০১. রাত দশটার মত বাজে

রাত দশটার মত বাজে। এমন কিছু রাত না, কিন্তু নায়লার অস্থির লাগছে। গেটে শব্দ হতেই সে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। এ জায়গাটাকে বারান্দা বলা ঠিক না। জায়গাটা ছাদের অংশ। তবু নায়লা বারান্দা বলে। ফ্ল্যাট বাড়ির গেট। কত মানুষ আসছে, কত মানুষ যাচ্ছে।

নায়লা বারান্দায় পঁড়িয়ে রইল। বারান্দা অন্ধকার, বাইরে থেকে তাকে দেখা যাবে না। সে ঠিকই দেখতে পাবে। গেটের কাছে এখন দুশ পাওয়ারের বাতি জ্বলে। এত দূর থেকে মানুষ চেনার কথা না, কিন্তু নায়লা চিনতে পারে।

কাজের মেয়ে ফিরুর মা রান্নাঘর থেকে তাকে ডাকছে। এমন চেঁচিয়ে ঢাকার মানে কি? সে কি বাবুর ঘুম ভাঙাতে চায়? এরা কিছুই শিখবে না? কতবার বলা হয়েছে চেঁচিয়ে ডাকবে না। যা নিষেধ করা হয় এই মহিলা সেটাই বেশি করে।

ও আম্মা। ও আম্মা।

বারান্দা থেকে নড়তে ইচ্ছা করছে না। যে কোন মুহূর্তে জামান এসে পড়বে। দশটার ভেতর সে সব সময় বাড়ি ফেরে। রিকশা থেকে নেমে সে গেট খুলে ঢুকছে এই দৃশ্য দেখতে নায়লার ভাল লাগে। অন্য কেউ এ কথা শুনলে তাকে পাগল ভাববে। রিকশা থেকে নেমে একটা লোক গেট খুলে বাড়িতে ঢুকছে–এতে ভাল লাগার কি আছে? কিন্তু নায়লার ভাল লাগে। শুধু ভাল লাগা না–শান্তি শান্তি ভাব হয়।

ও আম্মা। আম্মা।

চেঁচাচ্ছ কেন? বাবু উঠে যাবে না?

ভাইজানের গোসলের পানি দিয়া আসমু?

গা জ্বালা-করা কথা। এটা জিজ্ঞেস করার কি আছে? গোসলের গরম পানি বাথরুমে দিতে সে বলে এসেছে। ফিরুর মার মাথাটা খারাপ কিনা কে জানে। তাকে আম্মা ডাকছে, অথচ জামানকে ডাকে ভাইজান। ব্যাপারটা তাকে এক লক্ষ বার বলা হয়েছে। যতই বলা হয় ততবারই সে জিবে কামড় দিয়ে বলে, কিচ্ছু মনে থাকে না। ফিরুর শরণের পর থাইক্যা মাখা গেছে আউলাইয়া …

এই এক সমস্যা। যে কোন প্রসঙ্গে সে ফিরুর কথা নিয়ে আসে। সেদিন নতুন চায়ের কাপ হাত থেকে ফেলে ভেঙে ফেলল। এক সপ্তাহও হয়নি কেনা হয়েছে। নায়লা কিছু বলার আগেই সে কঁদো কাঁদো গলায় বলল, ফিরুর মরণের পর থাইক্যা কি যে হইছে আম্মা–হাত-পাও কাঁপে।

 

ও আম্মা। আম্মা। পানি দিমু বাথরুমে?

দাও। আর চেঁচিয়ে কথা বলো না। বাবু উঠে যাবে।

রিক্সা এসে থেমেছে গেটের কাছে। জামান নামছে। এত দূর থেকে মুখ দেখা যায়, কিন্তু নায়লা নামার ভঙ্গি দেখে বলে দিতে পারে। জামানের হাতে কি যেন পোটলা দেখা যাচ্ছে। তার বিশ্রী অভ্যাস হল, দুপুর-রাতে মাছ কেনা। তাও সব মাছ না–ইলিশ মাছ। বাজারের ব্যাগ নামিয়ে রেখে বলবে–ঝটপট দুটা পিস ভেজে দাও তো। কড়া ভাজবে।

রাত-দুপুরে কার মাছ কুটতে ভাল লাগে? তাছাড়া মাছ কাটার পর হাত আঁশটে গন্ধ হয়ে থাকে। সেই গন্ধ সারারাত লেগে থাকে। কি আছে ইলিশ মাছে? শীতকালের ইলিশ কেউ কেনে না। জামনি কিনে আনে।

ফিরুর মা?

জ্বি আম্মা। তরকারী গরম দাও। তোমার ভাইজান এসেছে।

রোজ দিন কেন যে এমুন দিরং করে! শহর-বন্দর জায়গা। একটা বিপদ-আপদ হইলে উপায় আছে?

তোমাকে ওস্তাদী ধরনের কথা বলতে হবে না। তোমাকে যা করতে বলা হয়েছে, কর।

গেট থেকে ফ্ল্যাটের দরজা পর্যন্ত আসতে জামানের ঠিক এগারো মিনিট লাগে। এর বেশিও না, এর কমও না। নায়লা ঘড়ি দেখে বের করেছে। দুতলা পর্যন্ত সিঁড়ি বেয়ে উঠতে সময় লাগে। জামান এক নাগাড়ে উঠতে পারে না। থেমে থেমে উঠতে হয়। তাদের একতলা একটা বাড়ি যদি থাকতো। ছোট্ট সুন্দর ছিমছাম একটা বাড়ি। কয়েকটা নারিকেল গাছ থাকবে বাড়ির সামনে। একটা কঁকড়া আমগাছ। যার ডালে একটা দোলনা কুলবে। বাবু দোলনায় চড়বে। দোলনায় চড়র বয়স বাবুর এখনো হয়নি। খুব শিগগিরই হবে–ছোট বাচ্চারা দেখতে দেখতে বড় হয়। ঐ তো মাত্র সেদিন ওঁয়া ওঁয়া করে কাঁদতো! পাশ কি করে ফিরতে হয় তাও জানতো না–আর আজ বাবার চশমা চোখে দিয়ে বলে–আপিস যাব। আপিস যাব।

জামানকে একদিন বলতে হবে ওকে যেন একদিন অফিসে নিয়ে যায়। দেখে আসুক আপিস ব্যাপারটা কি?

কলিংবেল বাজছে।

আজ কি ওর আসতে সময় বেশি লেগেছে? নায়লার মনে হচ্ছে সে অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে।

জামান হাঁপাতে হাঁপাতে ঢুকল। এই ফ্ল্যাটবাড়ির সিঁড়িগুলি খড়ি। উঠতে গেলে বুকে চাপ পড়ে। সে থেমে থেমে উঠে। এক একটা তালা উঠে খানিকক্ষণ সিড়ির রেলিং ধরে বিশ্রাম করে এটা না করে একটানে আসলে কম পরিশ্রম হবে ভেবে সে একবার একটানে উঠেছিল। এতে এমন সমস্যা হল–দম বন্ধ হয়ে আসার জোগাড়। হেঁচকির মত উঠে গেল। হার্টের কোন সমস্যাটমস্যা আছে নিশ্চয়ই।

দেখি নায়লা, পানি দাও তো। খুব ঠাণ্ডা পানি।

নায়লা পানি এনে দিল। খুব ঠাণ্ডা পানি দেবার উপায় নেই। ঘরে ফ্রীজ থাকলে তবে তো ঠাণ্ডা পানি। মাঝে মাঝে পাশের সীমাদের ফ্ল্যাট থেকে ঠাণ্ডা পানির বোতল নিয়ে আসে। রোজ রোজ তো আর আনা যায় না। নায়লঃ লক্ষ্য করল, বেচারা ঠাণ্ডা পানি মনে করে খুব আগ্রহ করে পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে চুমুক দিয়েই মনটা খারাপ করল। আচ্ছা, সে তো জানে তাদের ফ্রীজ নেই। তারপরও রোজ এসে ঠাণ্ডা পানি চায় কোন যুক্তিতে?

বাথরুমে গরম পানি দেয়া হয়েছে। গোসল করে ফেল।

যাচ্ছি। একটু জিরিয়ে নেই।

মানুষটা মুখ বড় বড় করে নিঃশ্বাস ফেলছে। দেখতে মায়া লাগছে। এত অল্পতে সে কাহিল হয়? গোসল করে সে চুপচাপ মিনিট পাঁচেক সময় শুয়ে থাকবে–তারপর খেতে আসবে। সেই গোসলও টকটকে গরম পানি ছাড়া হবে না। ভাদ্র মাসের গরমেও তার গোসলের জন্যে গরম পানি চাই।

জামান শার্ট খুলতে খুলতে বলল, বাবু ঘুমিয়ে পড়েছে?

হুঁ।

ওর ঘুমটা ভাঙাও দেখি।

কেন?

ওর জন্যে একটা খেলনা এনেছি।

কি খেলনা?

জামান কাগজের প্যাকেট খুব সাবধানে খুলছে। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয় চমকে যাবার মত কিছু বেরুবে। যদিও নায়লা খুব করে জানে, সেই সম্ভাবনা একেবারেই নেই। আজ মাসের ২৩ তারিখ। ওর হাতে কোন টাকাই নেই। সস্তা দামে প্লাস্টিকের বলল কিছু কিনেছে বোধহয়। বাবু অবশ্যি বল পেলেই খুশি। বল কেন যে কোন কিছু হাতে দিলেই খুশি। সেদিন জামান পকেট থেকে চকচকে সাদা রঙের একটা পাথর বের করে বলল, বাবা নাও, পাথর।

নায়লা বলল, পাথর পেলে কোথায়?

জামান উৎসাহের সঙ্গে বলল, মালিবাগ রেল ক্রসিং-এর কাছে রিকশা থেকে নেমে রেল লাইন থেকে নিয়ে এসেছি।

পাথর দিয়ে হবে কি?

বাবু খেলবে।

 

নায়লা প্রায় বলতে যাচ্ছিল–আমার বাবুর কি এতই খারাপ অবস্থা যে তাকে পথির দিয়ে খেলতে হবে? নিজেকে সামলে নিল–জামানকে এই কথা বলার কোন যুক্তি নেই। সে তার সাধ্যমত করছে। তাছাড়া মজার ব্যাপার হচ্ছে–বাবু ঐ পাথর পেয়ে যত খুশি হয়েছে অন্য কোন খেলনা পেয়ে তত খুশি হয়নি। পাথর সারাক্ষণ তার সঙ্গে সঙ্গে আছে। সে যখন গোসল করবে তখন পাখরটাকেও গোসল করাতে হবে। তেল মাখাতে হবে। পাথরের মাথার চুল আঁচড়ে দিতে হবে।

জামান প্যাকেটটা প্রায় খুলে ফেলেছে। কালো স্কচ টেপ সরানো হয়েছে। সে রহস্যময় ভঙ্গিতে বাক্স ধরে আছে।

কই লায়লা, বাবুকে তুললে না?

এখন ঘুম ভাঙলে কান্নাকাটি করবে।

যে জিনিস এনেছি দেখলে আর কান্নাকাটি করবে না।

কি এনেছ?

আন্দাজ কর তো দেখি।

মনে হচ্ছে ফুটবল।

ফুটবল বুঝি এ রকম প্যাকেট করে দেয়? বল একটা পলিথিনের ব্যাগে ভরে দিয়ে দেয় …, এ অন্য জিনিস দেখলে তোমার ব্রেইন ডিফেক্ট হয়ে যাবে।

জিনিসটা শেষ পর্যন্ত বেরুল। একটা হেলিকপ্টার। দেখার মতই জিনিস। সুইচ টিপে দিতেই লাল, নীল, সাদা, নানান রকম বাতি জ্বলতে লাগল। সাইরেনের মতো কয়েকবার শব্দ করার পর বন বন করে পাখা উড়তে লাগল। নায়লা হতভম্ব হয়ে বলল, এ কি! এটা কি আকাশে উড়ে যাচ্ছে নাকি?

কথা বলো না। মা দেখ।

হ্যাঁ, আকাশেই তো উড়ছে। উড়ার ভঙ্গি করছে। খট করে দরজা খুলে গেলো—পাইলট বেরিয়ে আসছে নাকি? তাই তো। তাই তো। নায়লা বললো, কী আশ্চর্য! পাইলট বেরিয়ে আসছে?

হুঁ।

জামান হাসছে। এমন ভঙ্গিতে হাসছে যেন এই খেলনা সে নিজেই বানিয়েছে। সে খুব সাবধানে সুইচ বন্ধ করলো।

জিনিসটার দাম কত আন্দাজ কর তো দেখি?

তুমি কিনেছ?

আমি কিনেছি কি না সেটা পরের কথা। দাম আন্দাজ কর।

এক হাজার?

যা বললে তাকে তিন দিয়ে গুন কর।

তিন হাজার টাকা দাম?

চেয়েছিল তিন হাজার। দুহাজার পাঁচশতে দিয়েছে।

তুমি নিশ্চয়ই কেনোনি?

পাগল হয়েছ? আমি কোথেকে কিনব? সে এক ইন্টারেস্টিং ইতিহাস। দাঁড়াও, বলি। গোসল করে নেই। গরম পানি দিয়েছ?

দিয়েছিলাম তো। ঠাণ্ডা হয়ে গেছে বোধহয়! দাঁড়াও, আবার গরম করি।

লাগবে না, লাগবে না। তুমি টেবিলে ভাত দিয়ে দাও। খিদে মারাত্মক লেগেছে। নায়লা, খেলনাটা খুব সাবধানে টেবিলের উপর তুলে রাখ! ব্যাটারিটা খুলে রাখ। থাক, দরকার নেই–তুমি খুলতে পারবে না।

জামান বাথরুমে ঢুকে গেছে। বাবু উঠে পড়েছে। সে বিছানায় বসে চেঁচাচ্ছে–মাম্মাট। মাম্মাট।

ছোট বাচ্চারা মাকে মাই ডাকে। মা ডাকটাই সহজ। কিন্তু বাবু ডাকে মাম্মটি। দুই বছরের বাচ্চা এমন কঠিন শব্দ কি ভাবে বলে কে জানে? এরকম কঠিন শব্দ শিখলই বা কার কাছে?

আম্মাট। মাম্মাট?

আসছি বাবা। আসছি।

বাতিস দুদু দাও।

বাতিস দুদু হচ্ছে তাকে বালিশে শুইয়ে বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। সে তিন রকম দুধ খেতে চায়–কোল দুদু (কোলে করে খাওয়াতে হবে), বসা দুদু (নায়লা বসে থাকবে, সে দাড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাবে) এবং বাতিস দুদু।

নায়লা বাতিস দুদু খাওয়াচ্ছে। জামান গোসল করার মাঝখানে সাবান গায়েই বাথরুমের দরজা খুলে মুখ বের করলো, বাবু উঠে গেছে না কি?

হুঁ। বাতিস দুদু খাচ্ছে।

ওকে ঘুম পাড়িও না। জাগিয়ে রাখবে।

ও জাগবে না। বাতিস দুদু খেতে খেতে ঘুমিয়ে পড়বে।

কথা বলে বলে জাগিয়ে রাখ।

কথা বলে জাগাবে কি, বাবু এর মধ্যেই ঘুমিয়ে কাদা। দুধ খাচ্ছে এই সঙ্গে অভ্যাসমত মায়লার মাথার চুল ধরে আছে।

নায়লা!

হুঁ।

হেলিকপ্টারের শানে নজুলটা শোন …

গোসল শেষ করে এসো, তারপর শুনব। বেশিক্ষণ পানি লাগাবে না ঠাণ্ডা লাগবে।

জামান গোসলের শেষে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ বিছানায় শুয়ে থাকে। আজ আর সে অন্যদিনের মত গোসল শেষ করে বিছানায় শুয়ে থাকলো না–সঙ্গে সঙ্গে খেতে বসলো।

বুঝলে নায়লা, দুপুরে লাঞ্চকে হয়েছে। আমার বস বদরুল সাহেব খবর পাঠালেন–আমার টেলিফোন। উনি খুবই বিরক্ত। উনার টেবিলে কেউ টেলিফোন করলেই উনি বিরক্ত হন। উনার ধারণা, এটা উনার পার্সোনাল টেলিফোন—অফিসের না। যাই হোক, টেলিফোন ধরলাম। দেখি একটা মেয়ে টেলিফোন করেছে। খুব মিষ্টি গলা।

নায়লা বলল, মেয়েটা কে?

বলছি তো–অস্থির হয়ো না। অস্থির হবার কিছু নেই। মেয়েটা হল হোটল শেরাটনের রিসিপশনিস্ট। এস, আলম নামের এক লোক আমাকে খোঁজ করছেন। রুম নম্বর দিয়ে রেখেছেন, আমি যেন সন্ধ্যার পর তার সঙ্গে অবশ্যই দেখা করি। আমি ধাধার মধ্যে পড়ে গেলাম–এস. আলমটা কে? একবার ভাবলাম যাব না, তারপর মনে করলাম, দেখেই আসি। গিয়ে দেখি আমাদের বল।

বল্টুটা কে?

স্কুল জীবনের বন্ধু। ভেরি ক্লোজ ফ্রেণ্ড। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত বেঁটেখাট ছিল–আমরা বল্টু ডাকতাম। হঠাৎ লম্বা হওয়া শুরু করলো–দেখতে দেখতে তালগাছ। তখন তার নাম হয়ে গেলো স্ক্রু ড্রাইভার। তবে ঐ নাম স্থায়ী হল না। আগের নামটা রয়ে গেল।

নায়লা খিলখিল করে হাসছে। হাসতে হাসতে সে বিষম খেলো। জামানও আনন্দিত চোখে তাকিয়ে আছে। এস, আলমের গল্প বলতে তার ভাল লাগছে।

তারপর হল কি–আমি তো হোটেলে উপস্থিত হলাম। গিয়ে দেখি পুরোদস্তুর এক সাহেব। সেই সাহেব আর কেউ না, আমাদের বন্দু।

বল্টু না, স্ক্রু ড্রাইভার।

ও হ্যাঁ, ক্রু ড্রাইভার। তের বছর পর ব্যটিাকে দেখলাম–আই এ পরীক্ষায় ফেল করে পালিয়ে গিয়েছিল।

কোথায় পালিয়ে গিয়েছিল?

কোথায় আমরাও জানতাম না। একদিন খবরের কাগজ খুলে দেখি, ছবি ছাপা হয়েছে শেষের পাতায়–সাবেহ আলম সাইকেলে করে বিশ্ব পর্যটনে বের হয়েছে। ভাঙা লক্কড় একটা সাইকেলে সাইনবোর্ড লাগানো–S. Alam World Tour. বন্টুর গলায় একটা ফুলের মালা হাসি হাসি মুখ।

মজার মানুষ তো!

মজার তো বটেই। সে যে বিশ্ব ভ্রমণে যাচ্ছে সে বিষয়ে আমাদের কিছুই বলে নাই–তার আত্মীয়-স্বজনদেরও কিছু বলে নাই। খুবই ইরেসপনসিবল টাইপের ছেলে। এই দেখ না, ঢাকায় সে এসেছে, দেশের বাড়িতে যায়নি। আত্মীয়-স্বজনের খোঁজও নেয়নি। হোটেল বসে আছে।

উনার মার সঙ্গেও দেখা করেননি?

মার সঙ্গে দেখা করবে কি? মা-কি বেঁচে আছে?

বাবুর খেলনা উনি কিনে দিলেন?

হুঁ। কেউ যে আড়াই হাজার টাকা দিয়ে খেলনা কিনতে পারে তাই জানতাম না। আশ্চর্য!

তুমি নিষেধ করলে না?

বন্দুকে নিষেধ করব আমি? আমার নিষেধ সে শুনবে? বন্টুর সঙ্গে তোমার পরিচয় হয়নি বলে এমন কথা তুমি বলতে পারলে–ওকে কাল নিয়ে আসব।

নায়লা চিন্তিত মুখে তাকিয়ে রইলো। মাসের শেষের দিকে গেস্ট আনার মত অবস্থাঁ কি আছে? ছেলেবেলার বন্ধু এলে একবেলা তো খাওয়াতেই হবে। ভালমত খাওয়াতে হবে। পোলাও-টোলাও করতে হবে। বাবুকে এ মাসে দুবার ডাক্তার দেখাতে হল। হাত এক্কেবারে খালি। ওর কাছে টাকা চাইতে হবে। ওই-বা কোথায় পাবে।

নায়লা, খুব সিম্পল খাওয়ার ব্যবস্থা করবে–ভাজি-ভুজি, টাকি মাছের ভর্তা ফর্তা, শুটকি, পারবে না?

পারব। উনি করেন কি?

কি করে জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছি। থাকে সিয়াটলে তবে প্রচুর পয়সা করেছে। দেশে এসেছে বিয়ে করার জন্যে। বিয়ে করে বউ নিয়ে ফিরবে।

বউ পেয়েছেন?

আসলই তো মাত্র পরশুদিন। এর মধ্যে বউ কোথায় পাবে? বউ তো আর দোকানে সাজানো থাকে না। হা হা হা…

সাজানো থাকলেই তোমার বন্ধুর জন্যে ভাল হত। দেখে-শুনে পছন্দসই কিনে নিতে পারতেন। পছন্দ না হলে এক সপ্তাহের মধ্যে ফেরত দিয়ে নতুন একজন …।

জামান বিরক্ত হয়ে বলল, এইসব কি ধরনের কথা?

ঠাট্টা করছি।

আজেবাজে ধরনের ঠাট্টা করবে না। চা দাও দেখি–চা খাব।

এখন চা খাবে? চা খেলে তো তোমার ঘুম হয় না।

কাল ছুটির দিন আছে। ঘুম দেরিতে এলেও ক্ষতি নেই।

টেবিল পরিষ্কার করে তারপর দেই।

আচ্ছা।

নায়লা শোন, দুধ-চিনি ছাড়া শুধু লিকারে এক কাপ চা দাও। লিকারের চা শরীরের জন্যে ভাল।

আচ্ছা।

চা বানিয়ে এনে নায়লা দেখে জামান নিজেই মুগ্ধ হয়ে হেলিকপ্টার দিয়ে খেলছে। শিশুরাও এত মুগ্ধ হয়ে কোন খেলনা নিয়ে খেলে না। নায়লাকে দেখে সে লজ্জিত মুখে বললো, ইন্টারেস্টিং, তাই না?

হুঁ।

সামান্য খেলনা, অথচ কি করেছে! সবই ইলেকট্রনিক্স। সায়েন্স কোথায় চলে যাচ্ছে। ঘরে পান আছে?

আছে।

চা খাবার পর পান খাব। কাল মিষ্টিপানের ব্যবস্থা রেখো তো নায়লা–বন্টুর আবার দেখি পান খাবার অভ্যাস হয়েছে। একসঙ্গে দুটা মিষ্টিপান মুখে দিয়ে কচকচ করে চিবোচ্ছে।

উনি দেখতে কেমন?

ছোটবেলায় বেকুপ টাইপ চেহারা ছিল। এখন রাজপুত্রের মত। যে কোন সিনেমায় তাকে হিরোর পার্ট দেবো।

জামানের চা খাওয়া হয়েছে, পানি খাওয়া হয়েছে। রাত প্রায় বারোটার মত বাজে। এখন ঘুমুতে যাওয়া দরকার। জামানের ঘুম আসছে না। স্ত্রীর সঙ্গে আরো কিছুটা সময় কাটাতে ইচ্ছা করছে। খুব অন্তরঙ্গ কিছু সময়। গোপন ইচ্ছাটা নায়লাকে কি ভাবে বলবে তাও বুঝতে পারছে না। লুজ্জালজ্জা লাগছে। এই সমস্যাটা তাকে খুব বিরক্ত করে। অন্য স্বামীদের এই সমস্যা হয় কিনা কে জানে।

নায়লা বলল, শুবে না?

জামান অস্বস্তির সঙ্গে বলল, ঘুম আসছে না। চা খাওয়াটা বোধহয় ঠিক হয় নি। বাজে কটা?

বারোটা পাঁচ।

ও, রাত তো অনেক হয়ে গেলো। চল ঘুমুতে যাই।

বলেও জামান বসেই রইলো। তার এখন এমন অবস্থা হয়েছে যে, সে নায়লার দিকে চোখ তুলে তাকাতেও পারছে না। তার ভয় হচ্ছে, সে তাকালেই নায়লা বুঝে ফেলবে কেন তার ঘুম আসছে না।

নায়লা।

উঁ।

খুব ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানি দাও তো।

খুব ঠাণ্ডা পানি তো পাব না। সাধারণ এক গ্লাস পানি দেই?

আচ্ছা দাও। ফিরুর মা কি শুয়ে পড়েছে?

হুঁ। কেন?

না এম্নি।

জামানের কেমন জানি উদাস উদাস লাগছে। মনে হচ্ছে মুখ ফুটে আজ রাতে সে স্ত্রীকে কিছু বলতে পারবে না।

নায়লা তাকে পানি দিয়ে চলে গেছে। যাবার সময় রহস্যময় ভঙ্গিতে বলেছে–তুমি বসে থাকে। আমি আসছি। বলতে বলতে ঠোটের ফাঁকে একটু যেন হাসলো। এর মানে কি? সে কি কিছু বুঝে ফেলল? বুঝে ফেললে খুব অস্বস্তির ব্যাপার হবে। শুধু অস্বস্তি না, লজ্জাও।

নায়লা শোবার ঘরে এসে নিজের মনেই খানিকক্ষণ হাসল। মানুষটার এত লজ্জা কেন? সে কি বাইরের কেউ? অনেক দূরের কেউ যাকে মুখ ফুটে কিছুই বলা যাবে না? নায়লা খুব সাবধানে স্টীলের আলমিরা খুলে টকটকে লাল রঙের শাড়ি বের করলো। ঠোটে লাল করে লিপিস্টিক দিল। কপালে টিপ দিল। চুল পিঠে ছড়িয়ে দিল। কাজল বানানো নেই। কাজল থাকলে সুন্দর করে চোখে কাজল দেয়া যেতো। মানুষটা কাজল খুব পছন্দ করে। বিয়েবাড়ি-টারি কোথাও যেতে হলে সে একবার না একবার বলবেই–নায়লা কাজল দিয়েছ? যেন সাজসজ্জার একটাই বিষয়–কাজল। আজ সে দারুণ একটা সাজ করে মানুষটাকে বলবে–দেখ তো কেমন লাগছে?

শাড়ি বদলাবার আগেই বাবু উঠে পড়েছে। বাতিস দুদু, বাতিস দুদু বলে চেঁচাতে শুরু করেছে। নায়লা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে মশারির ভেতর ঢুকল।

মম্মাট, বাতিস দুদু।

দিচ্ছি রে বাবা, দিচ্ছি।

বাবু এক হাত দিয়ে নায়লার চুল টানছে। পা গুটিয়ে বুকের কাছে নিয়ে ছোট্ট পুটলির মত হয়ে পড়েছে। তার গা থেকে কি সুন্দর গন্ধ আসছে। আচ্ছা, শিশুদের গা থেকে এক এক সময় যে এক এক রকম গন্ধ আসে তা কি কেউ লক্ষ্য করেছে?

ঘুমে নায়লার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। আধ-ঘুম আধো জাগরণে তার মৃনে হচ্ছে–আহা! বেচারা একা একা বসে আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *