1 of 2

০১. শীতের শেষ

শীতের শেষ কিন্তু গ্ৰীষ্ম এখনো তেমনভাবে আসরে নামেনি। বার্তাস মোলায়েম আর রোদুর যেন রেশমী ওড়না। বাজারে এখনো তরিতরকারি টাটকা সতেজ। দিনের বেলা জাগরণের সময় সহসা ক্লান্তি আসে না, রাত্রির নিদ্রা সুখকর। সময়টি প্রকৃতই মধুর।

বাংলায় বসন্ত শুধু কবি-কল্পনায় আর মা-শীতলার দয়ার প্রকাশে। শীত যেতে না যেতেই গা-পোড়ানো গ্ৰীষ্ম হুড়মুড় করে এসে পড়ে। কিন্তু এ বৎসরটি যে নিতান্তই ব্যতিক্রম। শীত ও গ্ৰীষ্ম এই দুই ঋতু যেন কিছু ব্যবধান রেখে দুই ধারে দণ্ডায়মান আর মধ্যখানে এসে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে বহুকালের অজ্ঞাতবাসের পর ঋতুরাজ বসন্ত। সুন্দর, সুস্নিগ্ধ, পিকরব মুখরিত, মন-উচাটন বসন্তকাল।

ছাতুবাবুর মাঠে সার সার তাঁবু পড়েছে। সকাল থেকে সেখানে শুধু কালো কালো মানুষের মাথা। আর মাঝে মাঝেই তার মধ্য থেকে চিৎকার উঠছে, ধ্যো মারা, ধ্যো মারা।

লাল বুলবুলি, শা বুলবুলি আর সেপাই বুলবুলি। লাল বুলবুলির সবঙ্গেই প্রায় কুচকুচে কালো, শুধু পেটের তলা আর লেজ লালবর্ণ। আর শা। বুলবুলি শাবক অবস্থায় থাকে পুরো খয়েরি, ক্রমশ শরীরের নানা অংশের রঙ সাদা হতে থাকে, মাথায় কুঁটি, ডাগর চোখে চঞ্চলভাবে তাকায় আর গলা ফুলিয়ে ডাকে।

তবে আসল লড়াকু হল সেপাই বুলবুলি। এদের ডানা খয়েরি, কিন্তু মাথার দুপাশে লাল রঙের রেখা। ঝুঁটিটি কালো। যেন সেপাইদের মতন লাল-কালো উষ্ণীষ পরে আছে মাথায়।

এক একজন বড় মানুষের তাঁবুতে বিশাল বিশাল খাঁচায় রাখা আছে। এই সব শিক্ষিত, যোদ্ধা পাখিদের। খালিফারা তাদের সর্বক্ষণ তোষামোদ করে চলেছে শিস দিয়ে। আজকের দিনটিতে বাবুদের চেয়ে বাবুদের বুলবুলিরাই নায়ক। সালিশী মশাই হাঁক দিলে এক একজন বাবু একজোড়া করে পক্ষী নিয়ে আসছেন লড়াইয়ের আঙিনায়। এই বুলবুলিগুলিকে চব্বিশ ঘণ্টা ধরে উপবাসী রাখা হয়েছে, সালিশী মশাই মাঝখানে এক খাবলা কাবলি ছোলা ছড়িয়ে দেবার পর দু পক্ষের দু জোড়া বুলবুলি ঝাঁপিয়ে পড়বে তার ওপর। এদের এমনই শিক্ষা দেওয়া হয়েছে যে বিপক্ষীয় পক্ষীদের আগে হটিয়ে না দিয়ে দানায় মুখ দেয় না। পক্ষীতে পক্ষীতে ঝটাপটি বেঁধে যাবার পর দর্শকরা। তুমুল হাততালি ও গালবাদ্য দিয়ে ওদের আরও উত্তেজিত করে তোলে। তারপর এক পক্ষের আহত বুলবুলি ভয় পেয়ে পিছিয়ে এলেই দর্শকরা দুয়ো দেয়, ধো মারা।

এই খেলার উদ্যোগের জন্য প্রতি বৎসর ব্যয়িত হয় লক্ষ লক্ষ মুদ্রা। তবে যারা বহু বৎসর বুলবুলির লড়াইয়ের প্রত্যক্ষদশী, যারা আসল সোয়োকীন, তাদের মতে, এ বৎসর খেলার মধ্যে যেন তেমন ধার নেই। কোথায় সেই আড়ম্বর, সেই গীত বাদ্য, সেই পয়সার ঝনঝনি। বাবুদের যেন তেমন আর মুরোদ নেই। এই মাঠেই মল্লিকবাড়ির বাবু, হরনাথের সঙ্গে লড়েছিলেন ছাতুবাবু স্বয়ং।। পক্ষীর খেলা তো নয়, যেন এক ধুন্দুমার কাণ্ড। সে দৃশ্য এখনো অনেকের মনে আছে। রাজা সুখময় রায়ের পুত্রেরাও এ খেলায় ঢেলে দিতেন অঢেল টাকা। আর সে রকম উঁচু নজর কজনের আছে।

দুবৎসর আগেই যেন হয়ে গেছে। শেষ জমজমাট বুলবুলখ্য পক্ষিগণের যুদ্ধ। সেবার এসেছিলেন রাজা সুখময় রায়ের বংশেরই রাজা রাজেন্দ্রনারায়ণ তাঁর বিশাল পক্ষিবাহিনী নিয়ে। আগে থেকেই ডংকা বাজিয়ে ঘোষণা করেছিলেন, তাঁর বুলবুলিদের রুখতে পারে এমন বুলবুলিওয়ালা ভূ-ভারতে কেউ নেই। তাঁর বুলবুলিদের যদি সত্যিই কেউ হারাতে পারে তাহলে তিনি নিজের মাথার মুকুট খুলে রাখবেন প্রতিপক্ষের পায়ের কাছে। সে খেলা দেখতে ছুটে এসেছিল। লাখে লাখে মানুষ, এমনকি সাহেব রাজপুরুষরাও আসর ঘেঁষে সার বেঁধে দণ্ডায়মান হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু অভূতপূর্ব অঘটন ঘটে গিয়েছিল সেবারেই। অতবড় মানী লোক রাজা রাজেন্দ্রনারায়ণ, তাঁকে কিনা। টক্কর দিতে এলো কোথাকার এক দয়াল মিত্তির।

বেলা দশটা থেকে খেলা শুরু, প্রথম খেলাতেই রাজার পক্ষী ঘায়েল। তার পরের বারিও। এবং তার পরের বার। মোট পঞ্চাশ জোড়া পক্ষীর খেলার ফলাফল নিয়ে জয় পরাজয় হবার কথা, কিন্তু সাঁইতিরিশ বার খেলার মধ্যে সাতাশবারই হারলেন রাজা রাজেন্দ্রনারায়ণ। তাঁর প্রথম দিকের বিস্ময় ক্রমশ পরিণত হলো গভীর শোকে। তাঁর অনুচরেরা নিয়মিত খবর রেখেছে যে কলকাতায় কোন কোন বাড়িতে পক্ষীদের কেমন তালিম দেওয়া হয়। একবারও দয়াল মিত্তিরের নামও কেউ উচ্চারণ করেনি। খেলার শেষ পর্যন্ত আর অপেক্ষা করতে পারলেন না রাজেন্দ্রনারায়ণ, দারুণ বিমর্ষ মুখে কুরুক্ষেত্রের দুযোধনের মতন রণে ভঙ্গ দিলেন।

লোকে বলে, সেই বুলবুলির লড়াইতে হেরে রাজা রাজেন্দ্রনারায়ণ মনের দুঃখে লালাবাবুর মতন বিবাগী হয়ে গেছেন।

এ বৎসরের রণাঙ্গনে সেই দয়াল মিত্তিরই জাঁকিয়ে বসে আছেন মাঝখানে, কিন্তু প্ৰতিপক্ষ বিশেষ কেউ নেই। কিছু কিছু নতুন উঠতি বাবু তাঁবু ফেলেছেন বটে, কেউ পাঁচ গণ্ডা, কেউ দশ গণ্ডী পক্ষীও এনেছেন। কিন্তু তাদের না আছে তেমন সহবৎ, না আছে রোশনাই। এই সব ফতোবাবুদের নামই আগে শোনা যায়নি। সেইজন্য ঝানু দর্শকরা নাসিকা কুঞ্চিত করে মন্তব্য করছে, এ যে দেকচি বাওয়া সড়ঞ্চে পোয়াতীর বুড়ো বয়েসের ছেলে গো! ড্যানাক ড্যানাক ড্যাডাং ড্যাং চিংড়ি মাছের দুটো ঠ্যাঙ!

সাধারণ দর্শকদের থেকে খানিকটা দূরে আলাদা দাঁড়িয়ে আছে যুগলসেতুর সুবিখ্যাত সিংহ পরিবারের সন্তান নবীনকুমার। এখন পঞ্চদশ বর্ষীয় যুবা। সে পরিধান করে আছে। হলুদ রঙের চায়না কোট ও সাদা পাপুঁটুলুন, কালো ইংলিশ লেদারের জুতো কিন্তু মাথায় টুপি পরেনি। বুকপকেটে একটি স্বৰ্ণময় ঘড়ি, তার গার্ড চেইনও সোনার। বাঁ হাতের তর্জনীতে একটি বৃহদাকার হীরকসমন্বিত অঙ্গুরীয়। তার কোমল লাবণ্যমণ্ডিত মুখমণ্ডলে চক্ষু দুটি অস্বাভাবিক রকমের উজ্জ্বল।

নবীনকুমারের পাশে দণ্ডায়মান তার সর্বক্ষণের সঙ্গী দুলালচন্দ্র। এই দুলালচন্দ্রের চেহারায় হঠাৎ পরিবর্তন এসেছে। তার মনিবের চেয়ে সে কয়েক বৎসরের বড়, মাত্র গত বৎসরই সে দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে, তাকে মনে হয় পালোয়ানের মতন। চওড়া স্কন্ধ, চওড়া কব্জি, ঘাড় স্কুল। বড় বড় চুল রেখেছে সে। নবীনকুমারের এখনো কণ্ঠ ভাঙেনি, তার স্বর কোমল, সুরেলা, অনেকটা নারীদের মতন। সেই তুলনায় দুলালচন্দ্রের কণ্ঠস্বর বয়স্ক পুরুষদের মতন। সে মালকোঁচা মেরে ধুতি পরে এবং গায়ের একটি তুলোর বেনিয়ান। ইদানীং সে বিম্ববতীর নির্দেশে নবীনকুমারকে আপনি আত্তে বলে কথা বলে।

নবীনকুমার দুলালচন্দেরীর দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলো, তুই আরও দেকতে চাস?

দুলালচন্দ্র সঙ্গে সঙ্গে বললো, আজ্ঞে, আপনি যা বলবেন।

নবীনকুমার বললো, তুই দোকতে চাস তো দ্যাক, আমি গাড়িতে গিয়ে বসি।

দুলালচন্দ্র বললো, আজ্ঞে না। আমিও যাবো।

বস্তুত দুলালচন্দ্র এই খেলা খুবই উপভোগ করছিল। বুলবুলির মতন নরম, সুশ্ৰী চেহারার পক্ষীও যে ঠোঁট দিয়ে একে অপরের উদর ফুটো করে দিতে পারে, সে আগে কখনো কল্পনাও করেনি। যুদ্ধে পরাজিত কোনো বুলবুলি যখন ওড়ার চেষ্টা করেও বার বার মাটিতে পড়ে যাচ্ছিল, তখন অন্য দর্শকদের সঙ্গে সেও উত্তেজনায় গলা মিলিয়েছে।

নবীনকুমার আগাগোড়া নীরব ছিল। দুলালচন্দ্রের অত্যুৎসাহ তার নজর এড়ায়নি। ফেরার জন্য পা বাড়িয়ে সে বললো, তোর মতন পাঁচপেচী লোকদের এই বুলবুলির লড়াইয়ে মন চুলবুলোবে তাতে আশ্চর্যর কিচু নেই—

দুলালচন্দ্র জিজ্ঞেস করলো, আজ্ঞে, আপনার ভালো লাগেনি?

নবীনকুমার বললো, বড় বড় বংশের মানী মানী লোকেরা যে এমন ছেলেখেলায় মাজে, সেটাই বড় তাজবের কতা। পঞ্চগব্যের আসল গব্যটি এদের মাতায় পোরা নিশ্চয়। কোতা উল্টে দ্যাখ, এদের সবার পেছুনে একটা করে ন্যাজ আচে!

দুলালচন্দ্র সবটা বুঝতে না পেরে চুপ করে রইলো।

গভীর ভারিকী চালে অগ্রসর হতে হতে নবীনকুমার আবার বললো, দেশটা ধনী বংশের মার্কটে ছেয়ে গ্যাচে, আর সেই সুযোগে বুদ্ধিমান, শক্তিশালী ইংরেজ লুটেপুটে নিয়ে যাচ্চে সব। ছ্যা, ছ্যা, ছা। বুলবুলি লড়াইয়ের এত নামডাক শুনিচি, তা কিনা। এই! এর চেয়ে মেয়েমানুষের পুতুল খেলাও ভালো।

ভিড় ছড়িয়ে বাইরে এসে নবীনকুমারের মুখের ভাবের পরিবর্তন হলো। হাসি ফুটলো এই প্রথম। সে বললো, তবে একটা ব্যাপারে আমি খুশী হয়েচি। হাটখোলার কালীপ্রসাদ দত্তর সব কটা পাখির ঠ্যাং খোঁড়া হয়েচে, ওকে হারিয়ে একেবারে ভুষ্টিনাশ করে দিয়েচে। বেশ হয়েচে, খুব হয়েচে, ভালো হয়েচে।

দুলালচন্দ্ৰ কালীপ্রসাদ দত্তকে চেনে না, সে বুঝতে পারলো না সেই বিশেষ ব্যক্তিটির হার হওয়ায় তার মনিব এত খুশী কেন।

নবীনকুমার আপন মনে একটুক্ষণ হাসলো, তারপর একদিকে অঙ্গুলি প্ৰদৰ্শন করে বললো, ওদিকে চ।

দুলালচন্দ্র বললো, আজ্ঞে, গাড়ি এদিকে।

নবীনকুমার এক ধমক দিয়ে বললো, জানি! ওদিকে চ!

ছাতুবাবুর মাঠে এই বুলবুলির লড়াই উপলক্ষে বেশ বড় একটা মেলা বসে যায়। পর পর মোয়া, মুড়কি, পাপড় আর তেলেভাজার দোকান। কিছুদিনের মধ্যেই গাজনের উৎসব আসছে, সেইজন্য রকমারি মাটির পুতুল, গামছা, হাঁড়িকুড়ির ব্যাপারীরা আসে কাছেই রামবাগান, সেখানকার অবিদ্যা-স্ত্রীলোকেরা খাতায় খাতায় আসে। কেনাকাটি করতে।

আর আসে পক্ষী বিক্রেতারা। নানা জাতের গৃহপোষ্য, রঙ-বেরঙের ছোট বড় পাখি তো থাকেই, সবচেয়ে বেশী থাকে বুলবুলি। নতুন বাবুরা আগামী বৎসরের লড়াইয়ের জন্য এখান থেকেই বুলবুলি কিনে নিয়ে যায়। কোন কোন বিশিষ্ট খালিফার তালিম দেওয়া বুলবুলি, দোকানদাররা সেইসব নাম হাঁকাহাঁকি করছে।

একটি পাখির দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালো নবীনকুমার। দুলালচন্দ্ৰকে বললো, কত দাম জিজ্ঞেস কর।

দুলালচন্দ্ৰ বিস্মিত হলো। এইমাত্র তার মনিব নিন্দে করলে এই পাখির লড়াইয়ের, এবার সে নিজেই পাখি কিনবে নাকি? আগামী বছর এখানে তাঁবু খাঁটিয়ে খেলতে আসবে? তার খামখেয়ালী মনিবের মনের গতিবিধি বোঝা ভার।

একজোড়া বুলবুলির দাম চার টাকা।

তা শুনে দুলালচন্দ্রের চোখ প্ৰায় কপালে ওঠার অবস্থা। এ লোকগুলো বলে কী? এরা ঠ্যাঙাড়ে না গলা কাটা? সাত আট টাকায় একটি দুধেল গাই পাওয়া যায়, আর এইটুকুনটুকুন। এক একটা পাখনার দাম দুটাকা। তার কম বয়স্ক মনিবকে দেখেই এরা বুঝতে পেরেছে সে খুব বড় মানুষের সন্তান, তাই এরা দাঁও মারতে চাইছে।

দুলালচন্দ্র বললে, দিনে ডাকাতি পেইচিস ব্যাটারা?

তখন পাশাপাশি দোকানদাররা বলতে লাগলো, বাবু ছায়েব, জমির শেখ খালিফার নাম শোনেননি? খিদিরপুরের জমির শেখ! তেনার নিজের হাতের শিকুনো-বাবু ছায়েব, মিঞা হোসেন সা, তিনি আরও বড় খালিফা, এই দ্যাখেন।

নবীনকুমার বললো, দরদাম কর। আমি কিনবো!

অনেক ধ্বস্তাধবস্তি করে দুটাকা জোড়ায় নামানো গেল। এর থেকে আর কমানো যাবে না। নবীনকুমার কোটের লম্বা পাশ পকেটে হাত ঢুকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, এই সবচেয়ে বড় খাঁচাটায় কটা বুলবুলি আচে গুণে দোকতে বল।

হিসেব করাই ছিল, আবার গণনা করা হলো। ছাঁচা বাঁশের লম্বা খাঁচাটিতে রয়েছে পঞ্চাশ জোড়া সেপাই বুলবুলি।

নবীনকুমার ঝনঝনি করে একশোটি টাকা ছুঁড়ে দিল দোকানীর সামনে। তারপর হাঁটু গেড়ে বসে খাঁচার দরজাটা সে নিজেই খুলে ফেললো।

কোনো বড় খালিফার কাছেই এসব পাখিরা তালিম পায়নি। যারা ধরে, তারাই কিছুদিন পরে সুতো বেঁধে রেখে একটু একটু পোষ মানায়। খাঁচার দরজা খোলা পেলেও এরা উড়ে যায় না সহসা।

নবীনকুমার তাদের ডাকতে লাগলো, আয়, আয়। একটা পাখিকে সে খপ করে ধরে ফেলে বাইরে আনলো। তারপর শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে বললো, যাঃ।

বুলবুলিটা ডানা ঝটপটিয়ে একটুক্ষণ ঘুরপাক খেল, বিস্মিত চোখে বুঝি একবার দেখে নিল মুক্তিদাতাকে, তারপর উড়ে চলে গেল।

দোকানদার অতিকে উঠে বললো, আরো করেন কী, করেন কী ছায়েব?

খাঁচার ওপর দু হাতের চাপড় মারতে মারতে নবীনকুমার বলতে লাগলো, আয়! আয়! বাইরে আয় সব।

ফুরুৎ ফারাৎ করে উড়ে বেরুতে লাগলো একটি দুটি বুলবুলি। নবীনকুমার নিজেও হাত ঢুকিয়ে একটা করে ধরে এনে ওপরের দিকে উড়িয়ে দিয়ে বলতে লাগলো, যাঃ। যেখেন ঠেঙে এসিচিস, সেখেনে যা। মাঠের ধান খা গিয়ে। হিমালয় পাহাড়ে উড়ে যা।

একশো বুলবুলি কয়েক মিনিটেই শেষ। নবীনকুমার পাশের খাঁচাটির কাছে সরে গিয়ে বললো, এটার মধ্যে কত আচে, হিসেব করে।

দেখতে দেখতে ভিড় ভেঙে লোকজন ধেয়ে এলো সেদিকে। মূল খেলা ছেড়েও দর্শকরা চলে এলো নবীনকুমারকে দেখতে। দাবানলের মতন খবর রটে গেল যে সিংগীবাড়ির ছোটকুমার দু হাতে টাকা ওড়াচ্ছেন। টাকা ওড়ানো নয় তো কী! এক একটা পাখি এক টাকা। অনেকে আবার সেই পাখিগুলিকে ধরার জন্য লম্বফঝম্বফ করতে লাগলো, কিন্তু একজনও একটাও ধরতে পারলো না।

তিনটি খাঁচা খালি করার পর নবীনকুমার একটু থামলো। কয়েকটি বুলবুলি কাছেই একটা বকুলগাছে বসে বিস্মিতভাবে ডাকাডাকি করছে। একঝাঁক চক্রাকারে ঘুরছে মাথার ওপর আকাশে। নবীনকুমার সেদিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো, সে এখন সত্যিকারের আনন্দ উপভোগ করছে। সামান্য কয়েকটি টাকার বিনিময়ে যে এমন আনন্দ পাওয়া যায়, সে জানতো না।

তার কাছে আর টাকা নেই। সে হাতের হীরক অঙ্গুরীয়টি খুলে দুলালচন্দ্রের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ইদিকে কোতায় স্যাকরার বাড়ি আচে দ্যাক। এটা বেচে যত টাকা পাস নিয়ায়।

দুলালচন্দ্ৰ কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো, ছোটবাবু, এবার উঠুন। আর দরকার নেই।

—তোকে যা বলচি কর।

—আজ্ঞে ও আংটি আমি বেচতে পারবো না, কত্তামা তা হলে আমায় রক্ষে রাখবেন না। ও আপনার বাবার আংটি।

—তবে যা, বাড়ি থেকে টাকা নিয়ায়।

—আর থাক না। এবার উঠন বরং—।

নবীনকুমার ওর সঙ্গে আর কোনো বাক্যব্যয় না করে আর একটি খাঁচার দরজা খুলতে গেল। সে খাঁচার মালিক হা হা করে উঠতেই সে ধমক দিয়ে বললো, কাল সিংহ বাড়িতে গিয়ে ডবল দাম নিয়ে আসবি। আমার কতার দাম লাখ টাকা।

বুলবুলির লড়াইয়ের প্রাঙ্গণ একেবারে দর্শকশ্বন্য। সমস্ত মানুষ এখন এদিকে। নবীনকুমার এক একটি খাঁচা খুলছে আর তুমুল আনন্দের শোরগোল উঠছে। ছাতুবাবুর বাগানে এমন অভিনব দৃশ্য কেউ কোনোদিন দেখেনি। দয়াল মিত্তির, কালীপ্রসাদ দত্ত পর্যন্ত নিজেদের তাঁবু ছেড়ে চলে এসেছেন এই নতুন খেলা দেখতে।

নবীনকুমার সব কটি খাঁচা শেষ করলো যখন, তখন ওদিকে বুলবুলির লড়াই অসমাপ্ত অবস্থায় বন্ধ হয়ে গেছে। যিনি সালিশী করতে এসেছিলেন, তিনি বিরক্ত হয়ে হাঁটা দিয়েছেন বাড়ির দিকে।

নবীনকুমার যখন উঠে দাঁড়ালো, তখন ঘন ঘন জয়ধ্বনি দেওয়া হতে লাগলো তার নামে। তার যাওয়ার পথ করে দেবার জন্য জনতা বীরের সম্মান দিয়ে ফাঁক হয়ে গেল। নবীনকুমারের জুড়িগড়ি পর্যন্ত বহু লোক এলো তার পেছনে পেছনে।

জুড়িগাড়িটির ঠিক সামনে রাস্তার ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে ছিল এক উন্মাদ। তার বয়েস হবে বছর পঞ্চাশেক, কাঁচা-পাকা চুল ও দাড়িগোঁফ বহুকালের ধূলোয় জট পাকানো।

এত মানুষের শোরগোলে সে ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়ালো। সামনেই নবীনকুমারকে দেখে সে হাত দুটি অঞ্জলিবদ্ধ করে বললো, বাবু, এটু জল দেবে, চিঁড়ে ভিজিয়ে খাবো!

নবীনকুমার পাগল, মাতাল ও পুলিশদের অত্যন্ত অপছন্দ করে। একেবারে মুখোমুখি এক বলশালী উন্মাদকে দেখে সে বলে উঠল, দুলাল!

দুলালচন্দ্ৰ অমনি এক কঠিন ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল উন্মাদটিকে।

নবীনকুমার গাড়িতে উঠে বসে দরজা বন্ধ করে দিল।

দুলালচন্দ্ৰ পাশের পাদানিতে দাঁড়িয়ে বললো, সহিস, হাঁকো। জুড়িগাড়ি চলে গেল কপকপিয়ে। সেই উন্মাদ তখন অন্যদের বলতে লাগলো, বাবু, এটু জল দেবে, চিঁড়ে ভিজিয়ে খাবো।

শহরের মানুষ বড় বিচিত্র রকমের আমোদখোর। অনেকে তখন সেই পাগলটিকে নিয়ে পড়লো। এ ব্যাটা চিঁড়ে চায় না, জল চায়। আগে চিঁড়ের খোঁজ কর, জল তো কত রয়েছে, পাঁচ পা অন্তর একটা করে পুকুর।

—বাবু, এটু জল দেবেন, চিঁড়ে ভিজিয়ে খাবো।

সবাই সামনে থেকে সরে যায়, আর একটু দূর থেকে বলে, আরে ব্যাটা, চিঁড়ে খাবি কেন, ভাত খা, ভেজাতে হবে না। আর একজন বললো, ভাত কেন, পোলাউ খা না, মনে মনে খাবি যখন, তখন পোলাউতে আপত্তি কী!

লোকটি যেন কারুর কথাই শুনতে বা বুঝতে পারে না। একঘেয়ে কাকুতিমাখা গলায় ও শুধু বলে চলে, বাবু, এটু জল দেবেন, চিঁড়ে ভিজিয়ে খাবো।

এক সময় অপরাহ্ন শেষ হয়ে সন্ধ্যা এলো, মেলা সাঙ্গ হলো। ছাতুবাবুর বাগান জনশূন্য হয়ে গেল। পশ্চিম দিগন্তে আকাশ অরুণ বৰ্ণ, রাত্রির মজলিসের জন্য প্ৰস্তুত হচ্ছে নগরী। গাছের ডালে ডালে এখনও কল-কৃজনে মত্ত হয়ে আছে অনেক পক্ষী। তাদের মধ্যে অনেকগুলিই স্বাধীন বুলবুলি।

কাছাকাছি আর কোনো মানুষ নেই, তবু সেই উন্মাদটি বলে যেতে লাগলো, বাবু, এটু জল দেবেন, চিঁড়ে ভিজিয়ে খাবো।

উন্মাদটি অসম্ভব ক্ষুধার্ত। কিন্তু সে কেড়ে খেতে জানে না। মস্তিষ্কের গোলযোগ হেতু সে ভিক্ষার সঠিক ভাষাটিও বলতে পারে না। সে যদি বলতো, বাবু, একটু চিঁড়ে দিন, জলে ভিজিয়ে খাবো, কেউ হয়তো দয়াপরবশতঃ তাকে কিছু খাদ্য দিত। কিন্তু ভাষার ভুলের জন্য তার ক্ষুধার কথা কেউ বুঝলো না। সে সবার উপহাসের পাত্র হলো।

কিন্তু সে কী করবে। বহুকাল আগে সে শুকনো চিঁড়ে ভিজিয়ে খাবার জন্য জলের সন্ধানেই বেরিয়েছিল। সে কথাই তার মনে গেথে আছে।

পথ দিয়ে চলতে চলতে সেই মূখ্য উন্মাদটি এক একবার রক্তবর্ণ আকাশের দিকে চায়, তারপর নিকটবতী কোনো পথচারীকে দেখলে আবার সেই ভুল ভাষাতেই বলে, বাবু, এটু জল দেবেন, চিঁড়ে ভিজিয়ে খাবো!

পথচারীরা ভয় পেয়ে বলে, আ মালো যা, এ ব্যাটা কে রে, দূর হ! দূর হ!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *