০১. রুচি যা আশঙ্কা করছিল

বারো ঘর এক উঠোন – জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী
প্ৰথম প্ৰকাশ : ৭ চৈত্র, ১৩৬২

উৎসর্গ

অভিসপ্ত বারো ঘরের বাসিন্দাদের

রুচি যা আশঙ্কা করছিল।

‘সেলাই-কল বিক্রি করা ছাড়া আমি আর উপায় দেখছি না।’ বাইরে থেকে ঘুরে এসে গায়ের জামা খুলতে খুলতে শিবনাথ বলল, ‘সেলাইর মেশিন বড়, না অপমান বড়।’

‘কেউ দিলে না, আর পঞ্চাশটা টাকা দিতে পারে এমন একজন বন্ধু নেই তোমার কলকাতা শহরে!’ রুচি অবাক।

‘ছিল, যবে দি গ্রেট হিমালয়ান ব্যাঙ্কের ম্যানেজার ছিলাম, রুচি! তা অতবড় আটতলা বাড়ির ব্যাঙ্কটাই যখন ডুবল, লোকের চোখে হারিয়ে গেল, আমি মাত্র দু’পদ দু’হাতে ও একটি ক্ষুদ্র মস্তকবিশিষ্ট মানুষ হয়ে কি করে আর বন্ধুদের কাছে আদরের ‘শিবু’ বলে অনন্তকাল পরিচিত থাকব আশা কর। ক’দিন আর ধামাচাপা দিয়ে রাখা যায়। মুখে বিড়ি দেখেই অতনু সেদিন ধরে ফেলল আমি ডুবেছি, তা ছাড়া ডুববার সময় কেউ কেউ টাকার থলে বেঁধে ডোবে বলে যে একটা কানা-ঘুষা রকমের কথা আছে, আমি তার ধারে কাছে দিয়েও নেই! অতনু স্রেফ ‘না’ করে বসল, তার টানাটানি যাচ্ছে, এখন কাউকে ধার কর্জ দিতে পারছে না।

রুচি চুপ ক’রে রইল।

তার নিজের হাতে তৈরি সুন্দর লেস পরানো ঢাকনা দেওয়া সেলাই-কলটা দেখল একবার।

‘বীরেন শালাকে কত চা সিগারেট খাইয়েছি, সে ব্যাটাও আজ কিছু দিলে না।’ পাঞ্জাবি ছেড়ে খাটের ওপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল শিবনাথ। ‘সবটা টাকা তুমিই যোগাড় করলে, এই সামান্য ক’টা টাকা আশা করেছিলাম, চেষ্টা-চরিত্র করলে আমি যোগাড় করতে পারব। কই,–হ’ল না, এখন দেখছি, আসলে মানুষ হিসেবে, অন্তরের দিক থেকে বিচার করলে মেয়েরা কিছুটা খাঁটি আছে, এ ওকে বিশ্বাস করার মাধুর্যটুকু হারায়নি। তোমার স্কুলের বন্ধুরা তোমায় ধার দিলে, আমাকে সবাই বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছে। এক বছর হয়নি চাকরি গেছে, কিন্তু তাই বলে পঞ্চাশটা টাকা কেউ দিতে চাইছে না আমি ভাবতেও পারছি না। ওরা কি জানে না আমার স্ত্রীর এখনো কাজ আছে, না হলে ভাত খাচ্ছি কি করে, কি করে আজও বেঁচে আছি।’ আলস্যে হাই তুলতে তুলতে কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে শিবনাথ কথাগুলো বলছিল। মঞ্জু এসে বাবার বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। শিবনাথের পাঁচ বছরের দুহিতা।

‘বাবা, আমরা নাকি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি?’

‘হ্যাঁ, কে বললে তোকে একথা?’ মেয়ের গালে আঙুলের টোকা দিয়ে শিবনাথ হাসে।

‘পাশের ফ্ল্যাটের রেবার কাছে।’ মঞ্জু হাসে।

রুচি বলল, ‘জানাজানির বাকি আছে নাকি কিছু, মোহিতবাবু আমাদের তাড়িয়ে দিচ্ছেন। দু’ মাসের বাড়িভাড়া বাকি রাখার পর তৃতীয় মাসে রেন্টকন্ট্রোল অফিসের হাঙ্গামা আছে বলে তিনি ভাড়াটে রাখেন না কখনো, সবাই জানে একথা।’

শিবনাথ বলল, ‘আহা, আমরা যে দু’ মাস ভাড়া দিতে পারিনি, কথাটা জানাজানি হল কি করে?’

‘মোহিতবাবুই বলবেন, বলেছেন হয়তো। এটা আবার একটা খুব না-জানাজানির কথা কি সবাই দেখেছে জেনেছে, শঙ্কর দত্ত লেনের বাড়ি ছেড়ে এসে এখানে উঠেও আমাদের চলছিল না। একশ’ টাকার চাকরি দিয়ে পঁয়তাল্লিশ টাকার একটা হাফ-ফ্ল্যাটের ভাড়া টানা যায় না। দেয়ালে সিঁড়িগুলোর কাছে মানুষকে একথা শিখতে হয় না।’

রুচি একটু অসন্তুষ্ট হয়েছে দেখে শিবনাথ দুহিতাকে বুকের ওপরে থেকে আস্তে আস্তে সরিয়ে দিয়ে বলল, ‘ভেবেছিলাম এর মধ্যে আবার একটা জুটে যাবে।’

বাবার চাকরি নেই মঞ্জু এটা ভাল করে জেনেছে। এখানেও বাড়িভাড়া আটকা পড়েছে। বাবা ও মার মধ্যে এখন কিছুক্ষণ এই নিয়ে কথা-কাটাকাটি চলবে, আবার একটু গোলমেলে হাওয়া বইতে পারে টের পেয়ে বুদ্ধিমতী মঞ্জু আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। যা ও এখন হামেশা করছে।

রুচি চুপ করে ছিল।

শিবনাথ আস্তে আস্তে বলল, ‘এ-বাড়িতে কে যেন সেলাই-এর মেশিন কিনতে চেয়েছিল, তোমাদের মেয়েদের মধ্যে কে যেন একটা সেকেন্ড-হ্যান্ড মেশিন খুঁজছেন শুনছিলাম?’

‘মলিনার মা। ও, তুমি মলিনার মার কাছে আমাদের মেসিন বিক্রি করতে বলছ নাকি! ‘ রুচি চমকে উঠল। রুচির তাকানো দেখে শিবনাথ পাংশু হয়ে গেল।

‘না, এতকাল এক বাড়িতে থেকে এত ঘনিষ্ঠতার পর ওদের কাছে এসব বিক্রি করা চলে না।’কড়িকাঠের দিকে চোখ রেখে শিবনাথ বিষণ্ণ গলায় বলল, ‘তা ছাড়া একটা মূল্যবান জিনিস আমাদের মত লোকের পক্ষে, ধর, বলা যায় না, হুট্ করে তোমারও একদিন চাকরি গেল, ঘরে একটা সেলাই-কল থাকলে শায়া ব্লাউজ সেমিজ ফ্রক সেলাই করেও পেট চালাবার একটা উপায় থাকে। কিন্তু কি-ই বা আর রাখতে পারছি। সত্যি সর্বস্বান্ত হলাম।’ একটু থেমে শিবনাথ বলল, ‘অবশ্য সময়টা এখন একটু খারাপ যাচ্ছে, কিন্তু আবাক হবে, আবার ফিরে পাব আমার বিশ্বাস আছে, রুচি।’

‘বিশ্বাস থাকা ভাল,’ রুচি বলল, ‘এখন খাওয়ার পাট শেষ করে বিছানাটা, টুকিটাকি জিনিসগুলি বাঁধাছাদা করার ব্যবস্থা কর। দু’ মাসের ভাড়া দিতে না পেরে সেলাই-এর মেশিনটা আপনার কাছে রেখে যাচ্ছি মোহিত বাবুকে এভাবে বলে বুঝিয়ে ওটা একেবারে বিক্রি করে না দিয়ে এখনকার মত দেনা শোধ করে চল এবাড়ি ছেড়ে পালাই, না হলে আরো অনেক অপমান সইতে হবে।

রুচি স্টোভে জল গরম করছিল। জল এইবার ফুটছে। কথা শেষ করে স্বামীর দিকে সম্পূর্ণ পিছন ফিরে ও যখন স্টোভ নিভিয়ে জলটা নামাতে ব্যস্ত, হাঁ করে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে শিবনাথ ভাবে। অপমান। এবাড়ির আর কারা কিভাবে অপমান করতে পারে তাই সে চিন্তা করে। মোহিতবাবু, বাড়ির যিনি খোদ মালিক তিনি এখানে থাকেন না, ভবানীপুরে তাঁর প্রাসাদ। কিন্তু শিবনাথ সে-সব প্রশ্নের একটাও স্ত্রীকে করতে সাহস পেলে না। মোহিতবাবু দারোয়ান, দুধওয়ালা, ধোপা, মুদি, ঝি, কাগজওয়ালা, রিক্সাওয়ালা, ছোলাভাজা চানা-ভাজাওয়ালা একটা না একটা, একজন না একজন পাওনাদার তাগিদ দিতে এসে দরজার সামনের সিঁড়িতে দু’বেলা দাঁড়াচ্ছে, চেঁচামেচি করছে, আর উল্টোদিকের ফ্ল্যাটের দরজা থেকে তা দেখা যাচ্ছে, সিঁড়ি দিয়ে লোকে উঠতে দেখছে, নামবার সময় দেখে। কেউ কিছু না বললেও এই দেখা এবং তা থেকে কিছু একটা অনুমান করার মধ্যেও যথেষ্ট অপমান মেশানো আছে–জিজ্ঞেস করলে রুচি হয়তো উত্তর দেবে। তাই কিছু না বলে শিবনাথ চুপ করে রইল। আর এই নিয়ে যত বেশি কথা হচ্ছে তত ঝগড়া বাড়ছে, রুচি শিবনাথ দু’জনেই জানে।

তারপর দুপুরে এক সময় শিবনাথ সেলাই-কলটা চিরকালের মত ঘরের বাইরে পাঠাবার ব্যবস্থা করতে বেরিয়ে গেল। একটা একটা করে এভাবে সব গেছে, যাচ্ছে। তাদের বিয়ের খাট, বড় ড্রেসিং টেবিল, রেডিও, শঙ্কর দত্ত লেনের বাড়ি থেকে এখানে আর টেনে আনা হয়নি। আর তখন এখানকার মত তাঁদের ক্যাস টাকার দরকার পড়েছিল। জলের দরে বিক্রি করে দিতে হয়েছে সব

জিনিসপত্র বাঁধা দিতে বিক্রি করতে অবশ্য শিবনাথের জুড়ি নেই কেউ। এক একটা যাচ্ছে আর রুচির বুকের একখানা করে পাঁজর ভাঙছে।

তাই যা-হোক একটা দাম ধরে মেশিনটা যদি কারো কাছে শিবনাথ বিক্রি করে দিয়ে এসে বলে, ‘মোহিতবাবুর কাছে রেখে এলাম। সুযোগমত ওর টাকা ওকে দিয়ে আমাদের জিনিস ফিরিয়ে আনব বলে এসেছি,’ রুচি জানে ওটা কোনোদিন আর ঘরে ফিরে আসবে না। আজ পর্যন্ত কিছু এল না।

পরশু দু’খানা বড় কাঁসার থালা বিক্রি করা হয়েছে, আর বড় জামবাটিটা।

বিক্রি করে সেই টাকায় কয়লাওয়ালা ও মুদির দেনা শোধ করা হয়েছে।

শিবনাথ বলছিল, ‘তা ছাড়া এত মালপত্র নিয়ে অত দূরের রাস্তা যেতে কী পরিমাণ টাকা খরচ হবে সেটাও আমাদের দেখতে হবে। এমনি তো এগুলো সারা বছর বাক্সে তোলা থাকে। বড় থালায় ছড়িয়ে সরু চালের ভাত আর রুই মাছের কালিয়া খাবার সুদিন আগামী পঞ্চাশ বছরেও আমাদের শ্রেণীর লোকের আসছে না এ সম্পর্কে তুমি নিশ্চিন্ত থেকো, কি বড় জামবাটিতে করে দই ক্ষীর খাওয়া।’

কথা শেষ করে শিবনাথ স্ত্রীকে দেখছিল।

জিনিসগুলো বিক্রি করে দেওয়া তেমন যে একটা ক্ষতির বা দোষের কাজ হয়নি অন্তত এইটুকুন রুচিকে জানাতে পেরে খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়ে শিবনাথ শেষে তার একটা চাকরির ইন্টারভিউর কথা তুলেছিল। নিশ্চয়ই হবে ওটা। এত লোক নেবে ফি বছর, একটা হিসেব করা আছে ওদের। অ্যান্ড ইট ইজ এ বিগ্ কনসার্ন–বোগাস ফার্ম হলে বিশ্বাস করতাম না।’

মুশকিল এই যে, চাকরি খুঁজতে গিয়ে শিবনাথ সব সময় বোঝে না কোন্ কাজটা তার হবে, হওয়ার সম্ভাবনা আছে, কোটা অনন্তকাল চেষ্টা করলেও হবে না।

মুশকিল, একটা ভাল ব্যাঙ্কের ব্রাঞ্চ অফিসের ম্যানেজারি করার পর যা-তা চাকরির জন্যে যেখানে খুশি ‘মাথা বিক্রি’ করতে ও ‘কান বাঁধা দিতে’ শিবনাথ নারাজ।

‘যখনকার অবস্থা যেমন তখন তেমন’–অন্তত খাওয়া-পরা কি থাকার বেলায় এই সত্য মেনে নিয়ে দিনকতক কষ্ট করতে রাজী, তাই বলে নিজের এফিশিয়েন্সি বা ইনটেলেক্‌টকে পথের ধুলোয় মিশিয়ে দেব না। জিনিস যাচ্ছে আবার হবে। তা ছাড়া ধর, ওখানে যদি আমার হয়েই যায়। তাই বলে পৃথিবী অন্ধকার দেখে সাড়ে পাঁচশ’র চেয়ার থেকে একেবারে একশ’ পঁচিশের চেয়ার টেনে নিয়ে হুট্ করে বসে পড়া সুইসাইডের সামিল হবে। দি গ্রেট হিমালয়ান ব্যাঙ্ক ফিরে না আসুক, ভাল কনসার্নে অন্তত একটু ভদ্র-রকমের মাইনেয় না গেলে দিনের নাগাল আবার কি করে পাব একবারটি চিন্তা করে দেখ। বয়েস বাড়ছে কি কমছে? ঝুঁকি নিতাম না যদি তোমার চাকরি না থাকত।’

এক কথায় নিজের চেষ্টাগুলো যখন একটার পর একটা ব্যর্থ হচ্ছে, তখন রুচির চাকরির ওপর ভরসা করে শিবনাথ একটির পর একটি জিনিস বাইরে পাঠিয়েছে।

আজ সেলাই কল দিয়ে এসে শিবনাথ অবশ্য বেশি কথা বলল না। কেননা রুচি অসম্ভব গম্ভীর হয়ে ছিল।

শিবনাথ বাজার থেকে ছিবড়ের দড়ি কিনে এনেছে।

দু’জনে হাত লাগিয়ে সব বাঁধাছাঁদা করবে এমনসময় রাজ্যের মহিলা এসে হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকল। সবাই এ-বাড়ির।

তারা বিভিন্ন ফ্ল্যাটের বাসিন্দা।

ওপরের ওঁরা এসেছে, নিচের ওঁরাও।

রুচি সমাদর করে সকলকে বসতে বলল।

মলিনার মা, সেবার মা, কুসুমের দিদি, চান্টুর বৌদি, শোভা, বকুল, বকুলের দিদি, মা ও মাসিমা।

সবাই একবার করে রুচিকে দেখল। আর দেখল ঘরময় ছড়ানো তোশক বালিশ মাদুর, ঘটি বাটি বালতি উনুন, শিল-নোড়া, জলের কুঁজো। ওপাশে এক জায়গায় গাদা করা কিছু পুরোনো বই, খবর-কাগজ। দু’টো ব্রাকেট, ভাল ও ছেঁড়া দু’তিন জোড়া জুতো। রান্নাঘর থেকে এইমাত্র টেনে আনা হয়েছে একটা প্রকাণ্ড ঝুড়ি। তার মধ্যে কয়লা, ঘুঁটে, অনেকগুলো পুরোনো শিশিবোতল, ছোট একটা আরশি, জুতোর ব্রাস, ফিনাইলের বোতল, ছেঁড়া গামছা ও একটা ছেঁড়া লুঙ্গি (রুচি ঘুঁটে ও কাঠ না থাকলে এ দুটো সময় সময় ছিঁড়ে কয়লা ধরাবার জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে), আর ঘুঁটে ও কয়লা ঝুড়ির পাশে আড়াআড়ি করে শুইয়ে রাখা একটা ঝাঁটা, একটা ঝাড়ন, হাতা, খুন্তি, সাঁড়াশি, রেশনের থলে। আর একধারে চা-এর বাসন, শূন্যগর্ভ দু’টো কাঁচের বোয়ম। যেন একটা বোয়মে চিনি রাখা হত আর একটায় ঘাসের ঘি বা তৈল। এখনও খানিকটা তলায় লেগে আছে। কতকগুলো পিঁপড়ে মরে মিশে আছে সেই তৈল জাতীয় তরল পদার্থটুকুর মধ্যে

‘কোথায় যাচ্ছেন দিদি?’ ছড়ানো জিনিসগুলো থেকে এক সময় চোখ তুলে কুসুমের দিদি প্রশ্ন করল, ‘শুনলাম ঘর ছেড়ে দিয়েছেন, আজই চললেন নাকি?

রুচি চুপ করে দিল।

‘আহা, ক’টা মাস একসঙ্গে এক বাড়িতে ছিলুম। হুট্ করে একটা ঘরের লোক চলে গেলে সত্যি মনে বড় কষ্ট হয়। আবার কবে দেখা হবে। আর কোনোদিন হয়তো দেখাই হবে না।’ কুসুমের দিদি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ‘সত্যি, এই শহরের এক একটা বাড়ির ভাড়াটেদের কথা ভাবলে আমার ট্রেনের যাত্রীর কথা কেবল মনে হয়। একসঙ্গে ক’দিন বাস করলুম, হাসলুম, গল্প করলুম, তারপর একদিন একটা পরিবার উঠে গেল। এ-জন্মে হয়তো আর ওদের সঙ্গে দেখা হ’ল না। কোথায় যাচ্ছেন, মঞ্জুর মা?’’বেলেঘাটা,’ রুচি সেবার মার মুখের দিকে তাকাল না।

‘বেলেঘাটা?’ বকুলের দিদি এক পা সরে এল। ‘আমার বোনঝিরা বেলেঘাটায় আছে। এই তো সেদিন শুঁড়া ফার্স্ট লেনের ওধারে জায়গা কিনে নতুন বাড়ি করল তৃপ্তির বাবা। ওধারটায় কি?’

রুচি গম্ভীর গলায় বলল, ‘ঠিক বলতে পারছি না। উনি জানেন। আমি এখনও ঘর দেখিনি। রাস্তার নামটাও জানি না।’

‘না না, কোনদিন যখন যাননি, কি করে আর জানাবেন।’ বকুলের মাসিমা বলল, ‘তবে বেলেঘাটার সবাই ভাল নয়, কোনো কোনো দিকটা তো শুনছি ভয়ানক নোংরা, কাঁচা ড্রেন, ময়লা, মাছি, আর জলের কষ্ট।

রুচি চুপ করে রইল।

‘আর মশা!’ বকুলের দিদি বলল, ‘তৃপ্তি ওরা তো সন্ধ্যা থেকে মশারির তলায় ঢোকে, আর দিনভর ঘরে পাখা ঘুরছে, তবু নাকি তিষ্ঠোতে পারে না

‘মশা থাকবেই, শহর তো নয় শহরতলী। শহরের যত জঞ্জাল আর আবর্জনা ঠেলে ঠেলে ওদিকেই পাঠানো হচ্ছে, কাজেই–’

সেবার মা বলল, ‘এদিকে কোথাও ঘর-টর বুঝি পেলেন না দিদি?’

রুচি স্থির চোখে সেবার মাকে একবার দেখে পরে আস্তে আস্তে বলল, ইচ্ছা করেই আমরা ওদিকে যাচ্ছি আমার ইস্কুল কাছে হয়, এখান থেকে দূর পড়ে। কষ্ট হচ্ছিল খুব।’

কেউ আর কথা বলল না হঠাৎ।

একটু পরে একটি মেয়ে বলল, ‘তা অবশ্য ওদিকে ভাড়াও কম। শহরে ঘরের যা গলাকাটা ভাড়া হচ্ছে, দিন দিনই বাড়ি-ভাড়া চড়ছে শুনছি তো। একে জিনিসপত্রের এত দাম, তার ওপর যদি ঘর-ভাড়াও এমন—’

‘হ্যাঁ,’–বকুলের বিধবা মাসিমা কৌটো থেকে দোক্তার মাজন তুলি নিয়ে দাঁতে ঘষতে ঘষতে বলল, ‘মোটে ঘর পাওয়া যাচ্ছে না, তার ওপর পাকিস্তানীদের ভিড়, ভাড়া বাড়বে না তো কি! একখানা ঘর পাওয়া কি মুখের কথা?’

‘ভাগ্যিস আমরা রায়টের পরই এ বাড়িতে চলে এসেছিলুম।’ বকুলের মা বলল, ‘এখন এই বাড়ির একটা ফ্ল্যাটের মত একটা ফ্ল্যাট,–পাওয়া তো যাচ্ছেই না, পাওয়া গেলেও ভাড়ার অঙ্ক শুনলে নাকি মূৰ্চ্ছা যেতে হয়, বলছিলেন সেদিন আমাদের কর্তা। তবু তো একদিক থেকে আমাদের মোহিতবাবু ভাল লোকই বলব। কী সুন্দর ঘর, জল কলের কত সুবিধে, সিঁড়ি বারান্দাগুলো কত চওড়া এ বাড়ির। ইচ্ছা করলে কি আর তিনি ভাড়া ডবল করতে পারেন না? করেন নি।’

রুচি চোখ তুলে শেষবারের মত মোহিতবাবুর ঘরখানা দেখছিল, প্রশস্ত বারান্দা, ওধারের চওড়া সিঁড়ি।

‘যে বাড়িতে যাচ্ছেন সে বাড়িতে ইলেকট্রিক আছে তো?’ বকুল প্রশ্ন করতে রুচি চমকে ওর মুখের দিকে তাকাল। এবং রুচির অপ্রসন্ন ভ্রূযুগল দেখে তৎক্ষণাৎ বুদ্ধিমতী মলিনার মা বলল, ‘আহা, বলছেন নিজে তিনি এখন পর্যন্ত ঘর দেখেন নি, মঞ্জুর বাবা ঠিক করে এসেছে। তা ইলেকট্রিক থাকবে না তো কি। ভদ্রলোক কেউ আবার ইলেকট্রিক নেই এমন বাড়িতে থাকতে পারে নাকি।’

‘আছে গো দিদি, আছে,’ বকুলের দিদি প্রতিবাদের সুরে বলল, ‘ইলেকট্রিক কেন; কল নেই এমন বাড়িও সেখানে আছে। রাস্তার পাইপ থেকে খাওয়ার, রান্নার জল তুলে আনছে বহু লোক, তৃপ্তি সেদিন বলে গেল।’

মলিনার মা হাঁ করে বকুলের দিদির কথা শুনছিল। সেবার মা, বলল, ‘সেগুলো তো শুনছি বস্তি। তা বস্তি তো এমন হবেই; এই মুক্তারামবাবু স্ট্রীটের ফ্ল্যাটের সুখ সেখানে আপনি পাবেন কি করে, তবে বস্তি যেমন আছে, ভদ্রলোকের বাড়িও আছে, সবাই কি আর আপনাদের তৃপ্তির বাবার মত টাকা খরচ করে বাড়ি তুলে আছে, জলের কল ইলেকট্রিক আলোর বহু বাড়ি আছে, আর ভদ্রলোকেরা সে-সব বাড়ি ভাড়া করে আছেন।’

যেন মুখে কাপড় চাপা দিয়ে বকুল খুক করে একটু হাসল।

রুচি তার চোখের দিকে তাকাতে বকুল তাড়াতাড়ি দেওয়ালের দিকে মুখে ফিরিয়ে শান্ত গম্ভীর হয়ে গেল।

আড়চোখে একবার রুচি ও নিজের মেয়েকে দেখে বকুলের মা আস্তে আস্তে বলল, ‘বস্তিই সেখানে বেশি, সেবার মা, আপনি বেলেঘাটা কোনদিন যা নি তো। মেথর মুচি বাস করে সেও বস্তি, আবার লেখাপড়া-জানা ভাল ভাল ঘরের লোকেরা পরিবার নিয়ে আছে, জল নেই, আলো নেই, টিনের বেড়া, ফুটো ছাদ, দিনরাত মশা-মাছি ভন ভন করছে–বস্তির অভাব নেই। বকুলের মত সেবার মত বড় বড় মেয়ে রাস্তার কলে জল আনতে লাইন দিয়ে দাঁড়ায় এমন কেলেঙ্কারি।’

মধ্যস্থ হয়ে গম্ভীর গলায় এবার মলিনার মা বলল, ‘তা হবে, হয়তো তাদের বাপ ভাইয়ের চাকরি নেই, কি আয় কমে গেছে। কম ভাড়ার বাড়িতে না থেকে করবে কি।’

‘আসল কথা সেখানেই, টাকার জোর না থাকলে কেবল কি থাকা? খাওয়ার কষ্ট করছে না মানুষ? এই শহরের মধ্যেই ভাল বাড়িতে থেকেও, খোঁজ নিয়ে দেখুন গে, অনেকের হয়তো কোনদিন হাঁড়ি চড়ে না, এমন অবস্থা যায়। ঈশ্বর না করুন, কাল আমাদের এমন অবস্থা হতে পারে, আপনার হতে পারে। জমিদারী নেই যখন, আজ তৃপ্তির বাবার চাকরি চলে গেল কাল আমাকেও হয়তো, বেলেঘাটা তো কাছে, বেলঘরিয়ায় বা বালিখালে গিয়ে টিনের ঘরে আশ্রয় নিতে হবে না, তাই বা কে জানে।’

‘থাক, আর বিনয় করতে হবে না দিদি।’ ঠোঁট ঈষৎ বাঁকা করে বকুলের দিদি বলল, ‘তৃপ্তির বাবা সেদিন স্যাকরা ডেকে মেয়ে-মা দুজনের জন্যে চারগাছা করে নতুন চুড়ি গড়তে দিয়েছে। সে-সব কথা আমাদের কানে আসে, চাকরি গেলে চারুবাবুর পরিবার উপোস করে থাকবে এসব কথা বাইরের রাস্তার লোককে বলো। শুনছি তো অলকা প্রেসের সবটা টাকাই ব্যাঙ্কে জমছে।’

অলকা, মানে তৃপ্তির মা, একটু লজ্জার ভান করে বলল, ‘না ভাই না, যত শোনা যায় তা নয়, কাজকারবার খারাপ যাচ্ছে, প্রেসের অবস্থা আগের মতন নেই।’

‘তা হাতি মরলেও লাখ টাকা’ বকুল বলল।

অলকা বলল, ‘তা তুমি আবার বড় কথা বলছ কি, তোমার বাবার ছোট্ট কাঠের কারবারটুকু তো শুনছি এখন ফুলে-ফলে ভরে উঠেছে, শুনছি তো হিমাংশু রায় টালিগঞ্জে জায়গা দেখছেন। আর ভাড়া বাড়ি নয়। তা এক সঙ্গে এক বাড়িতে ছিলাম মনে রেখে গৃহ-প্রবেশের দিন নেমন্তন্নটা করতে যেন ভুলো না।’

বকুল বলল, ‘আচ্ছা, যবে হবে তবে হবে, আমাদের রুচি বৌদি চলে যাচ্ছেন খুব কষ্ট হচ্ছে, বৌদি এদিকে বেড়াতে টেড়াতে এলে এবাড়ি হয়ে যেও, না হলে কিন্তু তোমাকে আমরা সবাই মিলে রোজ ভীষণ গালমন্দ করব।’

‘নিশ্চই আসব, কেন আসব না,’ মলিন হেসে রুচি বলল, ‘তোমাদের ছেড়ে যেতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে ভাই। ‘

‘মঞ্জুর বাবা এখন কি করছেন?’ বোঝা গেল বেশ একটু ভেবে চিন্তে বকুলের মা প্রশ্নটা করছে।

‘অর্ডার সাপ্লায়ার বিজনেস,’ বলল রুচি।

‘তা-ও একটা ব্যবসা বটে। হ্যাঁ, ব্যবসা ছাড়া এদিনে বাঁচা দায়, চাকরি একটা আমাদের ঠেকার জন্য রাখা, না হলে ব্যবসা-বাণিজ্য ছাড়া–’

‘এখন যাবার দিন এত সব টাকা-পয়সা ব্যবসা-বাণিজ্যের কথা না তোলাই ভাল, হয়তো এদের বেলাবেলি বেরিয়ে পড়তে হবে, অনেক দূরের পথ। চলো দিদি, আমরা যাই।’ সেবার মা সকলকে মনে করিয়ে দিলে।

‘হ্যাঁ, যেখানেই যাও ভাই, সুখে থেকো, এই ইচ্ছা, তুমি মাস্টারী করছ, মঞ্জুর বাবা অর্ডার সাপ্লায়ারের কাজ করছেন, মোটে একটা মেয়ে, তোমাদের ভয় কি? বেলেঘাটায় ভাল ভাল লোকও আছেন, এক-আধদিন বেড়াতে এসো।’

রুচি ঘাড় নাড়ল।

‘রিক্সায় যাবেন বুঝি?’ শোভা প্রশ্ন করল, ‘মালপত্ৰ?’

‘ঠেলা, তা ছাড়া উপায় কি।’ অভিজ্ঞা বকুলের মাসী জানিয়ে দেয়, ‘একটা লরী ভাড়া করতে পারলেই সুবিধা হবে। মালপত্র সঙ্গে নিয়ে তোমরা একবারে ওখানে পৌঁছে যেতে পারবে। রিক্সায় বাসে যাওয়া অসুবিধা,– ঠেলার সঙ্গে যাচ্ছে কে?’

তাদের চলে যাওয়া নিয়ে যে এরা এতখানি ভাবছে রুচির বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হ’ল না, সে নিজে বা শিবনাথ একেবারেই এখন পর্যন্ত ভেবে দেখেনি কেন, ভেবে রুচি অবাক হয়। ‘একটা ব্যবস্থা করতে হবে,’ গম্ভীর হয়ে রুচি বলল, ‘জিনিস তো আর ফেলে যাব না। ‘তা যাই কর দিদি, যে রকম বাড়িতেই থাক, মেয়েটার ওপর সব সময় চোখ রাখবে। এখানে ছিল তকতকে ঝকঝকে সিঁড়ি, বারান্দা, ছাদ, সুন্দর বাঁধানো উঠোন, রাতদিন আমাদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খেলাধূলা করেছে, ভয়ের কিছু ছিল না, না হোক সেখানকার সব ছেলেমেয়ে খারাপ। চোরডাকাতের ভয়টা নাকি বেশি শুনছি। ওর কানের রিং দুটো গিয়েই খুলে রেখো ভাই।’

বেশ একটু দুশ্চিন্তাগ্রস্ত চেহারা করে বকুলের মাসী বলল, ‘হ্যাঁ ভাই, আমিও সেকথা ভাবছিলাম, এখানে, এই শহরের ভিতরে এসব ছ্যাঁচড়া চোর থাকে না। তা ছাড়া এমন সুন্দর ভদ্রপাড়া আমাদের,–‘

তোমরা ভাবছ চোর-ডাকাত আমি ভাবছি ময়লা মাছি, শুনছি তো বেলেঘাটায় কলেরা- বসন্ত লেগেই আছে।’ বকুলের মা বলল, ‘শুধু মেয়েটাকে নয়, তোমরা দুজনেই গিয়ে টিকা নিয়ে ফেলো। আর জলটা ফুটিয়ে খেয়ো ভাই, পুকুর-পাতকুয়োর জল ব্যবহার করবে না।‘

‘আচ্ছা চলি বিদায়,’ রুচির সমবয়সী বকুল, তৃপ্তি, শোভা, সেবা হেসে হাত তুলে।

বলল, ‘আমরা সবাই একদিন দলবেঁধে আপনার বেলেঘাটার বাড়িতে গিয়ে হানা দেব। নতুন জায়গার সংসার দেখব।’

‘নিশ্চই যাবে, আমি গিয়ে চিঠি দেব।’

অপসৃয়মানা প্রতিবেশিনীদের দিকে তাকিয়ে রুচি আস্তে আস্তে বলল; তারপর এক সময় চুপ করে গেল।

সবাই বেরিয়ে যেতে শিবনাথ ঘরে ফিরে এল।

‘এরা হ’ল সব স্নব। আমরা যে এদের সংস্পর্শে ছেড়ে যাচ্ছি, একদিন থেকে ভাল।’

রুচি শব্দ করল না।

শিবনাথ বলল, ‘কম লেখাপড়া করে যুদ্ধের সময় বড় চাকরি বাগিয়ে ফেলেছিল, তাই আজ অত ফুটোনি। আর, ওসব প্রেস, কাঠের দোকান কিস্তু না, সবটাই ব্ল্যাক-মার্কেটিং। ব্ল্যাক-মার্কেট না করলে রোজ এত মাংস খাওয়া আর নিত্যনতুন শাড়ি গয়না পরা বেরিয়ে যেত। সুখের পায়রা সব। চাকা ঘুরবে দেখবে। শিগগির এদের সুখের নীড় ভাঙছে, থাকছে না কিছু।’

‘কে থাকবে?’ রুচি প্রশ্ন না ক’রে পারল না।

‘থাকব তুমি আমি, থাকবে ভালোবাসা। থাকবে যারা খুব বড়লোক, কয়েক কোটি টাকার মালিক, আর থাকবে যারা একেবারে নিঃস্ব, কিছুই নেই যাদের, তাদের বাঁচার ব্যবস্থা হচ্ছে, মাঝামাঝিদের ঠাঁই নেই, এরা সেই দলের।’

যখন চাকরি করত শিবনাথ এত ভাল বক্তৃতা করতে পারত না।

‘এই বেলা এগুলোতে হাত লাগাও।’ রুচি বলল, ‘তুমি বেকার নও, অর্ডার সাপ্লায়ের বিজনেস করছ বলে দিয়েছি।’

‘খুব ভাল করেছ। কেন বলবে না, এরা মানুষ নাকি যে, সত্যি কথা সর্বদা বলতে হবে। তুমি যে বুদ্ধি করে বলেছ ইস্কুলটা কাছে ব’লে ওদিকে চলে যাচ্ছি, খুব ভাল করেছ।’

‘যার নেই পুঁজিপাটা, সে যায় বেলেঘাটা।’দরজার পাশ দিয়ে হঠাৎ একটা কলরবের স্রোত বয়ে গেল।

রুচি ও শিবনাথ চমকে উঠল।

‘কে, কারা’?–ফিসফিসিয়ে বলল শিবনাথ

‘কানু বুড়ো বাবলু। এ বাড়ির ইস্কুলে-পড়া ছেলের দল, রুচি বলল, ‘কী শিক্ষা, কী ডিসিপ্লিন।’ দুই কর্ণমূল ওর লাল। কলরব করতে করতে ছেলের দল বেরিয়ে গেল।

‘কুকুরের বাচ্চা সব। ইতরের দল, আমরা অভাবে পড়ে বেলেঘাটায় যাচ্ছি, তোরা যাবি জেলে, ফাঁসির কাঠগড়ায় গিয়ে দাঁড়াবি। যত চোর ব্ল্যাক-মার্কেটিয়ার–’

গর্জন করছিল শিবনাথ। রুচি বলল, ‘আস্তে। ওদের দোষ কি, বড়দের মুখে শুনেছে, তা ছাড়া গালমন্দ করে কি হবে–আমরা বেলেঘাটায় যাচ্ছি, এটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই।

‘তা হলেও,–তা হোক, এই নিয়ে মকারি করার আছে কি।’ বালিশ-তোশকের বান্ডিল তৈরি করতে করতে শিবনাথ বলল, ‘ইচ্ছা করছিল, বাবলু আর ওটা কে? কানু।–দুই কান ধরে দুটোর মাথা আচ্ছা করে দেয়ালে ঠুকে দিই।’

‘ফৌজদারী মামলায় পড়তে যে,’বিছানার বান্ডিলে দড়ির গিঁট পরাতে পরাতে রুচি বলল।

শিবনাথ চুপ।

‘তা-ও এক রকম মন্দ ছিল না, বস্তির চেয়ে জেলখানা ভাল, কি বল?’ যেন ঠাট্টা করল পরে রুচি শিবনাথকে। ‘খাওয়াটা সেখানে ফ্রী।’

ইচ্ছা ছিল কেউ না জানে এভাবে এ-বাড়ি থেকে তারা সরে পড়বে। কিন্তু ইচ্ছা শোনে কে। ঠিক দুপুরবেলা ‘সুদর্শন’ এসে দর্শন দিলে দরজায়। এ-বাড়ির ধোপা। কোনদিনই সুদর্শন দুপুরে আসে না। আসে সন্ধ্যায়। ওপর ও নিচের আটটা ফ্ল্যাট ঘুরে ঘুরে রঙ-বেরঙের শাড়ি, সায়া, ফ্রক, বেড-কভার, বাবুদের আধময়লা টাই, পেন্টুলন, শার্ট, গেঞ্জি কুড়িয়ে রাত সাড়ে আটটায় সুদর্শন এসে উঁকি দিয়েছে রুচির ঘরের দরজায় মাইজীর কাপড়া যাবে কিনা ধোলাইয়ে জানতে। আজ আর সুদর্শনের হাতে ময়লা কাপড়ের পুঁটুলি নেই। অসময়ে দরজায় এসে ওকে দাঁড়াতে দেখে রুচির মুখ কালো হয়ে গেল। এ মাসে তার কিছুই যায়নি যদিও, গেল মাসে দু’খানা শাড়ি ধোয়ানো হয়েছিল সেই পয়সা এবং আগের কিছু পাওনা জমে আছে। : ধোপার কথা একেবারে রুচির মনে ছিল না।

‘আহা এমন অসময়ে তুই এলি!’ শিবনাথ চোখে-মুখে বিরক্তি প্রকাশ করল। সুদর্শন দাঁত বার করে হাসল।

কাপড় নিতে আসেনি সে। এসেছে পাওনা উসুল করতে। ‘বাবু কোথায় কুঠি ভাড়া করলেন?’

শিবনাথ সেই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে রুচির দিকে তাকল।

‘কত পাওনা হয়েছে তোমার?’ রুচি সোজাসুজি প্রশ্ন করল।

‘দো রুপেয়া ন’ আনা।’

নিঃশব্দে কৌটো থেকে পয়সা তুলে সেটা ধোপার হাতে দিয়ে বলল, ‘যাও’ আজ আর কাপড় যাবে না।’কিন্তু দেখা গেল শিবনাথের চেহারা ততক্ষণে বদলে গেছে। বেশ প্রফুল্লভাব।

‘কারোর পাওনা বাকি রেখে আমরা এখান থেকে যাব না, বুঝলি।’ বেশ বড় গলা করে শিবনাথ সুদর্শনকে বলল, ‘যাবি, বেলেঘাটা পর্যন্ত যেতে পারবি তোর গাধা চালিয়ে নিয়ে কাপড় আনতে? যাস তো তোকে দিয়েই সেখানে কাপড় ধোয়াব।’

‘উঃ তুমি এখন কাপড় ধোয়াবার কথা ভাবছ।’ রুচির রাগ বাড়ছিল।

লক্ষ্য করে শিবনাথ আর উচ্চবাচ্য করল না। হাতের কাজে মন দিলে।

বেগতিক দেখে সুদর্শন সরে পড়ল।

‘ধোপা-নাপিত সবাইর কাছে ঠিকানাটা দিয়ে রাখ, তারপর সেখানে গিয়ে তোমার টিনের ঘর দেখে এসে এ-বাড়ির দিদিমণিদের ছোট-মা ও বড়-মা’দের কাছে সবিস্তারে সেগুলি বর্ণনা করুক।’

শিবনাথও সেটা পছন্দ করে না। বলল, ‘ভুল হয়ে গেছে।’

রুচি বলল, ‘নাও, এইবেলা শিশি-কৌটোগুলো ভাঙা সুটকেসটার মধ্যে ঢোকাতে চেষ্টা কর।’

শিবনাথ সুটকেসের ডালা তুলল।

শূন্য শিশি-বোতলগুলো বাক্সের মধ্যে ঢেলে বিছাতে বিছাতে রুচি বলল, ‘বাবুপাড়ার ধোপা-নাপিত বেলেঘাটার বস্তিতে যায় না তা-ও ঠিক, তবু তো কি দরকার ঠিকানা জানিয়ে।’

সব মোটামুটি ঠিকঠাক করে তারা যাত্রা করবে এমন সময় রণদামূর্তি হয়ে সামনের দরজায় এসে দাঁড়াল এ বাড়ির ঝি কামিনী; এইমাত্র খেয়ে উঠে পান চিবোচ্ছে। অধরোষ্ঠ রক্তবর্ণ। ভিজে চুল পিঠময় ছড়ানো। দুই হাত কোমরে রেখে দ্রুত নিশ্বাস ফেলছে।

যেন এ-ঘরের লোক চলে যাচ্ছে কারো মুখে শুনে কামিনী ছুটে এসেছে ব্যস্ত হয়ে।

রুচির মুখ আবার অতর্কিতে কালো হয়ে গেল। কি ব্যাপার, না মঞ্জুর পরে মঞ্জুর যে ভাই কি বোনটি হবার কথা ছিল, তখন রুচি হাসপাতালে থাকতে দিনকতক শিবনাথকে রেঁধে খাইয়েছিল কামিনী, সেই ক’টা টাকা, এক বছর আগেকার পাওনা।

হিসাব বহুদিন থেকে ঠিক হয়ে আছে। ও মোট সাত টাকা পাবে। দেয়নি, কেননা কামিনীও চায়নি তেমন জোর করে–রুচিদিদিমণির এদিকে অভাব যাচ্ছিল ব’লে। যেন এই পাওনাটুকুর মধ্যে একটু প্রীতির রং ছিল এবং এক মাস যেতে ওটা দু’জনের মধ্যে প্রায় চাপা পড়ে গিয়েছিল তখন।

এভাবে একটা বছর ঘুরেছে।

কিন্তু এখন সেটা কামিনীতে দিয়ে দিতে হবে। ওর দরকার।

‘তুই কারোর কাছে বলিস না, আমি ঠিকানা লিখে দিচ্ছি, সামনের মাসে গিয়ে নিয়ে আসিস, ট্রাম বাসের পয়সা রাখ্। ‘

কামিনী রাজী হ’ল না।

রুচি মুশকিলে পড়ল।

কারণ হিসাব ক’রে রুচি দেখেছে এই টাকা থেকে সাত টাকা ঝি কে দিয়ে দিলে পথের সব খরচ মিটিয়ে সেখানে তাদের যাওয়া হয় না।

‘উঃ, সব ইতর-মাতালের জায়গা ওটা–সেখানে কি আমি মেয়েমানুষ যাব গুণ্ডার ছোর খেয়ে মরতে। বিশ বছরের ভিতর কামিনী মোক্তারামবাবু স্ট্রীট পার হয়ে কোথাও কারো বাড়িতে এক সন্ধ্যা পা ছোঁয়াতে গিয়েছে কি না জিজ্ঞেস কর এ বাড়ির বাবুদের, মা’দের। বেলেঘাটায় যাব মরতে সাত টাকার তাগিদ দিতে, ছোঃ!’

তাচ্ছিল্যভরে ঝি বলল, ‘নাও, রেখে দিও ওটা তোমাদের সংসারে, আর মনে করো এ ক’টা দিন ঝি হয়ে ছিল না, তোমার সতীন হয়ে খেটে গিয়েছিল কামিনী।’

কামিনী রক্তিম ঠোঁট ফুলিয়ে হাসছিল।

রুচি কথা বলল না।

যেন পৌরুষে লাগল, উত্তেজিত হয়ে শিবনাথ স্ত্রীর দিকে তাকায়। ‘এখান থেকেই তুমি ওর ওটা মিটিয়ে দাও, সাত টাকা আমরা রাস্তায় গিয়ে যা হোক করে ম্যানেজ করতে পারব।’

নানারকমের দেনা শোধ করে ও এ-মাসেরও পাঁচদিন খেয়ে রুচির ইস্কুলের মাইনের আর কুড়ি পঁচিশ টাকা হাতে অবশিষ্ট আছে। নিঃশব্দে সাতটি টাকা তুলে ও কামিনীর হাতে দিতে শিবনাথের চেহারার বিরক্তিভাবও চট্ করে কেটে গেল।

‘বুঝলে কামিনী, আমরা কারোর টাকা মারি না। ভদ্রলোকের সন্তান। লেখাপড়া শিখেছি।’

‘তা কি আর জানি না গো দাদাবাবু। ঠোঁট থেকে শ্লেষের হাসি মুছে ফেলে গম্ভীর গলায় ঝি বলল, তুমি বি-এ পাশ দিদিমণি রি-এ পাশ। এ-বাড়ির সবাই তো বলছে। তোমরা যদি আমার টাকা মারো তো মুখ্য পুরো করবে কি।’

‘তাই বলছিলাম, তুমি যদি সেখানে না যেতে আমি নিজে এসে একদিন দিয়ে যেতাম। তোমার পাওনা টাকা, আমরা কি তা রাখতে পারি?’ শিবনাথ প্রসন্ন গলায় হাসল।

কামিনী আরো নরম হয়ে যায়। ফিসফিসিয়ে বলে, ‘গড়পার যেতে কি বেলগাছে, টালায় কি দক্ষিণে ভবানীপুর কালীঘাটের দিকে ঘর-ভাড়া করলেও আমি একদিন সময় করে বেড়াতে যেতুম, গিয়ে দেখে আসতুম দিদিমণিকে মঞ্জুমামণিকে।’ কিন্তু খালের ওপার বেলেঘাটা বড্ড বিশ্রী জায়গা। ধুলো আর রোদ, মোষের গাড়ি আর খেঁকি-কুকুর ছাড়া সেখানে রাস্তায় কিছু চোখে পড়ে না। এই মোক্তারামবাবু স্ট্রীটের অত নম্বর বাড়ির জনার্দন রায় একবার কি দরকারে সেখানে গিয়ে ফিরে এসে কামিনীকে সেদিন বলছিল। কামিনী তা সবিস্তারে শিবনাথের কাছে এখন বর্ণনা করল।

‘না না, সাময়িকভাবে যাচ্ছি সেখানে, এদিক সুবিধামত ঘর পেলে ফের আমরা চলে আসব।’

‘তাই চলে এসো, সেখানে ছোটলোক ছাড়া ভদ্দরলোক থাকে না।’ বলে কামিনী ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

আর কেউ রইল না পথ রুখতে। সকলের পাওনা মিটিয়ে তবে ওরা মুক্তারামবাবু স্ট্রীটের বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় দাঁড়াতে পারল।

‘শেষ হুল ফুটিয়ে দিয়েছে কামিনী।’ রুচি রাস্তায় শিবনাথকে কয়েকবার কথাটা স্মরণ করিয়ে দিল। ‘বাবুপাড়ার ঝি ক্যানেলের ওধারে পা ছোঁয়াবে না।’

শিবনাথ বলল, ‘এই বাড়ির মানুষগুলোকে দেখেশুনেই ঝি-চাকরগুলো এমন আস্কারা পেয়েছে। বাইপ্রোডাক্ট। বেলেঘাটায় তোদের বাবুদের চেয়ে বড়বাবু নেই নাকি, তোদের চেয়ে চার ডবল বেশী রোজগার করে এমন অনেক গুণী রূপসী ঝি আছে!’

‘উঃ, ইচ্ছা করছিল আমার ওর চুলের ঝুঁটি ধরে মারি,–সতীন!’ রুচি বলল।

‘না না না।’ ঠেলার পিছনে কতক্ষণ হাঁটবার পর এক সময় রিক্সায় রুচির পাশে এসে বসে শিবনাথ বলল, ও চীৎকার করে লোক জড়ো করে এমন মামলা দাঁড় করাতে পারতো যে, আমাদের দুজনকেই হয়ত কোর্টে যেতে হত।’

আশ্চর্য, রাস্তায় যেমন খারাপ লাগছিল, একটু নিরিবিলিতে, ঘন ছায়ায় এসে সব কোলাহল ছাপিয়ে খালের জলের ছলছল শব্দটা খারাপ লাগল না; ঠাণ্ডা শিরশিরে হাওয়া দিচ্ছিল। গাছের মাথায় পাখি ডাকছিল। পাতার ফাঁক দিয়ে এক মুঠো তারা ঝকঝক করে উঠল হঠাৎ।

কামিনী, বকুল, বকুলের মুখরা মাসীর কথা মনে রইল না তাদের।

ঠিক বেলেঘাটা নয়। আর একটু দক্ষিণে।

লটবহর নিয়ে এক সময় খেয়া পার হতে হ’ল। একটু সময়ের জন্য নৌকায় ওঠা। মঞ্জু আহ্লাদে হাততালি দিয়ে উঠল

তারপর একটা গেঞ্জী কলের খটখট শব্দ, একটা করাত কলের ঘসঘস্ আওয়াজ অন্ধকার আর অফুরন্ত ঝিঁঝির ডাক শুনে এক থমথমে চীনা কারখানার পাশ কাটিয়ে ঘেঁটু ফুলের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে আরও খানিকটা হাঁটা-পথ। রিক্সা যায় কিনা বোঝা গেল না। কিন্তু রিক্সা কি মোটরগাড়ি চলতে পারে, এমন পথ এখন আর খোঁজাখুঁজি না করে মুটের মাথায় মালপত্র চাপিয়ে মাঠের ওপর দিয়ে তারা অগ্রসর হ’ল।

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ এই কুঠি।’

যারা মোট বইছিল, এই সময় তারা কলরব করে উঠল।

মাঠের রাস্তা শেষ হয়ে গেছে। এক আলোকোজ্জ্বল সুন্দর প্রাসাদোপম বাড়ির সামনে এসে ক্যারাভান দাঁড়ায়।

রুচি ঠিক বুঝতে পারল না।

‘শিবনাথ বলল, আমাদের নতুন বাড়িঅলা এখানে থাকেন। এঁর কাছে দু’মাসের ভাড়া জমা রেখে রসিদ ও চাবি নিয়ে বাড়িতে ঢুকতে হবে।’

এখন রুচি বুঝতে পারল।

মালপত্রের সঙ্গে সে দাঁড়িয়ে রইল। শিবনাথ গেট পার হয়ে ভিতরে ঢুকল।

চারিদিকে তাকিয়ে দূরে কাছে রুচি টিনের বেড়া টালির ছাউনি দেখতে পেল না। দেখল মাঠ, ফুলের বাগান, আর আম জাম ফলসা ও লিচু গাছের মত বড় বড় গাছ। গাছের তলা দিয়ে এঁকে বেঁকে গেছে পরিচ্ছন্ন লাল কাঁকরের পথ। অদূর একটা গ্যারেজ দেখা গেল। আয়নার মত চকচক করছে সুন্দর একটা গাড়ি। ডাইনে বাঁয়ে পিছনে সামনে খুঁটির মাথায় এতগুলি ইলেকট্রিক ডোম জ্বলছিল বলে অবশ্য রুচি বাড়ির প্রায় চারপাশের সবটা ছবি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে পারল।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে শিবনাথ বলল, ‘চল’।

আবার অন্ধকার। বনবাদাড় ঘেঁসে সরু অসমান রাস্তা।

একটা বাঁশের সাঁকো পার হ’তে হ’ল।

ঝিঁঝির ডাক উত্তরোত্তর বাড়ল। জঙ্গল থেকে মশার ঝাঁক উড়ে এসে হাঁটা অবস্থায়ও চোখে-মুখে কামড় বসিয়ে দিতে লাগল। শিবনাথ বলল, ‘আমাদের যখন মশারি আছে ভাবনা নেই।’

রুচি কথা বলল না। ভাবছিল দিনের বেলায়ও এখানে এমন মশায় কামড়ায় কিনা। ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই ত ঘর।’ মুটেরা আবার হৈ-হৈ করে উঠল।

সরু অসমান রাস্তার পাশে ছোট্ট একটা মুদি ডাল-তেল-নুনের সঙ্গে বিস্কুট, বাতাসা, মুড়ি, কাগজ, পেন্সিল, সাবান, বার্লির টিন, দুধ, মাখনের কৌটো, চুলের ফিতা, তালপাতার পাখা, পান, সুপারী, চুন, এমন কি ছেলেদের ধারাপাত আর সহজ অঙ্কন অবধি দু’কপি করে রেখেছে। ‘এই দোকানটা থাকাতে আমাদের সুবিধা হয়েছে,’ শিবনাথ বলল।

‘ডিপার্টমেন্ট্যাল স্টোর,’ রুচি বলল, ‘দুঃখের বিষয় কেরোসিনের ডিবি জ্বালাতে হচ্ছে। ইলেকট্রিক না থাকলে কত অসুবিধা।’

‘না, ইলেকট্রিক এসে যাবে। এদিকটাতে যখন পরপর দুটো বক্তি বসে গেল, তখন নিজের স্বার্থেই রায়সাহেব জঙ্গল পর্যন্ত বিজলীবাতি টেনে আনবেন। আরো দু’চারখানা দোকান রাতারাতি না হলে এখানে চলবে কেন।‘

রায়সাহেব তাদের নতুন বাড়িঅলা।

‘তোমার রায়সাহেব বুঝি বিরাট বড়লোক?’ রুচি প্রশ্ন করল।

‘বলে কি না বড়লোক!’ শিবনাথ নাকের ভিতর শব্দ করে হাসল। ‘একটা স’মিল আর একটা হোসিয়ারীর মালিক। দেখলে তো নিজের বাড়িখানা। গাড়ি ছাড়াও দু’টো ট্রাক আছে। রাতদিন গাছের গুঁড়ি আনছে বয়ে খাল থেকে, আর গাছের গুঁড়ি চিরে খাট-পালঙ্ক ড্রেসিং টেবিলের তক্তা করে ট্রাক বোঝাই করে সেগুলো চালান দিচ্ছে কলকাতার বড় বড় মার্চেন্টের কাছে। বিগ ফার্নিসার্স।

‘এই সবটা জায়গাই কি ওর?’

‘নিশ্চয়ই এবং বস্তি দু’খানাও।’ একটু থেমে শিবনাথ বলল, ‘একি তোমার মুক্তারামবাবু স্ট্রীটের বাড়িঅলা। এক বাড়ির সাতখানা কোঠা নিয়ে জমিদারী। রায়সাহেবের ফিশারী আছে, রেসের ঘোড়া আছে দুটো শুনতে পেলাম।’

রুচি চুপ করে রইল।

তারা মুদি-দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। মুটেরা মাথার বোঝা মাটিতে রেখে জিরোচ্ছে। কেননা রায়সাহেবের সরকার এসে তখনও পৌঁছয়নি। বস্তির কত নম্বর ঘর তাদের সরকার এসে আগে দেখিয়ে দিলে পরে দরজার তালা খুলে নতুন ভাড়াটেরা গৃহে প্রবেশ করবে। এই এখানকার নিয়ম।

ইতিমধ্যে ছোটোখাটো ভিড় জমেছে দোকানের সামনে। নতুন ভাড়াটে এসেছে পাড়ার লোক বুঝতে পারল। মুদি-দোকানের ঠিক পিছনে টালি-ছাওয়া টিনের বেড়ার সারি সারি ঘর দেখা যাচ্ছিল। কি ক’রে কোন গাছের মাথা ডিঙ্গিয়ে অনেক ডাল পাতার আড়াল ভেদ ক’রে রায় সাহেবের কুঠির ছাদে বসানো ইলেকট্রিক ডোমের এক আঁজলা আলো এসে ছিটকে পড়েছে টালির ছাদগুলোর ওপর টিনের বেড়ার গায়ে। কালো দাগ-ধরা টিন। তা বেড়া পুরোনো হলেও ছাদ নতুন টালি ঢেলে তৈরি হয়েছে বোঝা যায়।

শিবনাথ বলল, ‘বলছিলাম তখন যারা খুব বড়লোক তারা বাঁচবে আর খুব গরীব, মাঝামাঝি আছেন মানে তোমার মুক্তারামবাবু স্ট্রীটের হিমাংশুবাবু চারুবাবুদের দিন শেষ হয়ে এসেছে।’

রুচি কথা বলল না।

আর একটা সিগারেট খেতে ইচ্ছা হচ্ছিল শিবনাথের। সিগারেট ফুরিয়ে গেছে। পকেটে বিড়ি ছিল। কিন্তু নতুন জায়গায় এতগুলি লোকের সামনে বিড়ি ধরাতে তার কেমন লাগছিল।

‘নামে বস্তি। কিন্তু ভিতরের এ্যারেঞ্জমেন্ট ভাল। আমি কাল তো এসে দেখে গেছি। এই ঘর-দুর্ভিক্ষের দিনে রায়সাহেব বাড়ি দু’খানা তৈরি করে দিয়ে আমাদের মত-লোকের উপকারই করেছেন বলতে পার। আঠারো টাকায় একখানা ঘর এদিনে খারাপ না।

রুচি এখনো ঘর দেখেনি তাই চুপ করে রইল।

কে একজন এসে সামনে দাঁড়াল ব’লে শিবনাথ হঠাৎ মুখ বন্ধ করল।

রুচির বয়সী হবে। শিবনাথ অনুমান করল।

রুচির হাতে ঘড়ি নেই, ওর হাতে ঘড়ি। তাছাড়া বেশভূষার মোটামুটি রকম মিল আছে। মেয়েটি রুচির দিকে এগিয়ে এসে হেসে দুই হাত কপালে ঠেকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘ও আপনারা

বুঝি নতুন ভাড়াটে!’ রুচি কথা বলল না, শিবনাথ ঘাড় নাড়ল।

‘হ্যাঁ, আমিই কাল এসে বারো নম্বরের ঘর ভাড়া করে গেছি। আপনি কি ওই বাড়িতেই থাকেন? কাল কিন্তু দেখতে পাইনি।’

‘দুপুর বেলায় বাড়ি থাকি না। এই সপ্তাহে থাকব না। ডে ডিউটি চলছে। ইনি আপনার স্ত্রী বুঝি, আর এই সন্তান?’

পলকে রুচি এবং পরে মঞ্জুকে দেখে শিবনাথ মৃদু হেসে ঘাড় নাড়ল।

‘আপনি কি–’

‘হ্যাঁ, আমি উত্তরপাড়া হাসপাতালের নার্স। আমার নাম কমলা গাঙ্গুলী।’

‘আমার নাম শিরনাথ দত্ত। ইনি শ্রীমতী সুরুচি দত্ত। কমলাক্ষী বালিকা বিদ্যালয়ের সেকেন্ড টিচার।’

ভাগ্যিস শিবনাথ কোথায় কাজ করে তৎক্ষণাৎ যে ও জিজ্ঞেস করল না। মেয়েটিকে রুচির ভাল লাগল। আলাপে ভদ্রতায় মুক্তারামবাবুর স্ট্রীটের মেয়েদের চেয়ে কোনো অংশে হীন হয়, বরং রুচির শ্রদ্ধা হ’ল একজন স্কুল টিচারের চেয়ে বেশি ছাড়া তার মাইনেও কম না, তবু বস্তির সস্তা ঘরে আছে। বেশি ঘরভাড়া দিয়ে আরামে থাকার ভাগ্য তার হ’ল না অর্থাৎ ঘর খুঁজে পাচ্ছেন না, নাকি আরামে বাস করার চেয়েও টাকার অন্য দরকার বেশি–কথাটা জিজ্ঞেস করতে রুচির সাহস হ’ল না।

‘এসেছেন ভালই করেছেন,’ কমলা বলল। ‘ভাল মন্দ দুইই আছে, তবে টাকার অনুপাতে আজকালকার দিনের বিচারে ঘর নেহাত খারাপ না।’

‘হ্যাঁ, মোটামুটি রকম একখানা ঘরও শহরের ভিতর পাওয়া গেল না। যথেষ্ট চেষ্টা করা হয়েছে,’ শিবনাথ বলল এবং আড়চোখে একবার রুচিকে দেখল। ‘না পেয়ে অগত্যা এখানে আসতে হল।’ কমলা চুপ করে ছিল। শিবনাথ আবার বলল, ‘উঃ, উত্তরপাড়ায় তাহলে আপনাকে রোজ,–ট্রেনে যেতে হয় কি, না বাসে?’

‘হ্যাঁ, বাস ট্রেন দু’টোই দিনে দু’তিন বার চাপতে হচ্ছে। কোন্ সকালে বেরিয়েছি, এই তো ফিরলাম।’ ক্লান্তির ভঙ্গিতে কমলা ঈষৎ হেসে রুচির দিকে তাকাল। ‘আপনারও আজ ধকল কম যাচ্ছে না। বাড়ি বদলানোর হ্যাঁঙ্গামা কি কম!’

সরকার এসে গেল। হাতে একটা চাবির ছড়া, একটা টর্চ। গায়ে ফতুয়া, পায়ে চটি, চোখে পুরু চশমা। নতুন ভাড়াটে দম্পতিকে সম্বোধন করার আগে মদন ঘোষ কমলার দিকে তাকাল ‘কখন ফিরলেন, মিস্ গাঙ্গুলী?’

মুখের বিড়িটা ফেলে দিল ঘোষ।

‘এই মাত্র। কেন আমাকে খুঁজেছিলেন নাকি?’

‘আপনার ঘরের জানালার নতুন পাল্লা এসে গেছে। পারিজাতবাবু নিজে কারখানা থেকে কাঠ পছন্দ ক’রে তাঁর ছুতোর দিয়ে তৈরি করিয়ে দিয়েছেন। কাল তো আপনি জানালেন আমাকে কালই গিয়ে বাবুকে বললাম। দেখুন এর মধ্যে হয়ে গেল।’

‘হ্যাঁ, এক সকালের মধ্যেই যে জানালা তৈরি করিয়ে দেবেন আশা করিনি।’

‘শত হোক বড়ঘরের ছেলে তো, আপনারা পাঁচজন ভদ্রলোক এসে এখানে তাঁর জমিতে বাসা বেঁধেছেন, আপনাদের সুখসুবিধা দেখবেন বৈকি।’

‘শিবনাথ রুচির কানে ফিসফিসিয়ে বলল, পারিজাতবাবু রায়সাহেবের বড় ছেলে। রায়সাহেব বুড়ো হয়েছেন। বালিগঞ্জের বাড়ি থেকে নড়েন না। ছেলেই কাঠের কারখানা গেঞ্জির ফ্যাক্টরী দেখছে, আর এই বস্তি।’

‘তা পারিজাতবাবু আজ কোথায় গিয়েছিলেন? ওদিক গিয়ে আসছি তখন দেখলাম বৌ বাচ্চা দু’টো সঙ্গে নিয়ে ফিরছেন। খুব সাজগোজ করা সবাই।’ কমলা প্রশ্ন করল।

‘সিনেমায় গিয়েছিলেন সব। কলকাতার লাইট হাউসে ভাল জাঙ্গল পিক্‌চার এসেছে। রাত্রে আজ কুঠিতে ফিরে খাওয়াদাওয়াও নেই, হোটেলে সারা হয়েছে বই দেখে ফেরার পথে।’

‘যাকগে।’ কমলা একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলল। ‘আপনার বাবুকে ধন্যবাদ জানাবেন। এর বেশি, আমাদের আর কি করার আছে।’ মদন ঘোষের চোখের দিকে তাকিয়ে কমলা অর্থব্যঞ্জক একটু হাসল। ‘এত বড় লোকের আঠারো টাকা ঘরের ভাড়াটে আমরা।’

‘ছি ছি!’দাঁত দিয়ে জিভ কাটল ঘোষ। ‘তিনি আপনাদের সেই চোখেই দেখেন না। আপনি আছেন, রায় মশায়ের পরিবার আছেন, বিধুবাবু শেখরবাবুরা আছেন। সবাই তো ভাল ঘর না পেয়ে ঠেকে এখানে এসেছেন। তিনি তা খুব জানেন, সেই জন্যেই আমাকে দিনের মধ্যে দশবার ক’রে পাঠাচ্ছেন আট নম্বর বাড়ি দেখে আসতে কারোর কিছু অসুবিধা হচ্ছে কি না।’ শিবনাথ রুচির কানে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘মুক্তারামবাবু স্ট্রীটের বাড়িঅলা নয়। ঢের বেশি শিক্ষিত, অনেক বেশী প্রগতিবান। এঁর সংস্রবে এসে আমরা খারাপ করিনি।’

সরকার বলল, ‘আপনারা আর দাঁড়িয়ে কেন, চলুন। আপনাদের ঘর দেখিয়ে আমাকে এখুনি কলকাতায় যেতে হবে।’

‘কেন?’ কমলা প্রশ্ন করল।

মদন ঘোষ একটু বিষণ্ণ গলায় বলল, ‘বড় খোকাবাবুর পেটের ব্যথা হয়েছে, হোটেলে বোধ করি শুয়োরের মাংস ঠেসে খেয়েছিল। যেতে হবে আমাকে এই রাত ক’রে এখন সেই চৌরঙ্গির সাহেব পাড়ায় ওষুধের দোকানে।

‘কেন বেলেঘাটায় কোনো ডিসপেন্সারীতে কি পেটের অসুখের ওষুধ পাওয়া যায় না?’ কমলা সরু গলায় বলল।

মদন ঘোষ ঠোঁট প্রসারিত করে অর্থব্যঞ্জক হাসি হাসল।

‘পয়সা–দিদিমণি, পয়সার ওপর রায়সাহেব সবাইকে শুইয়ে রেখেছেন। শুধু ওষুধ! বৌদিমণির সেলাইয়ের ছুঁচ ভেঙ্গে গেলে নতুন ছুঁচ কিনতে আমাকে নিউমার্কেট ছুটতে হয়। অবশ্য রাহাখরচের বিলটাও তেমনি আমি ঠেসে করি। তাঁরা বিলাতী হোটেলে খান, আমি ফেরার পথে খিদে পায় বলে শেয়ালদায় এসে বাস বদলানোর সময় রেস্টুরেন্টে মাংস পরোটা মারি। বাবু কিছু বলেন না বটে, মুখ টিপে হাসেন, হাসেন আর বিলে সই মেরে দেন। তারপর ঠাট্টা ক’রে বলেন, সরকার মশাই, আজ শনিবার, চলুন আরামবাগ থেকে ঘুরে আসিগে।’

‘আরামবাগে কি?’ কমলা ব্যগ্র হয়ে প্রশ্ন করল। মদন ঘোষ হেসে মাথা নাড়ল। ‘সে আর বলব না, তা আর না-ই-বা শুনলেন। হে–হে।’ সরকার এত জোরে হাসে যে, মুদি দোকানের সামনে দাঁড়ানো লোক দুটি হচকিয়ে ওঠে।

‘ও বুঝেছি, না না, সে আমি জানতে চাইনে, তা আমার জিজ্ঞাসা নয়।’ কমলা হঠাৎ লজ্জিত হয়েছে এমন ভান করাতে মদন ঘোষ তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে-পড়া হাসিটাকে ছোট করে ফেলতে চেষ্টা করে। যেন গুটিয়ে সবাইকেই দুই ঠোঁটের মধ্যে রাখবার চেষ্টা ক’রে পরে বলে, ‘না না তেমন কিছু নয়, খুব যে একটা প্রাইভেট কিছু, বাস্তবিকই রায়সাহেবের ছেলেটি ভাল, পারিজাতবাবু পাক্কা জেন্টেলম্যান। বলছিলাম, আমাদের প্রভু-ভৃত্য সম্পর্ক, আমি তাঁর কর্মচারী। আবার দরকার হলে একসঙ্গে ফুর্তি করতেও ডাকেন।

কমলা বলল, ‘আপনি ভাগ্যবান। আমরাও পরের চাকর। প্রভু-ভৃত্যের দূরত্ব অনেক।’ যেন কথার অনুমোদন আদায়ের জন্য কমলা শিবনাথের দিকে তাকায়। শিবনাথ মাথা নেড়ে বলল, ‘একশ বার। কালচার্ড মনিব এমনি হয়।’ বলে বেশ আত্মীয়তার ভঙ্গিতে মদন ঘোষের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি হ্যাপি সরকার মশায়, এই বিষয়ে আমারও ওপিনিয়ন নিন।’

মদন ঘোষ প্রসন্ন দৃষ্টিতে নতুন ভাড়াটে দম্পতির দিকে তাকাল।

‘আহা, আপনাদের দেরী করে দিচ্ছি! চলুন। আপনারই নাম তো শিবনাথ দত্ত? বারো নম্বর ঘর। চলুন। আপনার মোটমাট ফ্যামিলির লোক সব এসে গেছে?’

‘হ্যাঁ, এই তো।’ শিবনাথ ঘাড় নেড়ে রুচি, মঞ্জু ও মুটে তিনটিকে দেখিয়ে দিলো।

‘চলুন মিস গাঙ্গুলী আপনি তো ঘরে যাচ্ছেন।’

‘চলুন।’

কমলা রুচির হাত ধরে অগ্রসর হ’ল।

মুদির দোকানে সামনেটা হঠাৎ ফাঁকা হয়ে গেল।

দোকানের সামনের দাঁড়ানো একজন আর একজনকে বলল, ‘আর এক বাবু এসেছেন টিনের ঘরে মশার কামড় খেতে। হা-হা।’

‘কি করবে রে দাদা। দিনকাল বহুৎ খারাপ হয়ে গেছে। শুধু কি রিফুউজি আতর পাউডার এসেন্স মাখা ক’গণ্ডা মাইয়া-ছাইল্যা দেখবি তুই আয়। রাস্তায় লাইন দিয়েছে ঘড়া কলসি নিয়ে গাড়ির জল ধরতে।’

‘কেন,’ একজন ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘রায়সাহেবের বাড়িতে তো কল বসেছে। অথচ ভাড়াটেদের ভাড়া বাড়েনি শুনলাম। এইজন্যে পারিজাতবাবুর ওপর সবাই খুশী।’

‘দিয়েছেন,’ দ্বিতীয় লোক বলল, বারোটা ফ্যামিলির জন্য একটা পাইপ। সেই পাইপ বিগড়াতে কতক্ষণ।’

‘তাও বটে।’ প্রথম ব্যক্তি অনুমোদনসূচক ঘাড় নাড়ল। ‘বিগড়াতে কতক্ষণ।‘

এই ধরনের বাড়িতে প্রথমটায় একটু চাপা ফিসফিসানি থাকে।

ফিসফিসানিগুলো এঘর থেকে ওঘরে ঘুরে বেড়ায়। মানে পুরোনোদের মধ্যে একজন আর একজনকে চুপি চুপি জিজ্ঞেস করে, ‘কোথা থেকে এলো? কারা? স্বামী-স্ত্রী মনে হচ্ছে। সঙ্গে একটি মেয়ে আছে। ভদ্রলোকের চাকরি নেই, না মাইনে কমেছে, নাকি শহরের বাড়িঅলার সঙ্গে মামলায় হেরে গিয়ে উৎখাত হয়ে বস্তিতে এসেছে, সুবিধামতন ঘর পাচ্ছে না। ভাল বাসা পেলে কালই আবার ফুড়ুৎ–’

‘তা বাপু এসেছে দেখা যাবে, যাক না দু’টো দিন। মোটে তো মোটঘাট নামালো।’

‘বৌটা ভদ্রলোকের চেয়ে দেখতে সুন্দর। দ্যাখ্ তাকিয়ে। মেয়েটা মার চেহারা পায়নি।’

‘না না, ভদ্রলোকও দেখতে বেশ ভাল। স্বাস্থ্যটিও ভাল।’

আট নম্বরের হিরণ বলল, ‘এত রাত ক’রে নতুন ঘরে এল, খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা কি হবে?’

‘কেন, বৌ-মানুষ, যদি তোলা উনুন সঙ্গে থাকে দু’টো ভাতে ভাত চাপিয়ে দেবে। কয়লা না থাকে আমাদের কারো কাছ থেকে চেয়ে নিক না। ফিরিয়ে দিলেই হ’ল।’

দশ নম্বরের কিরণের মন্তব্য শুনে হিরণ ঠোঁট টিপে হাসে। তারপর ফিসফিসিয়ে বলে, ‘মনে হয় না। দেখছিস না, মহিলা কেমন মুখখানা হাঁড়ির মতন ক’রে আছেন। হয়তো রাস্তায় ঝগড়া হয়েছে। জানত না সোয়ামী শেষটায় বস্তিতে এনে ঠেলে তুলবে। এখন দেখে শুনে আক্কেল গুড়ুম। এত রাতে রান্না করবে না ছাই!’

‘যা বলেছিস।’ কমলাও ঠোঁট টিপে হাসে, তারপর ফিসফিসিয়ে বলে, ‘বরং পুরুষটাকে একটু খুশিবাসি মনে হয়। হয়তো উদ্যোগ আয়োজন ক’রে কত্তাই রান্না চাপবেন।

‘হুঁ’, হিরণ সায় দেয়। ‘দেখে মনে হয় তিনি ঘুঁটে দেওয়া স্বামীদের দলের।‘

অর্থাৎ এই বাড়িতে এগারোটি পরিবারের সঙ্গে আর একটি পরিবার এসে বাসা বাঁধলো। এদের কারো স্ত্রীর চাকরিতে সংসার চলে! টেলিফোনে, স্কুলে, হাসপাতালে, ডেয়ারী ফার্মে। বেকার স্বামীরা, সংখ্যায় খুব বেশি নয় যদিও, দু’তিনটি, দুপুর বেলা ঘরে থেকে ছেলেমেয়ে দেখে, ঘরদরজা পরিষ্কার রাখে, ফাঁক পেলে কল থেকে ঘড়া ভরে জল নিয়ে আসে। স্ত্রীকে খেটেখুটে এসে যা’তে না এসব কাজে হাত দিতে হয়। এ-বাড়িতে যারা থাকে তাদের চাকর রাখবার ক্ষমতা থাকে না। আগের এক ভাড়াটের স্বামী নাকি দুপুর বেলায় বসে ঘুঁটে দিত অবশ্য বাড়ির ভিতরের উঠানে না, একটা পাঁচিলের গায়ে। তারপর থেকে এখানকার বেকার স্বামীদের ‘ঘুঁটে দেওয়া বর’ নাম পড়েছে।

কমলা চাপা গলায় বলল, ‘যাকগে লোকের ভাগ্য নিয়ে এসব সস্তা রসিকতায় কাজ নাই। তবু তো ওদের ঝি বৌ চাকরি করে খাওয়ায়, বাটনা বেটে, জল তুলেও মনে সান্ত্বনা থাকে। তোর আর আমার স্বামী আজ বেকার হ’লে কাল উনুন ধরানো বাটনা বাটা একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে। বুঝতে পারিস?’

বুঝতে পেরে হিরণ চুপ ক’রে থাকে। বিমল হালদারের বৌ আর অমল চাকলাদারের বৌ। চাকলাদার ও হালদার কোথায় দূরে ফ্যাক্টরির কাজে যখন বেরিয়ে যায়, দুজন, হিরণ ও কিরণ ভাবে তাদের কি দশা হবে। যেটুকুন লেখাপড়া জানে শহরে কি শহরতলীতে তাদের কেউ চাকরি দেবে না।

তাছাড়া, এ-বাড়ির আর পাঁচটি মেয়ের মতন হিরণ কিরণও তেমন চালাকচতুর, এমন নয়। হয়তো এতকাল পাড়াগাঁয়ে ছিল বলে দু’জনের স্বামী, যদি চাকরি করা তাদের দরকারও হয়, কিছুতেই বৌদের বাইরে যেতে দেবে না ধরে রেখেছিল।

দু’জনের স্বামীই কড়া। অমল ও বিমল চেষ্টা-চরিত্র ক’রে চাকরি জুটিয়েছে, পঁচাত্তর টাকা মাইনেয় শহরে পাকা কোঠা পাবে কোথায়, পরিবার এনে তুলেছে পারিজাতবাবুর বস্তিতে। অপেক্ষাকৃত পরিচ্ছন্ন, অপেক্ষাকৃত ভদ্র, তারা দূর থেকে শুনেছিল।

দু’নম্বর ও ছ’নম্বর ঘরের ফিসফিসানি হয় প্রবীণা প্রবীণায়।

হীরুর মা ও প্রমথর দিদিমায়।

হীরুর মা আটা মাখছিল।

প্রমথর দিদিমা এসে হাত ঘুরিয়ে, অর্থাৎ কথার চেয়ে ইঙ্গিতের ওপর বেশি জোর দিয়ে বলল, ‘তামা কাঁসা কিস্তু নেই। এলুমিনিয়মের ডেগচী আর কলাই করা লোহার থালা গ্লাস। একেবারে হাতকাটা জগন্নাথ হয়ে এসেছে বোন।’

‘তা আমি একনজর দেখেই বুঝে নিয়েছি।’ যেন আটা ডলতে গিয়ে মাথায় বেশি ঝাঁকুনি লাগছে সেই ভান ক’রে হীরুর মা প্রবলবেগে মাথা নাড়ল। ‘কত্তার মুখের আগুন তো দেখছি নিবছে না। সেকেন্ডে সেকেন্ডে সিগারেট ধরাচ্ছেন, বিবির পায়ে জুতো। আসলে ভিতরে মালমশলা নেই, বাইরের ফুটুনি দিয়ে ঢেকে রাখতে চাইছে। জুতো সিগারেট ক’দিন। দাঁড়াও না, পারিজাতের গোয়ালে মাথা গলিয়েছ, খোলস খসতে দেরি হবে না।’

ছ’ নম্বর আর বারো নম্বর ঘর দুটো ঠিক মুখোমুখি, কেননা বাড়িটা গোল। হীরুর মা’র রক থেকে শিবনাথের ঘরের ভিতর পরিষ্কার সব দেখা যাচ্ছে।

আরো বেশি দেখা যাওয়ার কারণ, এইমাত্র ওরা ঘরে ঢুকেছে, পর্দা খাটানো হয়নি। জিনিসপত্র ছত্রখান ক’রে রাখা। এবং পর্দা কোনোদিনই খাটানো হবে না একথা সবাই জানে। এ-বাড়িতে কোনো ঘরে পর্দা নেই।

‘আস্তে, দিদি আস্তে!’ প্রমথর দিদিমা ফিফিসিয়ে হীরুর মাকে সাবধান ক’রে দিলো।

হীরুর মা তা গ্রাহ্য করল না। বরং আটা ডলার ভান করে মাথাটা আরো জোরে নেড়ে নেড়ে প্রমথর দিদিমাকে বলল, ‘জিনিসপত্র আবার রাতেও রকে ফেলে রেখো না। অই তো শুনলাম কাল ওদিকের কোন্ এক বস্তিতে নাকি আবার চুরি হয়ে গেছে। সেখানেও সব ভদ্দরলোক, ঠিক এ বাড়ির মতন। তা নিত্যি নতুন লোক আসছে, যাচ্ছে এসব বাড়িতে, এমন তো হবেই। তুমি কা’র কতটা জানো বলো। ‘

প্রমথর দিদিমা হিস্ হিস্ ক’রে বলল, ‘আস্তে, বোন আস্তে।’

‘তা এ-বাড়িতে কম ঘটনা হয়েছে নাকি।’ তিন আর চার নম্বর পাশাপাশি দু’টো ঘরের মাঝের ছোট্ট চৌকোণ রকটায় ওপর ব’সে মৃদুমন্দ ভাষায় ও সম্ভব হ’লে হুঁকোর গুড়গুড় শব্দ দিয়ে কথাগুলোকে ঢেকে রাখতে চেষ্টা ক’রে বিধুবাবু শেখরবাবুকে বললেন ‘সেই যে, এক ইয়ং ম্যান্ এলো আর এলো তার আপ-টু ডেট স্ত্রী। না, আমি বলছি সঙ্গতিটা বড় কথা নয়, অভাবটাই সব সময় খাটছে না, যার জন্যে শহরের বাইরে পারিজাতের সস্তামতন এই কামরাগুলো তে-রাত্তির খালিও থাকছে না। ‘

‘যা বলেছ।’ হুঁকোর গুড়গুড় শব্দটা প্রবলতর ক’রে তার আড়ালে থেকে শেখরবাবু মন্তব্য করলেন, ‘ছি ছি, শেষটায় জানা গেল ইয়ে,–হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমার খুব মনে আছে সেই কথা, সাত নম্বর কামরা ভাড়া ক’রে ছিল দু’টিতে।’

‘না’ আমার বক্তব্য, ক্রাইসিস ফ্রাস্ট্রেশনের যোগবিয়োগ কষে সমাজ-বিজ্ঞানীরা আধুনিক সমাজের যে চিত্রই আঁকুন, আমরা তো চোখের ওপর দেখছি আমাদের আধুনিক সমাজটা কি দাঁড়িয়েছে, কেমন এর চেহারা হচ্ছে দিন দিন,–রেসিডেন্সিয়্যাল হাউসের অভাব, দুর্ভিক্ষ, বেকারসমস্যা তো আছেই, এদিকে এই ডামাডোলের বাজারে ভাল মন্দ, ইতর ভদ্র, শিক্ষিত অশিক্ষিত সব মিশে জগাখিচুড়ি হয়ে যাচ্ছে আমাদের এই লোয়ার মিডল ক্লাস সোসাইটি। কার ভিতরে কি আছে, কেমন প্রকৃতি, বাইরে থেকে বোঝার আর উপায় নেই।’

‘যা বলেছ।’ হোমিওপ্যাথ শেখর বারো নম্বর ঘরের জানালার দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে।’সেই যে, এক নম্বরে গেল বার খুলনা না রংপুরের একটা ফ্যামিলি এসেছিল,–ছি ছি, কী কেলেঙ্কারী ক’রে গেল শেষ পর্যন্ত–হ্যাঁ, অভাব আছেই, কিন্তু স্বভাবটাকে বাদ দিলে চলবে কেন। বাপ তো মোটামুটি রকম একটা চাকরি করত, অবশ্য পুষ্যি অনেক ছিল, বড় ফ্যামিলি, কিন্তু বড় ছেলেটা কী জঘন্য কাজ ক’রে গেল!’

রংপুরের পরিবারের দুষ্কৃতকারী জ্যেষ্ঠ পুত্রের কথা মনে করে স্কুলমাস্টার বিধু মুখাবয়ব অতর্কিতে গম্ভীর ক’রে ফেলল। ‘হবেই, এ বাড়িতে আড়াল বলে কিছু নেই। উঠোনে দাঁড়ালে সবগুলো ঘরের ভিতর দেখা যায়। এতগুলো পুরুষ স্ত্রী ছেলেমেয়ে। একটা পাতকুয়া, দেড়খানা পায়খানা। হামেশা এর ওর গায়ে ধাক্কা লাগছে।’

‘আমি ঠিক ক’রে ফেলেছি, সুবিধে পেলে এ-বাড়ি ছেড়ে দেব। এখানে কোনো ভদ্রলোক থাকতে পারে না। ‘

হোমিওপ্যাথ শেখরবাবুর গলার স্বর হুঁকোর শব্দকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে দেখে বিধু মাস্টার হিস্ হিস্ ক’রে উঠল। ‘আস্তে, আস্তে, শুনবে যে!

‘একি আর গেরস্ত বাড়ি বলা চলে, আমি বলব হোটেল। হোটেলবাড়ি বারোখানা কামরা। হ্যাঁ, এখানে সবাই মফস্বলের হোক, কোলকাতার হোক, যথেষ্ট শহুরে হাওয়া গায়ে মেখে বিপদে প’ড়ে এসে টিনের ঘরে বাসা বেঁধেছে। বা-বা! দেখছো তো, পাউডার সাবান এসেন্স-এর অভাব যাচ্ছে কখনো! কি সিনেমা দেখার, রেস্টুরেন্টে যাওয়ার! নামে বস্তি। কিন্তু কোনো কোনো ঘরে প্রগতির ঠেলা বড় শহরকে হার মানিয়ে দেয়।

‘থাক থাক।’ ঠাণ্ডা বিধুমাস্টার উত্তেজিত হোমিওপ্যাথকে শান্ত করে। ‘তোমার প্রাক্‌টিস্ ভাল, পয়সা আমদানী হচ্ছে, ভাল জায়গায় চলে যাও। বিপদ তো আমার,–আমাদের। এতগুলি মুখ। এই আয়।’

এরা দু’জনেই বারো নম্বর ঘর দু’দিনও খালি প’ড়ে রইল না, আবার নতুন ভাড়াটে এসে গেল দেখে উত্তেজিত বিক্ষুব্ধ হয়ে আছে।

জলের অভাব। জায়গার অভাব। চলাফেরার অসুবিধাই বা কি কম। একটি মানুষ চলে গেলে মনে হয়, অনেকখানি জায়গা ফাঁকা হ’ল। একটি লোক বাড়লে মনে হয়, পরমায়ু আরো কয়েক ঘণ্টা কমল।

শুধু কি জল জায়গার অভাব!

মনের অপ্রশস্ততা হিংসা কলহ নিন্দা পরচর্চা কুৎসা কদর্য স্বভাব এ-বাড়ির বাতাস ভারী ক’রে রেখেছে। এখানকার মানুষ মানুষই নয়। একজন আর একজনেরটা চোখে দেখছে বলেই এ অবস্থা, পর্দা নেই বলেই এত বিপদ!

শিবনাথ ও রুচির আবির্ভাবের পর সন্ধ্যা থেকে ফিফিস্ ক’রে দুই বন্ধু এই সব আলোচনা করছিল। আর বারো নম্বর ঘরের জানালা দিয়ে দেখছিল শিবনাথ ও রুচি কি করছে।

রুচি সব ছেড়েছে, কিন্তু সেকেন্ডহ্যান্ড স্টোভটা আজও আঁকড়ে ধরে আছে। সেটাই এখন খুব বেশি কাজে লাগল।

শিবনাথ একটু ঝাড়পোঁছ ক’রে বিছানা করে মঞ্জুকে শুইয়ে দিল। বেচারার সেই কখন থেকে ঘুম পেয়েছে। না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল ব’লে রুচির কম দুঃখ হচ্ছিল না। মাঝখানে এসে রুচির কাজে সাহায্য করে দিয়ে গেল কমলা এবং আরো কে দু’ তিনটি মেয়ে। শিবনাথ বাইরে চলে গেল সিগারেট কিনতে। তার সিগারেট ফুরিয়েছিল অনেকক্ষণ।

রুচি রান্না করছিল। আর জানালার বাইরে অপেক্ষা করছিল অনেকগুলো মেয়েমুখ। অর্থাৎ তারা জানতে চাইছে, কোথা থেকে এল এই পরিবার, কি বৃত্তান্ত।

কেননা সকলের আগে এটা জানাজানি হয়ে গিয়েছিল রুচি বি-এ পাস। এ বাড়ির আর কোনো মেয়ের এত শিক্ষা নেই। নবাগত বস্তিবাসিনী সম্পর্কে তাদের কৌতূহলটা তাই বেশি।

রুচি বলল, ‘আপনারা ঘরের ভিতর আসুন। উনি বেরিয়ে গেছেন।

তা ক’জনই বা এসে ভিতরে দাঁড়াবে। এইটুকুন ঘর। কমলা একজন একজন ক’রে সকলকে ভিতরে ডেকে পরিচয় করিয়ে দিলে! এর নাম সুনীতি, ডাক্তারবাবুর মেয়ে, ভাল গান গাইতে পারে; এর নাম মমতা, বিধুবাবুর মেয়ে, কবিতা লিখতে পারে; এর নাম বেবি, নাচতে পারে।

‘তোমার পুরো নাম কি বেবি বলো।’ সুন্দর চেহারার মেয়েটির চিবুক ধরে আদর করে কমলা বলল।

‘আমার নাম বেবি গুপ্ত।’

‘কোন স্কুলে পড়?’ রুচি প্রশ্ন করল।

‘এখন পড়ি না, নাম কাটা গেছে। লরেটোতে পড়তুম।’

‘কেন নাম কাটা গেল?’

‘বাবার চাকরি নেই।

‘কোথায় থাকতে, কোলকাতায়?’

‘পার্ক স্ট্রীট।’

‘তোমার বাবা কি করতেন, কোথায় চাকরি করতেন?’

‘একটা বড় মার্চেন্ট ফার্মে। বাবার চাকরি গেছে ব’লেই আমরা বস্তিতে এসে ঢুকেছি।’ বলে মেয়েটি মুখ কালো করল।

‘যাকগে।’ কমলা বেবিকে দরজার বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে লম্বা বেণী-পরা আর একটি মেয়েকে ভিতরে টেনে এনে দাঁড় করালো। ‘নাম অদিতি। আট নম্বর ঘরের। এর দাদা ফ্যাক্টরিতে কাজ করে।–এর বাবা বাস-কন্ডাক্টর, নাম মুকুল,–এটি পাঁচি, ওর বাবা মোড়ে ছোট্ট একটা সেলুন দিয়েছে, নাম–তোমার নাম কি বলো?’

‘ঢেঁপী।’

‘তোমার?’

‘ময়না।’

কমলা বলল, ‘এর বাবা ফেরিওয়ালা। আগে বড়বাজারে ভাল ফলের কারবার ছিল, ফেল ক’রে এখানে এসে সাবান-টাবান বিক্রি করছে।’

আর আছেন একজন শিক্ষক এবং পাশের ঘরে থাকেন শেখর ডাক্তার, হোমিওপ্যাথ। এই অঞ্চলে এসে তার হাতযশ হয়েছে। আগে ছিলেন পাকিস্তানে।

রুচি রান্না শেষ করে অন্য কাজে হাত দিতে তারা সরে গেল।

কমলাও বিদায় নিল।

‘মশাই! আমরাও রিফুইজী ছাড়া আর কিছু নয়।

মুদির দোকানের সামনে বিছানো বেঞ্চিটা একরকম ফাঁকা ছিল ব’লে বিশ্রাম করতে শিবনাথ বসেছে। ওপাশে বসা এক ভদ্রলোক দেশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে বিড়ি ধরাতে ধরাতে বললেন, ‘মশাই, কোথায় থাকতেন এর আগে?’

‘কোলকাতায়; মুক্তারামবাবু স্ট্রীটে। ভয়ে ভয়ে বলল শিবনাথ। বলে চুপ ক’রে গেল।

‘আবার চুপ ক’রে রইলেন কেন’, ভদ্রলোক যেন বিরক্ত হয়ে বিড়িটা ঠোঁটের কাছে নিয়েও টানেন না। ‘নানা স্ট্রীটের বাবুরা এই টিনের ঘরে এসে মাথা গুঁজছে। লজ্জার কিছুই নেই, বলুন, কি সার্ভিসে ছিলেন?’

শিবনাথ ঘাড় নেড়ে লোকটির দিতে তাকিয়ে রইল। দোকানের সামনে আর কেউ দাঁড়িয়ে নেই। অন্য খদ্দেররা চলে গেছে। দোকানে একটা বাক্সের ওপর ব’সে একটি লোক, শিবনাথ অনুমান করল, এরই দোকান। পুরু চশমা চোখে কেরোসিনের বাতির নিচে মাথা গুঁজে হিসাব লিখছে।

‘কি বলো, বনমালী! এখানে এসে যদি পরিচয় মানে পূর্বের নামধাম চাকরি বলতে লজ্জা করে তো পরে বাকি কাজগুলোর লজ্জা ঢাকতে অনেক কাঁথা-কম্বল জড়াবার দরকার পড়বে যে, হে-হে ভুল বলেছি?’

বনমালী তৎক্ষণাৎ মাথা তুলে এবং পুনঃ পুনঃ সেটি নেড়ে জানাল, ‘না ভুল নয়। কে. গুপ্ত কখনো ভুল বলে না।’

‘কে ইনি?’ শিবনাথ সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে এবার মুদির দিকে তাকায়।

‘আপনি মুক্তারামবাবু স্ট্রীটে থাকতেন, উনি ছিলেন পার্ক স্ট্রীটে সাহেবের সঙ্গে ফ্লাট ভাড়া করে। দাস দাসী ছিল, আর্দালি ছিল, আর উঠতে বসতে গাড়ি।’ বনমালীও একটা বিড়ি ধরায়। ‘তা চাকরি গেলে ক’টি বাঙালীর ছেলে খাড়া থাকে,–কই আমার তো চোখে পড়ে না, আমি দেখিনি। এখন বুঝুন সেই কে. গুপ্তকে আজ আঠারো টাকার ঘর ভাড়া করে থাকতে হচ্ছে মশাই; লজ্জার কিছুই নেই। সব সমান এখানে।

শিবনাথ, যেন এইবার লজ্জা ভাঙ্গল, এমনভাবে বেঞ্চির ওপাশে বসা ভদ্রলোকের দিকে আবার তাকাল।

‘হাজার টাকার ওপর তার মাইনে ছিল।’ বনমালী আরো পরিচয় দিলে কে. গুপ্তর। শিবনাথের প্রতিবেশী, প্রতিবেশী বা কেন, এক বাড়ির লোক। হয়তো তার পাশের ঘরেই এসে আজ শিবনাথ উঠেছে।

‘বিলিতী মার্চেন্ট অফিস যখন ঠেলা দেয় আকাশে ওঠে। যখন পড়ে তখন কি ভাঙ্গে, কি যায় তার হিসাব থাকে না। কত মূল্যবান রত্ন রাস্তায় ড্রেনে ডাস্টবিনে গড়াগড়ি যাচ্ছে। হ্যাঁ–এই গুপ্তের সই না হলে অত বড় অফিসটার পাঁচশ কর্মচারীর মাসের মাইনে আটকে থাকত। আজ তার সইয়ের এক পয়সা মূল্য’ নেই।’ বনমালী থামল।

‘থামলে কেন, বলো, বলে যাও বনমালী।’ কে. গুপ্ত বনমালীর দিকে না তাকিয়ে আবার একটা বিড়ি ধরায়। ‘একটা সই দিয়ে পাঠানো হয়েছিল সন্ধ্যেবেলা। আধ পয়সার চা ধার দেয়নি বনমালী পোদ্দার কে. গুপ্তর মেয়েকে বিশ্বাস ক’রে। অথচ এমনি দু’জনে বন্ধুত্ব কম কি।’

কে. গুপ্তর কথা শুনে বনমালী একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ও কতক্ষণ চুপ থেকে নিজের হিসাব দেখতে লাগল।

শিবনাথ দু’জনকেই মনোযোগ দিয়ে দেখছিল।

একটু পর বনমালী মুখ তুলে আর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘কি করব রে দাদা, আধপয়সার এই ধরো, ফোড়নও ধার দিতে আরম্ভ করেছি কি কাল এই যে এখন নিরিবিলিতে বসে তোমাদের সঙ্গে গল্প করছি, আরাম পাচ্ছি, তাও পাব না। দিনের বেলায় মাছির যন্ত্রণা বসতে পারি না–রাত্রে ধারে ফোড়ন নেবার খদ্দেরের ঠেলায় আমার প্রাণ বেরিয়ে যাবে। ধরে বিক্রি বন্ধ করার কি একটা কারণ গুপ্ত! না হলে তুমি কত বড় লোক ছিলে সে কি আমি জানি না। তাই তো ভদ্রলোককে বলছিলাম। কি লোক কি হয়ে গেল।’

বনমালী অত্যধিক গম্ভীরভাবে কথাগুলো বলায় কে. গুপ্ত আর কিছু বলল না। শিবনাথ, যথেষ্ট আলো না থাকা সত্ত্বেও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নতুন প্রতিবেশীকে দেখছিল। ‘যাকগে’, একটু পর কে. গুপ্তর থমথমে গলার শব্দ শোনা গেল। পাশে শিবনাথ বসে ভ্রূক্ষেপ নেই. ‘বাজে জিনিস নিয়ে তর্ক ক’রে আমি মাথা গরম করতে চাই না। পরশু ড্রাই ডে। যাহোক ক’রে একটা বোতল যোগাড় করার ব্যবস্থা করো। তারপর তুমি আধ পয়সার চা কি এক পয়সার নুন কাউকে ধার দেও না দেও বয়ে গেল।’

শিবনাথ বনমালীর দিকে তাকাতে বনমালী বোঝায়, ‘না, লজ্জা করবার লুকোবার কিছু নেই, মশাই। এখানে সবাই সবারটা জানছে দেখছে, না-জানানো না-দেখানোটাই খারাপ। কিন্তু জানছি বলেই আর দশটা লোককে এ-পাড়ার যে চোখে দেখছি কে. গুপ্তকে সেই চোখে দেখি না, দেখতে বুকে বাজে। এখানে কি কোনো শালা জানে যে, এই এমন সময় হলে এই লোক বন্ধুবান্ধব নিয়ে চৌরঙ্গির হোটেল গরম করে রাখত। দু’হাতে টাকা রোজগার করেছে, দু’হাতে খরচ করেছে, সে আর কথা কি। আজ পা ভেঙ্গে হাতি খানায় পড়েছে।

‘বলো থামলে কেন, বনমালী।’

‘তার রোজ বিকেলের জলখাবার ছিল পাঁচ ছ’টাকা।’ বনমালী শিবনাথকে শোনায়। ‘আজ জলযোগ সেরেছে মুদির দোকানের বেঞ্চিতে বসে দু’পয়সার তেলেভেজায়।’

‘থামিস কেন বনমালী, বলে শুনিয়ে দে আমার মুক্তারামবাবু স্ট্রীটের বন্ধুকে।’ বলে কে. গুপ্ত হঠাৎ এমনভাবে শিবনাথের দিকে তাকিয়ে গুজ গুজ করে হেসে উঠল যে শিবনাথ না হেসে পারল না।

‘তাই প্রশ্ন করছিলাম মশাই, বড় যে সাধ ক’রে পারিজাতের চিড়িয়াখানায় এসে সপরিবারে প্রবেশ করেছেন, গত বছর ক’টা কলেরা কেস হয়েছিল এ-বাড়িতে তার খবর রাখেন? এ বাড়িতে যক্ষ্মারুগী আছে, আরো কতো কি খারাপ রোগ আছে। মানুষ? চোর বদমাশ গুণ্ডা পকেটমার লোফার ইনফর্মার পাগল–

‘থাক থাক।’ বনমালী একটা হাত তুলে গুপ্তকে চুপ করতে বলল, এ-সব বলে আর কি হবে,–তা কি আর ইনি জানেন না। এতকাল মুক্তারামবাবু স্ট্রীটে ছিমছাম নিরিবিলি কামরায় বৌ বাচ্চা নিয়ে সুখের রাজ্যে ছিলেন। এখানে বারোটা পরিবার। পাঁচটা লোক ভাল, সাতটা লোক ইতর বদমায়েশ থাকবেই।’

বনমালীর কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে আর একজন এসে দাঁড়াল। গায়ে গেঞ্জি। হাতে হুঁকো।

‘নমস্কার, ডাক্তারবাবু।

বনমালীর দিকে তাকিয়ে ঈষৎ মাথা নেড়ে আড় চোখে বেঞ্চিতে বসা কে. গুপ্ত ও শিবনাথকে একবার দেখে আগন্তুক শেষটায় শিবনাথের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ‘আপনি এই এলেন বুঝি!

‘হ্যাঁ।’

‘ভাল, ভাল মানুষ মানুষের সঙ্গ ভালবাসে, সমাজবদ্ধ জীব, এ আর অন্যায় কথা কি।’ বলে শেখর ডাক্তার চোখ বুজে হুঁকোয় দুটো টান দিয়ে পরে গলার একটা অদ্ভুত শব্দ করে, হাসল কি কাশল বোঝা গেল না, শিবনাথের দিকে তাকিয়ে বলল ‘আপনার মশারি ফশারি আছে তো?’

শিবনাথ ঘাড় নাড়ল।

আপনারা সবাই টিকা ফিকা নিয়েছেন তো?’

‘হ্যাঁ, আসবার আগে তিনজনেই আমরা টিকা নিয়ে এসেছি।’ শিবনাথ ঢোক গিলল। ‘সাবধান।’ হুঁকোয় আবার দুটো টান দিয়ে ডাক্তার বলল, ‘এ-বাড়ির কিছুই বিশ্বাস নেই। এখানে যে বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে বেঁচে আছি এটাই জগদম্বার কৃপা।’ ·

কে. গুপ্ত নীরব।

বরং মনে হ’ল ডাক্তারের কথায় কান না দিয়ে আকাশের তারা দেখছিল। অদূরে একটা গাছের ডালে বাদুড়ের পাখার ঝপট্ শব্দ শোনা গেল। শেখর ডাক্তারের পাশে এসে দাঁড়াল বিধু মাস্টার। ‘আপনি নতুন এলেন?’

শিবনাথ ঘাড় নাড়ল।

‘আর কোথাও ভাল ঘরটর পেলেন না বুঝি?’

শিবনাথ মাথা নাড়ল।

মাস্টার এবার ডাক্তারের দিকে তাকায়। ‘অথচ দ্যাখো ডাক্তার, নিত্য ভাড়াটে জুটছে। একবেলা একটা ঘর তুমি খালি পড়ে থাকতে দেখছ না, কিন্তু কই, বাড়িতে পাতকুয়োটার সংস্কার করার কথাটা পারিজাত কানেই তুলছে না, সরকার শালাকে মাস শেষ হতে দিব্যি রসিদ বই দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছে ভাড়াটি আদায় করতে। বলি আমরা কি মানুষ না, এতগুলি লোক! একটা কল। এইরকম কাণ্ড কেউ দেখেছে কখনো! ইলেকট্রিক আনবে আনবে করে আজ দু’ বছর ঘোরাচ্ছে।’

‘তোমরা বলতে জান না তাই আদায় করতে পার না। বলার মত করে বললে পারিজাতের বাবার সাধ্য আছে বাড়তি পাইপ না বসিয়ে, কি আলো না আনিয়ে দেয় বাড়িতে। মাস মাস এতগুলি ভাড়ার টাকা পাচ্ছে। তা-ও আগাম। শেয়াল চরত রায়সাহেবের এই জমিতে শুনেছি ওয়ারের পরেও। এখানে ইমপ্রুভমেন্ট! পঞ্চাশ বছর বাকি। তা কিছু টিনটালি খরচ করে কোনো রকমে একটা খোঁয়াড় তৈরি করে দিয়ে পতিত জমি থেকে বেশ মোটা আয় হচ্ছে। করবে বৈকি একটার জায়গায় দুটো কল, আরো দুটো করে পায়খানা তৈরি করে দেবে, দিতে বাধ্য যদি আজ সব একজোট হয়ে ভাড়াটা বন্ধ করে দাও।’

ডাক্তারের এই কথায় মাস্টার একটু ক্ষুণ্ণ হল। ‘যা হবার নয়, তা তুমি বলছ কি করে। বারো ঘরের মধ্যে তুমি আমার দুটি ঘর দেখাও একরকম ভাবে হাঁটে, কথা বলে, খায়, কি একরকম কাজ করে। তুমি ডাইনে চললে আমি বাঁয়ে চলবই। তুমি যদি বল, জলের জন্য রেন্ট বন্ধ কর, আর একজন তৎক্ষণাৎ উত্তর দেবে, না, তার আগে চাই লাইট। এটা, বস্তি হলেও ভদ্রলোকের বস্তি। এখানে লেখাপড়া করার রেওয়াজ আছে। ছেলেমেয়েরা ইস্কুলে পড়ছে, ভাড়া বন্ধ করতে হয় আগে আলোর জন্য করব!’

বিধু মাস্টার চুপ করে রইল।

‘এখানে সবাই ভাবছে আমার কথা সকলের আগে থাকবে এবং সবার ওপরে। সবাই মাতব্বর।’

কথাগুলো না আবার কাউকে প্রকাশ্যভাবে ডাক্তার বলতে শুরু করে, যার অর্থ কলহসৃষ্টি, এই বাড়ির কয়েক সহস্র কলহ বিধু মাস্টার দেখে এসেছে। তাই একটু ভীরু গলায় বলল, ‘থাক গে। তুমি আমি চেঁচালে কি হবে। চল ওদিকটায় ঘুরে আসি। বাড়ি ঠাণ্ডা হতে রাত বারোটা।’ বলতে বলতে হাত ধরাধরি ক’রে দু’জনে দোকানের সামনে থেকে সরে পড়ল।

‘এ দু’টো হল আসল বজ্জাত, বুঝলি বনমালি। আমি সব দেখি, দেখে চুপ ক’রে থাকি। ভাবি কি হবে ব’লে। খামোকা কথা সৃষ্টি হবে কতকগুলো। কে ভাড়া দিচ্ছে কে দিচ্ছে না, কার দেবার ক্ষমতা কবে বন্ধ হবে—ওরা ভয়ানক টের পায়, ওরা এবং ওদের পরিবারে দু’টো। বাচ্চাগুলো পর্যন্ত বোঝে কার আর্থিক ক্ষমতা কতটা। সারাদিন এই ক’রে ঘুরে বেড়ায়। ব্যস, তারপর সোজা চলে যায় পারিজাতের বাংলোয়। গিয়ে বলে আসে, অমুকের একটা রেন্ট আটকে গেলে নোটিশ দিয়ে তুলে দেবেন। দু’বার চান্স নিতে গেলে ঠকতে হবে; কেননা, ঘরের মানুষগুলো ছাড়া এমন জিনিস নেই যে, সব বিক্রি করলেও দু মাসের ভাড়া উঠবে, কাজেই।’

জায়গাটা অন্ধকার থাকলেও শিবনাথ, কেদার গুপ্তর চোখ দু’টো, চোখের ভিতর পর্যন্ত বেশ দেখতে পাচ্ছিল। পরনে ছেঁড়া মতন পায়জামা। গায়ে কমদামী একটি গরম কোট। অনেকদিন চুল কাটছে না, দাড়ি বড় হয়েছে গালের। ‘আর বাকি যে ক’ঘর আছে, সেগুলোকে ছাগলও বলতে পারিস, মেষও বলা চলে। বৌগুলি কিন্তু দেখতে খুবসুরত। দু’টোই কাজে বেরিয়ে যায় সেই কাক-ভোরে, ঘরে ফেরে দুই দণ্ড রাত করে। একটা বুঝি স্টেট্ বাস-এর কন্ডাক্টর। ছুটির দিন হলেই সেজেগুজে বৌ নিয়ে কলকাতায় চলল মরদ সিনেমায়, রেস্টুরেন্টে খেতে। সব করতে রাজী আছে ওরা, কিন্তু ছুটির দিন বৌকে নিয়ে বেড়ানো বন্ধ রেখে জল বাতি নর্দমা পায়খানা মশামাছি থুথু নিয়ে মিটিং করবে না। এই দায় বুড়োদের ওরা জানে, তাদের স্টপ করতে বললে স্টপ করবে, চলতে বললে চলবে। এর বেশি কিছু করবে না। কাজেই–

কেদার গুপ্ত খসখসে গলায় হাসল। শিবনাথ হেসে গুপ্তর কথা সমর্থন করল।

‘কাজেই রাতদিন জল কল পায়খানা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছে এই বুড়ো শালিক দু’টো। এরাই এখানকার, মানে পারিজাতের বাবার চিড়িয়াখানার, পুরোনো জীব। হাজার অসুবিধা ভোগ করলেও বস্তি ছাড়বে না; কেননা, অন্য জায়গায় গিয়ে এমন বিনি পয়সায় জল কল পায়খানা নিয়ে পলিটিক্স করতে পারবে না। একটু বয়স হলে মানুষ পলিটিক্স করতে চায়, ডাক্তার আর মাস্টার হ’ল তার নিকৃষ্টতম দুষ্টান্ত। বস্তি এখন ওদের রাজনীতির এক নম্বর ফিল্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

হিসাবের খাতা থেকে বনমালী মাথা তুলল।

‘কিন্তু হিসাব এখনো বাকি রয়ে গেল গুপ্ত। মাস্টার, ডাক্তার, বাস-কন্ডক্টর আর ফ্যাক্টরির দুই ছোকরাকে নিয়ে হ’ল পাঁচ ঘর। এক ঘরে তুমি আছ, এক ঘরে এসেছেন আজ এই ভদ্রলোক।’ চিবুক নেড়ে ইঙ্গিতে শিবনাথকে দেখিয়ে বনমালী বলল, ‘আর? পারিজাতকে গিয়ে সাহস করে দু’কথা শোনাতে পারে এমন আর আছে কেউ?‘

‘পাঁচু ভাদুড়ী আছে এক ঘরে।’

‘সেই সেলুনওলা?’

কে. গুপ্ত মাথা নাড়ল।

‘মানুষের ঘাড় চেঁছে ব্যাটা দু পয়সা করছে শুনলাম। অথচ বস্তিটা ছাড়ছেনা তো,’বনমালী বলল।

শালা এক নম্বরের খুনি, পয়সা করবে না কেন?’ কে. গুপ্ত বলল, ‘আমি আর ওর দোকানে এখন চুল কাটতে যাই না।

‘কেন, ধারের খদ্দের নেয় না বুঝি পাঁচু?’

‘সেকথা হচ্ছে না। শালার ক্ষুরের ভয়ানক ধার। চুলের সঙ্গে ঘাড়ের মাংস তুলে ফেলে। নগদের কারবারেরও।

‘বলে কি?’ বনমালী অবাক হয়ে শোনে

‘চামার, এক নম্বরের চামার।’ গুপ্ত লম্বা চুলে হাত বুলিয়ে বলল, ‘আমার চুল কি আর কাটা হবে না, হবে, কিন্তু সেদিন ন্যায্য পয়সা মিটিয়ে দেবার পরও শালা আমাকে ইনসাল্ট করল। কি না,–দোয়ানিটা খারাপ।’

‘কি রকম! তোমার সঙ্গে বুঝি আর বেশি পয়সা ছিল না?’ বনমালী প্রশ্ন করল, ‘পাল্টেট দিতে পারলে না?’

কে. গুপ্ত মাথা নাড়ল।

একটু ভেবে বনমালী বলল, ‘তারপর থেকে বুঝি আর চুল কাটছ না, দাড়ি কামাচ্ছ না। এদিকে আর একটাও সেলুন নেই বটে। হবে, আস্তে আস্তে হয়ে যাবে।’

‘নাঃ।’ গুপ্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ‘সেলুন ছাড়া ভদ্রলোক চুল কাটতে পারে!’

বনমালীও দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

‘আহা, কত বড় সেলুন ছিল, কত আড়ম্বর ক’রে চুল কাটতে, দাড়ি কামাতে পার্ক স্ট্রীটের সেলুন ডি’লুক্সে। সে সব কি আমি জানি না।’

কে. গুপ্ত বলল, ‘থাক, অতীত ঘেঁটে লাভ নেই। কথা হচ্ছে পারিজাতকে গিয়ে দু’কথা বলা নিয়ে। উঁহু, ওই শালা ভয়ানক স্বার্থপর। কারুর জন্যে কিছু করবে না। নিজের সুখসুবিধা ছাড়া।’

‘কেন বাড়িতে জল-কলের সুবিধা হলে সেটা ওরও তো পাওনা হ’ল। পাঁচু ভাদুড়ী বলে কি?’

‘জল-কলে ভাদুড়ীর দরকার নেই। সারাদিন থাকে সেলুনে। রাতে পড়ে থাকে বেশ্যাবাড়ি। পাঁচু ভাদুড়ীর এ-বাড়ির সুখসুবিধা ভোগের সময় কতটুকুন।’

‘জুটেছে সব ভাল।’ বনমালী শিবনাথের দিকে তাকাল। পারিজাতের চিড়িয়াখানার যত সব চিড়িয়া। কিছু মনে করবেন না মশাই, বন্ধুলোক বলে গুপ্তকে ঠাট্টা করছি।’ দাঁত বার করে মুদি হাসল।

‘না আমার মনে করার কি আছে।’ বেশ সতর্কভাবে কথাটা বলে শিবনাথ চুপ করল। ‘থাক গে,’ বনমালী বলল, ‘আর,–কে আছে ভাড়াটে?’

‘বলাই। বড়বাজারে ওর ফলের দোকান ছিল। এখন কাপড়কাঁচা সাবান ফেরি করছে, বেলেঘাটার রাস্তায়। ও নাকি কাল সারাদিন একটাও সাবান বিক্রি করতে পারেনি, আমার কাছে ব’সে তখন কান্নাকাটি করছিল। আর চালাতে পারছে না। এদিকে ঘরে মেয়ে বড় হয়ে আসছে। ডুবছে লোকটা। কাজেই হেন ভাড়াটের আর সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে বাদ-প্রতিবাদ কি। আমার মতই চুপচাপ পড়ে আছে কোনার দিকের একটা ঘর নিয়ে।’

‘তাও বটে।’বনমালী ঘাড় নাড়ল। ‘এরকম অবস্থার ভাড়াটের একটু চুপচাপ থাকাই ভাল।’ কে. গুপ্ত আকাশের দিকে মুখ করে কি ভাবল।

‘সে জন্যেই আমি এসে তোর দোকানের সামনে সারাদিন এই বেঞ্চিটার উপর বসে থাকি বনমালী, যাতে না নিজের এই ক্রাইসিসের মধ্যে আবার ভাড়াটেদের স্ট্রাইক ফাইকের মামলায় জড়িয়ে গিয়ে একটা নতুন বিপদ ডেকে আনি।’

‘তা কি আর আমি বুঝি না–সে ত চোখেই দেখেছি। যাকগে,–বলাইকে নিয়ে দশঘর ভাড়াটে হল। বাকি দু ঘরে কে আছে?’

যেন বনমালীর এবারে প্রশ্নে কে. গুপ্ত বেশি বিরক্ত হল।

‘বাবা তুমি আছ সদরটি আগলে ব’সে। বড়িতে কটা মাছি ঢুকছে, কোন্ মাছিটা কার পাতে বসছে, কে কি দিয়ে ভাত খেয়েছে, সব তুমি জান। নয় নম্বরের প্রীতি বীথি আর এক নম্বর ঘরের ভাড়াটে কমলা কি তোমার দোকানে জিনিসপত্র কিনতে আসে না? এত বড়লোক হয়ে গেছে ওরা, ওদের সব কিছু এখন শহরের দোকান থেকে আসছে বুঝি!

‘অনেকটা তাই’, বনমালী গম্ভীর হয়ে বলল, ‘কমলা মাঝে মাঝে আসে।’

‘করিস তো টেলিফোনে চাকরি দুই বোন। ঘরে পুষ্যি কত!’

‘কমলার কোন পুষ্যি নেই।’ বনমালী বলল, ‘মাইরি নার্স আছে বেশ। কোন ডাক্তার ছোঁড়া নাকি বিয়ে করতে চাইছে। বিয়ে করবে না। বস্তির উন্নতি করবে। তাই এমন ভাল চাকরি করা সত্ত্বেও তোমাদের সঙ্গে সস্তাঘরের ভাড়াটে হয়ে আছে। হা-হা।’

‘তোকে বলেছে নাকি?’ কে. গুপ্ত, নাকে হাসল। ‘কি মশাই, আপনাকে বলেছে নাকি, এই মাত্র তো আপনার সঙ্গে আলাপ-সালাপ হ’ল দেখলাম। কার কথা হচ্ছে বুঝেছেন তো?’

শিবনাথ সলজ্জ হেসে ঘাড় নাড়ল। ‘হ্যাঁ, কমলা, নার্স বুঝি?’

‘হোক, আমি বলব, শী ইজ নো বেটার দ্যান এ বেবুশ্যে’–

‘এই গুপ্ত।’বনমালী ধমক দিল। ‘মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। কেন তোমার এত সব বাজে বকার প্রয়োজন। এক বাড়িতে, ধরতে গেলে এক চালার নিচেই আছ সবাই। বেশ তো, তিনি তো এসেছেনই এখানে, দু’দিন বাস করবেন। কে কি মালুম করার মতন চোখ আছে। নাও ওঠ, এইবেলা দোকানের দরজা বন্ধ করি। কি মশাই আপনি আসতে না আসতে গুপ্তর সাথী হয়ে পড়লেন নাকি?’

শিবনাথের চোখের দিকে তাকিয়ে বনমালী মৃদু হাসল।

‘না এই।’ শিবনাথ হঠাৎ ব্যস্ততার ভাব নিয়ে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করল। ‘বাড়ির ভিতরে খুব চেঁচামেচি, অনেক লোক, এখানে আপনার দোকানের সামনেটা এখন বেশ ফাঁকা। নিরিবিলিতে একটু বসেছিলাম।’

‘না না না।’বনমালী বুঝল শিবনাথ অন্যরকম বুঝেছে। ‘কেন বসবেন না, আপনারা দশজন ভদ্রলোক এখন এখানে বাস করতে আরম্ভ করেছেন দেখে সাহস করে আমিও দোকান করেছি। আসবেন, বসবেন বৈকি। বলছিলুম গুপ্তকে বড্ড বাজে বকে।’

শিবনাথ চুপ করে রইল।

কে. গুপ্ত বোঝা গেল বিড়ি খুঁজতে পকেট হাঁটকাচ্ছে।

সেদিকে তাকিয়ে বনমালী বলল, ‘সেটার কি হ’ল, আর একটা কাজের যে খবর পেয়েছিলে। কোট-পেন্টুলন প’রে সেদিন বেরোলে দেখলাম।’

বিড়ি পাওয়া গেল না। ব্যর্থ হয়ে হাত গুটোল কে. গুপ্ত। ‘হয়নি। হয়নি বলেই তো তোমার পায়াভাঙা বেঞ্চিটার ওপর এসে আজো বসি, আর একটা বাংলা বোতলের জন্য তোমায় বাবা ডাকি।’

কথা শেষ ক’রে গুপ্ত চুপ করে রইল।

সেদিকে দৃষ্টি না দিয়ে বনমালী শিবনাথের দিকে তাকাল। ‘গুপ্তর মতন এমন মন্দ বরাতের লোক আর দুটি দেখলাম না মশাই। কম সে কম, লাখ জায়গা থেকে চিঠি পেয়ে দেখা করতে ছুটে গেছে। হচ্ছে না, কোনোটায় সুবিধা করতে পারছে না। তাই বলছিলাম ভয়ানক সুখের চাকরি ছিল, আজ এই অবস্থা মাথা খারাপ হবে বৈকি। সেজন্যেই এত বাজে বকে।’ কথা শেষ করে মুদি আড়চোখে গুপ্তকে দেখল।

কে. গুপ্তর সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। বেঞ্চি ছেড়ে ওঠারও লক্ষণ নেই। ‘তুই আমায় সতী শেখাচ্ছিস, তুই আমায় মেয়েমানুষ চেনাচ্ছিস। বুঝলি বনমালী, আই হ্যাঁভ্ গট্ এনাফ্। আমার অফিসে আঠারোটা মেয়ে ঢুকিয়েছিলাম। আমি তাদের-চাকরি দিতাম এবং তা খেতেও পারতাম।’

সে কি আর আমি জানি না, তুমি কতবড় একজন বড়বাবু ছিলে।’ যেন একটু ভেবে বনমালী হেসে পরে প্রশ্ন করল, ‘তা ডুবো জাহাজের কাপ্তান না হয় হাত-পা ভেঙ্গে আমার দেকানের সামনে চিৎপটাং হয়ে পড়েছে, মেয়েগুলো এখন করছে কি?’ বনমালী মিটিমিটি হাসল।

‘সাঁতার দিয়েছে। ওরা ভাল সাঁতার কাটতে জানে বলে একটা অফিস ডুবতে থাকলে বেলাবেলি আর একটিতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। দেয় ওদের আশ্রয়। তাই বলে কি আমাকে দেবে?’ কে. গুপ্ত গলার একটা শব্দ করল। ‘তাই বলি, যা জানিস না, যে লাইনে তুই নেই সেই লাইনের খবর তুই আমায় শেখাসনি। চুপ করে থাকবি।’

একবার থেমে গুপ্ত শিবনাথের দিকে তাকায়। ‘দুনিয়া জুড়ে বেকার সমস্যা; কিন্তু যুবতী উপোস থাকছে, মুদি দোকানের সামনে বেঞ্চিতে বসে গাছের পাতা গুনছে, এমন দেশের নাম কি আপনি খবর কাগজে দেখেন মশাই? তাছাড়া আমরা যখন হালে স্বাধীন হয়েছি, প্ৰথম প্রথম এদিকটায় ভদ্রতাটা একটু বেশী করবই। কি বলেন?’

ইঙ্গিতটা বনমালী বুঝল কি না শিবনাথ বুঝতে পারল না, নিজে বুঝে মৃদু হাসল।

কে. গুপ্ত বলল, ‘আই ক্যান ওয়েল ইমাজিন হাউ শী ম্যানেজেস। বুঝেছেন মশাই, ওর হাতে ঘড়ি, মাখন না মেখে পাঁউরুটি খায় না। একটু ফল দুধ ঘরে বসে টুপটাপ চুকচুক করে বেশ চালাচ্ছে। আপনি একদিন উঁকি দিলে দেখতে পাবেন। আমি? ওর মতন মেয়েমানুষের ঘরে,–ও যদি আজ মরে গেছেও শুনি, উঁকি দেব না। উঁকি দেবার দরকার হয় না। বস্তির লোকের সব কিছু চাপা থাকে না। কে কি খাচ্ছে তা লুকোবার ‘জো নেই। খারাপ জিনিস তো বেরোবেই, ভালটাও আপনি খেতে পারবেন না। প্রকাশ পাবে। মাছি? শালা বিধু মাস্টারের বারোটা, ভুবনের ঘরের এগারোটা, ফ্যাক্টরির দু’ ঘরের আড়াইটে ক’রে ধরুন আর ওদিকটায় কারা থাকে? এইটুকুন বাড়িতে সবে হাঁটতে শিখেছে, কথা বলতে শিখেছে ত্রিশটা বাচ্চা মশাই। পিলপিল ক’রে রাতদিন এঘর-ওঘর করছে, আর এর রান্নার খবর এসে ওকে দিচ্ছে, ওর কি কি বাজার এল তাকে গিয়ে তৎক্ষণাৎ তার লিষ্টি দিচ্ছে।’

‘ভালই তো’ বনমালী বলল, ‘গরম মশলা দিয়ে রান্নার রেওয়াজ উঠে গেছে, এখন গন্ধে তরকারী বুঝবার উপায় নেই, কাচ্চাবাচ্চাদের কলরবে সেটা বোঝা গেলে মন্দ কি?’

কে. গুপ্ত বনমালীর কথায় কান না দিয়ে শিবনাথের দিকে তাকাল। ‘সুতরাং খবর আমাদের কানে আসছে। ফল মাখন দুধ ঘি ওবলটিন খেয়ে খেয়ে স্বাস্থ্যটা কেমন তাগড়াই করেছে লক্ষ্য করেছেন তো?’

শিবনাথ একটু আগে দেখা কমলাকে মনে করবার চেষ্টা করল।

বনমালী আর বাক্যব্যয় না ক’রে দোকানের আলো নিবিয়ে দরজায় তালা দিল।

‘যা বললাম ভুলে যেও না’, কে. গুপ্ত বলল।

বনমালী কথা বলল না।

বনমালী চলে যেতে কে. গুপ্ত গলা নামিয়ে শিবনাথকে বলল, ‘ভাবছেন মুদির সঙ্গে কেন আমার এত বন্ধুত্ব? ভয়ানক কাজ দেয় ওকে দিয়ে মশাই। কাল বললে বিশ্বাস করবেন কি, ওর দোকান থেকে তেল নুন ডাল মশলা, বৌ বুদ্ধি ক’রে আমার পুরোনো ফ্লাস্কটা মেয়েটাকে দিয়ে পাঠিয়ে ছটাক দেড়ছটাক ক’রে সবই তো নিয়ে গেল।’

শিবনাথ কে. গুপ্তের চোখের দিকে তাকায়। ‘ঘরের জিনিস বাঁধা রাখে বুঝি বনমালী?’

‘বাঁধা রাখে মানে। তাহ’লে ওর দোকানে যে পাড়ার লোকের ঘরের জিনিসপত্তরে এ্যাদ্দিনে পাহাড় জমত মশাই,–এত সব রাখতো বা সে কোথা? কাজেই বার্টার সিস্টেম। ছাড়িয়ে আনা ফিরিয়ে পাওয়ার প্রশ্ন নেই। মন্দ নয়। বনমালী সঙ্গে সঙ্গে অন্য লোকের কাছে সব বিক্রি করে দেয়।

শিবনাথ চুপ করে রইল।

‘আমার শালা সব গেছে,’ কে. গুপ্ত বলল, ‘ভাতের হাঁড়ি আর জলের ঘড়াটা ছাড়া। আর পরনের একখানা দু’খানা জামা-কাপড়। তা সেদিন ওয়াইফ ভেবে ভেবে শেষটায় যা হোক বার করতে পারল। মানে বেবির একজোড়া সায়া। বাক্সে তোলা ছিল। তা বেবি এখনো শায়া শাড়ি পরতেই আরম্ভ করেনি। জন্মদিনে কোন্ মাসী না পিসী ওকে উপহার দিয়েছিল। যাগে বনমালী শায়া রেখে দেশলাই সাবান এক বোতল কেরোসিন গিন্নির সূঁচসুতো আরো কি কি হাবিজাবী মিলিয়ে সুন্দর এতগুলো মনিহারী মেয়েটাকে দিয়ে পাঠিয়ে দিলে।’ কে. গুপ্ত হা হা করে হাসল। ‘আচ্ছা ব্যবসাদার। আর আপনি চাইলে না পাবেন কি ওর কাছে। বনমালী সব দিতে পারে আপনাকে, পাঁচফোড়ন থেকে আরম্ভ করে কনট্রোলের চাউল, ড্রাই ডে-এর মদ যত বোতল খুশি। ওর এইটুকুন দোকানই দোকান নয়। এটা কারবারের মুখ। শরীরটা এত বড় আর এত বেশি ছড়িয়ে আছে যে চট করে বোঝা যায় না, মালুমই হয় না সাদা চোখে।’

শিবনাথ ঢোক গিলল। কি ভাবছিল সে।

‘লোক খারাপ না।’ কে. গুপ্ত মাথা নাড়ল। ‘পয়সার লোভ বেশি। তা পয়সার লোভে, বনমালীর বলতে গেলে ‘ক’ অক্ষর গো-মাংস, আমাদের শিক্ষিত মহাজনরা এদিনে কম মারাত্মক রকমের ব্যবসা করছে কি, কি বলেন?

যেন অনিচ্ছাসত্ত্বেও শিবনাথ মাথা নাড়ল।

‘কি মশাই আপনি আমার কথায় বিশেষ মনোযোগ দিচ্ছেন না।’ যেন টের পেয়ে কে গুপ্ত হঠাৎ চুপ করল।

‘শুনছি বই কি।’ শিবনাথ বলল, ‘ক’টা বাজে?’

‘ও আপনার বুঝি হাতঘড়ি নেই? আমারটাও শালা গেছে অনেকদিন। তা দশটা হবে। যান আপনি ঘরে যান, নতুন জায়গায় এসেছেন, আপনার স্ত্রী আবার ভাবছেন হয়তো আমায় বস্তিতে ঢুকিয়ে লোকটা পালাল কোথায়।’ শিবনাথ এবার নাকে হাসবার চেষ্টা করল।

‘আপনি বুঝি এখানে বসে থাকবেন?’

‘আমি শালা চব্বিশ ঘণ্টাই এখানে পড়ে আছি। বনমালীর দরজায় ধন্না দিয়ে আছি, কেননা কসাই হলেও ও আমার শুকনো দিনে গলাটা ভেজায়। প্রকৃত বন্ধুলোক। তা ছাড়া, বাড়িতে ঢুকতে ইচ্ছা করে না। ওই মশাই ডাক্তারনীর দরুন। হ্যাঁ, এই যে এখন এসেছিলেন রোগা টিঙটিঙে শেখর ডাক্তার হোমিওপ্যাথ। সবচেয়ে বেশী ঝগড়াটে ডাক্তারনী আর সব চেয়ে চড়া ওর গলার আওয়াজ। উঃ মাথা ধরে যায় প্রভাতকণার চিৎকারে। তাই তো পালিয়ে এখানে চলে আসি মশাই, আপনার হয়তো শুনতে ভাল লাগবে, জানি না। আমার আয়ু অর্ধেক কমে গেছে ওর চিৎকার শুনেই।’

শিবনাথ বলল, ‘আমি চলি।’

‘না আপনি যান। আপনার ওয়াইফ ছেলেমানুষ।’

শিবনাথ বস্তির দিকে এগোতে এগোতে অনুমান করল কে. গুপ্তর বয়স কত, তাঁর স্ত্রী দেখতে কেমন, কত বয়স হবে। ‘আপনার ওয়াইফ ছেলেমানুষ।’ গুপ্তর কথাটা শিবনাথ মনে মনে আওড়ায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *