০১. মেজাজটা বিগড়ে গেলেও

পেন্ডুলাম – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন
Pendulum by Mohammad Nazim Uddin
প্রথম প্রকাশ : ডিসেম্বর ২০১৬

[রহস্যময় এক ডক্টর, নিজের চারপাশে রহস্য তৈরি করে রাখেন সব সময়। জাতীয় দৈনিকে একটি অদ্ভুত চাকরির বিজ্ঞাপন দিলেন তিনি, প্রাণি হিসেবে হাজির হলো মাত্র দু-জন। একেবারেই ভিন্ন প্রকৃতির সেই দুই তরুণ-তরুণীকে হতবুদ্ধিকর একটি রহস্য সমাধান করার ‘অ্যাসাইনমেন্ট’ দেয়া হলো। তদন্তে নামতেই পরিস্কার হয়ে গেলো ঘটনাটি যেমনি প্রহেলিকাময় তেমনি গোলকধাঁধাপূর্ণ। বিজ্ঞান আর অতিপ্রাকৃতের দোলাচলে দুলতে লাগলো তাদের সমস্ত হিসেব-নিকেশ। সব কিছুর কি কথা আছে? নাকি শেষ কথা বলে কিছু নেই?

মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের মৌলিক-থৃলার উপন্যাস পেন্ডুলাম পাঠকদেরকে দোলাচলে দুলতে দুলতে নিয়ে যাবে সেই রহস্যময়তার গভীরে।]

.

.

‘বহুকাল আগেই আমি আমার নিয়তি নিয়ে, আজ যা হতে পেরেছি তার জন্য দর কষাকষি করেছি এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের চিফ কমান্ডারের সাথে…দেখা এবং অদেখা জগতের চিফ কমান্ডার তিনি।’

– বব ডিলান

.

মুখবন্ধ

বাথরুমের লালচে বাল্বের আলোয় মলিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বাঁকাহাসি দিলো জোকার।

তার লাল টকটকে ঠোঁট ডানাল পর্যন্ত বিস্তৃত। সারামুখে ধবধবে ফ্যাকাশে সাদা রঙ মাখা। চোখের নিচে কালচে ছোপ। উন্মাদগ্রস্ত দৃষ্টি ভুতুরে আর ক্ষ্যাপাটে অভিব্যক্তি তৈরি করেছে। মাথার কোকড়ানো চুলগুলো অগোছালো-হার্লে কুইনের উন্মত্ততার নির্দশন।

হাত দিয়ে চুলগুলো ডান থেকে বামদিকে আঁচড়িয়ে ঠিকঠাক করে আয়নার দিকে তাকিয়ে সন্তুষ্টির হাসি দিলো সে।

দারুণ লাগছে তাকে!

নিজের প্রতিবিম্বের দিকে চেয়ে চোখ টিপে দিলো জোকার, “হোয়াই সো সিরিয়াস, ম্যান!?” আজ রাতে এই সংলাপটি কমপক্ষে বারো তোরোবার বলেছে।

না। তেরোবার নয়। এর চেয়ে বেশি, নয়তো কম। অপয়া তেরোর ভীতি আছে তার। নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় বিপদগুলো এই তেয়োর ফেরেই হয়েছে। সে লক্ষ্য করেছে, তেরো সংখ্যাটি কোনোভাবেই তার জন্য শুভ কিছু বয়ে আনে না। কখনও কখনও সেটা ভয়ঙ্কর বিপদেরও জন্ম দেয়। এ কারণে সব সময় সচেতনভাবে এটা এড়িয়ে চলে। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাস, আজ ঘটনাচক্রে সেটা এড়ানো সম্ভব হয়নি। ব্যাপারটা তাকে বেশ ভাবনায় ফেলে দিলেও কারো কাছে প্রকাশ করেনি সেটা। হৈহুল্লোর আর আনন্দ-ফুর্তির মধ্যেও বার কয়েক তার মনে এক অজানা আশঙ্কার উঁকি দিয়েছে।

মাথা থেকে অপয়া তেরোর দুভাবনাটি ঝেটিয়ে বিদায় করে একটু কুঁজো হয়ে হেলেদুলে আয়নার সামনে থেকে সরে এলো সে। কমোডের কাছে দাঁড়িয়ে প্যান্টের জিপারটা এক টানে নিচে নামিয়ে দিলো। আজ অনেক বেশি মদ আর বিয়ার পান করেছে। এ নিয়ে আধঘণ্টার মধ্যে তিনবার ব্লাডার খালি করতে হলো তাকে। বাকি দু-বার বিশাল বাগানের ঝোঁপের আড়ালে সেরেছে।

ছাদের দিকে মুখ করে চোখ বন্ধ করে ফেলল জোকার। কমোডের উপর প্রস্রাবের ধারা আছড়ে পড়ার শব্দটা তাকে পরম শান্তি দিলো।

“আহ!”

মুখ দিয়ে আনন্দধ্বনি বের হয়ে গেলো তার। প্রশ্রাবে নাকি পুরুষ মানুষ অর্ধেক সঙ্গমের আনন্দ পায়-সিগমুন্ড ফ্রয়েডের এ কথাটা মনে পড়তেই হেসে ফেলল।

ধুর! কিসের সাথে কী?

অল্প বয়স থেকেই এসবের অভিজ্ঞতা আছে তার। একটু আগেও এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে। এ কথা তার চেয়ে ভালো আর কে জানে।

হার্লে কুইন এখনও বেহুশের মতো বিছানায় পড়ে আছে। তার সাথে ‘প্রেমপর্ব’ শেষ হবার পর প্রায় অর্ধেক বোতল হুইস্কির সবটাই সাবাড় করে দিয়েছে পাঁচ মিনিটে। এক বসায় পুরো এক বোতল গেলার রেকর্ডও তার আছে। এক বন্ধুর সাথে বাজি ধরে খেয়েছিলো।

বাথরুমের ছোট্ট জানালা দিয়ে বাইরে থেকে মাংস পোড়ার গন্ধের সাথে বাতাসে ভেসে এলো অ্যালিস কুপারের কর্কষ কণ্ঠটটা। ডোরিয়ান গ্রে’র পছন্দের তারিফ না করে পারলো না। অশুভ আত্মাদের এই রাতের উপযোগি গান বেছে নিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে তার মনে পড়ে গেলো ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের কথা। সে কি এখনও পার্টিতে আসেনি? ও যদি আজ না আসে তাহলে একটু খারাপ লাগবে তার, তবে এতে করে অপয়া তেরোর হাত থেকে রেহাইও পেয়ে যাবে। এমনটা হলে মন্দ হয় না।

“হি ইজ অ্যা সাইকো…” ভেসে আসা গানের সাথে গুণগুণিয়ে বলে উঠলো জোকার। “হাঙ্গরি ফর লাভ!” তার রক্তে নাচন ধরলো, মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো বন্য ক্ষিদে। “অ্যান্ড ইটস ফিডিং টা-ই-ম…”

হঠাৎ মৃদু একটা শব্দ কানে গেলো তার কিন্তু বন্ধ চোখ খোলার আগেই সমস্ত শরীর ঝাঁকি দিয়ে উঠলো জোকারের। চোখ আর মুখ খুলে গেলো একসঙ্গে। অস্ফুট একটি শব্দ বের হলো তার মুখ দিয়ে। টের পেলো দম বন্ধ হয়ে গেছে, মুখ দিয়ে আর শব্দ বের করতে পারছে না।

নিজের প্রস্রাবের শব্দটা তখনও শুনতে পাচ্ছে। এলোমেলোভাবে পড়ছে কমোডের পাশে। সমস্ত শরীরের সাথে হাতদুটোও খিচুনি দিয়ে কাঁপছে। তার ফুসফুসে যেন গরম লোহার রড ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। সমস্ত শরীরে তীব্র এক যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ার আগেই পর পর কয়েকবার একই রকম অনুভূতি হলো। ঠিক কতোবার হলো সে জানে না।

মুহূর্তে তার সমস্ত জগত টলে গেলো। বুকটা চেপে আসতে চাইছে। ফুসফুসে যে আগুনের হলকা অনুভব করছে, সেটা যেন পুরো বুকটা পুড়িয়ে দিচ্ছে। অনেক চেষ্টা করেও মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের করতে পারলো না। তবে গোঙানি দিতে পেরেছে কিনা বুঝতে পারলো না সে। তার কানে শুধু ভো ভো শব্দ হচ্ছে। জাগতিক শব্দগুলো কেমন লেপ্টে গিয়ে ভোলা আওয়াজে পরিণত হলো। মনে হচ্ছে তার কানদুটো শক্ত করে কেউ চেপে ধরেছে।

পা দুটো টলে কমোডের পাশে নিজের প্রস্রাবের উপরেই মুখ থুবরে পড়ে গেলো সে। পড়ে যাবার সময় একহাত দিয়ে কমোডের এক প্রান্ত ধরার চেষ্টা করলেও কম্পিত হাতটা ব্যর্থ হলো।

মেঝেতে পড়ার পরই টের পেলো পিঠে উপর পর পর আরো কয়েকটি তীক্ষ্ণ আঘাত করা হচ্ছে, তবে সেই আঘাতের শব্দটাই কেবল তার কানে গেলো, যন্ত্রণা পেলো কিনা বুঝতে পারলো না। মুখ দিয়ে গল গল করে রক্তবমি হলেও সে কেবল টের পেলো নোনতা একটা অনুভূতি।

এসব কী হচ্ছে!-জোকার বুঝে উঠতে পারলো না।

উপুড় হয়ে পড়ে আছে সে, একটু ঘুরে দেখারও শক্তি নেই।

একটু পর, দুচোখে অন্ধকার নেমে আসার আগে কিছু একটা তাকে শক্ত করে ধরে চিৎ করে দিলো।

ভীতিকর একটা মুখ ভেসে উঠলো তার ঘোলা চোখের সামনে।

ফ্রাঙ্কেনস্টাইন!

অবশেষে এসেছে! কিন্তু তার সাথে এটা করলো কেন?! এর সবটাই কি আজকের আনন্দযজ্ঞের অংশ?!

জোকার নিশ্চিত হতে পারলো না।

তারপরই ভীতিকর মুখটা দুমরে মুচরে বদলে গেলো নিমেষে! বেরিয়ে আসলো আরেকটি মুখ।

এই দ্বিতীয় মুখটা চিনতে একটু বেগ পেলো সে। ভালো করে দেখার চেষ্টা করলো কারণ আস্তে আস্তে তার সমস্ত দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।

পুরোপুরি অন্ধকার হবার আগেই বদলে যাওয়া দানবটাকে চিনতে পারলো জোকার। সুতীব্র এক ভীতি জেঁকে বসলো সমস্ত শরীরে। টের পেলো দুচোখে অন্ধকার নেমে আসার সাথে সাথে দূর থেকে ভেসে আসা গানটার কোরাসও মিহঁয়ে যেতে শুরু করেছে :

ফিড মাই ফ্রাঙ্কেনস্টাইন…ফিড মাই ফ্রাঙ্কেনস্টাইন…ফিড মাই…

তারপর আরেকটা নতুন গান শুরু হলো কিন্তু সেই গানটা যে কার মনে করতে পারলো না। নিজের শোচনীয় অবস্থার কথা বেমালুম ভুলে গানের শিল্পী কে তা নিয়ে ভাবতে শুরু করে দিলো জোকার। এ মুহূর্তে গানটা অনেক বেশি অর্থবহ বলে মনে হচ্ছে। তার দিকে স্থিরচোখে চেয়ে থাকা ঘাতক যেন গাইছে সেটা। যদিও ওর ঠোঁটজোড়া একদমই নড়ছে না।

আই শ্যাল রাইজ-আপ ফ্রম দিস সালফার গ্রেভ
অ্যান্ড ওয়াক দিস ওয়ার্ল্ড টু সি ইউ ডাই…

তারপরই রক্তমাখা চাকুটা উঠে এলো, সজোরে বসিয়ে দেয়া হলো তার বুকের বামপাশে। দ্বিতীয়বার রক্ত বমি করে ফেলল জোকার। তার লাল টকটকে ঠোঁটদুটো এখন সত্যিকারের রক্তে রঞ্জিত!

.

অধ্যায় ১

সকাল সকাল মেজাজটা বিগড়ে গেলেও দ্রুত সামলে নিলো মায়া। চায়ে বেশি চিনি হলেই তার মুখ বিস্বাদ হয়ে যায়। দিনের শুরুটা তার কাছে সব সময়ই গুরুত্ব রাখে। একটা বাজে অনুভূতি দিয়ে শুরু করা দিন মানে প্রতি পদে পদে তিক্ততার মুখোমুখি হওয়া। মেজাজও কেমন খিটখিটে থাকে। ছোট্ট একটি ভুলের জন্যে আজকের সকালটাই বিস্বাদ হয়ে গেলো তার। কেন যে মেয়েটাকে বলতে ভুলে গেছিলো চায়ে চিনি কম দিতে!

প্রায় দু-বছর পর ঘরে বসে সাতসকালের চা খাচ্ছে। বিগত দু-বছর ধরে দিনের প্রথম চা খাওয়াটা হতো অফিসে। এটাই তার অভ্যেস হয়ে গেছে। তার কাজে আবার ছুটির দিন বলে কিছু নেই। ডাক্তার-পুলিশদের মতো সার্বক্ষণিক একটি পেশা। ন-টা পাঁচটা ডিউটির বালাই না থাকলেও প্রতিদিন তাকে অফিসে যেতে হয়।

হতো!

নিজেকে শুধরে দিয়ে মুচকি হেসে শহরের স্কাইলাইনের দিকে তাকালো। চৌদ্দ তলার উপরে তার ফ্ল্যাট। সকালের ঢাকা কেমনজানি সুন্দর লাগে তার কাছে, তবে সেটা অনেক উপর থেকে দেখলে। ভাবলো, তার এই আকস্মিক অবসর কতোটা দীর্ঘ হতে পারে। এই নির্জন ফ্ল্যাটে মাত্র দু-জন বাসিন্দা। গৃহকর্মি মেয়েটাকে বাদ দিলে পুরোপুরি একা সে। ১৩৫০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটে মাত্র দু-জন মানুষ।

বারান্দায় যে রকিং চেয়ারটা আছে তাতে বসে দোল খেলো চায়ের কাপটা রেখে। পাশের কফি টেবিলের উপর আজকের পত্রিকাটি রয়েছে। সব সময় হকার এতো সকালেই পত্রিকা দিয়ে যায় কিনা সে জানে না। এখন বাজে সকাল সাতটা। তার মতো গৃহকর্মি মেয়েটাও দেরি করে ঘুম থেকে উঠতো, তবে আজকে বেচারিকে আরামের ঘুম বাদ দিয়ে তার জন্য চা বানিয়ে দিতে হয়েছে।

এখন থেকে আমি ভোরবেলায় উঠবো, মনে মনে বলল। আবার জগিং শুরু করতে হবে। ফিগারটা ঠিকঠাক করা দরকার। দু-বছর ধরে যে কাজ করে গেছে সেখানে দেহসৌষ্ঠব আর রূপের কোনো দরকারই ছিলো না অথচ কাজটায় যোগ দেবার আগে একদম বিপরীত একটি ক্ষেত্রে বিচরণ করতো সে।

কাল থেকে তার দু-বছরের জীবনটা আবারো হুট করেই বদলে গেছে। নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসে গেছে এখন। পুরোদমে উঠেপড়ে লাগতে হবে তাকে। পুরনো কানেকশানগুলো ঠিকঠাক করতে খুব বেশি কষ্ট হয়তো করতে হবে না। তাই চাকরি ছেড়ে দেবার পর খুব একটা চিন্তিত নয় সে, কারণ নতুন কিছু শুরু করতে পারার সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে বেশ জোরেশোরে।

পত্রিকাটা তুলে নিলো হাতে। প্রথম পৃষ্ঠায় কোনোকালেই তার আগ্রহ ছিলো না। শুধু রাজনীতি আর সিরিয়াস সিরিয়াস সব বিষয় থাকে ওখানে। খেলার পাতাটাও খুব একটা টানে না। তার যতো আগ্রহ বিনোদন পাতা আর মফশ্বল-সংবাদের দিকে।

“আপা, চা খাইলেন না যে?”

পত্রিকা থেকে মুখ তুলে তাকালো সে। সোহেলি দাঁড়িয়ে আছে। বারান্দার দরজার সামনে।

“চা ভালো হয় নাই?” সে জানতে চাইলো।

“চিনি বেশি দিয়েছিস…আমি এতো চিনি খাই না,” কথাটা বলেই পত্রিকার দিকে মনোযোগ দিলো আবার।

চুপচাপ চায়ের কাপটা নিয়ে চলে গেলো সোহেলি।

বিনোদন পাতায় বেশ বড় করে মডেল ইরিনের ছবি ছাপিয়েছে। নামকরা টেলিকমের একটি টিভিসি করেছে মেয়েটা। বেশ আলোচনায় আছে এখন। সবগুলো চ্যানেলে প্রতিদিন অসংখ্যবার দেখানো হয়। হালের সেনসেশন।

এই মেয়েটা তিনবছর আগে তার কাছে কতোই না ধর্ণা দিয়েছিলো র‍্যাম্পে কাজ করার জন্য। সে নিজে তখন র‍্যাম্পের রানী। শেষ পর্যন্ত তার রেফারেন্সেই মেয়েটা সুযোগ পায়।

বিনোদন পাতায় আর কোনো খবর তাকে আকর্ষিত করলো না। পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে হঠাৎ থমকে গেলো, ভুরু কুচঁকে তাকালো সে। দুই কলাম ছয় ইঞ্চির একটি বিজ্ঞাপন। কালো একটি পিলারের মতো। শোক প্রকাশের জন্য এরকম ডিজাইন ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সেই কালো পিলারের উপরের দিকে বড় বড় সাদা অক্ষরে কিছু কথা লেখা। বিজ্ঞাপনের নিচে একটি পেন্ডুলামের ছবি। ভালো করে দেখলো, আসলে উপরের অক্ষরগুলোর ঠিক নিচ থেকেই একটা চিকন সুতো দিয়ে পেন্ডুলামটি আটকানো। কিন্তু পেন্ডুলামের ছবিটা নয়, তার নজর কাড়লো বিজ্ঞাপনের অভিনব ভাষা।

আপনি কি অতিপ্রাকৃত শক্তিতে বিশ্বাস করেন? বিশ্বাস করেন এ পৃথিবীতে যুক্তির বাইরেও ঘটনা ঘটে? বিজ্ঞানের এই উৎকর্ষতার যুগে সব কিছু যখন অতিমাত্রায় যুক্তি আর প্রমাণের উপর নির্ভর হয়ে পড়ছে তখনও কি আপনি মনে করেন ব্যাখ্যাত, রহসময় আর অলৌকিক কিছুর অস্তিত্ব রয়েছে?
যদি তা-ই মনে করে থাকেন, এবং এ বিষয়ে আপনার সম্যকজ্ঞান থেকে থাকে তাহলে নিচের ঠিকানায় যোগাযোগ করুন-আপনার জন্যে রয়েছে আকর্ষণীয় একটি কাজ। যারা রোমাঞ্চ আর চ্যালেঞ্জ নিতে আগ্রহি নন, ন’টা-পাঁচটা চাকরি করে জীবন ধারণ করতে চান তাদের আবেদন করার দরকার নেই। শুধুমাত্র বিশেষ যোগ তাসম্পন্ন ব্যক্তিরাই (নারী-পুরুষের কোনো ভেদাভেদ করা হবে না) এ কাজের জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচিত হবে।

বিশেষ যোগ্যতাসম্পন্ন?! আপন মনে বলে উঠলো সে। উদাস হয়ে আকাশের দিকে চেয়ে রইলো।

“আপা।”

চমকে তাকালো দরজার দিকে। সোহেলি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

“আধ-চামুচ চিনি দিছি এইবার।”

এ কফি টেবিলের উপর কাপটা রেখে চলে গেলো মেয়েটা।

কাপটা তুলে নিয়ে চুমুক দিতে দিতে অদ্ভুত বিজ্ঞাপনটির দিকে আবারো মনোযোগ দিলো মায়া।

.

সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা না-করেই লিখতে বসেছে আজ। কি-বোর্ডে খটাখট করে তার আঙুলগুলো টাইপ করে যাচ্ছে বিরামহীন। জটিল অধ্যায়ে আছে এখন। সাবজেক্টটা খুব কমই পরিচিত, সবাই এটাকে প্লাসিবো নামেই চেনে।

ভুলভাবে পরিচিত একটি শব্দ। জিনিসটা আম কিন্তু সবাইকে বোঝানো হয়েছে লিচু! তাকে এখন সেই পুরনো বিশ্বাস ভেঙে নতুন করে নির্মাণ করতে হবে। সহজ ভাষায় যতোটা সম্ভব বোধগম্য করে ব্যাখ্যা করা দরকার।

আউটসোর্সিংয়ের কাজ করে সে। বিভিন্ন বিষয়ের উপর ফিচার আর কলাম লেখে। এই লেখাটা এক সপ্তাহ ধরে থেমে ছিলো, কিছুতেই লিখতে পারছিলো না বিষয়টা তার নিজের কাছেও পরিস্কার মনে হয়নি বলে। এ কয়দিন প্রাসিবোর উপরে বেশ কয়েকটি বই পড়ে ফেলে, কিছু ডকুমেন্টারিও দেখে। গতকাল রাতে তার মনে হয়েছে বিষয়টা তার আয়ত্তে চলে এসেছে, এখন হয়তো লিখতে পারবে। আজ খুব সকালে ঘুম থেকে উঠেই লিখতে বসে যায়। লেখালেখির ব্যাপারটাই এমন। জোর করে হয়তো প্রেম ভালোবাসাও আদায় করা সম্ভব হতে পারে কিন্তু লেখালেখি অসম্ভব।

ইনকামিং মেসেজের বিপ হতেই টাইপ থামিয়ে পাশ ফিরে তাকালো। কম্পিউটার টেবিলের পাশেই তার মোবাইলফোনটা রাখা। লেখালেখির সময় সাইলেন্ট মুডে থাকলেও মেসেজের রিংটোন চালু রাখে। তার ঘনিষ্ঠজনেরা এটা জানে তাই কয়েকবার কল করে না পেলে এসএমএস পাঠিয়ে দেয়।

ফোনটা হাতে তুলে নিলো সে। কেউ তাকে মেসেজ পাঠিয়েছে। মেসেজটা ওপেন করতেই ভুরু কুচকে গেলো। অপরিচিত নাম্বার থেকে কেউ তাকে বলছে আজকের পত্রিকার নির্দিষ্ট একটি পৃষ্ঠা দেখতে।

আজ সকালের পত্রিকায় শুধুমাত্র চোখ বুলিয়েছে, ভালো করে অবশ্য পড়া হয়নি। পড়ার মতো কিছু তো আর সব দিন থাকে না। পাল্‌স বাড়িয়ে দেয়া, মেজাজ খারাপ করা সংবাদেই ভরা থাকে বেশিরভাগ সময়। ফোনটা রেখে পাশের ঘরে চলে গেলো। ডাইনিং টেবিলের উপর থেকে পত্রিকাটা হাতে তুলে নিয়ে নির্দিষ্ট পৃষ্ঠায় যেতেই দেখতে পেলো অভিনব একটি  বিজ্ঞাপন। সে ভেবেছিলাে তার বিখ্যাত এবং বহুল প্রচারিত চ্যালেঞ্জের বিষয়ে আগ্রহি কোনাে সংবাদ হবে হয়তাে। কোথাও নতুন কোনাে বুজরুকির আবির্ভাব ঘটেছে। দলে দলে লােকজন বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, আর অবধারিতভাবে সেটার ব্যাখ্যা দিতে হবে তাকে। নয়তাে কোনাে অন্ধবিশ্বাসির ফালতু চ্যালেঞ্জ মােকাবেলা করতে হবে।

পুরনাে পাগল ভাত পায় না নতুন পাগলের আমদানি! পুরাে বিজ্ঞাপনটি পড়ার পর মনে মনে বলে উঠলাে চারু আহসান।

পুরনাে পাগলটা অন্য কেউ নয়, সে নিজে!

.

অধ্যায় ২

সানগ্লাসের ভেতর দিয়ে বাড়িটার দিকে তাকালো মায়া।

বাইরের প্রখর রোদ বলছে সানস্ক্রিম ব্যবহার করা উচিত ছিলো। অনেকদিন এসব ব্যবহার করা হয় না বলে তার কাছে এরকম কোনো ক্রিম এখন নেই। আজকাল ছাতাও ব্যবহার করা হয় না। অবশ্য দু-বছর আগে হলে অন্যরকম হতো।

রাস্তায় নামলেই লোকজন তার দিকে চেয়ে থাকে, আজও এর ব্যতিক্রম হলো না। তার অদ্ভুত স্টাইল আর সাজগোজ সবার মনোযোগ কাড়ে। তরুণী একটা মেয়ে, ভড়কে দেবার মতো সাজসজ্জা-ব্যাপারটা চোখ টানবেই। বিশেষ করে পুরুষ মানুষের।

লম্বা আর কোকড়া চুলগুলো বেদেনিদের মতো খোঁপা করে মাথার উপর ছোট্ট একটা চূড়া বানিয়ে রেখেছে। কানের দু-পাশে কয়েক গোছা চুল নেমে গেছে অনেকটা অবহেলায়, ডান চোখের নিচে আঁকা আছে ছোট্ট আর সহজ-সরল একটি উল্কি-অশ্রুবিন্দু। এই ‘টিয়ারড্রপ ট্যাটু’ পাশ্চাত্যে বেশ জনপ্রিয়। এ দেশে সম্ভবত মায়াই একমাত্র মেয়ে যার মুখে এটা শোভা পাচ্ছে।

তার গলায় আর কানে অসংখ্য গহনা-কোনোটাই স্বর্ণের নয়। স্বর্ণ তার কাছে অসহ্য লাগে। তারচেয়েও বড় কথা এটা ওর সহ্যই হয় না।

চোখে সব সময় কাজল দেয় সে। তার কাজল দেবার ভঙ্গিটাও বেশ চোখে পড়ার মতো-পুরু, টানা এবং ভুতুরে। গায়ে যে ফতুয়াটা চাপিয়েছে সেটা কাসাবর্ণ। একেবারে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের চিবরের মতোই সেটার রঙ। সত্যি বলতে, চিবর কেটেই তৈরি করা হয়েছে এটা।

তবে ফতুয়ার পরের জিনিসটা একদমই আধনিক-লিভাইস জিন্স প্যান্ট। পায়ে যে চটিটা আছে সেটা নিজের ডিজাইন করা। একেবারে সাদামাটা। অনেকটা প্রাচীণ সন্ন্যাসীদের ব্যবহৃত চটির মতো।

জিন্স প্যান্ট ছাড়াও চমৎকার সুন্দর আর স্টাইলিস একটি ভ্যানিটি ব্যাগ ব্যবহার করে সে। তিন বছর আগে প্যারিসে শো করতে গেলে এটা কিনেছিলো। কালো চামড়ার এই ব্যাগটি তার খুবই প্রিয়, কারণ ব্র্যান্ডটা তার রেডিও প্রোগ্রামের সাথে বেশ ভালোই মানিয়ে যেতো-ভুডু।

সাদারঙের ডুপ্লেক্স বাড়িটার দিকে ভালো করে তাকালো সে। বাইরে থেকেই বোঝা যায় বিশাল লন আছে। এটার নক্সা আধুনিক আর ক্লাসিকের মিশ্রণে করা। ভবনের সামনে বড় বড় সুন্দর নক্সা করা চারটা গ্রিক কলাম আছে।

সে আশা করেছিলো অফিসভবন জাতীয় কিছু। কিন্তু চোখের সামনে যেটা দেখছে সেটা অভিজাত এলাকার প্রাসাদতুল্য একটি ভবন। অবশ্য গুলশানে এরকম আবাসিক ভবনেও অসংখ্য অফিস গজিয়ে উঠেছে আজকাল, বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই কোনটা আবাসিক আর কোনটা ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে।

মেইনগেটটা যেমন বিশাল তেমনি মজবুত। দৃঢ়ভাবে আগলে রেখেছে বাড়িটা, সেইসাথে ধরে রেখেছে আভিজাত্যটাকেও।

বাড়ির সামনে কেউ নেই!

খুব অবাক হলো সে। এরকম চাকরির বিজ্ঞাপন দেখার পর বিশেষ যোগ্যতাসম্পন্ন হোক আর না-ই হোক ‘ট্রাই করার মতো লোকের অভাব হয় না এ শহরে। দেশের প্রথম শ্রেণির একটি পত্রিকায় বেশ বড় করে বিজ্ঞাপনটি দেয়া হয়েছে, কমপক্ষে পাঁচ-ছয় লাখ মানুষের চোখে পড়েছে। আজ সকালে। ভেবেছিলো লাইনে দাঁড়াতে হবে। লাইন তো দূরের কথা কাকপক্ষীও নেই। কয়েক মুহূর্তের জন্য তার মনে হলো, ভুল ঠিকানায় চলে এসেছে বুঝি।

দারোয়ানকে বলামাত্রই আর কিছু জিজ্ঞেস না করে সোজা ভেতরে চলে যেতে বলল।

ডুপ্লেক্স বাড়িটার দরজা বিশাল। সেগুন কাঠের নক্সা করা একটি ডাবল ডোর। দরজার ডানপাশে কলিংবেলের সুইচটা টিপে দিলো সে।

টুং-টাং।

ভেতর থেকে বেলের মৃদু শব্দটা শুনতে পেলো। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো সে। বেলের আওয়াজ শোনার পর বাড়ির বাসিন্দারা তো আর সুপারম্যানের গতিতে ছুটে আসবে না। এই অভদ্রতাটুকু বেশিরভাগ মানুষ না করলেও মায়া করে। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর আবারো বাজালো।

টুং-টাং।

যথারীতি সাড়া-শব্দ নেই।

তৃতীয়বার বাজাতে যাবে অমনি আস্তে করে দরজাটা খুলে গেলো ভেতর থেকে। অবাক হয়ে দেখতে পেলো দরজার সামনে কেউ দাঁড়িয়ে নেই!

ভেতরটা বিশাল, খুব কমই আসবাব আছে। চারপাশে কয়েক জোড়া সোফা আর কফি টেবিল ছাড়া কিছু দেখতে পেলো না। বাতি জ্বলানো নেই তবে জানালা দিয়ে যেটুকু আলো এসেছে সেটুকু যথেষ্ট। কী এক অজানা ভয়ে দরজা দিয়ে না ঢুকে উৎসুক হয়ে ভেতরে তাকালো সে। কেউ নেই।

আজব! দরজাটা খুললো কে?

“ভিতরে আসুন।”

ভেন্ট্রিলোকুইস্টরা যে-রকম স্বরে পাপেটকে দিয়ে কথা বলায় ঠিক সে রকম একটি কণ্ঠ শুনে চমকে লাফ দিয়ে এক পা পিছিয়ে গেলো মায়া। “ওহ্” অবাক হয়ে দরজার নিচের দিকে চেয়ে দেখলো জিনিসটাকে!

ডাবল-ডোরের একটা পাল্লা ধরে প্রায় আড়ালে থাকা ক্ষুদ্রাতি এক মানুষের মাথা বের হয়ে আছে। বড়জোর তিন-ফুটের মতো উচ্চতা হবে। তার দিকে অভিব্যক্তিহীন দৃষ্টিতে চেয়ে আছে মানুষটা।

.

অধ্যায় ৩

চাকরিটা পাবার কোনো ইচ্ছে তার নেই, চাকরি করার লোকও সে নয়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বেরোবার পর ইচ্ছে করলে কোনো কপোরেট ফার্মে চাকরি জুটিয়ে নিতে পারতো। তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের প্রায় সবাই তা-ই করেছে। ওসবের ধারেকাছে না গিয়ে সে বেছে নিয়েছিলো পত্রপত্রিকায় ফ্রিল্যান্স লেখালেখি। এখন অবশ্য আউটসোর্সিং করে ভালোই চলে যায়। তবে এসব কাজকে সে রুটিরুজির ধান্দা হিসেবেই দেখে। সত্যিকার অর্থে যে কাজটাকে সে কাজ বলে মনে করে সেটা তার পেশা নয়। অনেকটা মিশনারিদের মতো নিজের জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছে মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে আসার সেবায়।

প্রথম দিকে তার পরিবার, আত্মীয়স্বজন আর বন্ধুবান্ধবেরা এ নিয়ে হাসাহাসি করতো, ভাবতো পাগলামি করছে। ধরে বেধে সুন্দরি একটা মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে দিলেই লাইনে চলে আসবে। কিন্তু সে লাইনে আসেনি। বরং অন্ধবিশ্বাস আর কুসংস্কারগ্রস্ত লোকজনকে লাইনে নিয়ে আসার জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছে। এখন নির্দিষ্ট বলয়ে ছোটখাটো একটি পরিচিতিও গড়ে উঠেছে তার। যারা তাকে পাগল ভাবতো তাদের অনেকেই ঈর্ষার চোখে দেখে তাকে।

অবশ্য নিজেকে সে পাগলই ভাবে। তবে আজ আরেক পাগলের সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়েছে। দেখা যাক, সত্যিকারের পাগল নাকি ভেক ধরা কোনো ধান্দাবাজ। তার ধারণা পরেরটাই হবে।

আজকের পত্রিকায় অদ্ভুত বিজ্ঞাপনটি পড়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এই পাগলটার সাথে দেখা করবে। তার মতো এক পাগল এ শহরে আবির্ভূত হয়েছে আর তার সাথে একটু মোলাকাত করবেশই একটু বাজিয়ে দেখবে না, আসলে তার মতলবটা কি?

আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছে রহস্যময় চাকরিদাতার সাথে কিভাবে কথাবার্তা এগিয়ে নিয়ে যাবে। তার সবচাইতে বড় অস্ত্রটাই ব্যবহার করবে আর সেটা করবে ধাপে ধাপে। অনেকটা শিকারিকে বুঝতে না দিয়ে প্রলুব্ধ করে ফাঁদে ফেলার মতো। আঘাতটা যখন করা হবে তখন ‘শিকার’ এমন কোণঠাসা অবস্থায় পড়ে যাবে যে নিজেকে সমর্পণ করতে বাধ্য হবে।

এতোদিন সে মোকাবেলা করে এসেছে প্রতিপক্ষদের, যারা ঠিক তার বিপরীতে অবস্থান করে। আজকের রহস্যময় বিজ্ঞাপনদাতাকে অবশ্য তার মতোই আরেকজন বলে মনে হচ্ছে। বিজ্ঞাপনের কথাগুলো যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে বলতেই হবে তার মতোই আরেকজনের আবির্ভাব ঘটেছে এ শহরে। তবে কথাবার্তা বললে বোঝা যাবে লোকটার আসল মতলব কি।

আচ্ছা, রহস্যময় চাকরিদাতা তো মহিলাও হতে পারে? মনে মনে বলল সে। তার ধারণা, এর সম্ভাবনা খুবই কম। এই চিন্তাটার পেছনে তার স্বজ্ঞা কাজ করছে না, যথারীতি যুক্তিবুদ্ধি ব্যবহার করেই বুঝতে পারছে।

বিজ্ঞাপনের ভাষা।

অভিজ্ঞতা থেকে জানে পুরুষ মানুষের ‘অফারিং’ আর মেয়েমানুষের ‘নিবেদন’ একরকম হয় না।

ঠিকানা দেখে দেখে বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়াতেই তার সন্দেহের মাত্রা বেড়ে গেলো।

এটা কোনো কমার্শিয়াল ভবন নয়।

কয়েক মিনিট বাড়িটা দেখে হিসেব করে নিলো। বাড়ির মালিক, সম্ভাব্য বিজ্ঞাপনদাতার আর্থিক যোগ্যতা প্রশ্নাতীত। অভিজ্ঞতা থেকে সে জানে, ধনীদের বিভিন্ন রকমের বাতিক থাকে। কিছু কিছু বাতিক ভড়কে দেবার মতো। মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্তের পক্ষে সেগুলো বোধগম্য করাও সহজ নয়।

বাতিকগ্রস্ত এক ধনী?

হতে পারে।

মুচকি হেসে বিশাল মেইনগেটটার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা দারোয়ানের দিকে এগিয়ে গেলো সে। কোনো কিছু বলার আগেই মাঝবয়সি লোকটি গেট খুলে দিলো। যেন প্রোগ্রাম করা কোনো রোবট।

“ভিতরে চইলা যান, স্যার,” ধব ধবে সাদা রঙের ডুপ্লেক্স বাড়িটার দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিলো দারোয়ান।

রহস্যময় অভ্যর্থনা! মনে মনে বলল সে। এসব নাটক করে কোনো লাভ নেই। রহস্য একটি ভুল শব্দ, অপূর্ণাঙ্গ ধারণা থেকে যার জন্ম। শব্দের আবিষ্কার বিজ্ঞানীরা করে না। শব্দের জন্ম দেয়, এর অর্থ আরোপিত করে, নতুন অর্থ দান করে একেবারেই সাধারণ মানুষজন। পুরোটাই লৌকিক ব্যাপার। যদি শব্দের উৎস হতো বিজ্ঞানীরা তাহলে রহস্য, অলৌকিক, অতিপ্রাকৃত, দৈব এসব ফালতু শব্দের জন্মই হতো না। এসবই মাত্র একটি শব্দে প্রকাশ করা হতো-অব্যাখ্যাতি। ব্যাখ্যাত হবার প্রতীক্ষায় আছে এমন কিছু!

এই শব্দটা শুনে আবার খুশিতে টগবগ করে ওঠে অনেকে। কিন্তু অতো খুশি হবার কোনো কারণ সে দেখে না। ভালো করেই জানে, আজ হয়তো ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না, আগামিতে সেটা করার মতো সময় ঠিকই চলে আসবে। শুধু অপেক্ষা মোগ্য লোকের জন্যে।

মুচকি হেসে লনটা পেরিয়ে ডুপ্লেক্স বাড়ির বিশাল কাঠের দরজার সামনে এসে কলিংবেল টিপে দাঁড়িয়ে থাকলো।

টুং-টাং।

কয়েক মুহূর্ত চলে যাবার পরও ভেতর থেকে কেউ দরজা খুলে দিলো।

আবারো টুং-টাং।

একই ফল।

অধৈর্য নামক দানবটি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাইলেও সেটাকে দমিয়ে রাখলো। ধৈর্য হলো যুক্তির সবচেয়ে বড় বন্ধু। এ কথা সে কখনও ভুলে যায় না।

তৃতীয়বার বেল বাজাতে উদ্যত হতেই দরজাটা খুলে গেলো। বিস্ময় নিয়ে দেখতে পেলো তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে অপূর্ব এক সুন্দরি। তাকে দেখে কেমন চেনা-চেনা লাগলো, কিন্তু ঠিক ধরতে পারলো না। কোথাও দেখেছে সম্ভবত।

চোখ ধাঁধানো সুন্দরি মেয়ের সামনে দাঁড়িয়ে খুব বেশি কিছু ভাবাটা কষ্টকর। সৌন্দর্যের নিজস্ব একটি শক্তি আছে। সেটা চিন্তার চেয়ে আবেগ আর অনুভূতিকেই বেশি জাগিয়ে তোলে।।

তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির মধ্যে সেই সৌন্দর্য আছে, আছে এক ধরণের রহস্য। তার বেশভূষা সেই রহস্যকেই যেন প্রদর্শন করছে। উৎকটভাবে।

চারু একটু চমকে গেলেও সেটা তার অভিব্যক্তিতে প্রকাশ পেলো না। তার ধারণা কি তাহলে ভুল? চাকরিদাতা একজন নারী!

মেয়েটার বামচোখের নিচে ছোট্ট একটা ট্যাটু দেখতে পেলা। কাজলটানা চোখের সাথে দারুণ মানিয়েছে। তার ঠিক পেছনে দেখতে পেলো সার্কাসের এক বামন দাঁড়িয়ে আছে। পিটপিট করে তাকাচ্ছে তার দিকে। বড়জোর তিনফুটের মতো হবে। এসব জিনিস’ দামি রেস্টুরেন্ট আর হোটেলের অভ্যর্থনার কাজেই বেশি মানায়, বড়লোকের বাড়িতে নয়।

রহস্য নির্মাণের চেষ্টা! মনে মনে বলে উঠলো সে।

“আসুন,” রিনরিনে কণ্ঠে তাড়া দিয়ে বলল মেয়েটি।

.

অধ্যায় ৪

কিছুক্ষণ আগে ডুপ্লেক্স বাড়ির দোতলায় উঠে অবাক হয়ে গেছিলো মায়া। যেমন বিশাল তেমনি জমকালো। একটা প্রাণীও নেই। তিন-চার জোড়া সোফা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, মেঝেতে পার্সিয়ান কার্পেট, দেয়ালে অসংখ্য পেইন্টিং। অ্যান্টিকের সমারোহ দেখে মনে হতে পারে এটা কোনো অ্যান্টিকশপ। কিংবা ব্যক্তিগত জাদুঘর।

বামন তাকে বসতে বলে চুপচাপ চলে যায়। তার ভাষায় ‘স্যার’ এক্ষুণি চলে আসবে।

মায়া চারপাশে দেয়ালগুলোতে চোখ বুলাতে লাগে। ছোটো-বড় মাঝারি-অতিক্ষুদ্র সব ধরণের অ্যান্টিক দিয়েই সাজানো। বাড়ির মালিক যে প্রচুর দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ায়, সে যে সাধারণ মানুষের মতো জামা-কাপড় আর ব্যবহার্য জিনিসের চেয়ে অন্যকিছুতে বেশি আগ্রহি সেটাই জানান দিচ্ছে যেন।

ঘরের এক মাথায় চমৎকার একটি ফায়ারপ্লেস চোখে পড়তেই অবাক হয় সে। শীতপ্রধান দেশে এটা থাকে কিন্তু এ দেশে এরকম জিনিস খুবই বিরল। যারা এটা বানায় তারা ডেকোরেশন পিস হিসেবেই ব্যবহার করে। একটু সামনে গিয়ে আরো অবাক হয়। এটা নিছক কোনো ডেকোরেশন পিস নয়। কিছু কাঠের গুঁড়ি আছে ফায়ারপ্লেসে, রীতিমতো জ্বলছে সেগুলো। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার কোনো উত্তাপ বের হচ্ছে না!

“ওগুলো আসল নয়…ফেইক।”

ভরাট একটি কণ্ঠ বলে উঠলে চমকে তাকায় মায়া। দেখতে পায় তার ঠিক পেছনে একটি সোফায় বসে আছে বয়স্ক এক লোক। হাতে একটি নক্সা করা চমৎকার ছরি। কখন এসে চুপচাপ বসে আছে টেরই পায়নি। লোকটার পা থেকে মাথা পর্যন্ত সবই সাদা-জুতো, মোজা, ফুলপ্যান্ট, শার্ট, চাপদাড়ি আর চুল। চোখের চশমার ফ্রেমটি কেবল কালো।

“ভেতরে ইলেক্ট্রিক লাইটের কারণে মনে হয় ওটা জ্বলছে।”

মায়া কৃত্রিম হাসি দিয়েছিলো কেবল।

“ওয়েলকাম।” সাদা লোকটি বলে।

“আপনি?”

“আমি ডক্টর আজফার হুসেন…বিজ্ঞাপনটা আমিই দিয়েছি।”

“ও,” মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে থেকেই বলে মায়া। লোকটার দৃষ্টি অন্তর্ভেদি।

“বসুন।”

সম্মোহিতের মতো পাশের একটি সোফায় বসে পড়ে সে।

“আমি কখনও কারোর চাকরির ইন্টারভিউ নেইনি,” প্রসন্নভাবে হেসে বলেছিলেন বিজ্ঞাপনদাতা। “কিভাবে যে কী করবো বুঝতে পারছি না।”

“আপনি তো জানেন আপনার কি ধরণের লোক লাগবে…এখন আমাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করে জেনে নিতে পারেন আমি আপনার রিকয়্যারমেন্টগুলো ফুলফিল করতে পারবো কিনা।”

স্মিত হাসেন সাদা লোকটি। “আপনি একজন সেলিব্রেটি। আপনাকে আমি চিনি। রেডিওতে চমৎকার একটি অনুষ্ঠান করতেন।”

করতাম মানে?! খুবই অবাক হয়েছিলো মায়া। মাত্র দু-দিন আগে চাকরি ছেড়েছে, এখনও তার বস্ ছাড়া এ কথা অফিসের কেউ জানে না। কিন্তু তার সামনে যে মানুষটা আছে তার ব্যক্তিত্বই এমন যে, মায়া ইচ্ছে করলেও জিজ্ঞেস করতে পারেনি কথাটা কোত্থেকে শুনেছেন তিনি।

“আপনার ঐ অনুষ্ঠানের আইডিয়াটা আমার কাছে দারুণ লেগেছে।” প্রশংসার সুরে বলেছিলেন ডক্টর।

“থ্যাঙ্কস।”

“সময় পেলেই আমি ওটা শুনতাম।”

এরকম একজন বয়স্ক ধনী লোক তার অনুষ্ঠান শুনতো! কথাটা শুনে ভালো লাগার একটি অনুভূতি বয়ে যায়।

“আমি এ কাজের জন্য যেরকম মানুষ খুঁজছি আপনি পুরোপুরি সেরকমই একজন, তাই কোনো ইন্টারভিউ নেবার দরকার দেখছি না।”

“তারপরও, আপনার জেনে নেয়া উচিত চাকরিটা করার ব্যাপারে আমার আগ্রহ কেমন…”

“সেটা করার তো কোনো প্রয়োজন দেখছি না। আগ্রহি বলেই তো এখানে এসেছেন,” কথাটা বলেই অন্তভেদি দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে থাকেন বিজ্ঞাপনদাতা।

মায়া কিছু বলেনি। ডক্টর ঠিকই বলেছেন। আগ্রহ না থাকলে এখানে কেন চলে আসবে।

“তারপরও কিছু কথাবার্তা বলতে হবে। এই ধরুন, কাজটার ধরণ, সুযোগ-সুবিধা, বেতন-ভাতা, এইসব।”

“জি, আমি সে-কথাই বলছিলাম,” বলেছিলো মায়া।

“আমি আগেই বলেছি, এটা আর সব চাকরির মতো নয়। ন’টা-পাঁচটা ডিউটি বলেও কিছু নেই। গবাধা কোনো কাজও আপনাদের করতে হবে না।”

আপনাদের? আরো লোক নেবে তাহলে। মনে মনে বলেছিলো মায়া।

“ঠিক আছে বুঝলাম, এসব কথা অ্যাডে দেয়া ছিলো কিন্তু আমাকে কি ধরনের কাজ করতে হবে সে-সম্পর্কে কিছুই জানি না। বিজ্ঞাপনে এ নিয়ে কিছু বলেননি।”

“একটু অপেক্ষা করুন, সব বলছি। এই ফাঁকে একটু কফি খাওয়া যাক।”

কাঁধ তোলে মায়া। তার দিক থেকে কোনো সমস্যা নেই। দিনে পাঁচ কাপ কফি যে খায় তার পক্ষে এক কাপ কফি খাওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়া অসম্ভব।

“এখন বলুন, আমার ব্যাপারে আপনি কি ফিল করছেন?” লোকটি অন্তর্ভেদি দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে মায়ার দিকে।

“বুঝলাম না?”

“বিশেষ যোগ্যতাসম্পন্ন…” কথাটা বলেই মুচকি হাসেন তিনি। “বিজ্ঞাপনে নিশ্চয় দেখেছেন। আমি জানি আপনার সেই যোগ্যতা রয়েছে।”

স্থিরচোখে চেয়ে থাকে মায়া।

“আপনি সব কিছুই বিচার করেন অন্যভাবে। আপনার মধ্যে একটা ক্ষমতা আছে। কোনো রকম প্রচেষ্টা ছাড়াই আপনি বিচার করতে পারেন। আপনার অনুভূতি খুবই প্রখর। যুক্তির চেয়ে এটাকেই বেশি প্রাধান্য দেন।”

এই লোক এতো কিছু জানলে কী করে? অবাক হয়ে ভাবতে থাকে মায়া।

“অবাক হবার কিছু নেই। আগেই বলেছি, আমি আপনার প্রোগ্রামটা মাঝেমধ্যে শুনতাম।”

ঠিক এ সময় বামন লোকটি তার মতোই বামনাকৃতির একটি ট্রলি নিয়ে ঘরে ঢোকে। তাদের দুজনের মাঝখানে ট্রলিটা রেখে চুপচাপ চলে যায় সে। ট্রলিতে দুটো কফি মগ, একটি কফি পট, কফি মেট, সুগার কিউব আর চামচ দেখতে পায়।

কফি দেবার জন্যে কাউকে অর্ডার করেনি এই লোক, তারপরও কিভাবে এসব চলে এলো মায়া বুঝতে পারে না।

“প্লিজ,” ট্রলির দিকে ইশারা করে প্রসন্নভাবে হেসে বলেন ডক্টর।

মায়া ট্রলি থেকে নিজের জন্যে এক মগ কফি ঢেলে অন্য একটা মগে কফি ঢালতে ঢালতে বলে, “চিনি কতোটুকু দেবো?”

“ওয়ান কিউব।”

একটা সুগার কিউব কফিতে ঢেলে মগটা বাড়িয়ে দেয় সামনের দিকে। “থ্যাঙ্কস।”

জবাবে মায়া শুধু হেসেছিলো। যতো শক্তিশালী ব্যক্তিত্বই হোক, মায়া তাদের সামনে কখনও নার্ভাস বোধ করে না।

“আমার ব্যাপারে আপনার অনুভূতি কি?” জানতে চেয়েছিলেন ডক্টর।

কফিতে চুমুক দিয়ে স্থিরচোখে চেয়ে থাকে মায়া। কোনো রকম চিন্তাভাবনা ছাড়াই সে বলেছিলো, “আপনার সাথে সব সময় আরেকজন থাকে!”

কথাটা শুনে সাদা পোশাকের লোকটির চোখের মণি শুধু অল্প একটু কেঁপে ওঠে। ঠিক তখনই কলিংবেলের শব্দ শোনা যায়। কয়েক মুহূর্ত ভেবে তারপর মায়াকে অবাক করে দিয়ে ডক্টর বলেন, সে যেন কষ্ট করে নিচে গিয়ে একজন অতিথিকে এখানে নিয়ে আসে। কথাটা এমনভাবে বলা হয় যে, মায়া মনে করেছিলো এটা তার ইন্টারভিউয়েরই অংশ। একটু দ্বিধার সাথে উঠে নিচে চলে যায় সে। দরজা খুলে দেখতে পায় বুদ্ধিদীপ্ত চেহারার এক তরুণ দাঁড়িয়ে আছে।

এখন সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠছে সেই ছেলেটাকে সঙ্গে নিয়ে। তার ধারণা এই যুবক অবশ্যই ইন্টারভিউ দিতে এসেছে। যদিও তাদের মধ্যে কোনো কথা হয়নি। ছেলেটা নির্ঘাত তার ভিন্নরকমের গেটআপ দেখে কৌতূহলি হয়ে উঠেছে। বার বার চোখে চোখে তাঁর অদ্ভুত অলঙ্কার আর বেশভূষা দেখছে। মায়ার মত কাউকে এখানে আশা করেনি হয়তো।

“আপনিই কি বিজ্ঞাপনটা দিয়েছেন?” সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বলল চারু।

“না।”

“তাহলে?”

মায়া জবাবটা না দিয়ে দোতলায় উঠে গেলো। সাদা পোশাকের এক লোককে দেখতে পেলো চারু। সোফায় বসে আছেন মূর্তির মতো। মিটিমিটি হাসছেন তিনি।

“উনি দিয়েছেন।” ভদ্রলোককে দেখিয়ে বলল মায়া।

“আসুন,” বেশ গম্ভির কণ্ঠে বললেন ডক্টর আজফার। “বসুন।”

চারু বসলো ডক্টরের ঠিক বিপরীতে একটি সোফায়। মায়া বসলো ডক্টরের পাশে।

“আমি ডক্টর আজফার হুসেন,” ঘোষণা করার মতো করে বললেন তিনি। “আমিই অ্যাডটা দিয়েছি।”

চারু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো ডক্টরের দিকে। মিটিমিটি হাসছেন ভদ্রলোক। যেন উপভোগ করছেন এটা। ভদ্রলোকের পাশে চমৎকার নক্সা করা একটি ছরি আছে। লোকটাকে দেখে মনে হচ্ছে না ক্ষ্যাপাটে কেউ। ধান্দাবাজ বলেও মনে হচ্ছে না। এরকম ধনী লোকেরা তার মতো মানুষজনের সাথে কী নিয়ে ধান্দা করবে? তাতে লাভ কী? ডক্টরের বিত্ত বৈভব আর ব্যক্তিত্ব দেখে মনে হচ্ছে না খারাপ কোনো উদ্দেশ্যও আছে। তবে অন্য একটি সম্ভাবনা তার মাথায় উঁকি দিতেই সতর্ক হয়ে উঠলো-মস্তিষ্ক বিকৃত কেউ হলে তার কাজকারবার নিয়ে অনুমাণ করাটা কঠিন হয়ে পড়ে।

এবার মায়ার দিকে তাকালো সে। মেয়েটা চুপচাপ বসে আছে। তার চোখেমুখে কোনো বিভ্রান্তি নেই। সাধারণত মেয়েদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় খুব প্রখর থাকে। খারাপ মানুষজন তারা এক ঝলক দেখেই বুঝে ফেলে। এই মেয়েটা যেরকম নিশ্চিন্তে বসে আছে তাতে মনে হচ্ছে ডক্টরের ব্যাপারে তার ধারণা আর যা-ই হোক, বাজে নয়।

“আপনারা দুজনেই ক্যান্ডিডেট,” ডক্টর আজফার আস্তে করে বললেন।

চোখ ধাঁধানো সুন্দরির সাথে চারুর চোখাচোখি হলে মেয়েটা কেবল স্মিত হাসলো।

“ওর সাথে এরইমধ্যে আমার কথা হয়েছে।”

চারু বুঝতে পারলো, কথা হয়েছে মানে ইন্টারভিউ নেয়া হয়ে গেছে। আর তার কি ফলাফল সেটা তো দেখতেই পাচ্ছে। সিলেক্ট না-হলে এতোক্ষণ বসিয়ে রাখতো না। তাহলে কি এ কাজে একাধিক লোক নেবে?

“আমি ওকে সিলেক্ট করে ফেলেছি,” বলেই প্রসন্ন হাসি দিলেন ডক্টর। সেই হাসির অর্থ হতে পারে চাকরিপ্রার্থীকে এটা জানিয়ে দেয়া যে, ইন্টারভিউয়ের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে, ব্যাপারটা এখন নিছক আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া আর কিছু নয়।

মায়া বিস্মিত হলেও পুরোপুরি নির্বিকার রইলো। হুট করে পেয়ে যাওয়া চাকরির আনন্দ নেই তার মধ্যে। সে ভাবছে, কাজটা কি সেটাই জানা হলো না অথচ চাকরি জুটে গেলো!

“এবার আপনার পালা, সেই প্রসন্ন হাসিটা ধরে রেখেই বললেন ডক্টর।

কাঁধ তুললো চারু। কোনো কথা না বলে পকেট থেকে একটা খাম বাড়িয়ে দিলো ডক্টরের দিকে। “এটা আমার সিভি…এখানে মোটামুটি সব কিছুই দেয়া আছে।”

সিভিটা হাতে নিয়ে এক মুহূর্ত দেখে একপাশে রেখে দিলেন ডক্টর আজফার, খুলে দেখার প্রয়োজনীয়তা বোধ করলো না। আগেই বলে নেই, এটা কিন্তু আর সব চাকরির মতো নয়, তাই ইন্টারভিউটাও একটু অন্যরকম হবে।”

আবারো কাঁধ তুললো চারু। তার দিক থেকে কোনো সমস্যা নেই। চাকরি-বাকরির ধান্দা করার জন্য সে এখানে আসেনি। সত্যি বলতে, এটা তার জীবনের প্রথম চাকরির ইন্টারভিউ। এর আগে কখনও চাকরিপ্রার্থী হয়ে কোনো অফিসে টু-ও মারেনি।

“আমি জানিও না কিভাবে ইন্টারভিউ দিতে হয়। বলতে পারেন, এর আগে কখনও চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দেবার অভিজ্ঞতা অন্তত আমার নেই।”

“তাহলে কিসের অভিজ্ঞতা আছে আপনার?”

ডক্টরের প্রশ্নে মুচকি হাসলো চারু। “পুলিশ, গোয়েন্দা, গুণ্ডা-টাইপের লোকজনদের কাছে কিছু ইন্টারভিউ দিয়েছি। অবশ্য সেগুলোকে ইন্টারোগেশন বললেই বেশি ভালো হয়।”

মাথা দোলাতে দোলাতে মুচকি হাসলেন ডক্টর। “হুম, বুঝতে পেরেছি। তবে ইন্টারভিউ বলেন আর ইন্টেরোগেশন, কোনোটারই অভিজ্ঞতা নেই আমার।”

তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকালো চারু। ডক্টরের মুখে এখনও প্রসন্ন হাসিটা লেগে আছে। যে কারণে সে পুলিশ-গোয়েন্দাদের জেরার মুখোমুখি হয়েছিলো সেটা এই লোকের জানার কথা নয়, তাহলে ডক্টর কৌতূহলি হয়ে জানতে চাইছেন না কেন? চাকরিদাতা যখন শুনবে প্রার্থীকে পুলিশ ধরে ইন্টেরোগেট করেছিলো তখন নিশ্চয় জানতে চাইবে, কেন।

অবশ্য জিজ্ঞেস করলেও সমস্যা ছিলো না। সে বুক ফুলিয়ে বলে দিতে সরকারি গোয়েন্দারা একবার তাকে ধর্মিয় অনুভূতিতে আঘাত করার সন্দেহে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলো। আর ভণ্ড এক পীরের চ্যালারা তাকে ধরে নানা রকমের হুমকি ধামকি দিয়ে বোঝাতে চেয়েছিলো সে যেন তার লম্বা নাকটা ‘বাবা’র ব্যাপারে না গলায়।

“আমি আপনাকে আশ্বস্ত করতে পারি, আপনার ইন্টারভিউ না-দেয়ার রেকর্ডটা আজকেও অক্ষুণ্ণ থাকবে!”

ভুরু কুচকে তাকালো চারু। এবার সে নিশ্চিত, তার পাশে যে মেয়েটা বসে আছে সে সিলেক্ট হয়ে গেছে। আর কাউকে দরকার নেই এই বাতিকগ্রস্ত বুড়োর। সুন্দরি আর তরুণী-এ দুটো বিষয় ছাড়া মনে হয় না আর কোনো কিছুর দরকার আছে তার!

“আপনি আবার ভেবে বসবেন না, আমার একজন লোকেরই দরকার, ইঙ্গিতপূর্ণভাবে মায়ার দিকে তাকালেন ডক্টর। বিজ্ঞাপনে কিন্তু আমি পদের সংখ্যা উল্লেখ করিনি।”

চারু বুঝতে পারলো তার সামনে যে বুড়ো বসে আছে সে গভীর জলের মাছ। লোকটা দীর্ঘ অভিজ্ঞতার ফলে অভিব্যক্তি আর শারিরীক ভাষা পর্যবেক্ষণ করে একটু আধটু মানুষের চিন্তা-ভাবনা পড়ে ফেলার ক্ষমতা রাখে হয়তো।

“বুঝলাম, কিন্তু ইন্টারভিউ না-নিয়ে আপনি কি করে বুঝবেন কাজটা আমি করতে পারবো কি-না? মানে, এ কাজে আমার যোগ্যতা আছে কি-না সেটা যাচাই করে দেখা দরকার আছে না?”

মাথা নেড়ে সায় দিলেন ডক্টর। “আপনার বেলায় খুব বেশি যাচাই বাছাই করার তো কোনো কারণ দেখছি না, মিস্টার…?”

“চারু…ওয়াসিফ আহসান চারু।”

“কিন্তু আপনি তো চারু আহসান নামেই বেশি পরিচিত, তাই না?”

অবাক হলো সে। এই লোক তাকে চেনে!

“অবাক হবার কিছু নেই,” আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বললেন ডক্টর। “আপনি এ নামে বেশ কিছু বই লিখেছেন। আমার বুক শেলফেও কিছু আছে। বুঝতেই পারছেন, আমি আপনার বই পড়ি।”

বিস্ময়ে তার দিকে তাকালো মায়া।

চারু আর কিছু বলল না। আবিষ্কার করলো বুড়ো ভক্ত-পাঠক পেয়ে সে ততোটা উদ্বেলিত হতে পারছে না যতোটা সুন্দরি-তরুণী ভক্ত পেলে হয়।

“অনেকের মতো আমিও আপনার চ্যালেঞ্জের ব্যাপারটা জানি। কেউ যদি অতিপ্রাকৃত আর অলৌকিক কিছু প্রমাণ করতে পারে তাহলে আপনি তাকে সঙ্গে সঙ্গে দশ লক্ষ টাকা দিয়ে দেবেন?”

আলতো করে মাথা নেড়ে সায় দিলো চারু আহসান। খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো তার মুখ। কারণ এখন পর্যন্ত কেউ তার কাছ থেকে টাকাটা নিতে পারেনি।

“সেজন্যে সব সময় পকেটে দশ লখ টাকার একটি চেক নিয়ে ঘুরে বেড়ান। যদিও আপনার অ্যাকাউন্টে সেই পরিমাণ টাকা আছে কিনা তাতে অনেকেরই সন্দেহ রয়েছে।”

অবাক হলো চারু। এটা ডক্টর কিভাবে জানলেন? তার অ্যাকাউন্টে সর্বসাকুল্যে…

“অবাক হবেন না,” চারুর চিন্তায় বিঘ্ন ঘটিয়ে বলে উঠলেন ডক্টর আজফার। মুখে মিটিমিটি হাসি। “আন্দাজে বলেছি কিন্তু। আপনার বই পড়ে আমার মনে হয়েছে আপনি এ ব্যাপারে খুবই আত্মবিশ্বাসি, ধরেই নিয়েছেন কেউ কোনোদিন এটা প্রমাণ করতে পারবে না।”

জবাবে কেবল মুচকি হাসলো চারু।

“আপনিই চারু আহসান?” অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর খুব অবাক হয়ে বলল মায়া। এই লোক তার রেডিও প্রোগ্রামটা নিয়ে ব্লগে সমালোচনা করে একটা লেখা লিখেছিলো গত বছর।

মেয়েটার এমন অবস্থা দেখে খুব মজা পাচ্ছে যুক্তিবাদি। তার মনে হচ্ছে এই মেয়েও ডক্টরের মতো তার বই পড়ে। তার লেখার ফ্যান।

“তা-তাহলে…আ-আপনি এখানে কেন?” মায়ার চোখেমুখে হতাশা আর অবিশ্বাস।

মেয়েটার দিকে অবাক হয়ে তাকালো চারু। “মানে?”

“বিজ্ঞাপনে তো বলা ছিলো-”

“ভুলটা আমারই,” মায়ার কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বলে উঠলেন। ডক্টর। “আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেইনি। আসলে ধরে নিয়েছিলাম এতোক্ষণে আপনারা নিজেরা পরিচিত হয়ে গেছেন।”

“উনার সাথে আমার তেমন কোনো কথাই হয়নি, ডক্টর,” বলল সাবেক রেডিও জকি। “আমি শুধু উনাকে এখানে নিয়ে এসেছি।”

“ও।” ডক্টর আর কিছু বললেন না।

সপ্রশ্নদৃষ্টিতে আজফার হুসেনের দিকে তাকালো চারু।

“ওর নাম মায়া,” ডক্টর আস্তে করে বললেন। “আপনি ওকে চিনতে পেরেছেন কি-না জানি না। ও মুক্তি রেডিও’র বিখ্যাত আর.জে মায়া। ভুত প্রেতের আসর নামের একটি জনপ্রিয় অনুষ্ঠান করে।”

ভুরু কুচকে ফেলল চারু। মায়া! মুক্তি রেডিও’র সেই সাইকি আর.জে!

“করতাম,” শুধরে দিলো মায়া। “ওই চাকরিটা এখন আর করছি না।”

ডক্টর এ নিয়ে আর কিছু বললেন না। তিনি চারুর প্রসঙ্গে বলতে লাগলেন, “যতোদূর জানি তামিলনাড়ুর বিজ্ঞানী ডক্টর আব্রাহাম কভুরও চারুর মতো পকেটে চেক নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন, এরকম চ্যালেঞ্জ জানাতেন। আরো অনেক দেশে অনেক যুক্তিবাদি মানুষ এরকম চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করে পকেটে চেক নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আপনার মতো তারাও সবাই র‍্যাশনালিস্ট সোসাইটির সাথেই জড়িত।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো চারু আহসান।

“আমি যে কাজের জন্য অ্যাডটা দিয়েছি সেটার জন্য আপনাদের মতো তরুণ, মেধাবি, উদ্যমি আর চ্যালেঞ্জ নিতে ভালোবাসে এমন দু-জন মানুষেরই দরকার।”

মায়া আর চারু, দু-জনের কেউই আপ্লুত হলো না কথাগুলো শুনে।

“কাজটা কি?” জানতে চাইলো চারু। আর.জে মায়ার উপস্থিতি তাকে ভাবিয়ে তুলেছে। এরকম একজন কেন এই ইন্টারভিউতে আসবে!

“অবাক হবার কিছু নেই,” যেন চারুর চিন্তা-ভাবনা পড়ে ফেলেছেন এমন ভঙ্গিতে বললেন ডক্টর। “আমি দুটো আলাদা অ্যাড দিয়েছি।” কথাটা শেষ করেই দু-জনের দিকে তাকিয়ে প্রসন্ন হাসি দিলেন। “আশা করি এরমধ্যে আর কোনো রহস্য খোঁজার দরকার হবে না।”

“আপনি আসলে কী চান, বলুন তো?” চারুর কণ্ঠে অধৈর্য।

“বলছি। তার আগে কি একটু কফি খাবেন?”

কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে চারুর চোখ চলে গেলো সামনের কফি টেবিলের দিকে। দুটো খালি কাপ বলে দিচ্ছে এরইমধ্যে একপর্ব কফি পান হয়ে গেছে। “না।”

“ওকে।” একটু চুপ মেরে কী জানি ভাবতে লাগলেন ডক্টর। সম্ভবত চিন্তা-ভাবনাগুলো গুছিয়ে নিচ্ছেন।

মায়ার সাথে চারুর চোখাচোখি হলে সে কিছুই বলল না। বোঝাই যাচ্ছে, তার মতো মেয়েটাও অপেক্ষা করছে ডক্টরের মুখ থেকে কথাটা শোনার জন্য।

এভাবে কয়েক মুহূর্ত কেটে যাবার পর গভীর করে নিঃশ্বাস নিয়ে মায়া আর চারুর দিকে তাকালেন ডক্টর। “আপনাদের দুজনের বিশ্বাস একদম ভিন্ন। চারু আহসান বিশ্বাস করে বৈজ্ঞানিক যুক্তি দিয়েই সবকিছুর ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব। এ জগতে অলৌকিক বলে কিছু নেই। আর মায়া বিশ্বাস করে অতিপ্রাকৃত শক্তির অস্তিত্ব আছে। এটা শুধু তার বিশ্বাস নয়, এটা তার নিজস্ব অভিজ্ঞতাও।”

মায়া নির্বিকার রইলো, চারু কেবল আড়চোখে তাকালো ওর দিকে।

“বিজ্ঞান কোনোভাবেই অতিপ্রাকৃত কিছুর অস্তিত্ব মেনে নেয় না। উল্টোদিকে, অতিপ্রাকৃত শক্তিতে বিশ্বাসিরাও বৈজ্ঞানিক যুক্তিকে একমাত্র সত্য হিসেবে মেনে নেয় না।” চারুর দিকে তাকালেন ডক্টর। তার চোখেমুখে এক ধরণের তাচ্ছিল্যের হাসির আভাস লেগে আছে। “এ দুই মতের লড়াই দীর্ঘকালের।”

ডক্টরের কথায় মুচকি হাসলো চারু। কথাটা সত্যি। বিজ্ঞানের সাথে কুসংস্কার আর ধর্মের লড়াই সুপ্রাচীন। কিন্তু অন্ধবিশ্বাসিরা জানে না যুক্তি বুদ্ধিই মানুষকে মানুষ করে গড়ে তুলেছে।

“এই যুক্তি জিনিসটা আসলে কি?”

ডক্টর প্রশ্নাকারে না বললেও চারু জবাব দিলো, “যুক্তি আসলে বুদ্ধিরই সুশৃঙ্খল একটি রূপ। বুদ্ধিকে যদি সংখ্যা হিসেবে গণ্য করেন তাহলে যুক্তি হলো তার গাণিতিক হিসেব। চিন্তার জগতে যুক্তি হলো একটি পদ্ধতি যা দিয়ে আপনি বাস্তবতাকে নিরুপণ করতে পারনে কিংবা বাস্তবতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ চিন্তা করতে পারবেন। সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন, একটু থেমে আবার বলল সে, “এটা আমাদের বুদ্ধিরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। গণিতের মতোই যুক্তি নামক জিনিসটা নিয়ে আমরা জন্মগ্রহণ করি। চর্চা করলে এটা অবশ্য তীক্ষ্ণ হয়। না করলে দিন দিন ভোতা হয় যায়। নির্বুদ্ধিতা বাড়তে থাকে।”

শেষ কথাটা ইঙ্গিতপূর্ণ হলেও মায়া ভাবলেশহীন থাকলো।

“থ্যাঙ্কস।” ডক্টরের মুখে আবারো সেই প্রসন্ন হাসি দেখা গেলো। “তাহলে বিশ্বাস কি?”

চারু তাকালো মায়ার দিকে। যেন এই প্রশ্নের জবাব তারই দেয়া উচিত।

“বিশ্বাস একটি অনুভূতি…এটা যুক্তি দিয়েও প্রতিষ্ঠিত হতে পারে আবার যুক্তি ছাড়াও জন্ম নিতে পারে,” বলল মেয়েটি।

“তার মানে বলতে চাইছেন, বিশ্বাস করার জন্য যুক্তি-বুদ্ধির কোনো দরকার নেই?”

চারুর প্রশ্নে মায়া। মুচকি হেসে বলল, “বললামই তো, এটা আসলে অনুভূতি। এরজন্যে কখনও যুক্তির দরকার পড়ে আবার কখনও দরকার পড়ে না।”

চারু কিছু বলতে যাবে অমনি ডক্টর হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলেন। “আজ একটু আগে আপনাদের মধ্যে পরিচয় হয়েছে, আজকের দিনে সমস্ত তর্ক-বিতর্ক তুলে রাখুন। আশা করি খুব শিঘ্রই এসব করতে পারবেন।”

চারু আর মায়া চুপ মেরে গেলো।

“আপনারা দুজনে হয়তো জানতে চাইবেন, আমি কোন্ দলে?” প্রসন্নভাবে হাসতে হাসতে মাথা দোলালেন ডক্টর। আমার জন্য এ প্রশ্নের জবাব দেয়াটা সত্যি কঠিন। জীবনের দীর্ঘ সময় ধরে আমি এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেরিয়েছি, পাইনি।” একটু থেমে আবার বললেন, “পৃথিবীর অসংখ্য জায়গায় ঘুরে বেরিয়েছি আমি, হিসেব করলে একশরও বেশি দেশ হবে। আর কতো শহর-গ্রাম, জনপদে হেঁটেছি সেটা হিসেব করা আমার পক্ষেও অসম্ভব। মাত্র আঠারো বছর বয়স থেকে আমি আমার এই সফর শুরু করেছিলাম। এখনও আমি ঘুরে বেড়াই, নতুন নতুন জায়গায় যাই, রোমাঞ্চিত হই, বিস্ময়ে বিমূঢ় হই…” গভীর করে দম নিয়ে নিলেন ডক্টর আজফার। “পৃথিবীর সব উন্নত সভ্যতা থেকে শুরু করে একেবারে আদিম বন-জঙ্গলে গেছি আমি। কতো কী দেখেছি@বলে শেষ করা যাবে না। আমার অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার বেশ সমৃদ্ধ বলতে পারেন। মুক্ত একটি মন নিয়ে আমি ওইসব জায়গায় গেছি, কোনো বিশ্বাসের পক্ষেই আমার দায়বদ্ধতা নেই, ছিলোও না কখনও। আমি খোলাচোখে দেখে বোঝার চেষ্টা করেছি, এই জগত-সংসারের স্বরূপ উদঘাটনের চেষ্টা করেছি কিন্তু একটা প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাইনি আজো-যুক্তি-বুদ্ধির বাইরে কিছুই কি নেই? অতিপ্রাকৃত কিছুর অস্তিত্ব কি আছে?”

ঘরে আবারো নেমে এলো পিনপতন নিরবতা।

“এ জীবনে অসংখ্য রহস্যময় ঘটনা আমি দেখেছি,” অবশেষে নিরবতা ভেঙে বললেন ডক্টর। “যুক্তি-বুদ্ধির বাইরে, ব্যাখ্যাতীত সব ঘটনা আর কাজকারবার। ওসব দেখে শিউরে উঠেছি, আমার রোমকূপ দাঁড়িয়ে গেছে কিন্তু নিজের বিচার-বুদ্ধি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারিনি। মনে রাখবেন, আমি পড়াশোনা করেছি দর্শনশাস্ত্র নিয়ে, কিছুদিন শিক্ষকতাও করেছি। আমি কুসংস্কারগ্রস্ত কেউ নই, আমার মুক্ত একটা মন আছে। তারপরও কোনোভাবেই অতিপ্রাকৃত ঘটনাগুলোর ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারিনি।” মুচকি হেসে চারুর দিকে তাকালেন ডক্টর। “মি. চারু আহসানের মতো আমি অবশ্য অতোটা তুখোড় নই। স্বীকার করছি, বুদ্ধিতে আমি কুলিয়ে উঠতে পারিনি। চারু আহসান যেভাবে ভণ্ডদের মুখোশ খুলে দেন সেটা সত্যি প্রশংসার দাবি রাখে।”

চারুর চোখেমুখে প্রচ্ছন্ন গর্ব ফুটে উঠলো।

“কিন্তু কুসংস্কারের সাথে অতিপ্রাকৃত শক্তিকে গুলিয়ে ফেললে বিরাট বড় ভুল করা হবে,” ডক্টর বলে উঠলেন। “ঠগবাজ, ধান্দাবাজ আর চতুর লোকজন অতিপ্রাকৃত বিষয়টাকে ব্যবহার করে পকেট ভরে থাকে, স্বার্থ সিদ্ধি করে। তাদের বুজরুকি, অপকৌশল ধরে ফেলা আর অতিপ্রাকৃত কোনো কিছুকে নস্যাৎ করে দেয়াটা এক বিষয় হতে পারে না।”

চারুর মুখে মেঘের কালোছায়া নেমে এলো, উজ্জ্বল হয়ে উঠলো মায়ার সুন্দর মুখটি।

“চারু আহসান যে কাজটা করে সেটা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে,” ডক্টর যেন ক্ষতি পূরণের উদ্দেশ্যে কথাটা বললেন। কিন্তু কতোটা পূরণ হলো বোঝা গেলো না। “ধান্দাবাজ লোকজনের বুজরুকি ধরে ফেলাটা কিন্তু সহজ কাজ নয়। তীক্ষ্ণ মস্তিষ্ক থাকলেও এ কাজ করা সম্ভব হবে না, যদি…” একটু থেমে চারুর দিকে তাকালেন ডক্টর আজফার। “…কাজটার প্রতি তীব্র প্যাশন না থাকে।”

“আপনি আসলে আমাদের দিয়ে কী করাতে চাইছেন সেটা একটু বলবেন কি?” জানতে চাইলো চারু।

মাথা নেড়ে সায় দিলেন ডক্টর। “আপনি যেটা করেন ঠিক সেটাই।”

“মানে?”

“সত্যকে তুলে ধরা। আপনি অলৌকিক ক্ষমতা দাবি করা লোকজনের বুজরুকি আর তাদের অপকৌশলগুলো উন্মোচিত করে আসল সত্য তুলে ধরেন।”

ভুরু কুচকে তাকালো চারু। “তাহলে উনার কাজটা কি হবে?” মায়াকে ইঙ্গিত করে বলল। “উনি তো…আপনি নিশ্চয় বুঝতে পারছেন?”

স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন ডক্টর। তার মুখে স্মিত হাসি। “একটা বিষয় পরিস্কার করে দেই, আমি আপনার মতো কিংবা ওর মতো নই। সুদীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, অতিপ্রাকৃত শক্তিতে আমার বিশ্বাস এবং অবিশ্বাস পেন্ডুলামের মতোই নিত্য এক দোলাচলে দুলছে। আমার যুক্তি বুদ্ধি আর শিক্ষা বলে এরকম কিছু নেই, থাকতে পারে না। কিন্তু এমন অসংখ্য ঘটনার সম্মুখিন হয়েছি যে, মনে হতে পারে এরকম শক্তি অবশ্যই রয়েছে। বলতে পারেন, আমি পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারিনি।”

“তা বুঝলাম কিন্তু আমি এখনও বুঝতে পারছি না আমার কী কাজ?” মায়া জানতে চাইলো অবশেষে।

মাথা নেড়ে সায় দিলেন ডক্টর। এ জগতে সীমাহীন রহস্য আছে। কখনও কখনও আমাদের সামনে এমন ঘটনাও হাজির হয় যার কোনো ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যায় না। এরকম ঘটনাগুলো আপনারা দুজনে মিলে সমাধান করবেন, ব্যাখ্যা করবেন।”

চারু আর মায়া মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো।

“চারু আহসান যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করবেন, মায়া তার সাইকি শক্তি দিয়ে বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করবেন। আপনারা এক টিমেই কাজ করবেন, একে অন্যেকে সহায়তা করবেন, একটা সত্যই খুঁজে বের করার চেষ্টা করবেন নিজেদের পদ্ধতিতে।”

চারু আর মায়া চুপ মেরে রইলো। তারা ডক্টরের কাছ থেকে আরো কিছু শুনতে চাইছে।

“আমার ধারণা, এই খেলায় দু-জন থাকতে হবে। নইলে সত্যের কাছে পৌঁছানো যাবে না।”

“আপনি এটাকে খেলা মনে করেন?” চারু বাঁকাহাসি দিয়ে জানতে চাইলো।

“না। নিছক খেলা মনে করি না। আমি বলতে চাইছি, এই যে বিশ্বাসের দোলাচল একবার এদিকে, আরেকবার ওদিকে দুলছে সেটা যেন পেন্ডুলামের মতোই স্থির হতে পারছে না। যেন প্রকৃতির প্রকৃতিটাই এমন! দু-দিকের টানে…দু-দিকের অস্তিত্ব ওটাকে বাধ্য করছে দুলতে। হয়তো এটাই সৃষ্টির রহস্য। আর আমি সেটাই জানতে চাই।”

“এতে আপনার কি লাভ?”

“লাভ-লোকসান ছাড়া কি দুনিয়াতে আর কিছু নেই?” নিঃশব্দে হাসলেন ডক্টর। “মি. আহসান, আপনি যে কাজটা করছেন সেটা করে আপনার কী লাভ হয়?”

“এটা আমার প্যাশন। লাভ-লোকসানের কথা চিন্তা করে এটা আমি করি না। আমি আমার প্যাশনটাকেই মিশন বানিয়েছি।”

“হুম। সেটা অবশ্যই বোঝা যায়। নইলে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর তো কোনো দরকার ছিলো না।”

কথার পিঠে আর কিছু বলল না চারু। “আপনার মতো আমারও এটা প্যাশন,” গম্ভির মুখে বললেন ডক্টর।

“আমি তো করছি মানুষকে বিজ্ঞানমনস্ক করার জন্য, সচেতন করার জন্য, তাদেরকে আলোকিত করার জন্য.. আপনি কি কারণে করতে চাইছেন?”

ঠোঁট ওল্টালেন আজফার হুসেন। “ঐ যে বললাম, নিজের কৌতূহল মেটানোর জন্য। কিংবা সত্যকে জানার সুতীব্র আকাঙ্খা থেকে।”

“তাহলে আপনি সেটা নিজে করছেন না কেন?”

চারুর কথায় কয়েক মুহূর্ত চুপ মেরে রইলেন ডক্টর। অবশেষে বেশ নাটকিয় ভঙ্গিতে বাম-পায়ের প্যান্টের নিচটা একটু তুলে ধরলেন।

মায়া আর চারু দু-জনেই কয়েক মুহূর্তের জন্য নির্বাক হয়ে চেয়ে রইলো ডক্টরের অদ্ভুত পা-টার দিকে।

এরকম কিছু দেখার জন্য প্রস্তুত ছিলো না তারা।

.

অধ্যায় ৫

উন্নতমানের একটি প্রস্থেটিক পা!

চারু আর মায়া ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি ডক্টরের এক পা নেই! বিশেষ করে মায়া। সে ডক্টরকে ছুরি হাতে হাঁটতে দেখেছে। ভদ্রলোকের হাটাচলার মধ্যে আভিজাত্য ছাড়া আর কিছু চোখে পড়েনি তার।

“কয়েক বছর আগে এক দুর্ঘটনায় পা-টা হারাই,” প্রসন্ন হাসি দিয়ে বললেন ডক্টর। যেন পা হারানোটা এমন কোনো বড় ঘটনা নয়। তবে এটাই একমাত্র কারণ নয়। আরো কিছু ব্যাপার আছে।”

সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে রইলো চারু আর মায়া।

“আমার বয়স, মাই ডিয়ার ফেলো। গতমাসে বাহাত্তরতম জন্মদিন পালন করেছি। মনের দিক থেকে নিজেকে আমি যতই তরুণ ভাবি না কেন, এ কাজের জন্য যে প্রাণপ্রাচুর্য লাগে সেটা আমার নেই। এসব রহস্য সমাধানে যে তীক্ষ্ণ বুদ্ধির দরকার হয় সেটাও কোনো কালে ছিলো না। যদি থাকতো আমি পেন্ডুলামের মতো দুলতাম না সারা জীবনভর।”

“তাই আপনি ঠিক করেছেন অন্যদের দিয়ে কাজটা করাবেন?” চারু বলল।

মাথা দোলালেন ডক্টর। “ঠিক তা নয়।”

“তাহলে?”

“এই খেলাটায়-মানে ‘খেলা’ শব্দটা নিয়ে যদি আপনার তেমন কোনো আপত্তি না-থাকে-আমরা তিনজন অংশ নিচ্ছি। আমি আয়োজ…আপনারা অংশগ্রহণকারি।”

মুচকি হাসলো চারু। “আমাদের দিয়ে এরকম কাজ করাতে গেলে সেটা কিন্তু বেশ ব্যয়বহুল হবে। এতো টাকা খরচ করে আপনার কী লাভ বুঝতে পারছি না।”

“হা-হা-হা, দু-জনকে চমকে দিয়ে প্রাণখোলা হাসি দিলেন ডক্টর। “টাকার কথা যদি বলেন, এটা আমার যথেষ্টই আছে। বলতে পারেন, এর জন্য যে পরিমাণ টাকার দরকার হবে তার চেয়ে অনেক বেশিই আছে। অথচ আমার কেউ নেই।” ডক্টরের শেষ কথাটা যেন খুব বিষণ্ণ শোনালো। “পরিবার-পরিজন, এমন কি আত্মীয়স্বজন বলতেও কেউ নেই আমার। এতো টাকা দিয়ে আমি কী করবো, বলতে পারেন?” চারু আর মায়া কিছু বলার আগেই ডক্টর বলে উঠলেন আবার, “আমার বাপ-দাদারা খুব ধনী ছিলেন। বাবার একমাত্র সন্তান হিসেবে তাদের কাছ থেকে আমি প্রচুর সম্পত্তি পেয়েছি, তার মধ্যে এই বাড়িটাও পড়ে।

“আমি নিজেও একটু-আধটু ব্যবসা করে বেশ ভালো আয় করেছিলাম। প্রচুর দেশ-বিদেশ ঘুরে খরচও করেছি কিন্তু তাতে সম্পত্তির খুব সামান্যই ব্যয় হয়েছে। এখনও অঢেল সম্পত্তি রয়ে গেছে আমার। তার থেকে একটু খরচ করলেই এটা করা সম্ভব।” একটু থেমে আবার বললেন, “অন্য ধনীদের মতো আমি পানাহার করি না। বাজে কোনো অভ্যেসও নেই আমার। বলতে পারেন, ফালতু সব শখ মেটানোর জন্য টাকা খরচ না করে এইসব করে আমোদিত হতে চাইছি। আমি যদি আমার বন্ধুবান্ধব কিংবা ঘনিষ্ঠজনদের মতো ক্লাবে গিয়ে মদ্যপান করতাম তাহলেও মাসশেষে কয়েক লাখ টাকা উড়ে যেতো। দামি গাড়ি কেনার শখ থাকলে কোটি-কোটি টাকা খরচ করতাম বছরে। আর নারীসঙ্গের কথা যদি বলেন…” গাল চুলকে নিলেন ডক্টর, “…উমমম…আমার অনেক বন্ধু আছে যারা এরকম কাজে কোটি টাকা ওড়াতেও দ্বিধা করে না। বুড়ো বয়সে সুন্দরি-তরুণী বগলদাবা করে ট্রফি ওয়াইফ বানিয়েছে। কেউ আবার স্ত্রী বানানোর প্রয়োজনও মনে করেনি।” একটু থামলেন ডক্টর। “আমি ওদের মতো নই। আমার যে সম্পত্তি আছে তা খরচ করার মতো কোনো অভ্যেস আমার গড়ে ওঠেনি। আগে প্রচুর ঘুরে বেড়াতাম, তাতে সামান্য কিছু খরচ হতো কিন্তু এখন আর পারি না। বয়স আমাকে কাবু করে ফেলেছে, তাই অনেকটাই থিতু হয়ে গেছি। বুঝতেই পারছেন, আমার টাকা ব্যাঙ্কে পড়ে থেকে দিন দিন বেড়েই চলেছে, সেখান থেকে মাসে যে ইন্টারেস্ট পাই তার খুব সামান্য খরচ করলেও আপনাদের দিয়ে এই কাজটা করাতে পারবো।

“আপনি তাহলে ধরে নিয়েছেন আমাদের পারিশ্রমিক কতত হতে পারে?” বলল চারু।

“না।”

“তাহলে কতো ব্যয় হবে সেটা কিভাবে ঠিক করলেন?”

“এটা খুব সোজা। বর্তমান চাকরির বাজারে আপনাদের মতো কেউ যে-পারিশ্রমিক পায় আমি তার চেয়েও একটু বেশি ধরে নিয়ে হিসেব করেছি। আশা করি, একজন যুক্তিবাদি মানুষ হিসেবে আপনি অযৌক্তিক কিছু দাবি করবেন না?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো চারু আহসান। “হুম, বুঝলাম। কিন্তু উনার ব্যাপারে কি ভেবেছেন? উনি তো যুক্তির ধার ধারেন না বলেই জানি।”

টিটকারিটা গায়ে মাখলো না মায়া। নির্বিকার থাকার চেষ্টা করলো সে।

প্রসন্ন হাসি দিলেন ডক্টর। “উনাকে নিয়ে আমি একদমই ভাবছি না। আমি শুধু জানি, যুক্তির চেয়ে অনুভূতি অনেক বেশি সুখকর! উনি নিশ্চয় এমন কিছু চাইবেন না যেটা সুখকর হবে না।”

মায়া কেবল মুচকি হাসলো।

“অবশ্য আমি আপনাদের পারিশ্রমিক ঠিক করে দেবো না, এটা আপনারা নিজেরাই ঠিক করে নেবেন। যদি আমার সাথে কাজ করতে রাজি হোন তো।”

মায়া আর চারু মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো।

“আপনারা দুজনেই ঠিক করে নেন, কত পারিশ্রমিক পেলে কাজটা করতে রাজি আছেন।”

“তার আগে আমাদের জানতে হবে কি কাজ করবো, কতোক্ষণ ধরে করবো, ছুটি পাবো ক-দিন…মানে, ডিটেইল জেনে নিতে হবে।”

“অবশ্যই।” ডক্টর গভীর করে দম নিয়ে আবার বললেন, “আপনাদের এ কাজে কোনো ধরাবাধা সময় নেই। অফিস বলেও কিছু নেই। যদিও আমার এই বিশাল বাড়ির একটা অংশ আপনাদের অফিস হিসেবে সাজিয়ে রাখবো। ইচ্ছে করলে আপনারা এখানে এসে কাজ করতে পারবেন, থাকতেও পারবেন। আপনাদের জন্য আমি তিন-চারটা রুম ছেড়ে দেবো। কেউ আপনাদের বিরক্ত করবে না। খাবার-দাবার থেকে শুরু করে সবই পাবেন এখানে। ইচ্ছে হলে যতোদিন খুশি থাকতেও পারবেন।”

ভুরু কপালে তুললো চারু। মায়া নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো। তবে সেটা অবিশ্বাসে।

“একটা অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করার জন্য নির্দিষ্ট কোনো সময়ও থাকবে না। রহস্যটা সমাধান করতে যতোদিন সময় লাগুক না কেন…সময় নেবেন।”

“কিন্তু অ্যাসাইনমেন্টগুলো দেবে কে?” চারু জানতে চাইলো।

“আমি দেবো। অবশ্য আমার সম্মতি নিয়ে আপনারা নিজেরাও অ্যাসাইনমেন্ট বেছে নিতে পারবেন। তবে প্রথম কয়েকটা অ্যাসাইনমেন্ট আমি-ই দেবো। বেশ কিছু সত্যিকারের রহস্যজনক ঘটনার খবর আমার জানা আছে।”

চারু আর মায়া কিছু বলল না।

“অ্যাসাইনমেন্টগুলো খুব সহজ কিছু হবে না। ধরে নিন, ওগুলো জটিল আর দুর্বোধ্যই হবে। সমাধান করাটাও হবে কঠিন। তবে আশা করি, আপনারা দুজন একসাথে কাজ করলে দারুণ কিছু বেরিয়ে আসবে।”।

“নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, এরকম অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে অনুসন্ধানে নামলে লজিস্টিক সাপোর্টের দরকার হয়,” যুক্তিবাদি সমিতির সাধারণ সম্পাদক বলল, “আমি যে কাজ করি সেখানেও কিছু সাপোর্ট নিয়েই করি। আমাদের র‍্যাশনালিস্ট সোসাইটির কিছু সদস্য আমাকে সব ধরণের সাহায্য করে। আপনি কি এরকম লজিস্টিক সাপোর্ট দিতে পারবেন?”

মাথা নেড়ে সায় দিলেন ডক্টর। “আশা করি আপনার ঐ র‍্যাশনালিস্ট সোসাইটির চেয়ে বেশিই দিতে পারব। টাকা থাকলে লজিস্টিক সাপোর্ট পাওয়া কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তারপরও কিছু কিছু ক্ষেত্রে অন্যরকম সাপোর্ট লাগবে। সেক্ষেত্রে উপরমহলে আমার বন্ধু-বান্ধব আর পরিচিতজনরা তো আছেই। আমাকে বিমুখ করার মতো মানুষ খুব কমই আছে এ দেশে।” আয়েশি ভঙ্গিতে চওড়া হাসি দিলেন ডক্টর। “বব ডিলান একবার বলেছিলেন, মানি ডাজেন্ট টক…ইট সয়্যারস টাকা শুধু কথা-ই বলে না, দিব্যিও দেয়…মাই ডিয়ার!”

“অ্যাসাইনমেন্টগুলো সব দেশের মধ্যেই হবে, নাকি বিদেশেরও কিছু থাকবে?” জানতে চাইলো মায়া।

“বিদেশের মাটিতে গিয়ে এমন কাজ করাটা খুব ঝুঁকিপূর্ণ হবে। আপাতত দেশের ভেতরেই কাজ করবেন আপনারা এই কথাটা বলে গভীর করে নিঃশ্বাস নিলেন আজফার হুসেন। “বাড়ির পাশে আরশিনগর…আমি সবার আগে পরশিকেই দেখতে চাই!”

“কোনো অ্যাসাইনমেন্ট সফলভাবে সমাধান করতে পারলে কি আমি সেটা নিয়ে বই লিখতে পারবো?”

চারুর প্রশ্নে মাথা নেড়ে সায় দিলেন ডক্টর। “অবশ্যই।”

মায়া বলল, “অ্যাসাইনমেন্টটা নিয়ে কাজে নামলে তো টাকা-পয়সারও দরকার।”

“ওগুলো নিয়ে চিন্তা করবেন না,” মেয়েটার কথায় বাধা দিয়ে বললেন ডক্টর। “যখন যা দরকার হবে শুধু বলবেন। আপনাদের এই খরচের কোননা হিসেবও আমি নেবো না। কেউ এটা মনিটরিং করবে না। এক্ষেত্রে আমি আপনাদের উপর বিশ্বাস রাখবো।”

এবার মায়ার মনোভাব জানার জন্য তার দিকে তাকালো চারু।

“আমি রাজি,” ডক্টরের দিকে তাকিয়ে বলল সে।

“আর আপনি?” চারুকে উদ্দেশ্য করে বললেন ডক্টর আজফার।

কাঁধ তুললো সে। “এরকম কাজ পেলে রাজি না-হবার তো কোনো কারণ দেখছি না।”

“দারুণ।” আস্তে করে বললেন ডক্টর। “এবার বলুন, আপনাদের পারিশ্রমিক কতো দিতে হবে।”

চারু আর মায়া ধন্দে পড়ে গেলো। তাদের দুজনের দিকে পালাক্রমে তাকালেন ডক্টর।

“আমার মনে হয় এটা আপনি বললেই বেশি ভালো হবে,” চারু বলল অবশেষে।

“না। আমি আগেই বলেছি, পারিশ্রমিক কতো সেটা আপনারাই ঠিক করবেন। আর এখনই বলতে হবে এমন কোনো কথা নেই। দুয়েকদিন পর জানালেও হবে।”

“ঠিক আছে। তাহলে একটু ভেবে জানাই আপনাকে।”

“অবশ্যই। আপনারা মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে আমাকে জানালেই আমি আপনাদের প্রথম অ্যাসাইনমেন্টটা দিয়ে দেবো।”

“মনে হচ্ছে অ্যাসাইনমেন্টটা ঠিক করেই রেখেছেন?” চারু বলে উঠলো।

মাথা নেড়ে সায় দিলেন ডক্টর। “যারা প্রচুর ভ্রমণ করে তারা খুব গোছালো আর ডিসিপ্লিন্ড থাকে…আমার মতো।” ডক্টরের প্রসন্ন হাসিতে কোনো উন্নাসিকতা নেই। “বেশ কিছু রহস্যময় ঘটনার খোঁজ আছে আমার কাছে যেগুলো এখনও নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়নি। আশা করি আপনাদের প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট হিসেবে চমৎকার কিছুই দিতে পারবো।”

চারু টের পেলো এক ধরণের শিহরণ বয়ে যাচ্ছে তার মধ্যে। এ জীবনে কোনো রহস্য সমাধানে ব্যর্থ হয়নি সে। ডক্টর কি অ্যাসাইনমেন্ট দেবেন সেটা আন্দাজ করার চেষ্টা করলো।

“স্যার?”

একটা নাকি-নাকি কষ্ঠ শুনে সম্বিত ফিরে পেলো চারু। বামনটা দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে।

“উনাদেরকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসো,” কথাটা বলেই উঠে দাঁড়ালেন আজফার হুসেন। “আপনাদের সাথে তাহলে শীঘ্রই দেখা হচ্ছে। টোটার কাছ থেকে আমার কন্ট্যাক্ট নাম্বারটা নিয়ে নেবেন।”

প্রসন্ন হাসি দিয়ে রাজসিক ভঙ্গিতে ছরি হাতে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন ডক্টর।

মায়া আর চারু অবাক হয়ে দেখতে পেলো প্রস্থেটিক পা নিয়ে রীতিমতো স্বাভাবিক মানুষের মতোই হেঁটে যাচ্ছেন ভদ্রলোক।

বোঝাই যাচ্ছে না তার একটা পা কৃত্রিম

.

অধ্যায় ৬

“কী মনে হচ্ছে আপনার?”

মায়ার কথায় ফিরে তাকালো চারু। তারা এখন ডক্টরের বাড়ি থেকে বের হয়ে নিরিবিলি রাস্তার ফুটপাত ধরে হাটছে।

“গভীর জলের মাছ!”

“কে?”

“ঐ পেন্ডুলাম।”

“উনার নাম ডক্টর-”

“জানি, জানি,” কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বলে উঠলো চারু আহসান।

মায়া আর কিছু বলল না। স্বল্পপরিচিত কারোর সাথে তর্ক করতে তার ভালো লাগে না। সত্যি বলতে তর্ক জিনিসটাই তার অপছন্দের।

“আমার ধারণা লোকটার অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে।”

“আমার তা মনে হচ্ছে না।”

মেয়েটার দিকে বাঁকাচোখে তাকালো যুক্তিবাদি।

“বয়স্ক আর নিঃসঙ্গ একজন মানুষ, টাকা-পয়সার কোনো অভাব নেই। একাকীত্ব থেকে এরকম অ্যাডভেঞ্চার করছেন সম্ভবত। ধনীদের অনেক ধরণের বাতিক থাকে, তাই বলে সবাইকে এক পাল্লায় মাপা ঠিক হবে না।”

“বলে যান, আমি শুনছি,” চারু বলল।

“অনেক ধনী আছে এরকম অ্যাডভেঞ্চার করে থাকে) ভার্জিন এয়ারলাইন্সের মালিক…কী যেন নামটা?”

“রিচার্ড ব্র্যানসন।”

“হুম। ব্র্যানসন নানা রকম অ্যাডভেঞ্চার করে বেড়ায়।”

“ওসব করতে গিয়ে একবার মরতেও বসেছিলো।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো মায়া। “আমার মনে হচ্ছে ডক্টর আজফারও সে-রকম একজন মানুষ।”

“আপনি খুব নিশ্চিত মনে হচ্ছে?”

“অনেকটাই। উনি যেমনটা বলেছেন, সব ধনী লোক মদ-জুয়া আর আজেবাজে নেশার পেছনে টাকা নষ্ট করে না।”

“হুম।”

চারুর দিকে তাকালো মায়া। আপনার কি মনে হচ্ছে, সত্যি করে বলুন তো?”

“লোকটার অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে।”

সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো মেয়েটি। তারা এখনও আস্তে আস্তে হাটছে। “আশ্চর্য, আপনি এভাবে ভাবছেন কেন? আমার কাছে মনে হয়েছে উনি একটু আলাদা। মানে, অন্য সবার মতো নন।”।

“আপনার পক্ষে এমনটা ভাবাই স্বাভাবিক। খুব সহজেই বিশ্বাস করে বসেন, যুক্তির ধার ধারেন না।”

চারুর টিটকারিটা হজম করে নিলো মায়া। বেশ শান্ত ভঙ্গিতেই বলল, “আমি যুক্তির চেয়ে অনুভূতিকে বেশি প্রাধান্য দেই…যেটা আপনার পছন্দ নয়। ভালো কথা, আপনি চাকরিটা করছেন তো?”

“আমি তো বলিনি করবো না।”

“ঐ যে বললেন, ডক্টরের অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে। এরকম লোকের সঙ্গে নিশ্চয় আপনি কাজ করবেন না?”

“করবো। কারণ আমারও একটা উদ্দেশ্য আছে।”

মায়া এবার ভুরু কুচকে তাকালো তার দিকে। “তাই নাকি?”

“এই নতুন পাগলের আসল উদ্দেশ্য কি সেটা আমাকে জানতে হবে।”

“নতুন পাগল! অবাক হয়ে তাকালো সাবেক রেডিও জকি, তারপর বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করলো, “তাহলে পুরনো পাগলটা কে?”

“আমি।” একটু গর্বিতভাবেই কথাটা বলল যুক্তিবাদি সমিতির সাধারণ সম্পাদক। তার দৃষ্টি সামনের দিকে। কিছু একটা খুঁজছে সে।

“আর যদি দেখেন ডক্টরের উদ্দেশ্য ভালো?”

মুচকি হাসলো চারু। “তাহলে তো কোনো কথাই নেই। চাকরির নামে তথাকথিত রহস্যময় আর অতিপ্রাকৃত ঘটনাগুলো ভুয়া প্রমাণ করার আরেকটি সুযোগ পেয়ে যাবো। এরকম কাজ আমি বিনে পয়সায় করি, ডক্টরের চাকরিটা লুফে নিলে এর বিনিময়ে বেতনও পাবো, সুতরাং এমন সুযোগ হাতছাড়া করার প্রশ্নই ওঠে না।”

“দেখুন, আপনি যে ধরণের কাজ করেন সেটা নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই। আপনি এমন সব ভণ্ডদের মুখোশ উন্মোচন করেন যারা নিজেদের অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারি বলে দাবি করে। আসলে তাদের

সে-রকম কোনো ক্ষমতাই নেই।”

“সে-রকম কোনো ক্ষমতাবান মানুষ সত্যি সত্যি আছে নাকি?” বাঁকাহাসি দিয়ে বলল চারু।

“অবশ্যই আছে।”

“তাই? দুয়েকটা নাম বলুন তো? কি কেরামতি আছে তাদের?”

“আপনার কি ধারণা যাদের সত্যি সত্যি এমন ক্ষমতা রয়েছে তারা ঢাকঢোল পিটিয়ে জানান দিয়ে বেড়ায় আপনার হাতে ধরাখাওয়া ঐসব ভণ্ডদের মতো?”

চারু চুপ মেরে কয়েক মুহূর্ত ভেবে বলল, “যা-ই হোক, আপনি ঐসব অলৌকিক ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের নিয়ে আসুন আমার কাছে…দেখুন, আমি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পারি কিনা। আরো একবার বুঝিয়ে দেবো, অলৌকিক বলে জগতে কিছু নেই, সব বোগাস।”

“একটু অপেক্ষা করুন, আমাদের তো এরকম কাজই দেয়া হবে। তখন আপনি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েন।”

মুচকি হাসি ফুটে উঠলে চারুর ঠোঁটে।

“তাহলে আপনি আর আমি একই টিমে আছি?”

“না। একই টিমে না। এখানেই আপনি ভুল করছেন।”

“মানে?” মায়ার চোখেমুখে বিস্ময়।

“আপনি একটা জিনিস বুঝতে পারছেন না, ঐ পেন্ডুলাম আপনাকে আর আমাকে একই টিমে রাখেননি?”

“কী বলেন, আজব কথা! উনি তো তা-ই বললেন।”

“হ্যাঁ, বলেছেন, কিন্তু আমরা আসলে একই টিমে নেই। উনি চালাকি করেছেন, আপনি সেটা ধরতে পারছেন না।”

“কিছুই বুঝলাম না। রহস্য না করে খুলে বলবেন কি?” মায়া সত্যি সত্যি কৌতূহলি হয়ে উঠলো।

“এটা খুবই সিম্পল ব্যাপার, পানির মতোই পরিস্কার। আমরা দুজন একটা খেলার মধ্যে আছি। আপনি আমার প্রতিপক্ষ। কিংবা বলা যায় আমি আপনার প্রতিপক্ষ। দু-জন প্রতিদ্বন্দ্বি একসাথে খেলতে পারে কিন্তু এক টিমে থাকে কী করে, বলেন?”

মেয়েটা বুঝতে পেরে চুপ মেরে গেলো।

“ডক্টর নিজেও কিন্তু বলেছেন, তিনি নিরপেক্ষ। তাহলে আমরা দুজন দুটো পক্ষ। সহজ হিসেব, বুঝেছেন? আসলে আমরা দু-জন গ্লাডিয়েটর, আর উনি হলেন মহান রোমান সম্রাট সিজার। আমাদের নিয়ে খেলবেন, মজা পাবেন, আমোদিত হবেন!”

“পুরো বিষয়টাকে অন্যসব খেলার মতোই ভাবছেন, এখানেই ভুলটা হচ্ছে আপনার।”

“তাই? তাহলে আমার ভুলটা ভাঙান দয়া করে।”

“উনি কিন্তু বলেছেন, একই টিমে দু-জন ভিন্ন মতের মানুষ রেখেছেন যাতে করে সত্যের কাছে পৌঁছানো যায়। আমার মনে হয় না, এছাড়া ডক্টরের আর কোনো উদ্দেশ্য আছে।”

“এই হলো আপনাদের নিয়ে এক সমস্যা, যুক্তির ধার ধারবেন না। শুধু মনে হয়। মনে হলেই হবে? এরকম মনে হওয়া দিয়ে দুনিয়া চলে না।”

“তাহলে দুনিয়া চলে কিভাবে?”

“যুক্তি দিয়ে…বুদ্ধি দিয়ে।”

“শুধু যুক্তি আর বুদ্ধি দিয়ে?”

“না। সেই সঙ্গে অবশ্যই সীমাহীন বোকামি দিয়েও।” চারুর ঠোঁটে বাঁকাহাসি।

“ওকে। আজ প্রথমদিন আমরা না-হয় ঝগড়া না করলাম?” কাঁধ তুলল চারু। প্রথমদিন তারও ইচ্ছে করছে না তর্ক-বিতর্ক করতে।

হাঁটতে হাঁটতে কিছুক্ষণ পর মেয়েটা বলল, “ঐ ডক্টরকে আপনার ঠিক পছন্দ হয়নি, এটা আমি বুঝতে পেরেছি। তো, পছন্দ না-হবার কারণটা কি বলা যাবে?”

“কারণ ঐ লোক আমাদের সাথে চালাকি করেছে। আমি এরকম চালাকি করা মানুষ পছন্দ করি না। লোকটা ভেবেছে আমাদের দুজনকে বেশ ভালোই থোকা দিতে পেরেছে কিন্তু সে জানে না, আমি তার থোকা ধরে ফেলেছি।”

“ধরে ফেলেছেন?” অবাক হলো মায়া।

“হুম।”

“কি রকম?”

“আপনি কি এটা খেয়াল করেননি, দুটো দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিলেন আর ইন্টারভিউ দিতে উপস্থিত হলাম কেবল আমরা দু-জন?”

“হুম। খেয়াল করেছি। এটার কিন্তু কারণ আছে।”

“কি কারণ?”

“বিজ্ঞাপনে স্পষ্ট করে বলা ছিলো, যারা জীবনটাকে টিপিক্যালভাবে যাপন করতে চায় তাদের আবেদন করার দরকার নেই,” বলল মায়া। “সেজন্যে খুব বেশি লোকজন আগ্রহি হয়নি, কেবল আমরা দু-জন এসেছি। আরো হয়তো কিছু লোক আসবে। তবে এই চাকরির জন্য লাইন পড়ে যাবে না। এটা একেবারেই ভিন্ন ধরণের চাকরি।”

“হাহ,” চারু বলল। “আপনার মতোই বলেছেন।”

“আচ্ছা। তাহলে এবার আপনার মতো করে বলেন…শুনে তৃপ্ত হই।”

“শুনুন, এ দেশে একটা চাকরির কথা শুনলে শত শত নয়, হাজার হাজার ছেলেমেয়ে আবেদন করে। সেটা যাই হোক না কেন। উনি যে বিজ্ঞাপনটা দিয়েছেন সেটা দেখে কম করে হলেও কয়েক শ লোকের একটা ভীড় থাকা উচিত ছিলো বাড়ির সামনে। তা-না, কেবল আমরা দুজন। তা ও আবার আমাদের সম্পর্কে অনেক কিছু জানেন-আপনার প্রোগ্রাম দেখেন, আমার বই পড়েন। এটা কাকতালিয় ব্যাপার বলে মনে করেন? অসম্ভব।”

মায়া কিছু বলল না, চুপ করে থাকলো। কিছু একটা ভাবছে সে। হাঁটতে হাঁটতে একটা পেপারস্ট্যান্ডের কাছে এসে পড়লো তারা দুজন।

“আপনি বাড়িতে কোন্ পত্রিকা রাখেন?” জিজ্ঞেস করলো চারু।

“মহাকাল।”

“আমি রাখি দৈনিক দিনলিপি। আজকের দিনের দুটো পত্রিকা কিনে নিলো চারু। “যে বিজ্ঞাপনটা দেখে আপনি এখানে ছুটে এসেছেন সেটা আবার পড়ে দেখেন, তাহলেই সব বুঝতে পারবেন।”

পত্রিকা হাতে নিয়ে বিজ্ঞাপনটা পড়তে গিয়ে অবাক হয়ে চেয়ে রইলো মায়া। যে বিজ্ঞাপন দেখে এখানে এসেছে সেটা পত্রিকার পাতা থেকে উধাও হয়ে গেছে জাদুবলে!

.

অধ্যায় ৭

বিস্ফারিত চোখে পত্রিকার পাতা থেকে মুখ তুলে তাকালো মায়া।

“আপনি কি আমার সাথে ফাজলামি করছেন?!”

তার মতো অবিবাহিত এক তরুণীকে লাক্সারি কনডমের আকর্ষণীয় একটি বিজ্ঞাপন দেখানোর মানে কি!

“আমি না, ফাজলামি করেছেন আপনার ঐ প্রিয় ডক্টর,” চারু মুচকি হেসে বলল। “ভালো করে দেখুন।

মায়া অনিচ্ছাসত্ত্বে আবারও তাকালো বিজ্ঞাপনের দিকে। “ঐ অ্যাডটা কোথায়?! এখানেই তো ছিলো!”

চারুর চোখেমুখে বিজয়ির হাসি। “বুঝতে পারলেন না?”

মাথা দোলাল মায়া। কিছুই বুঝতে পারছে না সে।

“ঐ ডক্টর আমাদের দুজনের বাড়িতে দুটো মোডিফাই করা পত্রিকা পাঠিয়েছেন। ঐ দুটো পত্রিকায় কেবল অ্যাডটা ছিলো। তাই আমি আর আপনি ছাড়া অন্য কেউ ইন্টারভিউয়ে যাবার প্রশ্নই ওঠে না।”

মায়া হতবাক হয়ে চেয়ে রইলো হাতের পত্রিকার দিকে। “মাই গড!”

“এবার বুঝুন। কতো কামেল লোক তিনি,” মুখ টিপে হেসে বলল চারু। “ভদ্রলোকের পরিকল্পনা কিন্তু পুরোপুরি সফল। আমরা এসেছি, তার অফারটা লুফেও নিয়েছি।”

“আচ্ছা, উনি তাহলে আগে থেকেই আমাদের সিলেক্ট করে রেখেছিলেন? আমাদের উপর হোমওয়ার্ক করেছিলেন, তাই না?”

“নয়তো কি? আপনার ঐ ভুত-প্রেতরা এসে খবর দিয়ে গেছে উনাকে?”

“ওয়াও!” টিটকারিটা গায়ে না মেখে মায়ার চোখেমুখে বরং প্রশংসার ঝিলিক দেখা গেল।

হতাশ হয়ে তাকালো চারু। মেয়েটার খুশির কারণ ধরতে পারছে না।

“তার মানে উনি আমাদেরকেই চাচ্ছিলেন। আমরাই ছিলাম উনার টার্গেট, আর কেউ না। এটা তো ভালোই। এরকম একটা কাজের জন্য উনি বেছে নিলেন আমাদেরকে। আই ফিল প্রাউড অ্যান্ড প্রিভেলেইড!”

“আপনি আসলেই একটা জিনিস। রেডিওতে কী সব প্রোগ্রাম করতে করতে মাথাটা পুরাই গেছে।”

“শাট আপ! প্রোগ্রামটা আপনার ঐ অলৌকিক বলে কিছু নেই বইটার চেয়েও জনপ্রিয় ছিলো। আমার শ্রোতা ছিলো কয়েক লাখ, আর আপনার বইটা…কতো কপি বিক্রি হয়েছে, হুম? পাঁচ-ছয় হাজার?”

“কিসের সাথে কী। আমার বইটা টাকা দিয়ে কিনতে হয় আর আপনার ঐ এফএম রেডিও’র ভুত-পেত্নির অনুষ্ঠান মাথামোটা অস্থির টিনএজাররা বিনে পয়সায় গেলে।”

“পেত্নি আসলো কোথকে? অনুষ্ঠানটির নাম ছিলো ভুত-প্রেতের আসর।”

“আরে, ঐ একই কথা,” হাত নেড়ে কথাটা উড়িয়ে দিলো চারু। “এখন কাজের কথায় আসুন।আপনি কতো চাইবেন?”

“কি?” বুঝতে না পেরে বলল মায়া।

“বেতনের কথা বলছি।”

“ও,” একটু ভেবে জবাব দিলো মেয়েটি, “আমি সত্তুর চাইবো।”

হাটা থামিয়ে মায়ার দিকে তাকলো সে। “সত্তুর!”

“হ্যাঁ। কেন, বেশি মনে হচ্ছে? মুক্তি রেডিওতে কিন্তু আমি পঞ্চাশ পেতাম, সে তুলনায় কী খুব বেশি চেয়েছি? কাজটা এসি রুমে বসে কথা বলার মতো সহজ কিছু নয়। বুঝতেই পারছেন…মানে…এটা-”।

হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলো চারু আহসান। “আমি কি বলেছি বেশি?”

মায়া ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে রইলো।

“আমার ধারণা এক লাখ চাওয়া উচিত…মিনিমাম।”

“এক লাখ?”

“হুম। ঐ বুড়ো পেন্ডুলামের টাকা-পয়সার কোনো কমতি নেই। কোটি কোটি টাকা ব্যাঙ্কে রেখে দিয়েছেন। আমার ধারণা কম করে হলেও দশ বারো-কোটি টাকা আছে তার ব্যাঙ্কে। এর অর্থ কী জানেন?” মায়ার কাছ থেকে জবাব পাবার আগেই সে বলতে শুরু করলো, “প্রতি মাসে কমপক্ষে দশ-বারো লাখ টাকা ইন্টারেস্ট পান। দেখলেন না, নিজে থেকেই বললেন, প্রতি মাসে যা পান তা খরচ করেও শেষ করতে পারেন না। সেখান থেকে আমাদের জন্য দু-লাখ খরচ করাটা এমন কী?”।

ভুরু কপালে তুললো মায়া। “বাপরে! আমি তো জানতাম আপনি যুক্তিতে সেরা, এখন দেখছি অঙ্ক কষতেও কম জানেন না।”

নিঃশেব্দ হাসলো চারু। “আমরা দুজনেই এক লাখ করে চাইবো, ওকে?”

বাঁকা হাসি দিলো মায়া। “আপনি এক লাখ চাইলে আমি তো আর সতুরে থাকতে পারি না, তাই না?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো চারু। “তাহলে দেরি না করে কালকেই পেন্ডুলামকে এটা জানিয়ে দিন।”

“প্লিজ…পে সাম রেস্পেক্ট হিম। কখন থেকে পেন্ডুলাম-পেন্ডুলাম করে যাচ্ছেন! উনাকে ডক্টর বলতে সমস্যা কোথায়? উনি কিন্তু টিটিএন টিভির ওই হোল্কা মালিকের মতো টাকা খরচ করে অনারারি ডক্টরেট খেতাব কিনে নেননি।”

দু-হাত তুলে আত্মসমপর্নের ভঙ্গি করলো চারু। “ওকে। ডক্টরকে কালই ফোন করে জানিয়ে দিয়েন।”

“সরি। আমি না, আপনি জানাবেন। এক লাখ টাকার প্রস্তাবটা কিন্তু আপনার।”

“আপনার কিন্তু তাতে সায় আছে,” টিপ্পনি কেটে বলল চারু। এমন তো নয়, আপনি এর চেয়ে কম বেতনে রাজি আছেন।

“উফ!” বিরক্ত হলো মায়া। “সব কথার পিঠে যুক্তি না চড়ালে আপনার ভালো লাগে না বোধহয়।”

চারু জানে কথাটা সত্যি। দীর্ঘদিনের চর্চার ফলে এই অভ্যেসটা তৈরি হয়েছে ওর। “ঠিক আছে, আমিই বলবো।”

.

অধ্যায় ৮

ডক্টর আজফার হুসেন ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে তার বিশাল কিচেনে ঢুকলেন। তার সার্বক্ষণিক সঙ্গি ছুরিটা এমনভাবে ঘরের মেঝেতে ঠুকছেন যেন মাথার মধ্যে গুঞ্জন করতে থাকা কোনো গানের সাথে তাল মেলাচ্ছেন।

ঘুম থেকে উঠে ব্রাশ করে শাওয়ার নেবার পর ইংরেজি-বাংলা মিলিয়ে তিন-চারটা দৈনিক পত্রিকা পড়ার পর ব্রেকফাস্ট করেন। সাধারণত নিজের ব্রেকফাস্ট নিজেই বানান, শুধুমাত্র অসুস্থ থাকলেই এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটে।

হাউজমেড ফ্রিজ থেকে দুধের বোতল, দুটো ডিম, একটুকরো পনির আর চার স্লাইস পাউরুটি আগেই বের করে কিচেন টেবিলের উপর রেখে দিয়েছে।

কিচেনের একপাশে স্টেরিও ডেক সিস্টেমের কাছে গেলেন ডক্টর। তার ঘরে এখনও বিলুপ্তপ্রায় টার্ন-টেবল রয়েছে, আছে কয়েক শ’ লং-প্লে’র কালেকশান। আজকালকার ছেলেপেলেরা এসব জিনিস দেখেনি বললেই চলে। মিউজিক তাদের কাছে ভার্চুয়াল জিনিস। হাত দিয়ে ধরে দেখার স্বাদ এরা পায় না। ইয়ারফোন গুঁজে দিয়ে সস্তা আর নিম্নমানের এমপি-থ্রি শুনে শুনে এদের কান স্কুল হয়ে গেছে। সঙ্গিতের আসল স্বাদ থেকে বঞ্চিত একটি প্রজন্ম। স্থূল জিভ যেমন অসাধারণ মদ চিনতে পারে না, তেমনি ভালো সঙ্গিতের কদর করতেও জানে না এরা।

গুন গুনিয়ে একটা সুর তুলতে তুলতে নিজের লং-প্লে’র কালেকশানের দিকে চলে গেলেন তিনি। মলদোভিয়ার প্রখ্যাত বেহালাবাদক এবং কম্পোজার মিহাই বোটোফি’র একটি লোকজ সুরের অ্যালবাম বেছে নিয়ে টার্ন-টেবলে চাপিয়ে দিয়ে আয়েশি ভঙ্গিতে রান্না করতে লেগে গেলেন ডক্টর। ছন্দময় বেহালার সুরে সুরে দুটো ডিমের সাথে একটুখানি দুধ মিশিয়ে ফেটে নিলেন। উত্তপ্ত ফ্রাইপ্যানে সেগুলো ঢেলে দিয়ে বেশ দক্ষতার সাথে রুটি আকৃতির ডিমটা ভাঁজ করে ফেললেন তিনি।

পঁচিশ বছর বয়সে বাবা মারা যাবার পর থেকে তিনি পুরোপুরি একা। মাকে হারিয়েছেন আরো আগে। এভাবে একা একা সকালের নাস্তা করতে কখনও খারাপ লাগে না। বরং এটা তার প্রতিদিনকার রীতি হয়ে গেছে। যখন দেশের বাইরে থাকেন তখন অবশ্য হোটেল-মোটেলের রেস্টুরেন্টেই নাস্তা করেন।

ডিমের ওমলেট আর চার স্লাইস পাউরুটি, সাথে একটুখানি পনির-এই হলো তার নাস্তা। বহুকাল আগে থেকেই বুদ্ধের একটি নিয়ম মেনে চলেন তিনি অল্প আহার অধিক বিহার। তার খাবার-দাবারের মেনু আর পাসপোর্ট দেখলেই বোঝা যাবে নিয়মটা কতো কঠোরভাবে মেনে চলেছেন জীবনভর।

ধীরে ধীরে ডিম আর পাউরুটি খেতে শুরু করলেন ডক্টর আজফার। এরপর হাউজমেডের বানানো কফি খাবেন। এই কফি আর চা জিনিসটা ভালো বানাতে পারেন না। এক্ষেত্রে অন্যের উপর নির্ভর না করে উপায় নেই।

আজকে তার মেজাজ খুব ভালো। যখন সব কিছু নিয়ন্ত্রণে থাকে, তার মতো করে ঘটতে শুরু করে তখন মেজাজ-মর্জি বেশ ভালো থাকে। ভালো করেই জানেন, এ জগতের অসংখ্য ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তবে মানুষ চাইলে অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, নিজের মতো করে নিজের পক্ষে নিয়ে আসতে পারে।

ঠিক এমন সময় তার মনোযোগে বিঘ্ন ঘটলো। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলেন টোটা দাঁড়িয়ে আছে।

তাকে কিছু বলতে হলো না, ডক্টর মাথা নেড়ে সায় দিতেই চলে গেলো সে।

.

ডক্টরের প্রাসাদোপম বাড়িতে দ্বিতীয়বারের মতো এসেছে মায়া আর চারু। তারা এখন বসে আছে দোতলার সেই ড্রইংরুমে যেখানে ডক্টরের সাথে দু দিন আগে তাদের দেখা হয়েছিলো। আজকেও টোটা নামের বামনটি তাদের অভ্যর্থনা জানিয়েছে গেটে।

গতকাল চারু যখন ডক্টরকে জানালো তাদের পারিশ্রমিক মাসে একলাখ টাকা তখন ফোনের অপরপ্রান্তে কোনো রকম প্রতিক্রিয়া টের পায়নি। ডক্টর যেন এমনটাই প্রত্যাশা করেছিলেন। “ও-কে।” টেনে টেনে বলেছিলেন তিনি। তারপরই চলে আসেন কাজের কথায়। “আপনারা কবে থেকে কাজে যোগ দিতে পারবেন?”

কোনোরকম চিন্তা-ভাবনা না করেই চারু বলে ওঠে তারা প্রস্তুত, কাল পরশু থেকেই কাজে যোগ দিতে পারবে। ফোনটা রেখে দেয়ার পর অবশ্য মনে হয়েছিলো মায়ার সাথে আলাপ না করে এটা বলা ঠিক হয়নি। কিন্তু মেয়েটাকে যখন ফোন করে জানালো কথাটা তখন সে “আচ্ছা, ঠিক আছে” বলে তার উদ্বেগ এক নিমেষে দূর করে দেয়।

“এই টোটা লোকটাকে ডক্টর কোত্থেকে কালেক্ট করেছে, জানেন?” আস্তে করে বলল চারু।

ম্যাগাজিন থেকে চোখ তুলে তাকালো মায়া। এখানে আসার পরই একটি বিদেশি ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করে দিয়েছে। “কোত্থেকে?”

“এক রেস্তোরাঁর মেইনগেটে সঙ সেজে দাঁড়িয়ে থাকতো। ডক্টর ওখানে খেতে গিয়ে ওকে দেখেন, তারপরই সঙ্গে করে নিয়ে আসেন।”

“তাই নাকি?”

মাথা নেড়ে আশ্বস্ত করলো চারু আহসান। এর আগে সাকাসের জোকার ছিলো। এখন তো সার্কাসের অবস্থা খুব খারাপ, একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এই বামনটা যে সাকাসে কাজ করতো সেটা বন্ধ হয়ে গেলে বেকার হয়ে পড়ে সে, তারপর ঐ রেস্তোরাঁয় কাজ নেয়।”

“আপনি এসব জানলেন কিভাবে?”

মুচকি হাসলো ‘অলৌকিক বলে কিছু নেই’ বইয়ের লেখক। “গুগল করে।”

অবাক হলো মায়া। “গুগলে এসবও খুঁজে পাওয়া যায়?”

“হুম। মনে রাখবেন, যা আছে ভূগোলে সবই পাবেন গুগলে!” কথাটা বলেই নিঃশব্দে হাসলো চারু।

মায়া নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো।

“ডক্টরের পরিচিত এক ভদ্রলোক মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্লগে এটা নিয়ে বিস্তারিত লিখেছিলো। সম্ভবত ডক্টরকে খুশি করার জন্য।”

“খুশি করার জন্য কেন?”

“ধনীদের সবাই খুশি করতে চায়, আর চিরকুমার ধনী হলে তো কথাই নেই।”

স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে থেকে ভুরু একটু উপরে তুলে আবারো ম্যাগাজিনে নজর দিলো মায়া।

“আমি ডক্টরের নাম দিয়ে গুগলে সার্চ দিলে এটাই সবার আগে চলে আসে। সেখান থেকে জেনেছি। বুঝলেন, ম্যাডাম?”

এবার চোখ তুলে তাকালো মেয়েটি। “বুঝলাম কিন্তু আমাকে দয়া করে ম্যাডাম বলবেন না। আমি আপনার চেয়ে বয়সে বড় হবো না। মে বি, কয়েক বছরের ছোটোই হবো।”

“তাহলে কি বলে ডাকবো?”

“মায়া। অনলি মায়া।”

“সেই সুযোগে আপনিও আমাকে চারু বলে ডাকার সুযোগ পেয়ে যাবেন, তাই না?” নিঃশব্দ হাসি দিতে লাগলো যুক্তিবাদি। “ভেরি স্মার্ট।”

“জি, না, ভাইয়া,” নাটকিয় ভঙ্গিতে বলে উঠলো মায়া। চারুর হাসিতে পানি ঢেলে দিলো যেন। “আমি আপনাকে চারুভাই বলে ডাকবো। হাজার হলেও আপনি আমার চেয়ে বয়সে বড়।”

ভুরু কুচকে চেয়ে রইলো চারু আহসান। প্রায় সমবয়সি কোনো সুশ্রী তরুণী যখন ভাইয়া বলে ডাকে তখন আর যাই হোক প্রীতিকর লাগে না। “আপনি কি করে শিওর হলেন আমি আপনার চেয়ে বয়সে বড় হবো?”

স্থিরচোখে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থেকে মায়া বলল, “আপনি নিশ্চয় আমার সম্পর্কেও অনেক কিছু জানার চেষ্টা করেছেন গুগল থেকে। ধরে নিচ্ছি আমার ফেসবুকেও ঢু মেরেছেন। আমি আমার ডেথ অব বার্থ ফেসবুকে দিয়ে রেখেছি। সুতরাং ওখান থেকে জেনেছেন আমার জন্ম কোন্ সালে। আপনি ভালো করেই জানেন আমি আপনার চেয়ে কয়েক বছরের ছোটো হবো।”

ভুরু কপালে উঠে গেলো চারুর। “ওয়াও! আমি মুগ্ধ!” কপট প্রশংসার সুরে বলল সে। “এটা কি আপনার ঐ সাইকি ক্ষমতাবলে বলছেন নাকি বেসিক উইমেন-ইন্সটিক্ট?”

“আপনার যেটা সুবিধাজনক বলে মনে হয় সেটাই ধরে নিন।”

“আপনি আমার চেয়ে মাত্র এক বছরের ছোটো, ওকে?”

“এক বছর তিনমাস আঠারো দিন,” কাটা ম্যাগাজিন থেকে চোখ না তুলেই বলল মায়া।

এবার সত্যি সত্যি তাজ্জব বনে গেলো চারু। বুঝতে পারলো, মায়াও তার ফেসবুকে ঢুঁ মেরেছে। ওখানে তার ডেট অব বার্থের উল্লেখ আছে। এ নিয়ে সে কিছু বলতে যাবে অমনি সাদা দেবদূতের মতো ধীরপায়ে ঘরে ঢুকলেন ডক্টর আজফার।

“গুড মর্নিং।” মুখে হাসি এঁটে বললেন তিনি।

চারু লক্ষ্য করলো তার হাটার মধ্যে কোনো অস্বাভাবিকতা নেই, শুধু ধীরগতি ছাড়া। তবে সেটা তাকে বরং আভিজাত্যই দান করেছে।

“গুড মর্নিং, ডক্টর, মায়া হাসিমুখে উঠে দাঁড়িয়ে বলল।

একটু বিরক্ত হয়ে চারুও উঠে দাঁড়ালো তবে কিছু বলল না। ডক্টর তাদেরকে বসার জন্য ইশারা করে একটা সোফায় বসে পড়লেন।

“কথা শুরু করার আগে চা-কফি খেয়ে নিলে ভালো হয়, কী বলেন?”

“আমি কফি,” মায়া বলল।

চারুর দিকে তাকালেন ডক্টর।

সে কাঁধ তুললো। “যদি সম্ভব হয় তাহলে চা।”

মুচকি হাসলেন আজফার হুসেন। “ওকে।” হাসি-হাসি মুখটা ধরে রেখেই একটু ভেবে নিলেন তিনি, তারপর কাজের কথায় চলে এলেন। “মানসিকভাবে আপনারা তাহলে প্রস্তুত?”

জবাবটা প্রথমে মায়া-ই দিলো। “জি…আমার দিক থেকে কোনো সমস্যা নেই।”

এবার চারুর দিকে তাকালেন। কাঁধ তুললো সে। “আমারও কোনো সমস্যা নেই।”

“গুড। ভেরি গুড।”

“কিন্তু একটা বিষয় পরিস্কার হতে চাইছি আমি,” চারু বলল।

“কি বিষয়?” কপালে ভুরু তুলে বললেন আজফার হোসেন। মায়ার দিকে তাকালেন তিনি। মেয়েটা ভুরু কুঁচকে চেয়ে আছে র‍্যাশনালিস্ট সোসাইটির জেনারেল সেক্রেটারির দিকে। Oে

“আপনি আমাদের দুজনের বাসায় মোডিফাই করা পত্রিকা পাঠিয়েছিলেন কেন? এই চালাকিটা করার কারণ কি?”

‘চালাকি’ শব্দটা ব্যবহার করায় ডক্টরের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো না, তবে মায়া খুবই অবাক হয়ে চেয়ে রইলো চারুর দিকে। তার অভিব্যক্তি যেন বলছে, শব্দচয়নে আরেকটু ভদ্রতা দেখানোর দরকার ছিলো। চারু আহসান অবশ্য পাত্তাই দিলো না। সে তার প্রশ্নের জবাব চাইছে।

“ওহ্, ডক্টর বলে উঠলেন। “ধরে ফেলেছে তাহলে, তার মুখে চওড়া হাসি।

অবাক হয়ে চারু আর মায়া তাকালো।

“এটা আমাকে বাধ্য হয়েই করতে হয়েছে।”

“বাধ্য হয়ে?” সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালো চারু।

গভীর করে শ্বাস নিলেন আজফার হুসেন। “ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করুন, হাজার-হাজার মানুষের ইন্টারভিউ নেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তার কোনো দরকারও নেই। যে দু-জন মানুষ আমার দরকার ছিলো তাদেরকে আমি আগে থেকেই বাছাই করে রেখেছিলাম। বাকিটা ছিলো তাদের আগ্রহ আর সম্মতি।”

“তাহলে আপনি আমাদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করলেন না কেন?

“কিন্তু তার আগে বলেন, আমাদেরকে কিভাবে বাছাই করলেন?” চারুর প্রশ্নটার পিঠে মায়া প্রশ্ন করে বসলো।

হাত তুলে তাদের দুজনকে আশ্বস্ত করলেন ডক্টর। “বলছি। চারু আহসানের বই আমি পড়েছি। ওর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অন্য অনেকের মতো আমিও জানি। আর মায়ার রেডিও প্রোগ্রামটা যে মাঝেমধ্যে শুনতাম সে কথা আগেই বলেছি,” একটু থেমে আবার বললেন তিনি, “এভাবেই আপনাদের দুজনকে সিলেক্ট করে রেখেছিলাম। আর সরাসরি কেন আপনাদের সাথে যোগাযোগ করিনি?” প্রসন্ন হাসি দিলেন আজফার হুসেন। “সেটা করলে আমি জানতেই পারতাম না আপনাদের আগ্রহ আছে কিনা। এ কারণেই পত্রিকার বিজ্ঞাপনটার ব্যবস্থা করেছি। মানে, একটু ভিন্নভাবে আর কি…যাতে করে বাড়ির সামনে চাকরিপ্রার্থিদের লাইন পড়ে না যায়, আবার যে দু-জনকে চাচ্ছি তাদের মনোযোগ যেন আকর্ষণ করতে পারি।” কথাটা শেষ করে তৃপ্তির হাসি দিলেন তিনি।

এই ব্যাখ্যায় মায়া খুশি হলেও চারু যেন পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারলো না। “আপনি কি শুধু আমাদের দুজনকেই সিলেক্ট করে রেখেছিলেন?”

রহস্যময় হাসি দিলেন ডক্টর। “এ প্রশ্নের জবাব জানাটা কি খুব দরকার?” একটু থেমে আবার বললেন, “আমি অবশ্য তার কোনো দরকার দেখছি না। আসল কথা হলো, আপনারা কাজটা করতে রাজি হয়েছেন বলে আমি খুব খুশি হয়েছি। ধরে নিতে পারেন, আমি যাদের ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছিলাম তাদের মধ্যে আপনারা দুজনই সেরা।”

“ডক্টর আজফার,” মায়া বলল, “আপনি আমাদের তুমি করেই বলবেন, বয়সে আমরা অনেক ছোটো।”

ডক্টরের মুখে আবারো সেই প্রসন্ন হাসি দেখা গেলো। তারপর চারুর দিকে ফিরলেন তার মনোভাব বোঝার জন্য।

কাঁধ তুললো যুক্তিবাদি লেখক। মনে হলো অবশেষে সন্তুষ্ট হয়েছে। ডক্টরের ব্যাখ্যায়।

“ঠিক আছে,” বলেই দরজার দিকে তাকালেন আজফার হুসেন। টোটা তার প্রায় সমান একটি টি-ট্রলি ঠেলে নিয়ে আসছে।

চারু ভেবে পেলো না তাদের চা-কফির ফরমায়েশ কিভাবে পেয়ে গেলো এই বামন। নিশ্চয় সিসিক্যাম আর সাউন্ড সিস্টেম আছে ঘরে।

উঠে দাঁড়ালো মায়া। ট্রলিটা নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে চা-কফি পরিবেশনে লেগে গেলো। “আপনি তো একটা কিউব, তাই না?” ডক্টর হাসিমুখে মাথা নেড়ে সায় দিলেন। “আর আপনি…মি. চারু?”

“নো সুগার।”

অবাক চোখে তাকালো মায়া। “আপনার ডায়াবেটিস আছে নাকি?”

চারুর চোখমুখ তিক্ততায় ভরে উঠলো। এরকম প্রশ্ন সে অনেক নাদানের মুখ থেকেই শুনে থাকে। এরা ভাবে চিনি ছাড়া চা কেবলমাত্র ডায়াবেটিসের রোগিরাই খায়। মায়ার মতো সুন্দরি, স্মার্ট তরুণীর কাছ থেকে এরকম প্রশ্ন মোটেও আশা করেনি। “না,” কাটাকাটাভাবে বলল। “আমি কোনো খাবারেই আলগা চিনি নেই না।”

“ও,” মায়ার ভুরু সামান্য ঢেউ খেলে গেলো।

“আমিও কিন্তু চায়ে চিনি নেই না,” বললেন ডক্টর, “শুধু কফিতে সামান্য নেই, নইলে খুব তেতো লাগে।”

মায়া একে একে দু-জনের হাতে কফি আর চায়ের কাপ তুলে দিয়ে নিজের কাপটা নিয়ে বসে পড়লো।

আলতো করে কফিতে চুমুক দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললেন ডক্টর। “আহ্! দারুণ হয়েছে।”

চারু আস্তে করে চায়ে চুমুক দিয়ে মায়ার দিকে তাকালো। মেয়েটা মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ডক্টর আজফারের দিকে।

“তোমাদের প্রথম অ্যাসাইনমেন্টটা খুবই ইন্টারেস্টিং,” কফিতে আরেকটা চুমুক দিয়ে বললেন ডক্টর। “ঘটনাটা আমাকে দারুণভাবে আকর্ষণ করেছে, আগ্রহি করেছে। সত্যটা জানার জন্য আমিও ব্যাকুল হয়ে আছি।”

চারু আর মায়া কিছু বলল না। তারা আরো কিছু শোনার জন্য অপেক্ষা করছে।

“আচ্ছা, তার আগে বলো হ্যালোউইন সম্পর্কে তোমরা কতোটুকু জানো?” পালাক্রমে দু-জনের দিকেই তাকালেন আজফার হুসেন।

“অক্টোবরের শেষ দিন…৩১ তারিখ মৃত আত্মাদের স্মরণে এটা পালন করা হয়,” আস্তে করে বলল মায়া।

চারুকে দেখে মনে হলো এসব বালখিল্য ব্যাপারে মোটেও আগ্রহি নয় সে।

“এই হ্যালোইন ডে-র উৎপত্তি কোথায় তা কি তোমরা জানো?” ডক্টর এবার তাকালেন চারুর দিকে। যেন এ প্রশ্নটার জবাব তার কাছ থেকেই আশা করছেন।

কিন্তু চারু কোনো কথাই বলল না।

“হ্যালোউইন শব্দটি এসেছে স্কটিশ শব্দ ‘অল হ্যালোজ’ ইভ থেকে,” ডক্টর বলতে লাগলেন। “এর অর্থ ‘শোধিত সন্ধ্যা বা পবিত্র সন্ধ্যা’। সময়ের বির্বতনে এটা ‘হ্যালোজ ইভ’ থেকে ‘হ্যালোইন’-এ রূপান্তরিত হয়েছে।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো মায়া। গতবছর হ্যালোউইনের রাতে বিশেষ একটি অনুষ্ঠান করেছিলো রেডিও মুক্তিতে। তখন এই উৎসবের অনেক তথ্য-উপাত্ত জোগাড় করে শ্রোতাদের জানাতে হয়েছিলো। হ্যালোইনের প্রতীক ‘জ্যাক-ও-ল্যান্টার্ন, এটা বানানো হয় ফাঁপা মিষ্টি কুমড়ার গায়ে ভীতিকর আকৃতির নাক-মুখ-চোখ খোদাই করে ভেতরে মোম বাতি জ্বালিয়ে। এ দিয়ে বোঝানো হয় আত্মাটা ভীষণ কষ্টে আছে, কিংবা স্বর্গ আর নরকের মাঝামাঝি অবস্থানে আছে ওটা। O

“প্রায় দু-হাজার বছর আগে আয়ারল্যান্ড, ইংল্যান্ড ও উত্তর-ফ্রান্সের যে অঞ্চলটি সেখানে বসবাস করতো কেল্টিক জাতি,” বললেন ডক্টর। “নভেম্বরের প্রথম দিনটি তাদের নববর্ষ বা সাহ-উইন হিসেবে পালন করা হতো। এই দিনটিকে তারা মনে করতো গ্রীষ্মের শেষ এবং অন্ধকারের বা শীতের শুরু বলে। অক্টোবরের শেষ দিনকে মনে করতো সবচেয়ে বাজে রাত, যে রাতে সব প্রেতাত্মা আর অতৃপ্তআত্মা তাদের মাঝে ফিরে আসে। এদের সঙ্গে যদি মানুষের দেখা হয় তবে সেই মানুষের ক্ষতি হতে পারে। তাই মানুষজন এ-রাতে বিভিন্ন রকম ভুতের মুখোশ, কাপড় পরে কাটাতো। রাতের বেলা আগুনের পাশে মুখোশ পরে বৃত্তাকারে ঘুরতে ঘুরতে মন্ত্র বলতো তারা। নিজের পরিবার ছোট হলে অন্যের বাড়িতে গিয়ে থাকতো। সমাজের সবাই একত্রিত হতো এক জায়গায়।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো মায়া। অনুষ্ঠানের প্রয়োজনে এসব তথ্য সে নেট থেকে জেনে নিয়েছিলো।

“এই অনুষ্ঠানের সঙ্গে দুটো ব্যাপার জড়িত-একটা হল ‘ট্রিক অর ট্রিট আরেকটি হলো জ্যাকের লণ্ঠন। ছোট ছোট বাচ্চারা বাড়ি বাড়ি ঘুরে আর দরজা নক করে বলতো ট্রিক অর ট্রিট, তখন তারা বাচ্চাদের ঝুলিতে কিছু ক্যান্ডি বা খাবার দাবার দিয়ে দিতো। এখনও সেটাই করা হয়।”

“যত ভুত-প্রেত আছে, সবাই নাকি এ রাতে চলে আসে লোকালয়ে,” মায়া আগ্রহি হয়ে বলল। দেখতে পেলো না চারু আহসান বাঁকাহাসি দিয়েছে তার কথাটা শুনে। “সেই সব ভুত-প্রেতদের খুশি করতে না পারলে বিপদ। সেজন্যে অক্টোবর মাসের শেষ দিনে এই হ্যালোইন উৎসব পালন করা হয়।”

“আমি বেশ কিছুদিন ইউরোপ-আমেরিকায় ছিলাম,” ডক্টর বললেন, “এই হ্যালোউইন পালন করা ওসব দেশে মাতামাতির শেষ নেই। এটা উদযাপন করতে মাসজুড়ে প্রস্তুতি চলে। এখন অবশ্য জাপান, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেও হ্যালোউইন পালন করা হয়।”

“এমন কি আমাদের এখানেও এটা অনেকে পালন করতে শুরু করেছে,” মায়া যোগ করলো।

সায় দিয়ে বললেন আজফার হুসেন, “কয়েক বছর ধরে শুরু হয়েছে, তবে খুবই সীমিত পরিসরে। অভিজাত এলাকার ধনী পরিবারের কিছু কিছু তরুণ-তরুণি এটা করে।”

এরকম একটি ইনভাইটেশন গত বছর মায়া পেয়েছিলো, তবে তাতে যোগ না দিয়ে রেডিওতে একটি অনুষ্ঠান করে সে। অনুষ্ঠানটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছিলো।

এমন সময় ঘরে আবারো টোটার প্রবেশ, তার হাতে দুটো ফাইল। বামন চুপচাপ, অনেকটা প্রোগ্রাম করা রোবটের মতো মায়া আর চারুর হাতে ফাইল দুটো দিয়ে ঘর থেকে চলে গেলো।

“এই ডোসিয়ারে বিস্তারিত সব আছে, তোমরা পড়ে দেখো। আশা করি রহস্যটা তোমাদেরওে আগ্রহি করে তুলবে।”

চারু তার কাপটা সামনের টেবিলে রেখে ডোসিয়ারটার দিকে নজর দিলো। প্রথম পৃষ্ঠায় বড় করে হ্যালোউইনের প্রতীক জ্যাক-ও-ল্যান্টার্নের একটি ভেক্টর ইমেজ আর বাংলা অক্ষরে দুটো শব্দ লেখা আছে।

.

হ্যালোউইন পার্টির বিভীষিকা

অধ্যায় ৯

বারিধারা ঢাকার অন্যতম একটি অভিজাত এলাকা। এখানে একবার লুঙ্গি নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিলো।

পরিহাসের বিষয়, উদ্যোক্তাদের প্রায় সবার বাপ-দাদা আর পূর্ব পুরুষেরা আরামদায়ক লুঙ্গি পরেই ঘুরে বেড়াতো। এমনকি কৈশোরে আর যৌবনে যখন তারা বারিধারায় উঠে আসেনি, তখন আরামদায়ক এই লুঙ্গি পরেই কাটিয়ে দিয়েছে বছরের পর বছর।

লুঙ্গিসংক্রান্ত বিধিনিষেধ আরোপের এই প্রচেষ্টাই বলে দেয়, ওখানে যারা বসবাস করে তাদের বেশিরভাগই নিজেদের শেকড় উপড়ে ফেলেছে, প্রোথিত করার চেষ্টা করছে অন্য কোথাও। আর এটা বেশ ভালোভাবে বোঝা যায় পরবর্তি প্রজন্মের দিকে তাকালে। কোনোরকম রাখঢাক না করেই নিজেদের উপড়ানো শেকড় পশ্চিমে গাঁড়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে তারা। এ কারণেই উঠতি বয়সি তরুণ-তরুণীরা পহেলা বৈশাখের চেয়ে থার্টি-ফাস্ট নাইটেই বেশি ‘ফান খুঁজে পায়। উদ্দাম সেই রাতের জন্য মুখিয়ে থাকে সারাটা বছর।

হয় বছরে একটিমাত্র থার্টিফার্স্ট তাদের তৃপ্ত করতে পারেনি, নয়তো ইংরেজি নববর্ষের এই হুজুগটি শহরের অন্যসব মামুলি জায়গাতে ছড়িয়ে পড়ে ‘গণ’ হয়ে যাওয়ায় ওখানকার কিছু তরুণ-তরুণী আরেকটি পশ্চিমা সংস্কৃতির অভাব বোধ করলো। থার্টিফার্স্ট খুব বেশি ‘কমন’ আর ‘ক্ষ্যাত’ হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। এখন চাই একেবারেই অন্যরকম কিছু।

কিন্তু সেটা কি হতে পারে?

হ্যালোউইন!

কারোর মাথায় এটা প্রথম আসে, বাকিরা সঙ্গে সঙ্গে লুফে নেয়। অসংখ্য চলচ্চিত্রে এই উৎসবটি তারা দেখেছে আর আফসোস করেছে, এমন স্মার্ট আর জমকালো একটি উৎসব নে এ দেশে নেই। তাদের প্রায় সবাই জানে হ্যালোউইন কি। পশ্চিমে বেড়ানোর উসিলায় কেউ কেউ নিজচক্ষেও উৎসবটি দেখেছে।

এই দেশে কেন এটা করা যাবে না?

প্রশ্নটা দীর্ঘদিন ধরে অনেকের মনেই ঘুরপাক খাচ্ছিলো হয়তো, উপযুক্ত সময় আর সুযোগ পেয়ে বিস্ফোরিত হলো অবশেষে।

বারিধারা এলাকার পাঁচ তরুণ-তরুণী এক ফাস্টফুডে হ্যাঁঙ্গ-আউট করার সময় সিদ্ধান্ত নিলো পরবর্তি হ্যালোউইন উৎসবটি তারা সেলিব্রেট করবে। তাদের অলিখিত দলনেতা মিসকাত, যার মা একজন এমপি, ঘোষণা দিলো সার্কেলের বাকি বন্ধুবান্ধবদের এটা জানিয়ে দেয়া হবে। তাদের পুরো সার্কেলটা অংশ নেবে এই উৎসবে।

মিসকাতদের সার্কেলটা খুব বড় না-হলেও ছোটো বলার অবকাশ নেই-চৌদ্দজনের একটি বন্ধুমহল। কলেজ আর ইউনিভার্সিটির উদ্দাম সময়ে আরো বড় ছিলো এটি। পরবর্তিতে কমে গিয়ে চৌদ্দতে থিতু হয়েছে। তারা সবাই সদ্য পড়াশোনা শেষ করে চাকরি কিংবা পৈতৃক ব্যবসায় ঢোকার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সপ্তাহের কয়েকটা দিন রেস্টুরেন্ট, ফাস্টফুড কিংবা কারোর বাড়িতে হ্যাঁঙ্গ-আউট করে।

তাদের সার্কেলে ছেলে-মেয়ের অনুপাত সমান না-হলেও সমস্যা হয়। আটজন ছেলে আর ছয়জন মেয়ের দলটি ভারসাম্য খুঁজে পেয়েছে দলের অন্যতম বিনোদন অ্যাঞ্জেল আর মুস্তফির কারণে। জন্মের দশ বছর পর অ্যাঞ্জেলের মধ্যে ফিফটি-ফিফটি অনুপাত আবিষ্কার করতে শুরু করে সবাই। স্কুলে সহপাঠিরা তাকে চার্লিস অ্যাঞ্জেল বলে ডাকতো। এক্ষেত্রে চার্লি অবশ্যই মিসকাত। বলতে গেলে মিসকাতের সঙ্গেই বেশি সময় কাটে অ্যাঞ্জেলের। সম্ভবত মিসকাতের গার্লফ্রেন্ড তাকে খুব একটা পছন্দ করে না, কারণ মেয়েটা মনে করে তার বয়ফ্রেন্ড অনেক বেশি সময় কাটায় অ্যাঞ্জেলের সাথে। এমনকি তার সাথে ডেটিং করার সময়ও এই ‘হিজড়া’টাকে সঙ্গে রাখে মাঝেসাঝে। প্রায় সবখানেই ওকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় মিসকাত।

মিসকাতদের সার্কেলে অলিখিত একটি নিয়ম আছে। পড়াশোনা শেষ করে তিন-চার বছরের মধ্যে বিয়ে করা যাবে না। এই সময়টাতে তারা জীবনের সমস্ত আমোদ-ফুর্তি করে নেবে। বিয়ে করলেই সার্কেল থেকে বাদ। এক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।

মুস্তফি নামের একজনের জন্য এই নিয়মটি রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ছে দিনকে দিন। তার বাবা একটি ইসলামিক দলের বিরাট নেতা। তারচেয়েও বিরাট ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের অধিকারি। এই ধর্ম-ব্যবসায়ি বাবা এখনই বিয়ের আওয়াজ দেয়া শুরু করে দিয়েছে। আরেক ধর্মের ঝাণ্ডাধারীর মেয়ের সাথে তার বিয়েটা নাকি বহুকাল আগেই, একেবারে নার্সিংহোমে ঠিক করে রাখা আছে! দুই ব্যবসায়িক আর রাজনীতিক বন্ধু তাদের সম্পর্কের বন্ধন আরো দৃঢ় করার জন্য নিজেদের ছেলেমেয়ের মধ্যে বিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর। মুস্তফির এই ফিক্সড করে রাখা বিয়ের কথা তার বন্ধুরা অনেক আগে থেকেই জানে, আর এ কারণেই বেচারার কপালে কোনো মেয়ে জোটেনি। বারিধারায় লুঙ্গিবিরোধী আন্দোলনে মুস্তফির বাবা সক্রিয় থাকলেও নিজের পরিবারকে সব ধরণের পশ্চিমা-সংস্কৃতি থেকে আগলে রেখেছে কড়া শাসনের মাধ্যমে।

তো, হ্যালোউইন পার্টির প্রস্তাবটি সর্বসম্মতভাবে গৃহিত হবার পর প্রশ্ন ওঠে একদল ছেলেমেয়ে নানান সাজে সজ্জিত হয়ে সারারাত পার্টি করবে তেমন জায়গা কোথায় পাবে তারা? বিশাল বড় একটা বাড়ি লাগবে। বারিধারা কিংবা আশেপাশে এমন কোনো বাড়ি নেই যেখানে এই পার্টি করা যেতে পারে। সবগুলো বাড়িই এখন অ্যাপার্টমেন্ট ভবন। কোনো ফ্ল্যাটে এরকম পার্টি করে প্রত্যাশিত ‘চার্ম’ও পাওয়া যাবে না। তাদের দরকার হ্যালোউইন পার্টি করার জন্য উপযুক্ত একটি জায়গা। ভুতুরে পরিবেশ সৃষ্টি করা যাবে এমন জায়গা হলে দারুণ হয়।

সবাইকে আশ্বস্ত করলো তাদের অলিখিত দলনেতা মিসকাত। সে জানালো গাজীপুরে তার দাদার একটি বিশাল বাড়ি রয়েছে। একতলার একটি পুরনো ভবন ছাড়া পুরো বাড়িটাই ফাঁকা। গাছপালা আর ফুলের বাগান আছে সেখানে, আর আছে ছোট্ট একটি পুকুর। কেয়ারটেকার ছাড়া ওখানে কেউ থাকে না। বাড়িটা এমনি এমনি পড়ে আছে। আগে দু-ঈদে যাওয়া হতো, এখন তা-ও হয় না। কয়েক মাস পর বিশাল জায়গাটি ডেভেলপ করা হবে একটি রিসোর্টে। তার মা সংরক্ষিত মহিলা এমপি হবার পর থেকে নিত্যনতুন ব্যবসায়িক চিন্তায় মশগুল থাকেন এখন। খামোখা পড়ে থাকা স্বামির পৈতৃক বাড়ির স্মৃতির মূল্য হেরে গেছে বাজার মূল্যের কাছে।

হ্যালোউইন পার্টির জন্য এমন একটি বাড়িই তো আদর্শ। ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য একটু ডেকোরেশন করে নিলে দারুণ কিছু হবে। তাদের দলে রাফা একজন শৌখিন ট্যাটু আর্টিস্ট, সেই সাথে ইন্টেরিওর ডিজাইনারও। ওকে দায়িত্ব দিলে পুরো বাড়িটা হ্যালোউইন পার্টির উপযোগি করে সাজাতে পারবে।

যাই হোক, তারা ঠিক করলো আসন্ন হ্যালোউইন পার্টিতে নিজেদের সার্কেলের বাইরে কাউকে নেবে না। সংখ্যার দিক থেকে তারা চৌদ্দজন একদম ‘পারফেক্ট’। সার্কেলের নেতা মিসকাতের আবার অপয়া তেরোর ভীতি আছে। টিসকাইডোফোবিয়া নামে পরিচিত রোগে আক্রান্ত মিসকাত সব সময় তেরো সংখ্যাটা এড়িয়ে চলে।

তো মিসকাতদের সার্কেলের সবাই বেশ আগ্রহভরে অপেক্ষা করলো দিনটির জন্য, প্রস্তুতি আর আয়োজনের কোনো ঘাটতি রাখতে চাইলো না তারা। দুই কেস বিয়ার আর কয়েক বোতল হুইস্কিসহ প্রচুর খাবার-দাবারের আয়োজন করা হলো হ্যালোউইন পার্টির জন্য।

৩১শে অক্টোবর সন্ধ্যায় ঢাকার অদূরে গাজীপুরের নির্জন বাড়িতে জড়ো হলো মিসকাতের সার্কেলের বারোজন। শেষ মুহূর্তে বাইকার বাবুর গার্লফ্রেন্ডের শয্যাশায়ি দাদি মারা গেলে তার পক্ষে হ্যালোউইন পার্টিতে উপস্থিত থাকাটা অসম্ভব হয়ে পড়ে। পরিবারের সাথে বিকেলের দিকে সে গ্রামের বাড়িতে চলে যায়। এদিকে তার বয়ফ্রেন্ড বাইকার বাবুও কস্টিউম জোগাড় করতে গিয়ে দেরি করে ফেলে। তবে সন্ধ্যার পর নিজের প্রিয় বাইকটা নিয়ে রওনা দিয়ে দেয় সে। এর ফলে ঘটনাচক্রে হ্যালোউইন পার্টির সদস্য সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াল অপয়া তেরোতে!

গাজিপুরে পৈতৃক বাড়িতে ঢুকেই কেয়ারটেকার শামসু মিয়াকে মিসকাত জানিয়ে দিলো, তাদের আরেকজন বন্ধু একটু দেরি করে আসবে। সে চলে আসার পরই যেন মেইনগেটটা তালা মেরে নিজের ঘরে গিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকে। আজ তার ছুটি। সকালের আগে তাকে আর দরকার হবে না। এ কথা শোনার চেয়েও পাঁচশ’ টাকার একটি নোট হাতে পেয়ে কেয়ারটেকার বেশি খুশি হলো। বাড়ির পেছনে মিসকাতের দাদার ওষুধি গাছের ছোট্ট বাগানের এককোণে নিজের ঝুপড়ি ঘরে গিয়ে আরামে ঘুম দেবে সে। বড়লোকের মাথানষ্ট পোলাপানগুলো সারা রাত ধরে যা খুশি করুক!

রাত আটটার আগেই তারা সবাই নিজেদের হ্যালোউইন পোশাক পরে নিলো। মিসকাত আগেই বলে দিয়েছিলো সে হিথ লেজারের অনুকরণে জোকার সাজবে। তার প্রেমিকা অমি সাজলো হার্লে কুইন, অ্যাঞ্জেল বেছে নিলো ক্যাটওম্যান, রাফা হলো লুসিফার, মুস্তফি সাজলো নাইটমেয়ার অন এলম স্ট্রিটের ফ্রেডি। রিকি আর তার প্রেমিকা টুপা সাজলো জম্বি কাল। নিমো সাজলো ডোরিয়ান গ্রে, ববি সাজলো লিলিথ, আনিকা হলো উইচ, আর রক্তপিপাসু ড্রাকুলার সাজ বেছে নিলো মারজানা।

দলনেতা মিসকাতের সাজসজ্জা এতটাই নিখুঁত হলো যে, প্রথম দেখায় নতুন যে কেউ চমকে যেতে বাধ্য। চুলের স্টাইল থেকে শুরু করে মেকআপ-গেটআপে কোনো কমতি রাখলো না। এমন সাজ সাজার পর থেকে তার আচরণেও পরিবর্তন চলে এলো। জোকারের স্টাইলে কথা বলতে শুরু করে দিলো সবার সাথে। যেন জোকারের ক্যারেক্টারে ঢুকে পড়েছে-হ্যালোউইন পার্টি শেষ না হলে সেটা থেকে বের হতে পারবে না।

দলের বারোজন সাজগোজ করে প্রস্তুত হয়ে গেলেও তেরোতম সদস্য বাইকার-বাবুর কোনো দেখা পেলো না। স্বাভাবিক কারণেই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো কেউ কেউ। অবশ্য মিসকাত সবাইকে আশ্বস্ত করলো এই বলে, বাবুর সাথে তার কথা হয়েছে সন্ধ্যার একটু পরই। বাইক নিয়ে সে রওনা দিয়েছে। একটু দেরি হলেও সে চলে আসবে।

বাড়ির এককোণে ঝোঁপের আড়ালে বারবিকিউ করার ব্যবস্থা করলো রিকি, তাকে সহায়তা করলো আনিকা। মূল পার্টির আয়োজন করা হলো বাড়ির সবচেয়ে বড় ঘরটিতে। আগে থেকেই বলে রাখার কারণে কেয়ারটেকার সাফ-সুতরো করে রেখেছিলো ওটা। সমস্ত বৈদ্যুতিক বাতি নিভিয়ে মোবাতি আর প্রদীপ জ্বালানো হলো সারা বাড়িতে। বেশ কয়েক জায়গায় মিষ্টি কুমড়ো কেটে হ্যালোউইনের প্রতীক জ্যাক-ও-ল্যান্টার্নও বসানো হলো। এর কৃকিত্ব রাফার। সে বেশ কিছু পুরনো হ্যারিকেনও জোগাড় করে এখানে সেখানে ঝুলিয়ে দিলো। কৃত্রিম মাকড়ের জাল, নরমুণ্ডু আর হাড়গোর দিয়ে পুরো বাড়িটাকে নারকিয় করে তোলার জন্য সে বাহবা পেলো সবার কাছ থেকে।

নারকিয় মমুহূর্তকে আরো বেশি মুখর করে তোলার জন্য হ্যালোউইনের উপযোগি গান নির্বাচনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে নিমোর উপরে।

বড়লোকের সন্তানদের এসব পাগলামি দেখে মেইনগেটের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কেয়ারটেকার শামসু বাঁকাহাঁসি হেসে বাড়ির বাইরে গিয়ে তালেবরের টঙ দোকান থেকে সিগারেট কিনে আনলো। আয়েশ করে সিগারেটে টান দিতে দিতে মনে মনে গালি দিলো সে। আর একটা ‘তারছেঁড়া পোলা’ চলে এলেই সে নিজের ঘরে গিয়ে আরাম করে ঘুম দিতে পারবে। ভালো করেই জানে, বাড়ির মালেকিন, এমপির ছেলে আর তার বন্ধুরা কি করবে আজ রাতে-ভুত-পেত্নি সাজার উসিলায় মেয়েমানুষ নিয়ে ফুর্তি করা!

এমপিসাহেবা এই পার্টির ব্যাপারে জানেন দেখে শামসু খুবই অবাক হয়েছে। দু-তিনদিন আগেই তাকে ফোন করে বলে দিয়েছেন মিসকাতের মা, তার ছেলে কিছু বন্ধুবান্ধব নিয়ে একটা পার্টি করবে, সে যেন সব গুছিয়ে রাখে।

যিমুন মা তিমুনি পোলা! মনে মনে বলেছিলো শামসু। মায়ে তো পোঙ মারতাছে দ্যাশের…আর পোলায় মারে বড়লোকের বেটিগো!

যা-ই হোক, রাত এগারোটার পরও বাবু এলো না দেখে তাকে ফোন করা হলো কিন্তু সেই ফোন বাবু ধরলো না। অগত্যা সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লো হ্যালোউইন পার্টি নিয়ে। অদ্ভুত আর ভীতিকর সব সাজপোশাকে ঘুরে বেড়াতে লাগলো বিশাল বাগানবাড়িতে। দশফুট উঁচু সীমানাপ্রাচীরের উপর দিয়ে যদি আশেপাশের কোনো কৌতূহলি মানুষ উঁকি মারতো তাহলে বহুল প্রচলিত আর পুরনো ভূতপ্রেতের বিশ্বাসটি আরো সুদৃঢ় হতো, পরদিন থেকে মুখরোচক ভুতের গল্প ছড়িয়ে পড়তো আশেপাশের গ্রামে। সে-রকম কিছু হলে কেয়ারটেকার শামসু মিয়ার জন্য সেটা বাড়তি সুবিধাই বয়ে আনতো-ভূতের বাড়িতে ঢু মারার সাহস করতো না কেউ। আম-কাঁঠাল, পেয়ারা আর বাগানের ফুল চুরি করা বেশ কমে যেতো। অলীক আর অদৃশ্য ভুতের দল কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শামসু মিয়ার সাথে পাহারাদারের কাজটা করতো তখন।

রাত বারোটার পর প্রচুর বিয়ার আর মদ্যপানের ফলে পার্টি যখন বেশ জমে উঠেছে তখনই উপস্থিত হলো ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। ততোক্ষণে শামসু মিয়া বাড়ির ভেতরে থাকা ‘ভুত-প্রেত’দের দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, নইলে গেট খুলে মূর্তিমান এক আতঙ্ককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে একটু হলেও ভড়কে যেতো।

ফ্রাঙ্কেনস্টাইন দেরি করে পার্টিতে যোগ দিলেও কেমন অদ্ভুত আচরণ করতে লাগলো। পার্টির সবাই তখন পানাহার করে একটু বেসামাল। ব্যাপারটা নিয়ে কেউ খুব একটা মাথাও ঘামলো না। শুধুমাত্র অ্যাঞ্জেল এ নিয়ে একটু অনুযোগ করেছিলো। রাগে গজ গজ করতে করতে তার পাশে বসে এ কথা জানাতেও ভোলেনি সে আরে বাবা, হ্যালোউইন পার্টিতে সবাই সেজেছে, তাই বলে কি সত্যি সত্যি ওরকম আচরণ করতে হবে। তার প্রিয় বন্ধু মিসকিটাও জোকারের সাজ সাজার পর থেকে সেই ক্যারেক্টারের ভেতর ঢুকে পড়েছে। এখন আবার বাবু একই কাজ করছে। এসব হচ্ছে কী!

তাদের দলনেতা মিসকাত থাকলে হয়তো আমুদে ভঙ্গিতে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের কাঁধে হাত রেখে জোকারের সেই বিখ্যাত ডায়লগটির অনুকরণে বলতে ‘হোয়াই সো সিরিয়াস, ম্যান?’ কিন্তু ফ্রাঙ্কেনস্টাইন আসার আগেই সে তার গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে শোবার ঘরে চলে যায়। অমি বেশি মদ খেয়ে হরহর করে বমি করে দিয়েছিলো একটু আগে। বেশি মদ সে কোনোকালেও খেতে পারে না, তারপরও ছেলেদের সাথে পাল্লা দিয়ে মদ খাবে, আর কিছুক্ষণ পরই উগলে দেবে সবটা। গত থার্টিফাস্ট নাইটে অ্যাঞ্জেলের উপরে যখন বমি করে দিয়েছিলো তখন দুয়েকজন মেয়ে হাসতে হাসতে বলেছিলো, ‘অমি আসলে সতীনের উপর ঝাল মিটিয়েছে!’

তো, ফ্রাঙ্কেনস্টাইনকে নিয়ে কেউ খুব একটা মাথা ঘামানোর ফুরসত পেলো না। বারবিকিউ পার্টি তখন জমে উঠেছে। যাদের একটু হুশ আছে তারা আগুনের চারপাশে জড়ো হয়ে বিয়ার খাচ্ছে। মুস্তফি মদ খেয়ে বেসামাল হয়ে তার ধর্মব্যবসায়ি বাপকে গালাগালি করে যাচ্ছে আপন মনে। কিভাবে তার বাপ তার জীবনটা অতীষ্ঠ করে তুলেছে, কতোটা পরাধীন হয়ে থাকে সে, কতো শখ-আহ্লাাদ বিসর্জন দিতে হয় তাকে, এসবের পাশাপাশি বাপের পছন্দের মেয়েকে যে বিয়ে করতে বাধ্য করা হবে তাকে সেটা নিয়েও ক্ষোভ ঝাড়লো। তার এই বকবকানিকে বাড়তি বিনোদন হিসেবেই দেখলো সবাই। কেউ কেউ টিপ্পনি কেটে তার জ্বালা আরো বাড়িয়ে তোলারও চেষ্টা করলো।

সব বন্ধুমহলেই কমপক্ষে একজন পেটুক থাকে, মিসকাতদের দলে সেটা রিকি। গায়েগতরে শুকনো হলে কি হবে, খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে ওকে হারিয়ে দেবার মতো কেউ নেই তাদের সার্কেলে। বারবিকিউ পার্টির সমস্ত দায় দায়িত্ব স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে সে। রাত একটার দিকে গ্রিল আর স্টেইক রেডি হবার পরও যখন মিসকাতের দেখা পেলো না তখন সবাই ধরেই নিলো হার্লে কুইনের সাথে জোকার নিশ্চয় অভিসারে মত্ত। তাদেরকে বিরক্ত করা ঠিক হবে না। অনেকের খিদে তখন তুঙ্গে। গ্রিল আর স্টেক না-হলে একদমই চলছে না।

একে একে বাকিরাও জড়ো হতে শুরু করলো বার-বি-কিউ’র সামনে। তবে মিসকাতকে বাদ দিয়ে বার-বি-কিউ পার্টি শুরু করতে ইতস্তত বোধ করছিলো অ্যাঞ্জেল। একান্ত অনিচ্ছায় খেতে শুরু করলে সে দেখতে পায় একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন।

ছেলেটা এমন করছে কেন? ওর অদ্ভুত আচরণে অ্যাঞ্জেল বেশ অবাক হলো। কয়েকবার হাত তুলে তাকে ইশারা করলো তাদের সাথে যোগ দেবার জন্য কিন্তু মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলো সে। অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের সাথে চোখাচোখি হতেই কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হলো তার।

সুস্বাদু খাবার সামনে পেয়ে তারা সবাই যখন খেতে শুরু করেছে তখনই ভেতর বাড়ি থেকে একটা চিৎকার ভেসে এলো। কণ্ঠটা তাদের সবার চেনা।

হার্লে কুইন! মিসকাতের গার্লফ্রেন্ড অমি।

তার চিৎকারে এমন কিছু ছিলো যে, বার-বি-কিউ রেখে সবাই ছুটে গেলো বাড়ির ভেতরে শোবার ঘরের দিকে। অমিকে সেখানে না পেয়ে সবাই ছুটলো ঘরের বাইরে, হলওয়ের শেষ মাথায় বিশাল বড় বাথরুমের দিকে। ওখানে গিয়ে দেখতে পেলো, বাথরুমের খোলা দরজার সামনে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে আছে মেয়েটা। আর ভেতরের দৃশ্য চোখে পড়তেই ভয়ে আৎকে উঠলো সবাই।

বাথরুমের মেঝেতে জোকাররূপি মিসকাত হাত-পা ছড়িয়ে চিৎ হয়ে পড়ে আছে। বুকে গেঁথে আছে একটা ছুরি। সারা শরীর ডুবে আছে রক্তে।

মিসকাত খুন হয়েছে। ধারালো ছুরি দিয়ে বীভৎসভাবে খুন করা হয়েছে তাকে।

মুহূর্তে হ্যালোউইন পার্টি বদলে গেলো এক বিভীষিকায়। সুবিধাপ্রাপ্ত ধনী পরিবারের সন্তানেরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়লো। মেয়েগুলো চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিলো তীব্র আতঙ্কে। কেয়ারটেকার শামসু মিয়াও ভড়কে গেলো, কিন্তু খবরটা মিসকাতের মা-কে জানানোর মতো বোধবুদ্ধি তার পুরোপুরি লোপ পেলো না।

প্রথমে এলো স্থানীয় থানার পুলিশ। তারপর টাকা থেকে মিসকাতের বাবা-মাসহ পরিবারের অনেকেই ছুটে এলো শৈষরাতের আগেই।

জ্ঞান ফিরে পাবার পর মিসকাতের গার্লফ্রেন্ড অমি জানালো, সে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। ঘুম ভাঙার পর পাশে মিসকাতকে না দেখে অবাক হয়নি। ভেবেছে, তাকে রেখে হয়তো বন্ধুদের সাথে বার-বি-কিউ পার্টিতে যোগ দিয়েছে। তলপেটে প্রচণ্ড চাপ অনুভব করায় বাথরুমের দিকে পা বাড়ায় সে, আর তখনই দেখতে পায় বীভৎস দৃশ্যটি।

খুনের পর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন যে লাপাত্তা হয়ে গেছে সেটা সবার আগে লক্ষ্য করে অ্যাঞ্জেল।

বাইকার বাবু, যে কি-না ফ্রাঙ্কেনস্টাইন সেজে সবার শেষে পার্টিতে যোগ দিয়েছিলো, যার আচার-আচরণ ছিলো খুবই অদ্ভুত, সে যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে সবার অগোচরে। কেউ জানে না ঠিক কখন সে পার্টি ছেড়ে চলে গেছে। বাকিরা পুলিশের জেরার মুখে এ ব্যাপারে কোনো তথ্যই দিতে পারলো না। স্বাভাবিকভাবেই পুলিশ বুঝে গেলো খুনি আর কেউ নয়, ঐ বাইকার বাবু।

মিসকাতের শোকাতুর মা খুব দ্রুত একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন-যতো দ্রুত সম্ভব তার ছেলের হত্যাকারীকে ধরতে হবে। সেই সাথে হ্যালোউইন পার্টির এই ঘটনাটি যেন কোনোভাবেই পত্র-পত্রিকায় আসতে না পারে সেই ব্যবস্থাও করতে হবে। খুনি কে তারা সবাই বুঝে গেছে, সুতরাং পত্রপত্রিকায় কিংবা টিভি-নিউজে এসব না-আসাই ভালো। এতে করে এমপিসহ বাকি পারিবারগুলোর সম্মান কমবে বৈ বাড়বে না।

পুলিশ ধরে নিলো বাইকার বাবুকে ধরতে পারলেই সব কিছু পরিস্কার হয়ে যাবে। খুনটা যে সে করেছে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তাকে ধরে প্যাদানি দিলেই সব বেরিয়ে আসবে ঠিক কি কারণে মিসকাতকে এভাবে হত্যা করা হলো।

নিহতের শরীরে কম করে হলেও দশ-বারোটি ছুরিকাঘাতের চিহ্ন রয়েছে। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত চাকুটা আলামত হিসেবে জব্দ করলো পুলিশ। বারবিকিউ করার জন্য কিছু কিচেন-নাইফ নিয়ে এসেছিলো মিসকাতের বন্ধুরা, তারই একটা ব্যবহার করেছে খুনি।

মিসকাতের লাশ ঢাকায় পৌঁছানোর আগেই সক্রিয় হয়ে ওঠে পুলিশ। স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী খবরটা জানার পর দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার আদেশ দিলেন।

একদল পুলিশ বাইকার বাবু হিসেবে পরিচিত চৌধুরি ইবনুল আহসান বাবুর বাড়িতে গিয়ে হতবুদ্ধিকর হয়ে পড়লো। পুলিশের চেয়েও বেশি অবাক হলো বাবুর পরিবার। তারা জানালো, গতকাল সন্ধ্যায় বাইক অ্যাকসিডেন্ট করে বাবু হাসপাতালে ভর্তি আছে। তার ডান পা-টা দু জায়গায় ভেঙে গেছে, মাথায় আঘাত পেয়েছে সে। রাতেই অপারেশন করতে হয়েছে পায়ে। ভাগ্য ভালো, এ যাত্রায় বেঁচে গেছে তাদের ছেলে।

হাসপাতালে গিয়ে এ কথার সত্যতা খুঁজে পেলো পুলিশ। ডাক্তাররা জানালো, গতকাল সন্ধ্যার পর পর, সম্ভবত সাতটার দিকে মারাত্মক আহত অবস্থায় বাবুকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। তার পায়ের আঘাতটি ছিলো বেশ গুরুতর। দ্রুত অপারেশন করতে হয়েছে। রোগি এখন অনেকটাই আশঙ্কামুক্ত।

এই হতবুদ্ধিকর ঘটনায় পুলিশসহ মিসকাতের পরিবার আর বন্ধুবান্ধব যারপরনাই বিস্মিত হলো। মিসকাতের মা, এমপিসাহেবা বিশ্বাসই করতে পারলেন না এটা। পুলিশকে আরো বেশি তদন্ত করার জন্য প্রবল চাপে ফেলে দিলেও শেষ পর্যন্ত একটা সত্যই জানা গেলো-৩১শে অক্টোবর সন্ধ্যার দিকে বাইকার বাবু গাজীপুরে রওনা দেবার পর পরই দুর্ঘটনার কবলে পড়ে মারাত্মক আহত হয়েছে।

আর একটা প্রশ্নেই পুলিশের তদন্ত থমকে দাঁড়ালো ঐদিন হ্যালোউইন পার্টিতে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন সেজে কে গিয়েছিলো?

.

ডক্টর আজফার চেয়ে আছেন মায়া আর চারুর দিকে। ছরিটা যে হাতে ধরে আছেন সেই হাতের উপরে অন্য হাত দিয়ে টোকা দিচ্ছেন উত্তেজনাবশত। তিনি বোঝার চেষ্টা করছেন ডোসিয়ারটা পড়ে কার কি রকম প্রতিক্রিয়া হচ্ছে।

দীর্ঘ সময় নিয়ে হ্যালোউইনের ডোসিয়ারটা পড়ার পর তারা দুজন মুখ তুলে তাকালো।

“এটা তো অবিশ্বাস্য!” বলল মায়া। তার কাজল দেয়া চোখদুটো যেন বিস্ফারিত হচ্ছে।।

চারুর কপালে ভাঁজ। যদিও নিজের বিস্ময় জোর করে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে সে।

“তোমার কি মনে হচ্ছে?” ডক্টর জিজ্ঞেস করলেন তাকে।

একটু গলি চুলকে নিলো সে। “ইন্টারেস্টিং। মনে হচ্ছে তদন্তটা খুব চ্যালেঞ্জিং হবে।”

মাথা দোলাল মায়া। “পুলিশ অলরেডি তদন্ত করেছে, তারা কিছুই বের করতে পারেনি!”

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ডক্টর। “শুধু পুলিশ নয়, ডিবিও ইনভেস্টিগেট করছে এটা, তারাও কিছু করতে পারেনি। সবকিছু ঐ একটা জায়গায় গিয়ে থমকে আছে-ফ্রাঙ্কেনস্টাইন সেজে হ্যালোউইন পার্টিতে কে গিয়েছিলো।”

চারু কিছু বলল না।

“খবরটা কোনো নিউজ-মিডিয়াতেই কিন্তু আসেনি,” বললেন আজফার হুসেন। “ধনী আর ক্ষমতাবান বাবা-মায়েরা চায়নি এটা। তারা আপ্রাণ চেষ্টা করেছে খবরটা যেন পত্রপত্রিকা কিংবা টিভি-নিউজে না-আসে।”

“এটা গত বছরের হ্যালোউইনের ঘটনা,” বলল মায়া। সেই রাতে আমি হ্যালোউইন উপলক্ষ্যে স্পেশাল একটি প্রোগ্রাম করেছিলাম।”

মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আক্ষেপে মাথা দোলাল চারু আহসান। কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ কী করে এমন অনুষ্ঠান করতে পারে তার মাথায় ঢোকে না।

“কেসটা কি এখনও তদন্ত করা হচ্ছে নাকি ডিপ ফ্রিজে চলে গেছে?” জানতে চাইলে চারু।

ছোট্ট করে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ডক্টর। “চলছে, তবে কাগজে কলমে। কোনো অগ্রগতি নেই। ঐ সাংবাদিক দম্পতির খুনের কেসটার মতো অবস্থা আর কি। এক জায়গায় থেমে আছে।”

“তাহলে এটাই আমার প্রথম অ্যাসাইনমেন্টট?”

চারুর কথায় ভুরু কপালে তুললেন ডক্টর, তারপর মুচকি হেসে বললেন, “হ্যাঁ, এটাই তোমাদের প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট।”

মায়া কিছু বলল না।

“কবে থেকে আমরা কাজ শুরু করবো?” জিজ্ঞেস করলো যুক্তিবাদি।

“ডোসিয়ারটা তোমরা বাসায় নিয়ে যাও, ভালো করে পড়ো। যখন মনে করবে তোমরা প্রস্তুত তখন কাজে নেমে পড়বে।”

চারু আহসান মাথা নেড়ে সায় দিয়ে মায়ার দিকে তাকালো। মেয়েটা যেন গভীর ভাবনায় ডুবে আছে।

“ডোসিয়ারের শেষে ঐ পার্টিতে যারা ছিলো তাদের সবার নাম-ঠিকানা আর কন্ট্যাক্ট নাম্বার দেয়া আছে,” বললেন ডক্টর। “তবে একটা কথা মনে রেখো, ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করাটা মোটেও সহজ হবে না।”

এটা চারু আন্দাজ করতে পারছে এখনই। অনেক অনুসন্ধানি কাজ করেছে সে, এরকম অ্যাসাইনমেন্টে কি রকম বাধা-বিপত্তি আসতে পারে সে সম্পর্কে কিছুটা ধারনা আছে তার।

“তাহলে তোমারা একটু ব্রেইন-স্টর্ম করে দেখো কাজটা কিভাবে, কোত্থেকে শুরু করবে,” বললেন আজফার হুসেন।

“আমি কাল থেকেই শুরু করতে চাই,” দৃঢ়ভাবে বলল চারু।

কাঁধ তুললেন ডক্টর। “দ্যাটস গুড। তোমাদের মতো আমিও এই রহস্যটা জানার জন্য উন্মুখ হয়ে আছি।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *