॥ ১ ॥
মুড়ো হয় বুড়ো গাছ
হাত গোন ভাত পাঁচ
দিক পাও ঠিক ঠিক জবাবে।
ফাল্গুন তাল জোড়
দুই মাঝে ভুঁই ফোড়
সন্ধানে ধন্দায় নবাবে॥
ফেলুদা বলল, ‘আমাদের এবারের জঙ্গলের ঘটনাটা যখন লিখবি তখন ওই ছ’ লাইনের সংকেতটা দিয়ে আরম্ভ করিস।’ সংকেতের ব্যাপারটা ঘটনায় একটু পরের দিকে আসছে; তাই যখন জিগ্যেস করলাম ওটা দিয়ে শুরু করার কারণটা কী, তখন ও প্রথমে বলল, ‘ওটা একটা কায়দা। ওতে পাঠককে সুড়সুড়ি দেবে।’ উত্তরটা আমার পছন্দ হল না বুঝতে পেরেই বোধহয় আবার দু’ মিনিট পরে বলল, ‘ওটা শুরুতে দিলে গল্পটা যারা পড়বে তারা প্রথম থেকে মাথা খাটাতে পারবে।’
আমি ফেলুদার কথা মতোই সংকেতটা গোড়ায় দিচ্ছি বটে, কিন্তু এটাও বলে দিচ্ছি যে মাথা খাটিয়ে বোধহয় বিশেষ লাভ হবে না, কারণ সংকেতটা সহজ নয়। ফেলুদাকে অবধি প্যাঁচে ফেলে দিয়েছিল। অবিশ্যি ও বুঝিয়ে দেবার পর ব্যাপারটা আমার কাছেও বেশ সহজ বলেই মনে হয়েছিল।
এত দিন ফেলুদার সব লোমহর্ষক অ্যাডভেঞ্চারগুলো লেখার সময় আসল লোক আর আসল জায়গার নাম ব্যবহার করে এসেছি, এবার একজন বারণ করায় সেটা আর করছি না। নকল নামের ব্যাপারে অবিশ্যি ফেলুদার সাহায্য নিতে হয়েছে। ও বলল, ‘জায়গাটা যে ভূটান-সীমানার কাছে সেটা বলতে কোনও আপত্তি নেই। নামটা করে দে লক্ষ্মণবাড়ি। যে ভদ্রলোক গল্পের প্রধান চরিত্র, তার পদবিটা সিংহরায় করতে পারিস। ও নামের জমিদার এ দেশে অনেক ছিল, আর তাদের মধ্যে অনেকেরই আদি নিবাস ছিল রাজপুতানায়, অনেকেই বাংলাদেশে এসে তোডরমল্লের মোগল সৈন্যের হয়ে পাঠানদের সঙ্গে যুদ্ধ করে শেষে বাংলাদেশেই বসবাস করে একেবারে বাঙালি ব’নে গিয়েছিল।’
আমি ফেলুদার ফরমাশ মতোই ঘটনাটা লিখছি। নামগুলোই শুধু বানানো, ঘটনা সব সত্যি। যা দেখেছিলাম, যা শুনেছিলাম, তার বাইরে কিছুই লিখছি না।
ঘটনার আরম্ভ কলকাতায়। ২৭ মে, রবিবার, সকাল সাড়ে ন’টা। তাপমাত্রা একশো ডিগ্রি ফারেনহাইট। গরমের ছুটি চলেছে। ফেলুদা কলকাতাতেই ফরডাইস লেনে একটা খুনের ব্যাপারে অপরাধীকে একটা আলপিনের ক্লু-এর সাহায্যে ধরে দিয়ে বেশ নাম-টাম কিনে দু’ পয়সা কামিয়ে ঝাড়া হাত-পা হয়ে একটু বিশ্রাম নিচ্ছে, আমি আমার ডাকটিকিটের অ্যালবামে কয়েকটা ভূটানের স্ট্যাম্প আটকাচ্ছি, এমন সময় জটায়ুর আবিভাব।
রহস্য-রোমাঞ্চ উপন্যাস লেখক লালমোহন গাঙ্গুলী ওরফে জটায়ু আজকাল মাসে অন্তত দু’ বার করে আমাদের বাড়িতে আসেন। ওঁর বইয়ের ভীষণ কাটতি, তাই রোজগারও হয় ভালই। সেই নিয়ে ভদ্রলোকের বেশ একটু দেমাকও ছিল, কিন্তু যেদিন থেকে ফেলুদা ওঁর গল্পের নানারকম তথ্যের ভুল দেখিয়ে দিতে শুরু করেছে, সেদিন থেকে লালমোহনবাবু ওকে বিশেষ সমীহ করে চলেন, আর নতুন কিছু লিখলেই ছাপার আগে ফেলুদাকে দেখিয়ে নেন।
এবার কিন্তু হাতে কাগজের তাড়া নেই দেখে বুঝলাম, ওঁর আসার কারণটা অন্য। ভদ্রলোক ঘরে ঢুকেই সোফায় বসে পকেট থেকে একটা সবুজ তোয়ালের টুকরো বার করে ঘাম মুছে ফেলুদার দিকে না তাকিয়ে বললেন, ‘জঙ্গলে যাবেন?’
