রনির জন্য আরো একজন নতুন মাস্টার ঠিক করা হয়েছে। এই মাস্টার সাহেব প্রতি শুক্রবার আসবেন। সময় এখনো ঠিক করা হয় নি। সকালে আসতে পারেন। বিকেলেও আসতে পারেন।
রনি লক্ষ করেছে বড় বড় দুঃসংবাদগুলি সে পায় নাস্তার টেবিলে। যেবার তাদের নেপালে বেড়াতে যাওয়া ঠিক হলো, রনি ব্যাগ গুছিয়ে পুরোপুরি তৈরি। স্কুলের বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছে। তাদের বাসার ঠিকানা নিয়েছে, নেপাল থেকে ভিউকার্ড পাঠাবে। তার ক্যামেরার জন্যে দুটা ফিল্ম কিনেছে। সেবারও নাশতার টেবিলে মা বললেন, নেপাল যাওয়া হচ্ছে না। এবারের শীত খুব বেশি পড়েছে। রনি তখন মাত্র পাউরুটি মুখে দিয়েছে। তার এতই মন খারাপ হলো যে, পাউরুটি গলায় আটকে খকখক করে কাশতে শুরু করল। মা রনির দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বললেন, ঠিক মতো খাও রনি। একটি আস্ত পাউরুটি মুখে দিয়ে ফেললে তো গলায় বাঁধবেই। বাবাও মুখের ওপর থেকে পত্রিকা নামিয়ে সরু চোখে তাকিয়ে রইলেন। যেন পাউরুটি গলায় বিঁধে যাওয়া বিরাট অপরাধ। অথচ অপরাধ তাঁরাই করেছেন। বেড়াতে যাওয়া ঠিকঠাক করে হঠাৎ বাতিল করে দিয়েছেন।
রনির ইচ্ছা করছে বাবা-মা দুজনের ওপরই রাগ করতে। রাগ করতে পারছে না, কারণ এই দুজনের কেউ তার বাবা-মা না। দুজনই নকল বাবামা। রনির ক্লাসের একটি মেয়ের সম্মা আছে (নাম মিঠু, অতিরিক্ত মোটা বলে তাকে ডাকা হয় মোটা-মিঠু, সংক্ষেপে মো মি)। দুজন ছেলের আছে সৎবাবা। আর রনির আছে একজন সৎবাবা, একজন সম্মা। ব্যাপারটা অন্যদের কাছে খুব অদ্ভুত লাগলেও রনির কাছে লাগে না। তার কাছে বরং ব্যাপারটা স্বাভাবিকই মনে হয়। রনির জন্মের সময়ই তার মা মারা গেলেন। বাচ্চা একটা শিশুকে বড় করতে হবে, রনির বাবা বিয়ে করলেন। কাজেই রনির মা হয়ে গেল সম্মা।
রনি যখন ক্লাস টু-তে উঠল তখন তার বাবা জাহাজড়ুবি হয়ে মারা গেলেন পর্তুগালের কাছে এক সমুদ্রে। সমুদ্রটার নাম ব্লু ক্যানেল। ক্যানেল মানে খাল। একটা সমুদ্রের নাম নীল খাল কী করে হয় রনি জানে না। হয়তো তারা কোনো ভুল করেছে। করুক ভুল। মূল ঘটনা হলো রনির বাবা মারা যাবার পর রনির সত্য বিয়ে করলেন। কাজেই রনির বাবা হয়ে গেল সত্বাবা।
এইসব নিয়ে রনির দুঃখ নেই। শুধু কেউ যখন তার দিকে তাকিয়ে বলে–আহারে, আসল বাবা-মা কেউ নেই। দুজনই নকল। কী কষ্ট! কী কষ্ট! তখন একটু রাগ রাগ লাগে।
কষ্ট কোথায়? কোনো কষ্ট নেই। স্কুলে বন্ধুদের সঙ্গে যখন থাকে, তখন কত ভালো লাগে। স্কুল লাইব্রেরি থেকে যখন বই নিতে যায়, তখন ভালো লাগে। বাসায় ফিরে যখন টিভি দেখে, তখন ভালো লাগে। পড়া শেষ করে কম্পিউটার গেমস খেলে, তখন ভালো লাগে।
খারাপ লাগে কখন?
সকালে নাশতা খাবার সময় খারাপ লাগে। (কারণ তখন বাবা-মার কঠিন কথা শুনতে হয়।)
টিচাররা যখন তাকে পড়াতে আসেন তখন খারাপ লাগে। (রনির তিনজন টিচার–ইংরেজি, ম্যাথ, সায়েন্স। এখন আবার একজন বাড়ল, আর্ট টিচার।)
সে যখন রাতে ঘুমুতে যায়, তখন খারাপ লাগে। কারণ একা ঘুমুতে তার খুবই ভয় লাগে। টিভিতে দেখা ভূতের ছবিগুলির কথা মনে হতে থাকে। টিভিতে দেখার সময় তত ভয়ঙ্কর লাগে না। একা ঘুমুতে যাবার সময় ভয়ঙ্কর লাগে। কফিনের ডালা আপনা-আপনি খুলে যাচ্ছে। একটা হাত বের হয়ে আসছে সেই হাতে লম্বা লম্বা নখ। নখের গায়ে রক্ত লেগে আছে।
বেশি ভয় লাগলে রনি চাদর দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলে। তখন মনে হয়, এই বুঝি কেউ এসে চাদর সরিয়ে রনির দিকে তাকিয়ে নাকি গলায় বলবেতুই কেঁ? বলেই কাতুকুতু দেয়া শুরু করবে। মেয়ে-ভূতরা বাচ্চাদের কাতুকুতু দিতে খুব পছন্দ করে।
রাতে ঘুমুতে যাবার সময় রনির মনে হয়, আসল বাবা-মা থাকলে কী করতেন? তারা নিশ্চয় রনিকে আলাদা ঘরে রাখতেন না। আর রাখলে খুব বেশি ভয় পেলে কেউ-না কেউ তার সঙ্গে ঘুমুতে আসতেন। হয় মা আসতেন, কিংবা বাবা আসতেন। আসল বাবা-মা দুজনের ছবিই রনির স্ক্রাপ-বুকে আছে। রনি ছবির দিকে তাকিয়ে চিন্তা করে দুজনের কে তার সঙ্গে ঘুমুতে আসতেন।
মার ছবিটা খুবই হাসিখুশি। হাসির মধ্যেই দুষ্টু দুষ্টু ভাব। হ্যাঁ, মা তো আসতই। তবে মা তার সঙ্গে থাকতে এলে সমস্যাও হতো। যে-রকম দুষ্ট দুষ্ট চেহারা, নিশ্চয়ই খুবই দুষ্টামি করত। তাকে ঘুমুতে দিত না। কাতুকুতু দিত। চুল টানত। ঘুমে যখন তার চোখ জড়িয়ে আসত, তখনো গল্প করত।
মার ছবি দেখেই মনে হয়, এই মহিলা গল্প করায় ওস্তাদ।
বাবার চেহারাটা আবার গম্ভীর ধরনের। চোখে চশমা। ভুরু সামান্য কুঁচকানো। গম্ভীর ধরনের মানুষ আবার ভেতরে ভেতরে হাসিখুশি হয়। হাসিখুশি ভাবটা তারা প্রকাশ করে না। বাবা নিশ্চয়ই তার সঙ্গে ঘুমুতো। তবে ঘুমুবার আগে নানান উপদেশ দিত–পৃথিবীতে ভূত বলে কিছু নেই। কাজেই ভূতের ভয়ে অস্থিত হওয়া কোনো কাজের কথা না। তাদের ছেলেমেয়েদের আদর আদর গলায় উপদেশ দিতে পছন্দ করে। স্কুলে সে দেখেছে মোটা-মিঠুর বাবা মেয়েকে স্কুল থেকে নিতে এসেই উপদেশ শুরু করেন। আদর আদর গলায় উপদেশ।
রনি যে এখন একেবারে একা ঘুমায় তা-না। ইদরিস মিয়া রনির ঘরের বাইরে বিছানা পেতে ঘুমায়। তার মাথার কাছে থাকে একটা মশার কয়েল, পায়ের কাছে থাকে আরেকটা কয়েল। ইদরিস মিয়া সারাক্ষণ কথা বলে। দিনের বেলা তো কথা বলেই, রাতে ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও কথা বলে।
ইদরিস মিয়া হলো রনির পাহারাদার। সে এ বাড়িতে রনি ঠিকমতো আছে কি-না, তার যত্ন ঠিক হচ্ছে কি-না, রনির নকল বাবা-মা তাকে অনাদর করছে কি-না সে এইসব লক্ষ করে এবং রনির দাদার কাছে রিপোর্ট করে তাকে রাখাই হয়েছে এই কাজে। ইদরিস মিয়ার ভাবভঙ্গি স্পাইদের মতো। রনির সঙ্গে কথা বলার সময় গলা নিচু করে কথা বলে, যেন ষড়যন্ত্র করছে। কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে এদিক-ওদিক তাকায়। এই সময় ইদরিসকে ইঁদুরের মতো দেখায়। টম এন্ড জেরির ইঁদুর। জেরি। রনির খুব হাসি পায়। সে অনেক কষ্টে হাসি চেপে রাখে।
ইদরিস তখন কথাও বলে ইঁদুরের মতো কিচকিচ করে নিচ্চিন্ত থাকেন ভাইজান, সব হিসাবের মধ্যে আছে। আপনার ওপর নজর খালি আমি একলা রাখতেছি না। আরো লোকজন রাখতেছে। অনেকের নজর আছে।
আমার ওপর এত নজর রাখার দরকার কী?
আছে, দরকার আছে। বিষয়সম্পত্তি, টাকাপয়সা সবই তো আপনের। আপনের পিতা লিখিতভাবে দিয়ে গেছেন। সেই সম্পত্তিও পাঁচ-দশ টাকার সম্পত্তি না। কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি। গুলশানে যে সাততলা দোকানতার ভাড়াই মাসে ত্রিশ লাখ। বিবেচনা করেন অবস্থা।
ত্রিশ লাখ মানে কত মিলিয়ন?
মিলিয়ন ফিলিয়ন জানি না ভাইজান, এইটা জানি বেশুমার টাকা। বেশুমার। বেশুমার।
বেশুমার টাকা মানে কী?
অত কিছু জানি না ভাইজান। একটা জিনিস জানি আমার কাজ আপনেরে চউক্ষে চউক্ষে রাখা। রাইতে যে আপনের ঘরের সামনে শুইয়া থাকি–আপনে কি ভাবেন ঘুমাই? ঘুমাই না, জাগনা থাকি। দুই চউক্ষের পাতা ফেলি না।
কিন্তু আমি যে নাক ডাকার শব্দ পাই?
এইটা কল্পনা। শিশু-মনের কল্পনা। তয় আমার একটা বিষয় আছে। জাগনা অবস্থায়ও আমার নাক ডাকে। বড়ই আজিব।
মাঝে মাঝে রনির দাদা, আসগর আলি, রনিকে দেখতে আসেন। এমন রাগী বুড়ো মানুষ রনি তার জীবনে দেখে নি। ধমক না দিয়ে সহজভাবে এই বুড়ো কোনো কথা বলতে পারে না। তার গা দিয়ে সিগারেটের কড়া গন্ধ আসে। এত কড়া গন্ধ যে রনির বমি আসার মতো হয়। তিনি রনির সঙ্গে তুই তুই করে কথা বলেন, এটাও রনির পছন্দ না। কথা বলার সময় খামচি দেয়ার মতো রনির কাঁধ ধরে রাখেন। রনির ব্যথা লাগে, তারপরও সে কিছু বলে না।
তুই কেমন আছিস?
ভালো।
এরা তোকে মারধর করে?
কারা মারবে?
আবার কারা? যাদের সঙ্গে আছিস তারা?
না তো। ঠিক করে বল। চড় থাপ্পড়, ধাক্কা?
না।
মারধোর করলে বা বকা দিলে, কোনোরকম অবহেলা করলে আমাকে বলবি। কোর্টে পিটিশন করে তোর কাস্টডি নিয়ে নেব। বুঝতে পারছিস?
পারছি।
আমার তো ধারণা তোকে মারে। তুই ভয়ে বলছিস না। ভয়ের কিছু নাই। খাওয়া দাওয়া ঠিকমতো দিচ্ছে?
হুঁ।
খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারেও সাবধান। যদি দেখিস তোকে তারা গোপনে কোনো শরবত খেতে দিচ্ছে, তাহলে খাবি না। নিতান্তই যদি খেতে ইচ্ছা হয় আগে ইদরিসকে এক চামুক খাওয়াবি।
কেন?
আরে এই গাধাকে নিয়ে দেখি যন্ত্রণায় পড়লাম। বিষ-টিষ খাইয়ে মেরে ফেলবে, এইজন্যে।
মেরে ফেলবে কেন?
মেরে ফেলবে না তো কী করবে? কোলে বসিয়ে চুমু খাবে? তুই দেখি তোর বাবার মতোই বেকুব হয়েছিস। তোর বাবা ছিল বেকুব নাম্বার ওয়ান, আর তুই হলি বেকুব নাম্বার টু।
বাবাকে বেকুব বলবেন না দাদাজান।
বেকুবকে বেকুব বলব না?
না।
এইটুকু বাচ্চা কেমন ধমক দিয়ে কথা বলে! আছাড় দিয়ে ভুঁড়ি গালায়ে দেব। তোর বাবা যখন তোর মতো ছিল, সেও চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলত। একদিন শূন্যে তুলে দিলাম আছাড়। মট করে পাটকাঠি ভাঙার মতো একটা শব্দ হয়েছে। তারপর দেখি কজির নিচে হাড় ভেঙে হাত ঝুলছে।
দাদাজান, তুমি দুষ্টলোক।
অবশ্যই দুষ্টলোক। এই দুনিয়ায় কোনো ভালো লোক নাই। যা আছে। সবই দুষ্ট।
রনি জানে তাকে নিয়ে নানান সমস্যা আছে। কয়েকবারই তাকে কোর্টে যেতে হয়েছে। সে কার সঙ্গে থাকবে এই নিয়ে মামলা। জজ সাহেবরা এইসময় তাকে জিজ্ঞেস করেন, খোকা তুমি কোথায় থাকতে চাও?
রনি সবসময় বলেছে, আমি যেখানে আছি সেখানে থাকতে চাই।
কেন?
ঐখানে আমার কম্পিউটার আছে, সে জন্যে।
তুমি তোমার দাদাজানের সঙ্গে থাকতে চাও?
না।
না কেন?
উনি খুবই রাগী। আমাকে একবার ফাজিল বলেছিলেন।
তোমার যে ছোটচাচা আছেন, উনার সঙ্গে থাকতে চাও না?
না।
উনিও কি রাগী? জানি না।
তোমার এক ফুপু আছেন–মেহরিনা খানম। মগবাজারে থাকেন। তাঁর সঙ্গে থাকবে?
না।
থাকবে না কেন?
উনি যখন কথা বলেন, তখন মুখ দিয়ে থুথু বের হয়। আমার গা ভিজে যায়। খুবই ঘেন্না লাগে।
জজ সাহেব দুজনের একজন হেসে ফেলতে গিয়েও ফেললেন না। গম্ভীর হয়ে বললেন, What a pity! A very unfortunate boy.
বড়রা এই ভুলটা সবসময় করে। তারা ভাবে ইংরেজিতে কথা বললে ছোটরা বুঝবে না। এই জজ সাহেব জানেন না, যে ইংরেজি রনি খুব ভালো জানে। গত পরীক্ষায় ইংরেজিতে সে A ডাবল প্লাস পেয়েছে। সে ইংরেজিতে একটা রচনা লিখেছিল। রচনার নাম My Last Vaccation. সে লিখেছিল নেপাল ভ্রমণ নিয়ে। (বানিয়ে লেখা। সে তো নেপাল যায় নি।) রচনাটায় একটাও বানান ভুল ছিল না।
জজ সাহেব বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি যেখানে থাকতে চাও থাকো। শুধু একটা ব্যাপার খেয়াল রাখবে। তুমি যেখানেই থাকো সাবধানে থাকবে।
কেন?
জজ সাহেবরা এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলেছেন।
রনি সাবধানেই থাকে। তার স্কুলব্যাগে একটা ম্যাগগাইভারের ছুরি আছে। টর্চলাইট আছে। মোমবাতি আছে, নাইলনের দড়ি আছে। সাবধানী মানুষের জন্যে এইসব দরকার আছে। কেউ যদি তাকে কোনো একটা অন্ধকার ঘরে আটকে রাখে, সে সেখান থেকে অবশ্যই বের হয়ে আসতে পারবে।
টুন টিন, টুন টিন করে কলিং বেল বাজছে। রনি ড্রয়িংরুমে বসে ছিল। কলিং বেলের শব্দ শুনে অবাক হলো। যেই আসুক দারোয়ান গেট থেকে ইন্টারকম করে আগে জানাবে কে এসেছে। শুধু তিনজনের বেলায় এই নিয়ম খাটে না। সেই তিনজন হলো রনি আর তার বাবা, মা। তিনজনের মধ্যে দুজন সে এবং মা বাড়িতেই আছে।
তাহলে কে এসেছে? বাবা? তিনি তো চিটাগাং। সোমবার আসবেন।
আজ মাত্র শুক্রবার। রনি দরজা খুলল। অপরিচিত এক লোক দাঁড়িয়ে GI
লোকটা তার দিকে তাকিয়ে বলল, কেমন আছ রনি?
রনি বলল, ভালো। অপরিচিত লোক তার নাম জানে এতে সে বিস্মিত হলো না। রনি দেখেছে অনেক অপরিচিত লোকই তার নাম জানে।
যাও খোকা তোমার মা-কে খবর দাও। আমি তোমার নতুন আর্ট টিচার। ইন্টারভু দিতে এসেছি। শুনেছি তিনি ইন্টার ছাড়া কাউকে রাখেন না।
ঠিকই শুনেছেন। আসুন, ভেতরে এসে বসুন।
এটা তোমাদের ড্রয়িংরুম?
জি।
যে রুমে ড্রয়িং করা হয় না তার নাম ড্রয়িংরুম কেন বলো তো?
জানি না কেন।
ভদ্রলোক ঘরে ঢুকে সোফায় আরাম করে বসলেন। রনি তার মা-কে খবর দিতে গেল। রনির মা সালমা বানু টিচারের ইন্টার নিচ্ছেন। সব টিচারকেই এই ইন্টারভু দিতে হয়। যারা ইন্টারভ্যুতে পাস করে তারাই শুধু পড়াতে পারে। নতুন এই আর্ট টিচারকে দেখেই রনির মনে হচ্ছে ইনি পাস করতে পারবেন না। কেমন আউলা ঝাউলা গরিব চেহারা। গাল ভাঙা। ভদ্রলোক এ বাড়িতে আসার আগে নিশ্চয়ই শেভ করেছেন। শেভ ভালো হয়নি। গালের বেশ কয়েকটা জায়গায় খাবলা খাবলা কাঁচাপাকা দাড়ি বের হয়ে আছে। হাতের নখ লম্বা। রনি নখ দেখেই বলে দিতে পারছে দুসপ্তাহ কাটা হয়নি। এই গরমেও গায়ে চাদর। চাদরটা এমনভাবে জড়ানো যে দেখে মনে হয় তার জ্বর এসেছে।
ভদ্রলোক কথা বলা শুরু করার আগেই চাদরের ভেতর থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করলেন। সঙ্গে সঙ্গে সালমা বানু বললেন, এ বাড়িতে সিগারেট খেতে পারবেন না।
ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গে সিগারেটের প্যাকেট চাদরের নিচে লুকিয়ে ফেলে বোকার মতো দাঁত বের করে হাসতে লাগলেন। রনি তখনি বুঝে গেল, এই লোকের চাকরি হবে না। তার একটু খারাপ লাগল। কোনো কারণ ছাড়াই লোকটাকে তার পছন্দ হয়েছে।
সালমা বানু বললেন, আপনার নাম কী?
আমার নাম মুহাব্বত আলি।
এটা আবার কেমন নাম?
বাবা শখ করে রেখেছে। আপনার যদি এই নামে ডাকতে অসুবিধা হয়, তাহলে মু-টা বাদ দিয়ে হাব্বত আলী ডাকতে পারেন। হাব্বত আলি নামটা খারাপ না।
সালমা বানু বললেন, মুহাব্বত আলি নামে তো কারোর আসার কথা না। আমাকে বলা হয়েছিল আর্ট টিচারের নাম–সেরাজুল সালেহিন।
উনি আসতে পারবেন না। এই একমাস উনি খুবই ব্যস্ত। আমাকে বলেছেন একমাস প্রক্সি দিতে। একমাস পর থেকে উনি নিয়মিত আসবেন।
সরি, কিছু মনে করবেন না। আপনাকে আমার পছন্দ হচ্ছে না। একমাস আর্ট টিচার না থাকলেও আমাদের অসুবিধা হবে না। সেরাজুল সালেহিন সাহেবের কাছে রনি ছবি আঁকা শিখবে।
আমি কিন্তু ছবি খুব ভালো আঁকি। আমার নামটা হয়তো আপনার কাছে খারাপ লাগছে। ছবি খারাপ না।
আপনি যদি মদিলিয়ানির মতো ছবিও আঁকেন, তাহলেও আমি আপনাকে রাখব না।
তাহলে আর কী করা! একটা চাকরির খুবই প্রয়োজন ছিল। আপনি যখন মদিলিয়ানির মতো আর্টিস্টকেও রাখবেন না–তখন আমি মুহাব্বত আলি কোন ছার!
মদিলিয়ানি কে জানেন?
জানি। উনার ভালো নাম আমেদো মদিলিয়ানি। ইতালির চিত্রশিল্পী এবং ভাস্কর। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বেশ কয়েকটি ছবিই তার আঁকা। আঠার শ চুরাশি সনে তার জন্ম। মারা যান প্যারিসে উনিশ শ বিশ সনে।
ঠিক আছে আপনি যেতে পারেন।
এক কাপ কফি খেয়ে যাই। শুধু মুখে চলে গেলে পরে আপনার নিজেরই খারাপ লাগবে। কফি খেতে খেতে আমি চট করে আপনার একটা স্কেচ করে ফেলি। স্কেচটা যদি আপনার পছন্দ হয়, আপনি আমার কাছ থেকে কিনে নিতে পারেন। আমি খুবই খারাপ অবস্থায় আছি। একশ টাকা পেলেও আমার লাভ।
স্কেচ করতে হবে না। আমি আপনাকে একশ টাকা দিচ্ছি। কফি খাওয়ানো সম্ভব না। কাজের লোকজন ব্যস্ত।
আমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে পারি। তাদের ব্যস্ততা কমুক। আসলে আমার তেমন কাজকর্ম নেই। আমার জন্যে এখানে বসে থাকা যা, রাস্তায় হাঁটাহাঁটিও তা। বরং এসি ঘরে বসে থাকাটা ভালো।
লোকটার কথাবার্তায় রনি খুব মজা পাচ্ছে। সে বুঝতে পারছে না মা শেষপর্যন্ত লোকটাকে কফি খাওয়াবে কি-না। মনে হচ্ছে খাওয়াবে না। রনি যেমন লোকটার কথাবার্তায় মজা পাচ্ছে, মা পাচ্ছে না। মা খুবই বিরক্ত হচ্ছে।
আপা, আমি কি বসব কফির জন্যে?
সালমা বানু উঠে দাঁড়ালেন। আর্ট টিচার ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গে খুবই আগ্রহের সঙ্গে বলল–চিনি বেশি দিতে বলবেন। আমি তিন-চার চামচ চিনি খাই। এরচে বেশি হলেও আমার অসুবিধা হয় না। ডায়াবেটিস যখন হবে তখন হবে। এখন থেকে চিনি খাওয়া ছাড়ার কোনো মানে হয় না।
সালমা বানু জবাব না দিয়েই ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। লোকটা রনির দিকে তাকিয়ে বলল, এই ফাঁকে তোমার মার একটা ছবি এঁকে ফেলা যাক, কী বলো? ভদ্রমহিলা তো আমার ওপর খুবই রেগে আছেন, ছবি দেখে যদি রাগটা কমে।
রনি বলল, আপনার জন্যে পেন্সিল আর কাগজ নিয়ে আসব?
লোকটা বলল, কিছু আনতে হবে না। আমার চাদরের নিচে সবকিছু থাকে। বলেই সে প্রথমে একটা পেন্সিল বের করল। তারপরই বের করল কাগজ।
কাগজ কুঁচকে ভাঁজ হয়ে আছে। দুই হাত দিয়ে ঘষে ভাজ ঠিক করল। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ ঝিম ধরে বসে রইল। তারপর অতি দ্রুত ছবি এঁকে ফেলে রনির দিকে কাগজটা এগিয়ে দিয়ে বলল–দেখ তো খোকা, কেমন হয়েছে?
রনির মন বলছিল লোকটা খুব ভালো ছবি আঁকে। দেখা গেল আসলেই সুন্দর ছবি। রাগী মুখে রনির মা বসে আছেন।
রনি বলল, ছবিটা খুব সুন্দর।
তোমার কি মনে হয় এই ছবি দেখে আমাকে চাকরি দেবে?
না।
আমারো মনে হয় না। আমার চেহারা তোমার মার পছন্দ হয়নি। মেয়েরা চেহারার ওপর খুব গুরুত্ব দেয়। শেভ করে ভালো কাপড়-চোপড় পরে আসা দরকার ছিল। নামটাও সমস্যা করেছে। মুহাব্বত আলি পছন্দ করার মতো নাম না। যাই হোক, কফি খেয়ে বিদায় নিই। তোমার নাম কী?
আপনি তো আমার নাম জানেন। যখন দরজা খুললাম তখন বললেন, কেমন আছ রনি।
রনি নাম জানি। এর মধ্যে নাম বদলে গেল কি-না সেইজন্যে জিজ্ঞেস করা। দেখ না আমার নাম ছিল মুহাব্বত আলি, তিন মিনিটের মধ্যে হয়ে গেল হাব্বত আলি।
রনি হেসে ফেলল এবং বুঝতে পারল এই আর্ট টিচারকে তার খুবই পছন্দ হয়েছে।
তোমার বুদ্ধি কেমন? ধাঁধা জিজ্ঞেস করলে পার? মাঝে মাঝে পারি।
যে-সব ধাঁধা পার তার দুই একটা বলো তো। তাহলে বুঝব কোন ধরনের ধাঁধা পার।
কোন মাছি উড়ে না–ঘামাছি। কোন স্টেশনে গাড়ি থামে না–রেডিও স্টেশন। এইসব।
এইসব সহজ ধাঁধা। কঠিন একটা জিজ্ঞেস করি। বলো দেখি—
কহেন কবি কালিদাস শৈশবের কথা।
নয় লক্ষ তেঁতুলগাছে কয় লক্ষ পাতা।
পারব না!
আমিও পারি না। নয় লক্ষ তেঁতুলগাছে কয় লক্ষ পাতা–কীভাবে বলব? একটা তেঁতুলগাছে কয়টা পাতা থাকে গুণে অবশ্যি দেখা যেতে পারে। সময়সাধ্য ব্যাপার।
রহিমা বুয়া কফির কাপ নিয়ে ঢুকল। সঙ্গে পিরিচের উপর দুটা বিসকিট। রনি দেখল লোকটা খুব আগ্রহ করে বিসকিট দুটা খেল। কিছু বিসকিটের গুঁড়া পিরিচে পড়ে ছিল। আঙুল দিয়ে জড়ো করে সেগুলিও মুখে দিল। কফির কাপে চুমুক দিয়ে আরামের শব্দ করল। তার মুখভর্তি হাসি। রহিমা বুয়া বলল, কফি খাইয়া আম্মা আফনেরে চইল্যা যাইতে বলছে।
আচ্ছা চলে যাব। আপনি এই ছবিটা ম্যাডামকে দেবেন?
রহিমা বুয়া ছবি হাতে নিয়ে রনির দিকে তাকিয়ে বলল, ভাইজান, আপনেরে চইল্যা আসতে বলছে।
রনির ইচ্ছা করছে লোকটার সঙ্গে গল্প করতে। সব মানুষের সঙ্গে গল্প করতে তার ভালো লাগে না। এই মানুষটার সঙ্গে গল্প করতে ভালো লাগবে তা বোঝাই যাচ্ছে।
মুহাব্বত আলি কফির কাপে শব্দ করে চুমুক দিল। মা থাকলে ভুরু কুঁচকে তাকাতেন। শব্দ করে যে-কোনো জিনিস খাওয়াই অভদ্রতা।
রনি মানুষটার দিকে তাকিয়ে আছে। মুহাব্বত আলি এবার তাকালেন রহিমার মার দিকে। গম্ভীর গলায় বললেন, রহিমার মা শোনো। তোমার ম্যাডাম বলেছিল একশ টাকা দেবেন। দোতলায় উঠে মনে হয় ভুলে গেছেন। দোতলার মানুষ একতলার মানুষকে সহজে ভুলে যায়। তুমি উনার কাছ থেকে টাকাটা নিয়ে এসো। আমি চলে যাব।
রহিমা বুয়া বিরক্ত মুখে চলে যাচ্ছে। বিড়বিড় করে আবার কী যেন বলল। রনি বুঝতে পারছে না রহিমা বুয়া এত বিরক্ত হচ্ছে কেন? এত বিরক্ত হবার মতো কিছু তো এই মানুষটা বলে নি।
রনির মনে ছোট্ট একটা খটকাও লাগছে–মানুষটা রহিমা বুয়ার নাম জানল কীভাবে? এত সহজভাবে বলেছে যেন রহিমা বুয়াকে সে অনেকদিন থেকে চেনে।
রনি মুহাব্বত আলির দিকে তাকিয়ে বলল, আপনাকে আমি কী ডাকব? কিছু ডাকতে হবে না। আমি যদি তোমার আর্ট টিচার হতাম, তাহলে স্যার ডাকতে বলতাম।
রনি বলল, আপনি রহিমা বুয়ার নাম জানলেন কীভাবে?
মুহাব্বত আলি হেসে ফেলে বললেন, তুমি নিশ্চয়ই ভাবছ আমার সুপারম্যানদের মতো ক্ষমতা-টমতা আছে। এসবের কোনো কারবারই আমার নেই। আমি তোমাদের গেটের দারোয়ানের কাছে সবার নাম জেনে নিয়েছি।
কেন?
বলা তো যায় না কখন কোন কাজে লাগে। কাজে তো লাগল। রহিমা বুয়াকে ডাকতে পারলাম। ভালো কথা, তোমার মা টাকা পাঠাতে দেরি করছে কেন? দেবে না নাকি?
একবার যখন বলেছে তখন দেবে।
তাহলে অপেক্ষা করি, কী বলো?
অপেক্ষা করুন।
টিভিটা ছাড়া তো, বসে বসে টিভি দেখি।
এখন টিভি ছাড়লে মা রাগ করবে।
রাগ করলে থাক।
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না, রহিমা বুয়া টাকা নিয়ে দোতলা থেকে নামল। মুহাব্বত আলি টাকাটা ব্যাগে রেখে উঠে দাঁড়ালেন। রনির দিকে তাকিয়ে বললেন, আসি?
রনির খুব ইচ্ছা করছে বলে, আবার আসবেন। শেষ পর্যন্ত বলল না। মানুষটাকে আবার দেখলে মা অবশ্যই রাগ করবেন। মা রাগ করলে বাবা রাগ করবেন। সে কাউকেই রাগাতে চায় না।