসাপেক্ষ। এইরূপ ভবিষ্য জন্মগত সুখাদি ভোগও অনুমানগম্য। কিন্তু তাহাও বলিতে পার না। কারণ, জ্যোতিষ্টোমাদি ইষ্টপ্রাপ্তি-হেতু এবং কলঞ্জভক্ষণাদি-বর্জন অনিষ্ট পরিহারমূলক–বেদের প্রমাণ ভিন্ন সহস্র সহস্র অনুমানের দ্বারাও তার্কিক শিরোমণিও তাহা সিদ্ধান্ত করিতে সমর্থ নহেন। এইজন্য বেদ অলৌকিক উপায়বোধক; কিন্তু তাহা লক্ষণের অতিব্যাপ্তি নহে। এইজন্য উক্ত হইয়াছে–প্রত্যক্ষের এবং অনুমানের দ্বারা যাহার উপায় বা কারণ পরম্পরা বোধগম্য হয় না, বেদের দ্বারা তাহা জানিতে পারা যায় বলিয়াই বেদের বেদত্ব সুসিদ্ধ।
সেই উপায়-পরম্পরা নির্ধারণই বেদের বিষয়ীভূত। বিষয়বোধজ্ঞানই বেদের প্রয়োজন। আর সেই জ্ঞানার্থীই অধিকারী সহিত তৎসমূদায়ের উপকাৰ্য্যোপকারকভাব সম্ভব। যদি বল,–এরূপ হইলে স্ত্রী শূদ্র সহিত সকলেই অধিকারী হইয়া পড়ে। কারণ, অনিষ্ট না হইয়া সকলেরই যাহাতে ইষ্ট সাধিত হয়–সকলেরই তাহাই কামনা। কিন্তু তাহা হইতে পারে না। কারণ, স্ত্রী ও শূদ্রের উপায়বোধসামর্থ্য থাকিলেও হেত্বন্তরের দ্বারা তাহাদের বেদাধিকার নিষিদ্ধ হইয়াছে। উপনীত ব্যক্তিরই অধ্যয়নে অধিকারের বিষয় সপ্রমাণ হয়; কিন্তু স্ত্রী-শূদ্রাদি অনুপনীত বলিয়া বেদাধ্যয়ন তাহাদের পক্ষে অনিষ্টজনক বলিয়াই উক্ত হইয়াছে। সুতরাং কিরূপে তাহাদের বেদজ্ঞান তাহাদের পক্ষে অনিষ্টজনক বলিয়াই উক্ত হইয়াছে। সুতরাং কিরূপে তাহাদের বেদজ্ঞান আয়ত্ৰীকৃত করা সম্ভবপর! পুরাণাদিতেও এতৎসম্বন্ধে প্রমাণ বিদ্যমান। অতএব উক্ত হয়–স্ত্রী, শূদ্র এবং দ্বিজবন্ধু ইহাদের বেদে অধিকার নাই। বেদ ইহাদের শ্রুতিগোচর হওয়াও উচিত নহে। মুনিগণ কৃপাপূর্বক এই বিধান নির্দেশ করিয়াছেন।
এই হেতু উপনীত ত্রিবর্ণের অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যেরই বেদের সহিত সম্বন্ধ। বোধকত্ব-হেতু তাহার প্রামাণ্য স্বতঃসিদ্ধ। কিন্তু পৌরুষের বাক্যেরও বোধকত্ব প্রতিপাদিত হয়। সৎপুরুষগত ভ্রান্তিমূলত্ব সম্ভাবনায় তৎপরিহার-কল্পে মূল প্রমাণের আবশ্যকতা উপলব্ধি হইয়া থাকে। কিন্তু বেদ সম্বন্ধে তাহা হয় না। কারণ বেদ নিত্য। বক্তৃদোষাশঙ্কার অনুদয় হেতুও বেদের নিত্যত্ব সিদ্ধ। এতৎসম্বন্ধে সূত্র-গ্রন্থে জৈমিনী বলিয়াছেন,-বাদরায়ণকে অপেক্ষা না করিলেও বেদ যে প্রামাণ্য, তাহাতে সন্দেহ নাই। (জৈ.সূ.অ.১পা.১অ.৪সূ.৫)। যদি বল-ব্রহ্মকাৰ্য্য-শ্রবণ হেতু অর্থাৎ দৈবকাৰ্যনিম্পাদক বলিয়া, কালিদাসাদি বাক্যের ন্যায় বেদ পৌরুষেয়;–যেহেতু শ্রুতিতে ঋচঃ সামানি জঞ্জিরে, ছন্দাংসি জঞ্জিরে তস্মাদজুস্তম্মদজায়ত প্রভৃতি বাক্য শ্রুতিতে পরিদৃষ্ট হয়। এই জন্য ভগবন বাদরায়ণ তাঁহার ব্রহ্মসূত্রে শাস্ত্রযোনিত্বাৎ (ব্র.সূ. ১-১-৩) প্রভৃতি সূত্রে ব্রহ্মকেই বেদকারণ বলিয়া স্বীকার করিয়াছেন। কিন্তু তাহাও বলিতে পার না। কারণ, তিস্মৃতির নিত্যত্ব স্বতঃসিদ্ধ। শ্রুতিতে বাচা বিরূপনিত্যায়াঃ; এবং স্মৃতিতে অনাদিনিধনা নিত্যা বাগুৎস্পৃষ্টা স্বয়ংভুবা প্রভৃতি বাক্য পরিদৃষ্ট হয়। বাদরায়ণও দেবতাদিকরণে সূত্র করিয়াছেন,-অতএব চ নিত্যত্ব (ব্র.সূ. ১-৩-২৯)। এই সকল বাক্যে পরস্পর বিরোধ উপস্থিত হয়। কিন্তু তাহাও বলিতে পার না। কারণ ব্যবহারিত্ব-হেতু নিত্যত্ব সিদ্ধ। সৃষ্টির পর হইতে সংহারের পূর্ব পর্যন্ত ব্যবহার কাল। তাহাতে বেদের উৎপত্তি এবং বিনাশ পরিদৃষ্ট হয় না। কাল এবং আকাশাদি যেমন নিত্য, বেদও সেইরূপ ব্যবহারকালে, কালিদাসদিবাক্যবৎ পুরুষ-বিরচিত নহে বলিয়া নিত্য। আদি সৃষ্টিকালে, কাল এবং আকাশাদির ন্যায় বেদও ব্রহ্মাসকাশ হইতে উৎপন্ন হইয়াছিল। অতএব বিষয়বেধ বিবক্ষিত হইলেও পরস্পর-বিরোধ সিদ্ধ নহে। ব্রহ্ম-দোষহীন নির্দোষ। বেদ তাঁহারই মুখনিঃসৃত অতএব বক্তৃদোষেরও কোনও সম্ভাবনা নাই। অতএব বেদ স্বতঃসিদ্ধ স্বতঃপ্রমাণ্য এবং ব্রহ্মবস্থিত। সুতরাং লক্ষণ ও প্রমাণ এবং বিষয় প্রয়োজন সম্বন্ধ ও অধিকারী প্রভৃতি সুসিদ্ধ হওয়ায়, বেদের প্রামাণ্য সুস্থিত হইল। অতএব বেদ যে ব্যাখ্যানযোগ্য, তদ্বিষয়ে অনুমাত্র সংশয় নাই। উক্ত বিষয়াদি সুসিদ্ধ হইল বলিয়া বেদাধ্যয়ন বিধি। কার–স্বাধ্যায়োহধ্যেতব্যঃ এইরূপ বিধি রহিয়াছে। কিন্তু যদি বল–পাঠমাত্র অধ্যয়ন-বাচ্য; তদ্বারা অর্থাববোধ বিহিত হয় বলিয়া বেদের ব্যাখ্যা করা অপ্রশস্ত। কিন্তু বিধিবোধপৰ্য্যবসায়িত্ব হেতু তাহাও বলিতে পারা যায় না। ভট্টমতানুসারিগণ কর্তৃক এতদ্বিষয় বহুত্র সপ্রমাণ হইয়াছে। এতদ্বিষয়ে শাস্ত্রোক্তি; যথা–অধীত বিষয়ে সম্যক জ্ঞান না জন্মিলে তাহা কেবল শব্দমাত্ৰে পৰ্য্যবসিত হয়। তাহা বিনাগ্নিতে শুষ্ককাষ্ঠ প্রজ্বালিত করিবার প্রচেষ্টার ন্যায়। তাহাতে যেমন কেহই সমর্থ হয় না; জ্ঞানহীন অধ্যয়নেও সেইরূপ কোনও ফলোদয় হয় না। ভারহীন শকট যেমন বৃথা; বেদ অধ্যয়ন করিয়া তাহার অর্থজ্ঞান না হওয়াও তদ্রূপ। আর যিনি বেদার্থে অভিজ্ঞ, তাহার অধ্যয়ন সফল, তিনি সৰ্ব্বমঙ্গল প্রাপ্ত হন। বেদ-জ্ঞানের দ্বারা পাপ বিধৌত হইলে মোক্ষ প্রাপ্ত হওয়া যায়। নিষ্কারণ-ধর্ম ষড়ঙ্গ বেদ অধ্যয়ন করা এবং তৎসম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করা ব্রাহ্মণের কৰ্ত্তব্য। তাহা না হইলে জ্ঞানকে পৃথক রাখিয়া বেদ অধ্যয়ন করা পাঠমাত্ৰে পৰ্য্যবসিত হয়। শঙ্করদর্শনের অনুসারিগণ বেদকে অস্তু নাম ইত্যাদি রূপে বর্ণন করেন। কিন্তু যজ্ঞের বিধি-সমূহের অনুসারী যে অনুষ্ঠান, তদন্যথায় সিদ্ধ হয় না। তাই বেদার্থজ্ঞা না জন্মিলে তদনুষ্ঠান বিধেয় নহে। কিন্তু পূর্বোক্ত বিধিবল-হেতু উচ্চারণ-মাত্র স্বতন্ত্র কোন বিষয় সূচিত হয়। তাই অনুষ্ঠানজ্ঞানের স্বতন্ত্র পৃথক ফলের বিষয় শ্রুত হইয়াছে; যথা,–যাহার অনুষ্ঠানজ্ঞান জন্মিয়াছে, তিনি সকল পাপ হইতে বিমুক্ত হন; এমন কি, অস্বমেধ দ্বারা যজ্ঞ করিলে ব্রহ্মহত্যা পাতকও নষ্ট হয়। সুতরাং যদি বলিতে চাও–অল্প-প্রয়াসসাধ্য অনুষ্ঠানের দ্বারা যদি তাহা সিদ্ধ হয়, তাহা হইলে কি বহু আয়সসাধ্য অনুষ্ঠানে তাহা ব্যর্থ হইবে! কিন্তু তাহাও বলিতে পার না। কারণ, মানস ও বাঁচিক ভেদে ভরণীয় ব্রহ্মহত্যার তারতম্য প্রখ্যাপিত হয়। ব্রহ্মহত্যা বহুবিধা। মনের দ্বারা সঙ্কল্পিত, বাক্যের দ্বারা অনুজ্ঞাত, অপরের দ্বারা কৃত, স্বয়ংকৃত, পুনঃপুনঃ কৃত-ইত্যাদি তারতম্যে ব্যবস্থারও তারতম্য আছে। স্বর্গ যেমন বহুবিধ, তেমনি ব্রহ্মহত্যাপাতক হইতে নিম্মুক্তিলাভ বহুরূপে কল্পিত। স্বর্গকাম ব্যক্তি অগ্নিহোত্র যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিবে, স্বর্গকাম ব্যক্তি দশপূর্ণমাস যাগসমূরে অনুষ্ঠান করিবে, স্বর্গকাম ব্যক্তি জ্যোতিষ্ঠোম যজ্ঞ সম্পন্ন করিবে–ইত্যাদি বাক্যে উচ্চাচ্চ কৰ্ম্মের দ্বারা একবিধ ফল প্রাপ্তি অসম্ভব বলিয়া স্বর্গের বহুবিধত্ব সূচিত হয়। অপচি, কৰ্ম্মানুষ্ঠানকালে যে বেদন বা জ্ঞান হয়, সেই কর্মের ফল অতিশয়িতরূপে উপজিত হইয়া থাকেন। উভৌ কুরুতে যশ্চৈতদ্দেবং বেদশ্চন বেদ ইত্যাদি বাক্য বেদাভিজ্ঞ এবং বেদে অনভিজ্ঞ ব্যক্তিগণ পৰ্য্যায়ক্রমে বলিয়া থাকেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যথার্থজ্ঞানে যাহা অনুষ্ঠিত হয়, তাহাই অধিকতর বীৰ্য্যসম্পন্ন হইয়া থাকে। মনীষিগণের ইহাই অভিমত। প্রশ্ন করিতে পার–অঙ্গ উপস্থি প্রভৃতি ইহার বিষয়ীভূত হইতে পারে না কি? উত্তরে বলিব-না, তাহা হইতে পারে না। কারণ-ন্যায়ের সমানত্বই তাহার হেতু। পূর্বোক্ত বাক্যাদির অর্থোপলব্ধি বিষয়ে উদ্বলক লিঙ্গাদিও বিষয়ীভূত বলিয়া মনে করিতে হইবে। প্রজাপতি প্রথমে সোমযাগ অগ্নিহোত্র পৌর্ণমাস অমাবস্য প্রভৃতি নামক পরস্পর উচ্চাবচ্চ যজ্ঞাদি সৃষ্টি করেন। তারপর সোম্যগ ও অগ্নিহোত্রাদি শ্রেষ্ঠতর অগ্নিষ্ঠোম, উকথ্য, অতিরাত্র প্রভৃতি ক্রমানুসারে পরস্পর উচ্চাচ্চ যাগসমূহের সৃষ্টি করিয়া প্রথম-সৃষ্ট অগ্নিহোত্রাদি যাগে অভিমান-বিশেষের দ্বারা উভয় ১ বর্গকে তুলিত করিয়া ব্যবস্থিত করিয়াছিলেন। এই বৃত্তান্ত যিনি অবগত আছেন, তিনি তাঁহার অনুষ্ঠিত অগ্নিহোত্রাদি যজ্ঞে অগ্নিষ্ঠোমাদি যজ্ঞের ফল প্রাপ্ত হইয়া থাকেন। তৎসম্বন্ধে ব্রাহ্মণে সূত্রিত হইয়াছে; যথা–প্রজাপতি অগ্নিহোত্র, অগ্নিষ্ঠোম, পৌর্ণমাস, উকথ্য-অমাবস্য, অতিরাত্র প্রভৃতি যজ্ঞসমূহকে সৃষ্টি করিয়াছিলেন। যেমন অগ্নিহোত্র, সেইরূপ অগ্নিষ্ঠোম; যেমন পৌৰ্ণমাসী, সেইরূপ উকথ্য; অমাবস্যা যেরূপ, অতিরাত্র সেই প্রকার বিদ্বজ্জন অগ্নিহোত্র-যাগে অগ্নিষ্ঠোমের ফল অধিগত করিতে পারেন এবং অপরকেও সেইরূপ ফল প্রদানে সমর্থ হয়েন। এইরূপ জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি অমাবস্যার অনুষ্ঠান অতিরাত্রের ফল স্বয়ং প্রাপ্ত হন এবং অপরকে সে যজ্ঞের অংশভাগী করিয়া থাকেন ইত্যাদি। এইরূপ বেদনার বা ফলসিদ্ধ-জ্ঞানের স্বতন্ত্র ফল সৰ্ব্বত্র প্রদর্শিত হইয়াছে। সেই ফলসিদ্ধত্ব-হেতু লিঙ্গত্ব সিদ্ধ; অপিচ তত্তদ্বিধিসমপে য এবং বেদ ইত্যাদি বচন-সমূহের বিজ্ঞান হইতে ফল শ্রুত হয়। সে সকল যদি অর্থবাদ হয়–এরূপ আশঙ্কাও হইতে পারে। এস্থলে নাম কল্পনা করিয়া লইলে, বিধেয়ার্থের প্রশংসাপরত্ব-হেতু অর্থাৎ যথার্থ অর্থের শ্রেষ্ঠত্ব নিবন্ধন, অজ্ঞানজনিত ঐ সকল বচনের অন্যার্থ-প্রকাশ অপরাধজনক বলিয়া স্বীকৃত হয়। সেইজন্য যাহা পর শব্দ তাহাই শব্দার্থ এই ন্যায়ে স্বার্থে প্রামাণ্য স্বীকৃত হইতে পারে না। কিন্তু তাহাও বলিতে পারা যায় না। কারণ, তাহাতে প্রমাণান্তর বাধিত হয়। দ্বিঃ সংবৎসরস্য সস্যঃ পচ্যতে অর্থাৎ দুই বৎসরের শস্য নষ্ট হইতেছে প্রভৃতি বাক্যের যে অর্থবাদ, তাহাতে বাধার অভাব না হইলেও অনুবাদত্ব হেতু স্বার্থে প্রামাণ্য স্বীকার করা যায় না। বেদনফল যে বচন-সমূহ, তাহাও অনুবাদক নহে। অর্থবোধেও তাহাতে কোনও বিঘ্ন ঘটে না। অতএব অর্থবাদত্ব বিদ্যমান থাকিলেও প্রকৃত পক্ষে স্বার্থে প্রামাণ্য সিদ্ধ হয়। নচেৎ, মন্ত্ৰার্থবাদাদি হইতে দেবতাদির বিগ্রহাদিমত্ব সিদ্ধ হইতে পারে না। এতৎসম্বন্ধে উক্ত হইয়াছে, বিরোধ-ক্ষেত্রে গুণবাদ, আর নিশ্চিত-পক্ষে অনুবাদ সিদ্ধ। ভূতার্থবাদ এবং তাহা হইতে অর্থবাদ–এই ত্রিবিধ মত স্বীকৃত হয়।
বহুভাবে বিদ্যমান-হেতু এবং বেদনমাত্র হইতে অপূৰ্ব্ব মত বেদনজন্য বেদের ব্যাখ্যা অবশ্য কৰ্ত্তব্য। ইষ্টপ্রাপ্তি এবং অনিষ্ট-পরিহারোপায়–বেদের যে বিষয়-পরম্পরা সামান্যতঃ নির্দিষ্ট হইয়াছে, তৎসমুদায় এক্ষণে সৃষ্টীকৃত হইতেছে। বেদসমূহ কাণ্ডদ্বয়াত্মক। পূৰ্ব্ব কাণ্ডের প্রতিপাদ্য– নিত্য, নৈমিত্তিক, জন্য ও নিষিদ্ধ এই চতুর্বিধ কৰ্ম্ম। দৃষ্টান্ত যথা, নিয়ত নিমিত্ত জন্য জীবনকাল পৰ্য্যন্ত অগ্নিহোত্র যজ্ঞ করিবে ইত্যাদি নিত্য। অনিয়ত নিমিত্ত বলিয়া যস্য গৃহান্দহত্যগ্নয়ে ক্ষামবতে পুরোডাশমষ্টকপালং নিৰ্ব্বপেৎ ইত্যাদি নৈমিত্তিক। চিত্রয়া যজেত পশুকামঃ ইত্যাদি জন্য। তস্মান্মলবদ্বাসসা না সংবদেত না সহাহসীত ইত্যাদি নিষিদ্ধ। নিতানৈমিত্তিক অনুষ্ঠানের দ্বারা। পূর্বোক্ত করণীয়-সমুহের অননুষ্ঠানজনিত প্রত্যবায়রূপ অনিষ্ট স্পষ্ট হয়। সেই প্রত্যবায়-সম্বন্ধে যাজ্ঞবল্ক্যর উক্তি; যথা,–বিহিত কৰ্ম্মের অননুষ্ঠান, নিন্দিত কৰ্ম্মের সেবন, ইন্দ্রিয়সমূহের অনিগ্রহ প্রভৃতি মানুষের পতনের হেতুভূত।
যাবজ্জীবমগ্নিহোত্রং জুহোতি প্রভৃতি বাক্যে বর্জনীয় বিষয়াদি অনুক্ত রহিয়াছে। কিন্তু সেই অনুক্ত বর্জনীয়াদি বর্জনে অনুষ্ঠাতা আপনার অভীষ্ট স্বর্গ প্রাপ্ত হইয়া থাকেন। সেই হেতু আপস্তম্ভ বলিয়াছেন,–তদ্যথা আর্ষে ফলার্থে নিমিত্তে ছায়াগন্ধাবনুৎপদ্যেতে স্পষ্টীকৃত হইয়াছে। ইষ্টব্যাঘাঞ্জপ যে অনিষ্ট, তাহা অর্থ হইতে পরিক্ষীণ হয়। নিষিদ্ধবর্জন হেতু রাগপ্রাপ্ত অনুষ্ঠানের ১ জন্য নরক ভোগ হয় না। কেবল যে নিত্যনৈমিত্তিক অনুষ্ঠানের আনুষঙ্গিক স্বর্গপ্রাপ্তি হয়, তাহা নহে; পরন্তু বিশুদ্ধা ধী শক্তি এবং বিজ্ঞানোৎপাদন দ্বারা পূর্বোক্ত নিত্যনৈমিত্তিক অনুষ্ঠান ব্রহ্মজ্ঞানের হেতু ভূত হইয়া থাকে। এইজন্যই বাজসনেয়িগণ বলিয়াছেন,বেদানুসারী মন্ত্রসমূহের অনুসরণে যজ্ঞ, দান তপ এবং অনাশক দ্বারা ব্রাহ্মণগণ জ্ঞান লাভ করিয়া থাকেন। যদি তাই হয়, তাহা হইলে পূৰ্বকাণ্ডে অশেষ পুরুষার্থসিদ্ধ হইলে, উত্তরকাণ্ডে তাহা হয় না বলিতে হইবে? কিন্তু তাহাও বলিতে পার না। কারণ, তাহাতে সেস্থলে অপুনরাবৃত্তি-লক্ষণের আত্যন্তিক পুরুষাৰ্থ অসিদ্ধ হয়। আথব্বণিকেরা কর্মীর দক্ষিণমার্গে দ্বারা চন্দ্রপাপ্তি এবং পুনরাবৃত্তি সম্বন্ধে বলিয়াছেন,-সে সোমলোকের বিভূতিসমূহ অনুভূতি করিয়া পুনরায় আবর্তিত হয়। ইত্যাদি। অতএব উত্তকাণ্ডে তাহারই অর্থজ্ঞাপক বিষয়-পরম্পরা পরিদৃষ্ট হইবে। আত্যন্তিক-পুরুষার্থ দ্বিবিধ–সদ্যোমুক্তি ও ক্ৰমনুক্তি। বর্তমানদেহ-পাতানন্তর সদ্যোমুক্তি সিদ্ধ হয়। তার পর উত্তরমার্গে গমন করিয়া ব্রহ্মলোকে স্থিতি। সেখানে চিরকাল ভোগ্যসমূহ ভোগ করিয়া ব্ৰহ্মলোকাবস্থানে তুত্রোৎপন্ন জ্ঞানে ক্রমমুক্তি সিদ্ধ হয়। এইজন্য উত্তরকাণ্ডে ব্রহ্মোপদেশ এবং ব্রহ্মোপন্থি এই দ্বিবিধ বিষয় প্রতিপাদিত হইয়াছে। ব্রহ্মেপন্থি প্রসঙ্গে ব্রহ্মদৃষ্ট প্রতীকোপাসনা সাংসারিক ফলকামনাকারীকে লক্ষ্য করিয়াই প্রতিপাদিত। ব্রহ্মোপাসক এবং প্রতীকোপাসক উভয়ই তুল্য। কিন্তু তাহা হইলেও উত্তরমার্গে প্রতীকোপাসকের বিদ্যুল্লোকের উর্দ্ধে ব্ৰহ্মলোকে গমনাভাব-হেতু ক্ৰমমুক্তির অসদ্ভাব হয়। সেইজন্য তাহাদের পুনরাবৃত্তি ঘটে। অপ্রতীকালম্বনান্নয়তি ইত্যাদি অধিকরণে এতদ্বিষয় দৃষ্ট হইবে (ব্রু সু. ৪।৩।১৫)। যদি বল পূৰ্ব্ব ও উত্তর উভয় কাণ্ডের বিষয়বিষেশ এবং প্রয়োজনবিশেষ যদিও একইরূপ প্রকৃতিসম্পন্ন, তথাপি পূৰ্ব্বকাণ্ডের আদিতে কৰ্ম্মান্তর পরিত্যাগ করিয়া দর্শপূর্ণমাস যজ্ঞ কিরূপে প্রতিপাদিত হইতে পারে? উত্তরে বলিব–প্রকৃতিত্ব এবং নিরপেক্ষত্ব ইহার কারণ। প্রকৃষ্টরূপে অঙ্গোপদেশ যাহাতে সমাহিত হয়, তাহাই প্রকৃতি। কৃৎস্ন অঙ্গ-বিষয়ত্ব–উপদেশে প্রশস্ত বা প্রকৃষ্ট পন্থা। বিকৃতিতেও বিষেষাঙ্গের উপদেশ কর্তব্য। প্রকৃতির অঙ্গান্তর-সমূহও অতিদিষ্ট হয়। অতএব অতিদেশের প্রকাভাব সিদ্ধ হইল। প্রকৃতি ত্রিবিধ-অগ্নিহোত্র, ইষ্টি এবং সোম। ত্রিবিধ প্রকৃতিতেই অন্যনৈরপেক্ষত্ব-হেতু স্ব স্ব অঙ্গজাত সৰ্বধিক বিষয়ের উপদেশই কৰ্ত্তব্য। সেস্থলে সোমযাগের স্ব-স্বরূপ অঙ্গসমূহে, যখন অন্য কোনও অঙ্গের অপেক্ষা বর্তমান থাকে না; তখন দীক্ষণীয়া প্রায়ণীয়া প্রভৃতিতে দর্শপূর্ণমাসের অপেক্ষত্ব-হেতু তাহার পূর্বভাবিত্ব অর্থাৎ দর্শপূর্ণমাসের প্রথম অনুষ্ঠান কদাচ যুক্তিমুক্ত নহে। ইষ্টযাগেও সোমযাগ অপেক্ষিত হয় না; সুতরাং ইষ্টেরই প্রাচীনত্ব অর্থাৎ পূৰ্ব্বত্ব যুক্তিসিদ্ধ। যদিও অগ্নিহোত্র-যাগের স্ব-স্বরূপ অঙ্গ-সমূহের সম্পাদনে, অন্য কোনও অঙ্গের অপেক্ষা থাকে না; কিন্তু তথাপি অগ্নিসিদ্ধি অপেক্ষিত হয় বলিয়া আহবনীয়াদি অগ্নির, পবমানেষ্টি সাধ্যত্ব-হেতু পবমান ইষ্টির, দর্শপূর্ণমাসের বিকৃতিত্ব-হেতু তৎপরম্পরা অগ্নিহোত্রেষ্টিতে দর্শপূর্ণমাস ইষ্টির অপেক্ষা থাকিলেও, তাহাদের পূর্বভাবিত্ব অর্থাৎ প্রথমানুষ্ঠান কদাচ মুক্তিদ্ধি নহে। যদি বল,–দর্শপূর্ণমাস যাগেও অগ্নি সাধ্য; সেইজন্য অগ্নিসাধক আধান প্রথম বক্তব্য। কিন্তু তাহাও হইতে পারে না। কেননা, আধানমাত্রেই অগ্নির সাদক নহে। পবমানেষ্টি সম্বন্ধেও তাহাই বক্তব্য। পূৰ্ব্বোক্ত অষ্টবিধ যজ্ঞে দর্শপূর্ণমাসের বিকৃতি-হেতু দর্শপূর্ণমাসই অপেক্ষিত হয়। অতএব নিরপেক্ষত্ব-হেতু দর্শপূর্ণসেষ্টিই প্রথম বক্তব্য। ঋগ্বেদের এবং সামবেদের আদিতে দর্শপূর্ণমাস আশ্নাত হয় না, ইহা সত্য। কিন্তু যজুর্বেদই প্রধান। যজুর্বেদে কর্মসমূহের স্বরূপ আনুপূর্বিক সমামাত হইয়াছে। সেই সেই স্বলে বিশেষ অপেক্ষায় অপেক্ষিত যাজ্যানুবাক্যাসমূহ ঋগ্বেদেও আস্নাত হইয়া থাকে। সামবেদে কেবল স্তোত্রাদিই আশ্নাত হয়। সে ক্ষেত্রে যজুর্বেদ ভিত্তিস্থানীয়; তদ্ভিন্ন অন্যান্য বেদ চিত্রস্থানীয়। তাহা হইতেই কৰ্ম্মসমূহের যজুর্বেদের প্রাধান্য। দর্শপূর্ণমাসেষ্টির প্রারম্ভেই তদ্বিষয়ে আন্নাত হইয়াছে। বেদ মন্ত্রব্ৰাহ্মণাত্মক হইলেও, ব্রাহ্মণ কর্তৃক মন্ত্রব্যাখ্যানরূপত্ব-হেতু প্রথমেই মন্ত্র সম্যক্ আহ্মাত হইয়া থাকে। মন্ত্র ত্রিবিধ–ঋক, সাম ও যজুঃ। বেদমধ্যে যজুম্মন্ত্রে অধ্বর্য্যর বাহুল্য হেতু, কোনও কোনও স্থলে ঋষ্মেন্ত্রে সমাবেশ থাকলেও, তাহা যজুম্মন্ত্র-রূপেই ব্যাখ্যাত হইয়া থাকে। অনাদিসিদ্ধ যাজ্ঞিক সমাখ্যার দ্বারা ইহার অধ্বর্যুবেদত্ব অবগত হওয়া যায়। দর্শপূর্ণমাস ইষ্টির মন্ত্র-সমূহ ত্রিবিধ; যথা–অধ্বর্য্য সম্পর্কীয় যজবান-সম্বন্ধি এবং হোতা সম্পর্কীয়। বেদে এতদ্বিষয় আন্নাত হইয়াছে। দৃষ্টান্ত যথা,–ইবে ত্বা প্রভৃতি প্রপাঠকে পঠিত মন্ত্ৰসমূহ অধ্বর্য্য সম্পর্কিত; সং ত্বা সিঞ্চানি ইত্যাদিতে পঠিত মন্ত্ৰসমূহ যজমান সম্বন্ধি; এবং সত্যং প্রপদ্যে প্রভৃতিতে পঠিত মন্ত্রাদি হোতা সম্বন্ধে প্রযুক্ত। এই সকল মন্ত্রের মধ্যে যজমান এবং হোতৃ সম্বন্ধীয় মন্ত্রসমূহ চিত্রস্থানীয় বলিয়া, ভিত্তিস্থানীয় অধ্বর্য্য সম্পর্কেও মন্ত্রই প্রথম পঠনীয়। ইে অধ্বর্য্য সংক্রান্ত মন্ত্রসমূহ ইবে ত্ব প্রভৃতি প্রপাঠকে ত্ৰায়াদশটী অনুবাকে আন্নাত হইয়াছে। তাহার প্রথম অনুবাকে বৎসাপাকরণার্থ মন্ত্ৰসমূহ; দ্বিতীয় অনুবাকের মন্ত্রসমূহ বৰ্হিসম্পাদনে বিনিযুক্ত তৃতীয়ানুবাকের মন্ত্রসমূহ দোহনার্থক; দ্বিতীয় অনুবাকের মন্ত্রসমূহ বৰ্হিসম্পাদনে বিনিযুক্ত তৃতীয়ানুবাকের মন্ত্ৰসমূহ দোহনার্থক; চতুর্থে হবিনিৰ্ব্বাপক মন্ত্র; পঞ্চমে ব্রীহি অবঘাতার্থক মন্ত্র; ষষ্ঠে তলপেষণাত্মক মন্ত্ৰসমূহ; সপ্তমে– কপালোপধান-বিষয়ক মন্ত্রসমূহ; অষ্টমে পুরোশনিস্পাদক মন্ত্র; নবমে বেদিকরণার্থক মন্ত্র;দশমে আজ্যগ্রহণমূলক মন্ত্ৰসমূহ এবং প্রসঙ্গক্রমে পত্নীসংনহনার্থক মন্ত্ৰসমূহ; একাদশে প্রাধান্যক্রমে এধু-সংনহননিমিত্ত বহিরাস্তরণাদিমূলক মন্ত্ৰসমূহ; দ্বাদশের মন্ত্ৰসমূহ–আধারগ্রহণমূল এবং ত্রয়োদশে সামিধেনিযাজ্যাজ্য ভাগ ও প্রাধনাগাদি নিম্পাদক মন্ত্ৰসমূহ সন্নিবিষ্ট হইলেও, হোত্ৰত্ব-হেতু তৎসমুদায় উপেক্ষিত হওয়ায়, উপরিতন প্রয়োগাঙ্গীভূত আধ্বৰ্য্যব এবং সুগব্যুহনাদি মন্ত্রসমূহ ত্রয়োদশ প্রপাঠকে আশ্নাত হইয়াছে। বিনিয়োগ-সংগ্রহকার কর্তৃক এতৎসমুদায় এইরূপ সংগৃহীত হইয়াছে; যথা–
যে দর্শপূর্ণমাসাঙ্গমা এতে সমাসতঃ। ইষোদ্যনুধাকেষু এয়োদশসু বর্ণিতাঃ ॥ বৎসাপাকরণং বহির্দোহো নিৰ্ব্বাপকমে। পেষণং চ কপালানি পুরোডাশশ্চ বেদিকা । আজ্যগ্রহেম্মসংনাহাবাধারোপরিতন্ত্রকে। ইত্যুজা অনুবাকার্থাঃ প্রতিমন্ত্র ক্রিয়োচ্যতে ॥
ইতি–বৎসাপকরণ কি প্রকার, তাহারা প্রাধান্য বা প্রাথম্যই বা কি প্রকারে সপ্রমাণ হয়–এরূপ সংশয়-প্রশ্ন উত্থাপিত হইলে তদুত্তরে বলিতে হয়,–দশযাগে এবং পূর্ণমাস যাগেক ত্রিবিধ হবিঃ নিৰ্বাপিত হয় দর্শাগে অগ্নিসম্বন্ধী অষ্টকপাল এবং ইন্দ্রসম্বন্ধি দধি ও পয়ঃ; পৌর্ণমাস যাগে অগ্নি সম্বন্ধি অষ্টকপাল আজ্যের দ্বারা প্রজাপতি সম্বন্ধি উপাংশ গোহগ্নীসোমীয় একাদশ কপাল প্রভৃতি আহবনীয়। প্রতিপদ দিনে দধিহোত্র যুগেদধিসম্পাদন জন্য অমাবস্যা তিথিতে রাত্রিকালে গোদোহন কর্তব্য। সেই দোহন জন্য প্রাতঃকালে লৌকিক দোহনের পূর্বে মাতৃগণসহ গননোদ্যত বসদিগকে মাতৃগণ হইতে অপসারিত করিতে হয়। ইহাই হইল–বৎসাপাকরণ। যথারীতি এতদনুষ্ঠান প্রথম কর্তব্য। সদোচ্ছিন্ন পলাশ-শাখা দ্বারা বৎসাপাকর বিধি বলিয়া, পলাশ-শাখা ছেদন জন্য ইষে ত্ব প্রভৃতি মন্ত্র প্রথমেই সমামাত হইয়াছে। সেই মন্ত্রের বৃক্ষছেদন-মূলক যে অঙ্গ, ব্রাহ্মণে তাহা কথিত হইয়াছে। অতএব ব্রাহ্মণ এবং মন্ত্র উভয়ই জ্ঞাতব্য,ছানোগ্যগণ এতদ্বিষয় অবধারণ করিয়াছেন। যথা,-ঋষিবাক্যে অনভিজ্ঞ যে ব্যক্তি ছন্দ, দেবতা, ব্রাহ্মণ এবং মন্ত্রে দ্বারা যজন যাজন এবং অধ্যয়ন ও অধ্যাপনাদি করে, গর্ত নির্মাণ করে, স্থানু পাতিত করে সে পাপভাগী হয়। এই সকলে তৎসমুদায় কথিত হইয়াছে। ঋষিদিগের সহিত সম্বন্ধযুক্ত যাহা তাহাই আর্য। ঋষিগণ অতীন্দ্রিয়ার্থদ্রষ্টা। তাঁহাদের বেদদ্রত্ব সম্বন্ধে কথিত হইয়াছে,–যুগান্তে ইতিহাস সহিত সমস্ত বেদ অন্তর্হিত হয়। স্বয়ম্ভব কর্তৃক অনুজ্ঞাত হইয়া মহর্ষিগণ তপঋপ্রভাবে সেই বেদ প্রাপ্ত হন।
ইষে বাদি মন্ত্রের ঋষিপ্রজাপতি। কাণ্ডানুক্রমণিকায় তৎসম্বন্ধে উক্ত হইয়াছে; যথা– শাশাদিন যাজমানং চ হোতুন হোত্রং চ দার্শিকং। তদ্বিধীন পিতৃমেধং চ নবাহহু কস্য তদ্বিদঃ। ইত্যাদি। শাখাদি ইষে ত্ব ইত্যাদি প্রপাঠক পৰ্য্যায়ভুক্ত। সং বা সিঞ্চানি ইত্যাদি অনুবাক ষটকান্তৰ্গত মন্ত্ৰসমূহ যজমানাখ্য। চিত্তি সুক ইত্যাদি মন্ত্র হোতৃপদবাচ্য। সত্যং প্রপদ্যে ইত্যাদি দার্শিক হোত্র। পূর্বোক্ত চতুর্বিধ মন্ত্রসমূহের চতুর্বিধ ব্রাহ্মণ ও তাহার বিধি আছে; পরে যুবাং সং ইত্যাদি পিতৃমেধ। সেইটী নয়টী কাণাড প্রজাপতি-দৃষ্ট। বেদাঙ্গভূত ছন্দ্ৰঃ নামক গ্রন্থে ছন্দে বিষয়-বিশেষ দ্রষ্টব্য। মন্ত্রপদব্যাখ্যার দ্বারা তৎপ্রতি পাদ্য অর্থরূপ দেবতার বিষয় জানা যায়। সেই সকল মন্ত্রে ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ব্রাহ্মণ-বিশেষ উদাহৃত হইয়া থাকে। যদিও ব্রাহ্মণে মন্ত্রের সর্বপ্রকার বিনিয়োগ আস্নাত হয় নাই; কিন্তু তথাপি কল্পসূত্রকার ব্রহ্মান্তর পর্যালোচনা করিয়া সেই সকল বিষয় স্পষ্টাকৃত করিয়াছেন। অতএব বৌধায়নাদি সূত্র গ্রন্থ হইতে উদাহরাদি সংগ্রহ করিয়া ব্রাহ্মণানুসারে বেদমন্ত্রের ব্যাখ্যায় অগ্রসহ হইতেছি।
ইতি ভাষ্যানুক্রমণিকার বঙ্গানুবাদ সমাপ্ত।
.
ভূমিকা
যজ্ঞানাং তপসাঞ্চৈব শুভানাঞ্চৈব কৰ্ম্মণাম বেদ এব দ্বিজাতীনাং নিঃশ্রেয়সকরঃ পরঃ৷৷ যশ্চ কাষ্ঠময়ো হস্তী যশ্চ চৰ্ম্মময়ো মৃগঃ। যশ্চ বিাহনধীয়ানস্ত্রয়ন্তে নামধারকাঃ।
[বেদহীন মনুষ্য–কাষ্ঠময় হস্তীর বা চৰ্মাবৃত্ত প্রাণহীন মৃগের ন্যায় নামধারী মনুষ্য মাত্র;–বেদ পাঠের শুভফল অবশ্যম্ভাবী;–বেদ-পাঠে অর্থজ্ঞান একান্ত আবশ্যক;–বেদার্থের সত্যজ্ঞানে শ্ৰেয়োলাভ,যজুর্বেদ-প্রচারের ইতিকথা;–বেদজ্ঞানের খনি;-যজুর্বেদ যেমন কর্মপদ্ধতি জ্ঞাপক, তেমনই জ্ঞানের পরিপোষক।]
যজ্ঞ-সমূহের, তপস্যাদি কাৰ্য্যের এবং সকল শুভকর্মের নিগূঢ় রহস্য বেদ-পাঠে অবগত হওয়া; এই জন্যই, বেদই দ্বিজাতিগণের পরম নিঃশ্রেয়সকর। যাঁহারা বেদ অধ্যয়নে বিরত আছেন, শাস্ত্র বলিয়াছেন তাহারা কাষ্ঠ-নিৰ্ম্মিত হস্তী অথবা চৰ্ম্মময় প্রাণহীন দেহধারী মাত্র। শাস্ত্র বাক্যের মৰ্ম্ম এই যে, মানুষ! যদি তুমি সাংসারিক আধিব্যাধি-শোকতাপ হইতে পরিত্রাণ লাভ করিতে চাও, যদি তোমার পরম-নিঃশ্রেয়স রূপ মুক্তিলাভ করিতে আকাঙ্ক্ষা থাকে, তুমি বেদ অধ্যয়নে প্রবৃত্ত হওযদি বেদ অধ্যয়নে প্রবৃত্ত না জন্মে, তুমি বৃথাই দেহধারণ করিয়া আছে, বুঝিবে! কাষ্ঠনির্মিত প্রাণহীন হস্তী যেমন অথবা চৰ্ম্মাচ্ছাদিত প্রাণশূন্য মৃগমূৰ্ত্তি যেমন–হস্তীর অথবা মৃগের উপযুক্ত কোনই কাৰ্য্যসাধক নহে; মনুষ্যদেহ ধারণ করিয়া, দ্বিজাতির মধ্যে পরিগণিত হইয়া, যদি বেদ অধ্যয়ন না করিলে, তোমারও দেহধারণ সেইরূপ বৃথাই হইবে।
সকল বেদ অধ্যয়ন সকলের পক্ষে সম্ভবপর না হইতে পারে। কিন্তু যিনি যে শাখার অন্তর্ভুক্ত, সে শাখার সে বেদ পাঠ করা তাহার একান্ত কর্তব্য। বিদ্যানুরাগী অনেকেই আছেন; বিদ্যার চর্চা অনেকের মধ্যেই বিদ্যমান দেখিতে পাই; গ্রন্থাদি পাঠে অনেকেই অকুণ্ঠিত-চিত্তে কালক্ষেপ করিয়া থাকেন; কিন্তু আপনার ইষ্টসাধক-ঐহিক-পারত্রিকের মঙ্গলপ্রদ যে বেদ, তৎপ্রতি অতি অল্প ধীমানেরই দৃষ্টি নিপতিত দেখি। ইহা যে আত্মার পরম অনিষ্টকর, তাহা অতি অল্প-জনেই স্মরণ করেন। শাস্ত্র তারস্বরে কহিয়াছেন–যন্ত্বনধীতবেদোহন্যত্র শ্রমং কুৰ্য্যাৎ অসৌ সসন্তানঃ শূদ্রত্বমেবিব অর্থাৎ, বেদ অধ্যয়নে বিরত থাকিয়া যিনি অন্য গ্রন্থাদি পাঠে সময়পেক্ষ করেন, পুত্ৰাদি সহ তাহার নীচগতি প্রাপ্তি ঘটে। বেদ পাঠের সুফল-বিষয়ে শাস্ত্র বাক্যের অন্ত নাই। সর্প যেমন খোলস পরিত্যাগ করিয়া নবদেহ লাভ করে, বেদাধ্যয়নের ফলে মানুষও সেইরূপ নবজীবন প্রাপ্ত হয়। শাস্ত্রোক্ত; যথা,সহস্ৰকত্বভ্যস্য বহিরেত ত্ৰিকং দ্বিজঃ। মহতোহপেনসো মাসাৎ ত্বচেবাহিব্বিমুচ্যতে৷৷
অনেকের বিশ্বাস, বুঝি বা তোতাপাখীর ন্যায় আবৃত্তি করিলেই বেদপাঠের ফললাভ হয়। তাই অনেক দেখি, মন্ত্রী মাত্র কণ্ঠস্থ আছে, কিন্তু অর্থজ্ঞান নাই। কেহ কেহ আবার, বুঝিয়াই হউক বা না বুঝিয়াই হউক বেদ-মন্ত্রের অর্থকে বাজালে আবৃত করিয়া রাখিতে চাহেন। প্রকৃত অর্থ বোধগম্য না হইলে, পরন্তু কদার্থ-বিভ্রমে নিপতিত থাকিয়া প্রাধান্য-খ্যাপনে প্রয়াসী হইলে, শোচনীয় অবস্থাতেই উপনীত হইতে হয়। আমাদের দেশের ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতগণের অনেকেই এখন এই অবস্থায় উপনীত। বেদ কি–তাহারা হয় তো চক্ষেও দেখেন নাই; অথবা, বেদের কোনও একটা প্রচলিত ব্যাখ্যা দেখিয়া, তাহাকে লজ্জাবিনম্র হইতে হইয়াছে; এই জন্য, বেদার্থ প্রচ্ছন্ন রাখিবার আকাঙ্ক্ষা, তাহাদের মধ্যে অতিমাত্রায় বলবতী দেখিতে পাই। কিন্তু যাঁহারা একবার চক্ষু মেলিয়া দেখিতে পারিবেন; বেদের মধ্যে কি অমূল্য রত্নরাজি ঔজ্জ্বল্য বিস্তার করিয়া আছে–তাহারা অবশ্যই তাহা দেখিতে পাইবেন;–তাহাদের নিকট, সত্যের আলোক-প্রকাশের ন্যায়, বেদ-বাক্যের অর্থ-প্রকাশ পক্ষে কোনও সংশয় উপস্থিত হইবে না। বেদাধ্যয়নে অর্থবোধ একান্ত প্রয়োজনীয়। বেদানুক্রমণিকার প্রারম্ভে মহামতি সায়ণাচাৰ্য্য তাই উচ্চকণ্ঠে বিঘোষিত করিয়াছেন, যিনি বেদ অধ্যয়ন করিয়াছেন, অথচ বেদের অর্থ অবগত নহেন; তিনি স্থাণুর ন্যায় কেবলমাত্র ভার বহন করিয়াই থাকেন। অগ্নিহীন প্রদেশে শুষ্ক-কাষ্ঠ নিক্ষেপ করিলে, যেমন অগ্নি প্রজ্জ্বলিত হয় না, অর্থ না জানিয়া বেদ-মন্ত্র অধ্যয়নও সেইরূপ নিষ্ফল জানিবে। এ সম্বন্ধে যাস্কোদ্ধৃত শাস্ত্রোক্তি; যথা,
স্থাণুরয়ং ভারহারঃ কিলাভুদধীত্য বেদং ন বিজানাতি যোর্থ। যোর্থজ্ঞ ইৎ সকলং ভদ্রমম্মুতে নাকমেতি জ্ঞানবিপূতপাপমা৷৷ যদগৃহীতমবিজ্ঞাতং নিগদেনৈব শব্দ্যতে। অনগ্লাবিব শুষ্কৈধোন তজ্জ্বলতি কহিঁচিৎ।
মনুষ্য-জীবনের যাহা চরম লক্ষ্য, বেদরূপ নেত্র দ্বারাই তাহা প্রত্যক্ষ হইয়া থাকে। যিনি বেদজ্ঞ নহেন, ব্রহ্মবস্তু তাহার জ্ঞানাতীত রহিয়াই যাইবে। শ্রুতি কহিয়াছেন,–নাবেদবিন্নুনুতে তং বৃহন্ত। শাস্ত্র বাক্য যদি মান্য করিতে হয়, আপনার শ্রেয়েলাভের প্রতি যদি প্রযত্ন থাকে, সমগ্র বেদ অধ্যয়নে সমর্থ যদি নাও হইতে পার, আপন আপন শাখার অন্তর্গত বেদ-পাঠে অনুরক্ত হও। স্বশাখোক্ত বেদও যদি সমগ্র পাঠ করিতে সমর্থ না হও, তবে যতদূর সামর্থ্য হয়, তৎপক্ষে বিরত হইও না। নিত্যকৰ্ম্ম-বিধিতে প্রতিদিন চতুর্বেদের আদ্যমন্ত্র-চতুষ্টয় ব্রহ্মযজ্ঞরূপে পঠিত হইয়া থাকে; সেই পঠন-ক্রিয়া হইতে আমরা কি শিক্ষা লাভ করি? তাহার সারমর্ম এই যে, চতুর্বেদ পাঠ করিতেই উদ্বুদ্ধ হও; সমগ্র বেদ পাঠে শক্তি না থাকে, যে বেদের যতটুকু পাঠ করিতে শক্তিমান হও, তাহাই অধ্যয়ন কর। হেলায় রত্ন হারাইও না। যে বেদের যতটুকু পাঠ করিবার সুবিধা হয়; অর্থজ্ঞানলাভপূৰ্ব্বক তাহাই অধ্যয়নে প্রযত্নপর হও। বঙ্গদেশের বড়ই দুর্ভাগ্য, বাঙ্গালীর নিতান্তই দুর্দৈব যে, বঙ্গাক্ষরে বা বঙ্গভাষায় এ পর্যন্ত বেদের ব্যাখ্যা প্রচারিত হয় নাই। মাত্র ঋগ্বেদের একটি সম্পূর্ণ এবং কয়েকটী অসম্পূর্ণ সংস্কারণ, এবং সামবেদের একটী মাত্ৰ সংস্করণ বঙ্গভাষাতে প্রকাশিত হইয়াছিল; কিন্তু যজুর্বেদ ও অথর্ববেদ যে কখনও বঙ্গভাষায় ব্যাখ্যাত বা প্রচারিত হইয়াছিল, তাহা জানিতে পারা যায় নাই। ঋগ্বেদাদিরও যে সকল সংস্কারণ প্রকাশিত হইয়াছিল, তাহা এখন একপ্রকার অপ্রচলিত; পরন্তু তৎসমুদায় পাশ্চাত্য-মতানুসারী একদেশদর্শিত দোষদুষ্ট; অর্থাৎ–সে সকল অনুবাদে বেদের বিশ্বজনীন মঙ্গলপ্রদ পবিত্র অর্থ অধ্যাহৃত হইয়াছে বলিয়া আমরা বিশ্বাস করি না। সে বিষয়, আমাদের ব্যাখ্যার সহিত অন্যান্য প্রচলিত ব্যাখ্যার তুলনায় আলোচনা করিলেই প্রতীত হইবে।
যে যজুর্বেদের ব্যাখা-প্রসঙ্গে এই ক্ষুদ্র ভূমিকা লিখিত হইতেছে, সেই যজুর্বেদীয় ব্রাহ্মণ এ দেশে বিরল নহেন; কিন্তু সেই বেদ ও তাহার ব্যাখ্যা এ দেশের সম্পূর্ণ বিরল। ভারতের অন্যান্য প্রদেশের যে ব্যাখ্যা যজুর্বেদের অন্তর্গত মন্ত্রের প্রচলিত আছে, তাহাও যে কতদূর সুসঙ্গত, আমরা বলিতে পারি না। মন্ত্রার্থের বিচারকালেই তাহার সঙ্গতি অসঙ্গতি হৃদয়ঙ্গম হইবে। যজুর্বেদের মন্ত্র বিষয়ে মহীধরের ভাষ্যই সৰ্ব্বত্র সমাদৃত হয়! আমরা মন্ত্রসহ সে ভাষ্যই প্রকাশ করিলাম। বাহুল্যভয়ে সে ভাষ্যের বঙ্গানুবাদ প্রকাশে যদিও বিরত রহিলাম; কিন্তু আমাদের আলোচনার মধ্যে তাহার স্থূল বিষয় সন্নিবিষ্ট হইল। সংস্কৃত ভাষায় অনভিজ্ঞ ব্যক্তিগণ সেই আলোচনা-দৃষ্টে ভাষ্যের মর্মার্থ অনুধাবন করিতে পারিবেন। এই ভূমিকার অব্যবহিত পরবর্তী যজুর্বেদানুক্রমণিকা–সেই ভাষ্যকার পণ্ডিতপ্রবর মহীধরেরই রচিত। তাঁহার ভাষ্য ও অনুক্রমণিকা বিশদ ও বিস্তৃত; কিন্তু তিনি যজুর্বেদোৎপত্তির যে বিবরণ প্রদান করিয়াছেন, তাহা সৰ্ব্বথা পুরাণ-প্রসঙ্গের অনুসারী নহে। অতএব, আমরা বিষ্ণুপুরাণ হইতে যজুর্বেদ উৎপত্তির ও বিস্তারের বিবরণ সংক্ষেপতঃ প্রকাশ করা আবশ্যক বলিয়া মনে করিলাম। বেদোৎপত্তির মূল-বিষয়ে বিষ্ণুপারণের উক্তি; যথা, ব্ৰহ্মণা চোদিতে ব্যাসো বেদান্ ব্যস্তং প্রচক্রমে অথ শিষ্যান স জগ্রাহ চতুররা বেদপারগান৷৷ ঋগ্বেদশ্রাবকঃ পৈলং জগ্রাহ স মহামুনিঃ বৈশম্পায়ননামানং যজুর্বেদস্য চাগ্রহীৎ৷৷ জৈমিনিং সামবেদস্য তথৈবাথর্ববেদাবৎ। সুমন্তুস্তস্য শিষ্যোহভূদ্বেদব্যালস্য থীমতঃ।।
ভাবার্থ, বেদব্যাস ব্রহ্মার নিকট হইতে চারি বেদ প্রাপ্ত হইয়া, চারি জন বেদপরাগ শিষ্যকে (পৈলকে ঋগ্বেদ, বৈশম্পায়নকে যজুর্বেদ জৈমিনিকে সামবেদ এবং সুমন্তকে অথর্ববেদ) শিক্ষা দিয়াছিলেন (বি. পু. ৩৫।৭.৯)। এ বিষয়ে অবশ্য, পুরাণের সহিত ভাষ্যকারের মতভেদ দৃষ্ট হয় না। গুরু বৈশম্পায়ন, শিষ্য যাজ্ঞবল্ক্যর প্রতি যে কারণবশতঃ রোষপরায়ণ হন, তাহার বিশেষ উল্লেখ অনুক্রমণিকায় নাই। বিপ্র নিন্দার কারণ যাজ্ঞবল্ক্যের প্রতি বৈশম্পায়ন রোষাবিষ্ট হইয়াছিলেন, পুরাণে এইরূপ উল্লেখ আছে। অধীতবিদ্যা উদ্গীরণ বিষয়ক রূপ ভাষ্যানুক্রমণিকাতে পুরাণেরই অনুবর্তী দেখি। কিন্তু একটী বিষয়ে পুরাণের সহিত ভাষ্যকারের মতদ্বৈধ দেখিতে পাই। পুরাণে আছে,–যজুংষ্যথ বিসৃষ্টানি যাজ্ঞবন্ধ্যেন বৈ দ্বিজাঃ। জগৃহুস্তিত্তিরা ভূত্বা তৈত্তিরীয়াস্তু তে ততঃ।। এখানেও গুরুতর ভাববত্যয় ঘটিয়াছে বলিয়া মনে করি না। কিন্তু যাজ্ঞবল্ক্যের পরিচয় প্রসঙ্গে পুরাণে আছে,–যাজ্ঞবল্ক্যস্তু..ব্রহ্মরাতসুতো দ্বিজঃ। অথচ শ্রুতিবাক্য,–বাজসনেয়েন যাজ্ঞবল্ক্যন। তবে কি বাজসনি ও দেবরাত অভিন্ন? অথবা, দুই যাজ্ঞবল্ক্যের বিষয় এখানকার লক্ষীভূত? অপিচ, পুরাণে বাজসনির উৎপত্তির বিষয় যাহা বর্ণিত আছে, তাহাতে যাজ্ঞবল্ক্যকে বাজসনির অপত্য (পুত্র) বলিতে পারা যায় না। যাজ্ঞবল্ক্য যখন সূর্যদেবের নিকট নিৰ্ম্মল বেদবিদ্যা লাভের প্রয়াসী হইয়াছিলেন, পুরাণের ভাষায় রূপকে প্রকাশ, সূৰ্য্যদেব তখন বাজিরূপ ধারণপূৰ্ব্বক অভিলাষানুরূপ বর প্রদান করিয়াছিলেন। সেই হইতে, বাজি-পোক্ত বলিয়া, বাজসনের নাম সূচিত হয়। যথা,–যজুংষি যৈরধীতানি তানি বিপ্রৈদ্বিজোত্তম। বাজিনস্তে সমাখ্যাতাঃ সূৰ্য্যাশ্বঃ সোহভবদ্যতঃ ॥ এই হইতেই শুক্লযজুর্বেদের শাখা বাজসনোর-সংহিতা নামে অভিহিত। পুরাণে উক্ত আছে, যজুর্বেদের আর এক নাম–অযাতযাম। বৈশম্পায়নেরও যে বিদ্যা অজ্ঞাত ছিল, সূৰ্য্যদেব কর্তৃক সে বিদ্যা পর্যন্ত যাজ্ঞবল্ক্যকে প্রদত্ত হইয়াছিল। এই হেতু সেই হইতে শুক্লযজুর্বেদের অপর একটী নাম অযাতযাম হয়।
যজুর্বেদের বিভাগাদির পরিচয়, ঋগ্বেদ-সংহিতায় ভূমিকা-প্রসঙ্গে উল্লিখিত হইয়াছে। অনেকে মনে করেন, উপনিষদ্ হইতে বেদ স্বতন্ত্র; উপনিষদে যে জ্ঞানমার্গের দিব্যজ্যোতিঃ দৃষ্ট হয়, বেদে তাহার অসদ্ভাব আছে। বলা বাহুল্য, এ মত পাশ্চাত্যের অনুসারী। অতি অসভ্য আদিম অবস্থায় যখন জ্ঞানের স্ফুরণ হয় নাই, তাঁহাদের মতে, বেদ সেই আদিকালের রচনা। পরিশেষে জ্ঞানস্ফুৰ্ত্তির সঙ্গে সঙ্গে উপনিষদাদি পরিস্ফুট হইয়াছিল কিন্তু সে ধারণা–বিভ্রম মাত্র। কেননা, উপনিষৎ-সমূহও বেদেরই অন্তর্ভুক্ত হইয়া আছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ এই বাজসনেয়-সংহিতার চত্বারিংশৎ অধ্যায় লক্ষ্য করতে পারি; সে অধ্যায়ে, ঈশোপনিষৎসম্পূর্ণ বিদ্যমান রহিয়াছে। এইরূপ ভিন্ন ভিন্ন উপনিষৎ বেদের ভিন্ন ভিন্ন স্থানে লক্ষিত হয়। কোনও কোনও উপনিষৎ বেদের অন্তর্ভুক্ত না হইয়াও বেদার্থপ্রকাশক-রূপে প্রদীপ্ত রহিয়াছে। ফলতঃ, বেদের মধ্যে, বেদের ব্যাখ্যার মধ্যে, উপনিষদের জ্ঞান যে ওতঃপ্রোতঃ অবস্থিত রহিয়াছে, চক্ষুষ্মন্ মাত্রেই তাহা প্রত্যক্ষ করিতে পারেন। এই যে যজুর্বেদ–যাহার ভূমিকার প্রসঙ্গে এতদ্বিষয় আখ্যাত হইল; তাহার মধ্যে জ্ঞান কৰ্ম্ম ভক্তি তিনেরই বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। যজুর্বেদ যেমন কৰ্ম্মপদ্ধতি-জ্ঞাপক, যজুর্বেদ জ্ঞানের পরিপোষক; আবার উহার মধ্যে ভগবদ্ভক্তির অমৃতনিঃশ্যন্দিনী ধারা প্রবাহমান রহিয়াছে। বৃহগ্রন্থ; ধৈৰ্য্যহারা হইলেই রসাস্বাদে বিঘ্ন ঘটিবে। একাগ্রচিত্তে মন্ত্রগুলির অভ্যন্তরে প্রবেশ করুন। কৰ্ম্ম জ্ঞান ভক্তি–ত্রিতত্ত্বের অনুপ্রাণিত হউন। দেখিবেন,অন্ধতমসাচ্ছন্ন হৃদয়ে দিব্যজ্যোতিঃ স্বতঃ-বিকশিত হইবে। হয় তো প্রথমাংশ কিছু দুৰ্ব্বোধ্য জটিল বলিয়া বোধ হইতে পারে; কিন্তু উত্তরোত্তর যতই অগ্রসর হওয়া যাইবে, ইক্ষুদণ্ডের ক্লেশকর চক্মণব্যাপারের পর চোষণণাপযোগী মধুর রসের ন্যায় আনন্দ-সুধাস্বাদ ততই অনুভূত হইবে।
.
যজুর্বেদানুক্রমণিকার বঙ্গানুবাদ
লক্ষ্মীদেবীকে, নরহরিদেবকে এবং গণপতিকে প্রণতিপূৰ্ব্বক, উবটের এবং মাধবের ভাষ্য দর্শন করিয়া, আত্মজ্ঞানপরিবর্ধন কামনায় এবং পরোপকারসাধনকল্পে, অর্থ সহ আমি যজুম্মন্ত্র প্রকটন করিতেছি।১।
অনুয়াকে দূরে পরিত্যাগ করিয়া, আমার প্রতি কৃপাপূৰ্ব্বক, বুদ্ধিমান দ্বিজশ্রেষ্ঠ পণ্ডিতগণ বেদরূপ এই দীপ, সরল অন্তঃকরণে দর্শন করিবেন।।২।।
আদিতে ব্রহ্মপরস্পরাক্রমে প্রচারিত বেদ (মহামতি) বেদব্যাস প্রাপ্ত হন। মন্দমতি মনুষ্যগণের কল্যাণ কামনা করিয়া, কৃপাপূৰ্ব্বক তিনি বেদকে চারি ভাগে বিভক্ত করেন; ঋক, যজুঃ, সাম, অথৰ্ব্ব এই চারি ভাগে কর্তৃক বেদ বিভক্ত হয়। ঐ বেদচতুষ্টয় সম্বন্ধে মহামতি বেদব্যাস, যথাক্রমে পৈল, বৈশম্পায়ন, জৈমিনি ও সুমস্তুকে উপদেশ দেন। তাহারা আবার আপন শিষ্যগণকে তাহা শিক্ষা দিয়াছিলেন। এই প্রকারে পরম্পরাক্রমে বেদের সহস্র শাখা প্রবর্তিত হইয়াছিল। অনন্তর ব্যাস-শিষ্য বৈশম্পায়ন, যাজ্ঞবল্ক্যাদি স্বশিষ্যগণকে যজুর্বেদ অধ্যয়ন করান। অতঃপর, কোনও কারণে হঠাৎ শিষ্য যাজ্ঞবল্ক্যের প্রতি ক্রুদ্ধ হইয়া, গুরু বৈশম্পায়ন, যাজ্ঞবল্ক্যকে বলিয়াছিলেন,–আমার নিকট অধীত বেদ পরিত্যাগ কর। যোগসামর্থ্যবশতঃ যাজ্ঞবল্ক্য বেদকে মূর্তিমান করিয়া যথাবিধি উদগীরণ করেন। গুরু কর্তৃক সেই বেদবিদ্যা পুনগৃহীত হইলে, বৈশম্পায়নের শিষ্যগণ তিত্তির মূৰ্ত্তি পরিগ্রহ করিয়া গুরু যাজ্ঞবল্ক্যর উদগীরিত সেই যজুর্বেদকে ভক্ষণ করেন। (ভাবার্থ এই যে, যাজ্ঞবল্ক্যের প্রতি গুরু বৈশম্পায়ন অসন্তুষ্ট হইলে, বৈশম্পায়ন-শিষ্য তিত্তির মুনিগণ যজুর্বেদ শিক্ষা করেন)। কিন্তু শিষ্যের বুদ্ধিমালিন্য-হেতু যজুর্বেদ কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করিয়াছিলেন। (বেদাংশের কৃষ্ণ-যজুদে নামের ইহাই তাৎপৰ্য্য)। অনন্তর বিষাদিত চিত্ত যাজ্ঞবল্ক্য সূৰ্য্যদেবের আরাধনার ফলে শুক্লযজুর্বেদ প্রাপ্ত হন। (ভাবার্থ এই যে,-গুরু বৈশম্পায়নের নিকট বেদাধ্যয়নের পর, সূৰ্য্যদেবের নিকট যাজ্ঞবল্ক্য বেদজ্ঞানের পূর্ণতা লাভ করেন; তাহাতে শুক্লযজুর্বেদ রূপ বেদ তাহার অধিগত হয়)। সেই শুক্ল যজুর্বেদের মন্ত্র সমূহ যাবাল, গৌধেয়, কাৰ্থ, মাধ্যন্দিন প্রভৃতি তাহার (যাজ্ঞবল্ক্যর) পঞ্চাশ শিষ্য কর্তৃক পঠিত হয়। এ সম্বন্ধে শ্রুতিতে (বৃহদারণ্য, মাধ্যং ৫।৫,৩০) উক্ত হইয়াছে, আদিত্যানোমানি ইত্যাদি; অর্থাৎ, আদিত্য হইতে অধীত, সুতরাং শুক্ল বিশুদ্ধ। বাজ অর্থাৎ অন্ন, সনি অর্থাৎ যিনি দান করেন, তিনি বাজসনি। তাহার অপত্যবাজসনেয়। সেই বাজসনেয়-রূপ মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য আপন শিষ্যদিগকে বেদ বিষয়ে শিক্ষাদান করিয়াছিলেন। তাহা হইতে মাধ্যদিন মহর্ষি যে যজুর্বেদের শাখা-বিশেষ প্রাপ্ত হন, তাহা মাধ্যন্দিন শাখা নামে অভিহিত। যদিও যাজ্ঞবল্ক্য আপনার বহু শিষ্যকে যজুর্বেদ অধ্যয়ন করাইয়াছিলেন, তথাপি জগদীশ্বরের কৃপায় মধ্যন্দিন সম্বন্ধীয় মাধ্যন্দিন-শাখাই লোকে প্রখ্যাত আছে। সেই মাধ্যন্দিন বেদ যিনি অধ্যয়ন করেন, জানেন, এবং শিষ্য-পরম্পরাক্রমে যাঁহাদের মধ্যে ঐ বেদের আলোচনা আছে, তাঁহারা মাধ্যন্দিন নামে অভিহিত হইয়া থাকেন। (ইহাই মাধ্যন্দিন-শাখায় উৎপত্তির মূল)।
শতপথ-ব্রাহ্মণে (শ.ব্রা, ১১।৫৬।৭) বিধি আছে,–অতএব স্বাধ্যায়োহধ্যেতব্যঃ ইতি। অর্থাৎ এই বেদ অধ্যয়ন করা কর্ত্তব্য। যিনি যে শাখায় অন্তর্নিবিষ্ট, তাহার পক্ষে সেই শাখা অধ্যয়ন করাই বিহিত; অর্থজ্ঞান-পূৰ্ব্বক অধ্যয়ন, প্রতি মন্ত্র, ঋষি, ছন্দঃ, দেবতা, বিনিয়োগ প্রভৃতির জ্ঞানলাভ বিধেয়। অন্যথায়, পাপ সংস্পর্শ ঘটে। পূৰ্ব্বোক্ত অধ্যয়ন-বিধি না-জানিয়া যাঁহারা বেদ অধ্যয়ন করেন এবং বেদবাক্য উচ্চারণ করেন, মন্ত্র জপ করেন তদ্বারা হোম-কৰ্ম্ম নিষ্পন্ন করেন, যাগ করেন এবং যাগ সম্পন্ন করান, তাহাদের ব্রহ্মকর্ম নিৰ্ব্বীৰ্য্য অর্থাৎ ফলোপধায়ক হয় না। মহর্ষি কাত্যায়ন (অনুক্রম ১।১) কহিয়াছেন, –ঐরূপ মন্ত্রোচ্চারণকারিগণ (যাহারা অর্থজ্ঞানশূন্য ও কৰ্ম্মপরাগ নহে), স্থাণুবৎ প্রতীয়মান হয়, তাহাদিগকে পাপ স্পর্শ করে এবং তাহাদিগের নীচগতি প্রাপ্তি ঘটে। মন্ত্রে ঋষি প্রভৃতি জ্ঞানের ফল বিষয়ে পুনঃপুনঃ শাস্ত্রে উক্ত হইয়াছে। ঋষি প্রভৃতির বিষয় অবগত হইয়া, যাঁহারা বেদ পাঠ করিবেন, তাহাদের শক্তি বৃদ্ধি হইবে; যাহারা অর্থোপলব্ধি করিয়া মন্ত্র পাঠ করেন, তাহারা অধিকতর শক্তিমন্ত হইয়া থাকেন। সে ক্ষেত্রে তাহারা জপে ও হোমে অভীষ্ট ফল প্রাপ্ত হইয়া থাকেন, কাত্যায়ন (অনু. ১।১) ইহাও বলিয়া গিয়াছেন। অতএব, বেদমন্ত্রের ঋষি প্রভৃতির জ্ঞান অত্যাবশ্যক। অন্যথা সকল কৰ্ম্মই পণ্ড হয়।
যজুর্বেদ-মন্ত্রের মধ্যে কতকগুলি যজুঃ (গদ্য) আছে, আর কতকগুলি ঋক্ (ছন্দঃ) আছে। ঋক্গুলির যথাযোগ্য অক্ষর ও পদের উচ্চারণ আবশ্যক। ছন্দো বিষয়ে কাত্যায়ন উপদেশ দিয়া গিয়াছেন। পিঙ্গলের মতে–যজুম্মন্ত্রের মধ্যে ষড়ুত্তর শতাজ্ঞয় অর্থাৎ এক শত ছয় অক্ষরে শেষ এবং একাক্ষরবিশিষ্ট দৈবী মন্ত্রও আছে। তদ্ভিন্ন হোতা যক্ষদ্ধনস্পতিঃ প্রভৃতি অধিক-অক্ষর-বিশিষ্ট যজুম্মন্ত্রে (অ. ২১।৪৬) ছন্দঃ কল্পনা করা হয় না।
প্রথম অধ্যায়ের এবং দ্বিতীয় অধ্যায়ের অষ্টাবিংশতি কণ্ডিকা পৰ্য্যন্ত অংশের মন্ত্রগুলি, দশপূর্ণমাস যজ্ঞে প্রযুক্ত হয়। ঐ সকল মন্ত্রেব ঋষি দেবতা–পরমেষ্টী প্রাজাপত্যঃ অথবা প্রাজাপত্যঃ। দ্বিতীয় অধ্যায়ের শেষ ছয়টি কণ্ডিকায় পিতৃযজ্ঞের মন্ত্র আছে; তাহার ঋষি প্রজাপতি। প্রথম অধ্যায়ের সমস্ত যজুম্ম একাপুরা ক্রস্যেতি (২।২৮) ঋক্। পিঙ্গলোক্ত ছন্দোবিধিতে যজুম্মন্ত্রের ছন্দঃ প্রভৃতির বিষয় বিবৃত আছে। বাহুল্যভয়ে তাহা এস্থলে উক্ত হইল না। যাহা ঋক্, তাহাকে ছন্দঃ বলিয়া জানিবে। আদি কণ্ডিকায় পাঁচটী মন্ত্র আছে। তন্মধ্যে দুইটী মন্ত্র এ্যক্ষর-বিশিষ্ট, তৃতীয় মন্ত্র-চতুরক্ষরবিশিষ্ট, চতুর্থ মন্ত্র– দ্বিষষ্ট্যক্ষরবিশিষ্ট, এবং পঞ্চম–নবাক্ষরবিশিষ্ট।
প্রকৃতি-আদিভূত যে মন্ত্র, তাহা দর্শপূর্ণমাস-যজ্ঞে প্রযোজ্য। যাহাতে সকল প্রকার কৰ্ম্মাঙ্গের বিষয়ে উপদেশ প্রদত্ত হইয়াছে, তাহাকে প্রকৃতি (প্রকৃতি-যাগ) বলে। যাহাতে অঙ্গবিশেষের উপদেশ আছে,, প্রকৃতির অঙ্গান্তরের বিকৃতি-হেতু, তাহা বিকৃতি নামে উক্ত হয়। প্রকৃতি–তিন প্রকার; যথা–অগ্নিহোত্র, ইষ্টি, সোম। দর্শপূর্ণমাস-যজ্ঞের অনুষ্ঠানের অধিকারী হইয়া প্রথমেই অগ্ন্যাধান মন্ত্র উচ্চারণ করা কর্তব্য মধ্যে পরিগণিত হইলেও পবমান ইষ্টিতে যে মন্ত্রের বিধান আছে, তাহার ব্যত্যয়ে কাৰ্য্য অসিদ্ধ হয়। পবমান ইষ্টিরূপ যাগের দর্শপূর্ণমাস-বিকৃতিহেতু সামমন্ত্রে দীক্ষণীয় অপ্রায়ণীয় (অনারম্ভনীয়) প্রভৃতি অবস্থায় দর্শপূর্ণমাস অপেক্ষিত থাকে। সেই হেতু সৰ্ব্বপ্রথমেই দর্শপূর্ণমাস মন্ত্র পাঠ করা বিধেয়। ইষে ত্ব প্রভৃতি মন্ত্র সেই বিষয়ে ইষ্টসাধক।*
.[*প্রথম কণ্ডিকায় ইযে ত্বা প্রভৃতি যে পাঁচটি মন্ত্র আছে, তাহার প্রথম, দ্বিতীয় ও পঞ্চম মন্ত্রের দেবতা শাখা, তৃতীয় মন্ত্রের দেবতা গোবৎসা, চতুর্থ মন্ত্রের দেবতা গাবঃ (গাভীসমূহ), এইরূপ অধ্যাহৃত হয়। ব্যাখ্যাকারগণ তদনুসরণেই ব্যাখ্যা করিয়া গিয়াছেন। আমাদের ব্যাখ্যা কিন্তু স্বতন্ত্ররূপ হইল। দুই ব্যাখ্যা মিলাইয়া যাহার যে ব্যাখ্যা গ্রহণীয়, তিনি তাহাই গ্রহণ করিবেন। (সম্পাদক)।]
.
.
যজুর্বেদ সংহিতা
[শুক্লযজুর্বেদ –- বাজসনেয়িয় — মাধ্যন্দিন সংহিতা — পূর্বার্ধ
প্রথম অধ্যায়
মন্ত্রঃ– ওঁ। ইষে ত্বোর্জে ত্বা বায়ব স্থ। দেবো বঃ সবিতা প্রাপয়তু শ্রেষ্ঠতমায় কর্মণে। আপ্যায়ধ্বমগ্ন্যা ইন্দ্রায় ভাগং প্রজাবতীরনমীবা অযক্ষ্মা। মা ব স্তেন ঈশত মাঘশংসো। ধ্ৰুবা অস্মিন গোপতৌ স্যাথ বীঃ। যজমানস্য পণুন পাহি৷৷১। বসোঃ পবিত্ৰমসি। দৌরসি পৃথিব্যসি। মাতরিশ্বনো ঘৰ্মোহসি বিশ্বধা অসি। পরমেণ ধামা দৃংহস্ব মা হৃর্মা তে যজ্ঞপতি র্ষীৎ৷৷২। বসোঃ পবিত্রমসি শতধারং বসোঃ পবিত্রমসি সহস্রাধারম্! দেবস্থা সবিতা পুনাতু বসোঃ পবিত্রেণ শতধারেণ সুস্বা। কামধুক্ষঃ৷৩৷৷ সা বিশ্বায়ুঃ। সা বিশ্বকর্মা। সা বিশ্বধায়াঃ। ইন্দ্রস্য ত্বা ভাগং সোমেনাতমি। বিষ্ণো হব্যং রক্ষ৷৷৷৷ অগ্নে ব্ৰতাপতে ব্ৰতং চরিষ্যামি তুচ্ছকেয়ং তন্মে রাধ্যতাম্। ইদমহমনৃত্যৎ সত্যসুপৈমি।।৫।কা যুনক্তি সত্বা যুক্তি কস্মৈ ত্বা যুনক্তি তস্মৈ ত্বা যুনক্তি। কর্মণে বাং বেষয় বাম৷৷৬৷৷ প্রত্যুষ্টং রক্ষঃ প্রত্যুষ্টা অরাতয়ঃ। নিষ্টপ্তং রক্ষো নিষ্টপ্তা অরাতয়ঃ। উর্বন্তরিক্ষমন্বেমি৷৷৭৷৷ ধূরসি ধূর্ব ধূর্বন্তং ধূর্ব তং যোহশ্মন্ ধূর্বতি তং ধূর্ব যং বয়ং ধূর্বামঃ। দেবানামসি বহ্নিতমং সম্নিতমং পপ্রিতমং জুষ্টতমং দেবহুতমম্।।৮৷৷ অনুমসি হবিধানং দৃংহ মা হৃার্মা তে যজ্ঞপতি হ্রার্ষীৎ। বিষ্ণুত্ত্বা ক্রমতা। উরুবার্তায়। অপহতং রক্ষঃ। যচ্ছন্তাং পঞ্চ৯৷৷ দেবস্য বা সবিতুঃ প্রসবেংশ্বিনোর্বাহুভ্যাং পূষ্ণো হস্তাভ্যাম্। অগ্নয়ে জুষ্টং গৃহাম্যষ্মীযোমাভ্যাং জুষ্টং গৃহ্নামি।।১০৷ ভূতায় ত্বা নারাতয়ে, স্বরভিবিখ্যেষং, দৃংহন্তাং দুৰ্যাঃ পৃথিব্যামুর্বন্তরিক্ষমন্বেমি, পৃথিব্যাস্থা নাভৌ সাদয়ামদিত্যা উপহেগ্নে হব্যংরক্ষ৷৷১১৷৷ পবিত্রে স্থা বৈষ্ণব্যেী, সবিতুর্বঃ প্রসব উৎপুনাম্যচ্ছিদ্রেণ পবিত্রেণ সূৰ্য্যস্য রশ্মিভিঃ। দেবীরাপো অগ্রেগুবো অগ্ৰেপুৰাহগ্র ইদমদ্য যজ্ঞং নয়তাগ্রে যজ্ঞপতিং সুধাতুং যজ্ঞপতিং দেবযুব৷১২৷৷ যুগ্ম ইন্দ্ৰোহণীত বৃত্ৰতূর্যে। যুয়মিন্দ্রমবৃণীধ্বং বৃত্ৰভূর্যে। প্রেক্ষিতা স্থ। অগ্নয়ে ত্বা জুষ্টং প্রেক্ষাম্যষ্মীযোমাভ্যাং দ্বা জুষ্টং প্রোফ্লামি। দৈব্যায় কর্মণে শুন্ধধ্বং দেবযজ্যায়ৈ যদ্বোহশুদ্ধাঃ পরজয়ুরিদং বস্তুচ্ছুন্ধামি৷৷১৩৷৷ শর্মাস্যবধূতং রক্ষোহবধূতা অরাতয়োহদিত্যাগসি প্রতি জ্বাদিতিত্ত্বে। অদ্রিরসি বানম্পত্যো গ্রাবাহসি পৃথুবুঃ প্রতি বৃহদিত্যাথেন্ডু৷৷১৪৷৷ অগ্নেশুনুরসি বাচো বিসর্জনং দেববীতয়ো ত্বা গৃমি বৃহদগ্রাবাহসি বানম্পত্যঃ। স ইদং দেবেনভ্যা হবিঃ শমী সুশমি শমী। হবিষ্কদেহি হবিষ্কৃদেহি হবিদেহী৷৷১৫৷৷ কুকুটোহসি মধুজি ইষমূৰ্জমাবদ ত্বয়া বয়ং সংঘাতং সংঘাতং জেন্ম বর্ষবৃদ্ধমসি। প্রতি ত্বা বর্ষবৃদ্ধং বে। পরাপুতংরক্ষঃ পরাপূতা অরাতয়োহপ-হতং রক্ষো বায়ুর্বো বিবিন। দেবো বঃ সবিতা হিরণ্যপাণিঃ প্রতিগৃত্মত্বচ্ছিদ্রেণ পাণিনা৷১৬৷ ধৃষ্টিরস্যপাইয়ে অগ্নিমা মাদং জহি নিব্যাদং সেধা দেবযজং বহ। ধ্রুবমসি পৃথিবীং দৃংহ ব্ৰহ্মবনি ত্ব ক্ষত্ৰবনি সজাতন্যপদধামি ভাতৃব্যস্য বধায়৷৷১৭৷৷ অগ্নেব্ৰহ্ম গৃঙ্খী, ধরুণমস্যন্তরিক্ষং দৃংহ ব্ৰহ্মবনি ত্বা ক্ষত্ৰবনি সজাতন্যপদধামি ভ্রাতৃব্যস্য বধায়। ধর্মসি দিবং দৃংহ ব্ৰহ্মবনি ত্বক্ষত্ৰৰনি সজাতবপদধামি ব্রাতৃব্যস্য বধায়। বিশ্বাভ্যাশাভ্য উপদধামি। চিত হোচিত ভৃগুণামরিসাং তপসা তপ্যধ্বম্৷৷১৮৷৷ শর্মাস্যবধূতং রক্ষোই-বধূতা অরাতয়োহদিত্যা গসি প্রতি স্বাাহদিতিৰ্বেত্ত্ব। ধিষণাহসি পৰ্বতী প্রতি ভ্ৰাহদিত্যাগ্বেত্ত্ব। দিবস্কনীরসি ধিষপাহসি পার্বতেয়ী প্রতি ব্ৰা পৰ্বতী বে৷৷১৯৷ ধানমসি। ধিনুহি দেবান্ প্রাণায় দো দানায় স্বা ব্যানায় ত্বা। দীর্ঘামনু প্রসিতিমায়ুষে ধাং দেবো বঃ সবিতা হিরণ্যপাণিঃ প্রতিগৃআত্বচ্ছিদ্রেণ পাণিনা চক্ষুষে ত্ব মহীনাং পয়োহসি৷৷২০৷৷ দেবস্য ত্বা সবিতুঃ প্রসবেংশ্বিনোর্বাহুভ্যাং পুষ্ণো হস্তাভ্যাম্। সংবপামি সমাপ ওষধিভিঃ সমোষধয়োরসেন। সংরবতীর্জগতীভিঃ পৃচ্যাং সং মধুমতীৰ্মধুমতীভিঃ পৃচন্তাম্৷৷২১৷৷ জনয়ত্যৈ ত্বা সংযৌমীদমগ্নে-রিদমগ্নীষোময়োরিষে ত্বা। ঘৰ্মোহসি বিশ্বায়ুরুরুপ্রথা উরু প্রথম্বোরু তে যজ্ঞপতিঃ প্রথমগ্নিষ্টে ত্বচং মা হিংসীৎ। দেবস্তুা সবিতা শ্ৰপয়তু বর্ষিষ্ঠেধি।।২২৷৷ মা ভের্মা সংবিথা। অতমেরুজ্ঞোহতমেরুর্যজমানস্য প্রজা ভূয়াৎ।ত্রিতায় ত্বা, দ্বিতায় হৈকতায় ত্ব৷২৩৷৷ দেবস্য ত্বা সবিতুঃ প্রসবেংশ্বিনোর্বাহুভ্যাং পূষ্ণো হস্তাভ্যাম্। আদদেহধ্বরকৃতং দেবেভ্যঃ।ইন্দ্রস্য বাহুরসিদক্ষিণঃ সহস্রভৃষ্টিঃশততেজা বায়ুরসি তিমতেজা দ্বিততা বধঃ।২৪৷৷ পৃথিবি দেবযজনন্যাষধ্যাস্তে মূলং মা হিংসিষ। ব্ৰজং গচ্ছ গোষ্ঠান। বর্ষ? তে দ্যো, বধান দেব সবিতঃ পরমস্যাং পৃথিব্যাং শতেন পাশৈর্যোহম্মান্বেষ্টি যং চ বয়ং দ্বিম্মস্তমতো মা মৌ।।২৫৷৷ অপাররূং পৃথিব্যৈ দেব্যজনাঘধ্যাস। ব্রজং গচ্ছ গোষ্ঠান। বৰ্ষতু তে দ্যৌবধান দেব সবিতঃ পরমস্যাং পৃথিব্যাং শতেন পাশৈর্মোহম্মান্দ্বেষ্টি যং চ বয়ং দ্বিমতো মা মৌ। অররো দিবং মা পপ্তো দ্ৰন্সস্তে দ্যাং মাস্ক।ব্রজং গচ্ছ গোষ্ঠান।বৰ্ষতু তে দ্যৌবধান দেব সবিতঃ পরমস্যাং পৃথিব্যাং শতেন পাশৈ যোহম্মান্দ্বেষ্টি যং চ বয়ং দ্বিষ্মমতো মা মৌ৷৷২৬৷৷ গায়ত্রণ ত্বা ছদসা পরিগৃহূমি। ত্রৈভেন ত্বা ছন্দসা পরিগৃহূমি। জাগতেন ত্বা ছন্দসা পরিগৃহূমি। সূক্ষ্মা চাসি শিবা চাসি। সোনা চাসি সুষদা চার্জতী চাসি পয়স্বতী চ৷৷২৭।পুরা কুরস্য বিপো বিরশিনুদাদায় পৃথিবীং জীবানুম। যামৈরয়ংশ্চন্দ্রমসি স্বধাভিস্তামু ধীরাসো অনূদিশ্য যজন্তে। প্রোক্ষনীরাসাদয়। দ্বিততা বধোহসি৷৷২৮৷৷ প্রত্যুষ্টং রক্ষঃ প্রত্যুষ্টা অরাতয়ো নিষ্টং রক্ষো নিষ্টপ্তা অরাতয়ঃ। অনিশিতোহসি সপত্নক্ষিদ্বাজিনং ত্বা বাজেধ্যায়ৈ সম্মাজি। প্রত্যুষ্টং রক্ষঃ প্রত্যুষ্টা অরাতয়ো নিষ্টপ্তং রক্ষো নিষ্টা অরাতয়ঃ। অনিশিতাইসি সপত্নক্ষিদ্বাজি-নীং ত্বা বাজেধ্যায়ৈ সম্মাজি৷৷২৯৷ অদিত্যৈ রাস্নাসি বিষ্ণোর্বেহেস্যুর্জে বৃহদন্ধেন বা চক্ষুষারপশ্যামি। অগ্নেৰ্জিহ্বাসি সুহূর্দেবেভ্যো ধামে ধামে মে ভব যজুষে যজুষে৷৷৩০। সবিতুস্থা প্রসব উৎপুনাম্যচ্ছিদ্রেণ পবিত্ৰেণ সূর্যস্য রশ্মিভিঃ। সবিতুর্বঃ প্রসব উৎপুনাম্যচ্ছিদ্রেণ পবিত্ৰেণ সূর্যস্য রশ্মিভিঃ। তেজোহসি শুক্ৰমস্যমৃতমসি, ধাম নামাসি প্রিয়ং দেবানামনাধৃষ্টং দেব্যজনমসি৷৷৩১৷
.
মন্ত্ৰার্থঃ– ১। হে দেব! অভীষ্টপূরণের জন্য আপনাকে আহ্বান করছি। (১) হে দেব! শক্তি এবং প্রাণ পাবার নিমিত্ত আপনাকে আহ্বান করছি। (২) হে দেবগণ! আপনারা আমাদের সম্বন্ধে বায়ুর মতো গতিশীল হোন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, হে দেবগণ! ত্বরায় আমাদের পরিত্রাণ করুন)। (৩) হে আমার চিত্রবৃত্তিনিবহ! সকর্মে প্রবর্তক জ্ঞানদেবতা, তোমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ ভগবৎ-আরাধনাদিরূপ সৎকর্মের জন্য প্রকৃষ্টরূপে পরিচালিত করুন। (ভাব এই যে, আমরা যেন নিয়ত সৎকর্মে নিরত থাকি) (৪) লোকপালিকা অজরা অক্ষরা বিনাশরহিতা হে দেবীগণ (অবিনশ্বর সত্ত্বের প্রবর্ধয়িত্রী সৎ-বৃত্তিসমূহ)! দেবতার উদ্দেশ্যে প্রদত্ত আমাদের পূজাকে অর্থাৎ ভগবৎ-উদ্দেশ্যে বিহিত আমাদের কর্মকে আপনারা সকলরকমে পরিবর্ধিত করুন। (ভাব এই যে, সৎ-বৃত্তির বা সত্ত্বভাবের দ্বারা আমরা যেন ভগবানের অনুসারী হই)। (৫) হে সৎ-বৃত্তিনিবহ! তোমাদের নিশ্চেষ্টতার দ্বারা পাপের প্রাধান্যখ্যাপক ইন্দ্রিয় ইত্যাদি চোর আমাদের যেন, হিংসা করতে সমর্থ না হয়। (ভাব এই যে, সৎ বৃত্তির প্রাধান্যের দ্বারা রিপুগণ নাশপ্রাপ্ত হোক)। (৬) হে দেবগণ। সত্যস্বরূপ আমাদের বুদ্ধিসমূহ (সবৃত্তিসমূহ বা সৎকর্মসকল) জ্ঞানাধারভূত এই হৃদয়ে আপনাদের বহনকারী হোক। (ভাব এই যে–আমাদের মধ্যে এইরকম ধী সঞ্জাত হোক, যার দ্বারা আমাদের হৃদয় দেশে নিয়ত দেবত্বের অধিষ্ঠান হয়)। (৭) হে দেব! প্রার্থনাকারী–আমার পাশববৃত্তিগুলিকে নাশ করুন, এবং আমাকে রক্ষা করুন। (প্রার্থনার ভাব এই যে,পশুবৃত্তির বা পাপের কবল হতে আমাকে সর্বথা পরিত্রাণ করুন)। (৮)। [এই কণ্ডিকার প্রথম চারটি মন্ত্র একটি মন্ত্রের মধ্যে পরিগণিত হয়।(কোন কোন গ্রন্থে আটটিই একটি মন্ত্র মধ্যে গণ্য হয়েছে)। ব্রাহ্মণদের পক্ষে ত্রিসন্ধ্যার পর চার বেদের প্রথম চারটি মন্ত্র উচ্চারণ করার বিধি আছে। সেই অনুসারে এই কণ্ডিকার প্রথম চারটি মন্ত্র ব্রাহ্মণগণ ত্রি-সন্ধ্যার সঙ্গে আবৃত্তি করেন। কিন্তু বড়ই আশ্চর্যের বিষয় এই যে, মন্ত্রের এক বিষম বিসদৃশ ব্যাখ্যা প্রচলিত রয়েছে। ভাষ্যের অনুসরণে সে ব্যাখার বঙ্গানুবাদ এমন দাঁড়ায়;–(১) হে শাখে! বৃষ্টির জন্য তোমাকে ছেদন করছি। (২) হে শাখে! বলপ্রাণ পাবার জন্য তোমাকে সংনমন করছি। (৩) হে গোবৎসসমূহ! তোমরা গাভীসকলের কাছ হতে অন্যত্র গমন করো, অথবা তৃণভক্ষণের জন্য দিবসে সেই সেই অরণ্যে চরে সায়ংকালে বায়ুবেগে যজমানের গৃহে গমন করো।(৪) হে গাভী-সকল! শ্রেষ্ঠতম কর্মের জন্য তোমরা প্রভূত-তৃণোপেত বনে গমন করো। যে মন্ত্র ব্রাহ্মণগণ প্রতিদিন সন্ধ্যা বন্দনার সাথে জপ করেন, এই তার প্রচলিত অর্থ! বাছুরগুলো মাঠে চরে আসুক, গরুগুলো ঘাস খাক, এই হলো আমাদের জপের মন্ত্র! যাই হোক, আমরা এই মন্ত্রের যে অর্থ অধ্যাহার করলাম, এবং ভাষ্যের আলোচনায় যে অর্থ সিদ্ধি হয়, –দুই অর্থে অশেষ পার্থক্য লক্ষিত হবে। ধীর-স্থির ভাবে সুধীবর্গ তা অনুধাবন করিবেন, এটাই অভিপ্রেত]।
২। হে দেব! আপনি ভগবানের নিবাসের হেতুভূত যজ্ঞ ইত্যাদি কর্মের পবিত্রতা সাধক হন। (প্রার্থনা–আমাদের কর্ম পবিত্র করুন। (১) হে দেব! আপনি দ্যুলোক হন, আপনি ভূলোক হন (ভাব এই যে,–হে দেব! আপনি চরাচর বিশ্বাত্মক সর্বব্যাপী। (২) হে দেব! আপনি বায়ুর দীপক (প্রকাশক) হন; (ভাব এই যে, বায়ুরূপে আপনি সর্বত্র পরিব্যাপ্ত); প্রকৃষ্ট তেজের দ্বারা আপনি। বিশ্বের ধারক(সকলের রক্ষক) হন। (৩) আপনি আমাদের বর্ধিত করুন; অর্থাৎ আমাদের শ্রেয়ঃসাধক হোন। কুটিল হবেন না; (ভাব এই যে, আমাদের ত্রুটিবিচ্যুতি দেখে, আমাদের প্রতি বিরূপ হবেন না)। আপনার সম্বন্ধীয় উপাসক, কখনও কুটিল হয় না–সদা সরল শুদ্ধ ভাবান্বিত হয়। (প্রার্থনা, আমিও যেন আপনার অনুকম্পার প্রভাবে সরল সৎ-ভাবসম্পন্ন হই। [এই কণ্ডিকার প্রথম মন্ত্রে কুশ-দ্বয়কে এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় মন্ত্রে স্থালীকে আহ্বান করা হয়েছে–এমন নির্দেশ দেখি। কিন্তু আমরা মনে করি, এখানেও সেই সর্বকারণ-কারণ পরমেশ্বরকে লক্ষ্য করেই প্রার্থনা জানানো হয়েছে। যজ্ঞের ক্রিয়া ইত্যাদিতে মন্ত্র যে ভাবেই প্রযুক্ত হোক, মন্ত্রের লক্ষ্য কিন্তু সেই একমাত্র পরাৎপর পরমেশ্বর। যজ্ঞের প্রতি অঙ্গে, অনুষ্ঠানের প্রতি স্তরে, ভগবানকেই যে স্মরণ করা হয়, তাঁর কাছে যে প্রার্থনা জানানো হয়, যজ্ঞাঙ্গে এ সকল মন্ত্রের প্রয়োগ সেই ভাবই দ্যোতনা করছে]।
৩। হে দেব! আপনি ভগবানের নিবাস হেতুভূত যজ্ঞ ইত্যাদি সৎ-কর্মের শত রকমের পবিত্রতা সাধক হন; এবং আপনি সৎকর্মের সহস্র রকমের পবিত্রতা সাধক হন। (ভাব এই যে,আপনার অনুকম্পায় আমাদের কর্মনিবহ সর্বতোভাবে সৎ-সহযুত পবিত্ৰীকৃত হোক)। [৩য় কণ্ডিকার প্রথম মন্ত্রটি দেবতার আহ্বানমূলক। শেষের দুটি মন্ত্র আত্মসম্বোধনসূচক। ভাষ্যে এই কণ্ডিকার মন্ত্র তিনটিতে ক্রমান্বয়ে শাখাদেবতাকে পয়োদেবতাকে এবং দোহনকর্তাকে সম্বোধন করা হয়েছে। সেই অনুসারে কুশবেষ্টিত শাখার দ্বারা শতধারে সহস্রধারে হবিঃ ইত্যাদি দেব-উদ্দেশ্যে প্রক্ষিপ্ত হয়, এখানে তা-ই লক্ষ্য আছে। পয়োদেবতাকে আহ্বান করে, হবিঃ ইত্যাদিকে তিনি পবিত্র করুন, এই ভাবের প্রার্থনা প্রকাশ পেয়েছে। পরিশেষে দোহনকর্তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, তুমি কোন্ গরুটির দুগ্ধ দোহন করেছ? ভাষ্যকারদের মর্মার্থ এমনই অবগত হওয়া যায়। কিন্তু আমরা মনে করি, মন্ত্রের প্রকৃত তাৎপর্য অন্যরকম। আমাদের বঙ্গানুবাদে সেই তাৎপর্য প্রকাশিত করেছি। মন্ত্র যে কার্যেই ব্যবহৃত হোক না কেন, মন্ত্রের যা লক্ষ্য, তাতে কেন ভাবান্তর ঘটাব? সকল মন্ত্রই, আমরা লক্ষ্য করে দেখেছি, এক সুরে বাঁধা। সকলেরই লক্ষ্য–পরব্রহ্মের সান্নিধ্যলাভ। জলে তিনি, স্থল তিনি, অনলে তিনি, অনিলে তিনি–তিনি কোথায় নেই? ঋষিগণ যে স্থালীর মধ্যে, পলাশশাখার অভ্যন্তরে, গোবৎস প্রভৃতিতে, ভগবানের সন্নিধি অবলোকন করেছেন, তা তাদের সর্বত্র ব্রহ্মদর্শনের ফল মাত্র]।(১) হে আমার মন! যাগ ইত্যাদি সৎকর্মের অশেষ রকমে পবিত্রকারক পুণ্যপ্রদ অনুষ্ঠানের দ্বারা জ্ঞান-প্রেরক সবিতা-দেব তোমাকে পবিত্র করুন। (ভাবার্থ, ভগবানের কৃপায় আমরা 1 যেন সৎকর্মপরায়ণ হই; তা-ই আমাদের একমাত্র পরিত্রাণের হেতু)। (২) হে আমার মন! তুমি কোন্ দেবতাকে সৎকর্মকে দোহন (আকর্ষণ বা সঞ্চয়) করেছ? (ভাবার্থ-সকর্মে চিত্ত সংন্যস্ত হলে, সকর্মমূলাধার ভগবানকে আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়)। (৩)।
৪। সেই দেবতা বিশ্বায়ুঃ–নিখিল বিশ্বের জীবন স্বরূপ। (১) সেই দেবতা বিশ্বকর্মা, অর্থাৎ সকল কর্মের মূলীভূত। (২) সেই দেবতা বিশ্বধায়াঃ অর্থাৎ সকলের ধারক ও পোষণকর্তা। (৩) হে আমার হবণীয় সামগ্রী দেবতার যজ্ঞভাগ-রূপ তোমাকে শুদ্ধসত্ত্বভাবে অর্থাৎ বিশুদ্ধা ভক্তির দ্বারা হৃদয়ে দৃঢ়ীকৃত করিতেছি। (ভাব এই যে,–আমার কৃত পূজা ভক্তি সহযুতা হয়ে হৃদয়ে দেবতাকে প্রতিষ্ঠিত করুক)। (৪) হে বিশ্বব্যাপক ভগবান্ বিষ্ণুদেব! হবনীয় আমাদের সত্ত্বভাবকে চিরকালের জন্য প্রতিষ্ঠিত রাখুন। (৫)। [ সোম শব্দের অর্থ–ভাষ্যমতে সোমবল্লীর রস, একরকম মাদক দ্রব্য। কিন্তু আমরা মনে করি–সোম শব্দের অর্থ–সোমনামক লতা নয়; অথবা সেই সোমলতার রসের বিষয়ও এখানকার অভিপ্রেত নয়। সোম শব্দে বিশুদ্ধ সত্ত্বভাব (ভক্তিভাব) বোঝায়]।
৫। অনুষ্ঠেয় সৎকর্মসমূহের সাধক হে জ্ঞানদেব! আমি সৎকর্মের অনুষ্ঠান করব; সেই কর্ম আপনার অনুগ্রহে যেন সম্পন্ন করতে সমর্থ হই; আমার সেই কর্ম নির্বিঘ্নে সিদ্ধ হোক। (১) প্রার্থনাকারী আমি এই মিথ্যাস্বরূপ মনুষ্য-জন্ম থেকে এই সৎকর্মসমূহের দ্বারা প্রত্যক্ষীকৃত সত্যস্বরূপ দেবতাকে লাভ করি–প্রাপ্তির ইচ্ছা করি। (ভাব এই যে, সৎকর্মের প্রভাবে আমি দেবত্ব-লাভে আকাঙ্ক্ষা করছি)। (২)। [এখানে অগ্নি-সম্বোধনে ভাষ্যেও যে জ্ঞানাগ্নির সম্বোধন আছে, তা পরিষ্কার বোঝা যায়]।
৬। [স্বগতঃ প্রশ্ন] কোন্ পুরুষ তোমাকে দেহের ও মনের সাথে যুক্ত করেছেন? (দেহের স্বার্থে মনের সংযোগপূর্বক কে তোমাকে সৃষ্টি করেছেন? [স্বগতঃ উত্তর] সেই পরমেশ্বরই তোমাকে দেহধারী মনুষ্য করেছেন। [স্বগতঃ প্রশ্ন] কোন্ মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ভগবান্ তোমাকে নিযুক্ত করেছেন? [স্বগতঃ উত্তর] ভগবানেরই কার্যসাধনের জন্য ভগবান্ তোমাকে প্রেরণ করেছেন।(১)। হে আমার দেহমন! তোমাদের সৎকর্ম সাধনের জন্য এবং সৎ-ভাব ব্যাপ্তির উদ্দেশ্যে ভগবান্ সৃষ্টি করেছেন। (ভাব এই যে, ভগবৎ-কর্ম সাধনের জন্য দেহ-মনের সংযোগের দ্বারা মনুষ্য উৎপন্ন হয়েছে)। [এই মন্ত্রটি, আপন দেহকে ও মনকে সম্বোধন করে প্রযুক্ত হয়েছে](২)। [৬ষ্ঠী কণ্ডিকার প্রথম মন্ত্রটি স্বগতঃ প্রশ্নোত্তরমূলক। প্রশ্ন উত্থাপিত ও সঙ্গে সঙ্গে উত্তর প্রদত্ত হয়েছে। ভাষ্যকারও প্রথম মন্ত্রে প্রশ্নোত্তরের ভাবই গ্রহণ করেছেন। তার মত এই যে, জলাধার কলসকে উদ্দেশ্য করে ঐ মন্ত্র বিহিত হয়েছে। দ্বিতীয় মন্ত্রে ভাষ্যকার বলেন, অগ্নিহোত্রহবনীকে এবং শূর্পকে সম্বোধন করা হয়েছে। এতে কেউ কেউ, শস্য ইত্যাদিকে ঝেড়ে ডাবার জলের মধ্যে রক্ষার ভাব গ্রহণ করেন। সেই অনুসারে ডাবাকে অগ্নিহোত্র হবনী বলা হয়। শূর্প বলতে, শস্য ইত্যাদিকে নিস্তুষকারক কুলা বুঝিয়ে থাকে। এ সকল কার্য যে পরমেশ্বরের দ্বারা সাধিত হয়, তা অনুমান করা সম্ভবপর নয়। অথচ ভাষ্যকার ডাবার ও কুলার কার্যকে পরমেশ্বরের কার্য বলে খ্যাপন করেছেন, এবং তাদের সম্বোধনেই মন্ত্র প্রযুক্ত বলেছেন]।
৭। হে দেব! সপ্রতিবন্ধক শত্রু (আমাদের দুর্বুদ্ধিসমূহ) প্রত্যেকে সর্বতোভাবে ভস্মীভূত হোক; আমাদের সকল রিপুশত্রুগণ, প্রত্যেকে বিশিষ্টরূপে দগ্ধ হোক। (ভাব এই যে, আমাদের দুর্বুদ্ধিসমূহ এবং রিপুশত্রুসমূহ সমূলে বিনাশ প্রাপ্ত হোক)।(১)। হে দেব! আমাদের দুর্বুদ্ধিস্বরূপ শত্রু, প্রত্যেকে সন্তপ্ত হোক; এবং আমাদের রিপুশত্রুগণ, প্রত্যেকে বিশেষভাবে তাপযুক্ত হোক। (ভাবার্থ-পূর্ব মন্ত্রেরই ন্যায়)।(২)। হে দেব! আমি যেন বিস্তৃত অন্তরিক্ষকে (কালকে) অনুসরণ করে চলতে পারি। (প্রার্থনার ভাব এই যে–হে দেব! আমি যেন সর্বদা শত্ৰুসকল নাশে সমর্থ হতে পারি, অনুকম্পা প্রদর্শনে তা-ই করুন) (৩)। [মন্ত্রের রক্ষঃ পদে ভাষ্যকার রাক্ষস-জাতিকে নির্দেশ করেন। তাতে ভাব আসে, রাক্ষসগণ, যজ্ঞের বিঘ্ন উৎপাদন করতো। আর তাদের দগ্ধ করবার জন্যই অগ্নির কাছে প্রার্থনা করা হতো। তারা নিষ্ট (সম্যভাবে পরিতপ্ত, শোকপ্রাপ্ত) হোক, অর্থাৎ তাদের বংশনাশ হোক। আমরা কিন্তু মন্ত্র দুটিতে রাক্ষসজাতি কিংবা যজ্ঞকারী লোকবিশেষের প্রতি লক্ষ্য দেখি না। এতে কালাকালেরও কোন সম্বন্ধ নেই। অতীত, অনাগত ও বর্তমান–তিন কাল ধরে যে শত্ৰু মানুষকে অহর্নিশ উত্যক্ত করছে, যে শত্রুর প্রবল প্রতাপে সকর্মনিবহ অনুষ্ঠিত হতে পারছে না–সেই অন্তঃশত্ৰু-কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ-মদ মাৎসর্য–এই মন্ত্রের লক্ষ্যস্থল। তৃতীয় মন্ত্রের লক্ষ্য;–আমার যেন চিরদিন সেই শত্রুদেরই শত্রু বলে জ্ঞান থাকে]।
৮। হে জ্ঞানস্বরূপ দেবতা! আপনি কাম-ক্রোধ ইত্যাদি রিপুশত্রুগণের সংহারকর্তা; আমাদের অমঙ্গলসাধক শত্রুগণকে আপনি বিনাশ করুন; প্রার্থনাকারী আমাদের সর্বদাই হিংসা করবার জন্য যে শত্রু উদযুক্ত রয়েছে, আপনি তাদের উচ্ছেদ-সাধন করুন; আমরা যে শত্রুকে বিনাশ করতে উদযুক্ত হবো অর্থাৎ যাদের বিনাশ করা প্রয়োজন হবে, আপনি তাদের বিনষ্ট করুন।(১)। হে আমার অন্তর্নিহিত জ্ঞানস্বরূপ দেব! আপনি দেবগণের (দেবভাব-নিবহের) শ্রেষ্ঠ বহনকর্তা, আপনি সেই ভাবসমূহের বিশুদ্ধভাবে সংরক্ষণকারী, আপনি সেই ভাবসমূহের সম্যকরূপে পূর্ণতাসাধক, আপনি তাদের (সেই দেবভাব-সমূহের) অতিশয় প্রিয় এবং সেই দেবভাবনিবহের শ্রেষ্ঠ আহ্বানকর্তা। (ভাবার্থ এই যে জ্ঞানের দ্বারা দেবগণ আহূত হয়ে প্রার্থনাকারীর হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত থাকেন)।(২)।[ ভাষ্য ইত্যাদিতে প্রকাশ, এই মন্ত্রদুটির সাথে গো-শকটের সম্বন্ধ বিদ্যমান। ধুর শব্দের আলোচনায় তারা বলেন,–ধুর (যুগের বলীবর্দবহনপ্রদেশ অর্থাৎ যে কাষ্ঠখণ্ডে বৃষের স্কন্ধদেশ সংযুক্ত থাকে) সংস্থিত হিংসক অগ্নিকে লক্ষ্য করে মন্ত্র উচ্চারিত হয়েছে। দ্বিতীয় মন্ত্রটি, ভাষ্যকারগণের মতে শকটকে লক্ষ্য করে উচ্চারিত হয়েছে। বলা বাহুল্য, ভাষ্যকারগণ যে ভাবে অর্থ করেছেন, তাতে পূর্বাপর সামঞ্জস্য রক্ষা করা যায় না।]
৯। হে দেব! আমাদের প্রতি বিরূপ হবেন না। আপনি আমাদের হবির (হৃদয়ের শুদ্ধসত্ত্ব ভাবের) পোষক ও রক্ষক হোন।(১)। হে দেব! আমাদের ত্রুটি-বিচ্যুতিতে বক্রভাব ধারণ করবেন না। আপনার উপাসক কখনও কুটিল হয় না। অর্থাৎ, আপনার অনুকম্পায় আমি যেন সর্বদা সরল সৎ-ভাবসম্পন্ন হই।(২)। হে আমার মন! তোমার অভ্যন্তরে (অর্থাৎ হৃদয়-সিংহাসনে) সেই সর্বব্যাপক পরমেশ্বরকে (বিষ্ণুকে) ক্রমে ক্রমে আরোহণ (স্থাপন) করাও (৩)। হে দেব (অথবা হে আমার অন্তর)! আপনি (তুমি) সর্বগ বায়ুর ন্যায় বিস্তৃত হোন (হও)। [দেবপক্ষ অর্থ এই যে, হে দেব! আপনি বায়ুর ন্যায় আমাদের দেহে সর্বব্যাপী হয়ে আমাদের পাপসমূহকে বিদূরিত করুন। মনঃপক্ষে অর্থ এই যে, হে আমার অন্তর! দেবসামীপ্যলাভের জন্য সঙ্কীর্ণভাব পরিত্যাগ করো; সকলের প্রতি অভিন্ন-ভাব প্রতিষ্ঠিত হোক]।(৪)। হে দেব! (অথবা, হে আমার মন!) যজ্ঞবিঘ্নকারক অসৎ-ভাবসমূহকে অপসৃত করে দিন (বা দাও) (৫)। হে আমার ইন্দ্রিয়-পঞ্চক! তোমরা সংযত হও (৬)।[এই কণ্ডিকায় ছটি মন্ত্র বিভিন্নরকম আহ্বানমূলক। এর প্রথম মন্ত্র দুটি ইষ্টদেবকে বা দেবসাধারণকে আহ্বান করে বিহিত হয়েছে। তৃতীয় মন্ত্রটি নিজের অন্তরকে (অন্তরাত্মাকে) আহ্বান করে প্রযুক্ত। চতুর্থ ও পঞ্চম মন্ত্র দুটি দেবতাকে এবং নিজের অন্তরকে–উভয়কে সম্বোধন করে প্রযুক্ত হতে পারে। ষষ্ঠ মন্ত্রটি ইন্দ্রিয় পঞ্চকের সম্বোধনমূলক বলে মনে করা যেতে পারে]। [মন্ত্রের যে অর্থ অধুনা প্রচলিত এবং ভাষ্য ইত্যাদিতে প্রকাশিত, আমরা সে অর্থকে সদর্থ বা মন্ত্রের প্রকৃত অর্থ বলে মনে করি না। ভাষ্যকারগণ বলেন, প্রথম দুটি মন্ত্রে গৌ-শকটের ঈষাদণ্ডকে সম্বোধন করা হয়েছে। তৃতীয় মন্ত্রে বিষ্ণুদেবতাকে যে শকটে আরোহণ করতে বলা হচ্ছে। চতুর্থ মন্ত্রে শকটস্থিত ধান্যগুলির আবরণ উন্মোচন করে বায়ুর দ্বারা সেগুলিকে শুষ্ক করতে বলা হয়েছে। পঞ্চম মন্ত্রে এই অপসারণ করে বাধা দূরীকৃতের কথা বলা হয়েছে। ষষ্ঠ মন্ত্রে যেন অঙ্গুলিগুলিকে সম্বোধন করে বলা হচ্ছে–হে অঙ্গুলিগণ! তোমরা পাঁচটি অঙ্গুলি দ্বারা ধান্য নিয়ে অর্পণ করো। ফলতঃ, এর কোনও অর্থের সাথে কোনও অর্থের সামঞ্জস্য নেই]।
১০। আমার অন্তরের শুদ্ধসত্ত্বভাবরূপ হে হবিঃ! দীপ্তিমান জ্ঞানপ্রদ সেই সবিতৃ-দেবের প্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে, আত্মবাহুকে দেবগণের অধ্বর্য্য-স্থানীয় অশ্বিদ্বয়ের বাহুযুগল মনে করে, এবং আপনার কর-যুগলকে দেবগণের পূজাংশভাগী পুষাদেবতার করস্বরূপ মনে করে, সেই বাহুযুগল এবং করদ্বয় দ্বারা তোমাকে ভগবানের উদ্দেশ্যে নিবেদন করছি। ভগবানের কর্মে আপনাকে নিবেদন করতে হলে, আপনার বাহুযুগলকে এবং করদ্বয়কে দেবতার সত্ত্বস্বরূপ বস্তু বলে মনে করা কর্তব্য (১)। হে হবিঃ। অগ্নিদেবের প্রীতির জন্য আমি তোমাকে ভগবানের উদ্দেশ্যে নিবেদিত (বিনিযুক্ত) করছি।(২)। হৈ হবি! জ্ঞানভক্তিস্বরূপ সেই অগ্নি ও সোম দেবতার প্রীতির জন্য আমি তোমাকে তাঁর (ভগবানের) উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করছি।(৩)। [ভগবানের উদ্দেশ্যে হবিঃ প্রদানকালে সাধক-যাজ্ঞিক যে ভাবে ভাবান্বিত হবেন, এই কণ্ডিকার তিনটি মন্ত্রের দ্বারা সেই ভাবের অধ্যাস করা হচ্ছে। [এমন যে উচ্চভাবপূর্ণ মন্ত্র, এর প্রচলিত অর্থ এই যে, যাজ্ঞিক, যেন কতকগুলি ধান্যকে সম্বোধন করে বলছেন, সবিতৃদেবের প্রেরণায়, অশ্বিদ্বয়ের বাহুযুগলে এবং পুষা দেবতার হস্তের দ্বারা, হে ধান্যসমূহ, তোমাদের আমি গ্রহণ করছি। এই বলে এক এক মুষ্টি ধান্য গ্রহণ করে যথাক্রমে অগ্নিকে এবং অগ্নি ও সোমদেবকে সম্বোধন করে বলা হচ্ছে-হে অগ্নি, তোমার জন্য এই ধান্যমুষ্টি গ্রহণ করলাম; এবং হে অগ্নি ও সোম, তোমাদের জন্য এই ধান্যমুষ্টি গ্রহণ করলাম। ইত্যাদি। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন]।
১১। হে হবিঃ (আমার অন্তর্নিহিত শুদ্ধসত্ত্বভাব)! তোমাকে বিশ্বসেবায় উৎসর্গ করছি; আত্মসুখ-কামনায় আমি অনুপ্রাণিত নই।(১)। হে হবিঃ! তোমার মধ্যেই স্বর্গস্বরূপ যজ্ঞ বা জ্ঞানস্বরূপ সূর্যদেব পরিদৃশ্যমান্।(সবৃত্তি ও শুদ্ধসত্ত্বভাবই জ্ঞানস্বরূপ স্বর্গরূপ) (২)। হেহবিঃ! তোমার প্রভাবে (যেন) এই পার্থিব জননমরণশীল নবদ্বারবিশিষ্ট দেবরূপ গৃহের দৃঢ়তা সম্পাদিত হয়। (অর্থাৎ আমি যেন ভগবানের কার্য-সাধনে সামর্থযুক্ত হই)।(৩)। হে দেব! আমি যেন বিস্তীর্ণ অন্তরিক্ষকে (কালকে) অনুসরণ করে চলতে পারি। (অর্থৎ, আপনি আমার রিপু-শত্ৰু সকল নাশের শক্তি আমায় প্রদান করুন।(৪)। হে হবিঃ! মাতৃক্রোড়ে যেমন শিশু স্থাপিত হয়, আমি তেমনই তোমাকে পৃথিবীর অঙ্কে স্থাপিত করেছি। অর্থাৎ,আমার সকল রকম সৎ-চিন্তা সৎ-ভাব ইহসংসারেই ন্যস্ত হয়েছে। হে জ্ঞানস্বরূপ অগ্নিদেব! আমার হব (হৃদয়ের শুদ্ধসত্ত্বভাব, জীবপ্রেমে লোকানুরাগের মধ্য দিয়ে) আপনি সংরক্ষণ করুন।(৫)। [এই কণ্ডিকায় মন্ত্র-পাঁচটির প্রথম তিনটি এবং শেষ মন্ত্রটির প্রথমাংশ হবির সম্বোধন মূলক। চতুর্থ মন্ত্র এবং পঞ্চম মন্ত্রের শেষাংশ দেবতাকে উদ্দেশ্য করে প্রযুক্ত হয়েছে। [ভাষ্যকারগণের মতে এই কণ্ডিকার পাঁচটি মন্ত্রে ব্রীহিশেষ (ধান্যগুলিকে) লক্ষ্য করা হয়েছে, এবং শকট হতে অবতরণকালে মন্ত্র উচ্চারণ করা হয়েছে। কিন্তু আমরা বলি, ব্যবহারিক কার্যে যে ভাবেই মন্ত্র প্রযুক্ত হোক, মন্ত্রের অর্থ ঐরকম নয়। মন্ত্র বিশ্বজনীন সৎ-ভাবপূর্ণ]।
১২। হে আমার সৎ-ও অসৎ কর্ম! তোমরা পবিত্রভাবাপন্ন ও ভগবৎসম্বন্ধযুক্ত হও। (আমাদের সৎ ও অসৎ উভয়বিধ কর্মই পবিত্র ও ভগবানের সাথে সম্বন্ধযুক্ত, হোক।(১)। হে আমার সৎ ও অসৎ কর্ম! তোমরা জ্ঞানপ্রদ সবিতৃদেবের প্রেরণায় (অনুকম্পায়) ত্রুটি-পরিপূণ্য বায়ুর মতো পবিত্রকারক এবং সূর্যরশ্মির মতো জ্ঞানপ্রদ হয়ে আমাদের উৎকর্ষ-সাধনে আমাদের পবিত্র করো। (বায়ু ও সূর্যরশ্মি শুদ্ধিসম্পাদক। তাদের প্রভাবে আমাদের সৎ অসৎ উভয় কর্ম পবিত্র হোক, এটাই প্রার্থনা) (২)। নিম্নদেশ প্রতি গমনশীলা, অপহতিনিবারণে শোধনকারিকা, দ্যোতমানাত্মিকা হে জলদেবতা! আপনারা অদ্য এই যাগ ইত্যাদি কর্মকে সত্ত্বর নির্বিঘ্নে সম্পাদন করে দেন। সুচরিত যাজ্ঞিককে ভগবানের সন্নিকর্ষলাভে সমর্থ করুন; দেবসম্বন্ধযুত সৎকর্মের অনুষ্ঠাতাকে দেবতার সান্নিকর্ষে নিয়ে যান। (ভাবার্থ এই যে, আমরা যেন সৎ-চরিত্র দেবভাবাপন্ন হয়ে ভগবানের সান্নিধ্যলাভে সমর্থ হই।(৩)। [এই কণ্ডিকার প্রথম দুটি মন্ত্রকে সৎ-অসৎ আপন কর্ম দুটিকে লক্ষ্য করে আত্ম-উদ্বোধনসূচক মনে করা যেতে পারে। তৃতীয় মন্ত্রটি আপঃ দেবতার সম্বোধনমূলক]। [ভাষ্যমতে, এই মন্ত্র তিনটির প্রয়োগ প্রক্রিয়া ও সাধারণ অর্থ এই যে, তীক্ষ্ণাগ্রভাগ কুশদ্বয়ের দ্বারা দুটি কুশকে ছেদন করতে হবে। সে কুশ যেন শুষ্ক না হয়। সে হিসেবে পবিত্রে শব্দে কুশকে বুঝিয়ে থাকে; পবিত্রে পদ কুশ দুটিকে সম্বোধন করে প্রযুক্ত হয়েছে। (আমরা পবিত্রে অর্থে পবিত্ৰভাবাপন্ন বলে মনে করি)। সেই অনুসারে হে কুশদ্বয়। তোমরা বিষ্ণু-সম্বন্ধী হও–এটাই মন্ত্রের মর্মার্থ দাঁড়ায়। দ্বিতীয় মন্ত্রে হবিগ্ৰহণীতে (হোমের হবিঃ-বিশিষ্ট পাত্রে) জলগ্রহণ করে কুশ দুটির দ্বারা জলকে মন্ত্রপূত করা হয়েছে। তৃতীয় মন্ত্র জলদেবীকে সম্বোধন করে বিহিত হয়েছে।
১৩। হে আমার সৎ বৃত্তিনিবহ! শত্ৰুসংহারের নিমিত্ত, রিপুশ-নাশের জন্য, সেই ভগবান্ ইন্দ্রদেব তোমাদের প্রেরণ করেছেন; আত্মশত্রু নিপাতের জন্য তোমরা সেই ভগবান্ ইন্দ্রদেবকে তোমাদের পরিচালক-পদে বরণ করো। (অর্থাৎ, আত্মশত্রুর সংহার-সাধনের জন্য সৎসম্বন্ধযুক্ত কর্মে অনুরক্ত হও)।(১-২)। হে আমার সৎ-বৃত্তিনিবহ! তোমরা সুসংস্কৃত (সর্বথা ভগবকর্মে বিনিমুক্ত) হও (৩)। হে আমার অন্তর! তোমাকে অগ্নিদেবের প্রীতির জন্য সুসংস্কৃত (সৎপথানুবর্তী) করছি।(৪)। হে আমার অন্তর! তোমাকে সেই জ্ঞানভক্তিস্বরূপ অগ্নি ও সোমদেবতার প্রীতির নিমিত্ত সুসংস্কৃত (সংপথানুবর্তী) করছি।(৫)। হে আমার সৎ-অসৎ বৃত্তিনিচয়! তোমরা দেবসম্বন্ধি যাগ ইত্যাদি সৎক্রিয়ার দ্বারা দেব ইত্যাদি সম্বন্ধি সৎ-জ্ঞান বর্ধনরূপ কর্মবিশুদ্ধি প্রাপ্ত হও। অসৎকর্মের দ্বারা তোমাদের যে অংশ পরাহত বা অপবিত্ৰীকৃত হয়েছে, আমি তোমাদের সেই অংশ (এই মন্ত্রে) পরিশুদ্ধ করছি।(৬)। [এই মন্ত্রগুলি সাধকের নিজের সৎ-অসৎ বৃত্তিনিচয়কে, সৎ-বৃত্তিকে অথবা নিজের মনকে উদ্দেশ্য করে তাদের পরিশুদ্ধি-সাধনের উদ্দেশ্যে উচ্চারিত হয়েছে]। [ভাষ্য অনুসারে প্রথম মন্ত্রটির ব্যাখ্যা হয় এই যে, ইন্দ্রের সাথে বৃত্রাসুরের সংগ্রামে ইন্দ্র জলদেবতাকে আত্মীয়-জ্ঞানে বরণ করেছিলেন; জলদেবতা সে আত্মীয়তা রক্ষা করেন। মন্ত্রে তা-ই স্মরণ করান হয়েছে। দ্বিতীয় মন্ত্রের ভাষ্যানুসারী অর্থ এই যে,জলকে পোক্ষণ (বিশুদ্ধ) করা হচ্ছে। তৃতীয় ও চতুর্থ মন্ত্র, যথাক্রমে অগ্নিদেবতার ও অগ্নিসোমদেবতার উদ্দেশ্যে, প্রদত্ত আহবনীয় দ্রব্যকে জলপ্রক্ষেপে পবিত্র করা হচ্ছে। পঞ্চম মন্ত্রে উদুখল ও মুষল প্রভৃতিকে সম্বোধন করে বলা হয়েছে– তোমরাও এই প্রক্ষিপ্ত জলে পবিত্র হও। কেন না, নীচ জাতিরা তোমাদের প্রস্তুত করেছে। এই জলে তোমাদের বিশুদ্ধতা সম্পাদিত হোক। আমাদের বঙ্গানুবাদ লক্ষ্য করলেই পার্থক্য বোঝা যাবে]।
১৪। হে আমার মন! তুমি (সৎসংস্রবযুক্ত হয়ে) মঙ্গলপ্রদ হও। (১)। তাহলে, আমার দুবুদ্ধিরূপ শত্রু বিকম্পিত হবে; এবং রিপুশত্রুগণ বিতাড়িত (নিপাতিত) হবে।(২)। হে আমার মন! (চঞ্চলতা প্রভৃতি হেতু) তুমি অনন্তসহ মিলনের প্রতিবন্ধকস্থানীয় হও; সেই অনন্ত তোমার প্রতি অনুগ্রহ করুন।(৩)। হে আমার মন! তুমি মহাবৃক্ষের মতো (ফল ছায়া ইত্যাদি দানে মর্ত্যলোকের প্রীতির আস্পদ হও) এবং অদ্রির মতো (তুষারপাত ও বাত ইত্যাদির অভিঘাতে অচঞ্চল) হও।(৪)। হে আমার মন! তুমি দৃঢ়মূল (ভগবানের চিন্তায় একাগ্র) এবং পাষাণের মতো দৃঢ় হও। অনন্তরূপ ভগবান্ তাহলে তোমার প্রতি অনুগ্রহ করবেন।(৫)। [এই কণ্ডিকার মন্ত্রগুলি নিজের মনকে সম্বোধন করে প্রযুক্ত হয়েছে]। [যজ্ঞে এই মন্ত্রের প্রয়োগকালে কৃষ্ণমৃগের চর্ম (কৃষ্ণাজিন) ও উদুখল প্রভৃতি দ্রব্য আবশ্যক হয়। প্রথম মন্ত্রে কৃষ্ণজিনকে সম্বোধন আছে। দ্বিতীয় মন্ত্রে ঐ কৃষ্ণাজিনের ধূলা ময়লা প্রভৃতি অপসারণ করা হচ্ছে। তৃতীয় মন্ত্রে ঐ কৃষ্ণাজিনকে ভূমিতে বিস্তৃত করা হচ্ছে। চতুর্থ মন্ত্রে সেই বিস্তৃত চর্মের উপর উদুখলকে স্থাপন করে, চতুর্থ ও পঞ্চম মন্ত্রে উদুখলকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে।–কি ভাবে কি অর্থে মন্ত্র ব্যবহৃত হয়, এটাই তার মর্ম।
১৫৷ হে মন! তুমিই জ্ঞানের বা অগ্নিদেবের বা আহবনীয়ের দেহস্বরূপ; তুমিই বাক্যের বা মন্ত্রের উৎপাদক বা উচ্চারণকারী; দেবতার প্রীতির জন্য আমি তোমাকে নিযুক্ত করেছি।(১)। হে মন! তুমি মহাবৃক্ষস্বরূপ, তুমি মহত্বাদিগুণণাপেত, তুমি পাষাণবৎ দৃঢ়; অর্থাৎ, তুমিই সর্বকর্ম-সম্পাদনে সমর্থ।(২)। হে মন! সেই যে তুমি, দেবগণের প্রীতির জন্য সকল রকম আবহনীয় রূপে সুষ্ঠুভাবে দেবসেবায় নিযুক্ত হও।(৩)। হে মন! তুমিই হবিঃ-দান-সমর্থ। এস, দেবতার অর্চনায় নিযুক্ত হও (৪)। [যজ্ঞে এই কণ্ডিকার মন্ত্রগুলি যেভাবে প্রযুক্ত হয়, ভাষ্যে তার ব্যাখ্যা আছে। সেই অনুসারে প্রথম মন্ত্রে ধান্যকে সম্বোধন দেখা যায়। মুষলকে ধারণ করে দ্বিতীয় মন্ত্র উচ্চারিত হয়েছে। তৃতীয় মন্ত্রও ঐ মুষলের সম্বোধনেই প্রযুক্ত। চতুর্থ মন্ত্রে, যাজ্ঞিক বা তার পত্নী যেন অপরাপর আত্মীয়জনকে আহ্বান করে বলছেন, –কে হবিঃ দান করবে? কে হবিঃ দান করবে? কে হবিঃ দান করবে? এস-এস-এস। আমরা মনে করি, এ কণ্ডিকার চারটি মন্ত্রই আত্ম-উদ্বোধনমূলক। মনই এখানকার সম্বোধ্য]।
১৬। হে আমার মন! তুমি অসৎবৃত্তিরূপ অসুরদের ত্রাসকারক (পাপপক্ষে কঠোরভাষী), এবং সৎবৃত্তির পোষক (অর্থাৎ সৎসম্বন্ধে মধুরভাষী) হও। ইষে ত্বা উর্জে ত্বা ইত্যাদি মন্ত্র দুটি উচ্চারণে প্রার্থনা করো। (অর্থাৎ শুক্লযজুর্বেদের প্রথম মন্ত্র দুটি ইত্যাদি দ্বারা অন্নরসপ্রাণ যাতে প্রাপ্ত হতে পার, তার উপযোগী মন্ত্র ইত্যাদি উচ্চারণ করো)। তোমার সাহায্যে, শ্রেয়কামী আমরা, অসৎ-বৃত্তি-সমূহকে প্রতিরুদ্ধ করে জয়যুক্ত হবো।(১)। হে মন! তুমি আমাদের অভীষ্ট-বর্ষণের (ইষ্ট-সিন্ধির হেতুভূত হও।(২)। হে মন! তোমাকে অভীষ্ট-পূরণের হেতুভূত বলে ভগবান্ (যেন) জানতে পারেন। (অর্থাৎ, তোমার কর্মের দ্বারা ভগবান তোমার প্রতি অনুগ্রহ-পরায়ণ হোন) (৩)। তাহলে, দুর্বুদ্ধিরূপ শত্রু দূরীকৃত হবে, আর রিপুশত্রুগণ বিমর্দিত হবে।(৪)। তাহলে, শত্রু দূরে অপসৃত ও নিহত হবে।(৫)। হে অন্তরস্থ অসৎ-বৃত্তি-নিবহ! সেই বিচ্ছিন্নকারক বায়ুদেব (প্রবলবেগে প্রবাহিত হয়ে) তোমাদের আমাদের অন্তর হতে পৃথক করে দেন।(৬)। হে অসৎ-বৃত্তি সমূহ। সেই মঙ্গলরূপ সুবর্ণহস্ত বিশিষ্ট জ্ঞানপ্রদাতা দ্যোতমান্ সবিতৃদেব তার কলঙ্করহিত হস্তের দ্বারা তোমাদের প্রতিগ্রহণ করুন; অর্থাৎ আমাদের অন্তর হতে তোমাদের অপসৃত করুন।(৭)। [এই কণ্ডিকার প্রথম পাঁচটি মন্ত্র মনঃ সম্বন্ধে এবং শেষ দুটি মন্ত্র অসৎ-বৃত্তিসম্বন্ধে প্রযুক্ত হয়েছে বলে মনে করা যায়।] [এই কণ্ডিকার মন্ত্রগুলি বহু উপাখ্যানের সাথে সম্বন্ধ বিশিষ্ট আছে বলে কথিত হয়। শস্যানামক যজ্ঞীয় আয়ুধকে, সূৰ্পকে এবং তণ্ডুল ইত্যাদিকে সম্বোধন করে মন্ত্রগুলি প্রযুক্ত হয়েছে,–এটাই প্রচলিত ভাষ্যগুলির অভিপ্রায়। ঐ উপলক্ষ্যে প্রথম মন্ত্র-পাঠের ফলদ্যোতক যে উপাখ্যান প্রচলিত আছে, তার মর্ম এই–যথা, দেবাসুরের যুদ্ধে মনুর এক বৃষভ দেবগণের সহায় হয়েছিল। সেই বৃষভের স্বর অসুর-নাশে মন্ত্রের কার্য করতো। অসুরেরা সেই জন্য বৃষভকে বধ করবার উদ্দেশ্যে ছদ্মবেশে মনুর কাছে এসে মনুকে গো-মেদ যজ্ঞের জন্য প্ররোচিত করে সেই বৃষভকে বলিদানের ব্যবস্থা করে। কিন্তু দেবগণের কৌশলে মন্ত্রটি মনুপত্নী লাভ করেন। অসুরেরা তখন মনুপত্নীকে হরণ করে। কিন্তু তখনও মন্ত্র নষ্ট না হয়ে শম্যারূপ আয়ুধে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। সেই থেকে যজ্ঞকালে দৃষৎ (শিল) ও উপলের (নোড়ার) উপর শম্যা আয়ুধের আঘাতবিধি ব্যবস্থিত হয়। সেই আঘাতের স্বরে অসুরগণ বিনষ্ট হয়। এই আখ্যায়িকা অবলম্বন করেই মন্ত্রটির অবতারণা। সপ্তম মন্ত্র অচ্ছিদ্র অঞ্জলি দ্বারা শূর্প (কুলা) থেকে পাত্ৰান্তরে তণ্ডুল-গ্রহণ মূলক। ঐ মন্ত্রের মর্মার্থ এই যে,–হিরণ্যপাণি সবিতা তণ্ডুলগুলিকে অচ্ছিদ্র অঞ্জলি দ্বারা অন্য পাত্রে রক্ষা করুন। সবিতা-দেবতাকে কেন হিরণ্যপাণি বলা হয় তার উপাখ্যানটি এই যে,–দেবাসুরের সংগ্রামকালে অসুরদের প্রাশিত্র নামক অস্ত্রের আঘাতে সবিতৃদেবতার হাত দুটি বিচ্ছিন্ন হয়েছিল। দেবগণ তখন তাঁর হিরণ্যময় হাত প্রস্তুত করে দেন। এই হলো ভাষ্যাকারদের ব্যাখ্যার ও টীকার মর্মার্থ। বলা বাহুল্য, আমাদের অর্থ সম্পূর্ণ বিভিন্ন রকমের]।
১৭। হে মন! তুমি স্বতঃই চঞ্চল হয়ে আছ। চাঞ্চল্য পরিহার করো।(১)। হে জ্ঞানস্বরূপ অগ্নিদেব! তুমি অপক জ্ঞান (বিভ্রম) বিদূরিত করো। দুষ্টজ্ঞান বা পাপবুদ্ধিরূপ দহন-জ্বালাদ শত্রুকে নিঃশেষ করো। (ভাবার্থ এই যে,–দাহক বা অজ্ঞানরূপ যে অগ্নি সদা প্রত্যক্ষীভূত হয়, তার অনুসরণে বিরত হও, জ্ঞানাগ্নিই সর্বসিদ্ধিকারক। (২)। হে মন! দেবভাব-সাধক জ্ঞানাগ্নিকে হৃদয়ে প্রতিষ্ঠা করো। অথবা, হে অগ্নিদেব দেবভাবসাধক জ্ঞানাগ্নিরূপে সর্বতোভাবে আপনি আমাদের অন্তরদেশে বিস্তৃত হোন।(৩) হে মন! তুমি একাগ্র হও; তোমার সৎবৃত্তির মূলকে দৃঢ় করো। ব্রহ্মবনি (অর্থাৎ ব্রাহ্মণভাবাপন্ন, সত্ত্বগুণোপেত) ক্ষত্ৰবনি (অর্থাৎ ক্ষত্ৰভাবাপন্ন, রজোগুণণাপেত) সজাতবনি (অর্থাৎ বৈশ্যভাবাপন্ন, তমোগুণেপেত)– সত্ত্বরজস্তমোগুণাধার তুমি; রিপুশনাশের জন্য (ভ্রাতৃব্যস্য বধায়) পরমাত্মায় বিনিবিষ্ট হও।(৪)। এই কণ্ডিকার দ্বিতীয় মন্ত্রটি অগ্নিদেবকে এবং অবশিষ্ট তিনটি আপন অন্তরকে সম্বোধন করে প্রযুক্ত হয়েছে। [ব্যবহারিক ক্ষেত্রে এই কণ্ডিকার মন্ত্রগুলিতে উপবেশকে (পলাশ শাখার একটি স্থলভাগকে), অগ্নিকে মালসাকে সম্বোধন করা হয়েছে। ফলতঃ চরু-প্রস্তুতের জন্য অগ্নির উপর মালসা স্থাপন করাই যেন এই মন্ত্রের মর্ম ও উদ্দেশ্য]।
১৮। হে অগ্নিদেব! আমাদের অনুষ্ঠিত কর্ম আপনি গ্রহণ করুন। অথবা, আপনিই ব্রহ্মস্বরূপ, অতএব আমাকে অনুগ্রহ করুন।(১)। হে মন! তুমি সৎ-বৃত্তি-সমূহের ধারক হও; তোমাতে সভাব-সমূহের ব্যাপকত্ব দৃঢ় করো; ব্রহ্মবনি ক্ষত্রবনি সজাতবনি–সত্ত্বরজস্তমোগুণাধার তুমি; রিপুশনাশের জন্য পরমাত্মায় বিনিবিষ্ট হও (২)। হে মন!তুমি সত্ত্বভাবের ধারক হও; শুদ্ধসত্ত্ব দৈবভাব তোমাতে দৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত করো। (ব্রহ্মবণি ইত্যাদি মন্ত্রাংশের অর্থ পূর্বৰ্মন্ত্রের অনুরূপ) (৩)। হে মন! সকল দিকের সবরকমের হিতসাধনের জন্য আমি তোমাকে নিয়োজিত করছি।(৪)। হে চিত্তবৃত্তিনিবহ! তোমরা ভগবানের অনুসারী হও (৫)। হে চিত্তবৃত্তিসমূহ! তোমরা অত্যুচ্চ জ্ঞানলাভের নিমিত্ত একাগ্রভাবে ভগবানের আরাধনায় প্রবৃত্ত হও। সকর্মর্সহজাত বিশিষ্ট জ্ঞানলাভই ভগবানকে প্রাপ্তির কারণ হয়ে থাকে।(৬)। [এই কণ্ডিকার ষষ্ঠ মন্ত্রে ভৃগূণাং এবং অঙ্গিরসাং শব্দ দুটিতে যে অর্থ গৃহীত হয়েছে, আপাতঃদৃষ্টিতে তা সাধারণের পক্ষে বিসদৃশ বলে বোধ হবে। কিন্তু মন্ত্রার্থের পূর্বাপর সামঞ্জস্য রক্ষা করতে হলে, ঐ শব্দ দুটিতে কখনই ঋষি-বিশেষের প্রতি লক্ষ্য আছে বলে মনে হয় না। ধাতুগত অর্থের শব্দার্থের অনুসরণে ভৃগু শব্দে অতি-উচ্চ এবং অঙ্গির শব্দে জ্ঞান অর্থ পরিগৃহীত হতে পারে। সেই অর্থই এখানে সুসঙ্গত। তপ্যধ্বং ক্রিয়াপদের সার্থকতা তাতেই প্রতিপন্ন হয়। এই কণ্ডিকার প্রথম মন্ত্র অগ্নিদেবকে, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ মন্ত্র মনকে এবং পঞ্চম ও ষষ্ঠ মন্ত্র চিত্তবৃত্তি সমূহকে সম্বোধন করে প্রযুক্ত হয়েছে। [এই কণ্ডিকার মন্ত্রদুটি যজ্ঞকার্যে ব্যবহৃত হয় বলে প্রথম মন্ত্রে উর্ধে উৎক্ষিপ্ত অগ্নিকে, দ্বিতীয় মন্ত্রে পুরোডাশাদির ধারক মালসাকে, তৃতীয় মন্ত্রে আর একটি মালসাকে, এবং চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ মন্ত্রেও অপরাপর মালসাকে সম্বোধন দেখা যায়। ষষ্ঠ মন্ত্রে মালসাগুলিকে বলা হয়–অঙ্গিরসের বংশীয় ভৃগুঋষির উদ্ভাবিত অগ্নির তাপ তোমরা প্রাপ্ত হও। কোনও কোনও ব্যাখ্যাকারের মত এই যে,ভৃগুঋষির পূর্বে কেউ আগুনের ব্যবহার করতে জানতেন না। তিনিই প্রথমে অগ্নির দাহিকা-শক্তির বিষয় সংসারে প্রকাশ করেন। তাই তার নাম মন্ত্রে আছে। আমরা লক্ষ্য করে দেখেছি, একই মন্ত্র ভিন্ন ভিন্ন কার্যে প্রযুক্ত হয়েছে। সে ক্ষেত্রে মন্ত্রের একটি সার্বজনীন অর্থ আছে নিশ্চয়ই স্বীকার করতে হবে। আমাদের বঙ্গানুবাদ তারই লক্ষ্যে স্থির হয়েছে।
১৯। হে মন! তুমি (সৎসংশ্রবযুত হয়ে) মঙ্গলদায়ক হও।(১)। তাহলে, আমার দুর্বুদ্ধিরূপ শত্ৰু বিকম্পিত হবে; এবং রিপুশত্রুগণ বিতাড়িত (নিপাতিত) হবে।(২)। হে আমার মন! (চঞ্চলতা প্রভৃতি হেতু) তুমি অনন্তসহ মিলনে প্রতিবন্ধক-স্থানীয় হয়ে থাকো; সেই অনন্ত তোমার প্রতি অনুগ্রহ করুন।(৩)। হে আমার মনোবৃত্তি! তুমি সৎ-বুদ্ধি-প্ৰদাত্রী এবং পর্বতের মতো দৃঢ় হও; আমার অন্তরাত্মা তোমাকে (তোমার চাঞ্চল্য-নিবন্ধন) অনন্তের বাধক বলে অবগত হোন।(৪)। হে মন! (সকর্মের প্রভাবের দ্বারা) তুমি দ্যুলোকবাসীরও স্তম্ভনকারী হও (৫)। হে আমার মনোবৃত্তি! তুমি সৎ-বুদ্ধিদাত্রী হও; অনন্তশক্তিশালিনী পরাপ্রকৃতি, তোমাকে পর্বতের মতো দৃঢ় (অচঞ্চল সৎ-ভাব-সম্পন্ন) বলে জানুন।(৬)। [এই কণ্ডিকার প্রথম তিনটি মন্ত্র ১৪শ কণ্ডিকায় আছে। এখানে যথাক্রমে মনকে ও মনোবৃত্তিকে সম্বোধন করা হয়েছে]।[যজ্ঞকার্যে ব্যবহারের ক্ষেত্রে এই কণ্ডিকার প্রথম তিনটি মন্ত্রের সম্বোধ্য সম্পর্কে চতুর্দশ কণ্ডিকায় আলোচনা আছে। এখানে চতুর্থ মন্ত্রে শিলাখণ্ডকে সম্বোধন করা হয়েছে বলে ভাষ্যকার নির্ধারণ করেছেন। এর পর পঞ্চম মন্ত্রে শম্যা (কীলক, যাঁতার খিল)-কে সম্বোধন করা হয়েছে। যষ্ঠ মন্ত্রে উপলখণ্ডকে সম্বোধন করে বলা হচ্ছে–হে উপলখণ্ড! তুমিই পোষণ-ব্যাপারে সমর্থ। তুমিও পর্বত হতে উৎপন্ন, দৃষও (অপর প্রস্তরখণ্ড) পর্বতস্যুতা। সে তোমাকে দুহিতার মতো বক্ষে গ্রহণ করুক। ফলতঃ, এই কণ্ডিকায় কৃষ্ণমৃগের চর্মের উপর একটি যাঁতা প্রতিষ্ঠিত হলো–এটাই বোধগম্য হয়। পরবর্তী কণ্ডিকার ভাবে প্রকাশ, সেই যাতায় যেন তল পেষণ করা হচ্ছে]।
২০। হে মন! তুমি সকলের প্রীতিস্বরূপ হও; অতএব, সমস্ত দেবভাবকে পোষণ (ধারণ) করো।(১)। হে মন! তোমাকে আমার প্রাণবায়ু-সংরক্ষণের (প্রাণায়) জন্য দীর্ঘজীবন কামনায় সংযত করছি।(২)। হে মন! তোমাকে আমার উদানবায়ু-সংরক্ষণের (উদানায়) জন্য (বাক্যসংযম,উদ্দেশ্যে) সংযম করছি।(৩)। হে মন! তোমাকে আমার ব্যানবায়ু-সংরক্ষণের (ব্যানায়) নিমিত্ত (শরীরবল রক্ষার জন্য) সংযত করছি। (৪)। হে মন! ইহসংসারে সম্পাদনযোগ্য অশেষ সকর্ম আছে জেনে আয়ুঃ-বৃদ্ধির জন্য (আয়ুষে). তোমাকে সংযত করছি। (বহুরকম সকর্মসাধনার জন্যই মনুষ্যজীবন লাভ হয়। সুদীর্ঘ আয়ুঃ ব্যতীত সে সকল সৎকর্ম সাধিত হতে পারে না। যোগ-সাধনাই আয়ু বৃদ্ধির একমাত্র উপায়। অসৎ বৃত্তি সমূহ আয়ুঃ হানিকারক। অতএব, এই মন্ত্রের শেষাংশে তাদের সম্বোধন করে বলা হয়েছে,) হে অসৎ-বৃত্তিসমূহ! সেই মঙ্গলরূপ সুবর্ণহস্তবিশিষ্ট জ্ঞান-প্রদাতা দ্যোতমান সবিতৃদেব, কলঙ্করহিত হস্তের দ্বারা তোমাদের প্রতিগ্রহণ করুন; অর্থাৎ, আমাদের অন্তর হতে তোমাদের অপসারিত করুন।(৫)। হে মন! দূরদৃষ্টি-সাধনের জন্য (দিব্যদৃষ্টি লাভের আশায়) তোমাকে নিয়োগ করছি।(৬)। হে মন! তুমিই বিশ্ববাসীর অমৃতস্বরূপ হও। অর্থাৎ,–আমাদের মন সকল সৎ কর্মের সাধক হোক–সঙ্কল্পের এটাই তাৎপর্য (৭)। [এই মন্ত্রের যে অর্থ প্রচলিত আছে, সেই অনুসারে তণ্ডুলকে, পিষ্টতণ্ডুলকে এবং ঘৃতকে সম্বোধন করে মন্ত্র প্রযুক্ত হয়েছে প্রতিপন্ন হয়। কর্মপদ্ধতি অনুসারে অবগত হওয়া যায়, দৃষতের (প্রস্তর খণ্ডের) উপরে তণ্ডুলরক্ষা করে প্রথম মন্ত্র উচ্চারিত। দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ মন্ত্র তণ্ডুলকে পেষণ করবার সময় প্রযুক্ত হয়। পঞ্চম মন্ত্রে সেই পিষ্ট তণ্ডুল অঞ্চলির দ্বারা গ্রহণ। করে কৃষ্ণাজিনে স্থাপন করা হয়। ষষ্ঠ মন্ত্র উচ্চারণকালে হবির প্রতি দৃষ্টি করতে হবে। সপ্তম মন্ত্রে পিষ্ট তণ্ডুলগুলি গব্যঘৃতে মিশ্রিত করতে হবে এবং বলতে হবে–হে আজ্য! গো-দুগ্ধ থেকেই তোমার উৎপত্তি। প্রচলিত অর্থ এমনই, ভাষ্য-আভাষেও এইরকম অর্থই পাওয়া যায়। আমরা কিন্তু মন্ত্রের মধ্যে যোগ সাধনার এক মহান্ উপদেশ বিদ্যমান দেখি। প্রথম মন্ত্রে মনকে ভগবানের প্রীতিসাধনে বিনিযুক্ত হতে বলা হয়েছে, সকল দেবভাব মনেতে প্রতিষ্ঠিত করার কথা হয়েছে। সেই দেবভাব কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, কিভাবে চিত্ত ভগবানের প্রীতিসাধনে প্রযুক্ত হতে সমর্থ হয়। পরবর্তী মন্ত্র ছটিতে তারই ব্যঞ্জনা আছে]।
২১। হে হবিঃস্বরূপ আমার শুদ্ধসত্ত্বভাব! দীপ্তিমান্ জ্ঞানপ্রদ সেই সবিতৃদেবের প্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে, আত্মবাহুকে দেবগণের অধ্বর্যুস্থানীয় অশ্বিদ্বয়ের বাহুযুগল মনে করে, এবং নিজের করযুগলকে দেবগণের পূজাংশভাগী পূষাদেবতার করস্বরূপ মনে করে সেই বাহুযুগল এবং করদ্বয়ের দ্বারা, তোমাকে ভগবানের উদ্দেশ্যে নিবেদন করছি। (ভগবৎ-কর্মে নিজেকে বিনিযুক্ত করতে হলে, নিজের বাহুযুগলকে ও করদ্বয়কে দেবতার বাহু ও হস্ত বলে মনে করা কর্তব্য) (১)। হে হবিঃ! তোমাকে সম্যকরূপে ভগবকার্যে নিয়োজিত করছি।(২)। আমাদের আপস্বরূপ স্নেহসত্ত্বভাব, আমাদের এই ওষধীরূপ কর্মফলাবসানে ক্ষয়মূলক জীবনের সাথে অচ্ছেদ্যভাবে সম্মিলিত হোক; আমাদের কর্মক্ষয়ে ক্ষয়সূচক ওষধীর মতো জীবনসমূহ রসময় ভগবানের সাথে সম্মিলিত হোক; আমাদের শুদ্ধসত্ত্বভাবসমূহ বিশ্ববাসী সকলের সাথে সম্মিলিত হোক; আমাদের মাধুর্যভাবসমূহ মাধুর্যময় ভগবৎ বিভূতির সাথে সম্মিলিত হোক (৩)। [হবিঃ স্বরূপ অন্তরের শুদ্ধসত্ত্বভাবকে সম্বোধন করে মন্ত্র তিনটি প্রযুক্ত হয়েছে বলে মনে করাই সঙ্গত]। [ভাষ্য অনুসারে প্রক্রিয়া-পদ্ধতির জন্য, অর্থাৎ ব্যবহারিক কার্যে প্রয়োগকালে, ব্যাখ্যাকারগণ এই কণ্ডিকার তিনটি মন্ত্রকে দুটি মন্ত্ররূপে গ্রহণ করে থাকেন। তাতে দেবস্য থেকে সং বপামি পর্যন্ত মন্ত্র এবং অবশিষ্ট অংশ দ্বিতীয় মন্ত্ররূপে গৃহীত। পূর্ব কণ্ডিকার মন্ত্র অনুসারে পিষ্ট প্রস্তুত হলে, পবিত্র (কুশ) সংযুক্ত পাত্রে স্থাপন করা হয়। তারপর এই কণ্ডিকায় সেই পিষ্টকে সম্বোধন করে বলা হয়–পিষ্ট। আমার অন্তরের সবিতা দেবতা আমার প্রেরণা করছেন। সেই অনুসারে অশ্বিদেবতার বাহু দুটির দ্বারা এবং দূদেবতার হস্ত দুটির দ্বারা তোমাকে এই পাত্রে নিক্ষেপ করছি। এরপর দ্বিতীয় মন্ত্রে সেই পিষ্টগুলিতে (চালের গুঁড়োতে) উপসর্জনী (শিলধোয়া পিটুলি) প্রদান করে তাদের উদ্দেশ্যে মন্ত্রোচ্চারণ করা হয়। ভাবার্থ এই যে, চালের গুঁড়া এবং শিলধোয়া জল এক হয়ে যাক। এবার আমাদের অনুবাদটি লক্ষ্য করুন]।
২২। হে মন! সৎ-ভাগ সংজননের জন্য তোমাকে ভগবকার্যে বিনিযুক্ত করছি।(১)। এই মনঃসম্বন্ধযুত জ্ঞান–অগ্নিদেব হতে উৎপন্ন। অগ্নিদেবই জ্ঞানস্বরূপ।(২)। এই মনঃসম্বন্ধযুত সৎকর্ম, সেই জ্ঞান-ভক্তি স্বরূপ অগ্নি ও সোমদেবের সাথে সম্বন্ধবিশিষ্ট; অর্থাৎ, অগ্নীষোম দেবতার অনুকম্পাতেই মানুষ, জ্ঞানভক্তির উৎপাদনকারী সৎকর্মের সাধনে প্রবৃত্ত হয়।(৩)। হে ভগবন্! অভীষ্টপূরণের জন্য আপনাকে আহ্বান করছি।(৪)। হে ভগবান্! আপনিই প্রকাশরূপ বিশ্বপ্রাণ হন।(৫)। হে ভগবন্! আপনি বহু রকমে প্রখ্যাত আছেন; আবার বহুভাবে প্রখ্যাত হোন।(পাপিদের পরিত্রাণের জন্যই ভগবান্ সর্বাপেক্ষা প্রখ্যাত। আমাদের মতো পাপীর পরিত্রাণ সাধনে তার মাহাত্ম্য বহুবিস্তীর্ণ হোক)। হে ভগবান্ তোমার অর্চনাকারী বহুরকম সৎকর্মের দ্বারা বিশেষভাবে প্রসিদ্ধি লাভ করুক।(৬)। হে ভগবন্! আপনার জ্ঞানমূর্তি আমার অজ্ঞানরূপ আবরণ (অহংভাব) নাশ করুক। (অর্থাৎ, জ্ঞানের আলোকে অজ্ঞানতা দূর হোক)।(৭)। অথবা–হে মন! সংসার-সন্তাপের দ্বারা আমার এই পাঞ্চভৌতিক দেহ যেন পীড়িত না হয়। অর্থাৎ, আমার দেহর সাধনার উপযোগী হোক।(৭)। [প্রথম অন্বয়ে অগ্নি:–জ্ঞানমূর্তি, ত্বচং মা–অজ্ঞানরূপ আবরণ, অহংজ্ঞান, হিংসীৎনাশ করুক! দ্বিতীয় অন্বয়ে অগ্নিঃ– অন্তর্দাহক, সংসার-সন্তাপ; তে–তব, চ:–চর্ম, বহিরাবরণ, পাঞ্চভৌতিক দেহ; মা হিংসীৎ–যেন পীড়িত না হয়]।(৭)। হে ভগবন্! আমার হৃদয়ের দ্যোতমান জ্ঞানসূর্য (কর্মের দ্বারা সমুন্নত) আমার হৃদয়রূপ স্বর্গে আপনাকে প্রতিষ্ঠিত করুক। অর্থাৎ, সৎ-কর্মের দ্বারা হৃদয়কে উন্নত করে আমি যেন সেই হৃদয়ে আপনাকে প্রতিষ্ঠিত করি–এই প্রার্থনা (৮)। অথবা–হে মন! নির্মল জ্ঞানস্বরূপ সেই ভগবান, তোমাকে চিরস্থায়ী চিরশান্তিময় স্থানে (স্থাপনপূর্বক) সৰ্বৰ্থা তোমার উৎকর্ষ সাধন করুক (৮)। [প্রথম অন্বয়ে সবিতা দেব–আমার হৃদয়ের দ্যোতমান জ্ঞানসূর্য; বর্ষিষ্ঠে–সমুন্মতে; নাকে–হৃৎস্বর্গে; পয়তু প্রতিষ্ঠিত করুক। দ্বিতীয় অম্বয়ে সবিতা নির্মজ্ঞানস্বরূপ; দেবঃ–দ্যোতমান, ভগবা; বর্ষিষ্ঠে– অতিপ্রবৃদ্ধে, চিরস্থায়িনি; নাকে–সর্ববিধদুঃখরহিতে, চিরশান্তিময় স্থানে; ইত্যাদি]। [এই কণ্ডিকায় প্রথম তিনটি মন্ত্র মনঃ সম্বন্ধযুক্ত, এবং চতুর্থ থেকে অষ্টম পর্যন্ত পাঁচটি মন্ত্র ভগবানকে সম্বোধন করে প্রযুক্ত হয়েছে মনে করা যায়। শেষের মন্ত্র দুটি, অর্থান্তরে মনের সম্বোধনসূচক বলেও গ্রহণ করা যায়]। [এই কণ্ডিকার মন্ত্র কটির মধ্যে, ভাষ্যকারদের ব্যাখ্যা-অনুসারে, পুরোডাশরূপ পিষ্টক-প্রস্তুতের প্রক্রিয়া প্রভৃতি পরিবর্ণিত হয়েছে। চালগুলি শিলায় অথবা যাঁতায় গুঁড়া করা থেকে আরম্ভ করে সপ্তম মন্ত্রে পুরোশে জলসেচ পর্যন্ত আছে। অষ্টম মন্ত্রে সেই পুরোডাশকে সঞ্চালিত করতে করতে বলা হচ্ছে,–হে পুরোডাশ! দ্যুলোকস্থ সবিতা দেবতা তোমাকে পরিপক্ক করুন। অর্থাৎ, পুরোডাশ যেন ধরে না যায়, উৎকৃষ্টভাবে প্রস্তুত হতে পারে, এটাই কর্মকাণ্ড অনুসারে মন্ত্র কয়েকটির বিশেষ লক্ষ্য। আমরা দেখেছি, মন্ত্রে কোথাও পুরোশের সম্বোধন নেই। অথচ, কোনও মন্ত্রে যে পুরোডাশের সম্বন্ধে আছে, তা-ও মনে আসতে পারে না]।
২৩। হে মন! তুমি ভীত হয়ো না, উদ্বিগ্ন হয়ো না। অর্থাৎ, ভয়-উদ্বেগ রহিত হয়ে তুমি পরমাত্মার আরাধনায় প্রবৃত্ত হও (১)। হে মন! দেবার্চনাকারী আমার অনুষ্ঠিত যজ্ঞকর্ম দোষবর্জিত হোক; আর, আমার এই মনুষ্যজন্ম, দোষশূন্য হয়ে ভগবানের আরাধনায় সাফল্য লাভ করুক (অর্থাৎ ভগবানের আরাধনাই জীবনের লক্ষ্য থোক ।(২)। অথবা-হে দেব! আমাদের যাগ ইত্যাদি সৎকর্ম দোষশূন্য হোক; আর, দেবতার অর্চনাকারী, ভগবানের করুণাপ্রার্থী জনের সন্তান-সন্ততি ও সম্পর্কিত জন আপনার অনুগ্রহে দোষশূন্য নিষ্কলঙ্ক হোক।(২)। [প্রথম অন্বয়ে প্রজা–প্রজনন, প্রকৃষ্ট জন্ম, মনুষ্যজন্ম। দ্বিতীয় অন্বয়ে প্রজা–সন্ততি, আত্মসম্পৰ্কীয় (জন)। ইত্যাদি]। হে মন! তোমাকে সেই সত্ত্বরজস্তমোগুণাত্মক ত্রিদেবের উদ্দেশ্যে নিয়োগ করছি।(৩)। হে মন! তোমাকে প্রকৃতি-পুরুষরূপ দেবদ্বয়ের উদ্দেশ্যে নিযুক্ত করছি।(৪)। হে মন! তোমাকে অদ্বিতীয় ব্রহ্মের উদ্দেশ্যে নিযুক্ত করছি। (৫)। [এই কণ্ডিকার মন্ত্র কয়েকটি মনঃ সম্বন্ধেই প্রযুক্ত বলা যেতে পারে। তার মধ্যে দ্বিতীয় মন্ত্রটি অর্থান্তরে ভগবানের সম্বোধনে প্রযুক্ত হয়েছেও বলতে পারা যায়]। [ভাষ্যের অনুসরণে এই কণ্ডিকার মন্ত্রগুলির যে অর্থ হয়, তাতে বোঝা যায়, অগ্নি থেকে পুরোডাশ নামাবার সময়, পুরোডাশকে সম্বোধন করে প্রথম মন্ত্র উচ্চারিত হয় এবং পরবর্তী মন্ত্রগুলিও যথাক্রমে পুরোশকে এবং সেই সংশ্লিষ্ট জলকে সম্বোধন করে উচ্চারিত হয়ে থাকে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য–তৃতীয় থেকে পঞ্চম মন্ত্রে পাত্ৰধৌত জলকে সম্বোধন করে যথাক্রমে বলা হয়েছে, হে পাত্ৰধৌত জল! ত্ৰিত-নামক দেবতার, দ্বিতনামক দেবতার এই একত-নামক দেবতার তৃপ্তির জন্য তোমাকে অর্পণ করছি। এইভাবে পাত্ৰধৌত জল পূর্বোক্ত তিনি দেবতার উদ্দেশ্যে অর্পণ-বিষয়ে পুরাণের উপাখ্যানটি এই :–অগ্নি এক সময়ে শত্রুভয়ে ভীত হয়ে জলের মধ্যে লুকিয়ে থাকেন। সেই সময়ে তার বীর্যে জলের মধ্যে ত্রিত, দ্বিত ও একত নামক তিন দেবতার পূজার বিষয় বিচার হয়। কিন্তু তখন যজ্ঞের এমন কোনই ভাগ অবশিষ্ট ছিল না যে, তারা পেতে পারেন। তখন পুরোডাশ-ধৌত জল, তাদের অর্পণ করবার জন্য ব্যবস্থা হয়; এইভাবে মন্ত্রগুলি পল্লবিত হয়ে আছে]।
২৪। হে হবিঃ (মদীয় শুদ্ধসত্ত্বভাব)! সবিতুঃ (জ্ঞানপ্রদস্য) দেবস্য (দ্যোতমানস্য) প্রসবে (প্রেরণে) অশ্বিনোৰ্ব্বাহুভ্যাং (দেবানামধ্বর্য্যরূপস্য অশ্বিদ্বয়স্য ভুজাভ্যাং) পূষ্ণ: (দেবানাং হবির্ভাদুহ: পূষাখ্যদেবস্য) হস্তাভ্যাং (করাভ্যাং) ত্বা (ত্বাং, ভগবদুদ্দেশ্যোৎসৃষ্টং হবীরূপং ভক্তিসুধাং বিশুদ্ধসত্ত্বভাবঞ্চ) নিবেদয়ামীতিশেষঃ। [মন্ত্ৰাৰ্থ ২১শ কণ্ডিকার ১ম মন্ত্রে দ্রষ্টব্য]।(১)। আমার যজ্ঞকর্ম সঞ্জাত ফল–দেবগণকে সম্যরকমে সমর্পণ করছি।(২)। হে দেবতাচরণে সমর্পিত কর্মফল! তুমি অনন্ত শক্তিশালী ভগবানকে পরমানন্দ প্রদান করে থাকো; তুমি অশেষ পাপনাশক, অমিত তেজঃসম্পন্ন, দেবতার সমীপে শীঘ্রগামী, পাপসমূহের দাহকর্তা এবং রিপুশত্রুগণের হননকারী হয়ে থাকো। (ভাবার্থ এই যে,-কর্মফল দেবতার উদ্দেশ্যে অর্পিত হলে অনন্ত ফল-উপধায়ক এবং পাপনাশক হয়ে থাকে।(৩)। [ভাষ্য অনুসারে বোঝা যায়, স্ফ নামক মৃত্তিকা খননের উপযোগী যন্ত্রবিশেষকে সম্বোধন করে এই কণ্ডিকার মন্ত্রগুলি উচ্চারণ করা হয়েছে। যজ্ঞের জন্য যূপকাষ্ঠ প্রোথিত করা প্রয়োজন। তার জন্য গর্ত খনন করা প্রয়োজন। তাই খন্তার মতো কোন জিনিষ এ স্থলের লক্ষ্য–এটাই প্রকাশ]।
২৫। দেবসম্বন্ধীয় কর্মের আধারস্থানীয় হে আমার স্থূলদেহ! কর্মফলের অবসানে তোমার ক্ষয়ের কারণকে নষ্ট করো না। অর্থাৎ, এই স্থূলশরীরের যেন আর পুনরাবৃত্তি না ঘটে–তা-ই করো।(১)। হে মন! তুমি তোমার কল্যাণাস্পদ প্রব্রজ্যা অবলম্বন করো; অর্থাৎ, সাংসারিক প্রলোভেনে বৈরাগ্যযুক্ত হও।(২)। হে মন! দ্যুলোকের অধিষ্ঠাত্-দেব তোমার অভীষ্ট পূরণ করুন; (তুমি দেবতার অনুগ্রহ লাভের উপযুক্ত হও) (৩)। হে দ্যোতমান্ সবিতৃদেব! যে আমাদের হিংসা করে, অথবা আমরা যার হিংসা-কামনা করি (অর্থাৎ আমরা যে শত্রুকে দ্বেষ করি, সে সকল শত্রুকে এই পৃথিবীর সীমান্ত-স্থানে শত-পাশ-বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখুন, কখনও তাদের ছেড়ে দেবেন না। (কাম-ক্রোধ ইত্যাদি রিপুবর্গ–আমাদের অসৎ বৃত্তিনিবহ আমাদের পরম শত্রু; আমার নিকট হতে তাদের দূরে রাখুন–এ-ই ভাবার্থ) (৪)। [প্রথমে স্থূলদেহকে, তারপর নিজের মনকে এবং পরিশেষে দ্যোতমান্ দেবতাকে সম্বোধন করে এই কণ্ডিকার মন্ত্র চারটি বিহিত হয়েছে। [ভাষ্য অনুসারে মন্ত্রগুলির যে অর্থ প্রচিলত আছে, তাতে যূপকাষ্ঠ স্থাপনের জন্য মৃত্তিকা খননের সময় তৃণ ইত্যাদি অপসারণ উপলক্ষ্যে মন্ত্রকটি প্রযুক্ত হয়ে থাকে।
২৬। আমি দেহের মঙ্গলসাধনের জন্য, হৃদয় হতে শত্রুকে দূরীকৃত করছি।(১)। হে মনঃ! ত্বং গোষ্ঠানং (কল্যাণাস্পদং) ব্রজং (প্রব্রজ্যাং) গচ্ছ (প্রাপ্নহি); বৈরাগ্যমবলন্বয়েতি ভাবঃ। [মন্ত্ৰাৰ্থ পূর্ব কণ্ডিকার দ্বিতীয় মন্ত্র দ্রষ্টব্য] (২)। হে মনঃ! দ্যৌঃ (দ্যুলোকাধিষ্ঠাতৃদেবঃ) বৰ্ষতু (তব অভীষ্টবর্ষণং করতু)। [পূর্ব কণ্ডিকার তৃতীয় মন্ত্রের মন্ত্রৰ্থ দ্রষ্টব্য]।(৩)। দেব (দ্যোতমান) সবিতঃ (হে সবিতৃদেব!) যঃ (শঃ) অস্মান(তব অনুগ্রহপ্রার্থিনঃ জনান)দ্বেষ্টি (দ্বেষং করোতি) যং চ(শত্ৰুং) বয়ং দিষ্মঃ (দ্বেষং কুৰ্ম্মঃ), তান সৰ্ব্বানেব শক্রন পরমস্যাং (অন্তিমায়াং) পৃথিব্যাং (ভূপ্রদেশে, ভূমেঃ শেষ সীমান্তে, অন্ধতামিস্ত্রে ইতি ভাবঃ) শতেন পাশৈঃ (বহুবিধবন্ধনৈঃ) বধান (বন্ধনং কুরু), মা মৌক (কদাচিদপি মা মুঞ্চ। [পূর্ব কণ্ডিকার চতুর্থ মন্ত্রে মন্ত্ৰাৰ্থ প্রাপ্তব্য] (৪)। হে অন্তঃ শত্রু! তুমি আমার হৃদয়রূপ দেবস্থানকে অধিকার করো না।(৫)। হে শত্রু! তোমার জীবনধারণের উপযোগী রস যেন আমার হৃদয়প্রদেশে সজ্জাত না হয়।(৬)। [৭ম, ৮ম ও ৯ম মন্ত্ৰাৰ্থ এই কণ্ডিকারই যথাক্রমে ২য়, ৩য় ও ৪র্থ মন্ত্রার্থে প্রাপ্তব্য] (৭–৯)। [পূর্ব কণ্ডিকায় উক্ত মন্ত্রোচ্চারণ করে তৃণ ইত্যাদি অপসারণ করে এই কণ্ডিকার মন্ত্রের দ্বারা গর্ত খনন করতে হয়। সেই অনুসারে এই কণ্ডিকার প্রথম মন্ত্রের অর্থ, পৃথিবী সম্বন্ধী দেবযজনাখ্য দেবীস্থান থেকে অররু-নামক অসুরকে দূরীভূত করে বধ করছি।পঞ্চম মন্ত্রে সেই অরুনামক অসুরকে সম্বোধন করে বলা হয়েছে, হে অররু! তুমি যাগফলরূপ দ্যুলোককে প্রাপ্ত হয়ো না।ষষ্ঠমন্ত্রে বেদীকে সম্বোধন করে বলা হয়েছে, হে বেদি! পৃথিবীরূপ তোমার উপজীব্য যে রস, তা যেন দ্যুলোককে প্রাপ্ত না হয়-মন্ত্র যে কার্যেই প্রযুক্ত হোক, আমরা মন্ত্রের মর্মার্থ স্বাতন্ত্ররূপে গ্রহণ করি না]।
২৭। হে মনোবৃত্তি! তোমাকে গায়ত্রী ছন্দোবিশিষ্ট মন্ত্রের দ্বারা সর্বতোভাবে ভগবৎ-সম্বন্ধে নিযুক্ত মন্ত্রের দ্বারা ভগবৎ-সম্বন্ধে নিযুক্ত করছি।(১)। হে মনোবৃত্তি! তোমাকে ত্রিষ্টুভ-ছন্দোবিশিষ্ট মন্ত্রের দ্বারা ভগবৎ সম্বন্ধে নিযুক্ত করছি। (২)। হে মনোবৃত্তি! তোমাকে জগতী-ছন্দোবিশিষ্ট মন্ত্রের দ্বারা ভগবৎ-সম্বন্ধে নিযুক্ত করছি।(৩)। হে মনোবৃত্তি! তুমি শোভনগুণবিশিষ্টা হও; তুমি শান্তভাবাপন্না হও।(৪)। হে মনোবৃত্তি! তুমি সুখস্বরূপা হও; তুমি সম্যক্ সদ্ভাবসম্পন্ন হও।(৫)। হে মনোবৃত্তি! তুমি বলপ্রাণপ্রদাত্রী হও; তুমি অমৃতপ্রদা হও (৬)। [এই কণ্ডিকার মন্ত্রগুলি, প্রচলিত অর্থে, বেদীকে সম্বোধন করে প্রযুক্ত হয়েছে বলে মনে করা হয়। আমরা মনে করি, বেদীকে নয়, আপন মনোবৃত্তির সম্বোধনেই এগুলি প্রযুক্ত) [প্রচলিত অর্থে এই কণ্ডিকার মন্ত্র কটি বেদীকে সম্বোধন করে প্রযুক্ত হয়েছে। বেদীর চারদিকে গণ্ডী দিয়ে, এক এক দিক লক্ষ্য করে, প্রথমতঃ, এক একটি মন্ত্র উচ্চারণ করার প্রথা আছে। তাতে প্রথম তিনটি মন্ত্রে যেন বলা হয়–বেদী! গায়ত্রীচ্ছন্দ দ্বারা তুমি রক্ষিত হও, ত্রিষ্টুপচ্ছন্দ দ্বারা তুমি রক্ষিত হও, জগতীচ্ছন্দ দ্বারা তুমি রক্ষিত হও। এইভাবে অবশিষ্ট মন্ত্রগুলিতেও বেদীকে লক্ষ্য করে বিভিন্ন উক্তি রয়েছে। কিন্তু আমরা এমন উক্তির তাৎপর্য ধারণা করতে অপারগ]।
২৮। শব্দব্রহ্মস্বরূপ হে পরমেশ্বর! আপনি (এই) হিংস্র রিপুশত্রুর সংগ্রামে জীবের প্রাণস্বরূপ শুদ্ধসত্ত্বভাবকে পার্থিবপদার্থসম্বন্ধ হতে (পাপসংশ্রব থেকে) ঊর্ধ্বে গ্রহণপূর্ব (মূর্ধিদেশে জ্ঞানধারে রক্ষা করে) আমাদের নিত্যকাল অনুগৃহীত করুন। দেবগণ (দেবভাবসমূহ) বেদজ্ঞান-সহ যে শুদ্ধসত্ত্বভাবকে চন্দ্রলোকে (স্নিগ্ধ আলোকময় মূর্ধিপ্রদেশে) সংরক্ষিত করেন; সারভূত সেই সামগ্রীকে পাবার কামনায় মেধাবিগণ সর্বদা আপনার আরাধনা করে থাকেন। (আমরাও যেন সেই সঙ্কল্পে আপনার আরাধনায় সমর্থ হই) (১)। হে ভগবন্! আপনি আমাদের পাপক্লেদ-প্রক্ষালনের উপায় বিধান করুন।(২)। হে ভগবন্! আপনি আমাদের শত্রুর সংহারকর্তা হোন (আমাদের শত্রুকে নাশ করুন) (৩)। [এই কণ্ডিকার মন্ত্র কয়টি ভগবানকে সম্বোধন করা হয়েছে বলে মনে করাই সঙ্গত]।[ভাষ্য-অনুসারে এই মন্ত্রের সঙ্গে একটি উপাখ্যানের সংশ্রব সূচনা করা হয়। ভাষ্যে লিখিত আছে,–পূর্বে দেবাসুরের যুদ্ধে দেবগণ ভীত হয়ে পৃথিবীর সারবস্তুকে এবং বেদকে চন্দ্রলোকে লুকিয়ে রাখেন। অসুরেরা সংগ্রামে পরাজিত হলেও, ঐ দুই সামগ্রীর সাহায্যে পুনরায় তারা বলশালী হতে পারবেন,এটাই উদ্দেশ্য ছিল। বেদী মার্জনা করবার সময় প্রথম মন্ত্র উচ্চারিত হয়; তাতে প্রথম মন্ত্রের অর্থ দাঁড়িয়েছে এই যে,–ক্রুর অসুরদের যুদ্ধের সময় পূর্বকালে পৃথিবীর যে সারভাগ পরিগ্রহণ করে বেদের সাথে ঊর্ধ্বদেশে চন্দ্রলোকে রক্ষিত হয়েছিল, হে যজ্ঞবেদী! তুমিই সেই সারসামগ্রী। সেই অনুসারে তোমাকেই উদ্দেশ্য করে মেধাবিগণ বন্দনা করছেন। দ্বিতীয় মন্ত্রে আগ্নি নামক ঋত্বিককে যেন আহ্বান করে বলা হয়েছে,-প্রোক্ষণী স্থাপন করো। তৃতীয় মন্ত্রে বেদীকে সম্বোধন করে বলা হয়েছে, তুমি আমাদের শত্রুসংহারক হও। এই মন্ত্রে স্ক্য বা বেদী-প্রস্তুতের খন্তাকে পরিত্যাগ করতে হবে। কর্মপদ্ধতি বিষয়ে আমরা বিতর্ক করি না। তবে আমাদের মত এই যে, মন্ত্র তিনটি ভগবানকে–পরমেশ্বরকে সম্বোধন করে প্রযুক্ত হয়েছে।
২৯। হে দেব! সৎপ্রতিবন্ধক শত্রু (আমাদের দুবুদ্ধি) সর্বতোভাবে ভস্মীভূত হোক; আমাদের রিপুশত্রুগণ, প্রত্যেকে বিশিষ্টরূপে দগ্ধ হোক। অর্থাৎ-হে দেব! আপনি আমাদের দুর্বুদ্ধিকে এবং রিপুশত্রুসমূহকে সমূলে বিনষ্ট করুন।(১)। হে দেব! আমাদের দুর্বুদ্ধিরূপ শত্রু, প্রত্যেকে সন্তপ্ত হোক; এবং আমাদের রিপুশত্রুগণ প্রত্যেকে বিশেষভাবে তাপযুক্ত (দগ্ধ) ভাবার্থ-ভগবান্ আমাদের দুর্বুদ্ধিসমূহকে এবং রিপুশত্রুগুলিকে সমূলে বিনাশ করুন।(২)। হে মন! তুমি শত্রুর প্রতি আসক্তিপর আছ।-তুমি শত্রুর নাশক হও। সকর্ম-প্রাপ্তির জন্য সকর্ম-সাধনের দ্বারা তোমাকে সংশোধন করছি। অর্থাৎ — হে মন! কাম-ক্রোধ ইত্যাদিকে শত্রু জেনেও তুমি স্বতঃই আসক্তি-বিশিষ্ট হয়ে থাকো। সুতরাং তুমি সংশোধিত হও।(৩)। [চতুর্থ ও পঞ্চম মন্ত্র যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় মন্ত্রে পুনরুল্লেখ মাত্র]।(৪-৫)। হে ধী! তুমি শত্রুর প্রতি আসক্তিসম্পন্না আছ। তুমি শত্রুনাশিকা হও। সকর্ম-প্রাপ্তির জন্য সকর্ম-সাধনের দ্বারা তোমাকে সংশোধন করছি। আমাদের ধী(প্রজ্ঞা) শত্রুর প্রতি (অর্থাৎ, কাম-ক্রোধ ইত্যাদির প্রতি) বিরূপ হয়ে (আসক্তি পরিশূন্য হয়ে) সকর্ম সাধনে নিয়োজিত হোক] (৬)। [এই কণ্ডিকার প্রথম, দ্বিতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম মন্ত্র দেব-সম্বোধনমূলক; তৃতীয় ও ষষ্ঠ মন্ত্র মনকে ও ধী-শক্তিকে সম্বোধন করে প্রযুক্ত]। [হবনীয় দান-পত্র ক (সুব) উষ্ণ করে প্রথম মন্ত্র দুটি উচ্চারিত হয়। এ হিসাবে, তৃতীয় মন্ত্রটি কমার্জন-উপলক্ষে উক্ত হয়ে থাকে। চতুর্থ ও পঞ্চম মন্ত্রে তিনটি ককে উত্তপ্ত করা হয়। তাতে প্রথম ও দ্বিতীয় মন্ত্রের অর্থই অধ্যাহৃত হয়ে থাকে। অর্থাৎ, তোমাদের তাপে শত্ৰুসকল নষ্ট হলো, এমন ভাবই প্রকাশ পায়। ষষ্ঠ মন্ত্রও তৃতীয় মন্ত্রেরই অনুরূপ। প্রভেদ–কেবল তিনটি ক-গ্রহণে ঐ মন্ত্র উচ্চারণ করতে হয়]।
৩০। হে ভগবান্! আপনি অনন্তরূপে আমাদের ভক্তি-সুধাস্বাদ-গ্রহণ-সমর্থ হয়ে রশনার মতো বিরাজমান আছেন।(১)। হে ভগবন্! আপনি বিষ্ণু (ব্যাপক) রূপে সর্বব্যাপক হয়ে আছেন।(২)। হে ভগবন্! আমি বল-প্রাণ পাবার কামনায় আপনাকে আহ্বান করছি।(৩)। হে ভগবন্! আমার বিভ্রমরহিত (অদব্ধ, অহিংস) নেত্রের দ্বারা আমি যেন আপনাকে দর্শন করতে সমর্থ হই। আপনার অগ্নিরূপ রশনা বিদ্যমান রয়েছে। আমার সর্ব রকম অবস্থিতির স্থানে, যাগ ইত্যাদি সকল সৎকর্মের অনুষ্ঠানে, সর্ব দেবের অধিষ্ঠানের জন্য (আমাতে সকল দেবভাব-বিকাশের নিমিত্ত্য আপনি সুষ্ঠু আহ্বানকারী হোন। [বিভ্রমরহিত দৃষ্টিতে তাকে দেখতে পেলে মনে হয়, — অগ্নিরূপে যে, তাঁর রসনা আছে। সেই রসনার দ্বারা তিনি সর্ব দেবগণকে (সর্বদেবভাবকে) আহ্বান করে থাকেন। আমার গৃহে গৃহে, আমার প্রতি কর্মে, আমার প্রতি পদক্ষেপে, আপনি (সেই দেবতা) দেবভাবকে আহ্বান করে আমাতে স্থাপন করুন,–এটাই মন্ত্রের শেষাংশের প্রার্থনা] ।(৪)। [কণ্ডিকার চারটি মন্ত্রই ভগবানের উদ্দেশ্যে প্রযুক্ত] [বেদীর পাশে গার্হপত্যাগ্নি প্রতিষ্ঠিত করে সেই বেদীর দক্ষিণ দিকে যজমান নিজের পত্নীকে উপবেশন করাবেন। এরপর তার হাতে মুঞ্জের যোক্ত (ফঁস বা অঙ্গুরীয়) পরাতে হবে। সেই সময় প্রথম ও দ্বিতীয় মন্ত্রে যোভ্রুকে সম্বোধন করে স্তুতি আছে। তৃতীয় মন্ত্রে অগ্নির উত্তাপে ঘৃতকে দ্রব করে আজ্যের স্তুতি রয়েছে। চতুর্থ মন্ত্র উচ্চারণকালে যজমান-পত্নী অধোমুখী হয়ে ঘৃতকে দর্শন করবেন। তাতে আজকে সম্বোধন করে মন্ত্রে যেন বলা হয়েছে, তোমাকে প্রীতির নেত্রে দর্শন করছি। তুমি আমার গৃহে গৃহে যজ্ঞে যজ্ঞে দেবগণের সুষ্ঠু আহ্বানকারী হয়ে আছ।–মুঞ্জকে পৃথিবীর রসনা ইত্যাদিরূপে বর্ণনার তাৎপর্য আমরা অনুধাবন করতে পারি না]।
৩১। হে আমার কর্ম! তুমি জ্ঞানপ্রদ সবিতৃদেবের প্রেরণায় (অনুকম্পায়) ত্রুটি-পরিশূন্য বায়ুর মতো পবিত্রকারক এবং সূর্যরশ্মির মতো জ্ঞানপ্রদ হয়ে আমাদের উৎকর্ষ সাধনে আমাদের পবিত্র করো। [সবিতু-প্রেরকস্য, জ্ঞানপ্রদস্য দেবস্য; সূৰ্য্যস্য, রশ্মিভিঃ–জ্ঞানস্বরূপস্য দেবস্য জ্যোতির্নিবহৈঃ]।(১)। হে আমার সৎ-অসৎ কর্মনিবহ! তোমরা জ্ঞানপ্রদ সবিতৃদেবের প্রেরণায় (অনুকম্পায়) ত্রুটি-পরিশূন্য বায়ুর মতো পবিত্রকারক এবং সূর্যরশ্মির মতো জ্ঞানপ্রদ হয়ে, আমাদের উত্তৰ্ষ-সাধনে আমাদের পবিত্র করো ।(২)। হে ভগবৎসম্বন্ধযুত কর্ম! তুমিই শুক্র (বিশুদ্ধ সত্ত্বরূপ), তুমিই বিনাশরহিত অমৃত (৩)। হে ভগবৎসম্বন্ধযুত কর্ম! তুমিই বস্তু, তুমিই বস্তুর সংজ্ঞা; তুমি দেবভাবের সংরক্ষক, তুমি সর্বত্র সাফল্যপ্রদ, তুমি সকল সঙ্কর্মের সাধক।(৪)। [এই কণ্ডিকার মন্ত্র কয়েকটি ভগবৎসম্বন্ধযুত কর্মকে ও সবরকম সাধারণ কর্মকে সম্বোধন করে প্রযুক্ত হয়েছে)। [ দ্বাদশ কণ্ডিকার দ্বিতীয় মন্ত্র আর এই কণ্ডিকার প্রথম ও দ্বিতীয় মন্ত্র প্রায় একই রকমের। এই কণ্ডিকার দ্বিতীয় মন্ত্রের এবং দ্বাদশ কণ্ডিকার দ্বিতীয় মন্ত্রের সাথে এই কণ্ডিকার প্রথম মন্ত্রের পার্থক্য অতি সামান্য। উক্ত দুই ক্ষেত্রে সম্বোধ্য বহুবচনান্ত পদ; আর এই প্রথম মন্ত্রের সম্বোধ্য–একবচনান্ত পদ। ভাষ্যকার সেখানে সম্বোধনে এক সামগ্রীকে লক্ষ্য করেছেন; এখানে আর এক সামগ্রীর প্রতি সম্বোধনে প্রযুক্ত হয়েছে। সেখানে সম্বোধ্য ছিল–জল; এখানকার সম্বোধ্য আজ্য (ঘৃত) ও প্রোক্ষণা (মার্জনের বা সেচনের পাত্র)। তাতে ভাষ্যকারের অর্থ দুই স্থলেই দুই রূপ দাঁড়িয়ে গেছে। আমরা মন্ত্র সম্বন্ধে পূর্বেও যে অর্থ অধ্যাহার করেছি, এখানেও সেই অর্থই পরিগৃহীত হয়েছে।
—দ্রষ্টব্য—
শুক্লযজুর্বেদের মন্ত্রগুলি মধ্যন্দিন, কণ্ব, জাবাল প্রভৃতি যাজ্ঞবল্ক্যের পঞ্চদশ শিষ্য কর্তৃক পঠিত হয়। মধ্যন্দিন, মাধ্যান্দিন শাখায় প্রবর্তক; কণ্ব কর্তৃক কাণ্ব শাখা প্রবর্তিত হয়। মাধ্যন্দিন-শাখার পাঠ এই গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে। কাণ্ব-শাখায় পাঠও প্রায়ই একরকম; মাত্র দু এক স্থলে দুএকটি শব্দের বা বাক্যের পরিবর্তন দেখতে পাওয়া যায়।
আবার, মাধ্যন্দিন শাখার কোনও কণ্ডিকায় হয়তো চারটি মন্ত্র আছে। কাণ্বথশাখাধ্যায়িগণ কখনও সেই চারটি মন্ত্রকে একটি মন্ত্র ধরে নেন। আবার, মাধ্যন্দিন-শাখার একটি মন্ত্রকে সময় সময় তারা একাধিক ভাগে বিভক্ত করে থাকেন। অপিচ, উভয় শাখার পাঠে কোথাও অতিরিক্ত পাঠ এবং কোথাও পাঠান্তরও দেখা যায়। তবে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে উভয় শাখার পাঠ অভিন্নই। মন্ত্রের ভাবের দিক থেকে বিচার করলে অতিরিক্ত পাঠ বা পাঠান্তরেও বিশেষ হেরফের দেখা যায় না। সুতরাং মাধ্যন্দিন শাখার অনুসরণেই শুক্লযজুর্বেদ অধ্যয়ন সার্থক বলে ধরে নেওয়া যায়।
আমরা ভাষ্যানুসারে প্রতিটি মন্ত্রের অর্থের সাথে আধ্যাত্মিক অর্থে মন্ত্রগুলির স্বরূপ সম্পর্কে এই প্রথম অধ্যায়ে বিশেষভাবে উল্লেখ করেছি। এর থেকেই সুধী পাঠক কর্মকাণ্ডের জন্য মন্ত্রের প্রয়োগ বিষয়ে তথা ভাষ্যকারদের দ্বারা মন্ত্রগুলির ব্যাখত অর্থ সম্পর্কে অবশ্যই অবগত হতে পারবেন। এর
পরবর্তী অধ্যায়গুলিতে কেবলমাত্র অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ক্ষেত্র ভাষ্যকারদের বক্তব্য উল্লেখিত হবে।
‘শুক্লযজুর্বেদ’-এর আরূক নাম তো ‘বাজসনেয় সংহিতা’। কৃষ্ণযজুর্বেদের আরেকটা নাম তৈত্তিরীয় সংহিতা। তাই নয় কি?
হ্যাঁ।