গ্রামের লোকদের সে রাতের চাঁদের কথা মনে পড়ে এবং তারা সেই চাঁদের বর্ণনা দেয়। আততায়ীদের হাতে ভাদ্র মাসের এক মেঘহীন পূর্ণিমা রাতে সুহাসিনীর মফিজুদ্দিন মিয়া সপরিবারে নিহত হওয়ার পরদিন, গ্রামবাসীদের কেউ কেউ মহির সরকারের বাড়ির প্রাঙ্গণে এসে জড়ো হয়। অনেকটা সময় পার হয়ে যাওয়ার পরও তারা ঘটনার আকস্মিকতার বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে পারে না; মহির সরকারের বাড়ির বাইরের উঠোনে লম্বা বেঞ্চে গোবর এবং বিচালির গন্ধের ভেতর বাকরহিত হয়ে বসে থাকে এবং থেলো হুঁকোয় তামাক খায়। সেই ভোরের নরম এবং শীতল আলোয় হুঁকো টানার জলজ শব্দে তাদের যে ইন্দ্রিয়াচ্ছন্নতা হয় তার ভেতর পূর্বদিনের রাতের ঘটনা একটি দূরবর্তী দুঃস্বপ্নের মতো ভেসে থাকে এবং সবকিছুর ভেতর চাঁদের প্রসঙ্গটি যেন তাদের কাছে বড় হয়ে ওঠে। তারা স্মরণ করতে পারে যে, এক অতিকায় চাঁদ উঠেছিল আগের দিন সন্ধ্যায়। হয়তোবা চাঁদের এই জাগরণে ব্যতিক্রমি কিছু ছিল না; কিন্তু ভাদ্র মাসের এই পূর্ণিমা রাতে সুহাসিনী গ্রামে যে ঘটনা ঘটে যায়, সে ঘটনায় গ্রামের মানুষ স্তম্ভিত হয়; কিন্তু তারপর তারা যখন এই ঘটনাবলি ব্যাখ্যা এবং বিশ্লেষণ করতে ব্যর্থ হয়, তখন মহির সরকারের বাড়ির উঠোনে তারা নির্বাক হয়ে হুঁকো টানে এবং তাদের শুধু পূর্ণিমার সেই চাঁদের কথা মনে পড়তে থাকে। তখন হুঁকোর গুড়গুড় শব্দ এবং খামিরা তামাকের গন্ধের ভেতর ডুবে থেকে তোরাপ আলি কথা বলে, সে বলে যে, আগের দিন সন্ধের সময় সে রাস্তার কিনারায় বেঁধে রাখা গরুর বাছুর ঘরে আনছিল; সে বলে, আমি পরথমে বুইজ্যার পারি নাই, শরীলের মইদ্দে কেমুন যানি ভাব হইবার নিছিল, কেমন যানি ঘোরঘোর নেশার নাহাল, চাইর দিকে কেমন যানি ধুলা ধুলা, কিন্তু ধুলার ভিতরে কেমন যানি ভাব, কেমন যানি রঙের নাহাল ছড়ায়া আছে; আমি তো বুজি না কি, খালি বুজি কিছু একটা; তার বাদে যহন ম্যাবাড়ির সামনে আইছি তহন বুইজব্যার পারি আসলে কি; দেহি কি ম্যাবাড়ির মাথাভাঙ্গা আম গাছটার ডাইন পাশ দিয়্যা পূন্নিমার চান ভাইসা উইঠছে। গ্রামবাসীদের সকলের এই চাদটির কথা মনে পড়ে এবং মহির সরকারের উঠোনে বসে তারা বলে যে, তাদের মনে হয়েছিল যেন এক ছিন্ন মুণ্ডুর মতো রক্তাক্ত চাদ গ্রামের মাথার উপর দিয়ে গড়িয়ে যায়। অমাবস্যার অন্ধকারের বদলে আততায়ীরা কেন পূর্ণিমার চন্দ্রালোকিত রাতকে বেছে নেয়, তা গ্রামবাসীরা বুঝতে পারে না; তারা কেবল এই বিষয়টি ভেবে বিস্মিত হতে থাকে যে, মফিজুদ্দিন মিয়া কি করে মারা যেতে পারে, এ রকম তো হওয়ার কথা ছিল না, তার তো ১১১ বৎসর বেঁচে থাকার কথা ছিল এবং তার বয়স তো মাত্র ৮১ বৎসর হয়েছিল বলে তারা জেনেছিল। মহির সরকারের উঠোনে কথা বলার সময় তোরাপ আলিও এই প্রসঙ্গটি সম্পর্কে ভয়ানক বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে, সে বলে, আগে যহন আমি ম্যাসাবের চুল কাইটতাম তখন ম্যাসাব একদিন আমাক সেই চিন্ন দেহাইছিল। এই কথা শুনে গ্রামের লোকেরা স্মরণ করতে পারে যে, তোরাপ আলি একসময় এই গ্রামে নরসুন্দরের কাজ করত, এ কথাটি সত্য, পরে তার স্ত্রীর ক্রমাগত হুমকির মুখে সে পেশা পরিবর্তন করে গ্রামের ভেতর ছোটো একটি মুদি দোকান খোলে। তোরাপ আলি বলে, মুদি দোকান খোলার অনেক আগে, ম্যাসাবের বাইর বাড়ির গাবগাছ তলায় ভরদুপুরবেলা আমি ম্যাসাবের চুল কাইটত্যাছি, ম্যাসাবের গায়ে সাদা চাদরখান জড়ায়া দিছি, চাদরের নিচের কিনার দিয়্যা কজি পর্যন্ত হাত বাইর হয়া রইছে; তোরাপ আলি বলে যে, তখন একসময়, ঝকঝক করে কঁচি চালাতে চালাতে সে খেয়াল করে যে, মফিজুদ্দিন মিয়া তার উরুর ওপর ডান হাতের তালু খুলে চিৎকরে ধরে আছে; সে বলে, চান্দাইকোনা থাইকতে আমি যহন চুল কাটার কাম শিখি, তখন এক ওস্তাদের কাছে আমি মানুষের হাত দেখা শিখছিলাম। তোরাপ আলির মুখে এই কথা শুনে সেই ব্যাতিক্রমি সময়ের ভেতরেও গ্রামের লোকেরা কেমন বিভ্রান্ত বোধ করে, গ্রামের প্রাক্তন নাপিত তোরাপ আলি জোতিষবিদ্যা জানে এ কথা তারা কখনো শুনেছিল কি না, তা তারা স্মরণ করতে পারে না, কিন্তু সময়টা ছিল তর্কের অনুপযুক্ত, তারা তাদের বিভ্রান্তিসহ নীরবে বক্তার মুখের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করে। তোরাপ আলি বলে যে, তখন সেই মুহূর্তে তার সামনে সে অসাধারণ একটি করতল প্রসারিত দেখতে পায়; মহির সরকারের উঠোনে জড়ো হওয়া কৃষকদের নির্লিপ্ত মুখের দিকে তাকিয়ে সে বলে, আমার ওস্তাদ শিখাইছিল যে, মাইনষের জীবনের উপুর ভর কইর্যা থাকে চাইরটা জিনিস, এ্যার একটা হইলো সূরযো, তার বাদে চান, মঙ্গল আর শনি; মাইনষের হাতে থাকে এই চাইর জনের রাজত্বের হিসাব, যুদি শনির রাজত্ব বাইড়া যায় তাইলে বাণিজ্যের নাও মাইর খায়, ফসলে পোকা হাঁটে, আন্ধারে পেঁচা ডাইক্যা ওঠে, আসে দুর্দিন; তবে সূরযের রাজত্ব যুদি বড় থাকে তাহইলে সাহস থাকে কইলজা জোড়া, আর তাইলে শনি কাবু হয়্যা থাকে; আর মঙ্গল যুদি রাজা হয় তাইলে সব ভালো; কিন্তু চান্দের রাজত্ব যুদি বড় হয় তাইলে কি হয় ওস্তাদ? আমি জিজ্ঞাস করি, আমার ওস্তাদ কয়, এ্যার কোনো ভালো-মন্দ নাই, কিম্বা এইটা ভালো-মন্দ দুই-ই; চান্দের আলো যহন ফেরেশতারা পিরথিবীতে ঢাইল্যা দেয়, তহন বিরিক্ষ আর পশুপাখির পরান নিঝঝুম হয়্যা আসে, তহন চান্দের রাজত্বে যে যায় সে কইতে পারে না, সে জাইগা না ঘুমায়া আছে, সে য্যান খালি এক নেশার ভিতর দিয়্যা হাইট্যা যায়; এই কথা কইছিল আমার সেই ওস্তাদ; আর সেইদিন ম্যাবাড়ির উঠানে গাবগাছের ছায়ায় চিৎ কইরা রাখা ম্যাসাবের হাতের জমিনে আমি সূরযের রাজত্ব বড় শক্ত দেখি, কিন্তু তার হাতের তালুত তার চাইতে বড় আছিল চান্দের পাহাড়। তোরাপ আলি বলে যে, মফিজুদ্দিন মিয়ার করতলের রেখা দেখে বহুদিন পূর্বে সেই দুপুরে সে ভয়ানক চঞ্চল হয়ে উঠেছিল, কারণ সে বলে যে, মানুষের হাতের রেখা আঙুলের দিক থেকে কজির দিকে নেমে আসে, কিন্তু মফিজুদ্দিন মিয়ার হাতের রেখাগুলো কজির কাছাকাছি স্থানে জটলাবন্ধ ছিল এবং এই জট থেকে তিনটি পাকানো দড়ির মতো রেখা আঙুলের দিকে প্রবাহিত হয়ে, কনিষ্ঠা ও অনামিকা, অনামিকা ও মধ্যমা এবং মধ্যমা ও তর্জনীর মাঝখানের গর্তে পতিত হয়েছিল। তোরাপ আলি বলে যে, মফিজুদ্দিন মিয়ার করতলের রেখাগুলোর, হাতের আঙুল বেয়ে নিচের দিকে নেমে যাওয়ার এই দৃশ্যে তার এক অস্বস্তিকর অনুভূতি হয়েছিল, তার কেমন ভয় লেগেছিল যেন; সে বলে, আমি চুল কাটা থামায়া তাকায়া থাকি, জিজ্ঞাস করি, ম্যাসাব আপনের হাতের রেখাগুলান এই রকম ক্যা? ম্যাসাব বিরক্ত হয় নাকি আমার কথা শুইন্যা, তা বুজিবার পারি না, কেমন গম্ভীর হয়্যা কয়, কি রকম? আমি সাহস রাইখ্যা কই, কেমন যানি গড়ায়া পইড়ত্যাছে, কি যানি বায়া পইড়ত্যাছে জমিনের দিকে মনে হয়। আমার এই কথা শুইন্যা ম্যাসাব নিজের হাতখান ঘুরায়া ফিরায়া দেইখলো, যানি নিজের হাত এ্যার আগে নিজেই দেখে নাই, তার বাদে এক পাশে নিচের দিকে ঝুলায়া দিয়া কইলো, যে জিনিস ঝইরা পড়ে তোরাপ, তা হইতাছে জেবন, এই হাত থেইক্যা যা ঝইরা পড়ে তা হইলো ত্যাজ; আমার এই বাড়ি আর এই গেরামে আমি কি জেবন আর ত্যাজের আবাদ করি নাই? তোরাপ আলি জালের মতো গল্পের যে শাখা-প্রশাখা বিস্তৃত করে, তার ভেতর মহির সরকারের উঠোনে সমবেত সুহাসিনীর লোকেরা ক্রমাগতভাবে জড়িয়ে যেতে থাকে, তাদের দিকে তাকিয়ে থেকে হুঁকোয় একটা লম্বা টান দিয়ে সে বলে যে, মফিজুদ্দিন মিয়ার বক্তব্য শোনার পরও তার কেমন যানি ভয় হয়েছিল এবং তার এই ভয় দেখে মফিজুদ্দিন মিয়া তাকে বলেছিল যে, হাতের রেখায় সে বিশ্বাস করে না, সে বলেছিল, আমি এক শ এগারো বচ্ছর বাঁচমু, এইট্যা লেখা হয়্যা আছে। তোরাপ আলি বলে যে, তখন সেই দুপুরবেলা গাবগাছের ঘন ছায়ার ভেতর মফিজুদ্দিন মিয়া তার লুঙ্গির গিট খসিয়ে নিতম্বের ডান দিকটা উন্মুক্ত করে তাকে দেখায় এবং তোরাপ আলি বলে যে, সে দেখতে পায় বার্ধক্যে কুঁচকে আসা নিতম্বের চামড়ার ওপর যেন কালো কালি দিয়ে লেখা আছে ১১১; সে বলে, আমার তবু কেমন যানি ভয় যায় নাই, কিন্তু তহন বুইজ্যার পারি নাই, এইট্যা কি; এহন বুইজতাছি, ম্যাসাবের হাতের রেখা বায়া আমার মনে হইছিল যানি রক্ত ঝইরা পড়ে; কাইল বিকালে যহন গরুর বাছুর ঘরে আনি, চান্দের নাল টকটকা চেহারা দেইখ্যা মনের ভিতরে আমার জানা আছিল, তবু কেন যানি বুঝি নাই যে, ম্যাসাবের হাতের ভিতর থেইক্যা খইস্যা ভাইস্যা উঠছিল ওই চান, ওই চান চুবান আছিল রক্তের ভিতর। তোরাপ আলির কথা যখন থামে, গ্রামের লোকদের সেই চাদটির কথা বিশদ মনে পড়তে থাকে; তারা যদিও জ্যোতিষবিদ্যায় তোরাপের পারঙ্গমতায় আশ্বস্ত হতে পারে না, তবু তাদের কারো কারো, যারা এখন বৃদ্ধ, যারা তাদের শৈশব এবং কৈশোরে মফিজুদ্দিনকে দেখেছে অথবা গল্প শুনেছে তার সম্পর্কে, তাদের মনে এ রকম একটি সন্দেহ দানা বেঁধে ওঠে যে, মফিজুদ্দিন মিয়ার সম্ভবত চাঁদের সঙ্গে কোনো এক ধরনের সম্পর্ক ছিল।
সুহাসিনীর লোকদের মনে পড়ে যে, মফিজুদ্দিনের মা ছিল বোবা, এতটুকু শব্দও সে করতে সক্ষম ছিল না এবং এই বোবা নারী, খালের পাড়ে একটি পোড়োভিটেয় তাদের জীর্ণ কুঁড়েঘরে, যে দিন রাতে তাকে প্রসব করার প্রক্রিয়ায় খড়ের গাদার ওপর, রক্তের ভেতর নিঃশব্দ যন্ত্রণায় দাপাদাপি করছিল, তখন তার পিতা আকালু ঘরের দরজায় বসে তামাক সেবন করছিল। সুহাসিনীর লোকেরা পরে জানতে পারে যে, আকালুর বোবা স্ত্রী খুব কষ্টের পর একটি ছেলেসন্তানের জন্ম দেয় এবং ছেলেটির জন্মের সেই একটি মুহূর্তে কুঁড়েঘরের দুয়ারে বসে প্রতীক্ষারত আকালু ঘরের ভেতর থেকে নবজাতকের চিৎকার শোনে এবং তখন গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে একচিলতে জ্যোত্ম তার পায়ের কাছে এসে লুটিয়ে পড়ে। আকালু পরে গ্রামের লোকদের বলে যে, শিশুটি চিৎকার করে ওঠামাত্র যেন জমে ওঠা অন্ধকার কেটে গিয়ে চাঁদের এই আলো এসে পড়ে এবং তখন সে বুঝতে পারে যে, সে রাতে পূর্ণিমা ছিল এবং এতক্ষণ এই পূর্ণিমার চাঁদে গ্রহণ লেগেছিল; গ্রহণ কেটে যাওয়ার শুরুর মুহূর্তে শিশুটি জন্মায় অথবা শিশুটির জন্মের মুহূর্তে গ্রহণ কেটে যেতে থাকে। আকালু বলে, ঘরের মইদ্দে ছাওয়ালের চিখুর হুইন্যা চইক্যা উইঠছি, দেখি কি, আমার ডাইন পায়ের পাতার উপুর চান্দের আলো আইস্যা পইড়ছে; সে বলে যে, একমুহূর্তে তার অন্তর আনন্দে ভরে যায় এবং তখন সে ঘরে ঢুকে ক্লান্ত স্ত্রীর দুপায়ের মাঝখানে ভেজা খড়ের ওপর শিশুটিকে কুড়িয়ে পায়, যেমন সুহাসিনীর লোকেরা বলে যে, একদা সে তার এই নীরব স্ত্রীটিকে কুড়িয়ে পেয়েছিল। কিন্তু সেদিন রাতে ঘরের ভেতর ঢুকে তার স্ত্রীর ক্লান্তিজনিত তন্দ্রার কারণে মানুষের এই শিশুটিকে কুড়িয়ে তুলে আনতে পারে না, সে দেখে যে, নবজাতক শিশু এবং তার মার মধ্যকার সম্বন্ধ সূত্রটি তখনো অটুট রয়ে গেছে। তখন শিশুটির এই অবস্থা দেখে তার এবার হাসি পায়, কারণ তার মনে হয় যে, শিশুটি খুঁটোয় বাধা ছাগলের বাচ্চার মতো আটকা পড়ে গেছে; কিন্তু কোনো কিছু না ভেবেই অথবা অজানা একধরনের ভয়ে সে হাত গুটিয়ে নেয়, জরায়ুর ভেতর থেকে নাড়ি টেনে বের করে শিশুটিকে মুক্ত করার চেষ্টা না করে অপেক্ষা করে। তারপর জরায়ুর ভেতর থেকে ফুল বেরিয়ে এলে শিশুটি যখন বিচ্ছিন্ন হয়, সে শিশুটিকে অন্ধকারে খড়ের ওপর নগ্ন জননীর বুকের কাছে রেখে বের হয়ে যায় এবং আকাশের দিকে মুখ উঁচু করে দেখে যে, চাঁদ ক্রমে রাহুর গ্রাস থেকে বের হয়ে আসে, এবং গাছের পাতায় এবং প্রান্তর জুড়ে জ্যোৎস্না ঝরে পড়তে থাকে এবং আকালুর মনে হয় যেন, রাতের নিস্তব্ধ চরাচরে এই জ্যোৎস্না পতনের ঝমঝম শব্দ সে শুনতে পায়। সে তার কুঁড়েঘরের দরজার কাছে দাওয়ায় বসে তুষের আগুনে কলকিতে তামাক সেজে ধূমপান করে, তারপর পূর্ণিমার চাঁদটি যখন পরিপূর্ণরূপে অনাবৃত হয়ে ঠিক মাথার ওপর ফুটে ওঠে তখন পুনরায় তার কুঁড়েঘরের ভেতর যায় এবং সে স্তন চোষার চুকচুক শব্দ শোনে। এরপর সুহাসিনীর ভূমিহীন কৃষক এবং একটি পোড়াভিটায় বোবা স্ত্রীকে নিয়ে একা একা বসবাসকারী আকালু ব্যস্ত হয়ে পড়ে, সে ভিটার পিছন দিকের বাঁশের ঝোপ থেকে বাঁশের চটা কেটে আনে এবং শিশুটিকে মায়ের কোলের ভেতর থেকে তুলে বাইরে চাঁদের আলোয় নিয়ে আসে। তারপর সে বাঁশের চটা দিয়ে শিশুটির নাড়ি কেটে সুতো দিয়ে বেঁধে দেয় এবং গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে ভিটার ওপর অঝোরধারায় নেমে আসা জ্যোৎস্নার আলোয় কলসিতে রাখা পানি দিয়ে তাকে গোসল করায়।
পরে, ভাদ্র মাসের এক পূর্ণিমা রাতে সুহাসিনীতে যে ঘটনা ঘটে যায় তার পরদিন সকালে মহির সরকারের বাড়ির উঠোনে তামাক সেবনরত গ্রামবাসী মফিজুদ্দিন মিয়ার জন্মের ঘটনা নিয়ে কথা বলার সময় যখন পূর্ণিমার জ্যোত্সার কথায় ফিরে আসে, তাদের পুনরায় কেমন দিশেহারা ভাব হয়। তোরাপ আলি পুনরায় চাঁদের পূর্বের বর্ণনায় ফিরে যায়, সে বলে যে, তার কেমন যেন শারীরিক অনুভূতি হয়েছিল, যখন সে মিয়াবাড়ির মাথাভাঙা আমগাছের ঠিক ওপরে মফিজুদ্দিন মিয়ার করতলের ভেতর থেকে ফসকে বেরিয়ে যাওয়া চাঁদটিকে দেখতে পায়; সে বলে, তহুনো আন্ধার হয় নাই, চাইর দিকে ভালোই দেখা যায়, এই সময় দেহি আসমানে এক বিদঘুইট্টা চান, আর নিচে, ম্যাবাড়ির সামনের পালানে ফজলের মা লাল শাক তোলে। গ্রামবাসীদের স্মৃতি তখন চমকিত হয়, ফজলের মার নাম তাদেরকে চমকিত করে তোলে, তাদের মনে পড়ে, মিয়াবাড়িতে লাশের সারির ভেতর তারা ফজলের মাকে দেখে নাই। তখন তাদের আবার এরকম মনে হতে থাকে যে, তারা হয়তোবা ফজলের মার মৃতদেহও দেখেছিল; এবং এই বিভ্রান্তির ভেতর তাদের মনে হয় যে, তাদের স্মৃতিভ্রংশ হয়ে গেছে; মিয়াবাড়িতে সেদিন সকালে কতগুলো লাশ দেখেছিল তার সংখ্যা তারা নির্ণয় করতে পারে না, কজন মারা গেছে? দশ জন, বিশ জন, পঁয়ত্রিশ জন? তাদের মনে পড়ে, সেদিন সকালে মিয়াবাড়ির বাইরের উঠোনে সার দিয়ে সাজিয়ে রাখা লাশগুলো তারা গুনে দেখেছিল, কিংবা, তারা কি তা দেখেনি? মহির সরকারের বাড়ির প্রাঙ্গণে কাঠের বেঞ্চ এবং বিচালির ওপর বসে হুকো টানতে টানতে তারা বিভ্রান্তবোধ করে, তারা কিছু বুঝতে পারে না এবং তাদের মনে হয় যে, তারা কেমন ক্লান্ত হয়ে আছে। এই সময় তাদের প্রথম চাদটির কথা মনে পড়ে এবং তারপর মনে পড়ে আগের দিন মধ্যরাতের পর মিয়াবাড়ির ভিটার দিক থেকে আসা বিস্ফোরণের শব্দ এবং মানুষের চিৎকারে তাদের ঘুম ভেঙে যাওয়ার কথা। তারা বলে যে, বিস্ফোরণের শব্দে জেগে ওঠায় তাদের শরীরে কাঁপুনি দেখা দেয়, একাত্তর সনের মুক্তিযুদ্ধের পর তারা গ্রামে এমন শব্দ এবং বন্দুকের গুলির ফট ফট আওয়াজ আর শোনে নাই, কতক্ষণ ধরে তারা মানুষের চিৎকার শুনতে পেয়েছিল, তা তারা বলতে পারে না, তারা শুধু বলে, অনেকক্ষণ ধইর্যা; তারপর মিয়াবাড়ির ভিটার গাছপালার ঘেরের ভেতর থেকে তারা আগুনের শিখা জ্বলে উঠতে দেখে। মহির সরকারের বাড়ির উঠোনে বসে, এই ব্যাপারটি সম্পর্কে গ্রামের লোকেরা নিশ্চিত হয় যে, গুলি এবং বিস্ফোরণের শব্দ, মানুষের চিৎকার এবং আগুনের শিখার ভেতর মিয়াবাড়ির ভিটার দিকে তাকিয়ে আগের দিন রাতে তারা বুঝতে পেরেছিল যে, মিয়াবাড়ির লোকেরা শেষ হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তারা বুঝতে পারে নাই, তারা কি করবে; তাদের মনে হয় যে, তখন তাদের মেন অবসাদ লেগেছিল এবং বন্দুকের গুলি খাওয়ার ভয়ও হয়েছিল তাদের। তবে মিয়াবাড়ির দিক থেকে যখন আর কোনো শব্দ বা চিৎকার শোনা যায় না তখন গ্রামের লোকদের পুনরায় মনে হতে থাকে, তারা এই অবস্থায় কি করবে এবং এভাবে তারা যখন সেই ব্যাখ্যাতীত অবসাদ ত্যাগ করে বাড়ির বার হয়ে মিয়াবাড়ির দিকে রওনা হয় তখন সকালের প্রথম অস্পষ্ট আলো দেখা যায় এবং তারা যখন এই ফিকে অন্ধকারের ভেতর মিয়াবাড়ির ভিটায় উঠে আসে, তারা ধ্বংসযজ্ঞের সেই দৃশ্য দেখতে পায় এবং তাদের কেয়ামতের কথা মনে হয়; বিধ্বস্ত এবং প্রজ্বলিত বাড়িঘরের দিকে তাকিয়ে তারা বিহ্বল হয়ে পড়ে এবং তাদের অনেকেই বুঝতে পারে না যে, তাদের সব অবসাদের ভেতরও তারা কাঁদে। কতক্ষণ তারা হতবিহ্বল হয়ে সেই অগ্নিকুণ্ডের দিকে তাকিয়ে ছিল তা তারা বলতে পারে না, তবে একসময় তারা তৎপর হয়, তারা গ্রামের ভেতর থেকে দ্রুত বালতি সংগ্রহ করে এবং পুকুর থেকে পানি এনে আগুন নেভায়; তারপর পুড়ে যাওয়া বসতবাড়ি, ধানের গোলা, খড়ের গাদা, ঝোপঝাড় খুঁজে দেখে, কেবলমাত্র কাচারিঘরে বাইরে থেকে শিকল তুলে আটকে রাখা চারজন কামলা ছাড়া আর একটিও জীবিত মানুষ তারা দেখতে পায় না, তাবা তখন লাশ খুঁজে বার করে এবং বয়ে এনে বাড়ির বাইরের উঠোনে ছাই এবং কাদার ওপর রাখে। এখানে তারা কটি লাশ রেখেছিল তার হিসেব তারা অল্প সময়ের ভেতর ভুলে যায়, মহির সরকারের বাড়ির উঠোনে বসে তারা যখন আঙুলে গুনে হিসেব করার চেষ্টা করে, সমগ্র হিসেব তারা দাঁড় করাতে পারে না; তাদের শুধু মনে হয়, অনেক লাশ ছিল, সকলের লাশ ছিল সেখানে। তাদের মনে পড়ে মফিজুদ্দিন মিয়ার গলার নিচ থেকে হৃৎপিণ্ড পর্যন্ত গুলির ক্ষত ছিল, লাশের সারিতে তার আট ছেলের প্রত্যেকে ছিল, ছিল ছেলেদের স্ত্রী এবং সন্তানেরা; মহির সরকারের উঠোনে বসে থাকা কৃষকেরা লাশের হিসেব করতে গিয়ে বিপর্যস্ত বোধ করে, কতজন ছিল মোট? তারা মনে করতে পারে না তখন মহির সরকারের উঠোন ছেড়ে তারা বের হয়, লুঙ্গি উঁচু করে ধরে খাল পার হয়ে তারা পুনরায় মিয়াবাড়ির ভিটায় এসে ওঠে, কিন্তু তাদের আর লাশ দেখার সুযোগ হয় না, এবার তারা বাড়ি ভরতি পুলিশ দেখতে পায়; পুলিশেরা মিয়াবাড়ির ভিটার চারদিকে পাহারা বসায়, বেশি মানুষজনকে কাছে ভিড়তে দেয় না। এই সময় গ্রামের মুদি দোকানদার তোরাপ আলি একজন পুলিশের সামনে গিয়ে সালাম দিয়ে দাঁড়ায় এবং চেহারায় একধরনের সতর্ক নির্লিপ্ততা ধরে রেখে, কতজন মরেছে তার সংখ্যা জানতে চায় এবং এভাবে সে জড়িয়ে পড়ে; কারণ, পুলিশটি লাশের সংখ্যা বলতে না পারলেও তোরাপ আলিকে ছেড়ে দেয় না, সে কোনো কিছু জানে কি না জানতে চায়। পুলিশটির কথা শুনে তোরাপ আলির প্রথমেই খুব স্বাভাবিকভাবে মনে হয়, সে কিছুই জানে না, সে বলে, না, কি জানমু? কিন্তু তখন, কিছুক্ষণ আগে মহির সরকারের বাড়ির উঠোনে যে চাদটির কথা সে বলেছিল, তার সেই অসাধারণ চাদটির কথা পুনরায় মনে পড়ে এবং সে আগের দিন সন্ধেয় জেগে ওঠা অস্বাভাবিক ধরনের এই চাঁদের কথা পুলিশটিকে বলে, এ রহম চান আমি জিন্দেগিতে দেহি নাই, মনে হইছিল যানি রক্তের ভিতর চুবান খায়া উইঠছিল চানটা, এবং তার এই কথা শুনে পুলিশ তাকে আটকায়। তোরাপ আলির আটক হওয়ার খবর শোনার পর সুহাসিনীর লোকেরা ভয় পেয়ে যায়, তারা দিনের বেলাটা কোনোরকমে পার করার পর রাতের অন্ধকার নামমাত্র বৌ-ছেলেমেয়ের হাত ধরে বিছানা-বালিশের পুঁটলি মাথায় নিয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে পাশের গ্রামগুলোতে গিয়ে ওঠে। ভয় পেয়ে গ্রামের কৃষকদের ব্যাপক হারে ভিটে ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনায় পুলিশের বেকায়দা হয়, তারা একদিন পরেই তোরাপ আলিকে ছেড়ে দেয় এবং বেশি তৎপরতা না দেখিয়ে দু-একদিন চুপ করে থেকে মাইক দিয়ে আশপাশের গ্রামে অভয় বাণী প্রচার করলে সুহাসিনীর লোকেরা পুনরায় তাদের পরিত্যক্ত ভিটায় ফিরে আসতে থাকে। তখন পুলিশ নীরবে আবার তৎপর হয়ে ওঠে, তারা সুহাসিনীতে একটি অস্থায়ী ফাঁড়ি বসায় এবং একজন একজন করে লোক ধরতে থাকে।
পুলিশের ভয়ে ভিটা ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে পুনরায় ফিরে আসার পর, এই সময় গ্রামের লোকেরা একটি পুরনো প্রসঙ্গ পরিবর্তিত আকারে নূতন করে শোনে এবং তারা বুঝতে পারে যে, মফিজুদ্দিন মিয়ার উপজেলা চেয়ারম্যান হওয়া হলো না। সুহাসিনীর লোকেরা এই কথাটি জেনেছিল যে, রায়গঞ্জকে এখন আর থানা নয়, উপজেলা বলা হবে এবং এই উপজেলার একজন চেয়ারম্যান থাকবে, রায়গঞ্জের মানুষের ভোটে সে নির্বাচিত হবে এবং তাদের মনে পড়ে যে, উপজেলায় একজন চেয়ারম্যান থাকবে এ কথা শুনে মফিজুদ্দিন মিয়া বলেছিল যে, সে-ই চেয়ারম্যান হবে। সুহাসিনীর লোকদের সে বলে, চেয়ারম্যনি আমি-ই হমু, বরমোগাছা ইউনিয়নে আমি আজীবন চেয়ারম্যান আছি, তোমরা আমাক সব সময় চেয়ারম্যান বানাইছ, আমি উপজেলার চেয়ারম্যানও হমু, আর তা তোমাগোরে ভালর নেইগাই। তারপর সে সুহাসিনীতে দীর্ঘদিন ধরে সম্পাদিত তার কাজের কথা গ্রামের লোকদের স্মরণ করিয়ে দেয় এবং বলে, এইখানে যহন কেউ পারে নাই তহন এই জেলা বোর্ডের রাস্তার উপুর এই গেরামের মাইনষের সুবিধার নেইগা কি আমি নয়নতারার হাট বসাই নাই? আমি কি তোমাগোরে নেইগা অনেক কিছু করি নাই? দশগেরামের মানুষ যহন খরায় কষ্ট পাইত্যাছিল, মাঠে ফসল আর ঘরে সুখ আছিল না, তহন এই যে গেরামের ভিতর জালের নাহাল পানি ভরা খাল, এইগুলান কি আমি ঘোড়ার ব্যবস্থা করি নাই? আমি কি তোমাগোরে দুঃখ-দুর্দশায় সক্কলের আগে খাড়া হই নাই, আর, আমি কি এই রায়গঞ্জে, এই বরমোগাছা আর তোমাগোরের সুহাসিনীর নেইগ্যা অত্যাচার সইহ্য করি নাই? গ্রামের ভিতরে কুত্তা মারার মাঠের উপুর দিয়্যা যুদি তাকাও, যুদি ম্যাটি ইক্যা দেখ তাইলে আমার শরীলের ঘামের গন্ধ কি পাওয়া যায় না?
সুহাসিনীর লোকদের তখন কুকুর মারার মাঠের কথা মনে পড়ে এবং গ্রামের যারা প্রবীণ, তারা দেখতে পায় যে, তাদের জীবনের সমুদয় গল্পের সঙ্গে ঘাস এবং লতার মতো জড়িয়ে আছে মফিজুদ্দিন মিয়ার অস্তিত্ব। তারা বলে যে, বহুদিন আগে মফিজুদ্দিন যখন মফিজুদ্দিন মিয়া হয়ে ওঠে নাই, মফিজুদ্দি ছিল–তখন তাদের শৈশবের কাল ছিল আর মফিজুদ্দিনের ছিল কৈশোর–তখন চৌদ্দ কিংবা পনেরো বছর বয়স ছিল তার। তখন একদিন গ্রামের লোকেরা জানতে পারে যে আকালুর ছেলে মফিজুদ্দিন পাগল হয়ে গেছে এবং লাঠি হাতে গ্রামের ভেতর সে একটি কুকুরকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। সেদিন সারা দিন সে ঘরে ফেরে না, তার বোবা মা উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়ে এবং তার পিতা আকালু যখন তাকে খুঁজে বের করে ঘরে নিয়ে যেতে চায়, সে ফিরে যেতে অস্বীকার করে; সে বলে যে, কাজিদের কুকুর তাকে কামড় দেয়ার জন্য তাড়া করেছিল, সেই খ্যাপা কুকুর দেখে সে ছুটে পালাতে চেষ্টা করেছিল, কিন্তু কুকুরটা তার পিছু ছাড়ে নাই। কুকুরটি তাকে গ্রামের পশ্চিম প্রান্তে রৌহার বিল পর্যন্ত তাড়িয়ে নিয়ে যায় এবং এখানে এই বিলের পাশে মফিজুদ্দিন একটি পুঁতে রাখা বাঁশের লাঠি পায়, সে লাঠিটা টেনে তুলে নেয় এবং তারপর মফিজুদ্দিন এবং কুকুরটি উল্টো ছোটা শুরু হয়। গ্রামের লোকেরা এ বিষয়ে একমত হয়েছিল যে, কাজিদের এই কুকুরটি পাগল হয়ে গেছে, তাদের অনেককে এর আগে প্রাণীটি তাড়া করেছিল; এবং সেদিন উল্টো দৌড় শুরু হওয়ার পর তারা দেখতে পায় যে, সুহাসিনীর মাঠ এবং ভিটাবাড়ির ওপর দিয়ে মফিজুদ্দিন লাঠি হাতে প্রাণীটিকে তাড়া করে ফেরে। সারা দিনের এই দৌড়ের পর মফিজুদ্দিন অথবা কাজিদের কুকুর কোনটি বা কে বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়ে তা গ্রামের লোকেরা জানতে পারে না, তবে সেদিন রাতে তারা এই ঘটনার শেষাংটা জানতে পারে; তারা শোনে যে, সারা দিন ছুটে বেড়ানোর পরও মফিজুদ্দিন যখন পিছু ছাড়ে না, কুকুরটি তখন পুনরায় রৌহার বিলের দিকে ছুটে গিয়ে বিলের পাড়ে নল খাগড়ার জঙ্গলের ভেতর লুকায় এবং মফিজুদ্দিন সেই জঙ্গলের মুখের কাছে লাঠি হাতে বসে থাকে। সেদিন আকালু যখন অন্ধকারের ভেতর রৌহার পাড়ের কাছে তার ছেলেকে খুঁজে বের করে, তখন মফিজুদ্দিন ভূলুণ্ঠিত অবস্থায় বুকের ভেতর বাঁশের লাঠি জড়িয়ে ধরে নিদ্রামগ্ন ছিল। সেদিন রাতে গ্রামের লোকেরা যখন এই কথা শোনে, তারা হাসে এবং পরদিন আকালুর সঙ্গে নিড়ানির কাজ করার জন্য সে যখন মাঠে আসে তখন মাঠের কৃষকেরা তাকে বলে, ক্যাবা মফিজদ্দি, কাইল হারাদিন কয়ডো কুত্তা মাইরল্যা? মফিজুদ্দিন গ্রামের লোকদের এই পরিহাসের উত্তর দেয় না, কিন্তু সেদিন বিকেলে কুকুর হত্যার ঘটনাটি ঘটে; গ্রামের কয়েকটি বাড়ির কিছু যুবক এবং কিশোর কাজিদের সেই কুকুরটিকে তাড়া করে নিয়ে আসে এবং এই দলের ভেতর সকলের আগে মফিজুদ্দিনকে দেখা যায়। গ্রামের লোকেরা বুঝতে পারে যে, কাজিদের এই কুকুরের পিছনে মফিজুদ্দিনের লাঠি হাতে ছোটা, আগের দিন শেষ হয়ে যায় নাই; পরদিন তা আবার শুরু হয় এবং এদিন সে একটি দল নিয়ে আসে এবং এদিন কুকুরটি ভুল করে ভোলা ফসলের মাঠের উপর দিয়ে দৌড় দেয় এবং স্বভাবতই সেখানে লুকানোর জায়গা না থাকায় ছ/সাত জন তরুণ কুকুরটিকে ধাওয়া করে লাঠি দিয়ে পেটাতে থাকে। খুব শীঘ্রই এই যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে, কুকুরটি আর পেরে ওঠে না, মাটির উপর পড়ে যায়; তখন সেই তরুণেরা মাটি খুঁড়ে মৃত কুকুরটিকে ফসলের মাঠের ভেতর পুঁতে ফেলে। তারপর থেকে ফসলের এই বিস্তৃত মাঠকে গ্রামের লোকেরা কখনো কুত্তা মারার মাঠ বলে উল্লেখ করতে থাকে এবং গ্রামের লোকেরা এখন যারা প্রবীণ, তাদের মনে পড়ে, অথবা তারা পরে হয়তো পুনরায় এইসব গল্প শুনেছিল যে, কাজিদের মালিকানাধীন পাগলা কুকুরটিকে মেরে ফেলায় কাজিদের ভয়ানক অপমান ও রাগ হয়। তারা এ বিষয়ে রায়গঞ্জ থানায় গিয়ে নালিশ করে এবং ফলে সুহাসিনীতে মফিজুদ্দিন বিখ্যাত হয়ে ওঠে, গ্রামের লোকেরা যখন এই সব গল্প শোনে, তারা বলে, আকালুর ছাওয়ালডোর ত্যাজ আছে বাপু। গ্রামের কাজিবাড়ির লোকেরা থানায় গিয়ে নালিশ করার পর একদিন বিকেলে দুজন সিপাইকে সঙ্গে নিয়ে একজন এএসআই সুহাসিনীতে এসে হাজির হয়। কাজিরা কি ধরনের অভিযোগ করেছিল গ্রামের লোকদের তা নির্দিষ্টভাবে জানা ছিল না, তবে খাকি রঙের শার্ট হাফ প্যান্ট পরা পুলিশের ছোট দারোগাটি যখন হিন্দুস্তানি ভাষায় জিজ্ঞেস করে, তারা মফিজুদ্দিনকে চেনে কি না, তখন গ্রামের লোকেরা নিশ্চিতরূপেই বুঝতে পারে যে, এটা পাগলা কুকুর মেরে ফেলার জের, তারা প্রথমে একটু ইতস্তত করে তারপর বলে যে, হ্যাঁ তারা আকালুর ছেলে মফিজুদ্দিনকে চেনে এবং পুলিশকে আকালুর ভিটা দেখিয়ে দেয়; তারপর পুলিশ যখন জানতে চায় যে, মফিজুদ্দিন কি খুব ডাকাতের মতো লোক, সে কি কোনো দল গড়েছে, সে কি গ্রামের ভেতর তছনছ করে বেড়ায়? তখন সুহাসিনীর লোকেরা বিভ্রান্ত বোধ করে, ভালো করে বিষয়টা বুঝতে পারে না; তারা বলে, আপনেরা কি কন! লোক না তো, ছ্যামড়া! গ্রামের এইসব লোকের কথা শুনে থানার ছোট দারোগার খুবই সন্দেহ হয়, কারণ তার মনে হয় যে, এই নিরীহ চাষিরা ভয়ানক প্রতারক হয়, এরাই টেররিস্টদের ভাত-কাপড় যোগায়; কিন্তু যখন দল এবং নাশকতার কোনো হদিস করতে পারে না তখন তারা কাজিদের বাড়ি কোনটা জানতে চায় এবং গ্রামবাসী কাজিদের ভিটা চিনিয়ে দিলে সন্ধে হয়ে আসার একটু আগ দিয়ে পুলিশ কাজিবাড়ির ভিটায় গিয়ে ওঠে। পুলিশ যখন ভয়ানক গালাগাল করতে থাকে মিথে: নালিশ করে তাদেরকে হয়রানি করার জন্য, তখন আলতাফ কাজি বলে যে, আকালুর ছেলে মফিজুদ্দিন একটা গুণ্ডা, সে তার পোষা কুকুরটিকে একদিন ধরে তাড়া করে বেড়ায়, তার পরদিন দল বেঁধে সেটাকে পিটিয়ে মারে; সে বলে, ওই ধানের ক্ষ্যাতের ভিতর তাড়ায়া নিয়া যায় আমার কুত্তাটাক মাইরা ফালায়। পুলিশ ব্যাপারটা বুঝতে পারে এবং দ্রুত থানায় ফিরে যায় এবং পুলিশ ফিরে গেলে গ্রামের ছেলেরা আকালুর বাড়ির দিকে ছোটে, তারা আকালুর ঘর এবং উঠোন খালি পড়ে থাকতে দেখে এবং তখন তারা দেখে যে, বাড়ির পিছনে ডোবার ধারে বাশঝাড়ের ভেতর মফিজুদ্দিনকে জড়িয়ে ধরে আকালু এবং তার বোবা স্ত্রী বসে আছে।
মফিজুদ্দিন মিয়ার বোবা মায়ের কথা গ্রামের বয়স্ক লোকদের স্মরণ হলে তাদের একধরনের ভালোলাগার অনুভূতি হয়; তারা যদিও কখনোই এই উপমাটি দাঁড় করাতে পারে নাই, তবু আকালুর বোবা স্ত্রীর কথা তারা যখন শোনে, তাদের সেই অনুভূতি হয়, যে রকম অনুভূতি তাদের হয় একটি শ্যামলা রঙের গাভীর শান্ত নির্বাক মুখ এবং ভিজা চোখের দিকে তাকালে। গ্রামের এই সব প্রবীণ লোক আকালুর স্ত্রীর গল্প তাদের শৈশবে তাদের মায়েদের কাছ থেকে শুনেছিল এবং পরে তা তাদের কাছ থেকে তাদের সন্তানেরা জানতে পারে; সুহাসিনীর প্রবীণ লোকেরা বলে যে, তারা অনেক কিছু শুনেছিল, আবার অনেক কিছু তারা শোনে নাই, অথবা অনেক কিছু হয়তো তারা শুনলেও ভুলে গিয়েছিল। তারা বলে যে, এই স্ত্রী লোকটিকে আকালু কোথায় পায় তা নির্দিষ্ট করে কেউ বলতে পারে না, তবে বহুদিন পূর্বে আকালুর জীর্ণ খড়ের কুটিরে যখন গ্রামের লোকের প্রথম একে দেখে সে মোটেও স্ত্রীলোক ছিল না, ছিল একেবারে শিশু, বয়স ছিল তিন কিংবা চার। সে সময় ক্ষেতমজুর আকালু গ্রামের মিয়াদের একটি পতিত ভিটায় তার বৃদ্ধা মাকে নিয়ে বাস করত এবং তখন তার বয়স ছিল পঁচিশ বৎসর; তখন একদিন গ্রামের লোকদের সে বলে যে গ্রামের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে আলি আসগর মিয়ার ধানক্ষেতের ভেতর, যার পাশ দিয়ে জেলা বোর্ডের রাস্তা চান্দাইকোনা থেকে এসে সিরাজগঞ্জের দিকে চলে গেছে, সে একটি বাচ্চা মেয়ে কুড়িয়ে পায়। আকালুর এই কথা গ্রামের মানুষ বিশ্বাস করতে চায় না, কিন্তু ঘটনার সত্যতা যখন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন তাদের এক ধরনের ঘৃণা হয়; কারণ তাদের মনে হয় যে, কোনো অবৈধ গর্ভের সন্তান হয়তো ফেলে দেয়া হয়েছিল এবং আকালু তা ধানক্ষেতের ভেতর থেকে কুড়িয়ে বাড়িতে নিয়ে আসে, তারা মাটির ওপর থুতু ফেলে হাত দিয়ে নাক চেপে ধরে এবং বলে, নাউযুবিল্লাহ; এবং তারপর এই শিশু মেয়েটিকে দেখার জন্য আকালুর বাড়ির অপরিচ্ছন্ন উঠোন গ্রামের মানুষে ভরে ওঠে। আকালুর মায়ের কোলের ভেতর বসে থাকা, পরিষ্কার কাপড় পরা ফর্সা মেয়েটিকে দেখে তারা বিস্মিত হয়ে পড়ে এবং একটি বিষয়ে তারা নিশ্চিত হয় যে, এই মেয়েটিকে গ্রামের ভেতর কেউ গোপন পাপের লজ্জায় ফেলে দিতে পারে না। তখন তারা এ বিষয়ে আকালুর বলা গল্প শোনে, সে বলে যে, সেদিন দুপুরে রোদের ভেতর আলি আসগর মিয়ার এই ক্ষেতটিকে সে ধান কাটার কাজ করছিল, উবু হয়ে দ্রুত কাঁচি চালানোর সময় সে হঠাৎ দেখে যে, একটু দূরে ধান গাছের ভেতর কি যেন নড়াচড়া করে। সে বলে যে, পাকা ধান গাছের ভেতর মৃদু আন্দোলন এবং শব্দে তার প্রথমে খুব ভয় হয়, আমার ক্যামন যানি তরাইসা নাগে, সে বলে। তারপর সে বলে যে, তার মনে হয় আধশোয়া হয়ে থাকা ধানের ভেতর হয়তো একটা খরগোশ লুকিয়ে আছে এবং তখন সে দৌড়ে বাড়ি গিয়ে মাছ মারার কোচটা নিয়ে আসার কথা ভাবে, কিন্তু একই সঙ্গে সে বুঝতে পারে যে, কোচ নিয়ে ফিরে আসতে আসতে খরগোশটি হয়তো সরে পড়বে, তখন সে ধান কাটার কাঁচি দিয়েই জটিকে ঘায়েল করার সিদ্ধান্ত নেয়। সে উবু হয়ে থেকেই খুব সন্তর্পণে এগিয়ে যায় এবং দেখতে পায় ধানক্ষেতের ভেতর কোনো খরগোশ লুকিয়ে নেই, পড়ে আছে একটি শিশু; সে বলে, এক্কেবারে কাছে যায়্যা আমি যহন ভাইবত্যাছি যে, এইবার কাঁচির আগাটা দিমু বসায়া, দেহি কি, হায় আমার আল্লাহ, ধান গাছের ফাঁক দিয়া দুইট্যা জ্বলজ্বইল্যা চোখ দেহা যায়, তহন আমার হুঁশ আসে, আমি বুইজ্যার পারি যে, এইট্যা তো কোনো খরগোশ না, এইটা একটা কচি ম্যায়ার মুখ, আর শরীলে তো সাদা সাদা লোম না, জামা। আকালু বলে যে, পাকা ধানের ক্ষেতে খরগোশের বদলে এ রকম একটি বাচ্চা মেয়েকে পড়ে থাকতে দেখে প্রথমে বিচলিত বোধ করে এবং বুঝতে পারে না সে কি করবে, তারপর সে হাঁটু গেড়ে বসে দুহাতের ভেতর মেয়েটিকে তুলে নেয় এবং এক দৌড়ে বাড়িতে এসে তার মায়ের কাছে দেয়। তখন সে এবং তার বুড়ো মা বুঝতে পারে, মেয়েটি কথা বলতে পারে না এবং কানেও শোনে না, এবং তখন সে বলে যে, এই নির্বাক এবং শান্ত শিশু মুখটার দিকে তাকিয়ে তার মনে বড় মায়া হয় এবং সে ঠিক করে যে, এই নির্বাক মেয়েটিকে সে রেখে দেবে। সুহাসিনী গ্রামের লোকদের মফিজুদ্দিন মিয়ার বোরা মায়ের সুহাসিনীতে আগমন-সম্পর্কিত এই বিভ্রান্তির কোনো দিনই আর সুরাহা হয় না। ধানক্ষেতের ভেতর একটি মেয়ে কুড়িয়ে পাওয়ার খবর যখন গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে তখন এ সম্পর্কে ব্যাখ্যা খুঁজে দেখা জরুরি হয়ে পড়ে এবং গ্রামের লোকেরা যখন এ নিয়ে মাথা খাটাতে থাকে তখন আকালু বলে যে, মেয়েটি আসলে মাটির ভেতর থেকেই উঠেছে, মাটি খুঁড়ে প্রথমে তার মাথাটি বের হয়ে আসে, এই সময় সে মেয়েটিকে দেখে এবং তাকে মাটি খুঁড়ে বের করে আনে; সে বলে, ক্যা মাটির ভিতর থেইক্যা গাছ যুদি উইঠপার পারে, তাইলে মানুষ উইঠলেও উঠপার পারে। কিন্তু আকালুর এই কথা গ্রহণ করা গ্রামের লোকদের পক্ষে খুবই কঠিন হয়, তারা বলে যে, মাটির ভেতর থেকে এমন সুন্দর জামা কাপড়সহ একটি মেয়ে বেরিয়ে আসতে পারে না। তখন এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে না পেয়ে আকালু কয়েক দিন চুপ করে থেকে ভাবে এবং তারপর একদিন বলে যে, সে মেয়েটাকে ন্যাংটোই পেয়েছিল; সে যখন ধান কাটছিল তখন সে তার নিকটেই ধান গাছের আলোড়নের শব্দ শুনতে পায় এবং দেখে যে, সেখানকার মাটি ফেটে গেছে। এবং সেখানে একটি ছোট্ট নগ্ন মেয়ে পড়ে আছে। কিন্তু আকালুর এই সংশোধিত গল্প শোনার পর গ্রামের লোকেরা যখন বলে যে, সে তাহলে এই মেয়ের জামা-কাপড় কোথায় পেল, তখন সে পুনরায় চুপ করে যায় এবং সুহাসিনীর মফিজুদ্দিন মিয়ার মায়ের আগমনের ঘটনা সম্পর্কে গ্রামের মানুষদের ভেতর তিনটি সম্ভাব্য তত্ত্ব প্রচারিত হয়। কিছু লোক বলে যে, আকালুর ভিটার উঁচু জামগাছের ডালে, যেখানে আকালু বড় বড় দুটো মাটির হাঁড়ি বেঁধে রেখেছে শীতের দিনের পথিক বালিহাঁসের ডিম পেড়ে যাওয়ার জন্য, সেখানে একদিন ডিমের খোজে আকালু উঠে দেখে যে হাঁড়ির ভেতর একটি ফুটফুটে মেয়ে বসে আছে। তারা বলে যে, এই কাণ্ডটি হয়তো কোনো দুষ্ট জিন করেছে; এই মেয়েটির দেশ হয়তোবা অনেক দূরে, হয়তোবা পারস্যে, হয়তোবা তুরস্কে, কারণ ওর গায়ের রঙ দেখো, চোখের তারা দেখো, নাক আর চিবুকের ডৌল দেখো! কিন্তু সংশয়বাদী কিছু লোক এই কাহিনী গ্রহণ করতে পারে না, তাদের কাছে ব্যাপারটা উদ্ভট বলে মনে হয়, তারা বলে যে, গাছের ডালের মাটির হাঁড়িতে এত বড় একটি মেয়ে বসে থাকতে পারে না এবং তাদের কেউ কেউ বলে যে, এই মেয়েটি সম্ভবত কোনো সদ্বংশীয় মেয়ে, হয়তোবা জমিদারবাড়ির, হয়তোবা ধনকুন্তির জমিদারবাড়িরই হবে। সিরাজগঞ্জ শহরে ধনকুন্তির জমিদারদের অনেক আত্মীয় আছে, হয়তো এই শিশুটি মায়ের সঙ্গে পালকিতে চড়ে সিরাজগঞ্জ যাচ্ছিল, হয়তোবা পালকির ভেতর তরুণী মাটির তন্দ্রা লেগেছিল এবং হয়তোবা সেই সময় পালকির দরজার ফাঁক দিয়ে শিশুটি নিচে পড়ে যায়; আর পালকির বেহায়ারা এমনই গুলিােের হয় যে তারা হনহনিয়ে চলে যায় শিশুটির পতন লক্ষ না করে, এবং পালকিটি এমন দ্রুত এগিয়ে যায় যে, শিশুটি বোবা হওয়ায় সে কোনো শব্দ করে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয় না। রাস্তার ওপর থেকে শিশুটি নিকটের ধানক্ষেতের ভেতর চলে আসে, এই সময় আকালু তাকে দেখতে পায় এবং বাড়িতে এনে তার বুড়ো মায়ের কোলে তুলে দেয়–এটা না করে সে যদি মেয়েটিকে নিয়ে মাঠেই অপেক্ষা করত, তাহলে সে হয়তো হারানো এই মেয়ের সন্ধানে ফিরে আসা লোকজন দেখতে পেত। কিন্তু সুহাসিনীতে এই গল্পও টেকে না, কারণ, শীঘ্রই একদিন ধনকুন্তিতে লোক পাঠানো হয় এবং তারা ফিরে আসে এই খবর নিয়ে যে, তাদের কোনো বাচ্চা মেয়ে হারানো যায় নাই। তখন অন্য এক দল লোক বলে যে, এই কাণ্ডটা আসলে ডাকাতরা ঘটিয়েছে, সেদিনের আগের রাতে কোথাও ডাকাতি করে ফেরার সময় তারা এই মেয়েটিকেও অপহরণ করে, কিন্তু পরে এই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় ধানক্ষেতের ভেতর ফেলে যায়। কিন্তু রায়গঞ্জ থানার পুলিশরা সুহাসিনী গ্রামের এক ভূমিহীন কৃষকের ক্ষেতের ভেতর বাচ্চা মেয়ে কুড়িয়ে পাওয়ার কথা শুনে চুপ করে থাকে, কারণ মেয়ে হারিয়ে যাওয়ার অভিযোগ তাদের কাছে কেউ করে নাই এবং তারা জানায় যে, আশপাশে সম্প্রতি কোনো ডাকাতি এবং ডাকাতির সময় শিশুকন্যা অপহরণের খবর তারা জানে না। তখন অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, গ্রামের লোকদের মনে হয় যেন আকালুর কথাই সত্যি, ধানক্ষেতের মাটির ভেতর থেকেই যেন এই কন্যাটির আবির্ভাব হয়েছিল এবং পরে গ্রামের লোকেরা এই কথাটিও জানতে পারে যে, মাটির মতোই, মৃণায়ী মেয়েটিও বোবা। এই মেয়েটির কি নাম ছিল তা সে নিজে বলতে পারে নাই এবং আকালুও এর নাম রাখার বিষয়টি খেয়াল করে না; পরবর্তী সময়ে গ্রামের লোকেরা বলে যে, মফিজুদ্দিন মিয়ার বোবা মায়ের কোনো নির্দিষ্ট নামের কথা তারা স্মরণ করতে পারে না, যদিও পরে একবার একদিন ভুল করে তাদের মনে হয়েছিল যে, তার মায়ের নাম বোধ হয়, নয়নতারা।
গ্রামের লোকেরা স্মরণ করতে পারে যে, বহুদিন পূর্বে এক বৃহস্পতিবার বিকেলে, সিরাজগঞ্জ-বগুড়া জেলা বোর্ডের রাস্তার পাশে সদ্য মাটিকাটা এক মাঠের ওপর গ্রামের লোকেরা যখন বাজার বসায় তখন মফিজুদ্দিনের যুবক বয়স; সে হাফ শার্ট আর লুঙ্গি পরে গ্রামের অনেকগুলো যুবকের সঙ্গে হাটের ভেতর দিয়ে হেঁটে গিয়ে এক প্রান্তে দাঁড়ায়, তাদের মাথার ওপর জেলা বোর্ডের রাস্তার কিনারার বড় কড়ই গাছের ছড়ানো শাখা বিস্তৃত ফণার মতো ঝুলে থাকে এবং গাছের এই সবুজ শাখার নিচে দাঁড়িয়ে, হাটের লোকেরা যখন তার চারদিকে ঘিরে আসে, সে তাদেরকে বলে যে, কোনো মাতবর কিংবা জমিদার তার কিছু করতে পারবে না, এবং গ্রামের লোকেরা সেদিন প্রথম মফিজুদ্দিনের জীবনের আয়ু-সম্পর্কিত তথ্যটি শোনে, সে তাদের দিকে হাত প্রসারিত করে দিয়ে বলে যে, সে এক শ এগারো বছর বাঁচবে, এতে কোনো ভুল নাই; তারপর সে এই নূতন লাগানো হাটের নামকরণ করে এবং বলে, আমি এই হাটের নাম দিলাম নয়নতারার হাট। এই নামটি শুনে গ্রামের লোকদের একধরনের বিস্ময় হয় এবং তাদের মফিজুদ্দিনের বোবা মৃত মায়ের কথা মনে পড়ে, তাদের মনে হয় যে, এই নামটি বোধ হয় তার সেই মায়ের, যার কোনো নাম এতকাল তারা শোনে নাই; কারণ তাদের অভিজ্ঞতা থেকে তারা স্মরণ করতে পারে যে, এ দেশে মানুষ তাদের জননীদের নামে তাদের সুকৃতির স্মারকচিহ্নগুলোর নামকরণ করে; তাই তখন সেই কড়ই গাছ তলায় তাকে ঘিরে থাকা মানুষেরা বলে ওঠে, এইটা ক্যাডা বাপু, এইটা কার নাম? তোমার মায়ের? এবং তখন গ্রামের লোকেরা জানতে পারে, নয়নতারা তার মায়ের নাম নয়, মফিজুদ্দিন তাকে ঘিরে থাকা লোকদের দিকে তাকিয়ে বলে যে, এটা তার মায়ের নাম নয়, নয়নতারা একটি বাজারের মেয়েমানুষের নাম। মফিজুদ্দিনের বলা বাক্যাবলি গ্রামের লোকেরা পরবর্তী সময়ে বহুদিন স্মরণ করতে পারে, সে বলে, নয়নতারা আমার মায়ের নাম না, নয়নতারা একটা ম্যায়া মানুষের নাম, নয়নতারা কি রহম ম্যায়া মানুষ আছিল আমি কইবার পারমু না, সে আছিল বাজাইর্যা ম্যায়া মানুষ, কিন্তু সে আছিল মায়ের নাহাল, বুইনের নাহাল, আরো অনেক কিছুর নাহাল; ম্যায়া মানুষ যা-ই হইক, ম্যায়া মানুষেক মাথায় কইরা রাইখপেন বাপু, ম্যায়া মানুষগোরে ছাড়া আমাগোরের বাঁচা নাই। সুহাসিনীতে নূতন লাগানো হাটের নাম যখন মফিজুদ্দিন নয়নতারার হাট রাখে এবং গ্রামের লোকেরা বুঝতে পারে যে, এটা তার মায়ের নাম নয়, তখন নয়নতারা সম্পর্কে তাদের ঔৎসুক্য হয়, কিন্তু মফিজুদ্দিনের মায়ের নাম তাদের আর জানা হয় না এবং তারা বুঝতে পারে যে, ধানক্ষেতের ভেতর কুড়িয়ে পাওয়া এই মেয়েটির নামকরণের বিষয়ে আকালু হয়তো সচেতন ছিল না, হয়তো প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে নাই, মানুষ যেমন নীরব গাছদের নামকরণ করে না। তবে গল্পের সময় কথা বলার সুবিধের জন্য গ্রামের লোকেরা সে সময় তাকে অকালুর মেয়ে বলত; আসলে শুধু এভাবে ডাকাই নয়, তাদের একসময় এ রকম মনে হয়েছিল যে, আকালু বস্তুত পিতার মমতা এবং যত্নে মেয়েটিকে লালন করেছিল, তার বুড়ো মা মরে যাওয়ার পর বালিকাটির দেখাশোনা করার পুরো ভার পড়েছিল তার একার ওপর। গ্রামের লোকেরা, পরে যখন ঘটনাটা অন্য রকম হয়ে দাঁড়ায়, এই উপমা দিয়েছিল যে, আকালু যেন নিজের হাতে কুমারী মাটিকে প্রস্তুত করেছিল প্রথম বর্ষায় নিজেই বীজ বপন করার জন্য। কারণ গ্রামের লোকেরা একসময় দেখে যে, আকালুর কুড়িয়ে পাওয়া যোবা মেয়েটির শরীরে গর্ভাবস্থার চিহ্ন ফুটে উঠতে থাকে এবং এ কথা যখন গ্রামে প্রচারিত হয় তখন গ্রামের লোকেরা আতঙ্কিত এবং ক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে, তারা বুঝতে পারে না এ রকম কি করে হয় এবং তারা বলে যে, এ পাপ, এ অন্যায়, এ ধর্মের বিরুদ্ধে কাজ। তখন একদিন শুক্রবারে জুম্মা নামাজ পড়ার জন্য মসজিদে গেলে মুসল্লিরা আকালুকে ঘিরে ধরে এবং আকালু তাদের ক্রুদ্ধ মুখের দিকে তাকিয়ে ক্রমাগত ঢোক গিলে, দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে বলে যে, বোবা মেয়েটিকে সে পাঙ্গাসি হাটের মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করে। সে বলে যে, মেয়েটি তার চাইতে অনেক ছোট হলেও এ কাজ না করে তার উপায় ছিল না, কারণ এই বোবা এবং কালা মেয়েকে সে কোথায় এবং কার কাছে বিয়ে দিত, কোথায় খুঁজে পেত সেই ছেলে, কে নিত এই মেয়েকে, যে একটি ছায়ার মতো নীরব এবং মুখাপেক্ষী; হয়তো কেউ তাকে নিত না, হয়তো নিলেও পুনরায় তাকে ফেলে যেত, যেমন একদিন হয়তো তাকে ফেলে গিয়েছিল কেউ। গ্রামের মানুষের আর কিছু বলার থাকে না এবং পরবর্তী সময়ে একদিন তারা আকালুর বোবা স্ত্রীর একটি পুত্রসন্তান প্রসবের খবর শোনে।
আকালুর বোবা স্ত্রী যেদিন সন্তান প্রসব করে, চাঁদের সেই পূর্ণিমা এবং গ্রহণের রাতে আকালু মাটিতে খড়ের ওপর হাঁটু গেড়ে বসে নগ্ন বোবা মায়ের স্তনের সঙ্গে লেগে থাকা ন্যাংটো সদ্যজাত ছেলেটির কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে নিচু মৃদু স্বরে আজান দেয়, আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর…। সে ঘরের মেঝের খড় পরিবর্তন করে বালিকা প্রসূতি এবং নবজাতক শিশুর শরীর শাড়ি এবং লুঙ্গি দিয়ে আবৃত করে, তারার এবং মাটির মালসায় তুষ ও কাঠকয়লার আগুন জ্বালিয়ে ঘরের দরজায় রেখে সে কিসের সন্ধানে তার বাড়ির ভিটা ছেড়ে পূর্ণিমার চাঁদের জ্যোত্সর ভেতর বের হয়ে যায়। গ্রামের লোকেরা বলে যে, সে রাতে একটি গুল্মজাতীয় গাছের সন্ধানে আকালু গ্রামের ভেতর প্রতিটি মাঠ এবং বাড়ির ওপর দিয়ে হেঁটে যায় এবং গ্রামের প্রান্ত থেকে প্রান্ত পর্যন্ত খুঁজে চন্দ্রালোকিত সে-রাতে দণ্ডকলসের চারটি গাছ পায়; কিন্তু গ্রামের লোকেরা বলে যে, চন্দ্রালোকের ব্যাখ্যাতীত ছলনার হাত থেকে আকালুও রেহাই পায় না, যে চারটি গাছ সে দণ্ডকলস মনে করে তুলে আনে তার ভেতর একটি অন্তত দণ্ডকলস ছিল না। আকালু যে চারটি গাছ খুঁজে পায় তাতে ছোট নাকফুলের আকারের এগারোটি ফুল ছিল এবং এই ফুলের ভেতর কয়েকটির রঙ সাদা হলেও অন্য কয়েকটির রঙ নিশ্চিতরূপেই ছিল হালকা বেগুনি; কিন্তু চাঁদের আলোয় আকালু তা বুঝতে পারে নাই, সে মনে করেছিল যে সবগুলোই ছোট্ট কলকির মতো দেখতে দণ্ডকলসের চমক্কার সাদা রঙের ফুল। গ্রামের লোকেরা বলে যে, আকালু দুটো গাছ পায় রৌহার বিলের ধারে, একটি পায় গ্রামের দক্ষিণ-পূর্বে একটি পোড়ো ভিটার ওপর এবং চতুর্থ গাছটি সে পায় গ্রামের মাঝখানে, যে মাঠের নাম পরে কুকুর মারার মাঠ হয়, সেই ফসলের মাঠের আলোর ওপর। চারটি গাছ শেকড়সহ টেনে উপড়ে তুলে নিয়ে আকালু শেষরাতের দিকে নিজের ভিটায় ফিরে দেখে যে, তার স্ত্রী এবং ছেলে অন্ধকার ঘরে খড়ের ভেতর ঘুমে ডুবে আছে। আকালু তখন ঘরের দরজায় রাখা মালসার স্তিমিত হয়ে আসা আগুন একটি কাঠি দিয়ে উসকে দিয়ে এই আগুনের তাপে তার হাত-পা সেকে নিয়ে ঘরে ঢোকে, তার সঙ্গে তখন ছিল দণ্ডকলসের চারটি বুনোগাছ। কুঁড়েঘরের ভেতরের অন্ধকারে সে দণ্ডকলসের গাছ থেকে ফুল ছিঁড়ে কলকির মতো ফুলের গোড়া টিপে তার নবজাত ছেলের মুখে মধুর স্বাদ তুলে দেয় এবং পরদিন সকালে তার প্রতিবেশী যারা তার বাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে যায়, তারা আকালুকে তার কুঁড়েঘরের দরজার সামনে মুক্ত আকাশের তলে খড়ের ওপর হাত-পা ছড়িয়ে দ্রিামগ্ন দেখে। এদের কেউ একজন যখন তাকে ডেকে ওঠায়, সে আড়মোড়া ভেঙে রাত জাগা চোখে তার দিকে তাকায় এবং একগাল হেসে বলে, ম্যাবাই কাইল আইতে আমার একখান ছাওয়াল অইছে। আকালু তখন তার সেই প্রতিবেশীটিকে পেতে রাখা খড়ের ওপর বসায় এবং সন্তানের জন্মকাহিনী বর্ণনা করে, সে বলে যে, সে তার ছেলের কানে আজানের ধ্বনি এবং মুখে মধু দিয়ে তার নাম রেখেছে, মফিজদ্দি, এবং আকালু যখন বলে যে, সে দণ্ডকলসের ফুলের নলের মতো গোড়া টিপে এই মধু বার করে, তখন সেই প্রতিবেশীটি আকালু যেখানে শুয়ে ছিল তার খুব নিকটে দণ্ডকলসের গুলজাতীয় গাছগুলো পড়ে থাকতে দেখে এবং সে শনাক্ত করতে পারে যে, শেকড় উপড়ে তুলে আনা এই গাছগুলোর সব ক’টি দণ্ডকলস নয়, এর একটি ভাং গাছ, কারণ সে দেখতে পায় যে, এই গাছটায় একটি ছোট্ট ফুল রয়ে গেছে এবং এই ফুলটির রঙ বেগুনি, দণ্ডকলসের ফুলের মতো সাদা নয়। তখন সুহাসিনী গ্রামের লোকেরা এইসব কথা জানতে পারে, তারা জানতে পারে যে, ভূমিহীন কৃষক অথবা ক্ষেতমজুর আকালুর গাছের মতো নীরব বোবা স্ত্রী একটি পুত্রসন্তান প্রসব করেছে এবং এই ছেলের পিতা, পুত্রের মুখে একই সঙ্গে মধু এবং ভাংয়ের নির্যাস তুলে দিয়ে তার নাম রাখে মফিজদ্দি; এবং গ্রামের এইসব মানুষ পরবর্তী সময়ে দেখতে পায় আকালুর ছেলে মফিজদ্দি কেমন করে মফিজুদ্দিন হয়ে ওঠে। বহু বছর পর, ভাদ্র মাসের ভয়াবহ পূর্ণিমা অতিক্রান্ত হওয়ার পরদিন মহির সরকারের উঠোনে বসে যখন তোরাপ আলি চাঁদের বর্ণনা দেয়, সে বলে, ম্যাসাব তার উরাতের উপুর তার হাতের তালুখান চিৎ কইর্যা রাইখছে, সেই দিকে তাকায়া আমি দেখি যে, তার হাতের জমিনে সবকিছু ছাড়ায়া উইঠছে চান্দের পাহাড়; তখন মহির সরকারের বাড়ির উঠোনে বসে থাকা গ্রামের প্রবীণ লোকদের মনে হয় যে, ক্ষেতমজুর আকালুর ছেলের, মফিজদ্দি থেকে মফিজুদ্দিন মিয়া হয়ে ওঠা সম্ভবত একেবারে অবধারিত হয়ে যায় যখন, কোনো কিছু না বুঝেই মিয়াবাড়ির আলি আসগর মিয়া তার কন্যা এবং একমাত্র সন্তানের নাম রাখে চন্দ্রভান আকতার। মহির সরকারের উঠোনে তোরাপ আলির কথা শুনে তাদের মনে হয় যেন তারাও তোরাপ আলির মতো একটি পাহাড় দেখতে পায়, সেই পাহাড় যেন একটি জীবন, মফিজুদ্দিনের জীবন; এবং সেই পাহাড়ের ওপর একটি চাদ হেসে ওঠে, সেই চাঁদ ছিল চন্দ্রভান।
মফিজুদ্দিনের বয়স যখন সতেরো এবং চন্দ্রভানের চৌদ্দ তখন এমন এক অবস্থার সৃষ্টি হয় অথবা মফিজুদ্দিন সৃষ্টি করে কিংবা তোরাপ আলির বর্ণনানুযায়ী চাঁদের প্রভাবের কারণে তৈরি হয় যে, ভূমিহীন দরিদ্র কৃষক আকালুর ছেলে মফিজুদ্দিনের সঙ্গে আলি আসগর মিয়া একমাত্র আদরের মেয়ে চন্দ্রভানের বিয়ে দেয় এবং মফিজুদ্দিনের সচেতন কোনো প্রয়াস না থাকলেও সুহাসিনীর লোকেরা তাকে মফিজুদ্দিন মিয়া বলে ডাকতে থাকে। পরবর্তী সময়ে নয়নতারার হাট যখন ক্রমে ক্রমে জমে ওঠে এবং তারও পরে মফিজুদ্দিন যখন খরাপীড়িত গ্রামের মানুষদের ডাক দিয়ে মাঠে নামিয়ে আনে এবং সুহাসিনীর ভেতর দিয়ে একটি হাতের বিস্তৃত আঙুলের মতো খাল কাটা হয় এবং মফিজুদ্দিন যখন গ্রামের মানুষদের সঙ্গে নিয়ে গ্রামের উত্তর দক্ষিণ পূর্বপশ্চিম সীমানায় তালগাছের চারা রোপণ করে, যাতে করে এই গাছগুলোর মতো সুহাসিনীও বেড়ে ওঠে এবং দূর থেকে দেখে মানুষ এই গ্রামকে শনাক্ত করতে পারে; তখন, সেই সময়, মফিজুদ্দিন বহুদিন বহুবার তার গ্রামের লোকদের এই কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যে, সে যা ছিল তাই আছে; সে বলে, আরে বাপু, আমি আকালুর ছাওয়াল মফিজদ্দি এক মুরুক্ষু মানুষ; কিন্তু মিয়াবাড়ির মেয়ে চন্দ্রভানকে বিয়ে করায় পরিস্থিতি এমনভাবে বদলে যায় যে, সুহাসিনীর লোকেরা সব জেনেও তাকে ম্যাসাব বলে ডেকে চলে এবং নয়নতারার হাট লেগে ওঠা এবং চন্দ্রভানের সঙ্গে তার পরিণয়ের পর তাকে পঞ্চায়েতের প্রধান বানায়। তারপর থেকে সুহাসিনী গ্রামে এবং ব্রহ্মগাছা ইউনিয়নে আর নির্বাচন হয় নাই, নির্বাচন এলে গ্রামের লোকদের এই কথাটি জানা থাকে যে, মফিজুদ্দিন মিয়া নির্বাচনে দাঁড়াবে এবং সে প্রার্থী হলে আর কেউ প্রার্থী হবে না; এভাবে, গ্রামের লোকেরা দেখতে পায় যে, মফিজুদ্দিন একনাগাড়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যায়। সুহাসিনীর মানুষের এই কথাটি জানা ছিল যে, মফিজুদ্দিন এক শ এগারো বছর জীবিত থাকবে, এবং যেকোনো কারণেই হোক, এ কথায় তাদের যেহেতু আস্থা জন্মে গিয়েছিল, তারা একসময় ধরে নিয়েছিল যে, এই এক শ এগারো বছর তাদের আর ভোট দেয়ার কোনো ব্যাপার নাই। তাদের এই জ্ঞান এবং এই জ্ঞানের যথার্থতার ধারণা নিয়ে তারা ব্রিটিশ আমলের শেষাংশ পাকিস্তানের যুক্তফ্রন্ট এবং আইউব খানের বিডি চেয়ারম্যানের কাল, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ন মাস এবং মুক্তিযুদ্ধোত্তর স্বাধীন বাংলাদেশের সময়কালের ভেতর দিয়ে পার হয়ে আসে এবং এই সুদীর্ঘকাল মফিজুদ্দিনের পরাজয়ের প্রশ্ন কখনো ওঠে নাই, কারণ, প্রথম দিকে গ্রামের লোকেরা নিজেদের আগ্রহের কারণেই তাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীনভাবে নির্বাচিত করতে চাইত, পরে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনে মফিজুদ্দিন এমন অভ্যস্ত হয়ে পড়ে যে, গ্রামের মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয়টি গৌণ হয়ে পড়ে এবং নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়লাভের ধারণা তার কাছে অপমানকর বলে মনে হয়; এই সময় কখনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা হওয়ার সম্ভাবনা দেখা গেলে পরিণতিতে প্রতিদ্বন্দ্বিকে সরে পড়তে হতো। সুহাসিনীর লোকদের মনে পড়ে যে, জীবনের বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করার পর, তারা তাদের চোখের সামনে মফিজুদ্দিন মিয়ার শরীর সঙ্কুচিত হয়ে আসতে দেখেছিল; তার পেশি শিথিল হয়ে ওঠে, চামড়া ঝুলে যায়। এই পর্যায়ে গ্রামের লোকদের হয়তো এ রকম মনে হয় যে, তারা মফিজুদ্দিন মিয়াকে আজীবন এ রকমই দেখছে, বৃদ্ধ এবং জীর্ণ; কিন্তু এই জীর্ণতার এখানেই শেষ, এরপর তা আর অগ্রসর হয় না, মনে হয় যেন এক জায়গায় দাড়িয়ে যায় মফিজুদ্দিনের জীবন, এবং এই জীবন অনড় ও স্থায়ী হয়ে ওঠে সুহাসিনীতে; সুহাসিনীর লোকেরা জানে, এক শ এগারো বছর বাচবে এই বৃদ্ধ। এই দীর্ঘ সময়ের ভেতর সত্তরের দশকের কোনো এক নির্বাচনের সময় সুরধ্বনি গ্রামের মেম্বার আফজাল খাঁ ব্রহ্মগাছা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হওয়ার চেষ্টা করে এবং তখন এই এলাকার লোকেরা জীর্ণতার ভেতর থেকে পুরনো মফিজুদ্দিনকে আবিষ্কার করে। এই নির্বাচনের মনোনয়ন দাখিলের নির্ধারিত তারিখের আগের দিন বিকেলে সুহাসিনীর লোকেরা মফিজুদ্দিন মিয়াকে সাদা পাঞ্জাবি পরে মিয়াবাড়ির ভিটা থেকে একা বের হয়ে আসতে দেখে, প্রথমে ভালোমতো বুঝতে না পারলেও তারা যখন দেখে যে, মফিজুদ্দিন ভিটা থেকে নেমে তার বাড়ির সামনের মেটে সড়ক ধরে এগিয়ে গিয়ে ডান দিকে মোড় নেয় তখন তাদের বুঝতে বাকি থাকে না যে, সেই বিকেলে মফিজুদ্দিন মিয়া কোথায় যায়। সুহাসিনীর লোকেরা এই কথা শুনতে পেয়েছিল যে, আফজাল খার ব্রহ্মগাছা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হওয়ার ইচ্ছার কথা শুনে মফিজুদ্দিন মিয়া ভয়ানক ক্রুদ্ধ হয়েছিল এবং তারা যখন একদিন বিকেলে বৃদ্ধ মফিজুদ্দিনকে মাথা বাঁকানো লাঠি হাতে একধরনের একরোখামির সঙ্গে সুরধ্বনি গাঁয়ের দিকে এগিয়ে যেতে দেখে, তারা রুদ্ধশ্বাস হয়ে থাকে। তারা সেদিন বিকেলে মফিজুদ্দিন মিয়ার পেছনে, একটু দূরে, তার নাতি ফৈজুদ্দিনকেও এগোতে দেখে, তারা দুজন মাটির ধুলোমর রাস্তা ধরে এগিয়ে যায় এবং সুহাসিনীর দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে শুকনো খালের কাছে পৌছে মফিজুদ্দিন অনুসরণকারীর উপস্থিতি টের পায়। খালের কনো খাদের ভেতর নেমে মফিজুদ্দিন একটু দাঁড়ায় এবং অনুসরণকারীকে অসতর্ক হয়ে ওঠার জন্য একটু সময় দিয়ে ত্বরিত ঘুরে হাতের লাঠি উঁচিয়ে তেড়ে আসে; ফৈজুদ্দিন একটু ইতস্তত করে পেছন ফিরে দৌড় দেয় এবং সুহাসিনীর লোকেরা দেখে যে, ফৈজুদ্দিন দৌড় দেয়ার পরেও মফিজুদ্দিন মিয়া তার পিছু ছাড়ে না; সে তাকে লাঠি উঁচিয়ে গালাগাল করতে করতে ধাওয়া করে, হারামযাদা, বাইঞ্চোত, কইছি যে আমার সঙ্গে কারুর আসা লাইগব না; শালা খায়ের বাচ্চার নেইগা আমিই যথেষ্ট, তবু পিছনে আইছে। সেদিন বৃদ্ধ মফিজুদ্দিনকে দেখে সুহাসিনীর মানুষের মনে হয় যে, মফিজুদ্দিনের কোনো বদল হয় নাই, এবং গ্রামবাসীদের ভেতর যারা প্রবীণ, তাদের তখন কুকুর মারার সেই ঘটনার কথা পুনরায় স্মরণে আসে এবং তারা দেখতে পায়, বহুদিন পূর্বের কিশোর মফিজুদ্দিন গ্রামের ওপর দিয়ে কাজিদের পাগলা কুকুরের পেছনে ধাওয়া করে বেড়ায়। সেদিন কাজিদের কুকুর তাড়া করে মারার পর গায়ে যখন পুলিশ আসে এবং তারা উল্টো অভিযোগকারী আলতাফ কাজির ওপর ক্ষেপে যায়, তখন সুহাসিনীর প্রথমে ভয় পেয়ে যাওয়া লোকেরা হেসে ওঠে, শালার আলতাব কাজি একটো বেকুব, তারা বলে; এবং এই কাহিনী যখন গ্রামে প্রচারিত হয় এবং আলি আসগর মিয়া তা শোনে, বিষয়টি সম্পর্কে সে খুব আগ্রহী হয়ে ওঠে এই কারণে যে, এই ঘটনায় আলতাব কাজির এক ধরনের অপদস্থ হয়। আলি আসগর মিয়া তার জমির বর্গাচাষি আকালুকে ডেকে পাঠায় এবং আকালু এলে পরে মফিজুদ্দিনের কাজিদের পাগলা কুকুর হত্যার কথা উল্লেখ করে বলে, তর ছাওয়ালডো একটা ভাল কাম হইরছে, একদিন অক আনিস আমার কাছে। আকালু তার ছেলের প্রশংসায় উৎফুল্ল হয়ে পড়ে এবং দৌড়ে গিয়ে তখনই মফিজুদ্দিনকে খুঁজে পেতে নিয়ে আসে এবং মফিজুদ্দিনের দিকে তাকিয়ে আলি আসগর মিয়ার মনে হয়েছিল যে, এই কিশোর অথবা নবীন যুবকটিকে বহুদিন দেখেও যেন সে দেখে নাই; তখন, বস্তুত হাটে বিক্রির জন্য ওঠানো গবাদি পশুর মতো সে মফিজুদ্দিনের শরীর বিশদ মনোযোগের সঙ্গে লক্ষ করে, সে দেখে যে, আকালুর মতো ঢ্যাঙা লম্বাচওড়া দেহকাঠামোর ওপর তার বোবা স্ত্রীর হালকা বর্ণের চামড়া জড়িয়ে এই কিশোর সৃজিত হয়ে উঠেছে। সে মফিজুদ্দিনের ক্ষীণ দড়ির মতো হাতের পেশি এবং কজির চওড়া হাড় লক্ষ করে এবং বুঝতে পারে যে, এই ছেলেটি যদি লাঙলের হাতল চেপে ধরে তাহলে পৃথিবীর মৃত্তিকার কোনো উপায় থাকবে না গভীরভাবে উন্মুক্ত না হয়ে। আলি আসগর মিয়া তখন মনস্থির করে ফেলে, সে একটু এগিয়ে গিয়ে মফিজুদ্দিনের পিঠের দিকে বাহুমূলের কাছে আলতো চাপড় দেয়, যেন মনে হয়, সে একটি চমৎকার দেখতে প্রাণীর দৃঢ়তা, তেজ এবং একই সঙ্গে আনুগত্যের পরিমাণ পরখ করে দেখতে চায়, এবং আকালুকে বলে তর ছাওয়ালডো যুয়ান মর্দা হয়্যা গেছে আকালু, অক আমার কাছে এহন বান্দা কামে লাগায় দে, অক আমি রাখমু। আলি আসগর মিয়ার এই প্রস্তাবে আকালু প্রথমে রাজি হয় না, কিন্তু আলি আসগর মিয়া যখন বেতন: হিসেবে বছরে আট মণ ধান, দুই জোড়া লুঙ্গি এবং এক জোড়া গামছা দেয়ার প্রস্তাব করে তখন আকালু বিষয়টি ভেবে দেখে এবং বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে, তারপর সে রাজি হয়; কিন্তু মফিজুদ্দিনকে সে রাজি করাতে পারে না। আকালু ছেলেকে বুঝিয়ে এবং একই সঙ্গে জোরাজুরি করে যখন আশা করতে থাকে যে, মফিজুদ্দিন এই কাজে যোগ দেবে, তখন একদিন ধানঘড়ায় যাত্রাদল এসে করতোয়া নদীর পশ্চিম পাড়ে মাঠের ওপর তাঁবু টানায়; সে সময়টা ছিল ফসল কাটার পরে শীতের কাল, তখন কৃষকের ঘরে ছিল ধান এবং হাতে অবসর, ফলে চতুর্দিকের লোকদের দল বেঁধে রাত্রিবেলা ধানঘড়ায় যাত্রা দেখতে যেতে এবং দিনের বেলা রোদে বসে হুঁকোয় তামাক খেতে খেতে সে সম্পর্কে আলোচনায় মশগুল দেখা যায়। এই যাত্রা দলটি দু মাস ধরে প্রতি সপ্তাহে পাঁচ দিন যাত্রাভিনয় করে পুনরায় তাঁবু গুটিয়ে ধানঘড়া ত্যাগ করে যায় এবং ধানঘড়াতে যাত্রাদলের বিদেয় হয়ে যাওয়ার দিন থেকে সুহাসিনীতে মফিজুদ্দিনকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। অন্তর্ধানের তিন বছর পর এক শ্রাবণের দিনে, সে যেভাবে হঠাৎ করে উধাও হয়েছিল, তেমনি হঠাৎ করে গ্রামে ফিরে আসে এবং আকালুর ভিটায় গিয়ে ওঠে এবং গ্রামের মানুষ, যাকে ভেবেছিল মরে গেছে কোথাও কোনোভাবে, তার মুখ থেকে তখন জানতে পারে যে, ভোলানাথ অপেরা কম্পানিতে সখী সেজে সে তার নিরুদ্দেশের তিনটি বছর কাটায়; যে সময়ের ভেতর তার বোবা গাছের মতো মা মরে যায় এবং বাপ আকালু বুড়ো হয়ে ওঠে। মফিজুদ্দিনের কাছ থেকে তখন সুহাসিনীর লোকেরা এমন সব জায়গার নাম শোনে, যে জায়গার নাম তারা এর আগে কখনো শোনে নাই; বর্ষার দিনে অবসরপীড়িত গ্রামের কৃষকদের বাদামি মুখের দিকে তাকিয়ে সে বলে, কি যে ভালো নাইগতো পাট কইতে, সখা সখা বীর তুমি, তোমাক কি সাজে এই করন্দন; কত যে বই যাত্রার, রাই বিরহিনী, অসুর বধ, নন্দলালের ফাঁসি, পল্লী মেয়ে, আরো কত কি। তার কাছ থেকে সুহাসিনীর লোকেরা জানতে পারে যে, এই যাত্রাদলের সঙ্গে গিয়ে সে রেলগাড়িতে চড়ে, যমুনা নদী পার হয়ে পূর্ব দিকে চলে যায়, কত রকমের লোক যে সে দেখতে পায়; সে বলে, এইখান থেইক্যা পরথম আমরা গেলাম সলপ, তারপর বেড়া, তারপর বেড়া থেইক্যা নদী পার হয়া গেলাম মানিকগঞ্জ, সেইখান থেইক্যা গেলাম গোয়ালনন্দ, তারপর কত জায়গায় যে গেলাম, ঝিনাইদহ, কুইষ্টে, কত জায়গা। তারপর আবার ঘুইরা আইসল্যাম ধূনট, অধিকারীক কইল্যাম, আমার ভালো নাইগত্যাছে না, আমি বাড়িত যামু; অধিকারী শালার ব্যাটা কয়, অক্ষণে মাত্র আইলাম, পালা শুরু হইব, আর তুমি কও বাড়িত যাইবা, তা কি হয়, অখন থাকো, পড়ে যায়ো; কিন্তু আমি কই, না, আমি আর থাকপ না, আমি চইলল্যাম; আর শালার আইসা দেখি যে, মাড়ো গ্যাছে মইর্যা। সুহাসিনীর মানুষদের তখন মফিজুদ্দিনের নীরব মায়ের কথা মনে পড়ে, যে নিজের আবির্ভাবের রহস্যের কোনো কিনারা না করে, ছেলে মফিজুদ্দিনের অনুপস্থিতিকালে একদিন মরে যায় এবং তিন বছর পর মফিজুদ্দিন যেদিন পুনরায় ফিরে আসে এবং আকালুর মুখে মায়ের মৃত্যুর খবর শোনে, পিতা-পুত্র একে অপরকে, বাজান, বলে ডেকে পরস্পরের গলা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদে। তবে সুহাসিনীর লোকেরা বলে যে, মফিজুদ্দিনের নিঃসঙ্গতা দ্রুত দূর হয়, কারণ, তার জীবনের আঙিনায় পুনরায় এসে দাঁড়ায় আলি আসগর মিয়া এবং এবার প্রায় একই সঙ্গে প্রবেশ করে চন্দ্রভান আকতার। সুহাসিনীর লোকেরা এই বিষয়ে অবহিত ছিল যে গ্রামের মাঝ বরাবর একটি হাট বসানোর ইচ্ছে আলি আসগর মিয়ার বহুদিন থেকে ছিল, কিন্তু হাট বসানোর অনুমতি সগ্রহ করতে গিয়ে সে হয়রান হয়ে পড়ে, সে রায়গঞ্জ থানায় গিয়ে প্রার্থনা করে, মহুকুমা শহর সিরাজগঞ্জে গিয়ে খোঁজ করে, অনুমতি দেয়ার আসল লোকটি কে বা কোথায় তার হদিস করতে পারে না; এবং এই সময়, দীর্ঘদিন নিরুদ্দিষ্ট থাকার পর গ্রামে ফিরে আসা আকালুর ছেলে মফিজুদ্দিনের সঙ্গে তার পুনরায় যোগাযোগ ঘটে। মফিজুদ্দিন যাত্রাদল থেকে ফিরে আসার পর গ্রামের অন্য সকলের মতো জানতে পারে যে, আলি আসগর মিয়া সুহাসিনীতে একটি হাট লাগানোর জন্য চেষ্টা করছে; তখন একদিন রৌহার বিল থেকে মাছ মেরে ফিরে আসার পথে মফিজুদ্দিনকে আলি আসগর মিয়া পুনরায় দেখতে পায়, যার পরিণতিতে মফিজদ্দি হয়ে ওঠে মফিজুদ্দিন মিয়া এবং সুহাসিনীতে পরবর্তী প্রায় সত্তর বৎসর তার জীবন এমনভাবে বিকশিত এবং আবির্তত হয়, যার গল্প, এই জীবনের অংশ এবং দর্শক হিসেবে সুহাসিনীর লোকদের দিন যাপনে ক্রমাগতভাবে ফিরে আসে। সুহাসিনীর লোকেরা বলে যে, সেদিন রৌহার বিলের কাছে আলি আসগর মিয়া কেন গিয়েছিল তা তারা জানে না, তবে তখন মাঠের ওপর মফিজুদ্দিনকে দেখে সে চিনতে পারে; সে বলে, তুই আকালুর ছাওয়াল মফিজুদ্দি না? এবং তখন, মফিজুদ্দিনকে বাধা কামলা হিসেবে পাওয়ার ইচ্ছে আলি আসগর মিয়ার মনে পুনরায় জাগে এবং তার স্মরণে আসে যে, মফিজুদ্দিন একদিন তার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য যাত্রাদলের সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিল। আলি আসগর মিয়া পুনরায় আকালুকে ডেকে পাঠায় এবং আকালু এলে বাইরের বৈঠকখানায় পেতলের হুঁকোয় তামাক সেবন করতে করতে মফিজুদ্দিনকে স্থায়ী মজুর হিসেবে পাওয়ার পূর্ব-ইচ্ছের কথা ব্যক্ত করে। আলি আসগর মিয়ার এই প্রস্তাবে আকালুর আপত্তি ছিল না, কিন্তু মফিজুদ্দিনকে নিয়ে তার ভয় ছিল, বিষয়টি নিয়ে জোরাজুরি করলে মফিজুদ্দিন যদি আবার পালায় এই ভয়ে আকালু আলি আসগর মিয়ার কথা শুনে তোতলায় এবং বলে, আমার ছাওয়ালডো কেমন যানি পাগলাইট্যা, ম্যাসাব, ও ভাল কামলা হবি না। কিন্তু আকালুর এই যুক্তি আলি আসগর মিয়া মানতে চায় না, তার মনে পড়ে মফিজুদ্দিনের মেদহীন তরুণ পেশি এবং হাতের কজির হাড়ের কথা; সে বলে, তুমি বাপু অক বুজায়া কও, কাম কইর্যাই যহন খাওয়া নাইগবো আমার এই হানেই করুক, বচ্ছরে আট মণ ধান আর দুই জোড়া লুঙ্গি আর দুই জোড়া গামছা, অক বুজাও। আকালু তার ছেলেকে এ সম্পর্কে কি বলে তা গ্রামের লোকেরা জানতে পারে না, তবে তারা জানতে পারে যে, আলি আসগর মিয়া মফিজুদ্দিনকে পাওয়ার এই অভিলাষ ব্যক্ত করার কিছুদিন পর, এক শুক্রবার নামাজের পর দুপুরবেলায়, জুম্মা ঘর থেকে সোজা আলি আসগর মিয়ার বাড়ির বাইরের উঠোনে সে গিয়ে দাঁড়ায় এবং আলি আসগর মিয়া নামাজ শেষে ফেরার পথে দেখে যে, তার বাড়ির উঠোনের গোলাপজাম গাছের ছায়া ঘেঁষে মফিজুদ্দিন অপেক্ষা করে আছে। মফিজুদ্দিনকে নিজের প্রাঙ্গণে খাড়া দেখে আলি আসগর মিয়া মাথার গোল কাপড়ের টুপি খুলে হাতে নিয়ে হেসে ওঠে, এবং বলে, কি রে আইছিস? আয় বৈঠকখানায় আয়, কথা কই; তারপর প্রথমে আলি আসগর মিয়া এবং তার পেছনে মফিজুদ্দিন টিনের চৌচালা বৈঠকখানায় প্রবেশ করে। আলি আসগর মিয়ার টিনের চৌচালা কাচারিঘরে তাদের কিসব আলাপ হয় এবং সেই আলাপ কিভাবে অগ্রসর হয়, গ্রামের লোকেরা তা বিস্তারিত জানতে পারে না, তবে তারা দুটো বিষয় সম্পর্কে অবহিত হয়; তারা বলে যে, এটা ছিল এক সেয়ানে সেয়ানে সাক্ষাৎকার, মফিজুদ্দিন ঘরের ভেতর চেয়ারে বসা আলি আসগর মিয়ার সামনে পুরোটা সময় দাড়িয়ে থেকে কথা বলে, মেঝেতে পায়ের ওপর বসে না। মফিজুদ্দিন প্রথমত বলে যে, গ্রামে হাট বসানোর জন্য এত চিন্তাভাবনা না করে জেলা বোর্ডের সড়কের ধারে পতিত খাস জমির ওপর হাট বসিয়ে দিলেই বসে যায়, পরে কেউ কিছু বললে গ্রামের লোকেরা একসঙ্গে তার সুরাহা করতে পারবে, এবং দ্বিতীয় ও সাংঘাতিক যে কথাটি মফিজুদ্দিন বলে তা হচ্ছে এই যে, আলি আসগর মিয়ার বাড়িতে সে চলে আসতে সম্মত আছে, তবে মিয়াবাড়ির বাধা কামলা হিসেবে নয়, মিয়াবাড়ির জামাই হিসেবে।
যে রাতে মফিজুদ্দিন মিয়া সপরিবারে নিহত হয় তার পরদিন গ্রামের লোকেরা বিধ্বস্ত এবং পুড়ে যাওয়া ঘরের ভেতর থেকে সব লাশ বের করে আনে, গ্রামের লোকেরা সেদিন কতগুলো লাশ গুনেছিল তার হিসেব তারা পুনরায় ভুলে যায়, তাদের মনে পড়ে, অনেক নারী পুরুষ আর শিশুর লাশ ছিল; তখন তারা চন্দ্রভানের লাশটি পায় দক্ষিণদুয়ারি ঘরের একেবারে ডানদিকের কোঠার দরজার কাছে, উপুড় হয়ে থাকা অবস্থায়। গ্রামের লোকেরা তাকে চিৎ করে দেখে যে, তার পা থেকে বুক পর্যন্ত আগুনে পুড়ে কালো কয়লার মতো হয়ে গেছে, তার বয়স্ক মুখটি শুধু অক্ষত আছে এবং গ্রামের লোকেরা দেখে যে, এই নারীর কুঁচকে আসা মুখের চামড়ার ওপর, উপরের ঠোঁটের বাম পাশে একটি কালো তিল সেই বিপর্যয়ের পরেও কেমন জ্বলজ্বল করে। সেদিন গ্রামের লোকেরা মিয়াবাড়ির বাইরের প্রশস্ত উঠোনে অন্যান্য লাশের সারির ভেতর চন্দ্রভানের দগ্ধ লাশটি এনে স্থাপন করে এবং পুলিশি ঝামেলা মেটার পর যখন পরদিন একটি বড় এবং লম্বা গর্ত করে লাশগুলোকে একত্রে সমাহিত করা হয়, তখন, গ্রামের অনেক লোক ভয়ে পালিয়ে যাওয়ার পরও যারা উপস্থিত ছিল, তারা মৃত চন্দ্রভানকে মৃত মফিজুদ্দিনের নিকট স্থাপন করার বিষয়ে যেন অবচেতনভাবেই খেয়াল রাখে; যেমন তারা খেয়াল রাখে কবরের সেই গর্তের ভেতর সিদ্দিক মাষ্টারের পাশে আলেকজানকে স্থাপন করার বিষয়, যে আলেকজানের জন্য আবুবকর সিদ্দিক তার নিজের জীবনের গতিপথ একদা বদলে ফেলে এবং সিদ্দিক মাষ্টার হয়ে ওঠে। সেদিন মিয়াবাড়ির উঠোনে, এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত তরমুজের মতো কেটে ফাঁক করা গর্তে লাশ দাফন করা হয়ে গেলে সুহাসিনীর লোকেরা মিয়াবাড়ির ভিটা ত্যাগ করে নিজেদের বাড়ির দিকে যায়, তখন তাদের সঙ্গে সুরধ্বনি গ্রামের বৃদ্ধ আফজাল খাঁ এবং তার যুবক ছেলে ইদ্রিস খাঁ নিচে রাস্তায় নেমে আসে; এবং তখন, সুহাসিনীর লোক যারা সেখানে ছিল, তারা দেখে যে, আফজাল খাঁর গাল এবং দাড়ি বেয়ে নেমে আসা অশ্রু চিকচিক করে, সে বলে, ম্যাসাব, আমার বাপের দোস্তো আছিল।
সুহাসিনীর লোকদের তখন তাদের গ্রামে হাট বসানো এবং মফিজুদ্দিন ও করিম খার বন্ধুত্বের কথা স্মরণ হয়। গ্রামের প্রবীণ লোকেরা, যারা এই সব ঘটনা তাদের শিশুকালে ঘটতে দেখেছিল এবং পরে এর গল্প শুনেছিল, বলে যে, বহুদিন পূর্বের এক শুক্রবার দুপুরে মফিজুদ্দিন আলি আসগর মিয়ার কাছে চন্দ্রভানকে বিয়ে করার প্রস্তাব করে মিয়াবাড়ির চৌচালা বৈঠকখানা থেকে বের হয়ে নিজের ভিটায় ফিরে যায় এবং সেদিন বিকেলে হাডুডু খেলার মাঠে সকলকে সে বলে যে, চাইলেই তারা গ্রামে একটা হাট বসিয়ে দিতে পারে, এবং তারপর সুহাসিনী এবং সুরধ্বনি গ্রামের লোকেরা দেখে যে, মফিজুদ্দিন এবং করিম খাঁর সঙ্গে দল বেঁধে তাদের কিশোর এবং যুবক ছেলেরা একদিন কোদাল হাতে ঘর থেকে বের হয়ে যায়, সুহাসিনীর উত্তর প্রান্তে, জেলা বোর্ডের সড়কের পাশের খাসজমির টুকরোটিতে দূর থেকে কেটে আনা মাটি ফেলে ভরাট এবং উঁচু করে তুলতে থাকে; এবং অল্প অল্প করে এভাবে, গ্রামের ছেলেরা আঠারো দিন ধরে মাটি কেটে ভূমিখণ্ডটিকে উঁচু রাস্তার প্রায় সমতলে নিয়ে আসে। হাট বসানোর মাঠ তৈরি হয়ে গেলে তারা কতগুলো ক্যানেস্তারা টিন নিয়ে চতুর্দিকে ছড়িয়ে যায় এবং টিন পিটিয়ে সুহাসিনী এবং এর আশপাশের, সুরধ্বনি, ব্যাঙনাই, বৈকুণ্ঠপুর, রৌহা, চকনূর ইত্যাদি গ্রামে এই ঘোযণা দেয় যে, পরবর্তী ফাল্গুন মাসের এক তারিখ, বৃহস্পতিবার সুহানিসীতে হাট বসবে। কিন্তু এই ঘোষণা দেয়ার কয়েক দিন পর ফাল্গুনের এক তারিখে হাট বসে না; কারণ, এক তারিখ আসার আগেই মফিজুদ্দিন হঠাৎ করে উধাও হয়ে যায় এবং গ্রামের লোকেরা সন্দেহ করে যে, মফিজুদ্দিন হয়তো এইসব কাজে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিল এবং সে পুনরায় যাত্রাদলে ফিরে গেছে। কিন্তু গ্রামবাসীদের এই সন্দেহ ভুল প্রমাণিত হয়, কয়েক দিন পর সে পুনরায় সুহাসিনীতে ফিরে আসে। এই দ্বিতীয় অন্তর্ধান থেকে ফিরে আসার পর মফিজুদ্দিনকে যাত্রাদল থেকে ফিরে আসার পরের মতো মুখর মনে হয় না, সে কেমন চুপ করে থাকে এবং তাকে উদ্ভ্রান্ত দেখায়; তারপর মনে হয় যেন সে সম্বিৎ ফিরে পেতে শুরু করে এবং একদিন তার পিতার পর্ণকুটিরের বাইরে এসে উঠোনে অপেক্ষমাণ গ্রামের যুবকদের সামনে দাঁড়ায় এবং সেই কথাটি বলে, যা পরবর্তীকালে এক পূর্ণিমা রাতের বিপর্যয়ের আগের দিন পর্যন্ত সুহাসিনীর লোকদের নিকট এক অলঙ্ঘনীয় বিশ্বাসের মতো টিকে থাকে। সেদিন কুঁড়েঘরের ভেতর থেকে বাইরে বের হয়ে মফিজুদ্দিন তার সম্মুখের কিশোর এবং যুবকদের দিকে কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে থাকে, তারপর বলে যে, সে এক শ এগারো বছর বাঁচবে, এবং তার কথা শুনে গ্রামের ছেলেরা বুঝে উঠতে পারে না, সে এরকম একটি কথা কেন এবং কি প্রসঙ্গে বলে; তবে তখন, নিজের জীবনের সীমা সম্পর্কে এই ঘোষণা দেয়ার পর, মফিজুদ্দিনের চেহরায় অতিদ্রুত এক ধরনের সুস্থিরতা ফিরে আসে এবং তারপর ঠিক হয় যে, ফাল্গুন মাসের ২৯ তারিখ, শেষ বৃহস্পতিবারে সুহাসিনীতে হাট বসবে। গ্রামের ছেলেরা তখন আকালুর ভিটা থেকে ক্যানেস্তারা টিন হাতে পুনরায় চতুর্দিকের গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে এবং গ্রামের লোকেরা বলে যে, তখন মফিজুদ্দিন করিম খাকে একা তাদের উঠোনে দেখতে পায়, সে করিম খাঁর কাঁধের ওপর ডান হাত রেখে তার গলা বেষ্টন করে কাছে টানে এবং চন্দ্রভানকে বিয়ে করার ইচ্ছের কথা বলে, আলি আসগর মিয়া সাবের মায়া চন্দ্রভানেক বিয়া করমুই, কোনো শালা আমার কিছু কইরবার পাইরব না, আমি এক শ এগারো বছর বাঁচমু, এই কইলাম তক দোস্তো। তারপর ফায়ুন মাসের শেষ বৃহস্পতিবার যখন সুহাসিনীতে প্রথম হাট বসে, সেদিন মফিজুদ্দিন বন্ধুদের সঙ্গে হাটের ভেতর দিয়ে হেঁটে গিয়ে জেলা বোর্ডের রাস্তার কিনারায় বন্ধুদের রচনা করা বৃত্তের ভেতর দাঁড়িয়ে ঘোষণা করে যে, এই হাটের নাম হবে নয়নতারার হাট; তারপর সে সকলকে পিছনে রেখে আলি আসগর মিয়ার বাড়ির প্রাঙ্গণে এসে দাঁড়ায় এবং সেদিন রাতে মফিজুদ্দিনের সঙ্গে চন্দ্রভানের বিয়ে হয়ে যায়, আকালুর ছেলেকে আলি আসগর মিয়া ঘরে তুলে নেয়।