ডাকাতরাজ – দেবারতি মুখোপাধ্যায়
বিস্মৃতপ্রায় মল্লরাজ্যের রোমাঞ্চকর আখ্যান
প্রথম প্রকাশ আগস্ট ২০২১
যাঁরা পরম ধার্মিক হয়েও বুঝিয়েছিলেন,
সনাতন ধর্ম উদারতার কথা বলে,
যাঁরা সাম্রাজ্য বিস্তার বা
আগ্রাসনের অনেক ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছিলেন
প্রজাদের কল্যাণসাধনকে, মনুষ্যত্বকে,
সযত্নে লালন করেছেন রাঢ়বঙ্গের লোকায়ত সংস্কৃতিকে,
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অরণ্যরাজ্য শাসন করা
সেই মল্লরাজাদের স্মৃতির উদ্দেশে।
আমার কথা
বাঁকুড়ার মন্দিরনগরী বিষ্ণুপুরে যাওয়ার প্রথম সুযোগ হয়েছিল বছরছয়েক আগে। তখন রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকে চাকরি করি, সেইসূত্রেই একটি ইনস্পেকশনে যাওয়া। প্রথম দেখায় খুব রোমহর্ষক কিছু লাগেনি। অটো—টোটো—রিকশায় ভরা জমজমাট একটি টাউন। পশ্চিমবঙ্গের আর পাঁচটা মহকুমা শহরের মতো বিষ্ণু পুরে মিউনিসিপ্যালিটি, ডাকঘর, থানা, অফিস, আদালত, হাসপাতাল, স্কুল সবই রয়েছে। আর রয়েছে এ-গলি ও-গলিতে অসংখ্য মন্দির। অধিকাংশই জরাজীর্ণ, পরিত্যক্ত। রাসমঞ্চ, জোড়বাংলা মন্দির, মদনমোহন মন্দির, দলমাদল কামান, বড়পাথর ছোটপাথর দরজা ইত্যাদি দেখে, ফিরে এসেছিলাম কলকাতায়।
বিষ্ণুপুর ফিরে এল দু-বছর বাদে। ভারতবর্ষের এক বীরকে নিয়ে ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখার তোড়জোড় করছিলাম। আমার কলেজজীবনের বন্ধু, বর্তমানে একটি কলেজের অধ্যাপক অরিত্র সব শুনে-টুনে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, ‘চর্বিত-চর্বণ না করে বাঙালি বীর, যাদের নিয়ে সেভাবে কাজই হয়নি, সেদিকে তো নজর দিতে পারিস!’
‘বাঙালি বীর! শশাঙ্ক?’
‘কেন শশাঙ্ক ছাড়া আর কেউ ছিলেন না বাংলায়?’ অরিত্র বিরক্তমুখে তাকিয়েছিল, ‘প্রতাপাদিত্য, ঈশা খাঁ, চাঁদ রায়, কেদার রায়, কংসনারায়ণ রায়, ফজল গাজী এইসব বাঙালি রাজাদের নিয়ে ক’টা লেখা হয়েছে বাংলায়? আর যে রাজবংশ প্রায় এক হাজার বছর ধরে শাসন করে গিয়েছে, সেই মল্লরাজারা? এঁদের নিয়ে লিখিস না কেন? ওরে, এঁরা তো বাংলার বীর। সুলতানের হিন্দু সেনাপতি কালাপাহাড়? হ্যাঁ, নিষ্ঠুর। কিন্তু মহাবীর তো বটে! একটু খাটতে হবে, হাতের কাছে রেডিমেড কিছু পাবি না। কিন্তু কাজটা একটা মাইলস্টোন হয়ে থাকবে।’
একহাজার বছর শাসন করেছে মল্লরাজবংশ! আমি হতবাক। জাপানের ইয়ামাটো রাজবংশ দীর্ঘতম রাজবংশ বলে জানি, আমাদেরই এই বাংলায় একটি রাজবংশ কিনা এতদিন শাসন করে গিয়েছে?
পরের সপ্তাহান্তেই চলে গেলাম বিষ্ণুপুর। নতুন চোখে দেখতে চেষ্টা করলাম সুপ্রাচীন নগরীটিকে। ভাবনার সেই শুরু, বইপত্র সংগ্রহের আরম্ভ। প্রথম মল্লরাজ আদি রঘুনাথ সিংহাসনে আরোহণ করেন ৬৯৪ খ্রিস্টাব্দে। এবং ৬১তম মল্লরাজ কালীপদ সিংহ ঠাকুরের রাজ্যশাসন শেষ হয় ১৯৮৩ সাল নাগাদ।
এই সুদীর্ঘ সময়কাল, অরণ্যরাজ্য বিষ্ণুপুর, মল্লরাজ্যের সমাজ, যুদ্ধ, অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে লেগে যায় প্রায় আড়াইবছর। এই সময়কালে বিষ্ণুপুর গিয়েছি অসংখ্যবার। আচার্য যোগেশচন্দ্র পুরাকৃতি ভবনে গিয়ে খুঁজেছি মল্লরাজ্যের ইতিহাস। দেখেছি বহু পুরোনো ভুর্জপত্র।
‘ডাকাতরাজা’ ইতিহাস সুরভিত উপন্যাস। ইতিহাসের শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকার দায় ঔপন্যাসিকের নেই, আর তা সম্ভবও নয়। ঊনপঞ্চাশতম মল্লরাজা বীরহাম্বীর ছিলেন মোঘল সম্রাট আকবরের সমসাময়িক। তাঁর জীবন যেমন বিচিত্র, তেমনই নায়কোচিত। সম্রাট অশোকের মতোই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর উত্তরণ ঘটেছে শক্তি থেকে ভক্তিতে। তাঁর সময়ে জড়িয়ে আছেন বৈষ্ণব পণ্ডিত শ্রীনিবাস আচার্য, দুর্ধর্ষ সেনাপতি কালাপাহাড়, মোঘল সিপাহশালার মুনিম খাঁ প্রমুখ।
কিন্তু বাংলার সেই শেষ স্বাধীন রাজ্য স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পরেও এতটাই উপেক্ষিত, অবহেলিত যে, মল্লরাজাদের গড়া অজস্র মন্দির, বাঁধ, পরিখা বুকে মৃতপ্রায় ইতিহাস বুকে চেপে দাঁড়িয়ে থাকে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে তারা ভগ্নপ্রায়!
ভাষাচার্য ডঃ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় আক্ষেপ করেছিলেন, ‘সমস্ত গুণাবলী থাকা সত্ত্বেও বাংলার এই সুপ্রাচীন মন্দিরনগরী বিষ্ণুপুর কাশী, মাদুরাই বা আগ্রার মতো কলানগরী হয়ে উঠতে পারল না। অতুলনীয় শিল্পকার্য হওয়া সত্ত্বেও বিষ্ণুপুরকে বাংলাই জনসাধারণ চিনল না, আদর করতে জানল না!’
ঋণী অনেকের কাছেই। সর্বাগ্রে যাঁর নাম না করলে নয়, তিনি বিষ্ণুপুরের অধিবাসী প্রখ্যাত শিল্পী শ্রীগৌতম কর্মকার মহাশয়। প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ শুধু নয়, তাঁর পরিবারের কাছ থেকে যে অমায়িক অকৃত্রিম আতিথেয়তা আমি পেয়েছি, সে ঋণ অপরিশোধ্য। বিষ্ণুপুর রাজপরিবারের অন্যতম সদস্য শ্রীজ্যোতিপ্রসাদ সিংহ ঠাকুরও নানা উপকরণ দিয়ে আমায় কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন। এছাড়াও সাহায্য করেছেন ‘মল্লভূম বিষ্ণুপুর’-এর লেখক মনোরঞ্জন চন্দ্র, আচার্য যোগেশচন্দ্র পুরাকৃতি ভবনের কর্মীরা।
উপন্যাসটি লেখা শুরু করেছিলাম প্রায় আড়াই বছর আগে। কিন্তু কিছুটা লিখে কলম নামিয়ে রেখেছিলাম। প্রায় পাঁচশো বছর আগেকার বাংলা, তার সমাজ, পুরুষ-নারী, পোশাক, জীবনযাপনের জন্য প্রচুর বই দেখার পাশাপাশি প্রায়ই ছুটতে হচ্ছিল সুদূর বিষ্ণুপুরে। তবু এত চরিত্র, এত ঘটনার বুনোট, এত ঘাত-প্রতিঘাত ঠিক যেন সামলাতে পারছিলাম না।
অবশেষে একরোখা জেদ করেই শেষ করলাম মল্লরাজা বীরহাম্বীরকে নিয়ে কাহিনি। এত প্রকাণ্ড ক্যানভাসে বিশাল ঐতিহাসিক উপন্যাস আমি আগে কখনো লিখিনি! সফল হয়েছি কতটা, তা বলবেন পাঠক।
পরিশেষে তিনজনের কথা না বললেই নয়। প্রথমজন আমার স্বামী সুরজিত, যে আমার প্রতিটা বইয়ের মতো এই বইয়েরও প্রথম পাঠক এবং কঠোর সমালোচক। দ্বিতীয়জন, আমার বন্ধু তথা প্রখ্যাত লেখক অভীক মুখোপাধ্যায়। গোটা পাণ্ডুলিপিটি সে পড়েছে, প্রয়োজনমতো সম্পাদনা করেছে, একেকটি চরিত্র ধরে ধরে আমার সঙ্গে আলোচনা করেছে। এবং তৃতীয়জন, এই গ্রন্থের প্রকাশক, স্বনামধন্য লেখক পিতৃপ্রতিম শ্রীত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায়, যিনি রাতের পর রাত জেগে সম্পাদনা করেছেন, নির্মম কাটাছেঁড়া করে মেদহীন করেছেন ডাকাতরাজাকে। টেলিফোনে তাঁর সস্নেহ বকুনিতে বুঝিয়েছেন, কোন অংশটা বাহুল্য, কোন অংশটিকে করতে হবে আরো নাটকীয়!
‘ডাকাতরাজা’ লিখতে গিয়ে আমি যে যে গ্রন্থের সাহায্য নিয়েছি, তার একটি অসম্পূর্ণ তালিকা দেওয়া হয়েছে। সম্পূর্ণ তালিকা দেওয়া সম্ভব নয়, কারণ এই অন্বেষণ চলেছে প্রায় তিনবছর ধরে। কত বই ঘেঁটেছি, কোথা থেকে কী তথ্য নিয়েছি, পুঙ্খানুপুঙ্খ মনে নেই।
নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু বলেছিলেন, ‘যে রাজ্যে দলমাদলের মতো কামান তৈরি হয়, আবার মদনমোহনের মতো বিগ্রহের বাসস্থান রচিত হয়, যেখানে ভগবানের নামে লোকের চোখে জল পড়ে, যেখানে দেশপ্রেম ও ভক্তির এমন সমন্বয় ঘটে, সেই রাজ্য বাংলা তথা ভারতকে প্রেরণা দিতে পারে।’
প্রণাম!
দেবারতি মুখোপাধ্যায়
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জী
১। বিষ্ণুপুরের অমর কাহিনী, ফকির নারায়ণ কর্মকার।
২। মল্লভূম বিষ্ণুপুর, মনোরঞ্জন চন্দ্র।
৩। বিষ্ণুপুর রান্দেল রাজবংশ ও বিষ্ণুপুরের ইতিহাস, পীতাম্বর দাশগুপ্ত (পাত্র)
৪। History of Bishnupur Raj—Abhaya Pada Mallik.
৫। মল্লভূম কাহিনী, শ্রী গঙ্গাগোবিন্দ রায়।
৬। পশ্চিম রাঢ় তথা বাঁকুড়া সংস্কৃতি, মাণিকলাল সিংহ।
৭। বাঁকুড়া জেলার পুরাকীর্তি, অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়।
৮। Bishnupur—Archeological Survey of India.
৯। মল্লেশ্বরী মা মৃন্ময়ী, কল্পনা সিংহদেব।
১০। ভারতকোষ, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ।
১১। লোকসংস্কৃতি, বাঁকুড়া লোকসংস্কৃতি আকাদেমি।
১২। বিষ্ণুপুরের দশ অবতার তাস, চঞ্চল কর্মকার।
১৩। Kinship and Ritual in Bengal—Lina Fruzzetti—Akos Ostor.
১৪। মেয়েদের ব্রতকথা, অক্ষয় লাইব্রেরী, কলকাতা।
১৫। শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী, ভক্তি বেদান্ত বুক ট্রাস্ট।
১৬। আমার নাম কালাপাহাড়, বিশ্বনাথ ঘোষ।
১৭। কালাপাহাড়, মোহিতলাল মজুমদার।
১৮। The Cult of Jagannatha—Kanhu Charan Mishra.
১৯। Journal of Asiatic Society Bengal—Old Series—Vol. LXIX—1900—pt. I.p. 189.
২০। A Study of History of Orissa—from the earliest times to Mukundadeva—Atul Chandra Pradhan.
২১। The Lives of the Vaishnava Saints Shrinivas Acharya—Narottam Das Thakur and Shyamananda Pandit—Steven Rosen.
২২। বিষ্ণুপুর দ্বিতীয় দিল্লী, রমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।…ইত্যাদি।
১
‘যুবরাজ! যদি অপরাধ না নেন, একটা কথা বলি।’
‘বলুন, মহাসেনাপতি।’
‘মোগলদের সামনে এখন আমাদের বাহিনীর আত্মসমর্পণ ছাড়া কোনও পথ কিন্তু খোলা নেই।’
‘কী বলছেন মহাসেনাপতি?’
‘আজ্ঞে যুবরাজ, যুদ্ধের হাওয়া সেদিকেই বইছে। ভাগ্যদেবতা আমাদের ওপরে প্রসন্ন নন। নইলে কি আর এই ক্ষুদ্র রাজ্যের ওপর দিল্লিশ্বরের দৃষ্টি এসে পড়ে?’
সদ্য গজিয়ে ওঠা নরম ঘাসের মতো সবুজাভ গোঁফে নিজের অজান্তেই হাত বোলালেন রাজকুমার। তিনি ভাগ্য এবং ভাগ্যদেবতা এই দুইয়ের ওপরে আস্থা রাখেন। কিন্তু পাশাপাশি এও বিশ্বাস করেন যে ভাগ্য উদ্যমী ও সাহসী পুরুষের পাশেই থাকে।
মোগল সম্রাট আকবরের বাহিনীর রণকৌশল অভিনব না-হলেও তাদের সৈন্যসংখ্যা অনেক বেশি। ভারের জোরেই কেটে যাবে।
কিন্তু সেই ভারকেও আয়ত্তে আনা সম্ভব, যদি তাকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলা যায়!
নিবিষ্টমনে চিন্তা করছিলেন যুবরাজ, মহাসেনাপতি ইতস্তত করে বলে উঠলেন, ‘তবে কি আমাদের সেনাদের আত্মসমর্পণ করতে বলব, যুবরাজ?’
যুবরাজ শূন্য দৃষ্টিতে তাকালেন মহাসেনাপতির দিকে। পিতৃতুল্য এই প্রৌঢ়কে তিনি অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করেন। বংশানুক্রমে এঁরা রাজ্যের সেনাপতি। এঁর পুত্র কুম্ভ বর্তমানে রাজ্যের একজন উপসেনাপতি, যুবরাজের বন্ধুস্থানীয়।
রাজ্যকে বহুবার বহু বিপদ থেকে এই মহাসেনাপতি রক্ষা করেছেন। তবে এইবারের মতো ভয়াল বিপদ এর আগে কখনো উপস্থিত হয়নি।
‘যুবরাজ! শুনছেন?’
যুবরাজ সংবিত ফিরে পেলেন। বললেন, ‘মহাসেনাপতি! আপনি নিশ্চয়ই রুটি গরম গরম খান?’
রুটি! গরম? থতমত খেয়ে গেলেন মহাসেনাপতি। বৃদ্ধ রাজা ধাড়ীমল্লের অনুগত তিনি। রাজার প্রতিনিধি রূপে তিনিই সব দিক দেখছেন। নেতৃত্ব দিচ্ছেন রাজ্যের যুবরাজ। না হয় পরিস্থিতি অনুকূল নয়, তাই বলে যুবরাজ তাঁর সঙ্গে এমন কটু রসিকতা করবেন? রাজ্যে অনেকেই জানে, তিনি গোধুমচূর্ণের রোটিকা খেতে বড় ভালোবাসেন। তাই বলে এই অসময়ে এমন লঘু প্রশ্ন কেন?
‘কী হল মহাসেনাপতি? উত্তর দিলেন না যে?’
‘আজ্ঞে।’ মহাসেনাপতি উত্তর দিলেন, ‘রুটি প্রায়ই খেয়ে থাকি। পছন্দও করি।’
‘বেশ। রুটি গরম থাকলে খেতে তো অসুবিধা! তখন কী করেন?’
‘কী আবার করব? ছিঁড়ে ফেলি! তারপর একটা করে টুকরো তুলে ব্যঞ্জনযোগে গলাধঃকরণ করি।’
যুবরাজ ঘাড় নাড়লেন। গম্ভীরভাবে বললেন, ‘আমাদের সামনে মোগলদের সৈন্যবলটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা। যখনই আমরা আক্রমণ করতে যাচ্ছি, তখনই সম্মুখ সমরে একেবারে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ছে।’
‘আর প্রতিবার ধাক্কা খেয়ে আমরা পিছু হঠছি। ইন্দ্রহাস আর রায়নার গড় আমরা হারিয়ে ফেলেছি। ওরা যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে আর বাকিগুলিকেও রক্ষা করা যাবে না, মাননীয়।’ দ্রুত বলে গেলেন মহাসেনাপতি।
‘অবশ্যই যাবে।’ যুবরাজ চিন্তামগ্নভাবে বললেন, ‘যদি রুটি টুকরো করার মতো আমরা মোগল বাহিনীকে টুকরো টুকরো করে ফেলতে পারি। আকবরের পেয়াদা মুনিম খাঁ ঘুঘু দেখেছে, ফাঁদ এখনও দেখেনি!’
‘বুঝলাম না।’
‘আপনি এখনই আমাদের বাহিনী থেকে বাছাই করা অন্তত একশোজনকে ডেকে নিন। তাদের চারটি দলে ভাগ করে ফেলুন। একটি দলকে পাঠান করাসুরগড়ের দিকে। দ্বিতীয় দল যাবে শিখরভূমে, ঝাঁটিপাহাড় থেকে বেশ কিছু পশ্চিমে। তৃতীয় দলের গন্তব্যস্থল হবে বেত্রগড়ের রায়কাদীঘির ঈশান কোণে, এবং অন্তিম ভাগ যাবে গোহালতোড় অরণ্যে।’ যুবরাজ একনিঃশ্বাসে বলে গেলেন।
বিস্মিত সেনাপতি। যুবরাজ বয়সে অত্যন্ত নবীন, কিন্তু সম্মানে অনেক বড়। তাঁর পরিকল্পনার মাথামুণ্ডু কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। চারদিকে চারটি ছোট ছোট সেনা দল পাঠিয়ে কী মহাকার্য সিদ্ধ হবে?
‘মহাসেনাপতি?’
‘হুঁ!’
‘আপনি তো প্রশ্ন করলেন না, তারপর কী হবে?’
মহাসেনাপতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘যুবরাজ! আপনি যখন ভেবেছেন নিশ্চয়ই অন্তর্নিহিত অর্থ আছে। আমি এখনও কিছু বুঝতে পারছি না।’
‘বলছি। ওরা ওই চারটি স্থানে গিয়ে পর্যবেক্ষণ চূড়া বানাবে। সহজ কথায় যাকে বলা হয় মাচান। উচ্চতা প্রায় চারতলা অবধি করতে হবে। ভেতরে ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাওয়া যাবে একেবারে শীর্ষে। আমাদের সেনারা প্রশিক্ষিত, খুব বেশি সময় লাগবে না। ওদের মাচান তৈরির কাজ শেষ হতে না-হতে প্রত্যেকটি মাচানের কাছে পৌঁছে যাবে আমাদের দস্যুবাহিনী।’
‘দস্যুবাহিনী! অর্থাৎ ডোম পাইকরা?’
‘হ্যাঁ মহাসেনাপতি। অন্য সময় রাজ্যের হয়ে গোপনে লুঠপাট, দস্যুবৃত্তি করলেও এখন তারাই আমাদের সেনার মতো কাজ করবে। আমি স্বয়ং একটি দলের নেতৃত্ব দেব। আপনি অন্য একটি দলের মাথায় থাকবেন। আপনার পুত্র কুম্ভ এবং অন্য একজন উপসেনাপতিকে বাকি দুটি দলের নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব নিতে হবে। মহারাজ নিজে থাকছেন রাজধানীতে। মাচান থেকে শত্রুর গতিবিধির ওপরে শ্যেনপক্ষীর মতো দৃষ্টি রাখা হবে।’
‘তারপর?’
‘তারপর সুযোগ বুঝলেই চারটি ছোট দল চারিদিক থেকে মুনিম খাঁয়ের বাহিনীকে আক্রমণ করবে। চৌতরফা আক্রমণে বিপর্যস্ত যবনেরা তখন ছত্রভঙ্গ হয়ে যাবে। আর ঠিক তখনই আমাদের বিখ্যাত কামানগুলো মুহুর্মুহু গর্জে উঠবে। আশা করছি, এই আক্রমণ প্রতিহত করার মতো বাঘের বাচ্চা মুনিম খাঁ নয়।’
মহাসেনাপতি হতবাক হয়ে গেলেন। যুবরাজ ইতিমধ্যেই নিজের শৌর্য বীর্যের বহু প্রমাণ দিয়েছেন। অত্যন্ত আগ্রাসী, শত্রুর সম্পদ লুঠপাটে সিদ্ধহস্ত। একইসঙ্গে বিচক্ষণ ও প্রজাবৎসল। রাজ্য যে একজন অত্যন্ত সুযোগ্য শাসক ভবিষ্যতে পেতে চলেছে, তার ইঙ্গিত আগেই পাওয়া গিয়েছে।
কিন্তু এই তরুণ বয়সেই কী ক্ষুরধার পরিণত বুদ্ধি—যুদ্ধকৌশল!
তাঁর মনে পড়ে গেল মাড়োয়ার প্রদেশের রাণা হাম্বীরের কথা। এভাবেই ছোট ছোট ভাগে ঝটিকা আক্রমণ করে নাকি আলাউদ্দিন খিলজির বাহিনীর কোমর ভেঙে দিয়েছিলেন।
প্রৌঢ় আর সময় নষ্ট করলেন না। যুবরাজের থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলেন সেনামহলে।
রাজ্যে সাজো সাজো রব উঠে গেল। যুবরাজের পরিকল্পনা মতো চতুর্দিকে চারটি দল চলে গেল। রাতারাতি গড়ে উঠল মাচান। মাচান থেকে শত্রুর অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে রাজ্যের দুর্ধর্ষ দস্যুবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ল মুনিম খাঁয়ের সেনাদলের ওপরে।
মৌমাছির চাকে ধোঁয়া দিলে যেমন অবস্থা হয়, ঠিক তেমনই দেখাচ্ছিল শত্রুবাহিনীকে। যুবরাজ বীরদর্পে শত্রুর মাথা কাটতে কাটতে সামনে এগোচ্ছিলেন।
মোগল সৈন্যরা প্রায় ধরাশায়ী। যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই শুধু মৃতদেহের স্তূপ। মোগলদের সেনাছাউনিগুলোকে তোপ দেগে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
মৃত্যুপ্রান্তর থেকে কালো ধোঁয়ার রাশ কুণ্ডলি পাকিয়ে উঠছে। ক্ষুদ্র এক অরণ্যরাজ্যের সঙ্গে সম্মুখসমরে দুর্ধর্ষ মোগলদের পরাজয় ঘটেছে। মুনিম খাঁয়ের বাহিনী পিছু হঠছে।
যুদ্ধ শেষ!
সন্ধ্যায় রাজবাড়ির কুলদেবী মা মৃন্ময়ীর মন্দিরে গিয়েছেন যুবরাজ। রাজকুলের এটি বহুপ্রাচীন রীতি। বিবাহ ইত্যাদি শুভ অনুষ্ঠানে রাজবাড়ির কোনও বিশেষ প্রতিনিধি মা’কে আমন্ত্রণ করতে যান। আর যুদ্ধযাত্রার আগে মায়ের আশিস তথা অনুমতি নিতে যেতে হয়। যুদ্ধ শেষেও মা মৃন্ময়ীর চরণে গিয়ে জানাতে হয়, মাগো তোমার আশীর্বাদে আমরা সকলে জীবিত আছি, কুশল আছি।
মৃন্ময়ী মন্দিরের সম্মুখে অবস্থিত পঞ্চবটির পাতা বেয়ে সন্ধ্যা নামছে। মায়ের মন্দিরে ওঠার সোপানশ্রেণীর পাশের থামের উপর থেকে শেকলে ঝুলছে পিতলের প্রদীপ। গব্য ঘিয়ের গন্ধে ম-ম করছে পরিবেশ।
হাতে রক্তজবার মালা। যুবরাজ মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশ করলেন। দেবীর মাটির মূর্তি। গলায় মাটির তৈরি নৃমুণ্ডের মালা। সন্ধ্যার আরতি সবে শেষ হয়েছে বলে এখনও বাতাসে ভাসছে ধুনোর ধোঁয়া আর সুগন্ধ।
যুদ্ধে অপ্রত্যাশিত বিজয়ের পর আজ প্রথম আরতি। তাই দেবী পীতবসনে সজ্জিতা। মায়ের পায়ের সামনে অধিষ্ঠিত ঘটে হাতের মালাখানি পরিয়ে দিয়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন যুবরাজ।
প্রণাম এবং প্রার্থনা সেরে ওঠার আগে চোখ খুলতেই তিনি স্তম্ভিত।
এ কী! চতুর্দিকে প্রদীপের আলো ঝলমল করছিল। কোথায় গেল সেই দীপশিখাগুলি?
এত নিকষ অন্ধকার কেন?
দিক ঠাহর করতে পারছেন না যুবরাজ। মেঝেতে হাতড়াতে থাকলেন। হাতে কিছু একটা ঠেকল! প্রায় গোলাকার, পেলব, সিক্ত, পিচ্ছিল কিছুর স্পর্শ।
কম্পিতহাতে বস্তুটাকে হাতে তুলে নিলেন তিনি। কোথা থেকে একটা নীলাভ আলো এসে ঠিকরে পড়ল হাতের ওপরে। তিনি স্পষ্ট দেখলেন, হাতে ধরে আছেন একটি কাটা মাথা। ফোঁটা ফোঁটা রুধিরে লাল হয়ে গেছে তাঁর হাত।
যুবরাজ শিহরিত, প্রস্তরবৎ। দেবীর সম্মুখে এ কী ভীষণ অবস্থায় পড়লেন!
দ্বিধাগ্রস্ত চোখে তিনি দেবী মূর্তির দিকে তাকালেন। নীল আলো আরও জোরালো হয়েছে। দেবীর শান্ত, সমাহিত মুখে এখন উষ্মা ফুটে উঠছে।
যুবরাজ স্পষ্ট দেখছেন পীতাম্বরা মায়ের বসন খুলে পড়েছে। মা এখন রণমূর্তি ধারণ করছেন। গলার মুণ্ডমালার নৃমুণ্ডগুলি আর কৃত্রিম মনে হচ্ছে না। এক একটি মানুষের কর্তিত মস্তক যেন গাঁথা হয়ে আছে দেবীর কণ্ঠের মালায়। টপটপ করে রক্ত ঝরে পড়ছে সেই মালা থেকে। সেই রক্তে পিছল হয়ে যাচ্ছে গর্ভগৃহের তল।
যুবরাজ আতঙ্কে কেঁপে উঠলেন। দরদর করে ঘামছেন তিনি। হাতে ধরা কাটা মাথাখানা আপনা হতেই পড়ে গিয়েছে। যুবরাজ চোখ বুঁজে ফেললেন। মনে মনে বললেন, ‘মা গো! এ তোমার কেমন লীলা? আমায় কী রূপ দেখাচ্ছ, মা? কী অপরাধ করেছি আমি?’
আর তখনই যেন আকাশবাণী হল। গম্ভীর নারীকণ্ঠে কেউ বলে উঠলেন, ‘ওরে যুবরাজ! কবে বন্ধ হবে তোর দস্যুবৃত্তি? রাজরক্তের ধারক বাহক হয়ে দিনমানে সম্মানের পাত্র হয়ে থাকিস, আর নিশিরাতে দস্যু পাঠিয়ে লুঠ করিস? ডাকাতরাজা নামে কোন গর্ব নেই রে, রয়েছে লজ্জা! অনেক হয়েছে। আর কখনো এমন করিস না। তবে কিন্তু ঘোর অনর্থ হবে! ঘোর অনর্থ হবে! ঘোর অনর্থ হবে!’
তিনবার দৈববাণী শেষ হওয়ামাত্র রাজার চোখ খুলে গেল। তিনি ত্বরিতে উঠে বসলেন। ঘামে ভিজে উঠেছে সর্বাঙ্গ।
কোথায় মন্দির? কোথায় মা মৃন্ময়ী? এ তো নিজের শয্যাকক্ষে, নরম বিছানার পালঙ্কে শুয়ে আছেন তিনি!
এই নিয়ে পরপর তিনদিন। তিন রাতে রাজা এই একই স্বপ্ন দেখলেন। না, স্বপ্ন পুরোটা নয়।
তাঁর প্রথম জীবনের সেই যুদ্ধ, যুবরাজ অবস্থায় মুনিম খাঁকে যুদ্ধে হারানো তো সম্পূর্ণ সত্য ঘটনা। কতদিন আগেকার কথা। তবু স্মৃতিপটে আজও উজ্জ্বল রয়েছে সম্পূর্ণ যুদ্ধ। ওই যুদ্ধের কিছুদিন পরই পিতৃদেব মারা যান। রাজা হন তিনি।
কিন্তু পরপর তিনরাতে দেখা মা মৃন্ময়ীর ওই লীলা?
সেও কি সত্যিই স্বপ্ন?
২
নিশ্চল অপরাহ্ন। পড়ন্ত রৌদ্র। তবু প্রখর দাবদাহে রাঢ়বঙ্গের রক্তমৃত্তিকা উত্তপ্ত। বাতাস নেই, শুষ্ক ভূখণ্ড, চরাচর স্তব্ধ।
রাজপথ প্রায় নির্জন। দু-একটি গো-শকট ও কতিপয় সারমেয় কেবল দৃশ্যমান।
মৃৎকুটীর বা অট্টালিকা তো বটেই, রাজধানীর কেন্দ্রে অবস্থিত রাজপ্রাসাদটিও এই প্রচণ্ড তাপে শীতল বাতাসের প্রতীক্ষায়।
যখন রাজপ্রাসাদের এক গোপন কক্ষে এই আখ্যানের সূত্রপাত ঘটছে, তখন সেখানে উপস্থিত রাজ্যের তিন অতি-সম্মাননীয় ব্যক্তিত্ব। রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী, রাজজ্যোতিষী এবং রাজা স্বয়ং।
কক্ষটি বাহুল্যবর্জিত। উত্তর কোণে রাজার জন্য সুনির্দিষ্ট সিংহাসন, তার সামনে দুটি পঙক্তিতে কয়েকটি আসন। কক্ষের বাইরে দণ্ডায়মান প্রহরী। উচ্চবর্গীয় অমাত্যদের সঙ্গে গোপন আলোচনার জন্য মূলত নির্দিষ্ট এই কক্ষ।
রয়েছে একটিমাত্র বাতায়ন। পাশেই ঝোলানো একটি পাখির পিঞ্জর। ওই পাখিটিই সব গোপনীয়তার একমাত্র সাক্ষী।
দিনরাত্রির সন্ধিক্ষণ আসন্ন। গব্য ঘৃতের প্রদীপ জ্বলছে, মিষ্টি গন্ধ ছড়াচ্ছে কক্ষময়। রাজজ্যোতিষী তাঁর গণনায় মগ্ন। তাঁর দিকে উৎকণ্ঠিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন রাজা ও প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী ধৈর্য সংবরণ করতে না-পেরে বলে ফেললেন, ‘পণ্ডিতমশাই! প্রায় এক প্রহর হতে চলল আপনি গণনায় বসেছেন। গুপ্তচরদের দেওয়া সংবাদ অনুযায়ী তারা আমাদের রাজ্যের সীমানায় এসে পড়বে শীঘ্রই। কিন্তু আপনি নিশ্চিত না-করলে…’
‘উনি তো নিজের কাজই করে চলেছেন!’ প্রধানমন্ত্রীর কথার মধ্যেই রাজা একটু অসন্তুষ্ট হয়ে বাধা দিলেন। বললেন, ‘অহেতুক ওঁর মনঃসংযোগে বাধা দিয়ে লাভ আছে? তাতে গণনা ভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা।’
‘আমার গণনা সমাপ্ত।’ বৃদ্ধ রাজজ্যোতিষী দৃষ্টি তুললেন। চোখের তারা ঈষৎ কম্পমান। তাঁর অসংখ্য জরারেখাকীর্ণ মুখমণ্ডলে চিন্তার ছাপ।
‘গুপ্তচরেরা সঠিক বলেছে। বহুদূরের এক রাজ্য থেকে তিনটি গো-শকট আসছে। আমাদের রাজ্যের উত্তর-পশ্চিমের গোপালপুর চটিতে আগামী শুক্লাদ্বিতীয়ায় তারা রাত্রিবাস করবে। তিনটি গো-শকটই বহুমূল্য রত্নরাজিতে পরিপূর্ণ। সঙ্গে বিশেষ কোনও সশস্ত্র প্রহরীও নেই।’
প্রধানমন্ত্রীর চক্ষু ঝলসে উঠল। তিনি রাজার দিকে তাকালেন, ‘তবে তো আর বিলম্ব করা যায় না রাজামশাই! এখনই নিতাই সর্দারকে ডেকে পাঠাই?’
প্রধানমন্ত্রীর উত্তেজনা স্বাভাবিক। এই রাজ্যের রাজকোষের একটি বৃহৎ অংশ আসে লুটের ধন থেকে। ইদানীং বহু রাজা বা জায়গীরদারদের কাছেই নিজের অঞ্চলের সীমানার মধ্যে দস্যুবৃত্তি অভিজাত ক্রীড়ায় পরিণত হয়েছে। প্রতিটি রাজ্যেই এর জন্য রয়েছে পৃথক বাহিনী। তাদের কাজই হল রাজাদেশে লুণ্ঠন কাজ সমাধা করা অত্যন্ত গোপনে। প্রকাশ্যে তারা রাজদরবারের সঙ্গে সম্পর্কও রাখে না। বলা বাহুল্য, রাজদরবারও জনসমক্ষে স্বীকার করে না তাদের অস্তিত্ব।
নিতাই সর্দার জাতে বাগদি। সে-ই এই রাজ্যের পাইক বাহিনীর প্রধান। তার দলে রয়েছে সেরা সেরা তিরন্দাজ আর পাইক। কুঠার, টাঙি, সড়কি হাতে তারা অতি হিংস্র নির্দয় প্রকৃতির। আদেশ মাত্র তারা চলে যায় হরণে এবং অপহরণে। প্রয়োজনে রক্তপাত হলেও তারা থাকে নির্বিকার।
‘না, জীমূতবাহন!’ রাজার দ্বিধাগ্রস্থ কণ্ঠ শুনে অবাক হলেন প্রধানমন্ত্রী, ‘এসব অনেক হয়েছে, আর নয়। এই লুঠতরাজ আর ভালো লাগছে না। রাজকোষে তো অভাব নেই কিছু!’
প্রধানমন্ত্রী বিমূঢ়ভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘আজ্ঞে, সকলেই তো করে থাকেন!’
‘সকলে অন্যায় করলে কি আমাকেও করতে হবে?’
‘কিন্তু রাজামশাই, মা মৃন্ময়ীর অভিলাষেই তো এই লুণ্ঠন। রাজকোষের অর্থ তো প্রজাকল্যাণেই ব্যয় হয়। এভাবেই ধনী থেকে দরিদ্রের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে সম্পদ, আমরা নিমিত্ত মাত্র!’
রাজা বললেন, ‘এটা নিছকই লুঠের সপক্ষে একটা অজুহাত! ঈশ্বর কখনও কারুর ধনসম্পদ ছিনিয়ে নেওয়াকে সমর্থন করতে পারেন না! তিনি আমাদের ”পরদ্রব্যেষু লোষ্ট্রবৎ” জ্ঞান করতে শিখিয়েছেন।’
জীমূতবাহন এই উত্তর আশা করেননি। যিনি একসময় সারা রাত জেগে প্রতীক্ষা করতেন ডাকাতদলের প্রত্যাবর্তনের পর সুসংবাদ শোনার আকাঙ্ক্ষায়, সেই রাজার এই আকস্মিক পরিবর্তনে প্রধানমন্ত্রী কেমন হতবাক হয়ে গেলেন। দ্বিধাগ্রস্ত দৃষ্টিতে তিনি রাজজ্যোতিষীর দিকে তাকালেন, ‘পণ্ডিতমশাই, আপনার গণনা যে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের মতো নির্ভুল, তা আমরা জানি। কিন্তু আপনিও কি রাজামশাইয়ের সিদ্ধান্তে সহমত? আমাদের সীমানার মধ্যে দিয়ে যাওয়া সেই ধনসম্পদ আমরা অপহরণ করব না?’
বৃদ্ধ জ্যোতিষী মৃদু হাসেন, ‘রাজসিদ্ধান্ত গ্রহণের আমি কে? আমি গণক মাত্র। সে কেবল নিজের বিদ্যার প্রয়োগ করতে পারে। ফলের লাভ বা ক্ষতির দায় তার নেই। আমি শুধু একটাই কথা বলতে পারি, রাজার জীবনে এক সন্ধিক্ষণ আসন্ন। রাজামশাই যদি এই সম্পদ গ্রহণ করেন, তাঁর জীবনে আমূল পরিবর্তন আসবে। এক ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হবে তাঁর জীবনের ধারা, আর তাঁকে কেন্দ্র করে সমৃদ্ধ হবে আমাদের রাজ্যও। এই সম্পদ তাঁর জীবনের ক্রান্তিকালের নির্দেশক!’
রাজজ্যোতিষীর কথার প্রহেলিকায় রাজা কিছুই বুঝতে পারেন না, শুধু তাঁর ভ্রূ আরও কুঞ্চিত হয়ে ওঠে।
‘রাজামশাই!’
রাজা নিরুত্তর, আনমনে তাকিয়ে রয়েছেন পিঞ্জরাবদ্ধ পাখিটির দিকে। কী যেন ভাবছেন গভীরভাবে।
প্রধানমন্ত্রী শেষ চেষ্টা করেন। অনুনয়ের ভঙ্গিতে বলেন, ‘আপনি দয়া করে যদি শুধু এবারের মতো অনুমতি দেন, তবে এই না হয় শেষবারের মতো লুঠ করতে যাবে নিতাই সর্দার! বিশেষত যেখানে রাজ্যের সমৃদ্ধির প্রশ্ন জড়িত!’
রাজা বিমর্ষ মুখে নিশ্চুপ থাকেন।
বাইরে সন্ধ্যা নামছে যুবতীর খোলা চুলের মতো। কুলুঙ্গির ওপর দেদীপ্যমান মৃৎপ্রদীপটির আয়ু ধীরে ধীরে শেষ হয়ে আসছে। আর সেই মুমূর্ষু আলোকে রাজার মুখের স্বেদবিন্দুগুলো ঠিক মুক্তোর মতোই উজ্জ্বল দেখাচ্ছে।
একসময় রাজা অস্ফুটে বলে ওঠেন, ‘বেশ। অনুমতি আমি দিলাম। কিন্তু নিতাইকে বলে দেবেন, কোনওরকম সংঘাত বা রক্তারক্তি যেন না হয়! ওসব আর ভালো লাগে না জীমূতবাহন!’
৩
প্রায় পাঁচশো বছর আগেকার এক প্রভাত। দিনকয়েকের অবিরাম ধারাবর্ষণের পর আজ সূর্যদেব স্বমহিমায় সদ্য আবির্ভূত হয়েছেন। পাখিদের সুরেলা কূজনে ও সদ্যস্ফুটিত রবিকিরণে চতুর্দিক ক্রমেই সমুজ্জ্বল হয়ে উঠছে, অথচ রোদের তেমন কঠোর দীপ্তি নেই।
বড় স্নিগ্ধ এই ভোর!
সুবিশাল এই রাঢ়দেশের নদীগুলি পশ্চিমের মালভূমি থেকে দিনের পর দিন কাঁকুড়ে পলিমাটি অক্লেশে বহন করে এনে যে সমতলভূমি বানিয়েছে, বর্তমানে তার স্থানে স্থানে ঢেউখেলানো, নাতিদীর্ঘ রুক্ষ পাহাড়। সেগুলোও গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে সিক্ত। সুউচ্চ বৃক্ষ, ছোট-বড় তরুরাজি সবই এখনও ভেজা।
এই উপত্যকা এখনও জনবসতিবিহীন, প্রধানত দূরাগত পথিকেরাই রাঢ়দেশে আগমনকালে সময় বাঁচাতে এই উঁচু-নিচু পথ বেছে নেয়। দেড়-দুই মানুষ উঁচু টিলাগুলি তারা সঙ্গে থাকা লাঠিতে ভর করে ত্বরিতগতিতে পার হয়ে যায়।
দৈনন্দিন আনাগোনা না হলেও পথিকদের চলার গতিতে নিজে থেকেই সবুজ ঘাসের মধ্যে আঁকা হয়ে গেছে সরু এক পায়ে চলা বনবীথিকা। দুপাশে অরণ্য, তা ঘন না-হলেও নানারকমের গুল্মলতায় পরিপূর্ণ। পথচারীরা এই পথে রাতে চলার ঝুঁকি নেয় না। তারা সারাদিন হাঁটে, দিনের আলো নিভে এলে আশ্রয় নেয় কোনও গাছতলায়, পরেরদিন সকালে আবার শুরু হয় পথচলা। তবে আশার কথা এই যে, এ অঞ্চলে হিংস্র পশু নেই, তাই ভয় অনেক কম।
এই মুহূর্তে এক যুবককে লাঠি হাতে সতর্ক পায়ে শুঁড়িপথ দিয়ে চলতে দেখা যাচ্ছে, সূর্য উদিত হতেই, হাঁটা শুরু করে দিয়েছে। গত দু’দিন প্রাকৃতিক দুর্যোগে তার এমনিতেই বেশ দেরি হয়ে গিয়েছে, মুষলধারায় বৃষ্টিতে তাকে দাঁড়িয়ে পড়তে হয়েছে বারবার। না-হলে ইতিমধ্যে তার গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়ার কথা।
ভাগ্যক্রমে আজকের দিনটা বড় সুন্দর। সে যতটা সম্ভব দ্রুতগতিতে হেঁটে চলেছিল।
যুবককে দেখলেই সম্ভ্রান্তবংশীয় মনে হয়। বয়স আনুমানিক পঁয়ত্রিশ চল্লিশ, ঋজু দেহকাণ্ডটি অত্যন্ত সুঠাম। প্রশস্ত কাঁধ, বলিষ্ঠ বাহু। তার হাঁটার গতির সঙ্গে সেগুলি সঙ্গত করে চলেছে। গালে গজিয়ে ওঠা দাড়ি প্রথম যৌবনের সবুজাভ কচি ঘাসের মতো গোটা গালে ছড়িয়ে রয়েছে। মাথার চুল ঘন, কোঁকড়ানো, পিছন দিকে তা নেমে গেছে ঘাড় পর্যন্ত।
যুবককে দেখলে বোঝা যায় সে ভিনদেশী। তার পরনে সৌখিন কাজ করা আচকান, নিম্নাঙ্গে পায়জামা। মাথায় পাগড়ি। এই অঞ্চলে এমন পোশাক কেউ পরে না। পাগড়ি অবশ্য সৈন্যবাহিনীর সেনারা পরে থাকে, কিন্তু এমন রঙচঙে আচকান পরে কেউ যুদ্ধ করতে যায় না।
জনহীন প্রান্তর পেরোতে যুবকের দেড় ঘণ্টা সময় লাগল। তারপর সে একটা গ্রাম দেখতে পেল। জল ও কিছু খাদ্যদ্রব্য তার সঙ্গে ছিল, কিন্তু গত দুদিনের দুর্যোগে সেগুলো নিঃশেষিত।
পল্লীটি ছিমছাম। পরিষ্কার। অজস্র শাল, পিয়াশাল, হিজলগাছে পরিবেষ্টিত। একপাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ছোট একটি নদী। স্রোত কম হলেও জল স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো।
যুবক এগিয়ে এল সেই নদীর পাশে। তারপর জলে নেমে নিঃসঙ্কোচে আঁজলা ভরে জল পান করতে লাগল। এখনও পর্যন্ত জনমনুষ্য তার চোখে পড়েনি।
সহসা তার মনে পড়ল, এই তল্লাটের কয়েকটি গ্রাম নাকি সম্প্রতি অজানা এক জ্বরে নিশ্চিহ্ন প্রায় হয়ে গেছে।
জলপান করতে করতে যুবক থমকে দাঁড়াল। এই গ্রামও তেমনই কোনও গ্রাম নয়তো? এই জল দূষিত হয়ে গেছে কি?
আশঙ্কা মাথায় আসতেই সে সোজা হয়ে দাঁড়াল।
না, সে ভীত নয়, সে সতর্ক। ব্রাহ্মণপরিবারে জন্ম হলেও পেশায় সে যোদ্ধা, মৃত্যুভয় তার নেই। কিন্তু সেই কাঙ্ক্ষিত মৃত্যু হবে বীরের মতো, যুদ্ধ করতে করতে, শত্রুপক্ষের হাতে। রোগে জরাজীর্ণ হয়ে বা কোনও দুরারোগ্য ব্যাধিতে নয়।
‘নির্ভয়ে জল পান করো। শুনেছি, ব্রীড়াবতী নদীর জল বড় উপকারী। আমরাও এইমাত্র তেষ্টা মেটালাম।’
যুবক চমকে পেছনে তাকাল। এক বয়স্ক ব্রাহ্মণ। তাঁর পরনে গরদের ধুতি। ঊর্ধ্বাঙ্গে পীতবর্ণ উত্তরীয়, তার ওপর জড়ানো নামাবলী। প্রশস্ত কপাল, মস্তক কেশবিহীন। মাথার পেছনে সরু ব্রহ্মকেশ কাঁধ পর্যন্ত নেমেছে।
ব্রাহ্মণের বয়স হলেও চেহারা শক্তপোক্ত, মুখের বলিরেখায় অভিজ্ঞতার ছাপ সুস্পষ্ট। তাঁর এক হাতে পুঁটলি, অন্যহাতে কমণ্ডলু।
তাঁর দুপাশে দণ্ডায়মান আরও দুই বটুক। বয়সে তারা বেশ নবীন, পোশাক একই রকমের। শুধু উত্তরীয়ের রঙ শ্বেতশুভ্র।
যুবক লক্ষ্য করল, দূরে আরও এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে। সে মধ্যবয়স্ক, তার মুখ কৌতুকে ভরা, মস্তকের তৈলাক্ত ইন্দ্রলুপ্তটি রোদে চকচক করছে। মিটিমিটি হেসে তাকিয়ে রয়েছে এদিকে।
যুবক বয়স্ক ব্রাহ্মণকে হাতজোড় করে নমস্কার করল, ‘প্রণাম হই পণ্ডিতমশাই।’
‘জয়তু!’ ব্রাহ্মণ আশীর্বাদের ভঙ্গী করলেন, তারপর বললেন, ‘পোশাক দেখে এই গ্রামে থাক বলে তো মনে হচ্ছে না। কোথা থেকে আসা হচ্ছে?’
যুবক করজোড়েই বলল, ‘আজ্ঞে পণ্ডিতমশাই, আমি আসছি তন্দা থেকে।’
‘তন্দা?’ ব্রাহ্মণ ভ্রূ কুঞ্চিত করে বললেন, ‘মানে যেখানে সুলেমান কররাণী নতুন রাজধানী স্থাপন করেছেন? সে তো অনেক দূর!’
‘আজ্ঞে পণ্ডিতমশাই।’ যুবক বিনম্রভাবে বলল, ‘আমাদের সুলতান গৌড় থেকে তন্দাতেই রাজধানী স্থানান্তর করেছেন বটে। আপনি কি এখানেই থাকেন?’
‘না।’ ব্রাহ্মণ পার্শ্ববর্তী দুই যুবকের দিকে তাকালেন, ‘আমরা তিনজন আসছি উত্তরের বৃন্দাবন থেকে। তুমি যেদিক থেকে আসছ, আমরা যাচ্ছি সেদিকেই। তবে তন্দায় নয়, যাব গৌড়ে। আমার নাম শ্রীনিবাস ভট্টাচার্য। এঁরা দুজন আমার সহকারী, শ্যামানন্দ ও নরোত্তম। আমাদের গরুগুলো বড় ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত। তাই এখানে আমরা বিশ্রাম করছি। লাঠিয়ালরা তাদের ঘাস খাওয়াতে নিয়ে গিয়েছে।’
যুবক ভক্তিভরে প্রণাম করল। তারপর একটু দূরে টাকমাথা ব্যক্তির দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ‘আর উনি? উনিও কি আপনাদের সঙ্গেই আসছেন?’
‘না। ওঁর সঙ্গে একটু আগে পথেই পরিচয় হয়েছে। উনি বিষ্ণুপুরের অধিবাসী, এদিকে এসেছিলেন কোনও কাজে। এখন ফিরছেন।’
বিষ্ণুপুরের অধিবাসী এবার কিছুটা এগিয়ে এল। যুবকের আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করতে করতে বলল, ‘আপনি কি সুলতানের দূত নাকি মশাই?’
‘না তো!’ যুবক সামান্য থেমে বলল, ‘তবে একসময় আমি সুলতানের সেনাদলে ছিলাম।’
‘অ। পেয়াদা!’ ব্যক্তিটি যেন কৌতুক সংবরণ করতে পারল না, চোখে ঝিলিক দিয়ে সুর কেটে বলল,
‘ল্যাকা ল্যাকা পেয়াদা,
দেয় খালি তাগাদা।
আবার আসামী ধরার যম!’
কথাটা বলেই সে একখানা জব্বর রসিকতা করে ফেলেছে এই ভঙ্গি করে আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজের কেশহীন মাথায় হাত বোলাতে লাগল।
‘সুলতানের সেনা ছিলে?’ শ্রীনিবাস পণ্ডিত বিস্মিতভাবে বললেন, ‘তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি হিন্দু। সুলতান তো অনেকদিন হল হিন্দু নিয়োগ বন্ধ করে দিয়েছেন শুনেছিলাম।’
যুবক যুক্তকরে বলল, ‘পণ্ডিত মহাশয় দেখছি সব খবরই রাখেন। হ্যাঁ, সুলতান কট্টর মুসলমান। হাজার হাজার হিন্দু কৃষককে নিষ্কর জমি দান করে তিনি ইসলামে দীক্ষিত করিয়েছেন। অনেক ব্রাহ্মণকেও কলমা পড়িয়ে রাজদরবারে মৌলভী করেছেন তিনি।’
‘হুম। শুনেছি তিনি নিয়ম করেছেন মসজিদের একহাজার গজের মধ্যে কোন হিন্দু মন্দির বা বৌদ্ধ মঠ রাখা চলবে না। কাঁসরঘণ্টা, ঢাকঢোল, খোলকরতাল সব বন্ধ। তুমি কীভাবে সেনাদলে ঢুকেছিলে?’
যুবক বলল, ‘কয়েক বছর হল তাঁর মেজাজ কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে পণ্ডিতমশাই। এক ব্রাহ্মণকন্যা তাঁর হারেমের প্রধান বেগম। বেগম সাহেবার এখনকার নাম জাকিয়া বেগম। তিনিই ধীরে ধীরে সুলতানের ধর্মোন্মাদনা কমাচ্ছেন। এখন সুলতান রাজদরবার, নফরখানা, সেনাদল সবেতেই আবার হিন্দু কর্মচারী নিয়োগ শুরু করছেন।’
স্থানীয় ব্যক্তিটি আবার হেসে গড়িয়ে পড়ে সুর কাটল, ‘কত রঙ্গ দেখালি গুইয়ে, তুলসীতলায় শুয়ে শুয়ে!’
‘আজ্ঞে, আপনি কি কিছু বলছেন আমাকে?’ যুবক এবার আর নিজেকে সংবরণ করতে পারল না, প্রশ্ন করে উঠল। ওই ব্যক্তির থেকে-থেকে সুর কেটে কথা বলাটা তাকে বিরক্ত করছে।
‘ওঁর কথায় কিছু মনে কোরো না।’ শ্রীনিবাস হাসিমুখে বললেন, ‘উনি একটু আগেই আমাদের কাছে নিজের পরিচয় জ্ঞাপন করেছেন। উনি কেশব ছড়াকার। কথায় কথায় ছড়া কাটেন। মল্লরাজ্যেও উনি নাকি এইজন্য বহুল সমাদৃত। সুলতানের ধর্মের পাগলামি কমছে, এ বড় ভালো খবর! যাক সেকথা। মল্লভূমে তোমার আসার কারণ কী?’
যুবক এতক্ষণ নিঃসঙ্কোচে কথা বলে চলছিল, সহসা ব্রাহ্মণের এই প্রশ্নে কেমন গুটিয়ে গেল। অধোবদনে বলল, ‘সেই কারণ কিছুটা ব্যক্তিগত পণ্ডিতমশাই। আসলে আমি রাজধানী বিষ্ণুপুরে যাচ্ছি। মল্লরাজের সঙ্গে সাক্ষাৎ করব। তবে এত অরণ্যসঙ্কুল অঞ্চল, পথের সঠিক দিক নিয়ে বারবার বিব্রত হয়ে পড়ছি।’
শ্রীনিবাস কেশব ছড়াকারের দিকে তাকালেন, ‘আপনি কি পথনির্দেশ দিয়ে ওকে সাহায্য করবেন?’
‘কেন করব না? আমাদের রাজ্যের অতিথি বলে কথা!’ কেশব ছড়াকার কিছুক্ষণ তীক্ষ্ন চোখে তাকিয়ে থাকল, তারপর নদীর দিকে আঙুল নির্দেশ করে বলল, ‘এই যে দেখছ ব্রীড়াবতী নদী, এই নদীর সমান্তরালে পশ্চিম বরাবর সোজা চলে যেতে হবে। প্রথমে পড়বে প্রদ্যুম্নপুর, মল্লভূমের প্রাচীন রাজধানী।’ কথাটা শেষ করে সে মাথা দুলিয়ে ফের ছড়া কাটল,
‘ইতিহাস প্রসিদ্ধ গ্রাম হয় পদুমপুর,
তার পশ্চিমে মল্লরাজ্য। আছে বিষ্ণুপুর।’
শ্রীনিবাসও সম্মতি জানালেন, ‘হ্যাঁ, আমিও প্রদ্যুম্নপুরের নাম আগেই শুনেছি। বিষ্ণুপুরের আগে প্রদ্যুম্নপুরই ছিল নাকি মল্লভূমের রাজধানী। সেখান থেকে পশ্চিমদিক বরাবর গেলে তবে বিষ্ণুপুর। প্রদ্যুম্নপুরটা ঘুরে দেখে যেতে পারো। প্রথম মল্লরাজা আদি রঘুনাথ ওখানেই এই মল্লরাজ্যের রাজধানী স্থাপন করেছিলেন।’
কেশব ছড়াকার বলল, ‘প্রদ্যুম্নপুরে আদি রঘুনাথ রাজার গড় এখনও আছে। কানাইসায়র, কুম্ভস্থল দুর্গও রয়েছে। রাজপরিবারের কিছু বংশধর ওখানে এখনও বাস করেন।’
যুবক মন দিয়ে শুনছিল। কথার মাঝেই বলে বসল, ‘রাজা আদি রঘুনাথ? সে কতদিন আগেকার কথা? একশো বছর?’
কেশব ছড়াকার এবার মুখব্যাদান করে বলল, ‘একশো? হাসালে! প্রায় সাড়ে আটশো বছর আগেকার কথা। আদি রঘুনাথ ছিলেন মল্লভূমের প্রথম রাজা। আর বর্তমান রাজা হলেন ঊনপঞ্চাশতম।’
যুবক এবার সসম্ভ্রমে বলল, ‘এতবছর ধরে একটাই রাজবংশ শাসন করে চলেছে এই রাঢ় দেশ? বড় আশ্চর্যের কথা!’
কেশব ছড়াকার ঝংকার দিয়ে উঠল, ‘তোমার মতো সুলতানের দেশের লোকেদের কাছে বিস্ময়ের ব্যাপার বৈকি! তোমাদের দুদিন অন্তর মনিব পাল্টায়, সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পাল্টায় রাজধানী, রাজকর্মচারী, আমীর-ওমরাহ!’
‘কথাটা আপনি কিছু ভুল বলেননি।’ শ্রীনিবাস পণ্ডিত হাস্যমুখে বললেন, ‘সেই যে বখতিয়ার খিলজি বিনাযুদ্ধে লক্ষ্মণ সেনের গৌড়কে অধিকার করে নিলেন, সেই থেকেই চলছে। তারপর মসনদে এলেন সামসুদ্দিন ইলিয়াস, তিনি রাজধানী নিয়ে গেলেন পাণ্ডুয়ায়। জালালউদ্দিন এসে আবার গৌড়ে ফেরত আনলেন রাজ্য। আর শেষে তোমাদের এই সুলেমান কররাণীর তো হিন্দু স্থাপত্যকীর্তিতে ভরা গৌড় পছন্দই হল না, তিনি রাজধানী বানালেন ছোট্ট হিন্দু গ্রাম তন্দাকে। ভেঙে ফেললেন গ্রামটাকে, পুড়িয়ে দিলেন জনপদ। সেই ধ্বংসস্তূপের ওপর গড়ে উঠল তাঁর মুসলমান রাজধানী তন্দা। কী, তাই তো?’
কেশব ছড়াকার অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গি করে বলল,
‘বাপরে বাপ! সুলতান যা নিষ্ঠুর!
পিঁপড়ের পেট টিপে বের করে গুড়!’
শ্রীনিবাস একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেললেন, ‘এদেশে ওসব কিছু নেই, জানো! এখানে হিন্দু-মুসলমান সবাই মিলেমিশে বাস করে। অপরাধ করলে সবার সাজা সমান। দেউলী গ্রামে আমার পরিচিতজনের মুখে শুনেছি রাজা যেমন পুরোহিতদের নিষ্কর জমি দান করেন, তেমনই সিদ্ধপীর কুরবান বাবাকেও নাকি গভীর শ্রদ্ধা করেন। তাঁকেও গড়ে দিয়েছেন সাধনাগৃহ। এছাড়াও অনেক ফকির রাজার স্নেহধন্য। তাই প্রজাদের অসন্তোষ নেই। তারা রাজাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে। শত্রুপক্ষ এলে সবাই একজোটে ঝাঁপিয়ে পড়ে।’
যুবক মুগ্ধ হয়ে শুনছিল। এই তেজস্বী ব্রাহ্মণের জ্ঞানের পরিধি দেখে সে অভিভূত হয়ে পড়ছিল। সুদূর উত্তরের অধিবাসী হয়ে ইনি বিদেশ বিভূঁইয়ের রাজপাট, রাজ্যনীতি সম্পর্কে এত সংবাদ রাখেন?
নরোত্তম ও শ্যামানন্দের হস্তপ্রক্ষালন শেষ, এবার শ্রীনিবাস পণ্ডিত নিজেও হাত-পা ধুয়ে নিয়ে প্রস্থানে উদ্যত হলেন। বললেন, ‘যাই হোক, তোমার সঙ্গে পরিচয় হয়ে বেশ ভালো লাগল।’ ডানহাত ওপরে তুললেন তিনি, ‘যে উদ্দেশেই যাও, সফল হয়ে এসো, আশীর্বাদ করি। মনে করলে, আজ রাতটা প্রদ্যুম্নপুরে রামনাথ ঘোষালের বাড়ি আশ্রয় নিতে পারো। সেও আমার খুব স্নেহভাজন। আমার নাম কোরো, সে সানন্দে থাকার আয়োজন করবে।’
যুবক কৃতজ্ঞচিত্তে বলল, ‘কী বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ দেব পণ্ডিতমশাই…!’
শ্রীনিবাস হাসলেন, ‘সে প্রয়োজন নেই। আগামীকাল খুব ভোরে প্রদ্যুম্নপুর থেকে রওনা হয়ে যেও। প্রদ্যুম্নপুর থেকে কিছুটা এগিয়ে কদম্বঘাটি পার হলেই বিষ্ণুপুর।’
কেশব ছড়াকার আবার বলে উঠল,
‘গাঁ ঢুকতে মদের ভাটি।
তবে জানবি কদমঘাটি।’
‘আহা, মল্লভূমের মতো ধর্মপ্রাণ রাজ্যের বিবরণ মধুশালা দিয়ে নাই বা দিলেন!’ শ্রীনিবাস যুবকের দিকে তাকালেন, ‘ভালো কথা, তোমার নামটা জানা হল না বাবা!’
যুবক হাসল। ইতিমধ্যে রোদ বেশ তপ্ত হয়ে উঠেছে। গরুদের আহারাদি শেষ, লাঠিয়ালরাও এসে পড়েছে।
বলল, ‘রুদ্রাক্ষ। আমার নাম রুদ্রাক্ষ লাহিড়ী, পণ্ডিতমশাই।’
কেশব ছড়াকার তর্জনি তুলে বলল,
‘টাকা নিবি গুণে,
পথ চলবি চিনে,
থেমে থাকবি তিনে।’
‘তাই হবে ছড়াকার মশাই!’ রুদ্রাক্ষ মৃদু হাসল। তারপর হাঁটতে শুরু করল ব্রীড়াবতী নদীর পাশ দিয়ে।
চঞ্চল বাতাস বয়ে আসছে। এই নদীর ওপর দিয়ে বয়ে চলা বাতাসেই যেটুকু জলকণা ভাসমান। এই পাহাড়, লালমাটির দেশে সাড়ে আটশো বছরের রাজত্বের অলৌকিক কাহিনী তাকে উজ্জীবিত করে তুলছিল।
তাকে অনেক পথ চলতে হবে। তার চক্ষে এখন শুধুই রাঢ়ভূমকে দেখার তীব্র আকর্ষণ!
৪
ষোড়শ শতাব্দীর বঙ্গদেশ। কিছুদিন হল দিল্লির মসনদে বসেছেন মোগল সম্রাট আকবর। কূটনৈতিক তথা বৈবাহিক সন্ধিতে মোগল সাম্রাজ্যের সীমা বাড়িয়েই চলেছেন নিরন্তর।
বাংলা ও বিহার শাসন করছে পাঠানরা। সুলতান পদে রয়েছেন সুলেমান খান কররাণী। সুলেমান কররাণী হিন্দুবিদ্বেষী হলেও নির্বোধ নন। তিনি জানেন, মোগল শক্তিকে অগ্রাহ্য করে তাঁর পক্ষে রাজ্য শাসন করা সম্ভব নয়। তাই তিনি জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে বিবাদে লিপ্ত না হয়ে প্রথমেই মসজিদে জুমার খুতবা পড়ে আকবরকে সর্বোচ্চ শাসক হিসেবে মেনে নিয়েছেন।
এইভাবে শান্তিজ্ঞাপন করে তিনি মোগল সম্রাটকে তুষ্ট রাখলেন বটে, কিন্তু ক্রমাগত প্রতিবেশী দেশ উৎকল, কোচবিহার অধিকার করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকলেন। আর তাঁকে যোগ্য সঙ্গত দিতে থাকলেন তাঁর পুত্র দায়ুদ খাঁ এবং হিন্দুবিদ্বেষী সেনাপতি কালাপাহাড়।
মোগল-পাঠান দ্বৈরথে বাংলা যখন রাজনৈতিক টানাপোড়েনের জটিলতায় পরিপূর্ণ, তখন বাংলার বিভিন্ন স্থানে বেশ কিছু দোর্দণ্ডপ্রতাপ শাসক আত্মপ্রকাশ করলেন।
আকবরের পক্ষে সমগ্র বাংলা অধিকার করা হয়ে উঠল দুঃসাধ্য বিষয়। বাংলার এই কয়েকজন পরাক্রমশালী শাসক হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে নিজেরা একজোট হয়ে মোগল আক্রমণকে একাধিকবার পরাহত করে দিলেন। ইতিহাসে এঁরা বিখ্যাত হয়ে আছেন বারো ভুঁইয়া নামে।
ঊনপঞ্চাশতম মল্লরাজা বীরহাম্বীর ছিলেন বারো ভুঁইয়াদেরই একজন, যিনি একাধিকবার মোগল ও পাঠান আক্রমণ প্রতিহত করেছিলেন। তাঁর মল্লভূম ছিল উত্তরে দামোদর নদ থেকে দক্ষিণে শিলাবতী নদী, পূর্বে মান্দারের প্রান্তভূমি থেকে পশ্চিমে শিখরভূম অর্থাৎ পঞ্চকোট পর্যন্ত বিস্তৃত।
সাড়ে আটশো বছর আগে মল্ল রাজবংশের সূচনা যখন ঘটেছিল, তখন দিল্লিতে শাসন করত হিন্দু রাজবংশ। সেই সময় ভারতের অধিকাংশ অঞ্চলে মুসলমান সম্প্রদায়ের নামই বলতে গেলে অনেকে শোনেনি।
পরবর্তীকালেও বাংলার একাংশের মুসলমান শাসকেরা এই অরণ্যরাজ্য সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না। এই কারণে, শতাব্দীর পর শতাব্দী বিষ্ণুপুরের রাজারা শাসনকাজ চালিয়ে যেতে পেরেছিলেন।
ফিরে যাওয়া যাক ষোড়শ শতকে। ভারতবর্ষের বাদশা আকবর শাসনকার্যের সুবিধার জন্য তাঁর সাম্রাজ্যকে প্রথমে বারোটি সুবাতে বিভক্ত করেন। ইলাহাবাদ, আগ্রা, আওধ, আজমেঢ়, আমেদাবাদ, বিহার, বঙ্গাল, মালব, মুলতান, কাবুল এবং লাহোর। পরে তিনটি সুবা আরও বাড়ে,—বরার, খানদেশ এবং আহমেদনগর।
বাদশাহের প্রতিনিধি হিসেবে একেকটি সুবা শাসন করতেন একেকজন সিপাহশালার। পরবর্তীকালে বাদশা কান্দাহার, কাশ্মীর, থাট্টা এবং উড়িষ্যা জয় করলেও আলাদা সুবা তৈরি করেননি। কান্দাহার আর কাশ্মীরকে কাবুলের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়, থাট্টাকে জোড়া হয় মুলতানের সঙ্গে।
একইভাবে বঙ্গাল আর উৎকল নিয়ে গঠিত হয়েছিল একটি সুবা। সেই সুবা’র সিপাহশালার প্রথম মল্লভূমকে মোঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন এবং রাজস্ব ধার্য করেন বছরে একলক্ষ সাত হাজার তঙ্কা।
তখন মল্লভূমের সিংহাসনে রাজা ধাড়ীমল্ল। মোগল বশ্যতা স্বীকার করে নিলেও তিনি ঠিকমত রাজস্ব দিতেন না। বরং ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বিষ্ণুপুরকে একটি শক্তিশালী দুর্গে পরিণত করেন। প্রভূত অর্থ বরাদ্দ করেন রণসজ্জা ও অস্ত্রনির্মাণ খাতে।
ধাড়ীমল্লের পর বংশের নিয়ম মেনে রাজা হলেন বীরহাম্বীর। এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র তিনিই।
তাঁর প্রকৃত নাম ছিল বীরসিংহ, কিন্তু মোগলদের বিরুদ্ধে তার পরাক্রম ও সংগ্রামের জন্য মেবারের রাণা হাম্বীরের সঙ্গে তাঁর নাম জুড়ে যায়।
দ্বৈরথের কাকতালীয় সাদৃশ্যে কালক্রমে বীরসিংহ হয়ে ওঠেন বীরহাম্বীর।
বাংলায় তখন চলছে উত্তাল সময়। উৎকলের রাজা হরিচন্দন মুকুন্দদেব বাংলার ত্রিবেণী পর্যন্ত জয় করে নিয়েছেন। ওদিকে সুলেমান কররাণীর সেনাপতি কালাপাহাড় রাগে ফুঁসছেন, উৎকল তিনি জয় করেই ছাড়বেন! গুঁড়িয়ে দেবেন জগন্নাথ মন্দির!
এমনই এক প্রেক্ষাপটে অরণ্যরাজ্য মল্লভূমের সিংহাসনে বসেছেন বীরহাম্বীর।
মহারাজ বীরহাম্বীর দীর্ঘকায় এক বলিষ্ঠ পুরুষ। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ শরীরে প্রথমেই চোখ যায় তার অন্তর্ভেদী দৃষ্টির দিকে।
তিনি গৌরবর্ণ নন। নিয়মিত কুস্তির অভ্যাস আর দিনরাত যুদ্ধের প্রস্তুতি পর্যবেক্ষণ করার ফলে তাঁর গাত্রবর্ণ এই মল্লভূমের মাটির মতোই লোহিতাভ। তা নিয়ে অবশ্য তিনি বিন্দুমাত্র ভাবিত নন। নিজের রাজ্য তাঁর নখদর্পণে, প্রজাদের কল্যাণে তিনি উদগ্রীব।
অন্যদিন স্নান সেরে এসে তিনি সময় নিয়ে আহ্নিক করেন, প্রাসাদের মন্দিরে গিয়ে কিছুক্ষণ কূলদেবতা অনন্তদেব বিষ্ণু এবং কুলদেবী মা মৃন্ময়ীকে চোখবুজে স্মরণ করেন। তারপর রাজসভায় গিয়ে শুরু হয় রাজ্যপরিচালনা। কিন্তু আজ মন্দির থেকে ফিরেই রাজা দ্রুত নিজেকে সজ্জিত করায় মন দিলেন।
বহুমূল্য শেরওয়ানী, সোনার কণ্ঠভূষণ পরে ফেললেন তিনি। গুনগুন করে সুরও এসে গেল গলায়। বীরহাম্বীর নিজের রোমশ বুকে হাত বোলাতে লাগলেন।
তাঁর মন আজ প্রসন্ন। আজ যে শুভদিন। গতকাল মধ্যরাতে মহারানী শিরোমণি ফুটফুটে কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়েছেন।
কন্যাসন্তানের জন্ম সেই সমাজে আনন্দ বয়ে আনে না। রাজমাতা স্বর্ণময়ী দেবী তো নতুন অতিথির আগমন সংবাদ শুনে তিনবার শঙ্খধ্বনি ছাড়া আর কোনও রীতি পালন করেননি, এমনকী নিজের মহল ছেড়ে পুত্রের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেও আসেননি।
কিন্তু বীরহাম্বীর নিজে অত্যন্ত খুশি। তাঁর সন্তানের সংখ্যা পাঁচ, কিন্তু প্রতিটিই পুত্রসন্তান। অন্যান্য কুমারদের পত্নীরা কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়েছেন, কিন্তু বীরহাম্বীরের তিন রানীর যে-কোনও একজন অন্তঃসত্ত্বা হয়েছেন মানেই যেন রাজপরিবারে আসতে চলেছে আরও এক রাজকুমার, এমনই অলিখিত নিয়ম হয়ে গিয়েছিল কয়েক বছরে। প্রতিটি পুত্রের জন্মের পরেই সাতদিন ধরে উৎসব চলেছে, গোটা রাজ্যবাসী তাতে অংশগ্রহণ করেছে, রাজকোষ থেকে যথেচ্ছ দান-খয়রাত হয়েছে। সেখানে কন্যাসন্তান জন্মালে এসব যে হবে না তা বোধহয় সবাই আগে থেকেই অনুধাবন করে ফেলেছিল।
মহারাজ নিজের মনে মিটিমিটি হাসছিলেন। এক ব্যতিক্রমী কাণ্ড ঘটিয়েছেন তিনি। মাত্র কয়েকঘণ্টার মধ্যে কন্যা জন্মের পরে এমন উৎসবের আয়োজনে রাজ্যবাসী চমৎকৃত।
মহারাজ আবার দর্পণে নিজেকে দেখতে লাগলেন। আহা! কতদিন ধরে তিনি কন্যাসন্তানের পিতা হওয়ার স্বপ্ন মনে মনে লালন করেছেন। একটি টুকটুকে মেয়ে লালডুরে কাপড় পরে খেলে বেড়াবে গোটা প্রাসাদের এমহল থেকে ওমহলে, রাজকার্য শেষ করে ফিরলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে তাঁর কোলে, এ তাঁর বহুদিনের স্বপ্ন।
গতকাল রাতে ইচ্ছা করেই এই অভীপ্সা তিনি প্রথমে প্রকাশ করেননি। তাঁর দ্বিতীয় পুত্র শীতল মধ্যরাতেই ওই সংবাদ নিয়ে এসেছিল। তিনি তখনো ঘুমোননি, দ্বিতলে বিশাল শয়নকক্ষে পদচারণা করছিলেন। বাতায়ন দিয়ে দূরের অন্তঃকুটির দেখা যাচ্ছিল।
মহারাজার কপালের ভাঁজগুলো তখন প্রশস্ত হচ্ছিল। রানীর প্রসববেদনা উঠেছে প্রায় দুই প্রহর হতে চলল, অথচ এখনও রাজবৈদ্য কৃষ্ণবল্লভকে অন্তঃকুটির থেকে বাইরে বেরোতে দেখা যায়নি। রাজবৈদ্য অবশ্য পুরুষ বলে প্রসবগৃহে প্রবেশাধিকার পান না, তিনি তাঁর সহকারীদের নিয়ে উপস্থিত থাকেন প্রসবগৃহের বহির্কক্ষে। একজন দক্ষ দাইয়ের নেতৃত্বে প্রসবকার্য সম্পন্ন হয়।
দ্বিতলের ওই বাতায়ন থেকে মহারাজ কাউকেই দেখতে পাচ্ছিলেন না। দুশ্চিন্তা যখন তাঁকে ছেয়ে ফেলেছে সেইসময়েই শীতল এল। সঙ্গে মহারাজার খাস ভৃত্য শ্রীধর।
শ্রীধরের মুখ গম্ভীর।
উদ্বিগ্নভাবে মহারাজ জিজ্ঞাসা করে, ‘কী সংবাদ, শীতল? সব কুশল তো?’
শীতল মেজরানী সুলক্ষণার পুত্র। তার বয়স আঠেরো, কিন্তু এর মধ্যেই সে রাজ্যের একজন উপসেনাপতি। সামরিক দিকে তার প্রবল আগ্রহ। মহাসেনাপতি কুম্ভ শীতলের মতামতকে গুরুত্ব দেন।
বীরহাম্বীরের জ্যেষ্ঠপুত্র এখন তুঙ্গভূম অঞ্চলের শাসনকর্তা। যুবতী স্ত্রীকে নিয়ে সে সেখানেই থাকে। পরবর্তী মল্লরাজরূপে নিজেকে প্রস্তুত করছে। পিতামহের অনুসরণে তারও নাম ধাড়ীমল্ল।
শীতল একটু ইতস্তত করে বলল, ‘বড়মা ভালো আছেন। রাজবৈদ্যমশাই আপনাকে জানাতে বললেন, তাঁর কন্যাসন্তান হয়েছে।’
মহারাজ অল্পক্ষণ ভ্রূ কুঞ্চিত করে তাকিয়েছিলেন, তারপর বলেন, ‘বেশ। বৈদ্যমশাইকে বোলো, রানী ও সন্তানের যত্নের যেন ত্রুটি না হয়।’
শীতল বেরিয়ে যাচ্ছিল। সঙ্গে শ্রীধরও।
মহারাজ শ্রীধরকে ডাকলেন, ‘শ্রীধর, দুর্গাপ্রসাদকে সত্বর খবর দাও।’
মহারাজার একান্ত সচিব দুর্গাপ্রসাদ ঘোষ। ব্যস্তসমস্ত হয়ে ছুটে এসেছিলেন রাজপ্রাসাদে।
বীরহাম্বীর বলেছিলেন, ‘ঘোষমশাই, রানী শিরোমণি কন্যার জন্ম দিয়েছেন। শুনেছেন তো?’
দুর্গাপ্রসাদ অভিজ্ঞ মানুষ। জানেন রাজাদের মন বুঝে কীভাবে প্রতিক্রিয়া দিতে হয়। বিমর্ষমুখে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ মহারাজ। একটু আগেই সংবাদ পেয়েছি।’
বীরহাম্বীর মুখে চওড়া হাসি নিয়ে বলেছিলেন, ‘এই আনন্দ উদযাপন করতে কাল আমি রাজ্যে মহা-উৎসবের সূচনা করতে চাই। আপনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে নিন।’
দুর্গাপ্রসাদ বললেন, ‘আজ্ঞে?’
‘হ্যাঁ। এই সুসংবাদ উপলক্ষ্যে কাল আমি মল্লেশ্বর শিব মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করব।’
দুর্গাপ্রসাদ হতভম্ব।
রাজ্যের দিকে দিকে শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা মল্ল রাজবংশে বিষয় নয়, প্রত্যেক রাজাই এই কাজ করে থাকেন। শিবরাত্রি, বাৎসরিক রাজ্যাভিষেকের মতো কোনও উৎসবের সময়ে হয়। কিন্তু কন্যা জন্মগ্রহণের জন্য মন্দির স্থাপন? তাও আবার বাবা মল্লেশ্বরের?
দুর্গাপ্রসাদের মনে পড়ে গেল, বছরখানেক ধরেই বীরহাম্বীর রাজ্যের মন্ত্রী-অমাত্যবর্গের কাছে মা মৃন্ময়ীর মতো মল্লেশ্বর বাবা শিবকেও রাজ্যে প্রতিষ্ঠা করার জন্য বাসনা প্রকাশ করছিলেন। স্থানও নির্দিষ্ট, ভট্টাচার্য পল্লীতে।
‘কী হল ঘোষমশাই? কী ভাবছেন?’
দুর্গাপ্রসাদ সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় নেড়েছিলেন, ‘আজ্ঞে না রাজামশাই। অতি উত্তম প্রস্তাব। কিন্তু এক রাত্রির মধ্যে মন্দির স্থাপন করা কি সম্ভব?’
‘আপনি বুঝতে ভুল করছেন।’ বীরহাম্বীর বলেছিলেন, ‘আমি এক রাতের মধ্যে মন্দির নির্মাণ করে ফেলতে বলিনি। বলেছি, ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে। এক প্রহর হল অক্ষয় তৃতীয়া শুরু হয়ে গেছে। এই পুণ্য তিথি থাকতে থাকতেই মন্দিরের কাজ শুরু হোক।’
দুর্গাপ্রসাদ কথোপকথন আর দীর্ঘায়িত করেননি। বলেছিলেন, ‘যথা আজ্ঞা মহারাজ।’
‘আর হ্যাঁ। মন্দিরের কাজ যেন একবছরের মধ্যেই সম্পূর্ণ হয়, সেটাও বলে দেবেন প্রধানমন্ত্রীকে। আগামী অক্ষয় তৃতীয়ায় রাজকন্যার প্রথম জন্মতিথিতে মন্দির জনগণের জন্য খুলে দেওয়া হবে। ওইদিনেই মন্দিরে গাজন উৎসব শুরু করব আমি।’
‘মহারাজ, গাজন তো চৈত্রসংক্রান্তিতে…?’
‘জানি। কিন্তু আমার মল্লেশ্বর শিবের গাজন প্রতিবছর অক্ষয় তৃতীয়াতেই হবে।’
রাত্রের কথা ভাবতে ভাবতে বড় আনমনা হয়ে পড়েছিলেন রাজা বীরহাম্বীর, সম্বিৎ ফিরল ভৃত্যের ডাকে। বলল, ‘প্রভু, রাজমাতা আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসছেন।’
বীরহাম্বীর সচকিত হলেন। রাজমাতা যে আসবেন, তা প্রত্যাশিত।
রাজমাতা স্বর্ণময়ী দেবী অত্যন্ত ব্যক্তিত্বময়ী নারী। সম্পর্কে বীরহাম্বীরের বিমাতা। তিনি ছিলেন পিতা ধাড়ীমল্লের প্রধান মহিষী। তাঁর নিজেরও এক পুত্র রয়েছে, জগত কুমার। জ্যেষ্ঠ পুত্রই রাজা হবেন, এই নিয়মে বীরহাম্বীর রাজা হয়েছেন, আর জগত হয়েছেন হিকিম। দ্বিতীয়পুত্রকে এদেশে বলা হয় হিকিম এবং তৃতীয় ও পরবর্তীদের কুমার। জগত ছাড়াও রসিক, যাদু, বাহাদুর এমন আরও কয়েকজন কুমার আছেন।
নিজের পুত্র রাজা না হতে পারায় স্বর্ণময়ী দেবীর মধ্যে বিন্দুমাত্র দুঃখ দেখা যায়নি। মাতৃহীন রাজাকে স্বর্ণময়ী পুত্রসম ভালোবাসেন।
স্বর্ণময়ী এলেন প্রায় একদণ্ডকাল পর, সঙ্গে অন্নদা।
অন্নদা এক মধ্যযৌবনা পরিচারিকা। সে স্বামী-পরিত্যক্তা। বেশ কয়েকবছর আগে দূরের কোনও দেশ থেকে তার শিশুকন্যা মেনকাকে নিয়ে সে এই মল্লভূমে চলে এসেছিল। তখন সে তরুণী। অন্নদার মধ্যে এমন এক আভিজাত্য ছিল যে অচিরেই সে এক রাজকর্মচারীর চোখে পড়ে যায়। সকন্যা তার স্থান হয় রাজবাড়ির দাসীমহলে। নিজের রূপ, সপ্রতিভতা, বুদ্ধি, কাজের কুশলতার জন্য এখন সে রাজমাতার প্রিয়তম পরিচারিকা।
তারপর থেকে স্বর্ণময়ীর প্রধান পরিচারিকা হিসেবেই অন্নদা অন্তঃপুরে নিজের প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করেছে। তার ঘন কালো কেশরাশিতে এখন দু-একটি রুপলি রেখা।
মেয়ে মেনকাও বড় যুবতী, সে নিযুক্ত মহারানীর মহলে। অন্নদা নিজে এখনও স্বর্ণময়ীর অন্ধের যষ্টিস্বরূপ।
স্বর্ণময়ী কিছুক্ষণ বীরহাম্বীরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বলে উঠলেন, ‘বীর! এসব কী শুরু করেছ তুমি?’
বীরহাম্বীরের পরিধান প্রায় শেষ, তিনি দরবারে যাবেন। সেখান থেকে চলে যাবেন ভট্টাচার্যপল্লীতে। হীরকশোভিত মুকুট মাথায় পরে তিনি বললেন, ‘প্রণাম, মাতা! কীসের কথা বলছেন আপনি?’
অন্নদা দরজার মুখে বুক অবধি ঘোমটা টেনে দাঁড়িয়ে রইল। স্বর্ণময়ী দেবী এগিয়ে এলেন পালঙ্কের কাছে। তিনি পরে আছেন শ্বেতবর্ণ শাড়ির ওপরে একটি পাটের পাছড়া, সঙ্গে সূক্ষ্ম দোলাই।
স্বর্ণময়ীর পিতা গোবিন্দ সিংহ ছিলেন মল্লরাজের অধীন সামন্তরাজা। স্বর্ণময়ীর শ্বশুরমশাই যখন তাঁকে পছন্দ করে এনেছিলেন, তখন তাঁর বয়স মাত্র বারো বছর। সেই সদ্যকৈশোর থেকে তিনি খেলে বেড়িয়েছেন রাজপ্রাসাদের নানা মহলে।
তাঁর স্বামীও তাঁকে চোখে হারাতেন। তা শুধু রূপের জন্যই নয়, তাঁর বুদ্ধিবিবেচনার জন্যও। রাজপরিবারের নিয়ম মেনে তাঁর স্বামীকে আরও তিনটে বিবাহ করতে হয়েছিল, কিন্তু পাটরানীর আসন থেকে তিনি কোনওদিন সরে যাননি। যখনই সমস্যা পুঞ্জীভূত হতো, তাঁর স্বামী ছুটে আসতেন তাঁর মহলে।
স্বর্ণময়ী বিক্ষুব্ধস্বরে বললেন, ‘বলা নেই কওয়া নেই, ভট্টঠাকুরের একটা মতামত নেওয়া নেই, তুমি আজ হঠাৎ করে মল্লেশ্বর মন্দিরের কাজ শুরু করতে বললে কেন?’
বীরহাম্বীর শান্তভাবে বললেন, ‘মন্দিরের কাজ তো এই বংশের সবাই হঠাৎ করেই শুরু করেন মাতা। পিতা নিজেও গণ্ডাখানেকের ওপর মন্দির স্থাপন করেছিলেন।’
স্বর্ণময়ী আরও অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন, ‘তুমি একশোটা মন্দির স্থাপন করো। কেউ বারণ করেনি, বীর। তাতে শুধু রাজ্যের প্রজাদের নৈতিক উন্নতিই যে হয় তা নয়, যে-কোনও আপৎকালে এই মন্দিরগুলোতেই প্রজাদের খাদ্য এবং আশ্রয় দেওয়া হয়। কিন্তু সবকিছুর একটা শুভতিথি আছে। মল্লেশ্বর মন্দির স্থাপন করতে চলেছ, তোমার রাজজ্যোতিষী এবং ভট্টঠাকুরের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত ছিল। তাছাড়া…’
বীরহাম্বীর তর্ক না করে বললেন, ‘তাছাড়া?’
স্বর্ণময়ী একটু ইতস্তত করলেন, তারপর অন্নদার দিকে একঝলক তাকিয়ে অনুচ্চ স্বরে বললেন, ‘শিরোমণির কন্যাসন্তান হয়েছে, ঠিক আ-ছে-এ, কিন্তু এত সমারোহ, মন্দির প্রতিষ্ঠা, এটা কি একটু দৃষ্টিকটু নয়?’
বীরহাম্বীর মনে মনে হাসলেন। রাজমাতা অবশেষে মূল বক্তব্যে এসে পৌঁছেছেন। এটাই তাঁর ক্রোধের প্রকৃত কারণ। তিনি বললেন, ‘দৃষ্টিকটুর তো কিছু নেই, মাতা। আমার পাঁচটি পুত্র রয়েছে। অনেকদিন পর কন্যা জন্মেছে রাজবংশে। এ তো মা মৃন্ময়ীর আশীর্বাদ! তাতে আনন্দ করব না তো কি শোকপালন করব?’
স্বর্ণময়ী চুপ করে গেলেন। কয়েকমুহূর্ত পরে বললেন, ‘আনন্দের আতিশয্যে আঙুলে অঙ্গুরীয় পরতে তুমি ভুলে গিয়েছ, বীর!’
বীরহাম্বীর সচকিত হয়ে উঠলেন। তাই তো! তাঁর দক্ষিণ হস্তের মধ্যমা শূন্য। অথচ সেখানে দিবারাত্র জ্বলজ্বল করে নীলকান্তমণির স্বর্ণঅঙ্গুরীয়। মোগলদের বিরুদ্ধে পুত্রের বীরত্বে পিতা ধাড়ীমল্ল এই অঙ্গুরীয় উপহার দিয়েছিলেন তাঁকে।
বীরহাম্বীর পিতার আশীর্বাদ মনে করেন এই আংটিকে। শয়নকাল ছাড়া কখনও খোলেন না। গতরাতের ঘটনাবাহুল্যে আজ বিস্মৃত হয়ে ছিলেন। আংটিটা আঙুলে পরতে পরতে হাসলেন, ‘ভাগ্যিস বললেন মাতা! সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছিলাম!’
৫
মৃন্ময়ী মাতার মন্দিরের পশ্চিমে রয়েছে একটি পুষ্করিণী। রাজপরিবারের অন্তঃপুরচারিণীদের জন্যেই তা ব্যবহার করা হয়। পুকুরের চারপাশ সুউচ্চ প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। মূল প্রাসাদ থেকে পিছনে দরজা দিয়ে সরাসরি আসা যায় এই পুষ্করিণীতে।
পুষ্করিণীর সিঁড়িপথের দুপাশের দুই বেদীতে শোভা পাচ্ছে নয়নাভিরাম দুটি হস্তী মূর্তি। তাদের পাশ দিয়ে পশ্চিম দিকে কিছুটা এগোলেই মূল অট্টালিকার খিড়কির দরজা। তাঁর একপাশে রাজপরিবারের প্রসবা মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট অন্তঃকুটি। শুধু রাজা বীরহাম্বীরের তিন রানীই নয়, কুমারদের স্ত্রীরাও এই আতুড়ঘর ব্যবহার করেন।
শিরোমণির খাস দাসী মেনকা বিরক্তমুখে একটি হস্তীমূর্তির পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। মহারানীর ঘনিষ্ঠতম দাসী হওয়ায় মেনকা নিজেকে ভৃত্যমহলের রানীই মনে করে। এমনকী তার নিজস্ব চাকরানীও রয়েছে। মেনকার ব্যবহারে বিরক্ত হলেও স্বয়ং মহারানী তার ওপর অসম্ভব নির্ভর করেন, তাই কেউ তাকে কিছু বলতে সাহস পায় না।
অবশ্য আরও একটা কারণ আছে। মেনকার ব্যবহার যেমনই হোক, তার গড়নটি যে অপূর্ব সুন্দর তা সকলেই একবাক্যে স্বীকার করে। তার স্ফীত নিতম্ব, পীনোন্নত স্তন, ক্ষীণ কটি যে-কোনও পুরুষকে কামজর্জর করতে বাধ্য। পিঠে একরাশ কালো চুল বিছিয়ে সে যখন চলে, তখন তাকে দেখে মনে পড়ে যায় কালিদাসের মেঘদূতম কাব্যের কথা। কিন্তু মেনকার সিংহীর মতো মেজাজের জন্য কেউ তার সঙ্গে ঠাট্টা ইয়ার্কি করতে ভরসা পায় না। শুধু দূর থেকে দেখেই আশ মেটায়।
কোনও অজ্ঞাত কারণে মেনকা এখনও অবিবাহিতা। তার মা অন্নদা দাসীও এই বিষয়ে নীরব ও নির্বিকার। অনেক দাসীই অন্নদাকে বলেছে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার কথা, কিন্তু অন্নদা উৎসাহ দেখায়নি।
এইসময় অন্তঃকুটি থেকে বেরিয়ে এল কিশোরী মনোহরা। সে প্রধানমন্ত্রী জীমূতবাহনের জ্যেষ্ঠা কন্যা। সে ভারি সুন্দরী—উজ্জ্বল গাত্রবর্ণ, দীর্ঘ কেশদাম আর আয়ত নয়ন। শিরোমণির সে বিশেষ স্নেহপাত্রী। তার নিজের মা অর্থাৎ মন্ত্রীজায়া প্রতিবছর সন্তান উৎপাদনে বড়ই ব্যস্ত থাকেন। তাই এতদিন নিঃসন্তান শিরোমণির আদরেই বেড়ে উঠেছে মনোহরা।
রাজ অন্তঃপুরে পালিত হওয়া সত্ত্বেও তার মধ্যে আত্মম্ভরিতা একটুও নেই। ভৃত্য থেকে অমাত্য, সকলের সঙ্গে সহজ ও সাবলীলভাবে মেশার জন্য মনোহরা সর্বজনপ্রিয়।
মহারানীকে সে ‘মা’ বলে সম্বোধন করে এবং নিজের সদ্য ভগ্নীটিকে নিয়ে সে রীতিমতো উত্তেজিত।
মেনকার কাছে এসে মনোহরা বলল, ‘রাজামশাই কখন আসবেন? মায়ের বিশ্রামের প্রয়োজন।’
মেনকা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ‘কী জানি! আজ আবার শুনচি মল্লেশ্বর মন্দিরের উদ্বোধন হবে। রাজামশাই কি উদ্বোধন করে অন্দরমহলে আসবেন?’
‘মনে হয় না,’ মনোহরা বলল, ‘শুনলাম তার এখনও বিলম্ব আছে। তবে আমি তো যেতে পারব না।’
‘কেন? যাবে না কেন?’
‘কী করব? হঠাৎ করে ঠিক হল যে। আমাকে আজ মামাবাড়িতে যেতে হবে। আমারও তো একটা ভাই হয়েছে, আজ একুশ দিনের পুজো।’
‘সঙ্গে কে যাবেন? তোমার বাবা?’
‘না। বাবামশাই অত ব্যস্ত, কী করে যাবেন? দাদা যাবেন। মল্লেশ্বর শিব মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন দেখা আমার ভাগ্যে নেই।’
‘অ।’ মেনকা বিরক্ত কণ্ঠে বলল, ‘এদিকে আমার রাজ্যের কাজ, যেতেও পারচি না। সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে রয়েচি মহারাজ আসবেন বলে!’
মনোহরা হাসল। একটি হস্তীমূর্তির গায়ে হাত রেখে বলল, ‘তোমার সবসময় এত তাড়া কেন গো মেনকামাসি?’
মেনকা যেন প্রস্তুত হয়েই ছিল, সঙ্গে সঙ্গে ঝঙ্কার দিয়ে বলে উঠল, ‘কী করব বলো, তোমার মতো কপাল করে তো আসিনি পিতিবিতে! প্রধানমন্ত্রীর ঘরে জন্মে, তারপর খোদ রানীমার কোলে গিয়ে শুয়ে থাকলে তাড়াহুড়ো করতুম না। তখন বসে বসে দশাবতার খেলতুম আর অমন মিষ্টি করেই হাসতুম!’
মনোরমা এবার আরও জোরে হেসে ওঠে। সে দশাবতার খেলতে বড় ভালোবাসে। রানীমার অন্দরমহলে তাদের অবসর কাটে দশাবতার খেলে।
সে বলল, ‘রাগলে তোমায় আরও সুন্দরী দেখায় মেনকামাসি!’
মেনকা কপট রাগ দেখিয়ে আর কি বলতে যাচ্ছিল, মনোহরা বলে উঠল, ‘ওই তো! শ্রীধর খুড়ো এসে গেছে।’
পিছুদুয়ার দিয়ে মহারাজের খাস ভৃত্য শ্রীধর স্বভাবসুলভ কেজো ভঙ্গীতে এগিয়ে আসছে। তার পাশে পাশে হেঁটে আসছে কেশব ছড়াকার।
কেশবকে দেখামাত্র মেনকার মুখের ভাব পালটে গেল। এই কেশব থাকলে মেনকা কিছুটা প্রগলভ হয়ে পড়ে। কেন, জানা যায় না। অথচ কেশব ছড়াকার সুযোগ পেলেই তাকে অকথা কুকথা বলতে ছাড়ে না।
মেনকা প্রায় দৌড়ে গেল শ্রীধর ও কেশবের দিকে। বলল, ‘রানীমাকে প্রস্তুত করেই রেখেচি। মল্লিকা শুধু ঘরে একটু সুগন্ধী ছড়াচ্চে।’
শ্রীধর ভ্রূ কুঁচকে বলল, ‘কী অবস্থা! তোমাদের এখনও হল না? রাজামশাই কিন্তু বেশিক্ষণ থাকতে পারবেন না। ভটচাযপল্লীতে সবাই পৌঁছে গিয়েছে। রাজামশাই গেলেই মন্দিরের ভিত গড়ার কাজ শুরু হবে।’
মেনকা বেণী দোলাল, ‘জানি গো, জানি। আমিও ভাবচি একটু ঘুরে আসব। পালকি বলে রেখেচি।’
কেশব ছড়াকার অমনি ব্যঙ্গের সুরে বলল, ‘শ্রীধর! তোদের রাজবাড়ির ঢেমনি দাসীগুলো দেখি পালকি ছাড়া এক পা হাঁটতে পারে না, এদিকে রাজপুত্তুররা হেঁটে হেঁটে রাজ্য ঘোরে। এ যে দেখি পচা আদার ঝাল বেশি, আর ফোঁপরা ঢেঁকির শব্দ বেশি! ভালো ভালো! এইজন্যই কই, বিষ্ণুপুরী মধুপুরী, ঢুকলে বেরোতে লারি।’
মেনকা তীব্র চক্ষে তাকাল কেশবের দিকে, কিছু বলল না।
শ্রীধর অবশ্য এত কিছু কথা শুনতেই পেল না, তার ধ্যানজ্ঞান সবসময় রাজার প্রতি। আর তার আছে কিছু পোষা পাখি।
‘মনোহরা মা, রানীমা এখন জেগে আচেন তো?’
‘হ্যাঁ গো খুড়ো। মা একটু আগেই ঘুম থেকে উঠেছেন।’ মনোহরা বলল।
‘বেশ বেশ।’ দরজার কাছে ঈষৎ কোলাহল শুনে শ্রীধর চলে গেল সেদিকে। রাজা সদ্যোজাত শিশুকন্যার মুখ দেখতে আসছেন।
মহারাজা যখন দুয়ার পেরিয়ে অন্তঃকুটির সম্মুখে এলেন, ততক্ষণে মনোহরা বিদায় নিয়েছে। পাঁচজন দাসী পুষ্পপাত্র, চন্দনপাত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বাইরের পথে।
মহারাজ এগিয়ে আসতেই মেনকা শঙ্খে ফুঁ দিল।
প্রধান মহিষী শিরোমণি উদাসচিত্তে জানলার পাশে শুয়েছিলেন। তাঁর চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ। অনতিদূরে একটি ছোট করণ্ডক, তার ওপরে শোয়ানো রয়েছে একদিনের শিশুটিকে। প্রতিটি শিশুকেই জন্মের পরে কেমন ভঙ্গুর দেখতে লাগে।
শিরোমণি বাতায়ন দিয়ে দূরের পুষ্করিণীর দিকে তাকিয়েছিলেন। গতরাতে প্রসবকালে তাঁর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ শুরু হওয়ায় স্বয়ং রাজবৈদ্যও আশঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর ওষুধে অবশ্য রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়েছিল। এখন সেই অসহ্য বেদনা অনেকটাই কমেছে।
কিন্তু তাঁর মন ভালো নেই। তিনি ভাবছেন, এবারেও তিনি মেজোরানী সুলক্ষণা ও ছোটরানী কাঞ্চনমণির কাছে হেরে গেলেন।
এতদিন রাজ্যের মানুষ ভাবতে শুরু করেছিল রানী শিরোমণি বুঝি বন্ধ্যা। তাঁর সঙ্গে রাজার বিয়ে হয়েছে প্রায় বাল্যবয়সে। দুজনে একসঙ্গেই কৈশোর পেরিয়ে উপনীত হয়েছেন যৌবনে। পরে রাজা আরও দুটি বিবাহ করলে সুলক্ষণা ও কাঞ্চনমণি একের পর এক পুত্রের জন্ম দিতে শুরু করেছিলেন, কিন্তু শিরোমণি অন্তঃস্বত্তা হতে পারেননি। সে নিয়ে রাজামশাই অবশ্য তাঁকে কিছু বলেননি, পাটরানীকে তিনি অত্যন্ত ভালোবাসেন। কিন্তু শিরোমণি নিজেই সবসময় সংকুচিত থাকতেন।
এতদিন পর যখন মা মৃন্ময়ী কৃপা করলেন, কেন তিনি অন্যদের সমকক্ষ হলেন না? নিজের অজান্তেই শিরোমণির গলায় দলা পাকিয়ে উঠল এক অব্যক্ত ব্যথা। পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা, যে স্ত্রী-পুত্রসন্তানের জন্ম দিতে পারেন না তার কি সমাজে কোনও সম্মান আছে? মল্লরাজারা চরিত্রবান, তাঁরা বিবাহিতা স্ত্রী ছাড়া কোনও উপপত্নী রাখেন না।
আসলে মল্লরাজাদের রাজ্যশাসনের আদর্শই হল ঈশ্বর উপাসনার মাধ্যমে প্রজাদের ঈশ্বরমুখী করে তোলা। এঁরা মনে করেন ধর্মীয় অনুশাসনকে প্রাধান্য দিলে নাগরিকদের সৎ, মহৎ ও উদার করে তোলা যায়। চৌর্যবৃত্তি, লুণ্ঠন, নারীর শ্লীলতাহানি বলতে গেলে এদেশে অকল্পনীয় ।
রাজা বীরহাম্বীর নিজেও সংযমী ইন্দ্রিয়ের পুরুষ। শিরোমণি সন্তান জন্ম দিতে না পারলেও তিনি কখনও মুখ ফুটে কিছু বলেননি। অন্য কোনও দেশ হলে হয়তো এতদিনে শিরোমণির স্থান হতো পিত্রালয়ে।
দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে শিরোমণি ভাবলেন, তবু তিনি রাজামশাইয়ের কোনও মান রাখতে পারলেন না!
সহসা শিশুকন্যাটি অল্পক্ষণের ঘুম ভেঙে কেঁদে উঠল। সদ্যোজাত সব প্রাণীর ক্রন্দনই বোধহয় একইরকম। শিরোমণি উঠলেন না, নিথর হয়ে শুয়ে রইলেন বাতায়নধারে। তিনি কিছু করতেও পারবেন না! তিনি ব্যর্থ, তাঁর স্তনে দুধ নেই। মা মৃন্ময়ী এইভাবে তাঁর সীমাবদ্ধতা চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিতে চান।
শিশুটির জন্য নিয়োজিত দুগ্ধ-মাতা পাশের ঘরেই অপেক্ষা করছিল। হন্তদন্ত হয়ে চলে এল। এসে শিশুটিকে কোলে তুলে নিল, বিজাতীয় আদরের শব্দ করতে করতে কাপড়ের আবরণ সরিয়ে তার মুখখানা ঠেসে ধরল নিজের বক্ষে। মুহূর্তে শিশুটির কান্না থেমে গেল।
শিরোমণির চক্ষু জ্বালা করে উঠল, তিনি আবার মুখ ঘুরিয়ে নিলেন বাইরের দিকে!
কিছুক্ষণের মধ্যে মেনকা প্রবেশ করল ঘরে, ‘রানীমা, রাজামশাই আসছেন রাজকুমারীকে দেখতে।’ তারপরই তার চোখ পড়ল স্তন্যদানকারী দাসীটির দিকে। স্বভাবজাত ঔদ্ধত্যে সে ধমকে উঠল, ‘কীরে? তুই যে এসে থেবড়ে বসে গেলি বড়? শাঁখের আওয়াজ শুনিসনি? যা এখান থেকে! রাজামশাই আসচেন।’
দুধ-মা শশব্যস্ত হয়ে উঠে রানী শিরোমণিকে প্রণাম করেই পেছন দিকের দরজা দিয়ে প্রায় ছুটে বেরোল।
ঘরের চৌকাঠে অন্য এক দাসীর গলা শোনা গেল, ‘রাজামশাই এসে পড়েছেন।’
মেনকা বিদ্যুৎগতিতে ঘরের অবস্থা একবার জরিপ করে নিয়ে নিষ্ক্রান্ত হল।
বীরহাম্বীর ধীরেসুস্থে কক্ষে প্রবেশ করলেন, কুলুঙ্গির ওপরে নিজের শিরোভূষণ কিরীটটি খুলে রাখলেন। তারপর হাসিমুখে দুই হাত প্রসারিত করে এগিয়ে এলেন আত্মজার দিকে।
তিনি লক্ষ্য করলেন, শিশুটির চক্ষু বন্ধ থাকলেও মুখটা যেন তাঁকে দেখেই কেমন হাসি হাসি হয়ে গেল, ঠোঁটদুটি ঈষৎ কেঁপে উঠল। কচি কচি হাত-পা নড়ে উঠল।
বীরহাম্বীরের মন তৃপ্তিতে ভরে উঠল। বস্ত্রের জেব থেকে তিনি একে একে বের করে আনলেন রাজস্বর্ণকারের দিয়ে যাওয়া অলঙ্কারগুলি। সবক’টি গহনা শিশুটির পায়ের কাছে মখমলের ওপর একে একে বিছিয়ে দিলেন।
শিশুটির নরম মাথার তালুতে হাত রেখে কিছুক্ষণ বিড়বিড় করলেন। তারপর মহারানীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি জানতাম, শিরোমণি। আমি জানতাম, অন্য কেউ না পারলেও তুমি ঠিক পারবে।’
শিরোমণি বিস্মিত হয়ে স্বামীর দিকে চেয়ে রইলেন।
মহারাজ আবার বললেন, ‘আমার কতদিনের স্বপ্ন ছিল কন্যার পিতা হওয়ার। আমি জানতাম, আমার সবচেয়ে কাছের জন ঠিক পারবে।’ বলতে বলতে তিনি এগিয়ে এলেন শিরোমণির কাছে।
অন্তঃকুটিতে অবস্থানকালে প্রসূতিকে স্পর্শ করার নিয়ম নেই, তবু তিনি আলতো ভাবে হাত রাখলেন শিরোমণির হাতে। তারপর কম্পিত গলায় বললেন, ‘আজ এই খুশিতে মল্লেশ্বর মন্দিরের কাজ শুরু করে দিচ্ছি। একমাস ধরে উৎসবও চলবে রাজ্যে। তোমার কী চাই বলো।’
শিরোমণি স্থবির! মহারাজ সত্যিই আবেগে কাঁপছেন। রানী অস্ফুটে বললেন, ‘মহারাজ, আমি ভেবেছিলাম আপনাকে রাজকুমার উপহার দিতে পারব…’
মহারাজার কানে যেন প্রবেশই করল না কথাটা। তিনি পিছন ফিরে আরও একবার দেখলেন তাঁর আত্মজাকে। শিশুটি বাপের মতো রঙ পেয়েছে! মুহূর্তে তাঁর মনে হল ওইটুকু কন্যাটি যেন মা মৃন্ময়ীরই জাগতিক রূপ, দুহিতার ছদ্মবেশে তাঁর কাছে থাকতে এসেছেন।
তিনি স্বগতস্বরে বললেন, ‘আহা, মল্লভূমের রাজকন্যা! দেখো শিরোমণি, আমি ওকে উজবেকী মেয়েদের মতো করে গড়ে তুলব!’
এসব কী বলছেন মহারাজ! ‘উজবেকী মেয়ে? তারা আবার কারা, মহারাজ?’
বীরহাম্বীর আলোকিত মুখে বললেন, ‘সেই যে সেবার দিল্লি গিয়েছিলাম, একজন ওমরাহের মুখে শুনেছিলাম। পশ্চিমে এক দেশ আছে, সেখানে উজবেকরা থাকে। তাদের মতো বীর জাতি বিশ্বে নেই। মোগল বাদশাহ একবার সেই দেশ জয় করতে গিয়েছিলেন। তাঁর পঁচিশ-ত্রিশ জনের একটি অশ্বারোহী সৈন্যের দল উজবেকদের একটি গ্রামে হানা দিয়ে লুঠতরাজ করছিল। সেইসময় এক উজবেক বৃদ্ধা সৈন্যদের বললেন, বাছারা, তোমরা কিন্তু এইভাবে লুঠতরাজ করো না। আমার মেয়ে এখন বাড়ি নেই, কোথায় যেন বেরিয়েছে। নইলে তোমরা টের পেতে। শোন, আমার মেয়ের ঘরে ফেরার সময় হয়ে গেছে, সময় থাকতে তোমরা সরে পড়ো।’
‘ওমা! মেয়েমানুষ একা একা বেরিয়েছে?’ শিরোমণি বিস্মিত।
‘আরে শোনোই না! বৃদ্ধার কথায় সৈন্যরা কর্ণপাত করল না। তারা গোটা গ্রাম লুঠ করে ঘোড়ার পিঠে সব বোঝাই করে নিয়ে চলতে লাগল। সঙ্গে গ্রামেরও কিছু লোককে বন্দি করে নিল। তাদের মধ্যে সেই বৃদ্ধাও একজন। কিছুদূর যেতেই এক অস্পষ্ট ধাবমান মূর্তির দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধা হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল, ওই যে! ওই তো আমার মেয়ে আসছে!’
‘তারপর মহারাজ?’
‘তারপর দুরন্ত বেগে ধাবমান ঘোড়ার খুরে খুরে ওঠা ধুলোর জাল ভেদ করে ধনুর্বাণধারী উজবেক কন্যার মূর্তি ক্রমেই স্পষ্টতর হতে থাকল। সে চিৎকার করে তেজোদৃপ্ত কণ্ঠে বলছে, যদি সৈন্যরা লুঠের সব সম্পত্তি ও বন্দীদের ফিরিয়ে দিয়ে ফিরে যায়, তবে সে আক্রমণ করবে না। মোগল সৈন্যরা গুরুত্বই দিল না! মুহূর্তের মধ্যে ঝাঁকে ঝাঁকে তির এসে সৈন্যদের গায়ে বিঁধল এবং তৎক্ষণাৎ তাদের মৃত্যু হল। মোগল সৈন্যদের নিক্ষিপ্ত তির বিচিত্র কৌশলে এড়িয়ে গিয়ে উজবেক কন্যা তির নিক্ষেপ করে চলল, প্রত্যেকটি বাণে কেউ না কেউ মরতে লাগল। এইভাবে গোটা দলের প্রায় অর্ধেককে নির্মূল করে উজবেক কন্যা তলোয়ার হাতে তাদের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাকিদের শিরোচ্ছেদ করল।’
‘সেকি মহারাজ! এটা সত্যি?’ গালে হাত দিয়ে বললেন শিরোমণি।
বীরহাম্বীর বললেন, ‘হ্যাঁ, সত্যি। আমার এই মেয়েকেও আমি বীরাঙ্গনা করে তুলব, এই আমার স্বপ্ন! তীরন্দাজি থেকে অসিচালনা, সব ওকে শেখাব।’
‘না, না। ওসবে কাজ নেই।’ মাথা নাড়লেন শিরোমণি, ‘এমনিতেই সে আপনার মতো দেবতুল্য পিতা পেয়েছে, এবার একজন ভালো স্বামী পেলেই তার জীবন ধন্য হয়ে যাবে।’
মহারাজ হাসলেন। সাধারণ হোক বা রাজরানী, মেয়েরা কিছুতেই স্বামী-সংসারের বাইরে বেরোতে পারে না। কিছু না বলে তিনি শিরোমণির ক্লান্ত প্রতিমার মতো পাণ্ডুর মুখখানি টেনে নেন কাছে।
৬
গ্রীষ্মের এক উজ্জ্বল প্রভাত। রৌদ্র থাকলেও মাঝেমধ্যেই একঝলক ঠান্ডা বাতাস এসে দেহমন জুড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে। অদূরের ক্ষেতে শ্যামল শস্যের আন্দোলন।
এপাশে একটা বেশ বড় পর্ণকুটির। তার একপাশে উন্মুক্ত স্থানে একটি রঙিন কাপড়ের পটমণ্ডপ। পটমণ্ডপটি সাময়িকভাবে প্রতি প্রত্যুষে বসানো হয়, আবার সূর্যাস্তের আগে মণ্ডপটি গুটিয়ে নেওয়া হয়।
এটিই রামেন্দ্রসুন্দর তর্কালঙ্কার মহাশয়ের চতুষ্পাঠী। পর্ণকুটিরটি তাঁরই বাসগৃহ।
নামে চতুষ্পাঠী হলেও রামেন্দ্র তর্কালঙ্কার মহাশয় ছাত্রদের প্রাথমিক শিক্ষাও দান করে থাকেন। তিনি অঞ্চলে সুপ্রসিদ্ধ শিক্ষক। চতুর্বেদের অধ্যয়ন প্রস্তুতি হিসাবে পড়ান ষড়ঙ্গ, ষড়দর্শন, একইসঙ্গে শেখান গণিত, ইতিহাস, ভূগোল। তাঁর ছাত্রেরা উচ্চ শিক্ষার চতুষ্পাঠীতে গিয়ে ব্যুৎপত্তির পরিচয় দেয়। বৈদ্য ছাত্রেরা পড়তে যায় আয়ুর্বেদ বিদ্যাপীঠে, পরে তারা যুক্ত হয় রাজচালিত দাতব্য চিকিৎসালয়গুলিতে।
তর্কালঙ্কার মহাশয়ের চতুষ্পাঠীর ছাত্র যে, ভবিষ্যতে উচ্চপদের রাজকর্মচারী হবে, এমন ধারণা প্রচলিত। তর্কালঙ্কার মহাশয় নিজেও একথা অবগত এবং সেইজন্য তাঁর অহংবোধ প্রকট।
আজ তিনি পড়াচ্ছিলেন ইতিহাস। সম্রাট অশোকের কলিঙ্গ জয়ের ইতিহাস। পড়ানো শেষ, এবার পড়া ধরার পালা।
তর্কালঙ্কার মহাশয় তুলোট কাগজের পুঁথিটি সামনের বস্ত্রখণ্ডের ওপরে রাখলেন। পুঁথিটি সুপ্রাচীন, তার প্রচ্ছদের পটচিত্রটি প্রায় খুলে এসেছে।
তর্কালঙ্কার মহাশয় খরদৃষ্টি ছাত্রদের দিকে তাকালেন। ছেলেরা বারো থেকে ষোল বছরের, ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় পরিবারভুক্ত। এদের অভিভাবকদের তিনি ব্যক্তিগতভাবে চেনেন। মল্লরাজ সমস্ত চতুষ্পাঠীকে অবৈতনিক ঘোষণা করলেও অভিভাবকেরা মাসের শেষে এসে বাড়ির শস্য, ফলমূল দিয়ে যায়। তিনি আপত্তি করেন না। গুরুদক্ষিণা বলে কথা!
প্রতিটি ছাত্রের ওপর দৃষ্টি ফেলতে ফেলতে একস্থানে এসে থেমে গেলেন। সেখানে তাঁর সবচেয়ে অমনোযোগী ছাত্রটি বসে সবার অলক্ষ্যে সামনের বালকটির চুল টানতে ব্যস্ত। অত্যাচারিত হওয়া বালকটি শান্ত, সে বারবার নিজের চুল ছাড়িয়ে নিচ্ছে। কিন্তু আবার টেনে ধরছে দুরন্ত ছাত্রটি।
তিনি ঈগলের মতো কিছুক্ষণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চিৎকার করে উঠলেন, ‘অ্যাই! অ্যাই রঘু!’
রঘু ওরফে রঘুনাথ ভয়ে ভয়ে উঠে দাঁড়াল, ‘বলুন পণ্ডিতমশাই।’
তর্কালঙ্কার ক্রোধান্বিত স্বরে বললেন, ‘ওটা কী হচ্ছিল শুনি?’
‘কই, কিছু না তো!’ রঘুনাথ দ্রুত দুপাশে মাথা নাড়ল। রঘুনাথের জিহ্বা মিথ্যাকথা বলতে গিয়ে হোঁচট খায়, এমন অপবাদ চরম শত্রুও দিতে পারবে না।
অন্য ছাত্র হলে এই মুহূর্তে মিথ্যাচারণের অপরাধে তর্কালঙ্কার মহাশয় বেত্রাঘাতে আধমরা করে দিতেন, কিন্তু এক্ষেত্রে করলেন না। শুধু অগ্নিদৃষ্টি হেনে বললেন, ‘আমি দেখেচি তুমি কী কচ্চিলে! প্রায়ই তুমি অন্যদের উপদ্রব করো। ফের যদি এমন দেখি রাজামশাইকে জানাতে বাধ্য হব। বলো, সম্রাট অশোক কতদিন আগে কলিঙ্গ জয় করেছিলেন? আমাদের এই মল্লভূমির কোন কোন অংশ তখন কলিঙ্গের অন্তর্গত ছিল?’
রঘুনাথ নিশ্চুপ, মাথা চুলকোচ্ছে।
‘ছি-ছি! তোমার দাদারা কত মনোযোগ দিয়ে আমার চতুষ্পাঠীতে পড়ে গিয়েছেন।’ তর্কালঙ্কার মহাশয় বিরক্তমুখে বললেন, ‘বসো।’
রঘুনাথের অবাধ্যতা বেড়েই চলেছে। রাজ্যের কনিষ্ঠ রাজকুমার বলে তিনি কিছু বলতে পারেন না।
পটমণ্ডপের একদিক উন্মুক্ত। সেই প্রবেশপথে দণ্ডায়মান একটি কিশোর ছেলে। শ্যামবর্ণ দোহারা গড়ন। মুখটা মলিন কিন্তু বড় মায়াবী।
ছেলেটি চতুষ্পাঠীর সীমানায় প্রবেশ করেনি। বাইরে থেকে ঝুলন্ত পেতলের বড় ঘণ্টাটি বাজিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রদের মধ্যে চাপা উল্লাস উথলে উঠল। আজকের মতো ছুটি।
দ্বারপ্রান্তের ছেলেটির নাম পবন বধিলা। জাতিতে শূদ্র। বংশপরম্পরায় তারা রাজ্যের মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত অপরাধীদের হত্যা করার কাজ করে। শ্মশানে ডোমের কাজও করে থাকে। মল্লভূম রাজ্যে ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, পুরোহিত আর ক্ষত্রিয় ছাড়া কারুর পাঠাধিকার নেই। যে জাতই হোক না কেন, নিজজাতির বৃত্তি ত্যাগ করে অন্যের বৃত্তি গ্রহণ করা এদেশে শাস্তিযোগ্য অপরাধ! ব্রাহ্মণসন্তান পৌরোহিত্য বা অধ্যাপনা করবেন, ক্ষত্রিয়পুত্র সামরিক থাকবেন, কর্মকার, শঙ্খকার, ধোপা, নাপিত, মাঝি প্রত্যেকেই বংশপরম্পরায় নিজের বৃত্তিতে থাকবে, এমনই নিয়ম।
কিন্তু রাজসভার অনুমতি নিয়েই পবন ছেলেটিকে তর্কালঙ্কার চতুষ্পাঠীতে দ্বাররক্ষক ও সময় নিয়ামকের কাজে বহাল করেছেন। ছেলেটি অনাথ, থাকে খুল্লতাতের কাছে। ছেলেটির খুড়োর একটি-দুটি গরু আছে ঠিকই, কিন্তু তাতে আয়-সংকুলান হয় না। তার চেয়ে এখানেই কাজ করুক।
আজও দ্বিতীয় প্রহর শেষ হতে পবন ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছিল। সব বালক একে একে তার পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল।
পবন অপেক্ষা করছিল কখন পটমণ্ডপ ফাঁকা হবে। গোটা মণ্ডপটি পরিমার্জন করলে আজকের মতো তার কাজ শেষ। সে চলে যাবে সোজা হেড়ে পর্বতের দিকে।
হেড়ে আসলে কিঞ্চিত উঁচু একটি টিলা। সেটাকেই সবাই পর্বত বলে ডাকে।
রঘুনাথ এল সবার শেষে। তার পরনে দুর্মূল্য পোশাক, মাথায় সুন্দর উষ্ণীষ। সে নিজের পরিচয় সম্পর্কে ওয়াকিলবহাল, সবসময় রাজপুত্রোচিত পোশাকে থাকে। সে কিছু চিবোচ্ছে। চতুষ্পাঠীতে কিছু খাওয়া নিষিদ্ধ, কিন্তু প্রায়ই সে এই সমস্ত অবৈধ কাজ করে থাকে।
পবনের কাছে এসে চোখ নাচিয়ে বলল, ‘চল।’
পবন বলল, ‘একটু দাঁড়া। মণ্ডপটা পরিষ্কার করে নিই। তুই বাইরে গিয়ে অপেক্ষা কর।’
পবন আরেকবার পিছু ডাকল, ‘ওহ, শোন। মৌর্যসম্রাট অশোক প্রায় তেরোশো বছর আগে কলিঙ্গ জয় করেছিলেন।’
পড়াশুনোর কথা শুনলেই রঘুনাথের মুখে বিরক্তির ভাব ফুটে ওঠে। কিন্তু এখন সে বেশ বিস্মিত হয়ে বলল, ‘তেরোশো বছর? তখন কত মল্লাব্দ রে?’
পবন দ্রুতগতিতে পটমণ্ডপ দেখে নিল। তর্কালঙ্কার মশাই অনেকক্ষণ আগেই গৃহে চলে গিয়েছেন, ছাত্ররাও ছুটেছে কিছু দূরের ক্রীড়াঙ্গনে। হেসে ফেলল, ‘মূর্খ! তেরোশো বছর আগে মল্লাব্দ! জানিস নে, মল্লাব্দ শুরু হয়েছে আটশো পঁচাত্তর বছর আগে?’
রঘুনাথ বন্ধুর টিপ্পনিতে রাগল না, বলল, ‘অ! তুই তো জানিস, অতসব সন তারিখ আমার মনে থাকে না।’
পবন হাসল, ‘রাজপুত্র বলে কথা!’
‘রাজপুত্র তো কী? আমি কি রাজা হব নাকি?’ রঘুনাথ ঠোঁট উল্টে বলল, ‘রাজা তো হবে ধাড়ীদাদা!’
‘আঃ, রাজা না হোস, সামন্তরাজা তো হবি, কিংবা নিদেনপক্ষে জমিদার। এই প্রাথমিক জ্ঞানগুলো তো লাগবেই। গতসপ্তাহেই তো পণ্ডিতমশাই সম্রাট অশোকের কলিঙ্গজয় পড়িয়েছিলেন তার দুশো বছর পরেই মল্লভূম আক্রমণ করলেন মালব দেশের রাজা চন্দ্রবর্মা। তার দুশো বছর পরে—’
‘থাম। তুই ভালো করে জানিস, আমি মন্ত্রি-সান্ত্রী রাজা-উজির কিছুই হব না। আরেকটু বড় হলেই আমি বেরিয়ে পড়ব, দেশ বিদেশ দেখব, পথে পথে ঘুরে বেড়াব। অশোকের কলিঙ্গজয় আমার কোন কাজে লাগবে না।’ রঘুনাথ বলল, ‘শোন, তুই আজ হেড়ে পাহাড়ে যাবি কি? গেলে বল, না গেলে আমি যাই।’
‘ওমা, তোর না কাল বোন হয়েছে? আজ থেকে তো রাজবাড়িতে উৎসব!’
‘সেইজন্যই আরও যাব। সবাই ব্যস্ত, কেউ দেখার নেই। চল চল!’
‘হয়ে গেছে। চল। এ কী রে! আজকেও ঘোড়ায় যাবি নাকি?’
মল্লভূম দেশের সমাজ ব্রাহ্মণ্যধর্মের অনুশাসনের উপরেই প্রতিষ্ঠিত। তবে বাস্তবে অতটা কঠোর কোনও নিয়ম নেই। এদেশে ব্রাহ্মণসন্তানের সঙ্গে নমঃশূদ্র বালক নির্দ্বিধায় কথা বলতে পারে। রাজপুত্র হওয়া সত্ত্বেও রঘুনাথরা পড়তে আসে চতুষ্পাঠীতেই। তবে অস্পৃশ্যতা রয়েছে, রয়েছে অন্যের বৃত্তিগ্রহণ বা অন্যজাতিতে বিবাহে কড়া নিষেধ।
পবন আর রঘুনাথ, দুজনে দুই মেরুর বাসিন্দা। রঘুনাথ ছোট রানী কাঞ্চনমণির পুত্র।
ওদিকে পবন অনাথ, শূদ্রসন্তান। মাঠে-ঘাটে ঘুরে বেরিয়ে রাতটুকু পিতৃব্যের গৃহের এককোণে কাটে তার। সে ধীরস্থির শান্ত। ইচ্ছা করেই চতুষ্পাঠীর এই কাজ নিয়েছে, যাতে পণ্ডিতমশাইয়ের শিক্ষা শুনে নিজের সমস্ত কৌতূহল নিবৃত্তি করতে পারে। তার কেবল ইচ্ছা করে বিষ্ণুপুর, বিষ্ণুপুর পেরিয়ে গোটা মল্লভূম, মল্লভূম পেরিয়ে গোটা বঙ্গদেশ, এমনকী এদেশ পেরিয়ে গোটা জগত জানতে। খুড়োর গৃহের দালানে যখন শুয়ে থাকে, রাতের আকাশে ঝিকমিক করতে থাকা নক্ষত্রপুঞ্জের মধ্যে সে হারিয়ে যায়। ওর মনে হয় কত অপার রহস্যই না লুকিয়ে আছে ওই মহাকাশের মধ্যে।
অর্থনৈতিক, সামাজিক ও স্বভাবগত দিক থেকে এত বৈষম্য থাকলেও দুজনের গভীর বন্ধুত্ব ঈর্ষণীয়। রঘুনাথ পবনকে ভীষণ ভালোবাসে, পড়া শেষ হলে তারা দুজনে কোনোদিন চলে যায় হেড়ে পাহাড়ের দিকে, কোনোদিন আবার যায় ব্রীড়াবতী নদীর দিকে। তীরে গিয়ে পা ঝুলিয়ে বসে থাকে চুপ করে। দূরে নৌকো চলে, সেদিকে তাকিয়ে দুজনে আকাশপাতাল ভাবে।
রঘুনাথের ঘোড়াটি শিশু। তার গোটা দেহ কৃষ্ণবর্ণ হলেও চারপায়ের নীচের দিকগুলি ও নাকের ডগা ধবধবে সাদা। তাই তার নাম পঞ্চকল্যাণ। এই অশ্ব রঘুনাথের বড় আদরের। এর বলগাতেও তাই রঘুনাথ সগর্বে নিজের নাম লিখে রেখেছে।
রঘুনাথ ঘোটকের গলায় কিঞ্চিৎ আদর করল কিছুক্ষণ। তারপর মাথার উষ্ণীষ খুলে পবনের হাতে দিয়ে বলল, ‘যা। লুকিয়ে রেখে আয়।’
উষ্ণীষ খুলে রাখলে পরনের পোশাক হেতু সম্ভ্রান্তবংশীয় বোঝা গেলেও রাজকুমারকে আলাদা করে চেনার উপায় থাকে না। রাজপুত্রের বেশে আর যাই হোক যেখানে ইচ্ছা যাওয়া যায় না।
উষ্ণীষ রাখার স্থান রঘুনাথ নিজেই বানিয়ে রেখেছে। কিছুদূরের এক পরিত্যক্ত মৃৎকুটীর। সেখানে মাঝেমাঝেই গল্পের আসর জমে। পবন আর রঘুনাথ তো থাকেই, উপস্থিত হয় রাজ্যের মধ্যম রাজকুমার, রঘুনাথের দাদা শীতলও।
শীতল স্বভাবে পরিণতমনস্ক। ভ্রাতা রঘুনাথের একেবারে বিপরীত হওয়া সত্ত্বেও সে ভাইকে খুবই স্নেহ করে। ভাইয়ের এই অসমবয়সী সখ্যতা নিয়ে তার কোনও সমস্যা নেই। তবে ভাইয়ের ঘোড়া নিয়ে দূরদূরান্তের অভিযানে শীতলের কড়া বারণ রয়েছে।
রঘুনাথ চড়ে বসে লাগামে টান দিতেই পঞ্চকল্যাণ চিঁহি-হি-ই শব্দে ডেকে উঠল। পবন ভিতু, সে ভয়ে ভয়ে পঞ্চকল্যাণের পিঠে উঠল।
পঞ্চকল্যাণও তার মনিবের মতোই দুষ্টু, জানে, পবন তাকে ভয় পায়। সে ইচ্ছে করে দেহ একবার ঝাড়া দিয়ে উঠল। পবন অমনি রঘুনাথকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল।
রঘুনাথ হাসতে হাসতে পা দিয়ে পঞ্চকল্যাণকে এক গোঁতা দিল, ‘কী হচ্চে পঞ্চকল্যাণ? দিনদিন বেয়াদপি বাড়চে, না?’ তারপর বন্ধুকে বলল, ‘সত্যি, তুই, আস্ত ভীতু একটা! এইটুকু বাচ্চা ঘোড়াকেও ভয় পাস! এই তো, আমাকে চেপে ধরে, হ্যাঁ, আরেকটু সোজা হয়ে বোস, এই তো হয়েচে।’
পবনের ভয় কাটেনি। সে বন্ধুকে প্রায় জাপটে ধরে বসেছিল। চতুর্দিকে দেখছিল সতর্ক দৃষ্টিতে। যদিও রঘুনাথ চলেছে কাঁচাপথে, এ-পথে লোকজন বিশেষ নেই। তবু আশঙ্কা তো থেকেই যায়। শূদ্র হয়ে সে যে শুধু রাজপুত্রের অশ্বে চড়েছে তাই নয়, তার সঙ্গে লেপ্টে বসে রয়েছে। কেউ কোথাও থেকে দেখে ফেললে ঘোর অনর্থ বাধবে।
সে একটু সরে গিয়ে বলল, ‘একটু আস্তে চালা।’
রঘুনাথের দুষ্টুমির সীমা নেই! সে তৎক্ষণাৎ পঞ্চকল্যাণকে আরও জোরে ছুটতে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল।
পবন সভয়ে বন্ধুকে আবার জাপটে ধরল, বলল, ‘অ্যাই, এত জোরে চলচিস কেন?’
রঘুনাথ কর্ণপাত করল না! সহর্ষে বলল, ‘এবার আর আমাকে ছোঁয়ার অপরাধে তোকে অতদূরের ষাঁড়েশ্বর মন্দিরেও নিয়ে যাবে না রে হতভাগা! শুনিসনি, পিতা নগরের মধ্যেই ভট্টাচার্য পল্লীতে নতুন শিবমন্দির বানাচ্চেন? হি-হি! এবার সটান সেখানেই নিয়ে যাবে, আর ঘাড়টা মাথা থেকে ঘচাং!’
পবন শঙ্কিতমুখে বসে থাকে। জাতপাতের কড়াকড়ি না থাকলেও এই রাজ্যে অস্পৃশ্যতা ভঙ্গ অপরাধই, তার বিচার হয় বিষ্ণুপুরের উত্তরে ডিহর গ্রামের ষাঁড়েশ্বর মন্দিরের আটচালায়।
মাঝে মাঝে পবন সত্যিই অবাক হয়ে যায়। এখানে চতুষ্পাঠীতে পড়ানো হয় সম্রাট অশোকের রাজ্যশাসন, অথচ বৌদ্ধধর্মকে রাজধর্ম করে সম্রাট অশোক যে উঁচু-নীচু ভেদাভেদ দূর করে দিয়েছিলেন, প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন সমতা, সেইদিকে কেউ দৃষ্টিপাত করে না।
পবন ফের মিনতি করে, ‘একটু ধীরে চালা না ভাই। আমার ভয় করচে!’ তারপর ব্রহ্মাস্ত্র ছোঁড়ে, ‘নইলে আমি শীতলদাদাকে বলে দেব, তুই আবার হেড়ে পাহাড়ে যাচ্ছিস।’
মুহূর্তে কাজ হয়। রঘুনাথের দৌরাত্ম্যে রাজবাড়ির সকলে ভীষণ অস্থির, কিছুদিন আগেই তার কপাল ফেটে গিয়ে প্রচুর রক্তপাত হয়েছিল। হেড়ে পাহাড়ে যাচ্ছে জানতে পারলে তার নিজস্ব অশ্ব বাজেয়াপ্ত হবে।
৭
রাজবাড়ির মুক্তাঙ্গনের উত্তরদিকে অবস্থিত মল্লভূম রাজসভা। তার কেন্দ্রে রাজসিংহাসন। তাতে এখন মধ্যাহ্নের সূর্যের মতো আসীন রাজা বীরহাম্বীর।
সিংহাসনের দুই পাশে দুইজন করে মোট চারজন প্রতিহারী। প্রতিহারীরা একাধারে দৌবারিক এবং মহারাজার আজ্ঞাবাহী সশস্ত্র দেহরক্ষী। মহারাজ রাজকার্যে যেখানে যান, তাঁকে এরা ছায়ার মতো অনুসরণ করে।
চারজন প্রতিহারীই এখন ময়ূরপুচ্ছের পাখা দিয়ে মহারাজকে বাতাস করে চলেছে।
রাজসিংহাসন থেকে কিছুদূরে রত্নখচিত সব আসনে বসে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী, বিভাগীয় মন্ত্রীবর্গ, কোটাল, মহাসেনাপতি ও অন্যান্য অমাত্যরা। অন্যদিকে পুঁথিপত্র নিয়ে রাজপ্রশস্তিকার ও ভট্টঠাকুর।
স্বতন্ত্র আসনে বসে আছেন রাজজ্যোতিষী দেবনাথ বাচস্পতি। তাঁর সামনে অবিন্যস্তভাবে ছড়ানো রয়েছে একরাশ ভূর্জপত্র, তিনি সেদিকে চেয়ে রয়েছেন। তাঁর সামান্য পিছনে তুলনামূলক মলিন আসনে বসে রয়েছে কেশব ছড়াকার। তার মুখে যথারীতি কৌতুকময় অভিব্যক্তি।
সকলের থেকে প্রায় পঞ্চাশ হাত দূরে করজোড়ে বসে রয়েছে আরও কুড়ি-পঁচিশজন ব্যক্তি। দেখেই অনুমান করা যায়, এঁরা রাজদরবারের নিয়মিত সভ্য নয়, বিশেষ কারণে তাদের আগমন। প্রত্যেকের মুখে লেপে আছে সংকোচ, উদ্বেগ।
অনেকেই জীবনে প্রথমবার রাজদরবারে এসেছে। এতদিন তাদের অধিকাংশই এসেছে দরবার পেরিয়েই যে বৃত্তাকার অভিষেক মঞ্চ রয়েছে, সেই পর্যন্ত। রাজসভাগৃহে প্রবেশের সৌভাগ্য ঘটে না। তাই তারা সবিস্ময়ে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে বিশাল প্রাঙ্গণের নান্দনিক সৌন্দর্য।
মহারাজ বললেন, ‘প্রধানমন্ত্রী, প্রথমে বলুন গোপগ্রামের কী সংবাদ?’
প্রধানমন্ত্রী জীমূতবাহন উঠে দাঁড়িয়ে মহারাজকে অভিবাদন জানালেন। তারপর স্থিরস্বরে বললেন, ‘কাজ ভালোই এগোচ্ছে মহারাজ। সিংভূম থেকে অনেক লোহার জাতির শ্রমিক আনা হয়েছে। তারা দিনরাত কাজ করছে। তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে কংসাবতী নদীর তীরে।’
‘হুম।’ মহারাজ কী যেন ভাবতে ভাবতে বললেন, ‘দুশো কামান তৈরি করতে কতদিন সময় লাগবে?’
‘বলছি রাজামশাই।’ জীমূতবাহন মনে মনে হিসাব করলেন, তারপর পিছন ফিরে তাকালেন জনতার দিকে। গলা সামান্য তুলে ডাকলেন, ‘গণেশ! এদিকে এসো।’
দণ্ডায়মান জনতার মধ্য থেকে একজন মধ্যবয়সি মানুষ এগিয়ে আসতে থাকে। বীরহাম্বীর লক্ষ্য করলেন, আশেপাশের লোকগুলো একে ফিসফাস করে কিছু বলছে। গণেশ নামক ব্যক্তিটির হাঁটু পর্যন্ত ধুতি, আধময়লা ফতুয়া, তার গায়ে লৌহচূর্ণের রক্তাভ রঙ।
গণেশ সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করল, ‘পেন্নাম হই মহারাজ! অধমের নাম গণেশ কর্মকার।’
জীমূতবাহন বললেন, ‘মহারাজ, গণেশই ওখানকার প্রধান, ওরই অধীনে কাঁসাইকুলা আর আঙ্গারার লোহারেরা কাজ করছে। ওরা আপনাকে কিছু জানাতে চায়।’
‘বলো।’ বললেন বীরহাম্বীর।
গণেশ ফের আভূমি প্রণাম করল। তারপর বলল, ‘আজ্ঞে রাজামশাই, আমরা খুব সুখেই আচি। কোনওকিচুর অভাব নেইকো। কিন্তু ইদানীং গোপগ্রামে ঠিকমতো কাজ করতে পারচি নে আজ্ঞে। রোজ অত্যেচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছি!’
‘অত্যাচার?’ বীরহাম্বীর এবার অকৃত্রিম বিস্ময় প্রকাশ করলেন, ‘কে অত্যাচার করছে তোমাদের ওপর? প্রতিহারীরা?’
‘না না রাজামশাই। তেনারা কিছু করেন না কো!’ গণেশ জিভ বের করে বলল, ‘ইন্দ্রহাসের মোঘল চৌকির সিপাইরা প্রভু। যখন-তখন হামলা চালাচ্ছে। ওপর থেকে রাতের অন্ধকারে হামলা চালিয়ে কাজের মাকড়া পাথরগুলো নষ্ট করে, আমাদেরকেও মারধর করে।’
‘এত বড় স্পর্ধা!’ বীরহাম্বীর গর্জন করে উঠলেন, ‘আমার রাজ্যের লোককে বাইরে থেকে এসে আক্রমণ করছে! প্রধানমন্ত্রী, প্রতিরক্ষা ওখানে আরও বাড়াননি কেন?’
‘বাড়িয়েছি মহারাজ। লাভ হয়নি। ওরা এমন অতর্কিতে আক্রমণ চালাচ্ছে যে কিছু করা যাচ্ছে না। ওদের উদ্দেশ্যই কাজের ক্ষতি করা।’ জীমূতবাহন নম্রকণ্ঠে বললেন, ‘আসলে ওদের ওপর তেমনই আদেশ রয়েছে মনে হয়।’
‘কার আদেশ?’
জীমূতবাহন বললেন, ‘মহারাজ, পুরো বিষয়টা বুঝিয়ে বলছি। শ্রদ্ধেয় পরলোকগত মহারাজ ধাড়ীমল্লের আমলেই মোগল সিপাহশালার বাংলা উড়িষ্যা নিয়ে একটি সুবা গঠন করে মল্লভূমের বার্ষিক রাজস্ব ধার্য করে দেন। আপনার বাবা মোগল বাহিনীর সঙ্গে অসমযুদ্ধে অবতীর্ণ না হয়ে সাময়িক বশ্যতা মেনে রাজস্ব মিটিয়ে দেন ঠিকই, কিন্তু তারপর ঠিকমতো রাজস্ব মোঘল দরবারে পাঠাননি। উপরন্তু সামরিক শক্তি বাড়াতে তিনিও কামান ও আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি করতে শুরু করেন। বাদশাহ আকবর ক্ষুব্ধ হন।’
বীরহাম্বীর মাথা নাড়লেন। প্রধানমন্ত্রী ঠিক বলছেন। মল্লরাজ্য নামেই মোঘল বাদশাহের অধীনে। সেই বুদ্ধি তিনিই পিতাকে দিয়েছিলেন। পরপর চার বছর মোঘল সিপাহীসান্ত্রীর দল যখন বিষ্ণুপুর থেকে রাজকর আদায় করে বেরোত, বীরহাম্বীর ডাকাত সেজে আক্রমণ করতেন, লুঠপাট করে ফেরত আনতেন রাজস্ব। রাজকর দেওয়া পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
মোঘল সিপাহশালার নিশ্চয়ই কিছু অনুমান করেছিলেন।
তারপর বীরহাম্বীর যখন রাজ্যভার নেওয়ার আগে বিদেশমন্ত্রী হিসাবে কিছুদিন কাজ করছিলেন, তখন একবার সৌজন্যমূলক সাক্ষাতের জন্য দিল্লির দরবারে গিয়েছিলেন। মোঘল সাম্রাজ্যের অতুল ঐশ্বর্য! দেখে তাঁর চক্ষুস্থির! বাদশাহ আতিথেয়তার ত্রুটি না রাখলেও ওই একই অভিযোগের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। বীরহাম্বীর মৌখিক প্রতিশ্রুতি দিলেও তেমন আমল দেননি।
তারপরেই ঘটল সেই ভয়ানক যুদ্ধ। পিতার মৃত্যুর কিছু আগেই দিল্লি থেকে বিশাল এক সৈন্যবাহিনী আসে বিষ্ণুপুরে, নেতৃত্বে ছিলেন মুনিম খাঁ। অতর্কিত আক্রমণে পিতা প্রথমে দিশেহারা হয়ে গেলেও বীরহাম্বীর নিজে প্রবল পরাক্রমে যুদ্ধ শুরু করেন।
তাঁর সেই লড়াই আজও লোকের মুখে মুখে ফেরে। কামানের গোলার আঘাতে মোঘল সৈন্যেরা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। তারপর থেকে তারা আর অগ্রসর হয়নি। শুধু সীমান্ত অঞ্চল ইন্দ্রহাস ও রায়না পর্যন্ত এসে চৌকিতে ঘাঁটি গেঁড়ে বসেছে মোঘল সিপাইরা।
অতঃপর মোঘল সিপাইরা আজ অবধি বড় গোলযোগ না পাকালেও ওদের বিশ্বাস করা যায় না।
কামান ঢালার সময়ে ওদের উৎপাত বিপদের পূর্বাভাষ নয়তো?
প্রধানমন্ত্রী বলে চললেন, ‘তারপর আপনি সিংহাসনে বসেই কুম্ভস্থলগড়, ইন্দ্রহাস অঞ্চলের মোঘল চৌকিগুলোয় আক্রমণ করেন, গোপগ্রামে আরও বেশি কামান নির্মাণে উদ্যোগী হন। এত শ্রমিক আসছে বাইরে থেকে! এমনকী আপনি গোপনে দিল্লি থেকে সুদক্ষ মোঘল কারিগরও নিয়ে এসেছেন। মোঘল কারিগরেরা মুসলমান হলেও মিশে যাচ্ছিল, কিন্তু দিল্লি থেকে ক্রমাগত ইন্ধনে অন্যরকম হয়ে উঠছে।’
গণেশ কথা বলে উঠল, ‘মোঘল কারিগরেরা আগে আমাদের কাজ শেখাত, এখন শেখাচ্ছে না।’
বীরহাম্বীর কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর প্রশ্ন করলেন, ‘মোঘল কারিগরেরা কতটা বেশি দক্ষ গণেশ? তারা কী পারে যা আমার লোহারেরা পারে না?’
গণেশ অধোবদন হয়ে বলল, ‘আজ্ঞে রাজামশাই, আমরা তো মাকড়া পাথর গলিয়ে লোহা বের করি। তারপর মাটির ছাঁচে ফেলে কামানের খোল বানাই। এতে সময় লাগে বেশি আর মজবুতও কম হয়। মোঘল কারিগরেরা অঙ্গার দেওয়া হাপরে গলানো লোহার সঙ্গে বালি নির্দিষ্ট অনুপাতে মেশায়। এতে খোল অনেক শক্ত হয়। আমরা এ পদ্ধতি জানি না।’
‘জানো না, জেনে নিতে হবে!’ বীরহাম্বীর প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকালেন, ‘আপনি শীঘ্র দক্ষ ও বিশ্বস্ত কারিগর আনাবার ব্যবস্থা করুন, যাদের শিক্ষায় রাজ্যের কর্মকারেরা মোঘল কারিগরদের সমকক্ষ হয়ে ওঠে। আর কিছু লাঠিয়াল পালোয়ান ওখানে পাঠান। কামান তৈরিতে গড়িমসি করা যাবে না। প্রকাণ্ড এক কামান বানান। সময় বেশি নেই।’
‘যথা আজ্ঞা, রাজামশাই।’
বীরহাম্বীর চিন্তামগ্ন হয়ে পড়লেন। মোঘল চৌকির এই আকস্মিক শত্রুতার পিছনে কারা রয়েছে?
৮
‘সে প্রায় নয়শো বছর আগেকার কথা। রাজস্থানের জয়পুর থেকে কয়েকজন তীর্থযাত্রী জগন্নাথ দর্শন করতে চলেছিলেন। দলে ছিলেন এক রাজবংশীয় পুরুষ ও তাঁর গর্ভবতী স্ত্রী। জ্যৈষ্ঠমাসের এক গোধূলিলগ্নে সেই মহিলা পথের মধ্যে এক পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়ে মারা গেলেন। তাঁর স্বামী পড়লেন অকূলপাথারে। একে বিদেশবিভূঁই, তায় সদ্য স্ত্রীবিয়োগ। তিনি কী করবেন বুঝতে না পেরে মৃতা স্ত্রী ও সদ্যোজাত সন্তানকে ত্যাগ করে দলের সঙ্গে তীর্থে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে একটি গাছের নীচে শিশুটিকে শুইয়ে দিলেন, রেখে দিলেন একটি পরিচয়পত্র ও একটি রাজতরবারি। সেই তরবারির নাম জয়শঙ্কর।’
বৃদ্ধ টানা বলে চোখ বন্ধ করলেন। নিরন্তর কথা বলায় তাঁর শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। সঙ্গের বালিকাটি ত্বরিতে তাঁর গলায় পাত্র থেকে জল ঢেলে দিল। জল পান করে বৃদ্ধ শান্ত হলেন।
‘সেই স্থানই কি আজকের এই প্রদ্যুম্নপুর দাদাঠাকুর?’ বসে থাকা মানুষটি প্রশ্ন করল।
বৃদ্ধ দুপাশে মাথা নাড়লেন, ‘না। সেই স্থানের নাম লাউগ্রাম, এখান থেকে বেশ কিছুটা দূর। মল্লবংশের আদি রাজা রঘুনাথকে সেখানেই জন্মদাতা ফেলে গিয়েছিলেন। এক বাগদী কুড়িয়ে পেয়ে ভরণপোষণের আশায় শিশুকে তুলে দেয় নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ পঞ্চানন ঘোষালের হাতে। পঞ্চানন ঘোষাল ছিলেন শক্তির উপাসক। রঘুনাথ বড় হলে তিনি বোঝেন রাজা হওয়ার লক্ষণ রয়েছে ছেলেটির মধ্যে। ব্রাহ্মণ স্বপ্নে পান আশ্চর্য দৈবাদেশ।’
বালিকা সঙ্গে সঙ্গে করজোড়ে চোখ বুজে গাইতে আরম্ভ করল,
‘সেই রাত্রে স্বপ্নে দ্বিজে প্রত্যাদেশ হয়
ভাবিস কি বালকের শুভ ভাগ্যোদয়।
সৌভাগ্য সূচনা তাহা, দেখেছ যা তুমি
রাখালে করিয়া রাজা ব্যক্ত হব আমি।
শিক্ষা দীক্ষা দিয়া তারে করহ মানুষ
আমার আদেশ ইহা থাকে যেন হুঁশ।’
বালিকার গলার স্বর যেমন সুমিষ্ট, তেমনই তার সুর তাল লয় জ্ঞান। সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিল। শেষ করে বালিকা গলবস্ত্র হয়ে ঈশ্বরের উদ্দেশে প্রণাম জানাল।
সামনে বসে থাকা মানুষরাও কপালে হাত ঠেকাল।
বৃদ্ধ বললেন, ‘যিনি দৈবাদেশ দিয়েছিলেন, তিনিই মল্লভূমের আদি দেবী দণ্ডেশ্বরী। এর কৃপাতেই রঘুনাথ পরবর্তীকালে লাউগ্রামে রাজ্যলাভ করেন। রাজা নৃসিংহদেবের পরে রঘুনাথ প্রদ্যুম্নপুরকে রাজধানী করে প্রতিষ্ঠা করেন মল্লভূম রাজ্যের। পালকপিতা পঞ্চানন ঘোষাল হন তাঁর রাজপুরোহিত ও প্রধান উপদেষ্টা। পরে রঘুনাথপুত্র জগতকুমার আনুষ্ঠানিকভাবে দেবীকে প্রতিষ্ঠা করেন। একই সময়ে রঘুনাথ মৎস্যশিকারে গিয়ে শালগ্রাম শিলাও পেয়েছিলেন। তিনি অনন্তদেব বিষ্ণু হিসেবে পূজিত হয়ে আসছেন।’ বৃদ্ধ লম্বা নিঃশ্বাস নিলেন, ‘লক্ষ্য করে দেখো, মল্লভূমের জন্মলগ্ন থেকেই সুন্দরভাবে বৈষ্ণব ও শাক্তধর্মের সমন্বয় ঘটেছে।’
লোকরা উঠে দাঁড়াল। তারপর চাদরের খুঁট খুলে যে যা পারল, ঢেলে দিল বৃদ্ধের সামনের বস্ত্রখণ্ডে।
রুদ্রাক্ষ লক্ষ্য করল সামান্য কিছুক্ষণের মধ্যেই বস্ত্রখণ্ড চাল, বাতাসা, শশা ও কলায় পরিপূর্ণ হয়ে গেল। ভিড় কমে যেতেই বৃদ্ধ উঠে দাঁড়ালেন, ধীরগতিতে বালিকার হাত ধরে সরে যেতে লাগলেন হাটতলা থেকে।
রুদ্রাক্ষ পিছু নিল। বৃদ্ধ মন্থর গতিতে হাট অঞ্চল পেরিয়ে এগোতে থাকলেন গড়ের দিকে।
প্রদ্যুম্নপুর বেশ সমৃদ্ধ জনপদ। গ্রামের দক্ষিণ দিকে রাজাদের গড়। উত্তরের দ্বারকেশ্বর নদী আর পশ্চিমের গভীর বনাঞ্চল প্রাকৃতিক জলদুর্গ আর অরণ্য তৈরি করে দিয়েছে।
রাজধানীর এমন আদর্শ স্থান ছেড়ে মল্লরাজারা বিষ্ণুপুর চলে গেলেন কেন?
ভাবতে ভাবতে সে বৃদ্ধের কাছাকাছি পৌঁছে গেল। যখন হাতদুয়েক দুরত্বে, তখন বৃদ্ধ সহসা পিছনে ফিরলেন। গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘কে তুমি? কী চাও? আমাদের পিছু নিয়েছ কেন?’
রুদ্রাক্ষ হাসার চেষ্টা করে বলল, ‘প্রণাম দাদাঠাকুর। আমি ভিনদেশী পথিক। আজ রাতটা প্রদুম্নপুরে কাটাব মনস্থ করেছি। কাল সকালে যাত্রা করব বিষ্ণুপুর। হাটে আপনার কথা শুনে বড় কৌতূহল হল।’
‘কী?’ বৃদ্ধের ভ্রূ কুঞ্চিত হল। তখনই রুদ্রাক্ষ বুঝল, বৃদ্ধ অন্ধ। ওইজন্যই বালিকার হাত তিনি শক্তভাবে ধরে রেখেছেন।
রুদ্রাক্ষ বলল, ‘আজ্ঞে দাদাঠাকুর, রাজধানীর জন্য প্রদ্যুম্নপুর আদর্শ ভৌগোলিক অবস্থানে হওয়া সত্ত্বেও মল্লরাজারা বিষ্ণুপুর চলে গেলেন কেন?’
বৃদ্ধের দৃষ্টি এবার কিছু নরম হল। ধীরে ধীরে বললেন, ‘কী নাম তোমার? কোথা থেকে আসছ? এখানে কোথায় আশ্রয় নিয়েছ?’
‘আমার নাম রুদ্রাক্ষ। আসছি তন্দা থেকে। আজ রাতটা রামনাথ ঘোষালমশায়ের গৃহে কাটাব বলে মনস্থ করেছি।’
‘বেশ।’ বৃদ্ধ মাথা নাড়লেন। তারপর বললেন, ‘এসো আমার সঙ্গে। কাছেই আমার বাসস্থান। একটু জলবাতাসা সেবন করে যাও।’ তারপর মুখ তুলে আবার বললেন, ‘আশঙ্কার কারণ নেই। আমি ক্ষত্রিয়। এখানে আদি রাজবাড়ি আছে। আমি সেখানেই থাকি।’
পরিত্যক্ত রাজবাড়িতে প্রবেশের জন্য বৃদ্ধ ও বালিকার পিছু পিছু রুদ্রাক্ষ অতিক্রম করল তিনটে সুগভীর পরিখা পাড়। মল্লভূমের শহর পরিকল্পনা-চিন্তাভাবনা ও যত দেখছিল, মোহিত হয়ে যাচ্ছিল। ওর ধারণা ছিল মুসলমান শাসকরা প্রশাসনিক দিক দিয়ে অনুকরণীয়। তাঁদের দূরদর্শিতা, নগরপরিকল্পনা অনেক এগিয়ে। কিন্তু এখানে এসে তার সেই ধারণা পালটে যাচ্ছে।
প্রতিটি পরিখায় সুগভীর খাত, তাতে জল বইছে প্রায় দু-মানুষ উঁচু। পরিখা অতিক্রম করতে গেলে মাঝবরাবর একটি করে তোরণ পেরোতে হয়। সেই তোরণে দাঁড়িয়ে রয়েছে সশস্ত্র দ্বাররক্ষক। তাঁদের পরনে পুরোদস্তুর সেনাবাহিনীর পোশাক, মাথায় শিরস্ত্রাণ, হাতে দীর্ঘ বল্লম।
বৃদ্ধ তোরণের কাছে পৌঁছতেই তারা সসম্ভ্রমে প্রণাম করল, তারপর প্রবেশদ্বার খুলে দিল। এইভাবে তিনটি পরিখা পার হওয়ার পর চতুর্থ পরিখার সামনে এসে রুদ্রাক্ষের মুখ থেকে অবচেতনে বেরিয়ে এল, ‘বাহ!’
বৃদ্ধ গর্বিতমুখে বললেন, ‘রাজবাড়িতে ঢোকার আগে এটিই সর্বশেষ পরিখা। সামনের প্রবেশদ্বারটি হল হনুমান তোরণ।’
রুদ্রাক্ষ সবিস্ময়ে দেখতে লাগল। সামনের হনুমানতোরণ নামের প্রবেশদ্বারের পুরো অংশ হাত দিয়ে ধরে রেখেছে বৃহদাকার এক হনুমান প্রস্তরমূর্তি। সে অস্ফুটে বলল, ‘এসব কি রাজা রঘুনাথই বানিয়েছিলেন?’
বৃদ্ধ বললেন, ‘না। প্রদ্যুম্নপুর গড় আগেই ছিল। নৃসিংহদেবও এই গড়েই রাজত্ব করে গিয়েছেন। এসো।’
বৃদ্ধ তোরণের দিকে এগিয়ে গেলেন। বালিকা তাঁকে ধরে রেখেছে। দ্বাররক্ষকেরা সসম্ভ্রমে দ্বার খুলে দিল।
রুদ্রাক্ষ ভাবছে, ইনি কি আদি রাজবাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছেন? কিন্তু তাই যদি হবে, হাটে ভিক্ষা করবেন কেন?
বৃদ্ধ ঢুকতে ঢুকতে বললেন, ‘আমি এখন আর ভালো দেখতে পাই না। বামদিকে দেখো, যে মন্দিরটা দেখছ, সেটি হল শ্যামচাঁদ মন্দির। সামনের অট্টালিকাটিই মল্লরাজবংশের রাজপ্রাসাদ। তার পিছনদিকে রয়েছে কোষাগার, শস্যাগার, সৈন্যাগার। সবই পরিত্যক্ত।’ বৃদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, ‘মৃত নগরী। আমরা যারা বাস করি, তারাও মৃত।’
রুদ্রাক্ষ এগিয়ে গিয়ে দেখছিল। রাজপ্রাসাদটি অত্যন্ত সুপ্রাচীন। চারিদিকে চারটি সুউচ্চ স্তম্ভ, মাঝে পুরু দেওয়াল। প্রাসাদের ছাদ বৃত্তাকার। নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে গজিয়ে উঠেছে বিশাল বটবৃক্ষ।
‘ওই যে দেখছ কানাইসায়র, শোনা যায় ওই পুষ্করিণীতেই ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন প্রাক্তন রাজা নৃসিংহদেব।’ বৃদ্ধ এগোলেন ভগ্নপ্রায় অট্টালিকার দিকে, বললেন, ‘হেম মা, ওঁকে সঙ্গে নিয়ে আয়। বারমহলে বসাবি।’
হেম নামক বালিকাটির বয়স আনুমানিক চোদ্দো-পনেরো বছর। মুখশ্রী কোমল, ওই গভীর পুষ্করিণীর মতো টলটলে, স্নিগ্ধ। পোশাক দেখে বোঝা যায় সে বিধবা। সাদা রঙের একটি নরম থান জড়িয়ে রেখেছে সারা দেহে, কিন্তু তার মাথায় কোনো অবগুণ্ঠন নেই। স্কন্ধদেশও উন্মুক্ত, অনাবৃত।
রুদ্রাক্ষ চোখ সরিয়ে নেওয়ার আগে লক্ষ্য করল, বালিকাটির বাম স্কন্ধের ওপরে রক্তকরবীর কুঁড়ির মতো একটা লাল রঙের তিল।
চোখ সরিয়ে নিয়ে বৃদ্ধের দিকে তাকাল রুদ্রাক্ষ, ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠল। বৃদ্ধ অন্ধ, কিন্তু চোখের গতিপথ দেখে মনে হয় তিনি সব দেখতে পাচ্ছেন!
হেম সসংকোচে বলল, ‘আপনি ভিতরে আসুন।’
অট্টালিকায় প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে ভৃত্যস্থানীয় একটি লোক দৌড়ে এল। বৃদ্ধ তার হাতে একটু আগে ভিক্ষায় পাওয়া চাল, ডাল, কলায় পূর্ণ বস্ত্রখণ্ড তুলে দিতে সে সেটা নিয়ে চলে গেল।
যিনি এই অট্টালিকায় বাস করেন, যাঁর নিজস্ব ভৃত্য রয়েছে, তাঁকে কেন ভিক্ষা করতে হয় জনপদে?
রুদ্রাক্ষের বিলম্ব হয়ে যাচ্ছে। সূর্য অস্তাচলে। নতুন জায়গা, অন্ধকার হয়ে গেলে ঘোষাল মশাইয়ের বাসস্থান খুঁজে বের করাটা দুরূহ হয়ে পড়বে।
বৃদ্ধ নিজেই বললেন, ‘আমি প্রদ্যুম্নপুর হাটে বসে মল্লবংশের অতীত বলি নিজের আনন্দে। কেউ খুশি হয়ে কিছু দান করলে অস্বীকার করি না। এসে বিতরণ করে দিই।’
বারমহলটি এখনও বাসযোগ্য রয়েছে। বৃদ্ধ তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বললেন, ‘তুই ওর জন্য কিছু খাবার ব্যবস্থা কর হেম।’
হেম মাথা হেলিয়ে চলে গেল। আবার ঘনিয়ে এল এক অস্বস্তিকর নীরবতা।
রুদ্রাক্ষ ভিতরে ভিতরে অস্থির হয়ে পড়ছিল। এই ভগ্নপ্রাসাদে প্রবেশ করা অবধি সে ভৃত্য বা রক্ষীস্থানীয় ছাড়া কাউকে দেখতে পায়নি। এই বৃদ্ধ ও বালিকাটির পরিচয় কী?
যাদের একটি ইন্দ্রিয় বিকল হয়ে পড়ে, তাদের অন্যান্য ইন্দ্রিয় বেশিই সক্রিয় থাকে। এই বৃদ্ধেরও তাই। ঈষৎ ঝুঁকে পড়ে তিনি বললেন, ‘আমি মল্লভূম রাজ্যের কুমার ছিলাম। আমারই মল্লরাজাধিপতি হওয়ার কথা ছিল। রাজা বীরহাম্বীরের জ্যেষ্ঠতাত আমি। ধাড়ীমল্ল ছিল আমার কনিষ্ঠ ভ্রাতা। আমাদের পিতা মারা যাওয়ার পর আমার রাজ্যাভিষেকের দিনক্ষণ যখন সব ঠিক, তখনই কিছু মন্ত্রীর সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে সিংহাসন দখল করে ধাড়ী। রাজ্যের প্রজারাও তাকে সমর্থন করে।’
রুদ্রাক্ষ শুনছিল। বলল, ‘প্রজারা ওঁকে সমর্থন করল কেন?’
‘কারণ আমি ছিলাম অবিবাহিত। আমার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারী থাকবে না, তখন ফের ধাড়ীকেই বসাতে হবে। তাই প্রথমেই তাকে সিংহাসনে বসানো ভালো। শুধু তাই নয়, জ্যেষ্ঠ হয়েও বিষ্ণুপুরে কুমার হিসাবে থাকলে আমার খারাপ লাগতে পারে, সম্মান কম হতে পারে, এই কারণ দেখিয়ে আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হল এই প্রাচীন পরিত্যক্ত রাজধানীতে। সেই থেকে এখানেই আছি।’
রুদ্রাক্ষ চকিতে একবার অন্দরের দিকে তাকাল। হেম নামক কিশোরীটি তাহলে বৃদ্ধের কে হয়?
বৃদ্ধ বুঝে ফেললেন। বললেন, ‘হেমনলিনী আমার পালিতা কন্যা। কিছু বছর আগে প্রাক্তন সেনাপতি শঙ্কর সিংহ এক দুর্ঘটনায় সস্ত্রীক প্রয়াত হন। তারপর থেকে তাঁর কন্যা হেমনলিনীকে আমি সন্তানস্নেহে লালন করেছি। সুযোগ্য পাত্র দেখে হেমের বিবাহও দিয়েছিলাম আমি, কিন্তু বিবাহের পরেই সর্পদংশনে তাঁর স্বামী মারা যায়। সেই থেকে ও আমার কাছেই রয়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় কি জানো, একজন রাজকুমার হয়েও সামান্য সুবিধাটুকু পাই না। একটিমাত্র ভৃত্য আমার। রন্ধন, গৃহকর্মাদি সব হেমকেই করতে হয়। ভাবতে পারছ?’
রুদ্রাক্ষ সমব্যথীর ভঙ্গিতে মাথা হেলাল, ‘আমাকে এবার উঠতে হবে দাদাঠা… রাজন!’
বৃদ্ধের নাম এখনও জানা যায়নি, ইচ্ছে করেই সে ‘রাজন’ ব্যবহার করল। বৃদ্ধ তাতে যে খুশি হয়ে উঠলেন, রুদ্রাক্ষের বুঝতে অসুবিধা হল না।
এবং তখনই ওর দিকে ঝুঁকে এলেন বঞ্চিত রাজকুমার, ‘জেনে হোক বা না জেনে তুমি ঠিক জায়গাতেই এসেছ বাবা।’
‘মানে?’ রুদ্রাক্ষ মুহূর্তে সচকিত। বারমহলের এই আলো আঁধারিতে বৃদ্ধের চোখে যেন খেলা করছে একরাশ কৌতুক।
‘আমি সব জানি।’ বৃদ্ধ সামান্য হাসলেন। তারপর স্বগতোক্তির ঢঙে বললেন, ‘ফারমুলী পাঠিয়েছে তো?’
রুদ্রাক্ষ স্তম্ভিত! প্রাথমিক বিস্ময় কাটিয়ে উঠে উত্তর দিল, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনিই তবে মাধব মল্ল?’
‘হ্যাঁ।’ বৃদ্ধের ঠোঁটের কোণে বিষাদের হাসি, ‘ফারমুলীর সঙ্গে আমার পত্রালাপ চলছে গত দুইবছর ধরে। হেম অনুলিখন করে দেয়।’
‘দু-বছর?’ রুদ্রাক্ষ বলল, ‘কিন্তু তখনও তো তিনি …।’
‘জানি। তখনও সে হিন্দু ছিল। তা হলেও বা। মল্লভূমের মতো সমৃদ্ধশালী রাজ্য যেকোন শত্রুরাজ্যের কাছেই লোভনীয়।’
‘কিন্তু তাতে আপনার লাভ? ফারমুলী রাজ্য দখল করলে আপনি কি সিংহাসন পাবেন?’
মাধব মল্ল হাসলেন। সরাসরি উত্তর না দিয়ে বললেন, ‘এই বয়সে এসে কোনও কিছুর প্রতি লোভ আমার আর নেই। কিন্তু প্রতিশোধস্পৃহা তো মুছে ফেলা যায় না! তোমার যাত্রা শুভ হোক। বিষ্ণুপুরে তোমার জন্য জগত কুমার সাগ্রহে অপেক্ষা করছেন।’
রুদ্রাক্ষ বলল, ‘প্রণাম। আমার একটা প্রশ্ন ছিল।’
‘কী?’
‘রাধামোহন লাহিড়ী নামে মল্লরাজ্যে কেউ বাস করেন?’
মাধব মল্ল কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন। তারপর বললেন, ‘শুনেছি বলে মনে পড়ছে না! তুমি রাজধানীতে লাহিড়ীপাড়ায় গিয়ে সন্ধান করো হয়তো খোঁজ পাবে।’
৯
তুষারধবল পর্বতরাজ হিমালয়। মহানন্দা নদী তার হিমবাহ থেকে উৎপন্ন হয়ে বহু দূর প্রবাহিত হয়ে শেষে গঙ্গায় এসে মিলেছে। পৌণ্ড্রবর্ধন ও কোচ—দুই রাজ্যকে পৃথক করে রেখেছে এই নদীই। পৌণ্ড্রবর্ধন দেশের রাজধানী মহাস্থানগড়, সেখানে বসবাস করে পোদজাতির মানুষজন। অপর প্রান্তে রয়েছে কোচ বা রাজবংশী রাজ্য। তাদের রাজধানী কোচবিহার।
দক্ষিণ হিমালয়ের তরাই অঞ্চল দিয়ে দক্ষিণবঙ্গের দিকে আসার পথে মহানন্দা তার দুপাশে সৃষ্টি করেছে কিষাণগঞ্জ, বারসোইয়ের মতো ছোটবড় গঞ্জনগরের। সেখানে দিনভর পণ্যবাহী জাহাজ-নৌকো এসে নোঙর করে। মহানন্দা এরপর প্রবেশ করেছে রাঢ়বঙ্গে, তারপর ক্ষীণকায়া হয়ে চলে গেছে বরেন্দ্রভূমির দিকে।
দ্বাদশ শতাব্দীতে এখানেই গড়ে উঠেছিল রাজা লক্ষ্মণ সেনের লক্ষ্মণাবতী বা গৌড়। তাল, তমাল আর খেজুর গাছে ছাওয়া এই অঞ্চলের সুপ্রসিদ্ধ গুড় থেকেই গৌড়।
এই ষোড়শ শতাব্দীতে গৌড় আর বাংলার রাজধানী নেই। সুলেমান বাংলা ও বিহারের শাসক হওয়ার পর তাঁর নতুন রাজধানী হয়েছে তন্দা।
শুধু বাংলা বিহার নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট নন, তাঁর বহুদিনের ইচ্ছা দক্ষিণের মন্দিররাজ্য উৎকল জয় করার। কিন্তু সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়েও সুলতান ব্যর্থ হয়েছেন উৎকল জয়ে। উৎকলরাজ মুকুন্দদেব দুরমুশ করে দেন সুলতানের সৈন্যদলকে। সেই পরাজয়ের গ্লানি তিনি আজও ভুলতে পারেননি।
সুলেমান এখন বার্ধক্যের দোরগোড়ায়। তাঁর হারেমে অগণিত বেগম ও ওয়াইফ আর মুলাজমা মিলে নক্ষত্র ঘটালেও সুলতানের প্রাণেশ্বরী এখনও সেই হিন্দু রমণী, জাকিয়া বেগম। তাঁর সংস্পর্শে সুলতানের উগ্রতা কমে গিয়েছে, তিনি রাজকর্মে আবার হিন্দুধর্মীদের নিয়োগ করছেন। তাঁর দুই পুত্র বায়েজীদ ও দায়ুদও ইতিমধ্যেই ছোটখাট বিদ্রোহ দমনে ও রাজ্যপরিচালনায় যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছে। সবকিছুই ঠিকঠাক, কিন্তু তবু যখন বসে তামাক সেবন করেন সুলতান, একটা হতাশা মনের ভেতর থেকে গুমরে ওঠে, আর একবার কি চেষ্টা করে দেখা যায় না? পাঠান হয়ে তিনি এক মদ্রদেশীয় ব্রাহ্মণ রাজাকে হারাবার কাবিল নন? উৎকল কি সত্যিই অজেয়?
গত কয়েকবছরে রাজ্যে কিছু চমকপ্রদ ঘটনা ঘটেছে। নয়নচাঁদ রায় ভাদুড়ী নামে এক ব্রাহ্মণ বহুদিন সুলতানের সৈন্যদলে যোগ দিয়েছিলেন। নিজ যোগ্যতায় নয়নচাঁদ ফৌজদার পদে উন্নীতও হয়েছিলেন। তাঁর আদি বাড়ি ছিল উত্তরের ভাদুড়িয়াতে। রাজধানী তন্দায় আসার পর স্ত্রী বন্দনা ও শিশুপুত্র রাজীবলোচনকে নিয়ে ছিল তাঁর সুখের সংসার।
কিন্তু হঠাৎ একদিন নয়নচাঁদ চোখ বুজলেন, তাঁর স্ত্রী ছোট পুত্রকে নিয়ে রাজধানী শহরে আতান্তরে পড়ে গেলেন।
বন্দনার পিতা মাধব রায় ছিলেন সচ্ছল বৈষ্ণব ব্রাহ্মণ। তিনি কন্যাকে নিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু বন্দনা শ্বশুর জ্ঞানেন্দ্রনাথের সঙ্গে স্বামীর আদিগৃহ ভাদুড়িয়ায় ফিরে যাওয়াই মনস্থ করলেন। ভাদুড়িয়ায় গিয়ে শুরু হল রাজীবলোচনের লেখাপড়া।
পিতামহ জ্ঞানেন্দ্রনাথ ছিলেন শৈব ব্রাহ্মণ, কিন্তু কালক্রমে তাঁর মধ্যেও বৈষ্ণব ধর্মমত প্লাবিত হয়েছিল। আদরের নাতি রাজুকে তিনি পরম স্নেহে বিদ্যাদান করতে লাগলেন।
রাজু ছিল অত্যন্ত মেধাবী। স্বল্পসময়ে সে প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করে ফেলে। জ্ঞানেন্দ্রনাথ উচ্চশিক্ষার জন্য তাকে পাঠান গৌড়ের বিখ্যাত পণ্ডিত সায়নাচার্যের চতুষ্পাঠীতে। সেখানে গিয়ে দ্রুত রাজীবলোচন প্রগাঢ় শাস্ত্রজ্ঞানী হয়ে উঠল। পাণিনি থেকে চতুর্বেদ, স্মৃতি থেকে ন্যায়, ব্রহ্মবৈবর্ত থেকে অষ্টাদশ পুরাণ সবই তার কণ্ঠস্থ। নবদ্বীপ ও গৌড়ে কয়েকটি ধর্মসভায় শাস্ত্রের নতুন ব্যাখ্যা পেশ করে সে পণ্ডিতমহলে সমীহের পাত্র হয়ে উঠল।
জ্ঞানেন্দ্রনাথ রাজীবলোচনকে তারপর পাঠালেন বৃন্দাবনে, সেখানে তাকে বিদ্যাদান করলেন গোস্বামী গোপালভট্টের এক শিষ্য।
শিক্ষকের কাছে দীক্ষিত হয়ে ফিরল রাজীবলোচন। তার কণ্ঠে ভক্তিপদের অপূর্ব স্তোত্র শুনে গ্রামের সকলে মুগ্ধ। শ্রীচৈতন্যের তিরোধানের পর তখন কয়েকবছর মাত্র কেটেছে। মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ছে রাজীবলোচনই হবে তাঁর উত্তরসূরি। মুমূর্ষু হিন্দুধর্মকে সে আবার প্রসারিত করবে দেশে-বিদেশে।
কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় অন্য।
মহাপণ্ডিত হয়ে ভাদুড়িয়ায় ফিরে এলেও রাজীবের মনে তৃপ্তি হয় না। সে পণ্ডিতের মতো এমন নিস্তরঙ্গ জীবন কাটাতে চায় না। তার দেহে রণকুশলী পিতার রক্ত! সে স্বপ্ন দেখে সৈনিক হওয়ার! এদিকে পরিবারের সকলে চায়, সে পুরোহিত হোক। ভাদুড়িয়া গ্রামেই সকলের শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে জীবন নির্বাহ করুক।
বেশ কিছুদিন দোলাচলের পরে সে একদিন তন্দায় চলে গেল। সুলতানের সঙ্গে দেখা করে আর্জি জানাল সৈন্যদলে যোগ দেওয়ার।
রাজীবলোচনের পিতা নয়নচাঁদকে বিস্মৃত হননি কররাণী। হিন্দু হলেও অমন বীর বিরল। পুত্র নিশ্চয়ই পিতার মতই তেজী হবে। তিনি রাজীবলোচনকে সৈন্যদলে নিয়োগ করলেন।
রাজীবলোচন পিতার মুখ রাখল। কয়েকবছরের মধ্যেই সে ফৌজদার হয়ে গেল। মাঝে একবার গ্রামে যেতে তার বিবাহও দিয়ে দেওয়া হল। স্থানীয় রাধামোহন লাহিড়ীর দুই কন্যা রুপালী ও রূপানী তখন যথাক্রমে ষোল ও তিন বছরের, তারাই হল রাজীবলোচনের স্ত্রী।
বিবাহের পর রাজীবলোচন একা ফিরে গেল তন্দায়।
তারপরই ঘটনা মোড় নিল অন্যদিকে।
সুলতান সুলেমান কররাণীর দুই পুত্র বায়েজিদ ও দায়ুদ ছাড়া এক কন্যাও ছিল। তার নাম দুলারী। সে প্রতিদিন প্রাসাদের বাতায়ন থেকে নদীতে স্নানরত রাজীবলোচনকে দেখতে পেত।
রাজীবলোচন দীর্ঘদেহী, অত্যন্ত সুপুরুষ, ঘন চুল, মোটা গোঁফ। পরনে একটি শ্বেতশুভ্র ধুতি পরে উপবীত কাঁধে নিরাবরণ প্রশস্ত ঊর্ধ্বাঙ্গে সে যখন হেঁটে যেত, নদীতে অর্ধনিমজ্জিত হয়ে উদাত্তকণ্ঠে গায়ত্রীমন্ত্র উচ্চারণ করত, সকলের মধ্যে সমীহ ফুটে উঠত।
সুলতানদুহিতা দুলারী হিন্দু ব্রাহ্মণ রাজীবলোচনের প্রেমে পড়ে গেল।
ইতিমধ্যে সুলতান আরও একবার বিপুল অর্থব্যয়ে রণসজ্জা আয়োজন করে উৎকল অভিযানে গেলেন। কিন্তু এবারও শোচনীয়ভাবে পর্যুদস্ত হয়ে ফিরে এলেন। এসে যখন শুনলেন, হিন্দু কাফেরকে মেয়ে ভালোবেসেছে, রাগে বেদনায় হতাশায় তিনি অত্যন্ত বিক্ষিপ্ত হয়ে তিনি পড়লেন।
সুলতানের প্রিয়তমা জাকিয়া বেগম তাঁকে বোঝালেন। রাজীবলোচন অত্যন্ত সুপুরুষ, অনিন্দ্যোজ্জ্বল গৌরকান্তি, যে-কোনও মেয়েই তার প্রতি আকৃষ্ট হবে।
একসময়ের দুর্দমনীয় তেজী সুলতান বয়সের ভারে এখন অনেক ধীর স্থির। তিনি বললেন, ‘পাঠানের মেয়ে হয়ে সে কিনা শেষে এক হিন্দু বামুনের প্রেমে পড়ল?’
বেগম মুখ টিপে হাসলেন, ‘হিন্দু বামুনের মেয়ে যদি পাঠানের প্রেমে পড়তে পারে, তবে উল্টোটা হতে দোষ কী, শাহেনশাহ!’
সুলেমান কররাণীর মুখে হাসি ফুটে উঠল। উজির ও অন্যান্যদের সঙ্গে পরামর্শ করে স্থির করলেন রাজীবলোচনকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করে জামাতা করবেন।
কিন্তু রাজীবলোচনকে সে-কথা জানাতেই সে বেঁকে বসল। সে নিজের ধর্মকে শ্রদ্ধা করে। সুলতান কন্যাকে বিবাহ করতে সে সম্মত আছে, কিন্তু নিজের ধর্ম পরিবর্তন করবে না।
শেষ পর্যন্ত রাজীবলোচনের সেই কথাও মেনে নেওয়া হল। রাজীবলোচন নিজে তো ধর্ম পরিবর্তন করলই না, বরং সিঁদুর দিয়ে দুলারীকে বরণ করল স্ত্রী রূপে। রাজধানী তন্দা পেরিয়ে বাংলায় ছড়িয়ে পড়ল এই ব্যতিক্রমী বিবাহ সংবাদ।
সুলতান জামাতা রাজীবলোচনকে সিপাহশালার করে দিলেন। রাজীবলোচন নবোদ্যমে সাম্রাজ্যকে আরও শক্তিশালী করতে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
কিন্তু এবার আঘাত এল অন্যদিক থেকে। রাজীবলোচন যবনকন্যাকে বিয়ে করেছে এটা হিন্দু সম্প্রদায়ের কেউ মানতে পারল না। ভাদুড়িয়ায় তার পিতামহ জ্ঞানেন্দ্রনাথ ও পরিবারকে জাতিচ্যুত করা হল।
রাজীবলোচন ভাদুড়িয়ায় ছুটল। কিন্তু সেখানেও তাকে প্রবল অপমানের সম্মুখীন হতে হল। গ্রামবাসীরা চিনতে না পারার ভান করে চলে যেতে লাগল। বিভ্রান্ত হয়ে সে ছুটে গেল গ্রামের চণ্ডীমণ্ডপে। কিন্তু তাকে মণ্ডপে উঠতেই দেওয়া হল না। গ্রামের প্রধান পুরোহিত ও মণ্ডলপতিরা তাকে সাফ জানিয়ে দিলেন যবনকন্যা বিয়ে করায় তার আর হিন্দুধর্মে স্থান নেই। সে ধর্মচ্যুত।
রাজীবলোচন হতচকিত! সে কুসংস্কারাচ্ছন্ন নয়, শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ ধৈর্যসহকারে সবাইকে বোঝাতে চাইল যে বিধর্মী বিয়ে করলে ধর্মচ্যুত হওয়ার বিধান হিন্দু শাস্ত্রে নেই। কিন্তু কেউ তার কথা শুনল না, কুৎসিৎ কথা বলে আরও অপমান করতে লাগল।
দিশেহারা হয়ে সে পিতামহ জ্ঞানেন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে গেলে সেখানেও তাকে নিরাশ হতে হল। জ্ঞানেন্দ্রনাথ সমাজচ্যুত হওয়ার ভয়ে কিছু করতে পারলেন না।
রাজীবলোচন ভদ্রাসনের চৌকাঠ থেকেই তখন দুই পত্নীকে বলল, ‘তোমরা আমার সহধর্মিণী। স্বামীকে অনুসরণ করাই তোমাদের কর্তব্য। চলে এসো আমার সঙ্গে।’
রুপানী নেহাতই শিশু। তবে রূপালী কিশোরী, সে সজলচোখে বলল, ‘মুসলমান সপত্নীর সঙ্গে কী করে থাকব আমরা, স্বামীন? ক্ষমা করুন আমাদের! অনেক অপমানিত হয়েছি এর মধ্যে, আর চাই না!’
রাজীবলোচন নিজে ধর্মজ্ঞানী, সুপণ্ডিত। একলহমায় তার নিজের মানুষরা তাকে ত্যাজ্য করে দেবে, সে কল্পনাও করতে পারেনি। ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে একবার ভাবল তরোয়ালের কোপে চণ্ডীমণ্ডপের সবাইকে কেটে ফেলে। রক্তগঙ্গা বইয়ে দেয় গ্রামে। পরক্ষণে নিজেকে সংবরণ করল। এরা ধর্মান্ধ আচরণ করতে পারে, কিন্তু তার তো বোধবুদ্ধি লোপ পায়নি।
এক বাল্যবন্ধুর পরামর্শে সে স্থির করল ভাদুড়িয়া থেকে সোজা চলে যাবে শ্রীক্ষেত্রে, জগন্নাথ ধামে। জগন্নাথ মহাপ্রভুকে দর্শন করলে মহাপাপীরও পাপ থেকে মুক্তি ঘটে।
যেমন ভাবা, তেমন কাজ। তার সঙ্গে তন্দা থেকে এসেছিল কয়েকজন সুবেদার, তাদের হাতে দুলারী ও সুলতানকে দুটি চিঠি দিয়ে সেই রাতের অন্ধকারে অশ্বপৃষ্ঠে রাজীবলোচন রওনা হয়ে গেল শ্রীক্ষেত্র অভিমুখে।
শ্রীক্ষেত্রের জগন্নাথ মন্দির দেশের অন্যতম জাগ্রত মন্দির। মন্দিরের বিগ্রহের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে নানা পৌরাণিক কাহিনী। সূর্যবংশীয় রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন ভগবান বিষ্ণুর দর্শন পেতে চাইলে এক সন্ন্যাসী তাঁকে নীলমাধব বিগ্রহের কথা বলেন। শতচেষ্টাতেও রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন সেই বিগ্রহ দেখতে না-পেয়ে দুঃখে আত্মহত্যা করতে গেলে দৈববাণী হয়, ‘বিষ্ণুর দারুব্রহ্ম মূর্তি প্রতিষ্ঠা করো রাজা! তাতেই বিষ্ণু প্রকট হবেন।’
দারুব্রহ্ম? রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন বিস্মিত। একের পর-এক দৈবাদেশ হয়। সমুদ্রের ওপর রয়েছে সেই বিশেষ কাঠ যা দিয়ে নির্মাণ করতে হবে মূর্তি। এক বৃদ্ধ ছুতোরশিল্পী অনন্ত মহারাণা রাজাকে প্রতিশ্রুতি দেন, একুশ দিন মন্দিরের দ্বার রুদ্ধ করে তিনি গড়বেন দারুব্রহ্মকে। এর মধ্যে কেউ যেন মন্দিরে প্রবেশ না করে।
কিন্তু রাজা ইন্দ্রুদ্যুম্নের সবুর সয় না। দিন পনেরো পরে খুলে দেন মন্দিরের দ্বার। বিস্মিত দৃষ্টিতে দেখেন সেই বৃদ্ধ নেই। পড়ে রয়েছে অসম্পূর্ণ মূর্তি।
সেই অসম্পূর্ণ রূপেই জগন্নাথ পতিতপাবন হয়ে বিরাজ করেন মন্দিরে। কিছু বছর অন্তর বদলে ফেলা হয় কাষ্ঠমূর্তি। এইভাবেই জগন্নাথের বারবার জন্মান্তর হয়।
কিন্তু পুরীর জগন্নাথধামে হতভাগ্য রাজীবলোচনের জন্য আরও ভয়ানক আঘাত অপেক্ষা করছিল। রোহিণীকুণ্ডে স্নান করে জগমোহন প্রাঙ্গণে সে সাতদিন সাতরাত ধরে প্রার্থনা করতে বসেছিল। মনে মনে জগন্নাথদেবকে বলে চলেছিল, ‘হে প্রভু! আমি জানি না আমি কী পাপ করেছি। তবু যদি সত্যিই আমি কিছু করে থাকি, তার জন্য আমি অনুতপ্ত। আমি প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই। ক্ষমা করুন ঠাকুর।’
রাজীবলোচন তার কাজ শেষ করতে পারল না। সপ্তম দিনে তাকে ঘিরে ধরল ক্রোধে উন্মত্ত পাণ্ডার দল। তন্দা থেকে সংবাদ এসে পৌঁছেছে, এক ম্লেচ্ছ সকলের অজ্ঞাতে প্রবেশ করেছে জগন্নাথ মন্দিরে! ছুটে এসেছেন মন্দিরের প্রধান পাণ্ডা নরসিংহ দয়িতাপতি।
‘এখনই বেরিয়ে যাও। এই মন্দির অতি পবিত্র, হিন্দুতীর্থ শ্রেষ্ঠ, এখানে বিধর্মীর কোন স্থানও নেই।’
‘আমি বিধর্মী নই। আমি বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ।’ মস্তক না নুইয়ে জবাব দেয় রাজীবলোচন।
‘তুই যবন বিবাহ করিসনি? তুই ম্লেচ্ছ নোস তো কে ম্লেচ্ছ? তোর এতবড় স্পর্ধা, লুকিয়ে জগন্নাথধামে ঢুকেছিস?’ চিৎকার করে ওঠেন নরসিংহ।
রাজীবলোচন সজোরে প্রতিবাদ করে, ‘সুলতানের কন্যাকে হিন্দুমতে বিবাহ করেছি। ইসলাম ধর্ম নিইনি। এই দেখুন আমার উপবীত! আহ্নিক, গায়ত্রীমন্ত্র থেকে সূর্য নমস্কার, সব করি।’
‘চুপ কর পাপিষ্ঠ!’ সজোরে রাজীবলোচনের গালে চড় কষান দয়িতাপতি, ‘এইসব করে আমাদের ধর্মকে অপবিত্র করছিস? তোর নরকেও স্থান হবে না!’
প্রচণ্ড সেই চপেটাঘাত যত না রাজীবলোচনকে আহত করে, অপমানিত করে তার সহস্রগুণ বেশি। পাণ্ডার দল তাকে কটূক্তি করে। ছিঁড়ে দেয় তার উপবীত। বলপ্রয়োগে তাকে মন্দির থেকে বের করে দেওয়া হয়।
সেইদিন লাঞ্ছিত অপমানিত রাজীবলোচন প্রতিজ্ঞা করে, মূর্তিসর্বস্ব এই ধর্মকে সে শেষ করে দেবে। তার এত অপমানেও জগন্নাথ নীরব রইলেন?
ক্রোধে দিকবিদিকজ্ঞানশূন্য রাজীবলোচন তন্দায় ফেরে। স্বেচ্ছায় সমস্ত আচার মেনে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। তিনবার কলমা পড়ে নতুন নাম নেয় মহম্মদ ফারমুলী। শেখে কী করে পড়তে হয় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ। আয়ত্ব করে আরবি ভাষা।
তার ভেতরে আগুন হয়ে ফুটছে প্রতিহিংসা। একটাই সঙ্কল্প—কুসংস্কারাচ্ছন্ন হিন্দুত্ববাদকে চিরতরে ধ্বংস করতে হবে।
অতঃপর গোটা বঙ্গে শুরু হয়েছে মহম্মদ ফারমুলীর ধ্বংসলীলা। দীর্ঘদেহী হলেও আগে তার চেহারায় কমনীয়তা ছিল, এখন প্রতিহিংসার আগুনে সেই সৌন্দর্য কোথায় হারিয়ে গেছে। মূর্তিমান দানবের মতো কালো আচকান পরে, মাথায় শিরস্ত্রাণ এঁটে সে যখন ঘোড়ায় চেপে ধুলো উড়িয়ে আসে, মানুষ দুধারে ভয়ার্ত হরিণের মতো পালায়।
সে এখন গোটা বাংলার ত্রাস, তার নামই হয়ে গেছে কালাপাহাড়।
কালাপাহাড় এখন সুলতানের প্রধান সেনাপতি। সুলতান নিজেও আগ্রাসী ছিলেন, তবে কালাপাহাড়ের মতো হিংস্র নয়। কালাপাহাড়ের লক্ষ্য যেন রাজ্যের সীমানা বিস্তার নয়, সে চায় বেছে বেছে হিন্দুরাজ্য আক্রমণ করতে।
হিন্দুনগরীগুলি দখল করেই সে আগুন ধরিয়ে দিতে আদেশ করে, তারপর সিপাহীরা ঝাঁপিয়ে পড়ে হিন্দুরমণীদের ওপর। সেই পৈশাচিক অত্যাচার থেকে শিশু, যুবতী, বৃদ্ধা কারো নিস্তার নেই!
দুলারী বেগম তো বটেই, স্বয়ং সুলতানও কালাপাহাড়ের এই উন্মত্ততা নিয়ে গভীর দুশ্চিন্তায়। সুলতান নিজেও একসময় হিন্দু বিদ্বেষী ছিলেন। কিন্তু পরে অনেক উদার হয়েছেন। হিন্দু প্রজারাও নিরাপত্তা আবার ফিরে পেতে শুরু করেছিল, কিন্তু কালাপাহাড়ের ভয়ংকর মানসিকতা হিন্দুদের আবার বিক্ষুব্ধ করে তুলছে।
সুলতান চিন্তান্বিত অবস্থায় বসেছিলেন।
এই সময় এক হাবসী প্রজা এসে খবর দিল, ‘জাহাঁপনা, সিপাহশালার আসছেন দেখা করতে।’
কালাপাহাড় এসেই সেলাম ঠোকে, ‘সালাম আলাইকুম হুজৌর! একটা দরখোয়াস্ত ছিল।’
‘দরখোয়াস্ত!’
‘জি হুজৌর, আমি উৎকল আক্রমণ করতে চাই। যদি সুলতান মেহেরবানি করে ইজাজত দেন, বান্দা বহত খুশ হবে।’
সুলতান চমকে ওঠেন, ‘উৎকল? না কালাপাহাড়, বারবার একই হারের শরমিন্দা হতে আমি রাজি নই। দায়ুদকেও বুঝিয়েছি। আর যে দেশেই তুমি আক্রমণ করো, আমার অমত নেই। জানো তো, দিল্লির বাদশাহ তোমাকে চাইছেন সেনাপতি হিসেবে। আমার তাতেও আপত্তি নেই। কিন্তু উৎকলে হামলা করো না।’
কালাপাহাড়ের মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। সে বিড়বিড় করল, ‘তা কী করে হয় সুলতান! উৎকলই যে আসল! হাজার হাজার হিন্দু পুতুলের আখড়া। জগন্নাথের ধাম!’
সুলতান পরিষ্কার শুনতে পান না। বলেন, ‘কিছু বলছ ফারমুলী?’
‘না হুজোর।’ কঠিন কণ্ঠে বলে কালাপাহাড়, ‘আপনি শেষ মওকা দিন, কথা দিচ্ছি উৎকল আমি জয় করবই। রাজা মুকুন্দদেবের মুণ্ডু আপনার পায়ে আমি ভেট দিতে চাই!’
সুলতান তবু রাজি নন। খানিকটা নিশ্চিত পরাজয়, ক্ষয়-ক্ষতির কথা ভেবে, বাকিটা কলাপাহাড়ের পাগলপন্তির জন্য দুদিকে মাথা নাড়তে থাকেন। কিন্তু কালাপাহাড় নাছোড়বান্দা। পুরোনো ঘা খুঁচিয়ে দিতে থাকে, ‘হুজুর! আপনি কবরে শুয়েও বারবার আফসোস করবেন। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও উৎকলের ওপর আপনি হামলা করেননি বলে।’
‘আঃ! তুমি বুঝতে পারছ না ফারমুলী! মুকুন্দদেব ভয়ানক ধূর্ত! আগেরবার পুরো তাকত দিয়েও…!’
‘গুস্তাকি মাফ করবেন হুজৌর, কিন্তু আগেরবার আপনার কাছে ফারমুলী ছিল না। এই মওকা ছাড়বেন না হুজোর। না-হলে ওই হিন্দু ব্রাহ্মণের কাছে আপনাকে সারাজীবন হেরে থাকতে হবে। আপনি বেহেস্তে গিয়েও শুকুন পাবেন না হুজৌর, এই খোয়ায়েশ আপনাকে বেচ্যায়েন করে তুলবে!’
সুলতান দোনোমনা করতে করতে রাজী হয়ে গেলেন। ঠিকই, আগের দুবার তো কালাপাহাড় ছিল না, ওর তেজকে উৎকল চেনে না। ওর রণকৌশল সম্পর্কেও কেন ধারণা নেই।
তিনি বড় শ্বাস ফেললেন, ‘বেশ। ইজাজত দিলাম। কিন্তু কীভাবে এগোবে ভেবেছ?’
‘জি সুলতান!’ কালাপাহাড় উত্তর দেয়, ‘আমি সিধা ঢুকব ওদের রাজধানী জাজপুরে। ছারখার করে দেব সব।’
‘জাজপুর?’ সুলতান বিস্মিত, ‘কোনদিক দিয়ে ঢুকবে?’
‘কেন মল্লভূমের সীমান্ত দিয়ে!’
‘মল্লভূম? সে তো স্বাধীন অরণ্যরাজ্য! তারা ইজাজত দেবে কেন!’ সুলতান বললেন, ‘নাকি সেই রাজ্যও আক্রমণ করবে?’
‘করব তো বটেই, সে-দেশেও মন্দিরের ছড়াছড়ি। কিন্তু যাওয়ার সময় নয়। আগে উৎকল, তারপর দেখা যাবে।’ কালাপাহাড় ক্রুর হাসি হাসল, ‘চর পাঠিয়েছি। পাক্কা আদমি, সব খবর নিয়ে আসবে। মল্লরাজার সব দুশমনদের একজোট করতে হবে না?’
‘উৎকলের মতো বিরাট রাজ্যে হামলা করবে, মল্লভূমে জাসুস পাঠিয়েছ!’ সুলতান অবাক দৃষ্টিতে তাকান, ‘কিঁউ? ওদের তো আমরা একতুড়িতে দখল করতে পারি।’
কালাপাহাড় চুপ করে থাকে। তারপর লম্বা সেলাম ঠুকে বেরিয়ে যায়।