মৃন্ময়ীর ঘুম ভাঙানোর মহান দায়িত্ব যে-কাজের মেয়েটি পালন করে তার নাম–বিন্তি। তার বয়স মৃন্ময়ীর কাছাকাছি সতেরো। মৃন্ময়ীর উনিশ। বিন্তি এসেছে নেত্রকোনার দুর্গাপুর থেকে। এই প্রথম তার ঢাকা শহরে আসা। বড়লোকদের কাণ্ডকারখানা কিছুই তার মাথায় এখনো ঢুকছে না। ভয়ে সারাক্ষণই তার কইলজা কাঁপে এবং পেট পুড়ে দুর্গাপুরের জন্যে।
সকাল আটটা। বিন্তি চায়ের কাপ নিয়ে মৃন্ময়ীর ঘরে ঢুকেছে। তার কলিজা কাঁপা শুরু হয়েছে। সে জানে মৃন্ময়ী এক্ষুনি তাকে কঠিন ধমক দেবে। ঘুম ভাঙলে মৃন্ময়ীর মেজাজ খারাপ থাকে। তার দায়িত্ব ভোর আটটায় আপার ঘুম ভাঙানো? আপ নিজেই তাকে এই দায়িত্ব দিয়েছে অথচ…
যথাসম্ভব নরম গলায় বিন্তি ডাকল, আপা! আপা।
মৃন্ময়ী মুখের উপর থেকে চাদর সরিয়ে কঠিন গলায় বলল, এমন এক থাপ্পড় খাবে। যাও বললাম। ভোর ছটার সময় বলে আপা। আপা।
আপা আটটা বাজে।
বাজুক আটটা। আমি এক থেকে তিন গুনব। এর মধ্যে তুমি যদি না যাও তা হলে থাপ্পড় খাবে। সত্যি সত্যি খাবে। এক থাপ্পড়ে দুর্গাপুর।
এই সময় বিন্তির কী করা উচিত সে ভেবে পায় না। তার কি উচিত চায়ের কাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা? নাকি সে ঘর ছেড়ে বাইরে চলে আসবে? সমস্যাটা নিয়ে সে রহিমার মার সঙ্গে আলোচনা করেছে। রহিমার মা এই বাড়ির হেড বাবুর্চি। অনেক দিন ধরে এদের সঙ্গে আছে। রহিমার মা বলেছে, খামার মতো খাড়ায়া থাকবি। নড়বি না। আফা ধমক-ধামক মুখে দিব। আর যদি চড় মারে মারব। বড়লোকদের চড়ে মজা আছে।
কী মজা?
চড় দিয়া বসলে আফার মন হইব খারাপ। তোরে দিব বখশিশ। পাঁচশ টেকাও পাইতে পারস। আফার ব্যাগে ভাংতি থাকে না। আর এরর টেকার নাই হিসাব।
রহিমার মা সব কথাই বাড়িয়ে বলে তবে এদের টাকার যে হিসাব নাই এই কথাটা খুব সম্ভব সত্যি। আপার ঘর গুছাতে গিয়ে একবার সে এমন ধাক্কা খেয়েছিল চিরুনি রাখার ডালায় পাঁচশ টাকার একটা প্যাকেট। রাবার দিয়ে বাধা। সবই চকচকা নোট। যাদের টাকার হিসাব নাই তারাই এত টাকা এইভাবে ফেলে রাখতে পারে।
আজ বিন্তির ভাগ্য খুবই ভালো। একবার ডাকতেই মৃন্ময়ী উঠে পড়ল। বিন্তির হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে সহজ গলায় বলল, বিন্তি মাকে একটু আসতে বল। খুবই জরুরি।
আপা ঘর গুছাব না?
ঘর গুছাতে হবে না। ঘর আরো নোংরা কর।
বিন্তি বের হয়ে গেল। আপার মেজাজ আজ কোন দিকে যাচ্ছে সে বুঝতে পারছে না। ঘর আরো নোংরা কর কথাটার মানেই বা কী?
মৃন্ময়ীর মায়ের নাম শায়লা। তিনি হাইপার টেনশানের রোগী। কোনো কারণ ছাড়াই তার প্রেশার (সিস্টোলিক) ধুম করে একশ হয়ে যায়। তখন তার ঘাড় ব্যথা করতে থাকে কপালের শিরা দপদপ করতে থাকে। দরজা-জানালা বন্ধ করে তাকে শুয়ে থাকতে হয়। তার ঘরে শীত-গ্রীষ্ম সবসময়ই এসি চলে। ঘরের টেম্পারেচার রাখা হয় ২১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে। ঘরে একটা জার্মান মেড হিউমিডি ফায়ার আছে, যার কাজ ঘরের জলীয় বাষ্প ৩৫ পারসেন্টে রাখা।
বসন্তকালটা শায়লার জন্য খুব খারাপ কাটে। এই সময় তাঁর অ্যালার্জির এটাক হয়। শ্বাসনালি ফুলে শ্বাস বন্ধের উপক্রম হয়। অ্যালার্জির নানান ধরনের অষুধপত্র খেয়েও কোনো লাভ হয় নি। এখন খাচ্ছেন চাইনিজ হার্বাল মেডিসিন। মনে হয় এই অষুধটা কাজ করছে। বসন্ত শুরু হয়েছে। আমগাছে মুকুল এসেছে। এখনও তার অ্যালার্জির অ্যাটাক শুরু হয় নি।
শায়লা মেয়ের ঘরে ঢুকলেন। চিন্তিত মুখে বললেন, তোর কী নাকি জরুরি কথা?
মৃন্ময়ী বলল, মা বসো। মুখোমুখি বসো।
শায়লা বসলেন। মৃন্ময়ী বলল, আজ প্রেশারের অষুধ খেয়েছ?
নাশতার পরে খাব।
তা হলে যাও প্রেশারের অষুধ খেয়ে তারপর সামনে এসে বসো। আমার কথা শুনে হুট করে প্রেশার বেড়ে যেতে পারে। তখন আরেক যন্ত্রণা।
শায়লা বললেন, তোর কী বলার এখনই বল।
প্রেশার বেড়ে গেলে আমাকে কিন্তু দুষতে পারবে না।
কী বলতে চাচ্ছিস বলে ফ্যাল।
মা আমার তো মনে হয় তোমার প্রেশার এখনই বেড়ে গেছে। নাক ঘামছে।
কথাটা কী?
মৃন্ময়ী চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল, কথাটা হচ্ছে আমি পরীক্ষা দিচ্ছি না।
পরশু তোর পরীক্ষা। আজ বলছিস পরীক্ষা দিবি না!
প্রিপারেশন খুবই খারাপ। পরীক্ষা দিলেই ফেল করব। ফেল করার চেয়ে পরীক্ষা না-দেয়া ভালো না?
তোর বাবা জানে?
বাবা জানবে কীভাবে? আমি নিজেই তো জানলাম ঘুম ভাঙার পর। কাল রাতে যখন ঘুমুতে যাচ্ছি তখনও জানতাম পরীক্ষা দিচ্ছি। ঘুম ভাঙার পর মনে হলো পরীক্ষা কেন দেব? ফেল করার জন্যে পরীক্ষা দেবার কোনো অর্থ হয়?
পরীক্ষা সত্যি দিবি না?
গড প্রমিজ, দেব না।
তোর বাবাকে বল। সে কী বলে শুনি।
মৃন্ময়ী বলল, পরীক্ষা আমি দিচ্ছি, বাবা দিচ্ছে না। কাজেই এখানে বাবার বলার কিছু নেই।
শায়লা বললেন, তোর বাবার তো জানা উচিত যে পরীক্ষা দিচ্ছিস না।
তুমি জানাও। আদর্শ মায়ের দায়িত্ব হলো মিডিয়েটর হিসেবে কাজ করা।
শায়লা উঠে পড়লেন। তার ঘাড়ব্যথা শুরু হয়েছে। কপালও দপদপ করছে। গলাও খুসখুস করছে। এলার্জি এটাকের আগে তার গলা খুস খুস করে।
মৃন্ময়ী রিমোট হাতে সিডিপ্লেয়ার চালু করল। কাল রাতে জর্জিয়ান চেন্ট নামের একটা সিডি প্লেয়ারে ঢুকিয়ে রেখেছিল। সকালে শুনবে এই ছিল পরিকল্পনা। যে-কোনো নতুন মিউজিক ভোরবেলায় শুনতে হয়। রাতে শুনতে হয় পরিচিত পুরানো মিউজিক।
মিউজিক শুনে মৃন্ময়ী হতভম্ব। চার-পাঁচটা মেয়ে শিয়ালের কান্নার মতো হুয়া হুয়া করছে। এদের মধ্যে একজন (মনে হয় সেই দলের লিড সিঙ্গার) একা কিছুক্ষণ হুয়া হুয়া করে। সে থেমে যেতেই বাকিরা ধরে।
বিন্তি দরজা সামান্য খুলে বাইরে থেকে বলল, আপা, আপনেরে নাশতা খাইতে ডাকে।
মৃন্ময়ী বলল, কে ডাকে, মা না বাবা?
খালুজান ডাকেন।
তোমার খালুজানের মানসিক অবস্থা কী? রাগত, নরমাল না হাস্যমুখি?
বিন্তি কিছু বলল না। খালুজানের মুখের দিকে সে ভয়ে তাকাতে পারে না। তিনি রাগ না হাস্যমুখি সে জানে না। জানতে চায় না।
মৃন্ময়ী বলল, বিন্তি তোমাকে না বলেছি ঘর অগোছালো করে রাখবে। শুরু কর। বিছানার চাদরটা মাটিতে ফেলে দাও। দুটা বালিশের একটা বিছানায় থাকবে আরেকটা কার্পেটে। বই আর সিডি সারা ঘরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখ।
বিন্তি ভয়ে ভয়ে বলল, আপা সত্যি বলতেছেন?
মৃন্ময়ী বলল, ভাষা ঠিক ক— বলতেছেন, করতেছেন অফ। শুদ্ধ ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করতে হবে— বলছেন, করছেন এই রকম। হাঁ করে দাঁড়িয়ে থেকো না। নাশতা খেয়ে ফিরে এসে যেন দেখি এ টোটাল মেস। টোটাল মেস শব্দের মানে জান?
না।
টোটাল মেসের মানে হচ্ছে পরিপূর্ণ বিশৃঙ্খলা।
মৃন্ময়ীর বাবা শাহেদুর রহমান চৌধুরী পেশায় একজন আর্কিটেক্ট। মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটি থেকে Water body planning–এ Ph.D. করেছেন। তার রেজাল্ট ছিল অসাধারণ। কিন্তু তিনি এখন পর্যন্ত Water body planning এর কোনো ডিজাইন করেন নি। ভবিষ্যতে করবেন এ রকম মনে হয় না। পড়াশোনা ছাড়া অন্য কোনো পরিশ্রমের কাজ তিনি করতে পারেন না। তাতে অবশ্যি তার কোনো সমস্যা হচ্ছে না। শাহেদুর রহমান চৌধুরী সাহেবের বাবা আলিমুর রহমান সাধারণ গেঞ্জি, সুতা এবং রবারের জুতার ব্যবসা করে এত টাকা করেছেন যে তার একমাত্র পুত্রকে জীবিকা নিয়ে কোনো রকম চিন্তা ভাবনায় যেতে হয় নি। অর্থ কী করে মানুষকে অকর্মণ্য করে ফেলে শাহেদুর রহমান তার উদাহরণ। এখন তার সময় কাটে আর্ট কালেক্টর হিসেবে। দেশ-বিদেশের প্রচুর ছবি তিনি জোগাড় করেছেন।
শাহেদুর রহমান বারিধারায় একটা বাড়িতে বাস করেন। বাড়ির চারতলাটা করেছেন ছবির মিউজিয়াম। ছবির সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। তিনি দুই কোটি চল্লিশ লক্ষ টাকায় গুলশানে একটা প্লট নিয়েছেন। ছবির মিউজিয়াম সেখানে সরিয়ে নেবেন। মিউজিয়াম তৈরির কাজ শুরু হয়েই বন্ধ হয়ে গেছে। জমির মালিকানা নিয়ে মামলা শুরু হয়ে গেছে। কোর্ট ইনজাংশান দিয়ে কাজ বন্ধ করে দিয়েছে।
নাশতার টেবিলের দিকে মৃন্ময়ীকে আসতে দেখে শাহেদুর রহমান বললেন, হ্যালো বিবি!
এই বিবি সাহেব-বিবির বিবি না, এই বিবি হলো Blue Bird-এর সংক্ষেপ। শাহেদুর রহমান তার মেয়েকে সব সময় বিবি ডাকেন।
মৃন্ময়ী বলল, হ্যালো জিবি (Grey bird)!
শুনলাম তুই পরীক্ষা দিচ্ছিস না।
মৃন্ময়ী বসতে বসতে বলল, কে বলেছে, মা?
হ্যাঁ।
মা কোথায়?
তোর কথা শুনে তার মনে হয় প্রেশার বেড়ে গেছে। সে তার ঘরে। প্রেশার মাপার জন্যে ডাক্তার ডাকা হয়েছে।
মৃন্ময়ী পাউরুটিতে মাখন লাগাতে লাগাতে বলল, পরীক্ষা দেব না কেন? পরীক্ষা দিচ্ছি। মাকে ভড়কে দেবার জন্য বলেছি পরীক্ষা দেব না।
প্রিপারেশন কেমন?
ভালো। প্রথমদিন Physical chemistry. এই পেপারটার প্রিপারেশন একটু Down,
শাহেদুর রহমান মেয়ের পাউরুটিতে মাখন লাগানো দেখছেন। আগ্রহ নিয়ে দেখছেন। আগ্রহের কারণ হচ্ছে মাখন লাগানো পাউরুটি মৃন্ময়ী কখনো খায় না। তবে রুটিতে মাখন লাগাতে তার খুবই ভালো লাগে।
শাহেদুর রহমান বললেন, তোর মধ্যে অনেক স্ট্রেঞ্জ ব্যাপার আছে।
মৃন্ময়ী বলল, তোমার মধ্যেও আছে। বিশাল বিদ্বান এক মানুষ, বিশ পঁচিশ হাজার বই পড়া ছাড়া জীবনে কিছুই করলে না।
সময় তো শেষ হয়ে যায় নি। দেখি তোর মাখন-লাগানো পাউরুটিটা দে। খেয়ে দেখি।
মৃন্ময়ী পাউরুটি এগিয়ে দিতে দিতে বলল, জমি নিয়ে মামলার খবর কী?
কোনো খবর নেই। মামলা চলছে।
তুমি তো ভালো ক্যাচালের মধ্যে পড়েছ।
হুঁ।
তোমাকে দেখে কিন্তু মনে হয় না তুমি চিন্তিত।
চিন্তিত হয়ে লাভ তো কিছু নেই। লাভ থাকলে বিরাট চিন্তার মধ্যে পড়তাম। তোর মার মতো প্রেশার-ট্রেশার বাড়িয়ে ভূমিশয্য। মামলা শুরু হওয়ায় আমার জন্যে কিন্তু একদিক দিয়ে ভালো হয়েছে।
কীরকম?
এখন চিন্তা করছি আরো বড় জায়গা নিয়ে কাজ করব। পঁচিশ-ত্রিশ বিঘা জমি। ডিজাইন, Water planing মন লাগিয়ে করা যাবে। পানির মাঝখান থেকে শ্বেতপাথরের বিল্ডিং ভেসে উঠল। জলপদ্ম। ধবধবে শাদা পাথরের ফুল। বিল্ডিংটা এমন হবে যেন মনে হয় সে জলে তার নিজের ছায়া দেখছে।
এ-রকম বিল্ডিং তো আছে। লুই কানের ডিজাইন। আমাদের সংসদ ভবন।
আমারটা সম্পূর্ণ অন্যরকম।
পুরো বিল্ডিং শ্বেতপাথরের?
হুঁ।
অনেক টাকার ব্যাপার। এত টাকা তোমার আছে?
ব্যাংক থেকে ধার নেব। বাবার কাছে হাত পাতব। বাবার কাছে ভিক্ষা চাইতে লজ্জা নেই।
মৃন্ময়ী চায়ের কাপ হাতে উঠতে উঠতে বলল, দাদাজান তোমাকে একটা পাই পয়সাও দেবে না। কাগজ আন। কাগজে লিখে দিচ্ছি।
শাহেদুর রহমান হাসিমুখে বললেন, বাবাকে রাজি করানো আমার জন্য কোনো ব্যাপারই না।
মৃন্ময়ী বলল, সকালে নাশতা খেতে বসেছ, তোমার হাতে বই নেই এটা কেমন কথা। চায়ে একটা চুমুক দেবে এক পাতা পড়বে। এটাই তো তোমার সিস্টেম।
মাঝে মাঝে সিস্টেমের বাইরে যেতে হয়। আমি ঠিক করেছি সপ্তাহে এক দিন কোনো বই পড়ব না। খবরের কাগজও না।
তাতে লাভ?
চোখের রেস্ট। ব্রেইনের রেস্ট। আজ আমার রেস্টের দিন। দেখি এক কাপ চা বানিয়ে দে। মেয়ের হাতে বানানো চা কেমন হয় টেস্ট করে দেখি।
মৃন্ময়ী চায়ের কাপ হাতে নিজের ঘরে ঢুকেছে। ঘর কিছুটা নোংরা করা হয়েছে। আরও হলে ভালো হতো। মুন্ময়ী হাতের কাপটা টিভির কাছাকাছি ছুড়ে ফেলল। এখন চারদিকে ভাঙা কাচের টুকরা। চা। কিছু চা ছিটকে টিভি-পরদায়ও পড়েছে। বিস্তি ভীত-চোখে তাকিয়ে আছে। মৃন্ময়ী বলল, ঘর অগোছালো করা হয়েছে ঠিকই কিন্তু এর মধ্যে এক ধরনের গোছানো ভাব আছে। বোঝাই যাচ্ছে ইচ্ছা করে ঘর অগোছালো করা হয়েছে। বুঝেছ?
কিছু না বুঝেই বিন্তি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
মূর্ণায়ী বলল, একটা বালিশ ছিঁড়ে বালিশের তুলা চারদিকে ছিটিয়ে দাও। আর কালো মলাটের ঐ মোটা বইটা আন। সবগুলো পাতা কুচিকুচি করে ছিড়বে। চার দিকে ছড়িয়ে দেবে।
আপা বই ছিড়া ঠিক না।
আমাকে উপদেশ দিতে হবে না। বই ঘেঁড়া খুবই ঠিক আছে। পৃথিবীতে এমন অনেক বই আছে যেগুলি শুধু যে ছিড়তে হয় তা না, ছিঁড়ে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলতে হয়। বুঝেছ?
জি।
এখনও তুমি বুঝতে পারি নি। আমি এ রকম একটা বই কোনো-একদিন তোমাকে দেখাব। পাতায় পাতায় নোংরা ছবি। এখন কাজে লেগে পড়। বালিশের তুলা উড়াবে এবং বই ছিড়বে।
বিন্তির খুব ইচ্ছা করছে আপাকে জিজ্ঞেস করতে এই কাজগুলি কেন করা হচ্ছে। সে জিজ্ঞেস করল না। সে আবছাভাবে ধারণা করল অতি বড়লোকদের অনেক বিচিত্র খেয়াল থাকে। এইটাও সে রকম কিছু।
মৃন্ময়ী রকিং-চেয়ারে দোল খেতে খেতে টেলিফোনে কথা বলছে। সে তার গলার স্বর অনেক খানি বদলেছে। যে-কেউ মৃন্ময়ীর গলা শুনে ভাববে মৃন্ময়ী ভয়ংকর সুস্থতার শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। শ্বাস কষ্টের অভিনয় করা তার জন্যে তেমন কঠিন কিছু না। মাকে সে দেখছে। মাসে একবার তার শ্বাস কষ্ট হবেই।
ছন্দা ভালো আছিস?
হুঁ।
কী করছিস?
পড়ছি। পরশু পরীক্ষা না!
ও আচ্ছা! পরশু পরীক্ষা।
ছন্দা বলল, তুই এমনভাবে কথা বলছিস কেন? তোর কী হয়েছে?
কিছু হয় নি।
অবশ্যই কিছু একটা হয়েছে।
ছন্দা আমি মারা যাচ্ছি।
কী বললি?
মৃন্ময়ী হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, কিছু না। Nothing.
এ রকম করে নিঃশ্বাস নিচ্ছিস কেন?
মৃন্ময়ী টেলিফোন রেখে দিল।
অভিনয় যতটুক করা হয়েছে তাতে ছন্দার খবর হয়ে যাওয়ার কথা। সে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসবে। তবে সময় লাগবে। ঝিকাতলা থেকে বারিধারা। খুব কম করে হলেও চল্লিশ মিনিট। নাটকটা ঠিকমতো সাজানোর জন্যে চল্লিশ মিনিট অনেক সময়। তাকে যেটা করতে হবে সেটা হচ্ছে মার কাছ থেকে ঘুমের অষুধ এনে রাখতে হবে। একটা দুটা না, এক গাদা। এ ছাড়া নাটক জমবে না।
বিন্তি!
বিন্তি কাগজ ছিড়তে ছিড়তে বলল, জি আপা! তাকে খালাম্মা বলে দিয়েছেন মৃন্ময়ী যতবার ডাকবে ততবার বিন্তিকে বলতে হবে– জি আপামণি। বার বার ভুল হচ্ছে। ভাগ্যিস খালাম্মার সামনে এখনও হয় নাই।
কাগজ ছেঁড়া কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ রাখ। আমার জন্যে কড়া এক কাপ কফি বানিয়ে আন।
বিন্তি উঠে দাঁড়াতেই মৃন্ময়ী বলল, তুমি কি পড়াশোনা জান?
ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়েছি।
ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়াশোনা খারাপ কিছু না। Fire and smoke এর বাংলা কী বল।
ধোঁয়া আর আগুন।
আমি বলেছি Fire and smoke, প্রথমে Fire তারপর Smoke, তুমি ধোঁয়া আগে কেন বললে?
ভুল হয়েছে আপামণি। কথার টানে বলেছি। আর বলব না।
ভাই-বোন কত জন?
দুই বোন, ভাই নাই।
ভাই নাই কেন?
বিন্তি মনে-মনে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল, ভাই নাই কেন এই প্রশ্নের সে কী। জবাব দেবে? আপা এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন জবাবটা শুনতেই হবে।
ক্লাস নাইনের পর আর পড় নি কেন?
বাপজান আলাদা সংসার করল। আমরা দুই ভইনের নিয়া মা পড়ল বিপদে।
ভইন কী? বল বোন। আবার বল।
আবার কী বলব আপামণি?
একটু আগে যেটা বলছিলে সেটা।
বিন্তি হতাশ ভঙ্গিতে বলল, বাপজান আলাদা সংসার করল। মা দুই মেয়েরে নিয়া পড়ল মহা বিপদে।
মৃন্ময়ী বলল, বাপজান আলাদা সংসার করল। তার মানে কি আরেকটা বিয়ে করল।
জি।
তোমার সৎমার নাম কী?
চিন্নাই বিবি।
তোমার বোনের নাম কী?
মিন্তি।
তোমার নাম বিন্তি। তোমার বোনের নাম মিন্তি?
আমরার গেরাম দেশের নিয়ম মিল দিয়া নাম রাখা।
শুদ্ধ করে কথা বল, গেরাম না গ্রাম।
বিন্তি বলল, গ্রাম।
তোমার মায়ের নাম কী?
শাহেরা।
তোমার বেতন কত?
আমি জানি না আপা। ম্যানেজার সাহেব বলেছেন উনি সব বিবেচনা করে নির্ধারণ করবেন।
তোমার বেতন যা-ই নির্ধারণ হোক প্রতিমাসের এই তারিখে তুমি আমার কাছ থেকে বখশিশ পাবে। এই বখশিশ হিসাবের বাইরে। খুশি হয়েছ?
জি আপা।
খুশি হলে মুখে হাসি নাই কেন? হাস। সুন্দর করে হাসবে। তারপর কফি বানাতে যাবে।
বিন্তির হাসি আসছে না। হাসো বললেই কি হাসা যায়? তার ক্ষীণ সন্দেহ হচ্ছে মৃন্ময়ী নামের পরীর চেয়ে এক হাজার গুণ রূপবতী মেয়েটার মাথার ঠিক নাই। মাথা-খারাপ মানুষের বিশ্বাস নাই। তারা এই ভালো, এই মন্দ।
কী হল? এখনও খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছ, হাসছ না কেন?
বিন্তি হাসার চেষ্টা করল।
মৃন্ময়ী বলল, গুদ্র। হাসি সুন্দর হয়েছে। আরও সুন্দর হতে হবে। ঠিকমতো হাসতে পারা মস্ত বড় গুণ। মৃন্ময়ী উঠে দাঁড়াল। তাকে মার কাছে থেকে ঘুমের ওষুধ নিতে হবে।
শায়লার ঘরের দরজা-জানালা শুধু যে বন্ধু তা না— দরজা-জানালার উপর ভারী পরদা টানানো। এসি থেকে শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছে, হিউমিডিফায়ার বিজ বিজ করছে। তিনি চোখের উপর লেবুর পানি মেশানো ভেজা টাওয়েল দিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন। ধবধবে সাদা বিছানার মাঝখানে সবুজ শাড়ির সরল রেখা। মৃন্ময়ী দরজা সামান্য ফাঁক করে দাঁড়িয়ে আছে। সে নিচু গলায় ডাকল, মা ঘুমাচ্ছ?
শায়লা বললেন, আগে দরজা বন্ধ কর। আলো আসছে। চোখে আলো লাগছে।
মৃন্ময়ী বলল, আমি তোমার ঘরে ঢুকব না মা। তোমার ঘরে ঢুকলে মনে হয় অপারেশন থিয়েটারে ঢুকেছি। তোমার শরীর এখন কেমন?
নিচেরটা পঁচানব্বই।
পালস কত? পালস নেমে গেছে।
মা শোন, আমি পরশু দিন ঠিকমতোই পরীক্ষা দেব। তোমার সঙ্গে ঠাট্টা করছিলাম। গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে বস।
শায়লা চোখ থেকে টাওয়েল সরিয়ে উঠে বসলেন। কাঁদো-কাঁদো গলায় বললেন, তুই এ-রকম পাগলামি করিস কেন?
কেন করি জানি না মা।
কাছে এসে একটু বস তো।
মৃন্ময়ী মার পাশে এসে বসল। শায়লা বললেন, সকালে নাশতা খাবার সময় তোর বাবাকে কেমন দেখলি?
ভালোই তো দেখলাম। নরম্যাল দেখেছিস?
হুঁ। অ্যাবনরমাল দেখার কথা?
তার বাবা টাকা-পয়সার বিরাট ঝামেলায় পড়েছে। ব্যাংক-লোনের কী জানি সমস্যা। আমাকে খোলাখুলি কিছু বলছে না।
বাবার কোনোকিছু নিয়ে তুমি শুধুশুধু দুশ্চিন্তা করবে না। বাবার মাথার উপর দাদাজান আছেন। দ্য গ্রেট মিস্টার মুশকিল আসান। এখন আমাকে বিশটা ঘুমের ট্যাবলেট দাও।
কেন?
ভয় নেই খাব না। তুমি ঘুমের ট্যাবলেট খাওয়া মেয়ে, আমি না।
তুই কেমন মেয়ে?
আমি তোমার মতো পুতুপুতু না, বাবার মতো রঙিন ফানুসও না। আমি আলাদা।
তুই বিয়ে করবি কবে?
কাউকে মনে ধরছে না। যেদিন কাউকে মনে ধরবে ধুম করে বিয়ে করে ফেলব। মা আমাকে ঘুমের ট্যাবলেট দাও।
ওষুধের বাক্স থেকে নে। নীল রঙের ট্যাবলেটগুলি ঘুমের।
মৃন্ময়ী ঘুমের ট্যাবলেট নিয়ে নিজের ঘরে ফিরল। বিন্তি কফির মগ-হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
মৃন্ময়ী বলল, কফি খাব না। বিন্তি মগটা আছাড়া দিয়ে ভেঙে ফ্যাল। হা করে তাকিয়ে থাকবে না। যা করতে বলছি কর।
বিন্তি মগ ভাল।
মগ ভাঙার দশ মিনিটের মাথায় ছন্দা ঘরে ঢুকল। সে চোখ কপালে তুলে বলল, ব্যপার কী রে? এ কী অবস্থা! হয়েছে কী?
মৃন্ময়ী ফোপানোর মতো করে বলল, বিন্তি তুমি সামনে থেকে যাও।
বিন্তি পালিয়ে বাঁচল। কি সব জটিল কাণ্ডকারখানা শুরু হয়েছে। এখানে না থাকতে পারাই ভাগ্যের ব্যাপার।
মৃন্ময়ী বলল, ছন্দা তুই আমাকে একটু সাহস দিবি? আমি বিশটা ঘুমের ট্যাবলেট হাতে নিয়ে বসে আছি। সাহসে কুলাচ্ছে না বলে খেতে পারছি না। মৃন্ময়ী হাতের মুঠা খুলে ঘুমের ট্যাবলেটগুলি দেখাল।
ছন্দা হতভম্ব গলায় বলল, Oh my God!
মৃন্ময়ী বলল, কেন আমাকে মরতে হচ্ছে সেটা আমি একটা কাগজে চিঠি লিখে গেছি। কাগজটা আমার টেবিলের ড্রয়ারে আছে। পুলিশি কোনো হাঙ্গামা যদি হয় তুই কাগজটা বের করে পুলিশের হাতে দিবি।
আমি একটু পড়ে দেখি?
মৃন্ময়ী ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, আচ্ছা পড়ে দেখ। কেউ যেন চিঠির। বিষয়ে কিছু না জানে।
গড প্রমিজ কেউ কিছু জানাবে না। আমি মরে গেলেও কাউকে কিছু বলব না।
প্রমিজ।
প্রমিজ।
ক্রস মাই হার্ট।
ক্রস মাই হার্ট।
মৃন্ময়ী ড্রয়ার খুলে খাম এনে ছন্দার হাতে দিল। ছন্দা চোখ বড় বড় করে পড়ল। কাগজের মাঝামাঝি সবুজ কালিতে একটা লাইন লেখা–
আমার মৃত্যুর জন্য আমার প্রিয় বান্ধবী ছন্দা দায়ী।
পুলিশ ইচ্ছা করলে তাকে ধরতে পারে।
সাত দিনের রিমান্ডেও নিতে পারে।
ছন্দা বলল, এর মানে কী?
মৃন্ময়ী বলল, এর মানে ঠাট্টা।
ছন্দা বলল, কোনটা ঠাট্টা?
মৃন্ময়ী বলল, সবটাই ঠাট্টা। ঘুম ভেঙে তোকে দেখতে ইচ্ছা করল। তখন এই আইডিয়া মাথায় এসেছে। গতরাতে তোকে নিয়ে বিশ্রী স্বপ্ন দেখেছি। স্বপ্নে আমরা দুজন নৌকায় করে গ্রামের এক হাটে উপস্থিত হয়েছি। হাটভর্তি মানুষ। আমাদের নৌকা পাড়ে ভিড়তেই হাট ভেঙে সবাই পাড়ে উপস্থিত। বিরাট হইচই। কারণ আমাদের দুজনের কারও গায়েই কিছু নেই। একটা সুতা পর্যন্ত না।
ছন্দা বলল, স্বপ্নটা এইমাত্র তুই বানিয়েছিস। ঠিক না? মৃ
ন্ময়ী বলল, হ্যাঁ।
তোর প্র্যাকটিক্যাল জোকস, পাগলামি এইসব আমি নিতে পারি না। আমি উঠলাম।
বেশি রাগ করেছিস?
না।
ছন্দা প্রায় ঝড়ের বেগে বের হয়ে গেল। ফিরেও এল ঝড়ের বেগে। বিছানায় ব্যাগ ছুড়ে ফেলে বলল, দুপুরে তোর সঙ্গে খাব। তোদের ঐ বাবুর্চিটা আছে না? রহিমার মা। তাকে রূপচান্দার শুঁটকি রান্না করতে বল। একবার খেয়েছিলাম তার স্বাদ মুখে লেগে আছে।
মৃন্ময়ী বলল, রূপচান্দা শুঁটকি ছাড়া আর কী খাবি?
কইমাছের ঝোল। আর টকের একটা আইটেম রান্না করতে বল তো! টক খেতে ইচ্ছা করছে।
ওকি ড়ুকি। শুঁটকি, কইমাছ, টকের আইটেম পাশ।
নতুন একটা মেয়ে দেখলাম। তোর কাজের মেয়ে?
হুঁ।
চেহারা সুন্দর তো! নাম কী?
নাম বিন্তি। ওর মায়ের নাম শাহেরা, সৎমায়ের নাম চিন্নাই বিবি। বোনের নাম মিন্তি। শুধু বাবার নামটা জানি না। বাবা বিন্তি মিন্তি দুই মেয়েকে মায়ের ঘাড়ে ফেলে আলাদা সংসার করেছে বলে এই ব্যাটার নাম জিজ্ঞেস করি নি।
ছন্দা বলল, আমার দেখা অতি অদ্ভুত কয়েকটি মেয়ের মধ্যে তুই একটা।
মৃন্ময়ী বলল, তুই অতি অদ্ভুত মেয়ে একটাই দেখেছিস। আমি। আমি ছাড়া আরেক জনের নাম কিন্তু তুই বলতে পারবি না।
পারব।
তা হলে বল। ত্রিশ সেকেন্ড সময়।
মনে করতে সময় লাগবে না?
মৃন্ময়ীর ঘরের দরজায় টোকা পড়ল। শাহেদুর রহমান সাহেবের অ্যাসিসটেন্ট ফরিদ হোসেন চাপা গলায় বলল, আপা আমি ফরিদ।
মৃন্ময়ী বলল, ফরিদ আপনি কী চান?
বড় সাহেব আমাকে পাঠিয়েছেন।
সেটা তো বুঝতেই পারছি। কীজন্যে পাঠিয়েছেন?
আপনার বান্ধবী ছন্দাকে তিনি দেখা করতে বলেছেন। তাকে কী-একটা ছবি দেখাবেন।
মৃন্ময়ী বলল, একটু দেরি হবে, আমরা গল্প করছি।
ছন্দা বলল, দেরি হবে না। আমি এখুনি যাচ্ছি। তুই এর মধ্যে ঘর গুছিয়ে নে। নোংরা ঘরে বসতে পারব না।
মৃন্ময়ী বিছানায় শুয়ে পড়ল। ছন্দা সহজে ছাড়া পাবে না। শুয়ে শুয়ে থার্মোড়িনামিক্সের চ্যাপ্টারটার উপর চোখ বুলানো যায়। এনট্রপির সঙ্গে কাওমের বিষয়টা মাথায় নিয়ে নেয়া। ইচ্ছা করছে না। তারচে বরং জর্জিয়ান চেন্ট কিছুক্ষণ শুনা যায়। শিয়ালের হুক্কা হুয়া।
ছন্দা শাহেদুর রহমানের সামনে বেতের চেয়ারে বসে আছে। সে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে! শাহেদুর রহমানের হাতে দেড় ফুট বাই দেড় ফুট একটা ওয়াটার কালার। ছবিতে দেখা যাচ্ছে পুকুরঘাটে পানিতে পা ড়ুবিয়ে একটি কিশোরী মেয়ে বসে আছে।
শাহেদুর রহমান বললেন, ছবিটা কেমন মা?
ছন্দা বলল, অসাধারণ।
ছবিটা দেখে যামিনি রায়ের কথা মনে হয় না?
যামিনী রায়ের নাম ছন্দা শুনে নি তারপরেও সে বলল, হুঁ হয়।
সেই তুলির টান, সেই রং এর ব্যবহার। ঠিক না?
জি।
পানিতে মেয়েটার যে রিফ্লেকশন সেদিকে তাকাও। আলো-ছায়ার খেলাটা দেখ। অপূর্ব না?
ছবিটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে পুরানো ঘাটের শ্যাওলার গন্ধ পর্যন্ত পাবে।
ছবিটা কার আঁকা?
নাম করা কেউ না। জহির নাম। ইয়াং ছেলে। আমি এক্সিবিশন থেকে কিনেছি। ওর আঁকা একটা ছবিই ছিল। আরও থাকলে অরিও কিনতাম।
কত দিয়ে কিনেছেন?
দশ হাজার টাকা।
কী আশ্চর্য এত টাকা!
শাহেদুর রহমান বললেন, মারে! ছবির বাজারে দশ হাজার টাকা কোনো টাকাই না। এস এম সুলতানের ওয়াটার কালার দুই লাখ টাকার নিচে পাবে না। জয়নুলের উডকাট কয়েক দিন আগে কিনেছি তিন লাখ পচাত্তুর হাজার টাকায়।
কী বলেন চাচা!
শাহেদুর রহমান আনন্দের হাসি হাসলেন।
ছন্দা বলল, চাচা আপনি নিজে ছবি আঁকা ধরেন তো অন্যের ছবি কেন কিনবেন। নিজে এঁকে যারে সাজিয়ে রাখবেন। দু-একটা ছবি আমরাও উপহার হিসেবে পবি।
শাহেদুর রহমানের আনন্দ আরো বাড়ল। এই মেয়েটা তার মনের কথা বলেছে। তিনি অনেক দিন থেকেই ভাবছেন ছবি আঁকা শিখবেন। ক্রিয়েটিভ কাজে বয়স কোনো ফ্যাক্টর না। Even a old dog can lear few new tricks, বৃদ্ধ কুকুরও কয়েকটা নতুন খেলা শিখতে পারে। জহির ছেলেটার ঠিকানা জোগাড় করা হয়েছে। সপ্তাহে তিন দিন সে যদি আসে মন্দ কি?
ছন্দা বলল, চাচা আমি যাই। মৃন্ময়ী অপেক্ষা করছে।
শাহেদুর রহমান বললেন, পাঁচটা মিনিট বোস। আমার সঙ্গে চা খাও। ফরিদকে চা দিতে বলি। চা খেতে খেতে আরো কিছু ছবি দেখ। শুধুমাত্র একটা রঙ দিয়ে আঁকা ছবির নমুনা দেখাব। আর্টিস্ট লেমন ইয়োলোর নানান শেড ব্যবহার করে কী জিনিশ যে তৈরি করেছেন! ছবি দেখলে মনে হয় সাত রঙের খেলা। আসলে একটা সাত রঙ লেমন ইয়েলো।
মৃন্ময়ী শেয়ালের ডাক শুনেই যাচ্ছে। বিন্তি অতি দ্রুত ঘর গুছিয়ে ফেলেছে। মেঝেতে কফির দাগ বসে গেছে। সে এখন দাগ উঠানোর জন্যে ভিক্সল দিয়ে মেঝে ঘসছে।
মুন্ময়ী সিডি বন্ধ করে হাতের ইশারায় বিন্তিকে ডাকল। বিন্তুি অবাক হয়ে কাছে এগিয়ে এল। ঘরে সে ছাড়া দ্বিতীয় ব্যক্তি নেই। তাকে কিছু বলতে হলে হাতে ইশারা করে কাছে ডাকতে হবে না।
আমার বান্ধবী ছন্দাকে তোমার কেমন লাগল?
বিন্তি বলল, ভালো।
ও দেখতে কেমন?
খুব সুন্দর।
আমার মতো
মৃন্ময়ী বলল, দশের মধ্যে নাম্বার দাও। দশে আমাকে কত দেবে আর ছন্দাকে কত দেবে।
বিন্তি চুপ করে আছে। কি বলবে সে? আপার যত অদ্ভুত অদ্ভুত প্রশ্ন।
মৃন্ময়ী বলল, ঝিম ধরে থাকবে না উত্তর দাও।
বিন্তি বলল, আপনি দশে নয় আর ঐ আপা সাত।
মৃন্ময়ী বলল, আমি দশে দশ না কী না? আমি এক পয়েন্ট কম কেন পেয়েছি? তুমি কি দশে দশ কোনো মেয়ে এর আগে দেখেছ?
জি না।
তাহলে তোমার স্ট্যান্ডার্ডটা কী? পয়েন্ট দিতে হলে একটা স্ট্যান্ডার্ড লাগে।
হুট করে পয়েন্ট দেয়া যায় না।
মৃন্ময়ী নাকে হাত দিয়ে নাকফুল খুলছে। নাকফুলটা হীরার। ওয়ান ফোর্থ ক্যারেট। শাহেদুর রহমান স্পেন থেকে তার মেয়ের জন্যে কিনে এনেছিলেন।
বিন্তি আমার এই নাকফুলটা তুমি বাথরুমের বেসিনে সোপকেসের পাশে রেখে আস। এমনভাবে রাখবে যেন হাত-মুখ ধুতে গেলেই চোখে পড়ে। আমার বান্ধবী ছন্দা চোর স্বভাবের মেয়ে। আমি দেখতে চাই সে নাকফুলটা চুরি করে কি-না। হা করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে না। আমি হা করে তাকিয়ে থাকার মতো কোনো কথা বলিনি।
বিন্তি নাকফুল নিয়ে বাথরুমে ঢুকল। মৃন্ময়ী আবারও শিয়ালসংগীত চালু করল।
কথা ছিল ছন্দা দুপুর পর্যন্ত থাকবে। দুপুরে রূপচান্দা শুঁটকি দিয়ে ভাত খাবে। হঠাৎ সে মত বদলালো। দুপুরে খাবে না। অনেক পড়া বাকি। বাসায় চলে যাবে।
ছন্দা বলল, তোদের গাড়ি কি আমাকে একটু নামিয়ে দিতে পারবে?
মৃন্ময়ী বলল, অবশ্যই পারবে।
তাহলে দেখা হবে পরীক্ষার হলে।
ছন্দা চলে যাবার পরেই মৃন্ময়ী বলল, বিন্তি দেখ তো বাথরুমে আমার নাক ফুলটা আছে কি-না।
বিন্তি বাথরুম থেকে ঘুরে এসে কাঁদো কাদো মুখে বলল, নাই আফা।
মৃন্ময়ী হাই তুলতে তুলতে বলল, জানতাম পাওয়া যাবে না।
আপা এখন কী হইব?
মৃন্ময়ী বলল, হইব আবার কি? বল হবে। প্রশ্নটা ঠিকমতো আরেক বার PI
আপা এখন কী হবে?
কিছুই হবে না। কি আর হবে? টেলিফোনটা দাও। বিন্তি টেলিফোন এনে দিল। তার হাত-পা কাঁপছে। কী ভয়ংকর ঘটনা অথচ আপা কত স্বাভাবিক যেন কিছুই হয় নি।
হ্যালো ছন্দা।
হ্যাঁ! আবার কোনো ঘটনা ঘটিয়েছিস? তোর টেলিফোন পেলেই বুকে ধাক্কার মতো লাগে। বল কী ঘটিয়েছিস?
আমি কিছু ঘটাইনি। আমার কাজের মেয়েটা ঘটিয়েছে। বাথরুমে বেসিনের উপর আমার নাকফুলটা রেখেছিলাম। এখন দেখি নেই। হীরের নাক ফুল।
বলিস কি! এই মেয়ে কতদিন ধরে আছে?
সপ্তাহখানেক হবে।
রেফারেন্স আছে, না রেফারেন্স ছাড়া রেখে দিয়েছিস?
জানি না রেফারেন্স আছে কি-না। ম্যানেজার সাহেব জানেন।
ওকে ভালো করে সার্চ কর। ওর জিনিসপত্র দেখ। ওকে একা সার্চ করলে হবে না, তোদের বাড়িতে ওয়ার্কিং ক্লাস যারা আছে সবাইকে সার্চ কর। ওদের মধ্যে এক ধরনের আন্ডারস্ট্যানডিং থাকে। একজন চুরি করে অন্যজন লুকিয়ে রাখে।
ভালো বুদ্ধি।
পুলিশের ভয় দেখিয়ে দেখ। নতুন এসেছে তো পুলিশ-ভীতি থাকবে।
পুলিশের ভয় দেখানো যেতে পারে। মেয়েটা কি রকম বদ শোন, আমাকে বলছে নাকফুলটা নাকি তুই নিয়েছিস।
কী!
সে কসম কেটে বলছে। এই শ্রেণী তো আবার কীরা-কসম কাটতে ওস্তাদ।
আমার কথা বলছে! মৃন্ময়ী লজায় আমার তো মরে যেতে ইচ্ছা করছে। ছিঃ ছিঃ! সে দেখলো কিভাবে আমি নিয়েছি? একবার বাথরুমে গিয়েছি। দরজা ছিল বন্ধ।
মৃন্ময়ী বলল, সে বলেছে সে কিছুই দেখে নি।
তাহলে?
বিন্তি বলছে তুই এ-বাড়িতে আসার পর সে বাথরুমে ঢুকে নি। তুই ছাড়া এটা না-কি কেউ নিতেই পারে না। তার লজিকও ফেলে দিতে পারছি না।
ছন্দা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, কী বললি! মৃন্ময়ী তুই কী বললি!
মৃন্ময়ী বলল, তুই নাকফুলটা ড্রাইভারের হাতে দিয়ে দে।
আমাকে এ রকম একটা কথা তুই বলতে পারলি? Of all persons you?
মৃন্ময়ী হেসে ফেলে বলল, ঠাট্টা করছি।
ছন্দা কাদো কাঁদো গলায় বলল, ঠাট্টা?
মৃন্ময়ী বলল, হ্যাঁ ঠাট্টা। আচ্ছা তুই ঠাট্টা নিতে পারিস না কেন? আমি ঠাট্টা করতে পারব না?
ছন্দা বলল, আমি আসলেই এ ধরনের ঠাট্টা নিতে পারি না। আমি তোর কাছে আর কোনোদিন আসব না প্রমিজ।
মৃন্ময়ী খিলখিল করে হাসছে। তার পাশে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে বিন্তি। এই বড়লোকদের ঠাট্টা-তামশার নমুনা? নাকফুল আর উদ্ধার হবে না?
বিন্তি!
জি আপামণি।
ছন্দা আমার অতি প্রিয় বান্ধবী। তাকে আমি খুব পছন্দ করি।
জি আচ্ছা।
মেঝে ঘষাঘসি বন্ধ করে চলে যাও। সন্ধ্যা পর্যন্ত আমি পড়ব। কেউ যেন আমার ঘরে না ঢুকে। দুপুরে আমি শুধু একটা স্যান্ডউইচ খাব। স্যান্ডউইচ তুমি আমার ঘরে দিয়ে যাবে। Now clear out.
বিন্তি ঘর ছেড়ে বের হয়ে গেল।