রামায়ণের সহজ আবেদন
বেদ ভারতবর্ষের ব্যাপক জনসাধারণের ধর্মগ্রন্থ নয়, তা হল রামায়ণ ও মহাভারত। এ দেশে গত দু’হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে মানুষ তার সংকটের মুহূর্তে যে গ্রন্থ থেকে দিকনির্দেশ খুঁজছে তা হল এই দুটি মহাকাব্য। অতএব এর পর্যালোচনার দাবিটি উপেক্ষা করা যায় না।
দুটি মহাকাব্যেরই পরিণতি এসেছে একটি বড় মাপের যুদ্ধের পরে। অপহৃত সীতাকে উদ্ধার করবার জন্য রাম-লক্ষ্মণ বানরসেনার সাহায্য নিলেন। বন্ধুত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বানররাজ সুগ্রীব তাঁর অনুচরদের ভিন্ন ভিন্ন দিকে পাঠিয়ে সীতার সন্ধান করলেন, এবং পরে রাম লক্ষ্মণের সঙ্গে সসৈন্যে গিয়ে সমুদ্রে সেতুবন্ধ নির্মাণ করে অন্যপারে লঙ্কায় উত্তীর্ণ হলেন। বানরসেনা কিন্তু সম্পূর্ণ নিরস্ত্র, যা অস্ত্রশস্ত্র তা ওই রাম লক্ষ্মণ দু-ভাইয়ের। তারই বা পরিমাণ কত হতে পারে? হনুমান যখন লঙ্কায় গিয়ে ঘুরে সব দেখছিলেন তখন কিন্তু একটি সমৃদ্ধ রাজ্যের রাজধানীর সমস্ত সম্ভার এমনকী প্রচুর যুদ্ধাস্ত্র ও যুদ্ধের উপকরণ সেখানে দেখতে পেয়েছিলেন।[১] যুদ্ধে রাক্ষসসেনা সুশিক্ষিত ও সশস্ত্র মানুষ সেনার মতোই লড়াই করেছিল। অযোধ্যায় সামরিক প্রস্তুতি ও সাজসজ্জা যে রকম, লঙ্কাতেও ঠিক সেই রকমেরই ছিল। ব্যতিক্রম বানর সেনা; যারা নিরস্ত্র, শুধু হাতে পাথর ছুঁড়ে, গাছ উপড়ে ফেলে যুদ্ধ করেছিল। রামের সেনা বলতে এরাই। শিক্ষিত রাক্ষসসেনা হেরেছিল এই নিরস্ত্র বানরসেনা এবং দুটিমাত্র অস্ত্রধারী যোদ্ধা— রাম, লক্ষ্মণের কাছে। এই সাংঘাতিক অসম যুদ্ধে একটা অতিলৌকিক উপাদান থাকবেই এবং ছিলও। গন্ধমাদন পর্বত বয়ে নিয়ে আসা এবং সেখানকার ভেষজ বিশল্যকরণীর সাহায্যে যুদ্ধে প্রায়-পরাস্ত হতচেতন লক্ষ্মণের জ্ঞান ফিরে আসে। যুদ্ধে মায়া-সীতা দেখানো, রামের মুণ্ড দেখানো এবং নানা মুনিঋষি এবং দেবতাদের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ, এ সবই অলৌকিক ঘটনা।
বিস্তর অলৌকিক ঘটনা সারা রামায়ণ জুড়েই আছে। গল্পের শুরু ঠিক রূপকথার মতোই: এক রাজা, তাঁর তিন রানি, রাজার হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া, কিন্তু রাজার ছেলে হয় না। ছেলে যে হল সে-ও রূপকথারই মতো অলৌকিক শক্তির সাহায্যে। তার পর কিশোর রাম-লক্ষ্মণকে নিতে এলেন বিশ্বামিত্র। তাঁর আশ্রমে রাক্ষসরা বেজায় দৌরাত্ম্য করছে, তাদের ঠেকাতে হবে। প্রথমত, রাক্ষসরা ভয়ানক শক্তিশালী জীব, তাদের হারাতে নিয়ে যাওয়া হল দুটি কিশোরকে। পথে অহল্যার কাহিনিতে দেখানো হল রাম সাধারণ মানুষ নন। যাই হোক, বিশ্বামিত্রের আশ্রমে রাক্ষসদের হারানো, এও প্রায় অলৌকিক ঘটনারই পর্যায়ে পড়ে। তার পরে বিয়ে। ওই কিশোরই হরধনু ভাঙল, যা বড় বড় বীর পারেনি। বিয়ের কিছুকাল পরেই যৌবরাজ্যে অভিষেকের সময়ে সব কিছু ভেস্তে গেল কৈকেয়ীর আবদারে: কবে তাঁর সেবায় সন্তুষ্ট হয়ে দশরথ দুটি বর দিয়েছিলেন, সেই সুবাদে রামকে বনবাস দিয়ে ভরতকে রাজা করার দাবি তুললেন কৈকেয়ী, এবং পূর্ব প্রতিশ্রুতির দায়ে রাজাকে তা-ই করতে হল। এখানে রূপকথার অন্য একটি আনুষঙ্গিক অংশ জুড়ল; রাজার ছেলে বনবাসী হল। এটা বহু রূপকথায় ঘটেছে।
রাম, লক্ষ্মণ ও সীতা বনে গেলেন। এখানে তাঁদের জীবনের দুটি অংশ: এক, দৈনন্দিন জীবনে ক্লেশ, কুঁড়ে ঘরে বাস, ফল পাকুড় এবং শিকারের মাংসে দিনযাত্রা নির্বাহ। এর অবশ্য একটি কাব্যিক দিকও আছে। কিন্তু বনে কখনও বাঘ সিংহ তাঁদের আক্রমণ করেনি, সাপ-বিছে কামড়ায়নি। এত অহিংস জঙ্গল বাস্তবে মেলে না। দ্বিতীয়ত, এখানে ওই সদ্য তরুণ দুটি রাজপুত্র, ধনুর্বাণ, বর্শা, তরবারি দিয়ে হাজার হাজার ভয়ংকর রাক্ষসকে প্রায়ই মেরে ফেলতে লাগলেন। এ অংশটা স্পষ্টতই অলৌকিক। যদি মনে রাখি যে, আদিকাণ্ডের প্রথমার্ধ ও উত্তরকাণ্ড বাদে বাকি অংশটাই আদি রামায়ণ এবং এ অংশে রাম বিষ্ণুর অবতার নন, ‘নরচন্দ্রমা’,[২] তা হলে সামান্য অস্ত্রে দুটি তরুণের হাতে প্রচণ্ড শক্তিশালী অগণ্য রাক্ষসের মৃত্যু— এ-ও অলৌকিক উপাদান। বনবাস পর্বে কিছু বৈচিত্র্য সঞ্চার ঘটেছে, খরদূষণ-তাড়কা- শূর্পণখা উপাখ্যানে; এরা সবাই রাম লক্ষ্মণের হাতে পরাস্ত হয়েছে, অপমানিত হয়েছে ও নির্যাতিত হয়েছে।
এই নির্যাতনের খবর পৌঁছেছে লঙ্কায়, সেখানে রাজা রাবণ রাম লক্ষ্মণকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার ইচ্ছায় সীতা হরণের জন্য মারীচের শরণ নিলেন। মারীচ এল সোনার হরিণের রূপ ধরে; আরও একটা অলৌকিক মাত্রা যুক্ত হল কাহিনিতে। সোনার হরিণ দেখে সীতা জেদ ধরলেন, ওই সোনার হরিণ তাঁর চাই। রাম হরিণের পিছু পিছু গেলেন। কুটীরে লক্ষ্মণ ও সীতা শুনতে পেলেন রামের গলা, ‘বাঁচাও’। সীতা জোর করে লক্ষ্মণকে পাঠালেন রামের নিরাপত্তার জন্যে। এ বার কুটীরে একলা সীতার কাছে ছদ্মবেশী রাবণ ভিক্ষা নিতে এসে জোর করে তাঁকে রথে তুলে রওনা হলেন। ছদ্মবেশও একটা অলৌকিক ব্যাপার, পুষ্পক-রথও তাই। লঙ্কায় সীতাকে অশোকবনে বন্দিনী করে রাখা হল, কারণ তিনি রাবণকে ভজনা করতে সম্মত হননি। রাবণ ধমকে বলে গেলেন, দু-মাসের মধ্যে সীতা রাজি না হলে তাঁকে মেরে কেটে খাওয়া হবে।
এদিকে রাম কুটীরে ফিরে সীতাকে না দেখতে পেয়ে বিলাপ করতে লাগলেন। ঘটনাচক্রে সুগ্রীবের সঙ্গে তাদের বন্ধুত্ব হল, এটাও লৌকিকের সীমা ছাড়িয়ে; মানুষে-বানরে বন্ধুত্ব। বলা বাহুল্য, এ-বানর পরিচিত সলাঙ্গুল বানরের মতো নয়, এরা মানুষের মতো কথা বলে, এবং এদের আচরণও মানুষেরই মতো। চর পাঠিয়ে সুগ্রীব সীতার সন্ধান পেলেন। হনুমান গেল লাফ দিয়ে সাগর পর্বত বনজঙ্গল পেরিয়ে— এ-ও অতিলৌকিক ঘটনা। তেমনই অতিলৌকিক পথে রাক্ষসী সিংহিকাকে মেরে ফেলার ঘটনা। রাম লক্ষ্মণ বানরসেনার সাহায্যে যে সমুদ্রে সেতুবন্ধন করলেন সেও সাধারণ সম্ভাব্যতাকে লঙ্ঘন করে। যুদ্ধে অতিলৌকিক ঘটনা বেশ কয়েকটাই ঘটে, কিন্তু নিরস্ত্র বানরসেনার হাতে ও ধনুর্বাণধারী রামলক্ষ্মণের হাতে সুশিক্ষিত সশস্ত্র রাক্ষসসেনার পরাভব, এইটেই সবচেয়ে বড় অলৌকিক। যুদ্ধের পরে রাম সীতাকে সর্বজনসমক্ষে পরিত্যাগ করলে সীতা চিতারোহণ করেন। দেবতারা ও দশরথ এসে তাঁর ‘সতীত্ব’ প্রতিপাদন করেন, এটাও অলৌকিক। যেমন অবান্তর পুষ্পক রথে দেশে ফেরা।
কাজেই দেখছি, পদে পদে অলৌকিকতার অবতারণা এবং রূপকথার মতো দুর্বল পক্ষের সবল পক্ষকে পরাস্ত করা এ সবই ব্যবহার করা হয়েছে, কাহিনিটিকে বাস্তব অর্থাৎ মানুষের পরিচিত জগৎ থেকে সরিয়ে অন্য এক স্তরে উন্নীত করবার জন্যে। সেখানে বাস্তব অবাস্তবের ভেদ নেই, গল্পের মধ্যে কাহিনিগত, চরিত্রগত বিশেষ কোনও জটিলতা নেই। যখনই কাহিনির প্রয়োজনে কোনও ব্যাপার ঘটা দরকার, যেটা বাস্তবে ঘটা অসম্ভব, তখনই অতিবাস্তবের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। এতে কাহিনিটির জনপ্রিয় হওয়া আরও সহজ হয়েছে। লোকে বারে বারে সুন্দর প্রকৃতি বর্ণনা পেয়েছে, কাহিনির মধ্যে পেয়েছে রোমহর্ষক উপাদান এবং অলৌকিকের বহুল প্রয়োগ, যা রূপকথার উপাদানের মতো এটিকে জনপ্রিয় করতে সাহায্য করেছে।
জীবনের যে ধরনের মূল্যবোধ রামায়ণে প্রতিফলিত হয়েছে তা মূলত পরিবারনিষ্ঠ। পিতা-পুত্র (রাম-লক্ষ্মণ ও দশরথ, রাবণ -ইন্দ্রজিৎ), মাতা-বিমাতা (কৌশল্যা-কৈকেয়ী), পারিবারিক ক্ষমতালোভে ষড়যন্ত্র (কৈকেয়ী-মন্থরার রামের বিরুদ্ধে ভরতের দাবি উপস্থাপন করা), সৌভ্রাত্র্য (রাম, লক্ষ্মণ, ভরত), ভ্রাতৃদ্বন্দ্ব, (বালী-সুগ্রীব, রাবণ-বিভীষণ), পরস্ত্রীহরণ ও ভোগ বা ভোগের চেষ্টা (রুমা-তারা, সীতা), বন্ধুকৃত্য (জটায়ু-সম্পাতি রামলক্ষ্মণের সহায়তা করেন দশরথের সঙ্গে বন্ধুত্বের সূত্রে), দাম্পত্যের ত্রুটি ও বিকৃতি (বালী-সুগ্রীব- রাবণ), অনুচরের আনুগত্য (হনুমান), দাসীর দৌরাত্ম্য (মন্থরা), ভ্রাতৃবধূ-দেবর (সীতা- লক্ষ্মণ), আরও ছোটখাটো শাখায় পল্লবে নানা উপকাহিনিতে এই ধরনের পারিবারিক মূল্যবোধের কথাই ঘুরে ফিরে এসেছে। সমাজের মানুষ প্রতিনিয়ত অব্যবহিত ভাবে যে সব সম্পর্কের জটিলতার সম্মুখীন হয় এবং প্রায় প্রত্যহ পদে পদে যে সব সমস্যা সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়, রামায়ণ সেই নীতি-দুর্নীতি-সুনীতির সম্বন্ধে পারিবারিক ও কতকটা সামাজিক অক্ষাংশে তার সম্বন্ধে দিকনির্দেশ দিয়েছে। পরিবারবদ্ধ সমাজজীবনে মানুষ স্বভাবতই চেয়েছে পারিবারিক সম্পর্কে সংঘাত ও সংশয়ে মহাকাব্যের কাছ থেকে আচরণের বিধি ও মূল্যবোধের দিশা। পারিবারিক সম্পর্কের সংঘর্ষে কী করণীয়, কেমন ভাবে তা করণীয়, তা দেখাক মহাকাব্য।
খ্রিস্টিয় প্রথম-দ্বিতীয় শতকে কুষাণ সাম্রাজ্যের কালে ভারতবর্ষে একটি ব্যাপক অন্তর্দ্বন্দ্ব, মূল্যবোধের দ্বন্দ্ব ঘটে। এর ফলে প্রচলিত সমাজবিধির বিশ্লেষণ করে নতুন, সার্বিক ভাবে গ্রহণীয় যে আচরণবিধি প্রবর্তিত হল, সেই পরিবর্তিত বিধানই হল এই মূল্যবোধের উৎস। রামায়ণের সমকালীন ভগবদ্গীতা, বাৎস্যায়নের কামসূত্র, মনুসংহিতা, সংস্কৃত জাতকের কিছু অংশেও এই মূল্যবোধই প্রতিফলিত। এর বিশদ আলোচনা না করেও সাধারণ ভাবে বলা যায়— জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা পিতার বিকল্প, অতএব সর্বতো ভাবে তাঁর বাধ্য হওয়া উচিত। পিতা দেবকল্প, তাঁর আদেশ নির্দেশ একান্ত ভাবেই অলঙ্ঘনীয়।[৩] বন্ধুর দাবি রক্ষণীয়। অনুগতের আশ্রয়স্থল হওয়ার দায়িত্ব আছে। দাম্পত্যে স্বামীই প্রভু, স্ত্রীর স্থান তার অনেক নিচে; কাজেই স্বামীর সেবা ও অভিলাষপূরণ স্ত্রীর একান্ত কর্তব্য। যত দিন দাম্পত্যপ্রেম উভয়ত প্রবাহিত, তত দিন স্ত্রীর একটা স্থান আছে। কিন্তু সম্পূর্ণ নির্দোষ স্ত্রীকেও সন্দেহ বশে বারবার প্রত্যাখ্যান করা সংগত; কারণ সমাজে ‘সতীত্ব’ একটি সর্বজনস্বীকৃত মূল্য। কিন্তু ‘সতী’র কোনও পুংলিঙ্গ প্রতিশব্দ না থাকায় স্বামীকে স্ত্রী-র সন্দেহ করার হেতু থাকলেও কোনও অবকাশ থাকে না। বংশমর্যাদা একটি সমাজস্বীকৃত মূল্য। তাই যুদ্ধ শেষে রাম সীতাকে বলতে পারলেন, ‘যুদ্ধ করেছি ইক্ষ্বাকু কুলের মর্যাদা রক্ষার জন্য’, অর্থাৎ তোমার জন্যে নয়। তাই যুদ্ধের শেষে অযোধ্যার সিংহাসন পেলেন ভরত, রামের বৈধ উত্তরাধিকারী লব কুশ নয়। শূদ্র ও চণ্ডাল ঊনমানব, তাই গুহক চণ্ডালের কাছে ফলমূলও গ্রহণ করা যায়নি (যদিও বনবাসী অবস্থায় মুনিঋষিদের আতিথ্য গ্রহণ করতে রামের বাধেনি)।[৪] আর ব্রাহ্মণ সন্তানের বাজারদর চণ্ডালের প্রাণের চেয়ে অনেক বেশি, তাই অকালমৃত ব্রাহ্মণ সন্তানের প্রাণের মূল্য শোধ করতে হল চণ্ডাল শম্বুককে নিজের প্রাণ দিয়ে। দু-একটা ব্যতিক্রমী চরিত্র বা ঘটনা থাকা সত্ত্বেও এই হল ওই সময়কার সমাজের মূল্যবোধের ছক। নারীর বা শূদ্রের সামাজিক অবস্থান উচ্চত্রিবর্ণের ও পুরুষের পায়ের নিচে।
ধর্মশাস্ত্র ও সমাজপতিরা যে ছকটি ধরে দিয়েছিল তা নিয়ে রামায়ণে কোনও সংঘাত নেই। মূলত পরিবারনিষ্ঠ ও সমাজনিষ্ঠ এ মূল্যবোধ সরলরৈখিক ভাবে রামায়ণে উপস্থাপিত হয়েছে। এ মহাকাব্যে সাড়া দিতে পাঠক শ্রোতাকে তাই তেমন কোনও মানসিক দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হতে হয় না। কাহিনিটিকে প্রচুর রূপকথার উপাদানে মণ্ডিত করে, অলৌকিকতায় ভরে দিয়ে সমৃদ্ধ বর্ণনার মধ্যে দিয়ে নারীর অবদমন, শূদ্রের সেবকত্ব, চণ্ডালের উপান্তবর্তিত্ব, রাজার গৌরব, স্বামীর সর্বময় কর্তৃত্ব, পিতা ও জ্যেষ্ঠভ্রাতার দেবতুল্য মহিমা প্রচার অতি সহজ ভাবে করা হয়েছে। আরও সহজ হয়েছে এর প্রক্ষিপ্ত অংশে মানুষ রামের বিষ্ণুর অবতার হয়ে ওঠায়, সীতার লক্ষ্মীস্বরূপিণী বলে উল্লেখিত হওয়ায়। কেউ কখনও প্রশ্ন করেনি যে, লক্ষ্মীর ত পূর্বজন্মে কোনও পাপ থাকার কথা নয়, তা হলে সীতা শেষ দুটি কাণ্ডে এত নির্যাতন, প্রকাশ্য অপমান, ও বারবার নির্বাসনের যন্ত্রণা ভোগ করলেন কেন। এ কেন’র উত্তর অতিকথায় মিলবে না, মিলবে তৎকালীন আর একটি মূল্যবোধে: স্ত্রী যথার্থ সতী না হলে সন্তানের পিতৃত্ব সংশয়িত হয় এবং সন্তানই তো পিতৃ-সম্পত্তির উত্তরাধিকারী; কাজেই স্ত্রীর প্রতি অহেতুক সন্দেহের উদ্রেক হলেও তাকে ত্যাগ করা চলে। নইলে ঋষি বাল্মীকি যার সতীত্ব সম্বন্ধে নিঃসংশয়ে উক্তি করেন তাকেও গ্রহণ করতে বাধে স্বামীর? অযোধ্যার লোকে বলেছিল,[৫] পরহস্তাগতা নারীকে যদি রাম গ্রহণ করেন তবে তো আমাদের ও ব্যাভিচারিণী স্ত্রীকে গ্রহণ করতে হবে। সমাজে এখনও পর্যন্ত এই জাতীয় মূল্যবোধেরই আধিপত্য এবং এই মূল্যবোধকে ঘটনাপ্রবাহের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করে রামায়ণ। এক দিকে তার রূপকথাধর্মিতা, অলৌকিকত্ব-সিঞ্চিত কাহিনির অতি সহজ আবেদন, অন্য দিকে মানুষ যে মানদণ্ড ধরে নির্দ্বন্দ্বে জীবন অতিবাহিত করতে চায় তার এমন সরল উপস্থাপনা — কাজেই রামায়ণের জনপ্রিয়তা অবশ্যম্ভাবীই ছিল। এ মহাকাব্যে সাড়া দিতে হলে কোনও বিশেষ নৈতিক দ্বিধাদ্বন্দ্বের সম্মুখীন হতে হয় না, যা কিছু নৈতিক সংঘাতের উপাদান ছিল কাহিনিতে তার নিঃসংশয় সমাধান ঘটেছে; পাঠকশ্রোতা আদর্শ হিসেবে এ মূল্যবোধ মেনে নিলে তাকে বড় কোনও মানসিক সংগ্রামের সম্মুখীন হতে হয় না। সাধারণ পাঠক এ-ই চায় এবং রামায়ণ কাব্য-সুষমায় মণ্ডিত করে তাকে এটাই দিয়েছে, কাজেই সমগ্র আর্যাবর্তে রামায়ণের অপ্রতিদ্বন্দ্ব জনপ্রিয়তা ঘটেছে। রামায়ণে কিছু কিছু নৈতিক সংঘাত অবশ্যই আছে, সেগুলির গুরুত্বও অনস্বীকার্য, তবু সেগুলি সংখ্যায় কম এবং অধিকাংশ সংঘাতই পাঠককে উদ্ভ্রান্ত বা যন্ত্রণাতুর করে তোলে না। পরিমাণগত ভাবে তাই এই কাব্যের সংকট এর সহজ আবেদনকে জটিল করে তোলেনি।
***
১. সুন্দরকাণ্ড; (৪:৫)
২. শ্রূয়তাং তু গুণৈরেভির্যো যুক্তো নরচন্দ্রমাঃ; (১:১১)
৩. বালকাণ্ড; (১:১১)
৪. অযোধ্যাকাণ্ড; (১১৭:৫, ১১৮-১১৯)
৫. উত্তরকাণ্ড; (৪৩:১৯)