০১. শান্তিনিকেতনে পড়তে যাবার আগ্রহ

শান্তিনিকেতনের দিনগুলি – সন্‌জীদা খাতুন

স্নেহভাজন পিয়াস মজিদের অনুরোধে শান্তিনিকেতনের দিনগুলি লেখা হয়েছে। এটি তাকেই উৎসর্গ করলাম

প্রাক্‌-কথন

শান্তিনিকেতন ছিল আমার স্বপ্নের দেশ। রবীন্দ্রনাথ বা রবীন্দ্রসাহিত্য পাঠের ফল হিসেবে নয় কিন্তু। হয়তো রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ঝাপসা ঝাপসা একটা প্রীতির বোধ থেকে। কারণ, চয়নিকা আর সঞ্চিত–এই দুই সংকলনই, বহুপাঠের ফলে রবীন্দ্রনাথ আর নজরুল উভয়ের প্রতি ভালোবাসার আবেগ মনে জেগেছিল। নজরুলেরও শান্তিনিকেতনের মতো কোনো প্রতিষ্ঠান থাকলে হয়তো সেখানে যাওয়ার ব্যাকুলতাও অন্তরে জন্ম নিত। তা না হওয়ায় রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনই হয়ে উঠেছিল স্বপ্নের আকর।

১৯৫৪ সালের শেষ দিকে আশ্রমে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গেই পথের পাশের ঝোঁপঝাড়ে কোথায় কী ফুল ফুটছে, তার নাম কী–এই সব জানবার আগ্রহে অধীর হয়েছিলাম। কাঁকুরে মাটিতে খালি পায়ে হাঁটবার বাস্তবতা যদিও সুখকর ছিল না, চলাফেরা চলত ঘোরে। স্বপ্নের মাটি কি না! তবে গাছপালা আর ফুলের পরিচয় মনকে প্রকৃতিসংলগ্ন করে আশ্চর্য শুশ্রূষা দিয়েছিল।

বিদ্যা অর্জনের অঙ্গন হিসেবেও শান্তিনিকেতন আমাকে কেমন আদরে বুকে টেনে নিয়েছিল সে-কাহিনি স্মৃতিতে ভাস্বর রয়েছে। আর কাকুরে মাটির মতো জীবনের কাটার নানা পরিচয় জীবনসত্যের মুখোমুখি করেছিল আমাকে, সেও স্বাপ্নিক স্মৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে প্রকাশ পেল এই লেখাতে।

শান্তিনিকেতন-জীবনের এই স্মৃতি শান্তিনিকেতনের আস্বাদ তৈরি করে থাকলে এ লেখা সার্থক মনে করে স্বস্তি পাব।

সন্‌জীদা খাতুন
ঢাকা, ৬ ভাদ্র ১৪২৬

.

০১.

অল্প বয়স থেকেই শান্তিনিকেতনে পড়তে যাবার আগ্রহ জন্মেছিল আমার। তার আগে একবার অবশ্য রবীন্দ্রনাথের ওপরে প্রবল ক্ষোভে বিক্ষুব্ধ হয়েছিলাম। মজার কথা! ‘মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে’ কবিতা পড়ে মনে হয়েছিল, এ কবিতা তো আমিই লিখতাম। রবীন্দ্রনাথ কেন লিখতে গেলেন! এই নিয়েই ছেলেমানুষি সংক্ষোভ। এই সব পার হয়ে নবম শ্রেণিতে উঠবার পরে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে নানা রকম ইচ্ছা জাগতে শুরু করল। তার একটি–নার্স হব। অন্যটি–শান্তিনিকেতনে গিয়ে লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে গান শিখে গাইয়ে হব।

নার্সিং শিখবার কথাটা বোধ করি বাবাকে বলা হয়নি। শান্তিনিকেতনে পড়বার কথায় বাবা বললেন, রবীন্দ্রনাথ চলে যাবার পরে ওখানে কি আর আগের পরিবেশ আছে! ওই বয়সের মেয়েকে একা একা বিদেশে পড়তে পাঠানো যায় না, কথাটা উহ্য থেকে গেলেও বুঝতে অসুবিধে হলো না।

নবম শ্রেণির পরে গ্র্যাজুয়েশনের আগেও আর একবার ঝোঁক এসেছিল–শান্তিনিকেতনে পড়তে যাব। বাবা নির্বিকার। যা বলবার তা তো বলেইছেন। তত দিনে গানে মেতে উঠেছি। ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর সোহরাব হোসেনের গানে মুগ্ধ হয়ে তাঁর শিষ্যত্ব বরণ করেছি। টানা তিন বছর গান শিখে ওঁর গানের ভান্ডার শূন্য করে ফেলেছি। বাবার পাষাণ তটে প্রতিহত হয়ে শান্তিনিকেতনের স্বপ্ন চুরমার হলে পর বাংলায় অনার্স নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া গেল।

পিতৃবন্ধুর কন্যা গোপা হেমাঙ্গী রায় চৌধুরীর লেখা কবিতার বই পড়ে দুহাতে কবিতা লিখে চলেছি তখন। বাবা দেখলেন, মেয়েটা পাগল। শেষে আমাকে কলকাতা নিয়ে গেলেন গোপাদিদির সঙ্গে মিতালি করিয়ে দিতে। গোপাদিদি বাংলায় অনার্স পরীক্ষা দিয়েছেন। গান গাইতে পারেন, ছবিও আঁকেন। রবীন্দ্রনাথের ‘মুদিত আলোর কমলকলিকাটিরে রেখেছে সন্ধ্যা আঁধার পত্রপুটে’ নাকি ‘কুঁড়ির ভিতরে কাঁদিছে গন্ধ অন্ধ হয়ে’ কবিতার একটি ছবি বাধিয়ে রাখা হয়েছে বাড়িতে। সংসারের কাজেও গোপাদিদি বাবা-মাকে বুদ্ধি পরামর্শ দিচ্ছেন দেখলাম। গুরুগম্ভীর মানুষ! ওঁর সঙ্গে কি বন্ধুত্ব চলে! এ যাত্রায় কলকাতা ঘুরেই শান্তিনিকেতনের আশা ছাড়তে হলো।

উনিশ শ চুয়ান্ন সালে আমার বাংলা অনার্স পরীক্ষা শেষ হবে হবে। এমন সময়ে বিশ্বভারতীর কাছে এক আবেদন পাঠিয়ে দিলাম। এমএ ক্লাসে ভর্তি হতে চাই। পরীক্ষা চলছে, তার মধ্যেই বিশ্বভারতীর চিঠি এসে হাজির–এমএ ক্লাসে আমার প্রভিশনাল অ্যাডমিশন হয়ে গেছে। এখন ওখানে গিয়ে টাকাপয়সা জমা করে ভর্তি হতে হবে। আমি তো মহাখুশি। আম্মুও হাসছেন, আব্বুকে এড়িয়ে কেমন শান্তিনিকেতনে পড়বার ব্যবস্থা হতে চলেছে! বাড়িতে আমার গানের মাতামাতি দেখে আম্মু খুশি ছিলেন। পড়ার সময় বাদ দিয়ে সন্ধ্যার দিকে গানের পরে গান গাইতাম। আমার বিছানায় আধশোয়া হয়ে আম্মু মন দিয়ে শুনতেন রোজ।

আব্বু কথা তুললেন, পড়বার খরচ আসবে কোত্থেকে। আম্মুই বললেন, কেন? স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটে পড়িয়ে আব্বু যে-টাকা পান, তাতেই খরচ পুষিয়ে যাবে। আব্ব চুপ। ঠিক হলো পরীক্ষা শেষ হলে আম্মু আমাকে ভর্তি করতে নিয়ে যাবেন শান্তিনিকেতনে। আমাকে পায় কে!

স্যুটকেস আর হোল্ডঅল গুছিয়ে নিয়ে আম্মুর সঙ্গে চললাম। যদুর মনে হয়, সেটা অক্টোবর মাস। বিশ্বভারতী আপিস থেকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন ভারতীদা। স্টেশন থেকে সোজা তাঁর আপিসে গিয়ে ভর্তিপ্রক্রিয়া শেষ করা গেল। মাত্র ৭৫ টাকা বেতনে এমএ দ্বিতীয় পর্বে পড়ব। প্রবোধচন্দ্র সেন ছিলেন বাংলা বিভাগের প্রধান। বললেন তিন বছরের অনার্স শেষ করলে প্রথম পর্ব এমএ ক্লাসে পড়বার দরকার নেই কোনো। বিশ্বভারতীতে এমএ দ্বিতীয় পর্বে একটি গবেষণাপত্র লিখতে হতো তখন। সেমিনারে একটি প্রবন্ধ পাঠ, আর সেমিনারে অন্যদের পেপারের ওপর আলোচনার জন্যে ২০০ নম্বরের পরীক্ষা। ভাইভাতেও ছিল পুরো ১০০ নম্বর।

প্রবোধ সেন বললেন, তিনি আমার বাবার বন্ধু। কাজেই আমি যেন তাকে কাকাবাবু বলে ডাকি। কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আমি কী বিষয়ে গবেষণা করতে চাই, আমার কিসে ঝোঁক। ভাষাবিজ্ঞানের ফোনেটিকসে আমার আগ্রহ জানিয়েছিলাম। বিভাগের এক কর্মীকে দিয়ে সত্যেন মজুমদার স্যারের কাছে আমাকে পাঠালেন। ইনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কোনো আঞ্চলিক ভাষা জানি কি না। মা কলকাতার মেয়ে, তাঁর কাছ থেকে যে-ভাষা পেয়েছি, সে-ভাষাই মান বাংলা বলে জেনেছি। সেই ভাষাতেই লিখি, পড়ি, কথা বলি। আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে কোনো পরিচয়ই নেই একেবারে। সত্যেনবাবু আলাওলের ওপর কাজ করেছেন জানতাম। বললেন, আলাওলের পদ্মাবতী নিয়ে কাজ করবে? ঢাকাতে সৈয়দ আলী আহসান স্যার তখন পদ্মাবতী সম্পাদনা করেছেন, সে আমাদের পাঠ্যই ছিল। আলাওল নিয়ে কত কী কাজ! অবস্থা বুঝে উনি আমাকে ফেরত পাঠালেন।

কাকাবাবু জানতে চাইলেন আর কী বিষয় তোমার ভালো লাগে? ছন্দ ভালো লাগে শুনে বললেন, ও নিয়ে তো কাজ করবার কিছু বাকি নেই, তুমি বরং সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত নিয়ে কাজ করো। পছন্দ হলো না, বললাম, নজরুল? বললেন, এ বাংলায় নজরুলের আসন এখনো তত পোক্ত হয়নি, ও নিয়ে কাজ করলে নানা মতের ঝামেলায় পড়বে। তুমি বরং লাইব্রেরি থেকে সত্যেন দত্তের বেণু ও বীণা আর কুহু ও কেকা নিয়ে যাও, পড়ে দেখে আমাকে জানাও সত্যেন দত্ত নিয়ে লিখবে কি না। অগত্যা নিশ্বাস ফেলে বেণু ও বীণা নিয়ে হোস্টেলে ফিরলাম।

প্রথম কবিতাটিতে ছন্দের কোনো নাচুনি নেই। প্রশান্ত সুর মনকে টানল-মন্দ নয় তো!

বাতাসে যে ব্যথা যেতেছিল ভেসে, ভেসে,
যে বেদনা ছিল বনের বুকেরি মাঝে,
লুকানো যা’ ছিল অগাধ অতল দেশে,
তারে ভাষা দিতে বেণু সে ফুকারি বাজে!

কতদিন হল বেজেছে ব্যাকুল বেণু,
মানসের ছলে বেজেছে বিভোল বীণা,
তারি মূর্চ্ছনা–তারি সুর রেণু রেণু,–
আকাশে বাতাসে ফিরিছে আলয়হীনা!

পরান আমার শুনেছে সে মধু বাণী,
ধরিবারে তাই চাহে সে তাহারে গানে,
হে মানসী দেবী! হে মোর রাগিণী-রাণী!
সে কি ফুটিবে না ‘বেণু ও বীণা’র তানে?

রাবীন্দ্রিক বটে। সেই জন্যেই হয়তো আমার আকর্ষণ! তখন বুঝিনি–বাস্তবিক এই রাগিণী-রাণীই সত্যেন্দ্রনাথের মানসী সত্যি সত্যি। পরে মোহিতলালের আলোচনা পড়ে ধরতে পেরেছিলাম, সত্যেন্দ্রনাথের সাধনার ধন ছিলেন মহাসরস্বতী–সুরের দেবী। কবিতায় সুরের বিচিত্র চলন ছিল, কেবল নাচুনে ছন্দের পাগলামি ছিল না বাস্তবিক। সমালোচকেরা ওই এক ছাপ মেরে দিয়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথের ললাটে। মানুষের স্বাধীন বিচার তাতে পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল।

পরদিন গেলাম কাকাবাবুর কাছে। উনি মনে মনে খুশি হলেন। ওঁর নিজের ঘরের একধারে জানালার পাশের টেবিলটি আমার পড়বার জন্যে নির্ধারণ করলেন। সত্যেন্দ্রনাথের কবিতার নানা বৈশিষ্ট্য আলোচনা করলেন। সত্যেন্দ্রনাথের একেক বইয়ের জন্যে একেকটি ছোট খাতা নিয়ে কবিতার বিষয়ওয়ারি শিরোনাম অনুযায়ী নিজের মতামত লিখে রাখতে লাগলাম।

কাকাবাবু বললেন, প্রবাসী, ভারতী, বিচিত্রা, সবুজপত্র এসব পত্রিকায় সত্যেন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর প্রকাশিত লেখাগুলো পড়ে নিলে সত্যেন্দ্রনাথকে নানাভাবে দেখতে পাওয়া যাবে। এ ছাড়া পুরোনো পত্রিকা ঘেঁটে সত্যেন্দ্রনাথের রচনার তালিকা করে দেখতে হবে কোন কোন কবিতা তাঁর গ্রন্থে সংকলিত হয়নি। এতে বিশাল এক তালিকা হলো সত্যেন্দ্রনাথের অপ্রকাশিত রচনার।

আমাদের আমলে (১৯৫৪-৫৫ সাল) শিক্ষার্থীরা পাঠাগারে ঢুকে বইয়ের র‍্যাক থেকে দরকারি বই খুঁজে নিয়ে ভেতরেই যেখানে সেখানে বসে পড়াশোনা করত। সেইভাবেই পড়া আর নোট করা শুরু হলো আমার।

.

০২.

ভোরে ঘুম ভাঙলে নানা রকম ঘণ্টা শুনতে পাই। কোনোটা কিচেন থেকে চা খেতে যাবার ডাক, কোনোটা লাইব্রেরির বারান্দায় বৈতালিক গায়কদের গানের প্রস্তুতি। বৈতালিক অর্থ বন্দনা বা স্তুতির গান। এই উপাসনা দিয়েই দিনের কাজ শুরু হতো। ওদিকে ঘণ্টার শব্দে বিভিন্ন ভবন থেকে লাইন বেঁধে বৈতালিকের জমায়েত শুরু হয়ে গেছে। চা খেতাম না, বৈতালিকেও যেতাম না। বরং একতলা ঘরের জানালায় পাঠভবনের মেয়েদের উঁকিঝুঁকি, গুনগুন গান শুরু হতো। স্কুলের ওপরদিককার শিক্ষার্থীরা আমাদের একতলা ব্লকের বাথরুম ব্যবহার করত। যাবার পথে মিনুদিকে সম্ভাষণ না করলে চলত না ওদের। সেভেন, এইট, নাইন, টেন-এর গানপাগল মেয়ে এরা। সেভেনের শ্যামলী খাস্তগীর, এইটের রমা, নাইনের ইন্দ্রাণী, মহাশ্বেতা আরও সব কারা। নতুন গান শিখলে শোনাত, গাইতে হতো মিনুদিকেও। প্রিয় গানের ফরমাশ হতো তো! আমি এমএ দ্বিতীয় পর্বের ছাত্রী। ওদের সঙ্গে কলকল করে গল্প চলত। কোথায় ভেসে যেত বয়সের বাধা। গ্রীষ্মের ছুটিতে বাড়ি ফেরার জন্য কী মন খারাপ! ছুটির পরে একবার নিউমার্কেট থেকে কাঁচের ছোট্ট ছোট্ট অনেক কুকুর নিয়ে গেলাম ওদের জন্যে। সে যে কী খুশি সবাই! ক্লাসে গিয়ে সবগুলো কুকুরকে খোয়াইয়ের ওপর নানাভাবে সাজাত। সাদা-কালো, বাদামি সাদা কত রকমের রং সেগুলোর। সাদা দুরকম–পানির মতো স্বচ্ছ আর দুধসাদা। কাঁচের বলতে পোরসেলিনের। আসলে শ্রীভবনের দিনগুলো বড় মধুর ছিল।

কলেজ অর্থাৎ আইএ, বিএ ক্লাসের মেয়েদের সঙ্গেও ছিল বেজায় ভাব। বিকেলে আমার সঙ্গে কে বেড়াতে যাবে, তাই নিয়ে শুরু হয়ে যেত মান-অভিমান। পরিস্থিতি বেশ খারাপ হয়ে পড়ত মাঝেমধ্যে। কবজা করবার প্রতিযোগিতা মূলের ভালোবাসাকে আচ্ছন্ন করে ফেলত। তখন পারুলডাঙা, লালর্বাধ, খোয়াইয়ের পথে গান গাইতে গাইতে ঘুরতে কী যে ভালো লাগত। কেকাই নিষ্ঠুরভাবে অন্যদের কাছ থেকে আমাকে ছিনিয়ে নিয়ে বেড়াতে যেত। গান গাইতেও ছিল অক্লান্ত। আমাকেও থামতে দিত না একদম। গানের ঝেকে দূরে দূরে চলে গিয়ে সন্ধের আগে শ্রীভবনে ফিরবার জন্যে হাইফাই করে বড় রাস্তা ধরে প্রায় দৌড় লাগিয়ে আসতে হতো।

সন্ধ্যায় হোস্টেলের প্রাঙ্গণে পাঠভবন (স্কুল) থেকে শিক্ষাভবন (তখনকার কলেজ) পর্যন্ত ছাত্রীদের লাইন করে দাঁড়াতে হতো। বড় সুধাদি সবার নাম ডেকে উপস্থিতি নিশ্চিত করতেন। কেকা কলেজে বিএ পড়ে বলে সমাবেশে তাকে হাজির থাকতে হতো। সে জন্যেই দ্রুত ফিরে আসবার চেষ্টা দুজনের। বিদ্যাভবন অর্থাৎ অনার্স, এমএ ক্লাসের শিক্ষার্থীদের সমাবেশে যোগ দিতে হতো না।

সমাবেশ শেষে ঘরে ফিরতাম একটা-দুটো শিউলিগাছের পাশ দিয়ে। তখনই জেনেছিলাম সন্ধ্যাবেলার আধো-ফোঁটা শিউলি ফুলের গন্ধই সবচেয়ে সুন্দর।

আমাদের একতলা দুটো ব্লকের মাঝখানে ছিল একটা সোনাঝুরিগাছ। সোনারঙের ঝুরি পড়ে তলাটা ছেয়ে থাকত। একটু দূরের ল্যাম্পপোস্টের আলোতে ব্লকের গায়ে সোনাঝুরির বাঁকা বাঁকা পাতার ছায়া দুলত। বারান্দার আলো নিভিয়ে রেখে ওই আলোছায়া দেখতাম মুগ্ধ হয়ে। সত্যি, দিনগুলি বেশ ছিল।

.

০৩.

একবার রাজা নাটকে সুদর্শনার ভূমিকায় অভিনয় করবার জন্যে কেকার ডাক পড়ল। অনার্স ক্লাসে রাজা আমাদের পাঠ্য ছিল। আমার প্রিয় নাটক। সুদর্শনার বেশ লম্বা আর কাব্যধর্মী কিছু সংলাপ তো আমার মুখস্থই ছিল। জানতে পেরে কেকা আমার কাছে এগুলো শুনতে চায়। আমিও পরমানন্দে বলি। মহড়ায় শান্তিদেব ঘোষ নিজে হাজির থেকে সংলাপগুলো প্রন্ট করে কেকাদের সাহায্য করতেন। রোজ কেকার সঙ্গে মহড়াতে যাই, মেতে আছি। একদিন শান্তিদা কী কাজে কলকাতা গেলেন। কেকার তো পার্ট মুখস্থ হয়নি। প্রম্পট করা না হলে কী করে মহড়া দেবে। বললাম, আমি নাহয় একটু একটু বলে দেব, চলো। কেকার পার্ট প্রম্পট করলাম আমি। ভুলুদারা (শান্তিদেব ঘোষের ভাই শুভময় ঘোষ) আমার বিষয়ে কৌতূহলী হলেন। নাটক করেছি কি না জিজ্ঞেস করলেন। ঢাকা বেতারে আমি নাটক করতাম। ভুলুদারা শুনেছেন, মনে করতে পারলেন। রাজা নাটক হয়ে গেলে আর এক নাটকের তাল তুললেন ভুলুদা-অমিতদারা। একটা বৈঠক ডাকলেন ওঁরা। বিকেলে নাটকের মহড়ায় যাই। প্রতিদিন সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান দেখি, এইসব করে সত্যেন দত্ত নিয়ে থিসিসটা শুরু করা হচ্ছে না। নিজেকে শাসন করে ভুলুদাদের বৈঠকে গরহাজির থাকলাম। শুনলাম ওঁরা আমার কথা জিজ্ঞেস করেছেন। কেকা বলেছে, থিসিস লিখবার কাজ শুরু করব বলে বৈঠকে যাইনি। এবার শেষরক্ষা হবে। ক্ষান্তমণির চরিত্রের জন্যে আমার কথা ভেবেছিলেন ওঁরা। নাটক করবার ইচ্ছেও মনের মধ্যে টগবগ করছে আমার। শেষ পর্যন্ত কী করে ঠিকই জুটে গেলাম ক্ষান্তমণির চরিত্র অভিনয়ে।

ক্ষান্তমণির স্বামী চন্দ্রকান্ত হয়েছিলেন সংস্কৃতের অধ্যাপক বিশ্বনাথদা। সব চরিত্রের কথা মনে নেই এখন। কেকা হয়েছিল কমল, শিখা গুহ ইন্দু, গদাই ভুলুদা, গদাইয়ের বাবা অমিতদা (অমিতাভ চৌধুরী)…এই সব। গোটা দুই গানও গেয়েছিলাম আড়াল থেকে।

নাটকের পরে একদিন মাংস রান্না করে খাইয়েছিলাম অমিতদাদের। কী ঘোড়ার ডিম বেঁধেছিলাম কে জানে। সবাই মহাখুশি। অমিতদা বললেন ডিংস রান্না করতে পারো? সে আবার কী? পরে শুনেছিলাম, ডিমের চারপাশে মাংসের কিমা জড়িয়ে ভেজে ও-রান্না করতে হয়। ডিংস নাম অমিতদার দেওয়া। মজা করবার ওস্তাদ তো! ছেলের নাম ‘অনির্বাণ। ওকে নিয়ে ছড়া লিখেছিলেন–

হাতে লৈয়া ধনুর্বাণ
আইলেন বাবু অনির্বাণ।

নাটকের পর থেকে আমাকে দেখলেই বলতেন, ‘এই যে ক্ষান্তমণি। এসো, এসো, মঙ্গল হোক’। কলকাতায় রিজেন্ট পার্কের কাছে কোথায় থাকতেন, বাসায় গেছি। নেমন্তন্ন করে খাইয়েছেন। খুব স্নেহ করতেন আমাকে। ওঁর ফ্ল্যাটের কাছেই থাকতেন অমিতা ঠাকুর। তাঁর কাছেও গিয়েছি রবীন্দ্রসংগীতের ভাবসম্পদলিখবার সময়ে কিছু প্রশ্ন নিয়ে। গান শুনতে চেয়েছিলেন, অমিতা সেন খুকুর রেকর্ডে গাওয়া ‘যে ছিল আমার স্বপনচারিণী’ শুনিয়েছি। অমিতা সেনের স্টাইলটা আয়ত্ত করতে পেরেছি, বলেছিলেন খুশি হয়ে।

সুভাষ চৌধুরীর সঙ্গে অমিয়া ঠাকুরের বাসায়ও গিয়েছিলাম। উনি গান শুনিয়েছিলেন অসাধারণ। সুভাষের এসরাজের সঙ্গে গান গাইতে উনি পছন্দ করতেন। আর একটা বৈঠকে ওঁর গান শুনবার সৌভাগ্য হয়েছিল। আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল, শুধাইল না কেহ গেয়েছিলেন। ব্যাকুলতা কাকে বলে সর্বান্তঃকরণে উপলব্ধি করেছিলাম সুরের নিপুণ গভীর মোচড়ে। এমন গান জীবনে আর শুনব না।

কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘স্বপন যদি ভাঙিলে’ শুনেছিলাম একবার পৌষমেলার সময়ে ছাতিমতলার উপাসনায়। ওঁর গান ছিল প্রথমেই। আমি ওখানে পৌঁছে তখনো বসতে পারিনি, ‘ভাঙিলে’র টানের সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখ দিয়ে দরদর করে জল ঝরে পড়ল! কী লাবণ্যময় যে সে-উচ্চারণ!

আর একবার এমএ ক্লাসে পড়বার সময়ে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছিলাম। শান্তিদেব ঘোষ মঞ্চ থেকে গান ধরলেন ‘ওহে জীবনবল্লভ, ওহে সাধনদুর্লভ’। কাজ করব কী, আকুল কান্নায় ভেঙে পড়লাম। এ গান শেষ করে আবার ধরলেন ‘ওই আসনতলের মাটির ‘পরে লুটিয়ে রব’। কীর্তনের আবেদনে চারপাশ ভুলে গেলাম।

এই সব অভিজ্ঞতা জীবনের অমূল্য সম্পদ।

নীলিমা সেন অর্থাৎ বাচ্চুদির গানের ভক্ত ছিলাম আমি বরাবর। রেকর্ডে তার গাওয়া ‘তোমার শেষের গানের রেশ নিয়ে কানে চলে এসেছি’ কিংবা আমার দোসর যে জন ওগো তারে কে জানে এসব গান গাইতাম তো বটেই, শান্তিনিকেতনে গিয়ে তাঁকে দেখে সমগ্র মানুষটিকে বেজায় ভালো লেগে গেল। নিরিবিলি শান্ত স্বভাব, ঘরোয়া সহজভাব। কাকাবাবু একদিন তাঁকে বললেন, বাচ্চু, একটি গান শোনাও। চৌকির প্রান্তে কোনোমতে ঝুলে বসেছিলেন। বললাম, বাচ্চুদি, ঠিক হয়ে বসে নিন–গান গাইতে সুবিধা হবে। কাকাবাবু আমাকে বললেন, ও গান গেয়েই ঠিক সুবিধা করে নেবে। আশ্চর্য! ওই রকম ঝুলে বসেই উনি গান ধরলেন, ‘অসীম ধন তো আছে তোমার, তাহে সাধ না মেটে। কণায় কণায় বেঁটে’ বলবার সময়ে প্রতিটি কণার কথা স্পষ্ট ফুটে উঠল। অবলীলাক্রমে গেয়ে গেলেন গানখানি। কারুকাজ আর তানে ভরা গানটি গেয়ে গেলেন বিনা আয়াসে।

আদর্শের ব্যাপারে আবার ছিলেন একেবারে অনড়। একবার মায়া সেনের বিলেতপ্রবাসী ছোট ভাই বিলেতে একদল শিল্পী নিয়ে যাবার আয়োজন করেছিলেন। সেই সময়ে বাচ্চুদির ওপরে দায়িত্ব পড়েছিল ‘শ্যামা’-র গান রেকর্ডিং করে নিয়ে যাবার। মায়াদির আরও এক ছোট ভাই ছিলেন কলকাতায়। রেকর্ডিংয়ের সময়ে তিনি গানের গ্যাপ মিউজিক কম্পোজ করতে শুরু করলেন। তাঁর নির্বাচিত যন্ত্রগুলোও গানের সঙ্গে মানানসই মনে হচ্ছিল না বাচ্চুদির। বাচ্চুদির আপত্তিতে ছেলেটি ভ্রূক্ষেপ করছিল না। বাচ্চুদি রেকর্ডিংয়ের দায়িত্ব ছেড়ে সরে গেলেন নীরবে। পরের পয়সায় বিলেত ঘুরে আসার সুযোগ বাচুদির কাছে তুচ্ছ হলো। প্রয়োজনে এ রকম ক্ষেত্রে তাকে খুব দৃঢ় হতে দেখেছি।

শ্রীভবন হোস্টেলে একদিন কলাভবনের একতলার ঘর থেকে ‘রহি রহি আনন্দতরঙ্গ জাগে’ গানটি ভেসে আসতে লাগল। ভজনের মতো ভক্তির ভাবে ভরা সে-গান কে গাইছেন, জানবার জন্যে খেপে উঠলাম। ছুটলাম সেদিকে। চোরের মতো চুপি চুপি জানালার পর্দা সরিয়ে দেখি দুহাতে মন্দিরা নিয়ে বাজাতে বাজাতে মধ্যবয়সী এক মহিলা বিভোর হয়ে গাইছেন ছন্দে ছন্দে। কলাভবনের শিক্ষিকা উমাদির ঘর ওটা। উনি অরবিন্দ নিলয়-এর ভক্তিমতী সদস্য। পরে খবর নিয়ে জানলাম, দক্ষিণ ভারতীয় রবীন্দ্রশিষ্য শ্রীমতী সাবিত্রী গোবিন্দ গান গেয়ে উপাসনা করছিলেন। ওঁর পাশে চোখ বুজে হাত জোড় করে বসে যোগ দিয়েছিলেন উমাদি। ওই গান আর কারও গলায় কখনো ভালো লাগবে না আমার।

উমাদিকে চিনতাম ক্ষমাদির সূত্রে। ক্ষমা সেন নাম ছিল বিয়ের আগে। রোজ বেলা এগারোটা-বারোটা নাগাদ ক্লাসের কাজ শেষ করে সাইকেল চালিয়ে উমাদির কাছে আসতেন তিনি। শান্তিনিকেতনে মেয়েদের সাইকেল চালানোর দৃশ্য ছিল দেখবার মতো। ছেলেদের চেয়ে আলাদাভাবে তৈরি সাইকেল। এতে মেয়েদের শাড়ি পরে চালাবার বিশেষ ব্যবস্থা ছিল। রোদ আড়াল করবার জন্যে বিশেষ ধরনের টোকা মাথায় দিয়ে সাইকেল চালিয়ে আসতেন ক্ষমাদি। ছন্দোময় ছিল তাঁর চালানোর ভঙ্গি।

নরম স্বভাবের ক্ষমাদি ভারি মিষ্টি করে গান গাইতেন। চেহারা চালচলন মিলিয়ে ভালোবাসবার মতন মানুষ। আমি তাঁর ছিমছাম করে সাজানো বাসাতেও যেতাম। পাঠভবনের শিক্ষার্থীদের ছবি আঁকা আর সেলাই করার ক্লাস নিতেন। গল্প শুনেছি ক্লাসের ছেলেমেয়েরা কথা না শুনে বেয়াড়াপনা করলে উনি নাকি ভ্যাঁ করে কেঁদে দিতেন। বড্ড ভালো মানুষ ছিলেন কিনা!

ক্ষমাদির বিয়ে হলো লাইব্রেরির কর্মী চৈতিদার সঙ্গে। উনিও আরেক ভালো মানুষ। আশ্রমে কেউ কোথাও গান গাইবে জানতে পেলেই এসরাজটি সঙ্গে নিয়ে উনি হাজির সংগত করতে। আমার গানের সঙ্গেও বাজিয়েছিলেন মনে আছে। বিয়ের পরে পূর্বপল্লীতে ভারি সুন্দর একটা বাড়ি করেছিলেন ওঁরা। তেমনি সুন্দর ঘরদুয়ারের সাজসজ্জা। কলাভবনের ছাত্রীর বাড়ি বলে কথা!

ক্ষিতীশ রায়ের মেয়ে মিষ্টুনি খোলা গলায় গান গেয়ে গেয়ে পথ চলত শান্তিনিকেতনে। পথঘাট গানের সুরে ভরে উঠত। চমৎকার লাগত। পরে এক ইংরেজকে বিয়ে করে শান্তিনিকেতন ছেড়ে গিয়েছিল সে। এরাই আসলে আশ্রমজীবনের সম্পদ। আকাশে বাতাসে গান ছড়িয়ে না গেলে রবীন্দ্রনাথের আশ্রমের আর কী মানে থাকল!

মিষ্টুনির ছোট বোন শর্মিলার (টুকু)-ও সহজে গান গেয়ে উঠবার ওই ধরনটা ছিল। অবশ্য আমি শান্তিনিকেতন ছেড়ে আসবার পরে ও বড় হয়ে উঠেছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে শান্তিনিকেতনের গানের দলে ঢাকায় এলে তাকে দেখেছি। তখন রীতিমতো ভালো গাইয়ে সে। এ-ও অবশ্য এক ফরাসি নাগরিককে বিয়ে করে ফ্রান্সে চলে গিয়েছিল। এখন শর্মিলা রায়কে পোমো নামে সবাই চেনে। গান নিয়ে যথেষ্ট পড়ালেখা করে সুনাম করেছে সে।

গানের প্রসঙ্গে প্রথম দিকেই সুভাষ চৌধুরীর নাম করেছি এসরাজ-বাজিয়ে হিসেবে। আমি যখন শান্তিনিকেতনে এমএ পড়ছি, তখন সুভাষ সংগীতভবনের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। ফিসফাস শুনতাম চতুর্থ বর্ষের সুপূর্ণা ঠাকুরের সঙ্গে নাকি তার ভাব। সুপূর্ণা ছিল ডে স্কলার। অর্থাৎ হোস্টেলে নয়, বাসায় থেকে পড়ত সে। বাসাতে ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে গান শিখত সে। চমৎকার গাইত বাস্তবিক। তার ‘আজি দক্ষিণ পবনে’ গান কানে বাজে এখনো। ওদিকে সুভাষের গান শুনিনি কখোনো। এক বছরের এমএ ক্লাসের পড়া শেষ করে ফিরে আসবার আগে একদিন সুভাষ আমাকে কো-অপে চা খেতে ডাকল। কো-অপ হচ্ছে কো-অপারেটিভ সোসাইটির দোকান। চা খাবার ব্যবস্থাও ছিল পাশে খড়ের গোল ছাউনির নিচে। চায়ের পরে সুভাষ বলল–মিনুদি, আজ আমি আপনাকে গান শোনাব। অবাক হলাম। তবে একটা ফাঁকিবাজি গান ধরল, ‘বঁধু, তোমায় করব রাজা তরুতলে’। এইটুকুনি গান, শুরু না হতেই শেষ হয়ে যায়। সেই প্রথম আর সেই শেষ তার গান শুনি। পাতলা গলা, পুরুষকণ্ঠের গাম্ভীর্য নেই কোনো। পরে রবীন্দ্রসংগীত বিশেষজ্ঞ হয়ে সে এসরাজ বাজিয়ে, গান শিখিয়েই জীবন পার করল। সুভাষের মতো দক্ষ শিক্ষক কলকাতাতে আর ছিল না। বলতে বলতে গানের কথায় ভুলে লেখাপড়া বা অন্যসব কথা ফেলে কোথায় চলে গেছি। ফিরে যাই আবার।

.

০৪.

আমার এমএ পড়বার সময়ে শান্তিনিকেতনের শিক্ষা আর বিদ্যাভবনে ‘সাহিত্যিকা’ নামে একটি আসরের আয়োজন হতো। নামটা নাকি রবীন্দ্রনাথেরই দেওয়া। শিক্ষার্থীদের লেখা কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদি পাঠের ব্যবস্থা ছিল। একদিন লাইব্রেরির রিডিং রুমে বসে কী একটা পড়ছিলাম। বেঁটেখাটো একটি ছেলে এসে ধরল আপনি নিশ্চয়ই কবিতা লেখেন, এবারকার সাহিত্যিকায় একটা কবিতা পড়ুন। ওরে বাপরে! এমন নাছোড়বান্দা! কবিতা লিখেছি অল্প বয়সে। অনার্স ক্লাসে কবিতার ওপরে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলাম। বলে, তাহলে সেই লেখাটিই পড়ুন! অগত্যা হার মানতে হলো। বিষয় ছিল কবিতার ভাব আর আঙ্গিকের পরস্পর সম্পর্ক। ভাষা আর ছন্দ পালটে দিলে নিহিত ব্যঞ্জনা চোট খেয়ে যায়। ক্লাসে সৈয়দ আলী আহসান স্যার করে দেখিয়েছিলেন মাইকেল মধুসূদনের ‘একাকিনী শোকাকুলা অশোককাননে/ কাঁদেন রাঘববাঞ্ছ’র অংশবিশেষ। যেমন, ‘অশোককাননে কাঁদিছেন একাকিনী/ শোকাকুল-প্রাণা রাঘববাঞ্ছা যিনি’। নেশা ধরে গেল। স্বরবৃত্তে বদলে ফেললাম, ‘অশোকবনে কাঁদছে দুখে রাঘব-বধূ সীতা/ একলা বসে আঁধারে সে, আকুল শোকান্বিতা’। রবীন্দ্রনাথের সেই জেদ করে ‘যুদ্ধ যখন সাঙ্গ হল বীরবাহু বীর যবে/ বিপুল বীর্য দেখিয়ে হঠাৎ গেলেন মৃত্যুপুরে’ লিখবার মতন। তাই কি মধুসূদনের ‘সম্মুখ সমরে পড়ি/ বীর-চূড়ামণি বীরবাহু/ চলি যবে গেলা যমপুরে’র সেই দৃপ্ত ভাব আসে! আলী আহসান সাহেব যেমন, তাঁর অনুসরণে আমিও তেমনি দেখাতে চেষ্টা করছিলাম–ও হয় না।

সভায় আলোচক ছিলেন কবি-অধ্যাপক অশোকবিজয় রাহা। তিনি উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন। সভাপতি ছিলেন প্রবোধচন্দ্র সেন। তিনি আরও কী কী কারণে পরিবর্তন হলে ব্যঞ্জনা মার খেয়ে যেতে পারে সংযতভাবে বুঝিয়ে বললেন। অশোকদার অকুণ্ঠ অনর্গল প্রশংসার পরে কাকাবাবুর ওই লাগাম টেনে ধরাতে মন খারাপ হয়ে গেল আমার। অভিমানে চোখ ফেটে জল আসে আরকি! পরদিন লেখাটি কোথাও ছাপবার জন্যে চাইলেন কাকাবাবু। দিতে বেশ দেরি করেছিলাম, মনে আছে। কাকাবাবু অবশ্য লেখাটা হারিয়ে ফেলে অনেক বেশি দেরি করেছিলেন ছাপাতে। তত দিনে আমি চলে এসেছি শান্তিনিকেতন থেকে। অনেক পরে কলকাতার ধ্রুপদী পত্রিকায় কাকাবাবুর পরিচিতিসুদ্ধ ছাপা হয়েছিল।

.

০৫.

আমি এমএ পড়বার সময়ে শ্রীভবন চালাতেন দুজন সুধাদি। কালো সুধাদি আর সাদা সুধাদি। ছাত্রীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতেন, বা বেশি রকম বকাবকি করতেন, তা-ও নয়। স্কুলের ছোট ক্লাসের ওরা ছিল সাদা সুধাদির অধীন। বাকি স্কুলের ওপর দিকের ক্লাস, শিক্ষাভবন, সংগীতভবন, কলাভবন, বিদ্যাভবনের কর্তৃত্ব কালো সুধাদির। স্কুলের মেয়েদের সঙ্গেই বেশি ভাব ছিল বলে সাদা সুধাদির দিকে খুব নজর রাখতাম। উনি বেশ জমিদারিভাবে এদিকে-ওদিকে দুটো পেঁপেগাছ, কুমড়োর মাচা ইত্যাদি করতেন। হোস্টেল ভবনে ঢুকবার গলির কোণে একটা কোটা রাখা থাকত। দেখলাম গাছের পেঁপেতে রং ধরছে। নষ্টামি বুদ্ধি গজাল। সুধাদির সামনেই তার কোটাখানা নিয়ে। গিয়ে গোটা দুই আধপাকা পেঁপে পেড়ে নিলাম। উনি বললেন না কিছু, তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলেন শুধু। আর একদিন মাঝারি সাইজের একটা মিষ্টিকুমড়ো ছিঁড়ে নেওয়া হলো। উনি হয়তো ভাবতেন, মেয়েটার লোভ তো কম নয়! ছোটদের নিয়ে কাঁচাপাকা ওই পেঁপে খেয়ে কী এমন লোভের নিবৃত্তি হলো! শুভ্রা ছিল ডে-স্কলার। অধ্যাপকের মেয়ে, বাড়িতে থেকে পড়ে। কুমড়োটা বাড়িতে নিয়ে গেল–ছোঁকা বেঁধে আনবে, সবাই তা-ই খাবে। কী যে প্রাপ্তি হয়েছিল। ওসব করে কে জানে। ছোটদের নেতৃত্ব দিতে হলে কিছু কিছু সরদারি করতে হয় অবশ্য। নেতাগিরি ভোগ করা গেল অন্তত। সুধাদি নিশ্চয়ই বিষনজরে দেখতেন আমাকে। সেটাই স্বাভাবিক।

এমএ ক্লাসের সেমিনারে প্রমথ চৌধুরীর ওপরে লিখতে হয়েছিল আমাকে। ভুলুদারা সব খবর রাখতেন। আমাকে বললেন ঋতুপত্র নামে পত্রিকা বার করছেন, তাতে ছাপবার জন্যে দিতে হবে লেখাটা। প্রমথ চৌধুরী নিয়ে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবেন্দ্ৰসিংহ রায় বই লিখেছিলেন। সেটিই আমার প্রধান অবলম্বন ছিল। পত্রিকাতে আমার প্রবন্ধ পড়ে সবাই খুব প্রশংসা করলেন। বলা হলো, লেখাতে কোনো মেয়েলি ছাপ নেই। অর্থাৎ প্রকাশভঙ্গি বলিষ্ঠ। জীবেন্দ্ৰসিংহ রায়ও লেখাটি পছন্দ করেছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের আমন্ত্রণে ঢাকায় এসে তিনি আমার খোঁজ করেছিলেন। বিভাগে আমাকে কোনো মূল্য দেওয়া হতো না। অধ্যাপক জীবেন্দ্ৰসিংহ রায় উপাচার্যকে বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিনারে আমাকে আমন্ত্রণ করিয়েছিলেন। আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, অমন লেখা লিখে আমি কেন নিজেকে এমন লুকিয়ে রাখলাম। ওই প্রশ্নের জবাব আমি দেব কী বলে! বিভাগীয় প্রধান যে বিরূপ ছিলেন আমার প্রতি! থাক সেসব বাজে কথা।

উনিশ শ চুয়ান্ন সালের শেষ দিকে বিশ্বভারতীর শিক্ষাভবন এক্সকারশনে যাচ্ছিল। পৌষমেলার পরে বিভিন্ন ভবন শিক্ষাসফরে বার হতো। বিদ্যাভবনে কোনো নড়াচড়া ছিল না। কেকাদের সঙ্গে আমিও যাব বলে অধ্যক্ষ সুধীরদার কাছে গিয়ে বায়না ধরলাম। উনিও রাজি হলেন। কেবল বললেন, মন্দির-টন্দিরে যাব তো, তোমাকে একটা অন্য নাম দিতে হবে। ঠিক আছে, তোমার নাম হোক ‘সংযুক্তা’। মুসলমান নামটা আড়াল করা হলো আরকি।

জুতো খুলে মন্দিরে ঢুকতে হতো। আমি অবশ্য বেশি ভেতরে প্রতিমার কাছ পর্যন্ত যেতাম না। সেই সময়ে রেজিস্ট্রার রঞ্জিতদার স্ত্রী কল্যাণীদির জেদ দেখেছিলাম। উনি মন্দিরে যেতেন না, জুতো খুলতে হবে বলে। বাইরে পায়চারি করতেন। তাঁর সঙ্গে এইটুকুন মেয়ে প্রমিতা গিয়েছিল। এত দিনে কবেই সে প্রমিতা মল্লিক নামে বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী হয়েছে।

শিক্ষাভবনের দলে ভুলুদা, বিশ্বজিহ্বারাও গিয়েছিলেন। মজা হতো গানের সময়ে। বাসে উঠে ওঁরা যে-গান ধরতেন আমিও তা গাইতাম। আসলে অনেক রবীন্দ্রসংগীত জানা ছিল আমার। এক গান শেষ না হতেই অন্য গান ধরতেন ওঁরা। সে গান আমিও জানি কি না দেখতেন। আমাকে ঠেকানো কঠিন ছিল। হার মানতেন ওঁরা অবাক হয়ে। শান্তিনিকেতনের বাইরে থেকেও অত গান জানে কেউ ভেবে অবাক হতেন। ‘ও আমার চাঁদের আলো’, ‘ও চাঁদ, তোমায় দোলা দেবে কে’–একের পর এক গান। ভুবনেশ্বরের উদয়গিরি, খণ্ডগিরি, পরে পুরীর জগন্নাথ মন্দির, কোনারক, চিলকা হ্রদ–কত যে ঘুরেছিলাম আমরা। আর গান গেয়েছিলাম। গানের পর গান গাইবার এই অভ্যাসটা আমার ছিল বরাবর। ভুবনেশ্বরে মুখ্যমন্ত্রীর বাসায় নেমন্তন্ন খেয়েছিলাম। ওঁর স্ত্রী মালতীদি শান্তিনিকেতনের ছাত্রী ছিলেন। এককালে। কটক রেডিও স্টেশনের ডিরেক্টর ছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী, ভুবনেশ্বরে মুখ্যমন্ত্রীর বাসায় তাঁকে দেখেছিলাম। কটকে গিয়ে চা-পর্বে নিমন্ত্রণ পেয়েছিলাম তার কাছ থেকে সদলে। পূর্ববঙ্গের মেয়ে বলে আমার কাছে পল্লিগীতি শুনতে চেয়েছিলেন মুজতবা আলী। ‘সখী, তারে বল ক্যানে বাঁশরি বাজায়’ গেয়েছিলাম বলে ভুলুদাদের সে কী রাগ! শান্তিনিকেতনের মেয়ে পল্লিগীতি গাইবে কেন?

ভুলুদা বিশ্বজিৎদাদের ওই এক রকমের গোঁড়ামি ছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিষয় নিয়ে লেখা গীতি-আলেখ্য ‘রূপান্তরের গান’ হচ্ছিল একবার কলাভবনের এলাকায় খোলামঞ্চে। আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো থেকে নিয়ে অনেক গণসংগীত ছিল তাতে। এসব কী গান হচ্ছে শান্তিনিকেতনে–মহা আপত্তি তাঁদের। ভুলুদা অবশ্য সেই সময়ে ছিলেন না। অথচ লাইব্রেরির বারান্দায় নির্মলেন্দু চৌধুরীর গানও তো হয়েছে। তিনি তো পল্লিগীতিই গেয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে। রবীন্দ্রনাথের আমলে সাহেবদের অদ্ভুত উচ্চারণে রবীন্দ্রসংগীতও তো হয়েছে আশ্রমে। তার বেলা? এসব আপত্তির কোনো মানে বুঝি না। বুঝি, রবীন্দ্রনাথের অন্তত ও রকমের অদ্ভুত গোঁড়ামি ছিল না।

হ্যাঁ, খানিক আগে সেমিনারের কথা লিখছিলাম। আমাদের ক্লাসে জীবন চৌধুরী নামে বর্ধমানের একটি ছেলে ছিল। আমরা পাঁচজন ছিলাম–আমি, মলয়া গঙ্গোপাধ্যায়, আদিত্য, পৃথ্বীন্দ্র আর জীবন। আমরা সেমিনারের আগে নিজেরা এক জায়গায় বসে প্রবন্ধটি শুনে সে-বিষয়ে সবাই আলোচনা করতাম। মজার ব্যাপার এই, কাকাবাবুর সামনে আসল সেমিনারের সময়ে জীবন চৌধুরী একাই সবার মতামতগুলো বলে ফেলত! আমরা এ-ওর মুখ দেখতাম। কাকাবাবু তো আর অতশত জানতেন না–সেমিনারে জীবনই সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়ে গেল ওই করে।

শান্তিনিকেতনের উত্তরায়ণ ছিল আমার পরম আকর্ষণের জায়গা। চুয়ান্ন-পঞ্চান্ন সালে ওখানে ঢুকবার ব্যাপারে তত কড়াকড়ি ছিল না। ফাইল হাতে নিয়ে যখন-তখন ঢুকে পড়তাম। প্রথম দিন ‘উদয়ন’ ভবনের বৈঠকখানায় ঢুকে রোমাঞ্চ হলো। বিশেষ ধরনের হাতলওয়ালা একটা চেয়ারে ‘শূন্য চৌকি’ কবিতাটি ফ্রেমে বাঁধাই করে রাখা ছিল। নিচে বসে বার দুই কবিতাখানি পড়লাম। শীতলপাটিতে ঢাকা দেয়ালের ঘরে সব আসবাবই কেমন অন্য ধরনের। মুগ্ধ বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে রইলাম। ভিতর দিকের বাগানে সরু সরু বাঁধানো পথ দিয়ে ঘুরে এক ছোট জলাশয়ে ঢুকে পড়লাম। জলের মাঝখানে খানিকটা জায়গা বাঁধানো। দু-একটি চেয়ার রাখা আছে, টেবিলও আছে একটা। সবই মেঝের সঙ্গে আটকানো। জলে মস্ত বড় দুটি লাল শাপলা ফুটে রয়েছে। অত বড় শাপলা দেখিনি আগে। পাথরের স্ল্যাব লাগানো পথ বেয়ে বেরিয়ে এসে বাগানের পথে খানিক পায়চারি করলাম। একেকটা ঝোঁপ থেকে মিষ্টি ফুলগন্ধ এসে বিবশ করে দেয়। উদয়ন ভবন থেকে যে পথে বেরিয়ে এসেছি, সেটি গুহাঘরের দুয়ার। গুহাঘরটি রথিঠাকুরের ছোট্ট দোতলা। দোতলায় চামড়ার আর কাঠের কাজের অসম্পূর্ণ কিছু নমুনা। রথিঠাকুর নাকি ওসব কাজে খুব দক্ষ ছিলেন।

বাগানে একটি অশোক ফুলের গাছ লাল হয়ে ছিল। সদর ঘাটের ইডেন স্কুলের বাগানে অশোক ফুল ফুটে থাকতে দেখেছি। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের বিষয়ে একটি লেখার বেশ খানিকটা অশোকগাছের নিচের বেঞ্চিতে বসে লিখেছিলাম। মাঝারি লম্বা একটা গাছে নতুন এক ফুল দেখছিলাম। বাচ্চাদের দুধের বোতল পরিষ্কার করবার ব্রাশের মতন দেখতে। নামও অস্ট্রেলিয়ান বটুল ব্রাশ। রংটা লাল। উত্তরায়ণে আরও একটি নতুন ফুল দেখেছিলাম। নীল রঙের। রবীন্দ্রনাথের দেওয়া নাম ‘নীলমণিলতা’। সোনাঝুরি নামটাও রবীন্দ্রনাথের দেওয়া। শান্তিনিকেতনেই প্রথম দেখি। উদয়নবাড়ির পুব দিকে আরও কটা বাড়ি রয়েছে। মাটির বাড়িটির নাম শ্যামলী’। বাইরের দেয়ালে কিছু ভাস্কর্য ছিল কালো আলকাতরার প্রলেপ দেওয়া। তার পাশে আর একটি ছোট একতলা, ‘পুনশ্চ’। এর পরে ছোট্ট দোতলা ‘কোনারক’। ওই সব ছোট ছোট ঘরে রবীন্দ্রনাথকে ধরত কেমন করে, অবাক লাগে। শেষ বাড়িটার শোবার জায়গা ছিল। সিমেন্ট করা। আর মেঝেতে একটা উঁচু ধাপ তো আবার নিচু। সমতল নয়। অমন কেন বুঝতাম না।

টেনিস কোর্টের লাগোয়া বড় বড় গোলাপের এক বাগান ছিল। বিশেষ যত্ন ছিল না বাগানটির সেই সময়ে। প্রাঙ্গণে দুটো ময়ূর ঘুরে বেড়াত। সারসও ছিল। গ্যারেজে রাখা ছিল একটা কালো রঙের মোটরগাড়ি। এখনকার উত্তরায়ণ বাড়ির প্রাঙ্গণে অনেকগুলো ইউক্যালিপটাস গাছ আছে। পরের দিকে ওখানে ঢুকতে ব্যাগ জমা রেখে যেতে হতো গেটের কাছে একটা ঘরে। আরও পরে রবীন্দ্রভবনে পড়াশোনা করতে যেতে আর একটা ঘরে নির্দিষ্ট বক্সে যার যার এটা-ওটা তালা দিয়ে রেখে যেতে হতো। ভবনের জিনিসের সুরক্ষার জন্যে ওসব বন্দোবস্ত। এত কিছুর পরেও তো নোবেল পুরস্কারটি চুরি হয়ে গেল!

আশ্রমে ঢুকবার পুব দিকের ফটকের কাছেই শান্তিনিকেতনের মন্দির। ফটকে লেখা আছে আশ্রম এলাকায় কোনো প্রতিমা-পূজা হবে না। এখানকার উপাসনা চলে ব্রাহ্মমতে। উপনিষদ থেকে নির্বাচিত কিছু মন্ত্র পাঠ আর গান দিয়ে এই উপাসনা। কিছু মন্ত্র পাঠ হয় সমস্বরে। মন্দিরে জমায়েত হবার জন্যে মন্দিরের ঘণ্টা থেকে চারটি চারটি ঘণ্টা পড়ে। আচার্য নিজে সেই ঘণ্টা বাজান। বাইরে তিন দিকের সিঁড়ির কাছে জুতো রেখে বারান্দা আর সিঁড়িতে বসেন সবাই। সপ্তাহে ছদিন ভোরের বৈতালিকের মতো একেক বুধবারে একেক ভবনের ওপরে গানের দায়িত্ব পড়ে। বুধবার শান্তিনিকেতনের ছুটির দিন।

মন্দির থেকে পুব দিকে রতনপল্লির রাস্তা ধরে চলে গেলে ওখানকার শ্মশান। ওখানে থাকতে একবার শ্রীভবনের শোভনার মৃত্যু উপলক্ষে শ্মশানে যাওয়া হয়েছিল। হোস্টেলের সুপারিনটেনডেন্ট সুধাদি আমাকে শ্মশানে যাওয়া থেকে নিবৃত্ত করেছিলেন। মুসলমানের শ্মশানযাত্রায় বোধ হয় বাধা আছে।

শ্মশানের পথে গেটের দুপাশে বড় বড় দুটি বাঁকুড়ার মাটির ঘোড়া লাগানো বাড়ি ছিল শুভ্রাংশুদার। যে শুভ্রাংশুদা মজা করবার জন্যে ল্যাংড়া আমকে প্রতিবন্ধী আম বলতেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে রেকর্ডিং করবার জন্যে ছাত্র ওয়াদুদ আর বোন ফাহমিদাকে নিয়ে একবার শান্তিনিকেতন গিয়েছিলাম। ফাহমিদার ট্রেনার হবেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, আমার বাচ্ছদি, আর ওয়াদুদের সুভাষ চৌধুরী। সেই সময়টায় সুভাষ শান্তিনিকেতনে-করা নিজের বাড়িতে বাস করছিল। দুপুরবেলা মোহরদির বাসায় খেলাম আমরা। সন্ধের পরে শুভ্রাংশুদার বাসায় গেলাম দেখা করতে। উনি রাতে ওঁর বাড়িতেই খেয়ে নিতে বললেন। বললাম, রাতে থাকবার জন্যে ইন্টারন্যাশনাল গেস্টহাউসে ফোন করে বলে দিন। উনি গল্প করছেন তো করছেন–ফোনটোন করেন না। অস্থির হয়ে উঠেছি রাতের ব্যবস্থাটা অনিশ্চিত হয়ে রয়েছে বলে। শেষ পর্যন্ত বললেন, কী দরকার অত হাঙ্গামা করবার–এখানে শুয়ে পড়লেই হয়! যেন সেই উটের গল্প–মুখ বাড়িয়ে খবর নিচ্ছিলাম, তারপর খাওয়াদাওয়া, শেষে শোয়া! এরপরে পুরো বাড়ির দখল নিয়ে ওঁদের বার করে দিলেই হয়! এমন মজলিশি লোক, গল্প পেলেই হলো! মজা করবার জন্যে ছেলেটাকে বাড়িতে ডাকতেন ‘গদাই’ বলে!

.

০৬.

এমএ ক্লাসে পড়বার সময়ে শ্রীভবনে থাকতাম। তারপরও বারবার গিয়েছি তো কাজ নিয়ে। নানা সময়ে নানা জায়গায় থেকেছি। একবার গোয়েঙ্কা হোস্টেলে। বেশির ভাগ রতনকুঠির স্কলার্স ব্লকে। আবার একবার ছিলাম পঞ্চবটীতে। পঞ্চবটীতে ছিল দু-কামরার। ফ্ল্যাটমতো আবাস। ভেতরের উঠোনে জলের কল, সেই কল থেকে খাবার জল সংগ্রহ করতে হতো। উঠোনে বিশাল একটা ফলসাগাছ ছিল। ফল ঝরে পড়ে থাকত নিচে। সুতপা ভট্টাচার্য খুব ভালোবাসত খেতে। মাঝেমধ্যে কুড়িয়ে রাখতাম ওর জন্যে।

রতনকুঠির স্কলার্স ব্লকেই ভালো দিন কেটেছিল। একটি ঘর, একটি কলঘর। যতীন কোম্পানি থেকে করানো ছোট একটা হারমোনিয়াম সঙ্গে নিয়ে যেতাম। ব্যবহারে ব্যবহারে ফাহমিদার যন্ত্রটা আমার নিজেরই হয়ে গিয়েছিল প্রায়। সকালে গলা সাধতাম। বিকেল আর সন্ধ্যায় কানাই সামন্ত মশাই, নিশি, কিশু, এ রকম–আরও অনেকে আসত, গান হতো। সারা দিন লেখালেখির কাজ করে বিকেল থেকে গানে গানে সময় কাটাতাম। কানাই সামন্ত মশাই প্রতিদিন চারটে বাজলেই রবীন্দ্রভবনের কাজকর্ম গুটিয়ে স্কলার্স ব্লক অভিমুখে হাঁটা দিতেন। প্রথমে থিন অ্যারারুট বিস্কুটসহযোগে এক কাপ চা খেয়ে চেয়ারে গুছিয়ে বসে চোখ বুজতেন। এবার গান শুনবেন। দিনের পর দিন কত যে গান শুনিয়েছি তাঁকে। তিনি আবার রবীন্দ্রনাথের কবিতার বই নিয়ে নির্জন মাঠে গিয়ে সুর দিয়ে গাইতেন চিৎকার করে। সামনাসামনি গান শুনবার এমন সুযোগ নাকি পাননি কখনো। বাধ্য হয়ে নিজেই গান গাইতেন!

আমার গবেষণাপত্রের কাজ নিয়েও প্রায়ই আলাপ করতেন কানাই সামন্ত মশাই। তার কাছ থেকে কত-যে দিকনির্দেশনা পেয়েছি। রবীন্দ্র-কবিতা তার মাথার ভাঁজে ভাঁজে সাজানো থাকত। রবীন্দ্রনাথের ‘মূল্যশোধ’ কবিতার হদিস পেয়েছিলাম তারই কাছ থেকে। এই কবিতাতেই কেবল মৃণালিনী দেবীর প্রতি রবীন্দ্রনাথের নিবিড় কৃতজ্ঞতা আর প্রীতির বোধ সুন্দর প্রকাশ পেয়েছে। কাব্যালোচনার কত বই যে কানাইবাবুর সংগ্রহে ছিল! দরকার বুঝে আমাকে নিয়মিত সরবরাহ করতেন। ওঁর বাড়ির উঁই লতার ফুল রুমালে করে এনে দিতেন আমাকে কোনো কোনো সকালে। রবীন্দ্রভবনের পাশ দিয়ে হেঁটে আসবার সময়ে গাছের নিচে পড়ে থাকা হিমঝুরি ফুলও আনতেন মাঝেমধ্যে কুড়িয়ে।

একবার আমি প্রসেনজিৎ সিংহদের বাড়িতে একটি কামরা নিয়েছিলাম। তখন কানাই সামন্ত মশাইয়ের কুয়ার ধারে খুব দোলনচাঁপা ফুটত। সে-ফুলও পেয়েছি উপহার।

রবীন্দ্র পাণ্ডুলিপি দেখতে হলে রবীন্দ্রভবনে ওঁরই শরণ নিতে হতো। আরও একজন ছিলেন সেখানে-শোভনলাল গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি আবার কারও মুখের দিকে চোখ তুলে তাকাতেন না। কিন্তু পাণ্ডুলিপির সব রকম খবর এঁরও মগজে সাজানো থাকত। এঁদের অবর্তমানে গবেষকেরা সব এখন কার কাছ থেকে সাহায্য পাচ্ছেন কে জানে!

স্কলার্স ব্লকে থাকতে সন্ধ্যার আগে রতনকুঠির বাগান থেকে আধো-ফোঁটা চামেলি-বেলির কুঁড়ি তুলে আনতাম। পাশের ঘরের সুতপাকে কিছু দিয়ে নিজের বালিশের পাশে রাখতাম বাকিটা। সুগন্ধে ঘর ভরে যেত।

কোনো দিন সন্ধের পরে কোনো লেখা তৈরি হয়ে গেলে রাত ৯টার দিকে ভোলা গলায় গান গাইতে গাইতে শ্যামবাটির পথে রওনা হতাম। ক্ষিতীশ রায় মশাইয়ের বাড়ির একটু পরেই থাকত শান্তা আর অসিত ভট্টাচার্য। ওঁদের বাড়ি গিয়ে লেখাটা পড়ে শুনিয়ে শান্তি হতো। এই দুই বন্ধু লেখার পর্যালোচনা করে মতামত দিলে নিজের ভাবনা সমৃদ্ধ করে নিতে পারতাম। আরও একজন ছিলেন, সত্যেন রায় মশাই। পূর্বপল্লিতে রেললাইনের ধারে ওঁর বাড়িতেও যেতাম লেখা শোনাতে। বড় উপকার হতে এঁদের লেখা শুনিয়ে। স্কলার্স ব্লকে নিজের ঘরেও লেখা পাঠের বৈঠক করেছি। একবার আসরে দানিয়েল চুক এসেছিলেন। রতনকুঠিতে ছিলেন তো সেই সময়ে! বৈঠকগুলো ভারি মন ভরিয়ে দিত।

পশ্চিম দিকের স্কলার্স ব্লকের সামনে ছিল গোলাপের বাগান। নানা রঙের বড় বড় গোলাপ ফুটত। কোনো কোনোটার অপূর্ব সুগন্ধ ছিল। গোলাপ ছিড়বার দিকে মন ছিল না আমাদের। অত বড় বড় ফুল। বাগানে সুন্দর। এই বাগানের দক্ষিণ প্রান্তে দুটি গাছে হ্যাঁমিলটনিয়া ফুটত। মিষ্টি গন্ধে বসন্তের শেষ দিনগুলি ভরে রাখত। অন্যদিকে বাগানটায় নাগকেশরের মতো দেখতে একটি ফুল ফুটত। মালি নাম বলেছিল আঙ্কোবা। নাকি দক্ষিণ ভারতের ফুল।

আশ্রম এলাকায় মন্দিরের পেছন দিকে খানিক দূরে তিন পাহাড়’ নামে একটা জায়গা ছিল। শুনেছি পুকুর খুঁড়বার চেষ্টায় মাটি খুঁড়ে ঢিবি করে রাখা হয়েছিল। তিনটি ঢিবি হয়েছিল বলে তিন পাহাড় নাম। তলায় জলের কোনো চিহ্ন দেখা যায়নি। বিশাল গর্ত হয়ে আছে। শান্তিনিকেতনে অনেক সাপ ছিল শুনেছি। তিন পাহাড়ের দিকটাতে নাকি খুব সাপ ছিল। ভয়ে ওদিকটায় যেতাম না। মীরা দেবীর বাড়ি ‘মালঞ্চ’তে খুব সাপ দেখা যায় শুনেছি জামিলের কাছে। জামিল চৌধুরী ওই বাড়িতে ছিলেন কিছুদিন।

.

০৭.

শান্তিনিকেতনে পড়তে গিয়ে প্রথম পর্ব এমএ ক্লাসের খনা মেয়েটিকে খুব ভালো লেগেছিল। মৃদু স্বভাব, শান্ত। অনুচ্চ স্বরে গান গাইত, ‘ক্ষত যত ক্ষতি যত মিছে হতে মিছে,/ নিমেষের কুশাঙ্কুর পড়ে রবে নীচে’। ওর স্বভাবের মতোই ঠান্ডা গানটি। পরে বাচ্চুদির গলাতে এ গান শুনে মনে হয়েছিল, বাচ্চুদির স্বভাবটাও ধরা রয়েছে এ গানে। খনা শান্তিনিকেতনে পড়া শেষ করেনি, চলে গিয়েছিল।

এমএ প্রথম পর্বের ছাত্রীদের সঙ্গে আমিও সংগীতভবনে পার্টটাইম ক্লাস করতাম। সকলেই যে গান গাইতে পারত, তা নয়। সেই জন্যেই কি না জানি না, শান্তিদেব ঘোষ আমাদের ক্লাস নিতে আগ্রহী ছিলেন না। ক্লাসের সময়টাতে প্রতি সপ্তাহে তিনি সাইকেলখানা নিয়ে ডাকঘরে রওনা হতেন নিজের চিঠিগুলো নিয়ে আসতে। তক্কে তক্কে থেকে সাইকেল থেকে তাকে নামিয়ে এনে ক্লাস করতাম কখনো কখনো।

শান্তিদা মাথা নিচু করে এসরাজ বাজাতে বাজাতে গান গাইতেন, আমরা সুর মেলাতাম। কোনো কোনো দিন কোলের কাছে রাখা স্বরলিপির বই দেখে সুর তুলে মাথা উঁচু করে গাইতে গেলেই সুর বদলে যেত। বড় বিব্রত হবার অবস্থা। কিচ্ছু করবার ছিল না। ফলে কিছুই শেখা হতো না সে ক্লাসে।

বিদ্যাভবনে ভর্তি হয়ে সংগীতভবনের অধ্যক্ষ শৈলজারঞ্জন মজুমদারের কাছে দরখাস্ত লিখে নিয়ে গিয়েছিলাম যে, ঢাকা বেতারে আমি নিয়মিত রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে আসছি অনেক দিন ধরে। কাজেই আমাকে সংগীতভবনের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গান শিখবার সুযোগ দেওয়া হোক। শৈলজাদা গম্ভীর হয়ে বললেন বিদ্যাভবনের অধ্যক্ষের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে আসতে হবে। সরাসরি ডক্টর প্রবোধ বাগচির ঘরে চলে গিয়ে দরবার করলাম। উনি প্রসন্নমুখে চিঠির ওপরে সুপারিশ করে দিলেন। এবার শৈলজাদা গম্ভীরতর হয়ে বললেন, সংগীতভবনের মন্দিরের ক্লাসে এসে বসতে পারো। গেলাম ক্লাসে। ওপরের ক্লাসের ছাত্রীরাই রয়েছে দেখলাম। তাদের আচরণে ক্লাসে নিজেকে বাঞ্ছিত বলে বোধ হলো না। এসরাজ হাতে মাটিতে বসে গান শেখাচ্ছেন গুরু, হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী, নিত্য নিঠুর দ্বন্দ্ব। এসরাজের ছড় দিয়ে পায়ের ওপরে তালে তালে আঘাত করে ছন্দ বুঝিয়ে দিচ্ছেন তিনি। ভারি চমৎকার লাগল। এ গানে ছন্দচ্যুত হব না কখনো আর। সে তো ভালো কথা কিন্তু সকলের বাঁকা দৃষ্টির আঘাত সইল না। পরদিন থেকে ক্লাসে অনুপস্থিত থাকতে লাগলাম। আমার আগ্রহের ওপর ঠান্ডা জল ঢালা হয়ে গেল। রবীন্দ্রভবনের অধ্যক্ষদের ভেতরেও দেখেছি গবেষকদের উৎসাহে জল ঢেলে দেওয়ার প্রবণতা প্রবল! ওদিকে আমার তত্ত্বাবধায়ক কাকাবাবুর কাছে পড়বার আগ্রহে যে কত উৎসাহ পেয়েছি! আদর্শ গুরু এঁরাই!

পিএইচডি করবার সময়ে উপেনদার (উপেন্দ্রকুমার দাস) স্নেহাদরও আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। খাবার সময় পার হয়ে যাচ্ছে, আমি লেখা শুনিয়ে চলেছি। উপেনদা সাগ্রহে শুনেছেন, আলোচনা করেছেন। থামিয়ে দেননি আমাকে।

পিএইচডি করবার সময়ে প্রবন্ধ পড়াবার এক অভিজ্ঞতার কথা বলি এখানে। রবীন্দ্রসংগীতের ভাবসম্পদের উপক্রমণিকা হিসেবে বিন্যাস করা প্রথম প্রবন্ধটি লিখে শান্তিদেব ঘোষকে পড়তে দিয়ে এসেছিলাম। পরদিন লেখার বিষয়ে খোঁজ নিতে শান্তিদার বাড়িতে গেলে হাসি বউদি বললেন, যাও, বকা খাবে। যাহোক তা হোক যেতে তো আমাকে হবেই। গেলাম। বললেন, এসব কী লিখেছ বোগাস? বললাম, অরুণ ভট্টাচার্য ‘রবীন্দ্রসংগীতের সুরসুষমা ও স্বরসঙ্গতি’ নামে যে চমৎকার বই লিখেছেন, তা থেকে সাহায্য পেয়েছি। ক্রুদ্ধ হয়ে আবার বললেন, ‘অরুণ ভট্টাচার্য! যতসব বোগাস! গোলাপকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে তার সৌন্দর্য বুঝতে হবে!’ কাঁচুমাচু হয়ে কথা না বাড়িয়ে লেখাটি হস্তগত করে ওঁর বাসা থেকে বেরিয়ে এলাম।

মনের মধ্যে ছড়ার একটি লাইন ঘুরতে লাগল, ‘হতাশ আমি হতাশ। সুতপা ভট্টাচার্যের ক্লাস ফোরের মেয়ে কুর্চি মা-বাবার ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে এক ছড়া লিখেছিল–

আটক আমি আটক
দেখতে পাবনা আমি যাত্রা কিংবা নাটক!…

ওই ছন্দটাই ঘুরছে মাথায়। ওকে চিঠি লিখলাম, শান্তিদা আমার লেখা দেখে যা-তা বলেছেন। তাই ‘হতাশ আমি হতাশ!’ কিন্তু ওর সঙ্গে মিল দেবার জন্যে বুক ফেটে যাবার ফটফটাস্’ শব্দ ছাড়া আর কিছু মনে আসছে না! তুই ছড়াটা লিখে পাঠা তো! বেশ কদিন সাড়াশব্দ নেই। শেষে সুতপা এক গদ্য কবিতা লিখে পাঠাল আমাকে। নাঃ, ওতে শান্তি হলো না। তখন নিজেই কলম তুলে নিয়ে লিখলাম–

হতাশ, আমি হতাশ!
শান্তিদাদা ফাটিয়ে দিলেন বুকখানা ফটফটাস!
পেডেণ্ডো ঠাউরিয়ে তাকে গিয়েছিলাম কাছে
শেষে দেখি ফিঙের মতন আছেন কাকের পাছে?
গানের বিষয় যত মুনিই লিখুন নাকো যাহা,
শান্তিদাদার মতে বেবাক্ বোগাস্ এখন তাহা!!

লিখে শান্তি হলো আমার। শঙ্খ ঘোষও ছড়াটাতে খুব মজা পেয়েছিলেন।

.

০৮.

ইন্ডোলজির ডক্টর আশিস সেন সত্যেনদার দিদির ছেলে। সত্যেন সেন (আমাদের সত্যেনদা) শান্তিনিকেতনে দিদিদের বাসায় থাকতেন অনেক সময়ে। আমি এমএ পড়বার সময়ে ওখানে ছিলেন না বলে দুঃখ করতেন। তারপরের লেখাপড়ার সময়ে আমি সত্যেনদাকে পেয়েছি। বাড়তি পেয়েছি সেজদিকে। আমার জন্যে কেমন অপেক্ষা করে যে থাকতেন। দুভাইবোনই। আশিস সেনও খুশি হতেন, অবিরল গান শোনাতাম বলে।

ক্ষিতিমোহন সেন ছিলেন সত্যেনদার কাকা। তাঁর কন্যা অমিতা সেনের বাড়িতে সত্যেনদার নেমন্তন্ন হলে আমারও নিমন্ত্রণ থাকত। সত্যেনদার চলনদার হবে কে? গল্পগুজব, খাওয়াদাওয়ার পরে ক্ষীণদৃষ্টি মানুষকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আমার ছুটি। ভাইকে সেজদির কাছে বুঝিয়ে দিয়ে রতনকুঠিতে ফিরতাম গান গাইতে গাইতে আশ্রম জাগিয়ে। দিনের বেলাতে সত্যেনদা দিব্যি চলে আসতেন স্কলার্স ব্লকে গানটান শুনে খুশি হয়ে ফিরে যেতেন। গান শোনার সূত্রেই কানাই সামন্ত মশাইয়ের সঙ্গেও ভাব জমে গিয়েছিল তাঁর। তারপরে সকালের দিকে একা একা অ্যান্ড্রজ পল্লিতে ওঁর বাসাতেও চলে যেতেন। সত্যেনদার ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাসগুলো পড়ে কানাই সামন্ত তো মহামুগ্ধ হয়ে ওঁর মহা ভক্ত হয়ে গেলেন।

ওই সময়ে সত্যেনদা আর এক কাণ্ড করতেন। হাঁটতে হাঁটতে যে-কোনো বাড়িতে ঢুকে পড়তেন। বাড়ির লোকে ‘কী চাই’ প্রশ্ন করলে বলতেন, ‘কিছু চাই না। আলাপ করব।’ ঢাকার কামরুননেসা স্কুলের এককালের প্রধান শিক্ষক সুজাতা মিত্র তখন থাকতেন চারুপল্লিতে। তার সঙ্গেও ভাব হয়ে গিয়েছিল। ভাব হয়েছিল অশীতিপর মনোরঞ্জনবাবুর সঙ্গেও। ইনি আমার গলায় ‘চরণ ধ্বনি শুনি তব, নাথ’ গান শুনতে চাইতেন আর শুনতে শুনতে কাঁদতেন। এঁর সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল বিনয়ভবনের সন্ধ্যা মৈত্রের বাসাতে। গান ভালোবাসতেন আর আমাকে দোলনচাঁপা ফুল পাঠিয়ে দিতেন। ছুটির দিনে মাঝে মাঝে কানাই সামন্ত মশাইয়ের সঙ্গে আমার ঘরে চলে আসতেন গান শুনতে।

পথে-ঘাটে গান গাইবার অভ্যাসের সূত্রেই সন্ধ্যা মৈত্রের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। সে-ও এক গানের পাগল। অ্যান্ড্রজ পল্লি থেকে রতনকুঠি গিয়ে ক্যাসেট আর রেকর্ডার দিয়ে আসত সে আমাকে। যখনই গান গাইবে, রেকর্ড করে রাখবে–এই তার কথা। সকালে গলা সাধবার পরে কিছু গান তো গাইতাম, সেগুলো রেকর্ড করে রাখা শুরু হলো। অনেক ক্যাসেটে গান ভরে গিয়েছিল। আবার একই গান একাধিকবার রেকর্ড করা হয়েছিল। আর বারবার এক গান শুনতে সন্ধ্যার কোনো ক্লান্তি ছিল না।

উনিশ শ পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আমরা খুব ভয় পেয়েছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি টিকতে পারবে কি না সন্দেহ হয়েছিল। দেশ থেকে সরে গিয়ে শান্তিনিকেতনে নিরিবিলি গবেষণার কাজ করাই শ্রেয় মনে হলো। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র গুছিয়ে শান্তিনিকেতনে গেলাম।

মণি সিংহের আত্মীয় সুরজিৎ সিংহ তখন বিশ্বভারতীর উপাচার্য। প্রবোধচন্দ্র সেন কাকাবাবুর কাছে সব কথা খোলামেলা বলেছিলাম। উনিও উপাচার্যকে সব খুলে বললেন। একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে রবীন্দ্রসংগীতের ভাবসম্পদ নিয়ে যে-গবেষণা শুরু করেছিলাম, সে কাজই শুরু করতে চাইলাম। প্রশ্ন উঠল–রেজিস্ট্রেশন কোথায়? পঞ্চান্ন-ছাপ্পান্ন সালে এমএ পরীক্ষার সময়ে যে রেজিস্ট্রেশন নম্বর ছিল, সেটাই যে আমার জন্যে কার্যকর, সে কথা মাথায় এল না কোনো পক্ষেরই। উপাচার্য প্রশ্ন করলেন, অন্য রাষ্ট্র থেকে এসে ওখানে কাজ করব যে তার অনুমতি কোথায়? অল্প দিন আগে নাকি ওখানে সিআইএর এক গোপন ঘাঁটি আবিষ্কার হয়েছিল, কাজেই আমার সবকিছু নিয়মমাফিক হতে হবে। ফাঁপরে পড়লাম। মণি সিংহের আত্মীয়টি কড়া মনোভাব নিয়ে বসে রইলেন।

দিনের পর দিন একেকটা দরখাস্ত নিয়ে দেখা করতে যাই, ফল হয় না। শুনি বলেছেন, কে ওঁকে বলেছে যে সব ঠিক হয়ে যাবে?

শেষ পর্যন্ত ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনের মধ্যস্থতায় দিল্লির সরকার থেকে একটি দীর্ঘ টেলিগ্রাম এল। কিছুই জানা ছিল না। কেমন দুর্ব্যবহার পাই ভাবতে ভাবতে সেদিন রেজিস্ট্রার্স অফিসে গিয়েছি। ডেপুটি রেজিস্ট্রার (শিক্ষা) হেসে বললেন, আপনার হয়ে গেছে। দিল্লি থেকে নাকি নির্দেশ এসে গেছে আমার বিষয়ে। তখন আবিষ্কার হলো বিশ্বভারতীর এমএ পরীক্ষা দেবার সময়ে আমার যে রেজিস্ট্রেশন ছিল, সেটাই কার্যকর রয়েছে। কেঁদে ফেলবার অবস্থা। সত্যি সত্যি ঘরে ফিরে হাউমাউ করে কেঁদেছিলাম সেদিন।

এর মাস নয়েক পরে যেদিন আমার পিএইচডি থিসিস জমা দিতে গিয়েছি, তখন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক পীযূষবাবুর মূৰ্ছা যাবার অবস্থা। রবীন্দ্রসংগীতের ভাবসম্পদ নিয়ে আজীবন চর্চা আমার। ভাবনাচিন্তা গোছানো ছিল, কাজেই গবেষণাপত্র গুছিয়ে তুলতে সময় লাগেনি। পীযূষবাবু সেই সময়ে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের বিষয়ে যে ধারণা পেয়েছিলেন, তাতে অমন ঝটপট পিএইচডি থিসিস জমা হতে পারে ভাবতেই পারেননি। সংগীত ভবনের এক বাংলাদেশি ছাত্র মুড়ি-চিড়ে ভাজা বিক্রেতা একটি মেয়ের সঙ্গে কী এক কেলেঙ্কারিতে জড়িয়েছিল। আর, আরেক বাংলাদেশি নামী প্রফেসর-কন্যা পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অফিসের পিয়নের সঙ্গে যোগসাজশে পরীক্ষার নম্বর ঘষামজা করে বাড়িয়েছিল!

থিসিস জমা দিতে গেলে পীযূষবাবু অবাক হয়ে পিয়নকে বলেছিলেন আমাকে চা দিতে। সে-চা স্পর্শ করবার অভিরুচি হয়নি আমার। রেজিস্ট্রেশন নিয়ে পীযূষবাবুর আপিসেই তো ঝকমারি হয়েছিল! এমনই ভাগ্য আমার! পদে পদে অযথা ঠোক্কর খেতে হয়েছে সারা জীবন।

থিসিস শেষ করা নিয়ে কিছু সুখস্মৃতি আছে আমার, এবার সেগুলো বলব। দেবীপদ ভট্টাচার্য ছিলেন কাকাবাবুর ছাত্র। আমাকে গুরুবোন বলতেন তাই। একদিন ভরদুপুরে রতনকুঠিতে ফোন করলেন আমাকে। উঠেছিলেন পূর্বপল্লী গেস্টহাউসে। বললেন কী লিখছ-টিখছ, তিনটের সময়ে চলে এসো নিয়ে আমার এখানে। শুনে দেখি। যেতে হলো। একটি প্রবন্ধ শুনে বলে উঠলেন, করছ কী টাইপ। করতে দিয়ে দাও, লেখার সঙ্গে সঙ্গে টাইপটা তো হয়ে যাবে। অর্থাৎ পছন্দ হয়েছে ওঁর। বললেন ভালো করেছ ব্যাদ’-এর থেকে শুরু করো নাই। এ রকম ছিমছামই হবে লেখা। খুশি হয়ে ফিরলাম। ড্যাম গ্ল্যাড বলে যাকে।

আরেক ঘটনা। সত্যেন রায় মশাইকে বলেছিলাম, আমি ছয় মাসের মধ্যে থিসিস লিখে ফেলব। উনি বললেন, পারবেন না। বললাম, চ্যালেঞ্জ! বললেন, ঠিক আছে, ছয় মাসে লিখতে পারলে আমি আপনাকে খাওয়াব। না পারলে আপনি আমাকে খাওয়াবেন। ওদিকে তো লিখতে লেগে গেল নয় মাস। শেষ হয়েছে শুনে উনি বললেন, নয় মাসে লেখাও যে সে কথা নয়! আমিই খাওয়াচ্ছি। আপনাকে, কবে খাবেন। আমার চেয়ে সুতপা ভট্টাচার্য বেশি খুশি। স্কলার্স ব্লকে আমার প্রতিবেশী বলে সে-ও নেমন্তন্ন পাবে। বউদির দক্ষ হাতের সুস্বাদু রান্না খেয়ে তৃপ্ত হলাম। এমন আদরের তুলনা নেই কোনো। সত্যেন রায় মশাই যে কত উৎসাহ দিতেন আমাকে! এসব মানুষের জন্যে খাটাখাটুনির কাজের অসামান্য পুরস্কার পাওয়া যায়।

সৌমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কেও বাড়ি গিয়ে বড় প্রবন্ধ শুনিয়েছি। খুশি হয়ে বুদ্ধি-পরামর্শ দিতেন। তাতে আমার চিন্তাভাবনা অনেক সমৃদ্ধ হতো। শান্তিনিকেতনের জীবনে কাজ করবার আনন্দ অনেক বেড়ে যেত জ্ঞানী-গুণীদের সাহচর্য-সহযোগিতায়।

.

০৯.

শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীর ব্যবস্থায় বাসা না পেলে নিশ্চিন্ত মনে কাজ করা কঠিন হতো। প্রসেনজিৎ সিংহ একবার, আর, আরেকবার শ্যামলী খাস্তগীর আমাকে বাড়িতে রেখে কাজ করবার সুযোগ করে দিয়েছিল। শ্যামলীর বাবা সুধীর খাস্তগীরের ‘পলাশ’ বাড়িতে দীর্ঘকাল ছিলাম একবার। দোতলাতে বাথরুমসুদ্ধ একটা বড়সড় কামরাতে দিব্যি আরামে থাকতাম। লেখার কাজে অখণ্ড মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ ছিল। আর গানের চর্চার পরিবেশও ছিল দারুণ। প্রত্যেক সন্ধ্যায় গানের মজলিশ বসত।

শ্যামলীর বাড়ির কোনাকুনি লাগোয়া একতলা বাড়িতে থাকতেন পণ্ডিত সুখময় ভট্টাচার্য। একবার শঙ্খ ঘোষ শান্তিনিকেতনে ওঁর সঙ্গে কী কাজে দেখা করতে গিয়েছিলেন। আমি সঙ্গ ধরলাম, পণ্ডিত মশাইয়ের বাড়ি যাব ওঁর সঙ্গে। কী রকম সংস্কার আছে-না-আছে জানা নেই। চললাম ভয়ে ভয়ে।

আমি শ্যামলীর বাড়ির দোতলায় থাকি শুনে সুখময় বাবু একেবারে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন। রোজ ভোরে সীমানা বেড়ার গাছ থেকে পূজার জন্যে বনটগর তুলতে গিয়ে আমার গলা সাধার সুর শোনেন উনি। সে নাকি ভারি মধুর! গানের কথা তো আর থামাতে পারেন না! কবে দেবব্রত বিশ্বাসের গাওয়া কী গান শুনেছিলেন, আবার শুনবার সাধ। ভালোমতো জানা না থাকলেও গাইতে হলো। যদিও উনি গানের সঙ্গে সঙ্গে অনর্গল স্মৃতিচারণা করে চললেন।

কথায় কথায় শুনলাম, পণ্ডিত মশাই নিজ সংসারের কাজ নিজে হাতে করেন। গরুর যাবতীয় সেবা তো বটেই, স্ত্রীর সন্তান প্রসবের সব কাজ পর্যন্ত নিজে করেছেন। সিলেটে পারিবারিক টোলের শিক্ষাদীক্ষা কেমন কঠিন ছিল, শুনেছি তখন। পাঁচ বছরের শিশুকেই সংস্কৃত ভাষায় সংস্কৃত শ্লোকের পাদপূরণ করতে হতো। অর্থাৎ পাঁচ। বছর বয়সেই সংস্কৃত ছন্দ মেলাতে হতো। তাহলে ভাষার পাঠ তো তার অনেক আগেই আয়ত্ত করতে হয়েছে!

আমি সেই সময়ে জন স্টুয়ার্ট মিলের জীবনবৃত্ত নামে একটি বই পড়ছিলাম। তাতে তিন বছর বয়সেই স্টুয়ার্ট মিল গ্রিক ভাষা আয়ত্ত করেছিলেন পড়ে চক্ষু চড়কগাছ হয়েছিল। বুঝে নিলাম সেকালের সংস্কৃত টোলের শিক্ষাও ওই রকমের আয়াসসাধ্য ছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *