এক ডজন একজন — মুহম্মদ জাফর ইকবাল
১. যখন একটি বাসা দেখতে খুবই সাধারণ কিন্তু আসলে সেটি অসাধারণ
বাসাটা দেখে প্রথমে কেউই বুঝতে পারবে না যে এটা অত্যন্ত বিচিত্র একটা বাসা। বাইরে থেকে দেখতে এটা খুবই সাধারণ। হালকা হলুদ রঙের চারতলা একটা বিল্ডিং, পাশে বেশ খানিকটা খালি জায়গা, সেখানে নানা সাইজের গাছ। কিন্তু কেউ যদি একটু খুঁটিয়ে দেখে তাহলেই তার মনের ভিতরে নানারকম খটকা লাগতে শুরু করবে। যেমন বাসার গেটের পাশে কালো রঙের গ্রানাইট পাথরে রূপালি অক্ষরে খুব সুন্দর করে লেখা আছে, খা খা খা বক্কিলারে খা! একটা বাসার সামনে কেন এই কথাগুলো লেখা থাকবে সেটা নিয়ে যে কোনো মানুষের মনে সন্দেহ হতে পারে। আসলে এটা এই বাসার নাম।
মানুষ বাসার নাম রাখে নাহার মঞ্জিল কিংবা চৌধুরী ভিলা। যারা আধুনিক তারা নাম রাখে ব্ল্যাকবেরী কিংবা সানথিলা। যাদের ভেতরে একটা কবি কবি ভাব আছে তারা নাম রাখে নিশীথে কিংবা বনলত। তাই বলে খা খা খা বৰ্কিলারে খা? এটা কী কখনো একটা বাসার নাম হতে পারে? এই বাসার মানুষগুলোর সাথে সেটা নিয়ে কথা বলে লাভ নেই, একটা বাসার নাম যে খা খা খা বৰ্কিলারে খা হতে পারে না সেটা তারা জানেই না। বাংলার একজন প্রফেসর তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন যে বকিলা বলে কোনো শব্দ নেই, শব্দটা বখিল বা কৃপণ। সাপুড়েরা সাপের খেলা দেখানোর সময় যারা পয়সা দিতে চায় না তাদেরকে ভয় দেখানোর জন্য এটা বলে। কিন্তু এই বাসার মানুষগুলোর শব্দের অর্থ বা উচ্চারণ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই, একটা কথা তাদের পছন্দ হয়েছে, ব্যাস, সেটা দিয়েই তাদের বাসার নাম রেখে ফেলেছে।
বাসাটা যদি কেউ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে তাহলে তার ভেতরে আরো কিছু বিষয় নিয়ে খটকা লাগতে পারে। যেমন ধরা যাক সবচেয়ে বড় গাছের ওপরে কাঠ, বাঁশ প্লাইউড এবং প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি ঘরটার কথা। কেন। একটা গাছের উপর ঘর সেটা এমনিতে কেউ বুঝতে পারবে না, কিন্তু যারা এই বাসা আর বাসার মানুষজনকে চিনে তারা জানে এই বাসার একজন একবার ঠিক করেছিল যে সে তার বাকি জীবন গাছের উপর কাটিয়ে দিবে। এবং সেজন্যে গাছের উপর এই ঘরটা তৈরি করা হয়েছিল। অন্য কোনো কারণ নয় গাছের উপর থেকে বাথরুম করার অসুবিধের জন্যে শেষ পর্যন্ত এই অসাধারণ পরিকল্পনাটা বাতিল করতে হয়েছিল।
যদি কেউ আরেকটু এগিয়ে এসে আরেকটু ভালো করে লক্ষ্য করে তাহলে দেখবে দোতালা থেকে একটা মোটা দড়ি একটা গাছের মগডালে বেঁধে রাখা হয়েছে। বাইরের মানুষজন কোনোদিন কল্পনাও করতে পারবে না এই বাসার সবচেয়ে দুষ্টু ছেলেটা এই দড়ি ধরে ঝুলে গাছের মগডালে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। সত্যি সত্যি সে পৌঁছেও গিয়েছিল কিন্তু নিজেকে সামলাতে না পেরে প্রচণ্ড বেগে সে গাছের ডালে ধাক্কা খেয়েছিল। সেই ধাক্কায় তার সামনের দুটো দাঁত এবং নাকের হাড়টা ভেঙ্গে গিয়েছিল। সামনের দুটো দাঁত আবার উঠেছে কিন্তু নাকের হাড়টা আর জোড়া লাগেনি বলে তার নাকটা একটু বাঁকা। সেটা নিয়ে কেউ খুব বেশি দুশ্চিন্তা করে না। কারণ সবাই জানে সে যখন আস্তে আস্তে আরো বড় হবে তখন নাকের হাড় থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস ভেঙ্গেচুরে যাবে, কেটে-কুটে যাবে, ঝলসে এবং পুড়ে যাবে। এই বাসার মানুষজন জানে যে এই অসাধারণ দুষ্টু, ছেলেটির দুষ্টুমির ঘটনাগুলো ছবি তুলে কিংবা ভিডিও করে রাখা দরকার, কারণ এরকম অকাট্য প্রমাণ না দিলে ভবিষ্যতে কেউ বিশ্বাস করবে না যে একজন মানুষের মাথা থেকে এরকম বিচিত্র দুষ্টুমির আইডিয়া বের হতে পারে। পৃথিবীতে গণিত কিংবা বিজ্ঞানের অলিম্পিয়াড হয় দুষ্টুমির অলিম্পিয়াড হলে এই দুষ্টু বাচ্চাটি দেশের জন্যে অনেকগুলো গোল্ড মেডেল নিয়ে আসতে পারতো।
কেউ যদি এই বিচিত্র বাসাটা আর তার এক পাশের ফাঁকা জায়গাটা আরো ভালো করে লক্ষ্য করে তাহলে সে আরো বিচিত্র কিছু জিনিস দেখতে পাবে। যেমন ফাঁকা জায়গাটার মাঝামাঝি একটা বিদঘুটে গর্ত দেখে সে অবাক হয়ে ভাবতে পারে কেন এটা করা হয়েছিল। এটাও একটা পরিত্যক্ত প্রজেক্ট, একটা কুমিরকে পোষার জন্যে এখানে একটা পুকুর খোদাই করার চেষ্টা করা হয়েছিল। সেই পুকুরে প্রচুর পানি আর লবণ ঢালা হয়েছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত কুমিরের বাচ্চা জোগাড় করা যায়নি বলে এই প্রজেক্টটা বাতিল করতে হয়েছিল। এই গর্তটাকে কী কাজে লাগানো যায় সেটা নিয়ে এই বাসার মানুষজন মাঝে মাঝেই চিন্তা ভাবনা করে। এখন পর্যন্ত যতগুলো প্রস্তাব এসেছে তার মাঝে সবচেয়ে ভালো প্রস্তাবটি দিয়েছেন এই বাসার সবচেয়ে বয়স্ক মানুষটি। তার নাম রাহেলা খাতুন কিন্তু তাকে এই নামে ডাকার মতো কেউ নেই। তার ছেলে মেয়ে এবং ছেলের বউ আর মেয়ের জামাইরা তাকে মা বলে ডাকে। তার নাতি নাতনিদের তাকে দাদি কিংবা নানি ডাকার কথা, কিন্তু তারা নানি দাদি ডাকার পাশাপাশি মাঝে মাঝেই তাকে মা ডেকে ফেলে। যদিও রাহেলা খাতুনের অনেক বয়স হয়েছে কিন্তু তার চেহারায় মোটেও বয়সের ছাপ পড়েনি, তার মাথার চুল এখনো কালো, মুখের চামড়া মসৃণ এবং দাঁতগুলো ঝকঝকে। যারা তাকে চেনে না তারা তাকে তার ছেলে মেয়ের বড়বোন বলে সন্দেহ করে।
বাসার সামনে এই বিদঘুটে গর্তটাকে কী কাজে লাগানো যায় সেটা নিয়ে যখন আলোচনা হচ্ছিল তখন রাহেলা খাতুন তার নাতি নাতনিদের বলেছিলেন, আমি মরে গেলে তোরা এই গর্তে আমাকে পুতে ফেলিস।
রাহেলা খাতুন হাল্কা পাতলা হাসি খুশি মানুষ তার শরীরে কোনো রোগ বালাই নেই। তার নাতি নাতনিরা তাকে অসম্ভব পছন্দ করে, রাহেলা খাতুন কোনো একদিন মরে যাবেন সেটা তারা কল্পনাও করতে পারে না। তারপরেও তারা গজ ফুট ফিতে দিয়ে তাকে মেপে দেখে বের করেছে যে রাহেলা খাতুন যদি তার পাগুলো ভাঁজ করে উত্তর পূর্ব থেকে দক্ষিণ পশ্চিমে কোনাকোনি ভাবে কবরস্থ হতে রাজি থাকেন তাহলে তাকে বাসার পাশে এই গর্তে পুতে ফেলা সম্ভব। রাহেলা খাতুন একশর্তে হাসিমুখে পা ভাঁজ করে কোনাকুনি ভাবে কবরস্থ হতে রাজি হয়েছেন, শর্তটি হলো তার কবরের ভেতর একটা টিউব লাইট লাগিয়ে দিতে হবে। অন্ধকার কবরের কথা চিন্তা করলেই তার নাকী ভয়ে বুক ধ্বক ধ্বক করতে থাকে। রাহেলা খাতুনের নাতি নাতনিরা বলেছে শুধু টিউব লাইট নয় তারা চার্জার সহ একটা মোবাইল টেলিফোনও কবরের ভিতরে দিয়ে দেবে। রাহেলা খাতুন ইচ্ছে করলেই কবরের ভেতর থেকে তার নাতি নাতনিদের মিসকল দিতে পারবেন, এবং তখন তারা ফোন করে তার খোঁজ খবর নেবে।
বাইরের মানুষের অবশ্যি এই ভেতরের খবরগুলো জানার কথা না, তাই তারা এই গর্তটা দেখে বড়জোর একটু অবাক হতে পারে তার বেশি কিছু নয়। তবে তারা যদি আরেকটু ভালো করে লক্ষ্য করে তাহলে অবাক হবার মতো আরো কিছু বিষয় পেতে পারে। যেমন খোলা জায়গাটার এক কোনায় অনেকটুকু জায়গা জুড়ে যে পোড়া দাগটা আছে, তাদের মনে সন্দেহ হতে পারে এটা কোথা থেকে এসেছে! এই বাসার যে বাচ্চাটির মাথায় বৈজ্ঞানিক আইডিয়া গিজগিজ করছে সে তার রকেট তৈরি করার জন্যে যে জ্বালানী আবিষ্কার করেছিল সেটার প্রথম পরীক্ষাটি এখানে করার চেষ্টা করা হয়েছিল। তখন সেখানে দাউ দাউ করে যে আগুন লেগেছিল সেটা এই এলাকার মানুষজন অনেকদিন মনে রাখবে।
মানুষজন যদি কৌতূহলী হয়ে আরো ভালো করে লক্ষ্য করে তাহলে তারা দেখবে একটা গাছের ডাল থেকে একটা মরা কাক ঝুলছে। কেন্দ্র একটা মরা কাক গাছ থেকে ঝুলছে সেই কারণটা কেউ জানে না, যে ঝুলিয়েছে সে নিজেও জানে না। তবে এটা ঝোলানোর পর দুইদিন এই এলাকার মানুষ কাকের কা কা চিৎকারে এক মুহূর্তের জন্যেও শান্তিতে থাকতে পারে নাই।
ভালো করে লক্ষ্য করলে মানুষজন এখানে দুটি ছাগলকে ঘুরে বেড়াতে দেখবে, একটির রং সবুজ অন্যটির গোলাপি। ছাগলের রং কখনোই সবুজ বা গোলাপি হতে পারে না তাই এটা অনুমান করা মোটেও কঠিন নয় যে এই দুটো ছাগলকে রং করা হয়েছে। কোরবানীর জন্যে ছাগল দুটো কেনা হয়েছিল কিন্তু বাচ্চাদের এই ছাগল দুটোর জন্যে মায়া পড়ে যাওয়ায় শেষ পর্যন্ত সেগুলোকে জবাই করা হয়নি। এই অংশটুকু বোঝা সম্ভব কিন্তু কেন ছাগল দুটোকে রং করতে হলো সেটা কারো পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। একটু ভালো করে লক্ষ্য করলে একটা বাঘের বাচ্চাকেও ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়, এই বাসার গাছ গাছালীর ভেতর একটা আস্ত রয়েল বেঙ্গল টাইগার ঘুরে বেড়াচ্ছে সেটা দেখে যে কেউ অবাক হয়ে যেতে পারে। কিন্তু একটু ভালো করে লক্ষ্য করলেই বোঝা যায় এটা মোটেও বাঘ নয়, এটা একটা বিড়াল। হলুদের উপর কালো ডোরাকাটা দাগ দেখে এটাকে প্রথমে বাঘের বাচ্চা মনে হলেও এটা মিউ মিউ করে ডাকে এবং এর ভেতরে বাঘের কোনো তেজ নেই। এই বাসার মানুষজন কেন একটা বিড়ালকে ধরে রং করে বাঘের বাচ্চা বানানোর চেষ্টা করেছে সেটা কেউ কখনো বুঝতে পারে নাই।
বিকেল বেলার দিকে এলে বাচ্চা কাচ্চাদের চেঁচামেচি এবং হই চই শুনে যে কেউ চমৎকৃত হবেন। শুধু এই বাসার বাচ্চারা নয়, তখন পাড়ার সব বাচ্চারা এখানে এসে হাজির হয়। এই ভোলা জায়গায় নানারকম খেলা চলতে থাকে, তবে সবচেয়ে দর্শনীয় হয় ফুটবল খেলা। মানুষজন সাধারণত ফাঁকা মাঠে ফুটবল খেলে কিন্তু এখানে ছোট বড় অনেক গাছের ফাঁকে ফাঁকে ফুটবল খেলা হয়। এখানে ফুটবল খেলার উত্তেজনা অনেক বেশি কারণ, খেলার সময় ফুটবল যে কোনো সময় যে কোনো গাছে লেগে সম্পূর্ণ উল্টো দিকে চলে যেতে পারে। কেউ যদি এই মাঠের ফুটবল খেলাটা ভালো করে লক্ষ্য করে তাহলে তারা অবাক হয়ে আবিষ্কার করবে যে এখানে মানুষের পায়ে লেগে যত গোল হয়েছে তার থেকে অনেক বেশি গোল হয়েছে গাছের গুঁড়িতে বল লেগে। শুধু যে বল গাছে ধাক্কা খায় তা নয়, যারা ফুটবল খেলছে তারাও যে কোনো সময় যে কোনো গাছে ধাক্কা খেয়ে উলটে পড়তে থাকে। যারা গোলকিপারের দায়িত্বে থাকে তারা সুবিধেজনক উত্তেজনায় গোলকিপাররা মাঝে মাঝে মাঠের মাঝখানে চলে যায় তখন হঠাৎ করে বল চলে এলে তারা কাছাকাছি যে কোনো দুটো গাছ দিয়ে গোলপোস্ট তৈরি করে নেয়। যারা ফুটবল খেলে তারা এসব ছোটখাটো খুঁটিনাটি নিয়ে মাথা ঘামায় না। মাঠের দুই পাশে দুটো গোলপোস্ট নিয়ে খেলা শুরু হলেও একবার মাঠের একই দিকে দুটো গোলপোস্ট চলে এসেছিল সেরকম উদাহরণও আছে। এখানে ছেলেরা এবং মেয়েরা সমান ভাবে ফুটবল খেলে। ছোট বড় মাঝারী যে কোনো সাইজের প্লেয়ার চলে এলেও তাকে নিয়ে নেয়া হয়। এখানে যারা খেলে এবং যারা খেলা দেখে সবাই সমানভাবে আনন্দ পায়। খেলার মাঠের দিকে মুখ করে থাকা চারতলা দালানের একতালার জানালার সবগুলো কাঁচ যে ভাঙা তার সাথে এই ফুটবল খেলার একটা সম্পর্ক আছে।
যারা শুধু বাইরে থেকে এই বাসাটি দেখে চোখ কপালে তুলে চলে যায় তারা অবশ্য কল্পনাও করতে পারবে না বাসার ভেতরে কী ঘটছে। তবে তারা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারবে, ভেতরের মানুষগুলো নিশ্চয়ই খুব বিচিত্র। তা না হলে একটা বাসায় এরকম ঘটনা কেমন করে ঘটতে পারে। তাদের ধারণা সত্যি, এই বাসার ভেতরের মানুষগুলো বাসাটির মতোই বিচিত্র।
এই বাসায় রাহেলা খাতুন তার ছেলেমেয়ে আর নাতি নাতনিদের নিয়ে থাকেন। জমিটা তার স্বামী বহু বছর আগে কিনে রেখে গিয়েছিলেন। কোনোদিন এখানে ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকতে পারবেন ভাবেননি। তার প্রধান কারণ জমিটা যখন প্রথম কেনা হয় তখন সেটা ছিল সাতফুট পানির নিচে। কোনো একদিন সেটা ভরাট করা হবে এবং সেখানে বাড়িঘর করা হবে কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি। রাহেলা খাতুনের স্পষ্ট মনে আছে তিনি কীভাবে তার এই জমিটা দেখতে গিয়েছিলেন।
রাহেলা খাতুনের স্বামীর নাম ছিল আসাদ রহমান, সরকারি ব্যাংকে ছোট একটা চাকরি করতেন। তাদের খুব টানাটানির সংসার, বিয়ের পর দেখতে দেখতে তিনটা বাচ্চা হয়ে গেছে। এর মাঝে আসাদ ব্যাংক থেকে টাকা ধার করে কোন দুনিয়ায় একটা জমি কিনে ফেললেন। জমি কেনার পর থেকে তার উৎসাহে মাটিতে পা পড়ে না। তাই একদিন রাহেলা খাতুনকে সেই জমি দেখাতে নিয়ে গেলেন। রাহেলা খাতুন তার একমাত্র সিল্কের শাড়ি পরে সেজে গুঁজে জমি দেখতে গেলেন। সাথে তার তিন ছেলে মেয়ে। বড়জন ছেলে, নাম মাসুদ, তার বয়স পাঁচ, দ্বিতীয়জন মেয়ে, নাম মিলি, তার বয়স তিন এবং ছোটজন ছেলে, নাম মতিন, বয়স মাত্র এক।
প্রথমে বাসে করে যেতে হলো এবং বাসে বমি করতে করতে বড় ছেলেটি নেতিয়ে গেল। বাস থেকে নেমে রিকশা, রিকশা থেকে নেমে পায়ে হেঁটে যেতে হলো আরো কয়েক কিলোমিটার। রাহেলা খাতুনের কোলে ছোট জন, বড় দুইজন আসাদের সাথে, একজন ঘাড়ে আরেকজন কোলে। কাদামাটির রাস্তায় পিছল খেতে খেতে হেঁটে একটা বিশাল জলাভূমির সামনে দাঁড়িয়ে আসাদ বললেন, এই যে আমাদের জমি।
রাহেলা খাতুন বললেন, জমি কোথায়? এইটা তো দেখি পানি।
আসাদ বললেন, সেই জন্যেই তো সস্তায় পেয়ে গেলাম। শুকনা হলে কী আমার মতন মানুষ জমি কিনতে পারে?
রাহেলা খাতুন মাথা নাড়লেন, আসাদ এই কথাটা সত্যি বলেছে। জিজ্ঞেস করলেন, কোনখানে আমাদের জমি?
আসাদ মাথা চুলকে বললেন, শীতের সময় যখন পানি নেমে যাবে তখন দেখা যাবে। এখন পানির নিচে।
তবুও তো জায়গাটা দেখি। কোন জায়গায় পানির নিচে?
আসাদ আবার মাথা চুলকালেন, তারপর হাত তুলে দেখিয়ে বললেন, ঐ যে মাদারগাছটা দেখছো, মনে কর তার কুড়ি গজ দক্ষিণে।
রাহেলা খাতুন মাদারগাছ চিনেন না, কুড়ি গজ কতটুকু সেটা আন্দাজ করতে পারেন না, উত্তর দক্ষিণ কোন দিকে হয় সেটাও জানেন না কাজেই কিছুই বুঝলেন না। তবুও স্বামীকে খুশি করার জন্য বললেন, ও! বুঝেছি।
ঠিক তখন সেই পানির উপর দিয়ে একটা কাক উড়ে যাচ্ছিল এবং উড়ে যেতে যেতে সেই কাক পানিতে বাথরুম করে ফেললো। আসাদ তখন মহা উৎসাহে বললেন, দেখেছ? দেখছ? কাকটা যে বাথরুম করেছে দেখেছ?
রাহেলা খাতুন মাথা নাড়লেন, বললেন, দেখেছি।
যেখানে বাথরুম হয়েছে সেখানে আমাদের জমি।
আসাদ হাসি হাসি মুখে সাতফুট পানির নিচে তার জমির দিকে তাকিয়ে রইলেন। রাহেলা খাতুনকে বললেন, বুঝলে রাহেলা, নিজের এক টুকরা জমি থাকতে হয়। সেই মাটির উপর একটা ছাদ তৈরি করে এক ছাদের নিচে সবাইকে থাকতে হয়।
রাহেলা খাতুনের একবার মনে হলো আসাদকে মনে করিয়ে দেন যে মাটির কোনো নিশানা নাই, পুরোটাই পানির নিচে কিন্তু তিনি সেটা করলেন না। মানুষটা এত উৎসাহ নিয়ে দেখাচ্ছে এখন এই সব ছোটখাটো বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানো ঠিক হবে না। আসাদ কাকের বাথরুম করা পানির দিকে তাকিয়ে থেকে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, একদিন আমি এইখানে বাড়ি তুলবো। সাত তালা বাড়ি। সেই সাত তালার নিচ তলায় থাকব তুমি আর আমি। দুই বুড়াবুড়ি। আর একেক তালায় থাকবে আমাদের একেক ছেলে মেয়ে।
রাহেলা খাতুন ভয়ে ভয়ে বললেন আমাদের ছেলে মেয়ে তো তিনজন।– আসাদ এক গাল হেসে বললেন, এখন তিনজন বলে সবসময় তিনজনই থাকবে নাকী? আমাদের আরো বাচ্চা কাচ্চা হবে না?
আরো হবে?
হ্যাঁ। কম পক্ষে ছয় জন। ঘর ভর্তি বাচ্চা কাচ্চা না হলে ভালো লাগে না।
ঠিক এই সময় তাদের বড় ছেলে মাসুদ রাহেলা খাতুনের শাড়ির আঁচল টেনে বলল মা।
রাহেলা খাতুন বললেন, কী হয়েছে?
মিলি-
মিলি তার মেয়ের নাম। জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে মিলির?
মিলি নাই।
রাহেলা খাতুন চমকে তাকিয়ে দেখেন সত্যি সত্যি মিলি নাই। তার মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল, আতংকে চিৎকার দিয়ে বললেন, কোথায় মিলি?
মাসুদ বরাবরই শান্ত স্বভাবের। সে খুবই শান্তভাবে পানির দিকে তাকিয়ে বলল, ঐ যে।
রাহেলা খাতুন দেখলেন, সামনে খোলা পানি সেখানে মিলি ডুবে যাচ্ছে। রাহেলা খাতুন সাথে সাথে পানিতে ঝাঁপ দিলেন।
তার কোলে ছিল ছোট ছেলে মতিন, তাকে মাটিতে রেখে নাকী তাকে নিয়েই পানিতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন তার মনে নাই। তার চেয়ে বড় কথা তিনি যে সাঁতার জানেন না তখন সেটাও তার মনে ছিল না। ভাগ্যিস সেখানে বেশি পানি ছিল না তাই মিলিকে টেনে তুলে ফেলেছিলেন, আসাদ তখন তাদের দুজনকে টেনে তুললেন। মিলি খক খক করে কাশতে লাগলো, রাহেলা খাতুন তার চুলের মুঠি ধরে ঝাকুনী দিয়ে বললেন, পাজি মেয়ে, তোকে পানির কাছে যেতে কে বলেছে?
রেগে একটা চড় দিতে যাচ্ছিলেন, আসাদ মেয়েটাকে টেনে সরিয়ে নিয়ে বললেন, আহা-হা-মারছ কেন?
মারব না তো মাথায় তুলে রাখব? আদর দিয়ে দিয়ে তুমি বাচ্চাগুলোকে নষ্ট করেছ।
আসাদ দুর্বল ভাবে হেসে বললেন, বাচ্চাদের আদর না করলে কাদের আদর করব?
সেদিন গভীর রাতে কাদামাখা অবস্থায় সবাই বাসায় ফিরে এসেছিলেন। রাহেলা খাতুন তার কাদামাখা সিল্কের শাড়িটা ধুয়ে পরিষ্কার করতে চেষ্টা করেছিলেন। খুব লাভ হয় নাই, তার সখের একমাত্র সিল্কের শাড়িটার রং উঠে বিতিকিচ্ছি হয়ে গিয়েছিল। আসাদ তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন চিন্তা করো না রাহেলা। ঈদের বোনাসটা পেলেই তোমাকে নতুন একটা সিল্কের শাড়ি কিনে দেবো।
সেই শাড়ি আর কিনে দেয়া হয় নাই। তিন ছেলে মেয়ে নিয়ে টানাটানির সংসার, দুই বেলা খাওয়ার জোগাড় করতেই হিমশিম অবস্থা সিল্কের শাড়ি কেনার সময় কোথায়? তার মাঝেই আসাদ তার সাত তালা বাড়ির স্বপ্ন দেখতেন। কীভাবে সেই বাড়ি হবে কেউ জানে না, কিন্তু স্বপ্ন দেখতে তো দোষ নেই। নিজের এক টুকরো জমি সেখানে নিজের একটা বাড়ি, সেটা কীভাবে কীভাবে জানি তার মাথায় মাঝে ঢুকে গেল।
.
নিজের জায়গা ব্যাপারটা আসাদ যে কতো গুরুত্ব দিয়ে নিয়েছিলেন সেটা বোঝা গেল একাত্তর সালে। যখন যুদ্ধ শুরু হলো তখন একদিন রাত্রে আসাদ বলল, বুঝলে রাহেলা, নিজের জায়গা না হলে জীবনের কোনো দাম নাই। সবার আগে দেশ স্বাধীন করতে হবে, তারপরে অন্য কথা।
রাহেলা খাতুন ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন করে দেশ স্বাধীন হবে?
যুদ্ধ করে।
রাহেলা খাতুনের বুক কেঁপে উঠল, যুদ্ধ করে?
হ্যাঁ।
কে যুদ্ধ করবে?
সবাই করবে। আমিও করব।
রাহেলা খাতুন ফ্যাকাসে মুখে বললেন, তুমি কেমন করে করবে? তুমি তো নিজে থেকে একটা মুরগিও জবাই করতে পার না।
আসাদ মুখ শক্ত করে বললেন, মুরগি জবাই করা এক জিনিস আর যুদ্ধ করা অন্য জিনিস।
রাহেলা খাতুন ফ্যাকাসে মুখে বললেন, তুমিও যুদ্ধে যাবে?
আসাদ মাথা নাড়লেন। রাহেলা খাতুন বললেন, আমাদের কী। হবে?
অন্য সবার যা হয় তোমাদের তাই হবে।
কিন্তু
কিন্তু কী?
রাহেলা খাতুন মাথা নিচু করে বললেন, আমার যে পেটে বাচ্চা।
আসাদের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, হাতে কিল দিয়ে বললেন, আমার একটা ছেলের জন্ম হবে স্বাধীন দেশে।
রাহেলা খাতুন অবাক হয়ে আসাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। সেই আসাদ সত্যি সত্যি একদিন যুদ্ধে চলে গেলেন।
.
একদিন দেশ স্বাধীন হলো, একজন একজন করে সবাই ফিরে এল শুধু আসাদ ফিরে এলেন না। রাহেলা খাতুন ঘরের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকতেন, খুট করে শব্দ হলেই ছুটে যেতেন দেখার জন্যে, ভাবতেন আসাদ এসেছেন। আসাদ আর কোনো দিনই ফিরে এলেন না। মানুষটা একেবারেই হারিয়ে গেল, যেন আসাদ নামে এই পৃথিবীতে কেউ কখনো ছিল না।
রাহেলা খাতুনের আসাদের জন্যে যতটুকু দুঃখ হয়েছিল তার থেকে অভিমান হয়েছিল অনেক বেশি, কেন মানুষটা তাকে এভাবে একা ফেলে রেখে চলে গেল? কেন কোনোদিন ফিরে এল না?
একদিন ছোট ছেলেটার জন্ম হলো, আসাদ যেরকম কল্পনা করেছিলেন ঠিক সেরকম স্বাধীন একটা দেশে। দেশটা স্বাধীন কিন্তু সেই দেশে বেঁচে থাকা খুব কঠিন। নূতন বাচ্চাটার নাম রেখেছেন জয়, ফুটফুটে একটা বাচ্চা কিন্তু তার মুখের দিকে তাকানোর সময় পান না। চারটা ছোট ছোট বাচ্চাকে নিয়ে বেঁচে থাকার জন্যে রাহেলা খাতুন যুদ্ধ শুরু করলেন। যে বাসায় থাকতেন সেই বাসাটা ছেড়ে বস্তির মতো একটা জায়গায় উঠে এলেন। এক ঘরে সবাই গাদাগাদি করে থাকেন বড় ছেলেটা মাঝে মাঝে বলে মা, লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে টেম্পোর হেলপার হয়ে যাই।
রাহেলা খাতুন বলতেন, খবরদার। তোর বাপ তোদের টেম্পোর হেলপার হওয়ার জন্যে জন্ম দেয় নাই।
রাহেলা খাতুন তার হাতের গয়না একটা একটা করে বিক্রি করে দিলেন। পুরানো একটা সেলাইয়ের মেশিন কিনলেন। দিনরাত সেটা দিয়ে ঘটর ঘটর করে কাপড় সেলাই করতেন। তখন কাপড়ের কী অভাব, তিনি খুঁজে পেতে ছোট ছোট কাপড়ের টুকরো জোগাড় করতেন, সেগুলো জোড়া দিয়ে শার্ট বানাতেন, জামা বানাতেন। সেগুলো বিক্রি করতেন। সবাই কম কম করে খেত, তিনি খেতেন আরো কম। কত রাত গিয়েছে যখন রাহেলা খাতুন শুধু এক গ্লাশ পানি খেয়ে শুয়ে পড়েছেন। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জন্যে সবকিছু বিক্রি করে দিয়েছিলেন- শুধু একটা জিনিস বিক্রি করেন নাই। সেইটা হচ্ছে সাতফুট পানির নিচে ডুবে থাকা জমিটা। সেই জমির দলিলটা একটা প্লাস্টিকের প্যাকেটের মাঝে রাখতেন, পোকায় না কেটে ফেলে সেজন্যে সেখানেই দুইটা ন্যাপথলিন রাখতেন। মাঝে মাঝে খুলে দেখতেন দলিলটা ঠিক আছে কী না।
.
একদিন ছেলে মেয়েরা বড় হলো। রাহেলা খাতুন নিজে কিংবা আসাদ যেটা করতে পারেন নাই তার ছেলেমেয়েরা সেইটা করলো। মাটি দিয়ে জমি ভরাট হলো। আসাদ যেটুকু জমি কিনেছিল তার পাশে আরো খানিকটা জমি কেনা হলো। জমিটার একপাশে সাত তালার জায়গায় চারতলা একটা বাসা হলো। নিচ তালাটা রাখা হলো রাহেলা খাতুনের জন্যে। ছোট ছেলে জয় এখনো বিয়ে করেনি (কিন্তু বিয়ে হয়ে যাবে হয়ে যাবে এরকম একটা আভাষ আছে), সে থাকে রাহেলা খাতুনের সাথে। উপরের তিনটা ফ্ল্যাটে রাহেলা খাতুনের তিন ছেলে মেয়ে থাকে। চার তলার ছাদে আরেকটা ফ্ল্যাট তৈরি হওয়ার কাজ শুরু হয়ে থেমে গেছে সেখানে একটা বড় খালি রুম এই বাসার পাঁচ নাতি নাত্নির দখলে। রাহেলা খাতুনের চার ছেলেমেয়ের তিন বউ জামাই মিলে সাতজন, নাতি নাত্নি পাঁচজন, এই নিয়ে এক ডজন। রাহেলা খাতুনকে নিয়ে হলো এক ডজন একজন। এই নিয়ে এক ডজন একজন কাহিনীর শুরু হয়েছে এখান থেকে।
adventur ar kono balo boy ase
adventur ar kono balo boy ase.