দেয়ালের দেশ – সৈয়দ শামসুল হক
লঞ্চ থেকে নেমে যখন নৌকোয় উঠল ফারুক, বেলা তখন পড়তি পহর। তেঁতুলিয়ার শাখা নদী আঁধার হয়ে আসছে। ইলশাঘাটা, লাখুটিয়া, উলানিয়ার নৌকো দুরন্ত পাড়ি জমিয়েছে। কেউবা মাঝরাতে, কেউবা ভোর রাতে পৌঁছবে।
সে তুলনায় ফারুক যাবে অনেক কাছে। টিম্বার মার্চেন্ট আবিদের বাংলোয়। হয়ত ঘন্টা তিনেকও লাগবে না স্রোত পেলে। নদী এখানে অনেক শান্ত। আকাশের দিগন্ত অবধি তার। বিস্তারই শুধু, কিন্তু দক্ষিণের মত জোয়ারের পাহাড়–ঢেউ ওঠে না এদিকে। দেখতেই যা। বিশাল। ছোট ছোট নৌকো নিয়ে এমনকি বাচ্চা ছেলেরাও পাড়ি দিয়ে ওপারে যায়। খেলনার মত তাদের নৌকো দেখে বুকে ভর করে ভয়। কিন্তু এখানকার অধিবাসীদের কাছে এ তুচ্ছ। নদী আর অরণ্যের সাথে সংগ্রামই তাদের জীবন। কিন্তু ফারুকের কেমন ভয় ভয় করে। আচ্ছা, এদিকে কি নৌকোডুবি হয় না? ধরো, আজকেই যদি অমন একটা দুর্ঘটনা ঘটে, তাহলে? ফারুক ছইয়ের ভেতরে পাটাতনে শুয়ে ভাবছিল। চোখ বুজলো। খানিকটা অবসাদে, খানিকটা হয়ত ভয়ে।
অথবা সে শুনেছে এদিকে নাকি নৌকোয় ডাকাতি হয়। বড় বড় জাঁদরেল পুলিশ সায়েবেরাও নাকি তাদের শায়েস্তা করতে গিয়ে হিমসিম খেয়ে যান। সে কথা মনে করলে গায়ের নোম খাড়া হয়ে ওঠে।
ফারুক হাতের আঙটি দুটো নাড়াচাড়া করতে করতে ভাবে, না এলেই সে পারত। বেশতো ছিল সে ঢাকায়। সব কিছু প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। আজ তিনবছর বাদে সেই ভুলে যাওয়া অতীতটাই তাকে যে এখানে টেনে আনবে তা কে জানতো? তাহমিনাকে তিনবছর আগেই ভুলে যেতে চেয়েছিল ফারুক।
তাহমিনার এতদিন পরে হঠাৎ আসা এক চিঠিতে এমন করে না বেরিয়ে পড়লেও চলতো। তাহমিনা লিখেছে, “এতদিন বাদে তোমাকেই লিখছি বলে অবাক হয়ো না ফারুক। তোমাকে আমি জানি। যদি কোনোদিন আমাকে তুমি তোমার বলে ভেবে থাকো, তাহলে এ চিঠিকে তুমি উপেক্ষা করবে না, এ আমি জানি। তোমাকে আমার ভীষণ দরকার। চিঠি পাবার সাথে সাথে এখানে চলে আসবে। জরুরি কাজ। আমার দিব্যি রইল, আসবে নিশ্চয়ই। পথের নিশানা নিচে লিখে দিচ্ছি। তাছাড়া আমাদের বাংলো এ অঞ্চলের সব মাঝিই চেনে। যতো কাজই তোমার থাক, তুমি আসবে ফারুক।”
তাহমিনাদের বাংলো এ নায়ের মাঝিও চেনে।
কিন্তু কী এমন বিপদ তাহমিনার? আর ফারুকই বা কী করতে পারে? একথা শুধু এখন নয় ঢাকা থেকেই মনে হয়েছে তার। কিন্তু না এসে পারে নি।
চিঠিটা যেদিন পেয়েছিল সেদিন অনেক রাতে ফারুক তার সুটকেসটা খুলেছিল। তাহমিনা কবে তাকে একটা ছবি দিয়েছিল। খুঁজে পেল না সেটা। ছবি দেয়ার ইতিহাসটা আজো তার মনে আছে। ফারুক একদিন সন্ধ্যার অন্ধকারে তাহমিনাদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বলেছিল বাগানে বিরাট এক সূর্যমুখীর সোনালির দিকে দেখিয়ে, কবিতা লিখতে ইচ্ছে হয়, তাহমিনা। তাই?
হ্যাঁ। এই অন্ধকারের মতই আমার চারদিকে অন্ধকার; আর তুমি যেন সেই অন্ধকারে সূর্যমুখীর মত।
বার থেকে বুঝি তাহমিনার বাবা কামাল সাহেব ফিরলেন। ওধারের বারান্দা থেকে তার ডাক শোনা গেল, মিনু, মিনু মা কইরে?
তাহমিনা বলেছিল, বাবা বুঝি পেশেন্ট দেখে ফিরলেন। যাই আমি।
যাবে?
বাঃ! বাবা ডাকছেন যে।
তাহমিনা চলে গেছ। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রইল ফারুক। হয়ত ও আর শীগগির আসবে না। এখুনি হয়ত কামাল সাহেব চা করতে বলবেন ওকে। তাহমিনাকে না হলে কামাল সাহেবের একদণ্ড চলে না।
কিন্তু তাহমিনা ফিরে এসেছিল একটু পরেই প্রায় দৌড়ে। বলেছিল, আমি ভাবলাম তুমি বুঝি চলে গেল। তারপর একটু থেমে, বলোত আমার হাতে কি?
ফারুক একটু ভাবল। কিন্তু তার আগে ও নিজেই উত্তর করল, ছবি। আমার ছবি। সেদিন আমরা সবাই স্টুডিওতে গিয়ে তুলেছিলাম। একটা গ্রুপ, আর সবার একটা করে। বাবা প্রিন্ট নিয়ে এলেন এই মাত্তর।
তাহমিনার হাত থেকে ফারুক কেড়ে নিল খামটা। একটু আলোর দিকে সরে বেছে বেছে বের করল তাহমিনার একলা ফটোর তিনটে প্রিন্ট।
তারপর বলল, একটা নিলাম। কাছে রাখব।
তাহলে আর এসো না। ছবিই দেখো। ছবি তো পেলে।
আচ্ছা তাই হবে। আসবো না। যদি তাই চাও।
সেই থেকে ছবিটা ফারুকের সুটকেশে। সে আজ পাঁচ বছর আগের কথা কী তারো বেশি হবে হয়ত।
সেদিন চিঠি পেয়ে রাতে সুটকেশটা তন্নতন্ন করে খুঁজেছিল ফারুক। কিন্তু ছবিটা পাওয়া যায়নি। অবশেষে তার মনে পড়ল, একদিন সে নিজেই ওটা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। আর খুঁজতে খুঁজতে চোখে পড়েছিল তাহমিনার আরো দুটো স্মৃতিচিহ্ন। একটা সেলুলয়েডের ছোট্ট স্বচ্ছ কেসে রাখা শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে যাওয়া মধুমল্লিকা। ফারুকের সাথে সন্ধি করে একদিন তাহমিনা দিয়েছিল। কেসের ভেতরে চ্যাপটা আর ম্লান হয়ে গেছে ফুল। বিবর্ণ হয়ে গেছে পাপড়ি। ধূসর হয়ে এসেছে। আর তার পাশে একটা কাগজের টুকরো। যার একপিঠে গোটা গোটা অক্ষরে একদিন তাহমিনা লিখে দিয়েছিল, রবীন্দ্রনাথের কবিতার কটা লাইন—-
কথা ছিল এক তরীতে কেবল তুমি আমি
যাব অকারণে ভেসে কেবল ভেসে।
লেখাগুলো আজো উজ্জ্বল ফারকের মনে হয়েছিল, ভালো করে কান পাতলে, আর বাইরের সমস্ত স্বর আর ধ্বনি থেমে গেলে, বুঝি আজো তাহমিনার সুরেলা গলায় সেই আবৃত্তি শুনতে পাওয়া যাবে।