ফেলুদা তক্তপোশের উপর কাত হয়ে শুয়ে থর হাইয়ারডালের লেখা ‘আকু-আকু’ বইটা পড়ছিল; লালমোহনবাবুর কথায় কনুইয়ে ভর করে খানিকটা উঠে বসে বলল, ‘আপনার জঙ্গলের ডেফিনিশনটা কী?’
‘একেবারে সেন্ট পারসেন্ট জঙ্গল। যাকে বলে ফরেস্ট।’
‘পশ্চিম বাংলায়?’
‘ইয়েস স্যার।’
‘সে তো এক সুন্দরবন আর তেরাই অঞ্চল ছাড়া আর কোথায়ও নেই। সব তো কেটে সাফ করে দিয়েছে।’
‘মহীতোষ সিংহরায়ের নাম শুনেছেন?’
প্রশ্ন করেই লালমোহনবাবু একটা মেজাজি হাসিতে তাঁর ঝকঝকে দাঁতের প্রায় চব্বিশটা এক সঙ্গে দেখিয়ে দিলেন। মহীতোষ সিংহরায়ের নাম আমিও শুনেছি। ফেলুদার কাছে ওঁর একটা শিকারের বই আছে— সে নাকি দারুণ বই।
‘তিনি তো উড়িষ্যা না অসম না কোথায় থাকেন না?’
লালমোহনবাবু বুক-পকেট থেকে সড়াৎ করে একটা চিঠি বার করে বললেন, ‘নো স্যার। উনি থাকেন ডুয়ার্সে— ভূটান বর্ডারের কাছে। আমার লাস্ট বইটা ওঁকে উৎসর্গ করেছিলুম। আমার সঙ্গে চিঠি লেখালেখি হয়েছে।’
‘আপনি তা হলে জ্যান্ত লোককেও বই উৎসর্গ করেন?’
এখানে লালমোহনবাবুর উৎসর্গের ব্যাপারটা একটু বলা দরকার। ভদ্রলোক বিখ্যাত লোকদের ছাড়া বই উৎসর্গ করেন না, আর তাদের মধ্যে বেশির ভাগই মারা গেছে এমন লোক। যেমন, ‘মেরুমহাতঙ্ক’ উৎসর্গ করেছিলেন ‘রবার্ট স্কটের স্মৃতির উদ্দেশে’ ‘গোরিলার গোগ্রাস’— ‘ডেভিড লিভিংস্টোনের স্মৃতির উদ্দেশে’, ‘আণবিক দানব’ (যেটা ফেলুদার মতে ম্যাক্সিমাম গাঁজা) ‘আইনস্টাইনের স্মৃতির উদ্দেশে’। শেষটায় ‘হিমালয়ে হৃৎকম্প’ উৎসর্গ করতে গিয়ে লিখে বসলেন ‘শেরপা-শিরোমণি তেনজিং নোরকের স্মৃতির উদ্দেশে’। ফেলুদা তো ফায়ার। বলল, ‘আপনি জলজ্যান্ত লোকটাকে মেরে ফেলে দিলেন?’ লালমোহনবাবু আমতা-আমতা করে বললেন, ‘ওরা তো কনস্ট্যান্ট পাহাড়ে চড়ছে—অনেক দিন কাগজে নাম-টাম দেখিনি তাই ভাবলুম পা-টা হড়কে গিয়ে বোধহয়…।’ দ্বিতীয় সংস্করণে অবিশ্যি উৎসর্গটা শুধরে দেওয়া হয়েছিল।
মহীতোষ সিংহরায় খুব বড় শিকারি তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু তা বলে কি আর এদের মতো বিখ্যাত? তবু তাকে উৎসর্গ করা হল কেন জিজ্ঞেস করাতে লালমোহনবাবু বললেন— বইটাতে জঙ্গলের ব্যাপারের অনেক কিছুই নাকি মহীতোষবাবুর ‘বাঘে-বন্দুকে’ বইটা থেকে নেওয়া। তারপর মুচকি হেসে জিভ কেটে বললেন, ‘মায় একটি আস্ত ঘটনা পর্যন্ত। তাই ভদ্রলোককে একটু খুশি করা দরকার ছিল।’
‘সে ব্যাপারে সফল হয়েছিলেন?’ ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
লালমোহনবাবু খাম থেকে চিঠিটা বার করে বললেন, ‘নইলে আর এভাবে ইনভাইট করে?’
‘ইনভাইট তো আপনাকে করেছে, আমাকে তো করেনি।’
লালমোহনবাবু এবার যেন একটু বিরক্ত হয়েই ভুরু-টুরু কুঁচকে বললেন, ‘আরে মশাই, আপনি একজন এলেমদার লোক, আপনার একটা ইয়ে আছে, আপনাকে না ডাকলে আপনি যাবেন না— এসব কি আর আমি জানি না? চার মাসে বইটার চারটে এডিশন হওয়াতে ওঁকে আমি সুখবরটা দিয়ে একটা চিঠি লিখি। তাতে আপনার সঙ্গে যে আমার একটু মাখামাখি আছে, তারও একটা হিন্ট দিয়েছিলুম আর কী। তাতেই এই চিঠি। আপনি পড়ে দেখুন না। আমাদের দুজনকেই যেতে বলেছে।’
মহীতোষ সিংহরায়ের চিঠির শুধু শেষের কয়েকটা লাইন তুলে দিচ্ছি—
‘আপনার বন্ধু শ্রীপ্রদোষ মিত্র মহাশয়ের ধুরন্ধর গোয়েন্দা হিসাবে খ্যাতি আছে বলিয়া শুনিয়াছি। আপনি তাঁহাকে সঙ্গে করিয়া আনিতে পারিলে তিনি হয়তো আমার একটা উপকার করিতে পারেন। কী স্থির করেন পত্রপাঠ জানাইবেন। ইতি।’
ফেলুদা কিছুক্ষণ চিঠিটার দিকে চেয়ে দেখে বলল, ‘ভদ্রলোক কি বৃদ্ধ?’
‘বৃদ্ধের ডেফিনিশন?’ লালমোহনবাবু আধবোঁজা চোখে প্রশ্ন করলেন।
‘এই ধরুন সত্তর-উত্তর।’
‘নো স্যার। মহীতোষ সিংহরায়ের জন্ম নাইনটিন ফোরটিনে।’
‘হাতের লেখাটা দেখে বুড়ো বলে মনে হয়েছিল।’
‘সে কী মশাই, মুক্তোর মতো লেখা তো!’
‘চিঠি না সই। চিঠিটা লিখেছে সম্ভবত ওর সেক্রেটারি।’
ঠিক হল আগামী বুধবার আমরা লক্ষ্মণবাড়ি রওনা হব। নিউ জলপাইগুড়ি পর্যন্ত ট্রেন, তারপর ছেচল্লিশ মাইল যেতে হবে মোটরে। মোটরের ব্যবস্থা আমাদের করতে হবে না, মহীতোষবাবু তাঁর নিজের গাড়ি স্টেশনে পাঠিয়ে দেবেন।
জঙ্গলে যাবার কথা শুনে ফেলুদার মন যে নেচে উঠবে, আর সেই সঙ্গে আমারও, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই, কারণ আমাদের বংশেও শিকারের একটা ইতিহাস আছে। বাবার কাছে শুনেছি বড় জ্যাঠামশাই নাকি রীতিমতো ভাল শিকারি ছিলেন। আমাদের দেশ ছিল ঢাকার বিক্রমপুর পরগনার সোনাদীঘি গ্রামে। বড় জ্যাঠামশাই ময়মনসিংহের একটা জমিদারি এস্টেটের ম্যানেজার ছিলেন। ময়মনসিংহের উত্তরে মধুপুরের জঙ্গলে উনি অনেক বাঘ হরিণ বুনো শুয়োর মেরেছেন। আমার মেজো জ্যাঠা— মানে ফেলুদার বাবা—ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে অঙ্ক আর সংস্কৃতের মাস্টার ছিলেন। মাস্টার হলে কী হবে— মুগুর ভাঁজা শরীর ছিল তাঁর। ফুটবল ক্রিকেট সাঁতার কুস্তি সব ব্যাপারেই দুর্দান্ত ছিলেন। উনি যে এত অল্প বয়সে মারা যাবেন সেটা কেউ ভাবতেই পারেনি। আর অসুখটাও নাকি আজকের দিনে কিছুই না। ফেলুদার তখন মাত্র ন’ বছর বয়স। মেজো জেঠিমা তার আগেই মারা গেছেন। সেই থেকে ফেলুদা আমাদের বাড়িতেই মানুষ।
আমার আর এক জ্যাঠামশাই ছিলেন, তিনি তেইশ বছর বয়সে সংসার ছেড়ে সন্ন্যাসী হয়ে পশ্চিমে চলে যান; আর ফেরেননি। তাঁরও নাকি অসাধারণ গায়ের জোর ছিল। আমার বাবা হলেন সব চেয়ে ছোট ভাই; বড় জ্যাঠামশাইয়ের সঙ্গে প্রায় পঁচিশ বছর বয়সের তফাত। বাবার বোধহয় খুব বেশি গায়ের জোর নেই; তবে মনের জোর যে আছে সেটা আমি খুব ভাল করেই জানি।
ফেলুদার প্রিয় বাংলা বই হল বিভূতিভূষণের ‘আরণ্যক’। করবেট আর কেনেথ অ্যাণ্ডারসনের সব বই ও পড়েছে। নিজে শিকার করেনি কখনও, যদিও বন্দুক চালানো শিখেছে, রিভলভারে দুর্দান্ত টিপ, আর দরকার পড়লে যে বাঘও মারতে পারে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তবে ফেলুদা বলে— জানোয়ারের মতি-গতি বোঝা মানুষের চেয়ে অনেক সহজ, কারণ জানোয়ারের মন মানুষের মতো জট পাকানো নয়। মানুষের মধ্যে যে সবচেয়ে বেশি সাদাসিধে, তারও মন একটা বাঘের মনের চেয়ে অনেক বেশি প্যাঁচালো। তাই একজন অপরাধীকে সায়েস্তা করাটা বাঘ মারার চেয়ে কম কৃতিত্ব নয়।
ট্রেনে যেতে যেতে ফেলুদা লালমোহনবাবুকে এই ব্যাপারটা বোঝাচ্ছিল। লালমোহনবাবুর হাতে মহীতোষ সিংহরায়ের লেখা তাঁর প্রথম শিকারের বই। বইয়ের প্রথমেই মহীতোষবাবুর ছবি, একটা মরা রয়াল বেঙ্গলের কাঁধে পা দিয়ে হাতে বন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ছাপাটা তত ভাল নয় বলে মুখটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না, তবে চওড়া চোয়াল, চওড়া কাঁধ, আর সরু লম্বা নাকের নীচে চাড়া দেওয়া চওড়া গোঁফটা বুঝতে অসুবিধা হয় না।
ছবিটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে লালমোহনবাবু বললেন, ‘ভাগ্যে আপনি যাচ্ছেন আমার সঙ্গে। এরকম একটা পার্সোনালিটির সামনে আমি তো একেবারে কেঁচো মশাই।’
লালমোহনবাবুর হাইট পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি। প্রথমবার দেখে মনে হবে বাংলা ফিল্মে কিংবা থিয়েটারে হয়তো কমিক অভিনয়-টভিনয় করেন। কাজেই উনি অনেকের সামনেই কেঁচো। ফেলুদার সামনে তো বটেই।
ফেলুদা বলল, ‘সরকার আইন করে শিকার বন্ধ করে দেবার ফলেই হয়তো ভদ্রলোক লেখার দিকে ঝুঁকেছেন।’
‘আশ্চর্য বলতে হবে’, লালমোহনবাবু বললেন, ‘পঞ্চাশ বছর বয়সে প্রথম বই লিখলেন, কিন্তু পড়লেই মনে হয় একেবারে পাকা লিখিয়ে।’
‘শিকারিদের মধ্যে এ জিনিসটা আগেও দেখা গেছে। করবেটের ভাষাও আশ্চর্য সুন্দর। হয়তো এটা জংলি আবহাওয়ার গুণ। পৌরাণিক যুগে যে সব মুনি-ঋষিরা বেদ-উপনিষদ লিখেছেন, তাঁরাও জঙ্গলেই থাকেন।
শেয়ালদা ছাড়ার কিছুক্ষণ পর থেকেই লক্ষ করছিলাম, মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। মাঝ রাত্তিরে যখন নিউ ফারাক্কা স্টেশনে গাড়ি থামল, তখন ঘুম ভেঙে গিয়ে দেখি বাইরে তেড়ে বৃষ্টি হচ্ছে, আর তার সঙ্গে ঘন ঘন মেঘের গর্জন। সকালে নিউ জলপাইগুড়িতে পৌঁছে বুঝলাম এ দিকটায় মেঘলা হলেও, গত ক’ দিনের মধ্যে বৃষ্টি হয়নি।
যে ভদ্রলোকটি আমাদের নিতে এলেন তিনি অবিশ্যি মহীতোষবাবু নন। ত্রিশের নীচে বয়স, রোগা, ফরসা, মাথার চুল উস্কো-খুস্কো, চোখে মোটা কাচের মোটা কালো ফ্রেমের চশমা। ভদ্রলোক আমাদের দেখে যে খুব একটা বাড়াবাড়ি রকম খাতিরের ভাব করলেন তা নয়, তবে তার মানে যে তিনি খুশি হননি সেটা নাও হতে পারে। মানুষের বাইরের ব্যবহার থেকে ফস করে তার মনের আসল ভাব সম্বন্ধে একটা ধারণা করে নেওয়াটা যে কত ভুল, সেটা ফেলুদা বার বার বলে। ভদ্রলোক নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন তিনি মহীতোষবাবুর সেক্রেটারি। নাম তড়িৎ সেনগুপ্ত। আমাদের মধ্যে কোনজন প্রদোষ মিত্তির আর কোনজন লালমোহন গাঙ্গুলী সেটা ভদ্রলোক দিব্যি আন্দাজে ধরে ফেললেন।
স্টেশনের বাইরে মহীতোষবাবুর জিপ অপেক্ষা করছিল। আমরা দশ মিনিটের মধ্যে স্টেশনেই চা আর ডিম-টোস্ট খেয়ে নিয়ে জিপে গিয়ে উঠলাম। আমাদের তিনজনের দুটো সুটকেস, আর ফেলুদার একটা কাঁধে-ঝোলানো ব্যাগ ছাড়া মাল বলতে আর কিছুই নেই, কাজেই জিপে জায়গার অভাব হল না। গাড়ি ছাড়ার মুখে তড়িৎবাবু বললেন, ‘মহীতোষবাবু নিজে আসতে পারলেন না বলে দুঃখিত। ওঁর দাদার শরীরটা ভাল নেই; ডাক্তার এসেছিল, তাই ওঁকে থাকতে হল।’
মহীতোষবাবুর যে দাদা আছে সেটাই জানতাম না। ফেলুদা বলল, ‘বেশি অসুখ কি?’ আমি বুঝতে পারছিলাম অসুখের বাড়িতে অতিথি হয়ে গিয়ে হাজির হতে ফেলুদার একটা কিন্তু কিন্তু ভাব হচ্ছিল।
তড়িৎবাবু বললেন, ‘না। দেবতোষবাবুর অসুখ অনেক দিনের। মাথার ব্যারাম। এমনিতে বিশেষ ঝঞ্ঝাট নেই। উন্মাদ নন মোটেই। দু’ মাসে তিন মাসে এক-আধবার মাথাটা একটু গরম হয়, তখন ডাক্তার এসে ওষুধের বন্দোবস্ত করে দেন।’
‘বয়স কী রকম?’ ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
‘চৌষট্টি। মহীতোষবাবুর চেয়ে পাঁচ বছরের বড়। পণ্ডিত লোক ছিলেন। ইতিহাস নিয়ে অনেক পড়াশুনা করেছেন।’
গাড়ি থেকে উত্তর দিকে হিমালয় দেখা যাচ্ছে। ওই দিকেই দার্জিলিং। দার্জিলিং আমি তিনবার গেছি, কিন্তু এবার যেদিকে যাচ্ছি সেদিকে আগে কখনো যাইনি। আকাশে মেঘ জমে আছে, তাই গরমটা কম। মাঝে মাঝে রাস্তার ধারে চা বাগান পড়ছে। শহর ছাড়ার পর থেকেই দৃশ্য ক্রমে বদলে যাচ্ছে। এবার পুব দিকেও পাহাড় দেখা যাচ্ছে। তড়িৎবাবু বললেন, ‘ওটাই ভূটান।’
তিস্তা পেরোবার কিছু পর থেকেই পথের ধারে জঙ্গল পড়তে লাগল। লালমোহনবাবু একপাল ছাগল দেখে হঠাৎ, ‘হরিণ, হরিণ!’ বলে চেঁচিয়ে উঠলেন। ফেলুদা বলল, ‘তাও ভাল, বাঘ বলেননি।’
তড়িৎবাবুর কথায় জানলাম মহীতোষবাবুর বাড়ির পশ্চিম দিকে মাইল খানেকের মধ্যেই নাকি একটা জঙ্গল রয়েছে, তার নাম কালবুনি। সেখানে এককালে অনেক বাঘ ছিল, আর সে-সব বাঘ সিংহরায়রা শিকারও করেছেন। কিন্তু এখন বড় বাঘ বা রয়েল বেঙ্গল টাইগার আর আছে কি না সন্দেহ, যদিও মাস তিনেক আগে নাকি কালবুনিতে মানুষখেকো বাঘ আছে বলে একটা শোরগোল উঠেছিল।
‘আসলে নেই?’ ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
তড়িৎবাবু বললেন, ‘একদিন একটি আদিবাসী ছেলের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল জঙ্গলে, তার গায়ে বাঘের আঁচড় ছিল।’
‘কিন্তু মাংস খায়নি?’
‘খেয়েছিল, কিন্তু সেটা বাঘ না হয়ে হায়না-জাতীয় কোনও জানোয়ারও হতে পারে।’
‘মহীতোষবাবু কী বলেন?’
‘উনি তখন ছিলেন না। হাসিমারার দিকে ওঁর চা বাগান আছে, সেখানে গিয়েছিলেন। বনবিভাগের কর্তাদের ধারণা বাঘ, কিন্তু মহীতোষবাবু বিশ্বাস করতে রাজি হননি। অবিশ্যি বনবিভাগের লোক এই তিন মাস খোঁজাখুঁজি করেও সে বাঘের কোনও সন্ধান পায়নি।’
‘আর-কোনও মানুষ খাওয়ার ঘটনাও ঘটেনি?’
‘না।’
মানুষখেকোর কথাটা শুনেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল। অবিশ্যি এ ব্যাপারে মহীতোষবাবুর কথাটাই মানতে হবে নিশ্চয়ই। লালমোহনবাবু সব শুনে-টুনে ‘হাইলি ইণ্টারেস্টিং’ বলে আরও বেশি ভুরু কুঁচকে জঙ্গলের দিকে দেখতে লাগলেন।
একটা ছোট নদী আর একটা বড় জঙ্গল পেরিয়ে, বাঁয়ে একটা গ্রামকে ফেলে আমাদের জিপ পিচ-বাঁধানো রাস্তা ছেড়ে একটা কাঁচা রাস্তা ধরল। তবে ঝাঁকুনি বেশিক্ষণ ভোগ করতে হল না। মিনিট পাঁচেক চলার পর গাছের উপর দিয়ে একটা পুরনো বাড়ির মাথা দেখা গেল। আরও এগোতে ক্রমে গাছপালা পেরিয়ে গেটওয়ালা প্রকাণ্ড বাড়িটার পুরোটাই দেখতে পেলাম। বাড়ির রং এককালে হয়তো সাদা ছিল, এখন সমস্ত গায়ে কালসিটে পড়ে গেছে। রং যা আছে তা শুধু জানালার কাচগুলোতে; রামধনুর সাতটা রঙের কোনওটাই বাদ নেই।
শ্বেতপাথরের ফলকে ‘সিংহরায় প্যালেস’ লেখা গেটটা পেরিয়ে আমাদের জিপ বাড়ির গাড়ি-বারান্দার নীচে গিয়ে দাঁড়াল।