০১. শব্দের শেকল

দ্য বডি – স্টিফেন কিং
অনুবাদ : উচ্ছ্বাস তৌসিফ

শরিফ উল্লাহ, রাকিব, আহমাদ, ওমর, গাফফার

–পঞ্চপাণ্ডবকে। যাদের সাথে ছেলেবেলার সোনালী দিনগুলো কাটিয়েছি। কী সব দিন যে গেছে!

অনুবাদকের কথা

বইটা আমি প্রথম পড়েছিলাম ২০১৬ সালে। ফিরে গিয়েছিলাম ফেলে আসা ছোটবেলার সেই দিনগুলোতে। যে ঘোরে চলে গিয়েছিলাম, সেটা মাথায় একরকম গেঁথে গেল। ভাবলাম, পারলে বইটা বাংলায় হাজির করব পাঠকের কাছে।

খোঁজ নিতে গিয়ে জানলাম, বইটার একটা অনুবাদ হয়েছে। যিনি করেছেন, তিনি অনুবাদক হিসেবে বেশ ভালো। খুশি হয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু সেই অনুবাদ ঘাঁটতে গিয়ে টের পেলাম, একটা ঝামেলা হয়ে গেছে। বইটা মূলত একজন মানুষের কৈশোরের শেষ সময়টুকুর স্মৃতিচারণ। নিষ্পাপ, নির্মল দিনগুলোকে পেছনে ফেলে কঠিন বাস্তবতার কষাঘাতে জর্জরিত হওয়ার সূচনাকালের গল্প। কিংয়ের ভাষায়, একটা রিচুয়াল। এর মধ্যে দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে সেই কিশোর ছেলেটি বড় হয়ে গেছে, বদলে গেছে তার দৃষ্টিভঙ্গি। মানে, গল্পটা আসলে কিশোরদের জন্যে লেখা না। এক কিশোরের ভাষ্যে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যে লেখা গল্প।

আমেরিকার এক কলেজ শিক্ষক পঞ্চম শ্রেণির বাচ্চাদের উপযোগী করে এই বইটার একটা কিশোর সংস্করণ করেছিলেন। কিন্তু সত্যি বলতে, পড়ার পরে বুঝেছি, সেটা আর কিং-এর গল্প থাকেনি। গল্পের সুর, মূলকথা–সবকিছুই পাল্টে গেছিল পুরোপুরি। আর বাংলায় অনূদিত হয়েছে ঐ সংস্করণটিই!

এটা আবিষ্কার করার পর ২০১৭ সালে আবারো বইটা অনুবাদ করার কথা ভাবলাম। শুরুও করেছিলাম, কিন্তু সাহসে কুলোয়নি। গত বছর বইমেলার আগে নাজিমভাইকে এই বইটার কথা বলেছিলাম, পড়তেও দিয়েছিলাম অনূদিত কিছু অংশ। উনি বললেন–করো। সাহসও দিলেন। তারপরও গত বছর মনে হচ্ছিল, আরেকটু সময় নেওয়া দরকার।

শেষ পর্যন্ত এই বছর বইটার অনুবাদ শেষ করলাম। যথেষ্ট সময় নিয়ে, ভালো করে কাজটা করতে চেয়েছি আমি। মূল গল্পের আবহ যথাসম্ভব সঠিকভাবে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছি। কতটুকু পেরেছি, জানি না।

মাঈন উদ্দিন শরীফ বইটার কিছু অংশ পড়ে বিভিন্ন মতামত এবং পরামর্শ দিয়ে আমাকে সাহায্য করেছে। নাজিমভাই যেভাবে কাজ এগিয়ে নিতে সাহস দিয়েছেন, সেজন্য আমি যারপরনাই কৃতজ্ঞ। আরেকজন মানুষের কথা না বললেই নয়। নাম উল্লেখ না করেই বলি, সে না হলে এত বিশাল কাজের শেষপ্রান্তে পৌঁছানো আমার পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব হতো না। তারজন্যেও রইল অনেক কৃতজ্ঞতা।

হ্যাপি রিডিং!

উচ্ছ্বাস তৌসিফ
মিরপুর, ঢাকা

অধ্যায় ১

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসগুলো কাউকে বলাটা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ। বলতে গিয়ে আপনি হঠাৎ করেই খুব লজ্জায় পড়ে যাবেন কিংবা খুব অস্বস্তি বোধ করতে থাকবেন। কারণ, শব্দের শেকল এই বোধগুলোকে ম্লান করে ফেলে। মাথার মাঝে যে ভাবনাগুলোকে অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত বলে মনে হয়েছিল, শব্দের শেকলে বাঁধা পড়তে গিয়ে চুপসে যাবে ওরা। কাজেই, বলতে গিয়ে কয়েক শব্দ বলার পরে দেখবেন, বলার মতো আর কিছু নেই। যেন সব কথা হঠাৎ করেই ফুরিয়ে গেছে। মনে হবে, বিষয়গুলো নিতান্ত সাধারণ আর দশটা ঘটনার মতোই তুচ্ছ। কিন্তু আসলেই কি তাই?

এই কথাগুলো আসলে বুকের একেবারে গহীণ কোণে লুকিয়ে থাকে। ঠিক যেখানে আপনার হৃদয়টা লুকানো আছে। এরা হচ্ছে আপনার হৃদয়ের কাছে পৌঁছনোর গোপন সূত্রের মতো। আপনার শত্রুদের কেউ যদি কোনোভাবে এসবের হদিস পেয়ে যায়, চাইলে সে সূত্র ধরে ধরে ঠিকই আপনার হৃদয়টুকু খুঁজে বের করে ফেলতে পারবে। কিংবা হয়তো এমন কিছু পেয়ে যাবে, এক কথায় যাকে বলে, বাজিমাৎ!

এই ধরনের কিছু নিয়ে কথা বলাটা এমনিতেই অসম্ভব কঠিন। তার ওপর আপনি যখন বলে শেষ করবেন, মানুষ আপনার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে। আপনি কী বলতে চাইছেন, কিংবা কেনইবা এই কথাগুলো বলতে গিয়ে কান্নাগুলো বিস্ফোরিত হয়ে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছিল, সেটা তারা কিছুতেই বুঝতে চাইবে না। আমার কাছে মনে হয়, এরচেয়ে খারাপ আর কিছু আসলে হয় না। কারণ, এই ব্যাপারগুলো মনের গহীণে গুমরে গুমরে ভালো একজন গল্প বলিয়ের খোঁজ করেনি। খুঁজেছে এমন কাউকে, যে মন দিয়ে শুনবে। শুনে অন্তত বুঝতে পারবে।

অনেকদিন আগের কথা। ১৯৬০ সাল হবে। আমার বয়স তখন বারো, কিংবা বলা যায়, তেরো চলছে। সে সময় জীবনে প্রথমবারের মতো একজন মৃত মানুষকে দেখেছিলাম। কিন্তু মাঝে মাঝে মনে হয়, এই তো সেদিন… বিশেষ করে, যেসব রাতে দুঃস্বপ্ন দেখে আমার ঘুম ভেঙে যায়। স্বপ্নের মাঝে ওর খোলা চোখে আকাশ থেকে শিলা নেমে আসে…

অধ্যায় ২

আমরা থাকতাম ক্যাসল রক শহরে। শহরের মাঝে একটা খালি জায়গা মতোন ছিল, ওর মাঝে একটা বিশাল এলম গাছ। আমাদের ট্রি হাউজটা ছিল ওই গাছের উপরে। আজ সেখানে ভ্রাম্যমাণ এক কোম্পানির অফিস, সেই এলম গাছটাও আর নেই। ওটা আমাদের কাছে সামাজিক ক্লাবের মতো একটা কিছু ছিল, কিন্তু এর কোনো নাম ছিল না। নিয়মিত সদস্য বলতে আমরা পাঁচ-ছয়জন, আর কিছু উড়নচণ্ডী ধরনের ছেলেপেলে। এরা। কিছুদিন আসত, আবার চলেও যেত। এভাবে আসতে দেওয়ার পেছনে কারণ ছিল। আমরা সেসময় নিয়মিত কার্ড খেলতাম। সাধারণত ব্ল্যাকজ্যাক খেলতাম, আর বাজির দর ছিল পেনি, খুব বেশি হলে নিকেল। সেজন্য আমাদের এমন কিছু মানুষ দরকার পড়ত, যাদেরকে ছিবড়ে বানিয়ে শুষে নেওয়া যায়। খাঁটি বাংলায় যাকে বলে, বলির পাঁঠা। তো, এই বলি হিসেবেই এদেরকে আসতে দেওয়া হতো।

আমাদের ট্রি হাউজের দেয়ালগুলো ছিল কাঠের তৈরি। কেবিন রোডে ম্যাকি লাম্বার এন্ড বিল্ডিং সাপ্লাইয়ের অফিসের পেছনে ওরা ওদের ময়লা বা নষ্ট যেসব জিনিস ফেলে দিত, ওখান থেকে ওই তক্তাগুলো নিয়ে এসেছিলাম আমরা। অমসৃণ, জায়গায় জায়গায় কাঠের কুঁচি মাথা বের করে আছে, মাঝে মাঝেই ছোট ছোট গর্ত হয়ে গেছে–এমন অবস্থা। টয়লেট পেপার আর পেপার টাওয়েল দিয়ে মেরামত করে কাজ চালানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এদিকে ছাদটা বানানো হয়েছিল বাতিল মাল ফেলার ডাম্প থেকে সংগৃহীত টিনের পাত দিয়ে। এই ডাম্পের ম্যানেজার আবার ভয়াবহ লোক। ওর একটা কুকুর ছিল। লোকে বলত, এই কুকুর নাকি সকালের নাস্তায় ছোট ছোট বাচ্চাদের সাবাড় করে দেয়। কাজেই, পুরো কাজটা আমাদেরকে, যাকে বলে, খুব চোখ-কান খোলা রেখে করতে হয়েছিল। সেদিন ওখানে একটা কাঁচের দরজাও পেয়ে গিয়েছিলাম আমরা। ট্রি হাউজে সেটা লাগানোও হয়েছিল। আপাতত মাছিদের হুটহাট আসা যাওয়া ঠেকাতে পারলেও, ওটার অবস্থা খুব একটা সুবিধের ছিল না। একেবারে জরাজীর্ণ যাকে বলে। দিনের যেকোনো সময় ওটা দিয়ে বাইরে তাকালেই মনে হতো সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। সূর্যটা এখনো কোন রকমে কষ্টে-সৃষ্টে ঝুলে আছে, একটু পরেই টুপ করে ডুবে যাবে।

এসব টুকটাক কিছু সমস্যা ছাড়া ট্রি হাউজটা আমাদের জন্য বেশ কাজের জায়গা ছিল। কার্ড খেলা হোক কিংবা মেয়েদের ছবিওয়ালা বই ঘাঁটাঘাঁটি করা, এমনকি আয়েশ করে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ার জন্যেও এর চেয়ে আদর্শ জায়গা আর ছিল না।

আধ ডজনের মতো কিনারা ভাঙা ছাইদান ছিল আমাদের। ছাইদানের নিচে বড় করে লেখা ছিল ক্যামেলস। এছাড়াও সুন্দরি মেয়েদের ছবি লাগানো ছিল দেয়াল জুড়ে, ছিল বিশ-ত্রিশটা তাসের প্যাকেট (টেডির চাচা ক্যাসল রক স্টেশনারি দোকান চালাতেন। টেডি ওনার কাছ থেকেই এসব নিয়ে এসেছিল। ওর চাচা নাকি একদিন ওকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আমরা কী ধরনের কার্ড খেলি। উত্তরে সে বলেছিল, আমরা ক্রিবেজ টুর্নামেন্টের আয়োজন করি। ওর চাচার নাকি মনে হয়েছে, ঠিকই আছে!), প্লাস্টিকের এক প্যাকেট পোকার চিপস আর একগাদা পুরাতন মাস্টার ডিটেক্টিভ মার্ডার ম্যাগাজিন। আর কোনো কাজ না থাকলে আমরা এই ম্যাগাজিন নিয়ে পড়তাম। ফ্লোরের নিচে ১২ বাই ১০ ইঞ্চির একটা গোপন খুপরি বানিয়েছিলাম আমরা। হঠাৎ আমাদের কারো বাবা যখন আমার ছেলে আর আমি হচ্ছি পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো বন্ধু–ভাব নিয়ে ট্রি হাউজে চলে আসতেন, আমাদের সব সিগারেটের প্যাকেট আর ম্যাগাজিনগুলো ওর মাঝেই লুকিয়ে রাখা হতো। বৃষ্টির সময় ট্রি হাউজের ভেতরে আটকা পড়ে গেলে মনে হতো, বুঝি কোনো জ্যামাইকান ডামের ভেতরে আটকা পড়ে গেছি! তবে, ওই গ্রীষ্মে কোনো বৃষ্টি হয়নি।

সেপ্টেম্বর মাস। মাথার উপরে কাঠফাটা রোদ। ঘাস শুকিয়ে একেবারে বাদামি হয়ে গেছে। পত্রিকার ভাষায়, ১৯০৭ সালের পরে এত শুষ্ক এবং তীব্র গরম আর কখনো দেখা যায়নি। এমনকি কারো বাগানে তেমন কোনো ফলমূল বা সবজিও হয়নি সেবার। ধুলি পড়া বোতলে বোতলজাত খাদ্য তখনও ক্যাসল রকের ঘরে ঘরে পড়ে আছে, এমন অবস্থা। ড্যানডেলিওন ওয়াইন পান করা ছাড়া সেই গ্রীষ্মে কারোই তেমন কিছু করার ছিল না।

দিনটা ছিল শুক্রবার। আমি, টেডি আর ক্রিস সকাল সকাল ক্লাবে চলে এসেছি। কার্ড খেলতে খেলতে নিজেদের মধ্যে নানারকম কথাবার্তা হচ্ছিল। ছুটি প্রায় শেষ, কয়েকদিন পরেই স্কুল খুলে দেবে–এ নিয়ে সবাই বেশ বিরক্ত। একজন আরেকজনের কাছে এ নিয়ে কয়েক দফা অভিযোগও করে ফেলেছি। দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ানো সেলসম্যান আর ফ্রেঞ্চদেরকে নিয়ে একশ বার শোনা পুরনো কৌতুক নিয়ে হেসে কুটি কুটি অবস্থা। এরমাঝে একটা কৌতুক ছিল এরকম: আপনি কীভাবে বুঝবেন যে কোনো ফ্রেঞ্চ আপনার বাসার পেছনের উঠোনে গিয়েছিল? যখন দেখবেন আপনার ময়লার ঝুড়িটা একেবারে খালি আর বাসার পেছনের কুকুরটা অন্তঃসত্ত্বা! এসব কৌতুক শুনে টেডি খুব আহত হওয়ার ভান করার চেষ্টা করত। কিন্তু খুব একটা সুবিধা করতে পারত না। কারণ, কোনো কৌতুক শুনলে আমাদেরকে সেটা না বলে সে শান্তি পেত না। শুধু ফ্রেঞ্চদের জায়গায় পোলাকদের নাম বসিয়ে দিত আরকি।

এলম গাছটা ছায়া ভালই দিত, কিন্তু আমরা ততক্ষনে শার্ট খুলে রেখে দিয়েছি যাতে ঘামে ভিজে চুপসে না যায়। সবাই মিলে থ্রি-পেনি-স্ক্যাট নামের একটা কার্ডগেম খেলছিলাম। ইতিহাসের সবচেয়ে ফালতু কার্ড গেম বলা যায় এটাকে, কিন্তু এই গরমে এরচেয়ে জটিল কিছু নিয়ে ভাবার মতো অবস্থা ছিল না আমাদের। আগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত আমাদের একটা বেশ ভালো স্ক্র্যাচ বল টিম গড়ে উঠেছিল, কিন্তু একে একে বেশিরভাগ সদস্যই চলে গেছে। যাই হোক, দ্বিমত না করে আমি তখন স্পেডস সাজাচ্ছিলাম। তেরো দিয়ে শুরু করেছিলাম, তারপর আট পেয়ে একুশে পৌঁছেছি–এরপর থেকে খেলা আর আগানোর নামও নেই। এই যখন অবস্থা, তখন ক্রিস নক দিল। আমিও আমার শেষ কার্ডটা বের করলাম, কিন্তু সুবিধাজনক কিছু ছিল না সেটা।

ডায়মন্ড কার্ডগুলো মেলে দিয়ে ক্রিস বলল, উনত্রিশ।

বিরক্ত ভঙ্গিতে টেডি বলল, বাইশ।

যাশ শালা! বলেই আমার শেষ কার্ডটা ছুঁড়ে মারলাম টেবিলের ওপর।

গর্ডি তো ধরা! একেবারে বস্তাপাতি নিয়ে দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল? বলেই টেডি ইইইই-ইইই-ইই করে ওর অদ্ভুত হাসিটা দিল। এটা ওর ট্রেডমার্ক হাসি। শুনে মনে হবে, কেউ যেন কাঠের ওপরে নখ দিয়ে আঁচড় কাটছে। শুনলে গা শিরশির করে ওঠে। অবশ্য ও যে একটু অদ্ভুত ধরনের, সে কথা আমরা সবাই জানতাম। বয়স ওর আমাদের মতোই ছিল, তেরোর কাছাকাছি। কিন্তু চশমা আর কানের হিয়ারিং এইডের জন্য ওকে আমাদের চেয়ে অনেক বয়স্ক মনে হতো।

চশমা ছাড়া টেডি বলতে গেলে কিছুই দেখতে পেত না। প্রায়ই দেখা যেত, মানুষ বলেছে একটা, কিন্তু সে বুঝেছে অন্যকিছু। বেসবল খেলতে গেলে বামদিকে থাকত ক্রিস আর ডানে বিলি গ্রিয়ার। টেডিকে রাখতে হতো ওদের অনেক পেছনে, একেবারে শেষ মাথার দাগের কাছে। আর আশা করতে হতো, এতদূরে এসে কেউ নিশ্চয়ই ওকে হিট করবে না। কারণ, কেউ ওকে ধরতে পারলেই হয়েছে, অদ্ভুত ওই হাসি দিয়ে সবকিছু একেবারে মাথায় তুলে ফেলত। মাঝে সাঝে হিট তো সবাইকেই হতে হয়। একবার এরকম হিট হওয়ার পরে প্রচন্ড বেগে দৌড় দিতে গিয়ে ট্রি হাইজের পাশের দাগটা পেরিয়ে চলে গেল টেডি, বেসবলের ভাষায়, মরে গেল। এরপর সে করল কী, সোজা আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎপটাং হয়ে পড়ে রইল পাঁচ মিনিটের মতো। গিয়ে দেখি, ওর চোখের সাদা অংশও বেরিয়ে পড়েছে। ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম দেখে। কিন্তু পাঁচ মিনিট পরে উঠে নাকের রক্ত মুছতে মুছতে কপালের ফুলে ওঠা অংশটা দেখিয়ে টেডি দাবি করল, বলটা নাকি ফাউল ছিল।

চোখের সমস্যাটা ওর জন্মগত হলেও কানের যে সমস্যা, এর পেছনের কোনোকিছুই আসলে স্বাভাবিক ছিল না। সে সময় চুলের ফ্যাশন বলতে সবাই বুঝত ছোট করে কদম ছাঁট দেয়া চুল। পুরো ক্যাসল রকে একমাত্র টেডির চুল ছিল বিটল ব্যান্ডের মতো, কান পর্যন্ত লম্বা। অথচ পরবর্তী চার বছরেও আমেরিকার কেউ বিটলের নামও ঠিকমতো শোনেনি। আসলে ওর কান দুটো ছিল জমে যাওয়া মোমের দলার মতো, ফোলা ফোলা। সেজন্য চুল দিয়ে কান দুটোকে ঢেকে রাখতে চাইত সে।

একদিনের ঘটনা। টেডির বয়স তখন আট। কেমন করে যেন একটা প্লেট ভেঙে ফেলেছিল ও। বাবা প্রচন্ড ক্ষেপে গিয়েছিলেন। ওর মা তখন দক্ষিণ প্যারিসের এক জুতার কারখানায় কাজে ব্যস্ত। উনি যখন এই ব্যাপারে জানলেন, ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে।

ওর বাবা ওকে টেনে হিঁচড়ে রান্নাঘরের শেষ মাথায় বড় ওভেনটার কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর, কোনোরকম সুযোগ না দিয়েই ওর মাথা চেপে ধরেছিলেন ওভেনের বার্নার প্লেটের মধ্যে, প্রায় দশ সেকেন্ডের মতো। এখানে শেষ হলেও হতো, তা হয়নি। চুল ধরে টেনে উঠিয়ে এনে আবারো মাথার উল্টোপাশ চেপে ধরেছিলেন ওভেনের মধ্যে।

ওকে ছেড়ে দিয়ে এসে উনি নিজেই হাসপাতালে ফোন দিয়ে ছেলের আহত হওয়ার খবর জানালেন। বললেন, ওরা যেন এসে ওকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। তারপর টিভি ছেড়ে দিয়ে, বন্দুকটা এনে হাঁটুর উপরে রেখে, সোফায় বসলেন অনুষ্ঠান উপভোগ করার জন্য। কিছুক্ষণ পর পাশের বাসার মিসেস ব্যুরো এসেছিলেন জিজ্ঞাসা করতে যে, টেডি ঠিক আছে কি না। বলতে চাচ্ছিলেন, টেডির চিৎকার শুনে ছুটে এসেছেন। কিন্তু কথা পুরোপুরি শেষ হওয়ার আগেই টেডির বাবা যখন ওনার দিকে বন্দুক তাক করে ধরল, ভদ্রমহিলা যাকে বলে, একেবারে আলোর বেগে ছুট লাগালেন। এবং বাসায় ফিরে সাথে সাথে পুলিশে ফোন দিলেন।

অ্যাম্বুলেন্সের লোকজনকে বাসায় ঢুকতে দিয়ে টেডির বাবা পেছনের উঠোনে চলে গেলেন পাহারা দিতে। লোকজন স্ট্রেচারে করে টেডিকে অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে তুলল। ওর বাবা অ্যাম্বুলেন্সের লোকদেরকে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, যদিও বোকার হদ্দরা ভাবছে এলাকা পুরোপুরি শক্রমুক্ত, কিন্তু তিনি নিজে তো জানেন যে, জার্মান সৈন্যরা এখনো স্নাইপার নিয়ে এদিক-ওদিক নানা জায়গায় ওঁৎ পেতে আছে। এক অ্যাম্বুলেন্স কর্মী টেডির বাবাকে জিজ্ঞাসা করল, তিনি আর কিছু সময়ের জন্যে পাহারা দিতে পারবেন কি না। তিনি হেসে বললেন, জীবন দিয়ে হলেও তিনি তার দায়িত্ব পালন করবেন। শুনে ওই কর্মী স্যালুট দিয়ে বেরিয়ে গেল। টেডির বাবা তার স্যালুটের জবাবও দিয়েছিলেন। অ্যাম্বুলেন্স টেডিকে নিয়ে চলে যাওয়ার কিছুক্ষন পরে স্টেট পুলিশ এসে নরম্যান ডুশাঁকে তার দায়িত্ব থেকে মুক্তি দেয়। প্রায় এক বছর ধরে তিনি বিড়াল দেখলে গুলি করে দেওয়া কিংবা মেইলবক্সে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার মতো অদ্ভুতসব কাজকর্ম করছিলেন। নিজের ছেলেকে ওভাবে বেদম পেটানো নিয়ে আদালতে শুনানি হলো। শুনানির রায় অনুযায়ী তাঁকে পাঠানো হলো টোগাস হসপিটালে। অবসরপ্রাপ্ত সৈন্যদের মানসিক চিকিৎসার জন্যে এই বিশেষ হাসপাতালে পাঠানো হতো। নরম্যান্ডি সমুদ্র সৈকতে ভয়াবহ এক যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন ওর বাবা, যথাসম্ভব সেই থেকেই ওনার এমন অবস্থা হয়েছে, অন্তত টেডি তাই ভাবত। কিন্তু বাবাকে নিয়ে বেশ গর্বিত ছিল সে এবং প্রতি সপ্তাহে মাকে নিয়ে হাসপাতালে যেত ওনাকে দেখতে।

আমাদের গ্যাংয়ের মধ্যে ওই ছিল সবচেয়ে বোকা। আর এক নম্বর পাগল! সব সময় অদ্ভুত সব কাজকর্ম করে বেড়াত। এরমাঝে ওর সবচেয়ে পছন্দের ছিল, টেডির ভাষায় ট্রাক উজিং। ধরা যাক, মালামাল নিয়ে রাস্তা দিয়ে একটা লরি প্রচন্ড বেগে ছুটে যাচ্ছে। সে ছুটে গিয়ে লরির সামনে দিয়ে দৌড়াতে থাকবে এবং একেবারে শেষ মুহূর্তে লাফ দিয়ে সামনে থেকে সরে যাবে। কখনো কখনো ট্রাকগুলো ইঞ্চিখানেকের জন্য ওকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যেতে পারত। খোদা জানে, কতবার আমাদেরকে হার্ট অ্যাটাকের মুখে ফেলেছে ও। ট্রাক ছুটে যাওয়ার সময় প্রচন্ড বাতাসের ধাক্কায় কাপড় ছিঁড়ে গেলে উচ্ছল হাসিতে ওর সারা মুখ ঝলমল করে উঠত। এদিকে আমাদের সবার ভয়ে একেবারে খবর হয়ে যেত। চোখে তো প্রায় কিছুই দেখতে পেত না টেডি। যদি কোনোবার হঠাত এক মুহূর্তের হিসেব এদিক ওদিক হয়ে যায়, তাহলে? টুথ এন্ড ডেয়ার খেলে না সবাই? ওই ডেয়ার খেলার সময়ও আমাদেরকে খুব সতর্ক থাকতে হতো। পাগলটাকে ডেয়ার দিয়ে যাই বলা হোক, সে সেটা করার চেষ্টা করবেই।

গর্জি শেষ, ইইইই-ইইই-ইইইই!

জাহান্নামে যাক! বলে একটা মাস্টার ডিটেক্টিভ ম্যাগাজিন তুলে নিয়ে পড়তে শুরু করলাম। ভাবলাম, ওরা খেলে শেষ করুক। বদ্ধ এলিভেটরে সুন্দরি কো-এড খুন নামের একটা গল্প পড়তে পড়তে একেবারে ডুবে গিয়েছিলাম ওর মাঝে। টেডি এসময় কার্ড হাতে তুলে নিয়ে একবার তাকাল, তারপর বলল, আমি নক দেব।

শুনলাম, ক্রিস চিৎকার করে বলছে, চারচোখা মাছির বাচ্চা!

টেডি সিরিয়াস ভঙ্গিতে জবাব দিল, মাছির তো চোখ চারটা না, এক হাজারের মতো। আমি আর ক্রিস একসাথে জোরে হেসে ফেললাম। অবাক চোখে আমাদের দিকে তাকাল টেডি, যেন বুঝতে পারছে না, আমরা কী নিয়ে হাসাহাসি করছি। ওকে নিয়ে এই আরেক সমস্যা। এমনসব মুহূর্তে এরকম অদ্ভুত জবাব দেবে যে শুনে বোঝার উপায় নেই রসিকতা করছে। নাকি সিরিয়াসলি বলছে। তারপর হাসতে থাকা মানুষজনের দিকে এমনভাবে তাকাবে যেন বলতে চাইছে, হায় খোদা, এখন আবার কী হলো?

ক্লাবের রাজা, রাণি এবং গোলাম মিলে টেডির হাতে অন্তত ত্রিশ ছিল, এদিকে ক্রিসের হাতে ছিল কেবল মোল। টেডি আবার কার্ড হাতে নিয়ে বাঁটা শুরু করলে, আমি গল্পে ফেরত গেলাম। বেশ উত্তেজনাকর একটা অংশ পড়ছিলাম। নিউ অরলিয়েন্সের এক মাতাল নাবিক এলিভেটরের ভেতরে কলেজের এক মেয়ের বুকের উপর ঢলে পড়ে গেছে, বদ্ধ জায়গায় সে নাকি ঠিক করে দাঁড়াতে পারছিল না। এ সময় শুনতে পেলাম, এলম গাছের একপাশে স্থির করে লাগানো মইটা বেয়ে কেউ ছুটে আসছে। ট্র্যাপড়োরের নিচের দিকের অংশে টোকা দিল কে যেন।

ক্রিস চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল, কে?

ভার্ন! গলা শুনে মনে হলো প্রচন্ড উত্তেজিত। ঠিক করে নিঃশ্বাস নিতে না পেরে হাঁফাচ্ছে।

উঠে গিয়ে ট্র্যাপড়োরের ছিটকিনি খুলে দিলাম। ছিটকে খুলে গেল দরজাটা, ফাঁকা জায়গাটা দিয়ে মাথা গলিয়ে দিল ভার্ন টেসিও। আমাদের গ্যাংয়ের আরেকজন নিয়মিত সদস্য। পুরো শরীর ঘেমে নেয়ে একেবারে জবজবে অবস্থা। চোখা মাথায় রবার দিয়ে চুল বেঁধে রেখেছে। সাধারণত চুলের ক্লিপ দিয়ে রক অ্যান্ড রোল গুরু ববি রিডলের মতো করে রাখত সে।

জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে ভার্ন বলল, এই কথাটা শুনে দেখ খালি!

কী কথা?

দাঁড়া, আগে দমটা একটু ফেলে নেই। বাসা থেকে পুরো রাস্তা একেবারে এক দৌড়ে এসেছি।

পুরো রাস্তা? ক্রিসের গলার স্বরে অবিশ্বাস। ভার্নের বাসা ছিল অন্তত দুই মাইল দূরে। পাগল! এই গরমে এই পুরো রাস্তা দৌড়ানো!

হ্যাঁ, আর সেটার কারণও আছে। তোরা তো বিশ্বাসই করতে চাইবি না!

যেন প্রশ্নটা শুনতেই পায়নি। প্রচন্ড উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে সে বলল, তোরা সবাই আজকে রাতে ক্যাম্প করতে পারবি বাইরে? ঘামে জবজবে মুখের মাঝে ওর চোখের তারা আরো কালো, আরো গভীর মনে হচ্ছিল। মানে, যদি বাসায় বলিস যে, আমাদের বাসার পেছনের মাঠে ক্যাম্প করবি, তোদেরকে ছাড়বে না আজকে রাতের জন্য?

বেঁটে দেওয়া কার্ড তুলে নিতে নিতে ক্রিস বলল, মনে হয় দিবে। কিন্তু আবু তো…একেবারে বাজে মুডে আছে মনে হয়। ড্রিংক করে যে…জানিসই তো।

পারতেই হবে! আজকে অবশ্যই পারতে হবে। আমি জানি, শুনলে তোদের একটুও বিশ্বাস হবে না। এই গর্ডি, তুই পারবি?

পারব সম্ভবত।

আসলে এসব আমার জন্য কোনো সমস্যাই না। সত্যি বলতে কী, এই গ্রীষ্মের পুরো ছুটির খুব কম সময়ই আমি বাসায় ছিলাম। আমার বড় ভাই ডেনিস এপ্রিলের দিকে জিপগাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিল।

.

ফোর্ট বেনিং, জর্জিয়া। মাত্র কিছুদিন হয়েছে, ডেনিস আর্মিতে যোগ দিয়েছে। ট্রেনিং শুরু হয়েছে কেবল। আরেকজনকে সাথে নিয়ে জিপে করে পিএক্সের দিকে যাচ্ছিল। আর্মির একটা লরি ওর জিপটাকে বোর্ডর্সাইড থেকে ধাক্কা দেয়। ঘটনাস্থলেই ওর মৃত্যু হয়। ওর সাথের সেই যাত্রী এখনো কোমায়। সপ্তাহ পেরোলেই ওর বয়স বিশ হওয়ার কথা ছিল। এমনকি ক্যাসল গ্রিনের ডালিস থেকে ওর জন্য জন্মদিনের কার্ডও কিনে রেখেছিলাম।

ঘটনা শোনার পরে অনেক কেঁদেছি। ওর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে গিয়ে পাগলের মতো কাঁদছিলাম। তখনো বিশ্বাস করতে পারছিলাম না ও আর নেই। যে মানুষটা আমার মাথায় চাঁটি মেরেছে, রবারের মাকড়শা দিয়ে ভয় দেখিয়ে কাঁদিয়ে ছেড়েছে আমাকে কিংবা পড়ে গিয়ে হাঁটুর কাছে ছিলে যাওয়ায় কান্না করে ফেলার পরে আমাকে চুমু দিয়ে আদর করে ফিসফিসিয়ে বলেছে, আর কত কাঁদবি, পিচ্চি? যে মানুষটা আমাকে একসময় স্পর্শ করেছে, তেমন কেউ যে মারা যেতে পারে, সে কথাটাই কেন যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না আমার। ড্যানি যে মারা যেতে পারে, এই ভাবনাটা আমাকে প্রচন্ড কষ্ট দিয়েছিল। প্রবল ভয়ে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিলাম আমি। কিন্তু পরে বুঝেছি, ওর মৃত্যু বাবা-মার ভেতর থেকে হৃদয়টুকুও ছিঁড়ে নিয়ে গেছে। আমার জন্য একজন সহযোগীর চেয়ে খুব বেশি কিছু ছিল না সে। এমনিতেও ডেনিস আমার আট বছরের বড় ছিল, তার উপরে ওর নিজের বন্ধু-বান্ধব আর ক্লাসের সহপাঠীরা তো ছিলই। হ্যাঁ, একসাথে অনেকগুলো দিন এক টেবিলে বসে খেয়েছি, কখনো কখনো ও হয়তো আমার বন্ধু ছিল, কখনো যম কিন্তু মূলত আমার কাছে সে ছিল, যাকে বলে, কেবলই আরেকজন মানুষ। মারা যাওয়ার আগের বছরখানেক ধরে তো ও ছিলই না আমার সাথে। মাঝে মাঝে ছুটিতে আসততা অবশ্য, কিন্তু ওইটুকুই। দেখতেও একরকম ছিলাম না আমরা। ওই গ্রীষ্মের অনেক অনেক পরে এক সময় বুঝতে পেরেছিলাম সত্যিটা। আমার কান্নার বেশিরভাগটকু আসলে ছিল আমার বাবা-মায়ের জন্যে। কিন্তু ওতে আমার নিজেরও কোনো লাভ হয়নি, ওনাদেরও না।

টেডি আবার জিজ্ঞাসা করল প্রশ্নটা। ঠিক কী নিয়ে এত লাফালাফি করছিস বল তো, ভার্ন?

এ সময় ক্রিস বলে উঠল, আমি নক দিচ্ছি।

মুহূর্তেই ভার্নের কথা ভুলে গিয়ে টেডি চিৎকার করে উঠল, কী! মিথ্যুক কোথাকার! তোর প্যাট হ্যান্ড (পোকার বা এ ধরনের কার্ড খেলায় একপক্ষ জেতার দিকে থাকলে অন্যপক্ষ যে ধরনের কার্ড পেলে ড্র হতে পারে) করার কোনো সুযোগই নেই! আমি তোকে অমন কার্ড দেইই-নি!

ক্রিস হাসতে হাসতে বলল, ভালোয় ভালোয় ডু মেনে নে, গাধা কোথাকার!

টেডি একসাথে করে ফেলে রাখা কার্ডগুলোর দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। পেছনে রাখা গানের অ্যালবামগুলো থেকে উইনস্টনদের একটা অ্যালবাম বেছে নিচ্ছিল ক্রিস। আমি উঠে এসে আরেকটা গোয়েন্দা ম্যাগাজিনের জন্য হাত বাড়িয়েছি।

লাশ দেখতে যাবি?

ভার্ন টেসিওর জবাব শুনে আমরা সবাই জায়গায় জমে গেলাম।

অধ্যায় ৩

এই ঘটনার কথা প্রথম শুনেছিলাম রেডিওতে। ফিলকো কোম্পানির একটা রেডিও ছিল আমাদের কাছে, সারাক্ষণই বাজত। রেডিও রাখার একটা ভাঙা বাক্স ছিল, যেটা আমরা সেই ডাম্পেই কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। লিউস্টনের ডব্লিউএএএম চ্যানেলটা টিউন করে রাখতাম বেশিরভাগ সময়। এই চ্যানেলে সব সুপারহিট আর পুরনো দিনের জনপ্রিয় গানগুলো বাজানো হতো। এরমাঝে ছিল জ্যাক স্কটের হোয়াট ইন দ্য ওয়ার্ল্ডস কাম ওভার ইউ, ট্রয় শন্ডেলের দিস টাইম, এলভিসের কিং ক্রেওল কিংবা রয় অরবিসনের অনলি দ্য লোনলি। যখন সংবাদ প্রচারিত হতো, কোনো এক বিচিত্র উপায়ে মাথার মাঝে চুপ থাকার সুইচটা অন করে দিতাম আমরা। খবরের পুরোটাই আসলে ফালতু জিনিসপত্র দিয়ে ভর্তি থাকত। কেনেডি আর নিক্সনের ব্যাপারে ভালো ভালো কথা বলা হতো, কিংবা মাতসু আর কুয়েময়ের ব্যাপারে। আমেরিকা যে রাশিয়ার চেয়ে বেশি পারমাণবিক শক্তির অধিকারী, সে নিয়েও কথা হতো। আর, কাস্ট্রো শেষ পর্যন্ত কীরকম বাজে ব্যক্তিত্বে পরিণত হচ্ছিল, জানা যেত তাও। কিন্তু রে ব্রাওয়ারের গল্পটা আমরা সবাই আরো অনেক মনযোগ দিয়ে শুনেছিলাম। কারণ, ছেলেটা আমাদেরই বয়সি ছিল।

ক্যাসল রক থেকে চল্লিশ মাইল দূরের চেম্বারলিন শহরের অধিবাসী ছিল সে। তিনদিন আগে গ্র্যান্ডস্ট্রিট ধরে দুই মাইল দৌড়ে এসে ভার্ন আমাদের সামনে রাতারাতি বিস্ফোরিত হয়েছিল! ওর কাছ থেকে জানা গিয়েছিল, মায়ের কাছ থেকে একটা পট নিয়ে ব্লুবেরি সংগ্রহ করার জন্য বেরিয়েছিল রে ব্রাওয়ার। সন্ধ্যার পরেও সে যখন ফিরে আসেনি, ওর পরিবার থেকে কাউন্টির শেরিফকে ফোন দিয়ে জানানো হয়। প্রথমে ওর বাড়ির কাছাকাছি সার্চ করা হয়, তারপর সেটা মটন, ডুরহাম এবং পনাল শহর পর্যন্ত বিস্তৃত করা হয়। দায়িত্বশীল পুলিশ, ডেপুটি, গেইম ওয়ার্ডেন এমনকি অনেক স্বেচ্ছাসেবকও এতে অংশ নেয়। এভাবে তিনদিন পেরিয়ে গেলেও ওর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। রেডিওতে যেভাবে বলছিল, শুনলেই বুঝতে পারতেন, বেচারাকে ওদের জীবিত খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল না বললেই চলে। এভাবেই একসময় সব খোঁজাখুঁজি থেমে যাবে। হয়তো কোনো নুড়ি পাথরের স্তূপে পিছলে গিয়ে দমবন্ধ হয়ে চাপা পড়ে থাকবে সে, কিংবা ডুবে পড়ে থাকবে কোনো ছোট নদীতে। হয়তো বছর দশেক পরে কোনো শিকারি ওর হাড়গোড় খুঁজে পাবে।

সার্চপার্টির ওরা ততদিনে মটনের বেড়িবাঁধের ওখানে আর চেম্বারলিন শহরের পুকুরগুলো খুঁজে দেখে ফেলেছে। আজকের মেইন শহরের দক্ষিণ পশ্চিমে এখন আর সেরকম কিছু হওয়া সম্ভবই না। এই এলাকার বেশিরভাগ অংশই নগরায়নের হাতে পড়ে বেমালুম বদলে গেছে, গড়ে উঠেছে মফস্বল শহর। আর, পোর্টল্যান্ড ও লুইস্টনের আশেপাশের অঞ্চলে তো সামুদ্রিক স্কুইডের কর্ষিকার মতো জায়গায় জায়গায় বেডরুম কমিউনিটি গড়ে উঠেছে। আশেপাশের শহরে কাজ করে এমন সব মানুষদের নিয়ে গড়ে ওঠা এলাকায় লোকজন বলতে গেলে শুধু ঘুমাতেই আসে নিজের ঘরে, সামাজিকতার কোনো বালাই নেই-এ কারণেই এমন শব্দের জন্ম হয়েছে।

কাঠগাছগুলো এখনো সেখানেই আছে। হোয়াইট মাউন্টেনের দিকে যাওয়ার জন্য পশ্চিমের রাস্তা ধরে আগালে আপনি বরং সেগুলোকে আরো ঘন হতে দেখবেন। তবে আজকের দিনে আপনি যদি একটা নির্দিষ্ট দিক ধরে নিয়ে পাঁচ মাইলের মতো এগোতে পারেন এবং দিক এলোমেলো করে

ফেলেন, অবশ্যই আপনার সামনে অন্তত একটা দুই লেনের রাস্তা পড়বে। কিন্তু ১৯৬০-এর সময় চেম্বারলেইন আর ক্যাসল রকের মাঝের পুরো এলাকাটা ছিল একেবারে অনুন্নত, এর মাঝে এমনও জায়গা ছিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে যাদের লিখিত কোনো অস্তিত্বও ছিল না। সে সময় বনের মধ্যে দিয়ে চলতে গিয়ে পথ হারালে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল প্রবল।

অধ্যায় ৪

ভার্ন টেসিও সেদিন ওদের বাড়ির উঠোনে মাটি খুঁড়ছিল।

আমরা সবাই এটুকু শুনেই ব্যাপারটা বুঝে গিয়েছিলাম। কিন্তু আপনাদের বোঝার জন্যে এক মিনিট সময় নিয়ে আমার সম্ভবত ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করা উচিত। টেডি ডুশ্যাঁ তো ছিল আধা-বোকা ধরনের, কিন্তু ভার্ন টেসিও যে কোনোদিক থেকে ওর চেয়ে বুদ্ধিমান ছিল–সে কথা বলার কোনো উপায় নেই। তারপরেও, ওর ভাই বিলি ছিল আরো ভয়াবহ ধরনের বোকা, যেটা সামনে আগালে আপনারা এমনিতেই বুঝতে পারবেন। যাই হোক, আগে বলে নেই ভার্ন সেদিন মাটি কোপাচ্ছিল কেন।

চার বছর আগের কথা। ভার্নের বয়স তখন আট। বাসার সামনের দীর্ঘ উঠোনে সে তখন পয়সা ভর্তি একটা জগ পুঁতে রেখেছিল। উঠোনের একপাশের অন্ধকার জায়গাটুকুর নাম দিয়েছিল গুহা। জলদস্যু ধাঁচের কোনো একটা খেলা খেলছিল সে, আর পয়সাগুলো হলো লুকানো গুপ্তধন তবে কী, আপনি যদি ভার্নের সাথে খেলেন, আপনি গুপ্তধন কথাটা কিছুতেই ব্যবহার করতে পারবেন না, আপনাকে বলতে হবে ডাকাতি করে আনা সম্পদ। তো, সে জগটাকে অনেকটা গভীর করে পুঁতে, মাটি দিয়ে গর্ত ভরাট করে দিয়ে, নতুন ফেলা মাটির উপরে বছরের পর বছর ধরে উড়ে বেড়ানো পুরনো পাতা দিয়ে ঢেকে দিল। তারপর গুপ্তধনের একটা মানচিত্র এঁকে, নিজের রুমে আর সব বিচিত্র সংগ্রহের সাথে রেখে দিল সেটা। মাসখানেকের মতো সময় এসব কিছুই ওর মনে ছিল না। তারপর কোনো একটা মুভি দেখতে গিয়ে হাতে পয়সার টান পড়লে, ওর মনে পড়ে গেল পুঁতে রাখা পয়সার কথা। মানচিত্র আনতে গিয়ে সে টের পেল, ওর মা এরইমাঝে ওর ঘর দুই থেকে তিনবার পরিস্কার করেছেন এবং ওর পুরনো সব বাড়ির কাজের কাগজ, চকলেটের মোড়ক, কমিক ম্যাগাজিন এবং কৌতুকের বই ওখান থেকে সরিয়ে এনে স্টোভে পুড়িয়ে ফেলেছেন কোনো এক সকালে রান্নার আগুন জ্বালানোর কাজে। এরই সাথে ভার্নের গুপ্তধনের মানচিত্রও রান্নাঘরের চিমনি দিয়ে ধোঁয়া হয়ে উড়ে গেছে, অন্তত হিসেব নিকেশ করে ও তাই ধরে নিয়েছে।

স্মৃতি ঘেঁটে জায়গা চিহ্নিত করে খুঁড়ে দেখেছে ও, কিন্তু লাভ হয়নি কিছুই। তারপর সে জায়গার ডানে-বামে সব খোঁড়া হয়ে গেছে, কিন্তু সেই একই অবস্থা। ফক্কা! সেদিন খোঁড়াখুঁড়ি স্থগিত রেখে চলে এসেছিল ভার্ন, কিন্তু তারপর থেকে এই খোঁড়ে তো সেই খোঁড়ে–এভাবেই চলছে। চার বছর, হ্যাঁ, চার বছর ধরে এই কাজ করে যাচ্ছে ও! মেজাজ খারাপ হওয়ার কথা না? মানে, শুনে কাঁদবেন না হাসবেন, সেটাও তো বোঝার উপায় নেই আসলে। পুরো ব্যাপারটা ওর কাছে অবসেশনের মতো হয়ে গেছে। টেসিওদের সামনের উঠোন হচ্ছে ওদের বাড়ির সমান লম্বা। চল্লিশ ফিট দীর্ঘ এবং সাত ফিট প্রশস্ত। হারামজাদা প্রায় পুরোটা উঠোন দুই থেকে তিনবার করে খুঁড়ে ফেলেও একটা পয়সাও পায়নি। তারপরও থামার নাম নেই। এদিকে ওর মাথার মধ্যে তখন পয়সার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। যখন প্রথম শুরু হয়েছিল, আমাকে আর ক্রিসকে ও বলেছিল, জগে যথাসম্ভব তিন ডলারের মতো আছে। এক বছর পরে সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে পাঁচ ডলারে এবং পরে কখন যেন সেটা দশ ডলার হয়ে গেছে! ওর কী অবস্থা, সেটা বিবেচনা করে প্রায়ই আমরা ওকে বলার চেষ্টা করেছি ব্যাপারটা। আমাদের কাছে পুরো ব্যাপারটা ছিল সরল-যেহেতু বিলিও এই জগের কথা জানত, তাই কোনো এক সময় সে নিশ্চয়ই খুঁড়ে তুলে নিয়েছে। ভার্ন কিছুতেই এ কথা বিশ্বাস করতে রাজি না। যদিও সে বিলিকে ভয়াবহরকম অপছন্দ করে–আরবরা ইহুদিদের যেমন অপছন্দ করে, মোটামুটি সেরকম অবস্থা! ক্রেতা সেজে দোকান থেকে চুরি করার অপরাধে ওর ভাইয়ের মৃত্যুদন্ড হবে কি না, এমন কোনো ভোট হলে ভার্ন খুশি খুশি হ্যাঁ ভোট দিত নিশ্চিত। একই সাথে বিলিকে এই ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞাসা করতেও রাজি ছিল না সে। সম্ভবত ওর ভয় ছিল, জিজ্ঞাসা করলেই বিলি হেসে বলবে, অবশ্যই! আমি কবেই ওই টাকা নিয়ে নিয়েছি রে, গাধা কোথাকার! বিশ ডলারের মতো ছিল আর আমি পুরোটা আরামসে খরচ করেছি! কাজেই, জিজ্ঞাসা করার বদলে মন টানলেই (আর অবশ্যই, বিলি না থাকলে) ও গিয়ে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করে দিত। আর প্রতিবারই ফিরে আসত ময়লা জিন্স, পাতা আর ধুলায় ভরা চুল আর খালি হাত নিয়ে। আমরা ওকে এই নিয়ে কত যে ক্ষেপিয়েছি! ওর নামই হয়ে গিয়েছিল পেনি–পেনি টেসিও! যদ্রুত সম্ভব, খবরটা পেট থেকে বের করে দেওয়ার জন্যেই যে শুধু ভার্ন এতটা পথ দৌড়ে এসেছিল, আমার সেটা মনে হয় না। আমার ধারণা, ও আমাদেরকে দেখাতে চাইছিল, ওর পয়সা খোঁজার মিশন থেকে শেষ পর্যন্ত ভালো কিছু বেরিয়ে এসেছে।

সেদিন সকালে সে আর সবার আগেই উঠে পড়েছিল ঘুম থেকে। কর্নফ্লেক্স খেয়ে নিয়ে ডাইভওয়েতে পুরনো বাস্কেটবলের জালে বল ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারছিল, এছাড়া আর কিছু করারও ছিল না। কারো সাথে ভূত-ভূত খেলা বা কিছুই করার নেই দেখে সে চিন্তা করল, আরেকদফা খুঁড়ে দেখা যাক। উঠোনে খুঁড়তে খুঁড়তে ভান শুনল, স্বচ্ছ কাঁচের দরজাটা জোরে বাড়ি খেয়েছে। জমে গেল সে, কোনো শব্দ করছে না। যদি বাবা হয়, তাহলে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসবে, আর যদি বিলি হয়, তাহলে বিলি আর চার্লি হোগান বেরিয়ে যাওয়া পর্যন্ত স্থির বসে থাকবে ওখানেই।

দুই জোড়া পা উঠোন পেরিয়ে গেল, তারপর চার্লি হোগান বাচ্চাদের মতো কাঁপা কাঁপা কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, জিসাস ক্রাইস্ট, বিলি, আমরা কী করব?

ভার্ন বলছিল, চার্লি হোগানকে ওভাবে কথা বলতে শুনে–যে চার্লি এলাকার সবচেয়ে শক্তপোক্ত ছেলেদের একজন–ওর কান কেমন গরম হয়ে গিয়েছিল। এই চার্লি আবার এইস মেরিল, আইবল চেম্বারসদের মতো ছেলেদের সাথে ঘোরাফেরা করত। আর, এরকম বদমাশদের সাথে চলতে হলে শক্তপোক্ত না হয়ে আসলে উপায় নেই।

বিলি জবাব দিয়েছিল, কিচ্ছু না। আমরা কেবল এইটুকুই করব, বুঝেছিস? মানে, কিছু না!

কিন্তু আমাদেও তো কিছু করতেই হবে, চার্লি বলছিল। ভার্ন যেখানে স্থির জমে আছে, এর কাছাকাছি উঠোনের এক জায়গায় বসে পড়ল ওদের দুজন। তুই দেখিসনি ওকে?

ভার্ন আস্তে করে ওদের আরেকটু কাছে এগিয়ে গিয়ে কান পেতে পড়ে রইল। সে সময় ও ভাবছিল, বিলি আর চার্লি হয়তো মদ খেয়ে কাউকে মেরে এসেছে। নড়ার সময় খেয়াল রাখছিল, একটা পুরনো পাতাতেও যেন ভুলেও কোনো শব্দ না হয়। যদি ওরা দুজন কোনোভাবে বুঝে ফেলত যে, ভার্ন আড়ি পেতে ওদের কথা শুনেছে; ওর কপালে কী অপেক্ষা করছিল, তা তো বুঝতেই পারছেন। ওর যেটুকু বাকি থাকত, সেটুকু যে কোনো কুকুরের খাবারের ক্যানেও জায়গা হয়ে যাবে।

আমাদের তো কিছু না। বিলি টেসিও জবাব দিল, আর ওই ছেলে যেহেতু মরেই গেছে, ওরও কিছু যায় আসে না। ওকে কেউ খুঁজে পেল কি না, তাতে কার বাপের কী যায় আসে? আমার কিছু যায় আসে না, বুঝেছিস?

ওরা রেডিওতে যে ছেলের কথা বলছিল, এটা নিশ্চয়ই সেই ছেলে। আমি নিশ্চিত, ব্রোকার, ব্ৰাওয়ার না ফ্লাওয়ার, কী যেন নাম। ওকে নিশ্চয়ই ট্রেন ধাক্কা দিয়েছে।

হ্যাঁ, বিলির কথার সাথে সাথে ম্যাচের কাঠি ঘষা দেওয়ার শব্দ শোনা গেল। ভার্ন দেখল, জ্বলন্ত ম্যাচের কাঠি ড্রাইভওয়েতে এসে পড়ল, তারপর সিগারেটের গন্ধ। বিলির গলা শোনা গেল আবার, ট্রেনই ধাক্কা দিয়েছে, আর ওটা দেখে তুই বমিও করে এসেছিস।

কোনো শব্দ নেই। ভার্ন বুঝল, চার্লি হোগান দারুণ লজ্জা পেয়েছে। কিছুক্ষণ পর আবার বিলির গলা শোনা গেল, যাই হোক, তোর কপাল ভালো, মেয়েরা ওসব দেখতে পায়নি। শব্দ শুনে বোঝা গেল, বিলি চার্লির পিঠ চাপড়ে দিচ্ছে। মেয়েরা দেখলে ওরা এই খবর এখান থেকে নিয়ে সেই পোর্টল্যান্ড পর্যন্ত ছড়িয়ে বেড়াত। আমরা অবশ্য ওখান থেকে অনেক তাড়াতাড়ি চলে এসেছি। তোর কি মনে হয়, কিছু একটা সমস্যা হয়েছে, এমন কিছু বুঝতে পারবে ওরা?

চার্লি উত্তর দিল, না। তাছাড়া, ম্যারি এমনিতেও ব্যাক হারলো রোডের ওই কবরস্থানটা পার হয়ে যেতে চায়নি। সে আবার ভুতের ভয় পায়। তারপর আবার সেই ভয় পাওয়া কান্না কান্না গলা শোনা গেল, জিশু। আমরা যদি কালকে ওভাবে গাড়ি নিয়ে না বের হতাম! যে শোতে যেতে চেয়েছিলাম, সেখানেই যদি যেতাম!

তারপর চার্লি আর বিলি ম্যারি ডটারি, বেভারলি থমাস এবং আরো কিছু মেয়েকে নিয়ে নানারকম বাজে কথাবার্তা বলতে লাগল। যেমন, তুই কখনো এমন বিচ্ছিরি মেয়েদেরকে কোনো কার্নিভাল শোর আশেপাশে দেখতে পাবি না–ব্রন, মোচ, আরো কত কিছু। কখনো কখনো ওরা চারজন–কিংবা ফাজি ব্র্যাকোভিচ বা এইস মেরিল সাথে থাকলে ছয়জন বা আটজন সাথে মেয়ে নিয়ে লিউস্টন পার্কিং লট থেকে গাড়ি নিয়ে বেরুতো। ওরা মূলত কান্ট্রিরোডের দিকে যেত প্রমোদ ভ্রমণের জন্য। সাথে থাকত দুই-তিন বোতল আইরিশ রোজ ওয়াইন এবং জিঞ্জার এলের ছয় বোতলের প্যাকেট। ক্যাসল ভিউ অথবা হারলো কিংবা শাইলোর কোথাও গাড়ি পার্ক করে মদ খেতে খেতে মেতে উঠত মেয়ে নিয়ে।

তারপর, যার গাড়ি নিয়ে গিয়েছিল, তার বাসার কাছাকাছি কোথাও গাড়ি ফেলে রেখে চলে আসত। ক্রিস এই ব্যাপারটাকে এক কথায় বলত, চিপ থ্রিলস ইন দ্য মাঙ্কি হাউস। এমন কিছু করতে গিয়ে ওরা অবশ্য কখনো ধরা খায়নি। তবে, ভার্নের আশা ছিল, কোনোদিন নিশ্চয়ই খাবে। বিলিকে কোনো এক রবিবার দিনে সংশোধনাগারে দেখে আসতে যাওয়ার একটা স্বপ্ন ভার্ন আজন্ম লালন করে গেছে বুকের গভীরে।

বিলি বলছিল, আমরা যদি পুলিশে খবর দেই, সবার আগে তারা জানতে চাইবে, আমরা এতদূরে হারলোতে গেলাম কীভাবে। আমাদের কারোই নিজস্ব গাড়ি নেই। তাই মুখ বন্ধ রাখাটাই সব দিক থেকে ভাল মনে হচ্ছে আমার কাছে। তাহলে ওরাও আমাদেরকে কিছু করতে পারবে না।

বেনামি কল তো করতে পারি, চার্লির জবাব।

বিলি ক্ষেপে গিয়ে একটা গালি দিয়ে বলল, পুলিশ এসব কল ট্রেস করতে পারে। হাইওয়ে পেট্রোল এবং ড্রাগনেটে আমি নিজে দেখেছি।

হ্যাঁ, সেটাও ঠিক, চার্লির গলা করুণ শোনাল। হায় জিশু! এইস যদি আমাদের সাথে থাকত, অন্তত পুলিশকে বলা যেত, আমরা ওর গাড়িতে ছিলাম।

হ্যাঁ, কিন্তু সে ছিল না।

হুম। চার্লি হাই তুলে বলল, তুই সম্ভবত ঠিকই বলছিস। একটা সিগারেটের গোড়া ছুঁড়ে দেওয়া হলো ড্রাইভওয়ের দিকে। শালা, আমাদেরকে কি না হেঁটে গিয়ে ট্রাকের পাশেই পেশাব করতে হলো। অন্যপাশে গেলে কী ক্ষতিটা হতো? আর, এখন আমার কেডসের ভেতরে বমি ঢুকে গেছে। গলাটা কেমন বুজে আসল চার্লির, হারমাজাদার বাচ্চা কেমন সুন্দর করে শুয়ে ছিল, জানিস? তুই দেখেছিস ওই হারামিকে, বিলি?

হ্যাঁ, দেখেছি। আরেকটা সিগারেটের গোড়া উড়ে এসে প্রথমটার পাশে পড়ল। চল, গিয়ে দেখি, এইস এখনো জেগে আছে কি না। আমার জুস লাগবে।

আমরা ওকে বলব?

চার্লি, আমরা কাউকে কক্ষনো বলব না। কাউকে না। আমার কথা বুঝতে পারছিস?

হ্যাঁ, বুঝতে পারছি। হায় জিশু! আমরা যদি কখনো ওই ডজ নিয়ে বের হতাম!

ধুৎ! মুখটা বন্ধ করে এবার চল তো!

টাইট জিন্স এবং কালো ইঞ্জিনিয়ার বুট জুতায় মোড়ানো দুই জোড়া পা সিঁড়ি ধরে নেমে গেল। ভার্ন তখন হাত-পায়ে ভর দিয়ে ছিল, জায়গায় জমে গেছে, এমন অবস্থা। আমাদেরকে বলার সময় সে বলেছে, ভয়ে ওর অণ্ডকোষ মুখ দিয়ে লাফিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। মোটামুটি নিশ্চিত ছিল, সে যে উঠোনের কোনায় লুকিয়ে আছে, বিলি সেটা টের পেয়ে যাবে এবং টেনে বের করে এনে খুন করে ফেলবে ওকে। বিলি আর চার্লি হোগান মিলে খোদা ওকে যে সামান্য মগজ দিয়েছে, সেটাও লাখিয়ে কান দিয়ে বের করে ফেলবে। ইঞ্জিনিয়ার বুট দিয়ে মাড়িয়ে, ফেলে চলে যাবে। কিন্তু ওদের দুজন একবারের জন্যেও হাঁটা থামায়নি। ভার্ন যে মুহূর্তে নিশ্চিত হয়েছে যে, ওরা চলে গেছে; সেই মুহূর্তেই হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এসেছে সে। তারপর এক দৌড়ে হাজির হয়েছে এখানে।

অধ্যায় ৫

তোর ভাগ্য আসলেই ভালো, আমি বললাম। তোকে পেলে হয়তো মেরেই ফেলত।

টেডি বলল, ব্যাক হারলো বোডটা আমি চিনি। এটা নদীর ওখানে গিয়ে শেষ হয়েছে। ওদিকে সাঁতার কাটতে গেলে আমরা মাছ ধরতাম।

ক্রিস মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিল, ওখানে আগে একটা ব্রিজ ছিল। আগে মানে, অনেক আগে। তারপর বন্যা হলো। এখন সেখানে শুধু রেললাইন ছাড়া আর কিছু নেই।

ক্রিসকে জিজ্ঞাসা করলাম, চেম্বারলেইন থেকে একটা বাচ্চা-ছেলে আসলেই অতদূর হারলোতে যেতে পারল? অন্তত বিশ থেকে ত্রিশ মাইল তো হবেই।

তাই তো মনে হয়। সম্ভবত হাঁটতে হাঁটতে কোনোভাবে রেললাইনে উঠে গিয়েছিল, তারপর সেটা ধরেই বাকি রাস্তা হেঁটে গেছে। হয়তো ভেবেছে, রেললাইন ধরে হেঁটে গেলে একসময় বেরিয়ে আসতে পারবে, কিংবা একান্ত প্রয়োজনে পতাকা বা কিছু দেখিয়ে ট্রেন থামাতে পারবে। কিন্তু এখন সেখানে কেবল অল্পকিছু মালবাহী ট্রেন চলে। তাও, GS &WM থেকে ডেরি এবং ব্রাউনসভিল পর্যন্ত। মানে, বের হতে হলে তাকে ক্যাসল রক পর্যন্ত পুরো রাস্তাটাই হেঁটে আসতে হতো। হয়তো শেষ পর্যন্ত সন্ধ্যার পরে কোনো ট্রেন আসলেই এসেছিল, এবং, ধাম! ব্যাপারটা বোঝাতে গিয়ে ক্রিস ওর ডান হাত মুঠি পাকিয়ে বাম হাতের তালুতে ঘুসি বসিয়ে দিল, মুখ দিয়ে ধাক্কা দেওয়ার শব্দ করছে। একশ ছিয়ানব্বই নম্বর রোড ধরে ছুটে যাওয়া বেশিরভাগ ট্রাকের সাথে একটুর জন্যে ধাক্কা এড়িয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতায় ব্যাপক অভিজ্ঞ আমাদের টেডিকে বেশ অদ্ভুতরকম তৃপ্ত দেখাল। ভাবছিলাম পুরো ব্যাপারটা। একটা ছেলে বাসা থেকে এত দূরে, মৃত্যু ভয়ে এমনিতেই নিশ্চয়ই আধমরা হয়ে ছিল। চেষ্টা করছিল যেভাবেই হোক, জিএসঅ্যান্ডডব্লিউএম ট্র্যাক ধরে যথাসম্ভব এগিয়ে যেতে। হয়তো মাথার উপরে ঝুলে থাকা নানারকম গাছ আর আশেপাশের ঝোঁপঝাড় থেকে ভেসে আসা রাতের বিভিন্নরকম আওয়াজ তাড়া করে ফিরেছে ওকে। সেজন্যেই হয়তো রেললাইন ঘেঁষে এগিয়ে গেছে ছেলেটা, ব্রিজের ওপর দিয়ে চলে যাওয়া রেললাইন ধরে হেঁটে গেছে সামনে। আর, ঠিক তখনই এসেছে ট্রেনটা। হয়তো সামনে লাগানো বড় বড় হেডলাইটগুলো ওকে সম্মোহিত করে ফেলেছিল, যে কারণে লাফ দিতে দিতে একটু বেশিই দেরি হয়ে গিয়েছিল বেচারার। কিংবা হয়তো প্রচন্ড ক্ষুধা এবং ক্লান্তির জন্য রেললাইনের উপরেই শুয়ে পড়েছিল বেচারা, আর এ সময়েই ট্রেনটা চলে এসেছিল। যেভাবেই হোক, ক্রিসের কথাই ঠিক। ফলাফল একটাই ছিল: ধাম! ছেলেটা মারা গেছে। পুরো ব্যাপারটা ভাবতে গিয়ে মনে হলো, অসুস্থ বোধ করছি।

যাই হোক, তোরা দেখতে যাবি তো? ভার্ন প্রচন্ড উত্তেজনায় ঘরের ভেতরে যেভাবে লাফিয়ে বেড়াচ্ছিল, দেখে মনে হবে, ওর বুঝি এখনি বাথরুমে যাওয়া দরকার।

আমরা সবাই ওর দিকে দীর্ঘ এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলাম। কারো মুখে কোন কথা নেই। তারপর, ক্রিস ওর হাতের কার্ডগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলল, অবশ্যই! বাজি ধরে বলতে পারি, পত্রিকায় আমাদের ছবি আসবেই!

হ্যাঁ? ভার্নের কথা শেষ হওয়ার আগেই টেডিকে দেখা গেল, ট্রাকের সামনে থেকে ঝাঁপ দেওয়ার সময়কার বিচিত্র হাসিটা ওর মুখে ফুটে উঠেছে। আবারো বলল, কী?

ক্রিস ব্যাখ্যা করার জন্যে কার্ড-টেবিলের ওপর ঝুঁকে এল, দেখ, আমরা চাইলে কিন্তু ওর লাশটা খুঁজে বের করে রিপোর্ট করতে পারব।

তারমানে, আমাদেরকে খবরে দেখাবে!

আমি ঠিক নিশ্চিত না, ভার্নকে দেখে মনে হলো একটু আগের উত্তেজনাটা আর নেই। বিলি বুঝে ফেলবে, আমি কীভাবে জেনেছি। পিটিয়ে ভর্তা করে ফেলবে আমাকে।

না, করবে না, আমি বুঝিয়ে বললাম, কারণ, সে সময় ওই ছেলেটাকে খুঁজে বের করব আমরা। চুরি করা গাড়িতে করে বিলি আর চার্লি হোগান যে কাজ করে এসেছে, তার কথা কিন্তু কেউ জানবে না। কাজেই, এই নিয়ে ওদেরকে আর চিন্তাও করতে হবে না। বরং ওরা তোকে একটা মেডেল দিলেও দিতে পারে।

তাই? পোকা খাওয়া দাঁতগুলো বের করে হেসে ফেলল ভার্ন। কেমন অদ্ভুতুড়ে লাগল ওর হাসি দেখে। ওর কোনো কাজে বিলি খুশি হবে, এই ব্যাপারটা যেন থুতনিতে একটা বেমক্কা ঘুসি বসিয়ে দিয়েছে–সেই ঘুসি খেয়ে আনন্দে পাগলের মতো হাসছে ভার্ন। আসলেই তোদের তাই মনে হয়?

টেডিও দাঁত বের করে হাসছিল। পরমুহূর্তেই কেমন সন্ত্রস্ত গলায় বলে উঠল, ওহ! ওহ!

কী হলো? ভার্নের গলা শুনে বোঝা গেল, ভয়টা আবারও ফিরে আসছে ওর মধ্যে। ভাবছে, টেডি হয়তো পুরো চিন্তাটার আসল কোনো জায়গায় ঘাপলা খুঁজে পেয়েছে। কিংবা হয়তো টেডির মাথার ভেতরে কী খেলে গেছে, সেটা ভাবতে গিয়েই অমন হচ্ছিল ওর।

আমাদের বাবা-মা, টেডি ব্যাখ্যা করল, আমরা যদি কালকে ওই ছেলের লাশ দক্ষিণ হার্লোতে খুঁজে পাই, তারা জেনে যাবে যে, আমরা ভার্নদের পেছনের মাঠে ক্যাম্প করে রাত কাটাইনি।

একমত হলো ক্রিস, হ্যাঁ, তারা বুঝবে, আমরা ওই লাশের খোঁজে গিয়েছিলাম।

না, বুঝবে না। বলেই বুঝলাম, কেমন হাস্যকর ধরনের অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে আমার বুকের ভেতর। একই সাথে ভয় এবং উত্তেজনা বোধ। করছি। কারণ, বুঝতে পারছিলাম, ধরা না খেয়েই পুরো ব্যাপারটার ইতি টানা যাবে। মিশ্র অনুভূতির কারণে গরম হয়ে গেছে শরীর, টের পেলাম মাথার ভেতরে ঝাঁ ঝাঁ করছে। হাত দুটোকে ব্যস্ত রাখার জন্য কার্ডগুলো তুলে নিয়ে বাঁটতে শুরু করলাম। ক্রিবেজ খেলা আর এই কার্ড বাঁটাটুকুই বড় ভাই ডেনিসের কাছে শিখেছিলাম আমি। আমার বয়সি সবাই ব্যাপারটাকে ঈর্ষার চোখে দেখত। সবাই কখনো না কখনো আমাকে জিজ্ঞাসা করেছে, এর পেছনের রহস্য আসলে কী। কেবল ক্রিস বাদে। শুধু সে-ই বুঝেছিল ব্যাপারটা। প্রতিবার যখন কাউকে এর রহস্যটা দেখিয়ে দেই, ডেনিসের একটুকরো করে ছেড়ে দিতে হয় আমাকে। আর, সবাইকে দেওয়ার মতো ওর খুব বেশি অবশিষ্ট ছিল না আমার কাছে।

বললাম, আমরা বলব, ভার্নদের পেছনের উঠোনে এতবার তাঁবু খাঁটিয়ে থেকেছি যে, বিরক্তি চলে এসেছে। সেজন্য আমরা ভেবেছি, বনের রাস্তা ধরে একটু ভেতরে গিয়ে কোথাও ক্যাম্প করব। যেটা খুঁজে পেতে যাচ্ছি, সেটা নিয়ে সবাই এত উত্তেজিত থাকবে যে, আমি নিশ্চিত, কেউ আমাদের এসব নিয়ে মাথা ঘামাবে না।

বাবা ঠিকই ধরবে আমাকে, এ সময়টায় ওনার ব্যবহার খুবই খারাপ থাকে। বলেই হঠাৎ আনমনে মাথা ঝাঁকাল ক্রিস, জাহান্নামে যাক! যা হয় হোক, আমি যাব।

ওকে, টেড়ি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, তখনো পাগলের মতো দাঁত বের করে হাসছে। যে কোনো সময় ওর অদ্ভুতুড়ে উচ্চকিত হাসিতে ভেঙে পড়বে পড়বে অবস্থা। তাহলে সবাই দুপুরের খাবারের পরে ভার্নের বাসায় একসাথে হই, নাকি? কিন্তু, রাতের খাবারের কথা কী বলব বাসায়?

ক্রিস জবাব দিল, আমি, তুই আর গর্ডি বলব, আমরা ভার্নের এখানেই রাতে খেয়ে নেব।

আর, আমি আম্মুকে ক্রিসের বাসার কথা বলব, জানাল ভার্ন।

এই পরিকল্পনা কাজ না করার কোনো কারণ নেই, যদি না হঠাৎ করে কোনো জরুরি সমস্যা দেখা দেয় কিংবা আমাদের বাবা-মায়েদের দেখা হয়ে যায়। তাছাড়া ভার্ন এবং ক্রিসের বাসায় কোনো ফোনও নেই। সে সময় অনেক পরিবার ফোন চালানোকে বিলাসিতা ভাবত, বিশেষ করে যাদের মাস চলত টেনেটুনে। আর, আমাদের কেউই ঠিক উচ্চবিত্ত শ্রেণির ভেতরে পড়ত না।

আমার বাবা এরই মাঝে অবসর নিয়েছেন। ভানের বাবা তখনো কারখানায় কাজ করতেন, আর ১৯৫২ সালের একটা ডিসোটো চালাতেন।

টেডির মায়ের ড্যানবেরি রোডে একটা বাড়ি ছিল এবং সুযোগ পেলেই উনি পেয়িং গেস্ট রেখে দিতেন। সে গ্রীষ্মে তিনি তেমন কাউকে খুঁজে পাননি। সেবার ফার্নিশড ঘর ভাড়া হবে লেখা সাইনবোর্ডটা জুন পর্যন্ত পার্লারের দেয়ালে ঝুলেছে। এদিকে ক্রিসের বাবার মেজাজ প্রায় সারাক্ষণই প্রচন্ড চড়ে থাকত। প্রায় সারাদিনই কম-বেশি মাতাল হয়ে থাকতেন। মোটামুটি নিয়মিতভাবে কল্যান সমিতির একটা ভাতা পেতেন তিনি। তাই নিয়ে এইস মেরিলের বাবা জুনিয়র মেরিল, আর কিছু স্থানীয় মদ্যপের সাথে মিলে বেশিরভাগ সময়টাই কাটাতেন সাকিস ট্যাভার্ন নামের এক বারে।

ক্রিস ওর বাবাকে নিয়ে তেমন কিছু বলতো না। কিন্তু সবাই জানতাম, বাবাকে সে বিষের চেয়েও বেশি ঘৃণা করে। কমবেশি প্রতি দুই সপ্তাহ অন্তর ওর শরীরে দাগ পড়ে থাকতে দেখা যেত কখনো থুতনিতে, কখনো ঘাড়ে। কখনোবা চোখ ফুলে গিয়ে অস্তগামী সূর্যের রং ধারণ করত। একবার ক্রিস মাথার পেছনে ভয়ংকর এক ব্যান্ডেজ নিয়ে স্কুলে এসেছিল। অন্যান্য সময় সে স্কুলে আসতেও পারত না। আসার মতো অবস্থাই থাকতো না, বাধ্য হয়ে ওর মা ফোন দিয়ে অসুস্থতার কথা বলে ছুটি চেয়ে নিতেন। ক্রিস এমনিতে যথেষ্ট স্মার্ট ছিল, কিন্তু সে প্রায়ই স্কুল ফাঁকি দিত। আর আমাদের শহরের স্কুল ফাঁকি মারা বন্ধ করার জন্য নিয়োজিত অফিসার, মিস্টার হ্যাঁলিবার্টন নিজের কাল শেভ্রোলে চালিয়ে নিয়মিত ক্রিসের বাসায় ফুঁ দিয়ে যেত। সেই শেভ্রোলের উইন্ডশিন্ডে যাত্রী পরিবহণের জন্য নয়- লেখা একটা স্টিকার লাগানো থাকতো সবসময়। হ্যাঁলিবার্টনকে আমরা বলতাম বার্টি, যদিও সামনা-সামনি কখনো বলিনি। তো, ক্রিস যদি কখনো স্কুল পালিয়ে বার্টির হাতে ধরা পড়ে যেত, সে তখন ক্রিসকে ধরে স্কুলে নিয়ে যেত এবং নিশ্চিত করত, ক্রিস যেন অন্তত এক সপ্তাহের ডিটেনশন বা অতিরিক্ত ক্লাস পায়। কিন্তু যেদিন সে এসে দেখত, বাবার কাছে মার খেয়ে ছেলেটা বাসায় পড়ে আছে, সেদিন আর সে কাকপক্ষীর কানে টু শব্দটাও করত না, চুপচাপ কেটে পড়ত। পরবর্তী বিশ বছর পেরোনোর পরে প্রথম আমার মাথায় এসব অন্যায় প্রায়োরিটি নিয়ে প্রশ্ন জাগতে শুরু করে।

বছরখানেক আগে ক্রিসকে দুই সপ্তাহের জন্য স্কুল থেকে সাসপেন্ড করা হয়। সে সময় ক্রিস রুম-মনিটরের দায়িত্ব পেয়েছিল। কাজ ছিল, টাকা সংগ্রহ করে দুধ কেনা এবং ক্লাসের সবাই যেন খায়, সেদিকে খেয়াল রাখা। এই দুধ কেনার কিছু টাকা সে সময় গায়েব হয়ে গিয়েছিল। অনির্ভরযোগ্য চেম্বার্সদের একজন হওয়ার অপরাধে বারবার কসম করে টাকা নেওয়ার ব্যাপারে নিজেকে নির্দোষ দাবি করার পরেও, সবকিছু মেনে নিয়ে ক্রিসকে চুপচাপ বেরিয়ে যেতে হয়েছিল স্কুল থেকে। ওর বাবা যখন এ খবর শুনলেন, উল্টো ওকে পিটিয়ে নাক আর ডান হাতের কব্জি ভেঙে ফেললেন। সে সময় তাকে এক রাতের জন্য হসপিটালে ভর্তি হয়ে থাকতে হয়েছিল।

.

ক্রিস খুব বাজে এক পরিবার থেকে এসেছিল, এবং সবাই একরকম ধরেই নিয়েছিল সে নিজেও সময়ের সাথে সাথে অমন বাজে একজনই হয়ে উঠবে। এমনকি সে নিজেও সেভাবেই ভাবতে শুরু করেছিল। ততদিনে ওর বড় ভাইয়েরাও শহরের সবার আশানুরূপ জীবন যাপন করতে শুরু করেছে। সতের বছর বয়সে সবার বড় ডেভ বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে নেভিতে যোগ দেয় এবং শেষ পর্যন্ত গিয়ে পড়ে পোর্টসমাউথ জেলে। দীর্ঘ সময়ের জন্য যাবজ্জীবন দন্ড দেওয়া হয়েছিল তাকে, অপরাধ ছিল ধর্ষণ এবং সন্ত্রাসবাদ। তারপরেরজন রিচার্ড, যার ডান চোখ খুবই হাস্যকররকম নার্ভাস দেখানোর ফলে সবাই আইবল বলে ডাকত। দশম গ্রেডে উঠে স্কুল বাদ দিয়ে সে আবার চার্লি, বিলি টেসিওদের সাথে মিশতে শুরু করে ভবঘুরে হয়ে গেল।

ক্রিসকে বললাম, আমাদের পরিকল্পনা মনে হয় ভালোই কাজ করবে। জন আর মার্টি যাবে? জন আর মার্টি ডিস্পেন আমাদের দলের দুই নিয়মিত সদস্য।

সোমবারের আগে তো আসবে না।

তাহলে আর কী? ওদের কপাল খারাপ।

আমরা তাহলে যাচ্ছি? ভার্নকে দেখে বোঝা গেল, এখনো অস্বস্তিতে ভুগছে। চাচ্ছে, আলোচনা যেন এক মিনিটের জন্যেও অন্য কোনোদিকে মোড় না নেয়।

জবাব দিল ক্রিস, মনে তো হয়। তা, আরেকদান স্ক্যাট খেলা যাক, কী বলিস?

কিন্তু কেউ রাজি হলো না। সবাই অনেক উত্তেজিত হয়ে আছে। ট্রি হাউজ থেকে নেমে, বেড়া টপকে চলে গেলাম পাশের খালি জায়গাটায়। ভার্নের পুরনো টেপ মারা বেসবল দিয়ে তিন-মাছি-ছয়-ভূত খেলা হলো কিছুক্ষণ, যদিও খেলে মজা পাচ্ছিলাম না কেউই। মন পড়ে আছে। ব্রাওয়ারের চিন্তায়। ছেলেটা ট্রেনের ধাক্কা খেয়ে পড়ে যে আছে, ওকে, কিংবা দেহাবশেষ যেটুকু আছে–আমরা গিয়ে কী অবস্থায় দেখব–সেটাই ভাবছিলাম। দশটার দিকে সবাই বাসার পথ ধরলাম। আগে বাবা-মার সাথে বোঝাপড়া করে না নিলে শান্তি পাচ্ছি না।

অধ্যায় ৬

বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে সোয়া এগারোটা বেজে গেল। মাঝরাস্তায় একবার অবশ্য ড্রাগস্টোরে নতুন পেপারব্যাক বই কী এসেছে, খোঁজ নেওয়ার জন্য থেমেছিলাম। নতুন জন ডি ম্যাকডোনাল্ডসের খোঁজে কয়েকদিন পরপর ওখানে যাওয়াটা আমার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। এক সিকি ছিল আমার কাছে। ভেবেছিলাম, নতুন কোনোটা আসলে নিয়ে নেব, কিন্তু পুরনোগুলোই কেবল পড়ে ছিল। এর প্রত্যেকটা আমি অন্তত হাফ ডজনবার করে পড়েও ফেলেছি।

বাসায় এসে দেখি, গাড়িটা নেই। মনে পড়ল, আম্মু তার দলবল নিয়ে একটা কনসার্ট দেখতে বোস্টনে গেছে। আমার মা প্রচন্ড কনসার্ট-ভক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। স্বাভাবিক, তাঁর একমাত্র ছেলে যেহেতু মরেই গেছে, কিছু করে মনকে সেদিক থেকে ফিরিয়ে রাখতে তো হবে।

জানি, শুনতে প্রচন্ড নির্মম লাগছে। আমার জায়গায় থাকলে আপনি হয়তো বুঝতেন, কেন আমি অমন করে ভাবতাম।

বাবা তখন বাসার পেছনের মরা বাগানে হোস পাইপ দিয়ে পানি দিচ্ছিলেন। তাঁর বিবর্ণ মুখ দেখে যদি মরা বাগানের ব্যাপারটা বোঝা নাও যায়, বাগানের দিকে তাকালেই খুব ভালোভাবে বোঝা যাবে। ধুসর, গুড়োগঁড়ো ঝরঝরে মাটি। ভুট্টা ছাড়া আর সবকিছু কবেই মরে গেছে। এই ভুট্টাও একজনের খাওয়ার মতো বড় হয়নি জীবনেও। বাবার ভাষ্যমতে, বাগানে পানি দেওয়ার ব্যাপারে কিছুই জানেন না তিনি। বাগান বাঁচাতে হয় স্বয়ং প্রকৃতিকেই হাত বাড়িয়ে দিতে হতো, নাহয় কাজের কাজ কিছুই হতো না। দেখা যেত, এক জায়গায় পানি দিয়ে ডুবিয়ে ফেলেছেন, তো আরেক সারির সব গাছ পানির অভাবে মরছে। কোনোভাবেই সমন্বয় করতে পারতেন না তিনি, অবশ্য তেমন কথাও বলতেন না এই নিয়ে। এক ছেলেকে এপ্রিলে হারিয়েছিলেন, বাগান হারিয়েছেন আগস্টে। তারপরেও যদি তাঁর এ দুটোর কোনোটা নিয়েই কথা বলতে ইচ্ছে না হয়, তাহলে সেটাকে তাঁর সৌভাগ্যই বলা উচিত। কিন্তু যে জিনিসটা ভালো লাগত না, সেটা হচ্ছে, আর কিছু নিয়েও কথা বলতেন না তিনি। বলার তো কিছু নেই, ব্যক্তিস্বাধীনতাকে আকাশে উঠিয়ে ফেললে যা হয় আরকি।

পাশে দাঁড়িয়ে বললাম, হাই বাবা! ড্রাগস্টোর থেকে নিয়ে আসা হাতের রোলোস দেখিয়ে বললাম, একটা নাও?

না। ধন্যবাদ। তিনি তখনো আগের মতোই নিঃস্ব ধুসর মাটিতে পানি দিয়ে যাচ্ছেন।

ভার্ন টেসিওদের বাড়ির পেছনের মাঠে কয়েকজন মিলে ক্যাম্প করব ভাবছি। আপত্তি নেই তো, না?

কারা এরা?

ভার্ন। টেডি ডুশ্যাঁ। ক্রিসও থাকতে পারে। বলতে বলতে ভাবছিলাম, এখনই বুঝি ক্রিসকে নিয়ে উপদেশ দেয়া শুরু হয়ে যাবে যে, ক্রিস আসলে অসৎ সঙ্গ। ঝুড়ির তলায় পড়ে থাকা পঁচা আপেল। চোর, এই কিশোর বয়সেই ভয়াবহ সব অপরাধ করে বসে আছে। কিন্তু বাবা মৃদু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ঠিক আছে, যাও।

গ্রেট! অনেক ধন্যবাদ!

ঘুরে ঘরের দিকে পা বাড়ালাম। ভাবছি, টিভিতে কী চলছে, গিয়ে দেখা যাক; এমন সময় বাবার গলা শুনে থেমে যেতে হল, গর্ডন, তুমি কেবল এই ছেলেগুলির সাথেই সময় কাটাতে চাও, তাই না?

ঘুরে তাকালাম, মনে মনে তর্কের প্রস্তুতি নিচ্ছি। কিন্তু ওনার চেহারায় তর্কের কোনো ছাপ ছিল না। এখন ভাবলে মনে হয়, থাকলেই বোধ হয় ভাল হতো। কাঁধ ঝুলে পড়েছে, আমার দিকে না তাকিয়ে মৃত বাগানের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। কেমন অতিলৌকিক এক ঝিলিক খেলা করছিল চোখে। ওগুলি কী? অশ্রু?

মানে আরকি–

একজন তো চোর, আর বাকি দুটো অকর্মার চেঁকি। আমার ছেলের কী চমৎকার বন্ধুভাগ্য!

ভার্ন টেসিও মোটেও অকর্মার চেঁকি না। এটুকু বলেই থেমে যেতে হলো। টেডিকে নিয়ে তর্ক করার কোনো অর্থ নেই আসলে।

বাবা জবাবে বলেছিলেন, বয়স বারো হয়ে গেছে, অথচ এখনো পঞ্চম গ্রেডে। আর, সেবার সে যখন বাসায় এসে রাতে থেকে গেল, পরেরদিন, রবিবারের পত্রিকার কৌতুকের পাতাটা সে দেড়টা ঘন্টা ধরে পড়েছে।

প্রচন্ড রাগ হচ্ছিল আমার। মনে হচ্ছিল, বাবা কাজটা ঠিক করছেন না। আমার বন্ধুদেরকে বাসায় আসা-যাওয়ার সময় ছাড়া বলতে গেলে দেখেনই নি। অথচ আমার অন্যান্য বন্ধুদেরকে তো বটেই, ভার্নকেও সেভাবে জাজ করছিলেন। ভুল করছিলেন। আর, ক্রিসকে যখন চোর বললেন, রাগে-দুঃখে চোখে লাল রং ছাড়া আর কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না আমি। ক্রিসের ব্যাপারে কিছুই তো জানেন না। বলতে চাচ্ছিলাম ওনাকে কথাগুলো। কিন্তু ক্ষেপিয়ে দিলে আবার বাসা থেকে যদি বের হতে না দেন, সেজন্য কিছু বলিনি। তাছাড়া, উনি ঠিক রাগ করে ছিলেন না। রাগ মানে, রাতের খাবারের সময় মাঝে মাঝে যা করেন। এত জোরে চিৎকার করতেন যে, সবাইকে খাবার ফেলে উঠেই যেতে হতো। ওনাকে কেবল প্রচন্ড ক্লান্ত আর অসুখি মনে হচ্ছিল। বয়স তেষট্টি হয়ে গেছে; সত্যি বলতে, বয়সে ওনার আমার দাদা হওয়া উচিত ছিল। আম্মুর বয়সও যে কম ছিল, তা না। পঞ্চান্নতে পা দিয়ে ফেলেছেন এরইমধ্যে। বিয়ের পরপরই তাঁরা বাচ্চা নিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। আম্মু অন্তঃসত্ত্বাও হয়েছেন, কিন্তু সেই বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তারপর আরও দুটো বাচ্চা নষ্ট হয়েছে এবং ডাক্তার বলে দিয়েছেন, ঠিকঠাক বাচ্চা নেওয়ার সম্ভাবনা তাঁর নেই বললেই চলে। আমি এর প্রতিটি জিনিস, প্রতিটি অধ্যায়, প্রতিটি লাইনসহ জানি। তাঁদের যেকোনো একজন যখনই আমাকে লেকচার দেওয়া শুরু করতেন, বুঝতেই পারছেন, বিস্তারিত সব না বলে কোনোভাবেই থামতে পারতেন না। বেয়াল্লিশ বছর বয়সি আমার বুড়োতে শুরু করা মায়ের পেটে আসা আমি যে স্রষ্টার বিশেষ দান এবং আমি যে আমার এই পরম সৌভাগ্যের মর্ম যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে পারছি না–এটা তাঁরা আমাকে প্রায়ই বোঝাতে চাইতেন। শুধু তাই নয়, আম্মুর অসম্ভব কষ্ট এবং ত্যাগের মর্মও যে আমি বুঝতে পারছি না, সেটাও তাঁরা বলতেন।

ডাক্তাররা বাচ্চা হবে না বলে জানিয়ে দেওয়ার পাঁচ বছর পরে তাঁর পেটে ডেনিস আসে। আট মাস পেটে থাকার পরে হুট করে বেরিয়ে চলে এসেছিল। পুরো আট পাউন্ড। বাবা বলে বেড়াতেন, বাচ্চা পুরো সময় পেটে থাকলে হয়তো পনের পাউন্ড হয়ে বেরুত। ডাক্তাররা এবারে বললেন, প্রকৃতি মাঝে মাঝে আমাদেরকে বোকা বানাতে পারে ঠিকই, কিন্তু এরপরে আর বাচ্চা হওয়ার একদমই সম্ভাবনা নেই। কাজেই, খোদাকে ধন্যবাদ দিয়ে এক বাচ্চা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকুন। তার দশ বছর পরে আমি পেটে আসলাম। আমি যে শুধু পুরো সময় পেটে ছিলাম, তাই না; আমাকে বের করতে হয়েছে পেট কেটে। এরকম অসহ্য অবস্থায় আছে, এমন কোনো পরিবারের কথা কখনো শুনেছেন? এমন এক পৃথিবীতে আমি এসেছি, যেখানে দুই বাচ্চা আগেই মারা গেছে–এই নিয়ে দিনের পর দিন ওয়াজ তো লেগে ছিলই, তার ওপর আমার ডায়াপার পরার বয়স শেষও হয়নি; আমার বড় ভাই ততদিনে এলাকার বড় ছেলেদের সাথে পাড়ার মাঠে বেসবল খেলাও শুরু করে দিয়েছে। বাবা-মার কথা বললে, স্রষ্টার একবারের উপহারই ওনাদের জন্য যথেষ্ট ছিল। মারা তো দূরের কথা, তাঁরা কখনো খারাপ ব্যবহারও করেননি আমার সাথে; কিন্তু তাঁদের জন্য আমি ছিলাম ভয়াবহ এক চমক। আর, বিশ বছর বয়সে হঠাৎ কোনো চমকে দেওয়া উপহার পেলে মানুষ যেরকম আনন্দিত হয়, চল্লিশে সম্ভবত তেমনটা আর হয় না। এমনকি আমার জন্মের পরে আম্মু অপারেশনও করিয়েছেন, পাড়ার আন্টিদের ভাষায় যাকে বলে জায়গামতো ব্যান্ডেজ মেরে দেওয়া। যথাসম্ভব, এইবেলা এসে তিনি শতভাগ নিশ্চিত হয়ে নিতে চেয়েছিলেন, স্রষ্টা যেন ভুল করে আর কোনো উপহার দিয়ে দিতে না পারেন। কলেজে ওঠার পর আবিষ্কার করলাম, একেবারে গাধা হয়ে যে জন্মাইনি, সেটাই আমার পরম সৌভাগ্য। তবে ভার্নকে বিটল বেইলির ডায়ালগ বুঝতে গিয়ে দশ মিনিটের মতো সময় নিতে দেখে বাবা সম্ভবত আমার ব্যাপারেও সন্দেহ করা শুরু করেছিলেন। যাই হোক, এই যে আমাকে বাসার সবার এড়িয়ে চলা, হাইস্কুলে থাকতে অদৃশ্য মানব নামের একটা বইয়ের উপর প্রতিবেদন না লিখলে সম্ভবত এর কিছুই সেভাবে বুঝতাম না আমি। মিস হার্ডির কথায় আমি যখন এই বই নিয়ে কাজ করতে রাজি হয়েছিলাম, ভেবেছি, এটা বুঝি সেই বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর বই। একজন লোক যে ব্যান্ডেজ পরে অদৃশ্য হয়ে থাকে, সেটা। এ নিয়ে আবার মুভিও হয়েছিল। ফস্টার গ্র্যান্টস-ক্লড রেইন মুভিতে এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন। পরে যখন বুঝলাম, এটা আসলে অন্য এক গল্প, তখন বই ফেরত দিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মিস হার্ডি আমাকে ছাড়েননি। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত খুশিই হয়েছি এটা নিয়ে কাজ করে। এই বইয়ের অদৃশ্য মানব এক নিগ্রো লোক। বিশাল কোনো ঝামেলা না পাকালে যাকে কেউ পাত্তাই দেয় না। সামনে দিয়ে গেলে চোখ ফিরিয়ে দেখে না, কথা বললে শোনে না, জবাব দেওয়া তো আরো দূরের কথা। লোকটা যেন মানুষ না, কালো ভূত। একবার শুরু করার পর পুরো বই আমি এমনভাবে গিলেছি যেন, বইটা জন ডি ম্যাকডোনাল্ডেরই লেখা। কারণ, পড়ার সময় মনে হচ্ছিল, র‍্যালফ এলিসন বইটা ঠিক আমার কথা ভেবেই লিখেছেন। রাতের খাবারের টেবিলে সবকিছুই ছিল ড্যানি-কেন্দ্রিক ড্যানি, তুমি কয়বার বলটাকে লাইনের ওপাশে পাঠিয়েছ? ড্যানি, তোমাকে স্যাডি হপকিন্স ড্যান্সে সাথে যাওয়ার জন্য কে প্রস্তাব দিয়েছে? কিংবা, ড্যানি, আমরা যে সেই গাড়িটা দেখেছিলাম, আসো সেটা নিয়ে বাপ-ব্যাটা একটু গল্প করা যাক। আমি হয়তো বললাম, কেউ আমাকে একটু মাখনটা দাও, নিশ্চিতভাবেই দেখা যাবে বাবা বলছেন, ড্যানি, তুমি নিশ্চয়ই আর্মিতেই যোগ দিতে চাও?

আমি হয়তো গলা আরেক পর্দা চড়িয়ে বললাম, দয়া করে কেউ আমাকে মাখনটা দাও আম্মা সেই মুহূর্তেই ড্যানিকে জিজ্ঞাসা করবেন, ডাউনটাউনে ছাড়ে যে প্যান্ডেলটন শার্টগুলো বিক্রি হচ্ছে, ওর একটা ড্যানির জন্য আনবেন কি না। দেখা যেত, মাখন শেষ পর্যন্ত উঠে গিয়ে আমার নিজেকেই নিতে হতো। আমার বয়স যখন নয়, কী হয় সেটা দেখার জন্য একরাতে চিৎকার করে আমি বলেছিলাম, খোদার দোহাই লাগে, আমাকে আলুগুলি দাও! আম্মা উত্তরে বলছিলেন, ড্যানি, তোমার গ্রেস আন্টি আজকে কল দিয়েছিল। তোমার আর গর্ডনের কথা জিজ্ঞাসা করছিল খুব।

ড্যানি যে রাতে ক্যাসল রক হাইস্কুল থেকে অনার্স শেষ করে গ্র্যাজুয়েট হলো, সে রাতে আমি অসুস্থতার ভান করে বাসায় রয়ে গিয়েছিলাম। স্টিভি ডারবোন্টসের বড় ভাই রয়েসকে দিয়ে এক বোতল ওয়াইল্ড আইরিশ রোজ কিনিয়ে, ওর অর্ধেক বোতল খেয়ে মাঝরাতে বমি করে বিছানা ভাসিয়ে ফেলেছিলাম। পরিবারের এই দশা হলে আপনি হয় বড়ভাইকে ঘৃণা করবেন, নাহয় তাকে মহান ব্যক্তিত্বের মতো করে ভক্তি করতে থাকবেন–অন্তত কলেজে মনোবিজ্ঞান পড়ানোর সময় তো এটাই শেখায়, তাই না? এক্কেবারে ফালতু কথা। যদ্দর মনে পড়ে, ড্যানিসকে আমি এই দুভাবের একভাবেও দেখিনি। আমাদের তর্কই হয়েছে হাতে গোণা কয়েকবার, আর হাতাহাতি মারামারি হয়ইনি কখনো। আসলে, মারামারির চিন্তাটাই হাস্যকর। চৌদ্দ বছরের কেউ অকারণ অজুহাত খুঁজে বের করে চার বছরের পিচ্চিকে পেটাবে–এমনটা আপনি নিজেও কখনো হতে দেখেছেন বলে মনে হয় না। আর, আমাদের বাবা-মা ওর ব্যাপারে এত বেশিই মুগ্ধ ছিলেন। যে, ছোটভাইকে দেখাশোনা করতে ওকে কখনো বাধ্য করেননি। কাজেই, দেখাশোনা করতে গিয়ে বড়ভাইদের ছোট ভাই-বোনের ওপর যেরকম ক্ষোভ তৈরি হয়, আমার উপরে ওর তেমন কোনো ক্ষোভ তৈরি হয়নি। ড্যানি যখন আমাকে সাথে করে কোথাও নিয়ে যেত, নিজের ইচ্ছায় নিয়ে যেত। ভালো স্মৃতির কথা ভাবতে গেলে মনে হয়, ওই সময়গুলিই আমার জীবনে সবচেয়ে চমৎকার সময় ছিল।

লুশ্যান্সের বাচ্চা, তোর সাথে এটা কে?

আমার ছোট ভাই। আর, মুখ সামলে কথা বল, ডেভিস। নাহলে ও তোকে পিটিয়ে ভর্তা করে ফেলবে। গর্ডি যথেষ্ট শক্তপোক্ত, বুঝেছিস?

কয়েক মুহূর্তের জন্য সবাই আমার চারপাশে জড়ো হয়ে যেত। বিশালদেহী, অসম্ভব লম্বা সব মানুষের কাছে সূর্যও ঢাকা পড়ে যেত, এমন অবস্থা।

হেই! এই মিচকা শয়তান আসলেই তোমার ভাই?

লজ্জা পেতাম খুব, মাথা নেড়ে সায় দিতাম আস্তে করে।

আসলেই একটা হারামজাদা, তাই না?

আমি আবারো সায় দিতাম। ড্যানিস সহ সবাই একসাথে আকাশ কাঁপিয়ে হেসে উঠত। তারপর ড্যানি দ্রুত দুইবার হাততালি দিয়ে বলত, কাম অন! আমরা কি অনুশীলন করব, নাকি বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকব সারাদিন?

কথা শুনে সবাই দৌড়ে নিজের জায়গায় গিয়ে দাঁড়াত, সাথে চলত বল ছোঁড়াছুড়ি, অনুশীলনের প্রস্তুতি।

গর্ডি, ওই বেঞ্চে গিয়ে বসো। কাউকে জ্বালাতন করো না, হ্যাঁ?

আমি বেঞ্চে গিয়ে দ্রভাবে বসে থাকতাম। গ্রীষ্মের মিষ্টি মেঘের নিচে নিজেকে আমার অসম্ভব ক্ষুদ্র মনে হতো। বসে বসে বড় ভাইকে পিচ করতে দেখতাম। কাউকে জ্বালাতাম না।

কিন্তু এমন খুব বেশি সময় আসেনি আমার জীবনে।

কখনো কখনো সে গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিত আমাকে। সেসব গল্প আমার মায়ের শোনানো গল্পের চেয়ে ঢের ভালো ছিল। আম্মু সবসময় জিঞ্জারবার্ড ম্যান বা থ্রি লিটল পিগসের গল্প শোনাত, শোনানোর জন্য শোনানো আরকি। আর ড্যানির গল্পের বিষয় ছিল ব্লু-বিয়ার্ড বা জ্যাক দ্য রিপার। বিলি গোটের গ্রাফকে নিয়ে যে গল্পটা আছে, সেটাও নিজের মতো করে শোনাত সে। সেই গল্পে ব্রিজের নিচের ট্রলটি শেষ পর্যন্ত জিতে যেত। সে যে আমাকে ক্রিবেজ খেলতে এবং বক্স শাফল করে তাস বাঁটতে শিখিয়েছে, সে কথা তো আমি এরইমধ্যে বলেই ফেলেছি। খুব বেশি না, কিন্তু এই নির্মম পৃথিবীতে আপনি সামান্য যেটুকু পাবেন, সেটুকুই তো আপন করে নেবেন, তাই না?

বয়স বাড়ার সাথে সাথে ড্যানিসের জন্য আমার যে ভালোবাসা ছিল, সেটা বদলে গিয়ে অদ্ভুত এক ধরনের করুণায় পরিণত হলো। আমার ধারণা, বেশিরভাগ খ্রিস্টানরাই ঈশ্বরের জন্য ঠিক এ ধরনের একটা কিছু অনুভব করে। আর ড্যানি যখন মারা গেল, আমি কিছুটা স্তম্ভিত এবং খানিকটা দুঃখ অনুভব করেছিলাম। কল্পনা করতে পারি, টাইম ম্যাগাজিন যখন ঘোষণা দিল, ঈশ্বর মারা গেছেন, তখন সেই ধার্মিক খ্রিস্টানরাও নিশ্চিত এমন কিছুই অনুভব করেছিলেন। এভাবে বললে কথাটা মনে হয় আরেকটু ভালো বোঝা যাবে: রেডিওতে ড্যান ব্লকারের মৃত্যু সংবাদ শুনে আমি যেমন দুঃখ পেয়েছিলাম, ড্যানিসের মৃত্যুতেও আমি তেমনই কষ্ট পেয়েছি। দুজনকেই আমি মোটামুটি একই হারে দেখে দেখে বড় হয়েছি, এবং দুজনই আমার জন্য ছিল একই দূরত্বের মানুষ।

ড্যানিকে একটা বন্ধ কফিনে করে দাফন করা হয়। দাফনের আগে কফিনের উপরে একটা আমেরিকান পতাকা রাখা ছিল (বাক্সটা মাটিতে নামানোর আগে আগে তারা পতাকাটা সরিয়ে ফেলেছিল। তারপর সেটাকে ভাঁজ করে তিনকোনা কোকড হ্যাঁটের মতো বানিয়ে আম্মাকে দিয়ে গিয়েছিল)। আমার বাবা-মা একদম ভেঙে পড়েছিল। ছয়মাসেও তারা নিজেদের এই ভাঙাচোরা অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারেনি, এবং তাদের অবস্থা দেখে আমি ঠিক বুঝতে পারতাম না, তারা আদৌ আর কখনো আগের মত পরিপূর্ণ অনুভব করতে পারবেন কি না। দেখে মনে হতো, মিস্টার এবং মিসেস ডাম্পটি। আমার ঘর থেকে এক দরজা পরেই ছিল ডেনিসের ঘর। সে ঘরের দেয়াল, খাট, আলমারি–সবকিছু দেখেই মনে হতো, সব বুঝি থমকে গেছে। কিংবা সময় চক্রে পড়ে থেমে গেছে সময়। দেয়ালে ঝোলানো কলেজ আইভি লিগের ছোট পতাকা এবং আয়নায় ঝোলানো মেয়েদের ছবি। ড্যানিসের প্রাক্তন প্রেমিকা ছিল ওরা। এই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে এত সময় নিয়ে চুল ডাকটেইল করে এলভিসের মতো করত যে, মনে হতো বুঝি ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। ডেস্কে স্তূপাকারে পড়ে আছে ট্রুস এবং স্পোর্ট ইলাস্ট্রেটেডের কপি। সময়ের সাথে সাথে পত্রিকাগুলো পুরাকীর্তিতে পরিণত হচ্ছিল। এরকম জিনিস সাধারণত সস্তা সেন্টিমেন্টাল মুভিতে দেখা যায়। কিন্তু পুরো ব্যাপারটা কোনোদিক থেকেই আমার জন্য সেন্টিমেন্টাল ছিল না। দিনদিন সবকিছু ভয়াবহরকম বীভৎস হয়ে উঠছিল চোখের সামনে। একেবারে বাধ্য না হলে ওই রুমেও যেতে পারতাম না আমি। বারবার মনে হতো, দরজার পেছনেই ড্যানি দাঁড়িয়ে আছে। কিংবা ঘাপটি মেরে আছে খাটের নিচে কিংবা আলমারির ভেতরে।

আলমারির দেরাজের কথাই বেশিরভাগ সময় ঘুরপাক খেত আমার মনে। আম্মা যদি তার দুঃখবিলাসের জন্য আমাকে ড্যানির পোস্টকার্ড এলবাম কিংবা ছবি জমিয়ে রাখার জুতার বাক্স এনে দিতে বলত, দেরাজের সামনে ভয়ে ভয়ে দাঁড়িয়ে থেকে কল্পনায় দেখতে পেতাম, ওটা আস্তে করে খুলে যাচ্ছে এবং তীব্র আতঙ্কে জমে গিয়ে আমি স্থির দাঁড়িয়ে আছি। কল্পনায় ড্যানিকে মনে হতো অন্ধকারের মাঝে ফ্যাকাশে, রক্তাক্ত এক অবয়ব, যার মাথার একপাশ ঘেঁতলে গেছে। গায়ের শার্টে একতাল ধুসর রক্ত আর মগজের মিশ্রণ শুকিয়ে লেগে আছে। রক্তাক্ত একটা হাত উঠে আসছে ধীরে ধীরে, হাতের নখগুলো বদলে গিয়ে পরিণত হয়েছে হিংস্র নখরে। কর্কষ অশুভ স্বরে চিৎকার করে উঠত অতিলৌকিক অবয়বটা, এই অবস্থা তো তোর হওয়ার কথা ছিল, গর্ডন। তোর হওয়ার কথা ছিল!

অধ্যায় ৭

স্টাড সিটি, লেখক: গর্ডন লুশ্যান্স। ১৯৭০ সালের শরষ্কালে পাক্ষিক গ্রীনস্পন কোয়ার্টারলির ৪৫তম সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল গল্পটি। লেখকের অনুমতি সাপেক্ষে গল্পটি এখানে অন্তর্ভুক্ত করা হলো।

.

মার্চ।

চিকো একটু বাঁকা হয়ে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বিবস্ত্র, দৃষ্টি বাইরের দিকে। দুই হাত বুকের উপরে বাঁধা। জানালার দুটো অংশ, ওপর আর নিচের অংশের মাঝে কাঠের ফ্রেম। ওর কনুইদুটো সেই ফ্রেমের উপরে রাখা। জানালার কাঁচে ফেলা নিশ্বাস কুয়াশার প্রলেপ সৃষ্টি করছে। পেটের সামনে পড়ে আছে খসড়া কাগজ।

জানালার নিচের অংশের কাঁচ খুলে গেছে। সে অংশটা একখন্ড কার্ডবোর্ড দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে।

চিকো।

সে ঘুরে তাকাল না। মেয়েটিও আর কিছু বলল না। মেয়েটির প্রতিচ্ছবি দেখা যাচ্ছে জানালার কাঁচে। ওর বিছানায় বসে আছে, মহাকর্ষের বাধা অগ্রাহ্য করে কম্বলটাকে গায়ে টেনে রেখেছে। চোখের মেকআপ এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। দেখে মনে হচ্ছে, চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে।

চিকোর দৃষ্টি মেয়েটার প্রতিচ্ছবিকে ছাড়িয়ে গেল। আরো দূরে, বাড়ির বাইরে, বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টির জন্য বরফের আস্তরণ ধুয়ে যাচ্ছে, বেরিয়ে পড়ছে নিচের মাটি। গত বছরের মৃত ঘাস চোখে পড়ছে। বিলির একটা প্লাস্টিকের খেলনা মই পড়ে আছে ওর মাঝে। ওর ভাই জনির ডজ গাড়িটা পড়ে আছে এককোণে। টায়ারবিহীন চাকাগুলোর কঙ্কাল বেরিয়ে পড়েছে। সে সময়ের কথা মনে পড়ে গেল, যখন দুই ভাই মিলে জনির পুরনো ট্রানসিস্টর রেডিওতে নতুন সুপারহিট গানের সাথে লিউইস্টনের ডব্লিউএলএএম রেডিও স্টেশন থেকে ভেসে আসা পুরনো দিনের বিখ্যাত গানগুলো শুনতে শুনতে একসাথে গাড়ি সারানোর কাজ করত। এভাবে কাজ করার সময় জনি কয়েকবার ওকে বিয়ারও খেতে দিয়েছে। এ সময় জনি বলত, দেখবি, কী জোরে ছোটে! গেটস ফলস থেকে ক্যাসল রকের মাঝে যা কিছু আছে, ছুট দিলে সব একেবারে খেয়ে নেবে, বুঝলি চিকো? আমরা কেবল নতুন ইঞ্জিনটা লাগিয়ে নেই, দাঁড়া!

কিন্তু সেটা পুরনো দিনের কথা। এখন আর সেই দিন নেই।

জনির উজ পেরিয়ে গেলে হাইওয়ে চোখে পড়ে। রোড চৌদ্দ, যেটি পোর্টল্যান্ড এবং দক্ষিণ নিউ হ্যাঁম্পশায়ারে গিয়ে উঠেছে। আর আপনি যদি ইউএস-১ রোড ধরে থমাসটনের ওখানে বামে মোড় নেন, তাহলে সোজা সেই উত্তর কানাডায় গিয়ে উঠতে পারবেন চাইলে।

চিকো গ্লাসের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল, স্টাড সিটি। তারপর হাতের সিগারেটে আরেকটা টান দিল।

কী?

কিছু না, জান।

চিকো? গলা শুনে বোঝা গেল, মেয়েটা একটুখানি হকচকিয়ে গেছে।

বাবা ফেরার আগে চিকোকে আবার বিছানার চাদর পাল্টাতে হবে। মেয়েটার রক্তপাত হয়েছে।

কী?

ভালোবাসি।

ঠিক আছে।

নোংরা মার্চ। সে ভাবছিল, তুই একটা নষ্টা মেয়ে। বেঢপ স্তন আর বুড়িয়ে যাওয়া মার্চের মতো চামড়া। মুখ জুড়ে নোংরা বৃষ্টির ঢল। ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ বলে বসল, এই ঘরটা জনি ব্যবহার করত।

কে?

আমার ভাই।

ওহ্। কোথায় সে?

আর্মিতে, যদিও জনি আসলে আর্মিতে নেই। গত গ্রীষ্মে সে যখন অক্সফোর্ড প্লেনস স্পিডওয়েতে কাজ করছিল, তখন একটা গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে এবং পিছলে রাস্তা ধরে পিট এরিয়ার দিকে এগিয়ে যায়। জনি সেখানে একটা শেভি চার্জার-ক্লাস স্টকার গাড়ির পেছনের চাকা পাল্টাচ্ছিল। কয়েকজন মিলে পেছন থেকে চিৎকার করে সাবধান করেছিল জনিকে, কিন্তু সে শুনতে পায়নি। সেই কয়েকজনের মাঝে চিকোও ছিল।

মেয়েটা জিজ্ঞাসা করল, ঠান্ডা লাগে না তোমার??

না। লাগছে আসলে, পায়ে। সামান্য।

তারপরই হঠাত ধাক্কা মারল ভাবনাটা, জনির যা হয়েছে, আগে হোক বা পরে, তোরও একই অবস্থা হবে। সবকিছু আবারও ভেসে উঠল চোখের সামনে: স্কিড করে পিছলে যাচ্ছে ফোর্ড মাস্টাং। নিচু হয়ে ছিল ওর ভাই, একহাতে শেভির পেছনের একটা টায়ার ধরে টানছিল। ওর ভাইয়ের সাদা টি-শার্টের ভেতরে মেরুদন্ডের প্রতিটা হাড় আলো-আঁধারের খেলায় কেমন ফুটকির মত দেখাচ্ছিল তখন। রানওয়ে ধরে পিছলে যাওয়া মাস্টাংয়ের ছুটে যাওয়ার পথে ছিটকে উঠছিল টায়ার ছেঁড়া রবার। সেই সাথে চাকার ধাতব কঙ্কালের সাথে রাস্তার পিচের ঘষায় ঝিলিক দিচ্ছিল আগুনের ফুলকি। শেষ মুহূর্তে জনি ওর পায়ের ওপর ভর দিয়ে সরে যেতে চেয়েছিল। পারেনি, গাড়িটা হামলে পড়েছে। তারপর মুহূর্তের মাঝে হলুদ আগুনের লকলকে শিখা গ্রাস করে নিয়েছে সমস্ত কিছু।

হ্যাঁ, পুরো ব্যাপারটা আরো ধীরে হতে পারত। এটুকু ভাবতেই চিকোর মাথায় দাদার কথা ভেসে উঠল, সাথে হসপিটালের গন্ধ। তরুণী নার্সের দল শয্যাগ্রস্ত রোগিদের বাথরুমের জন্য বিশেষ বেডপ্যান নিয়ে ছোটাছুটি করছিল। একটা স্থির শেষ নিশ্বাস। চলে যাওয়ার কি আসলেই ভালো কোনো উপায় আছে?

কেঁপে উঠে ঈশ্বরের কথা ভাবল সে। গলার চেইনে ঝোলানো রুপার সেন্ট ক্রিস্টোফার মেডেলে স্পর্শ করল আলতো করে। সে মোটেও ক্যাথলিক না, এবং অতি অবশ্যই মেক্সিকান না। ওর আসল নাম এডওয়ার্ড মে। কালো চুল এবং চুলে ব্রাইলক্রিম লাগানো, সাথে চোখা মাথার জুতো আর কিউবান হিল পরে থাকার জন্যেই ওকে বন্ধুরা চিকো বলে ডাকে। ক্যাথলিক না হলেও এই মেডেলটা সে সবসময় পরে থাকে। জনিও যদি এমন একটা মেডেল পরে থাকত, হয়তো সেদিন মাস্টাংটা ওর পাশ ঘেঁসে চলে যেত। কে জানে!

দৃষ্টি বাইরে, চিকো তখনো ধোঁয়া ছেড়েই যাচ্ছিল। মেয়েটা বিছানা থেকে উঠে দ্রুত ছুটে এল ওর কাছে। কেমন যেন গুটিয়ে যাচ্ছিল মেয়েটা, হয়ত ভয় পাচ্ছিল, হঠাত ঘুরে সে যদি ওর দিকে তাকায়। পিঠে উষ্ণ একটা হাত টের পেল সে। মেয়েটার স্তনের স্পর্শ পাচ্ছে, চাপ অনুভব করছে; পেটের ছোঁয়া লাগছে ওর পশ্চাৎদেশে।

তোমার শরীরটা ঠান্ডা! মেয়েটা বলল।

না। এই অঞ্চলটাই ঠান্ডা আসলে।

তুমি কি আমাকে ভালোবাসো, চিকো?

অবশ্যই! হালকা স্বরে এটুকু বলেই গলার স্বর কিছুটা গম্ভীর করে ফেলল সে। বলল, তুমি চেরির মত ছিলে।

মানে কী–

কুমারী ছিলে তুমি।

হাতটা আরেকটু উপরে উঠল। চামড়ার খাঁজ বেয়ে উঠে এল ঘাড়ের পেছনের ভাঁজে। মেয়েটা মৃদু গলায় বলল, আমি বলেছিলাম না তোমাকে?

খুব কষ্ট পেয়েছ তুমি? ব্যথা লেগেছে?

না, মেয়েটা হেসে ফেলল। ভয় পাচ্ছিলাম অবশ্য!

দুজন মিলে বাইরে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখতে লাগল ওরা। পানি ছিটাতে ছিটাতে একটা নতুন ওল্ডসমোবাইল গাড়ি ছুটে গেল চৌদ্দ নম্বর রোড ধরে।

চিকো বলে উঠল, স্টাড সিটি।

কী?

যে লোকটা গেল, সে তার নতুন স্টাডকার নিয়ে স্টাড সিটিতে যাচ্ছে।

যে জায়গাটা আলতো করে ছুঁয়ে ছিল, সেখানে আস্তে করে চুমু দিল মেয়েটা। চিকো এমনভাবে ঘাড় ঝাড়া দিয়ে উঠল, যেন কোনো প্রজাপতি ভুল করে বসে পড়েছে।

কী হয়েছে তোমার?

সে ঘুরে তাকাল। মেয়েটার চোখ ওর গা বেয়ে চট করে নেমে গেল নিচে। একমুহূর্ত, তারপরেই উঠে এল ঝটকা দিয়ে। দুই হাতে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করল মেয়েটা, তারপর নিশ্চয়ই মনে পড়ে গেল, মুভির দৃশ্যে নায়িকারা এমন করে না। কাজেই, হাত দুটো ছেড়ে দিল সে। কালো চুল, শীতের জমাট ক্রিমের মত শুভ্র ত্বক। শক্ত হয়ে ওঠা স্তন এবং একটু বেশিই কোমল পেট। শুধু একটাই সমস্যা, চিকো ভাবল, এটা কোনো মুভি

জেন?

কী?

সে বুঝতে পারছিল, প্রস্তুত হয়ে উঠছে। শুরু করে দেওয়ার অবস্থা আসেনি এখনো, কেবল প্রস্তুত হয়ে উঠছে। এটা কোনো সমস্যা না। সব ঠিক আছে, আমরা এখনো বন্ধু। স্থির গলায় এটুকু বলে মেয়েটার দিকে তাকাল সে, ওর দেহের স্পন্দনের সাথে মিশে যেতে চেষ্টা করছে। আবার যখন চোখ তুলে মেয়েটার মুখের দিকে তাকাল, ততক্ষণে মেয়েটার সারা গালে আবিরের ছোপ লেগেছে। তাকিয়ে থাকলে তোমার কি খুব সমস্যা হচ্ছে?

আমি, না…না, চিকো।

একটুখানি পিছিয়ে গেল মেয়েটা। চোখ বন্ধ করে বিছানায় বসে গা এলিয়ে দিল। তারপর মেলে ধরল পা দুটো। সে এখন ওর সবটা দেখতে পাচ্ছে। উরুর ভেতরের দিকের পেশিগুলো তিরতির করে পাগলের মতো কাঁপছে। টান টান শক্ত হয়ে ওঠা স্তন কিংবা দু-পায়ের মাঝের গোলাপি মুক্তোও ওকে এতটা উত্তেজিত করে তুলতে পারেনি। প্রচণ্ড উত্তেজনায় কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল সে, যেন সার্কাসের কসরত করতে গিয়ে বিশাল এক স্প্রিংয়ের ওপর চড়ে বসেছে। কবিরা যেমন বলে, ভালোবাসা হয়তো আসলেই মহান কিছু; কিন্তু সঙ্গম মানে সেই বিশাল স্পিংয়ের ওপর সার্কাস দেখিয়ে বেড়ানো ক্লাউনই। কোনো মেয়ে কীভাবে উত্তেজিত পুরুষ লিঙ্গের দিকে তাকিয়ে পাগলের মত না হেসে থাকে? পুরো ব্যাপারটাই কেমন হাস্যকর! ছাদে, জানালার শার্ষিতে, জানালার কাঁচবিহীন নিচের অংশে লাগানো কার্ডবোর্ডে বৃষ্টি আছড়ে পড়ছে। নিজের বুকের ওপর হাত দিয়ে একটুখানি চাপ দিল সে, এক মুহূর্তের জন্য মনে হচ্ছিল যেন প্রাচীন রোমান এক পুরুষ বক্তৃতা দেওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। বুকে ঠান্ডা স্পর্শ পেতেই হাতটা নামিয়ে নিল, মুখে বলল, চোখ খোল। বললামই তো, আমরা বন্ধু।

বাধ্য মেয়ের মতো চোখ মেলে ওর দিকে তাকালো মেয়েটা। চোখ দুটোকে এখন বেগুনি দেখাচ্ছে। জানালার কাঁচ বেয়ে নেমে যাওয়া বৃষ্টিজল মেয়েটার মুখে, ঘাড়ে এবং বুকের মাঝে তরঙ্গ সৃষ্টি করছে। বিছানাজুড়ে টানটান হয়ে শুয়ে আছে সে, ফলে পেটের কোমল অংশটা আঁটোসাঁটো হয়ে গেছে উত্তেজনায়। এই মুহূর্তে একদম পারফেক্ট মনে হচ্ছে ওকে। ওহ, চিকো! কেমন হাসি পাচ্ছে আমার! বলতে বলতেই কেঁপে উঠল মেয়েটা। অজান্তেই পায়ের গোড়ালি দুটো চেপে ধরল। সে এখন ওর পায়ের পাতা দেখতে পাচ্ছে। গোলাপি বরণ।

চিকো! চিকো!

মেয়েটার দিকে এগিয়ে যেতে লাগল সে। চোখ মেলে চেয়ে আছে মেয়েটা, দেখছে, ওর পুরো শরীর উত্তেজনায় কাঁপছে। কিছু একটা বলল মেয়েটা, একশব্দ, বোঝা গেল না ঠিক করে। এখন ওসব জিজ্ঞাসা করার সময় না। এক মুহূর্তের জন্য মেয়েটার সামনে হাঁটু গেড়ে প্রায় বসে পড়ল সে, কেমন অদ্ভুত এক অনুভূতি খেলা করছে বুকের ভেতরে। মেঝের দিকে নিরবিচ্ছিন্ন মনযোগে তাকিয়ে থাকল মুহূর্তখানেক, তারপর মেয়েটার হাঁটুর একটুখানি উপরে স্পর্শ করল হাত দিয়ে। নিজের ভেতরে বয়ে চলা সমুদ্রের প্রবল ঢেউয়ের সবটুকু বুঝে নিতে চাইছে। কী আদিম উদ্দামতা এর মাঝে। এভাবেই আরো কিছুক্ষণ থেমে থাকল।

এখন পুরো ঘরে একমাত্র শব্দ বলতে বেড-টেবিলে একগাদা স্পাইডারম্যান কমিক্স বইয়ের উপরে রাখা টেবিলঘড়ির মৃদু টিকটিক। মেয়েটার নিঃশ্বাসের গতি দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়ে উঠছে। সে যখন সামনের দিকে ডাইভ দিল, টের পেল শরীরের পেশিগুলো মেয়েটার শরীরের মাঝে মসৃণভাবে পিছলে যাচ্ছে। ওরা শুরু করল। এবারে সবকিছুই আগের চেয়ে ভালো হচ্ছে। এদিকে বাইরে, বৃষ্টির স্রোতে ধুয়ে যাচ্ছে জমাট তুষার।

আধাঘন্টা পরে চিকো হালকা নাড়া দিল মেয়েটাকে, আমাদেরকে উঠতে হবে। বাবা আর ভার্জিনিয়া একটু পরেই চলে আসবে।

হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে উঠে বসল মেয়েটা। এখন আর নিজেকে আড়াল করার কোনো চেষ্টা করছে না। মেয়েটার শরীরের স্পন্দন–দেহের ভাষা–একদম পাল্টে গেছে। যদিও এখনো যথেষ্ট পরিপক্ক হয়ে ওঠেনি (তবে সে নিজে বোধ হয় নিজেকে পরিপক্ক বলেই মনে করে, এমনকি একটা জুতোর ফিতে বাঁধার চেয়ে কঠিন কোনো কাজই এখনো শিখে উঠতে পারেনি; তারপরও, ওর দেহের ভাষা বেমালুম বদলে গেছে। ওর দিকে তাকিয়ে নড় করল সে, প্রত্যুত্তরে অনিশ্চিত ভঙ্গিতে হাসল মেয়েটা। একহাত বাড়িয়ে বেড-টেবিলের ওপর থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা নিল চিকো। মেয়েটাকে প্যান্টি পরতে দেখে একটা পুরনো দিনের গানের লাইন মনে পড়ে গেল, তোমার সমস্ত ছিন্ন করা পর্যন্ত বাজাতে থাকো, ব্লু…বাজাও তোমার ডিডগেরিডু। রোলফ হ্যারিসের টাই মি ক্যাঙ্গারু ডাউন। ভাবতে ভাবতে আপন মনেই হেসে ফেলল সে। জনি গানটা খুব গাইত। গানটার শেষটা ছিল এমন মরার পরে আমরা ওকে ট্যান করেছি, ক্লাইড। সেটাই এখন অমন করে ঝুলছে ওই শেডে!

মেয়েটা ব্রার হুক লাগিয়ে ব্লাউজের বোতামগুলো লাগাতে লাগাতে জিজ্ঞাসা করল, হাসছ কেন, চিকো?

এমনিতেই।

আমার পেছনের চেইনটা লাগিয়ে দাও না?

এখনো নগ্ন, মেয়েটার দিকে এগিয়ে গেল সে। চেইন লাগিয়ে দিল। গালে আলতো করে চুমু দিয়ে বলল, বাথরুমে গিয়ে তুমি চাইলে মুখ ধুয়ে ঠিকঠাক হয়ে নিতে পার। কিন্তু বেশি সময় নিও না, ঠিক আছে?

মেয়েটা অভিজাত ভঙ্গিতে উঠে গেল, চিকো সিগারেটে টান দিতে দিতে তাকিয়ে রইল সেদিকে। দারুণ লম্বা মেয়েটা, ওর নিজের চেয়েও; এমনকি বাথরুমের দরজা দিয়ে ঢোকার সময় মাথা একটুখানি নামিয়ে ঢুকতে হয়েছে ওকে। বিছানার নিচে নিজের আন্ডারওয়্যারটা খুঁজে পেল সে। আলমারির দেরাজের ভেতরের দিকে ঝুলানো ময়লা কাপড়ের ব্যাগে রেখে দিল সেটা, এবং পরিস্কার একটা খুঁজে নিয়ে পরে নিল। বিছানায় ফিরে আসার সময় পিছলে প্রায় পড়েই গিয়েছিল, কোনোমতে সামলে নিল নিজেকে। নিচের কার্ডবোর্ডের ফাঁক দিয়ে বৃষ্টির পানি এসে ভিজে গেছে এই অংশটা।

গডড্যাম ইট! বিরক্তি ঝরে পড়ল গলায়।

ঘরের চারদিকে একবার চোখ বুলাল সে মারা যাওয়ার আগে এই ঘরটা জনির ছিল (কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে সে ভাবল, কেন আমি ওকে বললাম, জনি এখনো আর্মিতে? অদ্ভুত!)। এই ঘরের ফায়ারবোর্ড ওয়াল ছাদের সাথে পুরোপুরি লাগানো না। আর, এটা এত পাতলা যে, রাতে যে বাবা আর ভার্জিনিয়া এখানে আসে, সে শব্দ ওপাশ থেকে পরিস্কার শোনা যায়। তাছাড়া, এই ঘরের মেঝেটাও কেমন যেন অদ্ভুতভাবে বাঁকানো। সেজন্য দরজা খোলা রাখতে চাইলে সেটা কিছু দিয়ে আটকে দিতে হয়, নাহয় ছেড়ে দিলেই সেটা নিজে নিজে বন্ধ হয়ে যায়। ওপাশের দেয়ালে ইজি রাইডার মুভির একটা পোস্টার লাগানো দুইজন মানুষ আমেরিকার খোঁজে ছুটে বেড়াচ্ছে এবং কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না। জনি বেঁচে থাকতে এই ঘরটা আরো অনেক প্রাণবন্ত ছিল। কেন বা কীভাবে, এ ব্যাপারে চিকোর নিশ্চিত কোনো ধারণা নেই; কিন্তু কথাটা সত্যি, এটুকু সে জানে। আরেকটা ব্যাপার সে নিশ্চিতভাবে জানে। কোনো কোনো রাতে এই ঘরটা তাকে তাড়া করে ফেরে।

মাঝে মাঝে সে ভাবে, এই বুঝি আলমারির দেরাজটা ঝটকা দিয়ে খুলে যাবে এবং পেছন থেকে পুড়ে কালো হয়ে কেমন দলা পাকিয়ে যাওয়া শরীর নিয়ে জনি বেরিয়ে আসবে। ওর হলুদ দাঁতগুলো বেরিয়ে থাকবে মুখ থেকে। দেখেই বোঝা যাবে, অগিদগ্ধ এই দাঁতগুলো গলে গিয়ে আবার শক্ত হয়ে বীভৎস আকৃতি নিয়েছে। জনি ফিসফিস করে বলবে, আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যা, চিকো। আর তুই যদি আমার ডজ-এ একটা আঙুলও দিস, খুন করে ফেলব একেবারে, বুঝেছিস?

চিকো মনে মনে ভাববে, বুঝেছি।

এলোমেলো বিছানার চাদরে মেয়েটার রক্ত লেগে আছে। সেদিকে তাকিয়ে সে এক মুহূর্তের জন্য স্থির দাঁড়িয়ে রইল। তারপর এক টানে কম্বলটাকে টেনে দিলে চাদরের উপরে। এখানে, ঠিক এখানেই। তোমার কেমন লাগছে, ভার্জিনিয়া? কেমন খোঁচাচ্ছে তোমাকে ব্যাপারটা? ভাবতে ভাবতে প্যান্ট পরে নিল সে, পায়ে গলাল ইঞ্জিনিয়ার জুতো। খুঁজে পেতে একটা সোয়েটার গায়ে চাপাল।

মেয়েটা যখন বেরিয়ে এল, ততক্ষণে সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে। মেয়েটাকে দেখতে দারুণ অভিজাত লাগছে। জাম্পারের উপর দিয়ে অসম্ভব কোমল পেটের কোনো চিহ্নই চোখে পড়ছে না। বিছানার দিকে একবার তাকিয়ে এগিয়ে গেল মেয়েটা। কী কী যে করল হাত দিয়ে, এখন দেখে বিছানাটাকে আর দায়সারাভাবে কম্বল টেনে ঢাকা দেওয়া মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে, বিছানাটা গোছানো হয়েছে।

বাহ! চিকোর কথা শুনে মৃদু হাসল সে, সচেতনভাবে একগোছা চুল গুঁজে দিল কানের পেছনে। চোখে পড়ার মতো শৈল্পিক ভঙ্গি মেয়েটার।

চলো, যাওয়া যাক।

হল এবং লিভিং রুম পেরিয়ে গেল ওরা। টিভির উপরে রাখা পুরনো, সাদা ছোপ পড়ে যাওয়া ছবিটার সামনে থেমে দাঁড়াল জেন। ছবিটায় ওর বাবার সাথে ভার্জিনিয়াকে দেখা যাচ্ছে। সাথে আছে হাইস্কুল-পড়ুয়া জনি, গ্রামারস্কুল-পড়ুয়া চিকো এবং ছোট্ট বিলি। ছবিতে জনি বিলিকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে।

ভার্জিনিয়া ছাড়া সবাই হাসছে। শুধু ভার্জিনিয়ার মুখ নিরুত্তাপ, ঢুলুঢুলু। বাবা ওই কুত্তীকে বিয়ে করার মাস পেরোনোর আগেই ছবিটা তোলা হয়েছিল, মনে আছে ওর।

তোমার বাবা-মা?

আমার বাবা। এটা আমার সৎ মা, ভার্জিনিয়া। আসো।

জেন চিকোকে ওর উইন্ডোব্রেকারটা ধরিয়ে দিয়ে নিজের কোট তুলে নিতে নিতে জিজ্ঞাসা করল, উনি এখনো এত সুন্দর?

বাবা তো তাই ভাবে।

বেরিয়ে এসে শেডের নিচে দাঁড়াল ওরা। জায়গাটা স্যাঁতস্যাঁতে। দেয়ালে ফাটল ধরেছে, এর মাঝ দিয়ে ছুটে যাওয়ার সময় বাতাস বিচিত্র সব শব্দ তোলে। একগাদা চাকাবিহীন টায়ার একপাশে পড়ে আছে। সাথে আছে জনির পরিত্যক্ত সাইকেল, দশ বছর বয়সে যেটা চিকো বুঝে নিয়েছিল এবং পরবর্তীতে বিধ্বস্ত করে ফেলে রেখেছে। আরো আছে একগাদা গোয়েন্দা ম্যাগাজিন, কাঁচের ফেরতযোগ্য পেপসির বোতল, গ্রিজ লাগানো পুরনো ইঞ্জিন-ব্লক এবং কমলার বাক্সভরা পেপারব্যাক বই। দ্য নাম্বারস অফ অ্যা হর্সের আঁকা একটি পুরনো চিত্রকর্ম দাঁড়িয়ে আছে ধুলোমলিন ঘাসের ওপর। চিকো ওকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করল। এদিকে একঘেয়ে সুরে বৃষ্টি ঝরেই যাচ্ছে।

চিকোর পুরাতন সেডান গাড়িটা ড্রাইভওয়ের কর্দমাক্ত অংশে দাঁড়িয়ে আছে। বিধ্বস্ত অবস্থা। এমনকি ব্লকের উপরে ফেলে রাখা এবং উইন্ডশিন্ডের জায়গায় লাল প্লাস্টিকের কাভার দিয়ে ঢাকা থাকার পরেও জনির ডজের অবস্থা এরচেয়ে ভালো দেখায়। চিকোর এটা একটা বুইক। গাড়ির গায়ের পেইন্টিংয়ের অবস্থা এমনিতেই যাচ্ছেতাই, তার ওপর জায়গায় জায়গায় মরিচা পড়ে গেছে। সামনের সিটগুলো বাদামি রংয়ের আর্মি কম্বল দিয়ে ঢাকা। যাত্রীসিটের সামনের সান ভাইজরটায় একটা বিশালাকৃতির বোতামের মতো জিনিস লাগানো, যাতে লেখা: আমি প্রতিদিন এটাই চাই। পেছনের সিটে মরচে ধরা একটা স্টার্টার অ্যাসেম্বলি পড়ে আছে। সে বেশ কয়েকবার ভেবেছে, বৃষ্টি থামলে সবকিছু পরিস্কার করে ফেলবে এবং স্টার্টারটাকে নিয়ে ডজে রেখে আসবে। কিংবা হয়তো রেখে আসবে না। বুইক থেকে এমনিতেই কেমন স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ আসে, তাছাড়া ওর নিজের স্টার্টারটাও প্রতিবার বুইকটাকে স্টার্ট দিতে অনেক সময় নেয়।

মেয়েটা জিজ্ঞাসা করল, সমস্যা কি ব্যাটারিতে?

এই অসহ্য বৃষ্টির জন্য মনে হয়, এটুকু বলেই গাড়িটাকে পিছিয়ে এনে রোডে উঠল সে। উইন্ডশিল্ডের ওয়াইপারের সুইচ চালু করে দিয়ে এক মুহূর্ত থেমে তাকিয়ে রইল বাড়িটার দিকে। পুরো নিরামিষ পানি রংয়ের বাড়ি। পাশের শেডটা একটু নিচু জায়গায়, কোণগুলো ডাবল-জয়েন্টেড, অ্যাসফাল্টের বদলে ছাদে টারপেপার ব্যবহার করা হয়েছে এবং সাইনবোর্ডের রং-চামড়া উঠে গিয়ে একেবারে বাজে অবস্থা হয়ে আছে।

ঘড়ঘড় শব্দ করে রেডিও চালু হয়ে যেতেই চিকো দ্রুত হাতে বন্ধ করে দিল। এরইমাঝে কপালের পেছন দিকটায় রবিবার বিকেলের নিয়মিত মাথাব্যথাটা শুরু হয়ে গেছে। গাড়ি চালিয়ে ওরা গ্রেঞ্জ হল, স্বেচ্ছাসেবী আগ্নিনির্বাপন কর্মীদের দপ্তর এবং ব্রাউনির দোকান পেরিয়ে এল। ব্রাউনির হাই-টেস্ট পাম্পের পাশেই স্যালি মরিসনের টি-বার্ডটা পার্ক করে রাখা। ওল্ড লুইস্টন রোডের দিকে গাড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে স্যালির উদ্দেশ্যে একহাত তুলে নাড়ল সে।

কে এটা?

স্যালি মরিসন।

দারুণ সুন্দরি।

জেনের গলা নিরুত্তাপ শোনাল।

এই মুহূর্তে খুব সিগারেটের অভাব অনুভব করছে চিকো। প্রত্যুত্তরে বলল, এরমাঝে ওর দুইবার বিয়ে হয়েছে এবং দুইবারই ডিভোর্সও হয়ে গেছে। এই ফালতু জায়গায় যেসব কথা ঘুরে-ফিরে শোনা যায়, ওসবের অর্ধেকও যদি বিশ্বাস করো, তাহলে মনে হবে, এই মেয়ে এখন শহরের সবচেয়ে আলোচিত…

দেখে এখনো তরুণী মনে হয়।

তরুণীই।

তুমি কখনো–?

মেয়েটার উরুতে একহাত আলতো করে বুলিয়ে দিয়ে হেসে ফেলল সে, না। আমার ভাই হয়ত করেছে, কিন্তু আমি না। তবে স্যালিকে আমি পছন্দ করি। নিয়মিত পাওয়া অ্যালিমনি আর একটা বিশালাকৃতির সাদা রংয়ের পাখি–এই নিয়েই আছে। এই শহরের কে কী বলছে, ওসব পাত্তা দেয় না মেয়েটা।

এখন মনে হচ্ছে, যাত্রাটা বেশ দীর্ঘ হবে। ডানে বয়ে চলেছে ধুসর পানির প্রবল অ্যান্ড্রোসকোগিন নদী। জমে থাকা বরফের কোনো চিহ্নও নেই। জেন চুপ হয়ে গেছে, মনে হচ্ছে, কিছু নিয়ে ভাবছে। একমাত্র শব্দ বলতে উইন্ডশিল্ড ওয়াইপারের একঘেয়ে আওয়াজ। গাড়ি যখন রাস্তার মাঝের খানাখন্দ দিয়ে ছুটছে, জমে থাকা কুয়াশা চোখে পড়ছে। বিকেল হয়ে এলে এই কুয়াশারা দলে ভারি হয়ে দখল করে নেবে পুরো রিভার রোড।

অবার্ন পেরিয়ে এলে, চিকো একটা শর্টকাট ধরে গাড়ি ঘুরিয়ে মাইনট অ্যাভিনিউতে উঠে এল। জনমানুষ তেমন নেই। চার লেনের পুরো রাস্তাটাকে প্রায় পরিত্যক্ত মনে হচ্ছে। আর মফস্বলের এই বাসাগুলো দেখে মনে হচ্ছে, মুখবন্ধ প্যাকেট। একটা বাচ্চাকে দেখা গেল, হলুদ রেইনকোট পরে কাদা আর খানাখন্দ এড়িয়ে সাবধানে রাস্তার একপাশের ফুটপাথ ধরে হেঁটে যাচ্ছে।

শাবাস, এগিয়ে যা! কোমল স্বরে বলল চিকো।

কী? সম্বিত ফিরে পেয়ে জানতে চাইল জেন।

কিছু না, বাবু। তুমি ঘুমাও।

এ কথা শুনে দ্বিধান্বিত ভাবে হেসে উঠল মেয়েটা।

কেস্টন স্ট্রিটে উঠে একটা প্যাকেট হয়ে থাকা বাড়ির ড্রাইভওয়েতে গাড়ি ঢুকিয়ে দিল চিকো, ইগনিশন বন্ধ করেনি।

ভেতরে আসলে আমি তোমাকে কুকি বিস্কুট দেব।

উত্তরে মাথা নেড়ে না করল চিকো, সম্ভব না। আমাকে যেতে হবে।

জানি, বলে একহাত চিকোকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেল মেয়েটা, আমার জীবনের সবচেয়ে চমৎকার সময়টার জন্য তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

হঠাত হাসি ফুটে উঠল ওর মুখে, চেহারা চমকাচ্ছে। পুরো ব্যাপারটাকে কেমন অতিলৌকিক দেখাল। চিকো বলল, সোমবারে দেখা হচ্ছে তাহলে, জেন। আমরা এখনো বন্ধুততা, নাকি?

তুমি তো জানই, আমরা বন্ধু, এটুকু বলে জেন আরেকবার চুমু খেল। ওকে। কিন্তু সে যখন একহাতে জাম্পারের ওপর দিয়ে স্তনে হাত দিতে চাইল, সরে গেল মেয়েটা। এমন করো না। আমার বাবা দেখে ফেলতে পারে।

মেয়েটাকে যেতে দিল সে, ঠোঁটের কোণে একটু আগের হাসির লেশ রয়ে গেছে এখনো। দ্রুত হাতে গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে গেল মেয়েটা, একছুটে পৌঁছে গেল বাড়ির পেছনের দরজায়। পরমুহূর্তে দেখা গেল, দরজার ওপাশে মিলিয়ে গেছে সে। মুহূর্তখানেক থেমে একটা সিগারেট ধরিয়ে নিল চিকো, গাড়িটাকে পিছিয়ে এনে উঠে এল রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ল গাড়িটা। এঞ্জিন চালু হওয়ার আগে মনে হলো, স্টার্টারটা বুঝি যুগ যুগ ধরে সময় নিচ্ছে। তারপর ফিরতি পথের দীর্ঘ যাত্রা। যতক্ষণে বাসায় পৌঁছেছে, ড্রাইভওয়েতে এসে দেখে বাবার স্টেশন ওয়্যাগনটা দাঁড়িয়ে আছে। ওটার পাশে গাড়িটাকে পার্ক করে এঞ্জিনটাকে থেমে যেতে দিল সে। তারপর কিছুক্ষণ বসে রইল চুপচাপ, কান পেতে বৃষ্টির শব্দ শুনছে। মনে হচ্ছে যেন কোনো লোহার ড্রামের ভেতরে বসে আছে।

ভেতরে বিলি টিভিতে কার্ল স্টর্মার এন্ড হিজ কান্ট্রি বুকারুস দেখছিল। চিকোকে ঢুকতে দেখেই লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল, উত্তেজিত হয়ে আছে।

এডি, এই এডি, পিট আঙ্কেল কী বলে গেছে, জানো? বললেন, উনি আর ওনার দলের লোকজন মিলে একটা আস্ত জার্মান সাবমেরিন ডুবিয়ে দিয়েছেন! তুমি আমাকে আগামী শনিবারের শোতে নিয়ে যাবে?

চিকো হাসতে হাসতে বিলির চুল ধরে টেনে দিয়ে বলল, জানি না। তুই যদি পুরো সপ্তাহ রাতের খাবারের আগে একবার করে আমার জুতোয় চুমো দিয়ে যাস, তাহলে ভেবে দেখতে পারি।

জোরে চিৎকার করে উঠল বিলি, হাসছে। একইসাথে চিকোর হাঁটুর নিচে লাথি বসিয়ে দিল।

বন্ধ করো এসব! স্যাম মে রুমে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, বন্ধ করো। দুজনেই জানো, তোমাদের মা এসব উল্টোপাল্টা কাজকর্ম একদম পছন্দ করে না। একহাতে টাই টেনে নামিয়ে জামার উপরের বোম খুলতে লাগলেন তিনি। হাতের প্লেটে সাদা পাউরুটি দিয়ে মোড়ানো তিনটে হটডগ, এর মাঝে মাস্টার্ড দিতে দিতে স্যাম মে জানতে চাইলেন, তুমি কোথায় ছিলে, এডি?

জেনের ওখানে।

বাথরুমে টয়লেট ফ্ল্যাশ করার শব্দ শোনা গেল। ভার্জিনিয়া। এক মুহূর্তের জন্য চিকো ভাবল, জেন সিঙ্কে কোনো চুল বা লিপস্টিক কিংবা কোনো ববি পিন ফেলে গেছে কি না।

ওর বাবা আবার বললেন, আমাদের সাথে গিয়ে পিট আঙ্কেল আর অ্যান আন্টিকে দেখে আসা উচিত ছিল তোমার। দ্রুত তিন কামড়ে একটা হটডগ শেষ করে নিয়ে আবার বললেন, তুমি এ বাসায় দিনদিন অচেনা মানুষে পরিণত হচ্ছ, এডি। এসব আমার পছন্দ না, অন্তত যতক্ষণ তোমার থাকা-খাওয়ার সব আমাদেরকে যোগাতে হচ্ছে।

চিকো জবাব দিল, থাকা-খাওয়ার সব না, কিছু।

স্যাম চট করে মুখ তুলে তাকালেন। প্রথমে মনে হলো, কষ্ট পেয়েছেন। পরমুহূর্তেই ক্ষেপে গেলেন প্রচন্ড। যখন কথা বললেন, চিকো দেখল, ফ্রেঞ্চ মাস্টার্ড লেগে ওনার দাঁত হলুদ হয়ে আছে। জনির হলুদ দাঁতের কথা মনে পড়ে গিয়ে কেমন অসুস্থ মনে হতে লাগল ওর নিজেকে। এদিকে বাবা বলে যাচ্ছেন, তোর মুখ! মুখ বেশি বড় হয়ে গেছে, না? নিজেকে এখনো অত বড় ভাবিস না, অপদার্থ কোথাকার!

কাঁধ ঝাঁকিয়ে শ্রাগ করে বাবার চেয়ারের পাশে রাখা টিভি ট্রে থেকে একটুকরো ওয়ান্ডার ব্রেড তুলে নিয়ে, ওর মাঝে কেচাপ ছড়িয়ে দিল চিকো। তিন মাসের মাথায় আমি এখান থেকে একেবারে চলে যাব।

কী বলিস তুই এগুলি?

জনির গাড়িটা ঠিক করে নিয়ে ক্যালিফোর্নিয়া চলে যাব আমি। ওখানে গিয়ে কাজ খুঁজে নেব।

আচ্ছা! বাবা এমনিতে বিশালদেহী মানুষ। বিশাল মানে, হাঁটাচলা করতে গেলে চোখে পড়ার মত। কিন্তু চিকোর মনে হলো, ভার্জিনিয়াকে বিয়ে করার পর মানুষটা কেমন ছোট হয়ে গেছে। আর, জনির মৃত্যুর পরে যেন আরো সঙ্কীর্ণ হয়ে গেছে সে।

মাথার ভেতরে জেনকে বলা কথাটা বেজে যাচ্ছে: আমার ভাই হয়তো, কিন্তু আমি না। এই লাইনের লেজ ধরেই আরেকটা বাক্য চলে আসছে। মাথায়: ব্লু, বাজাও তোমার ডিডেগেরিডু।

ওই গাড়ি নিয়ে তুই ক্যাসল রকের শেষ মাথায়ই যেতে পারবি না, আর কানাডা তো বহুদূর!

তাই মনে হয়? পেছনের ধুলা দেখলেই বুঝবে, শালার পেরেছি কি না।

এক মুহূর্তের জন্য বাবা কেবল তাকিয়ে রইল, পরমুহূর্তে হাতের হটডগটা ছুঁড়ে মারল ওর দিকে। বুকে এসে লাগল সেটা, সোয়েটার আর চেয়ার জুড়ে মাস্টার্ড ছড়িয়ে পড়েছে।

বেশি চালাক হয়ে গেছ, না? আরেকবার ওভাবে কথা বলে দেখ, তোমার নাক যদি আস্ত রাখি আমি!

হটডগটা হাতে নিয়ে দেখল চিকো। স্বস্তা জিনিস, ফ্রেঞ্চ মাস্টার্ড মেখে গেছে একেবারে। আরেকটু মাখুক। হটডগটা উল্টো বাবার দিকে ছুঁড়ে মারল সে। স্যাম উঠে দাঁড়াল, মুখের রং পুরনো পোড়া ইটের মত হয়ে গেছে। কপালের মাঝের শিরাটা তিরতির করে লাফাচ্ছে। টিভি ট্রের সাথে উরু লেগে ছিল, দাঁড়ানোর ধাক্কায় ঘুরে গেল সেটা। বিলি রান্নাঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ওদেরকে দেখছিল। একটা প্লেটে করে হটডগ আর ঝোল ঝোল করে রান্না করা শিমের বিচি নিয়েছিল সে। টিভি ট্রের ধাক্কায় ওর হাতের প্লেট থেকে কিছুটা ঝোল ছিটকে পড়ল মেঝেতে। চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেছে ওর, মুখ আতঙ্কে কাঁপছে। এদিকে টিভিতে কার্ল স্টর্মার এবং ওর সাথের কান্ট্রি কাউবয়রা লং ব্ল্যাক ভেইলের সবকিছু ধ্বংস করছে প্রবল নির্মমতায়।

যতটুকু সম্ভব ভালোভাবে ওদেরকে পেলে বড় করার পরে ওরা তোর মুখে থুতু মারবে, এটাই তো নিয়ম। হায়রে! গম্ভীর স্বরে এটুকু বলে নিজের চেয়ারে অন্ধের মতো হাত চালাল ওর বাবা, আধা-খাওয়া একটা হটডগ হাতে লাগতে সেটা তুলে নিল। ধরার ভঙ্গি দেখে মনে হলো রোগাক্রান্ত একটা পুরুষলিঙ্গ ধরে আছে। কেমন উদভ্রান্তের মতো সেই মহর্তেই ওটায় কামড় বসিয়ে দিল সে। চিকো দেখল, মানুষটা কাঁদতে কাঁদতে বিলাপ করতে শুরু করেছে, হায়রে! এটাই তো নিয়ম: ওরা তোর মুখে থুথু মারবে!

ঠিক সেই মুহূর্তে বিস্ফোরিত হলো চিকো, কোন জাহান্নামে ধরেছিল তোমাকে যে, ওকে বিয়ে করেছ? এটুকু বলেও থামতে পারল না সে, বলে যাচ্ছে, তুমি ওকে বিয়ে না করলে জনি এখনো বেঁচে থাকত।

চোখে জল নিয়েই চিৎকার করে উঠল স্যাম, এটা তো তোর দেখার বিষয় না। এটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।

জবাবে পাল্টা চেঁচিয়ে উঠল চিকো, ওহ! তাই নাকি? আমার তো কেবল ওর সাথে এক বাসায় বসবাস করতে হচ্ছে! আমাকে আর বিলিকে একসাথে থাকতে হচ্ছে ওর সাথে! চুপ করে দেখতে হচ্ছে, তোমাকে কীভাবে টেনে মাটিতে নামাচ্ছে। তুমি এমনকি বুঝতেও পারছ না

কী? নিচু স্বরে এমনভাবে কথাটা বলল, স্পষ্ট বোঝা গেল, ঝড়ের আগ মুহূর্তের মতো পাকিয়ে উঠছে সব কিছু। হটডগের বাকি অংশটা ভাঙা হাড় দিয়ে বানানো অস্ত্রের মতো শক্ত করে ধরল স্যাম। আমি কী বুঝতে পারছি না?

তুমি কিছু বুঝতে পারছ না, আরেকটু হলে মুখ দিয়ে কী বের হয়ে যেত, সে কথা ভেবে নিজেই ভয় পেয়ে গেছে।

নাটক করা বন্ধ কর, চিকো, এই মুহূর্তেই; নাহয় আমি পিটিয়ে তোর মাথা থেকে ভূত বের করে ছাড়ব।

প্রচন্ড ক্ষেপে না গেলে বাবা কখনো এ কথা বলে না, জানে সে।

ঘুরে দাঁড়াল চিকো, তারপরেই দেখল, রুমের ওপ্রান্তে দাঁড়িয়ে চুপচাপ নিজের স্কার্ট ঠিক করছে ভার্জিনিয়া। আর, শান্ত বাদামি চোখে ওকে দেখছে। আর কিছু সুন্দর না হলেও ভার্জিনিয়ার চোখগুলো দারুণ সুন্দর, যদিও মেকআপ করে বাকিসবও ঠিকঠাক করে রাখার চেষ্টা করে সে। কিন্তু এই চোখদুটো ওর সৌন্দর্য আরো বহুবছর ধরে টেনে নিয়ে যাবে, ভাবল চিকো, এবং অনুভব করল, অসুস্থ ঘৃণাটা আবারো ফিরে আসছে। মাথায় খেলে গেল সেই লাইনগুলো, কাজেই ও যখন মারা গেল, আমরা ওকে ট্যান করেছিলাম, ক্লাইড। সেটাই এখন অমন করে ঝুলছে শেডে!

ও তোমাকে …ইয়ের সাথে বেঁধে যেভাবে ইচ্ছে নাচাচ্ছে, আর তুমি যে কিছু করবে, সে মুরোদও তোমার নেই এতক্ষণ ধরে এত চিৎকার শুনে বিলি আর শেষ পর্যন্ত সহ্য করতে পারল না, প্রচন্ড আতঙ্কে চিৎকার দিয়ে হাত থেকে হটডগ আর শিমের বিচির প্লেট ফেলে দিল, দুই হাতে মুখ ঢেকে ফেলেছে। ঝোল পড়ে বিলির রবিবারের জুতো তো নষ্ট হলই, মেঝেতে বিছানো ম্যাট্রেস জুড়েও ছড়িয়ে গেল। এক পা এগোল স্যাম, তারপর চিকোর বাড়ানো আঙুল দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। আঙুল দেখে মনে হলো যেন বলতে চাইছে, আসো আসো, মীমাংসা হয়ে যাক। এইটুকু বুঝতে এত সময় লাগল তোমার!

ওভাবেই মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে ছিল দুজন, এসময় ভার্জিনিয়া প্রথম মুখ খুলল, নীচু গলা–চোখের মতো ওর গলাও একদম স্থির, শান্ত শোনাল।

তুমি কি তোমার ঘরে কোনো মেয়ে এনেছিলে, এড? তোমার বাবা আর আমি এসব ব্যাপারে কেমন বোধ করি, তোমার তো জানার কথা। একমুহূর্ত থেমে থাকল সে, তারপর কেমন আনমনে গলায় বলল, মেয়েটা রুমাল ফেলে গেছে।

তাকিয়ে রইল চিকো, প্রচন্ড অসহায় বোধ করছে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে না পেরে। পারছে না, অথচ চিৎকার করে বলতে চাইছে, কী প্রচন্ড নোংরা ভার্জিনিয়া, কী বাজেভাবে মানুষের পিঠে ছুরি বসিয়ে দিতে পারে; পেছনে ক্লিপ লাগিয়ে ঠেসে ধরে কেটে দিতে পারে হাঁটুর হ্যামস্ট্রিং, মুহূর্তে পঙ্গু করে দিতে পারে যে কাউকে।

বাদামি স্থির চোখগুলো যেন বলছে, চাইলে তুমি তখন আমাকে আঘাত করতে পারতে। আমি জানি, জনির মৃত্যুর আগে কী হয়েছে, কী হচ্ছিল, এসব তুমি জানতে। কিন্তু আমাকে আঘাত করার এই একটা ছাড়া আর কোনো উপায় তোমার নেই, তাই না চিকো? হ্যাঁ, সব জেনে গেলে, এই একভাবেই কেবল তোমার বাবা তোমাকে বিশ্বাস করত। কিন্তু এভাবে বিশ্বাস করাটা শেষ পর্যন্ত খুন করে ফেলত বেচারাকে।

নতুন পথ পেয়ে ভালুকের মতো আক্রমণ চালাল ওর বাবা, আমার ঘরে তুই মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করেছিস, হারামজাদা?

স্থির, শান্ত গলায় ভার্জিনিয়া শাসাল, এই ভাষা ব্যবহার করো না, স্যাম।

এইজন্যই কি তুই আমাদের সাথে যেতে চাসনি? যাতে, যাতে…

বলো! মরিয়া শোনাল চিকোর গলা। ওকে তোমার সাথে এমন করতে দিও না। বলে ফেল! যেটা বলতে চাচ্ছিলে, বলো?

তুই বের হয়ে যা এই বাসা থেকে স্নান শোনাল স্যামের গলা। তোর মা আর আমার কাছে মাফ চাওয়ার আগে এই বাসায় আর কখনো আসিস না।

কেঁদে ফেলল চিকো, এত সাহস তোমার! এই কুত্তিকে তুমি কক্ষনো আমার মা বলবে না। খুন করে ফেলব একেবারে!

বিলি চিৎকার করে উঠল, থামো, এডি। প্লিজ। এখনো হাত দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছে। হাতের ফাঁক দিয়ে ভেসে আসা শব্দগুলো চাপা শোনাল, আবছা, স্লান। আব্বুর সাথে চিৎকার করা বন্ধ করো, প্লিজ।

ভার্জিনিয়া দরজার সামনে থেকে এক পাও নড়েনি। চোখ দুটো চিকোর উপরে স্থির হয়ে আছে।

এক পা পিছিয়ে এল স্যাম। ওর হাঁটুর পেছনের পেশি ইজি চেয়ারের কিনারায় ধাক্কা খেলে ধুপ করে ওতে বসে পড়ল সে। এক হাতে মুখ ঢেকে ফেলল, যে মুখ দিয়ে এসব কথা বলছিস, তোর দিকে তাকাতেও ইচ্ছে করছে না আর। খারাপ লাগে তোর জন্য।

আর ওর জন্য তোমার কোনো সমস্যা হয় না, না? স্বীকার করতে চাও না কেন তুমি?

কোনো উত্তর নেই। এখনো চিকোর দিকে তাকাচ্ছে না। টিভি ট্রে হাতড়ে একটা হটডগ তুলে নিয়ে মাস্টার্ডের খোঁজে হাত বাড়াল সে। এদিকে বিলি কেঁদেই যাচ্ছে। ওদিকে টিভিতে, কার্ল স্টর্মার আর ওর কান্ট্রি কাউবয়রা ট্রাক চালানোর গান ধরেছে। কার্ল ওর পশ্চিম মেইনের দর্শকদের উদ্দেশ্যে বলল, আমার ট্রাক পুরনো হলে কী হবে, গতি কমেনি একটুও।

ভার্জিনিয়া শান্ত গলায় বলল, স্যাম, ছেলেটা এখনো বুঝতে পারছে না, সে কী বলছে। ওর বয়সে এই ব্যাপারগুলো মেনে নেওয়া একটু কঠিন। বড় হয়ে যাওয়াটা তো সহজ না।

শেষ কথা বলে দিয়েছে, বুঝল চিকো।

ঘুরে দরজার দিকে হাঁটা শুরু করল সে। এভাবে গেলে প্রথমে শেড ধরে তারপর উঠোনে বের হতে হবে। দরজা খুলে আবার ফিরে ভার্জিনিয়ার দিকে তাকাল সে। ওর মুখে নিজের নাম শুনে চোখ ফেরাল ভার্জিনিয়া, কী হয়েছে, এড?

চাদরে রক্ত লেগেছে, এক মুহূর্তের বিরতি। আমি ওর পর্দা ভেঙেছি।

ওর মনে হলো, ভার্জিনিয়ার চোখে কিছু একটা মুহূর্তের জন্য আন্দোলিত হয়েছে। নাও হতে পারে, হয়তো খুব করে চাইছে দেখেই এমনটা মনে হচ্ছে। এখন যাও, এড। তুমি বিলিকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছ।

বেরিয়ে গেল সে। বুইক স্টার্ট নিতে চাচ্ছিল না। এই বৃষ্টিতে হাঁটতে হবে ভেবে যখন প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছে, তখন শেষ পর্যন্ত ইঞ্জিনটা চালু হলো। একটা সিগারেট জ্বালিয়ে গাড়ি পিছিয়ে এনে উঠে এল চৌদ্দ নম্বর রোডে। মেঝের সাথে ক্লাচ চেপে ধরে গাড়ি ছোটাল সে, প্রচন্ড ঝাঁকি খাচ্ছে। জেনারেটরের বাতিটা হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে দুইবার মিটমিট করে উঠল, তারপর এসে স্থির হলো গাড়িটা, ছুট দিল গেট ফলসের রাস্তা কাঁপিয়ে। এতক্ষণে চিকো নিজের পথে উঠে এসেছে।

শেষ একবার জনির ডজের দিকে ফিরে তাকাল সে।

গেট মিলস অ্যান্ড উইভিংসে জনি চাইলে নিয়মিত কাজ নিতে পারত, কিন্তু সেটা নিতে হতো রাতের শিফটে। রাতের কাজ ওকে বিরক্ত করত না, চিকোকে বলেছিল সে, তাছাড়া প্লেন শহরের চেয়ে এখানে টাকাও বেশি পাওয়া যায়। কিন্তু তাদের বাবাকে অনেক সময় কয়েকদিন ধরে দিন-রাত টানা কাজ করতে হতো। আর, বাবার রাতের কাজ মানে ভার্জিনিয়ার সাথে জনিকে বাসায় থাকতে হতো; একা, কিংবা পাশের ঘরে চিকোসহ। আর দেয়ালগুলো ছিল একদম পাতলা। আমি থামতে পারতাম না আর সে আমাকে থামার চেষ্টা করার সুযোগও দিত না, জনি বলেছিল চিকোকে। হ্যাঁ, আমি জানি, এটা বাবার কী অবস্থা করবে, কিন্তু সে, সে নিজেও থামে না আর আমাকেও থামতে দেয় না। সে সবসময় আমার কাছে আসতে চায়। তুই তো জানিস, আমি কী বোঝাতে চাচ্ছি, নিজের চোখেই তো দেখিস। বিলির তো এসব বোঝার বয়স হয়নি, কিন্তু তুই তো দেখেছিস, না?

হ্যাঁ, সে দেখেছে। এজন্যই জনি প্লেন শহরে কাজ খুঁজতে গিয়েছিল আর বাবাকে বলেছিল, ওখানে ডজের পার্টস সস্তায় পাওয়া যায় দেখে একটু যাচ্ছে। এজন্যেই সেদিন সে টায়ার পাল্টাচ্ছিল, যখন ইনফিল্ড ধরে মাস্টাংটা পিছলে ছুটে গিয়েছিল ওর দিকে, সাথে ছিল প্রচন্ড বিস্ফোরণের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত উপকরণ। এভাবেই ওর সৎ মা ওর ভাইকে খুন করেছে। তোমার সমস্ত ছিন্ন করা পর্যন্ত বাজাতে থাকো, ব্লু। কারণ, এই জঘন্য বুইকে করেই যেভাবেই হোক আমি স্টাড সিটি যাচ্ছি। মনে পড়ে যেতে লাগল পোড়া রবারের গন্ধ, ওর ভাইয়ের সাদা টি-শার্টের ভেতরে মেরুদন্ডের প্রতিটি হাড় আলো-আঁধারের খেলায় কেমন ফুটকির মতো দেখাচ্ছিল। মনে পড়ে গেল, মাস্টাংটা ধাক্কা মারার সময় জনি কেমন অর্ধেকের মতো উঠে দাঁড়িয়েছিল, এমন সময় সেটা শেভির সাথে জনিকে পিষে ফেলে। বীভৎস এক শব্দ করে জ্যাক স্কু থেকে ছিটকে পড়ে শেভিটা। হলুদ লকলকে অগ্নিশিখা, গ্যাসোলিনের প্রচন্ড গন্ধ–ভাবতে ভাবতে গায়ের সবটা শক্তি দিয়ে মেঝের সাথে ব্রেক চেপে ধরে চিকো, কড়কড় করে প্রচণ্ড শব্দে কেঁপে উঠে থেমে যায় সেডানটা। সারা গা ভিজে জবজবে হয়ে গেছে, সিটের উপরে প্রায় শুয়ে পড়ে একহাতে প্যাসেঞ্জার সাইডের দরজাটা মেলে ধরে হড়হড় করে বমি করে দেয় সে। রাস্তায় জমে থাকা কাদা আর তুষারের। ওপর হলদে বমি ছড়িয়ে পড়ে, সেটা দেখে আরেকবার ভেতরের সবকিছু উল্টে আসে ওর। এই ভাবনাটাই আরো একবার উসকে দেয় অনুভূতিটা, তৃতীয়বারের মতো বমি করার পর শেষ পর্যন্ত একটু স্থির হয় সে। গাড়ির ইঞ্জিন প্রায় থেমেই গিয়েছিল, এ সময় আবার নিয়ন্ত্রণ হাতে তুলে নেয়। পাওয়ার দেয়ার চেষ্টা করতেই জেনারেটর আরেকদফা চোখ টিপে দেয় ওকে। স্থির বসে থেকে শরীরের কাঁপুনি একটু কমে আসার সুযোগ করে দেয় সে। এ সময় একটা নতুন ফোর্ড গাড়ি কাদাপানি ছিটাতে ছিটাতে দ্রুতবেগে পাশ দিয়ে ছুটে যায়। বিড়বিড় করে চিকো বলে ওঠে, নতুন স্টাড গাড়িতে করে স্টাড সিটি যাচ্ছে। শালা!

ঠোঁটে, গলায় বমির স্বাদ অনুভব করে চিকো। ওর কাছে মনে হয়, সাইনাসগুলোতেও বুঝি বমি ঢুকে গেছে। সিগারেট খাওয়ার ইচ্ছেও হয় না আর। ড্যানি কার্টার হয়তো ওর এখানে আজকে রাতটা কাটাতে দেবে। কালকে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়ার যথেষ্ট সময় পাওয়া যাবে। গাড়ি একটুখানি পিছিয়ে এনে রোড চৌদ্দ ধরে আবার ছুট দিয়ে চিকো।

অধ্যায় ৮

খুবই ফালতু এবং ড্রামাটিক, না?

পৃথিবী এর চেয়ে এক-দুটো ভালো গল্প তো পেয়েছেই। উঁহু, ভুল হলো। পৃথিবী আসলে এর চেয়ে হাজার-দুহাজারেরও বেশি ভালো গল্প পেয়েছে, আমি জানি। এই গল্পের প্রতি পৃষ্ঠায় অদৃশ্য এক ছাপমারা আছে, আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ক্রিয়েটিভ রাইটিং ওয়ার্কশপের ফল হিসেবে লিখিত। কারণ, এই গল্পকে এরচেয়ে ভালো কিছু বলার কেননা উপায়ই নেই, অন্তত একটা পর্যায় পর্যন্ত তো অবশ্যই। এখন আমার মনে হয়, এটা খুবই কাঁচা হাতের কাজ এবং দুঃখজনকভাবে হেমিংওয়ে স্টাইল এবং ফকনারের থিম থেকে ভয়াবহ প্রভাবিত। এরচেয়ে সিরিয়াস আর কিছু হতে পারে? বিশাল সাহিত্য যাকে বলে আরকি!

যদিও, চলমান ট্রেন্ড অনুসরণ করতে গিয়ে পুরো জিনিসটাকে সে সময় আমি বর্তমান কালের বাক্যে লিখেছিলাম। কী হাস্যকর!

কিন্তু এই গল্প যতই সিরিয়াস হওয়ার ভান করুক এবং যতভাবেই জাতে উঠতে চাক না কেন, এটা যে খুবই অনভিজ্ঞ এবং কম বয়সি এক ছেলের হাতে লেখা প্রচন্ডরকম যৌন-গল্প, সে কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই (স্টাড সিটি লেখার আগে আমি কেবল দুটো মেয়ের সাথে শুয়েছি, এর মাঝে আবার একজনের সাথে কিছু হওয়ার আগেই আমি ওর গায়ের উপরেই ফেলে দিয়েছি সবটা! আমি যে সে সময় এদিক থেকে গল্পের চিকোর ধারেকাছেও ছিলাম না, সে কথা নিশ্চয়ই আলাদা করে বলে দেওয়ার প্রয়োজন নেই)। মেয়েদের ব্যাপারে এই গল্পের মনোভাব ভয়াবহরকম বৈরি ও বাজে ধরনের, আর একটা জায়গায় এসে এটি একেবারে সত্যিকারের কুৎসিত রুপ ধারণ করেছে: স্টাড সিটির দুজন নারী চরিত্রকে সরল কথায় পতিতা হিসেবে দেখানো হয়েছে, আর তৃতীয় চরিত্রটি হচ্ছে মোমের পুতুল, যে কি না ভালোবাসি, চিকো কিংবা ভেতরে আসলে আমি তোমাকে কুকি বিস্কুট দেব ধরনের কথাবার্তা বলে। এদিকে চিকো হচ্ছে পেশিবহুল, ধূমপায়ী এবং পরিশ্রমী এক নায়ক, যে কি না প্রতিবাদস্বরুপ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে পারে এবং ব্রুস স্পিংস্টিনের পুরনো দিনের গানের রেকর্ড কিংবা এ ধরনের কিছু শুনতে পছন্দ করে। যদিও আমি যখন কলেজের সাহিত্য ম্যাগাজিনে গল্পটা দিয়েছিলাম (যেখানে ইমেজেস অফ মি শিরোনামের একটি কবিতা আর ছোট হাতের অক্ষরে গুঁড়ি শুড়ি করে লেখা ছাত্র-ছাত্রীদের পরিচয়ের বিস্তারিত তথ্যের মাঝখানে এটি প্রকাশিত হয়েছিল), তখনো কেউ ব্রুস স্পিংস্টিনের নামই শোনেনি। প্রচন্ড নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা অনভিজ্ঞ এক তরুণের কাজ এটি। অথচ পাঁচ বছর ধরে চেষ্টা করার পরে এটাই ছিল আমার লেখা প্রথম গল্প, যেটাকে আমার কাছে নিজের গল্প বলে মনে হয়। এমন এক গল্প, আমার পরিচয় ছাড়াই যেটি নিজে নিজে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে। কুৎসিত হলেও প্রাণ আছে গল্পটায়। এখনো যখন আমি গল্পটা পড়ি, এর নকল কঠোরতা এবং প্রবল ভান দেখে হাসতে হাসতে নিশ্বাস আটকে আসে আমার, কিন্তু এরপরেও, প্রতিটা ছাপানো অক্ষরের পিছনে আমি গর্ডন লুশ্যান্সের মুখ দেখতে পাই। বর্তমানের লেখক থেকে সেই গর্ডন লুশ্যান্স অনেক তরুণ এবং অবশ্যই এখনকার বেস্টসেলিং ঔপন্যাসিকের চেয়ে অনেক বেশি আদর্শবান–কারণ এখনকার গর্ডন তার বইয়ের চেয়ে বইয়ের কন্ট্রাক্ট নিয়ে বেশিী মাথা ঘামায়–আবার এতটাও তরুণ না যে, সেই কিশোর বয়সি গর্ডন লুশ্যান্সের মতো বন্ধুদের সাথে রে ব্রাওয়ারের লাশ দেখতে বেরিয়ে পড়বে। জীবনের উজ্জ্বলতা হারিয়ে ফেলার মাঝপথে ছুটে চলা এক গর্ডন লুশ্যান্স সে। না, তার লেখা এই গল্পটা খুব ভালো কোনো গল্প না; কারণ, ভেতর থেকে উঠে আসা যেসব স্বর, যেসব কথা তার অনেক মনযোগ দিয়ে শোনা উচিত ছিল, সেসব সেভাবে শোনার চেষ্টাই করেনি সে তখনো। কিন্তু এই গল্পেই আমি প্রথম আমার পরিচিত জায়গা ব্যবহার করেছি, ব্যবহার করেছি আমার কল্পনায় অনুভব করা বিভিন্ন জিনিস। আমাকে যে জিনিসগুলো বছরের পর বছর খুঁচিয়েছে, কষ্ট দিয়েছে, সেসব জিনিসকে নতুনভাবে প্রকাশ করতে পেরে নিজের ভেতরে তীব্র এক উল্লাস অনুভব করেছি আমি। কারণ, এ সময় সব কিছুর ওপর আমার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল। স্টাড সিটি লেখার কত আগে যে শেষবার আলমারির দেরাজের ভেতরে লুকিয়ে থাকা ড্যানির ভয়াবহতা এবং এবং ওর ঘরের কথা ভেবেছি! আমি সত্যিকার অর্থেই বিশ্বাস করতাম, সবকিছু ভুলে গেছি, কিন্তু গল্পে ঠিকই বেরিয়ে এসেছে সমস্ত কিছু, তবে কিছুটা পরিবর্তিত এবং নিয়ন্ত্রিতভাবে।

এই ব্যাপারে লিখতে গিয়ে আরো অনেক বেশি পরিবর্তন করার ইচ্ছেটাকে জোর করে আটকাতে হয়েছে। মনে হয়েছে, নতুন করে নিজের মতো করে লিখি, রসালো কিছু যোগ করি। সে সময় ওই ইচ্ছেটা প্রবল ছিল বলেই হয়তো এটুকু পরিবর্তন করেছি, কারণ, এখন গল্প পড়তে গিয়ে যা। লিখেছি, সেজন্য বিব্রত বোধ হয় আমার। তারপরও এর মাঝের অনেক কিছুই আমার পছন্দ। চুল ধুসর হয়ে পড়া বর্তমান শ্যান্স যদি এ গল্পে হাত দিতে চায়, সেসব জিনিস হয়তো সস্তা হয়ে যাবে, আর আগের মতো থাকবে না। সাদা শার্ট পরা জনির ছায়ার যে ছবি এই গল্পে আঁকা হয়েছে, কিংবা জেনের নগ্নদেহে ঢেউ তোলা বৃষ্টির যে বর্ণনা উঠে এসেছে, এদের যতটা ভালোভাবে উঠে আসার কথা, এরা আসলে তারচেয়ে অনেক ভালোভাবে এসেছে।

তাছাড়া, এটাই আমার লেখা প্রথম গল্প, যেটা আমি বাবা-মাকে দেখাইনি। কারণ, এর মাঝে বড় বেশি ড্যানি চলে এসেছে, ক্যাসল রক আবির্ভূত হয়েছে স্বরুপে। সেই সাথে প্রবলভাবে উঠে এসেছে ১৯৬০।

সত্যকে দেখলেই আপনি চিনতে পারবেন। কারণ, নিজের গায়ে হোক কিংবা অন্য কারো, সত্যের আঁচড় লাগলে রক্তক্ষরণ হবেই।

অধ্যায় ৯

আমার রুম ছিল দ্বিতীয় তলায় এবং সেদিনের তাপমাত্রা ছিল অন্তত নব্বই ডিগ্রির মতো।

সব জানালা খুলে রাখলেও বিকেলের মধ্যে এই তাপমাত্রা বেড়ে একশ দশের মতো হয়ে যাবে, আমি জানতাম। সে রাতে এরমাঝে ঘুমাতে হবে না দেখে আমি এমনিতেই খুশি ছিলাম, তার ওপর যেখানে যাব, সেখানকার কথা ভেবে প্রচন্ড উত্তেজনায় ভেতরে ভেতরে টগবগ করে ফুটছিলাম। দুটো কম্বল মুড়ে বেডরোল তৈরি করে আমার পুরনো বেল্টের সাথে বেঁধে নিলাম। যত টাকা-পয়সা আছে, সব গুছিয়ে জড়ো করে সাথে নিলাম; যার মাঝে সর্বসাকুল্যে মোট আটষট্টি সেন্ট ছিল। ব্যাস! যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলাম আমি।

বাবাকে এড়ানোর জন্য বাসার পেছনের সিঁড়ি ধরে নেমে এলাম নিচে। কিন্তু চিন্তার কিছু ছিল না আসলে, উনি তখনো বাগানে হোস পাইপ দিয়ে অনর্থক পানি দিয়ে যাচ্ছেন এবং পানি দেওয়ার সময় বাতাসে যে রংধনু তৈরি হচ্ছে, তাই দেখছেন নিবিষ্ট মনযোগে।

সামার স্ট্রিট ধরে হেঁটে একটা ফাঁকা পার্কিং লট ধরে শর্টকাট মেরে কার্বাইনের দিকে পা চালালাম। বর্তমানে ক্যাসল কলের অফিসগুলো এই কার্বাইনেই অবস্থিত। কার্বাইন থেকে যাবো ক্লাবহাউজে, এ সময় রাস্তার পাশে একটা গাড়ি এসে থামল। একহাতে ওল্ডবয় স্কাউট প্যাক নিয়ে ক্রিস নেমে এল, অন্যহাতে দুটো কম্বল মুড়ে বেডরোল করে কাপড়ের দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়েছে।

ধন্যবাদ, ভাই, বলল সে, তারপর গাড়ি চলে যেতেই ধীর পায়ে আমার দিকে এগিয়ে এল। ঘাড় থেকে বয় স্কাউট ক্যান্টিনটা ঝুলছে, যেটা একহাতের নিচ দিয়ে কোমরের কাছে এসে থেমেছে। চোখ দুটো ঝলমল করছিল। কাছে এসেই বলল, গর্ডি, একটা জিনিস দেখবি?

অবশ্যই। কী?

ব্লু পয়েন্ট ডিনার আর ক্যাসল রক ড্রগস্টোরের মাঝের সরু গলিটার দিকে ইশারা করে বলল, আগে এদিকে আয়।

জিনিসটা কী, ক্রিস?

বললাম তো, আগে এদিকে আয়!

ক্রিস গলিটার দিকে দৌড় দিলে কয়েক মুহূর্ত পর (আমার নিজের বিবেচনাবোধ ভুলে যাওয়ার জন্যে এটুকু সময়ই যথেষ্ট ছিল) আমিও ওর পিছনে পিছনে ছুট দিলাম। দুপাশের বিল্ডিংদুটো সমান্তরালভাবে বানানো হয়নি, বরং যত ভেতরের দিকে গেছে, ততই এরা একে অন্যের দিকে চেপে এসেছে। কাজেই, গলিটাও ভেতরের দিকে ধীরে ধীরে আরো সরু হয়ে গেছে। ফেলে রাখা পুরনো খবরের কাগজের স্তূপের মধ্যে দিয়ে কষ্টেসৃষ্টে ছুটে যেতে হলো, পায়ের নিচে প্রায়ই বিয়ার এবং সোড়া বোতলের ভাঙাচুরো পড়ছে। ব্লু পয়েন্টের পেছনে এসে থেমে গেল ক্রিস, বেডরোলটা নামিয়ে রাখল একপাশে। ঠিক এ জায়গাতেই আট থেকে নয়টা ময়লার বাক্স পাশাপাশি রাখা ছিল। কী ভয়াবহ দুর্গন্ধ!

ধ্যাৎ! জিশুর দোহাই, এবারে একটু মাফ কর না আমাকে!

মুখস্ত বুলির মতো জবাব দিল ক্রিস, তোর হাত দে।

মোটেও না। আমি বরং এখনই বমি করে

মুখের কথা আমার মুখেই রয়ে গেল। চারপাশের দুর্গন্ধময় ময়লার বাক্সের কথা মুহূর্তের মাঝে বেমালুম ভুলে গেলাম। ক্রিস ততক্ষণে ওর প্যাক নামিয়ে হাত ঢুকিয়ে দিয়েছিল। এই মুহূর্তে ওর হাতে কালো কাঠের গ্রিপসহ বিশাল এক পিস্তল দেখা যাচ্ছে।

হাসতে হাসতে ক্রিস বলল, কী হতে চাস, বললেন রেঞ্জার না সিসকো কিড?

হায় জিশু! তুই এই জিনিস কোথায় পেয়েছিস??

বাবার আলমারি থেকে মেরে দিয়েছি। পয়েন্ট ফোর্টি ফাইভ।

হ্যাঁ, তা তো দেখতেই পাচ্ছি বললাম ঠিকই, কিন্তু এটা কি ও যা বলছে তাই, নাকি পয়েন্ট থার্টি এইট, নাকি পয়েন্ট থ্রি ফিফটি সেভেন–এসব ব্যাপারে বিন্দুমাত্রও ধারণা ছিল না আমার। যতই জন ডি ম্যাকডোনাল্ডস আর এড মেকবেইনস পড়ি না কেন, বাস্তবে কন্সটেবল ব্যানারম্যান যে পিস্তলটা হোলস্টারে নিয়ে ঘুরে বেড়ান, সেটা ছাড়া আর কোনো পিস্তল কাছ থেকেও দেখিনি। আর, পিচ্চিরা ওনাকে যতই অনুরোধ করুক, ওই পিস্তল উনি জীবনেও হোলস্টার থেকে বের করতেন না।

টের পেলে তোর বাবা তোকে যে মারটা মারবে, সেটার কথা চিন্তা করেছিস? সেদিনও বললি, দিন দিন এমনিতেই ওনার ব্যবহার আরো খারাপ হচ্ছে।

ক্রিসের চোখ দুটো নেচে উঠল। সেটাই ব্যাপারটা, বাবা জীবনেও টের পাবে না। হ্যারিসনের ওখানে আট-দশটা বোতল নিয়ে দলবলসহ মাতাল হয়ে পড়ে আছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যেও ফিরবে বলে মনে হয় না। শালার নেশাখোরের দল! বলতে বলতে ওর ঠোঁটের কোণা ঘৃণায় বেঁকে গেল। আমাদের দলের ওই একমাত্র মানুষ, যে কখনো মদ ছুঁয়েও দেখেনি; এমনকি মানুষের কাছে নিজের মুরোদ দেখাতে গিয়েও না। আমাকে বলেছিল, বাবার মতো জঘন্য মদ্যপ হিসেবে বেড়ে উঠতে চায় না। আরেকবার ডিস্পেইন ভাইরা যখন ওদের বাবার কাছ থেকে পুরো ছয় প্যাকেট চুরি করে নিয়ে এসেছিল, ক্রিস তখন বোতল তো বোতল, এক চুমুক বিয়ারও চেখে দেখতে রাজি হয়নি। এজন্য অনেক কথা শুনতে হয়েছে ওকে। সেদিন ও আমাকে গোপনে বলেছিল, মদ জিনিসটাকেই সে খুব ভয় পায়। ওর বাবা নাকি এক মুহূর্তের জন্যেও মদের বোতল থেকে নাক বের করতে পারে না। বড় ভাইটা যখন সেই মেয়েটাকে ধর্ষণ করল, তখন সেও গলা পর্যন্ত মদ খেয়ে চুর হয়েছিল। এদিকে আরেক ভাই আইবল এইস মেরিল, চার্লি হোগান আর বিলি টেসিওর সাথে মিলে সারাক্ষণ সেই বোতল নিয়েই আছে। ওরা ককটেল মতো যেটা খায়, সেটাকে বলে পার্পল জেসাস। ক্রিস আমার কাছে আকুলভাবে জানতে চেয়েছিল, সে যদি কোনোদিন ভুলেও বোতল চেখেও দেখে, সে কী ওসব ছেড়ে বের হতে পারবে? জানি, এ কথা শুনে আপনাদের হাস্যকর লাগতে পারে। বারো বছরের এক পিচ্চি এক চুমুক অ্যালকোহল মুখে নেওয়ার আগেই নেশাখোর হয়ে যাবে কি না, সে কথা ভেবে এরকম আতঙ্কিত হয়ে আছে। কিন্তু ক্রিসের কাছে এই ব্যাপারটা মোটেও হাস্যকর ছিল না। এরকম সম্ভাবনা নিয়ে ও আসলেই খুব চিন্তিত ছিল, এবং এভাবে চিন্তিত হওয়ার মতো অবস্থাও নিতান্ত কম তৈরি হয়নি ওর জীবনে।

গুলিও আছে নাকি সাথে?

নয়টা–বাক্সে যা ছিল, সব নিয়ে এসেছি। বাবা খুঁজে না পেলে ভাববে, মাতাল অবস্থায় নিজেই বোতলে গুলি করে সব শেষ করেছে।

পিস্তলে কি গুলি লোড করা আছে?

না! খোদার দোহাই, তুই কী মনে করিস আমাকে?

শেষ পর্যন্ত পিস্তলটা হাতে নিলাম আমি। হাতের তালুতে যে ভার অনুভব করেছিলাম, সেটা মুহূর্তেই ভালো লেগে গেল। নিজেকে মনে হতে লাগল 87th Precinct এর স্টিভ ক্যারেলা, হেকলার নামের সেই সন্ত্রাসীর পেছনে ছুটছি কিংবা উন্মত্ত কোনো হিরোইনচির নোংরা বাসায় হামলা দেওয়ার সময় মায়ার মায়ারকে কিংবা বার্ট ক্লিংকে কভার দিচ্ছি। সামনের দুর্গন্ধময় ময়লার বাক্সগুলোর একটার দিকে নিশানা করে সিনেমাটিকভাবে ট্রিগার টিপে দিলাম,

কা-বাম!

পিস্তলটা আমার হাতে লাফিয়ে উঠল, ওমাথা থেকে ছিটকে বেরুল অগ্নিশিখা। মনে হলো, হাতের কবজিটা বুঝি ভেঙেই গেছে। হৃদপিন্ড লাফ দিয়ে গলায় উঠে এসেছে, কাঁপছে তিরতির করে। ময়লার বাক্সের ধাতব গায়ে একটা বিশাল গর্ত সৃষ্টি হয়েছে, মনে হচ্ছে যেন কোনো কালো জাদুকরের কাজ।

জিশু! বলে চিৎকার করে উঠলাম।

ক্রিস কেমন অদ্ভুত ধরনের শব্দ করছিল। আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না সে কি উন্মাদ আনন্দে পাগল হয়ে গেছে, নাকি প্রচন্ড আতঙ্কে কাঁপছে। শেষ পর্যন্ত উল্লাস ধ্বনি বেরিয়ে এল ওর মুখ থেকে, তুই করেছিস! তুই করেছিস! গর্ডি করে ফেলেছে! দেখ, সবাই দেখ, গর্ডন লুশ্যান্স ক্যাসল রকে গুলি চালিয়ে দিয়েছে!

চুপ কর! চিৎকার করে ওর শার্ট চেপে ধরলাম, বের হ এখান থেকে!

আমরা যখন দৌড় দিলাম, ততক্ষণে ব্লু পয়েন্টের পেছনের দরজা খুলে ওয়েট্রেসের সাদা ইউনিফর্ম পরা ফ্রেঞ্চিন টাপার বেরিয়ে এসেছে। শুনলাম, মেয়েটা চিৎকার করে বলছে, কে রে এখানে? কে এসব চেরি-বোম ফাটাচ্ছে?

ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় দিলাম। ড্রাগ স্টোর, হার্ডওয়্যার স্টোর, অ্যান্টিক আর সস্তা বইপত্র বিক্রির দোকান এবং অ্যাম্পোরিয়াম গ্যালোরিয়ামের পেছন দিয়ে শর্টকাট মেরে ছুটতে গিয়ে কাঁটাতারের বেড়া টপকাতে হলো। কাঁটাতারের খোঁচায় হাতের তালু ছড়ে গেল কিছুটা, কিন্তু ওসব দেখার সময় কই! শেষ পর্যন্ত কারান স্ট্রিট ধরে বেরিয়ে এলাম বাইরে। হাসতে হাসতে মারা যাওয়ার অবস্থা ক্রিসের, মেজাজ খারাপ করে দৌড়াতে দৌড়াতেই ওর দিকে পয়েন্ট ফোর্টি ফাইভটা ছুঁড়ে মারলাম। ওই অবস্থাতেই লুফে নিল সে, তারপর কেমন করে যেন কাঁধের ব্যাগটায় ঢুকিয়েও ফেলল। কারান স্ট্রিটের কোণ ধরে কার্বাইন স্ট্রিটে উঠে এসে দৌড়ের গতি কমিয়ে হাঁটা শুরু করলাম, এই গরমের মাঝে দৌড়াতে দেখে আবার কেউ না সন্দেহ করে বসে। ক্রিস তখনো হাসি থামাতে পারেনি।

ভাই রে, নিজের মুখটা যদি কেবল একবার দেখতি! ওহ! অমূল্য মুখভঙ্গি! বাঁধিয়ে রাখার মতো, যাকে বলে শালার মাথা ঝাঁকিয়ে প্রবল আনন্দে নিজের উরুতে বাড়ি মেরে আনন্দধ্বনি করে উঠল সে।

তুই জানতি পিস্তলটা লোডেড, তাই না? হারামজাদা! আমাকে যে ঝামেলায় ফেলে দিলি? ওই টাপির সুন্দরি আমাকে দেখেছে।

ধুর! সে তো ভেবেছে, কেউ বাজি ফুটিয়েছে। তাছাড়া, ওই বুড়ি নিজের নাকের সামনের কিছুও ঠিক করে দেখতে পায় না, আর এতদূরে কী দেখবে? জানিস তো, সে মনে করে চশমা পরলে নাকি ওর মুখের সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাবে। এই বলে এক হাতের তালু দিয়ে কোমরে বাড়ি মেরে আরেক দফা হাহা করে হেসে উঠল ক্রিস।

যাই হোক, তোর এই কাজটা আসলে খুবই লেইম ছিল। ঠিক করিসনি।

কাম অন! আমার কাঁধে একহাত রাখল সে, আমি আসলেই জানতাম, ওটা লোড করা ছিল। খোদার কসম, যা, আমার মায়ের নামে কসম করলে বিশ্বাস করবি? আমি শুধু বাবার আলমারিতে যেভাবে পেয়েছি, নিয়ে এসেছি। সাধারণত তো আনলোড করেই রাখে। শেষবার যখন রেখেছে, একেবারে বদ্ধ মাতাল ছিল মনে হয়।

আসলেই তুই নিজে লোড করিসনি??

না, স্যার!

মায়ের নামে কসম করেছিস কিন্তু। মিথ্যে বললে, তোর মা মরার পরে নরকে যাবে, বুঝিস।

হ্যাঁ, বাপ, কসম, ক্রুশ চিহ্ন এঁকে বিড়বিড় করে বুকে থুথু দিল সে, চার্চে গান গেয়ে প্রার্থনা করার সময় কয়েরবয়দের মুখ যেমন দেখায়, তেমন দেখাচ্ছিল ওকে।

কয়েকমুহূর্ত, মোড় ঘুরে যে ফাঁকা জায়গাটায় ট্রি হাউসটা আছে, ওখানে পা দিতেই আবার হাসিতে ফেটে পড়ল ক্রিস। ভার্ন আর টেডিকে দেখলাম বেডরোলের উপরে বসে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। সবার আগে ওদেরকে পুরো ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিল ক্রিস। প্রত্যেকে নিজের মতো করে আমাকে পঁচিয়ে শেষ করার পরে টেডি জিজ্ঞাসা করল, ক্রিস কী ভেবে পিস্তল সাথে নিয়েছে।

তেমন কিছু না, কিন্তু ধর, সামনে কোনো ভালুক পড়ে গেল? এরকম কিছু হলে লাগতে পারে আরকি। তাছাড়া, বনে একেবারে খালি হাতে রাত কাটানো একটু কেমন যেন, ভয় ভয় লাগে না?

সবাই মাথা নেড়ে সায় দিল। আমাদের মাঝে ক্রিস হচ্ছে সবচেয়ে সাহসী। ও এমন কিছু বললে এই নিয়ে সাধারণত কেউ আর কিছু বলে না। কিন্তু ওর জায়গায় টেডি যদি অন্ধকারে ভয় পাওয়ার সামান্য ইঙ্গিতও দিত, সবাই একেবারে জ্বালিয়ে ফেলত ওকে।

টেডি ভার্নকে প্রশ্ন করল, তোদের মাঠে তাঁবু টানিয়েছিস তো ঠিকঠাক করে?

টানিয়েছি মানে, ওর মাঝে দুটো ফ্ল্যাশলাইটও জ্বালিয়ে রেখে এসেছি, যাতে দেখে মনে হয় সন্ধ্যার পরেও আমরা ওখানেই আছি।

দারুণ করেছিস! ভার্নের পিঠ চাপড়ে দিলাম। ওর হিসেবে এইটুকু চিন্তা আসলেই অনেক কিছু। একটু লজ্জা পেল ভার্ন, হেসে ফেলল আনন্দে।

চল তাহলে, যাওয়া যাক! টেডির কথার জবাবে ক্রিস বলল, হ্যাঁ, চল। বারোটা তত বেজেই গেল প্রায়। আমরা সবাই ওকে ঘিরে দাঁড়ালাম।

ও বলল, আমরা বিমানের মাঠের মধ্যে দিয়ে হেঁটে, সনির টেক্সাকোর পাশের ফার্নিচারের দোকানটার পেছন দিয়ে গিয়ে ডাস্পটা ধরে রেলবোড় ট্র্যাকে গিয়ে উঠব। তারপর ওটা ধরে সোজা হেঁটে ব্রিজ পেরিয়ে গেলেই হার্লোতে পৌঁছে যাব।

টেডি জানতে চাইল, তোর হিসেবে কতদূর হবে মোট?

শ্রাগ করল ক্রিস, হার্লো তো বিশাল এলাকা। আমাদেরকে অন্তত বিশ মাইল হাঁটতে হবে। তোর কী মনে হয়, গর্ডি?

হতে পারে, আবার ত্রিশ মাইলও হতে পারে।

ত্রিশ মাইল হলেও কালকে বিকালের মাঝে ওখানে গিয়ে পৌঁছানো সম্ভব, যদি কেউ পিঠটান না দেয় আর কি।

এখানে কেউই অমন ভীতুর ডিম না, টেডির কথা শুনে আমরা সবাই একে অন্যের দিকে তাকালাম।

চল তাহলে! বলতে বলতে ক্রিস ওর ব্যাকপাক কাঁধে তুলে নিল। খালি জায়গাটা ধরে আমরা সবাই একসাথে পা বাড়ালাম। খেয়াল করলে বোঝা যেত, ক্রিস সামান্য এগিয়ে থেকে আপনাতেই আমাদের নেতৃত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *