০১. রুফ অফ দ্য ওয়ার্ল্ড

ব্ল্যাক অর্ডার – জেমস রোলিন্স / রূপান্তর : সাঈম শামস্ – নিউ ইয়র্ক টাইমস্ বেস্টসেলার

সিগমা ফোর্স # ৩

জীববিজ্ঞানের মেরুদণ্ড হলো বিবর্তনবাদ। এই অংশ বিজ্ঞানের একটি উন্নত থিওরির ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এখন প্রশ্ন হলো, বিবর্তনবাদ বিজ্ঞান নাকি বিশ্বাস?
–চার্লস ডারউইন

বিজ্ঞান ছাড়া ধর্ম পঙ্গু, ধর্ম ছাড়া বিজ্ঞান অন্ধ।
–আলবার্ট আইনস্টাইন

কে বলে আমি ঈশ্বরের বিশেষ নিরাপত্তায় নেই?
–অ্যাডলফ হিটলার

.

ইতিহাস থেকে

দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের শেষ কয়েক মাসে যখন জার্মানির অবস্থা একেবারে শোচনীয় তখন কে কার আগে নাৎসি বিজ্ঞানীদের বিভিন্ন প্রযুক্তি লুঠ করবে তা নিয়ে মিত্রবাহিনীর মধ্যে নতুন এক যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। এই লুঠ প্রতিযোগিতায় নেমেছিল ব্রিটিশ, আমেরিকান, ফ্রেন্স এবং রাশিয়ানরা। যে যার মতো করে নিজের দেশের জন্য লুঠপাট চালিয়েছিল। অনেক পেটেন্ট লুষ্ঠিত হয়েছিল তখন। যেমন : নতুন ভ্যাকুয়াম টিউব, চমকপ্রদ কেমিক্যালস, প্লাস্টিকস্ এমনকী ইউ ভি লাইটসহ পাস্তুরিত তরল দুধ! কিন্তু স্পর্শকাতর অনেক পেটেন্ট স্রেফ গায়েব হয়েছিল। যেমন : অপারেশন পেপার ক্লিপ; একশ নাৎসি ভি-২ রকেট বিজ্ঞানীদেরকে গোপনে নিযুক্ত করে আমেরিকায় নিয়ে আসা হয়েছিল তখন। পরে অপারেশন পেপার ক্লিপ সম্পর্কে তেমন কিছু আর জানা যায়নি।

তবে নিজেদের প্রযুক্তি বিনা যুদ্ধে সপে দেয়নি জার্মানরা। গোপন প্রযুক্তি ও পরবর্তী রাইখ প্রজননর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্য তারা অনেক চেষ্টা করেছিল। বিজ্ঞানীদের খুন করা, রিসার্চ ল্যাব ধ্বংস করে দেয়া থেকে শুরু করে গুহায় প্রিন্ট লুকিয়ে রাখা, লেকের পানিতে ডুবিয়ে দেয়া, ভূগর্ভস্থ কোটরে পুঁতে দেয়ার মতো নানান পদক্ষেপ নিয়েছিল তারা। আর এসবই ছিল মিত্রবাহিনীর হাত থেকে নিজেদের প্রযুক্তি রক্ষা করার বিভিন্ন কৌশল।

নির্বিচারে লুণ্ঠন অভিযান চলেছিল। নাৎসিদের রিসার্চ এবং অস্ত্রের ল্যাব ছিল সংখ্যায় শত শত। কতগুলো ছিল মাটির নিচে, বাকিগুলো জার্মানের বিভিন্ন জায়গায় ছড়ানো-ছিটানো। এছাড়াও অস্ট্রিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া এবং পোলান্ডেও তাদের অস্তিত্ব ছিল। তারমধ্যে সবচেয়ে রহস্যময় ছিল ব্রিসলাউ শহরের বাইরে অবস্থিত একটি রূপান্তরিত খনি। রিসার্চ ফ্যাসিলিটির কোড নাম ছিল “দ্য বেল”। এই রিসার্চ ফ্যাসিলিটির আশেপাশের এলাকার বাসিন্দারা বিভিন্ন সময় রিপোর্ট করেছিলেন, অদ্ভুতুড়ে আলো দেখা, রহস্যময় মৃত্যু ও বিভিন্ন অজানা রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন তারা।

রাশিয়ান ফোর্স খনিতে পৌঁছেছিল সবার আগে। তারা গিয়ে রিসার্চ ফ্যাসিলিটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পায়। এই প্রজেক্টের সাথে জড়িত ৬২ জন বিজ্ঞানীর সবাইকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। আর ফ্যাসিলিটির বাদ বাকি সব সরঞ্জাম কোথায় গায়েব হয়েছিল সেটা এক ঈশ্বর ছাড়া আর কেউ জানে না।

সে যা-ই হোক, তবে এতটুকু নিশ্চিত “দ্য বেল”-এর অস্তিত্ব সত্যি সত্যিই ছিল।

.

প্রস্তাবনা

১৯৪৫ ৪ঠা মে, সকাল ৬:২২ মিনিট।
ফরট্রেস সিটি অফ বিসলাউ, পোল্যান্ড

পয়ঃনিষ্কাশন পাইপের ভেতরে থাকা নোংরা পানিতে একটা ছেলের লাশ ভাসছে। ফুলে কেঁপে উঠেছে লাশটা। জুতোর ফিতে, প্যান্ট, শার্ট এগুলোতে দাঁত বসাচ্ছে ইঁদুর। সেনাবাহিনী হামলার স্বীকার এ-শহরের কোনকিছুই অপচয় হয় না।

 লাশটার পাশ দিয়ে চলে যাওয়ার সময় নাক কুঁচকালো জ্যাকব স্পোরেনবার্গ। নাড়ি-ভূড়ি, বিষ্ঠা, রক্তের দুর্গন্ধ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ওয়েট মাস্ক নাকে-মুখে জড়িয়ে রেখেছে। যুদ্ধের তিক্ত স্বাদ পাচ্ছে ও। সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় পয়ঃনিষ্কাশন পাইপ দিয়ে এখন তুলনামূলক কম লাশ যাচ্ছে। জ্যাকবের এখানে কিছু করার নেই। কিন্তু ওপর থেকে নির্দেশ দেয়া আছে, থাকতে হবে।

মাথার ওপরে এক জোড়া রাশিয়ান কামান শহরের বারোটা বাজিয়ে দেয়ার কাজ করছে। প্রতিটি গোলা বিস্ফোরণের সময় পুরো শরীরসহ নাড়ি-ভূড়ি কেপে উঠছে জ্যাকবের। রাশিয়ানরা গেট ভেঙ্গেছে, বোমা মেরেছে এয়াপোর্টে। কাইসারট্র্যাসে সাধারণ পরিবহন নেমে গেছে এমন অবস্থাতেও তাদের ট্যাংকগুলো সড়কগুলোতে দুলকিচালে ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রধান সড়ককে রূপান্তর করা হয়েছে ল্যান্ডিং স্ট্রিপে। আড়াআড়ি তেলের ব্যারেল বসিয়ে ব্যারেল থেকে ধোয়া তৈরি করে করা হচ্ছে কাজটা। ব্যারেলগুলো থেকে বেরুনো ধোঁয়ায় ছেয়ে গেছে ভোরের সকাল। আকাশ আজকে ভোর থেকে আর সকালে রূপান্তরিত হতে পারছে না। প্রতিটি রাস্তায়, গলিতে যুদ্ধ হচ্ছে। প্রতিটি বাড়ির বেসমেন্ট থেকে শুরু করে চিলেকোঠা পর্যন্ত যুদ্ধে জর্জরিত।

প্রতিটি বাড়ি যেন একেকটি দূর্গে পরিণত হয়।

সাধারণ জনতার উদ্দেশে গাউফিফটার হ্যাঁঙ্কস-এর শেষ নির্দেশ ছিল এটা। শহরকে যতক্ষণ সম্ভব নিজেদের কজায় রাখতে হবে। এর ওপর জার্মানির তৃতীয় প্রজন্ম নির্ভর করছে।

জ্যাকব স্পেরেনবার্গের ওপরেও নির্ভর করছে অনেক কিছু।

নিজের পেছনে থাকা অধীনস্থদের ওপরে গর্জে উঠল জ্যাকব। ওর ইউনিট হলো–স্পেশাল ইভ্যাকুয়েশন কমান্ডো। অর্থাৎ, জরুরি মুহূর্তে কোনো কিছু স্থানান্তর কিংবা অপসারণ করার কাজে ওর টিম দক্ষ।

হাঁটু পর্যন্ত ডুবে যাওয়ায় নোংরা পানি ঠেলে টিমের সদস্যরা জ্যাকবের পেছন পেছন আসছে। সংখ্যায় ওরা ১৪ জন। সবাই সশস্ত্র। সবার পোশক কালো। ভারী প্যাক বইছে সবাই। টিমের মাঝখানে অবস্থান করছে চারজন দীর্ঘাকায় সদস্য, এরা সবাই ইউরোপীয় সাবেক কম্যান, অতীতে বিভিন্ন জাহাজ ও বন্দরে পণ্য খালাস করার কাজ করে এসেছে। এদের কাঁধে রয়েছে ছিদ্রকারী পোল। বেজায় ওজন পোলগুলোর।

 জার্মানি ও পোল্যান্ডের মধ্যে সাডেটেনে অবস্থিত এই নিঃসঙ্গ শহরে রাশিয়ানদের আক্রমণ করার একটা বিশেষ কারণ আছে। হাইল্যান্ডে যাওয়ার প্রবেশদ্বারে কড়া নিরাপত্তা পাহারা হিসেবে কাজ করছে ব্রিসলাউ’র দুর্গগুলো। বিগত দু’বছর ধরে নানান শ্রমিকদেরকে ধরে একটা পাহাড়ে গর্ত খোঁড়ার কাজে জড়ো করা হয়েছে গোসরোজেন ক্যাম্পে। তাদেরকে দিয়ে ১০০ কিলোমিটার টানেল খুড়িয়ে তারপর সেটাকে ধসিয়ে দেয়া হয়েছে। আর এসব কাণ্ড করা হয়েছে একটা গোপন প্রজেক্টকে মিত্রবাহিনীর লোপ চোখ থেকে আড়াল করার জন্য।

 ডাই রেইজ… দ্য জায়ান্ট।

কিন্তু এত কাজ করেও ঘটনা পুরোপুরি গোপন করা যায়নি। ওয়েনসেলস্ মাইনের বাইরের কোনো এক গ্রামের বাসিন্দারা অদ্ভুত সব রোগ নিয়ে কানাঘুষা করেছিল। রহস্যময় রোগগুলো শুধু সেই বিশেষ এলাকার বাসিন্দাদেরকেই ভোগায়নি, যারা পার্শ্ববর্তী এলাকায় বাস করতো তাদেরকেও ভুগিয়েছে।

যদি প্রজেক্টের বিজ্ঞানীরা তাদের রিসার্চ সম্পন্ন করার জন্য আরও সময় পেতেন…

জ্যাকবের মনের এক অংশে এখন সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। গোপন সেই প্রজেক্ট সম্পর্কে সে আসলে সবকিছু জানতে পারেনি। অধিকাংশই হলো কোড নেম। যেমন : ক্রোনস। তবে সে যতটুকু জানতে পেরেছে সেটাও নেহাত কম নয়। প্রজেক্টের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজে ব্যবহৃত বডি দেখেছে সে। তাদের চিৎকার শুনেছে।

বিভীষিকা!

জ্যাকবের মনে ওই একটা শব্দ এলো। পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা ভাবতেই যেন ঠাণ্ডা হয়ে গেল ওর রক্ত।

বিজ্ঞানীদের পরপারে পাঠাতে ওর কোনো সমস্যা হয়নি। ৬২ জন পুরুষ ও এক নারীকে বাইরে নিয়ে গিয়ে দু’বার করে মাথায় বুলেট ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। ওয়েনসেলস মাইনের গভীরে কী হচ্ছিল… কিংবা এখানে এসে কী পাওয়া গিয়েছিল সেটা কারো জানা চলবে না। শুধু একজন গবেষককে প্রাণে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে।

ডক্টর টোলা হিরজফিল্ড।

জ্যাকব শুনতে পেল ওর পেছন পেছন আসতে টোলা হিরজফিল্ড গাইগুই করছে। অনেকটা টেনে-হেঁচড়ে নিয়ে আসা হচ্ছে তাকে। দু’হাত পিছমোড়া করে বাঁধা। ডক্টর টোলা মেয়ে হিসেবে বেশ লম্বা। বয়স ত্রিশের কাছাকাছি। ওর স্তনগুলো ছোট হলেও প্রশস্ত কোমর আর পা দুটো বেশ সুগঠিত। চুলের রং কালো, মসৃণ। তিন মাস মাটির নিচে, সংরক্ষিত দুধের মতো ফ্যাকাসে রঙের ত্বক ওর। অন্য সবার সাথে ওকেও মেরে ফেলা হতো কিন্তু বাবা হিউগো হিরজফিল্ডের কারণে বেঁচে যাচ্ছে ও। প্রজেক্টের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে কর্মরত ছিলেন হিউগো। কিন্তু তার রক্তে দুর্নীতির কণা বইছে, একদম শেষ মুহূর্তে এসে সেটা প্রমাণ করে দিয়েছেন। ইহুদির রক্ত বইছে তার শরীরে। নিখাদ ইহুদি হলে এক কথা ছিল কিন্তু তিনি হলেন শংকর জাতের ইহুদি। যাকে বলে, আধা-ইহুদি। নিজের রিসার্চের যাবতীয় ফাইল ধ্বংস করার চেষ্টা করেছিলেন হিউগো কিন্তু অফিসে আগুন লাগানোর আগেই একজন গার্ড তাকে গুলি করে। তার মেয়ের কপাল ভাল, এই রিসার্চ সম্পর্কে পুরো জ্ঞান আছে ওর। ডক্টর টোলা রিসার্চের কাজগুলো চালিয়ে যেতে পারবে। বাবার মতো মেয়েও অনেক মেধাবী। এখানকার অন্য কোনো বিজ্ঞানীর চেয়ে টোলা ওর বাবার রিসার্চ সম্পর্কে বেশি জ্ঞান রাখে।

কিন্তু ওকে ভয় না পাইয়ে প্রলোভন দেখিয়ে এখান থেকে নিয়ে গেলেই বরং ভাল হতো।

 যখনই টোলার দিকে তাকাচ্ছে তখনই ওর চোখে ঘৃণার আগুন দেখতে পাচ্ছে জ্যাকব। ওর সেই ঘৃণার উত্তাপ জ্যাকব বেশ ভাল করে টের পাচ্ছে। সমস্যা নেই, মেয়েটা ঠিক ওর বাবার মতো সহযোগিতা করবে। ইহুদিদের সাথে কীভাবে চলতে হয় সেটা জ্যাকবের ভাল করেই জানা আছে। বিশেষ করে এরকম আধা-ইহুদিদের ব্যাপারে সে একজন বিশেষজ্ঞ।

শংকর জাত।

আধা-ইহুদি, এরা সবচেয়ে জঘন্য। জার্মানির সেনাবাহিনীতে প্রায় লাখ খানেক আধা-ইহুদি আছে। ইহুদিদের চেয়ে আধা-ইহুদিদের একটু বেশিই খাটতে হয়। কোনো ক্ষেত্রে জীবন দেয়ার প্রয়োজন হলে সেখানে এইসব আধা-ইহুদিদেরকে পাঠানো হয়ে থাকে। সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার সময়ও বাড়তি পরীক্ষা দিয়ে ঢুকতে হয় আধা-ইহুদিদের। তাদেরকে প্রমাণ করতে হয়, সৈন্য হিসেবে তারা অনেক কঠোর ও হিংস্র, জার্মান সরকারের প্রতি তাদের আনুগত্য ইহুদিদের চেয়েও বেশি।

যতই আনুগত্যের পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে আসুক না কেন, জ্যাকব কখনো এসব আধা-ইহুদিদেরকে বিশ্বাস করে না। টোলার বাবা-ই জ্যাকবের অবিশ্বাসকে সঠিক প্রমাণ করে দিয়েছেন। হিউগোকে রিসার্চের যাবতীয় তথ্য ধ্বংস করার চেষ্টা করতে দেখে জ্যাকব মোটেও অবাক হয়নি। ইহুদিদের কখনো বিশ্বাস করতে নেই, ওদেরকে শেষ করে দিতে হয়।

কিন্তু হিউগো হিরজফিন্ডকে হত্যা করার অর্ডারে স্বয়ং ফাহরির সাইন করেছেন। সেই অর্ডারে শুধু এই আধা-ইহুদি বাবার মেয়েই নয় জার্মানের মাঝখানে কোনো এক জায়গায় বসবাসরত একজোড়া বুড়ো বাবা-মা’কেও বাঁচিয়ে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। শংকর জাতের ইহুদিদের প্রতি জ্যাকবের যতই অবিশ্বাস থাক না কেন ফাহরির নির্দেশ তাকে পালন করতেই হবে। অর্ডার পেপারে পরিষ্কার লেখা ছিল : পুরো মাইন খালি করতে হবে। রিসার্চের কাজ চালিয়ে নেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় রির্সোস রেখে বাকি সবকিছু ধ্বংস করতে হবে।

তারমানে ডক্টর টোলাকে প্রাণে বাঁচিয়ে রাখতেই হচ্ছে।

এবং একটা শিশুকেও বাঁচিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

কাপড়ে প্যাঁচিয়ে একটা প্যাকে রাখা হয়েছে নবজাতকটিকে। ইহুদি শিশু। বয়স সর্বসাকুল্যে এক মাসের বেশি হবে না। বাচ্চাটিকে চুপ করিয়ে রাখার জন্য হালকা সিডেটিভ দেয়া হয়েছে।

বাচ্চাটি জ্যাকবের ঘৃণা ভরা মনে আকস্মিক পরিবর্তন এনে দিয়েছে। এই ইহুদি বাচ্চার ক্ষুদে হাতের ওপর নির্ভর করছে তৃতীয় নাৎসি প্রজন্ম। যদিও এধরনের চিন্তা একটু কঠিন। তারচেয়ে বরং বাচ্চাটাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মেরে ফেলাই ভাল ছিল। কিন্তু জ্যাকবের এখানে কিছু করার নেই। সে নির্দেশ পালন করছে মাত্র।

ডক্টর টোলা বাচ্চাটির দিকে কীভাবে তাকাচ্ছে সেটা খেয়াল করেছে জ্যাকব। টোলার চোখে সে একই সাথে আগুন ও দুর্দশার ছাপ দেখতে পেয়েছে। বাবার রিসার্চ চালিয়ে নেয়ার পাশাপাশি ওকে বাচ্চাটির পালক মায়ের দায়িত্বও পালন করতে হবে। ইতোমধ্যে বাচ্চাকে ঘুম পাড়ানো, খাওয়ানো এসব কাজ করতে হচ্ছে ওকে। এই বাচ্চাটির মুখের দিকে তাকিয়েই জ্যাকবের টিমের সাথে সহযোগিতা করছে টোলা। বাচ্চার প্রাণনাশের হুমকি দেয়ার পরেই টোলা ওদেরকে সাহায্য করতে রাজি হয়েছে।

ওদের মাথার উপরে মর্টার শেল বিস্ফোরিত হলো। হাঁটু টলে উঠল সবার। বিস্ফোরণের শব্দে কানে তালা লাগার জোগাড়। সিমেন্টের পলেস্তরায় ফাটল ধরল, চুন, সুরকি পড়ল ড্রেনের নোংরা পানিতে।

কম্পনের ধাক্কা থেকে নিজেকে সামলে নিল জ্যাকব। পাশে এসে দাঁড়িয়ে পয়ঃনিষ্কাশন পাইপের সামনের দিকে থাকা একটা শাখার দিকে নির্দেশ করল তার সেকেন্ড ইন কমান্ড, অসকার হেনরিকস।

‘স্যার, আমরা ওই টানেল ধরে এগোব। ওটা স্টর্ম ড্রেন, বেশ পুরোনো। মিউনিসিপ্যালের ম্যাপ বলছে, এটা নদীতে গিয়ে মিশেছে। ক্যাথেড্রাল আইল্যান্ড থেকে জায়গাটা খুব বেশি দূরে নয়।’

সায় দিয়ে মাথা নাড়ল জ্যাকব। আইল্যান্ডের কাছাকাছি কোথাও একজোড়া ছদ্মবেশী গানবোট অপেক্ষায় রয়েছে। ওখানে রয়েছে আরেকটা কমান্ডো ইউনিট। দূরত্বের হিসেবে এখান থেকে খুব একটা বেশি নয়।

মাথার উপরে মুহুর্মুহু গোলাবর্ষণ করে রীতিমতো তুলকালাম চালাচ্ছে রাশিয়ানরা। জ্যাকব খুব দ্রুত সবাইকে পথ দেখিয়ে এগিয়ে চলল। সর্বনাশের মোলোকলা পূর্ণ করতে শহরে রাশিয়ানরা পাগলের মতো আক্রমণ করছে। শহরের বাসিন্দাদেরকে আত্মসমপর্ণ করতেই হবে, তাছাড়া কোনো উপায় নেই।

শাখা টানেলের কাছে পৌঁছেই জ্যাকব জলকপাটের নোংরা মই বেয়ে ওপরে উঠতে শুরু করল। ওপরে ওঠার সময় তার জুতো থেকে প্যাঁচ-প্যাঁচ শব্দ হচ্ছে। টানেলের ভেতরে থাকা তীব্র দুর্গন্ধে জ্যাকবের নাড়ি-ভূড়ি গলা দিয়ে উঠে আসে আসে অবস্থা। দুর্গন্ধ যেন মই বেয়ে ওর পেছন পেছন তাড়া করছে।

ইউনিটের বাকি সবাই ওর পথ অনুসরণ করল।

 জ্যাকব ওর হ্যান্ড-টর্চ জ্বালিয়ে সিমেন্ট ড্রেনের দিকে তাক করল।

বাতাস থেকে এখনো দুর্গন্ধ কমেনি নাকি?

টর্চের আলোর রশ্মিকে সামনে রেখে নতুন উদ্যমে এগিয়ে গেল সে। আর একটু গেলেই পালানোর রাস্তা, মিশন প্রায় কমপ্লিট। রাশিয়ানরা ওয়েনসেলস্ মাইনে থাকা ইঁদুর দর্শন করতে পারার আগেই ওর ইউনিট সিলেসিয়ার অর্ধেক পথে থাকবে। রাশিয়ানদের স্বাগতম জানানোর জন্য জ্যাকব ল্যাবরেটরির প্যাসেজগুলোতে বুবি ট্র্যাপ বোম সেট করে এসেছে। যমদূতের দর্শন ছাড়া ওখানে রাশিয়ান আর তাদের মিত্রবাহিনীরা কিছুই পাবে না।

নিজের কাজে সন্তুষ্ট হয়ে তাজা বাতাস টানতে টানতে এগিয়ে চলল জ্যাকব। এই সিমেন্ট টানেল তির্যকভাবে ঢাল তৈরি করে ধীরে ধীরে নেমে গেছে। জ্যাকবের ইউনিট এগোচ্ছে আগের চেয়ে আরও দ্রুতগতিতে। ওদের এগোনোর ফাঁকে ফাঁকে বোমা ফাটাচ্ছে রাশিয়ান সেনাবাহিনী। রাশিয়ানরা তাদের পুরো শক্তি নিয়ে হাজির হয়ে গেছে। নদী কতক্ষণ ফাঁকা থাকবে সেটা বলা যাচ্ছে না।

 বাচ্চাটি মৃদু স্বরে কান্না শুরু করল। হালকা ভোজের সিডেটিভের প্রভাব কেটে গেছে। জ্যাকব তার টিমের মেডিক্যাল সদস্যকে সাবধান করে দিয়েছিল, বাচ্চাটিকে যেন কড়া ডোজের সিডেটিভ না দেয়া হয়। বাচ্চার জীবন ঝুঁকিতে ফেলা চলবে না। কিন্তু হয়তো ওদের ভুল ছিল…

কান্নার আওয়াজ ধীরে ধীরে শক্তিশালী হচ্ছে।

উত্তর দিকে কোথাও একটা মর্টার শেল বিস্ফোরিত হলো।

বাচ্চার কান্নার ভলিউম এখন তুঙ্গে। টানেলের ভেতরে প্রতিধ্বনি করছে ওর কান্নার আওয়াজ।

‘বাচ্চাটাকে চুপ করাও!’ যে সৈনিক বাচ্চাটিকে নিয়ে এগোচ্ছিল তাকে নির্দেশ দিল জ্যাকব।

বাচ্চা রাখার প্যাকটা কাঁধ থেকে দ্রুত নামাতে গিয়ে হালকা গড়নের সৈনিকের মাথায় থাকা কালো ক্যাপ পড়ে গেল। বাচ্চাটিকে শান্ত করতে গিয়ে আরও কাঁদিয়ে ফেলল সে।

‘দাও… দেখি,’ বলল টোলা। ওর কনুই ধরে ছিল একজন, তার কাছ থেকে জোর করে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল ও। বাচ্চাটাকে আমার কাছে দিন।

জ্যাকবের দিকে তাকাল সৈনিক। ওদের মাথার ওপরে চলা বিস্ফোরণের বহর এখন থেমেছে। সব চুপচাপ। কিন্তু নিচে বাচ্চাটা কেঁদেই চলেছে। মুখ কুঁচকে সায় দিল জ্যাকব।

টোলার কব্জিতে থাকা বাধন খুলে দেয়া হলো। নিজের আঙুলগুলোতে রক্ত সঞ্চালন করার জন্য ডলতে ডলতে বাচ্চাটির কাছে গেল ও। বাচ্চাকে টোলার কাছে দিয়ে ভারমুক্ত হলো সৈনিক। বাচ্চটিকে কোলে তুলে আস্তে আস্তে দোল খাওয়াতে শুরু করল টোলা। বাচ্চার দিকে ঝুঁকে ওকে আরও কাছে নিল ও। শিশুটির কানের কাছে টোলা ফিসফিস করে কী যেন বলতে শুরু করল। টোলার পুরো শরীর নরম হয়ে উষ্ণ আবেশে জড়িয়ে নিল বাচ্চাটিকে।

ধীরে ধীরে কান্নার আওয়াজ থেমে গেল। বাচ্চাটি এখন চুপচাপ কাঁদছে।

সন্তুষ্ট হয়ে টোলার গার্ডের দিকে মাথা ঝাঁকাল জ্যাকব। টোলার পিঠে গ্যার ঠেকিয়ে ধরল গার্ড। বাচ্চার কান্না থেমেছে। এবার চুপচাপ ব্রিসলাউের ভূগর্ভস্থ টানেলের ভেতর দিয়ে এগোতে শুরু করল সবাই।

অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে ড্রেনের নোংরা দুর্গন্ধের জায়গায় স্থান করে নিল ধোয়ার গন্ধ। জ্যাকবের হ্যান্ড-টর্চ স্টর্ম ড্রেনের শেষ প্রান্ত আলোকিত করল। কামান থেকে গোলাবর্ষণ থামলেও প্রায়ই গোলাগুলির আওয়াজ ভেসে আসছে পূর্বদিক থেকে। ধারে কাছে পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ শোনা যাচ্ছে।

পেছনে থাকা সদস্যদের দিকে তাকাল জ্যাকব। ওদেরকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার নির্দেশ দিয়ে রেডিওম্যানকে বলল, “বোটগুলোকে সিগন্যাল দাও।‘

কেতাদুরস্তভাবে মাথা ঝাঁকিয়ে সামনে এগোল রেডিওম্যান। ধোয়ার ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল সে। কয়েক মুহূর্তের ভেতরে লাইটের ফ্ল্যাশ ব্যবহার করে পার্শ্ববর্তী আইল্যান্ডে সিগন্যাল আদান-প্রদান করা হয়ে গেল। জলপথটুকু পেরিয়ে জায়গামতো বোট পৌঁছুতে মিনিট খানেক সময় লাগবে।

টোলার দিকে তাকাল জ্যাকব। মেয়েটা এখনো বাচ্চাটিকে কোলে রেখেছে। চুপচাপ চোখ বন্ধ করে রয়েছে বাচ্চাটি।

জ্যাকবের চোখে চোখ পড়ল টোলার, দৃঢ়ভাবে বলল, “আপনি জানেন, আমার বাবা-ই ঠিক ছিলেন,’ এতটুকু বলে হঠাৎ চুপ মেরে গেল ও। সৈনিকদের কাছে থাকা বিভিন্ন সিলমারা বারের দিকে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে আবার জ্যাকবের দিকে ফিরল টোলা। ‘আপনি আপনার চেহারা দেখেই সেটা বুঝতে পারছি। আমরা… আমরা অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছিলাম।’

 ‘আমি বা আপনি, আমাদের কেউ-ই ওরকম বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার কোনো অধিকার রাখি না,’ জ্যাকব জবাব দিল।

‘তাহলে কে রাখে?’

মাথা নাড়ল জ্যাকব, অন্যদিকে ঘুরতে শুরু। স্বয়ং হেনরিক হিমল্যার ওকে এই অর্ডার দিয়েছেন। এখানে জ্যাকবের কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ ছিল না। ও বুঝতে পারছে, টোলা এখনো ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

‘এটা ঈশ্বর ও প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ করেছিল,’ ফিসফিস করে বলল টোলা।

‘বোট চলে এসেছে,’ রেডিওম্যানের এই ঘোষণা জ্যাকবকে কোনো জবাব দেয়া থেকে বাঁচিয়ে দিল। রেডিওম্যান স্টর্ম ড্রেনের মুখ থেকে ফিরে আসছে।

নিজের লোকদের শেষবারের মতো নির্দেশ দিল জ্যাকব। সবাইকে জায়গামতো দাঁড় করালো। সামনে থেকে সবাইকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল ও। এই টানেল ওদেরকে রিভার ওডের একটা ঢালু তীরে পৌঁছে দেবে। অন্ধকার ধীরে ধীরে কমতে শুরু করছে। মিশনের জন্য এই অন্ধকার ওদের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু উজ্জ্বল হয়ে উঠছে পুব আকাশ। তবে নদীর ওপরে ঝুলে থাকা ধোয়ার মেঘ পানিকে এখনো সূর্যের আলো থেকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এই ধোয়ার ভারী চাদর ওদেরকে সাহায্য করতে পারে।

কিন্তু সেটা কতক্ষণ?

 একটানা গুলিবর্ষণ শুরু হয়ে গেছে। ওগুলোকে পটকাবাজির মতো শোনাচ্ছে। যেন। ব্রিসলাউ শহরের ধ্বংস উপলক্ষে ফোঁটানো হচ্ছে ওগুলো।

দুর্গন্ধের কবল থেকে মুক্তি পেয়ে জ্যাকব তার ওয়েট মাস্ক খুলে ফেলল। ফুসফুসে ভরে নিল তাজা বাতাস। সীসার মতো ধূসর পানিতে চোখ বুলাল ও। বিশ ফুটি দুটো বোট নদীর পানি কেটে তরতর করে এগিয়ে আসছে। মৌমাছির গুঞ্জনের মতো একটানা শব্দ করছে ওগুলোর ইঞ্জিন। বোট দুটোর অগ্রভাগে সবুজ তেরপলের নিচে কোনমতে লুকিয়ে রাখা হয়েছে একজোড়া এমজি-৪২ মেশিন গান।

বোটের পেছনে এইমাত্র আইল্যান্ডের একটা কালো অবয়ব ফুটে উঠল। ক্যাথেড্রাল আইল্যান্ড আসলে আক্ষরিক অর্থে কোনো দ্বীপ নয়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে মাটি দিয়ে ভরাট করে এই দ্বীপের সাথে তীরের সংযোগ করে দেয়া হয়েছে। ওই শতাব্দীতেই ঢালাই লোহা দিয়ে তৈরি সবুজ রঙের একটা ব্রিজ তীরের সাথে দ্বীপের সংযোগ আরও উন্নত ও সহজ করে দিয়েছে। সেই ব্রিজের নিচ দিয়ে দুটো গানবোট এগিয়ে আসছে।

চার্চের দুটো টাওয়ারের চূড়োর দিকে তাকাল জ্যাকব। সূর্যের আলো এসে পড়ছে ওগুলোতে। এই গির্জার কারণেই দ্বীপের নাম ক্যাথেড্রাল আইল্যান্ড নামকরণ করা হয়েছিল। এই আইল্যান্ডে আধ ডজন চার্চ আছে।

টোলা হিরজফিল্ডের কথাগুলো এখনো জ্যাকবের কানে বাজছে।

এটা ঈশ্বর ও প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ করেছিল।

সকালের ঠাণ্ডা জ্যাকবের ভেজা কাপড়ের ভেতর সেঁধিয়ে পড়ছে। চামড়ায় গিয়ে বিঁধছে কাঁটার মতো। এখান থেকে চলে গিয়ে এই দিনগুলো ভুলে যেতে পারলে তৃপ্তি পাবে সে।

 প্রথম বোট তীরে পৌঁছে গেছে। নিজের ভাবনার জাল ছিঁড়ে যাওয়ায় খুশিই হলো জ্যাকব। ইউনিটের সদস্যদেরকে চটজলদি দুটো বোটে উঠে পড়ার জন্য তাগাদা দিল সে।

 কোলে বাচ্চাটিকে নিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে টোলা। ওর পাশে একজন গার্ড পাহারা দিচ্ছে। সূর্যের আলোতে ঝকমকিয়ে ওঠা চার্চের চুড়ো দুটো ওর চোখেও পড়েছে। গোলাগুলি চলছে এখনো। ধীরে ধীরে গোলাগুলির আওয়াজ আরও কাছে আসছে। ট্যাংকগুলো এগোচ্ছে ধীর গতিতে, সেই শব্দও শোনা যাচ্ছে। চিৎকার ও কান্নার আওয়াজ মিলেমিশে একাকার।

টোলা যে ঈশ্বরের বিরুদ্ধাচরণের কথা বলে ভয় পাচ্ছিল সেই ঈশ্বর কোথায়?

নিশ্চয়ই এখানে নয়।

বোট ভরে যাওয়ার পর টোলার দিকে এগোল জ্যাকব। বোটে উঠন। কথাটা সে আরও কঠিনভাবে বলতে চাইলেও টোলার চেহারায় কিছু একটা ছিল যার কারণে ততটা কঠোরভাবে বলতে পারল না।

 নির্দেশ মতো কাজ করল টোলা। দৃষ্টি এখনো ক্যাথেড্রালের দিকে। ওর চিন্তা ভাবনার সীমানা আকাশকেও ছাড়িয়ে গেছে।

ঠিক এই সময়ে জ্যাকব খেয়াল করে দেখল ডক্টর টোলা নারী হিসেবে কত সুন্দরী। হোক না আধা-ইহুদি। টোলা বোটে পা রাখল। একটু টলে উঠলেও সামলে নিল নিজেকে। বাচ্চার ব্যাপারে খুব সতর্ক রয়েছে। ধূসর পানি আর ধোয়ার চাদরের দিকে আবার তাকাল টোলা। পাথরের মতো শক্ত হলো ওর চোখ-মুখ। নিজের বসার জন্য সিট দেখার সময়ও ওর চোখে স্ফুলিঙ্গ দেখা গেল।

স্টারবোর্ড বেঞ্চে গিয়ে বসল টোলা। ওর সাথে সাথে গার্ডও এগোল।

ওদের থেকে একটু তফাতে বসল জ্যাকব। বোটের পাইলটকে যাত্রা শুরু করার নির্দেশ দিল। দেরি করা চলবে না। নদীতে চোখ বুলাল সে। পশ্চিম দিকে যাত্রা শুরু করছে ওরা। সূর্য উদয়ের দিক থেকে সম্পূর্ণ উল্টো দিকে।

 ঘড়ি দেখল জ্যাকব। এতক্ষণে নিশ্চয়ই এখান থেকে দশ কিলোমিটার দূরে একটা পরিত্যক্ত এয়ারফিল্ডে জার্মান জাঙ্কার জু-৫২ ট্রান্সপোর্ট প্লেন ওদের জন্য অপেক্ষা করছে। হামলা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য জার্মান রেড ক্রস দিয়ে মেডিক্যাল ট্রান্সপোর্টের ছদ্মবেশ দেয়া হয়েছে ওটাকে।

বোট দুটো গভীর পানিতে নেমে গেল, ইঞ্জিনের গুঞ্জন বাড়ছে। রাশিয়ানরা এখন ওদেরকে আর আটকাতে পারবে না। মিশন কমপ্লিট।

বোটের দূরবর্তী প্রান্তে কিছু একটা নড়াচড়া করায় জ্যাকবের দৃষ্টি

সামনে ঝুঁকে বাচ্চাটির মাথায় গুচ্ছ খানেক চুলে আলতো করে চুমো দিল টোলা। মুখ তুলে জ্যাকবের চোখে চোখ রাখল ও। জ্যাকব ওর চোখে ঘৃণা কিংবা রাগ দেখতে পেল না। টোলার চোখের ভাষায় ছিল দৃঢ়সংকল্প।

টোলা এখন কী করতে যাচ্ছে সেটা জ্যাকব বুঝতে পেরেছিল। ‘না…।’

 কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।

পেছনে থাকা নিচু রেইলের দিকে ঝুঁকে পা ছুঁড়ে নিজেকে ওপরে তুলে দিল টোলা। বাচ্চাটাকে বুকের ভেতরে নিয়ে উল্টো দিকে ডিগবাজি খেয়ে ঠাণ্ডা পানিতে পড়ল।

আচমকা এরকম ঘটনায় একেবারে হকচকিয়ে গেছে টোলার গার্ড। হতভম্ব হয়ে পানিতে অন্ধের মতো গুলি করতে শুরু করল সে।

দ্রুত সামনে এগিয়ে এসে গার্ডকে থামাল জ্যাকব। বাচ্চাটার গায়ে লেগে যাবে তো।

 বোটের কিনারায় গিয়ে পানির ওপর সে অনুসন্ধানী দৃষ্টি বুলল। ওর ইউনিটের সদস্যরা উঠে দাঁড়াতেই দুলে উঠল বোট। জ্যাকব ধূসর পানিতে নিজের প্রতিবিম্ব ছাড়া আর কিছু দেখতে পেল না। বোটের পাইলটকে বৃত্ত রচনা করে পানির ওপর চক্কর দেয়ার নির্দেশ দিল সে।

কিছুই পাওয়া গেল না।

পানির নিচ থেকে ভেসে আসা বুদবুদ খুঁজছিল জ্যাকব, কিন্তু বোট বেশি ওজন হয়ে যাওয়ার ফলে পানিতে অতিরিক্ত টেউ খেলে যাচ্ছিল। বুদবুদ চোখে পড়ল না। রাগে, হতাশায় রেইলে ঘুষি মারল জ্যাকব।

যেমন বাবা… তেমন মেয়ে…।

একমাত্র আধা-ইহুদিরাই এরকম দুঃসাহসিক কাজ করতে পারে। জ্যাকব এর আগেও এরকম ঘটনা দেখেছে। মা তার নিজের সন্তানকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছে, যাতে সন্তানকে সামনে আরও বেশি কষ্ট ভোগ করতে না হয়। জ্যাকব ভেবেছিল, টোলা ওরকম নয়। মেয়েটার মন হয়তো আরও শক্ত। কিন্তু যা হওয়ার তা তো হলোই। হয়তো টোলার আর কোনো উপায় ছিল না। বাধ্য হয়ে কাজটা করেছে সে।

 নিশ্চিত হওয়ার জন্য অনেক সময় নিয়ে চক্রাকারে ঘুরল জ্যাকবের বোট! ওর ইউনিটের লোকেরা দু’পাশের তীরে সতর্ক দৃষ্টি রাখল। নেই। মাথার ওপর থেকে হু উস করে একটা মর্টার শেল উড়ে যেতে দেখে আর বেশি দেরি করল না ওরা।

ইউনিটের সবাইকে যার যার সিটে বসার নির্দেশ দিল জ্যাকব। পশ্চিম দিক দেখাল সে, ওখানে প্লেন অপেক্ষা করছে। ওদের কাছে এখনো প্রয়োজনীয় বাক্স ও কাগজ-পত্র আছে। টোলা আর বাচ্চাটা হাতছাড়া হওয়ায় দুটো ক্ষতি হয়েছে। টোলার বিকল্প না পাওয়া গেলেও বাচ্চার ক্ষতি হয়তো পুষিয়ে নেয়া যাবে। আরেকটা বাচ্চা নিয়ে গেলেই হলো।

‘চলো।‘ অর্ডার দিল জ্যাকব।

বোট দুটো আবার রওনা হয়ে গেল। ইঞ্জিন গর্জে উঠল পূর্ণ শক্তিতে।

ব্রিসলাউ পুড়ে তৈরি হওয়া ধোয়ার চাদরের ভেতরে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ওরা অদৃশ্য হয়ে গেল।

***

টোলা শুনতে পেল বোটের শব্দ ধীরে ধীরে দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে।

 ক্যাথেড্রাল ব্রিজের একটা মোটা পিলারের আড়ালে পানিতে ভাসছে ও। এক হাতে বাচ্চাটির মুখ শক্ত করে চেপে ধরে আছে, যাতে কোনো শব্দ না হয়। মনে মনে আশা করছে, ছোট বাচ্চাটি যেন নাক দিয়ে যথেষ্ট বাতাস নিতে পারে। কিন্তু বাচ্চাটি বেশ দুর্বল।

দুর্বল টোলাও।

টোলার গলার একপাশ ভেদ করে বুলেট বেরিয়ে গেছে। টকটকে লাল রক্ত নিঃশব্দে মিশে যাচ্ছে পানিতে। দৃষ্টিশক্তি কমে গেছে টোলার। পানির ওপরে বাচ্চাটিকে ধরে রাখার জন্য রীতিমতো নিজের সাথে যুদ্ধ করছে।

কিছুক্ষণ আগে, বাচ্চাসহ ও যখন পানিতে লাফ দিয়েছিল তখন ইচ্ছে ছিল ওরা দু’জনই পানির নিচে মারা যাবে। সোজা কথায়, বাচ্চাটিকে নিয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল টোলা। কিন্তু বরফ শীতল পানি আর গলায় বুলেটের আঘাত পাওয়ায় ওর পরিকল্পনায় পরিবর্তন আসে। চার্চের চুড়ো এসে পড়া সূর্যের আলোর কথা মনে পড়ল ওর। না, ও ধর্মের কথা স্মরণ করেনি। আলোর কথা মনে পড়ায় ও উপলব্ধি করতে পেরেছিল “মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে।” পৃথিবীর অনেক জায়গা এরকম আছে যেখানে ভাই ভাইয়ের সাথে লড়াই করে না। মায়েরা তাদের বাচ্চাদেরকে খুন করে না।

পানির আরও গভীরে সঁতরে গিয়েছিল টোলা। স্রোত ওকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল ব্রিজের দিকে, আপত্তি করেনি ও, স্রোতের মর্জিমতো ভেসে গিয়েছে। পানির নিচ দিয়ে ডুব-সাঁতার দেয়ার সময় নিজের ফুসফুসে থাকা বাতাস বাচ্চাকে দিয়ে বাঁচিয়েছিল টোলা। হাত দিয়ে বাচ্চাটির নাক চেপে মুখে মুখ লাগিয়ে বাতাস দিয়েছিল ও। যদিও ওর ইচ্ছে ছিল আত্মহত্যা করবে কিন্তু সিদ্ধান্ত বদল করার পর যখন বাঁচার জন্য সংগ্রাম শুরু করল তখন টোলা হয়ে উঠল দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

ছেলেটির কোনো নাম রাখা হয়নি।

নামবিহীন অবস্থায় কারো মারা যাওয়া উচিত নয়।

বাচ্চার মুখে আবার বাতাস ভরল ও। অন্ধের মতো পানির নিচে সাঁতরে এগোল। নিতান্তই ভাগ্যগুণে মোটাপিলারের আড়ালে আশ্রয় পেয়ে গেল টোলা।

বোট দুটো চলে গেছে, ওর আর দেরি করা চলবে না। রক্তক্ষরণ হচ্ছে ওর। টোলা বেশ ভাল করেই বুঝতে পারছে, ঠাণ্ডা পানির কারণেই এখনো বেঁচে আছে ও। কিন্তু সেই ঠাণ্ডা দুর্বল বাচ্চাটির জীবনকে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।

তীরের দিকে সাতারাতে শুরু করল টোলা। উনুতভাবে পা ছুড়ছে। দুর্বলতার কারণে সঠিকভাবে এগোতে পারছে না। বাচ্চাটিকে নিয়ে পানির নিচে ডুবে গেল টোলা।

না।

ডুব-সাঁতার দিয়ে এগোচ্ছে। হঠাৎ করে যেন খুব ভারী হয়ে গেছে পানি। বেশ যুদ্ধ করতে হচ্ছে পানির সাথে।

টোলা হার মানার পাত্রী নয়।

হঠাৎ একটা পাথরের সাথে বেমক্কা ধাক্কা খেল ওর পা। চিৎকার করে উঠল টোলা। ভুলে গিয়েছিল সে এখন পানির নিচে। হড়হড় করে নদীর পানি ওর মুখে ঢুকে গেল। পানির ভেতরে আরেকটু তলিয়ে গেল ও। শেষবারের মতো টোলা পা ছুঁড়তে শুরু করল। পানির নিচ দিয়ে তরতর করে এগিয়ে চলল ও।

খাড়া তীরের ছোঁয়া পেল পায়ের নিচে।

এক হাত আর হাঁটুর ওপর ভর করে পানি থেকে উঠে আসার চেষ্টা করল টোলা। গলার কাছে বাচ্চাটাকে ধরে রেখেছে। তীরে পৌঁছে মুখ থুবড়ে পড়ল ও। আর এক ইঞ্চিও সামনে এগোনোর শক্তি পাচ্ছে না। ওর রক্তে বাচ্চাটির শরীরে মাখামাখি হয়ে গেছে। অনেক কষ্টে বাচ্চাটির দিকে তাকাল ও।

কোনো নড়াচড়া করছে না বাচ্চাটি। শ্বাসও নিচ্ছে না। একদম চুপচাপ।

চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা করল টোলা।

 কাঁদো, বাবু, একটু কাদো…

***

আওয়াজটা প্রথম শুনতে পান ফাদার ভেরিক।

তিনি আর তার ব্রাদাররা সেন্ট পিটার অ্যান্ড পল চার্চের একটা ভূগর্ভস্থ ওয়াইন। সেলারে আশ্রয় নিয়েছেন। গতকাল রাতে যখন ব্রিসলাউে বোমা হামলা শুরু হয়েছিল তখন এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছেন তারা। হাঁটু গেড়ে প্রার্থনা করেছেন, তাদের আইল্যান্ড যেন নিরাপদ থাকে। পঞ্চদশ শতাব্দীতে এই চার্চ নির্মাণ করা হয়েছিল। শহরের সীমানা নির্ধারণ করার সময় ভাগ্যগুণে রক্ষা পেয়েছিল চার্চটি। এখন আবার সেই স্বর্গীয় সৌভাগ্যের প্রয়োজনীয়তা উপস্থিত হয়েছে।

সেই আওয়াজ এবার দেয়ালে প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করল।

ফাদার ভেরিক উঠে দাঁড়ালেন। বয়স হয়ে গেছে তাঁর, উঠে দাঁড়াতে বেশ বেগ পেতে হলো।

“কোথায় যাচ্ছেন?” জানতে চাইল ফ্রানজ।

‘আমি একটু দেখে আসি বিড়ালগুলো বোধহয় ডাকছে,’ ফাদার জবাব দিলেন। গত দুই দশক ধরে নদীর পাড়ে থাকা বিড়াল ও বিভিন্ন সময় চার্চের আশেপাশে ঘুরে বেড়ানন কুকুরদেরকে এটা সেটা খাইয়ে আসছেন ফাদার।

‘এখন সঠিক সময় না,’ আরেকজন ব্রাদার সতর্ক করলেন, তার কণ্ঠে ভয়।

মৃত্যুকে এখন আর ফাদার ভেরিক ভয় পান না। সেলার পেরিয়ে ছোট প্যাসেজে পা রাখলেন তিনি। প্যাসেজটা নদীর সামনে গিয়ে শেষ হয়েছে। অন্যসময় এই প্যাসেজে কয়লা দিয়ে সবুজ বোতল স্টোর করে রাখা হয়। যদিও বোতলগুলো এখন ওক গাছ আর ধুলোবালির ভেতর গড়াগড়ি খাচ্ছে।

পুরোনো দরজার কাছে পৌঁছে খিল তুলে দিলেন ফাদার।

কাজটা করার সময় এক কাধ দিয়ে দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। ক্যাচ ক্যাচ শব্দে আর্তনাদ করে উঠল পুরোনো দরজা।

 প্রথমেই ধোয়া এসে তার মুখে আঘাত হানল। আবার হলো আওয়াজটা। শব্দের উৎসের খোঁজে নিচ দিকে তাকালেন ফাদার। “Mein Gott im Himmel”

একজন নারী দেহ পড়ে রয়েছে। কোনো নড়াচড়া নেই। তাড়াতাড়ি নারীর কাছে এগিয়ে গেলেন তিনি। নতুন এক প্রার্থনা করতে করতে হাঁটু গেড়ে বসলেন।

নারীর গলায় হাত দিয়ে পরীক্ষা করলেন, এখনো বেঁচে আছে কি-না। কিন্তু ভেজা রক্ত ছাড়া আর কোনো সাড়া পেলেন না ফাদার। শরীরের মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঠাণ্ডায় পাথর হয়ে গেছে।

মৃত।

আওয়াজটা আবার হলো। কান্নার আওয়াজ। নারী দেহের ওপাশ থেকে এসেছে।

নারীর নিচে বাচ্চাটির দেহ অর্ধেক চাপা পড়ে আছে। সারা গায়ে রক্ত।

বাচ্চাটি ভিজে ঠাণ্ডায় নীল হয়ে গেছে, বেঁচে আছে এখনো। নারী দেহের নিচ থেকে বাচ্চাটিকে উদ্ধার করলেন ফাদার। ভেজা বাচ্চাটিকে নিজের গায়ের কাপড় দিয়ে জড়িয়ে নিলেন তিনি।

ছেলে শিশু।

তিনি দ্রুত বাচ্চাটির পুরো শরীর পরীক্ষা করলেন। দেখলেন রক্ত বাচ্চার শরীর থেকে ঝরেনি। মায়ের শরীরের রক্ত বাচ্চাটির শরীরে মেখে গিয়েছিল।

দুঃখ মাখা দৃষ্টিতে বাচ্চার মায়ের দিকে তাকালেন তিনি। এত মানুষ মারা যাচ্ছে। নদীর ওপারে তাকালেন। পুড়ছে শহর, ধোঁয়া দলা পাকিয়ে উঠে আকাশে আশ্রয় নিচ্ছে। গুলিবর্ষণ চলছে এখনো। এই নারী কী বাচ্চাকে বাঁচানোর জন্য পুরো নদীপথ পাড়ি দিয়ে এসেছিল?

 ‘শান্তিতে থাকো, নারীকে উদ্দেশ্য করে বললেন ফাদার। শান্তিই তোমার প্রাপ্য, তুমি এটা অর্জন করে নিয়েছ।’

ফাদার ভেরিক প্যাসেজের দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন। রক্ত, পানি মুছে দিলেন বাচ্চার শরীর থেকে। বাচ্চার মাথার চুলগুলো তুষারের মতো সাদা; বেশ নরম, পাতলা। বয়সে এক মাসের বেশি হবে না।

ফাদারের পরিচর্যা পেয়ে বাচ্চার কান্না আরও শক্তিশালী হয়ে উঠল। চোখ বন্ধ করে খুব জোর দিয়ে কাঁদছে বাচ্চাটি, ওর ছোট্ট চেহারায় সেটার ছাপ ফুটে উঠল। যদিও এখনো ও দুর্বল, ঠাণ্ডায় কাতর।

‘বাবু, তুমি কাঁদছ।

 ফাদারের কণ্ঠ শুনে বাচ্চাটি চোখ খুলল। কেঁদে চোখ দুটো ফুলিয়ে ফেলেছে। সুন্দর নীল চোখ মেলে তাকাল ফাদারের দিকে। নীল চোখ বুদ্ধিমত্তা ও সতোর পরিচয় বহন করে। যদিও এখানকার অধিকাংশ নবজাতক নীল চোখ নিয়েই জন্ম নেয়। তবুও, ফাদারের মনে হলো, এই চোখ জোড়া নীল চোখের সুনাম রাখবে।’

শরীরের উষ্ণতা দেয়ার জন্য বাচ্চাটিকে আরও কাছে নিলেন ফাদার। একটা রং তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। আরে কী ওটা? বাচ্চাটির পা দেখলেন তিনি। গোড়ালির ওপর কে যেন একটা চিহ্ন এঁকে দিয়েছে।

না, আঁকেনি। ঘষে নিশ্চিত হয়ে নিলেন ফাদার।

গাঢ় লাল কালি দিয়ে ট্যাটু করা হয়েছে।

তিনি ট্যাটুটা ভাল করে দেখলেন। দেখতে একটা কাকের থাবার মতো লাগছে।

ফাদার ভেরিক তার তরুণ সময়ের একটা বড় অংশ ফিনল্যান্ডে কাটিয়ে এসেছেন। সেই সূত্রে, এই চিহ্ন চিনতে পারলেন তিনি। নরওয়েজীয় প্রাচীন বর্ণমালার একটা হলো এই চিহ্ন। কিন্তু এই বর্ণ দিয়ে ঠিক কী বুঝানো হয়েছে তা সম্পর্কে ফাদারের কোনো ধারণা নেই।

মাথা নাড়লেন তিনি। এরকম বোকামি কে করল?

তিনি বাচ্চার মায়ের দিকে আবার তাকালেন।

পিতার পাপের বোঝা সন্তানকে বইতে হবে না।

বাচ্চার মাথায় লেগে থাকা রক্তের শেষ ফোঁটাটুকু মুছে দিলেন ফাদার। নিজের উষ্ণ গাউনের ভেতরে বাচ্চাটিকে জড়িয়ে নিলেন।

‘ছোট বাচ্চা… পৃথিবীতে এসেই কী কঠিন পরিস্থিতির মুখেই না পড়েছে।‘

.

প্রথম খণ্ড

০১.

রুফ অফ দ্য ওয়ার্ল্ড

বর্তমান সময় ১৬ মে, সকাল ৬:৩৪ মিনিট।
হিমালয়
এভারেস্ট বেজ ক্যাম্প, ১৭ হাজার ৬০০ ফিট।

বাতাসের পিঠে মৃত্যু ভর করেছে।

প্রধান শেরপা তাসকি তার পেশাদারিত্বের গাম্ভীর্য বজায় রেখে ঘোষণা করলেন। এই ব্যক্তি বেশ খাটো। মাথায় থাকা কাউবয় হ্যাটসহ তার উচ্চতা টেনে-টুনে পাঁচ ফুট হতে পারে। কিন্তু যেভাবে পাহাড় বেয়ে তরতর করে উঠে এসেছেন তাতে মনে হয়, তিনিই বুঝি এখানকার সবার চেয়ে লম্বা ব্যক্তি। আড়চোখে প্রেয়ার পতাকাগুলোর দাপাদাপি দেখছেন তিনি।

ডা. লিসা কামিংস ওর নিকন ডি-১০০ ক্যামেরার ঠিক মাঝখানে আনল তাসকিকে। ছবি তুলল। তাসকি এই গ্রুপের গাইড হিসেবে কাজ করলেও লিসার কাছে তিনি একটা সাইকোমেট্রিক টেস্ট সাবজেক্ট। লিসা বর্তমানে যে বিষয়টা নিয়ে গবেষণা করছে সেটার জন্য একদম মোক্ষম ব্যক্তি এই তাসকি।

অক্সিজেনের কোনো বাড়তি সরবরাহ ছাড়া এভারেস্টে উঠতে গেলে মানব শরীরে কী কী প্রভাব পড়ে সেসব নিয়ে গবেষণা করার জন্য নেপালে এসেছে লিসা। ১৯৭৮ সালের আগে কেউ-ই বাড়তি অক্সিজেন সরবরাহ ছাড়া এভারেস্ট জয় করতে পারেনি। এখানকার বাতাস খুবই পাতলা। অবস্থা এতটাই নাজুক যে, প্রচুর অভিজ্ঞতাসম্পন্ন পর্বতারোহীরা বোতলজাত অক্সিজেনের সাহায্য নিয়েও বিভিন্ন রকম সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। যেমন : দুর্বল হয়ে যাওয়া, বিভিন্ন অঙ্গের সমন্বয়তার অভাব, একজন মানুষকে দুজন দেখা, দৃষ্টিভ্রম ইত্যাদি। ধরে নেয়া হয়েছিল, এভারেস্টের সর্বোচ্চ চূড়া অর্থাৎ আট হাজার মিটার উচ্চতায় বোতলজাত অক্সিজেনের সহায়তা ছাড়া পৌঁছুনো অসম্ভব।

তারপর ১৯৭৮ সালে দু’জন আনাড়ী পবর্তারোহী এই অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখালেন। হাঁপাতে থাকা ফুসফুস নিয়ে তারা পৌঁছে গেলেন এভারেস্টের চূড়ায়। পরবর্তী কয়েক বছরে প্রায় ৬০জন নারী-পুরুষ সেই দু’জন পর্বতারোহীদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে এভারেস্ট জয় করে এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।

নিম্ন-চাপযুক্ত বায়ুমণ্ডলে মানব শরীর কেমন আচরণ করে সেটা পরীক্ষা করে দেখার জন্য এরচেয়ে আর ভাল পরিবেশ পাওয়া লিসার পক্ষে সম্ভব নয়।

এখানে আসার আগে উচ্চ-চাপে মানব শরীর কেমন আচরণ করে-এর ওপর পাঁচ বছর পড়াশোনা করেছে লিসা। পড়ার পাশাপাশি বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য ডিপ ফ্যাদম নামের এক রিসার্চ শিপে চড়ে গভীর সমুদ্রে গিয়ে ডুবুরিদের পর্যবেক্ষণ করেছে। তারপর ওর ব্যক্তিগত ও পেশাগত দুটো জীবনেই পরিবর্তনের প্রয়োজন পড়ায় এনএসএফ-এর প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল ও। এবার ওর গবেষণার বিষয়বস্তু সম্পূর্ণ উল্টো : নিম্নচাপযুক্ত বায়ুমণ্ডলে মানব শরীর কেমন আচরণ করে তা পর্যবেক্ষণ।

আর এই গবেষণার কাজেই ডা. লিসা পৃথিবীর ছাদ অর্থাৎ এভারেস্টে এসেছে।

শেরপা তাসকি’র আরেকটা ছবি তোলার জন্য তৈরি হলো লিসা। অন্যান্য শেরপার মতো তাসকি তার দলকে নিজের নামের মতো আগলে রেখেছেন।

পতপত করে উড়তে থাকা প্রেয়ার পতাকাগুলোর কাছ থেকে একটু সরে গিয়ে দাঁড়ালেন তাসকি। ধীরে ধীরে মাথা ঝাঁকালেন তিনি। হাতের দুই আঙুলের ফাঁকে একটা সিগারেট ধরে এভারেস্টের চূড়ার দিকে তাক করে আছেন। দিনটা ভাল না। এই বাতাসের পিঠে মৃত্যু ভর করেছে। একই কথার পুনরাবৃত্তি করলেন তিনি। হাত নামিয়ে সরে গেলেন। নিজের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছেন তাসকি।

যদিও দলে থাকা অন্যান্যের মতামত এখনো নেয়া হয়নি।

দলের সদস্যদের মাঝে আপত্তিসূচক গুঞ্জন শোনা গেল। মুখ তুলে মেঘবিহীন নীল আকাশ দেখল সবাই। দশ জনের এই দলটি বিগত নয় দিন যাবত অনুকূল আবহাওয়াপূর্ণ একটা ভাল দিনের অপেক্ষায় রয়েছে। এর আগে, ঠিক গত সপ্তাহে যখন ঝড় হয়েছিল তখন পাহাড়ে না ওঠার ব্যাপারে অবশ্য কেউ কোনো আপত্তি তোলেনি। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট সাইক্লোনের কারণে এখানকার পরিবেশ একদম খারাপ হয়ে গিয়েছিল। একশ মাইলেরও বেশি বেগে আসা ঝড়ো হাওয়া নাজেহাল করেছিল ক্যাম্পকে। রান্নার জন্য খাটানো তাবু উড়ে গিয়েছিল, মানুষজনকে শুইয়ে ফেলেছিল উন্মত্ত হাওয়া। তার ওপর তুষার ঝরার ফলে অবস্থা আরও খারাপ হয়েছিল। তুষার এসে যেন ত্বক ডলে দিচ্ছিল সিরিশ কাগজের মতো।

পরদিন ভোরটা হলো পর্বতারোহীদের আশার মতো উজ্জ্বল। সূর্যের আলো প্রতিফলিত হচ্ছিল কুমু হিমবাহ আর বরফের দেয়াল থেকে। সবার মাথার উপরে তুষারাবৃত এভারেস্ট অবিচল হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এভারেস্টের আশেপাশে রয়েছে আরও কয়েকটা পাহাড়ের চূড়া। দেখে মনে হচ্ছে, সাদা পোশাকে কোনো বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছে।

একশ’র মতো ছবি তুলল লিসা। দিনের আলো পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রাকৃতিক পরিবেশেরও যে সৌন্দর্যের পরিবর্তন ঘটে সেটা ধরা পড়ল ওর ক্যামেরায়। এভারেস্টের স্থানীয় নামের মর্ম বুঝল ও। চোমোলাংমা, চীনা ভাষা। অর্থ করলে দাঁড়ায়–পৃথিবীর স্বর্গীয় দেবী। নেপালিতে বলে সাগারমাতা। অর্থাৎ, আকাশের দেবী।

মেঘের মাঝে অবিচল দাঁড়িয়ে থাকা বরফ ও চুড়া সমৃদ্ধ এই পর্বত যেন সত্যিই এক দেবী। ওগুলো যেন এভারেস্টের পূজো করতে এসেছে, আকাশকে ছুঁয়ে চুমো খাওয়ার জন্য নিজেদেরকে প্রমাণ করছে ওরা। জনপ্রতি খরচা হয়েছে পয়ষট্টি হাজার ডলার। ক্যাম্পের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, কুলি, শেরপা, ইয়াক (চমরি গাই); এসব কিছুর ব্যবস্থা হয়েছে ওই পয়ষট্টি হাজার টাকার মধ্যে। খাটো সাইজের একটা মাদি ইয়াক ডাক ছাড়ল, ওর ডাক প্রতিধ্বনি হলো উপত্যকার গায়ে। পর্বতারোহীদের কাজের জন্য দুই ডজন ইয়াক আছে এখানে। ওগুলোর লাল-হলুদ রঙ ক্যাম্পের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে। ঝড়ের দেবতা কবে এখান থেকে ফিরে যাবেন এই আশায় আরও পাঁচটা ক্যাম্প এই পাথুরে পাহাড়ি ঢলে অপেক্ষা করছে।

তবে ওদের প্রধান শেরপার ভাষ্য অনুযায়ী, ঝড়ের দেবতা আজ ফিরে যাচ্ছেন না।

‘একদম বিরক্ত হয়ে গেলাম,’ বোস্টন স্পোর্টিং কোম্পানির ম্যানেজার ঘোষণা করলেন। তার পরনে লেটেস্ট ডাউন-ডুভেট ওয়ান পিস। নিজের ভারি প্যাকের পাশে দাঁড়িয়ে দু’হাত আড়াআড়ি অবস্থায় রেখেছেন তিনি। বসে বসে দিন প্রতি ছয়শ ডলারেরও বেশি অপচয় করছি। ওরা আমাদেরকে ঠকাঁচ্ছে। আকাশে তো মেঘের কোনো ছিটেফোঁটাও নেই!

বিরক্ত হলেও নিজের গলার স্বর যতদূর সম্ভব নিচু রেখেই কথাগুলো বললেন তিনি। অসন্তোষ প্রকাশ করে সবার সামনে খারাপ হওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই।

 লিসা এরকম স্বভাবের লোক আগেও দেখেছে। এই স্বভাবের লোকগুলো খচর টাইপের হয়। লোকটার সাথে এক বিছানায় রাত কাটানো ঠিক হয়নি, ভাবল লিসা। স্মৃতি হাতড়াতে শুরু করল ও। স্টেটস্-এ একটা সাক্ষাতের কথা মনে পড়ল। সেটুল এর হ্যাঁয়াটে একটা প্রাতিষ্ঠানিক মিটিঙের পর বেশ খানিকটা হুইস্কি খেয়ে ওখানে গিয়েছিল লিসা। লিসা যদি একটা জাহাজ হয় তাহলে বোস্টন বব হলো এক বন্দরের নাম। এই অঞ্চলে বব ছাড়া হয়তো আরও বন্দর আছে। কিন্তু লিসা একটা ব্যাপারে মোটামুটি নিশ্চিত, ভবিষ্যতে কখনো বোস্টন ববের বন্দরে নোঙ্গর করবে না ও।

ওর এরকম ভাবনার অন্যতম কারণ হলো এই লোকটার বিরক্তিকর স্বভাব। লোকটা সবসময় উল্টো কথা বলে। মেজাজটা এমন, যেন যুদ্ধ করবে।

 অন্যদিকে মুখ ঘোরাল লিসা। রাগ করে শক্তি নষ্ট করার দরকার নেই। ছোট ভাইয়ের দিকে তাকাল ও। জশ; লিসার ছোট ভাই। বিগত দশ বছর ধরে পর্বতারোহণ করছে সে। অভিজ্ঞতা প্রচুর। বোনের টিমে সে একজন পথ প্রদর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। বছরে কম করে হলেও দুবার এরকম পর্বত অভিযানে দায়িত্ব পালন করে জশ।

 জশ কামিংস ওর এক হাত উঁচু করল। বোনের মতো সে-ও স্বর্ণকেশী, হালকা পাতলা। পরনে কালো জিন্স, ওর স্পোর্টস বুটের ভেতরে গরম পরিধেয় গুঁজে রাখা। গায়ে দিয়েছে ধূসর রঙের থার্মাল শার্ট। বিভিন্ন অভিযানের জন্য এই শার্টগুলো বিশেষভাবে তৈরি হয়ে থাকে।

গলা খাকারি দিল ও। ‘তাসকি বারো বার এভারেস্টে উঠেছেন। পাহাড়ের মতি গতি ভাল বোঝেন তিনি। যদি তিনি বলেন, সামনে এগোনোর জন্য আবহাওয়া সুবিধের নয় তাহলে আমরা এখানে আরও একটা দিন থাকব। আমাদের সময় পার করব দক্ষতার চর্চা করে। আর যদি কেউ অন্য কোথাও ঘুরে আসতে চায়, সেক্ষেত্রে আমি তাদেরকে দুটো গাইড দিয়ে দিতে পারি। একদিনের জন্য তাঁরা রডোডেনড্রন বনের কুমু উপত্যকা থেকে ঘুরে আসতে পারে।‘

দলের ভেতর থেকে একজন হাত তুলা। ‘আচ্ছা, এভারেস্ট ভিউ হোটেলে একটা চক্কর মেরে আসলে কেমন হয়? গত ছয় দিন ধরে আমরা এই ছাতামার্কা তাবুতে ক্যাম্প করে সময় কাটাচ্ছি। ওখানে গিয়ে একটু গরম পানিতে গোসল করতে পারলে কিন্তু মন্দ হয় না।’

প্রস্তাবের সপক্ষে গুঞ্জন শোনা গেল।

‘আমার মনে হয় না, কাজটা খুব একটা ভাল হবে,’ সাবধান করল জশ। ‘ওই হোটেলে যেতেই লাগবে এক দিন। হোটেলে রুমগুলোতে উচ্চতা জনিত সমস্যা মোকাবেলার জন্য অক্সিজেনের ব্যবস্থা করা আছে। কিন্তু ওখানে থাকলে আপনাদের এই বর্তমান সহ্য শক্তি দুর্বল হয়ে যাবে। মোটের ওপর, আমাদের অভিযানের দেরি হয়ে যাবে।’

‘হ্যাঁ! আমরা তো খুব দ্রুত এগোচ্ছি! কোনও দেরি হচ্ছে না!’ ফোড়ন কাটল বোস্টন বব।

জশ ববকে পাত্তা দিল না। লিসা খুব ভাল করেই জানে, তাঁর ছোট ভাইকে বৈরি আবহাওয়ার ব্যাপারে কোনো বিষয়ে জোর করে লাভ হবে না। জশ অহেতুক কোনো ঝুঁকি নেবে না। যদিও এখন আকাশ একদম ঝকঝকে নীল দেখাচ্ছে। কিন্তু লিসা এ-ও জানে, আকাশের এই রূপ বদলাতে বড়জোর কয়েক মিনিট লাগে। ক্যাটালিনা কোস্টের সাগরের পাশে বড় হয়েছে ও আর জশ। ওরা দুজনই জানে ঝকঝকে মেঘমুক্ত আকাশ কী করে রুদ্র মূর্তি ধারণ করে। আকাশের ভাব-গতি ওদের চেনা আছে। আবহাওয়ার নাড়ি-নক্ষত্র বোঝার জন্য শেরপা’র মতো অত দক্ষ চোখ হয়তো জশের নেই কিন্তু একজন শেরপার সিদ্ধান্তকে সে সম্মান দিতে জানে।

 এভারেস্টের চূড়ায় ভাসমান তুষার পুচ্ছের দিকে তাকাল লিসা। তুষার পুচ্ছের ধারা শিখরের ওখান দিয়ে ঘন্টায় দুইশ’ মাইলেরও বেশি গতিতে ছুটছে। পুচ্ছটির লেজ বেশ দীর্ঘ। দেখে মনে হচ্ছে আট হাজার মিটার উপরের ওই জায়গায় তুষার ঝড় বেশ ভালই তাণ্ডব চালাচ্ছে। এই ঝড় যে-কোনো মুহূর্তে ওদের দিকে ধেয়ে আসতে পারে।

‘আচ্ছা, আমরা অন্তত ক্যাম্প ওয়ান পর্যন্ত তো যেতে পারি, নিজের মত দাঁড় করানোর চেষ্টা করল বোস্টন বব। ওখানে গিয়ে তারপর নাহয় আবহাওয়ার মতি-গতি বুঝে সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে’।

আমতা আমতা করে যতটা সম্ভব সাবধানে নিজের অভিমত দিল স্পোর্টস স্টোরের ম্যানেজার। এখানে আরও সাত দিন বসে থাকতে হবে ভেবে হতাশায় তার চেহারা লাল হয়ে গেছে।

এই লোকটার প্রতি লিসা আগে অনেক আকর্ষণবোধ করতো।

ববের কথার জবাবে উঁচু গলায় কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল জশ। কিন্তু নতুন একটা আওয়াজ ওকে বাধা দিল। ড্রাম থেকে উৎপন্ন থাম্প-থাম্প ধরনের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। শব্দের উৎস, পুব দিকে চোখ ঘোরাল সবাই। উদীয়মান সূর্যকে পেছনে রেখে একটা কালো হেলিকপ্টার এগিয়ে আসছে। দেখতে অনেকটা ভীমরুলের মতো, বি-টু স্কুইরেল এ-স্টার ইকুইরেল। উদ্ধারকারী হেলিকপ্টার। এভারেস্টের মতো বিশালাকৃতির পাহাড়ের গায়ে নির্বিঘ্নে উদ্ধার অভিযান চালানোর জন্য বিশেষভাবে ডিজাইন করা হয়েছে একে।

দলের মাঝে পিনপতন নীরবতা।

এক সপ্তাহ আগে, সর্বশেষ ঝড় শুরু হওয়ার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে একটা দল নেপালের সাইড দিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল। রেডিও যোগাযোগের মাধ্যমে ওরা পৌঁছে গেছিল ক্যাম্প টু-তে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে একুশ হাজার ফিটের বেশি উচ্চতায়।

সূর্যের আলো থেকে নিজের চোখ আড়াল করল লিসা। ওই দলের কোনো বিপদ হয়েছে নাকি?

ফিরিচের হিমালয় রেসকিউ অ্যাসোসিয়েশনের হেলথু ক্লিনিকে (এইচ.আর.এ) গিয়েছিল লিসা। পাহাড়ে উঠতে গিয়ে বিভিন্ন রোগে ও অসুস্থতায় পড়ে পবর্তারোহীরা এখানে ভর্তি হয়। হাড় ভাঙ্গা, ফুসফুস ও মস্তিষ্ক সংক্রান্ত সমস্যা, মাংসে বরফের পচন ধরাসহ, হৃদরোগ, আমাশয়, তুষার অন্ধতা, বিভিন্ন রকমের জখম এবং এসটিডি নিয়ে এই ক্লিনিকের কাছে দারস্থ হয় পর্বতারোহীরা। এমনকী যৌনরোগ নিয়েও এখানে অনেকে ভর্তি হয়।

কিন্তু এখন কী হয়েছে? রেডিওর জরুরি ব্যান্ডে তো কোনো বিপদ সংকেত পাওয়া যায়নি। একটা হেলিকপ্টার বেজ ক্যাম্পের চেয়ে একটু উঁচু পর্যন্ত উড্ডয়ন করতে পারে। পাতলা বায়ুর কারণে তারপর আর এগোতে পারে না। যার মানে, হেলিকপ্টারটা নির্দিষ্ট উচ্চতা পর্যন্ত উদ্ধার অভিযান চালাতে সক্ষম। পঁচিশ হাজার ফিটের উপরে কোনো লাশ থাকলে সেটাকে উদ্ধার করা সম্ভব হয় না। এভারেস্টের বরফ শীতল কবরে সেই লাশের ঠাই হয়। পরিত্যক্ত গিয়ার, শূন্য অক্সিজেন সিলিন্ডারের সাথে লাশের সলিল সমাধি ঘটে। বরফে শক্ত হয়ে মমির মতো রয়ে যায় এভারেস্টের গায়ে।

হেলিকপ্টারের আওয়াজে একটু পরিবর্তন এলো।

‘ওটা এই দিকে আসছে,’ বলল জশ। সবাইকে স্টর্ম তাবুর কাছে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিল। হেলিকপ্টারকে নামার জন্য সামনে থাকা সমতল কঁকা করল ও।

আকাশ থেকে অবতরণ করল কালো হেলিকপ্টার। রোটরের বাতাসে বরফের টুকরো এদিক-সেদিক ছিটকে গেল। কী যেন সঁই করে ছুটে গেল লিসার নাকের ঠিক নিচ দিয়ে। প্রেয়ার পতাকাগুলো বাতাসের ঝাপটায় উন্মাদের মতো নৃত্য শুরু করেছে। ইয়াকওলো চেঁচিয়ে উঠল। পাহাড়ের গায়ে অনেক দিনের জমে থাকা সুনসান নীরবতা আজ কেটে গেল।

কিডের ওপর ভর দিয়ে নামল হেলিকপ্টার। দরজা খুলে বেরিয়ে এল দু’জন। একজনের পরনে সবুজ ক্যামোফ্লেজ ইউনিফর্ম, কাঁধে অটোমেটিক ওয়েপন, রয়েল নেপালিজ আর্মির একজন সৈন্য সে। আরেকজন বেশ লম্বা, পরনে লাল রঙের গাউন কোমরের ওখানটায় শার্শির রশি বাঁধা, পুরো মাথা পরিষ্কার করে কামানো। বুদ্ধ সন্ন্যাসী।

 দু’জন সামনে এগোতে এগোতে শেরপাদের সাথে নেপালী ভাষায় দ্রুত কী যেন বলল। বিভিন্ন রকম অঙ্গ-ভঙ্গি শেষে নির্দেশ করল এক হাত দিয়ে।

হাতটা লিসার দিকে তাক করা।

সন্ন্যাসী লিসার দিকে পা বাড়ালেন। পঁয়তাল্লিশের মতো বয়স তার, গায়ের রং ফর্সা কিন্তু ফাঁকাসে, চোখ বাদামি।

সৈনিকের ত্বক অবশ্য একটু কালো। তার দুচোখের অবস্থান স্বাভাবিকের চেয়ে কাছাকাছি। লিসার বুকের ওপর দৃষ্টি আটকে রয়েছে ওর। জ্যাকেটের চেইন খুলে রেখেছে লিসা। লোমশ ওভারকোটের নিচে থাকা স্পোর্টস ব্রা দেখা যাচ্ছে। নেপালিজ সৈনিকের দৃষ্টি ঠিক ওখানেই আটকে রয়েছে।

অন্যদিকে সন্ন্যাসী তাঁর চোখ সংযত রেখেছেন, লিসাকে উদ্দেশ্য করে একটু মাথা নোয়ালেন তিনি। ব্রিটিশ উচ্চারণে নিখুঁত ইংলিশে বললেন, ‘ডা. কামিংস, এভাবে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। কিন্তু বিষয়টা জরুরি। এইচ,আর,এ থেকে জানতে পারলাম, আপনি একজন মেডিক্যাল ডাক্তার।

ভ্রু কুঁচকে মুখ হাঁড়ি করে লিসা জবাব দিল, “হ্যাঁ।

‘কাছের এক মঠে রহস্যময় রোগ দেখা দিয়েছে। অসুস্থ হয়ে পড়েছে ওখানে থাকা সবাই। পাশের গ্রাম থেকে এক লোক তিন দিন পায়ে হেঁটে খুন্ডি হাসপাতালে গিয়ে খবরটা পৌঁছে দিয়েছিল। আমরা ভেবেছিলাম খবরটা জানার পর এইচ.আর.এ থেকে কোনো একজন ডাক্তার ওখানে হাজির হবে। পরে জানতে পারলাম ক্লিনিকেই ডাক্তার সংকট চলছে। ডা, সোরেনসন আপনার কথা বললেন, বেজ ক্যাম্পে আছেন আপনি’।

সাইজে ছোট-খাটো কানাডিয়ান ডাক্তারের কথা মনে পড়ল ওর। মহিলা ডাক্তার। এক সন্ধ্যায় লিসা ও সেই ডাক্তার একসাথে চা খেয়েছিল। আমি কীভাবে আপনাদের সাহায্য করতে পারি? লিসা প্রশ্ন করল।

 ‘আমাদের সাথে ওখানে যাবেন? মঠটা দুর্গম জায়গায় হলেও এই হেলিকপ্টারে করে যাওয়া যাবে’।

 ‘কতক্ষণ…?’ প্রশ্ন করে জশের দিকে তাকাল ও। দলের অন্য সদস্যদের কাছ থেকে এদিকে এগিয়ে আসছে সে।

সন্ন্যাসী মাথা নাড়লেন। কিছুটা লজ্জা ও কুষ্ঠাবোধ তার চোখে দেখা গেল। যেতে ঘণ্টা তিনেক লাগবে। ওখানে গিয়ে কী অবস্থা দেখতে পাব সেটা আগেভাগে বলা যাচ্ছে না।’ দুশ্চিন্তায় আবার মাথা নাড়লেন।

‘আমরা এখানে একদিন আছি, সমস্যা নেই।’ বলল জশ। বোনের কনুই ধরে কাছে এল ও। কিন্তু আমি তোমার সাথে যাব।’

 জশের প্রস্তাব লিসার খুব একটা পছন্দ হলো না। নিজের খেয়াল কীভাবে রাখতে হয় সেটা লিসা ভাল করেই জানে। অন্যদিকে ওকে নেপালের রাজনৈতিক অবস্থাও মাথায় রাখতে হবে। ১৯৯৬ সাল থেকে এখানে বিভিন্ন সময় চোরাগুপ্ত হামলা হয়ে আসছে। মাওবাদীরা মঠগুলোকে ভেঙ্গে সেখানে সামাজিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। বিভিন্ন সময় লোকজনদেরকে ধরে কৃষি কাজে ব্যবহৃত কাস্তে দিয়ে একটা একটা করে অঙ্গ কেটে নেয়ার জন্য তারা কুখ্যাত। যদিও এখন যুদ্ধবিরতি চলছে। কিন্তু নৃশংস ঘটনাগুলো ঘটছে মাঝেমাঝেই।

সৈনিকের হাতে থাকা তেল চিকচিকে রাইফেলের দিকে তাকাল লিসা। সন্ন্যাসীর মতো একজন পবিত্র মানুষের সাথে সশস্ত্র প্রহরী! ছোট ভাইয়ের প্রস্তাবটা হয়তো আরেকবার ভেবে দেখা উচিত।

‘আমার কাছে মনিটরিঙের জন্য কিছু ইকুইপমেন্ট আর সামান্য ফাস্ট এইড কিট ছাড়া তেমন কিছুই নেই’। ইতস্তত করে সন্ন্যাসীকে বলল লিসা। ‘গুরুতর পরিস্থিতি হলে একাধিক রোগীর জন্য আমি হয়তো খুব একটা সাহায্যে আসতে পারব না।’

মাথা নেড়ে হেলিকপ্টার দেখালেন বুদ্ধ। ওটার রোটর এখনো ঘুরছে। ‘ডা. সোরেনসন আমাদের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু সংগ্রহ করে রেখেছেন। আপনাকে আমরা একদিনের বেশি আটকে রাখব না। আপনি ওখানে গিয়ে কীরকম পরিস্থিতি বুঝলেন সেটা পাইলটের স্যাটেলাইট ফোনের মাধ্যমে প্রয়োজনমতো জায়গায় জানিয়ে দিতে পারবেন। এমনও হতে পারে পরিস্থিতি এখন অনেকটা অনুকূলে। সেক্ষেত্রে দুপুর নাগাদ আমরা ফিরে আসতে পারব।’

শেষ বাক্যটা বলার সময় তার মুখের ওপর দিয়ে কেমন যেন এক ছায়া দেখা গেল। শেষ কথাটা তিনি নিজে বিশ্বাস করেন না। তার শব্দগুলোতে চিন্তার রেশ ছিল… সাথে ভয়ও।

বুক ভরে পাতলা বাতাস টেনে নিল লিসা। ওতে ওর ফুসফুস কোনমতে ভরল। একটা শপথ করেছিল লিসা। অনেক ছবি তোলা হয়েছে। আসল কাজে নেমে পড়তে হবে ওকে।

বুদ্ধ সন্ন্যাসী লিসার চেহারা দেখে কিছু একটা বুঝতে পারলেন। তাহলে আপনি আসছেন?

‘হ্যাঁ।

 ‘লিসা…’ সতর্ক করল জশ।

‘আমি ভাল থাকব। ভাইয়ের হাত চেপে ধরল ও। পাহাড়ে ওঠার জন্য তোমাকে একটা টিমের নেতৃত্ব দিতে হবে।’

বোস্টন ববের দিকে ফিরে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল জশ।

 ‘অতএব আমি না আসা পর্যন্ত এখানে নিজের দায়িত্ব পালন করো।’

বোনের দিকে তাকাল জশ। সস্তুষ্ট হতে পারলেও আর কথা বাড়াল না ও। নিজের চোখ-মুখ শক্ত করে বলল, “সাবধানে থেকো।’

রয়্যাল নেপালিজ আর্মি আমার নিরাপত্তা দেবে, সমস্যা নেই।

সৈনিকের অস্ত্রের দিকে তাকাল জশ। ‘সেজন্যই তো চিন্তা হচ্ছে।’ কথাটা যতটুকু সম্ভব হালকা করে বলার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল ও। কিন্তু তিক্ততা প্রকাশ হয়েই গেল।

লিসা জানে এরচেয়ে ভাল কোনো উপায়ে জশকে পটানো যেতো না। চট করে ভাইকে জড়িয়ে ধরল ও। নিজের তাবু থেকে যাবতীয় মেডিক্যাল ব্যাকপ্যাক আনলো। তারপর ঘুরন্ত রোটরের ঝাপটা বাঁচিয়ে চড়ে বসল হেলিকপ্টারের ব্যাকসিটে।

পাইলট ওর দিকে ফিরেও তাকাল না। কোপাইলটের সিটে বসল সৈনিক। বুদ্ধ সন্ন্যাসী, নিজেকে আং গেলু নামে পরিচয় দিয়েছেন, লিসার সাথে ব্যাকসিটে বসলেন তিনি।

কানে শব্দ নিরোধক হেডফোন পরল লিসা। হেলিকপ্টারের ইঞ্জিনের গর্জন বাড়ার সাথে পাল্লা দিয়ে রোটর ঘোরার গতি বেড়ে গেল। হালকা বাতাসে ভর দিয়ে উঠতে গিয়ে দ্রুত উপর-নিচ দুলে উঠল যান্ত্রিক পাখি! সাবসনিক ধরনের তীক্ষ্ণ আওয়াজ তুলে

অবশেষে পাথুরে ভূমি ছাড়ল হেলিকপ্টার। দ্রুত উপর দিকে উঠতে লাগল।

গিরিসঙ্কটের ওপর দিয়ে হেলিকপ্টারটা যখন বাঁক নিচ্ছিল তখন লিসার মনে হলো ওর পাকস্থলী বোধহয় নাভির নিচে নেমে গেছে। জানালা দিয়ে নিচে তাকাল ও। তাবু ও ইয়াকগুলোকে দেখতে পেল। জশকে দেখল, একটি হাত উঁচু করে রেখেছে। বিদায় জানাচ্ছে নাকি সূর্যের আলো থেকে চোখ আড়াল করার জন্য হাত তুলেছে? জশের পাশে দাঁড়িয়ে আছে তাসকি শেরপা। কাউবয় হ্যাঁটের কারণে তাকে হেলিকপ্টার থেকেও সহজে চিহ্নিত করা গেছে।

কিছুক্ষণ আগে শেরপা আকাশ দেখে যা বলেছিলেন সেটা আবার মনে হতেই লিসার চিন্তা-ভাবনাগুলো যেন বরফে জমে গেল।

বাতাসের পিঠে মৃত্যু ভর করেছে।

এই মুহূর্তে চিন্তাটা মোটেও সুখকর নয়।

লিসার পাশে ঠোঁট নাড়িয়ে নীরবে প্রার্থনা করছেন বুদ্ধ সন্ন্যাসী। কীসের ভয়ে প্রার্থনা করছেন তিনি? এই হেলিকপ্টারে চড়ার ভয় নাকি মঠে গিয়ে কী অবস্থা দেখবেন সেটার ভয়?

পেছনে হেলান দিল লিসা। শেরপার কথাটা এখনও ওর কানে বাজছে।

আজকের দিনটা সত্যিই খারাপ।

.

সকাল ৯টা ১৩ মিনিট।
 উচ্চতা : ২২ হাজার ২৩০ ফিট।

বড় বড় পা ফেলে গভীর ফাটলযুক্ত অঞ্চল অনায়াসে পেরিয়ে যাচ্ছে সে। স্টিলের ক্রাম্পগুলো সেঁধিয়ে যাচ্ছে তুষার ও বরফের গভীরে। নগ্ন পাথর নিয়ে গড়ে উঠেছে পাহাড়ের দু’পাশে থাকা উপত্যকা। ওখানটা শৈবাল জাতীয় উদ্ভিদে ছেয়ে গেছে। খাড়া হয়ে উঠে গেছে এই গিরিসঙ্কট।

তার লক্ষ্যের দিকে।

পরনে ওয়ান-পিস গুজ-ডাউন স্যুট। সাদা-কালো রঙের রেখায় ক্যামোফ্লেজ করা। তার মাথা ঢাকা রয়েছে সোমশ হুডি দিয়ে, স্লে-গগলস পরার কারণে আড়াল হয়ে গেছে চোখ দুটো। একটা প্যাক নিয়ে উঠছে সে। ওটার ওজন একুশ কেজি। ওর মধ্যে বিভিন্ন রকম জিনিস আছে। যেমন : বরফ আকড়ে ধরার কুঠার, সেই কুঠারের এক মাথায় আবার প্যাচানো রয়েছে পলি বোপ (দড়ি)। এছাড়াও আছে হেকলার অ্যান্ড কচ অ্যাসল্ট রাইফেল, অতিরিক্ত বিশ রাউন্ড ম্যাগাজিন এবং একটা ব্যাগে রয়েছে নয়টি অগ্নি-সংযোগকারী গ্রেনেড।

বাড়তি কোনো অক্সিজেন প্রয়োজন নেই তার। এমনকি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এত উঁচুতে উঠেও নয়। বিগত চুয়াল্লিশ বছর ধরে এই পাহাড়কে সে নিজের ঘর-বাড়ি বানিয়ে ফেলেছে। যেকোনো শেরপার সাথে পাল্লা দেয়ার মতো জ্ঞান রাখে। তবে এই ব্যক্তি কিন্তু শেরপাদের ভাষায় কথা বলে না। এর চোখ দুটোও ভিন্ন রঙের। একটা হিম শীতল নীল অন্যটা ধবধবে সাদা! এরকম ভিন্ন ধরনের দুটো চোখ থাকার কারণে তাকে সহজেই আলাদা করে লক্ষ করা যায়। আরেকটা বিষয় তাকে আলাদা করার জন্য দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে। সেটা হলো, তার ঘাড়ে থাকা ট্যাটু।

কানে থাকা রেডিও বেজে উঠল।

 ‘মঠে পৌঁছেছ?”

নিজের গলা ছুঁয়ে নিল সে। ‘চোদ্দ মিনিট লাগবে।’

‘দুর্ঘটনা সম্পর্কে কিছু একটা শব্দও ফাঁস হওয়া চলবে না।’

‘সব সামাল দেয়া হবে।’ নাক দিয়ে নিঃশ্বাস নেয়ার মধ্যেও নিজের কণ্ঠস্বর অক্ষত রাখল সে। নির্দেশদাতার কণ্ঠে ভয়ের সুর ছিল, বিষয়টা তার কান এড়ায়নি। কত ভয় পায়। আসলে এই গ্রানাইট ক্যাসলের এদিকে ও খুব একটা আসে না। তাই নির্দেশদাতা ভয় পাচ্ছেন। একদম কোনো এক প্রান্তে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে সে।

কেউ তার কাছে এসে কিছু জানতে চায় না। না চাওয়াটাই ভাল।

 তবে যখন প্রয়োজন পড়ে তখন ওকে ডেকে নেয়া হয়।

ওর ইয়ারপিস আবার জ্যান্ত হয়ে উঠল। ওরা খুব শীঘ্রি মঠে পৌঁছে যাবে।

জবাব দেয়ার কোনো প্রয়োজনবোধ করল না ও। দূর থেকে ভেসে আসা হেলিকপ্টার রোটরের আওয়াজ শুনতে পেয়েছে। মগজকে হিসেবের কাজে লাগিয়ে দিল ও। তাড়াহুড়োর কোনো প্রয়োজন নেই। পাহাড় ওকে ধৈর্য ধরতে শিখিয়েছে।

ফুসফুসের গতিকে অক্ষুণ্ণ রেখে লাল-টাইলের ছাদযুক্ত পাথুরে ভবনের দিকে এগিয়ে চলল সে। টেম্প অচ মঠের অবস্থান উপত্যকার কিনারায়। নিচ থেকে এখানে সহজে উঠে আসার রাস্তা একটাই। মঠের সন্ন্যাসী ও তাদের শিষ্যরা বাইরের দুনিয়া নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায় না।

তবে সেটা বজায় ছিল তিন দিন আগ পর্যন্ত।

ওই দুর্ঘটনা।

তার কাজ ছিল পুরো কাজ একদম পরিষ্কারভাবে শেষ করা।

 হেলিকপ্টারের আওয়াজ বেড়ে যাচ্ছে। নিচ থেকে উঠে আসছে ওটা। আপন গতিতে এগোল সে। হাতে যথেষ্ট সময় আছে। হেলিকপ্টারে যারা আছে ওদের মঠে পৌঁছুনো প্রয়োজন।

সবকটা একসাথে খুন করতে সুবিধে হবে।

.

সকাল ৯টা ৩৫ মিনিট।

হেলিকপ্টার থেকে নিচের পৃথিবীকে দেখে মনে হচ্ছে এটা যেন পুরোদস্তুর একটা ছবির ফটোগ্রাফিক নেগেটিভ। রঙহীন, সাদা-কালো। তুষার ও পাথরে মাখামাখি। কুয়াশা ঢেকে রেখেছে পর্বতের চূড়োগুলোকে, ছায়ায় ঢাকা পড়েছে গিরিসঙ্কটগুলো। বরফ আচ্ছাদিত উপত্যকা থেকে প্রতিফলিত হচ্ছে সূর্যরশ্মি। প্রতিফলিত রশ্মির দাপটে চোখ প্রায় তুষার অন্ধতায় আক্রান্ত হওয়ার দশা।

 এত উজ্জ্বল আলো থেকে বাঁচতে চোখ পিট পিট করল লিসা। মূল দুনিয়াকে ছেড়ে এসে এখানে বাস করে কারা? এরকম বৈরি পরিবেশে কারা থাকে? আরাম ও ভাল জায়গা থাকা সত্ত্বেও মানুষ কেন এরকম দুর্গম এলাকাকে বেছে নেয়?

এই প্রশ্ন লিসাকে ওর মা প্রায়ই জিজ্ঞেস করত। কেন এত কষ্ট করা? রিসার্চ শিপে পাঁচ বছর কাটানো, তারপর পাহাড়ের কঠিন পরিস্থিতিতে টিকে থাকার জন্য এক বছর ট্রেনিং নেয়া আর এখন নেপালে এভারেস্টে ওঠার পায়তারা! আরামের জীবনকে পায়ে ঠেলে এত ঝুঁকি নেয়া কেন?

একদম সাদামাটা জবাব ছিল লিসার : কারণ এখানে চ্যালেঞ্জ আছে। পর্বতারোহণের কিংবদন্তী জর্জ ম্যালেরিকে যখন প্রশ্ন করা হয়েছিল, কেন তিনি এভারেস্টে চড়েছেন, তখন কী তিনি এরকম জবাব দেননি? এভারেস্ট ছিল তাই চড়েছি। প্রশ্নাঘাত করতে ওস্তাদ সাংবাদিকের মুখের ওপর এই বিখ্যাত লাইনকে জবাব হিসেবে ছুঁড়ে দিয়েছিলেন তিনি। মায়ের প্রশ্নের বিপরীতে লিসার জবাবও কী একেবারে মোক্ষম ছিল না? এখানে কী করছে লিসা? জীবনে প্রতিদিন নিত্য নতুন চ্যালেঞ্জ আসে। জীবিকা নির্বাহ করা, অবসরের জন্য সঞ্চয় করা, ভালবাসার মানুষকে খুঁজে বের করা, বিপদ-আপদকে মোকাবিলা করা, সন্তান মানুষ করা ইত্যাদি।

 ভাবনার ঘুড়ি উড়ানো বন্ধ করল লিসা। হঠাৎ এক ধরনের উপলব্ধি হলো ওর। প্রকৃত জীবনকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য আমি কোনো ভিন্ন জীবনের পেছনে ছুটছি না তো? এজন্যই কী আমার জীবনে এত পুরুষ আসা সত্ত্বেও কেউ নোঙর ফেলেনি?

 লিসার বয়স এখন তেত্রিশ। একা, কোনো বাধন নেই, প্রত্যাশা নেই। একজন মানুষ ঘুমাতে পারবে এরকম স্লিপিং ব্যাগে একা একা রাত কাটিয়ে কোম্পানির জন্য গবেষণা করে যাচ্ছে। মাথার চুল কামিয়ে এরকম একটা পাহাড়ি মঠে সন্ন্যাসী হয়ে যাওয়াটাই বোধহয় ওর জন্য ভাল হবে।

কেঁপে উঠল হেলিকপ্টার, একটু খাড়া হয়েছে।

চিন্তার জাল ছিঁড়ে বাস্তবে ফিরল লিসা।

ওহ, শিট…

দম আটকে ফেলল ও। পাহাড়ের বিপজ্জনক রিজু এর ওপর দিয়ে আলতো করে ভেসে গেল হেলিকপ্টার। কোনোমতে পাশের একটা গিরিসঙ্কটের সাথে সংঘর্ষ এড়াল এটা।

সিটের হাতলকে শক্ত করে চেপে ধরছে ওর আঙুলগুলো। আঙুলের চাপ হালকা করার চেষ্টা করল ও। হঠাৎ ওর মনে হলো, তিন বেডরুমের একটা কটেজ আর আড়াইটা বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে জীবন কাটালে মন্দ হয় না!

 লিসার পাশে থাকা আং গেলু সামনে ঝুঁকে পাইলট আর সৈনিকের দিকে তাকিয়ে নিচের দিকে ইশারা করে নির্দেশ দিলেন। রোটরের আওয়াজে তার মুখের কথা ঢাকা পড়ল।

 বাইরের দৃশ্য দেখার জন্য জানালার কাঁচের সাথে নিজের গাল ঠেকাল লিসা। আলতো করে বাঁকানো প্লেক্সিগ্লাস ওর নরম গালে চুমো খেল। প্রথমবারের মতো নিচে একটু রঙের আভাস দেখা যাচ্ছে। লাল টাইলের ছাদ। আটটা পাথরের ভবন চোখে পড়ল। ওটার তিনদিকে দাঁড়িয়ে আছে বিশ হাজার ফুটি পাহাড়। আর একদিক আগলে রেখেছে পাহাড়ের খাড়া কিনারা।

টেম্প ওচ মঠ।

অত্যন্ত খাড়াভাবে ভবনের দিকে নামতে শুরু করল হেলিকপ্টার। লিসা খেয়াল করল একপাশে একটা আলুর ক্ষেত আছে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কিছু গবাদি পশু আর গোলাঘর চোখে পড়ল। সব কেমন চুপচাপ। যান্ত্রিক পাখিতে চড়ে আসা অতিথিদেরকে স্বাগত জানাতে কেউ এগিয়ে এল না।

 তারচেয়েও অলক্ষুণে ব্যাপার খেয়াল করল লিসা, কিছু ছাগল আর নীল রঙের ভেড়া রয়েছে গবাদি পশুর মধ্যে। ওগুলোও নড়াচড়া করছে না। মনে হচ্ছে, হেলিকপ্টারের শব্দ শুনে ঘাবড়ে গিয়ে ভয়ে শক্ত হয়ে গিয়েছে। ভূমিতে পড়ে আছে ওগুলো, পাগুলো মোচড় খেয়ে রয়েছে, ঘাড় বাঁকা, একদম অস্বাভাবিক অবস্থা।

আং গেলু-ও এসব দেখে নিজের সিটে বসলেন। লিসার চোখে চোখ পড়ল তার। কী হয়েছে? সামনে পাইলট আর সৈনিকটির মধ্যে কোনো একটা বিষয় নিয়ে মত বিরোধ চলছে। পাইলট এরকম জায়গায় হেলিকপ্টার নামাতে চাইছে না। কিন্তু জয় হলো সৈনিকের। কারণ সে পাইলটের পাছায় রাইফেলের নল ঠেসে ধরেছে। ক্রুদ্ধ হয়ে নিজের নাকে-মুখে অক্সিজেন মাস্ক আরো জোরে চেপে ধরল পাইলট। মাস্ক চেপে ধরার পেছনে রাগ আর বাতাসের প্রয়োজনের চেয়ে ভয়ের প্রভাবটাই বেশি।

সৈনিকের কথা মতো চলছে পাইলট। কন্ট্রোলের গলা টিপে ধরে হেলিকপ্টারকে ভূমিতে নামাতে শুরু করল। গবাদি পশুরগুলোর কাছ থেকে যতটা সম্ভব দূরে নামবে সে। মঠের পাশে থাকা আলু ক্ষেতের প্রান্তকে স্থির করল লক্ষ্য হিসেবে।

চারদিকে পাহাড়বেষ্টিত সমতল ভূমিতে সারি সারি অবস্থায় ক্ষেতটা গড়ে উঠেছে। সদ্য গজানো সবুজ অঙ্কুরে সেজেছে ক্ষেত। পাহাড়ের এত উঁচুতে আলু চাষ করার পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছিল ব্রিটিশরা, উনবিংশ শতাব্দীতে। তারপর থেকে আলু এরকম অঞ্চলের জন্য একটি অপরিহার্য শস্যে পরিণত হয়।

বেমক্কা ঝাঁকি খেয়ে পাহাড়ি ভূমিতে অবতরণ করল হেলিকপ্টার। নামতে গিয়ে বেশ কয়েকটা চারা গাছ নষ্ট করেছে, সেটা বলাই বাহুল্য। রোটরের বাতাসের তোপে অঙ্কুরগুলো থরথর করে কাঁপছে।

এখনও কেউ তাদের আগমন সম্পর্কে হাজিরা দেয়নি। মৃত গবাদিপশুর কথা ভাবল লিসা। বাঁচানোর মতো কেউ কী এখানে আছে? নাকি সবাই মরে গেছে? কী হয়েছে এখানে? সম্ভাব্য বিভিন্ন কারণ ওর মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। খাদ্যে বিষক্রিয়া, বিষাক্ত বাতাস, ছোঁয়াচে কোনো রোগ কিংবা কোনো সংক্রামক? জানতে হলে ওর আরও তথ্য প্রয়োজন।

‘আপনি বরং এখানেই থাকুন,’ সিট বেল্ট খুলতে খুলতে লিসাকে বললেন আং গেল। আমরা মঠ পরীক্ষা করে আসি।

 নিজের মেডিক্যাল প্যাক তুলে নিল লিসা। মাথা নেড়ে বলল, “আমি ভয় পাই না। আর আপনাদের সাথে গেলে হয়তো আমি কিছু প্রশ্নের উত্তরও দিতে পারব।’

নড় করলেন আং গেলু, হড়বড় করে কী যেন বললেন সৈনিককে। সশব্দে হেলিকপ্টারের পেছনের হ্যাঁচ খুলে নিচে নামলেন। এক হাত বাড়িয়ে দিলেন লিসার দিকে।

রোটরের ঝাপটার সহায়তায় ঠাণ্ডা হাওয়া হেলিকপ্টারের উষ্ণ শরীরের ভেতরে ঢুকে পড়ল। মাথায় পারকা’র হুড তুলে দিয়ে লিসা টের পেল এখানে যতই ঠাণ্ডা পড়ক অক্সিজেন এখনও আছে। তবে এমনও হতে পারে, ভয়ে ঠাণ্ডা লাগছে ওর। খানিক আগে ওর মুখ থেকে বেরোনো কথাটা একটু বাড়িয়েই বলা ছিল।

 সন্ন্যাসীর হাত ধরল ও। পশমি হাতমোজা থাকার পরও টের পেল সন্ন্যাসী বেশ শক্তিশালী এবং হাত বেশ উষ্ণ। পরিষ্কার করে কামানো মাথা ঢাকার কোনো প্রবণতা দেখা গেল না তার মধ্যে। এরকম হিম শীতল ঠাণ্ডায় তিনি অভ্যস্ত।

হেলিকপ্টার থেকে নামার পরও রোটরের বাতাসের নিচে দাঁড়িয়ে রইল লিসা। সবশেষে নামল সৈনিক। পাইলট নামেনি। নির্দেশ অনুযায়ী বাধ্য হয়ে এখানে হেলিকপ্টার ল্যান্ড করিয়েছে ঠিকই কিন্তু ককপিট ছাড়তে রাজি নয়।

হ্যাচ বন্ধ করে দিলেন আং গেলু। আলুর ক্ষেত পেরিয়ে পাথুরে ভবনগুলোর দিকে দ্রুত এগোল ওরা তিন জন।

ওপর থেকে লাল টালিঅলা ভবনগুলো দেখতে যতটা লম্বা মনে হচ্ছিল নিচে নেমে দেখা গেল ওগুলো তারচেয়েও লম্বা। মাঝের ভবনটাকে দেখে মনে হচ্ছে ওটা তিন তলার মতো উঁচু। প্যাগোডার মতো ছাদ আছে ওতে। সব ভবন বেশ সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো। দরজা, জানালার কাঠামোর চিত্রে রংধনুর রং ব্যবহার করা হয়েছে। সোনালি রঙের লতা-পাতা আঁকা আছে দরজার সরদলে। ছাদের কোণা থেকে নেমে এসেছে পাথরের ড্রাগন আর পৌরাণিক পাখি। ছাদযুক্ত দ্বার-মণ্ডপ আরও কয়েকটা ভবনের সাথে সংযোগ স্থাপন করে একটু উঠোন ও ব্যক্তিগত জায়গা করে দিয়েছে। কাঠের তৈরি প্রার্থনার চাকায় খোদাই করা রয়েছে প্রাচীন হরফ। বিভিন্ন রঙের প্রার্থনা পতাকা ঝুলছে ছাদ থেকে। বাতাসের কারণে থেমে থেমে দুলছে ওগুলো।

সাঙরিলা নামের পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত এই ভবনগুলো দেখতে অনেকটা রূপকথার মতো মনে হচ্ছে। লিসা খেয়াল করে দেখল এসব দেখতে দেখতে ধীরে ধীরে পা ফেলছে ও। কোনোকিছু নড়ছে না। বন্ধ করা রয়েছে অধিকাংশ জানালা। নীরবতা একদম জেঁকে বসেছে।

বাতাসে কেমন যেন একটু দুর্গন্ধ পাওয়া গেল। গবেষক হওয়ার আগে লিসা যখন মেডিক্যাল স্টুডেন্ট ছিল তখন থেকেই মৃত জিনিসগুলোর সাথে তার ওঠা-বসা। মৃত জিনিসের দুর্গন্ধ সে এখনও ভোলেনি। ও প্রার্থনা করল, গন্ধটা যেন মাঠের এই গবাদি পশুদের হয়। কিন্তু এখানে কারও চিহ্ন না দেখে খুব একটা আশাবাদী হতে পারল না লিসা।

সৈনিককে সাথে নিয়ে আং গেলু পথ দেখাচ্ছেন। ওদের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য দ্রুত পা চালাল লিসা। দুটো ভবন পার হয়ে ওরা এখন মাঝখানে দাঁড়ানো ভবনের দিকে এগোচ্ছে।

মূল উঠোনে বিভিন্ন কৃষি যন্ত্রপাতি কেমনভাবে যেন ছড়ানো-ছিটানো অবস্থায় রয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে, তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে ফেলে গেছে কেউ। দু’চাকার একটা গাড়ির সাথে বাঁধা অবস্থায় রয়েছে ইয়াক। গাড়ি উল্টো হয়ে রয়েছে, মারা গেছে জন্তুটা। এটার পা-গুলোও শক্ত হয়ে ছড়িয়ে আছে, ফুলে গেছে পেট। দুধ সাদা চোখ মেলে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে প্রাণহীন দেহ। কালো দুই ঠোঁটের ভেতর দিয়ে ওর ফোলা জিহ্বা বেরিয়ে এসেছে।

লিসা খেয়াল করে দেখল মৃতদেহের কাছে মাছি কিংবা অন্য কোনো ছোট কীট পতঙ্গের আনাগোনা নেই। পাহাড়ের এত উঁচুতে কী মাছি থাকে? ও সঠিক জানে না। আকাশের দিকে তাকাল লিসা। কোনো পাখি নেই। বাতাসের শব্দ ছাড়া কোনো শব্দ নেই।

‘এই দিকে,’ বললেন আং গেলু।

কয়েকটা লম্বা দরজার দিকে এগোলেন সন্ন্যাসী! দরজাগুলো পেরিয়ে ভবনের মাঝখানে অর্থাৎ মঠের মূল কেন্দ্রে যাওয়া যাবে। হাতল ধরে পরীক্ষা করে দেখলেন ওটা তালাবন্ধ নয়, খোলা। তিনি দরজা খুললেন, কজাগুলো ঝাঁকিয়ে উঠল।

দরজার ওপাশে প্রথম প্রাণের চিহ্ন মিলল। দরজার দু’পাশে ব্যারেল সদৃশ বাতি জ্বলছে। ডজনখানেক মোমবাতি জ্বলছে ওগুলোর সাথে। বাতিগুলো মাখনের সাহায্যে জ্বলে। ইয়াকের মাখন। কিন্তু ভেতরে সুগন্ধের বদলে আরও বেশি দুর্গন্ধ পাওয়া গেল। এটা কোনো শুভ লক্ষণ নয়।

এমনকী সৈনিকটিও এখন দরজার চৌকাঠের কাছ থেকে পিছিয়ে দাঁড়িয়েছে। তার অটোমেটিক ওয়েপনকে এক কাধ থেকে আরেক কাঁধে স্থান বদল করল, নিজেকে নিশ্চিত করল আরকী। সন্ন্যাসী অবলীলায় ভেতরে পা চালালেন। শব্দ করে ডাকলেন তিনি। প্রতিধ্বনিত হলো তার আওয়াজ।

 আং গেলুর পেছন পেছন প্রবেশ করল লিসা। সৈনিকটি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল।

আরও কয়েকটা ব্যারেল বাতি জ্বলে উঠে আলোকিত করল মন্দিরের ভেতরটা। ঘরের দু’পাশের দেয়ালে প্রার্থনার চাকা সারিবদ্ধ করে রাখা। জুনিপারের সুগন্ধীযুক্ত মোমবাতি আর ধূপকাঠি জ্বলছে সেগুন কাঠ দিয়ে তৈরি আট ফুট উঁচু বুদ্ধ মূর্তির কাছে। বাকি দেবতাগণ তার কাঁধের পেছনে জায়গা করে নিয়েছে।

মন্দিরের অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশে নিজের চোখগুলোকে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে লিসা। ও খেয়াল করে দেখল, কাঠের গায়ে এবং দেয়ালে আঁকা চিত্রে এমন কিছু দৃশ্য দেখানো হয়েছে যেগুলো দেখতে খুব একটা ভাল লাগছে না। মোমবাতির অল্প আলোতে পৈশাচিক লাগছে ওগুলোকে। উপরের দিকে তাকাল ও। কাঠের খুঁটি দোতলা পর্যন্ত উঠে গেছে। ওপর থেকে ঝুলে থাকা এক গুচ্ছ বাতিকে ধরে রেখেছে ওগুলো। তবে বাতিগুলো জ্বলছে না। সব বন্ধ ও ঠাণ্ডা।

আবার হাঁক ছাড়লেন আং গেলু।

ওদের মাথার উপরে কোনো এক স্থানে কিছু একটা শব্দ করে উঠল।

হঠাৎ শব্দ হওয়ায় ভড়কে গেল ওরা। সৈনিক একটা ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে ওপরের দিকে তাকাল। লাইটের আলো আর তার পাশে ছায়া ছাড়া আর কোনোকিছু চোখে পড়ল না।

 কাঠের ওপর আবার শব্দ হলো। ওপরের তলায় কে যেন নড়াচড়া করছে। কেউ বেঁচে আছে এরকম সংকেত পাওয়া সত্ত্বেও ভয়ে লিসার রোম দাঁড়িয়ে গেল।

মুখ খুললেন আং গেলু। ‘মন্দিরের দেখাশোনা করার জন্য একটা ব্যক্তিগত মেডিটেশন রুম আছে। সিঁড়ি পেছন দিকে। আমি যাচ্ছি। আপনি থাকুন।

লিসা তার কথা মেনে নিতে চাচ্ছিল কিন্তু মেডিক্যাল ব্যাকপ্যাক আর দায়িত্ব, দুটোর প্রয়োজনীয় উপলব্ধি করল ও। গবাদি পশুগুলোর মৃত্যুর জন্য মানুষ দায়ী নয়। সেটা লিসা বেশ ভাল করেই বুঝতে পারছে। যদি কেউ এখনও বেঁচে থাকে তাহলে সে হয়তো বলতে পারবে, এখানে আসলে কী ঘটেছিল। আর এ-কাজে লিসা-ই সবচেয়ে উপযুক্ত।

নিজের ব্যাকপ্যাকটাকে আরও ভাল করে কাঁধে রাখল লিসা। ‘আমি আসছি।’

কথাটা জোর গলায় বললেও আং গেলু’র পেছনেই রইল ও।

বুদ্ধ মূর্তির পেছনে গেলেন সন্ন্যাসী। ওদিকে একটা দরজা আছে। স্বর্ণখচিত পর্দা পেরিয়ে এগোলেন তিনি। একটা ছোট হলওয়ে ভবনের আরও গভীরে যাওয়ার পথ দেখিয়ে দিল। বন্ধ জানালাগুলোর ফাঁক-ফোকর দিয়ে অল্প করে রুপোলি আলো ভেতরে আসছে। ভেতরটা অন্ধকারাচ্ছন্ন, ধূলিময়। সাদা চুনকাম করা দেয়ালের দিকে আলো ফেলল ওরা। টকটকে লাল রক্ত আর নোনতা গন্ধেই যা বোঝার বোঝা গেল। আরও কাছে গিয়ে পরীক্ষা না করলেও চলবে।

রক্ত।

এক জোড়া নির্জীব নিথর পা হলের মাঝখানের একটা দরজার সামনে পড়ে রয়েছে। আং গেলু লিসাকে মন্দিরে ফিরে যাওয়ার জন্য ইশারা করলেন। মাথা নাড়ল লিসা, সন্ন্যাসীকে পেরিয়ে এগোল। যে পড়ে আছে তাকে বাঁচানোর কোনো আশা নেই, এটা লিসা জানে। কিন্তু অভ্যাসবশত এগোচ্ছে সে। পাঁচবার লম্বা লম্বা পা ফেলে লাশের কাছে পৌঁছে গেল লিসা।

দৃশ্য দেখে বুক ছলকে উঠল ওর। পিছিয়ে এলো।

পা দুটো ওখানে আছে কিন্তু কোনো শরীর নেই। শুধুই একজোড়া কাটা পা, উরুর কাছ থেকে কেটে নেয়া হয়েছে। সাহস করে রুমের ভেতরে তাকাল ও। কাঠের ডাল পালার মতো মানুষের ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হাত-পা জড়ো করা রয়েছে রুমের মাঝখানে। এ যেন এক কসাইখানা।

 শুধু তাই-ই নয়। কয়েকটা কাটা মুণ্ডুও আছে। দেয়াল ঘেঁষে সুন্দর করে সাজানো আছে ওগুলো। সব মুণ্ডুর চোখ খোলা অবস্থায় ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। ভয়ঙ্কর।

লিসার পাশে এলেন আং গেলু। এরকম দৃশ্য দেখে তার চোখ-মুখ শক্ত হয়ে গেল। মুখ দিয়ে কী যেন বলতে শুরু করলেন বিড়বিড় করে। শুনে মনে হলো ওগুলোর অর্ধেক প্রার্থনা, অর্ধেক অভিশাপ।

 তার আওয়াজ শুনেই বোধহয় রুমের ভেতরে কিছু একটা নড়ে উঠল। হাত-পা’র স্তূপ থেকে একটু দূরে একটা নগ্ন দেহ চোখে পড়ল। পুরো মাথা কামানো। সদ্যজাত শিশুর মতো সারা শরীরে রক্ত। ইনি মন্দিরের একজন সন্ন্যাসী।

নগ্ন দেহের কণ্ঠ থেকে হিস-হিস শব্দ ভেসে এলো পাগলের প্রলাপের মতো। তার চোখে অল্প আলোক রশ্মি প্রতিফলিত হচ্ছে, রাতের আঁধারে থাকা নেকড়ের মতো লাগছে তাকে।

নগ্ন দেহটা ওদের দিকে এগোতে শুরু করল। হাতে ধরে নিয়ে আনছে একটি তিন ফুটি ধারালো কাস্তে। কয়েক কদম পিছিয়ে গেল লিসা। আগন্তুককে থামানোর জন্য হাত তুলে আং গেলু নরম কণ্ঠে বললেন, ‘রেলু নাআ, রেলু নাআ।

 লিসা বুঝতে পারল আং গেল এই পাগলকে চেনেন। এই মঠে আসার আগে থেকেই একে চিনতেন আং গেলু। হাত তুলে নাম ধরে ডাকার ফলে পাগল সন্ন্যাসীর পাগলামো থামল। কিন্তু এতে পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল।

 বিকট চিৎকার জুড়ে দিয়ে পাগল সন্ন্যাসী ঝাঁপিয়ে পড়ল তার জ্ঞাতি ভাইয়ের ওপর। আং গেলু তাকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। শরীরের সাথে সাথে পাগল সন্ন্যাসীর মানসিক অবনতিও ঘটেছে। তাকে জড়িয়ে ধরে দরজার কাঠামোর একপাশে বসালেন আং গেলু।

চটপট কাজে লেগে পড়ল লিসা। প্যাক নামিয়ে জিপার খুলল ও। মেটাল কেস বের করে খুলল ওটা।

ভেতরে এক সারি প্লাস্টিক সিরিঞ্জ আছে। আপদকালীন সময়ে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন ওষুধ ভরা রয়েছে ওগুলোতে। যেমন : ব্যথার জন্য মরফিন, শ্বাসকষ্টের জন্য ইপিনিফিরিন, ফুসফুস সংক্রান্ত সমস্যার জন্য ল্যাসিক্স ইত্যাদি। প্রত্যেকটা সিরিঞ্জের গায়ে নাম লেখা থাকলেও লিসা ওগুলোর অবস্থান মুখস্থ করে রেখেছে। কারণ জরুরি মুহূর্তে প্রতিটি সেকেন্ড অনেক মূল্যবান। মেটাল কেসের ভেতরে থাকা সর্বশেষ সিরিঞ্জটা বের করল লিসা।

মিডাজোলেম। স্নায়বিক উত্তেজনা কমায়। এরকম উচ্চতায় পাগলামো ও দৃষ্টিভ্রম মোটামুটি সাধারণ ঘটনা। ওষুধের মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়।

 নিজের দাঁত ব্যবহার করে সিরিঞ্জের উঁচ উনাক্ত করল লিসা। তাড়াতাড়ি হাত চালাল।

আং গেলু এখনও লোকটাকে ধরে রেখেছেন। কিন্তু পাগল সন্ন্যাসী তার হাত থেকে ছোটার জন্য ছটফট করছে। ঠোঁট ফেটে গেছে আং গেলুর। তিনি গলার একপাশে কাস্তে ধরে রেখেছেন।

‘ওকে শক্ত করে ধরে রাখুন!” চিৎকার করে বলল লিসা।

আং গেলু তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করলেন। কিন্তু সে-সময়, সম্ভবত ডাক্তারের মতি গতি বুঝতে পেরে পাগল সন্ন্যাসী খেপে গেল। আং গেলুর গালে গভীরভাবে কামড় বসাল সে। আং গেলু আর্তনাদ করে উঠলেন। তাঁর গালের মাংস উঠে হাড় বেরিয়ে পড়েছে।

কিন্তু পাগলকে এখনও ছাড়েননি। শক্ত করে ধরে রেখেছেন।

লিসা তার সিরিঞ্জের উঁচ ঢুকিয়ে দিল পাগলের গলায়। ঠেলে দিল প্লঞ্জার। ‘ছেড়ে দিন ওকে!’

পাগলকে দরজার কাঠামোর সাথে শক্ত করে ঠেসে ধরলেন আং গেলু। পাগলের মাথার খুলি কাঠের সাথে বাড়ি লেগে আওয়াজ করে উঠল। ধাক্কা দিয়ে পেছনে সরল ওরা।

‘এক মিনিটের মধ্যে সিডেটিভ ওর শরীরে কাজ করবে।‘ ইনজেকশনটা পাগলের শিরদাঁড়ায় দিতে পারলে বেশি ভাল হতো। কিন্তু যেরকম আক্রমণ চলছিল তাতে গলায় না দিয়ে কোনো উপায় ছিল না। আশা করা যায়, এতেই কাজ হয়ে যাবে। একবার শান্ত হয়ে গেলে তারপর সেবা করা যাবে। হয়তো কিছু প্রশ্নের জবাবও মিলবে তখন।

যন্ত্রণায় গুঙিয়ে উঠল নগ্ন সন্ন্যাসী, গলায় হাত দিয়ে রেখেছে। সিডেটিভ পুশ করা হয়েছে ওখানে। আবার ওদের দিকে ফিরল সে। মেঝে থেকে সেই কাস্তেটা তুলে দাঁড়াল সোজা হয়ে।

আং গেলুকে হেঁচকা টান দিয়ে সরাল লিসা।‘ থামো…

 ধ্রাস!

সরু হল কাঁপিয়ে রাইফেল গর্জে উঠল। রক্তের ফোয়ারা বইয়ে ফেটে গেল পাগল সন্ন্যাসীর মাথা। নিজের মাথার টুকরো টুকরো অংশের ওপর ধপাস করে পড়ে গেল সে।

গুলি নিক্ষেপকারীর দিকে তাকাল লিসা ও আং গেলু।

নেপালিজ সৈনিকের কাঁধে অস্ত্র ঝুলানো রয়েছে। ধীরে ধীরে নিচে নামিয়ে আনল ওটা। সৈনিকের সাথে আবার আঞ্চলিক ভাষায় ভর্ৎসনা করতে শুরু করলে আং গেলু। সৈনিকের কাছ থেকে অস্ত্র নিয়ে নিলেন।

লাশের কাছে গিয়ে পালস চেক করল লিসা। নেই। লাশের দিকে তাকিয়ে কিছু উত্তর খোঁজার চেষ্টা করল ও। পাগলামোর মূল কারণ বের করার জন্য একটা মর্গ ও সাথে ফরেনসিক সংক্রান্ত আধুনিক সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজন। তবে সেই লোকের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, এখানে যা কিছু হয়ে থাকুক না কেন সেটা কেবল মাত্র একজনকে আক্রান্ত করেনি। বিভিন্ন মাত্রায় ভুগিয়েছে সবাইকে।

কিন্তু কী সেটা? ওদের পানিতে কোনো ভারী ধাতু ছিল, ভূগর্ভস্থ বিষাক্ত গ্যাস কিংবা কোনো বিষাক্ত ছত্রাক, খাদ্যশস্য? নাকি তারচেয়েও বড় কিছু, যেমন ইবোলা? নাকি নতুন কোনো ধরনের রোগ? গরুর পাগলামো সংক্রান্ত কিছু? ইয়াকগুলোর কথা মনে করল লিসা। পেট ফোলা মৃত গবাদি পশুগুলোর কথা ভাবল ও। কিছুই বুঝতে পারছে না।

আং গেল ওর কাছে এগিয়ে এলেন। তাঁর গাল রক্তে ভেসে যাচ্ছে তবে তিনি সেটাকে পাত্তাই দিচ্ছেন না। তাঁর যত কষ্ট এই মৃত দেহটাকে নিয়ে।

“ওর নাম রেলু নাআ হাভারসি।’

 ‘আপনি ওকে চিনতেন।

সম্মতি সূচক মাথা নাড়লেন সন্ন্যাসী। ‘আমার বোনের বরের চাচাতো ভাই ছিল ও। বড় হয়েছিল এক অজোপাড়ায়। মাওবাদী বিদ্রোহীদের সাথে জড়িয়ে পড়েছিল ও। কিন্তু ওদের ওরকম সহিংস আচরণ ওর পছন্দ হয়নি। ওখান থেকে পালিয়ে গেল। আর মাওবাদীদের দল থেকে কারও পালানো মানে হলো মৃত্যুর টিকেট কেটে নেয়া। ওকে লুকানোর জন্য আমি মঠের একটা পদে বসিয়েছিলাম। মাওবাদীরা ওকে কোনোদিনও খুঁজে পেত না। এখানে ও বেশ শান্তিতেই ছিল… আর ওর জন্য এরকমই প্রার্থনা করেছিলাম আমি। আর এখন তো ও নিজের শান্তির পথ খুঁজে পেয়েছে।’

‘আমি দুঃখিত।

দাঁড়াল লিসা। পাশের রুমে থাকা বিচ্ছিন্ন হাত-পায়ের দৃশ্য আবার কল্পনা করল। কোনো আঘাতের ফলে কী ওরকম পাগলামোর সূচনা হয়েছিল? ওসবের ভয়েই এমন পাগলামো করছিল সন্ন্যাসী?

আরেকবার শব্দ হলো মাথার ওপরে।

 সব চোখ ওপর দিকে তাকাল।

ওরা সবাই কীসের জন্য ওপরে এসেছিল, ব্যাপারটা লিসা ভুলেই গিয়েছিল। সরু ঢালু একটা সিঁড়ি দিকে নির্দেশ করলেন আং গেলু। ওটা লিসার চোখে পড়েনি। তবে ওটাকে সিঁড়ি না বলে মই বলাই ভাল।

“আমি যাব,’ বললেন তিনি।

‘একসাথে থাকব আমরা,’ আপত্তি তুলল লিসা। ব্যাগের কাছে গিয়ে আরেকটা সিরিঞ্জ তুলে নিল ও। এটাতেও সিডেটিভ লোড করা আছে। সিরিঞ্জটা হাতে রাখল। ‘আপনার তুষোড় সৈনিককে বলুন, সে যেন অস্ত্রের ট্রিগার থেকে আঙুল দূরে সরিয়ে রাখে।’

মইয়ে সবার আগে পা রাখল সৈনিক। দ্রুত ওপরে উঠে গিয়ে ওদেরকে ইশারা করল সে। লিসা মই বেয়ে উপরে উঠে দেখল এটা একটা ফাঁকা রুম। এক কোণায় পাতলা বালিশের তূপ দেখা গেল। রজন আর নিচ থেকে ভেসে আসা ধূপের গন্ধ পাওয়া গেল রুমে।

সৈনিকটি দূর প্রান্তে থাকা কাঠের দরজার দিকে অস্ত্র তাক করে রেখেছে। দরজার নিচ দিয়ে আলো আসছে। কেউ কাছে এগোবার আগেই একটা ছায়া আলোর ওপর দিয়ে চলে গেল।

কেউ আছে ওখানে।

আং গেলু সামনে এগিয়ে গিয়ে দরজায় নক করলেন।

শব্দ থামল।

দরজার এপাশ থেকে ডাকলেন তিনি। লিসা তার কথাগুলো বুঝতে না পারলেও কেউ একজন বুঝতে পারল। শব্দ হলো কাঠের সাথে ঘষা খাওয়ার। খিড়কি ভোলা হয়েছে। একটু ফাঁক হলো দরজা… ওই পর্যন্তই।

দরজায় হাত রাখলেন আং গেলু।

‘সাবধান!’ ফিসফিস করে বলল লিসা। নিজের হাতে থাকা সিরিঞ্জকে আরও শক্ত করে চেপে ধরল। এটাই ওর একমাত্র অস্ত্র।

ওর পাশে থাকা সৈনিকটিও একই আচরণ করল তার অস্ত্রের সাথে।

আং গেলু দরজা পুরোপুরি খুলে ফেললেন। সরু গলির সাইজের রুম দেখা গেল। মেঝেতে পাতা বিছানা রয়েছে রুমের এক কোণায়। একটা ছোট্ট সাইড টেবিলের পাশে জায়গা করে নিয়েছে তেলবাতি। প্রসাবের তীব্র কটু গন্ধ আর বিছানার নিচে রাখা ভোলা পট থেকে আসা মলের গন্ধে রুমের বাতাস পুরোপুরি দুর্গন্ধ হয়ে আছে। এখানে যে-ই থাকুক না কেন, এরকম ব্যক্তি আজকের দিনে বিরল!

এক কোণায় এক লোক ওদের দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আং গেলুর মতো তার পরনেও লাল গাউন কিন্তু গাউনটা নোংরা, ছিঁড়ে গেছে জায়গায় জায়গায়। লোকটা গাউনের নিচের অংশ উরুর ওপরে বেঁধে রেখেছে। তার নগ্ন পা দুটো দেখা যাচ্ছে। দেয়ালে লেখার কাজ করছে সে। আঙুল দিয়ে আঁকছে।

রং হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে তার নিজের রক্ত!

 আগেরটার চেয়েও বেশি পাগলামোয়

তার অন্য হাতে একটা ছোরা ধরা আছে। নগ্ন পা দুটোর বিভিন্ন জায়গায় গভীর ক্ষত। তার রঙের উৎস ওগুলো। আং গেলু রুমে ভেতরে ঢোকার পরও তার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। সে আপনমনে নিজের কাজ করে যাচ্ছে।

 ‘লামা খেমসার,’ বললেন আং গেলু, তার কণ্ঠে উদ্বেগ।

 তার পেছন পেছন ঢুকল লিসা, ওর হাতে সিরিঞ্জ একদম তৈরি। আং গেলু ওর দিকে তাকাতেই মাথা নাড়ল ও। সৈনিকের দিকে ফিরে ইশারা করল লিসা। নিচে যেটা ঘটেছে এখানেও সেটা পুনরাবৃত্তি হোক এটা চায় না ও।

ঘুরল লামা খেমসার। তার চেহারা নির্জীব, চোখগুলো কাঁচের মতো এবং একটু দুধ সাদা ধাঁচের। কিন্তু মোমের আলো তার চোখ থেকে খুব উজ্জ্বলভাবে প্রতিফলিত হলো, খুবই উজ্জ্বলভাবে।

‘আং গেলু’, বিড়বিড় করল বুড়ো সন্ন্যাসী, মাথা ঘুরিয়ে চার দেয়ালে আঁকা হাজার হাজার রেখার দিকে তাকাল। রক্তমাখা আঙুল তুলল সে, আবার কাজ শুরু করবে।

 একদম স্বাভাবিকভাবে সন্ন্যাসীর দিকে এগোলেন আং গেলু। এই সন্ন্যাসী হলো মঠের প্রধান ব্যক্তি। এর অবস্থা এখনও অত খারাপ হয়নি। হয়তো তার কাছ থেকে কিছু উত্তর পাওয়া যাবে। স্থানীয় ভাষায় কথা বলতে শুরু করলেন আং গেলু।

 মাথা নাড়ল লামা খেমসার, যদিও তার রক্ত শিল্পকর্ম এখনও বন্ধ হয়নি। বুড়ো

সন্ন্যাসীর সাথে কথা বলার চেষ্টা করছেন আং গেলু, এই ফাঁকে লিসা দেয়ালের দিকে নজর দিল। এই ধরনের লেখার সাথে লিসার কোনো পরিচিতি নেই, তবে ও লক্ষ করল দেয়ালে প্রায় একই ধরনের চিহ্ন বারবার লেখা হয়েছে, প্রায় কাছাকাছি দেখতে ওগুলো।

নিশ্চয়ই কোনো অর্থ আছে ওগুলোর। ব্যাগ থেকে এক হাত দিয়ে ক্যামেরা বের করল লিসা। কোমরের কাছে ক্যামেরা রেখে দেয়ালের দিকে তাক করে ছবি তুলল ও। কিন্তু ফ্ল্যাশলাইটের কথা ওর খেয়াল ছিল না।

ফ্ল্যাশের আলোয় ঝলসে উঠল পুরো রুম।

চিৎকার করে উঠল বুড়ো সন্ন্যাসী। হাতে ছোরা নিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। বাতাসে চালাল ছোরাটাকে। চমকে উঠে পিছু হটলেন আং গেলু। কিন্তু তাকে লক্ষ্য করে ছোরা চালানো হয়নি। অস্পষ্ট শব্দ করে ভয়ে আর্তনাদ করে উঠল লামা খেমসার, ছোরা চালিয়ে দিল নিজের গলায়। টকটকে লাল রক্তের ধারা গড়াতে শুরু করল। শ্বাসনালী কেটে গেছে। রক্তে বুদবুদ তৈরি করে শেষ নিঃশ্বাস শ্রাগ করল বুড়ো সন্ন্যাসী।

শরীর ঘুরিয়ে ছোরার খোঁচা এড়িয়ে ছিলেন আং গেলু। লামা খেমসারকে ধরে মেঝে শুইয়ে দিলেন তিনি। রক্তে আং গেলুর গাউন, হাত ও কোল ভিজে গেল। আঘাতপ্রাপ্ত স্থান থেকে রক্ত ঝরা বন্ধ করার চেষ্টা করলেন আং গেলু কিন্তু সে চেষ্টা বৃথা।

 ‘ওকে নিচে নিয়ে যেতে হবে, আমাকে সাহায্য করুন।’ বলল লিসা। ‘ওনার শ্বাসকার্য চালানোর ব্যবস্থা করতে হবে।’

মাথা নাড়লেন আং গেলু। তিনি জানেন, আর কোনো লাভ হবে না। বুড়ো সন্ন্যাসীর দেহকে একটু নড়ালেন তিনি। রক্তের সাথে বের হওয়া বুদবুদগুলো দেখে বোঝা যাচ্ছিল বুড়ো সন্ন্যাসী শ্বাস নিচ্ছে। ইতোমধ্যে সেই বুদবুদগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। বয়স, রক্তক্ষরণ ও পানিশূন্যতার কারণে লামা খেমসার এমনিতেই দুর্বল ছিল।

‘আমি দুঃখিত,’ বলল লিসা। ‘আমি ভেবেছিলাম…’ দেয়ালের দিকে দেখাল ও। ‘আমি ভেবেছিলাম ওগুলো গুরুত্বপূর্ণ।

আং গেলু মাথা নাড়লেন। ‘কিছুই না। স্রেফ পাগলের পাগলামো।’

আর কী বলবে ভেবে পেল না লিসা। স্টেথোস্কোপ বের করে বুড়ো সন্ন্যাসীর বুক পরীক্ষা করতে শুরু করল। ব্যস্ততার মুখোশ পড়ে নিজের অপরাধ ঢাকার চেষ্টা করল ও। ভাল করে কানপাতল ও। কোনো হার্টবিট নেই। কিন্তু সন্ন্যাসীর পাজরে অদ্ভুত ক্ষত আবিষ্কার করল। আস্তে করে গাউন সরিয়ে বুকের ক্ষতগুলো উন্মুক্ত করল লিসা।

নিচের দিকে তাকালেন আং গেলু, দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।

দেখা গেল শুধু দেয়ালে লিখেই ক্ষান্ত হয়নি লামা খেমসার। সন্ন্যাসীর বুকে একটা চূড়ান্ত চিহ্ন আঁকা রয়েছে। ওই একই ছোরা দিয়ে এবং সম্ভবত সন্ন্যাসী তার নিজ হাতেই কাজটা করেছে। তবে দেয়ালে আঁকা চিহ্নগুলোর মতো ভাঙ্গা ক্রসের এই চিহ্নটা অপরিচিত নয়।

একটা স্বস্তিকা।

হঠাৎ ওরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রথম বিস্ফোরণের ধাক্কায় ভবন কেঁপে উঠল।

.

সকাল ৯ টা ৫৫ মিনিট।

আতঙ্ক নিয়ে জেগে উঠল সে।

বজ্রপাতের শব্দ তাকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। না বজ্রপাত নয়। বিস্ফোরণ। নিচু সিলিং থেকে পাস্টারের ধূলি নেমে এলো। উঠে বসল সে। কোথায় আছে সে, বুঝতে পারছে না। ওর সামনে থাকা রুম যেন একটু চক্কর মেরে উঠল। শরীর থেকে পশমি কম্বল ফেলে দিল ও। অদ্ভুত ধরনের খাটে রয়েছে সে, পরনে শুধু লিনেনের একটা ব্রিচক্লাউট। এক হাত উঁচু করল ও। হাত কাঁপছে। গরম পেস্টের মতো স্বাদ পেল মুখের ভেতর। পুরো রুম প্রায় অন্ধকারই বলা চলে, চোখ জ্বালা করলো ওর। আকস্মিক কাঁপুনিতে কেঁপে উঠল শরীর।

 এখন কোথায় আছে, আগে কোথায় ছিল সে-সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই তার।

বিছানা থেকে পা নামিয়ে ওঠার চেষ্টা করল সে। উচিত হয়নি। ওর পৃথিবী আবার অন্ধকার হয়ে গেল। ধপ করে পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারাতে যাচ্ছিল কিন্তু গুলির আওয়াজ সেটা হতে দিল না। অটোমেটিক ফায়ার। কাছেই হয়েছে। গুলির শব্দ মিলিয়ে গেল।

 আবার চেষ্টা করল ও। আগের চেয়ে জোরদারভাবে। কিন্তু ওর স্মৃতিশক্তি এমনভাবে ধরা দিল যেন ও একটা দরজার দিকে এগোচ্ছে। আঘাত করছে দরজায়, হাত দিয়ে টানছে, নব ধরে ঘোরানোর চেষ্টা করছে কিন্তু…

সেটা তালাবন্ধ।

.

সকাল ৯ টা ৫৭ মিনিট।

‘হেলিকপ্টার,’ বললেন আং গেলু। ‘ধ্বংস হয়ে গেছে ওটা।’

উঁচু জানালার একপাশে দাঁড়িয়ে আছে লিসা। কিছুক্ষণ আগে বিস্ফোরণ হয়েছে। প্রাথমিক ধাক্কা কেটে যাওয়ার পরই জানালা খুলে বাইরে তাকিয়েছে ওরা। সৈনিকটা বলছে, সে হয়তো নিচে উঠোনের ওদিকে কাউকে নড়াচড়া করতে দেখেছিল।

এখান থেকে গুলি ছোঁড়া হলেও জবাবে ওদিক থেকে কোনো গুলি ছোঁড়া হয়নি।

‘কাজটা কী পাইলট করেছে?’ প্রশ্ন করল লিসা। হয়তো ইঞ্জিনে কোনো সমস্যা দেখা দিয়েছিল, ভয়ে কাজটা করেছে সে।

সৈনিকটি এখনও জানালার কাছে নিজের পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একচোখ স্কোপে রেখে নজর রাখছে।

আলু ক্ষেতের ওদিক থেকে উঠে আস: ধোয়ার দিকে নির্দেশ করলেন আং গেলু। হেলিকপ্টার ওখানেই পার্ক করা ছিল। ‘ওটা কোনো যান্ত্রিক দুর্ঘটনা ছিল, আমি বিশ্বাস করি না।’

‘তাহলে আমরা এখন কী করব?’ লিসা জানতে চাইল। আরেকজন পাগল সন্ন্যাসী হেলিকপ্টার উড়িয়ে দিয়েছে নাকি? যদি দিয়ে থাকে তাহলে এই মঠে এরকম কতজন ম্যানিয়াক ঘুরে বেড়াচ্ছে? কাস্তে হাতে থাকা সন্ন্যাসী ও নিজের গলায় ছোরা ঢুকিয়ে দেয়া সন্ন্যাসীর কথা মনে করল ও। হচ্ছেটা কী এখানে?

‘আমাদের যেতে হবে?’ বললেন আং গেলু।

 ‘কোথায়?

‘এখান থেকে হাঁটা পথে একদিন লাগবে, ছোট্ট একটা গ্রাম আছে। এখানে যা-ই হয়ে থাকুক না কেন সেটা আমাদের তিনজন ছাড়াও আরও লোকজনের জানা দরকার।’

 ‘এখানে থাকা বাকিরা কোথায়? সবাই আপনার আত্মীয়ের মতো অতটা অসুস্থ নাও হয়ে থাকতে পারে। আমাদের তো তাদেরকে সাহায্য করা উচিত, তাই না?

 ‘ডা, কামিংস, আমার প্রথম কাজ হলো আপনার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তারপর এই ঘটনাকে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষকে জানানো।

‘কিন্তু যদি এখানে সংক্রামক জীবাণু থেকে থাকে? ভ্রমণের ফলে আমরা তো তাহলে ওগুলোকে ছড়িয়ে দেব।

জখম হওয়া গালে আঙুল বুলালেন সন্ন্যাসী! ‘হেলিকপ্টার ধ্বংস হয়ে গেছে, যার মানে দাঁড়াচ্ছে আমাদের যোগাযোগ মাধ্যম নেই। যদি এখানে থেকে যাই তাহলে আমরাও মারা যাব। বাইরের দুনিয়া এই ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানতে পারবে না।’

আং গেলু উচিত কথা বলেছেন।

‘যতক্ষণ না আরও বিস্তারিত না জানতে পারছি ততক্ষণ বাইরের মানুষদের কাছে আমরা আমাদের উপস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি।’ বললেন তিনি। সাহায্য চাইব ঠিকই কিন্তু সেটা করব নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে।

‘কোনো শারীরিক সংযোগ নয়’ বিড়বিড় করল লিসা।

মাথা নাড়লেন সন্ন্যাসী। ‘আমরা যে তথ্য বহন করছি, সেটার জন্য এতটুকু ॥ নেয়া যেতেই পারে।’

লিসা ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল। নীল আকাশের দিকে যাত্রা করা কালো ধোঁয়ার দিকে তাকাল ও। এখানে যে কতজন আক্রান্ত হয়েছে সেটা এখনও অজানা। ওরা নিশ্চয়ই বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেয়েছে। যদি ওদের তিনজনকে পালাতেই হয় তাহলে খুব দ্রুত পালানো উচিত।

‘চলুন।’ বলল লিসা।

তীক্ষভাবে সৈনিককে কিছু বললেন আং গেলু। মাথা নেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল সে। জানালার কাছ থেকে পজিশন বদলে নিজের অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত হলো।

রুম ও সন্ন্যাসীর দিকে শেষবারের মতো দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দৃষ্টিতে তাকাল লিসা। ধরে নিল, সম্ভাব্য সংক্রামক জীবাণু আছে। ওরা কী ইতোমধ্যে ওতে আক্রান্ত হয়ে গেছে। নিজেকে বিচার বিশ্লেষণ করতে করতে রুম থেকে বেরিয়ে মই বেয়ে নামল লিসা। ওর মুখ শুকিয়ে গেল, শক্ত হয়ে গেল চোয়ালের মাংস, হৃদপিণ্ড যেন উঠে এল গলার কাছে। কিন্তু এগুলো তো হচ্ছে ভয়ের কারণে, তাই না? উড়ে এসে এরকম পরিস্থিতিতে পড়ার ফলে এরকম প্রতিক্রিয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। নিজের কপালে হাত দিল ও। একটু ভেজা, তবে জ্বরের কোনো লক্ষণ নেই। নিজেকে সামলে নেয়ার জন্য গভীরভাবে নিঃশ্বাস নিল ও। বোকামীর কথা চিন্তা করল। যদি সংক্রামক জীবাণুগুলো আক্রমণ করে থাকে তাহলে ওটার প্রভাব এক ঘণ্টার মধ্যেই দেখা দেবে।

মন্দিরে থাকা বুদ্ধ ও তার পার্শ্ববর্তী দেবতাদের অতিক্রম করে এগোল ওরা। দরজার ওখানে দিনের আলো একদম জ্বলজ্বল করছে।

এক মিনিট ধরে উঠোন পরীক্ষা করল সৈনিক। সন্তুষ্ট হয়ে ওদের ইশারা করল। এগিয়ে গেল লিসা ও আং গেলু।

উঠোনে পা দিয়েই ওখানকার অন্ধকারাচ্ছন্ন কোণাগুলোর দিকে তাকাল লিসা। আশা করছিল, কাউকে হয়তো নড়াচড়া করতে দেখবে। কিন্তু সব চুপচাপ, সুনসান। কিন্তু বেশিক্ষণের জন্য নয়…

ও আরেকটু সামনে এগোতেই দ্বিতীয় বিস্ফোরণ ঘটল। ভবন বিস্ফোরিত হলো এবার। তার ধাক্কা পৌঁছে গেল উঠোন পর্যন্ত। বিস্ফোরণের ধাক্কায় হাত-পা ছড়িয়ে ছিটকে পড়ল লিসা। কাঁধের ওপর ভর করে গড়িয়ে পড়ল, ওর দৃষ্টি পেছন দিকে।

 আগুনের লেলিহান শিখাকে সাথে নিয়ে আকাশের দিকে যাত্রা করেছে লাল টাইলগুলো। জানালাগুলোকে দুমড়ে-মুচড়ে দিয়ে বেরিয়ে এল বিস্ফোরণের আগুন। দরজাগুলো টুকরো-টুকরো হয়ে গেল। আরও ধোয়া ও আগুনের জন্ম হলো। এক পশলা গরম বাতাস বয়ে গেল লিসার ওপর দিয়ে।

কয়েক পা সামনে এগিয়ে থাকা সৈনিকটির পেছনে এসে ধাক্কা দিয়েছিল শকওয়েভ। অস্ত্রের সাথে তার আঙুলগুলো জড়িয়ে ছিল আষ্টেপৃষ্ঠে। হামাগুড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে আকাশ থেকে ফিরতি পথ ধরে নেমে আসা টাইলগুলোর কবলে পড়ল সে।

ধাক্কা কাটিয়ে আং গেলু উঠে দাঁড়িয়ে লিসার দিকে এক হাত বাড়িয়ে দিলেন।

 এটাই ছিল তার শেষ কাজ।

আগুনের গর্জন ও টাইল ভাঙ্গার আওয়াজকে ছাপিয়ে আরেকটা আওয়াজ শোনা গেল। একটা গুলির আওয়াজ। সন্ন্যাসীর চেহারার ওপরের অংশ রক্তে ভেসে গেল।

কিন্তু এবার ওই সৈনিকটি গুলি করেনি।

সৈনিকের কাধ থেকে স্ট্রীপের সাহায্যে অস্ত্রটি ঝুলে আছে। টাইলগুলোর কবল থেকে নিজেকে সরিয়ে নিল সৈনিক। গুলির আওয়াজ হয়তো ওর কানে যায়নি, কিন্তু আং গেলুকে লুটিয়ে পড়তে দেখে ওর চোখ বড়বড় হয়ে গেল। খুব দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখাল সে। ডান দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে পার্শ্ববর্তী ভবনের ছায়ায় আশ্রয় নিল। লিসার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করল ও, আতঙ্কিত হওয়ায় ঠিকভাবে উচ্চারণ করতে পারল না।

 মন্দিরের দরজার দিকে হামাগুড়ি দিয়ে পিছিয়ে গেল লিসা। পাথুরে উঠোনে আরেকটা গুলির আওয়াজ হলো। লিসার পায়ের আঙুলের কাছে এসে মুখ থুবড়ে পড়ল বুলেট। নিজেকে রীতিমতো উড়িয়ে নিয়ে গেল লিসা। দরজা পেরিয়ে অন্ধকারে প্রবেশ করল।

কোণায় দাঁড়িয়ে ও খেয়াল করল, সৈনিকটি দেয়াল ঘেঁষে এগোচ্ছে। এখানেই কোথাও স্নাইপার দিয়ে গুলি চালাচ্ছে কেউ। তাই স্নাইপারের দৃষ্টি বাঁচাতে সতর্কতা অবলম্বন করছে সে।

লিসা জানে না কীভাবে শ্বাস নিচ্ছে ও। ওর চোখ দুটো বড় হয়ে গেছে। ছাদের প্রান্ত আর জানালাগুলোয় সন্ধানী দৃষ্টি বুলাল ও। আং গেলু’কে গুলি করল কে?

তারপর একজনকে দেখতে পেল লিসা।

অন্য ভবনের ধোয়ার চাদর থেকে একটা ছায়া বেরিয়ে এলো। লোকটা দৌড় দেয়ায় আগুনের ঝলসানিতে তার হাতে থাকা ধাতব কিছু একটা ঝকমক করে উঠল। অস্ত্র। স্নাইপার তাহলে নিজের অবস্থান পরিবর্তন করে নতুন জায়গায় যাচ্ছে।

পিছু হটল লিসা। প্রার্থনা করল ছায়া যেন ওকে পুরোপুরি লুকিয়ে রাখে। ইশারা করে সৈনিককে ডাকল ও। দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে, আস্তে আস্তে লিসার দিকে এগিয়ে আসছে, মন্দিরের দিকে। তার দৃষ্টি ও অস্ত্র দুটোই ছাদের দিকে তাক করা। স্নাইপারের দৌড় ওর চোখে পড়েনি।

চিৎকার করল লিসা। গেট আউট! সৈনিকটি হয়তো ওর ভাষা বুঝতে পারবে না কিন্তু কী বোঝাতে চাচ্ছে সেটা তো বুঝতে পারবে। সৈনিকের চোখে চোখ পড়ল ওর। নিজের লুকোনো জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকেই ইশারা করল লিসা। স্নাইপার কোন পথ দিয়ে গেছে সেটার একটা রাস্তা ইশারায় বুঝিয়ে দেয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু ওই লোক গেল কোথায়? এতক্ষণে কী নিজের পজিশন নিয়ে নিয়েছে?

‘দৌড়াও!’ চিৎকার করল লিসা।

 লিসার দিকে এক পা এগোল সৈনিক। তার কাঁধের পেছনে ঝলসে উঠল কী যেন। ভুল প্রমাণিত হলো লিসার ধারণা। পাশের ভবনের একটা জানালার পেছনে আগুন নৃত্য শুরু করে দিয়েছে। আরেকটা বোম।

হায় ঈশ্বর…

সৈনিকটি এগোনোর মাঝপথে বিস্ফোরিত হলো ওটা। তার পেছনে থাকা দরজা হাজার টুকরো হয়ে ছিটকে গেল, সৈনিকটিকেও ছাড়ল না। তাকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে ফেলল উঠোনের ওপর। মুখের ওপর ভর করে আছড়ে গড়াতে শুরু করল সে।

গড়ানো থেমে গেলেও সৈনিকটি আর নড়ল না। ওর পোশাকে আগুন ধরে যাওয়ার পর নিথর হয়ে পড়ে রইল সে।

মূল মন্দিরের আরও ভেতরে চলে গেল লিসা, দরজা খুঁজছে। পেছনের পথের দিকে গিয়ে সরু হলে পা রাখল ও। ওর কোনো পরিকল্পনা নেই। সত্যি বলতে, কী করছে কী ভাবছে সেটার উপরে ওর নিজেরই কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।

তবে ও একটা ব্যাপারে নিশ্চিত। আং গেলু আর ওদের সৈনিককে যে খুন করেছে সে কোনো পাগল সন্ন্যাসী নয়। প্রতিটা বিস্ফোরণ খুব হিসেব করে ঘটানো হয়েছে, পুরো ব্যাপারটা দক্ষ হাতের কাজ।

লিসা এখন একা।

সরু হলওয়ে দেখল ও। রেলু নাআ’র রক্তাক্ত লাশ চোখে পড়ল ওর। ওটা ছাড়া হলওয়ের বাকিটুকু একদম পরিষ্কার। মৃত সন্ন্যাসীর কাস্তেটা যদি ও নিতে পারতো,.. তাহলে অন্তত একটা অস্ত্র হতো হাতে…

হলের দিকে পা বাড়াল লিসা।

এক পা ফেলে দ্বিতীয় পা ফেলতে যাবে এমন সময় পেছন থেকে বাধাগ্রস্ত হলো ও। একটা নগ্ন বাহু ওর গলা প্যাচিয়ে ধরল। কর্কশ কণ্ঠে ওর কানের কাছে ঘেউ করে উঠল সে। ‘নড়বে না।’

অবশ্যই নড়বে! লিসা আক্রমণকারীর পেটে কনুই চালিয়ে দিল।

উফ শব্দ করে মালিক তার বাহু সরিয়ে নিল। কারুকার্য খচিত পর্দার ওপর গিয়ে পড়ল সে। ওজন সইতে না পেরে পর্দা খসে পড়ল। পাছার ওপর ভর করে আছড়ে পড়ল সে।

ঘুরে দাঁড়িয়েছে লিসা, দৌড় দেয়ার জন্য একদম তৈরি।

লোকটার পরনে জাঙ্গিয়া ছাড়া কিছুই নেই। তার চামড়ার রং তামাটে তবে এখানে সেখানে পুরোনো কাটা-ছেঁড়ার দাগ আছে। কালো লম্বা চুলগুলো এলোমেলো, চেহারার প্রায় অর্ধেক ঢেকে দিয়েছে। আকার আকৃতিতে লোকটা বেশ পেশিবহুল, চওড়া কাঁধের অধিকারী। তাকে দেখতে তিব্বতিয়ান সন্ন্যাসী নয়, আমেরিকান মনে হচ্ছে।

কিংবা পরনে থাকা জাঙ্গিয়ার জন্যও এরকম মনে হতে পারে।

গুঙিয়ে লিসার দিকে তাকাল সে। তার নীল চোখ দুটোতে বাতির আলো প্রতিফলিত হলো।

‘কে তুমি?’ প্রশ্ন করল লিসা।

 ‘পেইন্টার,’ গোঙানির সাথে জবাব দিল সে। ‘পেইন্টার ক্রো।’

1 Comment
Collapse Comments

thanks for the book. kindly upload other books from the same series. please upload the most recent book of the series
“Kingdom of Bones”.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *